সরিৎশেখর দিন ঠিক করে রেখেছিলেন পঞ্জিকা দেখে। বিদেশযাত্রা এবং জ্ঞানার্জনের প্রশস্ত সময় আগামী মঙ্গলবার। নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত্রে, কিন্তু বিকেলবেলায় জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই যাত্রা শুরু করা যায়। এসব আগেভাগেই ছকে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু মুশকিল হল আজ কাগজে দেখলেন বুধবার কলকাতায় বামপন্থিরা হরতালের ডাক দিয়েছে। বাড়িতে কাগজ রাখা বন্ধ করেছিলেন তিনি, শুধু রবিবার দুটো কাগজ নেন। বাকি ছয়দিন কালীবাড়ির পাশে নিত্য কবিরাজের দোকানে বসে পড়ে আসেন। নাতির পাশের খবর সবাইকে দিয়ে সেদিনের কাগজটা হাতে তুলতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। বাটারা আর হরতাল ডাকার দিন পেল না! সরিৎশেখরের হঠাৎ মনে হল নাতিকে তিনি একটা অনিশ্চিত এবং অগ্নিগর্ভ হাঁ-মুখের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কলকাতা শহরকে বিশ্বাস করতে পারা যায় না, অন্তত এই কাগজগুলো পড়ে মনে হয় কলকাতা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। রাতদিন মারামারি, মিছিল, হরতাল, ছাত্র-আন্দোলন সেখানে লেগেই আছে। অনিমেষ সেখানে গিয়ে নিজেকে কতটা নিরাপদে রাখতে পারবে? একেই ছেলেটার মাথায় এই ধরনের একটা ভূত সেই পনেরোই আগস্ট থেকে চেপে আছে-সেটা উসকে উঠবে না তো? হেমলতার ভয় কলকাতায় গেলে মেয়েরা তার ভাইপোকে চিবিয়ে খাবে। শনিবাবা বলেছিলেন, এর জীবনে প্রচুর মেয়ে আনবে, তারা সর্বনাশ করবে, আবার তাদের জন্যই ওর উন্নতি হবে। কিন্তু মাথা খেয়ে নিলে তারপর আর কী ছাই হবে! হেমলতার এইসব চিন্তা সরিৎশেখরকে স্পর্শ করে না। তার নাতির ওপর বিশ্বাস আছে। মেয়েছেলে ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তেমন হলে তিনি নিজে কলকাতায় যাবেন। কিশোরী মিত্তিরের বাড়ি শোভাবাজারে। এককালে এই অঞ্চলে ছিলেন তিনি, সরিৎশেখরের ভারি অন্তরঙ্গ। অনিমেষের দেখাশোনার ভার তিনি নিয়েছেন চিঠির মাধ্যমে। অতএব তেমন কিছু হলেই খবর পাবেন সরিৎশধর। এই সময় তার চট করে বড় ছেলে পতিতোষের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে জলপাইগুড়িতে রেখেছিলেন আর-একজনের কাছ থেকে খবরাখবর ঠিকমতো পাবেন এই আশায়। পেয়েছিলেন? সবই ঠিক, কিন্তু কলকাতায় না গেলে অনিমেষের ভবিষ্যৎ এই শহরের চারপাইে পাক খাবে। আনন্দচন্দ্র কলেজ থেকে আহা-মমি ফল করে পাশ করার আশা পাগলও করবে না। অতএব প্রেসিডেন্সি অথবা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অনিমেষকে ভরতি করতে হবেই। তাঁর ইচ্ছা ও সেন্ট জেভিয়ার্সে প্রতি হোক। মিশনার কলেজ, ইংরেজিটা ভালো শিখবে, সহবত পাবে। সরিৎশেখর এখনও বিশ্বাস করেন ইংরেজিতে উত্তম ব্যুৎপত্তি না থাকলে জীবনে বড় হওয়া যায় না। তারপর খবরে জেনেছে সে-কলেজে মেয়েরা পড়ে না, হেমলতায় আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কোএড়ুকেশন কজে সম্পর্কে তার নিজস্ব কোনো গোঁড়ামি নেই। তবে চিকিৎসার চেয়ে সতর্কতাই শ্রেয়। অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে দেশের ভালো ভালো ছেলেরা পড়ে, বিখ্যাত অধ্যাপকরা পড়ান। মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকা যায় ছাত্রের পড়াশুনার ব্যাপারে। যদিও সেখানে মেয়েরা পড়ে। তবে এই মেয়েরা যখন মেধাবী এবং কৃতী, নাহলেওই কলেজে ভতি হতে পারত না, তাই তাদের সময় হবে না ছেলেদের মস্তিষ্ক চর্বণ করার। আর করলেও তার নাতবউ পড়াশুনায় স্কলার-সরিৎশেখর অতটা আশা করতে পাবেন না। তা ছাড়া প্রেসিডেন্সির গায়েই নাকি বেকার হোস্টেল। পায়ে হেঁটে আসাযাওয়া করবে অনিমেষ। গাড়িঘোড়ায় চাপার ব্যাপারে কলকাতা শহরকে অবিশ্বাস করেন তিনি। বেকার হোস্টেল থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স কত দূর-হেঁটে যাওয়া অসম্ভব কি না কিশোরী মিত্রকে জানাতে লিখেছিলেন। অনেকেই যেমন হয়, চিঠি দেবার সময় সব পয়েন্টের কথা খেয়াল করে না–কিশোরী মিত্রও তা-ই করেছেন।
আজ নাতিতে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন সরিৎশেখর। যাবার আগে বাপের সঙ্গে দেখা করে আসুক। মাতাপিতার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো সন্তান জীবনে উন্নতি করতে পারে না। অনিমেষকে তাই তিনি স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন, দু-চারদিন থেকে আসুক। সাধারণত ছেলেটা সেখানে যেতে চায় না-এবার বলতেই রাজি হয়ে গেল। ফাঁকা বাড়িতে সরিৎশেখর চুপচাপ বসে অনিমেষের কথা ভাবছিলেন। ওর কলকাতায় পড়তে যাবার ব্যাপারে প্রথমে মহীতোষের ইচ্ছা ছিল না ঠিক, কিন্তু তিিন বরাবর জোর করে এসেছেন। কিন্তু সেখানে ছেলেটার পেছনে প্রতি মাসে যে-খরচ হবে তা যোগানোর সামর্থ্য তার নেই। পেনশন আর এই সামান্য বাড়িবাড়া-এতে তাকে যেভাবে চলতে হচ্ছে তা থেকে অনিমেষকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। ওরা পড়াশুনার দায়িত্ব তাই মহীতোষকে নিতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন সে তা নেবে। নিজের সন্তানদের পেছনে তিনি জীবনের কতখানি উপার্জন ব্যয় করেছেন, সেগুলো থাকলে আজ তিনি অনিমেষকে কারও কাছে পাঠাতেন না। অতএব মহীতোষ তার নিজের ছেলের জন্য টাকা খরচ করবে না কেন? ঠিক এই মুহূর্তে তার মনে হল যে এতদিন তিনি যেন অনিমেষের কেয়ারটেকার হয়ে ছিলেন। সেই স্বৰ্গছেঁড়া ছেড়ে চলে আসার সময় বউমার কাছ থেকে যে-ছেলেটার দায়িত্ব হাত পেতে চেয়ে নিয়েছিলেন, এত বছর ধরে যাকে বুক দিয়ে আড়াল করে রেখে বড় করলেন, আজ সেই দায়িত্ব তার শেষ হয়ে গেল। এখন তিনি মুক্ত। কিন্তু এটুকু ভাবতেই তার সমস্ত শরীর কেমন দুর্বল হয়ে গেল। উত্তরের বারান্দায় ভাঙা বেতের চেয়ারে বসে সরিৎশেখর অনেক বছর পরে তার জরাগ্রস্ত চোখ দুটো থেকে উপচে-পড়া জলের ধারাকে অনুভব করলেন। চোখ মুছতে একটুও ইচ্ছে হর না তাঁর।
কুচবিহার-লেখা বাসে চেপেছিল অনিমেষ। ময়নাগুড়ি রোড়ে এলে টিকিট কাটার সময় জানতে পারল সেটা স্বৰ্গছেঁড়ায় যাবে না, ধূপগুড়ি থেকে ঘুরে অন্য পথ ধরবে। এখন নেমে পড়াও যা ধূপগুড়িতে নামাও তা। মিছিমিছি বেশি পয়সা খরচ হয়ে গেল। ধূপগুড়িতে নেমে ও স্বৰ্গছেঁড়ার দিকে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাঁটবার হলে ঘনঘন বাস পেত, কিন্তু আজ বোধহয় অপেক্ষা করতে হবে। বার্নিশ থেকে পরের বাসা, অথবা মালবাজার মেটেলি থেকে বাস এলে সেটাতে উঠতে হবে। অথচ এখান থেকে স্বৰ্গছেঁড়া বেশি দূর নয়-মাইল আটেক। দৌড়েই চলে যাওয়া যায়।
অনেকদিন পরে স্বর্গহেঁড়ায় যাচ্ছে সে। অথচ সেই প্রথমবারের মতো উত্তেজনা হচ্ছে না, এখন সমস্ত মন বসে আছে বুধবার সন্ধেবেলার দিকে তাকিয়ে। মলবার ঠিক ছিল, কিন্তু হরতালের জন্য দাদু দিনটা পিছিয়ে দিলেন। বৃহস্পতিবার কলকাতায় পৌঁছাবে সে। ভাবতেই সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠল ওর। এতদিন ধরে বিভিন্ন বই, খবরের কাগজ আর মানুষের মুখেমুখে শুনে মনের মধ্যে কলকাতা এক স্বপ্নের শহর হয়ে গেছে। সেখানে যেতে পারার সুযোগ পেয়ে অনিমেষ আর-কিছু। ভাবতে পারছিল না। ওর মনে পড়ল অনেক অনেক দিন আগে যখন সে ছোট ছিল তখন একদিন দাদ ওকে বলেছিলেন, কলকাতায় যখন যাবে যোগ্যতা নিয়ে যাবে। প্রথম ডিভিশনে পাশ করলে নিশ্চয়ই যোগ্য হওয়া যায়। অনিমেষের মনটা এখন বেশ ভালো হয়ে গেল। স্বৰ্গছেঁড়ায় আসবার আগে সামান্য অস্বস্তি ছিল। মহীতোষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার পড়াশুনার খরচ যদি মহীতোষ না দেন তা হলে এ সি কলেজেই পড়তে হবে। মনেমনে একটা কুণ্ঠাও বোধ করছিল সে। সেই ঘটনার পর থেকে মহীতোষের সঙ্গে তার কথাবার্তা একদম হয় না বললেই চলে। জলপাইগুড়িতে তিনি কদাচিৎ আসেন, এলে মুখোমুখি হল দুএকটা ছাড়া-ছাড়া কথা বলে মহীতোষ কৰ্তব্য শেষ করেন। ছোটমা এর মধ্যে যে-কবার এসেছেন তার বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাপের বাড়িতে। মহীতোষ ইদানীং ছোটমাকে। নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছেন। বাবাকে ও কিছুতেই নিজের বলে ভাবতে পারে না। আঘ, বাবার সেসব অভ্যেস কি চলে গেছে? জী জানি!
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল অনিমেষ, কানের কাছে বিকট আওয়াজে একটা হর্ন বেজে উঠতেই ভীষণরকম চমকে উঠল। সামলে নিয়ে ও দেখল একটা কালো গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হটা বেজেছে ওটাতেই। ঝুঁকে পড়ে ড্রাইভারকে দেখতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল সে। বত্রিশটা দাঁত বের করে বাপী স্টিয়ারিং-এ বসে হাসছে, চোখাচোখি হতে চেঁচিয়ে বলল, উঠে আয়। বাপী গাড়ি চালাচ্ছে-বুঝতে-না-বুঝতে অনিমেষ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। বেশ ঝকঝকে তকতকে গাড়ি তবে নতুন নয়।
বাপী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, তুই এখানে কী করছিলি?
অনিমেষ বলল, কুচবিহারের বাসে উঠে পড়েছিলাম। কিন্তু তুই-গাড়ি চালাচ্ছিস?
কেন? ভ্রূ তুলল বাপী, এটা আবার শক্ত কাজ নাকি!
কার গাড়ি এটা?
বীরপাড়ার খোকনদার। আমি মান্থলি সিস্মেমে চালাই। দুনম্বর পেট্রোল পেলে ভালো হয়, নাহলে এই ছয়-সাতশো টাকা মাস গেলে-তা-ই-বা কে দেয় বল!
বাপী ইঞ্জিন স্টার্ট করল। আরও বিস্ময়, অনিমেষ কোনোরকমে বলল, তুই ট্যাক্সি চালাস?
ইয়েস, প্রাইভেট। এই তো একজনকে বার্নিশে ছেড়ে এলাম।
বাপীর গাড়ি চলতে শুরু করলে অনিমেষ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ওর সমবয়সি একজন গাড়ি চালাচ্ছে-কীরকম চালায় কে জানে, যদি অ্যাক্সিডেন্ট করে। কিন্তু সে দেখল বাপীর গাড়ির চাকা একটু এপাশ-ওপাশ হচ্ছে না। আর মাঝে-মাঝেই ও এক হাত ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তমুখে বসে আছে-তার মানে বেশ পাকা ড্রাইভার। বাপীটা চিরকালই দুর্দান্ত, কিন্তু এইরকম হবে এটা কল্পনা করতে পারেনি সে। কিন্তু বাপীর তো এখনও আঠারো বছর হয়নি, তার আগে লাইসেন্স পাওয়া যায়। প্রশ্নটা করতেই বাপী গম্ভীরমুখে বলল, লাইসেন্স হয়ে গেছে। ডেট অভ বার্থ গণাদা ঠিক করে দিয়েছে। গণাদাকে চিনলি? আরে আমাদের এখানকার এম-এল-এ। ইলেকশনের সময় হেভি খেছিলাম তো ওর হয়ে, কমিউনিস্টরা শালা সব বোন্ড আউট হয়ে গিয়েছে। তা গণাদা দুই বছর ম্যানেজ করে লাইসেন্স বের করে দিয়েছে। আমার তো আর পড়াশুনা হল না।
পড়লি না কেন? অনিমেষ ওদের ছোটবেলার কথা ভাবল।
দুস! ওসব আমার আসে না। আর পড়েও তো টাকা রোজগারের ধান্দা করতে হবে। বিশুটা মাইরি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে এখন থেকে বাগানের চাকরির ধান্দায় লেগেছে। কত পাবে? বড়জোড় তিনশো, আমি পাচ্ছি ছয় সাত-ব্যস, আর কী চাই।
বিশ্ব সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে?
ঘাড় নাড়াল বাণী, ই। তারপর যেন মনে পড়ে যেতে জিজ্ঞাসা করল, তুই?
মুখ নামিয়ে নিমেষে বলল, ফার্স্ট ডিভিশন।
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে জবর ব্রেক কষল বাণী। মাথাটা অল্পের জন্য ইকে যাওয়া থেকে বেঁচে গেল, কিন্তু তার আগেই হইহই করে ওকে জড়িয়ে ধরল বাপী, আরে বাস, আগে বলিসনি-আমি জানতাম তুই ফার্স্ট ডিভিশন পাবি-উঃ কী আনন্দ হচ্ছে, আমাদের অনি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে! কথাগুলো বলতে বলতে সে টপাটপ চুমু খেতে লাগল অনিমেষকে। অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই মুখ সরিয়ে নিতে পারবে না অনিমেষ, ও বুঝতে পারছিল বাপীর উচ্ছ্বাসের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা নেই।
উচ্ছ্বাস কমে এলে বাপী স্টিয়ারিং-এ ফিরে গিয়ে বলল, তুই মাইরি বহুৎ বড়া অফিসার হবি, না? কলকাতায় পড়তে যাবি, না জলপাইগুড়িতে?
গম্ভীর গলায় অনিমেষ বসল, কলকাতায়।
কী কপাল মাইরি! কত সিনেমা-স্টার দেখবি-আঃ! নে সিগারেট খা।
এর মধ্যে ও কখন প্যাকেট বের করেছে দেখেনি অনিমেষ, এখন বাপীকে একটা কড়া সিগারেট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরতে দেখল। আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ, না, আমার ঠিক অভ্যাস নেই।
সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল বাপী, যা বাবা, তুই খাস না? একদম গুড বয়? আরে তুই এখন স্কুলবয় নস, কলেজে উঠেছিস-একটা সিগারেট খা ভাই। আমার হাতে হাতেখড়ি কর-চিরকাল তা হলে আমাকে মনে রাখবি। বেশ কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করতে অনিমেষ হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিল। ফস করে দেশলাই জ্বেলে নিজেরটা ধরিয়ে বাপী ওটা ধরিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। খুব আন্তে সিগারেটটায় টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল অনিমেষ। একটা কষা স্বাদ জিভটাকে ভারী করে তুলেছে। নাক দিয়ে ধোয়া বের করার সাহস ওর হচ্ছিল না। জানলার পাশে বসে ভুড়য়া নদীকে চলে যেতে দেখল এবার। বাঁক ঘুরতেই স্বৰ্গছেঁড়া। উত্তেজনায় জোরে টানতে গিয়ে ধোয়াটা পেটে ঢুকে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে খকখকে কাশি এস গেল ওর। দম বন্ধ হবার যোগাড়। সিগারেটটা রাস্তায় ফেলে দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিল না সে। ব্যাপার দেখে বাপী হেসে বলল, মাইরি অনি, তুই একদম গুড বয় হয়ে আছিস!
মুঠো খুললেই হাতের রেখার মতো পরিস্কার, বাঁক ঘুরতেই চা-বাগানের মাথা ডিঙিয়ে স্বৰ্গছেঁড়া চোখ পড়ল। চায়ের পাতা দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন িবশির করে অনিমেষের। একটু আগে আঙরাভাসার ওপর দিয়ে পার হবার সময় বাপী বলেছিল, জি স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে একটা দারুণ ব্যাপার হচ্ছে।
স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে কোনো দারুণ ব্যাপার ঘটলে সেটা যেন ঠিক মানায় না। চুপচাপ শান্তভাবে স্বৰ্গছেঁড়ার দিনগুলো কেটে যাবে-ভোরবেরায় ট্রাকটরগুলো শব্দ করে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে যোরাফেরা করবে, বলিরা দল বেঁধে পাতি তুলতে বা ঝাড়াই-বাছাই-এর কাজে ছুটতে, বাবুরা সাইকেলে হেলতে দুলতে ফ্যাক্টরি বা অফিসে যাবেন, আর তারপর গোটা দিন স্বৰ্গছেঁড়া দেয়ালা করে যাবে একা একা। বাণী বলল, আজ সেবার হরতাল করেছে-কেউ সকার থেকে বের হয়নি।
সে কী। ভীষণরকম চমকে গেল অনিমেষ। ওর চট করে সুনীলদার মুখটা মনে পড়ে গেল। এখানকার কলিকামিনদের সঙ্গে সুনীলদা এসে কিছুদিন থেকে গেছে। কিন্তু এ-জিনস স্বর্গহেঁড়ায়। কখনো হয়নি। দাদুর চলে যাওয়ার দিন যে-কুলিরা ওঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছিল তারাই আজ ধর্মঘট করছে-কিছুতেই মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। ও দেখল রাস্তার দুধারে আজ ছুটির দিনের দৃশ্য। কুলিলাইন থেকে বের হয়ে মেয়ে-পরুষ পিচের রাস্তায় দুপাশে বসে, দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অনিমেষ বলল, কী করে করল? কেন করল?
পি এস পি আর সি পি আই। মাইনে বাড়াবার জন্য, ভালো কোয়ার্টারের জন্য, আর কী কী যেন সব। গোলমাল হতে পারে আজ। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাপী কথা বলছিল। স্বৰ্গছেঁড়া টি এস্টেটের নেমপ্লেটটা চোখে পড়তেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিল বাপী, ঠিক অনিমেষদের বাড়ির সামনে সেটাকে দাঁড় করিয়ে বলল, বিকেলে বাজারে আসিস। কাল অনেক রাত অবধি খুব খাটুনি গেছে, এখন ঘুমোব।
দরজা খুলে অনিমেষ মাটিতে পা দিতেই ইউক্যালিপটাস পাতার তীব্র গন্ধ ভক করে নাকে লাগল। ও দেখল পাশেই একটা বাঁদরলাঠি গাছে বড়সড় শকুনকে ঘিরে কতকগুলো কাক খুব চিৎকার করছে। ও বাপীকে বলল, এত খাটিস না, মারা পড়বি।
বাপী গাড়ি চালিয়ে চলে যাবার সময় বলে গেল, দূর শালা! বিয়েবাড়ির খাটুনি, কাল এসে তোকেও খাটতে হত। আমাদের সীতাদেবীকে কাল হরধনু ভঙ্গ করে রামবাবু আজ নিয়ে যাচ্ছে। একরাশ ধোয়া ছেড়ে গাড়িটা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ পাথরের মতো রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
এখান থেকে সার-দেওয়া বাগানের কোয়ার্টারগুলো পরিষ্কার দেয়া যায়। মাঠ পেরিয়ে কাঁঠালিচাঁপা গাছটার পাশ ঘেঁষে সীতাদের কোয়ার্টারটাকে আজ একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। বেশকিছু মানুষ সেখানে জটলা করছে, ত্রিপল টাঙিয়ে অনেকখানি জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে। পাশেই একটা লরিতে পাট আলমারি তোলা হয়েছে, সেটার পাশ-ঘেঁষে কালো রঙের অস্টিন গাড়ি দাঁড়িয়ে। সীতার বিয়ে গেল। সংবিটা ফিরে আসতেই অনিমেষ বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করল। এই প্রথম ওর মনে হল কী-একটা জিনিস যেন হারিয়ে গেল, আর কোনোদিন সে ফিরে পাবে না। শেষবার-দেখা সীতার ঘুমন্ত জোরো মুখ, অদ্ভুত আড়াল রেখে কাছে টেনে নেওয়ার মতো কথা-অনিমেষ এই আসাম রোডের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করল সীতাকে ও ভালোবেসেছিল। ঠিক যেভাবে রম্ভা তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল কিংবা উর্বশীর চোখের চাহনিতে যে-আহ্বান ছিল এটা সেরকম নয়। সত্যি বলতে কী, প্রেম-ভালোবাসা ওর মাথায় কখনোই তেমন। জোরালোভাবে আসেনি, আর আসেনি বলে রম্ভাকে ওর ভালো লাগেনি একবিন্দু, উর্বশীর ব্যাপারে সে একটুও উৎসাহ পায়নি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ওর মনে হল সীতা ওকে ভালোবাসত এবং একটুও চিন্তা না করে তার মনের ভেতর সীতার জন্য একটা নিশ্চিন্ত জায়গা তৈরি করা ছিল যেখানে বাইরের কোনো সমস্যার আঁচ লাগার কথা কখনোই কল্পনায় আসেনি। সীতাটা চট করে বিয়ে করে ফেলল। ওর মা তো ওকে পড়া করাতে চেয়েছিলেন। তা হলে কি ও পড়াশুনায় ভালো ছিল না। সেই সীতা-ছোটবেলায় হাত ধরলে যে ভ্যা করে কেঁদে উঠত, কয় বছর আগে ওর সঙ্গে কথা বলার সময় যে-সীতা একদম নিজের অনুভূতি ওর মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে-তার বিয়ে হয়ে গেল! অথচ ও তো সীতাকে কখনো কোনো চিঠি লেখেনি, মণ্টুর মতো মুখ করে বলেনি, আই লাভ ইউ সীতা। তা হলে ওর বুকের ভেতর এরকম করছে কেন? সীতা কী করে জানবে অনিমেষের মনের মধ্যে এরকম ব্যাপার ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হল, সীতা জানত, নিশ্চয়ই জানত–অন্তত জানা উচিত ছিল। দুপাশের মরে শুনিয়ে-যাওয়া পাতাবাহারের গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটুতে হাঁটুতে ওর মনে হল, এই পৃথিবীতে তার জন্য কোনো ভালোবাসা অপেক্ষা করে নেই।
ক্লাবঘর বন্ধ। ওপরের খড়ের চাল এলোমেলো। ওদের কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এসে অনিমেষ একটু থমকে দাঁড়াল। এখন বাবার বাড়িতে থাকার কথা নয়। এই সময় ছোটমা নিশ্চয়ই জলখাবার খেতে ব্যস্ত। দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে দূর থেকে উলুধ্বনি ভেসে এল। যেন শুনতে চায় এইরকম ভঙ্গিতে জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগল।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। খিড়কিদরজার দিকে তাকাল অনিমেষ। বাইরে থেকে আঙুল ঢুকিয়ে একটু কায়দা করলে দরজাটা খোলা যেত, এখনও সেরকম আছে কি? সিড়ি দিয়েনিচে নামতে যাবে এমন সময় ও দেখল একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে আসছে ওর দিকে। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, আপনাকে ডাকছে।
কে?
অনিমেষ অবাক হল। ছেলেটির মুখ সে আগে দেখেনি, ওরা চলে যাবার পর নিশ্চয়ই ও হয়েছে। ছেলেটির বুক ওঠানামা করছিল, বলল, মাসিমা।
মাসিমা কো অনমেষদের কোয়ার্টারটা দেখাল সে। ছোটমা ওকে ডাকছে তা হলে। ছোটমা কোথায় আছে নিশ্চয়ই গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে ওকে। অনিমেষকেইতস্তত করতে দেখে ছেলেটি বলল, দিদিমাও আপনাকে বারবার করে যেতে বলল।
দিদিমা?
ওই যে, যার বিয়ে হচ্ছে তার দিদিমা। ছেলেটি বিজ্ঞের মতো হাসল এবার। এতক্ষণে অনিমেষের কাছে ব্যাপারটা দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছে। ওর মনের ভেতরে যে-অভিমানটা এতক্ষণ টলটল করছিল সেটা যেন চট করে গড়িয়ে গেল। সীতাদের বাড়িতে সে যাবে কেন? ওকে দেখে ছোটমা তো চলে আসতে পারত। এতদিন পর সে স্বৰ্গছেঁড়ায় আসছে, অথচ ছোটমা ওখানে বসে থাকল। ও ভাল ছেলেটিকে বলে দেয় যে সে যাবে না, কিন্তু তার আগেই ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আসছে।
একটু দ্বিধা করল অনিমেষ। এখন সে কী করবে? নিশ্চয়ই কেউ এসে বাইরে দাঁড়িয়েছে যাকে ছেলেটি জানান দিল। না গেলে ব্যাপারটা খুবই খারাপ দেখাবে। আর এই সময় ওর মনে হল, সীতাকে আর কোনোদিন সে দেখতে পাবে না। কনের বেশে সীতাকে দেখবার লোভ হঠাৎ ওর মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ব্যাগটা হাতে নিয়েই অনিমেষ ছেলেটির সঙ্গে মাঠে নেমে পড়ল। সীতাদের কোয়ার্টারের দিকে ঘুরতেই ও দেখতে পেল দূরে মাঠের ওপর নিজেদের বাড়ির সামনে একটি ছোট মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ঠাকুমা দাঁড়িয়ে আছেন। তার পেছনে ত্রিপলের তলায় লোকজন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনিমেষ ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে ঠাকুমাকে প্রণাম করল। উঠে দাঁড়াতেই খপ করে বুড়ি ওর হাত চেপে ধরলেন, রাগ করেছিস?
ভীষণ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। ঠাকুমা কী বলতে চাইছেন? ও না-বুঝে ঘাড় নাড়ল। কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাকুমা বললেন, পাশের খবর এসেছে?
ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।
ফাস্টো কেলাস?
হেসে ফেলল অনিমেষ, হ্যাঁ।
সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, মিষ্টি নিয়ে আয়, অ বউমা, কোথায় গেলে সব–আমার অনিবাব ফাস্টো ক্লাস পাশ করেছে। সে-বেটি থাকলে আজ কী করত–বলতে বলতে মুখটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল ঠাকুমার। কান্নায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, সীতুটাকে আজ পার করে দিল রে।
ভালোই তো, মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ, ভালোই তো। আপনি বলতেন, মেয়েদের জন্ম হয়েছে সংসার করবার জন্য।
ঠাকুমার পায়ে জোর নেই, বোধহয় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আর শরীরটাকে খাড়া রাখতে পারছিলেন। ওকে টলতে দেখে অনিমেষ একহাতে জড়িয়ে ধরে সামলে দিল। সেভাবেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তাই বলে ডবল বয়সের মানুষের সঙ্গে বিয়ে দেবে গো! আমরা কথা শুনল না—পাত্র অফিসার নাকি।
ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই পেছনের জটলা থেকে সীতার বাবা উঠে এসে তাঁকে ধরলেন, আঃ মা, কী বলছ তুমি! এখন এসব বলে লাভ আছে।
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন ঠাকুমা, কিন্তু তার শরীরটা কাঁপতে লাগল থরথর করে। সীতার বাবা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তুমি তো খুব বড় হয়ে গেছ, কদিন পরে তোমাকে দেখলাম। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছ? বাঃ বাঃ, বেশ! খুব ভালো হল আজকের দিনে এসেছ। যাও ভেতরে যাও।
ঠাকুমাই লেংচে লেংচে ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। ত্রিপলের তলার লোকগুলো ওর দিকে উৎসুক-চোখে তাকিয়ে আছে। ঠাকুমার কথাটা শোনার পর ভেতরে যাবার ইচ্ছেটাই উবে গিয়েছিল। এই বিয়ে কি সীতার বাবা জোর করে দিয়েছেন? ওর খেয়াল হল, বিয়ের ব্যাপারে মতামত দেবার বয়স সীতার এখনও হয়নি। হলে পরে কি সীতা প্রতিবাদ করত?
চা-বাগানের বিয়েবাড়িতে আতিশয্য তেমন হয় না। জলপাইগুড়ি শহরে বন্ধুদের দাদা-দাদির বিয়েতে গিয়ে অনিমেষ মাঝে-মাঝে সানাই বা মাইক বাজতে দেখেছে, মেয়েরা ছুটোছুটি করে বিয়েবাড়ি জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু চা-বাগানের আচার-অনুষ্ঠান পালন হয় আন্তরিকভাবে, কিন্তু বিয়েবাড়ির চটক তেমন থাকে না। সাধারণত কোয়ার্টারের ভেতরে যে উঠোনমতো জায়গা থাকে সেখানেই অনুষ্ঠানটা হয় আর অসমবয়সি মেয়েরা আচার খাওয়ার মতো রসিয়ে রসিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানটা সম্পন্ন করায়। অনিমেষ দেখল ঠাকুমা ওকে ঘর পেরিয়ে উঠোনে নিয়ে যাচ্ছেন।
ভেতরে পা দিতেই আবার উলুধ্বনিটা কানে এল। কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে ঠাকুমা চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলেন। ততক্ষণে ওরা ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে গেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে উঠোনে নজর পড়ল অনিমেষের। ঠিক মধ্যিখানে চারদিকে চারটে কলাগাছ পুঁতে মাঝখানে বর-বউ বসে আছ। তাদের ঘিরে মেয়েদের জটলা। ছোটমাকে দেখল অনিমেষ, সীতাকে জড়িয়ে ধরে কিছু-একটা করছেন। ওকে দেখে হাসবার চেষ্টা করলেন। সীতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। একটা জবুথবু কাপড়ের পুটলির মতো দেখাচ্ছে সীতাকে। মাথা নিচু, বেনারসি কাপড়ের পাড়টা চকচক করছে। সীতার মাথার মুকুট এখন বর্শার ফলার মতো তার দিকে তাক করা। মুখটা দেখতে পেল না অনিমেষ। সীতার পাশে যিনি বসে আছেন তাকে বেশ শক্তসমর্থ, বলে মনে হল ওর। নিশীথবাবুদের বয়সি হবেন বোধহয়। ঠাকুমার হাঁকডাকে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ মোটা গোঁফ আছে সীতার বরের! ঠাকুমার ডাকে সীতার মা আড়াল থেকে ঘোমটা-মাথায় বেরিয়ে এলেন। এক পলক দেখেই অনিমেষ বুঝে ফেলল উনি একটু আগেও খুব কাঁদছিলেন। সীতার। মা এসে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আর-একজনের হাতে দিয়ে বললেন, কী ভালো লাগছে আজ তুমি এসেছ! সীতা বারবার তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করছিল তুমি আসবে কি না। অনিমেষ মাথা নিচু করল। ওর হঠাৎ খেয়াল হল পাশের খবর দিয়েছে যখন তখন এঁদের প্রণাম করা উচিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর সীতার বরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতেই ও মত পালটে ফেলল। ঠাকুমা ততক্ষণে ওর ফার্স্ট ডিভিশনে পাশের খবর, ওর মতো ভালো ছেলে হয় না, পনেরোই আগস্ট স্বৰ্গছেঁড়ার সমস্ত ছেলের মধ্যে থেকে শুধু ওকেই পতাকা তুলতে দেওয়া-এইসব সাতকাহন পাঁচজনকে গর্ব করে শোনাচ্ছেন।
অনিমেষ সীতার ওপর চোখ রেখেছিল। ও দেখল সে এসেছ, সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুনেও সীতা একবারও মুখ তুলে ওকে দেখল না। সীতার মা বললেন, জানিই তো, ও ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ না করলে কে করবে! তুমি বসো, এখন তো কলকাতায় পড়তে যাবে, আর কবে পেটভরে খাওয়াবার সুযোগ পাব জানি না।
উনি দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে অনিমেষ দেখল বিয়ের বরকনেকে ছেড়ে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে ঠাকুমা ওকে টানতে টানতে উঠোনে নামিয়েছেন, বিয়েতে এলি না তো কী হয়েছে, বাচিবিয়েতে এলি এই ভাগ্যি। নে আমাদের জামাইকে দ্যাখ। ওগো নাতজামাই, এই যে ছেলেটাকে দেছি, ভীষণ বিদ্বান। তোমার বউ-এর সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলা করত। ভদ্রলোক এমনিতে খুব অস্বস্তি নিয়ে বসেছিলেন, কথাটা শুনে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে নমস্কার করলেন। এতবড় লোক তাকে নমস্কার করছে দেখে হকচকিয়ে অনিমেষ হাতজোড় করতেই ঠাকুমা হেসে ফেললেন, ওমা, এইটুকুনি ছেলেকে নমস্কার করছ কী গো! এই সময় সীতার পাশে বসে-থাকা ছোটমাকে বলতে শুনল অনিমেষ, আমার ছেলে।
ভদ্রলোক আবার হাসলেন, হাসিটা ভালো লাগল না অনিমেষের। কেমন বোকাবোকা। ঠাকুমা আবার ডাকলেন, ও হুঁড়ি, দ্যাখ কে এসেছে! লজ্জায় মাথা যে মাটিতে ঠেকল, আমাদের যেন আর কোনোদিন রে হয়নি!
একটু একটু করে মুখ তুলল সীতা। বেনারসি, মুকুট আর ওড়নার চালচিত্রের সামনে সীতার মুখটা ঠিক দুর্গাঠাকুরের মতো দেখাচ্ছে। বুকের মধ্যেটা হঠাৎ থম-ধরা দুপুর হয়ে গেল অনিমেষের, সীতার দুই চোখের পাতা শ্রাবণের আকাশ রয়েছে। অথচ কী সহজ গলায় সীতা কথা বলল, তোমরা নাড় গোপালকে না খাওয়াও ঠাকমা।
কথা শেষ হতেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ফেলল সীতা। চোখে জল না এনে বুকভরে কেঁদে যাওয়া যায়–অনিমেষ সেইরকম কাঁদতে কাঁদতে সীতার চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়াল। প্রচণ্ড দুঃখের মধ্যে হঠাৎ একধরনের সুখ মানুষ পেয়ে যায়। অনিমেষের মনে হল বিয়ের খবরটা কানে যেতেই ওর বুকের মধ্যে যে-ইচ্ছেটার খবর ও পেয়েছিল, এই মুহূর্তে সীতা সেটাকে আসনে বসিয়ে দিল। পায়েপায়ে বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। বাসিবিয়ে আশীর্বাদ বোধহয় বাবা এসে তাড়া দিলেন, ওদের যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে!
মিষ্টিমুখ না করে সীতার মা ছাড়লেন না। এদিকে মেয়ে-জামাই চলে যাবে-বাড়িসুদ্ধ সেসব ব্যাপারে ব্যস্ত ছিল। এ-বাড়িতে অনিমেষের এখন কেমন একলা একলা লাগতে শুরু করল। কন্যাযাত্রীদের খাওয়াদাওয়া আগেই চুকে গিয়েছিল। জামাই যেতে বসেছে। সীতাকে খাওয়ানোর জন্য জোর চেষ্টা চলেছে, সে খাবে না। এলোমেলো একটু ঘুরে ওর মনে হল এখন এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়াই ভালো। ঠিক এই সময় ছোটমা ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে কাছে এল, চলো, এখন বাড়ি যাবে তো? ঘাড় নেড়ে ব্যাগটা ওর হাত থেকে নিয়ে অনিমেষ ছোটমার সঙ্গে বেরিলে এল। ছোটমা মাথায় অনেকখানি ঘোমটা টেনে দিয়েছে, চওড়া-পেড়ে টাঙাইল শাড়িতে ছোটমাকে চমত্তার দেখাচ্ছে। ওর হঠাৎ মনে হল, ছোটমা তেমনি রোগাই আছে।
বাইরে আর-একটা গাড়ি এসেছে মেয়ে-জামাইকে নিতে। লরিতে মালপত্র তোলার কাজ শেষ। ওরা চুপচাপ মাটে নেমে এল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছোটমা বলল, তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ, আর কী লম্বা! অনিমেষ হাসল। ছোটমা আবার বলল, সীতাটা খুব ভালো মেয়ে ছিল, না?
ছিল বলছ কেন? অনিমেষ কথাটা ধরে দিতে চাইল।
বিয়ে হলে মেয়েদের পুনর্জন্ম হয়। তারপর একটু থেমে বলল, আমার ওপর তোমার রাগটা করেছে?
অনিমেষ মুখ তুলল, রাগ করতে যাব কেন খামোকা?
তা হলে নিজের মুখে আমায় তোমার পাশের খবর দিলে না কেন?
অনিমেষ দেখল ছোটমার মুখটা কেমন হয়ে গেল। ও তাড়াতাড়ি বাল, ঠাকুমা বললেন তাই ভাবলাম শুনেছ। সবাই তো ফার্স্ট ডিভিশন পায়-নতুন আর কী!
ইস, বেশি বেশি! তোমার বাবা শুনলে ভীষণ খুশি হবেন। কদিন থেকেই খবরটা শোনার জন্য ছটফট করছেন। এবার কলকাতায় যাবে তো, দিন ঠিক হয়েছে?
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির সামনে চলে এসেছিল। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল,, বুধবার।
বারান্দায় উঠে ছোটমা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর চট করে ডান হাতের মধ্যমা থেকে একটা আংটি খুলে অনিমেষের বাঁ হাতটাকে ধরে ফেলল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই ছোটমা আংটিটা ওর বাঁ হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিল, অনিমেষ, আমি তো হাজার হোক তোমার মা, তোমাকে কোনোদিন কিছু দিতে পারিনি-এইটে কখনো হাত থেকে খুলবে না, কথা দাও।
হাতটা মুখের সামনে তুলে ধরতেই অনিমেষ দেখল চকচকে নতুন সোনার আংটির বুকে বাংলায় অ অক্ষরটা লেখা রয়েছে। তার মানে ছোটমা তাকে দেবে বলেই আংটিটা করিয়ে রেখেছিল। অনিমেষের বুকটা ভার হয়ে গেল, কোনোরকমে সে বলল, তুমি জানতে আমি ফার্স্ট ডিভিশন পাব।
আস্তে-আস্তে ছোটমা বলল, আমি রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম যে!
ব্যাগটা মাটিতে রেখে অনিমেষ ছোটমাকে প্রণাম করল। খুব শান্ত হয়ে প্রণাম নিয়ে অনিমেষের নত মাথায় নিজের দুই হাত চেপে ধরল ছোটমা।
চাবি বের করে যখন অনিমেষকে দরজা খুলতে বল। ছোটমা, ঠিক তখন পেছনে সাইকেলের আওয়াজ হল। এতদিন কড়ায় তালা লাগানো হত, অনিমেষ–তালাটাকে আগে দেখেনি। সাইকেলের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, মহীতোষ নামছেন। চোখাচোখি হতেই মহীতোষ যেন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। সাইকেলটাকে রেখে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এলেন কথা না বলে। অনিমেষ দেখল বাবার চেহারাটা কেমন বুড়ো বুড়ো হয়ে গিয়েছে, একটু রোগা লাগছে। সিড়ির ধাপে পা দেবার আগেই অনিমেষ দ্রুত নেমে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি।
কথাটা শুনেই মহীতোষ দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবার মাথা তার সমান, আলিঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল। মহীতো ওকে জড়িয়ে ধরে ওপরে উঠে এলেন, খোকাকে খেতে দাও।
চটপট অনিমেষ বলল, আমি খেয়েছি।
এই সময় একটা কান্নার রোল উঠল সীতাদের বাড়িতে। ওরা তাড়াতাড়ি বাইরে এগিয়ে এসে দেখল প্রথমে কালো গাড়ি, পেছনে লরিট। সীতাদের বাড়ি ছেড়ে এগিয়ে আসছে। সীতার ঠাকুমা মা প্রচণ্ড জোরে কেঁদে-কেঁদে উঠছেন। সীতার বাবাকে চোখে পড়ল না। গাড়ি যখন ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তার দিকে বাঁক নিচ্ছে, ঠিক তখন অনিমেষ সীতাকে দেখতে পেল। জানলার ধারে গাল চেপে সীতা একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এত দূর থেকেও সীতার চোখ থেকে জল গড়াতে দেখল অনিমেষ।
মহীতোষ হঠাৎ বলে উঠলেন, ভাগ্যিস আমাদের মেয়ে নেই। তারপর ছেলে আর স্ত্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন, দাদু ভালো আছেন?
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
তোমার খবরে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন। ওঁর জন্যেই এটা সম্ভব হল। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, অনিমেষ, এখন তুমি বড় হয়েছ। আমরা তো ভগবান নই, অনেক সময় অনেক ভুল করি-সেগুলো মনে রেখো না। সুখ পাওয়া ভাগ্যের কথা, কিন্তু তাই বলে দুঃখের কথা মনে রাখলে শুধু কষ্ট পেতে হয়।
অনিমেষ কিছু বলল না। বাবা কী বলতে চাইছেন সে বুঝতে পারছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সেব কথা তার মনে এক আসছে না। সীতার চোখ দুটো মন থেকে সরাতে পারছিল না সে। ও দেখল, গাড়িগুলো ধূপগুড়ির রাস্তায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে মহীতোষ বললেন, ওহহো তোমরা তাড়াতাড়ি করো, বাগানের লেবাররা খুব খেপে গেছে আমরা কাজ করেছি। বলে, ওরা এখানে হামলা করতে আসতে পারে।
ছোটমা আঁতকে উঠে বলল, সে কী! কী হবে তা হলে?
মহীতোষ বললেন, জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। বাজারের সত্য সেনের বাড়িতে তোমাদের রেখে আস;। গোলমাল মিটে গেলে আবার ফিরে আসবে।
ছোটমা দৌড়ে দরজা খুলতে গেল। এই সময় অনিমেষ দেখল, কিছু কুলিকামিন হইহই করতে করতে ফ্যাক্টরির দিকে ছুটে যাচ্ছে আসাম রোড দিয়ে। নিজের শরীরের মতো পরিচিত স্বৰ্গছেঁড়ায় এধরনের ঘটনা ঘটতে পারে-একদম বিশ্বাস হচ্ছিল না অনিমেষের। এই মুহূর্তে ওর চোখের সামনে। সীতা নেই।
ভেতরে থেকে মহীতোষের গলা ভেসে গেল, অনিমেষকে ডাকছেন। অনিমেষ সাড়া দিয়ে দেখল, চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথ দিয়ে সাইকেলগুলো দ্রুত মাঠের দিকে ছুটে আসছে। টাইপবাবু, ডাক্তারবাবু, পাতিবাবু, মশাবাবুরা জোরে জোরে প্যাডেল ঘুরিয়ে যে যার কোয়ার্টারের দিকে চলে যাচ্ছেন। মনোজ হালদারকে চিনতে পারল অনিমেষ, সেইরকম চেহারা আছে এখনও, নিজের কোয়ার্টারের দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ সাইকেল ঘুরিয়ে সীতাদের কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সীতার বাবাকে ওঁদের গেটে দেখতে পেল অনিমেষ। মাথা নেড়ে কিছু কিজ্ঞাসা করে চ্যাঁচামেচি করে বাড়ির লোকদের কিছু বলতে লাগলেন। এই সময় আরও কিছু লেবারকে পতাকা-হাতে লাইন থেকে ছুটে আসতে দেখল অনিমেষ। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ হইহই করতে করতে চা-বাগানের নুড়িবিছানো পথটায় ঢুকে যাচ্ছে। এবং অনিমেষ অবাক হয়ে শুনল কেউ-একজন চিৎকার করে উঠতেই বাকিরা জানান দিল, জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বলার ধরনটা শহরে-শোনা ধ্বনির মতো নয়, এবং বেশ মজা পেয়ে গেছে ওরা–ভাবভঙ্গিতে তা-ই মনে হল। ওরা চলে যাওয়ার পর অনিমেষ দেখল আসাম রোডের ওপারে মাড়োয়ারি দোকানের ঝাঁপ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।
অনিমেষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। এই শান্ত সরল মানুষগুলো হঠাৎ একম খেপে গেল কেন? ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে বাবুদের দেখলে এরা কেনোর মতো গুটিয়ে যায়, বাবুদের কোয়ার্টারের ছেলেকে কাজে লাগাতে পারলে ধন্য হয়, তারাই এখন খেপে গেল কেন? আর বাবুদের তো এমন ভয় পেতে দেখেনি ও! লোকগুলো কী চাইছে? টাকাপয়সা-খাবারদাবার? ওর মনে পড়ল সুনীলদা বলেছিল পৃথিবীতে দুটো জাত ছে, একদল হল সর্বহারা, অন্যদল বুর্জোয়া। বুর্জোয়া মানে যার সব আছে, কিন্তু সামান্য কিছু হারাবার ভয়ে যে অনেক বেশি সর্বহারাদের কাছে আদার করে। তা হলে এই লেবারগুলো সর্বহারা? কিন্তু ওর মনে হল বাবা এবং অন্য বাবুরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন। এরা আর যা-ই হোক, এই কোয়ার্টারগুলোতে এসে হামলা করবে না। কখনো কোনো মদেসিয়া ওঁরাওকে ও অভদ্র হতে দেখেনি, হাড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে গেলেও না। অনিমেষ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোয়ার্টারগুলোকে ভালো করে দেখল। সবকটার দরজা বন্ধ। আসাম রোড দিয়ে হুশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল স্বৰ্গছেঁড়ার চেহারাটা যেন অনেকখানি পালটে গেছে। এই মাঠের মধ্যে দাঁড়ানো গাছ দুটো কেমন শীর্ণ, পাতাবাহার গাছগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে, বৈশাখমাসের শেষে প্রখর রোদে প্রখর রোদে স্বৰ্গছেঁড়া এখন পুড়ছে। অথচ চিরকাল এখানে একটা ঠাণ্ডা ভাব থাকত, এই সময় ভুটানের পাহাড় থেকে মেঘগুলো বৃষ্টি নিয়ে আসত।
কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে এল অনিমেষ। আর বাবা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং এই প্রথম ওঁর মুখে সে খোকা ডাকটা শুনতে পেল। অন্য সময় হয়তো খোকা শুনলে তার হাসি পেত, কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর ডাকটা ভালো লেগেছিল। এখান থেকে চাল যাওয়ার পর থেকে বাবার সম্পর্কে ওর মনে যে-দৃণা এবং তিক্ততা বাসা বেঁধেছিল, এই মুহূর্তে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাবা যেন আমূল পালটে গেছেন। শুধু তার সঙ্গেই নয়, ছোটমার সঙ্গেও বাবা কী ভালো ব্যবহার করছেন। মহীতোষের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকার সময়কার অস্বস্তিটা ওর মনে আবার এল। বাল্যকাল থেকে এ-পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। কীসব যে চটপট হয়ে যায়! যাকে দেখতে আজ খারাপ লাগল, কাল হয়তো সেটা অন্যরকম হতে পারে।
আশ্চর্য, বসার ঘরটা ঠিক সেইরকম আছে! এই যে এতগুলো বছর কেটে গেল, এই ঘরটার ওপর তার কোনো ছাপ পড়েনি। শুধু সোফার ওপর কভারগুলো এখন পালটে গেছে এবং-। অনিমেষ। পায়েপায়ে সোফার পাশে দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে তার চার-পাঁচ বছরের মুখটা হাসছে। কী ভীষণ দুই-দুই লাগছে চোখ দুটো। নিজের যে এরকম একটা। ছবি আছে একদল জানা ছিল না, অনিমেষ দেখল এই এত বছর হয়ে গেল, তার মুখ খুব সামান্যই পালটেছে। এই ছবি আগে এখানে ছিল না। বাবা নিশ্চয়ই নতুন করে বাঁধিয়ে এখানে টাঙিয়েছেন। কবে থেকে? অনিমেষের সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
মাঝের ঘরে পা দিতেই অনিমেষ দেখল বাবা দ্রুত জানলাগুলো বন্ধ করছেন, ছোটমা উবু হয়ে বসে সুটকেসে কীসব ভরছে। ওকে দেখে ছোটমা বলল, তুমি এতদিন পর এলে, আর কী হাঙ্গামায় পড়তে হল বলো তো?
অনিমেষ বলল, কিন্তু এখানে গোলমাল হবে কেন?
মহীতোষ বললেন, লেবাররা স্ট্রাইক কল করেছিল যখন তখন আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। আজ যেহেতু আমরা অফিসে গেছি, ওরা খেপে গেছে। স্ট্রাইকটো যে আমাদের নয় সেটা ওরা বুঝতে চাইছে না।
অনিমেষ বলল, আমাদের বাগানের কুলিরা এমন করবে কোনোদিন কেউ কল্পনা করতে পারিনি!
মহীতোষ বিরক্ত হয়ে বললেন, ওদের দাবিগুলো ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে কোনো কাজ হয় না। জলপাইগুড়ি থেকে লোক এসে রাতদিন তাতিয়ে এই কাণ্ড করেছে, তারপর আমাদের জুলিয়েনবাবু আছেন-তিনিই তো এখন ওদের নেতা।
জুলিয়েন? প্রশ্নটা করেই অনিমেষ ভাবল, বাবা কি সুনীলদাকে চেনেন?
বকু সর্দারের ছেলে। তোর দাদুর পেছনে যে-বকু সর্দার দিনরাত ঘুরে বেড়াত। বকুটা,মরে গেছে, ওর ছেলে হল এদের পাণ্ডা। আবার মজা হল জুলিয়েন কিন্তু নিজে লেবার নয়, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টোরকিপার-ছোট মালবাবু। কোম্পানি এখন মদেসিয়াদের বাবুদের চাকরিতে গেলেন।
কুলিদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে ওঁরা এবং বোনাই যাচ্ছে, বাগানের সাই: কোয়ার্টার ছেড়ে বাজারে দিকে চলে যাবে। যেহেতু বাজার-এলাকাটা চা-বাগানের আওতায় পড়ে না, তাই সেখানে গেলে কুলিরা হামলা করতে পারবে না। এতদিন ধরে যে-মানুষগুলোকে দিনরাত চোখের ওপর দেখে আসছেন এই বাগানের বাবুরা, আজ যেন আর তাদের বিশ্বাস করতে পারছেন না অথচ মজার ব্যাপার, দুদলই এই বাগানে কী। বিলেতে বসে কলকাতার অফিসের মাধ্যমে কোম্পানি এই বাগানের ওপর কর্তৃত্ব করছে এবং তার সরাসরি দায়িত্ব ম্যানেজারের ওপর। কুলিরা দাবিদাওয়া মানেজারকে জানিয়েছে, ম্যানেজার সেটা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। যতক্ষণ কোনো সিদ্ধান্ত না হবে ধর্মঘট চলবে! ম্যানেজার সকাল থেকে তার বাংলোর সামনে একগাদা সিকিউরিটির লোক বসিয়ে রেখেছেন-সবাই জানে সাহেবের কাছে দুটো বন্দুক আছে। ওখানে হামলা সহজে হবে না। কিন্তু কুলিরা বাবুদের কাজে যাওয়াটা মানতে পারছে না। জুলিয়েন নিজে আজ কুলিদের সঙ্গে আছে। যদিও বাবুদের ইউনিয়ন আলাদা, তবু কুলিদের রাগ ওঁদের ওপরই পড়েছে। এতদিন ধরে যা-কিছু হুকুম ওরা পেয়েছে তা বাবুদের কাছ থেকেই, ম্যানেজারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ওদের হয় না। জলিয়েন ওদের পরিষ্কার করে না বললেও ওদের বুঝতে কষ্ট হয়নি, যা-কিছু অত্যাচার তা এই বাবুদের মাধ্যমেই সাহেব করেছেন। তাই আজ বাবুরা কাজে গিয়েছে খবর পেয়ে দলেদলে লোক ছুটছে ফ্যাক্টরির সামনে।
মহীতোষদের ডেকে ম্যানেজার আগাম খবরটা দিয়েছেন। সাদা-চামড়ার এই সাহেব উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলোয় স্কটিশদের শেষ প্রতিনিধি। এখন ভালো হিন্দি বলতে পারেন ভ্রলোক। অত্যাচারী বলতে যা বোঝায় মহীতোষরা একে সেরকম মনে করেন না। অবশ্য সাহেবের একটা নিজস্ব গোয়েন্দাবাহিনী আছে, যারা ওঁকে এই চা-বাগানের সব খবর আগাম এনে দেয়। তাই সাহেব যখন মহীতোষের ডেকে কুলিদের সম্ভাব্য আক্রমণের কথা বলছিলেন তখন চট করে কেউ বিশ্বাস করতে গারিননি। এতদিনের পরিচিত মুখগুলো, যারা সাত চড়েও রা কাড়ে না, তারা আজ আক্রমণ করবে ভাবতে পারছিলেন না। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে তারা খবর পাচ্ছিলেন, বিভিন্ন পার্টির লোক এসে লাইনে-লাইনে কুলিদের তাতাচ্ছে কিন্তু কেউ সেটায় তেমন গা করেননি। দীর্ঘকাল ধর্মঘট বা আন্দোলন চালাবার মতো মানসিক এবং আর্থিক ক্ষমতা এদের নেই-এটা সবাই জানে না। এই চা-বাগানে যে-সমস্ত কুলিকামিন কাজ করে তাদের বেশির ভাগ হপ্তায়-হপ্তায় টাকা পায়। যদিও একটা পরিবারের একদম শিশু ও বৃদ্ধ ছাড়া ছেলে মেয়ে বাবা সবাই কাজে আসে, কিন্তু হপ্তার টাকা পেলে সেটা ঘরে পৌঁছায় খুব সামান্য। স্বৰ্গছেঁড়ার চৌমাথায় বিরাট ভাটিখানা তো আছেই, শনিবার রাত্রে জুয়োর বোর্ড বসে যায় ডব্লিউ-এর শেষে। ডব্লিউ হল ছোট ছোট বাজার-কিন্তু তারপর জুয়াড়িয়া না এসে সেখানে ফাঁদ পাতে অনেক রাত পর্যন্ত পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে। কুলিরা যে-টাকা রোজ হিসাবে পায় কামিনরা পায় তার অর্ধেক। এই টাকা হাতে এলেই এদের মেজাজ হাড়িয়া না হলে শান্ত হয় না। ফলে দুদিন যেতে-না-যেতে ধারের মাত্রা বাড়তে থাকে।
এইরকম অর্থনৈতিক অবস্থা যাদের, যারা ম্যানেজার তো দূরের কথা–বাবুদের দেখলেই হাতজোড় করে অনুগ্রহের আশায় দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা নিচু করে, তাদের কোনো পলিটিক্যার পার্টির লোক খ্যাপালেও কোনো কাজ হবে না এই বিশ্বাস সকলের ছিল। কিন্তু কদিন থেকে উত্তেজনা চরমে উঠে আজ সকালে যখন মহীতোষরা ফ্যাক্টরিতে এলেন তখন দেখলেন একটা লোক নেই ধারেকাছে, আংরাভাসার বুকে হুইলটা পর্যন্ত ঘুরছে না। নিঝুম হয়ে আছে স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের ফ্যাক্টরি এবং অফিস। দু-একজন যারা ভয়েভয়ে এসেছিল, গতিক সুবিধের নয় বলে গা-ঢাকা দিয়েছে। ফাঁকা ফ্যাক্টরিতে থাকতে ওদের অস্বস্তি হচ্ছিল, এমন সময় সাহেব তার কোয়ার্টারে বাবুদের ডেকে পাঠিয়ে আক্রমণের সংবাদ দিলেন। ডাক্তারবাবু কথাটাকে একদম নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, কুলিরা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। আজ এত বছর তাকে দেবতার মতো মেনে এসেছে, এখন ওঁর গায়ে হাত তুলবে? অসম্ভব! কিন্তু সাহেব বললেন, যেহেতু দেশ এখন স্বাধীন। হয়েছে আর তার নিজস্ব ক্ষমতা নেই, তাই সেরকম কিছু হলে তিনি বাবুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেন না। সেজন্য তিনি ওঁদের বিশ্বস্ত আনুগত্যের কথা স্মরণ রেখে আগাম খবরটা জানিয়ে দিচ্ছে এবং যদি সম্ভব হয় বাবুরা যেন এখনই কোনো নিরাপদ জায়গায় সাময়িকভাবে চলে যান। গোলমাল মিটে গেলে সাহেব আশা করেন যে তারা কাজে যোগ দেবেন এবং এই আনুগত্যের কথা সাহেব তার সুপরিশসহ কোম্পানিকে জানিয়ে দেবেন। একথা শোনার পরই ওঁরা যে যার কোয়ার্টারে ফিরে এসেছেন।
মহীতোষের অবশ্য মাথায় আর-একটা চিন্তা ছটফট করছিল। স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরিয়ে
গেছে। অনিমেষ হয়তো আজই স্বৰ্গছেঁড়ায় আসবে। ছেলে যদি পাশ না করতে পারে তার বলার কিছু নেই। কারণ মাধুরী চলে যাওয়ার পর তিনি একমাত্র টাকা পাঠানো ছাড়া ওর প্রতি কোনো কর্তব্য করেননি। তা ছাড়া কোনোকালেই তিনি ছেলেকে কাছে ডেকে নিজের করে নিতে পারেননি। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিবাহের পর থেকে তার মধ্যে ছেলের সম্পর্কে একটা অস্বস্তি এমন দানা বেঁধেছিল যে, ভালোভাবে কথা বলতে যেন কিসে বাধত। তারপর সেই বীভৎস দিনগুলো। সন্তানের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে কোনোদিন ব্ৰিত করেনি, বরং তিনিই এরকম কিছু হোক চেয়েছিলেন। এ-পক্ষের ছেলেমেয়ে এলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে–সংসারে জড়েয়ে পড়লে অনেক অস্বস্তি কেটে যাবে, এইরকম একটা ধারণা মাথায় ঢুকে যাওয়ায় সেই অশান্তির সময়টা চলে এল। ওষুধপত্র, টোটকা, মাদুলি-কিছুতেই যখন স্ত্রী পুত্রবতী হল না, তখনই যোগাযোগ হল অধর তান্ত্রিকের সঙ্গে। তিনদিন তিনরাত সরুগার শ্মশানে ওঁর সঙ্গে বসে কারণ পান করার পর হঠাৎই তার মনে হল তিনি অত্যন্ত অন্যায় করেছেন। এই স্ত্রীকে বিবাহ এবং সন্তান কামনা করে তিনি মাধুরীর প্রতি চূড়ান্ত অসম্মান দেখিয়েছেন। ফলে সন্তান–ইচ্ছা চট করে মিলিয়ে গেল-তান্ত্রিক তাকে শেখালেন কী করে মৃত মাধুরীর আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অদ্ভুত গোরের মধ্যে কেটে গেল দিনগুলো। এখনও সব ব্যাপার স্পষ্ট করে মনে পড়তে চায় না। তান্ত্রিক বাড়িতে এসে নিয়মিত দক্ষিণা নিয়ে যেত। সেই সময় মুখ গু৭জে কাজ করে গেছে এই স্ত্রী, ঝাড়িকে বাড়ি থেকে তিনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। জলপাইগুড়িতে গেলে ছটফট করতেন কতক্ষণে স্বৰ্গছেঢ়ায় ফিরে আসেন। মাধুরীর দেখা তিনি পেতেন কি? কেমন অস্পস্ট ধোঁয়াটে একটা ধারণা তার এখনও আছে যে অধর তান্ত্রিক মাধুরীর মুখোমুখি ওঁকে করিয়ে দিয়েছিলেন একদিন। মাধুরীকে খুব দুখি-দুখি মনে হয়েছিল সেদিন। অধর তান্ত্রিক বলেছিল, তার সন্তানকামনাই মাধুরীকে দুঃখী করেছে।
তারপর সেই রাত এল। তিনি অনিমেষকে কী বলেছিলেন খেয়াল নেই, শুধু মনে আছে অনিমেষ ওঁকে ঠেলে দিয়েছিল। যখন জ্ঞান এল তিনি দেখলেন মাথায় ব্যান্ডেজ, সমস্ত শরীর দুর্বল তিনি কিছুই চিন্তা করতে পারছেন না। ছেলে জলপাইগুড়ি ফিরে যাওয়ায় সময় তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন তাকে বলে দিতে যে সরিৎশেখর যেন এসব ঘটনার কথা জানতে না পারেন। ছেলের কারণেই তিনি আঘাত পেয়েছেন মাথায় এই বোধ হতেই চট করে গুটিয়ে গেলেন মহীতোয। অনিমেষ কথা রেখেছিল, তার কারণ এর পর কতবার তিনি জলপাইগুড়ি গিয়েছেন, সরিৎশেখর এসব ব্যাপারে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। অনিমেষ সম্পর্কে যেটুকু আড়ষ্টতা ছিল মনেমনে, সেটা যেন এই ঘটনার পর লজ্জায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। নিজের তৈরি-করা বেড়াটা আর কখনো তার পক্ষে ডিঙানো সম্ভব হল না।
বিছনায় শুয়ে থাকার সময়ই বাড়ি এই বাড়িতে ফিরে এল। ওঁর অবস্থা দেখে সে চিৎকার কান্নাকাটি করে অধর তান্ত্রিককে গালাগালি করতে লাগল। তিনি দেখলেন ঝাড়ি যেন হঠাৎ অসমসাহসী হয়ে এ-বাড়ির ভালোমন্দ দেখাশুনা করছে। সুস্থ হয়ে শুনলেন অধর তান্ত্রিক আর সরুর্গার শ্মশানে নেই, কিছু লোক এক রাত্রের অন্ধকারে সেখানে গিয়ে মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এত ব্যাপার ঘটে গেল অথচ তার স্ত্রীর যেন কিছুতেই কোনো বিকার নেই। খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে সে-তুলেও আর ওই সময়ের কথা উচ্চারণ করে না।
আজ বাড়ি ফিরেছিলেন একটা উত্তেজনা নিয়ে। ফিরে এসে পুত্রকে দেখে ওঁর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। অথচ কিছুই বলতে পারলেন না। এমনকি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরার সময় তার মনে হয়েছিল এ যেন তার সন্তান নয়। যৌবনে এসে-পড়া একটা প্রায় পূর্ণ শরীর, যার গোঁফের রেখা স্পষ্ট, গালে সামান্য ব্রন, মাথায় যে তার সমান-তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেও দীর্ঘ দূরত্নের বলে বোধ হচ্ছিল। একমাত্র বুকের ভেতর ছাড়া সন্তান কখনো চিরকাল পরিচিত থাকে না-অনিমেষ তো হবেই। কিন্তু কী খেয়ালে আজ ওকে তিনি খোকা বলে ডেকে উঠলেন। ওর যখন হামাগুড়ি দেবার বয়স, মাধুরীর নকল। করে মহীতোষ মাঝে-মাঝে খোকা বলে ডাকতেন। আধো-বুলি-ওঠা অনিমেষ তাকটা শুনলেই কা-কা করে উঠত। এটা ছিল একটা মজার খেলা ওদের কাছে। আজ সব কথা যা বলা যায়নি এই একটি ডাকের মাধ্যমে যেন বলে ফেলেছেন তিনি-ভেতরটা কেমন শান্তিতে ভরে যাচ্ছিল।
ভেতরের ঘরের দরজা বন্ধ করে মহীতোষ ছুটে যেতেই অনিমেষ ভ্রূ কুঁচকে এই ঘরটা দেখল। আশ্চর্য, মায়ের ছবিটা তো আর এখানে নেই। সেই অন্ধকারে ধোয়াটে পরিবেশে মাধুরীর বিষণ্ণ ছবিটা, যেটা দারুণ চাপ সৃষ্টি করত বুকের মধ্যে-অনিমেষ অবাক হয়ে দেখল, সেটা কোনোকালে এখানে ছিল কি না বোঝা যাচ্ছে না। বরং ঘরটা বেশ পরিষ্কার, দুটো সিঙ্গল খাটা জোড়া দিয়ে বিছানা পাতা আছে। বাবা এবং ছোটমা এখানে শোন-বোঝাই যাচ্ছে। অনিমেষ নিজের অজান্তেই মাধুরীর ছবিটা এখানে না দেখতে পেয়ে খুশি হল। ধীরপায়ে ও ভেতরের বারান্দায় আসতেই বাবার গলা শুনতে পেল, খোকা, ঝাড়িকে ডাক-আর দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।
কথাটা শুনে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। এখানে আসার পর চটপট এমন সময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে সে তাল রাখতে পারছে না। ঝাড়িকাকু এ-বাড়িতে আবার কী করে ফিরে এল। বাবা তো ওকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মাত্র ত্রিশ মাইল দূরত্বে থেকে ও এসব ঘটনা জানতে পারল! স্বৰ্গছেঁড়া থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে ওর সঙ্গে সংযোগ রাখার দায়িত্ব যেন কারও নেই, সে যে এই বাড়ির একমাত্র ছেলে, এই জায়গার সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক-একথা সবাই যেন চট করে ভূলে গেছেন। অবশ্য সে একা নয়, যে-দাদু চিরকাল এখানে থেকে গেলেন, তাকেও কেউ কোনো কথা জানাবার প্রয়োজন বলে মনে করে না। অভমানটা বুকের মধ্যে জমতে শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর খেয়াল হল এখান থেকে চলে যাওয়ার পর সে একটি চিঠি নিজে লেখেনি। চিঠি লিখলে ও নিশ্চয়ই সেব কথা জানতে পারত। চিঠির কথা মনে হলেই সীতার কথা মনে পড়ে যায়।
উঠোনে নেমে এল অনিমেষ। পেয়ারাগাছটায় একগাদা চড় ইপাখি হইচই করছে। উঠোনের ওপাশে সেই বুড়ো কাঁঠালগাছটাকে অ্যাদ্দিনে সত্যিই জরাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। গায়ে শ্যাওলা পড়ে জবুথবু হয়ে রয়েছে গাছটা। নিজের অজান্তেই বুকভরে নিশ্বাস নিল অনিমেষ–আঃ! ওর মনে হল এইসব রক্তের মতো পরিচিত গছিগাছিল গন্ধ যেন ও বাতাসে পাচ্ছে।
এই সময় ও ঝাড়িকাকুকে সেখানে দেখতে পেল। সেই খাকি রঙের হাফপ্যান্ট আর ছিটের ফতুয়া পরে ঝাকিকাকু একটা ঝুড়ি নিয়ে পেছনের বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে। এই কবছরে অনেকটা বদলে গেছে ঝাকিকাকু। চুল পেকে গিয়ে শরীরটা একটু কুঁজো হয়েছে। ও এগিয়ে যেতেই ঝাকিকাকু থমকে দাঁড়াল। বোধহয় অনিকে এতখানি লম্বা সে আশা করেনি। বিস্ময়টা কাটিয়ে উঠে পিতলের সেই দাতটা বের করে হাসল, পাশ করেছিস?
ততক্ষণে ওর সামনে এসে পড়েছে, অনিমেষ, ঘাড় নেড়ে দুহাতে ঝাড়িকাকুর হাত দুটো ধরে বলল, কেমন আছ তুমি?
সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আরও বুড়োটে হয়ে গেল, মাথা নেড়ে ঝাকিকাকু বলল, ভালো না রে, দুপায়ে যা বাতের ব্যথা-বেশিদিন বাঁচতে আর ভালোও লাগে না।
সেকথায় কান কান দিয়ে অনিমেষ বলল, ওঃ, তোমাকে এ-বাড়িতে দেখে কী ভালো লাগছে।
ঝাজিকাকু বলল, মহী যদি এখানে জায়গা না দিত, তা হরে না খেয়ে মরেই যেতাম। এই বুড়ো বয়সে ওসব কাজ পারি? তা কর্তাব কেমন আছেন? বগদি?
অনিমেষ বল, ভালো আছেন, তবে বয়স তো হচ্ছে।
ঝাড়িকাকু বলল, হ্যাঁ রে, বয়স না হলে কেউ বুঝতে পারে না সে-জিনিসটা কেমন। তা তুই তো এখন কলকাতায় যবি পড়তে, না? ফিরে এলে দেখবি তোদের ঝাড়ি আর নেই। তা না-ই থাকলাম, তুই বড় হ অনি। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় খবরটা দিল, তোর সেই মাস্টারশাই-যার কাছে তোতে আমাতে গিয়েছিলাম রে-মরে গেছে।
চট করে সেই নস্যিমাখা ঘেমো মুখটা যেন সমস্ত আকাশ জুড়ে অনিমেষের চোখের সামনেটা ভরাট করে দিল। এইমাত্ৰ-বেলা ঝাড়িকাকুর কথাটায় একটা মুখ ভেসে উঠল-ওর সমস্ত কান জুড়ে যিনি বন্দেমাতরম শব্দটা শুনিয়েছিলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনিমেষ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সেটা দেখে ঝাকিকাকু অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে বলল, কাদিল না অনি, ওভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে মহীষে ভেতরের বারান্দায় এসে ওদের দেখতে পেলেন, কী করছিস তোরা এখনও, এর পরে অনিমেষের দিকে একবার তাকিয়ে খুব নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে।
মহীতোষই দ্রুত বলে গেলেন, বাগানের কুলিরা খেপে গেছে, বাড়িতে এসে হামলা করতে পারে। জিনিসপত্র যেখানে যা আছে পড়ে থাক, এখন বাজারে চলো।
ঝাড়িকাকু বলল, কুলিরা খামোকা হামলা করতে যাবে কেন?
রেগে গেলে কারও মাথা ঠিক থাকে। আমরা কাজে গিয়েছি বলে ওরা রেগে গেছে। চলো চলো। মহীতোষ তাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন।
কিন্তু ঝাড়িকাকুর ব্যস্ততার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ঘাড় নেড়ে বলল, তোরা যাবি যা, আমি যাব না।
মহীতোষ বললেন, যদি মারধোর করে?
আমাকে মারবে না। আমি ওদের সবাইকে চিনি। আমি গেল এই বাড়ি দেখবে কে?
ঝাড়িকাকু এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় ঝুড়িটাকে লমিয়ে রাখল। মহীতোষ কিছু বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাঁধ ঝাকিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে ঝাড়িকাকু বলল, মানুষের রকম দেখেছিস, যাদের সঙ্গে এতদিন বাস করল এখন তাদেরই ভয় করছে। এই মদেসিয়াগুলোর মতো সরল মানুষ কখনো কাউকে মারতে পারে?
ঝাড়িকাকুর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এত নির্লিপ্ত এবং ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে বোধহয় খুব কম মানুষই পারে। বাবার অস্থিরতা ও ঝাড়িকাকুর স্থিরতা খুব স্পষ্ট হয়ে ওর চোখে পড়ছিল। হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে ঝাড়িকাকু বলল, এই অনি, তুই দাঁড়িয়ে আছি কেন, যা, চলে যা তাড়াতাড়ি।
অনিমেষ বলল, সত্যি ওরা মারতে পারে? আমরা তো কোনো দোষ করিনি!
ঝাড়িকাকু বলল; তা হোক, তবু তোর যাওয়া ভালো।
কিন্তু তুমি যাচ্ছ না কেন? ঝাড়িকাকুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনিমেষের এইভাবে চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
এবার ঝাড়িকাকু হেসে ফেলল, যতই পাশ কর বাবা, তুই এখনও ছেলেমানুষ আছিস। ওরে, আমি যে বাঙালি নই তা এই বাগানের সব কুলি জানে। আমাকে কিছু বলবে না।
অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গে ও একদম ভুলে গিয়েছিল যে ঝাড়িকাকু বাঙালি নয়। অবশ্য একথা ওকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন ওর নিজেরই অবিশ্বাস হচ্ছিল, সেইসঙ্গে ওর মনে একটা বিষণ্ণতা কোথা থেকে চলে এল। নিজে বাঙালি নয় এই কথাটা কি ঝাড়িকাকু এতকাল সযত্নে লালন করে এসেছে মনেমনে? তা হলে এই বাড়ির মানুষ হয়ে যায় কী করে? কেন বাবার সমস্যা নিয়ে ঝাড়িকাকু কষ্ট পেয়েছিল। অনিমেষ বুঝতে পারল না। কিন্তু একথাটা ঠিক, বাঙালি নয় বলে ঝাড়িকাকু শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছে আজকে। হয়তো এই কারণেই আজ বাড়িটা রক্ষা পেয়ে যাবে। কোনো-কোনো সময় দুর্বলতাই মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে থাকে।
এতদিন বাদে স্বৰ্গছেঁড়ায় এক, অথচ এখনই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কী যে সব ব্যাপার হয়ে যায়। অনিমেষ যেন অতিকষ্টে বারান্দায় উঠে এল। ততক্ষণে ছোটমা একটা বিরাট ব্যাগ নিয়ে এদিকে চলে এসেছে। না, বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যাওয়া হবে না। সেটা ভেতর থেকে বন্ধ করে এদিকের দরজা দিয়ে যাওয়া হবে যাতে বাইরে থেকে কেউ চট করে বুঝতে না পারে কেউ বাড়িতে নেই। অনিমেষের সীতার ঠাকুমার কথা মনে হল। যদি সবাই চলে যায় কোয়ার্টার ছেড়ে কত বাচ্চাকাচ্চা এইসব কোয়ার্টারে নিশ্চয়ই আছে। ও ছোটমাকে হাত নেড়ে বিড় কিদরজা দিয়ে একছুটে বাইরে এল। আর আসতেই একটু অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। মাঠ পেরিয়ে বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে বাবুরা ছেলে মেয়ে বউদের সঙ্গে নিয়ে আসাম রোডের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। অনেককেই ও চিনতে পারছিল-কেউ-কেউ নতুন। সীতার বাবা-মাকে দেখতে পেল না সে এই দলের মধ্যে। ওরা আসাম রোডের ওপর উঠে বাজারের পথে বাঁক ঘুরতেই অনিমেষ ফিরল। ছোটমা ততক্ষণে উঠোনে নেমে এসেছেন। পেছনে বাবা। বাবার হাতে সুটকেস। অনিমেষ এগিয়ে গিয়ে ছোটমার হাত থেকে ব্যাগটা নিতেই ছোটমা বলল, ঠাকুরকে ফেলে রেখে যাচ্ছি-জল-বাতাসাও পাবেন না।
মহীতোষ হাঁটতে হাঁটতে বললেন, রাখো তো তোমার ঠাকুর। বেঁচে থাকলে তোমরা অনেক জল-বাতাসা দেবার সুযোগ পাবে।
ছোটমা হঠাৎ সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠল, তোমরা সত্যি কী করেছ ওদের বলো তো যে এখন প্রাণের ভয় পাচ্ছ?
মহীতোষ বিরক্ত হলেন, আঃ, এখন বকবক না করে পা চাও তো।
খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে আসতে আসতে অনিমেষ বলল, অন্য বাবুর সবাই একটু আগে চলে গেছে, শুধু ঠাকুমাদের দেখলাম না।
ছোটমা বললেন, সে কী! কী হবে! ওঁর পক্ষে তো যাওয়াও অসম্ভব। একবার খোঁজ নিলে হয় না? বিয়েবাড়ির সব অগোছালো হয়ে পড়ে আছে।
মহীতোষ হতাশ ভঙ্গি করলেন। ঝাড়িকাকু পেছন পেছন আসছিল, কথাটা শুনে বলল, তোমরা যাও, আমি দেখছি।
বিয়েবাড়ি শব্দটা কানে যেতেই অনিমেষ কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। আচ্ছা, যদি সীতারা যাবার আগই রাগী কুলিরা এসে পড়ত? তা হলে সীতা কি নতুন বেনারসি পরে বাবার সঙ্গে একটু-আগে-দেখা বাবুদের মতো দৌড়ে পালাত?
মহীতোষ আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিলেন। ঝাড়িকাকুকে সীতাদের বাড়ির দিকে এগোতে দেখে অনিমেষ ছোটমার সঙ্গে বাবার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল। ছোটমা বললেন, যা-ই বল বাপু, এই কুলিদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বাবুরা ভালো ব্যবহার করত না, নাহলে পালাবার কথা মনে আসবেই-বা কেন? কথাটাকে মনেমনে সমর্থন করে অনিমেষ পেছন থেকে বাবার শরীরটাকে লক্ষ করল, এই মুহূর্তে অত বড় মানুষটাকে কেমন অসহায়-অসহায় দেখাচ্ছে।
মহীতোষ ঘাড় ফিরিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিমেষ চট করে ডানদিকে মাঠের শেষপ্রান্তে ফ্যাক্টরিতে যাবার রাস্তার দিকে তাকাল। হইহই শব্দটা জলস্রোতের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে এখন। ক্রমশ কালো কালো মাথাগুলো দেখা গেল।
অসহায়ের মতো ওরা আসাম রোডের দিকে তাকাল, সেখানে পৌঁছানোর আগেই কুলিরা নিশ্চয়ই ওদের ফেলবে। কার। এখন ওরা ঠিক মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে।
চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে, সামান্য যে-কজন রাস্তার মুখে গেটের সামনে পৌঁছেছে তার অনেক অনেক গুণ বেশি লোক যে এখনও আড়ালে রয়েছে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না ওদের। মহীতোষ দৌড়ে স্ত্রী-পুত্রদের কাছে এসে হতাশ গলায় বললেন, তখন থেকে তাড়া দিচ্ছি তোমরা শুনলে না। এখন কপালে কী আছে কে বলতে পারে! সব বাবু চলে গেল সময়মতো-! কয়েক পা হেঁটে আসতেই ওদের বাড়ির সামনের ক্লাবঘরটা আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মধ্যিখানে। এই সময় মাদলের শব্দ শুনতে পেল। অনিমেষ দেখল ছোটমার মুখ একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এখনই দ্রুত পা চালিয়ে আসাম রোডে উঠে যাওয়া উচিত। অবশ্য কুলিরা যদি আক্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকে তা হলে ওরা এই মুহূর্তে যত দূরত্বেই থাক ছোটমাকে নিয়ে। ওদের হাতের নাগালের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা যে রীরিক আঘাত করবে এমন তো নাও হতে পারে। হয়তো চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে ক্রোধ প্রকাশ করবে। তারপর বুঝিয়ে বললে বুঝতেও পারে। ওদের বাড়িতে আসবার আগে সীতাদের বাড়ি কুলিদের সামনে পড়বে–সীতার মাবাবা-ঠাকুমা তো বাড়িতেই আছেন।
খুব দ্রুত এসব কথা চিন্তা করে অনিমেষ বাবাকে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো বাড়িতেই ফিরে যাই। মহীতোষও বোধহয় সেরকম চিন্তা করছিলেন, কথাটা শুনে দ্রুত খিড়কির দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। অনিমেষ হাঁটতে গিয়ে দেখল ছোটমা তেমন জোরে পা ফেলতে পারছে না। ওকে সাহায্য করার জন্য অনিমেষ ছোটমার ডান হাতটা ধরল। ধরেই চমকে উঠল, এত শীতল হাত সে এর আগে কোনোদিন ধরেনি।
খিড়কিদরজা বন্ধ করতেই মনে হল একটা ব্রিট আড়াল হয়ে গেল-আপাতত কোনো ভয় নেই। এতটুকু হেঁটে আসতেই ছোটমা হাপাচ্ছে, অথচ যাবার সময় কোনো অসুবিধে ছিল না। হাটা ক্রমশ বাড়ছে, বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর লোক এখন মাঠে জমায়েত হয়েছে। তাদের গলায় বিক্ষোভের আওয়াজটা হঠাৎ উল্লাসে রূপান্তরিত হয়ে গেল। ব্যাপারটা কী অনিমেষ বুঝতে পারল না। ওর মনে হল এখন ঝাড়িকাকু এখানে উপস্থিত থাকলে তবু যেন কিছুটা বল পাওয়া যেত। বাবা এই বাড়ির কর্তা-অথচ বাবাকে কী অসহায় লাগছে দেখতে!
মহীতোষ পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোঁজার ভঙ্গি করে শেষ পর্যন্ত হতাশ গলায় বলে উঠলেন, যাচ্চলে, সিগারেটের প্যাকেটটা ঘরে ফেলে এসেছি।
ছোটমা এতক্ষণে কথা বললেন, এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? দরজা খোলো, আমি ঘরের ভেতর বসব-যা হয় হোক।
মহীতোষ যেন অন্য কোনো উপায় চিন্তা করছিলেন, কথাটাকে আমল দিতে চাইলেন না, পাগল!
ছোটমা বলল, সীতার বাবা-মা যদি বাড়িতে থাকতে পারে তো আমরা পারব না কেন?
মহীতোষ বললেন, সীতার বাবা আজ অফিসে যায়নি, ছুটিতে আছে। তাই ওদের কোনো ভয় নেই, ওঁকে তাই কিছু বলবে না দেখো।
অনিমেষ কথাটা শুনে বাবার দিকে তাকাল। সীতার বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ের জন্য দুটি নিয়েছিলেন। সেটাই এখন তার কাজে লাগবে। কুলিদের তিনি বোঝাতে পারবেন যে তিনি কাজেইও যাননি এবং মনে কোনো পাপ নেই বলে কোয়ার্টার ছেড়ে কোথাও চলে যাননি। কুলিরা কি শুনবে সেকথা? অন্তত এখন পর্যন্ত সীতাদের বাড়ি থেকে যখন কোনো আর্তনাদ ভেসে আসছে না, তখন এর উলটোটা ভাবা যাচ্ছে না।
নিজের উঠোনে ফিরে ছোটমা ধাতস্থ হয়েছে। কুলিদের হল্লাটা ক্রমশ বাড়ছে। ওরা টের পেয়ে গেছে বাবুরা তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে গেছে। প্রথম কোয়ার্টারে কাউকে না পেয়ে বোধহয়। সেটার ওপর পাথর ছুড়ছে ওরা। অনিমেষরা এখান থেকেই টিনের ছাদে-পড়া পাথরের দুমদাম শব্দ শুনতে পেল। বোধহয় এই শব্দেই ছোটমার চেতনা অন্যরকম কাজ করল। গোয়ালঘরের দিকে কয়েক। পা এগিয়ে ছোটমা বলল, চলো পেছনদিকে চলে যাই।
মহীতোষ বললেন, তুমি নদী পার হতে পারবে? আর নদী পার হলেই তো কুলিলাইন। গিয়ে কী লাভ হবে?
ছোটমা বলল, এই লাইনের মেয়েদের আমি চিনি। দেখো ওরা আমাদের কিছু বলবে না। সামনে যারা এসেছে তারা অন্য লাইনের লোক।
মহীতোষ অগত্যা কী করবেন বুঝতে না পেরে ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ বলল, এখানে দাঁড়িয়ে তো কোনো লাভ হবে না। তার চেয়ে চলো।
ওরা এবার পেছনের দরজা দিয়ে বেশ জলদি হাঁটতে লাগল। অনিমেষ দেখল বুনো গাছে বাড়ির পেছনটা ছেয়ে গেছে। একটিমাত্র সরু পায়ে-চলা-রাস্তা গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে নদীর দিকে চলে গেছে। গোয়ালঘরটা শূণ্য, শুধু একটা লালরঙা গোরু তার বাচ্চাকে নিয়ে খুঁটিতে বাঁধা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে সেটা চট করে বাচ্চাটার গা চাটতে লাগল। গোয়ালঘরটা দেখে অনিমেষের কালীগাই-এর কথা মনে পড়ে গেল। ও বুঝতে পারল বেচারা মরে গেছে। এছত একটা ব্যথা ওর মনটাকে হঠাৎ ছুঁয়ে গেল। ও কোনো কথা না বলে চুপচাট হাঁটতে লাগল। এখান দিয়ে। চলাফেরা করলেই কালীগাই-এর সেই হাম্বা ডাকটা যেন কান বন্ধ করেও শোনা যায়।
নদীর সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। অনিমেষ দেখল জলেরা এখনও চুপচাপ বয়ে চলে যায়। তবে এখানে নদীর গভীরুতা যেন আরও কমেছে। মাঝে-মাঝে শ্যাওলা বুকে নিয়ে ঘোট ঘোট চড়া মাথা তুলেছ। স্রোত আছে-কিন্তু ভীষণ বয়স্ক দেখাচ্ছে নদীটাকে।
অনিমেষ আগে জলে নামল। হাঁটুর নিচেই জল, ব্যাগ নিয়ে পার হতে কোনো অসুবিধা হল না। জলের তলায় এখনও সেইরকম নানা রঙের নুড়িপাথর পড়ে আছে। ওর পায়ের শব্দেই বোধহয় একটা লাল চিংড়ি লাফিয়ে অন্য ধারে চলে গেল। পার হয়ে অনিমেষ বলল, না, কোনো স্রোতই নেই, চলে এসো।
ছোটমা মহীতোষের হাত ধরে ধীরে ধীরে পার হয়ে এল। এপারে এসে মহীতোস হাঁফ ছেড়ে বললেন, ভাগ্যিস কোম্পানি আর নদীটার ওপর নজর দেয় না-নাহলে পার হওয়া যেত না।..
অনিমেষ ভাবল জিজ্ঞাসা করে যে নদী বন্ধ হয়ে গেলে ফ্যাক্টরির হুইলটা চলবে কী করে, কিন্তু ঠিক সে-সময় একটা উদোম বাচ্চাকেও ও অবাকচোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বছর ছয়সাতের মদেসিয়া ছেলেটি দুপাশের বুনো গাছের মধ্যে দিয়ে যে-চলার পথটা কলিলাইনের দিকে চলে গেছে তার একপাশে একটা হোঁতকা কুকুরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জুলজুল করে ওদের দেখছে। মহীতোষও বাচ্চাটাকে দেখেছিলেন, নেহাতই গোবেচারা একটা কালো রোগা শিও। কিন্তু ওর মনে হল এটাই যদি এখনই ছুটে গিয়ে লাইনে ওঁদের উপস্থিতির কথা সবাইকে জানিয়ে দেয়, তা হলে আর কিছুই করার থাকবে না। কী করবেন বুঝতে না পেরে তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। অনিমেষ কিছু বলতে হয় তাই জিজ্ঞাসা করল, এই, মরা ঘর কিধার।
ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না, শুধু ওর দুটো হাত কুকুরছানাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল। আর এই সময় পেছনে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের প্রান্তে ওদের কোয়ার্টারের সামনে বোধহয় চিৎকারটা এসে পৌঁছেছে, কারণ এখানে দাঁড়িয়েও ওরা বুঝতে পারছিল দুরত্বটা বেশি নয়। সেইসঙ্গে মাদলে ড়ুম ড়ুম ড়ুম শব্দ যেন অদ্ভুত আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে যাচ্ছিল। শব্দটা প্রকট হতেই ছেলেটার মুখচোখের ভাব বদলে গেল। খুব উত্তেজিত হয়ে সে একটা হাত শব্দটাকে লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরে গোগোঁ করে আওয়াজ করতে লাগল। মুহূর্তে অনিমেষরা বুঝতে পারল বেচারা কথা বলতে পারে না। ওর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, হাতের কুকুরছানাটা ঝুলে পড়েছে। ছোটমা বোধহয় সামলাতে পারল না নিজেকে, চট করে একটা হাত বাচ্চাটার মাথায় রাখল। অনিমেষ দেখল সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল, তারপর ছোটমার গা-ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু ওর চোখ দুটো ভীষণ অবাক হয়ে ছোটমার মুখের ওপর সেঁটে রইল। মহীতোষ বোধহয় এ-দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখতে চাইছিলেন না, সুটকেসটা তুলে বললেন, লাইনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, বরং নদীর ধার দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চা-বাগান পড়বে, একবার এতে ঢুকে পড়লে আর কোনো বয় নেই। বাগান দিয়ে সোজা এগিয়ে খুটিমারি ফরেস্টের কাছে বাজারের রাস্তা পেয়ে যাব, চলো।
ওরা এগোতেই বাচ্চাটা ছোটমার কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করল। এক হাতে কুকুর অন্য হাতে কাপড় ধরে সে গোগোঁ শব্দ করে ছোটমাকে লাইনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ঠিক এই সময় দড়াম দড়াম শব্দ শুরু হয়ে গেল। ক্ষিপ্ত কুলিরা ওদের কোয়ার্টারের টিনের ছাদে পাথর ফেলছে। অনিমেষ নদীর ধারে দিয়ে সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল, এবার ফিরে এসে বলল, না, কোনো রাস্তা নেই, কাটাগাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মা যেতে পারবে না।
মহীতোষ নিজের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাওয়াটা পছন্দ কছিলেন না, একটু উষ্ণ গলায় বললেন, পারবে না বললে তো হবে না, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ছোটমা বলল, যা কপালে আছে হবে–লাইন দিয়েই চলল।
মহীতোষ বললেন, যা হলে মিছিমিছি বাড়ি ছেড়ে এলে কেন? কপাল ঠুকে বাড়িতে থেকে গেলেই তো হত!
ছোটমার জেদ এসে গেল চট করে, আমি তো তা-ই থাকতে চেয়েছিলাম, তোমরাই তো পেয়ে দৌড়ে মরছ। আমি এগোচ্ছি, এই লাইনের মেয়েরা আমাকে চেনে, কিছু বলবে না। তোমরা আমার পেছনে এসো।
মহীতোয় কিছু বলার আগেই ছোটমা সরু পায়ে-চলা-পথটা দিয়ে বাচ্চাটার সঙ্গে হাঁটতে আরম্ভ করল। মহীতোষ চুপচাপ ওদের চলে-যাওয়াটা দেখছিলেন। অনিমেষে কাছে এসে বলল, চলো?
কাঁধ ঝাঁকালেন মহীতোষ, জেনেশুনে এরকম রিস্ক নেবার কোনো মানে হয়? যেই বাচ্চাটা আঁচল ধরে টেনেছে অমনি মন নরম হয়ে গেল। অনিমেষ অনেক কষ্টে হাসি চাপল, বাবা এবং মায়ের এই ব্যাপারটা ওর কাছে নতুন–বাবাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে এখন। অগত্যা ছেলের সঙ্গে মহীতোষ স্ত্রীর অনুগাম হলেন। জঙ্গলটুকু পার হতেই কয়লার গুড়ো–বিছানো রাস্তাটা পড়ল। ডানদিকের চা-বাগান থেকে উঠে এসে সোজা ফ্যাক্টরির দিকে চলে গিয়েছে। ট্রাক্টরের ভারী চাকার দাগ রয়েছে এখানে। রাস্তার ওপাশে সার দিয়ে কুলিদের ঘরগুলো। বেশির ভাগই খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়াল, দুএকটা ইটের গাঁথুনি থাকলেও ওপরে খড় চাপানো হচ্ছে। অনিমেষ দেখল সমস্ত লাইনটা খাখা করছে। কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ বাড়ির দরজা বন্ধু, গরুগুলো খুঁটিতে বাধা, মুরগিগুলো মেজাজে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। মহীতোষও বিস্ময়ে দেখছিলেন। এই অঞ্চলে তিনি অনেক বছর আগে এসেছিলেন। তাঁর কোয়ার্টার থেকে সামান্য দূরত্বের এই লাইনে আসবার কোনো প্রয়োজন তার পড়ে না। এখন এই নিঝুম পরিবেশ তাঁকে ভীষণরকম আশ্বস্ত করল। বোঝাই যাচ্ছে এই লাইনের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মন্দ এই মুহূর্তে তার বাড়ির সামনে জমায়েত হয়েছে। বেশ উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি এই বেলা লাইনটা পার হয়ে চলো।
অনিমেষরা কেউই এরকম আশা করেনি, এখন দ্রুত হাঁটা শুরু করে দিল। বাচ্চাটা সঙ্গে আসছিল, মহীতোষ তাকে ধমকালেন, এ ছোঁড়াটা, ঘর যা।
সে শুনল কি না বোঝা গেল না, কারণ তার মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরম আনন্দে সে ছোটমার হাত ধরে একটা মাটির বাড়ির দাওয়ার দিকে নেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ছোটমা বলল, অ গেল যা, এ ছোড়া যে ছাড়ে না। আর এর বাপ-মায়ের বুদ্ধি দ্যাখো–একে একা ফেলে পালিয়েছে সব। পালানো শব্দটা অনিমেষের কানে গাললেও সে কিছু বলল না। ছেলেটা ততক্ষনে গোগোঁ করে আঙুল তুলে কাউকে দেখবার চেষ্টা করছে। একটু এগোতেই ওদের নজরে পড়ল, ঘরটার দাওয়াতে রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কেউ বসে আছে, তার সামনে অনেকটা গম ওকুতে দেওয়া হয়েছে, বসে-থাকা মানুষটার হাতে একটা লাঠি-বোধহয় কাক চিল থেকে পাহারা দেবার জন্য। অনিমেষ দেখল ম্যানুষটা স্ত্রী কি পুরুষ চট করে বোঝা যাচ্ছে না, কারণ তার মাথার সাদা চুল গুড়িগুড়ি করে ছাঁটা। গায়ের চামড়া ঝুলে গুটিয়ে এসেছে। বেচারা চোখে দ্যাখে না বোধহয় কারণ ওরা এত কাছে এসেছে তবু তার কোনো ভাবান্তর নেই। বাচ্চাটা হঠাৎ ছুটে গিয়ে গোগো চিৎকার করতে সে একটু নড়েচড়ে বসে নিদাঁত মাড়ি বের করে কিছু বলল। মহীতোষ একটু সামনে গিয়ে ভালো করে লক্ষ করে বললেন, সেরা বলে মনে হচ্ছে।
ছোটমা বলল, সেরা? সেই যে তুমি যার গল্প বলেছিলো?
মহীতোষ মাথা নাড়লেন, তারপর কাছে গিয়ে ডাকলেন, এই তুমার নাম সেরা?
লোলচর্ম-মুখটা এবার যেন-হদিস পেল তার সামনে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। অনিমেষ এর আগে কোনোদিন সেরাকে দেখেনি অথবা এরা নামও শোনেনি। মদেসিয়া লাইনে এ-নামের কেউ থাকতে পারে ভাবা যায় না। যদিও বয়স হয়েছে বেশ তবে বোঝাই যায় রোগে ভুগে ভুগে এর অবস্থা এইরকম জীর্ণতায় এসে ঠেকেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এর গায়ে রঙ অন্য পাঁচটি মদেসিয়ার মতো সাদা হয় কখন কে জানে, বরং যে-কোনো বাঙালি মেয়ের সঙ্গে মিলে যায় চট করে। চোখের পাতা সাদা হয় কখন কে জানে, সাদা চোখের মণি যেন আতিপাতি করে খুঁজতে চাইল সামনে দাঁড়ানো মুখগুলোর দিকে চেয়ে, কৌন?
সেরাকে দেখে মহীতোষ পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এখন আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে পরিস্থিতির কথা মনে পড়ে গিয়ে চট করে গুটিয়ে গেলেন। তারপর স্ত্রী-পুত্রের দিকে অকিয়ে বললেন, বেচারার বয়স হয়ে গেছে বলে চিনতে পারছে না-চলো যাওয়া যাক। ওই তো চা-বাগান দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু ততক্ষণে সেরা উঠে দাঁড়িয়েছে লাঠিতে ভর করে, আর সেই বাচ্চাটা দৌড়ে গিয়ে কুকুরছানাসমেত ওর এক হাতের তলায় অবলম্বন হয়ে গিয়েছে। মহীতোষ যখন যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছেন ঠিক তখনই সেরা বলে উঠল, বুড়াবাবাকে লেড়কা?
মহীতোষের পা দুটো যেন শক্ত হয়ে গেল। অনেকদিন বাদে কেউ তাকে এই নামে সম্বোধন করল। তিনি যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকেছিলেন তখনই সেরার যৌবন ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু ওর গল্পটা বেশ চালু ছিল। সে-সময় পাতি তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে ওকে ফ্যাক্টরিতে, বাছাই-এর কাজে লাগানো হয়েছিল। মইতোষ দেখেছিলেন কাজের চেয়ে ও বেশি কথা বলত আর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কত ছিল যে যারা পছন্দ করত না তারাও চাষ করে শুনত। সেই সেরা এখন অথর্ব হয়ে তাকে পুরনো নামে ডেকে ফেলল-শহী, একটু রোমাঞ্চিত হলেও তার মনে হল পেছনে বিপদ নিয়ে। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় এখন নয়। তবু যাবার সময় তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
ও কৌন, ব, বেটা–আরে কাহা ভাগতিস রে ও বুড়োবাবাকে লেড়কা?
মহীতোষরা দাঁড়িয়ে পড়লেন! সেরার গলা থেকে এরকম আওয়াজ বের হতে পারে কল্পনা করা যায় না। সেরার গলা শুনে যদি কেউ থেকে থাকে অশেপাশে, বেরিয়ে এলেই হয়ে গেল! মহীতোষ সেরার শোনার মতো গলায় বললেন, হ্যাঁ।
বুড়োবাবাকে লাতি ও ছোউয়া, ইধার আ, মো পানে আ, তুহার মুখ দেখি। জোরে জোরে অনিমেষকে ডাকতে লাগল সে।
মহীতোষের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ছোটমা বলল, যাও, তাড়াতাড়ি ঘুরে এসো।
অনিমেষ সামনে এগিয়ে যেতেই সেরা বাচ্চাটার মাথা থেকে বেরিয়ে যেতেই সেরা বাচ্চাটার মাথা থেকে সরিয়ে নিজের বুকে হাত রেখে বলল, মেরা নাম সেরা, ফা: কেলাস। বেস্ট। শেষের শব্দটা একটু মনে করে নিয়ে বলল। আর তার পরই ফোকলামুখে হেসে বলল, হাম নুডিড় হো গিয়া। বুড়বাবাকে লাতি? তুর জনম হল তো বুড়াবাবা মিঠাই খাওয়ালেক, আভি তু জোয়ান হো গিয়া বাপ, হাম বুড়ি হো গিয়া। কথাগুলো অসংলগ্ন কিন্তু অনিমেষ অনুভব করছিল আন্তরিকতা না থাকলে এভাবে কথা বলা যায় না। অথচ এই মুহূর্তে অন্য কুলিরা প্রতিশোধ নিতে তাদের কোয়ার্টারের সামনে হল্লা করছে। কেন যে এমন হয়! মৃদু হেসে ও চলে আসতে চাইছিল, কিন্তু সেরা ছাড়বার পাত্র নয়, সামান্য গলা নামিয়ে সেরা বলল, ও জেনানা কৌন হ্যায়? তুর দোসরা মা?
অনিমেষ বলল, হ্যাঁ। আমরা যাচ্ছি।
কাঁহা যাহাতিস রে?
বাজারে।
বা-জা-র! তুর ঘরকা সামনে রাস্তা ছোড়কে ইধারসে কাহে?
অনিমেষ কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে বাবার দিকে তাকাল। মহীতো ওকে ইশারা করে চলে আসতে বললেন। আর এই সময় নদীর ওপারে চিষ্কার চ্যাঁচামেচি বেড়ে গেল সহসা। এমন শব্দ করে মাদলগুলো বাজাতে লাগল যে অনিমেষের মনে পড়ল রহস্যময় আফ্রিকা বইতে এই ধরনের মাদল বাজিয়ে নরখাদকদের আসবার গল্প সে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে শুনল সেরা বলছ, শালা হারামি! হরতাল করবেক, কাম করবেক নাই, সাহেব পয়সা নেহি দেগা তো খায়গা ক্যা? সবকোই নিমকহারাম হো গিয়া! বিড়বিড় করে যাদের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনিমেষ আর দাঁড়াল না, দৌড়ে মহীতোষদের সঙ্গ নিল। বাদিকে একটা টিউবওয়েল, সেটা ছাড়াতেই ঝুপড়ি-হয়ে-থাকা বিরাট অশ্বথগাছের গা-ঘেঁষে চা-বাগানের শুরু। ওরা যখন চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তখন পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেল-খুব দ্রুত একটা লঘু আওয়াজ এগিয়ে আসছে। চা-গাছ ওদের বুজ–সমান উঁচু, মাঝে-মাঝে বড় শেডট্রি আর পাতি তোলার সুবিধেয় জন পায়ে-চলার রাস্তা চলে গেছে বাগানময়। মহীতোষ বললেন, বসে পড়ো, বসে পড়ো!
ওরা তিনজনেই বসে পড়ল চটপট। লাইনে এখন জোর কথাবার্তা চলছে। সেইসঙ্গে হাসি আর চিৎকার। মাদলটা ঘুরেফিরে অনেকরকম বোল তুলছে এখন। এগিয়ে-আসা আওয়াজটা হঠাৎ থেমে গেছে। সামনের ওই বিরাট অন্ধকার-করে-রাখা অশ্বথগাছটার জন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যে এসেছে সে কি ওদের সন্ধান পেয়েছে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল সেরা নিশ্চয়ই ওদের কথা ফিরে-আসা। কুলিদের বলবে না। আর যদি ওরা টের পেত তা হলে এতক্ষণে দল বেঁধে এদিকে ছুটে আসত। কিছুক্ষণ এভাবে উবু হয়ে বসে থেকে অনিমেষের অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। চারাগাছগুলোর তলায় ঢোকার কোনোপ্রশ্ন নেই কিন্তু ওরা যেখানে রয়েছে তা তলায় অনেক দুলো আগাছা, ঘাস শরীরটাকে ব্ৰিত করছিল। মহীতোষ যেন ফিসফিসিয়ে ছোটমাকে বললেন, এও কপালে লেখা ছিল। ছোটমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, চোখ বন্ধ করে বসে আছে। এই সময় অনিমেষ ওকে দেখতে পেল। পায়েপায়ে এগিয়ে এসে মুখে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছে। মহীতোষও ওকে দেখেছিলেন। স্বস্তির নিশ্বাসটা তার এত জেরে হয়েছিল যে ছোটমা চোখ খুলে সামনে দেখল এবং সেই সময় বাচ্চাটা এদিকে মুখ ফেরাল। তিনটে মানুষ যে এভাবে উবু খুলে সামনে দেখল এবং সেই সময় বাচ্চাটা এদিকে মুখ ফেরাল। তিনটে মানুষ যে এভাবে উবু হয়ে বসে আছে সে-দৃশ্যে ওর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা। গেল না। ও অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ সামনে এগিয়ে এসে ডান হাতটা এগিয়ে ধরল।
অনিমেষ দেখল ওর হাতে একটা কাগজের মোড়ক ধরা আছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে, এইভাবে। পেছন ধাওয়া করে এসে কী দিতে চাইছে ও? মোড়কটা নিয়ে কাঁপাহাতে সেটাকে খুলল অনিমেষ। পুরনো খবরের কাগজের ভাঁজগুলো খুলতেই অনিমেষ তাজ্জব হয়ে গেল। গোটা-চারেক গুড়ের বাতাসা রয়েছে তাতে। ও মুখ তুলে তাকাতেই দেখল ছেলেটা হলদে দাঁত বের করে হাসল, তারপর একটা হাত পেছনদিকে ওদের লাইনের দিকে নির্দেশ করেই সেটাকে ফিরিয়ে অনিমেষের দিকে উঁচিয়ে ধরে অবোধ্য শব্দ করে চলল। পেছন থেকে মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?
অনিমেষ ওদের বাতাসাগুলো দেখাল। ছোটমা বলল, আহা রে, তোমাকে খেতে দিয়েছে বুড়ি, কী ভালো দ্যাখো তো!
মহীতোষ বললেন, আশ্চর্য!
অনিমেষ এতখানি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল, ও কোনো কথা বলতে পারছিল না। যাদের ভয়ে ওরা বাড়ি ছেড়ে চা-বাগানের মধ্যে লুকিয়ে আছে তাদেরই একজন তাকে প্রথম দেখল বলে চারটে বাতাসা পাঠিয়ে দিয়েছে মুখমিষ্টি করতে। হয়তো এই বাতাসাগুলো সেরার কাছে মহার্ঘ জিনিস, কিন্তু তা-ই সে পাঠিয়ে দিয়েছে সরিৎশেখরকে সম্মান দেবার জন্য। এই মুহূর্তে অনিমেষ দাদুর জন্য গর্ব অনুভব করছিল। ও দুটো বাতাসা বাচ্চাটার হাতে দিতেই সে একসঙ্গে মুখে পুরল, তারপর হাত নেড়ে অনিমেষকে ডাকতে লাগল।
অনেকক্ষণ থেকে অনিমেষের মনের মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা তিল তিল করে জন্ম নিচ্ছিল। এইভাবে বাড়িতে আসামাত্র কিছু গরিব কুলির ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ও মনেমনে আর সমর্থন করতে পারছিল না। ওর মনে হচ্ছিল আজ কুলিদের এই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছন নিশ্চয়ই সুনীলদার পরিশ্রম আছে। সেই সুনীলদার সঙ্গে তার মিত্রতা, সুনীলদার শেষযাত্রার সঙ্গী হওয়া, সর্বহারাদের সম্পর্কে সুনীলদার কথা শুনে অনেক কিছু স্পষ্ট করে দেখা-এখানে এসে এইভাবে পালিয়ে বেড়ানোর ফলে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। আসলে এখানে আসামাত্রই এতসব ঘটনা পরপর ঘটে গেল যে সে মাথা ঠিক করে কোনোকিছু চিন্তা করতে পারেনি। এখন এই মুহূর্তে বাচ্চাটার হাতে পাঠারে বৃদ্ধা। মদেসিয়া রমণীর ভালোবাসা পেয়ে ভীষণভাবে নাড়া খেল। এইভাবে পালিয়ে বেড়াবার কোনো অর্থ হয় না। ওর মনে হল ও নিশ্চয়ই রাগী কুলিদের বোঝাতে পারবে যে ওদের শত্রু: তারা নয়। এই বাচ্চাটা যেন অনিমেষকে লজ্জা দিয়ে গেল। ও আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাচ্ছি।
মহীতোষ চমকে উঠলেন, সে কী! কোথায় যাচ্ছিস?
অনিমেষ বাবার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণের ভাবা কথাগুলো বলব-বলব করেও বলল না। ওর মনে হল এসব কথা বাবা বুঝবেন না। বাবার যখন যৌবন ছিল তখন তিনি দেশকে স্বাধীন করার জন্য কোনো আন্দোলন করেননি। এই ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো নিজের পরিবারের বাইরে আর-কিছু ভাববার মতো মানসিকতা বাবার কখনো তৈরি হয়নি। এখানকার কংগ্রেস কমিউনিস্ট কোনো ব্যাপারই তাকে স্পর্শ করে না। এই চা-বাগানের কুলিদের ওপর তিনি কখনোই অত্যাচার করেননি বটে, কিন্তু এরা যে মানুষ, মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য, এরা চেষ্টা করতে পারে সেটাও তিনি ভাবতে পারেন না। যেন ঈশ্বর পৃথিবীতে যাকে যেভাবে চিরকাল রেখে এসেছেন সে সেইভাবে থাকবে। শুধু নিজের এবং পরিবারের মানুষের ওপর কোনো আঘাত হলে তিনি বিচলিত। হয়ে উঠবেন। অনিমেষের মনে হল, তার জানাশোনা মধ্যবিত্ত মানুষরা সবই বাবার মতো একা একা।
ও এইসব কথা বলল না, শুধু বলল, দেখে আসি কী ব্যাপার। এইভাবে কতক্ষণ বসে থাকব।
মহীতোষ স্পষ্ট বিরক্ত হবেন, কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষ এগিয়ে গিয়েছে। মহীতোষ চাপা গলায় বললেন, মরবে মরবে, চিরকাল এইরকম জেদি থেকে গেল, বুদ্ধিসুদ্ধি হল না!
ছেলেটার হাত ধরে অনিশেষ চা-বাগান থেকে উঠে আসছে এমন সময় পেছন থেকে ছোটমার ডাক শুনতে পেল। পেছন ফিরে সে দেখল ছোটমা এগিয়ে আসছে। ও এটা ভাবতে পারেনি, ভেবেছিল বাবা আর ছোটমা আপাতত এখানে থাকুন, পরিস্থিতি বুঝে পরে ব্যবস্থা করা যাবে।
ছোটমা এসে বলল, চলো।
তুমি যাবে? অনিমেষ বিশ্বাস করতে পারছিল না।
আমি আর বসে থাকতে পারছি না। তা ছাড়া তোমার যদি কোনো ক্ষতি না হয় আমারও হবে। আর যা-ই হোক মেয়েদের ওরা কিছু বলবে না। চলো।
ছোটমাকে হাঁটতে দেখে অনিমেষ বলল, বাবা?
উনি থাকুন। সবাই তো সমান নয়। ওঁর পক্ষে এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। বরং এখানেই ওঁর মনে হবে বিপদ কম। ছোটমার কথা শুনে অনিমেষ চুপচাপ হাঁটতে লাগল। পেছন থেকে মহীতোষের গলায় চাপা ডাক ওরা আর শুনতে পেল না, কারণ ততক্ষণে সেই বিরাট অশ্বগাছটা ওরা পেরিয়ে এসেছে। ছোটমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের কেমন গুলিয়ে গেল। মানুষের চরিত্র ও এখন কিছুই বুঝতে পারে না।
দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন কলিলাইনে মেলা বসেছে। প্রচুর মানুষের ভিড়, গেল হয়ে তারা নাচ দেখছে। পরস্পরের কোমর জড়িয়ে ধরে ছেলেমেয়েরা মাদলের তালে আগুপিছু হয়ে নাচছে। প্রথমে ওদের দেখতে পেয়েই অনিমেষের বুকটা কেঁপে উঠেছিল, কী হবে কে জানে। কিন্তু খুব দ্রুত ও নিজেকে সামলে নিল, পরিস্থিতি যা-ই হোক ও তার মোকাবিলা করবে। ছোটমার মুখ দেখে মনে হল না একটুও ভয় পেয়েছে। যারা এইরকম আনন্দ করে নাচতে পারে তারা কি মানুষকে আক্রমণ করতে পারে?
স্বৰ্গছেঁড়ার কুলিলাইনে তাদের সীমানায় কোনো বাবুর বউকে আসতে দেখেনি কখনো, ফলে ওদের দেখতে পাওয়ামাত্র ভিড়টা জমাট বেঁধে গেল। সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখ তুলে ওদের দেখছে। ছেলেটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওদের সামনে এসে অনিমেষ খুব অস্বস্তি বোধ করল। এই মানুষগুলোকে দেখে একটুও রাগী বলে মনে হচ্ছে না। কাকে কী কথা বলা যায়-পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় অনিমেষের গোলমাল হয়ে গেল। ও বাচ্চাটার হার টানে সেরার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ছোটমা বলল, সবাই দেখছে।
সেরা দাঁড়িয়ে ছিল দাওয়ায়। ওদের ফিরে আসতে দেখে ফোকলামুখে বাচ্চাটাকে কিছু বলতেই সে ঘাড় নেড়ে জবাব দিল, দিয়ে হাসল। লাটিতে ভর রেখে একটু সামনে এগিয়ে সেরা সমবেত জনতাকে দেখাল, বুড়োবাবুকে লাতি।
একটা গুঞ্জন উঠল, যেন মুহূর্তেই জনতা অনিমেষকে চিনতে পারল। ছোটমাকে অনেক কামিন চেনে। তারা ঠারেঠোরে কথা বলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে একজন বয়স্ক মদেসিয়া এগিয়ে এল ওদের দিকে। অনিমেষ ঠিক বুঝতে পারছিল না হাওয়া কোনদিকে, শার্ট-প্যান্ট পরা প্রৌঢ় লোকটিকে দেখলে মনে হয় বেশ ভদ্র। লোকটি সামনে এসে ওদের দেখে বলল, আপনি মহীবাবুর ছেলে?শষ্ট বাংলা উচ্চারণ, কথা বলার মধ্যে একটা কর্তৃত্বের আভাস আছে। অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। এখানে কী করছেন?
অনিমেষ জবাব দেবার আগেই ছোটমা বলল, বেড়াতে এসেছি।
উত্তরটা বোধহয় আশা করেনি লোকটি হেসে বলল, এখানে কাউকে বেড়াতে আসতে দেখিনি কখনো। আমার নাম জুলিয়েন, এখানকার লেভার ইউনিয়নের সঙ্গে আছি।আজ হরতাল হবার পর বাবুরা তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে বাজারে চলে গেছেন আমাদের ভয়ে আর আপনারা এখানে বেড়াতে এসেছে-এটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার।
অনিমেষ এবার কথা বলল, আপনারা ভয় দেখাচ্ছেন কেন? বাবুদের বিরুদ্ধে তো আপনাদের লড়াই নয়!
নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু হরতাল জেনেও কাজে গিয়ে ওঁরা ভয় পেয়ে গেছেন। আসলে সাহেবকে হাতে রাখতে চায় সবাই। মিডলক্লাস মেন্টালিটি। অথচ আমাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না ওঁদের আক্রমণ করার। আমরা এত হাজার শ্রমিক ইচ্ছে করলে-যাক, সাহেব আমাদের বেশির ভাগ দাবি মেনে নিয়েছেন-প্রথম পদক্ষেপে এটা বিরাট জয়। সেই জয়-উৎসব এতে আমরা আপনাদের ওখানে গিয়ে দেখলাম কোয়ার্টাস খালি। জুলিয়েন হাসল।
কথাটা মুনে ভীষণ ভালো লাগল অনিমেষের। হঠাৎ ও বলে ফেলল, আজ সুনীলদা থাকলে খুব খুশি হতেন।
হ্যাঁ। ওঁর কাছে আমি অনেক গল্প শুনতাম।.
অনিমেষ বরতেই জুলিয়েন ওর দুই হাত জড়িয়ে ধরল, সুনীলবাবু না এলে আমরা অন্ধকারে থাকতাম। আপনি যখন সুনীলবাবুর বন্ধু তখন আমাদেরও বন্ধু।
অনিমেষ অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। এই মানুষগুলোকে কী চট করে ওরা ভুল বুঝেছিল! ওর মনে হল একসঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করেও মানুষের সঙ্গে মানুষের চেনাশোনা হয় না।
হঠাৎ ওর চোখে পড়ল ছোটমা অশ্বথগাছের পাশ দিয়ে চা-বাগানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জুলিয়েনের হাত-ধরা অবস্থায় ও বলল, আমার বাবা ওখানে আছেন।
জুলিয়েন ছোটমার যাওয়াটা দেখছিল। একটু চুপ করে থেকে ও বলল, বুঝতে পেরেছি। চলুন আপনি আমার ঘরে বসবেন।
অনিমেষ বুঝতে পারল, বাবাকে লজ্জা দিতে চাইছে না জুলিয়েন। ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে হাঁটতে লাগল অনিমেষ।
খাওয়াদাওয়া সারতে বিকেল গড়িয়ে এল। ছোটমা মহীতোষকে নিয়ে আগেই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। অবশ্য মহীতোষ নাকি কুলিলাইনের সামনে দিয়ে পার ফিরতে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে সামান্য এগিয়ে ফ্যাক্টরির পাশ-ঘেঁষে ছোট সাঁকোটা পেরিয়ে সুরকি-বিছানো ধটা দিয়ে ওরা ঘুরে এসেছেন। সমস্ত চা-বাগানে আজ খুশির আমেজ লেগেছে, দিনদুপুরে হাড়িয়া খেয়ে নাচগান গুরু হয়ে গিয়েছে। ওদের জীবনে এরকম ঘটনা এর আগে ঘটেনি, স্বয়ং সাহেব বাংলোর বারান্দায় জুলিয়েন আর তিনজনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেক্ষণ আলোচনা করে ওদের দাবি মেনে নিয়েছেন। ওরা জীবনে কখনো গল্প শোনেনি যে বাররা ওদের ভয়ে কোয়ার্টার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। এই আনন্দের প্রকাশ কিছু ছেলের মধ্যে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তারা বাবুদের কোয়ার্টারের উপর ঢিল ছুড়েছে, গাছপালা ছিঁড়েছে, গাছপালা ছিঁড়েছে-ব্যস, এর বেশি এগোয়নি। জুলিয়েন সম্পর্কে পুরনোপন্থি মানুষদের মনে, যে-সন্দেহের মেঘ ছিল তা রাতারাতি কেটে গিয়ে সে এখন নায়ক হয়ে গিয়েছে। অনিমেষ জুলিয়েনদের ঘরে বসে সেটা বেশ টের পাচ্ছিল।
জুলিয়েনের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগল অনিমেষের। সরিৎশেখরকে স্পষ্ট মনে আছে ওর। ওর বাবা বকু সর্দারের দিনগুলো থেকে এতদিন স্বৰ্গছেঁড়া খুব-একটা পালটে যায়নি। কালো কালো মানুষগুলো হাঁড়িয়া খেয়ে নিজেদের মধ্যে যতই মারামারি করুক, সাহেব তো দূরের কথা, বাবুদের সামনে পড়লে কেঁচো হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর আগে ওদের একটা দাবি সাহেবদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল যে কুলিদের যেসব ছেলে কলেজে উঠবে, মিশনারিদের কাছ থেকে তবু আপত্তি উঠেছিল। জুলিয়েন আর একজন এই চা-বাগানে বাবুর গজ পেয়ে দেখল ওদের কোয়ার্টার অন্য বারদের সঙ্গে নয়-দূরে লাইন-ঘেঁষে তৈরি হল। আবার মজার ব্যাপার, অন্য যে লেবার-ছেলেটি বাবুর চাকরি পেল সে বড় কোয়ার্টারে যাবার পর অন্য লেবারের ভালোবাসা। এই সময় সুনীলদা না এলে এখানকার লেবারদের সংগঠিত করা যেতে না। এমনকি জুলিয়েন নিজেও খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল সে-সময়। পি এস পি বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার যে যোগযোগ ছিল তাতে ওদের সম্পর্কে ভালো ধারণা ও মনেমনে তৈরি করতে পারছিল নাউনীলদা ওকে একটা ছবি দিয়ে গেছে। ছবিটা দেখাল জুলিয়েন। এর আগে ছবি কখনো দেখেনি অনিমষে। দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ়ের ছবি। নিচে ইংরেজিতে নাম লেখা-কার্ল মার্কস। পেছনে সুনীলদার নিজের হাতে লেখা কয়েকটা লাইন-যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে, তার মুখে খবর পেলাম সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক। চট করে সুনীলদার মুখটা মনে গেল অনিমেষের, সেইসঙ্গে হুড়মুড় করে চলে এল ওকে শ্মশানে নিয়ে যাবার রাতটার কথা। জুলিয়েন বলল, সুনীলবাবুকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের জানি। বদলা নিতে পারতাম, কিন্তু তা তাদের বেশিদিন বাঁচতে দেওয়া হয় না। আবার মজার ব্যাপার হল, তারা নিহত হন বলেই সে-কাজটা দ্রুত হয়ে যায়। আ, এই মাকসও তো সাহেব ছিলেন-অথচ দেখুন।
ফিরে আসার সময় অনিমেষ চুপচাপ একা একা হেঁটে এল নদী পেরিয়ে। চারধারে যেন পরবের মেজাজ-মাদল বাজছে-ছেলেমেয়েরা গান গাইছে। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু এবং কার্স মার্কস-অনিমেষ যেন দুটো হাত দিয়ে এই তিনজনকে ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে হাটছিল। দেশ বড়, না। দেশের মানুষ বড়।
নদী পার হতেই ঝাড়িকাকুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখেই গলা তুলে বকাঝকা করতে আরম্ভ করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি-তোর বাবা কখন এসে গিয়েছে-বিকেল হয়ে গেল, খাওয়াদাওয়া করতে হবে না?
অনিমেষ হেসে ফেলল, খিদেবোধটা ওর একদম হয়নি আজ। সীতাদের বাড়িতে মিষ্টি খাওয়ার পর এতসব উত্তেজনাময় ঘটনা ঘটে গেল যে খাওয়ার কথা আর মনেই হয়নি। কিন্তু ঝাড়িকাকুর ব্যাপারস্যাপার অনেকটা দাদুর মতো, বিকেল হতে এখনও অনেক দেরি, তবু বলল বিকেল হয়ে গিয়েছে।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ঝাড়িকাকু বলল, তোরা মিছিমিছি চলে গেলি, ওরা আনন্দ করতে এসেছিল। সীতাদের বাড়ি থেমে মিষ্টি খেয়ে গেল।
অনিমেষ বলল হুঁ। জুলিয়েন বলল।
জুলিয়েন? জুলিয়েনকে তুই চিনিস? ঝাড়িকাকু ওর মুখের দিকে তাকাল।
একটু আগে আলাপ হল। বেশ ভালো লোক।
ভালো লোক খিঁচিয়ে উঠল ঝাড়িকাকু, ওই তো সব নষ্টের গোড়া। এতদিন ধরে কুলিদের খেপিয়ে খেপিয়ে আজ এইসব করেছে। সবাই বলে ও নাকি কমনিষ্ঠ।
কী বলল? হেসে ফেলল অনিমেষ, কম নিষ্ঠ মানে জান?
ওই তো, যারা গরিব মানুষদের খ্যাপায়। নির্লিপ্ত গলায় ঝাড়িকাক জবাব দিল।
দূর। কম নিষ্ঠ মানে হল কোনো কাজে যার আন্তরিকতা নেই। আর তুমি যেটা বলতে চাইছ সেটা হল কমিউনিস্ট।
অনিমেষ বুঝয়ে বলতেই ঝাড়িকাকু কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা গান্ধীবাবা কি কমিউনিস্ট।
প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ হকচকিয়ে গেল প্রথমটা। ওর মনে হল, হ্যাঁ বলতে পারলে ওর ভালো লাগত। কিন্তু কোথায় যেন আটকে যায়। পরক্ষণেই ওর খেয়াল হল, ঝাড়িকাকু মহাত্মা গান্ধীর নাম জানে তা হলে। যে-মানুষটার নাম এইরকম নির্জন জায়গায় ঝাড়িকাকুর মতো নিরক্ষর মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে সে-মানুষ কংগ্রেসি কি কমিউনিস্ট-তাতে কিছু এসে-যায় না। কার্ল মার্কস সম্পর্কে ও তেমন-কিছু জানে না। সুনীলদার মুখে দুই-একবার নামটা শুনেছিল। দুনিয়ার সর্বহারাদের কথা যারা চিন্তা করেন তাদের গুরু হলেন কার্ল মার্কস। ছবিটা দেখে শ্রদ্ধা জাগে মনে। ওঁর সম্পর্কে আরও জানতে হবে-অনিমেষ মনেমনে স্থির করল। খাওয়াদাওয়া সারতে বিকেল হয়ে গেল। সকালবেলায় রান্নাবান্না হয়নি। কুলিরা চলে গেলে ঝাড়িকাকু বাড়ি ফিরে উনুন জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়ে দিয়েছিল। ছোটমা সবকিছু অন্যদিনের মতো সেরে নিয়ে রান্না শেষ করলে অবেলায় ওদের খাওয়া হল। আঙ্গ অনিমেষ বাবার সঙ্গে বসে খেল। আজকের এই ব্যাপারটা মহীতোষকে বেশ নড়বড়ে করে দিয়েছে। তিনি যে অযথা ভয় পেয়েছিলেন এটা স্বীকার করতে এখন তিনি প্রস্তুত নন। সাহেব কুলিদের দাবি। মেনে নেবে এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। বরং গতকালও তিনি সাহেবকে ভীষণ একরোখা। দেখেছিলেন আর আজ সকালে কুলিদের মুখচোখ দেখে তিনি নিশ্চিত ছিলেন এরা একটা তুরকালাম কাণ্ড করতে পারে। কিন্তু কী ব্যাপার ঘটল যে সাহেব ওদের দাবি মেনে নিল, যাতে কুলিদের জয় হয়ে গেল! এটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। অন্য বাবুদের সঙ্গে কথা বললে অবশ্যই ব্যাপারটা জানা যেত। কিন্তু এরপর কী করে এই বাগানে থাকা যাবে? কুলিরা তো বেপরোয়া হয়ে যাবে। একবার অধিকারের স্বাদ পেলে কি আর তাদের তোয়াক্কা করবে? এতদিন, সেই ছেলেবেলা থেকে এখানে এই ছেঁড়ায়। এই সম্মানের সঙ্গে তিনি বসবাস করছেন-আজ মনে হচ্ছে তাতে ফাটল ধরে গেল। ওদের দাবি ছিল, বাস করবার মতো ভালো কোয়ার্টার্স, রেশনের পূর্ণ পরিমাণ দেওয়া। চাকরির নিরাপত্তা এবং কারও ব্যক্তিগত কাজে কোনো শ্রমিককে কাজে লাগানো চলবে না। সাহেব কী কী দাবি মেনে নিয়েছেন জানা। নেই-কিন্তু এর পরে ওরাই চোখে রাঙাবে। ওর মনে হল সরিৎশেখর যে-আরামে চাকরি করি গিয়েছেন, তার অনেক সময়ে কাঠোর হতে হয়, কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হবে না। দুপুর থেকেই তার মনে হচ্ছিল, যদিও এখনও অনেকদিন চাকরি বাগানে চাকরি পাওয়া অসম্ভব নয় কিন্তু সেখানেও এই স্বৰ্গহেঁড়ার হাওয়া যে লাগবে না তা কে বলতে পারে। সারাজীবনে নিজের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি নয়, তারপর অনিমেষের পড়াশুনা আছে। যদি কলকাতায় ভালো ফল করে তা হলে ওদের ডাক্তারি পড়াবার বাসনা আছে। এই একটি প্রফেসনে এই দেশে কারও অর্থের অবাব হয় না। ডাক্তারি পড়বার খরচ অনেক, তিনি জানেন। তাই ও যতিদিন-না নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে ততদিন এইভাবে মুখ বুজে চাকরি করে যেতে হবে।
কেতে বসে তেমন কোনো কথা হয়নিইবকেলে খবরের কাগজটা দিয়ে গেলে মহীতোষ সিগারেট ধরিয়ে বাইরের ঘরের সোফায় বসেছিলেন কাগজ-হাতে। নিমেষ বেরুতে যাচ্ছিল, তিনি ওকে ডাকলেন। কলকাতায় যাবার ব্যাপারে বাবার সঙ্গে এখন অবধি কোনো কথাই হয়নি। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি আছে-কোথায় গিয়ে উটবে, কীভাবে কলেজে গিয়ে ভরতি হবে-কত টাকা লাগবে। নিজের থেকে মহীতোষের সঙ্গে আলোচনা করতে ওর সঙ্কোচ হচ্ছিল। এখন তিনি ডাকতেই ও ঘু দাঁড়াল। মহীতোষ সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কবে যাওয়া যেন ঠিক হল?
বাবার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, বুধবার।
টিকিট কাটা হয়েছে? মহীতোষ কাগজের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না।
অনিমেষের মনে হল এখন বাবার চেহারাটা যেন আমূল পালটে গেছে, দুপুরে কুলিদের। আক্রমণের সময়কার চেহারাটা যেন উধাও হয়ে গেছে। কুব গম্ভীর এবং চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। ও বলল, না। হলদিবাড়ি থেকে ঞ কোচ আসে সেটায় উঠব।
আর-কেউ যাচ্ছে বন্ধুবান্ধব?
কয়েকজন যাবে কলকাতায় পড়তে, তবে একসঙ্গে যাকে কি না জানি না।
যেতে পারবে তো একা?
হুঁ।
আমি সঙ্গে গেলে ভালো হত, তা নিজেই যাও। কেউ দেখিয়ে দিয়ে শেখার চেয়ে নিজে ঠেকে শিখলে লাভ হয় বেশি। আমার এক বন্ধু আছে, বউবাজারের কাছে থাকে, তাকে লিখেছি তোমার কথা। সে সাহায্য করবে। তা ছাড়া তোমার ছোটকাকা এছ কলকাতায়। সে ব্যস্ত লোক-সময় পাবে কি না জানি না। আমাকে হঠাৎ চিটি দিয়েছে তমি পড়তে কলকাতায় গেলে যেন ওকে জানানো হয়। বুধবার রওনা হভে-উ, তা হলে এখনই টেলিগ্রাম করে দিতে হয় দেব্রতকে। কোন কলেজে অতি হবে?
জানি না। প্রেসিডেন্সি কলেজে–
হ্যাঁ, প্রথমে ওখানেই চেষ্টা করবে দেবব্রত, না হলে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়বে। সায়েন্স নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভরতি হবে, এটাই আমার ইচ্ছা।
সায়েন্স! অনিমেষ ঠোঁটটা কামড়াল, আমার ইচ্ছা আর্টস নিয়ে পড়ব। দাদুও চান ইংরেজিতে আমি যেন এম এ পাশ করি।
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে হাতের কাগজটা নামিয়ে রাখলেন মহীতোষ, না না, আর্টস নিয়ে পড়লে সারাজীবন কষ্ট করতে হবে। এখন সায়েন্স ছাড়া কদর নেই, তোমাকে ডাক্তারি পড়তে হবে।
অনিমেষ যেন চোখে আতঙ্ক দেখল, কিন্তু আমার ফে আর্টস ভালো লাগে!
হাত নেড়ে যেন মহীতোষ কথাটা উড়িয়ে দিলেন, শখের ভালো লাগা আর বেঁচে থাকা এক কথা নয়। আর্টস পড়ে এম এ পাশ করে তুমি কী করবে? স্কুল-কলেজে মাস্টারি? কত টাকা পাবে মাইনে? সারাজীবন কষ্ট পাবে, মনে রেখো। তা ছাড়া আমার আর চাকরি করতে ভালো লাগ না। যদ্দিন-না তুমি দাঁড়াচ্ছ ততদিন আমাকে করতে হবে। তাই ডাক্তারি পাশ করলে তোমার টাকার অভাব হবে না।
অনিমেষ কোনরকমে ঢোক গিলে বলল, আমার অঙ্কএকদম ভালো লাগে না।
মহীতোষ বললেন, চেষ্টা করলে সবকিছু সম্ভব। এই যে আমি, আমার কখনো ইচ্ছে ছিল না এই চা-বাগানের চাকরি করি। কিন্তু তোমার দাদুর পক্ষে আমাকে আর পড়ানো সম্ভব ছিল না তখন, আর আমাকে বাধ্য হয়ে এই চাকরি নিতে হল। তা চেষ্টা করে আমি তো অনেক বছর কাটিয়ে দিলাম। সেদিক দিয়ে তুমি ভাগ্যবান।
অনিমষ বলল, যদি ভালো রেজাল্ট না হয়।
এবার মহীতোষ বড় বড় চোখে ছেলের দিকে তাকালেন, তা হলে বুঝব তুমি পড়াশুনায় যত্ন নাওনি। শোনো, তোমার মার ভীষণ সাধ ছিল তোমাকেডাক্তার করাব।
এই ধরনের একটা বোঝা ও ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনিমেষ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এ-ব্যাপারে যেন ওর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না! বাবা এবং দাদু যা বলবেন তা-ই ওকে মেনে নিতে হেব! আর ওদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেই অমোঘ অস্ত্রের মতো মায়ের নাম করে একটা বক্তব্য চাপিয়ে দেওয়া হবে। যেন মা যা বলে গেছেন, ও তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। অনিমেষের সন্দেহ, মা সত্যিই এইসব বলে গিয়েছেন কি না। ওর স্থির বিশ্বাস, মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন তা হলে নিশ্চয়ই সে তাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারত। ও এখন কী করবে? যদি সে বাবাকে মুখের ওপর বলে দেয় যে সায়েন্স নিয়ে পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তা হলে কি বাবা তার কলকাতায় যাওয়া বন্ধ করে দেবেন? কী জানি! সংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ও ঠিক করল, এব্যাপারে দাদুর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাবা নিশ্চয়ই দাদুর মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারবেন না। অতএব এখন চুপ করে থাকাই শলো।
মহীতোষ খবরের কাগজটা আবার তুলে নিলেন, যেন-ব্যাপারে যা বলার তা বলা হয়ে গেছে, আমি খোঁজ নিয়ে তোমাকে মাসে একশো কুড়ি টাকা পাঠালেই ভালোভালো চলে অনিমেষ যাবে। দশ-বারো টাকার বেশি হাতখরচ লাগা উচিত নয়। আর বাজে ছেলেদের সঙ্গে একদম মিশবে না। কলকাতা হল এমন একটা জায়গা যেখানে একটু আলগা হলেই নষ্ট হয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না। কলেজ ছাড়া হোস্টেলের বাইরে কোথাও যাবে না, আর কখনোই ইউনিয়ন বা পলিটিক্যাল পাটির সংস্রবে যাবে না। রাজনীতি একটি ছাত্রের জীবন যেভাবে বিষিয়ে দেয় অন্যকিছু সেভাবে পারে না। যাহোক, আমি চাই তুমি মাথা উঁচু করে আমার সামনে ডাক্তার হয়ে এসে দাঁড়াও।
এখন প্রায় সন্ধে। আসাম রোডের গাছগুলোয় হাজার পাখির চিৎকার যেন রবিবারের হাটের চেহারা নিয়েছে। মাঝে-মাঝে এক-একটা গাড়ি শহুশ করে ছুটে যাচ্ছে। অনিমেষ শেষ সূর্যের রোদের আভা-মাখা কোয়ার্টারগুলোর দিকে তাকাল। এই ছবির মতো বাড়িগুলো ওপর বুকের ভেতরে সেই ছেলেবেলা থেকে একই রকম জায়গায় আছে, শুধ সীতাদের বাড়িটা ছাড়া। ওই ত্রিপল, দুটো কলাগাছ–দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। এই নির্জন রাস্তায় অজস্র পাখির গলা শুনতে শুনতে ও হাঁটছিল। ওর সমস্ত শরীর এখন কেমন ভারী লাগছে। বাজারের সীমা আসার আগেই ও থমকে দাঁড়াল, ওর বুকের মধ্যে চিরকালের চেনা এই স্বৰ্গছেঁড়া তিল তিল করে যে-মোচড় দিচ্ছে সেটা অনুভব করতে করতে এগিয়ে-আসা মানুষটার দিকে তাকান। এই এত বছর পরেও ও রেতিয়াকে একই রকম দেখল। সেই ময়লা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, একটা নোংরা ফুলহাতা শার্ট, চুলগুলো রুক্ষ, পা দিয়ে রাস্তা মেপে এগিয়ে আসছে। ওর বসন্তের ছাপ-মারা মুখটায় সেইরকম ভীরুতা এখনও লেগে আছে।
মুখোমুখি হতেই অনিমেষ রেতিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পায়ের শব্দ যত মৃদুই হোক-না কেন, রেতিয়া হঠাৎ কুঁকড়ে গেল, তারপর ওর অন্ধ চোখ দুটো চট করে বন্ধ করে কান খাড়া করে শব্দ চিনতে চাইল। অনিমেষের সেই খেলাটা মনে পড়ল। ও-এবার গলাটা ভারী করে জিজ্ঞাসা করল, কাহা যাহাতিস রে?
সেইভাবে দাঁড়িয়ে রেতিয়া জবাব দিল, ঘর।
মেরা নাম বোল।
প্রশ্নটা শুনেই বেতিয়ার মুখটা.আকাশের দিকে উঠে গেল। সেই বসন্তে-খোঁড়া মুখটা সহসা ছুঁচলো হয়ে গিয়ে দুটো চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। অনিমেষ বুঝতে পারল ও প্রাণপণে গলায় স্বরটা মনে করতে চেষ্টা করছে। কত বছর দেখা হয়নি অনিমেষে সঙ্গে, তা ছাড়া গলা পালটে সে কথা বলেছে, কিন্তু এখন অনিমেষ একাগ্র হয়ে প্রার্থনা করছিল যেন রেতিয়া ওকে চিনতে পারে। আর সেই মুহূর্তে রেতিয়া ওর লাল-ছোপ-ধরা দাঁত বের করে একগাল হাসল। যেন ওর ধাধাটা মিটে গেছে এমন ভঙ্গিতে ও হাত বাড়িয়ে দিল, অনি!
নিজের নামটা রেতিমার গলায় শুনে অদ্ভুত সুখে অনিমেষের সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি এসে গেল। ও চট করে রেতিয়ার বাড়ানো হাত দুটো ধরতেই বুকের গভীরে দ্রুত-হয়ে-ওঠা মোড়টা ঝরঝর করে দুচোখ থেকে কান্না হয়ে ঝরে পড়ল। ও কোনো কথা বলতে পারছিল না। নেতিয়া যেন এরকমটা আশা করেনি, ও অনিমেষের হাত ধরেই জিজ্ঞাসা করল, অনি।
এবার হাতটা ছাড়িয়ে নিল অনিমেষ, তারপর দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, হ্যাঁ।
ক্যা হুয়া তুমহারা? রোতা হ্যায় কাহে।
কেন কান্না এল? রেতিয়ার এই প্রশ্নটার জবাব ও সত্যিই চট করে নিজেই খুঁজে পেল না। এই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে এই বোধটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র বুক চেপে ধরেছিল। তারপর সীতাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে কী যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেতিয়ার মুখে নিজের নামটা শুনতে পেয়েই ওর মধ্যে চট করে কান্নাটা এসে গেল। অনিমেষ বলল, এইসেই। বেতিয়া হাম কলকাতামে যায়েগা।
বেতিয়া যেন চিন্তিত হল, উতো বহু দূর-জলপাই সে ভি-না?
অনিমেষ একথার জবাব দিল না। সে জলপাইগুড়িতে থাকুক কিংবা কলকাতায়-স্বৰ্গছেঁড়ার সঙ্গে যে-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তা কোনোদিন কমবে না। শুধু এই রেতিয়ার মতো কেউ যখন এত বছর পরও তার গলা মনে রেখে নাম ধরে ডেকে ওঠে, তখন মনটা কেমন হয়ে যায়।
বাজারের দিকে যাবার ইচ্ছে ছিল ওর। কাল হয়তো-দুপুরের আগেই ওকে চলে যেতে হবে। তাই আজ স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার-এলাকায় ঘুরে আসার ইচ্ছা ছিল ওর। বিশু কিংবা বাপীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে নিশ্চয়ই ভালো লাগত। কিন্তু এই সন্ধে-হয়ে-যাওয়া সময়টা.ওর মনে রেতিয়ার সঙ্গে হেঁটে ওকে লাইনে পৌঁছে দিলেই বোধহয় ভালো লাগবে। এখন আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ওর একটুও ইচ্ছে করছিল না। হঠাৎ ওর মনে হল, স্বৰ্গছেঁড়ার গাপালা মাটি মাঠ আংরাভা নদীর মতো রেতিয়া যেন প্রকৃতির একটা অদ। ও রেতিমার হাত ধরে রাখার পাশ ধরে হাঁটতে লাগল। কমশ অন্ধকার সমস্ত চরাচর ছেয়ে যেতে লাগল। মাথার ওপর পাখিরা এখন গাছে-গাছে জায়গা পেয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুম ক্যায়সা হ্যায় রেতিয়া?
রেতিয়া সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল কিছুটা, তারপর বলল, আজ হাম কুছ নেহি খায়-হামকো কই খানে নেহি দিয়া।
সে কী, কেন? অবাক হয়ে গেল অনিমেষ।
বেচারা রেতিয়া অন্ধ বলে কাজ করতে পারে না এবং ওর বাপ মা দাদার কাছে থাকে। তা হলে তারা ওকে খেতে দেয়নি কেন? বিমর্ষমুখে রেতিয়া বলল, আজ সুবেরে সব হরতাল পরব কিয়া। কই, ঘমে নেহি হ্যায়। সামনে সব হাড়িয়া পিকে বেহুঁশ হো গিয়া।
বাজারে গিয়ে চা খাসনি?
কেন দেয়নি জিজ্ঞাসা করল না অনিমেষ, শুধু পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশকিছু খুচরো পয়সা বের করে না শুনে রেতিয়ার হতের মুঠোয় গুঁজে দিল। রেতিয়া চমকে গিয়ে হাতটা ওপরে তুলতেই পয়াসগুলো আঙুলের ফাঁক গলে টুংটাং করে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল। যাঃ, গির গিয়া পয়সা। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে রেতিয়া মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে হাতড়ে পয়সা খুঁজতে লাগল। এখন এখানে ঘন অন্ধকার। সাদাচোখে কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মাঝে ছুটে-যাওয়া এক-টকেটা গাড়ি অন্ধকারকে ছুড়ে ফেলে মুহূর্তের জন্য চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে। এইরকম একঝলক আলোয় অনিমেষ দেখল অনেক দূরে রেতিয়ার নাগালের বাইরে একটা এক আনা পড়ে আছে। ও চট করে এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলতেই জায়গাটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। তীব্র আলোর পর অন্ধকার আরও গাঢ়তর হয়। ছড়িয়ে-থাকা পয়সাগুলো খুঁজতে ওকে এখন হাতড়াতে হচ্ছে। অনিমেষ আবিষ্কার করল, ওর সঙ্গে রেতিয়ার এই মুহূর্তে কোনো পার্থক্য নেই-দুজনেই এই মুহূর্তে অন্ধ।
ছোটমা বোধহয় আগে থেকেই বিছানাপত্র ঠিক করে রেখেছিলেন। মহীতোষের একটা পুরনো হোন্ডল ছিল, সেটাই পরিস্কার করে বিছানাপত্র ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। ঝাড়িকাকু সেটাকে মাথায় নিয়ে ওর সঙ্গে চলল। সকালে মহীতোষ তাঁর বন্ধু দেব্রতবাবুর ঠিকানা-লেখা একটা চিঠি দিয়ে দিয়েছেন অনিমেষকে। টেগ্রিাম করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি অবশ্যই স্টেশনে আসেন। প্রিয়তোষকে তিনি পরে জানাবেন, যদি ভরতি হতে অসুবিধে হয় তবেই যেন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মহীতোষ ভাই-এর সাহায্য নেওয়া ঠিক পছন্দ করছেন না।
টাকাপয়সা যত্ন করে ওর সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল। ছোটমা বারবার করে এ-ব্যাপারে সজাগ হতে বললেন ওকে। যাবার সময় যখন অনিমেষ ওদের প্রণাম করল, তখন, মহীতোষ অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, যখন যা দরকার হবে আমাকে জানিও, সঙ্কোচ করবে না।
কুচবিহার থেকে আসা বাসে জিনিসপত্র তুলে ও যখন উঠতে যাচ্ছে হঠাৎই ঝাড়িকাকু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল অনিমেষ, কিন্তু কান্না বড় ছোঁয়াচে রোগ। তবু সে কোনোরকমে ঝাড়িকাকুকে বলল, এই, তুমি কাঁদছ কেন?
সমস্ত বাসের লোক অবাক হয়ে দেখল, ঝাড়িকাকু কান্না গিলতে গিলতে বলল, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না রে, তোকে আর আমি দেখতে পাব না-তুই ফিরে এসে দেখবি আমি নেই, মরে গেছি।
দাঁড়াতে পারল না অনিমেষ, ঠোঁট কামড়ে দ্রুত বাসে উঠে পড়ল। বাসসুদ্ধ লোক এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝাড়িকাকু সরে রাস্তার পাশে যেতেই বাসটা ছেড়ে দিল। দুহাতে নিজের গাল চেপে সেই বেঁটেখাটো প্রৌঢ় মানুষটাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল সে। হঠাৎ ওর সমস্ত শরীরে টা দিয়ে উঠল, সত্যি যদি তার ঝড়িকাকুকে না দেখতে পায়? চোখ বন্ধ করে ফেলল অনিমেষ।
হুহু করে বাসটা ছুটে যাচ্ছে। সেই ইউক্যালিপটাস গাছগুলো-ওদের কোয়ার্টারগুলো, স্বৰ্গছেঁড়ালেখা বাগানের বিরাট বোটা সে দৌড়ে দৌড়ে পেছনে চলে যেতে লাগল। ওদের বাড়ির বারান্দায় কি ছোট দাঁড়িয়েছিলেন? ঠিক বুঝতে পারল না অনিমেষ। সবুজ গালচের মতো চা-বাগানটা যেন ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। দূরের ফ্যাক্টরি-বাড়িটার ছাদ চোখে পড়ল। মহীতোষ বোধহয় এতক্ষণে সেখানে ফিরে গিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। হঠাৎ এই মুহূর্তে অনিমেষের বাবার জন্য কষ্ট বোধ হল। ওর। মনে হল ও যেন বাবাকে ঠিক বুঝতে পারিনি। কেমন একা একা হয়ে আছেন উনি, সেখানে অনিমেষ কেন, ছোটমাও কোনোদিন পৌঁছাতে পারেনি।
মুঠো বন্ধ করার মতো একসময় স্বৰ্গছেঁড়া হারিয়ে গেল। আংরাভাসার পুল পেরিয়ে যেতেই অনিমেষ পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিল। ওকে এখন অনেক দূর যেতে হবে, অনেক দূর। পেছনে স্বর্গছেঁড়া চুপচাপ পড়ে থাক। সেই ছোট্টবেলার নদীটা এবং তার রঙিন মাছগুলো, সেই কুয়াশার অথবা কাঁঠাল গাছের অন্ধকারগুলো–তারা এখানে ঘোরাফেরা করুক। নতুন দিদিমণি নেই, ভবানী মাস্টার যেখানে গিয়েছেন সেখানে কি এই স্বৰ্গছেঁড়ার মতো শান্তি আছে? জানা নেই, কিন্তু সেই ঘামের গন্ধমাখা স্নেহের স্পর্শটুকু তিনি নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে পারেননি। স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার দিনদিন পালটে যাচ্ছে-জলপাইগুড়ি শহরটা যেন ক্রমশ স্বৰ্গছেঁড়াকে গ্রাস করে নিচ্ছে-নিক, এখন তার কিছুই এসে, যায় না। তবু কেন যে রেতিয়ারা এখনও বোকার মতো পায়ে মেপে এক কাপ চায়ের জন্য অতটা পথ হেঁটে যায় আর অনেক বছর পরও তার গলা শুনে চট করে চিনে ফেলে! হয়তো একদিন আর পারবে না। অনিমেষের খেয়াল হল এই পথ দিয়েই সীতা মাথায় মুকুট পরে দুটো চোখ-চেয়ে দেখতে-দেখতে চলে গেছে।