০৪. সরিৎশেখর আজ সকালে শিলিগুড়ি গিয়েছেন

সরিৎশেখর আজ সকালে শিলিগুড়ি গিয়েছেন। ওঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত পাগলঝোড়া টি এস্টেটের রিটায়ার্ড হেডক্লার্ক তেজেন বিশ্বাসের গৃহপ্রবেশ আজ। সরিৎশেখরের যাবার ইচ্ছে ছিল না বড়-একটা, গেলেই খরচ। ইদানীং টাকা পয়সার ব্যাপারে আগের মতন দরাজ হতে পারেন না তিনি। পেনশনের টাকা, সামান্য শেয়ার ভিডিডেন্ড আর মহীতোষের পাঠানো অনির নামে কিছু টাকা-এর মধ্যেই তাকে ম্যানেজ করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে এখন একটা আধুলি তার কাছে একটা টাকার মতোই মূল্যবান। তাই তেজের বিশ্বাস যখন এসে হাতজোড় করে যাবার জন্য অনুরোধ করল তখন সরিৎশেখর ব্রিত হয়ে পড়েছিলেন। এখন প্রতিদিন তাকে হিসাব করে চলতে হয়। ব্যাংকে বেশকিছু টাকা তিনি একসময়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সে-টাকার কথা চিন্তা করতে গেলে নিজেকে কেমন ছোট মনে হয়। তা তেজেন বিশ্বাসের বাড়িতে হেমলতা প্রায় জোর করে পাঠালেন বাবাকে। এই একঘেয়ে জীবনের বাইরে একটু ঘুরে আসা হবে, মনটা ভালো থাকবে। সেজেগুঁজে আজ সকাল নটার ট্রেনে শিলিগুড়ি চলে গেলেন সরিৎশেখর, সন্ধের ট্রেনে ফিরে আসবেন অবশ্যই।

আজ স্কুল ছুটি। দাদু চলে যাওয়ার পর অনি পড়ছিল নিজের ঘরে। শীত চলে গেছে, স্কুলে পড়াশুনা এখন জোর কদমে চলছে। এমন সময় বাইরে দরজায় খুব জোর কড়া নড়ে উঠল। বই রেখে ঘরে বাইরে এসে অনি দেখল পিসিমা রান্নাঘরে রয়েছেন, কড়া নাড়ার শব্দ বোধহয় কানে যায়নি। ইদানীং হেমলতা কানে একটু কম শুনছেন। কড়াটা আর-একবার শব্দ করে উঠতেই অনি.দৌড়ে এসে দরজা খুলল।

মাঝবয়সি একজন মহিলা, মাথায় অনেকখানি ঘোমটা দেওয়া, অথচ ঘোমটা দেওয়ার ধরন থেকে বোঝা যায় অনভ্যস্ত হাতে দেওয়া, একটি বছর দুয়েকের বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অনিকে দেখামাত্র মহিলা হাসলেন, তারপর বললেন, তুমি নিশ্চয়ই অনি, না? অনি দেখল হাসবার সময় মহিলার কালো মাড়ি বেরিয়ে পড়ে। কেমন একট বিচ্ছিরি সেন্ট না পাউডারের গন্ধ ওঁর শরীর থেকে আসছে। অনি ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা বাচ্চাটাকে বললেন, প্রণাম করো, প্রণাম করো, তোমার দাদা হয়। বলামাত্র দম-দেওয়া পুতুলের মতো বাটি হেট হয় হাত বাড়িয়ে ওর পায়ের মাটি ছুঁয়ে মাথায় বোলাল। অনি চমকে উঠে সরে দাঁড়াতে গিয়েও সুযোগ পেল না। আজ অবধি কেউ তাকে প্রণাম করেনি, এতকাল ও-ই সবাইকে প্রণাম করে এসেছে। ওর মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছিল। এই সময় বাচ্চাটা আধো-আধো গলায় বলে উঠল, জল খাব।

মহিলা বললেন, খাবে বাবা, একটু দাঁড়াও। দাদা তোমাকে জল খাওয়াবে, দুধ খাওয়াবে, সন্দেশ খাওয়াবে, তা-ই না?

অনি হতভম্ব হয়েজিজআসা করল, আপনি কে?

আমি? মহিলা আবার হাসবার চেষ্টা করলেন, চিনতে পারছ না তো! আচ্ছা আগে বলল, বাড়িতে এখন কে আছেন?

আমি আর পিসিমা।

দাদু কোথায় গেছেন, বাজারে।

না। দাদু আজ শিলিগুড়িতে গিয়েছেন।

ও, তা-ই নাকি! বলে মহিলা ঘুরে দাঁড়ালেন গেটের দিকে। সেখানে কেউ নেই, কিন্তু মহিলা গলা তুলে ডাকলেন, চলে এসো, তোমার বাবা বাড়িতে নেই। অনি অবাক হয়ে দেখল গেটের একপাশে ইলেকট্রিক পোস্টের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এদিকে আসছে। তার মুখচোখ কেমন বসা-বসা, গায়ের শার্ট খুব ময়লা আর পাজামার নিচের দিকটায় অনেকটা ফাটা। কাছাকাছি হতে অনির মনে হল একে সে চেনে, থুতনির কাছে অতখানি দাড়ি ঝোলা সত্বেও ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে। ও চকিতে মহিলার দিকে তাকাল। এতক্ষণ যেটা লক্ষ করেনি সেটা দেখতে পেয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। মহিলার শাড়িটা বোধহয় ঠিক আস্ত নেই আর বাচ্চার জুতোর ডগা ফেটে পায়ের আঙুল বেরিয়ে এসেছে। ঠিক এই সময় লোকটি কাছাকাছি হয়ে মোটা গলায় বলল, আমাদের অনির দেখি স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়েছে। কথাটা শোনামাত্র অনি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। কয়েক লাফে সমস্ত বাড়িটা ডিঙিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। হেমলতা তখন মাটিতে বাটি নিয়ে বসে তরকারি কুটছিলেন। ছেলেটাকে হনুমানের মতো দুপদাপ করে আসতে দেখে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই অনি তার কানের কাছে গরম নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, জ্যাঠামশাই এসেছে।

অল্পের জন্যে বাটিতে আঙুলটা দুটুকরো হল না, হেমলতা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসেছে।

জ্যাঠামশাই, সঙ্গে একজন বউ আর এইটুকুনি একটা বাচ্চা ছেলে।

কথাটা বলতে বলতে অনি দেখল পিসিমা সোজা হয়ে বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এমন গলায় হেমলতা বললেন, পরিতোষ এসেছে তুই চিনতে পারলি? কিন্তু ও তো বিয়ে-থা করেনি-যাঃ, তুই ভুল দেখেছিস!

হেমলতা উঠতে যাচ্ছেন এমন সময় হাঁকটা ভেসে এল রান্নাঘরে, ও দিদি, কোথায় গেলে! দ্যাখো কাদের এনেছি।

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বস্ত্রহাতের মতো বললেন, পরিই তো৷ কিন্তু এখন আমি কি করব এখন?

আরে তোমাকে ডাকতে ডাকতে গলা ধরে এল, আর তুমি এখানে বসে আছ, বাইরে এসো, প্রণাম করি। অনি দেখল জ্যাঠামশাই রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। :

হেমলতা ভাইয়ের দিকে তাকালেন। এত বিচ্ছিরি চেহারা হয়েছে যে চট করে চেনা মুশকিল। এই ভাই তার বড় ভাই, এককালে সেই ছেলেবেলায় ওঁর কত আদরের ছিল-হঠাৎ বুকের ভিতরটা কেমন নড়েচড়ে উঠতেই কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলেন হেমলতা। বাবা ওকে ত্যজপুত্র করেছেন, এ-বাড়িতে ওর প্রবেশাধিকার নেই। এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হল।

যেন হেমলতা কী চিন্তা করছেন টের পেয়ে গেল পরিতোষ, কিছু কোরো না, তোমাদের ফাদার ফেরার আগেই কেটে পড়ব।

এতক্ষণে হেমলতা যেন সাড়া পেলেন, শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এলি?

তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, তা ছাড়া-একটু থেমে অনির দিকে তাকাল পরিতোষ, অনেকদিন বউ-বাচ্চারা পেটভরে খায়নি। অবশ্য তোমাদের ফাদার বাড়ি থাকলে আমি ঢুকতাম না। বউটা শালা কিছুতেই শুনতে চায় না, একবার শ্বশুরবাড়ি আসবেই, বাঙাল তো, গো ভীষণ।

বাঙাল? বাঙালের মেয়ে বিয়ে করেছিস তুই?

বিয়ে করিনি। করতে বাধ্য হয়েছি। আমার একটা বাচ্চা ছেলে আছে, তাকে তুমি দেখবে না?

হেমলতা উঠে দাঁড়ালেন। বাবাকে তিনি চেনেন। আজ অবধি ভুলেও একবার বড় ছেলের নাম করেননি কখনো। বরং প্রিয়তোষের খোঁজখবর গোপনে নেবার চেষ্টা করছেন তিনি-হেমলতা সেটা বুঝতে পারেন। পরিতোষ তার কাছে মৃত। এই অবস্থায় হেমলতার কী করা উচিত? ভাইকে থাকতে বলা মানে বাবাকে অসম্মান করা নয়? আর সবার মধ্যেই তো তিনি ফিরবেন, তখন অবশ্য সন্ধে হতে অনেক দেরি আছে। হেমলতা দরজার সামনে এলে পরিতোষ ঝুঁকে তাকে প্রণাম করতে যেতেই তিনি চমকে পিছিয়ে দাঁড়ালেন, রাস্তার ময়লা কাপড়ে ছুঁয়ে দিয়ো না, আমার জ্ঞান হয়ে গেছে।

পরিতোষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমার তো আর জামাকাপড় নেই।

হেমলতা বললেন, তা হলে সরে দাঁড়াও, প্রণাম করার প্রয়োজন নেই।

পরিতোষ দিদির কাছ থেকে এই ধরনের কথা আশা করেনি, স্থলিত গলায় সে উচ্চারণ করল, তুমি মাইরি ফাদারের মতোই নিষ্ঠুর।

সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, নিজে যেন সাধুপুরুষ। এক ফোঁটা দয়ামায়া নেই যার সে আবার অন্যকে নিষ্ঠুর বলে!

কথাটা শুনেই পরিতোষ গর্জে উঠল, অ্যাই, চুপ।

চুপ করব কেন? অনেক চুপ করেছি, আর নয়।

কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা উঠোনের দিকে তাকাতেই দেখলেন বারান্দার সিঁড়িতে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটি রোগাটে বউ বসে আছে। বুঝতে পেরেও জিজ্ঞাসা করলেন হেমলতা, এরা কারা?

যেন কিছুই হয়নি এমন গলায় পরিতোষ বলল, ওই তো, তোমার ভাই বউ আর ভাইপো। দিদিকে আবার প্রণাম করতে যেও না, রাস্তার কাপড়ে আছ।

এমন ভান কর যেন বুদ্ধিতে বৃহস্পতি। মুখ নেড়ে পরিতোষকে কথাটা বলল মহিলা, তারপর হঠাৎ গলার স্বর বদলে গেল তার। বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে হেমলতার দিকে এগিয়ে এসে প্রায় কেঁদে ফেলল, মুখে বড় বড় কথা বলত লোকটা, তাই শুনে ভুলে গেলাম। বিয়ের পর একদিনও পেটভরে খেতে পাইনি, বুকের দুধ শুকিয়ে যাবার পর একে আর দুধ দিতে পারিনি। দিদি, আমি ওকে জোর করে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে, আপনিও তো মেয়ে, আমাকে ক্ষমা করবেন না।

হেমলতার পেছনে পেছনে অনি বেরিয়ে এসেছিল। হঠাৎ পরিতোষ যেন তা আবিষ্কার করে বলে উঠল, ইে ছেলেটা, তুমি এখানে কী কাছা যাও, বড়দের কথার মধ্যে থাকতে নেই। তারপর চাপা গলায় বলল, ফাদারের পেয়ারের নাতি তো, এলেই সব রিপোর্ট করবে। …  …।

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন হেমলতা, পরি, তুই-তুই একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছিস। ছি ছি ছি। সারাটা জীবন বাবাকে জ্বালিয়ে এলি, নিজের এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই, আবার এই মেয়েটাকে বিয়ে করে কষ্ট দিচ্ছিস, ছি!

হাসল পরিতোষ, বিয়ে আমি করিনি, আমাকে করেছে।

মহিলা এই সময় ড়ুকরে কেঁদে উঠতে হেমলতা বিচলিত হয়ে উঠোনে নেমে এলেন। জ্যাঠামশাইয়ের ধমক খেয়ে অনি কী করবে বুঝতে পারছিল না। লোকটা খারাপ, খুবই খারাপ। তাদের বাড়িতে কেউ এভাবে কথা বলেনা।ও দেখল বাচ্চাটা টলতে টলতে হেঁটে উঠোন পেরিয়ে বকফুলের গাছের দিকে চলে যাচ্ছে-মোদিকে কারও নজর নেই। জ্যাঠামশাইয়ের শরীরের পাশ কাটিয়ে ও নিচে নেমে বাচ্চাটাকে ধরতে গেল। বেচারা এত নিজবি যে সামান্য হেঁটে আর দাঁড়াতে পারছিল না, অনিকে পেয়ে ওর হাঁটু জড়িয়ে ধরল। পরিতোষ সেটা লক্ষ করে বলল, বাঃ, দুই ভাইয়ে দেখছ বেশ ভাব হয়েছে।

মহিলা তখনও কাঁদছিল। হেমলতা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বয়েস বেশি নয়, কিন্তু অসব পোড়-খাওয়া-দেখলেই বোঝা যায়। ভালো খেতে না পেয়ে শরীর ক্ষয়টে হয়ে গেছে। এ-বাড়ির বউ হবার কোনো গুণ চেহারায় নেই। মাধুরী বা নূতন বউয়ের চেহারা দেখলে মনটা যে মিতায় ভরে যায় এই মেয়েটির মধ্যে তার বিন্দুমাত্র ছায়া নেই।

হেমলতা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

যেন বেরিয়ে-আস-কান্নাটা গিলছে এমন গলায় উত্তর এল, সাবিত্রী।

তোমার বাবা কি বিয়ে দেবার আগে খোঁজখবর নেননি? কাটাকাটাভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন হেমলতা। উঠোনের এক কোণে বাচ্চাটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে অনি অন্যদিকে তাকিয়ে পিসিমার কথা শুনছিল। এতদিনের দেখা পিসিমার সঙ্গে এই পিসিমাকে ও কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। হঠাৎ ওর মনে হল, পিসিমার গলা দিয়ে যেন দাদু কথা বলছেন।

আমার বাবা নেই, যশোরে দাঙ্গার সময় মারা যায়। বিয়ের পর আমরা জানতে পারলাম না ত্যজ্যপুত্র। সাবিত্রী বলল।

বাঃ, বিয়ের আগে ছেলের বাড়িঘর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন বোধ করলে না কেউ! চমৎকার! হেমলতা হিসাব মেলাতে পারছিলেন না।

পরিতোষ হাস, তখন আর উপায় ছিল না যে! আমাকেও কেটে পড়তে দিল না, রাতারাতি জোর করে বিয়ে দিল। নইলে আমাদের বংশে-

চুপ কর! তোর মুখে বংশ কথাটা একদম মানায় না। যাক, বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন এসেছ তখন এমনি চলে যেতে বলছি না। সন্ধেবেলায় বাবা আসার আগেই বিদায় হয়ো। আর তার অনুমতি না পেলে এই বাড়িতে কখনোই এসো না-মনে থাকে যেন। হনহন করে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। হেমলতা।

পিসিমা চোখের আড়াল হওয়ামাত্র অনি জ্যাঠামশাইকে মাথার উপর দুহাত তুলে একটা নাচের ভঙ্গি করতে দেখল। জেঠিমার কান্না চট করে থেমে গিয়ে কালো কালো দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। বড় বড় পা ফেলে জ্যাঠামশাই জেঠিমার কাছে নেমে এসে চাপা গলায় বললেন, দারুণ হয়েছে। তুমি মাইরি জব্বর অ্যাক্টিং করলে সাবু। বউদি একদম আউট। …..

জেঠিমা বললেন, ঝগড়া না বাধালে তোমার দিদি আমার কথা শুনতই না।

জ্যাঠামশাই বললেন, আমি তো ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম তুমি অরিজিনাল ছাড়ছ কিনা!

জেঠিমা বলরেন, পাগল। একটা কথা তো সত্যি বলেছ।

জ্যাঠামশাই বললেন, কী

এই বাড়িটার কথা। এতবড় বাড়ি যার তাকে কি বকা যায়। এমনভাবে হাসলেন জেঠিমা যে অনির খুব খারাপ লাগল।

এটা আমার বাবার বাড়ি-আমার নয়। তাছাড়া আমাকে ত্যজ্যপুত্র করা হয়েছে-নো রাইট এই বাড়িতে। জ্যাঠামশাই উদাস গলায় বললেন। ওঁর চোখ সমস্ত বাড়িটায় ঘুরছিল।

দেখো না, আস্তে-আস্তে সব জল হয়ে যাবে। মানুষের রাগ আমার জানা আছে। কিন্তু শেষবার একটা সত্যি কথা বলো তো, শুধু টাকা চুরি করেছিলে বলে ত্যজ্যপুত্র করেছিল না অন্য কারণ ছিল? জেঠিমার চাপা গলার স্বর কেমন হিসহিসে।

পরিতোষ খুব অস্বস্তির মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ফাইটিং কোরো না, একটু লটঘট করেছিলাম। প্রথম যৌবন তো!

কী বললে বুড়ো ভাম, পাঁচ বছর আগে প্রথম যৌবন ছিল তোমার—

ফুঁসে-ওঠা সাবিত্রীকে হাতজোড় করে থামিয়ে দিল পরিতোষ, নিজেদের মধ্য খেয়োখেয়ি করে শেষ পর্যন্ত লক্ষ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যেতে চাও? আরে পুরুষমানুষের ওরকম একটু আধটু হয়ই, তা নিয়ে কেউ মাথা-খারাপ করে না। তাছাড়া দুজনের ধান্ধাই তো এক।

সাবিত্রী নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেও বোঝাই যায় হজম করতে পারছে না ব্যাপারটা। হঠাৎ ও এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে অনির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল সে, খুব তো চেঁচিয়ে ভেতরের খবর বলছ, ওদিকে ছোঁড়াটা হাঁ করে সব গিলছে। কথাটা শোনামাত্র পরিতোষ ঘাড় ঘুরিয়ে অনিকে দেখতে পেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সাবিত্রী চাপা গলায় তাকে বাধা দিল, খবরদার, বকাবকি করবে না। মিষ্টি কথায় ওকে হাত করে নিতে হবে।

অনি দেখল জেঠিমা ওর দিকে আসছে। বাচ্চাটা তখন থেকে ঠায় ওর হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনি বুঝতে পারছিল ছেড়ে দিলেই ও পড়ে যাবে। জেঠিমা বলরে, কী সুন্দর দেখতে তোমাকে অনি! আহা, মার জন্য খুব কষ্ট হয়, না? সত্য মারে।

অনি জেঠিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল না কী জবাব দেবে। আজ অবধি এ-ধরনের প্রশ্ন তাকে কেউ করেনি। এরা এ-বাড়িতে আসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্র করেছে এটাও বুঝতে পারছিল। ত্যজ্যপুত্র হলেও জ্যাঠামশাই এ-বাড়ির সব খবর রাখে।

বাচ্চাটাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে অনি বলল, একে ধরুন।

সাবিত্রী অবাক হয়ে বাচ্চাটাকে টেনে নিতে দেখল অনি গটগট করে উঠোন পেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। রাগে গা জ্বলে গেল সাবিত্রীর। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পরিতোষের কাছে এসে বসল, দেখলে, ছেলেটার তেল দেখলে? কথাটার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলে না!

পরিতোষ মুখ বেঁকাল, ফাদারের সবকটা ব্যাড ভাইসেস ও পেয়েছে। আচ্ছা করে আড়ং ধোলাই দিতে হয়!

চোখের আড়াল হতেই অনি পা টিপে টিপে বাগানের মধ্যে দিয়ে ফিরে এল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ও রান্নাঘরের ওপর নজর রাখতে লাগল।

বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে জামা খুলতে খুলতে পরিতোষকে বলতে শুনল অনি, ও বড়দি, আজ তোমার হাতের রান্না খাব।

হেমলতা কোনো উত্তর দিলেন না। পরিতোষ কান পেতে উত্তরটা শোনার চেষ্টা করে না পেয়ে যেন খুশি হল। অনি দেখল জ্যাঠামশাই জেঠিমার দিকে একটা চোখ কুঁচকে হাসলেন। জামাটা খুলতেই অনির চোখ বড় হয়ে গেল। জ্যাঠামশাইয়ের গেঞ্জিটা ছিঁড়ে ফেটে একাকার। দু এক জায়গায় সেলাই করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পিসিমা বলেন গেঞ্জি সেলাই করে পরলে লক্ষ্মী চলে যায়। জ্যাঠামশাই কী করে ওটা পরেন।

জ্যাঠামশাই পায়ের ওপর পা দিয়ে বললেন, দিদির রান্না কোনোদিন খাওনি তো, আহা, মাইরি তোমরা রাঁধতে জান না।

জেঠিমা খিঁচিয়ে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, রান্না করার মতো জিনিস কোনোদিন এনেছ যে রাঁধব। শুনলে গা জ্বলে যায়।

হঠাৎ জ্যাঠামশাই বলে উঠলেন, যাও না, দিদিকে একটু সাহায্য করো। একা একা বাঁধছেন, দুই-একটা পদ তৈরি করে নিজের কৃতিত্ব দেখাও।

জেঠিমা হতচকিত হয়ে বোধহয় রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন, এমন সময় পিসিমার গলা ভেসে এলে, কাউকে আসতে হবে না। রাস্তার কাপড়ে এ-বাড়িতে কেউ রান্নাঘরে ঢোকে না। বাথরুমে জল আছে, বাচ্চাটাকে একবারে স্নান করিয়ে দিতে বল। ভদ্রলোকের মতন দেখতে হোক।

কথাটা শুনে জেঠিমার মুখ বেঁকে যেতে দেখল অনি। জ্যাঠামশাই চট করে উঠে দাঁড়ালেন, সেই ভালো, যাও, মন দিয়ে সাবান মেখে স্নান করে নাও। আমি বরংছোঁড়াটার কাছ থেকে লেটেস্ট খবর নিই গে।

জ্যাঠামশাইকে এদিকওদিকে তাকাতে দেখে অনি চুট করে বাগানের ভিতরে চলে গেল। ইদানীং ঝোপঝাড় বেশি হয়ে গেছে বলে সরিৎশেখর লোক লাগিয়ে বাগান সাফ করার কথা বলেন। লোক পাওয়া আজকাল মুশকিল বলেই এখনও পরিষ্কার হয়নি। অনি এই সুযোগটাকে কাজে লাগাল। জ্যাঠামশায়ের মুখোমুখি হতে ওর একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। লোকটাকে অত্যন্ত বদ মনে হচ্ছে ওর।

খেতে বসে অবাক হয়ে গিয়েছিল অনি। একটা লোক এত ভাত খেতে পারে? একসঙ্গে খেতে চায়নি ও, পিসিমা তাগাদা দিয়ে স্নান করিয়ে বসিয়েছেন। বাচ্চাটার খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল। তাকে বড়ঘরের মেঝেতে বিছানা করে ঘুম পাড়িয়ে আসা হয়েছে। পরিতোষ স্নান করে সরিৎশেখরের একখানা ধুতি লুঙ্গির মতন জড়িয়েছে। হেমলতা এতক্ষণ সেটা লক্ষ করেননি। অনির বারংবার তাকানো দেখে বুঝতে পারলেন, তুই বাবার ধুতি পরেছিস?

পরিতোষ খেতে-খেতে বলল, সিম্পল রান্না অথচ কী টেস্ট, আহা! হ্যাঁ, কী বললে? ধূতি? আমার পায়জামার চেহারা দেখেছ তুমি কোনোদিন কম পাজামা আমাকে পরতে দেখেছ। দিস ইজ লাইফ। বুঝলে!

খেয়ে উঠে ধুতি ছেড়ে রাখবি। একেই তোদের ঢুকতে দিয়েছি বলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি, তারপর যদি এসব জানতে পারে–কথাটা শেষ করলেন না হেমলতা।

পরিতোষ দিদির দিকে তাকাল, মাইরি দিদি, এটা কি মুসলমানদের তালাক যে ত্যজ্যপুত্র বললাম আর সমস্ত সম্পর্ক চুকে গেল? তুমি বুকে হাতে দিয়ে বলো তো, আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়লে কষ্ট হয় না?

হেমলতা একবার অনির দিকে তাকিয়ে বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললেন, কিন্তু বাবা বলেন যে দুষ্ট ক্ষত হতে হলে সেটা বাড়তে না দিয়ে যদি হাতটা কেটে ফেলতে হয় তা-ই ভালো, শরীর বাঁচে।

অদ্ভুতভাবে হাসল পরিতোষ। তারপর বলল, আর-একটু ভাত দেবে? কম পড়বে না তো?

হেমলতা ভেতর থেকে ভাত এনে দিতে পরিতোষ বলল, ব্যাপারটা কী জান, তোমরা চিরকাল হাতটা কেটে ফেলার কথাই ভেবেছ, ওষুধ দিয়ে হাতটা সারিয়ে তোলার কোনো চেষ্টাই করনি। তুমি কি ভেবেছ আমি পাষাণ? আমার মনের মধ্যে তোমাদের কথা আসে না? আমরা সব ভুলে যেতে পারি, কিন্তু ছেলেবেলার কথা কি ভুলে যেতে পারি।

হেমলতা বললেন, এসব কথা এখন থাক।

জ্যাঠামশাই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, জেঠিমা বলে উঠলেন, দিদি যখন বলছেন, তখন আর কথা বাড়াচ্ছ কেন?

জেঠিমা স্নান করেছেন, কিন্তু সেই আগের কাপড়ই তার পরনে। কথাটা সঙ্গে সঙ্গে যেন মেনে নিলে জ্যাঠামশাই, ঠিক আছে, থাক। আমাকে আর-একটু আমড়ার টক দাও।

খাওয়াদাওয়ার পর অনি নিজের ঘরে চলে এল। এখন জ্যাঠামশাইকে অনেকটা জানা হয়ে গেছে। মুখ-হাত ধোওয়ার সময় জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যে ওঁরা হলদিবাড়িতে আছেন এখন। দাদু যে-ট্রেনে শিলিগুড়ি থেকে আসবেন তাতেই ওদের উঠতে হবে যদি যেতে হয়। না হলে কাল সকালে। ট্রেন আছে-রাতটা থেকে যেতে হয়। পিসিমা সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, সে-চিন্তা যেন ঘুণাক্ষরে মাথায় না আসে, বিকেলের অনেক আগেই ওদের চলে যেতে হবে।

কথাটা শোনার পর থেকে অনি ভাবছিল স্টেশনে যদি মুখোমুখি দেখা হয় তা হরে দাদু ওদের চিনতে পারবেন কি না। জ্যাঠামশাইয়ের চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, দাড়ি রেখেছেন, তবু দাদু ঠিক চিনে ফেলবেন। কিন্তু তারপর কী হবে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনি এইসব ভাবছে, তখন দরজা খুলে পরিতোষ মাথা বাড়াল, বাঃ, বেশ ঘটা তো! অনি তড়াক করে উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল, পড়াশুনা কেমন হচ্ছে।

কোনোরকমে অনি বলল, ভালো।

খারাপ হবার কথা নয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ বাবা-আমার ছেলেটাকে দেখেছ।

পেট পুরে খাবার দিতেই পারি না তো-পড়াশুনা করাব-সত্মা কেমন চিজ শহরের মেয়ে তো? অনির একটা পেনসিল টেবিল থেকেই তুলে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে জ্যাঠামশাই এমনভাকেকথা বলে যাচ্ছিল যে অনি ঠিক তাল রাখতে পারছিল না।

শেষের কথাটা না ধরে অনি বলল, সত্য।

জ্যাঠামশাই বলল, আরে তোমার বাবা বিয়ে করেনি? আমি শালা চিন্তাই করতে পারি না, এত বড় ছেলে যার সে কী করে বিয়ে করে-তা বাবার এই বউ তোমার সত্য হল না? তুমি কী বলে ডাক?

ছোটমা। কথাগুলো শুনতে অনির খুব খারাপ লাগছিল।

ওই হল, বাচ্চ্য কটালের আর-এক নাম এঁচোড়। দেখতে শুনতে কেমন?

ভালো।

তোমার জেঠিমার চেয়ে ভালো?

কোনোরকমে অনি বলল, জানি না।

কী ফরসা ছিল এককালে, দেখলে মনে হত বেনারসি ল্যাংড়া খাচ্ছি। এখন অবশ্য না খেয়ে খেয়ে আমসত্ত্ব হয়ে গিয়েছে-ছোটকা আসে না

জ্যাঠামশাই কথা শুরু করেন যেভাবে শেষ সেভাবে করেন না। ছোটকা মানে প্রিয়তোষ এটা বুঝতে পারল অনি, না।

শালা এক নম্বরের বৃদ্ধ। বাঙালি হয়ে পলিটিক্স বোঝে না। আরে আখের গোছাতে হবে বলেই যদি দল করবি তবে কংগ্রেস কর! আমার কাছে গিয়েছিল একদিন। তোমার কাছে টাকাপয়সা আছে। জ্যাঠামশাই ওর দিকে ফিরে চাইলেন।

অনি প্রথমে কথাটা ধরতে পারেনি, শেষে দ্রুত ঘাড় নাড়ল না।

ছোটকাকু এখন কোথায়?

জানি না। তোমার জেঠিমার হাতে তেল-মুড়ি কেয়ে হাওয়া হয়ে গেল। বেশিক্ষণ রাখা রিঙ্কি-কে দেখে ফেলবে-ফাদারের কাছ থেকে টাকা নেয় না? এখন তো সব কমিউনিস্টরা দেখি ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করে, পুলিশ কিছু বলে না, ও-শালা তা হরে অন্য কারণে পালিয়েছে, তা-ই না? কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন জ্যাঠামশাই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুবার আড়মোড়া ভেঙে বললেন, জব্বর খাওয়া হয়ে গেছে আজ। অনেক প্রাইভেট কথা বললাম, কাউকে বলিস না ভাই।

উনি ঘর থেকে চলে যাবার পর অনির খেয়াল ল জ্যাঠামশাই ওকে ভাই বললেন। ও হেসে ফেলল, লোকটা যেন কীরকম। আচ্ছা, আখের গোছাতে কি লোকের কংগ্রেস করে? আখের গোছানো মানে তো বড়লোক হওয়া। নতুন স্যার মোটেই বড়লোক নয়। তবে

যাবার সময় হেমলতা প্রায় তাড়িয়ে ছাড়লেন। সাবিত্রীর যেন যেতে কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না। বারবার বলছিল, দিদি, আমি না হয় যোকাকে নিয়ে বেকে যাই। উনি দেখবেন, খোকাকে ফেলতে পারবেন না।

হেমলতা কান দেননি সেকথায়। বলেছেন, সরিৎশেখর বাড়িতে থাকাকালীন ওরা আসুক, উনি কিছু বলবেন না, কিন্তু ওঁর অনুপস্থিতিতে এদের থাকা চলবে না। অনি দেখছিল যাওয়ার সময় অনেকগুলো পোটলা হয়ে গিয়েছে। এগুলো পিসিমা দিয়েছেন, না ওঁরা জোর করে নিয়েছেন, বুঝতে পারছিল না। প্রায় দরজার কাছে গিয়ে পরিতোষ বলল, যাঃ, এক পেটি চা দাও!

হেমলতা ইতস্তত করে বললেন, মহী এখনও চা পাঠায়নি।

এমন গুল মার না! আমি দেখলাম খাটের তলায় দুটো পেটি পড়ে আছে। একটা নিচ্ছি। বলে সটান ভিতরে গিয়ে একটা পাঁচ-পাউণ্ডের পেটি বের করে আনল।

হেমলতা বললেন, সন্ধে হয়ে আসছে। এবার—

পোঁটলাগুলো গুছিয়ে বেঁধে নিয়ে ওরা হেমলতাকে প্রণাম করল। সকালে ওদের প্রণাম করা হয়নি, অনি এবার চট করে প্রণাম সেরে নিল। জ্যাঠামশাইকে প্রণাম করার সময় তিনি হঠাৎ এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন, মাইরি দিদি, আমি শালা এক নম্বরের হারামি।

হেমলতা বললেন, মুখ-খারাপ না করে এবার এসো।

আসতে বলছ? অনিকে ছেড়ে দিল পরিতোষ?

না। আর হ্যাঁ, এই টাকাটা তোমার ছেলেকে মিষ্টি খেতে দিলাম। জন্মাবার পর ওকে প্রথম দেখলাম তো। হঠাৎ হাতে মুঠো থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে সাবিত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরতেই সে সেটাকে হেমলতার বোঝার আগেই নিয়ে ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলল।

মাইরি দিদি, তুমি নমস্য। জন্মাবার পর অনিকে ফাদার আংটি দিয়েছিল, আর তুমি আমার ছেলেকে টাকা দিলে। অবশ্য তা-ই-বা কে দেয়!

কথাটা শেষ করে পরিতোষ পুঁটলি নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সাবিত্রী তার পিছনে বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটছিল।

অনি পিসিমার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়া দেখছিল। প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। গেটের বাইরে গিয়ে সাবিত্রী বাচ্চাটাকে নিয়ে একবার ঘুরে দাঁড়াল। অনি শুনল এতক্ষণে বাচ্চাটাকে দিয়ে জেঠিমা বলতে পারল, টা-টা।

হঠাৎ হেমলতা বললেন, অনিবাবা, দাদু এলে এদের আসার কথা তুমি বলে ফেললা না, বুঝলে?

অবাক হয়ে অনি বলল, কেন?

হেমলতা একটু অস্বস্তিতে বললেন, সারাদিন পরিশ্রমের পর একথা শুনলে ওঁর শরীর খারাপ হবে। যা বলার আমি বলব।

কিন্তু দাদু যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন?

হাসলেন হেমলতা, না, করবেন না।

কিন্তু সেই রাত্রে, সরিৎশেখর আসার অনেক পরে, অনি যখন বুক-দুরুদুরু হয়ে বসে আছে তখন দাদুর চিৎকার শুনতে পেল। তাড়াতাড়ি পা টিপে টিপে দুর শোওয়ার ঘরের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও। সরিৎশেখর বলছিলেন, তুমি অন্যায় করেছ। কেন তাকে ঢুকতে দিলে? পিসিমা চাপা গলায় কী যেন বলরেন। তুমি জান সে চারধারে বলে বেড়াচ্ছে ব্যাংকে আমার নামে লাখ টাকা আছে। আমি নাকি চামার। সরিৎশেখর আক্ষেপে গলায় বললেন পিসিমা গলা শুনতে পেল অনি, আমি বলে দিয়েছি যেন এ-বাড়িতে সে আর কোনোদিন না আসে। আপনি এ নিয়ে আর চিন্তা করবেন না।

তুমি ভীষণ অন্যায় করেছ ঐ অপদার্থটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়ে। আঃ, আমার রাত্রে ঘুম হবে। কিছুক্ষণ চুপচাপ। অনি চলে আসবে ভাবছে, এমন সময় শুনতে পেল দাদু জিজ্ঞাসা করছেন, বাচ্চাটা কার মতো দেখতে হয়েছে?

মায়ের আদল আসে। পিসিমা, মা-মুখো বাচ্চারা সুখী হয়।

সরিৎশেখরের গলার আওয়াজটা অন্যরকম ঠেক অনির কাছে।

আজ ইন্টারস্কুল ক্রিকেট ফাইনালে জেলা স্কুল নয় রানে এফ. ডি. আই.-কে হারিয়েছে। স্কুলে উপর-ক্লাসের ছেলেরা বিজয়-উল্লাস চলার সময় হেডমাস্টারমশাইকে ধরেছিল যাতে আগামীকাল স্কুল ছুটি থাকে। সেটা পাওয়া গেল কি না এখনও জানা যায়নি। তাই স্কুলের সামনে বেশকিছু ছাত্রের জটলা হয়েছে। মাঠের একপাশে গোলপোস্টের গা-ঘেঁষে নতুন স্যারের সঙ্গে অনিরা বসে ছিল। এমন সময় এফ. ডি. আই. স্কুলের নবীনবাবু ওদের কাছে এলেন। নবীনবাকুকে এর আগে দেখেছে অনি। ভীষণ নস্যি নেন আর কংগ্রেস করেন। ছাব্বিশে জানুয়ারিতে কংগ্রেসের এসেশনে নবীনবাবুর হাতে পতাকা ছিল। এফ. ডি. আই.-এর ছেলেরা পোশাক পালটে চুপচাপই চলে গেল। ইন্টারকুলের যত খেলা হয় প্রতিটিতেই প্রায় ওরা জেলা স্কুলকে হারায় শুধু এই ক্রিকেটটা বাদে। আজকে জেলা স্কুলের অরুণ ব্যানাজী দারুণ খেলেছে, সামনেবার ও থাকছে না, তখন দেখা যাবে-এইসব বলতে বলতে ওরা চুপচাপই চলে গেল।

নবীনবাবু রুমালে নাক মুছতে মুছতে নতুন স্যারকে বললেন, নিশীথ, তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা ছিল। নবীনবাবুকে দেখে অনির খুব হাসি পাচ্ছিল। খেলা চলার সময় কোনো বল বাউন্ডারি পেরিয়ে গেলে নিজের স্কুলের ছেলেদের গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগাচ্ছিলেন। অনিদের স্কুলের বড়রা সেই গালাগালিগুলো আওড়ে যাচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে।

নতুন স্যার বললেন, আরে বসুন না এখানে, এখনও তেমন ঠান্ডা নেই।

নবীনবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ওয়েদার চেঞ্জ হচ্ছে তো, হিমটিম লাগলে-তা ছাড়া-বলে ওদের দিকে তাকালেন নবীনবাবু।

নতুন স্যার বললেন, খুব ব্যক্তিগত কথা?

নবীনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাজনীতির ব্যাপারে।

নতুন স্যার হাসলেন, ও, তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। এরা আমার খুব অনুগত ছাত্র। তেমন গুরুতর ব্যাপার নয় আশা করি!

নবীনবাবু এবার ধুতি সামলে ঘাসের ওপর বসলেন, এবারও আমরা তোমাদের কাছে হেরে গেলাম। ফুটবলে দেখে নেব।

নতুন স্যার হাসলেন। অনির খুব ইচ্ছে করছিল ফুটবল নিয়ে কথা হোক। ওঁদের স্কুলের দুজন ছেলে আজ আট বছর ধরে নাকি ফুটবল খেলার জন্য পাশ করতে পারছে না। নবীনবাবু বললেন, ছাব্বিশে জানুয়ারির পর একদম হইচই হল না, কেমন আলুনি-আলুনি লাগছে।

নতুন স্যার বললেন, হইচই করার মতো লোক নেই, আর ঘটনাটাও কোনো ভদ্রলোক সমর্থন করেননি।

নবীনবাবু বললেন, কিন্তু ওদের পার্টির সভ্যদের ধরে পুলিশ প্যাঁদালো, এ তো সবাই চোখের ওপর দেখেছে।

নতুন স্যার বললেন, ওরা পার্টির সভ্য নয় নিশ্চয়ই। কোনো পার্টি এই ধরনের হঠকারী কাজ করবে না। আমরা তো জানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার পর ওরা এখনও আগোছালো।

নবীনবাবু বললেন, তা হলে এ-কাজ করল কে?

নতুন স্যার বললেন, নিশ্চয়ই কিছু মাথাগরম ছেলে। পুলিশ নাকি বলেছে, সবাই শহরের নয়। এসব নিয়ে ভাববেন না।

নবীনবাবু বললেন, আমি ভাবতে পারি না নিশীথ, এত কষ্ট করে এত রক্ত দিয়ে কংগ্রেস স্বাধীনতা আনল, আর সেদিনের কয়েকটা পুঁচকে ছোঁড়া তাকে অপবিত্র করে দিল! এই প্রতিদান?

হঠাৎ নতুন স্যারের গলার স্বর পালটে গেল, একথাই তো দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে। গান্ধীজিকে হত্যা করতে এদেশের মানুষের হাত কাঁপেনি। কিন্তু সেটা কজনের হাত? যিশুখ্রিস্ট নিহত হলে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষের চোখ খুলত না। আমরা সেই কথাই সবাইকে বোঝাব।

নবীনবাবু সামনে ঝুঁকে যেন অনিরা শুনতে না পায় এমন গলায় বললেন, কাল শশধরবাবুর সঙ্গে দেখা হল। ঐ ঘটনাটাকে কাজে লাগিয়ে লাল পার্টির বারোটা বাজাতে প্ল্যান হচ্ছে।

নতুন স্যার বললেন, সে কী! এটা তো ওদের কাজ নয়, আমরা জানি।

নবীনবাবু বললেন, জানাটা আর জানানোটা এক নয়। শশধরবাবু বললেন, এই সুযোগে ওদের মুখে কালি বোলালে ইলেকশনে ওরা মাথা তুলতে পারবে না। নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন ওয়ার।

নতুন স্যার বললেন, ইলেকশন! কবে?

নবীনবাবু কৌটে খুলে আবার নস্যি তুললেন, তা জানি না, তবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে নির্বাচন তো অবশ্যম্ভাবী!

হঠাৎ নতুন স্যার বলরেন, যারা সেদিন কাজটা করল তাদের একজনকে আমি চিনি। খুব ভালো কবিতা লিখত। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, ও যে কোনো রাজনীতিতে বিশ্বাস করে আমি কোনোদিন টের পাইনি।

নবীনবাবু রুমালে নাক মুছতে মুছতে বললেন, শশধরবাবু আজ তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন।

নতুন স্যার বললেন, বাড়িতে থাকবেন?

নবীনবাবু বললেন, বাড়িতে থাকবেন।

নবীনবাবু বললেন, না-না। তোমাদের পাড়ায় বিরাম করের বাড়িতে আজ সন্ধেবেলায় উনি আসবেন, সেখানেই যেতে বলেছেন। বিরামবাবুকে চেন?

হ্যাঁ, ওঁর স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ আছে।

খুব সুন্দরী মহিলা, না?

নবীনবাবু প্রশ্নটা করতে অনি দেখল নতুন স্যার চট করে ওদের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। তারপর একটু অস্বস্তি-মাখানো গলায় বললেন, ওই মহিলারা যেরকম হন আর কি।

নবীনাবাবু হাসলেন, একটু হাতে রেখো, মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে আমাদের ক্যান্ডিডেট হচ্ছেন। ইনকিলাব পার্টিদের কে হচ্ছে জান?

নতুন স্যার অন্যমনস্ক হয়ে ঘাড় নাড়লেন। কথাগুলো শুনতে শুনতে অনি ফস করে বলল, আচ্ছা, ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে কী?

সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাতে নতুন স্যার বললেন, হঠাৎ তোমার মাথায় প্রশ্নটা এল কেন?

অনি আস্তে-আস্তে বলল, বন্দেমাতরম্ শব্দটার মানে তো আমরা জানি, কিন্তু ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে তো জানি না। আম, এখন থাক, আমি পরে জিজ্ঞাসা করব।

কথা বলার ধরন দেখে সবাই হোহো করে হেসে উঠতে অনি মাথা নিচু করল। হঠাৎ হঠাৎ মুখ থেকে নিজের অজান্তে কথা বেরিয়ে যায়। নতুন স্যার বললেন, পরে কেন? আঘ, তোমরা যে সব হাসছ তোমাদের কেউ মানেটা বলো দেখি?

অনি চোখ তুলে দেখল, ওরা কেউ কথা বলছে না, প্রশ্নটা শুনে নিজেদের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে হঠাৎ নবীনবাবু ফিসফিস করে বলে উঠলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না। আমি চলি। নতুন স্যার কিছু বলার আগেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

আরে আপনি যাচ্ছেন কোথায়? একসঙ্গে শশধরবাবুর কাছে যাব ভেবেছিলাম। নতুন স্যার বলে উঠলেন।

শশধরবাবু বিরাম করের বাড়িতে যাবে? তা হলে অবশ্য। একটু যেন খুশি হরেন নবীনবাবু, আমার সঙ্গে আলাপ নেই, এই সুযোগে আলাপ হয়ে যাবে, চলো।

নতুন স্যার বললেন, আরে এখনও তো সন্ধে হয়নি!

নবীনবাবু বললেন, বয়স অল্প তো, ঠাওর পাও না। এই সন্ধে হয়নি মনে হওয়া সময়টা খুব ডেঞ্জারাস! চোরা হিম কখন মাথার ভেতর ঢুকে গিয়ে চেপে বসবে টের পাবে না। আমার আবার সাইনাসের ট্রাবল আছে। সাইনাস কি বংশগত রোগ?

নতুন স্যার উঠতে উঠতে বললেন, জানি না। তা হলে আপনার পক্ষে নস্যি নেওয়া তো উচিত হচ্ছে না।

ওঁকে উঠতে দেখে অনিরাও উঠে পড়ল। এখন সন্দে হয়নি বটে, কিন্তু পশ্চিমের আকাশটার লাল আভাটা কেটে গেছে। স্কুলের বিশাল মাঠটা জুড়ে অদ্ভুত শান্ত এক ছায়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে।

নতুন স্যার বললেন, চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক।

নবীনবাবুর কথাটা মনঃপুত হল না, না না, ওরা আবার হাঁটবে কেন, ছাত্রদের পড়ার সময় হয়ে গেছে। এখন তোমাদের কর্তব্য মন দিয়ে পড়ানা করা, রাজনৈতিক আলোচনা করার জন্যে পরে অনেক সময় আছে। সন্ধে হয়ে আসছে, এখন বাবারা দৌড়ে বাড়ি চলে যাও।

নতুন স্যার হেসে অনির কাঁধে হাত রাখলেন, বাড়ি যেতেহলে ওদের বড় রাস্তা অবধি একসঙ্গে যেতে হবে তো। চলো তোমরা। যা, যে-কথা জিজ্ঞাসা করছিলে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ মানে হল-বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

নবীনবাবু বললেন, তা-ই বললা! আমার তো ধ্বনিটা শুনলে কেমন ধমক-ধমক মনে হয়। তা ভাই বিপ্লবটা কোথায় যে তা অনেক দিন বাঁচবে।

নতুন স্যার হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমি যতদূর জানি, যে-কোনো শোষণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তাকেই কমিউনিস্টরা বিপ্লব বলে থাকে। পৃথিবীর আর-এক প্রান্তে একজন অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষ এক হয়ে যে-সগ্রাম করেছিল তার ফলে সেই দেশে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যায়। সেই সংগ্রামের সম্মানে পৃথিবীর সর্বত্র শোষিত মানুষের বুকে.উৎসাহ আনতে কমিউনিস্টরা বলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

অনি বলে ফেলল, এখন তো আমরা স্বাধীন হয়েছি, ইংরেজরা চলে গেছে, শোষকরা তো আর নেই। তা হলে কেন ওরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে সেদিন অমন মার খেলে।

নবীনবাবু চমকিত হয়ে বললেন, এ-ছেলে তো খুব তৈরি। গুড, গুড। তবে জেনে রেখো খোকা, নেতারা যা বলেন তা-ই মেনে নেবে, কোনো প্রশ্ন করতে নেই। প্রশ্ন করলে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না।

নতুন স্যার বললেন, ও তো এখনও বালক, কৌতূহল না থাকলে ওকে মানায় না। ওরা বলে, যে-স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তা নাকি ইংরেজরা দয়া করে দিয়ে গেছে। কেউ কি দয়া করে ক্ষমতা দেয় যদি বাধ্য না হয়? ওরা বলে দেশে স্বাধীনতার পর কোনো পরিবর্তন হয়নি। অবস্থা একই আছে। আমরাই যেন এখন শোষক। নিশ্চয়ই কেউ একথা ভাবতে পারে, তার স্বাধীনতা আছে ভাবার। আমরা রাশিয়ার মতো কারও ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইনি। কিন্তু আমাদের ভুল দেশের লোকের কাছে ধরিয়ে দিতে ওঁরা বিদেশ থেকে আদর্শ আমদানি করল কেন? এমন একটা ধইন ওরা বেছে নিল যার অর্থ দেশের সাধারণ মানুষ জানে না। দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর পুজো করার কী প্রবণতা! সুভাষ বোষ কংগ্রেসের আদর্শ মেনে না নিতে পেরে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেননি, তিনি বলেছিলেন জয় হিন্দ। আসলে নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে না বললে, কোনোদিন দেশের মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না।

নবীনবাবু বললেন, নিশ্চয়ই। এদেশে আগামী একশো বছুরেও কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসবে না।

নতুন স্যার ম্লান হাসলেন, দুঃখ হয়, কয়েকটা তাজা তরুণ ছেলে কী ভ্রান্ত হয়ে বিপথে চলে গেল! আচ্ছা, এবার তোমরা যাও।

ওরা দাঁড়িয়ে দেখল, নতুন স্যার আর নবীনবাবু বিরাম কর মশাইয়ের বাড়ির দিকে চলে গেল। অনির বন্ধুরা ডানদিকে সেনপাড়ার দিকে চলে গেলে ও একা একা হাঁটতে লাগল। নতুন স্যারের সব কথা ও বুঝতে পারেনি। কিন্তু বন্দেমাতরম্ শব্দটা উচ্চারণ করলে বুকের মধ্যে যেরকম চনমন করে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বললে তা করে না। সেদিন ঐ ধ্বনিটা শোনার পর বাড়িতে একা একা ও আবৃত্তি করেছে। খুব জোরালো মিলিটারি-মিলিটারি বলে মনে হয়। হঠাৎ মনে হল, নতুন স্যার হয়তো ঠিক কথা বলেননি। এই ছেলেগুলো কি এতই বোকা যে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলতে বলতে মার খাবে! কোথাও একটা ব্যাপার আছে যা হয়তো নতুন স্যার জানেন না। অনির ছোটকাকার কথা মনে পড়ল। ছোটকাকা কোথায় এখন? ছোটকাকা কোথায় এখন? ছোটকাকা তো বন্দেমাতরম্ শুনলে মুখটা কেমন করত! কিসের জন্যে ছোটকাকা এখনও বাড়ি আসে না? ছোটকাকা তো সব বুঝত। এসব কথা ভাবতে গিয়েই অনির মনে পড়ে গেল তপুপিসি এখন জলপাইগুড়িতে। গার্লস স্কুলে দিদিমণি হয়ে গেছে তপুপিসি। পিসিমা সেদিন দাদুকে বলছিলেন কথাটা। বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে এই চাকরিটা নিয়ে স্কুলের হোস্টেলে আছে। অনির ভীষণ মনে হতে লাগল, তপপিসি নিশ্চয়ই ছোটকাকার খবর জানে। কেন মনে হল অনি জানে না, কিন্তু ও ঠিক করল তপুপিসির সঙ্গে দেখা করবে।

দুদিন বাদে এক বিকেলে অনি তিস্তা গার্লস স্কুলের সামনে এসে দাঁড়াল। আর কদিন বাদেই দোল। জলপাইগুড়িতে দোলটা বেশ বাড়াবাড়ি রকম হয়ে থাকে। গার্লস স্কুলের পথে আসতে আসতে অনি বিহারি মজুরদের চিৎকার করে ঢোলক বাজিয়ে হোলির গান গাইতে দেখেছে। স্কুলের মেইন গেট বন্ধ, তবে গেটের একপাশে ছোট একটা দরজা কেটে বের করা হয়েছে। অনি, দেখল বয়স্ক পুরুষ মহিলারা সেই ছোট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। সাহস করে অনি ওদের পিছুপিছ চলে এল। গেটের এপাশে বিরাট মাঠ, অনেক গাছপালা, তারপর ইংরেজি ই অক্ষরের মতো ফুলবিভিং। কোথায় তপুপিসির হোস্টেল বুঝতে না পেরে অনি এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে ভাবল, এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি। তপুপিসির ভালো নাম ও জানা নেই। মাঠের দিকে তাকাল ও, মেয়েরা হাড়ুড়ু খেলছে। এত বড় মেয়েদের হাড়ুড়ু খেলতে ও কখনো দেখিনি। কয়েকটা শাড়িপরা মেয়ে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে ফিক করে হেসে গেল। মুহূর্তে অনির নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। ঠিক সেই সময় একটা দারোয়ানগোছের লোক ওকে জিজ্ঞাসা করল সে কাকে চায়।

অনি বলল, নতুন দিদিমণি।

দারোয়ান বলল, কৌনসা দিদিমণি? নাম ক্যা?

অনি বলল, তপুদিদিমণি! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে এসেছে।

কা বোলতা? পুরা নাম কহ। দারোয়ান খিঁচিয়ে উঠল।

পুরো নাম জানি না। অনি বলল।

তব ভাগো। দো মিনিট নেহি থা আর ফটসে ঘুস গিয়া। যা ভাগ। লিডিস স্কুলমে ঘুঁসনেমে বহুত মজা-হাঁ?

লোকটা অনির হাত ধরে টানতে টানতে গেটের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। অনি বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি চলে যাচ্ছি। ওর খুব লজ্জা করছিল। মাঠের অন্য মেয়েরা ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ একটি মেয়ে দৌড়ে ওদের দিকে দারোয়ানকে ডাকতে ডাকতে এল। ডাক শুনে দারোয়ান ওকে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ওর শক্ত লোহার মতো আঙুলের চাপে অনির হাত ভেঙে যাবার উপক্রম। হলি। মেয়েটি হপতে হাঁপাতে কাছে এসে বলল, দারোয়ান, দিদি ওকে ছেড়ে দিতে বলল।

কোন দিদি? দারোয়ান বোধহয় এটা আশা করেনি।

ডেপুটি দিদি। মেয়েটি কথাটা বলতেই দারোয়ান ওর হাত ছেড়ে দিল। অনির মনে হল, ওর হাতটা নিজের কবজির কাছে ভেঙে গেছে। একটুও সাড়া পাচ্ছে না। অন্য হাতটা দিয়ে ও অবশ্য

জায়গাটায় মালিশ করতে গিয়ে নল মেয়েটি তাকে বলছে, তোমাকে দিদিমণি ডাকছেন।

খুব অবাক হয়ে অনি ওর মুখের দিকে তাকাল। ফ্রক-পরা এই মেয়েটি মাথায় তারই মতো লম্বা, দৌড়ে এসেছে বলে মুখটা একটু লালচে। ও বলল, আমাকে

মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

কে? অনি টিক বুঝতে পারছিল না।

ডেপুটি দিদি।

আমি তো–! অনি ভয় পেল, হয়তো তার এই প্রবেশের জন্য স্কুলের কর্তৃপক্ষ ওকে শাস্তি দেবেন, শুধু দারোয়ানের আঙুলের চাপই যথেষ্ট নয় অনি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এখানে তপু দিদিমণি কোথায় আছে, স্বৰ্গছেঁড়ায় থাকতেন? মেয়েটিকে তুমি বলতে কেমন বাধল অনির।

উনিই তো আমাদের ডেপুটি। উনিই তোমাকে ডাকছেন। অনির বোকামি দেখে মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসল।

তুপুপিসি কী ধরনের কাজ করে যাতে তাকে ডেপুটি বলা যায় তার কোনো ধারণা ছিল না অনির। ও মেয়েটির পেছনে পেছনে অনেকটা পথ হেঁটে এল। এর আগে কোনো গার্লস স্কুলের ভেতর ও ঢোকেনি, এখন এতগুলো মেয়ের মধ্যে প্রশ্ন দৃষ্টির সামনে হাঁটতে গিয়ে অনির খুব অস্বস্তি হতে লাগল। অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা এবং পুরুষালি সপ্রতিততা একসঙ্গে ওকে পেয়ে বসল।

মাঠের শেষে চেয়ারে গা এলিয়ে তপূপিসি বসেছিল। অনিদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। অনি খানিকটা দূর থেকে তপুপিসিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ রোগা হয়ে গেছে তপূপিসি। মুখচোখ যেন কেমন-কেমন, রাগী-রাগী মনে হয়।

মেয়েটি বলল, দিদি, ওকে এনেছি। কথাটা শেষ হতেই তপপিসি ওকে হাত ধরে কাছে টেনে নেন, ওমা আমাদের অনি, তুই কত বড় হয়ে গেছিস! দূর তেকে দেখে আমি একদম অবাক। একবার ভাবি অনি কি না, তারপর হাঁটা দেখে বুঝলাম এ নির্ঘাত তুই। খুব লম্বা হয়েছিল যাহোক, সোজা হয়ে দাঁড়া দেখি, ওমা, আমি কোথায় যাব-তুই যে একদম আমার মাথায়-মাথায় হয়ে গেছিস! গালে হাত দিতেই তপূপিসির মুখের গাভীর্য কোথায় পালিয়ে গেল। এই ধরনের কথা শুনে অনির খুব ভালো লাগছিল। এইভাবে নিজের লোকের মতো কথা কেউ বলে না আজকাল। ও দেখল মেয়েটি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তপুপিসিকে দেখছে। বোধহয় ওদের কাছে, তপুপিসির এই চেহারাটা অজানা। তপুপিসি বলল, এই ছোঁড়া, সেই যে এলি, তারপর আর তপুপিসির স্বৰ্গছেঁড়ায় গেলি না? খুব নিষ্ঠুর তুই। তার পরেই ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় গলাটা অদ্ভুত নরম হয়ে গেল তার, মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয়, না রে? তপুপিসির হাতটা ওর কাধের ওপর ছিল। অনি মাথা নিচু করল! ও আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছে, ইদানীং মায়ের কথাবার্তা কেউ বললেও বেশ সহ্য করতে পারে, আগেকার মতো দমবন্ধ হয়ে কান্না পায় না।

তোর নতুন মা কিন্তু খুব ভালো মেয়ে। আচ্ছা, তুই কার কাছে এসেছিস এখানে? কী পরিচিতি আছে এখানে? তপুপিসি যেন হঠাৎই বাস্তবে ফিরে এলে।

হাসল অনি, তোমার কাছে এসেছিলাম।

আমার কাছে সত্যি? তা হলে ফিরে যাচ্ছিলি কেন?

দারোয়ান তাড়িয়ে দিচ্ছিল। তোমার পুরো নাম বলতে পারিনি।

কথাটা শুনে হাঁ হয়ে গেল তপুপিসি, সে কী! তুই আমার নাম জানিস না?

নিজেকে সামলাতে সামলাতে অনি বলল, কী করে জানব, তুমি ডেপুটি-ফেপুটি হয়েছ।

ওমা, আরে আমি তো এই হোস্টেলে থাকি আর মেয়েদের খুব শাসন করি, তাই ওরা ডেপুটি সুপারিন্টেভেট করে দিয়েছে। তপুপিসি বোঝালেন। তা হারে, কার কাছে শুনলি আমি এখানে আছি?

অনি বলল, শুনলাম পিসিমা বলছিল।

তপুপিসি বলল, বড়দি, মোসোমশাই ভালো আছেন। অনি ঘাড় নাড়ল।

কেউ তোকে পাঠিয়েছে আমার কাছে তপুপিসি চোখ বড় বড় করল!

ঘাড় নাড়ল অনির, না।

এই প্রথম অনির মনে হল, ও যে-জন্য তপুপিসির কাছে এসেছে সেটা বলতে ওর কেমন সঙ্কোচ হচ্ছে। ছোটকাকুর কোনো খবর পুপিসির কাছে পেতে হলে যে-সম্পর্কটা থাকা দরকার সেটা আছে কি? অনির মনে পড়ল সেই চিঠিটার কথা, যার অথ তখন সে বুঝতে পারেনি কিন্তু তপুপিসির জন্য কষ্ট হয়েছিল। এই তো তপুপিসি বাড়িঘর ছেড়ে একা একা এখানে আছেন, কেন, কী জন্যে?

তপুপিসি জিজ্ঞাসা করল, কেন এসেছিল বলনা রে!

এবার অনি ঠিক করল, ও বলেই ফেলবে। মাথা নিচু করে ও বলল, আমি একটা কথার মানে বুঝতে পারি না। ছোটকাকু থাকলে আমি জিজ্ঞাসা করতাম। তুমি জান কোথায় ছোটকাকু আছে?

আমি জানব এই ধারণা তোর কী করে হল? যেন একটা গভীর কুয়োর ভেতর থেকে কথা বলছে তপুপিসি।

অনি সত্যি কথা বলে ফেলল, আমি তোমার চিঠিটা পড়েছিলাম, পুলিশ সেটা পায়নি। ছোটকাকু চলে যাবার পর পুলিশ এসে ওটা পেলে তোমাকে ধরত। দাদুর আলমারিতে চিঠিটা রয়েছে, তুমি যদি চাও এনে দিতে পারি।

তপুপিসি বলল, কী কথার মানে তুই বুঝতে পারিস না অনি?

বন্দেমাতরম্ আর ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ছোটকাকু কেন দ্বিতীয়টাকে বেছে নিল? কোনটা বড় অনি বলল।

কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে তপুপিসি বলল, তুই এত ছোট ছেলে, তোর এসবে কী দরকার! এ বড় শক্ত জিনিস, ভীষণ নেশা। মদের চেয়েও খারাপ নেশা। এ-নেশা সব খায়। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের এই নেশা থেকে অনেক দূরে থাকা উচিত।

ঠিক সেই সময় ঢং ঢং করে পেটা-ঘড়িতে ভিজিটরদের যাবার নির্দেশ বাজল অনি দেখল গার্জেনরা সব গেটের দিকে চলে যাচ্ছেন। তপুপিসি-হঠাৎ কেমন-কেমন গলায় বলে উঠল, অনি, তার খবর কখনো যদি পাস আমাকে বলে যাবি? আমায় ছুঁয়ে বলে যা, বলে যাবি তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *