১০. জলপাইগুড়ি শহরে প্রচণ্ড শীত

এবার জলপাইগুড়ি শহরে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। প্রবীণেরা এর মদ্যেই বলতে আরম্ভ করেছেন, সেই চল্লিশ সালের পর এত মারাত্মক শীত নাকি তারা দেখেননি। অনিমেষের এইসব কথা শুনলে বেশ মজা লাগে। লোকেরা যে কী করে সব কথা মনে রাখে! এই যেমন বর্ষকালে ঝমঝম করে তিনদিন ধরে আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি পড়ল, অথবা জ্যৈষ্ঠমাসে রাতদুপুরেও ঘেমে গিয়ে হাতপাখার। বাতাস খেয়ে হল, ব্যস, বৃদ্ধরা বলতে আরম্ভ করেন সেই অমুক সালের পর নাকি এবারের মতন বৃষ্টি বা গরম এর আগে দেখেননি।

তবে এবারের ঠান্ডাটা জব্বয় কনকনে। ভোরবেলা বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে পা রাখতে একদম ইচ্ছে হয় না। সকাল হচ্ছে দেরিতে, সেই আটটা অবধি সামনের মাঠে কুয়াশার চুপচাপ বসে থাকে। আবার সাড়ে চারটে বাজতে-না বাজতেই অন্ধকার ডালপালা মেলে দেয়। এতদিন ওর কোনো সোয়েটার ছিল না। তুষের চাদর গায়ে দিয়ে শীতটা দিব্যি কাটিয়ে দিত। সেই কোন ছেলেবেলার ফুলহাতা পুলওভারটা এখনও সুটকেসে ভোলা আছে। ওর বন্ধুবান্ধবরা কত রকমারি সোয়েটার পরে বিকেলে বাঁধের ওপর বেড়াতে হয়-অনিমেষের এতিদন ছিল না, পরার প্রশ্নও ওঠেনি। এবার জয়াদি ওকে নীল-সাদা-হলুদ-মেশানো একটা সোয়েটার তৈরি করে দিয়েছেন, কথা ছিল টেস্টে অ্যালউড হলেই ও সেটা পাবে। অনিমেষ জানত টেস্টে সে কখনোই ফেল করবে না, তবু এর আগে তো কখনো টেস্ট দেয়নি, চিরকাল এ-সময় অ্যানুয়াল পরীক্ষাই দিয়ে এসেছে, এবার তাই উত্তেজনা ছিল আলাদারকম। কাল ফল বেরিয়েছে, জেলা স্কুল থেকে এই বছর সবাই টেস্টে পাশ করে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। অনিমেষের স্থান চতুর্থ: অর্ক, অরূপ, মণ্টু এবং অনিমেষ। মণ্টুর অবশ্য এই প্লেস পাওয়াতে কিছু যায়-আসে না। তবে ইদানীং পড়াশুনায় মনোযোগী হয়ে পড়েছে যেন ও। এবার একটাও প্রশ্ন ইচ্ছে করে ছেড়ে আসেনি।

তিন মাস পর ফাইনাল পরীক্ষা। এবার ফি জমা দিতে হবে। কাল বিকেলে যখন বাড়িতে এসে ও খবরটা দিল তখন জয়াদি পিসিমার কাছে বসে ছিলেন। খবর শুনে পিসিমা তো চ্যাঁচামেচি করে দাদুকে ডাকাডাকি করতে আরম্ভ করলেন। জয়াদির সামনে পিসিমার কাণ্ড দেখে অনিমেষের লজ্জা-লজ্জা লাগছিল। কিন্তু জয়াদি চট করে পিসিমার দলে ভিড়ে গেলেন, ও বাবা, তুমি ফোর্থ হয়েছ। জেলা স্কুলের ফোর্থ বয় মানে তো ফার্স্ট ডিভিশন একদম বাধা-ইস, এটুখানি ছেলে কলেজে পড়তে চলল!

চটির শব্দ হতে জয়াদি দৌড়ে চলে গেলেন আচমকা। অনিমেষ দাদুকে দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। টেস্টে পাশ করলে কি প্রণাম করা উচিত?

সরিৎশেখর নাতির মুখের দিকে তাকিয় বললেন, আমাদের বংশে কেউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেনি। তোমার এবারের মার্কস কেমন?

অনিমেষ মাথা নিচু করে তিন নম্বর কিছুই না, একটু পড়াশুনা করলে ওটা পেতে অসুবিধে হবে। তুমি এখন বাইরের জগৎ থেকে মনটা সরিয়ে নাও। জীবনে বারবার ফাইনাল পরীক্ষা আসে না। কথাটা বলে চট করে ঘুরে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষ দাদুর এইরকম নিরাসক্ত কথাবার্তায় অভ্যস্ত, কিন্তু একটু পরেই চটির আওয়াজ ফিরে এল, এই নাও, রোজ খাওয়াদাওয়ার পর দুচামচ করে খাবে।

একটা বড় শিশিতে সিরাপমতন কিছু তিনি অনিমেষের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। হতভম্বের মতো সেটাকে হাতে নিয়ে অনিমেষ তার গায়ে কোনো লেবেল দেখতে পেল না, এটা কী?

সরিৎশেখর খুব নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, ধীরেশ কবিরাজকে দিয়ে করিয়েছি, ব্রাহ্মীশাক থেকে তরি এই টনিকটা খেলে তোমার ব্রেন ভালো হবে, সব ব্যাপারে উৎসাহ আসবে। দেখবে তিন নম্বর পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।

অনিমেষ বিহ্বল হয়ে পড়ল। কত আগে থেকে দাদু তার জন্য এত চিন্তা করেছেন! ও শিশিটাকে আঁকড়ে ধরল। সরিৎশেখর বললেন, তোমার ফাইনাল পরীক্ষার ফি কত, জান?

সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ল অনিমেষ, না। টাকাপয়সায় কথা উঠলেই আজকাল ওর খুব অস্বস্তি হয়।

সরিৎশেখর বললেন, ঠিক আছে, আমি জেনে নেব। তোমাকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে অনিমেষ। তোমার মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম।

কথাটা শুনে দাদুর দিকে তাকাল অনিমেষ। সরিৎশে এখন অলসপায়ে ভেতরে চলে যাচ্ছেন। মাকে দাদু কবে কথা দিয়েছিলেন? এতদিন শোনেনি তো সে! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে যখন এসেছিলেন, তখনই কেউ দশ বছর বাদে কাউকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করানোর কথা দিতে পারে না। ওর মনে হল দাদু গুলিয়ে ফেলছেন। স্মৃতিতে কোনকিছু গোলমাল হয়ে গেলে মৃত ব্যক্তির নাম করে নিজের ইচ্ছেটা স্বচ্ছন্দে চালিয়ে দেওয়া যায়। ধরা পড়ার ভয় থাকে না এবং সেটা জোরদারও হয়। অনিমেষ হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে জয়াদির গলা পেল ও, এ মা, একা একা দাঁড়িয়ে হাসছ যে, পাগল হয়ে গেলে নাকি!

অনিমেষ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল জয়াদি একটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসেছেন, কী ওটা?

ফস করে নীল-সাদা-হলুদ-মেশানো সোয়েটারটা বের করে ওর সামনে ধরল, পরে ফ্যালো।

জয়াদি ওর জন্য সোয়েটার বানালে, মাঝে-মাঝে বুক-পিঠের মাপ নিয়ে যান, একথা সবাই জানে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে অনিমেষের ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। সে চিৎকার করে পিসিমাকে ডাকল, পিসিমা-তাড়াতাড়ি!

সরিৎশেখর যখন কথা বলছিলেন তখন হেমলতা রান্নাঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। চিৎকার শুনে ছুটে এলেন, ও মা, হয়ে গেছে! বলিসনি তো! কী সুন্দর! আর-জন্মে জয়া তোর কেউ ছিল অনি।

জয়াদি হেসে বললেন,, ও মা, এ-জন্মে আমি বুঝি কেউ নই?

অনিমেষ হাত বাড়িয়ে সোয়েটারটা নিল। কী নরম উল! পিসিমা আর জয়াদিতে মিলে ওকে সোয়েটারটা পরালেন। পিসিমা সমানে জয়াদিল হাতের প্রশংসা করে যাচ্ছেন আর জয়াদি ওর চারপাশে ঘুরে ঘুরে সোয়েটারটা ঠিক করে দিচ্ছেন-অনিমেষের খুব লজ্জা করছিল। সুন্দর ফিট করেছে সোয়েটারটা, পিসিমা বললেন, তুই পাশ করে কলকাতায় গিয়েও এই সোয়েটারটা পরতে পারবি তিন-চার বছর।

জয়াদি বললেন, তখন দেখবেন এটা পছন্দই হবে না।

পিসিমা বললেন, আমি তো বাবা এত ভালো সোয়েটার কাউকে পরতে দেখিনি।

কলকাতায় পড়তে যাচ্ছে। কথাটা ইদানীং এ-বাড়িতে মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে। মহীতোষ নাকি সরিৎশেখরকে বলেছেন সেকথা। অনি যদি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে তা হলে কলকাতায় পাঠাবেন। এখানকার এ সি কলেজে পড়াশুনা খুব-একটা সুবিধে হবে না। কলকাতায় যাবার কথা শুনলেই দম বন্ধ হয়ে আসে আনন্দে। কলকাতা বাংলাদেশের প্রাণ। বেশি ভাবতে গেলেই অনেকরকম চিন্তা আসে। কলকাতার রাস্তায় সিনেমা-স্টাররা ঘুরে বেড়ায়, কবি-লেখকরা সেখানে। আড্ডা দেন। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কলকাতার রাস্তায় হেঁটেছেন। অদ্ভুত একটা রোমান্টিক জগৎ তৈরি হয়ে যায় মনেমনে। ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে-যেমন করেই হোক। হাতের শিশি আর বকের সোয়েটারটার দিকে তাকাল সে। সামান্য টেস্টে অ্যালাউড হয়ে যদি এতগুলো মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা হলে ফাইনাল পরীক্ষায় সে কেন ডিভিশন পাবে না? সোয়েটারের নরম ওমটা শরীরে জড়িয়ে অনিমেষ পিসিমা আর জয়াদির দিকে তাকিয়ে এই প্রথমবার আবিষ্কার করল, যারা খুব অল্পেই খুশি হয় তাদের জন্য সবকিছু করা যায়।

নতুন সোয়োটারটা পরে অনিমেষ বিকেলবেলায় বেরিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে যে যাচ্ছে সে-ই একবার ওকে ঘুরে দেখছে। নতুন স্যার একবার খবর দিয়েছিলেন দেখা করার জন্য। নিশীথবাবুকে ও আজও মাঝে-মাঝে পুরনো নামে ভাবে। বোধহয় সংস্কারের মধ্যে যেটা একবার ঢুকে যায় তাকে চট করে ছাড়ানো যায় না। জলপাইগুড়ি শহরে এবার নির্বাচনী প্রচার এখনও শুরু হয়নি। মাঝে-মাঝে কংগ্রেসি অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে কিছু পোস্টার দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেস থেকে তেমন গা করছে এখন। জেলা থেকে যিনি মন্ত্রিত্ব পান তিনি হেরে যাবেন অতি বড় সমালোচকও আশা করতে পারেন না। তাকে কদিন আগে দেখেছে অনিমেষ, বেশ নধরকান্তি, দুধেআলতা রঙ, বয়স হয়েছে। এখন নড়েচড়ে বসতে অসুবিদে হয়। অথচ জেলার মানুষ, বিশেষ করে রাজবংশীরা ভদ্রলোককে ভীষণ সমর্থন করে। সেটাই ওঁর জোর। অবশ্য কংগ্রেসের জোড়া বলদ নিয়ে নামলেই হল-যে দাঁড়াবে সে-ই ভাববে আমাকেই সমর্থন করছে।

সুনীলদার সেই বন্ধু যার সঙ্গে শোনে আলাপ হয়েছিল, সে বলেছিল পার্টি অফিসে আসতেই হবে তার কোনো মানে নেই। আগে মনটা তৈরি করো। কথাটা ভালো লেগেছিল অনিমেষের। কমিউনিস্ট পার্টি, পি এস, পি ফলোয়ার্ড ব্লক-এই তিনটি বিরোধী দল এই শহরে বিক্ষোভ করে মাঝেমাঝে-কিন্তু কেমন যেন দানা বাঁধে না। খবরের কাগজে আজকাল কলকাতার খবর পড়ে অনিমেষ। সেখানে প্রায়ই মিছিল হয়-খাদ্য আন্দোলন হয়, তারপর সব চুপচাপ হয়ে যায়–যেন আগের দিন কিছুই গুরুতর ব্যাপার হয়নি। এখানেই কেমন খটকা লাগে অনিমেষের। নিশীথবাবুর সঙ্গে একদিন খোলাখুলি আলোচনা করেছিল অনিমেষ। নিশীথবাবু বলেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম করছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ওরা জানেই না ওরা কী চায়। তারপর অনিমেষকে দমিয়ে দেবার জন্য বলেছেন, যারা কমিউনিস্ট পার্টির মাথায় বসে সর্বহারাদের প্রতি দরদ দেখিয়ে গরম-গরম কথা বলে, খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, তারাই নিজস্ব প্রাসাদে বসে সেটা করে থাকে। যার পেটে খাবার নেই তাকে সহজেই উত্তেজিত করা যায়, কিন্তু তার খিদে মেটানোর রাস্তাটা বলে দেওয়া সহজ নয়। কমিউনিস্টরা সেটা জানে, তাই ও-পথে যায় না।

অনিমেষ বলেছিল, কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ তো গরিব-গরিবের কথা কংগ্রেস ভাবে না কেন? গরিবদের জন্য কংগ্রেস কী করেছে।

বিরক্ত হয়েছিলেন নিশীথবাবু, আট বছরেই একটা দেশকে দেওয়া যায় না। সময় লাগবে অনিমেষ। কমিউনিস্টরা যখন কোনো কথা বলে, রাশিয়ার কথা আওড়ায়। বড় বড় বোলচাল ছাড়া কোনো কমিউনিস্টকে বক্তৃতা দিতে শুনবে না। তুমি কি ওদের দিকে ঝুঁকবে, অনিমেষ?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেনি অনিমেষ। পরে বলেছিল, আমার যেন কেমন লাগে। কমিউনিস্টরা যা চায় সেটা ভালো লাগে, কিন্তু যেভাবে চায় সেটা একদম ভালো লাগে না।

নিশীথবাবু মুখ দেখে অনিমেষ স্পষ্ট বুঝতে পারলে, উত্তর ওঁর একদম পছন্দ হয়নি। গম্ভীরমুখে বলেছিলেন, অনিমেষ নিজের দেশকে নিজেদের মতো করেই সেবা করা উচিত। মাছনি কংগ্রেসের সবাই ত্রুটিমুক্ত নয়, অনেকেই স্বার্থ নিয়ে আসে, তবু এদের নিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। অভিজ্ঞতা যত বাড়ে কাজ করতে তত সুবিধা হয়।

টাকাপয়সা হাতে এলে সরিৎশেখর আবার আগের মতো হয়ে যান। বাড়িভাড়া নিয়ে যে গোলমাল হয়েছিল সিটা এখন আর নেই, নিয়মিত টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু বাজারদর যেরকম বাড়ছে, তাতে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। জালের দাম হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে। প্রিয়তোষ মাঝে-মাঝে চিঠি দেয়। টাকাপয়সার দরকার হলেই যেন তাকে জানানো হয়-এই ইচ্ছে জানিয়ে সে ঠিকানাসহ চিঠি দিচ্ছে, সরিৎশেখরের মাঝে মাঝে লোভ হয় টাকা চাইতে, কিন্তু শেষ সময়ে সামলে নিয়ে উত্তর দিচ্ছেন না। তার সন্দেহ হেমলতার সঙ্গে প্রিয়তোষের যোগাযোগ আছে। তবে পরিবোষ একদম মাড়ায় না এদিকে। একটুও কষ্ট হয় না তার জন্য সরিৎশেখরের। মহীতোষ আসেন মাঝে-মাঝে-নিয়মিত ছেলের নাম করে টাকা পাঠান। মহীতোষের একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে এর মধ্যে। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছেন আর চেহারাটা হয়ে গিয়েছে বুড়োটে-বুড়োটে। এ-পক্ষে সন্তানাদি হল না তার। মহীতোষের স্ত্রী স্বৰ্গছেঁড়া থেকে একদম নড়তে চায় না। তাকে অনেকদিন দেখেননি তিনি। হেমলতা বলতে মহীতোষ বলছিলেন, সে ও-বাড়ি ছেড়ে নড়বে না।

বয়স তাকেও কবজা করেছে। শরীরের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কিন্তু বড়সড় কোনো অসুখ তার হয়নি, সেই রিকশার ধাক্কায় পড়ে গিয়ে পাঙা ছাড়া। শীত সহ্য করতে আজকাল একটু কষ্ট হয়। লালইমলির সেই পুরনো গেঞ্জি, পাঞ্জাবি মোটা কাপড়ের কোট আর তুষের চাঁদরে লড়ে যান প্রাণপণে। বাঁচতে খুব ইচ্ছে হয় তার। 3 কী জিনিস হচ্ছে পৃথিবীতে, অন্যান্য মানুষের মতো চট করে মরে যাবার কোনো বাসনা হয় না। কন্তু মুশকিল হল, শীত পড়েছিল শানিয়ে-তা একরকম ছিল, সঙ্গে যে আজ রাত থেকে অসময়েরর বৃষ্টি নামল! একদম শ্রাবণমাসের বৃষ্টি।

শীতকালে জলপাইগুড়িতে হঠাৎ-হঠাৎ বৃষ্টি আসে। ঠান্ডাটা বাড়িয়ে দিয়ে যায়। যে সমস্ত মানুষ জরায় থিতোচ্ছিল তার টুপটাপ চলে যায় এ-সময়। তিস্তায় তখন টানের সময়। শীতের দাপটে ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে নদীটা। তবু জল এখনও টলমলে। স্রোতের ধার নেই, যৌবন-ফুরিয়ে যাওয়া মহিলার মতো শুধু জাবর কটে যাওয়া। বাঁধ প্রায় সম্পূর্ণ। ওপাশে সেনপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার বুকের ওপর পুল বানাবার কথাবার্তা চলছে। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে-বাসে আসাম যাওয়া যাবে। পক্ষিরাজ ঠ্যাকসিগুলো গা-গতর ঝেড়েমুছে এই কটা বছর কিছু কামিয়ে নেবার জন্য কিং সাহেবের ঘাটের দিকে, আসব-আসব করছে। এই সময় সন্ধে থেকেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল।

ভোর হল, ঘড়ি দেখলে বোঝা যায়-আকাশ তেমনি গোমড়ামুখো। জল ধরবার চিহ্ন নেই। যেন বর্ষা চলে যাওয়ার সময় এই মেঘগুলোকে হিমালয়ের ভাঁজে-ভাঁজে ফেলে রেখে গিয়েছিল, নাহলে এই সময়ে এত বৃষ্টি পড়ে কখনো তিস্তার জল বাড়ছে। যেন কোনো গুপ্ত ওষুধে যৌবন ফিরে এল। তার-এরকমটা কখনো হয় না। লক্ষ্মীপুজোর পর এত জল তিস্তায় বয় না। কিন্তু শহরের মানুষ এবার নিশ্চিন্ত। সেই প্রলয়ঙ্কর বন্যাটাকে রুখে দেবে নতুন-তৈরি বাঁধ। তিস্তা সরাসারি শহরটাকে গ্রাস করতে পারল না এবার। কিন্তু করলার জল ছিটকে উঠে এল কিছু-কিছু নিচু জায়গায়। হাসপাতালপাড়াটা এই ঠাণ্ডায় তিনদিন জলের তলায় ড়ুবে রইল। আহাদী মেয়ের মতো করলা গিয়ে মুখ ঘষছে। কিং সাহেবের ঘাটের পাশে তিস্তার বুকে।

ঠিক তিনদিন তিনরাতের শেষে বৃষ্টি থেমে রোদ উঠল। হেমলতার অবস্থা খুব কাহিল। গরম বস্ত্র তার বেশি নেই। যতক্ষণ পেরেছেন উনুনের পাশে বসে থেকেছেন। চিরকাল এই কাঠকয়লার আগুনগুলো তাকে শীত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আপদমস্তক-মোড়া সরিৎশেখর রোদ উঠলে উঠোনে এসে বসলেন। দুজনে গল্প করছিলেন, আজ সন্ধে থেকে শীত ডবল হয়ে পড়বে। রোদ উঠলেই শীত বাড়ে। অনিমেষ বাজারে গিয়েছিল। শুধু আলু, পেঁকিশাক আর ঢ্যাঁড়শ নিয়ে ফিরে এসে বলল, শিকারপুর ফরেস্টের দিকে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে, ভোটপাটি ভেসে গেছে।

হেমলতা বাজার দেখে বললেন, ইস, তুই এতক্ষণ ধরে এই বাজার আনলি?

অনিমেষ বলল, কিছু থাকলে তো, আনব! সবাই মারামারি করে নিয়ে নিচ্ছে যা পাচ্ছে। অনেকদিন পরে বাজারে গিয়ে অনিমেষ অত্যন্ত বিরক্ত। ফেরত-টাকাটা সে দাদুর দিকে বাড়িয়ে দিল।

সরিৎশেখর টাকা নিয়ে বললেন, মাছ এনেছ?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।

সরিৎশেখর রাগ করলেন, কী আশ্চর্য তোমাকে আমি যা বলি শোন না কেন? এখন এই তিনমাস মাছ না খেলে তোমার শরীরে বল হবে কী করে? বেশি পড়াশুনা করতে গেলে শরীরে জোর দরকার হয়।

অনিমেষ হাসল, ত্রিশ টাকা সের কাটাপোনা খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। অত দামের মাছ তাই সবাই কিনছে না। মাছ না খেলেও আমার চলবে।

নিশীথবাবু বললেন, আমাদের আরও দুর্গম জায়গায় যেতে হবে। এখান থেকে জল হয়তো আজ দুপুরেই নেমে যাবে, তা ছাড়া অন্য পার্টিও রিলিফ নিয়ে আসতে পারে।

ওরা যে চলে যাচ্ছে মানুষগুলো প্রথমে বুঝতে পারেনি। কিন্তু সেটা বোঝমাত্র কান-ফাটানো চিৎকার উঠল। কাকুতি-মিনতি থেকে শুরু করে কান্ন-অনিমেষের নামে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। নিশীথবাবু এটা কী করে করলেন! অভুক্ত মানুষগুলোকে কিছু খাবার দিয়ে গেলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হত! তা ছাড়া কাগজের লেখাটা দেখার আগে পর্যন্ত ওর মুখ দেখে মনে হয়নি আরও দুর্গম জায়গার জন্য এই খাবারগুলোকে রাখতে হবে। ডিঙিনৌকো দূরে চলে যাচ্ছে দেখে এবার গালাগালি শুরু হল! পৃথিবীর শেষতম অশ্লীল ভাষায় গালাগালিগুলো শুনতে শুনতে অনিমেষ বলল, স্যার, না খেতে পেলে এরা মরে যাবে। কিছু দিলে ভালো হত।

অনিমেষের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন নিশীথবাবু। জবাব দেবার কোনো প্রয়োজন মনে করলেন না যেন। অনিমেষ দেখল কয়েকজন বোধহয় আর থাকতে না পেরে গাছ থেকে হলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর প্রাণপণে সঁতার কেটে কাছে আসবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু নৌকো তখন অনেক দূরে, ওদের নাগালের বাইরে। এর ভাঙা ঘর, ওর উঠোনের পাশ দিয়ে ওরা চলেছে। হঠাৎ অনিমেষের চোখে পড়ল একজন প্রায় পুটলি হয়ে-যাওয়া বুড়ি একটা ভাঙা ঘরের টলে-থাকা খড়ের চালে কোনোরকমে বসে আছে। কিন্তু-একটা আসছে বুঝতে পেরে চোখে হাতের আড়াল দিয়ে অদ্ভুত খনখনে গলায় বলে উঠল সে, কে যায়-অ মণি-আইলি নাকি? ওরা কেউ কোনো কথা বলল, না, নিঃশব্দে জায়গাটা পার হয়ে গেল। বুড়ি তখনও কেটে-যাওয়া রেকর্ডের মতো বলে যাচ্ছে, অ মণি-কথা ক, অ মণি-কথা ক।

নিশীথবাবু এবার অনিমেষের দিকে ফিরে তাকালেন। একটু অস্বস্তি হচ্ছে ওঁর মুখ দেখলে বোঝা যায়। যেন নিজের সঙ্গে কথা বললেন উনি, নিজেকে শক্ত করো অনিমেষ। আজকেই ওরা খাবার পেয়ে যাবে। কমিউনিস্টরা গতবার এদের ভোট পেয়েছিল, খাবার ওরাই পৌঁছে দেবে।

কেউ যেন লক্ষ কাঁটাওয়ালা চাবুক দিয়ে ওকে আচমকা আঘাত করেছে, অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, আপনি এইজন্য ওদের খাবার দিলেন না?

পরগাছা দেখেছ যাদের খাবে তারই সর্বনাশ করবে। কংগ্রেস সরকার এদের আশ্রয় দিয়ে গ্রাম তৈরি করে দিয়েছিল, তার বিনিময়ে ওরা কমিউনিস্টদের ভোট দিচ্ছে। জেনেশুনে মানুষ দ্বিতীয়বার ভুল করে না। তা ছাড়া আমাকে হুকুমমতো কাজ করতে হচ্ছে।

অনিমেষ বলতে গেল, কিন্তু।

না, আর কথা নয়। রাশিয়াতে কোনো কমিউনিস্ট যদি এইরকম পরিস্থিতিতে তার দলনেতাকে প্রশ্ন করত তা হলে তার চরম শাস্তি হয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা বাক্-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তাই তুমি প্রশ্নটা করতে পারলে। তফাত বুঝতে চেষ্টা করো।

অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাল। সেই গ্রামটা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। অ মণি কথা ক বৃদ্ধার গলাটা ভুলতে পারছে না সে। হঠাৎ ওর মনে হল সুভাষ বোস, গান্ধীজি যদি এ-পরিস্থিতিতে পড়তেন তা হলে তারা কী করতেন। নিশ্চয়ই নিশীথবাবুর মতো কথা বলতেন না। মানুষের খাবার নিয়ে, একদম নিঃস্ব-হয়ে-যাওয়া মানুষের বাঁচবার অধিকার নিয়ে যে-রাজনীতি চলছে তা সমর্থন না করলে যদি রাজনীতি না করা যায় তবে দরকার নেই তার রাজনীতি করে। ওর মনে পড়ল নিশীথবাবু অনেকদিন আগে একবার বলেছিলেন, যারা বাস্তহারা, বন্দেমাতরাম মন্ত্র তাদের মুখে আসতেই পারে না। কথাটা আজ এতদিন বাদে তিনি নিজের আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নতুন করে। আচ্ছ, কমিউনিস্টরাও কি কোনো কংগ্রেসি গ্রামে গেল রিলিফ দেবে না? কী জানি! অনিমেষ আর ভাবতে পারছিল না।

যত ওপরে উঠছে ওরা তত নদী ছোট হচ্ছে। সেইসঙ্গে স্রোতের দাপট বাড়ছে মূল নদী নৌকো বাওয়া অসম্ভব হত। অনিমেষ দেখল অজস্র গাছপালা নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, আজ তাদের ধরতে কোনো মানুষ নদীতে নামেনি। এত বেলা হল, সূর্য মাথার ওপর তার পা রাখল, কিন্তু খিদে পাচ্ছে না এতটুকু। খাওয়ার কথা বলছে না কেউ। এমন সময় মাঝি বলছে, বাবু, ওপারে যাওয়া হইব না।

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, বুঝতে পেরেছি। তা হলে এদিকটাই সেরে যাই। আরও বাদিকে একটা গ্রাম আছে সেখানে চলো।

বাঁদিকটা বেশ জঙ্গল, জল বোধহয় উঠতে পারেনি সেখানে। কারণ নদী থেকে সেটা অনেকটা উঁচুতে। কিন্তু সেই জলে ডাঙাটির পাশ দিয়ে তিস্তার একটা স্রোত ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছুদূর যেতেই জঙ্গলের মধ্যে একটা মানুষ চিষ্কার করে কিছু বলল। নিশীথবাবু মাঝিকে ভালো জায়গা দেখে নৌকা ভেড়াতে বলতে সে বলল, বাবু, এডা তো কুষ্ঠরোগীদের গ্রাম!

নিশীথবাবু বললেন, হ্যাঁ, সেখানেই যাব। কুষ্ঠরোগীরা কি মানুষ নয়?

ডেঙ্গো জমিটায় জল ওঠেনি। চারপাশে জলের মধ্যে নৈবেদ্যর চুড়ার মতো মাথা উঁচু করে জেগে রয়েছে জায়গাটা। সূর্য এখন মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে সামান্য হেলেছে, কিন্তু আকাশটার চেহারা আবার টসকেছে। বৃষ্টির মেঘ নয়, কিন্তু একটু একটু করে ঘোলাটে হয়ে উঠছে আকাশ, রোদের চটক ফট করে মরে গেল।

অনিমেষ ডাভার দিকে তাকাল। কুষ্ঠরোগীরা থাকে এখানে! একটা চিৎকার অবশ্য শুনেছিল সে, কিন্তু এখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গল ভেদ করে দৃষ্টি বেশি দূরে যায়ও না। সকাল থেকে এত রোদ হল তবু এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে গাছের পাতায় ডালে এখনও স্যাঁতসেঁতে ভাবটা আছে। কতখানি এলাকা নিয়ে ভাঙাটা কে জানে! তবে বেশ উঁচুতে। কিন্তু এরকম ঘন জঙ্গলে মানুষ থাকে কী করে! বাইরে থেক তো কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না, কুষ্ঠরোগীরা তো মানুষ-অনিমেষ নিশীথবাবুর দিকে তাকাল।

পরিষ্কারমতো একটা জায়গা দেখে নৌকোটো ভেড়ানো হল। নিশীথবাবু নৌকো থেকে নেমে কয়েক পা হেঁটে ভেতরে গিয়ে বোধহয় কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার ফিরে এলেন, আরে মালগুলো নৌকো থেকে নামাও, চুপচাপ বসে আছ কেন?

এক এক করে ব্যাগগুলো মাটিতে নামানো হলে মাঝি বলল, বাবু, কত সময় লাগব?

নিশীথবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে তো সারাদিনের চুক্তি আছে, অপেক্ষা করো।

এতক্ষণ নৌকোয় বসে শুধু জল দেখতে-দেখতে অনিমেষের একঘেয়ে মনে হচ্ছিল, হাত-পা নাড়তে না পেরে খিল ধরে যাবার যোগাড়-এখন হাঁটতে পেরে স্বস্তি হল। বন্যার্তদের জন্য রিলিফ নিয়ে এসেছে অথচ এখানে তো বন্যার জল ওঠেইনি। কথাটা নিশীথবাবু শুনে খুব বিরক্ত হলেন, কী আশ্চর্য, এটুক তোমার মাথায় ঢুকল না যে যারা জলে আটক হয়ে থাকে তারা খাবারের অভাবে অভুক্ত থাকবেই। জলবন্দিরা যে বন্যার্ত নয় তা তোমায় কে বলল?

অনিমেষ উত্তর দিল না কিন্তু নিশীথবাবু কথাটা সে মানতে পারছিল না। অনেক ভিখিরি দুতিনদিন না-খেয়ে থাকে শহরের রাস্তায়, কই, তাদের তো রিলিফ দিতে যাওয়া হয় না! বন্যা এসে যাদের উৎখাত করেছে তারাই তো বন্যার্ত।

এমন সময় নিশীথবাবু বললেন, সবার যাবার দরকার নেই। তোমার তিনজন আমার সঙ্গে এসো। আঙুল দিয়ে তিনি অনিমেষ আর দুজনকে ডাকালেন। বাকিরা থেকে গেল সেখানেই। ওদের মুখ দেখে অনিমেষ বুঝতে পারছিল যেতে না হওয়ায় ওরা খুব সন্তুষ্ট হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, নৌকো থেকে নামতেই সবাই দ্বিধা ছিল। যাওয়ার আগে একটা ব্যাগ খুলে নিশীথবাবু থেকেযাওয়া সঙ্গী এবং মাঝিদের কিছু খাবার দিলেন। চিড়ে গুড় আর লালচে পাউরুটি। এখন এই দুপুরপেরনো সময়টা এই সামান্য খাবার দেখেই অনিমেষের জিভে জল এসে গেল। ও যেন হঠাৎই টের পেল ওর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খিদে একদম সহ্য করতে পারে না ও। আজ অবধি অসময়ে খেতে হয়নি কখনো। কিন্তু আজ সকাল থেকে এই নৌকোয়-নৌকোয় ঘুরে আর সেই গলায় ফাঁস দিয়েঝুলেথাকা. লোকটাকে দেখার পর থেকে ওর খিদের অনুভূতিটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন হঠাৎ সেটা ফিরে এল।

কিন্তু নিশীথবাবু ব্যাগের মুখ বন্ধ করে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর সঙ্গে এগোতে লাগলেন। অনিমেষের সঙ্গী একটা মোটামতন লোক এমন সময় বলে ফেলল, বন্যার্তদের খাবার দিতে গিয়ে আমরাই ক্ষুধার্ত হয়ে গেলাম। একটু খেয়ে নিয়ে জোর করলে হত না?

নিশীথবাবু বললেন, না না, আমরা এখানে বসে খাওদাদাওয়া করলে যাদের জন্য খাবার এনেছি তারা কী ভাববে! ওদের দিয়ে তবে খাওয়া যাবে।

লোকটি মাথা নাড়ল, না, সেকথা ছিল না। তিনটে টাকা আর খিদের সময় খাবার এইরকম কথা পেয়ে কাজে এসেছি। এখন উলটোপলাটা বললে চলবে কেন?

কথাটা শুনে লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকাল অনিমেষ। সে কী। বন্যার্তদের সেবা করতে সত্যিকারের কংগ্রেসি নয়, শুধু নিশীতবাবুর মতো দুএকজন ছাড়া।

নিশীথবাবু খুব অস্বস্তিতে পড়েছেন বোঝা গেল, খিদে পেয়েছে তো এতক্ষণ নৌকোয় বসে খেলে না কেন? কাজের সময় যত ঝামেলা কর!

আমি তো মানুষ! আপনি লোকগুলোকে খেতে দিলেন না, আমি খাই কী করে? ঠিক আছে, চলুন, যা বলবেন করছি, দেখবেন টাকাটা যেন না মারা যায়।

লোকটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করল। নিশীথবাবু চাপা গলায় অনিমেষকে শুনিয়ে বললেন, এইসব লোক নিয়ে দেশে বিপ্লব হবে, ভাবো!

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটা বোধহয় অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এদের দেখছিল, এখন কাছে আসতেই মুমুখি হল। বেঁটেমতন, গায়ে কাপড় জড়ানো এবং মুখচোখ ভীষণ ফোলা-ফোলা। ওদের দিকে গকিয়ে লোকটা বলে উঠল, কী আছে ব্যাগে, খাবার?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, কংগ্রেস থেকে রিলিফ নিয়ে এসেছি।

লোকটা ঘাড় নাড়ল, খুব বান এসেছিল, শহর ভেসে গেছে।

নিশীথবাবু বললেন, শহরে জল ঢোকেনি।

লোকটা বলল, আমাদের এখানেও না। তবে কাল থেকে কেউ কিছু খাইনি, না এলে নৌকো ডবিয়ে দিতাম। আসুন, মোড়ল আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছে।

প্রথমদিকে লোকটার কথাবার্তা ছিল একধরনের, শেষ কথাটা বলার সময় ওকে খুব রাগী-রাগী রাগল। লোকটার পিছুপিছু ওরা হাঁটতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা-পথ বেশ পরিষ্কার। কিছুদুর যেতেই আর বাইরের জল চোখে পড়ল না। পথের ধারে ময়লা রক্তমাখা ফেটি পড়ে আছে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল অনিমেষের। নিশীথবাবু নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে সেগুলোকে টপকে যেতে বললেন। কিছুটা যেতেই জঙ্গলটা যেন চট করে উধাও হয়ে গেল। সামেন বিরাট মাঠের মতো পরিষ্কার জমি, তার চারধারে ছোট ছোট খেলার ঘরের মতো ঘর। ঘরগুলোর চালে টিন দেওয়া, দেওয়াল যে যেরকম পেরেছে দিয়েছে। যে-কোনো ঘরেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। তবে ঠিক মধ্যিখানে বেশ শক্তমতন বিরাট চালাঘর। তার তলায় বেঞ্চি করে কাঠের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। মাঠের এক কোণে অনেক মানুষ চুপচাপ বসে আছে। দূর থেকে তাদের ময়লা কাপড়ের স্তুপ বলে। মনে হচ্ছিল। ওরা খোলা জমিতে এসে পড়তেই লোকটা ওদের সেখানে দাঁড়াতে বলে দ্রুত সেদিকে চলে গেল। নিশীথবাবু চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কীভাবে এরা বেঁচে আছে দ্যাখো। আর শোনো, এদের সামনে তোমরা-এমন-কিছু কোরো না যাতে এরা আঘাত পায়।

মোটা লোকটা বলল, একদম কুষ্ঠরোগীদের ডেরায় নিয়ে এলেন, এরকম কথা ছিল না।

নিশীথবাবু কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। অনিমেষ দেখল দুজন লোক সেই জটলা থেকে ওদের চিনিয়ে-নিয়ে-আসা লোকটির সঙ্গে উঠে এসে চালাঘরটার নিচে দাঁড়াল। পথপ্রদর্শকটি এগিয়ে এসে ওদের বলল, আসুন, মোড়ল আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে।

নিশীথবাবুর পেছন পেছন ওরা চালাঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। এখন রোদ নেই, একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সমস্ত মাঠটা জুড়ে জুড়ে অদ্ভুত মায়াময় একটা ছায়া নেমেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ সেই বাতাসে একটা শুটকো গন্ধ পেল। গন্ধটা গা গুলিয়ে দেয়। মোটা লোকটি ফিসফিস করে বলল, কেউ শালা টেঁসেছে নির্ঘাত।

শহর থেকে এ জায়গাটা বেশি দূরে নয়, কিন্তু এ-অঞ্চলে অনিমেষরা কখনো আসেনি। তিস্তার তীর ধরে পায়ে হেঁটে নিশ্চয়ই এদিকের মানুষজন যাওয়া-আসা করে। শহরে যেসব কুষ্ঠরোগীকে ভিক্ষে করতে দেখা যায় তারাই যে এতটা দূর হেঁটে এই ডেরায় ফিরে আসে আগে জানত না অনিমেষ। ওর মনে পড়ল, কোনোদিন বিকেলবেলায় ও শহরের রাস্তায় একজন কুষ্ঠরোগীকেও ভিক্ষে করতে দেখেনি। এক-একজনকে দেখে মনে হত এ নিজে হাঁটতে পারবে না, অথচ কী করে যে সে আসে এবং উধাও হয়ে যায় কিছুতেই ধরতে পারত না সে।

ওদের এগিয়ে যেতে দেখে দূরের জটলার ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন উঠল। ব্যাগগুলো যে খাবারের বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধে হচ্ছে না। চালাঘরের নিচে দাঁড়ানো একজন লোক হাত তুলে নিষেধ করতেই গুঞ্জনটা চট করে থেমে গেল।

চালাঘরের সামনে এসে অনিমেষ মাটিতে চোখ নামিয়ে ফেলল। একটা শীতল স্রোত যেন হঠাই নড়েচড়ে পা থেকে মাথায় উঠে এল। একপলক তাকিয়েই আর তাকাবার শক্তিটা খুঁজে পেল না সে। যে-লোকদুটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের গায়ে পা-ঝুল-শার্ট, শার্টের ওপর ছেঁড়া কোট ঢাপানো। কোমর থেকে একটা ময়লা চিরকুট কাপড় লুঙ্গির মতো হাঁটুর নিচ অবধি জড়ানো। পায়ে কাপড়ের জুতো আছে। কিন্তু একটা লোকের বাম হাত কবজির পর শেষ হয়ে গিয়েছে, মুখের দিকে তাকালে চোখে এক লক্ষ সুচ ফোটে। কারণ তার নাক সেই, চলগুলোর জায়গায় লা চামড়া গদদশ করছে। অন্যজনের বিস্থা আরও বীভৎস। কার কানের লতি যেন ছিঁড়ে পড়েছে। ওপরের ঠোঁট না থাকায় দাঁতগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কারোরই চোখে পাতা নেই, দ্বিতীয়জনের আঙুলগুলো ছোট হয়ে এসেছে, একটা আঙুল গোড়া থেকে খসে গিয়ে চামড়ায় লেগে ঝুলছে।

চালাঘরের ঠিক মাঝখানে বেঞ্চিগুলোর গায়ে ইটের গোল চৌহদ্দিতে আগুন জ্বলছে। কাঠের আগুন। ইঁটগুলো উঁচু বলে ওরা দূর থেকে এটাকে লক্ষ করেনি। আগুনটা এইভাবে জ্বলছে, কী কাজে লাগে কে জানে!

আপনারা কেন এসেছেন?

আমি তো মানুষ! আপনি লোকগুলোকে খেতে দিলেন না, আমি খাই কী করে? ঠিক আছে, চলুন, যা বলবেন করছি, দেখবেন টাকাটা যেন না মারা যায়।

লোকটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করল। নিশীথবাবু চাপা গলায় অনিমেষকে শুনিয়ে বললেন, এইসব লোক নিয়ে দেশে বিপ্লব হবে, অবো! ·

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লোকটা বোধহয় অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল, এখন কাছে আসতেই মুখোমুখি হল। বেঁটেমতন, গায়ে কাপড় জড়ানো এবং মুখচোখ ভীষণ ফোলা-ফোলা। ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলে উঠল, কী আছে ব্যাগে, খাবার?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন, কংগ্রেস থেকে রিলিফ নিয়ে এসেছি।

লোকটা ঘাড় নাড়ল, খুব বান এসেছিল, শহর ভেসে গেছে?

নিশীথবাবু বললেন, শহরে জল ঢোকেনি।

লোকটা বলল, আমাদের এখানেও না। তবে কাল থেকে কেউ কিছু খাইনি, না এলে নৌকো ডবিয়ে দিতাম। আসুন, মোড়ল আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছে।

প্রথমদিকে লোকটার কথাবার্তা ছিল একধরনের, শেষ কথাটা বলার সময় ওকে খুব রাগী-রাগী রাগল। লোকটার পিছুপিছু ওরা হাঁটতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা-পথ বেশ পরিষ্কার। কিছুদুর যেতেই আর বাইরের জল চোখে পড়ল না। পথের ঋরে ময়লা রক্তমাখা ফেটি পড়ে আছে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল অনিমেষের। নিশীথবাবু নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে সেগুলোকে টপকে যেতে বললেন। কিছুটা যেতেই জলটা যেন চট করে উধাও হয়ে গেল। সামেন বিরাট মাঠের মতো পরিষ্কার জমি, তার চারধারে ছোট ছোট খেলার ঘরের মতো ঘর। ঘরগুলোর চালে টিন, দেওয়া, দেওয়াল যে যেরকম পেরেছে দিয়েছে। যে-কোনো ঘরেই মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। তবে ঠিক মধ্যিখানে বেশ শক্তমতন বিরাট চালাঘর। তার তলায় বেঞ্চি করে কাঠের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে। মাঠের এক কোণে অনেক মানুষ চুপচাপ বসে আছে। দূর থেকে তাদের ময়লা কাপড়ের স্তুপ বলে মনে হচ্ছিল। ওরা ভোলা জমিতে এসে পড়তেই লোকটা.ওদের সেখানে দাঁড়াতে বলে দ্রুত সেদিকে চলে গেল। নিশীথবাবু চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কীভাবে এরা বেঁচে আছে দ্যাখো। আর শোনো, এদের সামনে তোমরা এমন-কিছু কোরো না যাতে এরা আঘাত পায়।

মোটা লোকটা বলল, একদম কুষ্ঠরোগীদের ডেরায় নিয়ে এলেন, এরকম কথা ছিল না।

নিশীথবাবু কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। অনিমেষ দেখল দুজন লোক সেই জটলা থেকে ওদের চিনিয়ে-নিয়ে-আসা লোকটির সঙ্গে উঠে এসে চালাঘরটার নিচে দাঁড়াল। পথপ্রদর্শকটি এগিয়ে এসে ওদের বলল, আসুন, মোড়ল আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে।

নিশীথবাবুর পেছন পেছন ওরা চালাঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। এখন রোদ নেই, একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সমস্ত মাঠটা জুড়ে জুড়ে অদ্ভুত মায়াময় একটা ছায়া নেমেছে। হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ সেই বাতাসে একটা শুটকো গন্ধ পেল। গন্ধটা গা গুলিয়ে দেয়। মোটা লোকটি ফিসফিস করে বলল, কেউ শালা টেঁসেছে নির্ঘাত।

শহর থেকে এ-জায়গাটা বেশি দূরে নয়, কিন্তু এ-অঞ্চলে অনিমেষরা কখনো আসেনি। তিস্তার তীর ধরে পায়ে হেঁটে নিশ্চয়ই এদিকের মানুষজন যাওয়া-আসা করে। শহরে যেসব কুষ্ঠরোগীকে ভিক্ষে করতে দেখা যায় তারাই যে এতটা দূর হেঁটে এই ডেরায় ফিরে আসে আগে জানত না অনিমেষ। ওর মনে পড়ল, কোনোদিন বিকেলবেলায় ও শহরের রাস্তায় একজন কুষ্ঠরোগীকেও ভিক্ষে করতে দেখেনি। এক-একজনকে দেখে মনে হত এ নিজে হাঁটতে পারবে না, অথচ কী করে যে সে আসে এবং উধাও হয়ে যায় কিছুতেই ধরতে পারত না সে।

ওদের এগিয়ে যেতে দেখে দূরের জুটলার ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন উঠল। ব্যাগগুলো যে খাবারের বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধে হচ্ছে না। চালাঘরের নিচে দাঁড়ানো একজন লোক হাত তুলে নিষেধ করতেই গুঞ্জনটা চট করে থেমে গেল।

চালাঘরের সামনে এসে অনিমেষ মাটিতে চোখ নামিয়ে ফেলল। একটা শীতল স্রোত যেন হঠাৎই নড়েচড়ে পা থেকে মাথায় উঠে এল। একপলক তাকিয়েই আর তাকাবার শক্তিটা খুঁজে পেল না সে। যে-লোকদুটি সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের গায়ে পা-কুল-শার্ট, শার্টের ওপর হেঁড়া কোট চাপানো। কোমর থেকে একটা ময়লা চিরকুট কাপড় লুঙ্গির মতো হাঁটুর নিচ অবধি জড়ান। পায়ে কাপড়ের জুতো আছে। কিন্তু একটা লোকের বাম হাত কবজির পর শেষ হয়ে গিয়েছে, মুখের দিকে তাকালে চোখে এক লক্ষ সুচ ফোটে। কারণ তার নাক সেই, চুলগুলোর জায়গায় লাল চামড়া গদদগ করছে। অন্যজনের বস্থা আরও বীভৎস। কার কানের লতি যেন ছিঁড়ে পড়েছে। ওপরের ঠোঁট না থাকায় দাঁতগুলো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কারোরই চোখে পাতা নেই, দ্বিতীয়জনের আঙুলগুলো ছোট হয়ে এসেছে, একটা আঙুল গোড়া থেকে খসে গিয়ে চামড়ায় লেগে ঝুলছে।

চালাঘরের ঠিক মাঝখানে বেঞ্চিগুলোর গায়ে ইটের গোল চৌহদ্দিতে আগুন জ্বলছে। কাঠের আগুন। ইটগুলো উঁচু বলে ওরা দূর থেকে এটাকে লক্ষ করেনি। আগুনটা এইভাবে জ্বলছে, কী কাজে লাগে কে জানে!

আপনারা কেন এসেছেন?

একটু খোনা-খোনা গলায় দুজনের একজন কথা বলল। অনিমেষ মুখ তুলে দেখল না, তবে অনুমান করল নিশ্চয়ই হাতহীন লোকটি প্রশ্নটা করেছে। নিশীথবাবু নিশ্চয়ই একটু দমে গিয়েছিলেন, কারণ উত্তরটা দিতে তিনি ইতস্তত করছেন বোঝা গেল, মানে, চারধারে বন্যার জলে সব ভেসে গেছে, আপনারাও নিশ্চয়ই খাবার পাননি, আমরা রিলিফ নিয় বেরিয়েছি–তাই চলে এলাম।

উত্তরটা শুনে খোনা-খোনা গলা বলল, ভালোই হল। আমাদের অবশ্য দুদিনের খাবার মজুত ছিল-কী আছে ওতে?

নিশীথবাবুর আদেশের জন্য ওরা অপেক্ষা করল না, ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখানে বসার কী দরকার, এবার চলে গেলই হয়। অনিমেষ লক্ষ করছিল, নিশীথবাবু আপনিআপনি করে কথা বলছিলেন। অবশ্য খোনা-গলা লোকটার কথা বলার ধরনে ভিখিরিসুলভ কোনো ব্যাপারই নেই, বরং বেশ কর্তৃত্বের সুর প্রকাশ পাচ্ছিল।

মোটা লোকটা ব্যাগ নামানোর পর যেন মুক্তি পেয়ে বলল, চলুন যাওয়া যাক।

নিশীথবাবু এবারও তার কথায় কান দিলেন না। বরং আস্তে-আস্তে চালাঘরের ভেতরে ঢুকে বেঞ্চিতে বসলেন। অন্য লোক দুটো তার সামনে হেঁটে উলটোদিকের বেঞ্চিতে বসল। তৃতীয় লোকটি, যে ওদের এখানে নিয়ে এসেছে, বডিগার্ডের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিশীথবাবু বসে ওদের দিকে তাকালেন, কী হল, তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? অগত্যা অনিমেষকে চালাঘরে ঢুকতে হল, ও বুঝতে পারল মোটা লোকটি বেজারমুখে ওর সঙ্গে আসছে।

বেঞ্চিতে বসামাত্র কাঠের আগুনের ওম ওদের শরীরে লাগল। বাইরে যে হিম বাতাস বইছিল তার চেয়ে এই উত্তাপ অনিমেষের কাছে আরামদায়ক মনে হল। মোটা লোকটি অনেক ইতস্তত করে বেঞ্চিতে বসল। তার বসবার প্রনটা সবার নজরে পড়েছিল, কারণ এই সময় খোনা লোকটি বলে উঠল, চিন্তা করবেন না, যে-সমস্ত রোগী সংকামক তারা এই বেঞ্চিতে বসে না। আপনি স্বচ্ছন্দে বসুন।

অনিমেষ এতক্ষণে সবার সামনের দিকে তাকাল। তার অনুমানই ঠিক, যার নাক নেই সে এতক্ষণ কথা বলছিল। নিশ্চয়ই এ হল মোড়ল, আর দাঁত-বের-করা লোকটি ওর সহকারী। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চেহারাগুলো ক্রমশ ওর সহ্য হয়ে গেল। অভ্যাস হয়ে গেলে সবকিছু একসময় মেনে নেওয়া যায়। এই সময় মোড়ল খোনা গলায় বলল, খোকা, খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে, নৌকো করে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে।

অনিমেষ চটপট ঘাড় নাড়ল, না।

নিশীথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে কতজন আছেন?

একশো তিনজন ছিলাম আজ সকাল পর্যন্ত, একজন একটু আগে মারা গিয়েছে। কেন বলুন তো? আপনারা কি সরকারি লোক? লোকটি এখনও একটাও কথা বলেনি, শুধু তখন থেকে সে অন্যমনস্কভাবে তার ঝোলা আলটা মুচড়ে যাচ্ছিল।

নিশীথবাবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না, আমরা কংগ্রেস থেকে রিলিফ দিচ্ছি। সরকারি লেভেলে এসব করতে সময় লাগে।

মোড়ল বলল, ও একই হল। কংগ্রেস আর সরকার তো আলাদা নয়। তা সরকার তো আমাদের সাহায্য দেয় না; শহরে ভিক্ষে করতে গেলে পুলিশ ঝামেলা করে।

নিশীথবাবু বললেন, সবে তো আমরা স্বাধীন হয়েছি, এখনও সব দিক সামলে ওঠা সম্ভব হয়নি। চিন্তা করবেন না, আমি গিয়ে ডি সির সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলব।

মোড়ল বলল, ভালো খক ভালো। তারপর সে তার বডিগার্ডকে বলল, এদের খাবার ব্যবস্থা করো, এত দূর থেকে এসেছেন আমাদের উপকার করতে।

সঙ্গে সঙ্গে নিশীথবাবু বলে উঠলেন, না না, আপনাদের ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমরা ফিরে গিয়ে খাব।

মোড়ল বলল, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। তিনজন লোক আমাদের সবার জন্য রাধে। তাদের অসুখ আছে, কিন্তু তা একদম সংক্রামক নয়। আজ পাঁচ বছর হল অসুখ তাদের বাড়েনি।

নিশীথবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমরা এই রুটি গুড় খাচ্ছি। মাথা ঘুরিয়ে তিনি মোটা লোকটিকে বললেন, কিছু রুটি আর গুড় ব্যাগ থেকে বের করে আনো তো! :

তড়াক করে মোটা লোকটা উঠে গিয়ে ব্যাগের মুখ খুলতে লাগল। যদি এদের রান্না-করা খাবার খেতে হয় সেজন্য সে এক মুহূর্ত ব্যয় করতে রাজি ছিল না। অনিমেষ দেখল আকাশ আবার কালো। হয়ে আসছে।

নিশীথবার বললেন, আচ্ছা, আপনাদের এখানে যত লোক আছেন তাদের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ। কজন? মানে মুখচোখ দেখে বোঝা যায় না তাদের অসু হয়েছে, আমি এরকম লোকের সংখ্যা জানতে চাইছি।

বিকৃত মুখচোখ হলেও বোঝা গেল মোড়ল খুব অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। কয়েক মুহূর্ত তাকে ভাবতে দেখল অনিমেষ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, এভাবে বলা মুশকিল।

নিশীথবাবু বললেন, তরু–।

মোড়ল বলল, এই রোগ হয়েছে জানলেই আপনারা সংসার থেকে বার করে দেন, তা আজ মুখচোখ খেয়ে যায়নি এরকম লোকের সন্ধান করছেন, উদ্দেশ্যটা কী?

নিশীথবাবু বললেন, আমরা একটা জিনিস চিন্তা করেছি, তাতে আপনাদের উপকার হবে।

মোড়ল বলল, উপকার পেলে কে না নিতে চায় বলুন! তবে তেমন বিশ্বাস হয় না। এই দেখুন, এতদিন কেউ আসেনি এখানে, রাখালগুলো গোরু চরাতে পাশের মাঠে এসে লক্ষ রাখত যেন কোনো গোরু দলছাড়া হয়ে এখানে না ঢুকে পড়ে। তা এখন এত জল, বৃষ্টি হল, চারধারে ভেসে গেল মানুষ-এই এখন আপনারা এলেন খাবার নিয়ে। আবার শুনছি উপকারও হবে–কী জানি!

মোটা লোকটি খাবার নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। ব্যাগের মধ্যে কী কী ছিল দেখেনি অনিমেষ। এখন মোটা লোকটি ওর হাতে একটা লালচে হাফ পউরুটি আর এক ঢেলা আখের গুড় দিতে ও নিশীতবাবুর দিকে তাকাল। নিশীথবাবুরও তা-ই বরাদ্দ এবং তিনি তা স্বচ্ছন্দে খেতে আরম্ভ করেছেন। মোটা লোকটি ইচ্ছে করেই চারটে রুটি এনেছে যাতে নিজেরটা শেষ করে সে চটপট অতিরিক্তটা খেতে পারে। দুপুরবেলায় আজ অবধি সে ভাত চাড়া কোনোদিন অন্যকিছু খায়নি। খুব ছোটবেলায় কারও বাড়িতে দুপুরে রুটি হলে ও মনে হত তারা খুব গরিব, ভাত খাওয়ার সামর্থ্য। নেই। এই পরিবেশে ওর এতক্ষণ খিদেবোধটা ছিল না, কিন্তু শুকনো রুটিতে একটা কামড় দিতেই মনে হল পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। এখন এই খিদের মুখে ওর মনে হল এত ভালো খাবার অনেকদিন সে খায়নি।

নিশীথবাবু বললেন, আপনারা খাবেন না?

মোড়ল বলল, আমরা দুবার খাই। উদয় এবং অস্তকালে। আপনারা চিন্তা করবেন না। এখানে কত রুটি আছে।

নিশীথবাবু একটা আনুমানিক সংখ্যা বললে মোড়ল হাত নেড়ে বডিগার্ডকে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলতেই সোজা দূরের জটলার কাছে চলে গেল। শুকনো রুটি গলায় আটকে যাচ্ছিল, একটু জলে পেলে হত। কিন্তু মোটা লোকটা ফিসফিস করে বলল, খবরদার, জল খাবেন না। কলেরা হবে। লালা দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে গিলে ফেলুন।

এমন সময় অনিমেষ দেখল বডিগার্ডটার পেছনে পেছনে সমস্ত কুষ্ঠরোগী উঠে আসছে। মোটা লোকটা ফিসফিসিয়ে বলল, চলেন এইবেলা যাই।

এগিয়ে-আসা দলটার দিকে তাকিয়ে মোড়ল বলল, আমাদের এখানে একুশজন মেয়েছেলে আছে। তার মধ্যে সাতজন বুড়ি-তেমন হাঁটাচলা করতে পারে না, যে মারা গেছে সেটা মেয়েছেলে-বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল।

নিশীথবাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তার স্বামীও এখানে আছেন?

মোড়ল বলল, আছে তবে খুঁজে বের করা যাবে না।

বডিগার্ড ততক্ষণে ওদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটা বিরাট সাপের মতো হয়েসেটা মাঠময় কিলবিল করছে। অনিমেষ ফোঁসফোঁস শব্দ শুনে শুনে দেখল মোটা লোকটি তার পাশে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এখন অনিমেষের আর সেই ভয়-ভয় ভাবটা নেই। সে স্থিরচোখে লোকগুলোকে দেখল। মেয়েরা আছে, তবে তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাধা। এতক্ষণ লক্ষ করেনি, এখন অনিমেষ দেখল বডিগার্ডের ডান হাত থেকে মাঝে-মাঝে টপটপ কমে রক্ত মাটিতে পড়ছে। ওর হঠাৎ সেই অনেকদিন আগের এক সকালবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তিস্তার ওপর নৌকোয় বসে সে আঙলহীন যে-মানুষটির হাত ধরে বাঁচিয়েছিল সে কি এখানে আছে? কুষ্ঠরোগীরা কতদিন বাঁচে। সেই লোকটা কি এখন বেঁচে নেই অনিমেষ এখনও চোখ বন্ধ করলে তার সেই চিৎকারটা শুনতে পায়, কেন বাঁচালি? কেন বাঁচালি? অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে লাইনটাতে ভালো করে সেই মানুষটিকে খুঁজতে লাগল। এমন সময় ওর নজরে পড়ল মাঠের শেষপ্রান্ত যেখানে এতক্ষণ মানুষগুলো বসেছিল সেখানে একটা শরীর ময়লা কাপড় মুড়ি দিয়ে টানটান হয়ে শওয়ে আছে। যে-মেয়েটির কথা একটু আগে মোড়ল বলছিল সে মাঠের ওপর মরে পড়ে আছে। মরে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া-মাঝিটার সেই কথা এখন ভীষণরকম সত্যি বলে মনে হল অনিমেষের।

গুঞ্জন থেকে হইচই শুরু হয়ে গেল আচমকা। সবাই এগিয়ে এসে আগে ব্যাগটার কাছে পৌঁছতে চায়। বডিগার্ড চিৎকার করে তাদের সামাল চেবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার একার পক্ষে সেটা প্রায় অসম্ভব। অনিমেষ মুখগুলো দেখল, প্রত্যেকটি মুখ কিছু পাবার আশায় বীভৎস হয়ে উঠেছে। শেষতক মোড়ল উঠে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে ক্রমশ হইচইটা কমে এল। মোড়ল চিৎকার করে তাদের থামতে বলে কথা শুরু করল, এইসব, খাবার আমাদের জন্য। এই বাবুরা কংগ্রেস থেকে আমাদের জন্যে এত ভেঙে নিয়ে এসেছেন। কেউ কেড়ে নেবে না, সবাই পাবে। যে বেয়াদপি করবে আমি তাকে ক্ষমা করব না। প্রত্যেকে লাইন দিয়ে খাবার নিয়ে যাও।

সাধারণ দেখতে এই লোকটির এত প্রভাব নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না অনিমেষ। সবাই চুপচাপ এসে খাবার নিতে লাগল। বডিগার্ড এক-একটা রুটিকে কয়েক টুকরো করে কিছু চিড়ের সঙ্গে ওদের হাতে দিচ্ছিল। এই সময় মোড়ল ফিরে এসে নিশীথবাবুকে বলল, এইবেলা আপনি দেখে নিন প্রত্যেককে আপনার কাজে লাগবে কি না। নিশীথবাবু বোধহয় একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন, এখন সোজা হয়ে বসে ওদের লক্ষ করতে লাগলেন। তিনি খুব খুশি হচ্ছে না মুখ দেখে। বোঝা গেল।

এক এক করে সবার নেওয়া হয়ে গেল। শেষের দিকে কয়েকজন বুড়ি বোধ হয় খুব কম। পেয়েছিল। তারা গুঁইগুই করতে টুপটাপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বুড়িগুলো পড়িমড়ি করে নিজেদের চালাঘরের দিকে ছুটে গেল। ওদের যাওয়ার ভঙ্গি দেখে কষ্ট হল অনিমেষের। এমন সময় দূর থেকে চিৎকার ভেসে এল। কারা যেন কাউকে ডাকছে। মোড়ল বলল, আপনাদের সঙ্গীরা বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়েছে।  নিশীথবাবু মোটা লোকটিকে বললেন, ওদের গিয়ে বলো, আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসছি।

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র মোটা লোকটি প্রাণপণে দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। বৃষ্টি এলে নৌকোয় ওরা ফিরবে কী করে? অনিমেষ নিশীথবাবু দিকে তাকাল। তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। মোড়ল বলল, এখন বৃষ্টি হবে না। তা আপনি যা চেয়েছিলেন পেয়েছেন?

নিশীথবাবু মাথা নাড়তে সে বলল, পাওয়া যায় না কখনো। আমরাও বোধহয় আর আপনার উপকার পেলাম না, কী বলেন?

নিশীথবাবু বললেন, তা কেন! তবে যা দেখলাম তাতে জন-পনেরোর বেশি লোক পাওয়া যাবে না। মেয়েরা অবশ্য কাজে লাগতে পারে, তবে দেখতে হবে হাতের আঙুলগুলো ঠিক আছে কি না।

মোড়ল বলল, তাও হল না, সব মজে গেছে। গিয়ে ভালোই হয়েছে, প্রাণ বেরিয়ে যেত পুরুষগুলোর। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলবেন বাবু?

নিশীথবাবু বললেন, তেমন-কিছু নয়, যদি প্রয়োজন হয় এসে বলে যাব।

মোড়ল হাসল, আপনারা আর আসবেন না। এখান থেকে যে যায় সে আর আসে না।

নিশীথবাবু কথাটার জবাব দিলেন না, অনিমেষকে ইঙ্গিত করে চালাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর পেছনে যেতে গিয়ে অনিমেষের নজর পড়ল মোড়লের সঙ্গীর দিকে। এতক্ষণ সে একটাও কথা বলেনি, শুধু একনাগাড়ে হাতে হেঁড়া আঙুলটা মুচড়ে যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই এটা ওর মুদ্রাদোষ, কিন্তু এরকম বীভৎস মুদ্রাদোষের ওপর এতক্ষণ চোখ রাখতে পারেনি অনিমেষ। এখন দেখল পাক খেয়ে খেয়ে আঙুলটার ঝুলে-থাকা চামড়াটা চুপচাপ খসে গিয়ে সেটা লোকটার অন্য হাতে উঠে এসেছে। প্রচণ্ড নাড়া খেল অনিমেষ। নিজের একটা আঙুল হাতের তালুতে নিয়ে লোকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সামান্যক্ষণ দেখল, তারপর সেটাকে ছুটে ইটের চৌহদ্দিতে জ্বলা আগুনের ভেতর ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা চামড়া-পোড়া গন্ধ বের হল সেখান থেকে। খুব জোর পা চালিয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। লোকটা তখন আগুনের কাছে ঝুঁকে পড়ে তার আঙুলটা দেখছে। চট করে নিজের আঙুলের দিকে তাকাল অনিমেষ।

মোড়ল বলল, চললেন?

নিশীথবাবু ঘাড় নাড়লেন।

মোড়লের যেন কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, যাওয়ার আগে একটু কষ্ট করতে হবে যে! আমার সঙ্গে একটু আসুন।

নিশীথবাবু অবাক হলেন, কেন? কী ব্যাপার?

মোড়ল কোনো উত্তর না দিয়ে ওদের ইঙ্গিতে আসতে বলে সামনের এক ঝুপসিঘরের দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। ওর বডিগার্ড তখনও ওদের পাশে দাঁড়িয়ে। নিশীপবাবু যেন বাধ্য হয়েই বললেন, চলো দেখে আসা যাক।

মাঠটা পেরিয়ে ছোট ঝুপসিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মোড়ল বাইরে থেকে চিৎকার করে ডাকল, ক্ষেন্তি ও ক্ষেত্তি, বাচ্চাটাকে নিয়ে বাইরে আয়।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বউ বাইরে বেরিয়ে এল। তার সর্বাঙ্গ কাপড়ে মোড়া, মাথার মোমটা বুক অবধি নেমে আসায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোলের ওপর একগাদা কাপড়ের স্তুপের ওপর একটা লালচে রঙের শিশু শুয়ে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে।

মোড়ল একটু দূর থেকে ঝুঁকে পড়ে বাচ্চাটাকে চুকচুক শব্দ করে আদর করল। তারপর নিশীথবাবুর দিকে ফিরে মাঠের শেষপ্রান্তে শুয়ে-থাকা মৃতদেহটিকে দেখিয়ে বলল, ওর মেয়ে। কী সুন্দর মুখোনা দেখুন।

অনিমেষ দেখল, সত্যি একটা ফুলের মতো মেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। এত হাত পা মুখ চোখ সব নিখুঁত, কোথাও অসুস্থতার চিহ্ন নেই। পৃথিবীর আর যে-কোনো মানুষের বাচ্চার মতো সম্পূর্ণ সুস্থ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

মোড়ল বলল, একে নিয়ে যাবেন?

নিশীথবাবুর মুখের দিকে তাকাল অনিমেষ, তিনি ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েছেন। মুখচোখ কেমন হয়ে গেছে। কোনোরকম বললেন, দোখ, কথা বলে দেখি।

মোড়ল বলল, আপনি যেরকম চাইছিলেন ঠিক সেরকম না। তার চেয়ে বেশি বলতে পারেন। মুখ চোখ হাত আঙুল সব ঠিক আছে। বাবু একে নিয়ে যান, নইলে একদিন ও আমাদের মতো হয়ে যাবে! আপনি যা চেয়েছিলেন পেয়ে গেলেন বাবু।

নিশীথবাবু এবার ঘুরে দাঁড়ালেন, আমি গিয়ে খবর দেব। এসো অনিমেষ।

আর দাঁড়ালেন না তিনি, হনহন করে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগলেন। ওঁকে যেতে দেখে অনিমেষও পা চালাল। পেছনে মোড়লের গলা ভেসে এল, কী এল, কী হল বাবু, ও বাবু অনিমেষ নিশীথবাবুর সঙ্গে জঙ্গলটার কাছে পৌঁছে গিয়ে দেখল মোড়ল দুহাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে আদর করছে। বডিগার্ডটা ওদের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসছে আর চালাঘরের মধ্যে আগুনের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সেহ লোকটা এখনও তার আঙুলটাকে পুড়ে যেতে দেখছে।

ততক্ষণে অনিমেষ কথা বলল, বাচ্চাটা দেখতে খুব সুন্দর। নিয়ে এলে ওকে বাঁচানো যেত হয়তো। আপনি তো এইরকম চাইছিলেন।

জঙ্গল পেরিয়ে নৌকোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিশীথবাবু কেন এলেন কিছুতেই বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। জলপাইগুড়ি শহরে বা গ্রামে তো সেরকম মানুষ অনেক আছে। নাকি সেসব মানুষ নিশীথবাবুর কথা সবসময় শুনবে না, এদের পেলে সুবিধে হত? নৌকোয় বসে হিম বাতাসে কি না জানে না, অনিমেষের সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল আচমকা।

সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী বিপুল ভোটে বিরোধীদের পরাজিত করে নির্বাচিত হয়ে গেলেন। লোকসভার প্রার্থী অপেক্ষাকৃত অখ্যাত, কিন্তু তাকেও জিততে কিছু ব্লেগ পেত হ না। সেই বন্যার পর থেকে অনিমেষ আর বংগ্রেস অফিসে যায়নি, ফাইনাল পরীক্ষার চাপটা যেন পাহাড়ের মতো রাতারাতি ওর ওপর এসে পড়েছিল। সরিৎশেখর রাতদিন লক্ষ রেখেছিলেন বাইরের দিকে যেন ওর মন না যায়। নাতির পরীক্ষা নয়, যেন তিনি নিজেই স্কুল ফাইনাল দিচ্ছেন। নিশীথবাবু কয়েকবার লোক পাঠিয়েছিলেন অনিমেষকে ডাকতে, সরিৎশেখর সযত্নে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্যার সময়ে অনিমেষ যে-অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছল তার ফলে রাজনীতিতে ওর আগ্রহটা যেন হঠাই মিইয়ে গেল। ওর খুব মনে হয়েছিল এই নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী জিততে পারবে না। রাজনীতি করতে গেলে মিথ্যা কথা বলতে হয়, শঠতা ছাড়া রাজনীতি হয় না-এসব ব্যাপার এর আগে এমন চোখে আঙুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়নি। নিশীথবাবুর মুখের কথা আর কাজের ধারার মধ্যে এত পার্থক্য-ব্যাপারটা মেনে নিতে ওর কষ্ট হচ্ছিল।

দুপুরে মণ্টু আর তপন মাঝে-মাঝে ওদের বাড়িতে আসত টেস্ট পেপার সলভ করতে। মণ্টুদের ও সেই অভিজ্ঞতার কথাটা বলেছিল। এই প্রথম সে নিশীথবাবুর সমালোচনা বন্ধুদের কাছে করল। ব্যাপারটা অনিমেষকে যতটা উত্তেজিত করেছিল মণ্টুকে তার কিছুই করল না। ইদানীং মণ্টু একদম পালটে গেছে। আগের মতো গা-জোয়ারি ভাবটা একদম নেই। মেয়েদের আলোচনার আর করে না। একসময় ও দাদার কাছ থেকে শুনে এসে কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলত মাঝে-মাঝে, এখন তাও বলে না। নিশীথবাবুর কথা শুনে ও নির্লিপ্তের মতো বলল, এসব ব্যাপার নিয়ে তুই কেন ভাবছিস, তোর ভোট আছে?

অনিমেষ হকচকিয়ে গেল, ভোট নেই বলে আমরা ভাবব না। কংগ্রেসকে কোথায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে বল তো! এই দল একসময় কারা করেছিল, ভেবে দ্যাখ!

মণ্টু বলল, আমার মাকে ছেলেবেলায় দেখেছি, কী সুন্দর দেখতে ছিল, চোখ জুড়িয়ে যেত। আর এখন রোগা হয়ে গিয়ে চামড়া ঝুলে গেছে, হাড় বেরিয়ে গেছে-এখন দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না মা এককালে সুন্দরী ছিল। তাই বলে হা-হুতাশ করে মাকে আমি আবার সুন্দরী করতে পারব? এখন যেরকম সময় সেরকম ভাবাই ভালো।

কথাটা ভাবতে ভাবতে অনিমেষ বলল, কিন্তু এরকম চললে আমাদের দেশের কোনো উন্নতি হবে?

মণ্টু খিঁচিয়ে উঠল, ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না তো! এই দেশ কি তোর পৈতৃক সম্পত্তি যে তুই ভেবে মরছিস! ধর তুই যদি তিনবার স্কুল ফাইনাল ফেল করিস, তোর দাদু যদি আর না পড়ায়, তা হলে কী করছি? কংগ্রেস তোকে দেখবে? কোনো বড় নেতার বাড়িতে গেলে তার ছেলেমেয়ে তোকে ভ্যাগাবণ্ড ভাববে! ওসব ছাড় অনিমেষ।

তপন ফিক করে হেসে বলল, হাঁস খেটেখুটে ডিম পাড়ে, আর দারোগবাবু ওমলেট খায়।

মণ্টু বলল, ঠিক। আগে নিজের কেরিয়ার তৈরি কর, তারপর অন্য কথা। দ্যাখ-না, বিরাম কর কেমন ম্যানেজ করে এখান থেকে কেটে পড়ল। শুনছি কলকাতার বরানগরে বাড়ি কিনেছে। মেনকার বিয়ে হয়ে গেছে এক বড়লোকের সঙ্গে। নিশীথবাবুর কী হল? হোল লাইফ শালা জেলা স্কুলে মাস্টারি করে কাটাবে।

জীবনে এই প্রথম অনিমেষ চিন্তা করল, ও যদি ভালোভাবে পাশ না করতে পারে তা হল কী হবে! দাদু আজকাল প্রায়ই বলেন, ফার্স্ট ডিভিশন হলে কলকাতায় পাঠাবেন-বাব নাকি এরকম প্রতিজ্ঞা দাদুর কাছে করে গেছেন। দাদুর ইচ্ছা অনিমেষকে ইংরেজির এম-এ হতে হবে অথবা আইন পাশ করবে অনিমেষ-এ-বংশে যা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারত না কোনোদিন। এই অবস্থায় যদি ওর রেজাল্ট খারাপ হয়! অনিমেষ মনেমনে বলল, তা কখনো হবে না, হতে পারে না। আজ অবধি সে কখনো খারাপ কিছু করেনি, খারাপ কিছু হতে পারে এরকম চিন্তা করতে ওর কষ্ট হয়। মণ্টুর দিকে তাকাল সে। কী করে বড়দের মতো ও যে-কোনো কাজ করার আগে দুটো দিক ভেবে নেয়।

হঠাৎ মণ্টু বলল, আচ্ছা অনি, তোর জীবনের অ্যাম্বিশন কী?

ভ্রূ কোঁচকাল অনিমেষ, অ্যাম্বিশন?

মণ্টু বলল, হ্যাঁ। তবে এইম অভ লাইফ বলে এসেটা মুখস্থ বলিস না।

 

চট করে জবাব দিতে পারল না অনিমেষ। সত্যি তো, কোনোদিন সে ভেবে দেখেনি বড় হয়ে কী করবে। কেউ চাকরি করে, কেউ ডাক্তার ইঞ্চিনিয়ার বা উকিল হয়। আবার কেউ-কেউ রাজনীতি করে মন্ত্রী হয়ে যায়। ব্যবসা করে বড়লোক হচ্ছে অনেকে। আবার চাকরি বা ব্যবসা করে সাধারণ মানুষ হয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাতে অনেককেই সে দেখছে চারপাশে। এককালে, কেউ যদি ওকে এই প্রশ্ন করত তা হলে সে চটপট করার দিত, দেশের কাজ করব। কিন্তু এখন-অনিমেষের একটা লেখার কথা মনে পড়ল। কার লেখা এই মুহূর্তে মনে নেই। মানুষ এবং জন্তুর মূল পার্থক্য হর, জন্তু চিরকাল জন্তই থেকে যায়। দুহাজার বছর আগে একটা গোরু যেভাবে ঘাস খেত, দিন কাটাত, আজও সেভাবেই সে ঘাস খায়, দিন কাটায়। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন যে-জ্ঞান অর্জন করে সেটা সে তার সন্তানের জন্য রেখে যায়। সে যেখানে শেষ করছে তার সন্তান সেখান থেকে শুরু করে। এই যে এগিয়ে যাওয়া, তার নামই হল উত্তরণের পথে পা বাড়ানো এবং সেটা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আফ্রিকার গভীর অরণ্যে সভ্যতার সংস্রবহীন যে-মানুষ আদিগন্তকাল একইভাবে জীবন কাটাচ্ছে তার মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই। প্রকৃত সভ্য মানুষ এগিয়ে যাবে। তা-ই যদি হয়, তা হলে আমাদের পূর্বপুরুষ যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন আমরা তার চেয়ে আরও উন্নত কোনো উপায়ে কাটাব। যেভাবে. ওঁরা দেশের কথা ভেবেছেন, দেশের উন্নতির স্বপ্ন দেখেছেন, অথচ সে-সময় প্রতিকূল পরিবেশে তা অসম্ভব থেকে গেছে-আজ আমরা তা সব করব। কিন্তু শুধু একজন ডাক্তার, ইঞ্চিনিয়ার বা ব্যবসায়ী। হয়ে কি তা সম্ভব! আমরা যাদের উত্তরাধিকারী তাদের কাছে কী জবাব দেব সুভাষচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধী, দেশব, বুবদ্রিনাথ-এরা তো কেউ চাকরি করেননি কখনো। অন্যের চাকর হয়ে কি স্বাধীনভাবে দেশের কথা ভাবা যায়!

মণ্টু আর তপন একদৃষ্টিতে অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনিমেষ যে প্রশ্নটার উত্তর দিকে পারছে না এতে ওরা মজা পাচ্ছিল। মণ্টু বলল, কী রে, ধ্যান করছিস নাকি?

তপন বলল, আমার ঠিকুজিতে লেখা আছে আমিনাকি খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হব।

ঠিকুজির কথা শুনে অনিমেষের চট করে শনিবার মুখটা মনে পড়ে গেল। শনিবাবা বলেছিলেন যে, আঠারো বছর বয়সে সে জেলে যাবে। আর অনেক অনেক বছর আগে অন্নপ্রাশনের সময় ও নাকি বই ধরেছিল-দাদু বলেছিলেন, বড় হলে এ আইনজ্ঞ হবে। এসব নিতান্তই ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। ওর। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ বলল, ভবিষ্যতে কে কী হবে আগে থেকে বলা যায়?

মণ্টু বলল, তবু লক্ষ্য তো থাকবে একটা, না হলে এগোবি কী করে?

অনিমেষ হাসল, তুই এবার সেই রচনার ভাষায় কথা বলছিস।

মণ্টু বলল, আমি ঠিক করেছি যদি ফার্স্ট ডিভিশন পাই তা হলে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হয়ে আই এসসি পড়ব। আমাকে ডাক্তার হতে বলে।

সেই রাতে অনিমেষ চুপচাপ ছাদে চলে এল। এখন শীত যাবার মুখে, সামান্য চাদর হলেই চলে যায়। সরিৎশেখর হেমলতা অনেকক্ষণ শুয়ে পড়েছেন। রাত বারোটা নাগাদ সরিৎশেখর পাশের ঘর থেকে একবার গলা তুলে বললেন, এবার শুয়ে পড়ো। ছাদে দাঁড়িয়ে সে একআকাশ তারা দেখতে পেল। এইসব তারার দিকে তাকালে একসময় ও মাকে দেখতে পেত। এখন হঠাৎ ওর সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই ছাদেই মা পড়ে গিয়েছিলেন, আঠারো বছর বয়সে জেলে যাবার কথা শুনে মা অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। অনিমেষ দূরের বাঁধ পেরিয়ে নিরীহ বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে-থাকা তিস্তা নদীকে দেখল। দুমাসেই কাশগাছ গজিয়ে গেছে। কারা যেন মাইকে এখনও শহরের পথে-পথে ভোট চেয়ে আবেদন করে যাচ্ছে। আজ রাত বারোটার পর আর প্রচার চলতে না। অনিমেষ তারাদের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেলল, আমি বড় হয়ে কী হব? এই হিম-মাখা রাত, ঝকমকে তারার আকাশ, তিস্তার বুক থেকে উঠে-আসা নিশ্বাসের মতো কিছু বাতাস অনিমেষের প্রশ্নটা শুনে গেল চুপচাপ। খুব গভীর কোনো দুঃখ বুকের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে-খেতে যেন চলকে উঠল, অনিমেষ দেখল একটা তারা টুক করে খসে গিয়ে কী দ্রুত নেমে যেতে-যেতে অন্য একটা তারার বুকে মুখ লুকোল। সমোহিতের মতো ছাদময় পায়চারি করতে করতে একটা শব্দের সঙ্গে মনেমনে মারামারি করতে লাগল-জানি না, জানি না।

নির্বাচনে বামপন্থি প্রার্থী হেরে যাবার পর কংগ্রেস বিরাট বিজয়মিছিল বের করেছিল। খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেনি অনিমেষ। নির্বাচনের আগে অবধি ও শুনে আসছে সবাই কংগ্রেস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করছে। ইংরেজ আমলে এর চেয়ে সবাই সুখে ছিল, জিনিসপত্রের দাম যেরকম আকাশছোয়া হয়ে গেছে তাতে সাধারণ মানুষ বাঁচতে পারে না। আর এসব কথাই বামপন্থিরা প্রকার করছিল একটু অন্যরকম সংলাপে। ফলে অনিমেষ ভেবেছিল এই নির্বাচনে কংগ্রেস একদম মুছে যাবে। কিন্তু বিপুল সমর্থন পেয়ে জিতেছে শুনে প্রথমে যে-স্বস্তিটা ওর এসেছিল, ক্রমশ তা থিতিয়ে গেলে নিজের কাছেই নিজে কোনো জবাব পেল না। তা হলে মানুষ যত কষ্ট পাক, যত গালাগালি দিক তবু কংগ্রেসকেই ভোট দেবে। বামপন্থিদের, বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। বন্যার সময় যে-রাজনীতি দেখে এসেছে, সাধারণ মানুষ সেসর জানলেও বোধহয় বিশ্বাস করতে চায় না। এমনকি সরিৎশের পর্যন্ত ভোট দেবার আগে কংগ্রেসকে লক্ষবার গালাগাল করে জোড়া বলদেই চাপ দিয়ে এলেন। জলপাইগুড়িতে কাস্তে ধানের শিষে সোনালি রোদ আর পড়ল না। এরকমটা যে হবে তা বোধহয় সবার আগে বামপন্থিরাই খবর রাখত। তাই নির্বাচন শেষ হবার পরপরই তারা আবার আন্দোলন নেমে পড়ল-যেন নির্বাচনের রায়ে তাদের কিছু এসে যায় না।

 

এতদিন ধরে জেলা স্কুলে চেনা গণ্ডিতে পরীক্ষা দিয়েছে অনিমেষ। সেখানকার পরিবেশ একরকম আর এবার ফাইনাল দিতে গিয়েও ভীষণরকম অবাক হয়ে গেল। চার-পাঁচটা স্কুলের ছেলেরা পাশাপাশি পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে অনিমেষের পামের ছেলেটি সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছে তাকে কাতা দেখাবার জন্য। ছেলেটির গালভরতি দাড়ি, বয়স হয়েছে। অনিমেষ বিরক্তি প্রকাশ করতে সে বলল, আট বছর হল ভাই, এবার পাশ করতে হবেই। বলে কোমর থেকে বই বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল, উত্তরগুলো দাগিয়ে দাও।

আপনি নকল করবেন? কোনোরকমে কথাটা জিজ্ঞাসা করল সে। জেলা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে নকল করার রেওয়াজ নেই। বড়জোর কেউ-কেউ হাতের চেটোয় কিছু-কিছু পয়েন্ট লিখে আনত। একবার একটি ছেলে মুদির দোকানের স্লিপের মতো কাগজে খুদি-খুদি করে উত্তর লিখে এনেছিল, সুশীলবাবু তাকে ধরতে পেরে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ছেলেটিকে ট্রান্সফার নিতে হয়েছিল। ওই ধরনের কাগজকে বলা হয় চোখা, মণ্টুর কাছ থেকে জেনেছিল অনিমেষ। অত খুদিখুদি করে লিখতে যে পরিশ্রম এবং সময় দরকার হয় সে-সময় উত্তরটা সহজেই মুখস্থ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দেবার সময় এই ছেলেটির দুঃসাহস দেখে তাজ্জব হয়ে গেল।

ছেলেটি মুখ খিঁচিয়ে বলল, কোত্থেকে এলে চাঁদ, সতীত্ব দেখানো হচ্ছে! পেছনে চেয়ে দ্যাখো, টুকলির বাজার বসে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে অনিমেষ দেখল কথাটা একবর্ণ মিথ্যে নয়। ফসফস করেই বই-এর পাতা ছেঁড়ার শব্দ; খাতার তলায় কাগজ ঢুকিয়ে ঝুঁকে পড়ে যারা লিখছে তাদের কাছে যাদের কাছে উত্তর নেই তারা ক্রমাগত অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছে শেষ হয়ে গেলে দেবার জন্য। জেলা স্কুলের আরও কয়কটি ছেলে ছিল ঘরটাতে, অনিমেষ দেখল তারা যেন কিছুই ঘটছে না এরকম ভঙ্গিতে উত্তর লিখে যাচ্ছে। যে-ভদ্রলোক গার্ড দিচ্ছিলেন তিনি এখন চেয়ারে বসে মোহন সিরিজের একটা বই পড়ছেন তন্ময় হয়ে। বইটার নাম দেখতে পেল ও, হতভাগিনী রমা।

সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল অনিমেষের। সবাই যদি বই দেখে নকল করে লেখে তা হলেকেউ ফেল করবে না। এইসব মুখ কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি-ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার-সব জায়গায় নকল করে পাশ করা যায়? যদি যায় তা হলে ওরা তো কিছুইনা-জেনে যে যার মতো বড় হয়ে যাবে। এক মুহূর্তের জন্য অনিমেষের মনে হল ওর মাথায় কিছু নেই-ও একটাও উত্তর লিখতে পারবে না। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকল সে। পাশের ছেলেটি বোধহয় ভাবগতিক দেখে সুবিধে হবেনা বুঝতে পেরেছিল, নিজের মনেই উচ্চারণ করল, কী মালের পাশেই সিট পড়ল এবার!

অনিমেষ শুনল সে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, স্যার, পেচ্ছাপ করতে যাব।

গার্ড ভদ্রলোক বই থেকে মুখ না তুলে বললেন, এক ঘণ্টা হয়নি এখনও।

ছেলেটি বলল, এক ঘন্টা অবধি চেক করতে পারব না।

যাও।

শোনামাত্রই ছেলেটা বেরিয়ে গেল। অনিমেষ দেখল যাবার সময় সে উত্তরপত্রটা জামার ভেতর ঢুকিয়ে নিল। দ্বিতীয় ঘন্টার শেষে বাথরুমে গিয়েছিল সে। বাথরুমটা যেন পড়ার ঘর হয়ে গিয়েছে। যারা আসছে তারা কেউ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। বিভিন্ন আকারের কাগজের টুকরো থেকে বই-এর পাতার স্কুফ হয়ে গেছে সেখানে। সেই ছেলেটিকে এখান দেখতে পেল না সে। কিছুই বলার নেই, অনিমেষের লজ্জা করছিল সেখানে জলবিয়োগ করতে। কোনো গার্ড বা কর্তৃপক্ষের কেউ একবারও তদারকিতে আসছেন না এদিকে। অনিমেষ ফিরে আসছে, মণ্টুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এক রুমে সিট পড়েনি ওদের, মণ্টু ওকে জিজ্ঞাসা করল, কটা বাকি আছে তোর?

অনিমেষ বলল, তিনটে!

খুব সিরিয়াস মুখচোখ করে মণ্টু বলল, তাড়াতাড়ি কর, সময় নেই বেশি।

অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, কী অবস্থা দ্যাখ, এরকম টুকলিফাই চলে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

মণ্টু গম্ভীরমুখে বলল, যারা করছে করুক, তোর কী?

অনিমেষ ফিরে এসে সিটে বসতেই একটা অভিনব কাণ্ড হয়ে গেল। ও দেখল ওর খাতাটা ডেস্কে নেই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এপাশ-ওপাশ দেখতে ও প্রথমে ঠাওর করতে পারল না খাতাটা কোথায়। এমন সময় পেছনের ছেলেটি চাপা গলায় ওকে বলল, লাস্ট বেঞ্চিতে নিয়ে গেছে। অনিমেষ দেখল দুটি ছেলে পাশাপাশি শেষ বেঞ্চিতে বসে একটা খাতা থেকে খুব দ্রুত টুকে যাচ্ছে। ও মোহন সিরিজের দিকে তাকাল, ভদ্রলোক টানটান হয়ে আছেন। ভীষণ রাগ হয়ে গেল অনিমেষের, দ্রুত শেষ বেঞ্চিতে গিয়ে চট করে খাতাটা কেড়ে নিল। আচমকা খাতাটা উঠে যাওয়াতে ছেলে দুটি হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে একজন দ্রুত নিজেকে সামলে বলল, শেষ লাইনটা বলে দাও শুরু। কথাটা বলার মধ্যে এমন একটা রোয়ারি ছিল, অনিমেষ থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ওকে মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি বলল, কেন ওরকম করছ, আরে আমাকে চিনতে পারছ না? কংস অফিসে দেখা হয়েছিল, মনে নেই। আমরা ভাই-বেরাদার।

এমন সময় পেছন থেকে একটা চিৎকার কানে এল, অ্যাই, হোয়াট আর ইউ ড়ুয়িং দেয়ার? কী নাম তোমার, নম্বর কত? মোহন সিরিজ বইটাকে এক আঙুলে চিহ্নিত করে দ্রুত ছুটে এসে অনিমেষের সামনে দাঁড়ালেন, অ্যাই, তোমার সিট কোথায়?

ভীষণ নার্ভাস হয়ে অনিমেষ বলল, সামনের দিকে।

তা এখানে কী করছ? নকলবাজি। আমার ক্লাসে সেসব একদম চলবে না। কোন স্কুল তোমার, নম্বর কত বলো? তর্জনী তুলে গর্জন করলেন জ্বলোক।

আমার খাতা এরা নিয়ে এসেছিল—আমি কিছু জানি না। অনিমেষ কোনোরকম বলল। একটা ভয় আচমকা ওকে ঘিরে রল এইবার। এই ভদ্রলোক যদি রেগেমেগে ওরেক ক্লাস থেকে বের করে দেন, অথবা ওর নামে নালিশ করেন, তা হলে চিরকালের জন্য ও ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেল। নির্ঘাত ফেল করিয়ে দেবে ওকে।

খাতা নিয়ে এসেছিল আর আমি দেখলাম না, ইয়ার্কি। কে এনেছিল? ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলেন।

এই সময় সেই এসেছিল আর আমি দেখলাম না, ইয়ার্কি! কে এনেছিল? ভদ্রলোক ফুঁসে উঠলেন।

এই সময় সেই কংগ্রেস অফিসের ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, আমি স্যার, এই টেবিলের পাশে কাতাটাকে উড়ে আসতে দেখে তুলে রাখলাম। যা বাতাস চারধারে।

বাতাস বাতাস কোথায়? ফ্যান তো বন্ধ। আর উড়ে এল যখন তখন আমায় বললে না কেন? আর উড়ল কেন? তুমি কোথায় ছিলে?

ভদ্রলোক কী করবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। অনিমেষ ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার কথা মনে। কী চমৎকার মিথ্যে কথা বলে ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ওর মনে হল এই মুহূর্তে ছেলেটার কথায় সায় না দিলে বাঁচাবার উপায় নেই। ও বলল, বাথরুমে গিয়েছিলাম আমি। সেসময়

কী খাও যে এত ঘনঘন বাথরুম পায়। কিন্তু আমাকে বলনি কেন?

গার্ড আবার ছেলেটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। হাসি চেপে ছেলেটি বল, স্যার, আপনার রমার বোধহয় খুব বিপদ তাই ডিস্টার্ব করতে চাইনি।

হকচকিয়ে গেলেন:ভদ্রলোক, আঁ, আমার মা? ওঃ হ্যা; তা বটে। ঠিক আছে, যে যার সিটে ফিরে যাও। আমার ঘরে কোনো আনফেয়ার ব্যাপার চলবে না।1.

যেমন এসেছিলেন তেমনি দ্রুত ফিরে গেলেন ভদ্রলোক। অমিমেষ নিজের সিটে যাবার জন্য সময় ছেলেটি আবার ডাকল, কই, লাস্ট লাইনটা হোক, আফটার অল আমরা এক পার্টির লোক।

অগত্যা অনিমেষকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের খাতা থেকে এক নম্বর প্রশ্নটার শেষ লাইনটা ফিসফিস করে পড়ে যেতে হল।

 

সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরছিল। এটা ঠিক সেই উত্তরবঙ্গীয় বৃষ্টি, যা কিনা এঁটুলির মতো দিনরাতের গায়ে সেঁটে বসে থাকে। রাত্তিরবেলায় ঝমঝমিয়ে আকাশ ভেঙে পড়ে, আবার সকালবেলায় ছিচকাঁদুনে মেয়ের মতো সুচ বেঁধায়। জেলা স্কুলের লম্বা ঢাকা-বারান্দায় অনিমেষরা সেই সকাল থেকে গুলতানি মারছিল। খবর আছে আজ রেজাল্ট বের হবে।

অবশ্য এরকম গত কয়েক দিন ধরে রোজই আসছে। হঠাৎ কেউ বলল, রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে-হোট ঘোট স্কুলে-কোথায় কী! গতকাল রেডিওতে নাকি বলেছে এ-বছর পার্সেন্টেজ খারাপ নয়। আবার আজ সকালে হেডমাস্টার মশায় এসে বললেন, দারুণ খবর আছে তার কাছে, মার্কশিট না এলে তিনি কিছু বলবেন না।

কদিন থেকে উত্তেজনাটা বুকের মধ্যে দলা পাকাচ্ছিল-যদি খারাপ হয় তা হলে কী হবে?

সরিৎশেখর গতকাল রেডিওতে কলকাতায় ফল বেরিয়ে গেছে শুনে আর ঘুমুতে পারেননি। সারারাত ছটফট করেছেন। ভোরবেলায় উঠেই অনিমেষকে বলেছেন, রেজাল্ট বের হলে অবশ্যই যেন সে বাড়িতে চলে আসে। আজকে তার বেড়াতে যাওয়া হল না। হেমলতা ভোরবেলায় বাবার হাঁকডাকে উঠে পড়ে একশো আটবার জয় নাম লিখে একমনে জয়গুরু বলে যাচ্ছেন। অনিমেষ যখন বেরুচ্ছে তখন একটা কাগজ ভাঁজ করে তার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। অনিমেষ গেট খুলে বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে একবার পেছন ফিরে দেখল দাদু আর পিসিমা বাইরের বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। দাদুর দুই হাত জোড় করে বুকের ওপর রাখা, পিসিমার ঠোঁট দুটো নড়ছে।

হাত-পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল ওর। চুপচাপ করে একা বাঁধের ওপর দিয়ে জেলা স্কুলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওর মনে সেই ভয়টা চট করে ফিরে এল। যদি সেই গার্ড ভদ্রলোক মুখে কিছু না বলে চুপিচুপি ওর নামে রিপোর্ট করে দেন তা হলে কী হবে! আর-এ হয়ে গেলে সে এই বাড়িতে ফিরে আসবে কী করে? অনিমেষ মনেমনে ঠিক করল, যদি সেইরকম হয় তা হলে সে ওই ভদ্রলোককে ছেড়ে দেবে না, তার জন্য যদি তাকে জেলে যেতে হয় তো তা-ই হোক। জেলে যাবার কথা মনে হতেই শনিবাবার ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়ে গেল ওর। যাঃ, আঠারো বছর হতে ওর তো এখনও দুই বছর বাকি আছে। কিন্তু ভয়টা কিছুতেই ওকে ছেড়ে যাচ্ছিল না, অস্বস্তিতা থেকেই গেল।

মুখচোখ সবারই শুকনো। ফিনফিনে বৃষ্টির জলে সবারই জামাকাপড় সঁতসেঁতে। বেরুবার আগে পিসিমা ছাতির কথা বলেছিলেন, ছাতি নিয়ে বের হলে বন্ধুরা খ্যাপায়-একথাটা পিসিমাকে বলে-বলে বোঝাতে পারে না সে। সকাল নটা বেজে গেল, এমনও মার্কশিট এল না। তপন বলল, আচ্ছ খেলাচ্ছে মাইরি, ভাল্লাগে না! যা করবি করে ফ্যাল!

অর্ক সিগারেট ধরাল। এই প্রথম স্কুল-কম্পাউন্ডে বসে অনিমেষ কাউকে সিগারেট খেতে দেখল। তপন বলল, অ্যাই অর্ক, কী হচ্ছে

অর্ক কেয়ার করল না, বেশ করছি, খাবার জিনিস খাচ্ছি। পারলে হেড়ুকে বল আমায় রাস্টিকেট করতে।

সেটা আর সম্ভব নয় এখন এই মুহূর্তে, সবাই মেনে নিল। জেলা স্কুলের কারওর ওদের ওপর কর্তৃত্ব এখন বুক ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে ও যেভাবে রিং বানাতে লাগল তাতে বোঝাই যায় ও এব্যাপারে বেশ পোক্ত। এই সময় নিশীথবাবু স্কুলে এলেন। ওদের সামনে দিয়ে যেতে-যেতে অনিমেষকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন, তোমাদের রেজাল্ট এসে গেছে। একটু পরেই স্কুলে এসে যাবে। অনিমেষকে মাথা নিচু করতে দেখে বললেন, কী, খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছ মনে হচ্ছে। কষ্ট করে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। এমন সময় উনি বোধহয় অর্ককে দেখতে পেলেন। অর্ক সেইরকম ভঙ্গিতে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে, নিশীথবাবুকে দেখে একটু সঙ্কোচ করছে না। চলে যাওয়ার আগে তিনি একটু হেসে বলরেন, আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না?

অনিমেষ দেখল, অর্কের মুখটা হঠাৎ কেমন হয়ে গেল। নিশীথবাবু চলে যাওয়ার পর ওর হাতেই সিগারেট জ্বলে-জ্বলে ছোট হয়ে যেতে লাগল। মুখে কিছু না বললেও আর যেন টানতে পারছিল না। আবার কী আশ্চর্য, সিগারেটটা ফেলে দিতেও ওর যেন কোথায় আটকাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত ওদের চোখের সামনে দিয়ে একজন স্যার রেজাল্টের কাগজপত্র নিয়ে হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরে ঢুকে গেলেন। দমবন্ধ উত্তেজনায় সবাই ছটফট করছে। স্কুলের টেকা দারোয়ান অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে, সে কাউকে ভেতরে যেতে দেবে না! ওদের পুরো ১টা হেডমাস্টারমশাইর ঘরে সামন দাঁড়িয়ে অথচ কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। এই সময় আনিমেষ লক্ষ করল, ওর হাতের তেলোয় চটচটে ঘাম জমছে-অদ্ভুত দুর্বল লাগছে শরীরটা। এর মধ্যে একজন স্যার এসে বলে গেলেন ওদের রেজাল্ট নাকি ভালো হয়েছে, মার্কশিট দেখে প্রত্যেকের ফলাফল। নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে-সেটাই একটু বাদে নোটিসবোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। মণ্টু, অনিমেষ এবং তপন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। মণ্টু বলল, লাস্ট ডে ইন স্কুল!

তপন ঘাড় নাড়ল, যদি শালা গাড্ডা মারি-অহঙ্কার করলে উলটোটা হয়। আর এই সময় বৃষ্টিটা নামল আর-একটু জোরে। ছাট আসছিল বারান্দায়-ওরা সরে সরে নিজেদের বাঁচাচ্ছিল। তপন আবার কথা জুড়ল, আমাদের কার দুঃখে আকাশ কাঁদছে কে জানে! শুনেছি অমঙ্গল কিছু এলে প্রকৃতি জানিয়ে দেয়।

তারপর দরজা খুলে গেল হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরের। তিনি বাইরে এলেন। এখন বর্ষাকাল, তবু তিনি গলাবন্ধ সাদা অংকোট পরেছেন। ওঁর পেছনে ভূগোল-স্যার। তার হাতে একটা বিরাট কাজ ভাজ করা। নোটিসবোর্ডের দিকে ওদের এগিয়ে যেতে সবাই নীরবে পথ করে দিল। সেখানে। হেডমাস্টার ঘুরে দাঁড়ালেন। সামনে দাঁড়ানো উদগ্রীব মুখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে তিনি যেন। সামান্য কাঁপতে লাগলেন, এইমাত্র তোমাদের ফলাফল এসেছে-এ খবর তোমরা নিশ্চয়ই পেয়েছ। আজ আমার, আমাদের স্কুলের সবচেয়ে আনন্দের দিন। তোমরা জান, এ-বছর আমি রিটায়ার করব-যাবার আগে আমি যে-গৌরবের মুকুট তোমাদের কাছ থেকে পেলাম তা চিরকাল মনে থাকবে। আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি, এই সময় তার কণ্ঠস্বর চড়ায় উঠে কাঁপতে লাগল, আমার স্কুলের কেউ অকৃতকার্য হয়নি। তোমরা আমার মুখ উজ্জ্বল করেছ। সঙ্গে সঙ্গে যেন পাথরচাপা একরাশ নিশ্বাস আনন্দের অভিব্যক্তি হয়ে প্রচণ্ড আওয়াজে ছড়িয়ে পড়ল। হেডমাস্টারমশাই দুহাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বললেন। শব্দ একটু ম্রিয়মাণ হলে তিনি বাঁহাতে গলার বোতামটা ঠিক করতে করতে বললেন, এ ছাড়া আর-একটি খবর আছে। আমাদের স্কুল থেকে একজন এই বছর স্কুল ফাইনালে দ্বিতীয় হয়েছে-এই জেলা থেকে আজ অবধি কেউ সে-সম্মান পায়নি।

খবরটা সবাই শুনে থ হয়ে গেল। স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। এর আগে এফ ডি আই থেকে একজন নিচের দিকে স্ট্যান্ড করতেই শহরের হইচই পড়ে গিয়েছিল। কে সেই ছেলে? অরূপ? টেস্টে ওর রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো ছিল। এই সময় হেডমাস্টারমশাই গলা তুলে ডাকলেন, অর্ক-অর্ক আছ এখানে?

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা পেছনে দাঁড়ানো অর্ককে জড়িয়ে ধরল হইচই করে। হেডমাস্টারমশাই দেখলেন এই মুহূর্তে ওকে আলাদা করা অসম্ভব। তিনি একজনকে বলে গেলেন, অর্ক যেন যাবার সময় দেখা করে যায়।

ভূগোল-সার ততক্ষণে নোটিসবোর্ডে কাগজটা টাঙিয়ে দিয়েছেন। সবাই সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে একমাত্র অর্ক ছাড়া। সবাই একসঙ্গে নিজের রেজাল্ট দেখতে চায়। অনিমেষ কিছুতেই ভিড় ঠেলে এগাতে পারছিল না। ও দেখল অর্ক দূরে দাঁড়িয়ে মেজাজে নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাজ্জব হয়ে গেল অনিমেষ, এই মুহূর্তে কেউ সিগারেট খেতে পারে! ভিড়টার দিকে তাকাল সে–যদি থার্ড ডিভিশন হয়ে যায়-আর-এ হয়নি বোঝা যাচ্ছে, হলে হেডমাস্টারমশাই নিশ্চয় বলতেন। আর পারল না অনিমেষ অপেক্ষা করতে, ভিড়ের একটা দিক সামান্য ফাঁক হতেই সে ঢুকে পড়ল সেইখান দিয়ে। তারপর ঠেলেঠলে একেবারে নোটিসবোর্ডের। ছয় ইঞ্চির মধ্যে ওর চোখ চলে এল। প্রথমে সার-ওদওয়া পিঁপড়ের মতো নামগুলো চোখে ভাসল। সহ্য হয়ে এলে ও প্রথম থেকে নামগুলো পড়তে লাগল। অরূপ ফার্স্ট ডিভিশন-একটা দাড়ি, অর্ক একটা দাড়ি, তারপর দুটো দাঁড়ি-দুটো-দুটো-একটা-দুটো-নিজের নাম চোখে আসতেই দৃষ্টিটা পিছনে ডানদিকে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে ওপরে তুলে ধরে চিৎকার করে উঠল। নোটিসবোর্ডের ওপরে মাথা উঠে যাওয়ায় নিজের নামের পাশে এক দাড়িকে বিরাট লম্বা দেখল সে।

সমস্ত শরীরে লক্ষ কদমফুলের নন-তপনের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সময় নিল অনিমেষ। তপন সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে। এবং মণ্টু ফার্স্ট ডিভিশন। বারোজন ফাস্ট ডিভিশন, আঠারোজন সেকেন্ড, বাকিরা থার্ড ভিশিন। মন্ট এগিয়ে এসে সাহেবি কায়দায় গম্ভীরমুখে ওর সঙ্গে যাডশেক করল। তপনের কোনো আপসোস নেই-ও জানত দ্বিতীয় ডিভিশনই ওর বরাদ্দ। ওরা বেশ দৃঢ়পায়ে বাইরে হেঁটে এসে অর্ককে খুঁজল-না, অর্ক কোথাও নেই। হেডমাস্টারমশাই-এর ঘরেও যায়নি।

তপন বলল, আমরা এখন কলেজ স্টুডেন্ট-আঃ, ফাইন!

মণ্টু বলল, মাইরি, শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে গেলাম। ভাবাই যায় না! শালা আজ যদি রম্ভারা এখানে থাকত তো ট্যারা হয়ে যেত।

অনিমেষ কিছু বলল না। স্কুল থেকে বের হবার আগে সে একবার নিশীথাবু সঙ্গে দেখা করে যাবে কি না ভাবল। কিন্তু মণ্টুরা বেরিয়ে যাচ্ছে-এবং সঙ্গে সঙ্গে কুষ্ঠরোগীদের ডেরাটার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ও শক্ত হয়ে গেল।

বাইরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে। একটুও তোয়াক্কা না করে ওরা রাস্তায় নেমে পড়ল। মণ্টু বলল, চল গার্লস স্কুলটা দেখে আসি-ওখানে ফেলু মেয়েরা আজ হেভি কাঁদবে।

এখন এই বৃষ্টিতে হাঁটতে অনিমেষের ভীষন ভালো লাগছিল। ও একবার ভাবল, দাদুকে একছুটে বলে আসে খবরটা, কিন্তু বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা চেপে গেল। আজ বাংলাদেশে ও একাই শুধু স্কুল ফাইনাশ পাম করেনি। বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে ওরা শহরটাকে ভিজতে দেখল। শহরের লোকরাও বিভিন্ন ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে তিনটি কাকভিজে তরুণের ব্যাপার দেখে অবাক হল। গার্লস স্কুলের দিকে যেতে-যেতে তপন হঠাৎ গান ধরল, এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা হাতে হাতে ধর গো/আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন-স্বর্গ।

ও এক লাইন গাইছে, অনিমেষ আর মণ্টু পরের লাইনটা আবৃত্তি করছে। এই বৃষ্টির জল গায়ে মুখে মেখে গান গাইতে গাইতে ওরা ঝোলানো পুলের ওপর এসে দাঁড়াল। অনিমেষদের সুরের ঠিক নেই, কিন্তু একটা খুশির জোয়ার বুরকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। এক ভদ্রলোক ছাতি-মাখায় আসছিলেন, মন্টর চেনা-হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী, রেজাল্ট বেরিয়েছে। পাশ করেছ মনে হচ্ছে? গাইতে গাইতে ঘাড় নাড়ল মণ্টু, মুখে জবাব দিল না।

গার্লস স্কুলের কাছে এসে গানট থেমে গেল। আর তখনই ওরা একটা মেয়েকে দেখতে পেল। বৃষ্টির মধ্যে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। ওরা দেখল মেয়েটার মুখ কান্নায় মুচড়ে গেছে। সামলাতে পারছে না বেচারা। ওদের তিনজনেরই মন-খারাপ হয়ে গেল আচমকা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখতে-দেখতে মণ্টু বলল, চল বাড়ি যাই। যেন এই কথাটার জন্যই ওরা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। তিনজনেই তিনদিকে কোনো কথা না বলে দৌড়তে লাগল।

বাড়ির গেটে হাত দিতেই অনিমেষ দেখল পিসিমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায় যেন সে চলে যাওয়ার পর থেকে একচুরও নড়েননি। দাদুকে দেখতে পেল না সে। পিসিমা ওকে দেখেছেন, তার চোখ দুটো অনিমেষের মুখের ওপর। পায়েপায়ে কাছে এগিয়ে গেল অনিমেষ। হেমলতা ভাইপোর। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। অনিমেষ ইচ্ছে করে চুপ করে ছিল। ওর বেশ মজা লাগছিল পিসিমার অবস্থা দেখে। কী বলবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে হেমলতাকে প্রণাম করল, আমি পাশ করেছি, ফার্স্ট ডিভিশন হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলেন হেমলতা। অনিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন, আতিশয্যে চিৎকারটা কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। অনিমেষ দেখল পিসমার মুখ ওর বুকের ওপর-ও অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। কান্না-মেশানো গলায় হেমলতা তখন বলছিলেন, অনিবাবা, তুই পাশ করেছিস-ও। মাধু দ্যাখ-তোর অনি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে-মাধু চোখ-ভরে দ্যাখ।

মায়ের নাম শুনে থরথর করে কাঁপতে লাগল অনিমেষ। এই সময় জুতোর শব্দ তুলে সরিৎশেখর দরজায় এসে পঁাড়ালেন। অনিমেষ তখনও হেমলতার দুহাতের বাঁধনে আটকে! সরিৎশেখর গম্ভীরমুকে নাতিকে দেখলেন, তারপর বললেন, আশা করি ফার্স্ট ডিভিশন হয়েছে

বাবার গলা শুনে হেমলতা অনিকে ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ-আপনার নাতি মুখ রেখেছে-আপনি মাধুকে কথা দিয়েছিলেন।

নিজের শরীরটাকে যেন অনেক কষ্টে সামলে নিলে সরিৎশেখর, কথা তো সবাই দিতে পারে, রাখে কয়জন! এই আনন্দের খবরের জন্য এতকাল বেঁচে আছি, হেম।

অনিমেষ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দাদুকে প্রণাম করল। সরিৎশেখরের হাতটা ওর মাথার ওপর এলে অনিমেষ অনুভব করল দাদুর শরীর কাঁপছে। বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলছেন। অনিমেষ উঠে দাঁড়ালে সরিৎশেখর গম্ভীর গলায় বললেন, কিন্তু এতে আমি সন্তুষ্ট নই অনিমেষ, তোমাকে আরও বড় হতে হবে-আমি ততদিন বেঁচে থাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *