জেলা স্কুলের পাশে তিস্তার কিনারে একটা নৌকো বালিতে আটক হয়ে আছে জল শুকিয়ে যাওয়া থেকে। অনেকটা পথ দৌড়ে অনিমেষ সেখানে থামল। এখন সমস্ত শরীরে কুলকুল করে ঘাম নামছে, জোর ওঠানামা করছে বুকটা। ও নৌকোর গায়ে ঠেস দিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। মটু বা তপনকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। মণ্টুরা এখানে প্রায়ই আসে। কেন আসে তা এতদিন জানত না। সে, আজ জানতে পেরে নিজেকে আরও ছেলেমানুষ বলে মনে হচ্ছিল। ইদানীং স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে বুঝতে পারছে ও। রোজ সকাল-বিকেল ফ্রি-হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ করে বেশ খিদে পায়। হাত ভাঁজ করলে বাইসেপগুলো চমৎকার ফুলে ওঠে। নতুন স্যার বলেছেন যে জাতির স্বাস্থ্য নেই তাদের কিছুই নেই। তাই প্রতিটি কিশোর নাগরিকের উচিত নিজের শরীরের প্রতি যত্ন তিন ইঞ্চি ছুঁয়ে ফেলেছে। পড়ার ঘরে স্কেল দিয়ে দেওয়ালে ছোট ছোট করে মাপ দিয়ে মাঝে-মাঝেই উচ্চতা জরিপ করে নেয় অনিমেষ। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই গোঁফের রেখা দেখা গেছে, কিন্তু ওর মুখ একদম পরিষ্কার। পিসিমা বলেন মাকুন্দদের নাকি গোঁফদাড়ি হয় না, তাই তোরবেলায় তাদের মুখদর্শন প্রলে অযাত্রা হয়। কী করে হয় ওর মাথায় ঢোকে না। বাচ্চা ছেলের মুখ দেখলে যদি অযাত্রা না হবে তো বয়স্ক মানুষের গোঁফছাড়া মুখ দেখলে তা হবে কেন? তা হলে যাদের মাথাজুড়ে টাক, একটাও চুল নেই, তাদের দেখলেও অযাত্রা হবে? পিসিমার সঙ্গে ও প্রাণপণে এসব তর্ক চালিয়েও জিততে পারে না শেষ পর্যন্ত। পিসিমার শেষ অস্ত্র, তুই এখনও ছোট-এসব বুঝবি না। হঠাৎ হেসে ফেলল অনিমেষ, তারপর মনেমনে বলল, আজ থেকে আমি আর ছোট নই, আমি এখন বড় হয়ে গেছি। একদিন মণ্টু বলেছিল পেন্সিলের মুখ ব্লেডের গোল গর্তে টাইট করে চমৎকার গোঁফ কামানো যায়। অনিমেষ ঠিক করল এবার মাঝে-মাঝে ও এই কায়দাটা করবে, তা হলে গোঁফ বেরুতে দেরি হবে না মোটেই। আর হ্যাঁ, ওর জমানো চার টাকা ছয় আনা দিয়ে একটা জাঙ্গিয়া কিনতে হবে। একা যেতে পারবে না সে, মণ্টুকে নিয়ে যেতে হবে দিনবাজারে। জাঙ্গিয়া না পরলে পুরুষমানুষ হওয়া যায় না।
চুপচাপ ও জেলা স্কুলের পাশের রাস্তাটায় উঠে এল। এখন প্রায় বিকেল। আকাশ সামান্য মেঘলা বেল রোদটা মোটেই গায়ে লাগেনি এতক্ষণ। মাঠের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে অনিমেষ দেখতে পেল নতুন স্যার ওকে হাত নেড়ে ডাকছেন। এই সময় নতুন স্যারকে এখানে দেখতে পাবে ভাবেনি অনিমেষ। এতদিন হয়ে গের্ল নিশীথবাবু এখানে আছেন, তবু নতুন স্যার নামটা আংটির মতো ওঁর অঙ্গে এটে আছে। আর-একটা মজার ব্যাপার এই যে, অনিমেষ এতটা বড় হল তবু নতুন স্যার একই রকম আছেন। চেহারায় একটুও বুড়ো হননি। অনিমেষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে মেপে দেখেছে যে তার আর নতুন স্যারের উচ্চতায় পার্থক্য খুব বেশি নয়।
কাছাকাছি হতে নতুন স্যার বললেন, কোথায় গিয়েছিলে অনিমেষ?
অনিমেষ বলল, তিস্তার চরে বেড়াতে।
নতুন স্যার যেন অবাক হলেন প্রথমটায়, তারপর হাসলেন, ও, তরমুজ খেয়ে এলে বুঝি, ওরা প্রায়ই কমপ্লেন করে স্কুলের ছেলেরা নাকি চুরি করে তরমুজ নিয়ে আসে।
অনিমেষ বলল, না, আমি তরমুজ খাইনি।
নতুন স্যার কথাটা শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় এ-ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না, ও গুড, যা শোনো, তোমাকে একটা কথা বলার আছে। তুমি তো এখন বড় হয়েছ, তোমার সঙ্গে আমি ফ্র্যাঙ্কলি সব কথা বলে আসছি এতকাল তাই এই ব্যাপারটা বলতে কোনো সঙ্কোচ অবশ্য আমি বোধ করছি না। কিন্তু তোমাকে আশ্বাস দিতে হবে, এটা কাউকে বলবে না।
নতুন স্যার ওর মুখের দিকে চেয়ে কথা মেষ করতে অনিমেষ অবাক হয়ে গেল। সেই ক্লাস থ্রি থেকে আজ অবধি কোনোদিন নতুন স্যার ওর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেননি। অনিমেষ খুব বিচলিত গলায় বলল, না না স্যার, আমি কাউকে বলব না, আপনি যা বলেন তা আমি কখনো অমান্য করি না।
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে অনিমেষ হঠাৎ আবিষ্কার করল ওর গলাটা কেমন অত শোনাল নিজের কাছেই। খুব খুশি হয়ে নতুন স্যার ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, আমি জানি। এই স্কুলে তুমিই একমাত্র তৈরি। আমি বিরামদাকে বলেছি তোমার কথা। ওর সঙ্গে কয়েক পা হেঁটে হঠাৎ গলার স্বর পালটে নতুন স্যার বললেন, আচ্ছ, মটু ছেলেটা কেমন?
আচম্বিতে প্রশ্নটা আসায় থতমত হয়ে গেল। কেন? কোনোরকমে বলল সে।
নতুন স্যার বললেন, ওর সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলে। এই এত অল্প বয়সে ও দেশের কথা না ভেবে নোংরা আলোচনা করে শুনতে পাই। তুমি তো ওর সঙ্গে মেশ, তাই জিজ্ঞাসা করছি।
কোনোরকমেই অনিমেষ মিত্যে কথা বলতে পারছিল না। আবার আশ্চর্য, সত্যি কথাটা বলতে ওর একটুও ইচ্ছে করছে না। আসলে মণ্টু যা বলে এবং আজ একটু আগেও যা দেখিয়েছে তার মধ্যে এমন একটা সরলতা থাকে যে ব্যাপারটা খারাপ হলেও অনিমেষের মনে হয় না যে খারাপ। এখন মণ্টুর বিরুদ্ধে কিছু বললে নতুন স্যার নিশ্চয়ই তা হেডস্যারকে বলবেন এবং তা হলে মণ্টুর কাছে ও মুখ দেখাবে কী করে? এই সময় নতুন স্যার আবার বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে বিরামদার বাড়ির সামনে অশ্লীল অক্ষরটা মণ্টুই লেখে।
সঙ্গে সঙ্গে সজোরে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না না, এ একদম মিথ্যে কথা, মণ্টু কখনো লিখতে পারে না।
ওকে আপাদমস্তক দেখে নতুন স্যার বললেন, তুমি বলছ?
বেশ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে অনিমেষ জবাব দিল, হ্যাঁ।
এই কথাটা ওকে মিথ্যে বলতে হচ্ছে না। কথা বলতে বলতে ওরা বিরামবাবুর গেটের সামনে এসে গিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে মুখটা বেঁকলেন নতুন স্যার। অনিমেষ দেখল এখন বিরামবাবুর নামের আগে কাঠকয়লা দিয়ে অক্ষরটি লেখা আছে। বেশ উত্তেজিত গলায় নতুন স্যার বললেন, দেখছ, কী রুচি স্বাধীন ভারতের ছেলেদের! ছি ছি ছি! বিরামদার মতো একজন রেসপেক্টবল কংগ্রেসি কি এখানকার ছেলেদের কাছে একটু সৌজন্য আশা করতে পারেন না? আচ্ছা, লেখাটা কি তোমার পরিচিত মনে হচ্ছে অনিমেষ?
অনিমেষ কিছুক্ষণ দেখে ঠাওর করতে পারল না। অক্ষরটা তো এইরকমই হয়। তাকে লিখতে বললেও সে এইরকম লিখত। সরলভাবে ঘাড় নাড়ল সে। নতুন স্যার কয়েক পা হেঁটে হাত দিয়ে অকে মুছতে চেষ্টা করতে সেটা কেমন ঝাঁপসা হয়ে ধেবড়ে গেল। তারপর রুমালে হাত মুছতে মুছতে বললেন, এই ব্যাপারটা আর বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না। যে করছে তাকে ধরতে হবে। এব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চাই অনিমেষ।
কী সাহায্য করবে বুঝতে না পেরেও ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। আর এই সময় ও দেখল গেটের ভেতরে বাগানে একটা ছোট্ট কুকুরকে চেনে বেঁধে মুভিং ক্যাসেল হেঁটে আসছেন। মুভিং ক্যাসেলের তুলনায়, কুকুরটা এত ছোট যে ব্যাপারটা মানাচ্ছিল না। টকটকে লাল শাড়ি পরেছেন মুভিং ক্যাসেল, চোখ টেনে নেয়। হঠাৎ গেটের কাছে ওদের দেখতে পেয়ে দ্রুত এগিয়ে এলেন তিনি, ওমা, নিশীথ! কখন এলে? সারাদিন তোমার কথা ভাবছিলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন ভাই, ভেতরে এসো।
গলার স্বরটা এত মিহি এবং মোলায়েম এবং কাঁপা-কাঁপা যে অনিমেষ আজ অবধি কাউকে এভাবে কথা বলতে শোনেনি। ও অবাক হয়ে গুনল নতুন স্যার এতক্ষণ যে-গলায় কথা বলেছিলেন তা যেন মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল। কেমন বিগলিত ভঙ্গিতে নতুন স্যার বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল, বিরামদা আছেন?
অদ্ভুত একটা ভঙ্গিমায় মুভিং ক্যাসেল বললেন, আঃ বিরামদা আর বিরামদা, আমার কাছে বুঝি আসতে নেই? আমি না থাকলে তোমাদের বিরামদা হত? আরে, ভেতরে এসো-না!
চট করে গেট খুলে ভেতরে গিয়ে অনিমেষের কথা মনে পড়তে নতুন স্যার ঘুরে দাঁড়ালেন। মুভিং ক্যাসেল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটি কে?
নতুন স্যার বললেন, আমার ছাত্র অনিমেষ।
অ। তুমি একদিন এর কথা বলেছিলে, না? বেশ বেশ। খুব মিষ্টি দেখতে তো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? এসো-না আমাদের বাড়িতে। মুভিং ক্যাসেল মাথা নেড়ে অনিমেষকে ডাকলেন।
কী করবে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। ওর মনে হল এখন চলে যাওয়াই উচিত, নাহলে নতুন স্যার হয়তো বিরক্ত হবেন। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই নতুন স্যার ওকে ডাকলেন, এসো অনিমেষ।
অনিমেষ ভেতরে এসে গেটটা বন্ধ করতেই মুভিং ক্যাসেলের বুকসুটা ওর পায়ের কাছে শরীর ঘষতে লাগল। একরত্তি কুকুরটার কাণ্ড দেখে ও অবাক। মুভিং ক্যাসেল শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আমার জিমির দেখছি পছন্দ খুব। তোমাকে ওর খুব ভালো লেগেছে। বলে চেনটা অনিমেষের হাতে দিয়ে দিলেন।
নতুন স্যার মুভিং ক্যসেলের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন বারান্দার দিকে, পেছন পেছন কুকুর নিয়ে অনিমেষ। কয়েক পা হেঁটে প্রকৃতির ডাক শুনতে পেলল জিমি। পেছনে দুই পা ভেঙে বসে জলবিয়োগ করতে লাগল সে। চেন-হাতে দাঁড়িয়ে খুব অস্বস্তিতে পড়ল অনিমেষ। এখানেই মানুষের সঙ্গে পশুর তফাত, মনেমনে ভাবল সে, যতই আদর করুন মুভিং ক্যাসেল একে, সময়-অসময় জ্ঞানটা শেখাতে পারবেন না। কুকুরটা আনন্দে গুটগুট করে চলতে শুরু করলে অনিমেষ বারান্দার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করর। লম্বা বারান্দার তিনদিক মানিপ্ল্যান্টে ঢাকা তবে ভেতরে দাঁড়ালে সামনের রাস্তা এমনকি ওদের স্কুলের অনিমেষের হাত থেকে চেনটা নিয়ে জিমির গলা থেকে খুলে সেটাকে চেয়ারের গায়ে ঝুলিয়ে রেখে দিলেন। জিমি এখন তার বুকের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মুভিং ক্যাসের অনিমেষের হাত থেকে চেনটা নিয়ে জিমির গলা থেকে খুলে সেটাকে চেয়ারের গায়ে ঝুলিয়ে রেখে দিলেন। জিমি এখন তার বুকের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মুভিং ক্যাসেল ঘাড় নেড়ে ডাকলেন, এসো।
দেওয়ালজুড়ে গান্ধীজির ছবি। বাবু হয়ে বসে চরকা কাটছেন। মুখে এমন একটা প্রশান্তি আছে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বিরাট ফ্রেমে হাতে-আঁকা এরকম জীবন্ত ছবি এর আগে দেখেনি অনিমেষ। এদিকের দেওয়াল আলমারি আর তাতে মোটা মোটা বই ঠাসা। আলমারির সামনে সাদা রঙের বেতের সোফাসেট। তার একটিতে একজন প্রৌঢ় বসে আছেন। মাথার চুলে সামান্য পাক ধরেছে, খুব রোগা এবং বেঁটে মানুষ। গায়ে ফিনফিনে আদির গিলে-করা পাঞ্জাবি। ওদের দেখে সোজা হয়ে বসলেন, আরে নিশীথ যে, এসো এসো, তোমার কথাই ভাবছিলাম।
গলার স্বর এত সরু যে চোখ বন্ধ করে শুনলে বোঝা যাবে না যে কোনো পুরুষমানুষ কথা বলছে! কিন্তু সরু হলেও এর বলার ধরনে এমন একটা সুর আছে যে সহজেই আকৃষ্ট করে। নতুন স্যার সোফাটায় বসে জিজ্ঞাসা করলেন, শরীর কেমন আছে বিরামদা?
বিরামবাবু বললেন, আমার তো তো চিরকেলে হাঁপানি রোগ, বাতাস চললেই বাড়ে। ভালো আছি, বেশ আছি-যতটা থাকা যায়। কিন্তু কিছু ব্যবস্থা হল?
নতুন স্যার বললেন, এখনও হয়নি, তবে অ্যাদ্দিন তো তেমন চেষ্টাও হয় আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, কয়েকদিনের মধ্যে এটা যাতে বন্ধ হয় তার ব্যবস্থা করব। আমার সঙ্গে বনবিহারীবাবুর কথা হয়ে গেছে, তা ছাড়া হোস্টেলের ছেলেদের গ্রুপ করে ওয়াচ রাখতে বলেছি।
বিরামবাবু সরু করে বললেন, স্ট্রেও। কাদের জন কাজ করব বলো। এই তো সব চেহারা। অবশ্য যারা খ্রিস্টকে হত্যা করেছিল, গান্ধীকে গুলি করেছে, তারা যে আমার বাড়ির সামনে অশ্লীল অক্ষর লিখবে এটাই তো স্বাভাবিক, না?
এই সময় মুভিং ক্যাসেল অনিমেষের পাশে দাঁড়িয়ে কেমন গলায় বলে উঠলেন, তোমার ঠাকুর্দার আর খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না যে এরকম হতচ্ছাড়া নাম রাখল। বিরাম যে কারও নাম হয়। জীবনে শুনিনি।
বিরামবাবু হাসলেন, আসলে আমাদের সংসারে অনেক ছেলেমেয়ে আসছিল বলেই বোধহয় ঠাকুর্দা আমার নামকরণের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন। তা এই ছেলেটি কে?
নতুন স্যার কিছু বলার আগেই মুভি ক্যাসেল বলে উঠলেন, নিশীথের ছাত্র। ভারি সুন্দর দেখতে, চিবুকটা দেখেছ
কথাগুলো তার মুখের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিমায় বললেন উনি যে মুহূর্তে লাল হয়ে গেল অনিমেষ। কিন্তু ততক্ষণে নতুন স্যার বলতে কি করেছেন, ভীষণ সিরিয়স ছেলে এ, প্র্যাকটিক্যালি এই স্কুলে অনিমেষই আমার নিজের হাতে তৈরি। ও দেশের কথা ভাবে, কংগ্রেসকে ভালোবাসে। ওকে নিয়ে এলাম আমার কাছে, কারণ এই ইলেকশনে আমি চাই ও কাজ করুক। একটু প্র্যাকটিক্যাল অতিতা হোক।
মুভিং ক্যাসেল বলে উঠলেন, কিন্তু এ যে একদম বাচ্চা ছেলে!
বিরামবাবু হাসলেন, তুমি অবশ্য রান্নাঘরে ঢোক না, তাই বলে যে রাঁধে সে চুল বাধে না? আমরা কবে পলিটিক্স শুরু করি। আরে এসব কি তোমার এম এ পাশ করে চাকরি নেবার মতো ব্যাপার?
নতুন স্যার হাসলেন, তারপর অনিমেষের দিকে ফিরে বললেন, ব্যস, তোমার সঙ্গে বিরামদার আলাপ হয়ে গেল।
অনিমেষ বুঝতে পারছিল প্রণাম করলেই ভালো হয় কিন্তু সেটা করতে ওর একদম ইচ্ছে করছিল। হাতজোড় করে নমষ্কার করতেই বিরামবাবু মাথা দুলিয়ে বললেন, খুশি হলাম, বড় খুশি হলাম। আমাদের পার্টি অফিসে যাওয়া-আসা আরম্ভ করো।
মুভিং ক্যাসেল জিমিকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিমেষের হাত ধরলেন, ব্যস দীক্ষা হয়ে গেল তো, এবার তুমি আমার হেফাজতে। প্রথম দিন এলে, একটু মিষ্টিমুখ করে যাও, এসো। মুভিং ক্যাসেল ওর হাত ধরে অন্দরমহলে নিয়ে এলেন।
ভেতরে একটা প্যাসেজ, প্যাসেজের পাশ দিয়ে ঘরগুলো। অনিমেষের মনে হল ওরা ভেতরে আসার আগে কেউ-কেউ এখানে ছিল, ওদের আসতে দেখে দ্রুত সরে গেল। জিমি এখন যেন ঘুমিয়ে আছে এমন ভঙ্গিমায় মুভিং ক্যাসেলের বুকে পড়ে আছে। ডানপাশের প্রথম ঘরটায় ওকে বসতে বলে মুভিং ক্যাসেল ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষ দেখল একটা সুন্দর খাট আর তাতে বিরাট বেডকভার জুড়ে নীল রঙের ময়ুর কাজ করা আছে। ঠিক সামনেই একটা হাতলহীন সোফা, ইচ্ছে করলে শোওয়াও যায়, অনিমেষ সেটায় বসল। সামনেই একটি অল্পবয়সি মেয়ের ছবি, ভীষণ সুন্দর দেখতে, তাকানোর ভঙ্গিটায় এমন অদ্ভুত আদুরেপনা আছে যে ভালো না লেগে যায় না। খুব চেনা-চেনা মনে হতে ও বুঝে ফেলল ইনিই মুভিং ক্যাসেল, নিশ্চয় অনেককালের ছবি, এখনকার চেহারার সঙ্গে মিল বলতে শুধু চোখে।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুভিং ক্যাসেল ভেতরে এলেন, কী দেখছ?
অনিমেষ মুখ নামিয়ে বলল, আপনার ছবি।
খুব অবাক এবং খুশি হলেন মহিলা, ওমা, ছেলের দেখছি একদম জহুরির চোখ। অনেকেই চিনতে পারে না। আমরা মেজো মেয়ে বলে, মা কী ছিলেন আর কী হয়েছেন। কথাটা শেষ করতে করতে বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন উনি। আর বোধহয় চমকে গিয়ে জিমি চোখ মেলে ওর বুকের মধ্যিখানের খোলা উঁচু সাদা চামড়ায় চট করে জিভটা বুলিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে খেপে গেলেন মুভিং ক্যাসেল, আঃ, কী অসভ্য কুকুর রে বাবা, যা পছন্দ করি না তা-ই করবে! নাম তুই কোল থেকে নাম! ধমকে ওকে বিছানায় নামিয়ে দিতে কুকুরটা সুড়সুড় করে ময়ূরের পেটের ওপর। গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। যেন খুব পরিশ্রম হয়েছে এমন ভঙ্গিমায় মুভিং ক্যাসেল বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন, তারপর আঁচল দিয়ে জিমির লালা বুক থেকে মুছে বললেন, তোমরা কোথায় থাক?
টাউন ক্লাবের কাছে। অনিমেষ বলল।
ওমা তাই নাকি! একই পাড়ায় আছি অথচ এতদিন তোমাকে দেখিনি! তোমরা কয় ভাইবোন?
আমার ভাইবোন নেই, দাদু-পিসিমার কাছে থাকি।
কেন, তোমার বাবা-মা?
বাবা স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে আছেন। অনিমেষ মায়ের কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। ও দেখল পাশের দরজা দিয়ে একটি মেয়ে হাতে হোট ডিশ নিয়ে ঘরে এল। মেয়েটি বেশ বড়, শাড়ি পরা, গায়ের রং ফরসা তবে খুব সুন্দরী নয়। একে অনিমেষ দেখেছে রিকশা করে বই নিয়ে আনন্দচন্দ্র কলেজে যেতে। মেয়েটির নাম নিশ্চয়ই মেনকা। কারণ বিরাম করের তিন মেয়ের মধ্যে একজনই শাড়ি পরে এবং তার নাম তো এই। মেনকার হাতের ডিশে চারটে সন্দেশ।
মুভিং ক্যাসেল বললেন, মানু, এই ছেলেটির নাম অনিমেষ, আমাদের নিশীথের প্রিয় ছাত্র। বেশ মিষ্টি চেহারা, না?
মেনকা হাসল, তারপর অনিমেষকে বলল, এটা খেয়ে নাও তো লক্ষ্মী ছেলের মতো।
কপট রাগে ভঙ্গি করল মেনকা, ইস একটুখানি ছেলে, আবার না না বলা হচ্ছে। দেখি হাঁ করো তো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। একটা সন্দেশ হাতে তুলে অনিমেষের মুখের কাছে নিয়ে এল মেনকা। ব্যাপার সুবিধের নয় দেখে অগত্যা অনিমেষ মুখ করে দেখছিলেন, এবার বললেন, তা তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে বলো তো?
সন্দেশটা গিলতে গিলতে অনিমেষ বলতে গেল মাসিমা, কিন্তু তার আগেই মেনকা বলে উঠল, দাঁড়াও, তোমাকে আমি হেল্প করছি। আচ্ছা বাপীকে তোমার নিশীথদা কী বলে, দাদা তো? বেশ, তা হলে মা হল তার বউদি। তুমি যদি বাপীকে বিরামদা বল, তা হলে তোমার বউদি হয়ে গেল। হাসিহাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, এত বড় মহিলাকে বউদি কী করে বলা যায়। তা ছাড়া নতুন স্যারকে তো ও দাদা বলে ডাকে না। মেনকা বোধহয় ওর সমস্যাটা বুঝেই বলল, এদিকে নিশীথটা আমাদেরও দাদা, কিন্তু তুমি আমাকে মেনকাদি বলবে। আসলে আমরা সবাই দাদা বৌদি দিদি। মাসিমা মোসেমশাই বলা এ-বাড়িতে অচল।
এই সময় অনিমেষ অনুভব করল দরজায় আরও কেউ দাঁড়িয়ে। মুখ ফিরিয়ে দেখতে ওর লজ্জা করছিল। মুভিং ক্যাসেল সেদিকে তাকিয়ে বললেন, আয়, জলটা দিয়ে যা, ছেলেটার গলা শুকিয়ে গেল বোধহয়। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, অনিমেষ এই দ্যাখো, আমার আর দুই মেয়ে, উর্বশী আর রম্ভা।
খুব অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। কাচের গ্লাসে যে জল নিয়ে এসেছে তাকে দেখে ওর মনে ল দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা থেকে যেন সে সটান নেমে এসেছে। হুবহু এরকম দেখতে। ছিপছিপে, পানপাতার মতো মুখ, গায়ের রঙ কচি কলাপাতার মতো, আর টানা-টানা কী আদুরে চোখ দুটো। শুধু চুলগুলো ঘাড় অবধি ছাটা। চাহনিটা বড়দের মতো আর তার মাথার চুল হাটু অবধি সটান নেমে এসেছে। বোঝাই যায় এটাই ওর গর্ব।
মেনকো ওর মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠতে ছোটটিও গলা মেলাল। শুধু ছবির মতো মেয়েটি শব্দ না করে হাসল। অনিমেষ দেখল হাসলে ওর গজদাঁত দেখা যায়। সেটা যেন আরও সুন্দর। গজদাঁত তো বাবারও আছে, কিন্তু বাবাকে তো এমন দেখায়। মেনকা বলল, কী, খুব ঘাবড়ে গেলে বুঝি! একদম অস্পসারদের মধ্যে এসে পড়েছ! আমি মেনকা, ও উর্বশী আর এ রম্ভা।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুভিং ক্যাসেল বলল, বুঝতে পেরেছি। আমার ছবির সঙ্গে খুব মিল,? উর্বশী আমার অতীত, কী বলা?
লজ্জায় লাল হয়ে অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
উর্বশী বলল, জল।
এত মিষ্টি গলার আওয়াজ যে অনিমেষ চট করে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা ধরল। কাচের গায়ে উর্বশীর লাল-আভা-ছড়ানো আঙুলগুলো আস্তে-আস্তে আলগা হতে অনিমেষ ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিল। ঠিক এমন সময় দরজায় কেউ এসে দাঁড়াতে মেনকাদি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ দেখল দরজায় এখন কেউ নেই এবং সেদিকে তাকিয়ে রার ঠোঁটের কোণটা কৌতুকে নেচে উঠল।
মুভিং ক্যাসেল এবার বললেন, অনিমেষ, তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে গেলে, তোমার ওপর আমি দায়িত্ব ছিলাম, স্কুলের কোন ছেলে গেটে লিখে যায় তা তোমাকে বের করতে হবে। কী লজ্জা বলো তো! আবার ইদানীং নিশীথের সঙ্গে মানুর নাম এক করে দেওয়ালে-দেওয়ালে লেখা। হচ্ছে! সত্যি, এই শহরটার যা অবস্থা হচ্ছে ক্রমশ, আর থাকা যাবে না।
অনিমেষের মনে পড়ে গেল শহরের দেওয়ালে-দেওয়ালে এখন নিশীথ+মেনকা লেখা আছে।
মুভিং ক্যাসেল উঠলেন, তোমরা গল্প করো, আমি একটু কাজ সেরে নিই। যাবার সময় বিছানা থেকে জিমিকে কোলে তুলে নিয়ে অনিমেষের চিবুক ডান হাতে নেড়ে দিয়ে গেলেন। হাতটা যখন নাকে কাছে এসেছিল অনিমেষ চাঁপাফুলের গন্ধ পেল। উনি চলে গেলে রম্ভা বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে অনিমেষ চোখ সরিয়ে নিল। এই মেয়েটা ওর চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু পা দুটো কী মোটা-মোটা, তাকালে কেমন লাগে। চট করে মনে পড়ে গেল-একটু আগে রাকে নিয়ে মণ্টু আর তপনের ঝগড়ার কথা! ইস, ওরা যদি জানত এখন অনিমেষ কোথায় আছে। রম্ভার দিকে তাকালেই শরীরটা কেমন করে ওঠ।
উর্বশী ও দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আটা।
এতক্ষণ যে এটা হাতেই ধরা ছিল খেয়াল করেনি অনিমেষ, উর্বশীর বাড়ানো-হাতে সেটা দিয়ে বলল, আমি যাই।
সঙ্গে সঙ্গে রম্ভা বলে উঠল, সে কী, যাই মানে? নিশীথদ তো এখন দিদির ঘরে গল্প করছে। একসঙ্গে এসেছ একসঙ্গে যাবে।
অনিমেষের ভালো লাগছিল, কিন্তু এই মেয়েটার বলার ধরনটা ওর পছন্দ হচ্ছিল না। ও দেখল উর্বশী ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে বলল, কাজ আছে।
মাথা নাড়ল অনিমেষ, না।
রম্ভা বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়।
অনিমেষ বলল, নাইন।
রম্ভা ছাড়া কাটল, নাইন ফাইন। আমি হেভেন, আর ও টাইট। বলে ও পা দোলাতে লাগল।
উর্বশী বলে উঠল, এই, পা দোলায় না, মা বারণ করেছে না?
বা পা নাচানো বন্ধ করে বলল, দেখছ তো, তোমরা পা নাচালে দোষ নেই, যত দোষ মেয়েদের বেলায়।
অনিমেষ বুঝল ওরা সেভেন আর এইটে পড়ে। কিন্তু ও যেন উঁচু ও যেন উঁচু ক্লাসে পড়েও ঠিক পাত্তা পাচ্ছে না।
রম্ভা বলল, এই, কথা বলছ না কেন?
অনিমেষ বলল, তোমরা কোন স্কুলে পড়?
তিস্তা গার্লস স্কুলে।
ওখানে তপুদি পড়ায়?
তপুদি ওরে বাবা, খুব ট্রিট। চেন নাকি?
ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, চিনি।
রম্ভা বলল, তোমার সঙ্গে একটা ছেলে দুপুরবেলায় তিস্তার।কে গেল, তার নাম কী?
অনিমেষ অবাক হল, তুমি দেখেছ?
হুঁ। লম্বামতো, কোঁকড়া চুল, খুব ডাঁট মেরে আমাকে দ্যাখে। রম্ভা হাসল।
ও, মণ্টুর কথা বলছ। অনিমেষ বুঝল মণ্টু ঠিকই বলে যে রম্ভা ওকে দেখেছে।
মণ্টু ফন্টু জানি না, ছেলেটা কেমন? অবহেলাভরে কথাটা বলল রম্ভা।
ভালো। ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।
তোমার চেয়েও? বলে খিলখিল করে হেসে উঠল রম্ভা।
সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মনটা বিশ্রী হয়ে গেল। এই মেয়েটার কথাবার্তা খুব খারাপ, গায়ে কেমন জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
আমি ভালো না। বেশ রেগে গিয়ে অনিমেষ জবাব দিল।
কে বলল? এবার প্রশ্নটা উর্বশীর।
হাসিটা যেন থামছিল না রম্ভার, দিদির গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, বোঝে।
আর ঠিক তখনি বাইরে সাইকেলের বেল খুব দ্রুত বাজতে বাজতে চলে গেল। অনিমেষ দেখল রঙ খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সাইকেলটা আবার বেল বাজিয়ে ঘুরে আসতে ও উঠ দাঁড়াল। তারপর যেন কোনো কাজ মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিমায় বলর, আমি আসছি।
এই বলে আস্তে আস্তে যেন কিছুই জানে না এইভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনিমেষ দেখল উর্বশীর মুখ থমথমে। রম্ভ চলে যেতে ওখাটের ওপর আলতো করে বসে বলল, তুমি কিছু মনে কোরো না, রম্ভাটা এইরকম। মায়ের কাছে এত বকুনি খায় তবু ঠিক হয় না আমার এসব একদম পছন্দ হয় না।
অনিমেষ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ও মনে মনে উর্বশীর কথার সঙ্গে যে একমত এটা জানবার জন্যই যেন চুপ করে থাকল। দুজনে ঘরে বসে আছে অথচ কেউ কথা বলছে না এখন। অদ্ভুত নিঃশব্দ এই পরিবেশটা ওর খুব ভালো লাগছিল। বাইরের রাস্তায় যে এতক্ষণ সাইকেলের বেল বাজাচ্ছিল সে বোধহয় চুপ করে গেছে, কারণ এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই।
হঠাৎ উর্বশীর দিকে মুখ তুলে তাকাতে ও দেকতে পেল যে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে, যেন বেশ মজা পেয়ে গেছে, কী ভাবছিল এতক্ষণ?
আমি? কই, কিছু না তো! অনিমেষ অবাক হল।
আমি দেখলাম তোমার মন অন্য কোথাও চলে গেছে। আচ্ছা, তুমি সবচেয়ে কাকে বেশি ভালোবাস? দেখি আমার সঙ্গে মেলে কি না। উর্বশী বলল।
অনিমেষ এখন এই উত্তরটা দেবার জন্য আর ভাবে না। কিন্তু এই কয় বছর আগে অবধি ও চেঁচিয়ে বলতে পারত দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু এখন বুঝে নিয়েছে সত্যি সত্যি যে দেশকে ভালোবাসে সে চেঁচিয়ে কথাটা সবাইকে জানায় না। এগুলো নিজের কাছে রেখে দিলে সুখ হয়। বিলিয়ে দিলে বড় খেলো হয়ে যায়।
অনিমেষ চুপ করে আছে দেখে উর্বশী বলল, বলতে লজ্জা করছে বুঝি? সব ছেলেমেয়েই মাকে ভালোবাসে, তাই মাকে বাদ দিয়ে
ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অনিমেষ বলল, না, আমার তো মা নেই।
আমাকে খুব ছোট রেখে মা চলে গিয়েছেন। অনিমেষ বলল।
মা নেই? খুব অবাক হল উর্বশী, ওর গলাটা যেন কেমন হয়ে গেল।
তোমার খুব কষ্ট, না?
উর্বশীর মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হল, সত্যি সত্যি বেচারার মন-খারাপ হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা সহজ করতে ও বলল, প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, এখন ঠিক হয়ে গেছে। তা ছাড়া নতুন স্যার বলেছেন, গর্ভধারিণী মা না থাকলে কী হয়, জন্মভূমি-মা আছেন, তাকে ভালোবাসলেই সব পাওয়া হয়ে যাবে।
ভ্রূ কুচকে উর্বশী বলল, কে বলেছেন একথা?
অনিমেষ বলল, নতুন স্যার, মানে নিশীথদা।
সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠল উর্বশী, তুমি এসব বিশ্বাস কর নিশীথদা এসব বলে বাবার মন ভেজায়, নইলে দিদির সঙ্গে লভ করতে পারবে না। এখন আমাদের পাশের ঘরে যাওয়া বারণ, জান
ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ল অনিমেষ উর্বশী খারাপ শব্দ কিছু বলেনি, কিন্তু নতুন স্যার সম্বন্ধে শোনা কথাটা ও এমনভাবে সত্যি করে বলি! তবু অনিমেষ বলল, কেন?
আহা! বোঝ না যেন কিছু! ক্লাস নাইনে পড় না তুমি? তারপর গম্ভীর গলায় বলল, নিশীথদা এখন দিকিকে বাংলা পড়াচ্ছে!
ও! খুব ঘাবড়ে গেল সে।
ওসব চিন্তা ছাড়ো, বুঝলে! দেশ-ফেশ কিছু নয়। নিজের মায়ের চেয়ে বড় কেউ নেই। সেসব ইংরেজ আমলে ছিল, তখন সবাই দেশকে স্বাধীন করতে চেস্টা করত, এখন এসব চলে না। উর্বশী বলল।
যাঃ! হাসল অনিমেষ, স্বাধীন হয়েছে বলে দেশ আর মা থাকবে না?
উর্বশী মাথা নাড়ল, তুমি যদি একথা পাঁচজনকে বল তারা তোমাকে বোকা,ভাববে। এই দ্যাখো, আমার বাবা নাকি বিয়ারিশের আন্দোলন না কী করেছিল। এখন এই শহরের নেতা, গান্ধীজির শিষ্য, সবাই সম্মান করে অনেই লোক বলে তারপর হঠাৎ হলা পালটে বলল, অথর্চ আমার মায়ের গায়ে দেখেছ কী বিলিতি সেটের গন্ধ, আমার জামাকাপড় কী দেখছ, দিদির যা আছে না তোমার চোখখারাপ হয়ে যাবে। বাবার অমত থাকলে এসব হতা।
হাঁ করে খাওলো শুনছিলানিমেষ। উর্বশী র মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ থেকে একশো বছর আগে আমার মতো মেয়ের বিয়ে কত কী হয়ে যেত। এখন কেউ সেটা ভাবতে পারে তেমনি দেশকে মা বলে পুজো করাটা তখনকার আমলে ছিল, বুঝলে?
এত তাড়াতাড়ি অনিমেষ কথাট হজম করতে পারছিল না, কিন্তু নতুন স্যার–
ঠোঁট বেঁকাল উর্বশী, তোমার নতুন স্যারে কথা বোলো না। যা ইয়ার্কি করে না, কান লাল হয়ে যায়। তুমি খুব বোকা ছেলে।
এবার অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।
এতদিন ধরে মণ্টুরা যেসব কথা ওকে বলে বোঝাতে পারেনি, আজ এই মেয়েটা সেকথাই বলে তাকে কেমন করে দিচ্ছে।
ওকে দাঁড়াতে দেখে খাট থেকে নেমে এল উর্বশী, কী হল, যাচ্ছ?
যা যাই, সন্ধে হয়ে আসছে। অনিমেষ বলল।
কিন্তু তোমার নতুন স্যার—
থাক, আমি একাই যাই।
হঠাৎ চট করে উর্বশী ওর হাত ধরল, এই আমাকে ছুঁয়ে বলো, আজ আমি যেসব কথা বললাম, তা তুমি কাউকে বলবে না।
তুলোর মল নরম স্পর্শ হাতের ওপর পেয়ে অনিমেষ চমকে ওর দিকে তাকাল। উর্বশীর চোখ দুটো কী আদুরে ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। অনিমেষ আস্তে-আস্তে বলল, কেন?
এসব কথা কাউকে বলতে নেই। বাবা শুনলে আমাকে মেরে ফেলবে। খুব চাপা গলায় উর্বশী বলল।
তাহলে তুমি বললে কেন? অনিমেষ ওর চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছিল না।
জানি না। তারপর হেসে বলল, তুমি খুব বোকা বলে তোমাকে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে, তাই। কথা দাও।
অনিমেষের বুকের ভেতরটা কেমন করতে রাগল, কিন্তু আমি যে-।
ওকে থামিয়ে দেয় উর্বশী, তুমি কি খুব দুঃখ পেয়েছ?
নিজের মনের কথাটা উর্বশীর মুখে শুনে ও মুখ তুলে তাকাতে দেখল পাশের দরজায় রম্ভা দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। চোখচোখি হতে নিজের ঠোঁট কামড়ে সে দ্রুত সরে গেল।
গেট খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই তিস্তার দিকে নজর গেল অনিমেষের। হোট জটলা হচ্ছে একটা সাইকেলকে ঘিরে। উর্বশীর ঘর থেকে বেরিয়ে বিরামবাবুকে নমস্কার করে অনিমেষ একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে আসছিল। আসার সময় মুভিং ক্যাসেলকে দেখতে পায়নি ও। উর্বশীর কথাগুলো মানের মদ্যে যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে সেটা ও ঠিক সামলাতে পারছিল না। নতুন স্যার মেনকাদিকে ভালোবাসেন, তাকে বাংলা পড়ান, আবার দেশকেও ভালোবাসেন, অনিমেষকে জননীর মতো তাকে গ্রহণ করতে বলেন। অনিমেষের মনে হয় এর মধ্যে দোষের কিছু থাকতে পারে না। এটা ও মেনে নিতে পারছিল। কিন্তু বিরামবাবু, যিনি এখানকার কংগ্রেসের নেত, মিউনিপ্যালিটির কর্তা, তিনি মুভিং ক্যাসেলের বিলিতি সেন্ট, শাড়ির টাকা যোগান কী করে। নতুন স্যার এসব কথা জেনে, জানাটাই স্বাভাবিক, এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন-এই ব্যাপারটি ও সহ্য করতে পারছিল না। ও বেশ বুঝতে পারছিল সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিরাট ফাকি আছে। উর্বশী বলল, বিরামবাবুর মন ভিজিয়ে নতুন স্যার এ-বাড়িতে আসার সুযোগ পান। অনিমেষের ভেতরটা টলমল করছিল।
আবার উর্বশী যে এত কথা বলল তার জন্য ওকে ওর একটুও খারাপ লাগছিল না। কী সহজে উর্বশী বাবা-মায়ের কথা ওকে বলে দিল। কেন? রম্ভা, এমনকি মেনকাদিকেও ওর ঠিক পছন্দ হয়নি। উর্বশীর চোখ, লালচে আঙুল, গজদাত-অনিমেষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। বুকের মধ্যে একটা গভীর আরাম ক্রমশ জায়গা জুড়ে নিচ্ছিল।
এইসব ভাবতে ভাবতে অনিমেষ গেট খুলে বাইলে এল এবং তখনই জটলাটা ওর নজরে পড়ল। কয়েক পা এগোতেই মণ্টুর গলা শুনতে পেল, মণ্টু খুব চাচাচ্ছে। একদৌড়ে ও কাছে গিয়ে দেখল, মণ্টু একটা সুন্দরমতো ছেলের জামার কালার মুঠোয় নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে আর তপন একটা সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত শাসিয়ে যাচ্ছে। ওদের ঘিরে পাঁচ-ছয়জন পথচলতি লোকের ভিড়, তবে সবার মুখ হাসিহাসি। বোঝা যায় ওরা একটা মজার ব্যাপার দেখছে। যে-ছেলেটিকে মটুয়া ধরেছে তার বয়স ওদের মতো বা সামান্য বেশি হতে পারে। ফরসা, ফুলপ্যান্ট পরা, কোমরে বেল্ট আছে আর মাথাজুড়ে একটা বিরাট শিঙাড়া মণ্টুর কথার জবাবে একটা-কিছু আবার বেয়াদবি মারা হচ্ছে। মেরে বাপের বাসিবিয়ে দেখিয়ে দেব, বুঝলি!
ছেলেটার জামপ্যান্ট বেশ দামি, বোঝা যায় বড়লোকের ছেলে এবং এ-ধরনের আক্রমণে অভ্যস্ত নয়। সে বলল, মিছিমিছি মারছ, আমি এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম।
তপন দুহাতে-ধরা সাইকেলটা ঝাকিয়ে বলল, আবার মিথ্যে কথা! আমরা স্পষ্ট দেখলাম তিনচারবার বেল বাজিয়ে বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করা হচ্ছিল! জানলায় ও আসতেই বেস থেমে গেল। কোন পাড়ায় থাকিস, বল।
কোনোরকমে ছেলেটা বলল, বাবুপাড়ায়।
মণ্টু বলল, কেন এসেছিল এখানে।
অনিমেষ একটা ব্যাপারে অবাক হচ্ছিল। এই ছেলেটির শরীর দেখে বোঝা যায় যে গায়ের জোর কম নয় মণ্টুর থেকে। অথচ ও কেমন অসহায় হয়ে মটুর হাতের মুঠোয় নিজের জামার কলার ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগেও বোধহয় চড় ঘুসি পড়েছে, কারণ ওর গালে লাল দাগ ফুটে উঠেছে। ইচ্ছে করলে ও লড়ে পালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যাচ্ছে না কেন? ছেলেটাকে চুপ করে থাকতে দেখে মটু বাঁ হাত দিয়ে ওর চুলের শিঙড়া খপ করে ধরে হ্যাচকা টান দিল। যন্ত্রণায় মাথা নোয়াতে নোয়াতে ছেলেটা বলে উঠল, আমাকে আসতে বলেছিল।
মণ্টু চট করে বাঁ হাতটা ছেড়ে দিয়ে বোকার মতো উচ্চারণ করল, আসতে বলেছিল।
হ্যাঁ আমার বোন ওর সঙ্গে পড়ে। বোনকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল। ছেলেটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কথাগুলো বলল।
ফ্যাসফ্যাসে গলায় মণ্টু বলল, মিথ্যে কথা, একদম বিশ্বাস করি না। কোনো প্রমাণ আছে।
এতক্ষণে যেন একটু জোর পেয়েছে ছেলেটি পায়ের তলায়, দুহাত দিয়ে মণ্টুর মুঠো থেকে নিজের জামাটা ছাড়িয়ে বলল, এসব ব্যাপারে কি কোনো ড্রশান থাকে। তবে যদি বিশ্বাস না কর ওকে ডেকে আনন, আমি তোমাদের সামনে জিজ্ঞাসা করব।
সঙ্গে সঙ্গে মণ্টু একটা ঘুসি মারল ছেলেটরি মুখে, কিন্তু দ্রুত মুখটা সরিয়ে নেওয়ায় ঘুসিটা কাঁধে গিয়ে লাগল। যন্ত্রণায় ছেলেটা দুহাতে কাঁধ চেপে ধরল। মণ্টু বলছিল, শালা, ভদ্রলোকের মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভজাতে চাও? কোনো প্রমাণ-ফ্রমাণ নেই। আমি একদম বিশ্বাস করি না।
হঠাৎ ছেলেটা রুখে দাঁড়াল, আমি এখানে আসি না-আসি তা তোমাদের কী? তোমরী ওর কেউ ওর?
মণ্টু বলল, আবার কথা হচ্ছে। আমি কেউ হই না-হই সে-জবাব তোকে দেব? আজ প্রথম দিন বলে ছেড়ে দিলাম, আবার যদি কোনোদিন দেখি এইখানে টাকি মারতে তা হলে ছাল ছাড়িয়ে নেব। যাঃ।
ছেলেটা ঘুরে সাইকেলটা ধরতে যেতে তপন বলল, লেগেছে তোর?
একটু অবাক হয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে ছেলেটা বলল, না। বোধহয় নিজের কষ্টের কথা স্বীকার করতে চাইছিল না।
তপন হাসল, গুড। তা হরে ক্ষমা চা, বল, আর কোনোদিন এসব করব না।
ছেলেটা বলল, তোমরা আজ সুযোগ পেয়ে যা ইচ্ছে করে নিচ্ছ। বেশ, আমি ক্ষমা চাইছি। তপন ওকে সাইকেলটা দিয়ে দিতে সে দৌড়ে লাফিয়ে তাতে উঠে পড়ে একটু নাগালের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, এই শালারা, শোন, এর বদলা আমি নেব। পাপাড়ার সাধন মৃধার পার্টিকে আজই বলছি। কথা শেষ করেই জোরে প্যাডেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল।
কয়েক পা ফুটে থমকে দাঁড়াল মটু, যা যা, বল শালা সাধনকে। আমি যদি রায়কতপাড়ার আশেকদাকে বলি তোর সাধন লেজ গুটিয়ে নেবে।
কিন্তু কথাগুলো ছেলেটার কোন অবধি পেীছাল না। আর কোনো মজার দৃশ্য দেখা যাবে না বুঝে ভিড়টা পলকে হালকা হয়ে গেল। অনিমেষ ওদের কাছে এগিয়ে গেল। তপন প্রথমে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
অনিমেষ বলল, এখানে কী হয়েছে রে?
মণ্টু বলল, আরে তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে দেখি এই মালটা সাইকেলে পাক খাচ্ছে আর বেল বাজাচ্ছে। টাঙ্কি মারার আর জায়গা পায়নি! আবার সাধন মৃধার ভয় দেখাচ্ছে। মণ্টু যেন তখনও ফুসছিল।
অনিমেষ বলল, মারতে গেলি কেন মিছিমিছি।
মণ্টু বলল, বেশ করেছি মেরেছি। প্রেমের জন্য জীবন দেয় সবাই, তা জানিস?
তারপর টেনে টেনে বলর, আই লাভ রম্ভা।
হঠাৎ মুখ ফসকে অনিমেষ বলে ফেলল, রা তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল।
সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হয়ে গেল মণ্টু। ও যেন বিশ্বাস করতেই পারছে না কথাটা। তারপর কোনোরকমে বলল, তোকে জিজ্ঞাসা করেছে।
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল।
তোর সঙ্গে আলাপ আছে বলিসনি তো! গুল মারবি না একদম। মণ্টু ওর সামনে এসে দাঁড়াল।
অনিমেষ বলল, আগে আলাপ ছিল না, একটু আগে হল। এখানে আসতে নতুন স্যার আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
কথাটা শেষ করতেই তপন দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল, তোর কী লাক মাইরি, একই দিনে বেদিং বিউটি থেকে লাভিং বিউটি সব দেখলি। তোকে একটু হেঁদে দে।
তিস্তার পাড়ে হাঁটাত হাঁটতে ওদের সব ব্যাপারটা বলতে হল। শুধু উর্বশী যে কথাটা ওকে সবশেষে বলেছে সেটা বন্ধুদের ভাঙল না। শোনা হয়ে গেলে মটু বলল, না রে অনি, অ অক্ষরটা যে-ই লিখুক এবার আমি ধরবই! র যখন আমাকে লাইক করে তখন এটা আমার প্রেস্টিজ ইমু। তুই মুভিং ক্যাসেলকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলিস। আসামি ধরা পড়লে আমাকে ভাই ও বাড়িতে নিয়ে যাস।
তপন বলল, আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। অনিমেষ ঘাড় নেড়ে না বলল। হতাশ গলায় তপন নিজের মনে বলল, আমাকে শালা মেয়েরা পছন্দ করে না। এইখ্রনগুলো যতদিন না যাবেনিজের গাল থেকে হাত সরিয়ে ও মণ্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, মাইরি, নিশীথবাবুটা হেভি হারামি। গাছেরও খাচ্ছে তলারও কুড়োচ্ছে!
গালাগালি শুনে প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল অনিমেষের। ও চিষ্কার করে উঠল, খুব খারাপ হচ্ছে তপন। না জেনেশুনে একটা অনেস্ট লোককে গালাগালি দিবি না! কিন্তু অনেস্ট শব্দটা বলার সময় ওর কেন জানি না বিরামবাবুর মুখটা মনে পড়ে গেল।
মণ্টু হাসল, তুই কিছুই জানিস না অনি, আগে মুভিং ক্যাসেলের সঙ্গে নিশীথবাবুকে সব জায়গায় দেখা যেত। কলকাতায় কতবার নাকি ওরা দুজনে গিয়েছে। তখন মেয়েরা ছোট ছিল। মেনকার সঙ্গে লাইন হয়েছে, তা সবাই অনুমান করতাম, কিন্তু শিওর ছিলাম না। তুই আজ ঠিক খবরটা দিলি।
একই দিনে একটা মানুষের এতরকম ছবি দেখতে পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল অনিমেষ। নতুন স্যার দেশকে ভালোবাসেন, মেনকাদিকেও. ভালোবাসতে পারেন, মেনকাদির বাবা অসৎ হলেও মেনকাদি তো সৎ হতে পারে। কিন্তু তার মেনকাদির মাকে-এই ব্যাপারটা সব গোলমাল করে দিচ্ছিল।
হঠাৎ তপন মণ্টুকে বলল, তুই শালা এবার থেকে বাংলা হেভি নম্বর পাবি।
মণ্টু অবাক হয়ে বলল, কেন?
কেন আবার! ভায়রাভাইকে কেউ কম নম্বর দেয়? কথাটা বলে ও চোঁচোঁ করে দৌড় মারল।
মানে বুঝতে পেরে মণ্টু ওকে দৌড়ে ধরতে যেতে যখন বুঝতে পারল ও নাগালের বাইরে চলে গেছে, তখন দাঁড়িয়ে পড়ে অনিমেষকে বলল, বন্ধু হোক আর যা-ই হোক, মেয়েদের ব্যাপারে সবাই খুব জেলাস, না রে!
অনিমেষের কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ও চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। যত বড় হচ্ছে তত যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষের কতরকম চেহারা থাকে!