সিংহগড়ের কিচনি-রহস্য

সিংহগড়ের কিচনি-রহস্য

সেবার অক্টোবর মাসে কর্নেলের সঙ্গে সিংহগড়ে বেড়াতে গিয়ে এক অদ্ভুত পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম। অদ্ভুত বলার কারণ, সে আচমকা একটা গাছের ডাল থেকে আমার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে কাতুকুতু দিয়ে অস্থির করছিল একটা ছড়া শেখানোর জন্য।

হ্যাঁ–একটা অদ্ভুত ছড়া।

তবে ঘটনাটা গোড়া থেকেই বলা যাক। সিংহগড় বিহারের একটা সমৃদ্ধ শিল্পকেন্দ্র। আমরা উঠেছিলুম জনপদ থেকে একটু দূরে ধারিয়া নদীর তীরে একটা টিলার গায়ে সরকারি ডাকবাংলোতে। রাত্রে পৌঁছে ভোরে যথারীতি কর্নেল মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন। এবং ফিরে এসে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরুব, জয়ন্ত। সিংহগড়ের পুরনো বসতি এলাকায় একটা গাছে দুর্লভ প্রজাতির একটা অর্কিড দেখে এলুম। অত উঁচুতে এই প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে উঠতে পারলুম না। এবার গিয়ে দেখা যাক, উঁচু গাছে চড়ার জন্য কোনও লোক খুঁজে পাই নাকি। খিদে পেয়েছিল বলে তাড়াতাড়ি চলে এলুম।

ব্রেকফাস্ট করে আমরা ন’টা নাগাদ বেরিয়েছিলুম। পাহাড়ি এলাকা। পুরনো বসতি নির্জন খাঁ-খাঁ করছিল। রাস্তাটাও এবড়ো-খেবড়ো। দু-ধারে ঢেউ খেলানো মাটির ওপর একটা করে পুরনো বাড়ি। অনেক বাড়িরই চৌহদ্দির পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, বাগানবাড়ির মতো। রাস্তার দু-ধারে যত ঝোঁপঝাড়, তত গাছ। কর্নেল আমাকে একখানে দাঁড়াতে বলে সামনে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই বাড়িটার উঠোনে একটি কিশোর গরু চরাচ্ছিল। ঘাস আর ঝোঁপঝাড় ভর্তি উঠোন।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ওপর থেকে মাথায় ঝাকড়মাকড় চুল, মুখে গোঁফদাড়ি, গায়ে ময়লা, ছেঁড়া হাওয়াই শার্ট, পরনে হাঁটু থেকে ছেঁড়া পাতলুন, একটা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে হি-হি হেসে বলল, এই ছড়াটা বল দিকি! নইলে কাতুকুতু দেব।

বলেই সে আওড়াল :

পঞ্চভূতে ভূত নাই
মুখে ঈশ ভজ ভাই
তালব্য শ পালিয়ে গেলে
যোগফলে অঙ্ক মেলে
হর হর ব্যোমভোলা
খাও ভাই গুড়ছোলা।।…

আমি চমকে গিয়ে হতবাক। সে আমাকে নোংরা আঙুলে কাতুকুতু দিতে শুরু করল। বল। বল। নইলে কাতুকুতু-কাতুকুতু-কাতুকুতু…

অগত্যা চেঁচিয়ে ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল! কর্নেল সেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছেন। আমার চিৎকার কানে ঢুকছে না। এদিকে পাগল আমাকে ছড়াটা না শিখিয়ে ছাড়বে না। বারবার ছড়াটা বলছে আর কাতুকুতু দিচ্ছে। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতেও পারছি না।

সেই সময় ডানদিকের বাড়ি ভাঙাচোরা গেট সরিয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটি ছড়ি। তিনি তাড়া করে এলেন। অ্যাই বাঁদর। আবার বদমাইসি শুরু করেছ? লাঠিপেটা করব হতভাগাকে।

পাগল সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে গাছপালার ভেতর উধাও হয়ে গেল। ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না। ও আমার ছোটভাই বিক্রমজিৎ। ক’মাস থেকে উন্মাদ রোগে ভুগছে। রাঁচির কাছে কাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলুম। সেখান থেকে পালিয়ে এসে লোককে জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে। তা আপনারা কি কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন?

এতক্ষণে কর্নেল ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। বললেন, কী হয়েছে জয়ন্ত?

ভদ্রলোক বিব্রতভাবে বললেন, তেমন কিছু না। আমার ভাইয়ের কথা হচ্ছিল। আমার ভাই বিক্রমজিৎ উন্মাদ রোগে ভুগছে।

কর্নেল হেসে ফেললেন। জয়ন্তকে কাতুকুতু দিচ্ছিল দেখলুম। আপনি কি এখানকার বাসিন্দা?

ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ। আমার নাম অমরজিৎ সিংহ। এই বাঙালিটোলায় থাকি। ওই আমার বাড়ি। আপনাদের পরিচয় পেলে খুশি হতুম।

কর্নেল তার একটা নেমকার্ড এঁকে দিলেন। উনি সেটা পড়ে বললেন, আপনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? নেচারিস্ট মানে?

প্রকৃতি প্রেমিক বলতে পারেন। আর আমার এই তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার। অমরজিৎ আমাদের নমস্কার করে বললেন, কী বলব কর্নেলসায়েব! আমারই পূর্বপুরুষের নামে সিংহগড় নাম। একসময় আমার পূর্বপুরুষ এখানকার জমিদার ছিলেন। তাদের পদবি ছিল রাজা। এখন প্রায় নিঃস্ব অবস্থা বলতে পারেন। অভিশাপ কর্নেলসায়েব। দেবতার অভিশাপ।

কর্নেল বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহ হচ্ছে। তবে আমার এই হবি। ওই গাছের ডগায় একটা অর্কিডের ঝাড় আছে। এই ছেলেটিকে দিয়ে সেটা পেড়ে আনাই আগেই। তারপর কথা হবে।

অমরজিৎ সিংহ বললেন, চলুন। আপনাদের সঙ্গে যাই নইলে পাগল বিক্রমজিৎ হয়তো আবার উৎপাত শুরু করবে। এদিকটাতে বাইরের লোক দেখতে পেলেই ওর পাগলামি বেড়ে যায়।

বাঁ-দিকে পোড়ো একটা বাড়িরই অংশ ছিল জায়গাটা। সেখানে জঙ্গল হয়ে আছে। একটা বিশাল শিরীষ গাছের ডগায় কর্নেল অর্কিড়টা ছেলেটিকে দেখিয়ে দিলেন। সে তরতর করে চড়ে গেল ডগায় এবং কর্নেলের নির্দেশ মতো অর্কিডের ঝাড়টা উপড়ে নিয়ে নেমে এল। কর্নেল তাকে দশ টাকা বখশিস দিলেন। সে খুশি হয়ে চলে গেল।

.

কর্নেল পিঠে আঁটা কিটব্যাগ থেকে একটা পলিথিনের থলি বের করলেন। থলির ভেতর কালো কাদার মতো জিনিসের ওপর অর্কিডের ঝাড়টা বসিয়ে দিয়ে বললেন, ব্যাস! আমার কাজ শেষ।

অমরজিৎ বললেন, থলের তলায় এগুলো কি সার? কর্নেল হাসলেন। সার বলার চেয়ে পরজীবী এই উদ্ভিদের খাদ্য বলা উচিত। ওগুলো পচা কাঠের গুঁড়ো। তার সঙ্গে কিছু মাটি মেশাতে হয়েছে। আসলে কাঠে কার্বন আছে। গাছের ডালের কোনওে খোঁদলে বৃষ্টির জল জমে জায়গাটায় পচন ধরে। সেখানে অর্কিডের সূক্ষ্ম বীজকণিকা বাতাসে উড়ে এসে পড়লে অর্কিড় গজায়। তার খাদ্য ওই পচা কাঠের কার্বন।

রাস্তায় গিয়ে অমরজিৎ বললেন, এখানে একসময় প্রচুর বাঙালি ভদ্রলোক বাস করতেন। এখন অনেকেই বাড়ি বেচে দিয়ে বা ফেলে রেখে চলে গেছেন। কালেভদ্রে বাঙালিরা এখানে বেড়াতে আসেন। আপনারা দয়া করে যদি গরিবের বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দেন, খুশি হব।

কর্নেল বললেন, অবশ্যই। বিশেষ করে আপনার পূর্বপুরুষই এই সিংহগড়ের প্রতিষ্ঠাতা। আপনার কাছে পুরনো কথা শুনলে ভালো লাগবে।

গেটটা লোহার। কিন্তু মরচে ধরে অর্ধেকটা ভেস্তে গেছে। বাউন্ডারি ওয়াল মোটামুটি টিকে আছে। উঠোনে শুকনো ফোয়ারা এবং গাড়িবারান্দা বা পোর্টিকো আছে। দোতলা বাড়ি। আমাদের নিচের হলঘরে বসিয়ে অমরজিৎ ওপরে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, দিদিকে বললুম আপনাদের কথা। আপনারা অতিথি। অন্তত এক কাপ চা না খাওয়ালে চলে?

ঘরটা হলঘরই বটে। একপ্রান্ত থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে সিঁড়িটা কাঠের। বনেদিয়ানার নিদর্শন এটা। কিন্তু ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। কয়েকটা ছেঁড়াফাটা গদি আঁটা চেয়ার আর একটা বিশাল গোল টেবিল। একপাশে তক্তাপোশ মাদুর পাতা এবং একটা বিছানা গোটানো আছে।

আমরা চেয়ারে বসলুম। উল্টোদিকে মুখোমুখি অমরজিৎ বসে একটু হেসে বললেন, যমপুরীর যম হয়ে বসে আছি কর্নেলসায়েব। কিন্তু যম তো ধনসম্পদ পাহারা দেয়। আমি কি পাহারা দিচ্ছি? শুধু বংশের স্মৃতি এই বাড়িটা। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই গায়ের জোরে কেউ দখল করে ফেলবে। যেমন, বেশ কিছু বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। এদিকে বাড়ি যে বেচব, কিনবে কে? এদিকটায় লোকে আসতে চায় না। কারণ, টাউনশিপের দিকে যেসব সুযোগসুবিধা–রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, জলের কল এসব আছে, এদিকটায় সেসব নেই। কুয়ো থেকে জল তুলতে হয়। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। পুর্বদিকে ধারিয়া নদীর ধারে একটা জেলেবসতি আছে। তারা গরিব লোক। মহাজন তাদের রক্ত শুষে নেয়।

কর্নেল বললেন, আপনি দেবতার অভিশাপের কথা বলেছিলেন।

অমরজিৎ জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠাকুরদার ঠাকুরদা যে দুর্গপ্রাসাদে বাস করতেন, সেটা এখন ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গল। ঠাকুরদা বাবার আমলে জমিদারির খানিকটা টিকে ছিল। তিনিই এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। মাঝে-মাঝে এসে এই বাগানবাড়িতে বাস করতেন। পরে দুর্গপ্রাসাদ মেরামতের অভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। তখন শেষ জীবনটা এ বাড়িতে কাটান। সেই সময় দুর্বুদ্ধিবশে তিনি গৃহদেবতার রত্নালঙ্কার বিক্রি করে ব্রিটিশ সরকারের প্রাপ্য বার্ষিক কর পরিশোধ করেন। কর না মেটালে জমিদারি নিলামে বিক্রি হয়ে যেত। ব্যাস! গৃহদেবতার অভিশাপ লাগল। ঘোড়ায় চড়ে যেতে-যেতে হঠাৎ সেই ঘোড়া কেন যেন খেপে গিয়ে তাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। তিনি পাহাড়ের খাদে পড়ে মারা যান। আমার ঠাকুরদা শত্রুজিৎ সিংহের বাতিক ছিল পায়রা পোষা। এ বাড়ির ছাদে পায়রা ওড়ানোর সময় তিনি পা ফস্কে নিচে পড়ে মারা যান। আমার বাবার নাম ছিল ইন্দ্রজিৎ। তাঁর শখ ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর। ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে তিনিও

অমরজিৎ হঠাৎ থেমে গেলেন। ওপর থেকে সাদা থানপরা এক মহিলা মৃদুস্বরে ডাকছিলেন, ঝন্টু, ঝন্টু!

অমরজিৎ সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে একটা ট্রে নিয়ে এলেন। তাতে দুকাপ চা আর দুটো প্লেটে দুটো করে সন্দেশ ছিল। তার অনুরোধে সন্দেশ খেতে হল। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, আশ্চর্য লাগছে। পর-পর দুর্ঘটনায় মৃত্যু!

অমরজিৎ বললেন, অভিশাপ। তাছাড়া আর কী বলব? ঠাকুরমা আমাদের দু-ভাই এবং দিদিকে মানুষ করেছিলেন। দিদির বিয়ে দিয়েছিলেন পাটনায়। জামাইবাবু ছিলেন রেলের অফিসার। বিয়ের দু-মাস পরে তিনি ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। অথচ আমাদের বংশের ওপর দেবতার অভিশাপ।. যাই হোক, ঠাকুরমা মারা গেলে দিদি আমাদের দুই নাবালক ভাইয়ের গার্জেন হলেন। জমিদারি বাবার আমলেই হাতছাড়া হয়েছিল। কিছু জমি আর একটা আমবাগানের জোরে প্রাণরক্ষা। এখানকার আম খুব বিখ্যাত। গ্রীষ্মে এলে আম খাওয়াতে পারতুম। তবে চোরের উৎপাতে অস্থির। আজকাল গাছের মুকুল এলে আম ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে দিই। একথোক টাকা পাই।

কর্নেলে চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনার ভাই পাগল হয়েছেন কবে?

গত ডিসেম্বরে মন্টু–মানে বিক্রমজিৎ গড় জঙ্গলে ঢুকেছিল। ওর পাখি পোষার বাতিক আছে। পাখি ধরতে গিয়েছিল ওর বন্ধু মাধবের সঙ্গে। মাধবের কাছেই শুনেছিলুম, হঠাৎ মন্টু পা হড়কে পড়ে যায়। তারপর হাত-পা ছুঁড়ে প্রলাপ বকতে-বকতে দৌড়ুতে থাকে। মাধব আমাকে খবর দিয়েছিল। কয়েকজন লোক নিয়ে ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। হঠাৎ একটা গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আবোলতাবোল কী সব বলতে শুরু করল। ওকে ধরে নিয়ে এলুম। তারপর শেষে কাকে হাসপাতালে রেখে এলুম। কিছুদিন আগে কীভাবে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। শুধু দিদির কথা শোনে। রাতে ওই বিছানায় শুয়ে থাকে। দরজার ভেতরে তালা এঁটে দিই। সারা রাত প্রলাপ বকে। দেবতার অভিশাপ ছাড়া আর কী বলব? বাবার মৃত্যুর পর মা হৃদরোগে মারা যান। শুধু আমি আর দিদি অভিশাপ থেকে এখনও পর্যন্ত মুক্ত আছি। সবই দেবতার রহস্যময় লীলা। আমাদের দুজনকে হয়তো আরও সাংঘাতিক কোনও শাস্তি দেবেন।

.

আপনার দিদির নাম কী?

পরমেশ্বরী।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মন্টুবাবু কী একটা ছড়া বলেছিলেন যেন?

অমরজিৎ হাসলেন। ঠাকুরমা আমাদের দু-ভাইকে ওই ছড়াটা শেখাতেন। কিছু বুঝি না।

ছাড়াটা কী যেন?

অমরজিৎ আওড়ালেন :

পঞ্চভূতে ভূ নাই
মুখে ঈশ ভজ ভাই
তালব্য শ পালিয়ে গেলে
যোগফলে অঙ্ক মেলে
হর হর ব্যোমভোলা
খাও ভাই গুড় ছোলা।…

গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে অমরজিৎ জিগ্যেস করলেন, আপনারা কোথায় উঠেছেন কর্নেলসায়েব?

কর্নেল বললেন, সরকারি ডাকবাংলোতে। আমরা কয়েকটা দিন আছি। সকাল নটায় ব্রেকফাস্টের সময় কিংবা সন্ধ্যার দিকে বাংলোয় থাকব। যদি ওখানে যান, খুশি হব। আপনাদের বংশের ঘটনাগুলো ভারি অদ্ভুত। আমারও অনেকরকম হবি আছে। অদ্ভুত-অদ্ভুত ঘটনা ঘটলে আমি সেখানে নাক গলাই।

অমরজিৎ কথাটা শুনেই চাপা গলায় বলে উঠলেন, তাহলে আজ সন্ধ্যায় আমি যাব। কারণ, বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিলেন। থাক। যথাসময়ে সব বলব।

কর্নেল অর্কিড ভর্তি থলেটা আমাকে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, জয়ন্ত! পাগলের হাতে কাতুকুতু খেয়ে তুমি জামাটা নোংরা করে ফেলেছ।

দেখে নিয়ে বললুম, ছ্যা, ছ্যা। কালি মাখিয়ে দিয়েছে দিখছি। ওর আঙুলে কালি লেগে ছিল।

কালি নয়। মনে হচ্ছে, পচা পাঁক ঘেঁটেছিল কোথাও। বলে কর্নেল হাসলেন। তুমি একটা কথা মনে রেখ। পাগল যা-যা করবে, তুমিও ঠিক তাই-তাই করলে সে তোমাকে পাগল ভেবে তক্ষুনি পালিয়ে যাবে। তুমি যদি ওকে পাল্টা কাতুকুতু দিতে, দেখতে ও তখুনি বলত, আরে, এ যে দেখছি এক পাগল। তারপর কেটে পড়ত।

বলেন কী? কোনও বইয়ে পড়ছেন বুঝি?

হ্যাঁ। পড়েছি। এই আচরণকে ইংরেজিতে বলে লোগোথেরাপি। এই মন্টু পাগল আজ আমাকেও কাতুকুতু দিতে হামলা করেছিল। আমি উল্টে ওকে কাতুকুতু দিতে গেলুম। কাতুকুতু কাতুকুতু কাতুকুতু। ব্যাস মন্টু থমকে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলে উঠল, দুচ্ছাই। এ যে দেখছি একটা বদ্ধ পাগল। বলে কেটে পড়ল।

আপনার ‘লোগোথেরাপি’ অনুসারে তোতলাদের সঙ্গে তোতলামি করতে গেলে কিন্তু বিপদ।

না। তোতলামি সারাতে তোতলাদের কোনও নাটকে তোতলার পার্ট দিতে হয়। আমি বলছি পাগলদের কথা। কর্নেল বাইনোকুলারে কী দেখে নিলেন। তারপর বললেন, কী কাণ্ড। পাগল মন্টু একটা গাছের মগডালে চড়ে বসে আছে দেখছি। আগে জানলে ওকে দিয়েই অর্কিডটা পেড়ে নিতুম।

.

দুই

দুপুরে আমাদের ঘরে ক্যান্টিন-বয় খাবার দিতে এল। কর্নেল তাকে জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী?

সে বিনীতভাবে বলল, আমি রামপরসাদ আছি স্যার।

আচ্ছা রামপ্রসাদ, এখানে গড়ের জঙ্গলটা কোথায়?

সে একটু ভেবে নিয়ে বলল, জি সার, আপনি কিনি-কিলার কথা বলছেন?

কিচনি কেন?

রামপ্রসাদ মুখে ভয়ের ছাপ ফুটিয়ে বলল, ওহি কিলার চারতরফ খাদা আছে সার। বহত পানি ভি আছে। খাদার পানিতে কিচনি আছে।

কর্নেল হাসলেন। তুমি দেখেছ?

না সার। উয়ো কিচনি যিসকো দেখা দেতি, উয়ো পাগলা হো য়াতা। অর মর যাতা।

রামপ্রসাদ চলে গেলে জিগ্যেস করলুম, কিচনি কী?

জলের প্রেতিনী। শুনলে তো? যাকে সে দেখা দেয়, সে পাগল হয়ে মারা পড়ে। মন্টু–মানে বিক্রমজিৎ সিংহ তাহলে গড়ের জঙ্গলে কিচনি দেখেই পাগল হয়েছে।

যত সব বাজে কুসংস্কার।

কর্নেল মাছের টুকরো থেকে কাটা ছাড়িয়ে মুখে ভরলেন। বললেন, এখানে নদী থাকায় মাছের অভাব নেই। কী অপূর্ব স্বাদ। আমার ধারণা গড়ের জঙ্গলের গড়খাইয়ে যে মাছগুলো আছে, তাদের স্বাদ আরও খাসা। সঙ্গে ছিপ আনলে মাছ ধরার চেষ্টা করতুম।

হেসে ফেললুম। তারপর কিচনি দেখে পাগল হয়ে আমাকে বিপদে ফেলতেন। আপনাকে রাঁচির কাকে উন্মাদাশ্রমে পাঠাতে হত।

তবে যে বললে বাজে কুসংস্কার?

হ্যাঁ। তবে কুসংস্কার মানুষকে নির্বোধ করে ফেলে এই যা।

কর্নেল তারিয়ে-তারিয়ে মাছ খেতে-খেতে বললেন, দেড়টা বাজে। আড়াইটেতে আমরা গড়ের জঙ্গল দেখতে যাব। সাবধান জয়ন্ত, তুমি যেন হঠাৎ কিছু দেখে নির্বোধ হয়ে পড়ো না।

খাওয়ার পর রামপ্রসাদ ট্রে নিতে এল। কর্নেল তাকে বললেন, রামপ্রসাদ! তুমি তখন সবই বললে। কিন্তু কিচনিকেলা কোথায় তা তো বললে না?

সে পশ্চিমের খোলা জানালার দিকে আঙুল তুলে বলল, উয়ো দেখিয়ে সার। ওহি জঙ্গল আছে।

লক্ষ করে দেখলুম, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা উঁচু ঢিবি দেখা যাচ্ছে। সেটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। যতদূর দেখা যাচ্ছে, ঢেউ খেলানো মাঠ–কোথাও আবাদি, কোথাও অনাবাদি এবং ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। তিনদিকে আরও দূরে নীল পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ ধীরে ভেসে বেড়াচ্ছে। বাংলোর নিচে দক্ষিণে একটা কাঁচা রাস্তা এগিয়ে গেছে। এঁকেবেঁকে অসমতল সবুজ প্রান্তরের বুক চিরে রাস্তাটা হয়তো কোনও পাহাড়ি জনপদে পৌঁছেছে।

কিছুক্ষণ পরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। কর্নেল যথারীতি পিঠে কিটব্যাগ এঁটে এবং তার মধ্যে প্রজাপতি ধরা জাল খুঁজে রেখেছেন। স্টিকটা টিনের ফাঁকে বেরিয়ে আছে। গলায় ঝুলছে ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার। রোদ থেকে টাক বাঁচাতে চুপি পরেছেন। পায়ে হান্টিং বুট পরেছেন। একেবারে অভিযাত্রীর প্রতিমূর্তি।

আমরা কাঁচা রাস্তায় জলকাদা বাঁচিয়ে সাবধানে হাঁটছিলুম। কর্নেল মাঝে মাঝে থেমে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। পাখি কিংবা প্রজাপতি।

দূরের কোনও পাহাড়ি গ্রাম থেকে একদল আদিবাসী আসছিল। তারা আমাদের দেখেও দেখল না। পাশ দিয়ে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে-বলতে চলে গেল। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর দেখলুম, রাস্তাটা গড়ের জঙ্গলকে এড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমে চলে গেছে। সেখানে একটা অনুর্বর ব্লাড় জমির উপর দিয়ে কর্নেল হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, গড়ের জঙ্গলে মানুষজন সত্যি যায় না দেখা যাচ্ছে। কোনও পায়ে চলা পথের চিহ্ন নেই।

বাঁদিকে নাক বরাবর এগিয়ে যতই ঢিবির ওপর জঙ্গলটার কাছাকাছি হচ্ছিলুম, কে জানে কেন একটু গা-ছমছম করছিল। জঙ্গলের ছায়া পূর্বে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। কারণ সূর্য পশ্চিমের আকাশে একটু ঢলে পড়েছে। চারদিকে অসংখ্য গ্রানাইট পাথর ছড়িয়ে আছে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর। গড়খাইয়ের সামনে পৌঁছে কর্নেল বললেন, ওই দেখ জয়ন্ত। ওইখানে ছিল দুর্গপ্রাসাদে যাওয়ার পথ। ব্রিজ ভেঙে জলে পড়ে গেছে। তবে এই টুকরোগুলোর ওপর দিয়ে জঙ্গলে ঢোকা যায়।

সেখানে গিয়ে লক্ষ করলুম, গড়খাইয়ের এপারে পুরনো রাস্তার কিছু চিহ্ন এখনও আছে। পাথরে বাঁধানো রাস্তার ওপর দু-ধারের মাটি ধুয়ে নেমে পথটাকে লুকিয়ে ফেলেছে। ব্রিজের কাঠামো পাথরে খিলান করা। ওপারে বিশাল তোরণের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছিল। মধ্যিখানে একটুখানি ফাঁকা জায়গা। তারপর পাথরের ইটের তৈরি পথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। নানারকম রঙবেরঙের ফুলে ভরা ঝোঁপঝাড়।

কর্নেল বাইনোকুলারে ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এস জয়ন্ত। সাবধানে পা ফেলবে। পাথরগুলো পিছল মনে হচ্ছে।

বললাম, ভাববেন না। মাউন্টেনিয়ারিংয়ের ট্রেনিং কাজে লাগাব।

গড়খাইয়ের জলটা কালো এবং কেমন আঁশটে গন্ধ যেন। সম্ভবত রাশিরাশি পাতা পচে এই অবস্থা হয়েছে। পেরিয়ে গিয়ে কর্নেল বললেন, এক মিনিট। দুটো ডাল কেটে লাঠি তৈরি করে নিই। সাপ থাকা খুবই সম্ভব। তা ছাড়া টাল সামলানোর জন্যও লাঠি দরকার।

উনি কিটব্যাগ থেকে ডালকাটা ‘জাঙ্গল নাইফ’ বের করে একটা বেঁটে অজানা গাছের শক্ত দুটো লম্বা ডাল কাটলেন। তারপর লাঠি তৈরি করে একটা আমাকে দিলেন।

দিলেন বটে, কিন্তু সাপের কথা ভেবে প্রতি মুহূর্তে শিউরে উঠছিলুম। ঝোঁপঝাড় এবং ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর একটা উঁচু পাথরের দেয়াল এবং ঘরের একটা অংশ চোখে পড়ল। ঘর বলা উচিত নয়। ঘরের অংশ। লোহার কড়িবরগা কোনও কালে কারা খুলে নিয়ে গেছে। স্থানে স্থানে উঁচু গাছও বিকেলের হাল্কা বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। জায়গাটা পাখির চিড়িয়াখানা বলা চলে। কর্নেল পাখি দেখছিলেন বাইনোকুলারে। দক্ষিণের ঢালে গাছপালার মাথায় বসে থাকা এক সারস দম্পতির ছবি তুললেন। ক্যামরার টেলিলেন্স ফিট করে নিয়েছিলেন আগেই। তারপর উত্তরে বাইনোকুলারে কী দেখতে-দেখতে চাপা স্বরে বলে উঠলেন। কী আশ্চর্য! জয়ন্ত, বসে পড়।

আমাকে কাঁধ চেপে বসিয়ে দিয়ে কর্নেল বসলেন। জিগ্যেস করলুম, কী?

কর্নেল বললেন, কিচনি নয় মানুষ।

কোনও আদিবাসী হয়তো শিকারে এসেছে?

না। বলে উনি আবার বাইনোকুলার চোখে রাখলেন। আস্তে বললেন, ভদ্রলোককে আমি বাংলোয় দেখেছি। দোতুলার উত্তরদিকের ঘরে উঠেছেন। কিন্তু উনি এখানে কী করছেন?

এতক্ষণে লোকটাকে দেখতে পেলুম। প্যান্ট, চকরাবকরা গেঞ্জি এবং মাথায় টুপি পরা ষণ্ডামার্কা চেহারার একটা লোক। মুখে জমকালো গোঁফ আছে। একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে এস। একটু পরে সে চমকে ওঠার ভঙ্গিতে ডাইনে ঘুরে দাঁড়াল এবং পকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে দুহাতে ধরে দুবার গুলি ছুড়ল। নিঝুম জঙ্গলে আচমকা বিকট শব্দ এবং ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখি উড়ে পালিয়ে গেল।

লোকটা এবার যেন ভয় পেয়েই পাথর থেকে লাফ দিয়ে নেমে গুঁড়ি মেরে দৌড়োতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে দেখলুম পূর্বের তোরণের ধ্বংস্তূপের কাছে একবার ঘুরে কিছু দেখল এবং আবার একটা গুলি ছুঁড়ে নেমে গেল ঢাল বেয়ে।

কর্নেল এবার একটু উঁচু হয়ে বাইনোকুলারে দেখতে-দেখতে বললেন, পালিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রলোক। জানি না, কিচনি দেখে গুলি ছুঁড়ে পালাচ্ছেন কি না। বাংলোয় ফিরে হয়তো আর একজন পাগলের দেখা পাব।

কর্নেলের কৌতুকে কান দিলুম না। বললুম, আপনি অদ্ভুত ঘটনা দেখলে নাক গলান। এটা একটা সাংঘাতিক অদ্ভুত ঘটনা।

হুঁ। একটু অপেক্ষা করো। ভদ্রলোক আরও দূরে চলে গেলে ব্যাপারটা দেখতে যাব।

আমি সেই পাথরের চত্বরটার দিকে লক্ষ রেখেছিলুম। এতক্ষণে দেখলুম, কী আশ্চর্য, সেই মন্টু পাগল চত্বরটাতে উঠে ধেই-ধেই করে নাচছে এবং ছড়াটা আওড়াচ্ছে।

একটু পরে সে অদৃশ্য কোনও লোককে কাতুকুতু দিতে থাকল। মুখে বলছিল সে, কাতুকুতু, কাতুকুতু, কাতুকুতু।

কর্নেল বললেন, পাগলকে দেখে ওই ভদ্রলোক ভয় পেয়ে গুলি করলেন কেন? অমন করে পালিয়েই বা গেলেন কেন? চলো জয়ন্ত আমরা মন্টুবাবুর কাছে যাই।

বললুম, যদি ও ঢিল ছোঁড়ে?

এস তো দেখা যাক।

কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। কিছুটা এগিয়ে একটা চাঙড়ে উঠে কর্নেল ডাকলেন, মন্টুবাবু। কাতুকুতু দেব। কাতুকুতু, কাতুকুতু, কাতুকুতু।

অমনি পাগল করজোড়ে বলে উঠল, ওরে বাবা। মরে যাব। মাইরি মরে যাব।

তাহলে চুপটি করে দাঁড়ান।

দাঁড়িয়েই তো আছি মুনিবর। পাগল হেসে অস্থির হল। মুখে দাড়ি দেখলে মাইরি সাধু সন্থেসি মনে হয়। সক্কালে দূর থেকে চোখে কালো চোঙ লাগিয়ে কী দেখছিলে বলো তো?

কর্নেল বললেন, আপনাকে দেখছিলুম। আপনি গাছে-গাছে গেছোবাবা হয়ে ঘোরেন কেন?

পাগল বলল, ঘুরি কি সাধে রে ভাই? দেখতে পেলে যে ওরা ধরে নিয়ে যাবে। তারপর অ্যায়সা কাতুকুতু দেবে, ওরে বাবা!

কথা বলতে-বলতে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কর্নেল। আমি তার পেছনে। পাথরের চত্বরটার কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল চাপা গলায় বললেন এক ভদ্রলোক এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে পালিয়ে গেলেন কেন?

পাগল হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, ভয় পেয়ে পালাল।

কিচনি দেখে?

ওরে বাবা। বোলো না। নাম করলেই বিপদ।

কিন্তু আপনাকে তো কিচনি কিছু বলেন না!

পাগল গম্ভীর মুখে বলল, ওর সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেছে। বলে দুপা পিছিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকাল সে। এই! তোমরা রাঁচি থেকে আমাকে ধরতে আসো নি তো?

কখনও না। আমরা কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছি। তা আপনি নাকি ক’মাস আগে এই গড়ের জঙ্গলে এসে কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন। তারপর পাগল হয়ে

পাগল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি পাগল না রে ভাই। আমাকে পাগল বললে খুব দুঃখ পাই।

ঠিক আছে আপনি পাগল না। কিন্তু এখানে কেন এসেছিলেন? কেন এখানে এখনও আসেন?

কী কথার ছিরি! আসব না? ছোটবেলা থেকে আসি। আমার চৌদ্দ পুরুষের জায়গা। ঠাকুরমা বলতেন, রোজ গড়ের জঙ্গলে যাবি। বলে সে ঠোঁটে তর্জনী রাখল। নাহ্। বলব না। ঠাকুরমা পইপই করে বলেছিলেন, কাউকে কিছু বলবিনে।

দাদাকেও বলবেন না?

কখনও না।

দিদিকে?

উঁহু।

জোরে মাথা নেড়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে নিচে নামল। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে কোথায় লুকিয়ে গেল।

কর্নেল পাথরের চত্বরে উঠে বাইনোকুলারে তাকে খুঁজতে থাকলেন। তারপর বললেন, আশ্চর্য তো! কোথায় গেলেন মন্টুবাবু?

হয়তো কোথাও গুঁড়ি মেরে বসে আছেন।

কর্নেল চত্বর থেকে নেমে বললেন, এস তো। যেদিক থেকে উনি এসেছিলেন, সেই দিকটা একবার দেখা যাক।

উত্তর-পশ্চিম কোণে পাথরের ঘরের যে অংশটুকু টিকে আছে, সেখানে গিয়ে কর্নেল খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে হেসে উঠলেন।

জিগ্যেস করলুম, হাসছেন কেন?

ওই দেখ জয়ন্ত। এখানে-ওখানে কারা খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। আসলে সর্বত্র প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ গুপ্তধনের গুজব রটনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

প্রকৃত পাগল এই গুপ্তধন সন্ধানীরা। বলে কর্নেল পূর্বদিকে ঘুরলেন। চলো। ফেরা যাক। আলো কমে এসেছে।

.

আমরা পূর্বদিকের ভাঙা তোরণের কাছে পৌঁছুলুম। তোরণের ধ্বংসস্তূপের ওপর একটা উঁচু অশ্বত্থ গাছের ডগা থেকে মন্টু পাগলের চিৎকার শোনা গেল। সেই ছড়াটা সুর ধরে সে আওড়াচ্ছে–

পঞ্চভূতে ভূত নাই
মুখে ঈশ ভজ ভাই
তালব্য শ পালিয়ে গেলে
যোগফলে অঙ্ক মেলে
হর হর ব্যোমভোলা
খাও ভাই গুড়ছোলা।…

আমরা সাবধানে গড়খাই পেরিয়ে গিয়ে সে পথে এসেছিলুম, সেই পথে ফিরে চললুম। বাংলোয় পৌঁছতে ছটা বেজে গেল। দোতলায় উঠে কলিংবেল বাজিয়ে রামপ্রসাদকে ডেকে কর্নেল কফি আনতে বললেন। তারপর দক্ষিণের ব্যালকনিতে বসলেন। এই সময় দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল বললেন, কাম ইন।

অবাক হয়ে দেখি, সেই চকরাবকরা গেঞ্জি পরা ষণ্ডামার্কা ভদ্রলোক। তিনি নমস্কার করে বললেন, একটু বিরক্ত করতে এলুম। কিছু মনে করবেন না। জানলা দিয়ে আপনাদের গড়ের জঙ্গল থেকে ফিরতে দেখছিলুম। তাই একটা কথা জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হল। আপনারা ওখানে ভয়ঙ্কর চেহারার কালেকুচ্ছিত একটা প্রাণীকে দেখতে পাননি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য। আমরা চিনির দর্শন পাইনি।

ভদ্রলোক চেয়ারে বসে বললেন, ওহ। আমার একটা হরিল এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে।

কর্নেল বললেন, বলুন। শোনা যাক।…

.

তিন

ভদ্রলোকের পরিচয় জানা গেল কথার ফাঁকে। তাঁর নাম হীরালাল রায়। পাটনায় থাকেন। বংশ পরম্পরায় বাঙালি। পাটনায় কন্ট্রাক্টর এবং অর্ডার সাপ্লাই-এর ব্যবসা আছে তার। সিংহগড়ে ব্যবসার কাজে এসেছেন। এখানে এসে গড়ের জঙ্গলে কিচনির গল্প শুনেছেন। তাঁর এই একটা স্বভাব। অদ্ভুত কোনও গল্প শুনলেই তার সত্যমিথ্যা যাচাই করা। তাই তিনি জেদের বশে গড়ের জঙ্গলে গিয়েছিলেন।

.

তারপর ঘুরতে-ঘুরতে একখানে থপথপ শব্দ শুনে চমকে ওঠেন। পরক্ষণে তার চোখে পড়ে, বিশাল ব্যাঙের মতো একটা কালো রঙের জন্তু। কিন্তু মাথায় বড়-বড় চুল আছে। মুখটা ভয়ঙ্কর। দুটো লাল চোখ ঠেলে বেরিয়ে আছে।

দেখামাত্র হীরালালবাবু তার লাইসেন্স করা রিভলভার থেকে দুবার গুলি ছোড়েন। লক্ষভ্রষ্ট হয়েছিল গুলি। তিনি আঁতকে দিশাহারা হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। যেতে-যেতে একবার ঘুরে দেখেন, বীভৎস জন্তুটা তাকে তাড়া করে আসছে। তখন আবার একবার গুলি ছোড়েন। কিন্তু এবারও গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তখন তিনি প্রাণভয়ে গড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে আসেন।

আমি বলতে যাচ্ছিলুম, তাকে আমরা পালাতে বা গুলি ছুঁড়তে দেখেছি। কিন্তু কর্নেল আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন, আমরা কিন্তু কিছুই দেখিনি। তবে একজন পাগলকে উঁচু গাছের মগডালে চড়ে গান গাইতে দেখেছি।

হীরালাল ভুরু কুঁচকে বললেন, পাগল? গাছের ডালে?

হ্যাঁ। বদ্ধ পাগল ছাড়া আর কে গাছের মগডালে চড়ে গান গাইবে?

এই সময় রামপ্রসাদ কফির ট্রে নিয়ে এল। কর্নেল হীরালালবাবুকে কফি খেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি চা-কফি কিছুই খান না। তিনি এবার বললেন, আপনারা কি কলকাতা থেকে আসছেন?

কর্নেল পকেট থেকে তার নেমকার্ড দিলেন। আমিও আমার নেমকার্ড দিলুম। হীরালালবাবু কার্ড দুটো পড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনি রিটায়ার্ড কর্নেল! আর আপনি সাংবাদিক। কর্নেলসায়েব আপনি গভমেন্টকে যদি জানান, তাহলে মিলিটারি পাঠিয়ে গড়ের ঙ্গল খুঁজে আজব জন্তুটাকে ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেবে। আর জয়ন্তবাবু আপনি খবরের কাগজে ব্যাপারটা লিখলে তা আরও ভালো হয়।

কর্নেল হাসলেন। আগে কিচনির দর্শন পাই এবং তার ফটো তুলি, তবে তো?

হীরালালবাবু চলে গেলেন। ততক্ষণে আলো জ্বেলে দিয়েছিল রামপ্রসাদ। আমরা চুপচাপ কফি খেতে থাকলুম। একটু পরে কর্নেল আস্তে বললেন, ভদ্রলোকের কথা শুনে কী মনে হল জয়ন্ত?

সত্যি কথাই বললেন। কিছু গোপন করলেন না।

হ্যাঁ। তবে একজন ব্যবসায়ী লোকের পক্ষে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার কতটা স্বাভাবিক এটাই প্রশ্ন।

ব্যবসায়ী হলে কি কেউ অ্যাডভেঞ্চারার হতে পারে না?

পারে হয় তো। কিন্তু—

কিন্তু কী?

কর্নেল চুপচাপ কফি খাওয়ার পর চুরুট ধরিয়ে বললেন, একটা অস্বাভাবিকতা থেকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী লোক। ব্যবসার কাজে সিংহগড়ে এসেছেন। কাজেই পরিচিত লোকজন আছে। সত্যি কিচনি দেখার জন্য গড়ের জঙ্গলে গেলে হীরালালবাবুর পক্ষে সঙ্গীসাথী নিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। একা গিয়েছিলেন কেন? কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে আপন মনে বললেন, নাহ। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া ওঁর বয়স। উনি যুবক নন যে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে উৎসাহ থাকবে। ওঁর বয়স পঞ্চাশের বেশি বলেই মনে হল। এ বয়সে-নাহ জয়ন্ত। খটকা থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া আমরা ওঁকে নেমকার্ড দিলুম। কিন্তু উনি আমাদের ওঁর নেমকার্ড দিলেন না। আজকাল ব্যবসায়ীরা পকেটে নেমকার্ড নিয়ে ঘোরে।

কর্নেলের ব্যাখ্যায় যুক্তি ছিল। তবে এ নিয়ে ওঁর মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। স্পোর্টিং গেঞ্জি এবং প্যান্ট পরা শক্ত সমর্থ গড়নের মানুষ হীরালাল রায়। সঙ্গে লাইসেন্স করা রিভলভারও আছে। রিভলভার–

অ্যাঁ? নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হয়ে মুখ দিয়ে শব্দটা বের করে ফেললুম।

কর্নেল বললেন, কী হল জয়ন্ত?

আচ্ছা কর্নেল, কোনও ব্যবসায়ী রিভলভার রাখতে পারেন, যদি শত্রুর ভয় থাকে তবেই। তাই?

কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ।

কিংবা যে ব্যবসায়ী দামি জিনিসের কারবার করেন, সঙ্গে প্রচুর টাকাকড়ি থাকে, তিনি আত্মরক্ষার জন্য–

কথায় বাধা পড়ল। রামপ্রসাদ এসে সেলাম দিয়ে বলল, এক বাবুসাব আসলেন সার। আপনাদের সঙ্গেতে দেখা করবেন।

পাঠিয়ে দাও তাকে। আর একটা বাড়তি কাপপ্লেট দিয়ে যাও। পটে এখনও কফি আছে।

রামপ্রসাদ যাঁকে নিয়ে এল, তিনি অমরজিৎ সিংহ। পরিচ্ছন্ন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। হাতে একটা ছড়িও আছে। নমস্কার করে ব্যালকনিতে একটা চেয়ারে বসলেন তিনি।

কর্নেল বললেন, গড়ের জঙ্গলে বিকেলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আপনার ভাইকে দেখলুম।

অমরজিৎ বললেন, ওকে আটকে রাখতে পারি না। বেঁধে রাখলে দিদি বকাবকি করে। ওই গড়ের জঙ্গলে ঢুকে কী দেখে আতঙ্কে পাগল হয়ে গিয়েছিল। এবার প্রাণটা হারাবে। কী করব বলুন?

রামপ্রসাদ একটা কাপপ্লেট দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এস।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বসলুম। কর্নেল অমরজিৎবাবুকে কফি তৈরি করে দিয়ে বললেন, আপনি কীসব ঘটনার কথা বলবেন বলেছিলেন। এবার স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।

অমরজিত্যাবু কফি খেতে-খেতে বললেন, মন্টু পাগল হওয়ার পর থেকে ন’মাসে মোট ন’খানা উড়ো চিঠি পেয়েছি। একই কথা। একই কাগজে লাল কালিতে লেখা। সঙ্গে এনেছি। দেখাচ্ছি। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না।

বলে পাঞ্জাবির ভেতর পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন উনি। খামটা হলুদ রঙের। কর্নেলের হাতে দিয়ে আস্তে বললেন, চিঠিগুলো প্রতি ইংরেজি মাসের মাঝামাঝি ভোরবেলা গেটের ভেতর ভাঁজ করে কেউ ফেলে দিয়ে যায়। দিদিরি পরামর্শে এ নিয়ে পুলিশের কাছে যাইনি। পড়ে দেখলেই বুঝবেন।

কর্নেল খাম থেকে ভাঁজ করা চিঠিগুলো বের করলেন। চোখ বুলিয়ে আমাকে একটা চিঠি দিলেন দেখলুম, সম্বোধনহীন চিঠিতে আঁকাবাঁকা বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে–

দেবতার অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলে শীঘ্র তাকে
উদ্ধার করে গড়ের জঙ্গলে ঈশান কোণে
শিমুলতলায় গোপনে রেখে এস। রাখার পর আর
পিছনে তাকিও না। তাহলে আবার অভিশাপ
লাগবে। সাবধান। এই কথা যেন কেউ জানতে
না পারে। জানালে অনিবার্য মৃত্যু।

কর্নেল ন’খানা চিঠিতে চোখ বুলিয়ে ভাঁজ করে খামে ভরে বললেন, আপনাদের গৃহদেবতা কী?

অমরজিৎ বললেন, শিব। আমাদের বাড়িতে ছোট একটা মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে। দিদি তার পুজোআচ্চা নিজেই করে। আগে একজন ব্রাহ্মণ পুজারি ছিলেন। অর্থাভাবে তাকে বিদায় দিতে হয়েছিল। আমরা ক্ষত্রিয়। কিন্তু দিদির মতে, ক্ষত্রিয়েরও পুজোর অধিকার আছে। যাই হোক, এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু চিঠিগুলো অদ্ভুত। কোন দেবতাকে উদ্ধার করতে হবে বা কীভাবে করতে হবে, জানি। তিনি কোথায় আছেন, তাও জানি না।

কর্নেল বললেন, আপনি বলছিলেন, আপনার ঠাকুরদার বাবা নাকি গৃহদেবতার অলঙ্কার বিক্রি করার ফলে অভিশাপ লেহেছিল। কিন্তু শিবলিঙ্গে তো রত্ন বা অলঙ্কার পরানো হয় না।

অমরজিৎ গম্ভীর মুখে বললেন, ঠাকুরমার মুখে শোনা কথা। তবে তখন আমি নিতান্ত বালক। তাই এ প্রশ্ন মাথায় আসেনি। পরে এসেছিল। তারপর এই চিঠি পাওয়ার পর দিদির সঙ্গে আলোচনা করেছি। দিদি বলেন, জন্মাবধি আমরা বাড়ির মন্দিরে শিবলিঙ্গ দেখে আসছি।

চোখ বুজে সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, আচ্ছা, এমন তো হতে পারে। আপনার ঠাকুরদার বাবার মৃত্যুর আগে ওই মন্দিরে অন্য কোনও বিগ্রহ ছিল। সেটা হঠাৎ হারিয়ে গেলে আপনাদের ঠাকুরদা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

.

অমরজিৎ নড়ে বসলেন। হ্যাঁ। হ্যাঁ। দিদিও ঠিক এই কথা বলেছিলেন। মোট কথা, এমন কিছু ঘটে থাকলে তা আমাদের জন্মের আগেই ঘটেছিল।

আমি বললুন, আপনাদের কোনও জ্ঞাতি–মানে নিকটাত্মীয় কেউ নেই এখানে?

অমরজিৎ বললেন, নাহ, আর নিকটাত্মীয় বলতে ঠাকুরমার দাদার বংশধররা আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের কস্মিনকালে যোগাযোগ নেই। শুনেছি আমার ঠাকুরমা পাটনার মেয়ে ছিলেন।

কর্নেলের দিকে তাকালুম। উনি চোখ বুজে চুরুট টানছেন।

অমরজিৎ বললেন, আর যদি নিকটাত্মীয় ধরেন, জামাইবাবুর দাদা এবং ছোটভাই। তারাও পাটনার লোক। তবে তাঁদের এসব কিছুই জানার কথা নয়।

কর্নেল চোখ খুলে বললেন, এছাড়া আর কোনও ঘটনা ঘটেছে?

না। কিন্তু আমার ভাবতে অবাক লাগে, গড়ের জঙ্গলে গত ডিসেম্বরে মন্টু কোনও পাথরে পা হড়কে গিয়ে আচমকা পাগল হল কেন? দিব্যি সুস্থ শান্ত ভদ্র ছিল মন্টু। মাধব ওর সঙ্গে ছিল। সেও খুব অবাক হয়েছিল।

ওর সেই বন্ধু মাধব এখন কোথায় আছেন?

মাধব এখানেই আছে। সিংহগড় টাউনশিপে বড় একটা দোকান করেছে। যে বাড়ির উঠোনে গরুচরানো রাখালটাকে ডেকে আপনি গাছে চড়িয়েছিলেন, ওটাই মাধবদের বাড়ি। বাড়িটা এখন খালি পড়ে আছে। ওরা টাউনশিপে নতুন বাড়ি করেছে।

মাধবের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। ওঁর ঠিকানাটা বলুন।

অমরজিৎ বললেন, গান্ধী মার্কেট বললে যে-কোনও রিকশাওয়ালা পৌঁছে দেবে। ওখানে বিজয়া ভ্যারাইটি স্টোর্স বেশ বড় দোকান। মাধবকুমার বোস। ডাকনাম বাবু।

কর্নেল বললেন, চিঠিগুলো আমার কাছে রাখতে আপত্তি আছে?

আজ্ঞে না। আপনি যদি এর একটা কিনারা করতে পারেন, আতঙ্ক থেকে রক্ষা পাই। আর–দিদি বলছিল, কাল দয়া করে যদি দুপুরবেলা এই গরিবের বাড়িতে দুমুঠো খান

সে হবেন। আপনার দিদির হাতে সময় মতো চেয়ে খাব। কাল সকালে আপনার দিদির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

অবশ্যই। দিদিও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

আমরা সাড়ে নটার মধ্যে যাব। বলে কর্নেল ঘরে ঢুকে খামটা তার ব্যাগে ঢোকালেন। তারপর ব্যালকনিতে ফিরে এসে বসলেন। আচ্ছা অমরজিৎবাবু, গড়ের জঙ্গলে কিচনি বা জলের প্রেতিনী আছে বলে এখানে গুজব শুনলুম। এ বিষয়ে আপনার কী ধারণা?

অমরজিৎবাবুর মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। আস্তে বললেন, হ্যাঁ। ওখানে একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী বলুন বা ভূতপেত্নি যাই বলুন, আছে সেকথা সত্যি।

আপনি দেখেছেন?

অমরজিৎ চাপা গলায় বললেন, মন্টু পাগল হওয়ার পর কাকে মানসিক হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দিয়ে এসে একদিন খেয়ালবশে গড়ের জঙ্গলে গিয়েছিলুম। মন্টু কি কিচনি দেখে ভয় পেয়ে পাগল হয়ে গেছে? কিচনি বলে সত্যি কি কিছু আছে? মনে এই প্রশ্নটা তোলপাড় করছিল। খুলেই বলছি কর্নেলসায়েব। আমার এখানে একটু বদনাম আছে। ডানপিটে সাহসী জেদি স্বভাবের জন্যও বটে, আবার মারকুটে বলেও বটে। অনেক বদমাশকে আমি এ যাবৎ ধোলাই দিয়েছি। শরীরে ক্ষত্রিয়ের রক্ত বইছে। যাই হোক, গড়ের জঙ্গলে ইচ্ছেমতো ঘোরঘুরি করে বেড়াচ্ছিলুম। হঠাৎ চোখে পড়ল, খানিকটা দূরে একটা ঝোঁপের আড়ালে কী একটা প্রকাণ্ড কালো জন্তু বসে আছে। ভালুক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু না। বিশাল একটা ব্যাঙের মতো প্রাণী। মাথায় লম্বা চুল। দুটো লাল চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। জন্তুটা চলতে শুরু করলে থপ থপ শব্দ হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার আর সাহস হল না দাঁড়িয়ে থাকতে। খুঁড়ি মেরে পালিয়ে এলুম। তারপর মাথার জেদ চেপে গিয়েছিল। এখানকার জেলে এবং আদিবাসীদের মধ্যে সাহসী লোক জোগাড় করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গড়ের জঙ্গলে পরদিন হাঁকা লাগালুম। হাঁকা বোঝেন তো সার?

হ্যাঁ। শিকারের জন্য জঙ্গল তোলপাড় করা।

ঢাক-ঢোল-শিঙে বাজিয়ে হাঁকা শুরু হল। বিকেল পর্যন্ত তন্নতন্ন খোঁজা হল। কিন্তু কোথায় সেই বিদঘুঁটে জন্তুটা? তার পাত্তাই পেলুম না।

ঠিক আছে। কাল সকালে তা হলে যাচ্ছি। খাওয়ার আয়োজন নয়। দিদিকে বলবেন।

অমরজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে চলি?

আমরা এগিয়ে দেব কি বাড়ি অবদি? ওদিকটায় তো আলো নেই।

অমরজিৎ হাসলেন। টর্চ আছে। তবে কর্নেলসায়েব কি আমার কথা মন দিয়ে শোনেননি। ঝন্টু সিংহের নাম শুনেই গুণ্ডা বদমাস লেজ তুলে পালিয়ে যায়। আচ্ছা, চলি। নমস্কার।

কর্নেল দরজা খুলে ওঁকে বিদায় দিয়ে এসে আস্তে বললেন, করিডরে হীরালালবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। আমি দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকে গেলেন।

বললুম, তাহলে আমাদের সাবধানে থাকা দরকার।

কর্নেল সে কথায় কান দিলেন না। বললেন, চিঠিগুলো তো তুমি দেখেছ। কী মনে হল?

সবগুলো দেখিনি।

কর্নেল হাসলেন। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় পরীক্ষা করে দেখবে চলো। তারপর বলবে।

ঘরে ঢুকে কর্নেল খামটা আমাকে দিলেন। চিঠিগুলো বের করে খুঁটিয়ে দেখলুম। তারপর বললুম, একই ভাষা। একই হাতের লেখা।

আর কিছু?

আর কিছু–মানে, কোনও বৈশিষ্ট্যের কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

লোকটা বাঙালি এবং শিক্ষিত।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, জয়ন্ত। এই চিঠিগুলো একটা চিঠির ফোটো কপি। মূল চিঠিটা লোকটার কাছে আছে। সে প্রতি মাসে একটা করে ফোটো কপি পাঠাচ্ছে।

অবাক হয়ে বললুম, তাই তো। কাগজগুলো মোটা। অক্ষরগুলোও হুবহু একরকম। যেন জেরক্স কপি।

জেরক্স কপির রঙ কালো হয়। এগুলো লাল। এ থেকে বোঝা যায়, লোকটার নিজস্ব প্রিন্টিং মেশিন আছে। সেই মেশিনটা সম্ভবত অর্ডার দিয়ে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। স্পেশাল কোনও মেশিন। যাই হোক, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। জয়ন্ত আমার কাজটা এবার সহজ হয়ে গেল।…

.

চার

কর্নেল অভ্যাসমতো ভোরে বেরিয়েছিলেন। সাড়ে আটটায় ফিরে এসে বললেন, তুমি আজ সকাল-সকাল উঠেছ দেখছি।

একটু হেসে বললুম, হয়তো হীরালালবাবুর ভয়ে। আপনি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যান। সেই সুযোগে লোকটা হানা দিতে পারত।

কর্নেল কিটব্যাগ, ক্যামেরা ও বাইনোকুলার রেখে বললেন, হীরালালবাবুকে দূর থেকে দেখেছি।

কোথায়?

গড়ের জঙ্গলের চারদিকে চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সঙ্গে এক ভদ্রলোক ছিলেন অবশ্য।

মন্টুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়নি?

নাহ। বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে নিচের ক্যান্টিনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। সাবেক বসতি এলাকায় যাবার পথে গাছের দিকে লক্ষ রেখেছিলুম। আচমকা পাগল মন্টুবাবু ঝাঁপ দিয়ে পড়ে কাতুকুতু না দেন। জামা নোংরা করে ফেলাটা কাতুকুতুর চেয়ে বিচ্ছিরি।

অমরজিত্যাবু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। হল ঘরে গিয়ে বললেন, মন্টু রাতে বাড়ি ফেরেনি। দিদি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আমারও ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। মন্টু যেখানেই থাক, সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসে। খোঁজ নিতে বেরিয়েছিলুম ভোরবেলায়। কেউ তাকে দেখেনি।

আমাদের দোতলায় নিয়ে গেলেন অমরজিৎ। তার শোবার ঘরের বারান্দায় পুরনো বেতের চেয়ারে বসালেন। তার দিদি পরমেশ্বরী এসে আমাদের নমস্কার করে থামে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।

কর্নেল বললেন, মন্টুবাবু রাতে বাড়ি ফেরেননি শুনলুম!

পরমেশ্বরী একটু চুপ করে থেকে বললেন, গাছ থেকে পড়ে যেতেও পারে। ওর ওই দুর্বল শরীর। আবার কেউ ওকে মেরে ফেলতেও পারে।

কেন?

আপনি ঝন্টুর কাছে উড়ো চিঠিগুলো তো দেখেছেন?

হুঁ। কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। সেজন্যই এসেছি।

বলুন।

আপনার তো পাটনায় বিয়ে হয়েছিল। সেখানকার হীরালাল রায় নামে কোনও ব্যবসায়ীকে চেনেন?

না তো। পাটনা থেকে কবে চলে এসেছি। এমন হতে পারে, হয়তো চিনলেও ভুলে গেছি। কেন এ কথা জিগ্যেস করছেন?

ভদ্রলোক গড়ের জঙ্গলে কাল থেকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করে বেড়াচ্ছেন।

অমরজিৎ বললেন, গুপ্তধনের গুজবে অনেক নির্বোধ ওখানে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে। সরকার জায়গাটা দখল করেছেন এই মাত্র। শুনেছিলুম, প্রত্নবিভাগ ওখানে উৎখনন করে ইতিহাসের উপাদান খুঁজে দেখবেন। এখনও সেই প্ল্যান নাকি ফাইলচাপা আছে।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, যাই হোক, পরমেশ্বরী দেবীকে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনাদের বাড়িতে যে মন্দির আছে, সেখানে শিবলিঙ্গ আছে। আপনি কি জানেন, অতীতে ওই মন্দিরে অন্য কোনও বিগ্রহ ছিল?

না। ছোটবেলা থেকে শিবলিঙ্গ দেখে আসছি। তবে–বলে পরমেশ্বরী হঠাৎ থেমে গেলেন।

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, হুঁ। বলুন।

ঠাকুমার কাছে শুনেছি, ঠাকুরদার বাবার আমলে সিংহগড় প্রাসাদে শিবের বিগ্রহই ছিল। সেই বিগ্রহের রত্নালঙ্কার বিক্রি করে বংশে অভিশাপ লেগেছিল।

অমরজিৎ বললেন, আমি কিন্তু কোথাও শিবের বিগ্রহ–মানে মূর্তি দেখিনি। শুনেছি দক্ষিণ ভারতে নটরাজরূপী বিগ্রহ আছে। উত্তর ভারতে হরপার্বতীর যুগ্ম বিগ্রহ দেখেছিলুম।

কর্নেল বললেন, উড়ো চিঠিতে বিগ্রহ দাবি করা হয়েছে। লিঙ্গরূপী বিগ্রহ হলে তা এতদিন উড়ো চিঠি লেখার বদলে উপড়ে নিয়ে যেত লোকটা। আচ্ছা পরমেশ্বরীদেবী, মাধববাবুর বাবা বা ঠাকুরদাকে কি আপনি দেখেছেন?

হ্যাঁ। ওঁদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল। মাধবের পূর্বপূরুষ আমাদের পূর্বপুরুষের কর্মচারী ছিলেন।

মাধবের সঙ্গে আপনার ছোটভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল?

হ্যাঁ। স্কুল থেকে ওরা সহপাঠী। এখানে কলেজ ছিল না। আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। তাই মন্টুকে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি। মাধব পাটনা কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু বি এ-তে ফেল করেছিল। তারপর আর পড়াশোনা করেনি।

অমরজিৎ বললেন, আমিও কলেজে পড়ার সুযোগ পাইনি। এখন অবশ্য এখানে কলেজ হয়েছে।

কর্নেল বললেন, মাধবের বাবা বেঁচে আছেন?

পরমেশ্বরী বললেন, হ্যাঁ। ওর বাবা কমলকুমার বোস হাসপাতালে কম্পাউন্ডারি করতেন রিটায়ার করে নিজেই ডাক্তার হয়েছিলেন।

অমরজিৎ বললেন, হাতুড়ে ডাক্তার। তবে গরিবদের ডাক্তার হিসাবে সুনাম ছিল। এখন বয়স হয়েছে। ধর্মে মতি হয়েছে। তীর্থ ভ্রমণের বাতিক আছে। তার ছেলে মাধব স্টেশনারি দোকানের সঙ্গে ওষুধের দোকানও করেছে। তাই মায়ের নামে বিজয়া ভ্যারাইটি স্টোর্স খুলেছে। আমার অবাক লাগে, মাধব মন্টুর মতোই টো টো করে ঘুরে বেড়াত। কয়েক মাসের মধ্যে ব্যবসা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।

কর্নেল পরমেশ্বরীদেবীকে বললেন, হীরালাল রায়ের কথাটা স্মরণ করার চেষ্টা করবেন।

পরমেশ্বরী বললেন, হ্যাঁ। আমার স্বামী রেলের কর্মী ছিলেন। কত লোকের সঙ্গে আলাপ ছিল। বন্ধুদের কোয়ার্টারে ডেকে এনে ছুটির দিনে খাওয়াতে ভালবাসতেন।

আমার পক্ষে সম্ভব হলে হীরালালবাবুর একটা ছবি তুলে আপনাকে দেখাব।

চেনা হলে নিশ্চয় চিনতে পারব।

আমি তাহলে উঠি।

পরমেশ্বরী ব্যস্ত হয়ে বললেন, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যান কর্নেলসায়েব।

ধন্যবাদ। আবার এসে খাব। বলে কর্নেল উঠলেন। অমরজিৎবাবু, আপনার ভাইকে যদি দুপুর অব্দি খুঁজে না পান, আমাকে যেন জানাবেন। আর হ্যাঁ, পরমেশ্বরীদেবীকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। গড়ের জঙ্গলে জলের পেত্নি কিচনি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

পরমেশ্বরী গম্ভীর মুখে বললেন, ঝন্টু নাকি দেখেছিল। তবে আমার ধারণা, ওর চোখের ভুল। আসলে গড়ের জঙ্গলে গুপ্তধনের গুজবের মতো এও একটা গুজব। বিহারের গ্রামাঞ্চলে কিচনির ওপর লোকের অগাধ বিশ্বাস।…

রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে কর্নেল বললেন, কোনও রহস্যময় ঘটনার উৎস খুঁজতে হলে আগে পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড স্পষ্ট জানা চাই। মোটামুটি একটা ব্যাকগ্রাউন্ড জানা হয়ে গেল। চল। এবার টাউনশিপে যাওয়া যাক।

সরকারি বাংলোর নিচের চত্বরে সাইকেল রিকশা পাওয়া গেল। কর্নেল রিকশাওয়ালাকে বললেন, গান্ধী মার্কেট। জলদি জানা পড়েগা ভাই।

কয়েকটা চড়াই উতরাই এবং পোড় জমি, ঝোঁপজঙ্গল পেরিয়ে আমরা টাউনশিপে পৌঁছুলুম। রিকশাওয়ালা কুড়ি টাকা ভাড়া চেয়েছিল। সেটা ন্যায্য ভাড়া বলতে হবে। গান্ধী মার্কেট আধুনিক ধাঁচের বাজার। তার মানে, সাধারণ মানুষের জন্য এ বাজার নয়।

বিজয়া ভ্যারাইটি স্টোর্স বিশাল দোকান। কর্নেল তার ক্যামেরার জন্য দু-রিল কালার ফিল্ম কিনলেন। তারপর ফার্মেসির কাউন্টারে গিয়ে কয়েকটা অ্যানালজেসিক ট্যাবলেট কিনে কর্মচারীটিকে বললেন, প্রোপাইটার মাধববাবুর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। তিনি কি আছেন?

কর্নেলের সায়েবি চেহারা এবং দাড়ি দেখে কর্মচারীটির মনে সম্ভবত ভক্তি জেগেছিল। সে বলল, উয়ো দেখিয়ে। উনহি মাধবজি আছেন। এ ভারুয়া, সাবলোঁগকো মাধবজিকা পাশ লে যা।

এক তরুণ আমাদের দোকানের ভেতর এদিক-ওদিক গলিখুঁজি ঘুরিয়ে মালিকে কাছে পৌঁছে দিল। গোল টেবিলের এক কোনায় ক্যাশিয়ার কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন। অন্য কোনায় দুটো টেলিফোনের সামনে আরামদায়ক আসনে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সি প্যান্ট-স্পোর্টিং গেঞ্জি পরা এক ভদ্রলোক বসে দুটো টেলিফোনেই পালাক্রমে কথাবার্তা বলছেন। আমাদের দেখে ইশারায় তিনি সামনের চেয়ারে বসতে বললেন।

আমরা বসলুম। একটা পরে টেলিফোন রেখে তিনি বললেন, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ সার?

অমরজিৎবাবুর বর্ণনার সঙ্গে মিলছে না। টো টো করে বনেবাদাড়ে ঘোরা মন্টুবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুটির একটা ছবি মনে দাঁড় করিয়েছিলুম। ছবিটা মুছে গেল। কর্নেল তার নেমকার্ড দিয়ে বললেন,

অমরজিৎ সিংহের কাছে আপনার পরিচয় পেয়ে আলাপ করতে এলুম।

মাধববাবু কার্ডটা দেখে রেখে দিলেন। তারপর হাসি মুখে বললেন, আমি কি আপনার মতো মানুষের আলাপের যোগ্য? বলুন, হট না কোল্ড–

ধন্যবাদ। বেশিক্ষণ সময় নেব না। আপনি ব্যস্ত মানুষ।

চাপে পড়ে ব্যস্ত হয়েছি। নইলে আমি একসময় ছিলুম টো-টো কোম্পানিতে।

তার হাসির সঙ্গে কর্নেলও হাসলেন, হ্যাঁ। ঝন্টুবাবু বলেছিলেন। আপনি তার ভাই মন্টুবাবুর বন্ধু। দুজনে বনেজঙ্গলে পাখির খোঁজে বেড়াতেন। তো মন্টুবাবু হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।

খুব ট্র্যাজিক ঘটনা। বেচারা এত ভালো, ভদ্র আর সরল ছেলে ছিল। ছোটবেলা থেকে আমার বন্ধু সে।

আমার জানতে আগ্রহ হচ্ছে। ডিসেম্বরে গড়ের জঙ্গলে গিয়ে কী এমন ঘটেছিল যে মন্টুবাবু—

হাত তুলে কর্নেলকে থামিয়ে মাধববাবু বললেন, আমি নিচে দাঁড়িয়ে ছিলুম। মন্টু একটা পাথরের স্ল্যাবে উঠে ফঁদ পাততে যাচ্ছিল। পা স্লিপ করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর তার জ্ঞান ফেরে। তারপর প্রলাপ বকতে শুরু করে। আমার বাবা ডাক্তার। তিনি পরে ওকে পরীক্ষা করে বলেছিলেন মাথার ভেতর কোনও নার্ভে চোট লেগে ওর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। এনিওয়ে, আপনার এ ব্যাপারে আগ্রহের কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?

আছে। কার্ডে আপনি দেখেছেন, আমি একজন নেচারিস্ট। নেচার–অর্থাৎ প্রকৃতিতে অনেক রহস্যময় জিনিস আছে। আমি সেই রহস্যের পিছনে ছুটে বেড়াই। মন্টুবাবু প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে হঠাৎ পাগল হয়েছিলেন। সেই রহস্য আমাকে আগ্রহী করেছে।

সিংহ ফ্যামিলির সঙ্গে কি আপনার আগে থেকে আলাপ ছিল?

না। সদ্য কাল আলাপ হয়েছে। অর্কিড় সংগ্রহও আমার হবি। তো অমরজিৎবাবুর বাড়ির উল্টোদিকে একটা উঁচু গাছের মাথায় বিরল প্রজাতির একটা অর্কিড় দেখেছিলুম। হঠাৎ একটা গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে এক পাগল আমার এই তরুণ বন্ধুটিকে কাতুকুতু দিয়ে অস্থির করছিল।

মাধববাবু হাসলেন। হ্যাঁ। পাগল হওয়ার পর মন্টু এমন করে বেড়াচ্ছে শুনেছি।

কর্নেল বললেন, অমরজিৎবাবু দৌড়ে এসে একে বাঁচান। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ছোটভাইয়ের পাগল হওয়ার ঘটনা তার কাছেই শুনেছি। আপনার সঙ্গে মন্টুবাবুর বন্ধুত্বের কথা এবং কীভাবে মন্টুবাবু পাগল হন, সবই বলেছেন তিনি। তা আমার মনে হয়েছে, গড়ের জঙ্গলে কোনও রহস্যময় প্রাকৃতিক শক্তির পাল্লায় পড়েই কি মন্টুবাবু পাগল হয়েছিলেন? যেহেতু আপনি ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাই আমার আপনার সবটা শোনার আগ্রহ জেগেছে।

ওই তো বললুম। তেমন কোনও অলৌকিক দৃশ্য আমি দেখিনি।

গড়ের জঙ্গলে কিচনি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

মাধববাবু কথায়-কথায় হাসেন। হাসতে-হাসতে বললেন, কে জানে মশাই। গড়ের জঙ্গল নিয়ে কত অদ্ভুত গুজব চালু আছে। আমি কিচনি-টিচনি দেখিনি। তবে সম্প্রতি পাটনা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু এখানে এসেছেন। তিনি কাল বিকেলে গড়ের জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে নাকি স্বচক্ষে কিচনি দেখে পালিয়ে এসেছেন।

তাঁর নাম কী? কোথায় উঠেছেন তিনি?

হীরালাল রায়। সরকারি বাংলোতে উঠেছেন। আজ তাকে আমার বাড়িতে চলে আসতে বলেছি।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আপনার বন্ধুর সঙ্গে আমার তাহলে আলাপ হয়েছে। উনি কিচনি দেখে নাকি রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়েছিলেন।

হীরালাল রায়ও এক পাগল। বলে মাধববাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ওঁর রিভলভার আছে জানতুম না।

একটা কথা। আজ সকালে অমরজিৎবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি বললেন, মন্টুবাবু রাতে বাড়ি ফেরেননি। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাগলের ব্যাপার। কোথাও আছে। ফিরবেখন।

আপনার বাবা ডাক্তার। তার সঙ্গে আলাপ করতে পারলে খুশি হতুম।

বাবা হরিদ্বার গেছেন। একেকজন একেক রকমের পাগল। বাবা ধর্মপাগল।

উঠে আসার সময় লক্ষ করলুম, মাধববাবু বেজায় গম্ভীর হয়ে গেছেন। বাইরে গিয়ে কথাটা কর্নেলকে বললুম। কর্নেল বললেন, বন্ধু রিভলভার সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন, এই ব্যাপারটা সম্ভবত ওঁকে চিন্তিত করেছে। যাই হোক, চলো, আমরা আপাতত বাংলোয় ফিরি।…

বাংলোর লনে রঙবেরঙের ফুলগাছ। তাতে প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে বেড়াচ্ছিল। কর্নেল হঠাৎ প্রজাপতির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সেই সময় দেখলুম, একটা ব্রিফকেস এবং কাঁধে মোটা একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে হীরালালবাবু বেরিয়ে আসছেন। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে কর্নেলের ছবি তোলা দেখে চলে গেলেন।

কর্নেল ছবি ভোলা বন্ধ করে এগিয়ে এলেন। তারপর একটু হেসে চাপা স্বরে বললেন, কাজ হয়ে গেল। ভাগ্যিস ভদ্রলোককে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলুম।

জিজ্ঞেস করলুম, কিন্তু কী কাজ হয়ে গেল?

প্রজাপতির ছবির সঙ্গে হীরালাল রায়ের ছবি তুললুম। রোদে স্ন্যাপশট। ছবিটা ভালই হবে।

আমরা দোতলায় নিজেদের ঘরে ফিরে পোশাক বদলে দক্ষিণের ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। কর্নেল বাইনোকুলারে গড়ের জঙ্গল দেখতে-দেখতে হঠাৎ বলে উঠলেন, সর্বনাশ। যা সন্দেহ করেছিলুন, তাই হয়েছে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, ঝন্টুবাবুকেও দেখতে পাচ্ছি। একদল লোক তাঁর সঙ্গে গড়ের জঙ্গল থেকে–হ্যাঁ। ওরা একটা মাচায় চাপিয়ে মড়া বয়ে আনছে। জয়ন্ত। পাগল মন্টুবাবু মারা পড়েছেন।

কর্নেলের হাত থেকে বাইনোকুলার নিয়ে দেখলুম, সত্যি তাই। গাছের ডাল কেটে মাচা বানিয়ে একদল লোক সেটা বয়ে আনছে। উজ্জ্বল রোদে দেখা যাচ্ছিল মন্টুবাবুকে। মাচায় চিত হয়ে আছেন। আগে হেঁটে চলেছেন তার দাদা ঝন্টুবাবু।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। আমি এখনই আসছি। তুমি ঘর ছেড়ে নড়ো না। সাবধান।…

.

পাঁচ

কর্নেল ফিরে এলেন প্রায় একঘণ্টা পরে। কলিং বেল টিপে রামপ্রসাদকে ডেকে খাবার আনতে বললেন। তারপর বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখে জল দিয়ে ভোয়ালেতে মুছে বললেন, তুমি কি স্নান করেছ?

বললুম, না। স্নান করব না। ঘটনাটা আগে বলুন।

কর্নেল চেয়ার টেনে বসে বললেন, কয়েকজন আদিবাসী গড়ের জঙ্গলে খরগোস শিকারে ঢুকেছিল। তারা পাগল মন্টুর ক্ষতবিক্ষত মড়া দেখতে পেয়ে ঝন্টুবাবুকে খবর দিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার, উড়ো চিঠিতে যে শিমুল গাছের কথা আছে, তার তলায় পড়েছিলেন মন্টুবাবু। আমি বাংলো থেকে যাবার সময় কেয়ারটেকারের ঘর থেকে থানায় টেলিফোন করে গিয়েছিলুম। ঝন্টুবাবুর ধারণা, গাছ থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে। ওঁকে বুঝিয়ে বললুম, তবু পোস্টমর্টেম করা দরকার। পুলিশকেও জানানো দরকার যাই হোক, শিগগির জিপে চেপে পুলিশ এসে গিয়েছিল। সেই মাচায় চাপিয়েই বডি মর্গে নিয়ে গেল। আদিবাসীরা সিংহগড়ের রাজবংশের প্রতি খুব অনুগত দেখলুম। তবে এখন ওসব কথা থাক। খিদে পেয়েছে।

ট্রেতে খাবার এনে টেবিলে রেখে রামপ্রসাদ বলল, সার! আজ কিচনি এক বাবুকো মার ডালা। উয়ো এক পাগল আদমি থা। পহেলা কিচনি দেখকার বাবু পাগল হো গয়া। দুসরা বার কিচনি উসকো মার ডালা।

কর্নেল বললেন, শুনেছি রামপ্রসাদ।

রামপ্রসাদ ভয়ার্ত মুখে বলল, আপনারা নতুন আসিয়েছেন সার। কভি কিচনিকি কিলামে মাত ঘুসিয়ে। উয়ো বহত খতরনাক জাগাহ আছে।…

খাওয়ার পর কর্নেল ব্যালকনিতে বসে চুরুট ধরালেন। আমি অভ্যাস মতো বিছানায় গড়িয়ে নিচ্ছিলুম। চোখের পাতায় ঘুমের টান এসেছিল। কর্নেলের ডাকে চোখ খুলতে হল। উঠে পড়ো জয়ন্ত। বেরুব।

উনি সেজেগুজে তৈরি। আমি প্যান্ট-শার্ট পরে তৈরি হয়ে নিলুম। তারপর কাল বিকেলে যে রাস্তা ধরে গড়ের জঙ্গলে গিয়েছিলুম, সেই রাস্তায় হেঁটে চললুম।

আধঘণ্টার মধ্যে গড়ের জঙ্গলে পৌঁছে গেলুম আমরা। কর্নেল বাইনোকুলারে শিমুল গাছটা খুঁজে বের করে বললেন, কালকের লাঠি দুটো রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলুম। আসার সময় দেখতে পেলুম না। দাঁড়াও। আগে দুটো লাঠি দরকার।

কালকের মতো গাছের লম্বা ডাল কেটে লাঠি তৈরি করে আমরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললুম। শিমুল গাছটার তলায় গিয়ে দেখি, পাথরের ওপর শুকনো রক্তের ছাপ এখনও রয়ে গেছে। শিমুল গাছটা শরৎকালে খুব ঝাপালো হয়ে আছে। কিন্তু কাটাভর্তি গুঁড়ি বেয়ে কারও পক্ষে এই গাছে চড়া সম্ভব নয়।

কর্নেল খুঁটিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে পা বাড়ালেন। তারপর ঘাসের দিকে ঝুঁকে বললেন, এই ঘাসগুলো কাত হয়ে গেছে। রক্তের ছাপও দেখতে পাচ্ছি। বোঝা যাচ্ছে, কেউ মন্টুবাবুর লাশ টেনে নিয়ে গিয়ে শিমুল গাছের তলায় রেখেছিল।

কর্নেল আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বললেন, এখানেও রক্তের ছাপ দেখা যাচ্ছে। জয়ন্ত, তুমি বিশেষ করে পেছনে আর দুপাশে লক্ষ রাখবে।

উনি খুঁড়ি মেরে রক্তের ছাপ অনুসরণ করছিলেন। আমি সতর্ক দৃষ্টে পিছনে এবং দুপাশে লক্ষ রেখে হাঁটছিলুম। একখানে আবার একটা পাথরের স্ল্যাব দেখা গেল। বেশ চওড়া। কয়েকটা কোণ আছে পাথরটার। নক্ষত্রের প্রতীক বলা চলে। কর্নেল বললেন, এটা বোধ হয় দুর্গপ্রাসাদের ছাদে কোনও জায়গার ওপর থামের মাথায় বসানো ছিল। মোগল আমলের স্থাপত্যে চবুতরার মাথায় এ ধরনের ছাদ থাকত। হ্যাঁ, ভাঙা থামের চিহ্নও লক্ষ করছি। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানেই রক্তের ছাপ শেষ হয়েছে। জয়ন্ত, আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হল।

কী সন্দেহ?

মন্টুবাবুকে খুন করেছে কেউ। আমার মনে আগে থেকেই এই সন্দেহটা থেকে গেছে। মন্টুবাবু সম্ভবত এমন কিছু গোপন কথা জানতেন, তা ওঁর কাছে জানার জন্য ওঁকে পীড়ন করায় উনি পাগল হয়ে যান।

বলেন কী! মাধববাবু তো–

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, মাধববাবু মিথ্যা বলতেও পারেন। হ্যাঁ। ওই দেখ এই পাথরের ওপাশে ছেঁড়া নাইলনের দড়ির কয়েকটা টুকরো পড়ে আছে। জয়ন্ত। কাল সারারাত এবং আজ সকাল পর্যন্ত মন্টুবাবুকে দড়ি বেঁধে এখানে ফেলে রাখা হয়েছিল।

বলে কর্নেল পাথরটার শেষদিকে গিয়ে ঝুঁকে বসলেন। সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। এখানে। মন্টুবাবুর লাশে বুকের কাছে আর গালে পোড়া দাগই আমি দেখেছিলুম। তখন মনে হয়েছিল, ওগুলো ময়লা বা কাদার ছোপ। কর্নেল মুখ তুলে সামনে একটা ঝোঁপের দিকে তাকালেন। বললেন, ওই দেখ জয়ন্ত। ওগুলো বিছুটির ঝোঁপ। পায়ে বিছুটিপাতা লাগলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। কয়েকটা বিছুটি গাছ পড়ে আছে লক্ষ করো। হাতে গ্লাভস পরে কেউ পাগলের ওপর অকথ্য পীড়ন করেছে। শেষে ধৈর্য হারিয়ে মেরে ফেলেছে।

আমি বিছুটির জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। সেই কোথাও চাপা থপ থপ শব্দ হল। কর্নেলও শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন। তখনই উঠে দাঁড়িয়ে শব্দটা লক্ষ করে বাইনোকুলার তুললেন। বললেন, কী একটা কালো প্রকাণ্ড জন্তুর পিঠ দেখতে পেলুম। মাথায় লম্বা চুলও আছে। সেই কিচনি। থাক। বিরক্ত করব না। থানা থেকে সি আই ডি ইন্সপেক্টর রমেশ পাণ্ডের আসার কথা। এতক্ষণ এসে পড়া উচিত ছিল। জিপে আসার অসুবিধে নেই। পৌনে তিনটে বেজে গেল।

কর্নেল ঘড়ি দেখে শিমুল গাছটার তলায় গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলুম। জায়গাটা উঁচু বলে পূর্বদিকে তোরণের ধ্বংসস্তূপ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বাইনোকুলারে আবার চারদিক দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে জিপের শব্দ এল কানে। কর্নেল ঘুরে দেখে বললেন, এসে গেছেন রমেশ পাণ্ডে।

চারজন সশস্ত্র কনস্টেবলের সঙ্গে রোগাটে চেহারার এক পুলিশ অফিসার সাবধানে ভাঙা ব্রিজের পাথরে পা রেখে গড়ের জঙ্গলে ঢুকলেন। কর্নেল হাত নেড়ে ডাকলেন, মিঃ পাণ্ডে। এখানে আসুন।

পুলিশের দলটি বুটের শব্দে জঙ্গল কাঁপিয়ে এগিয়ে এল। রমেশ পাণ্ডে বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল কর্নেল সরকার। ডেডবডির পোস্টমর্টেমের প্রাইমারি রিপোর্ট পেয়ে কোয়ার্টারে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে বেরুতে–যাই হোক। আপনি এতক্ষণ নিশ্চয়ই কিছু সূত্র পেয়ে গেছেন।

কর্নেল তাকে রক্তের ছোপগুলো দেখাতে-দেখাতে সেই খাঁজকাটা পাথরটার কাছে গেলেন। নিজের মতামত দিয়ে বললেন, মর্গের রিপোর্ট কী বলছে বলুন?

রমেশ পাণ্ডে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। ডেডবডিতে অত্যাচারের চিহ্ন আছে। তবে মারা হয়েছে গুলি করে। মাথার পেছনে গুলি করে পাথর দিয়ে থ্যাতলানো হয়েছে। পিঠে এবং কোমরেও ভোতা জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। যাতে মনে হয় উঁচু জায়গা থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে মারা গেছে লোকটা। মাথার ভেতর হাড়ের খাঁজে বুলেটনেল আটকে ছিল। পয়েন্ট পঁয়ত্রিশ ক্যালিবারের রিভলভার থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়েছিল। দৈবাৎ গুলিটা ঘুরতে-ঘুরতে হাড়ের খাঁজে আটকে গিয়েছিল। মাথা ছুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চান্স ছিল। তা হলে ডাক্তার অন্য রিপোর্ট লিখে বসতেন। আসলে অত খুঁটিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই এখানকার হাসপাতালে। হ্যাঁ, ডাক্তারের মতে, ভোরের দিকে মারা হয়েছিল। রাইগর মর্টিস সবে শুরু হয়েছে, এমন সময়ে বডি ডাক্তারের হাতে দেওয়া হয়।

কর্নেল বললেন, আপনাকে এক ভদ্রলোকের কথা বলেছিলুম।

পাণ্ডে হাসলেন। পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছি। এবার গিয়ে ওঁর অস্ত্রটা চাইব। লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস কি না এবং কত ক্যালিবার, তাও দেখব। কিন্তু একজন পাগলকে এমন করে খুন করার কোনও মোটিভ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার কী ধারণা?

কর্নেল বললেন, ভিকটিমের দাদা অমরজিৎ সিংহ কোনও আভাস দিতে পারেননি?

না। আসার সময় ওঁর সঙ্গে দেখা হল। হাসপাতালে বডির ডেলিভারি নিতে যাচ্ছিলেন। উনি শুধু বললেন, দেবতার অভিশাপ ছাড়া কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।

কর্নেল হাসলেন। গুলি করে মারাও কি দেবতার অভিশাপ?

পাণ্ডে চাপা স্বরে বললেন, ব্যাকগ্রাউন্ডটা তদন্ত করলে জানা যাবে। সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে কোনও গন্ডগোল ছিল কি না। মাধব বোস ভিকটিমের বন্ধু ছিলেন। এখন ভদ্রলোক বড় ব্যবসায়ী। তার কাছেও যাব আমরা।

ইন্সপেক্টর রমেশ পাণ্ডে নাইলনের দড়িগুলো, সিগারেটের টুকরো এবং সাবধানে বিছুটির ডালগুলো খবরের কাগজ ব্যাগ থেকে বের করে মুড়ে নিলেন। তারপর বললেন, চলুন। ফেরা যাক।

কর্নেল বলেন, আপনারা এখোন। আমি এই জঙ্গলে অর্কিড আছে কি না খুঁজে দেখি। তাছাড়া দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতিও এখানে দেখতে পাওয়া সম্ভব।

পাণ্ডে হাসলেন। সাবধান কর্নেল সরকার। গড়ের জঙ্গলে নাকি কিচনি আছে, জলের প্রেতিনী।

কর্নেলও হাসতে-হাসতে বললেন, দেখা গেলে তো ভালো হয়। ছবি তুলব।

কিন্তু সাবধান। এখানে নাকি সাপের খুব উপদ্রব আছে।

বলে রমেশ পাণ্ডে কনস্টেবলদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। ভদ্রলোক দেখতে রোগাটে হলেও খুব স্মার্ট মনে হল।

উনি চলে যাওয়ার পর জিগ্যেস করলুন, আপনার পরিচয় কি উনি জানেন?

আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। এই পরিচয়ই যথেষ্ট। ওঁকে আমার নেমকার্ড দিয়েছি। যদি বেশি উৎসাহী হন, তাহলে কলকাতায় ট্রাঙ্ককল করে লালবাজার পুলিশে হেটকোয়ার্টারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে খবর নেবেন। তাতে আমার বেশি সুবিধে হবে।

কর্নেল বাইনোকুলারে আবার কিছুক্ষণ চারদিক খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর পা বাড়িয়ে আস্তে বললেন, কিচনি সত্যি এখানে আছে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, কিচনি কেন মন্টুবাবুকে রক্ষা করতে আসেনি! মন্টুবাবু বলেছিলেন, কিচনির সঙ্গে তার নাকি ভাব হয়েছে।

বোগাস। আপনিও কী দেখতে কী দেখছেন। ভালুক-টালুক হয় তো।

কর্নেল হঠাৎ থেমে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বললেন। তারপর বাঁ-দিকে একটা স্কুপের আড়ালে হাঁটু মুড়ে বসে ক্যামেরায় কীসের ছবি তুললেন। পরপর তিনবার ক্যামেরার শাটার ক্লিক করল।

তারপর সরে এসে আস্তে বলেলেন, চলো। কেটে পড়া যাক।

গড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আগের রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে জিগ্যেস করলুম, অমন চুপিচুপি কীসের ছবি তুললেন এবার বলুন।

কিচনির।

ভ্যাট।

বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছে। এক মিনিট। এখনও আলো আছে। ফিল্মের রিলটাতে আর দু-তিনটে ছবি তোলা যায়। রিলটা শেষ করে আজ রাতেই ওয়াশ ডেভালাপ প্রিন্ট করে ফেলব।

কর্নেল তার স্যুটকেসে পোর্টেবল স্টুডিও সরঞ্জাম এনেছেন। বাইরে কোথাও গেলে ওটা সঙ্গে নিয়ে যান। বাথরুমকে ডার্করুমে পরিণত করেন। ব্লাড় জমিটার ওপর যেতে-যেতে কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে মুখে হুস শব্দ করলেন। অমনি এক ঝাঁক পাটকিলে রঙের পাখি উড়ে গেল। কর্নেল পর-পর শাটার টিপে উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ ওঁর মুখে কেমন বিরক্তির ছাপ লক্ষ করে বললুম, কী? ছবি উঠবে না মনে হচ্ছে নাকি?

কর্নেল বলেন, না জয়ন্ত। ছবি উঠবে। আসলে, সিংহ পরিবারের দেবতার অভিশাপের মতো আমার জীবনেও যেন এই একটা অভিশাপ। যেখানে এই লালঘুঘুর ঝাক দেখেছি, সেখানেই খুনোখুনিতে আমাকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। কাল সকালে এখানে এই লালঘুঘুর ঝক দেখেছিলুম। ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু বরাবরকার মতো মনে-মনে একটু আঁতকে উঠেছিলুম। তুমি কুসংস্কার বলবে। বলো। কিন্তু এটা হয়।….

বাংলোয় ফিরে যথারীতি ব্যালকনিতে বসে আমরা কফি খেলুম। তারপর কর্নেল বললেন, বাথরুমে যেতে হলে যাও জয়ন্ত। এবার ঘণ্টা তিনেকের জন্য বাথরুম ডার্করুম হবে।

বাথরুমকে ডার্করুম বানিয়ে কর্নেল ঢুকে গেলেন। ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ রইল। আমি ব্যালকনিতে বসে সময় কাটাতে আরও এক পেয়ালা কফি সাবাড় করলুম। পটে আরও কফি লিকার ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এবার টেবিলল্যাম্প জ্বেলে আমার কাছে এসে বসলেন। বললেন, চারটে নেগেটিভ প্রিন্ট করতে দিলুম। হীরালালবাবুর ছবি ভালোই উঠেছে। ফুলের সামনে হীরালাল। আর কিচনির ছবি আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি উঠেছে। জায়গাটাতে পুরো রোদ ছিল না। তিনটেই পাশ থেকে তোলা।

বললুম, তাহলে ভূতপেত্নি নয়। কোনও জন্তু!

নিশ্চয়। কর্নেল হাসলেন। পেত্নি হলে কি আর ছবি উঠত?

এই সময় দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল উঠে গিয়ে বললেন, কে?

রামপ্রসাদের সাড়া এল। হামি রামপ্রসাদ আছি সার। আপনার টেলিফোন আসল। তাই বড়াসাব বলল, কর্নিলসাবকো খবর দো।

কর্নেল দরজা খুলে বললেন, চলে যাচ্ছি। জয়ন্ত, দরজা আটকে দাও। সাড়া না পেলে দরজা খুলো না।

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। দরজা আটকে ঘরেই বসলুম। আমার একটা লাইসেন্স করা ফায়ার আমর্স আছে। বাইরে গেলে সঙ্গে নিই। এবার তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিলুম। অস্ত্রটা সঙ্গে থাকলে সাহস বেড়ে যেত। কিন্তু এখন আর আক্ষেপ করে লাভ নেই।

মিনিট পনেরো পরে কর্নেলের সাড়া পেয়ে দরজা খুলে দিলুম। উনি দরজা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে বললেন, মিঃ পাণ্ডের টেলিফোন। হীরালাল রায়কে অ্যারেস্ট করেছেন। আচমকা মাধববাবুর বাড়িতে হানা দিয়েছিলেন ওঁরা। হীরালালবাবুর কাছে একটা পয়েন্ট পঁয়ত্রিশ ক্যালিবারের রিভলভার পাওয়া গেছে। সিক্স রাউন্ডার ফায়ার আর্মস দুটো গুলি ভরা আছে। বাকি চারটে ফায়ার করা হয়েছে। চিনির কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি মিঃ পাণ্ডে। বললুম, হীরালালবাবুকে কাল আমরা তিনটে গুলি ছুঁড়তে দেখেছিলুম। তাহলে চতুর্থটা মন্টুবাবুর মাথায় ঢুকেছে।

কর্নেল বললেন, আমি মিঃ পাণ্ডেকে বললুম, এখানে ফরেন্সিক এক্সপার্ট বা ব্যালাস্টিক মিসাইল এক্সপার্ট নেই। ডাক্তারের অনুমানের ওপর নির্ভর না করে বুলেট নেলটা পাটনায় ফরেন্সিক এক্সপার্টের কাছে পাঠান।

কিন্তু হীরালালবাবুর আচরণ সন্দেহজনক।

কর্নেল একটু চুপ করে বললেন, জয়ন্ত, আজ সকালে হীরালালবাবু গড়ের জঙ্গলে আর একটা গুলি কিচনিকে লক্ষ করে ছুঁড়েছিলেন। আমি কাছাকাছি ব্লাড় জমিটার পাশে ছিলুম। উনি জঙ্গল থেকে পড়ি কি মরি করে পালিয়ে এসে এক রাউন্ড ফায়ার করেছিলেন।

বললুম, তাহলে কে মারল মন্টুবাবুকে? রহস্য যে জট পাকিয়ে গেল।

কর্নেল বলেন, তাছাড়া সমস্যা হল, একই ক্যালিবারের ফায়ার আর্মস অন্যেরও থাকতে পারে। কাজেই রহস্য সত্যিই জটিল হল।

.

ছয়

রামপ্রসাদ রাতের খাবার রেখে গিয়েছিল। কর্নেল তাকে বলেছিলেন, আমরা আজ দেরি করে খাব। তুমি বরং সকালে এসে এঁটো থালাবাটি আর ট্রে নিয়ে যেও।

রাত সাড়ে দশটায় কর্নেল বাথরুমে ঢুকে আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। লক্ষ করেছিলুম, দড়িতে ক্লিপ এঁটে চারটে ছবি ঝোলানো আছে। তখনও ছবিগুলো শুকোয় নি। আমরা খেয়ে নিয়েছিলুম। তারপর রাত এগারোটা নাগাদ কর্নেল ছবির প্রিন্টগুলো নিয়ে এসে টেবিলল্যাম্পের আলোয় আমাকে কিচনির ছবি তিনটে দেখিয়েছিলেন।

পাশের ঝোঁপের উচ্চতা আন্দাজ করে বোঝা গিয়েছিল, জন্তুটা অন্তত পাঁচফুট উঁচু। অবিকল প্রকাণ্ড ব্যাঙের মতো দেখতে। মাথায় কঁকড়া চুল আছে। বসে আছে ঠিক ব্যাঙের মতো। পাশ থেকে তোলা ছবি। তাই শুধু দেখা যাচ্ছিল একটা চোখ ঠেলে বেরিয়ে আছে। অজানা কোনও প্রাণী হওয়াই সম্ভব।

পরদিন ভোরে কর্নেল বেরিয়েছিলেন। আমার ঘুম ভেঙেছিল সাতটা নাগাদ। কলিং বেল বাজিয়ে রামপ্রসাদকে ডেকে আজ বেডটি আনিয়ে নিলুম। কর্নেল সকাল-সকাল ফিরে এলেন। বললেন, আজ বেড়ানো হল না। সিংহবাড়ি গিয়েছিলুম। পরমেশ্বরীকে হীরালালের ছবি দেখালুম। উনি ছবি দেখে অবাক হয়ে বললেন, এ তো তার দেবর বনবিহারী। গোঁফ রেখেছে। দেখতে মোটাসোটাও হয়েছে। খুব দুর্ধর্ষ ছেলে ছিল। রেলের চোরাই লোহালক্কড় বিক্রির অভিযোগে দুবার ধরা পড়েছিল। তার স্বামী ভাইকে অনেক তদ্বির করে বাঁচিয়েছিলেন। তার সঙ্গে এ বাড়িতে সে কয়েকবার এসেছে। অমরজিৎবাবুও সায় দিয়ে বললেন, ছবিটা দেখে তার চেনা লাগছে। মাধবের সঙ্গে বনবিহারীর আলাপ হয়েছিল এখানেই। মন্টু, মাধব আর বনবিহারী একসঙ্গে ঘুরে বেড়াত। ওঁরা দুজনেই খুব অবাক হয়েছেন। কেন বনবিহারী তাদের বাড়ি না এসে বাংলোয় উঠেছে? কেনই বা সে হীরালাল নাম নিয়েছে? তাকে পুলিশ খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছে শুনেও দুজনে অবাক। মন্টুকে কেন সে খুন করবে? যাই হোক, অমরজিৎ এবং পরমেশ্বরীকে চুপচাপ থাকার পরামর্শ দিয়ে এলুম।

জিগ্যেস করলুম, ওঁদের কিচনির ছবির কথা বলেননি?

কর্নেল হাসলেন। চেপে যাও জয়ন্ত। কিচনি সম্পর্কে ভুলেও মুখ খুলবে না।

ন’টায় ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কর্নেলের কথামতো বেরুনোর জন্য তৈরি হচ্ছি, সেইসময় দরজায় কেউ নক করল। দরজা খোলা ছিল কর্নেল বললেন, কাম ইন।

ঘরে ঢুকলেন রমেশ পাণ্ডে। পরনে পুলিশের পোশাক নেই। প্যান্ট-শার্ট পরে এসেছেন। তিনি একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, বুলেট নেলটা কাল সন্ধ্যায় স্পেশাল মেসেঞ্জার মারফত পাটনায় ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠিয়েছিলুম। কিছুক্ষণ আগে ট্রাঙ্ককলে ব্যালাস্টিক মিসাইল এক্সপার্ট রঘুবীর সিনহা জানালেন, বুলেটটা থ্রি নট থ্রি। তবে ওটা পয়েন্ট আটত্রিশ ক্যালিবারের রিভলবার থেকে ছোঁড়া হয়েছে। এই অবস্থায় হীরালাল বাবুকে আটকে রাখার মানে হয় না। তার রিভলভারটার লাইসেন্স আছে। ব্যবসায়ী লোক। সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে ঘোরেন। তাই

কর্নেল তাঁর কথার ওপর বললেন, ভদ্রলোকের আসল নাম কিন্তু বনবিহারী রায়। উনি ভিকটিম মন্টুবাবুর দিদি পরমেশ্বরী দেবীর দেবর। আপনি অমরজিৎবাবু এবং পরমেশ্বরীদেবীর কাছে গেলে এ খবর পেয়ে যাবেন। আমি সকালে হীরালালবাবুর ছবি নিয়ে তাদের কাছে গিয়েছিলুম।

পাণ্ডে বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি হীরালালের ছবি তুলেছিলেন?

হ্যাঁ। কর্নেল হাসলেন। গড়ের জঙ্গলে ওঁর যাতায়াত দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তাই কাল লনে ফুলে বসা প্রজাপতির ছবি তোলার ছলে ওঁর ছবি তুলেছিলুম। আমার সঙ্গে ফটো প্রিন্টের পোর্টেবল সরঞ্জাম আছে। ছবিটা আপনাকে দিচ্ছি। পাটনায় এই ভদ্রলোকের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে পারেন।

ছবিটা পকেটে রেখে রমেশ পাণ্ডে একটু হেসে বললেন, কর্নেল সরকারের ব্যাকগ্রাউন্ডটাও কাল রাতে জেনে গেছি। আমাদের সবরকম সহযোগিতা পাবেন। আপনি নিজের পথে হাঁটুন। আমরা আমাদের পথে হাঁটি। আশা করি, এক জায়গায় পরস্পর মুখোমুখি হতে পারব।

কর্নেলের কথায় কলিং বাজিয়ে রামপ্রসাদকে ডেকে কফির অর্ডার দিলুম। রমেশ পাণ্ডে বললেন, সিংহগড়ে পয়েন্ট আটত্রিশ ক্যালিবারের লাইসেন্সড রিভলভার কারও নেই। যদি থাকে সেটা বেআইনি। আপনি নিশ্চয় জানেন, বিহার মুল্লুকে বেআইনি অস্ত্র প্রচুর আছে। আমরা বহু ক্ষেত্রে অসহায়। রাজনীতিকদের চাপে সব জেনেও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা মিঃ পাণ্ডে, সিংহগড়ে অফসেট বা লেজার প্রিন্টিং প্রেস আছে?

সিংহগড়ে? নাহ কর্নেল সরকার। তবে সাবেক আমলের ট্রেডল মেশিনের প্রিন্টিং প্রেস আছে। বিজ্ঞাপন, পাঁউরুটির মোড়ক ইত্যাদি ছাপা হয়। এখানে ওসব আধুনিক টেকনলজির প্রিন্টিং প্রেসে কী ছাপবে?

রমেশ পাণ্ডের জন্য কফি এল। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ বকবক করলেন। একসময় কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, সিংহগড়ে প্রাচীন মূর্তি বা ভাস্কর্য পাচারের কোনও চক্র কি কখনও ধরা পড়েছিল মিঃ পাণ্ডে?

হ্যাঁ। গতবছর একটা চক্র আমরা খুঁড়িয়ে দিয়েছিলুম। এলাকার বিভিন্ন মন্দির থেকে প্রাচীন বিগ্রহ চুরি করে ট্রাকে পাচার করা হচ্ছিল। দলে পাঁচজন লোক ছিল। চারজন ধরা পড়েছিল। তারা জেল খাটছে এখনও। একজন ধরা পড়েনি। সেই কিন্তু রিং লিডার। তার আসল নাম ধোলাই দিয়ে সাগরেদের কাছে আদায় করতে পারিনি। তারা বলেছিল, তাকে ব্যাঙবাবু বলে জানে। সেই ব্যাঙবাবু নাকি বাঙালি। তবে সে কোথায় থাকে, তা তারা জানে না।

ব্যাঙবাবু? কর্নেল কেন যেন একটু চমকে উঠলেন। ব্যাঙা ডাকনাম শুনেছি। কিন্তু ব্যাঙবাবু তো অদ্ভুত নাম!

পাণ্ডে বললেন, বুঝুন কর্নেল সরকার। থার্ড ডিগ্রি ধোলাই কী জিনিস নিশ্চয় জানেন। সেই ধোলাই খেয়েও তারা ব্যাঙবাবু’ ছাড়া অন্য নাম বলেনি। আমার ধারণা, লোকটা বাইরে থাকত। পাটনা হোক, কি কলকাতা হোক। তার চেহারার বর্ণনা আদায় করেছিলুম। বেঁটে, গোলগাল লোক। কাঁচা পাকা চুল। বয়সে বৃদ্ধ। কিন্তু তার গায়ে নাকি প্রচণ্ড জোর। তারা বারতিনেক রাতের বেলায় তাকে বাঙালিটোলার একটা পোড়োবাড়িতে দেখেছিল বাড়ি সার্চ করে আমরা কোনও সূত্র পাইনি। দিনরাত ওত পেতে থেকেও তার পাত্তা মেলেনি। বলে পাণ্ডে একটু হাসলেন। তো মূর্তি পাচারের কথা কেন বলুন তো?

কর্নেল বললেন, পাগল মন্টুবাবুকে অত্যাচার করে মেরে ফেলায় এই প্রশ্নটা মাথায় এসেছে। মন্টুবাবু কি কোনও প্রাচীন দামি বিগ্রহের খোঁজ রাখতেন?

হ্যাঁ। আপনারা প্রশ্নে যুক্তি আছে। রমেশ পাণ্ডে কফি দ্রুত শেষ করলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ কর্নেল সরকার। আমার মাথায় এটা আসা উচিত ছিল। মন্টুবাবু সিংহগড় রাজবংশের লোক। তার পড়ে পূর্বপুরুষের কোনও বিগ্রহের খবর জানা সম্ভব ছিল–যা তার দাদা জানতে পারেননি। মন্টুবাবুকে হত্যার একটা মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে। আচ্ছা, চলি। প্রয়োজনে পরস্পর যোগাযোগ রাখব।

রমেশ পাণ্ডে চলে গেলে কর্নেল আপন মনে বললেন, ব্যাঙবাবু।

বললুম, গড়ের জঙ্গলে তোলা কিচনির ছবিটা কিন্তু ব্যাঙের মতোই।

কর্নেল হাসতে-হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। চল, বেরুনো যাক। এই খেলাটা সেই ব্যাঙের বলেই মনে হচ্ছে। তবে আপাতত ব্যাঙবাবুর চেয়ে ব্যাঙজাতীয় ওই জন্তুটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি বাংলোর পশ্চিমে অসমতল সেই মাঠের রাস্তায় গিয়ে বললুম, আবার গড়ের জঙ্গলে? কর্নেল একই জায়গায় বারবার গিয়ে শুধু এই বিদঘুঁটে জন্তুটার ছবি তুলে কী হবে? জন্তুটা আর যাই করুক, পাগল মন্টুবাবুকে সে তো খুন করেনি।

কর্নেল বললেন, বুঝতে পারছি। তুমি বনবিহারী ওরফে হীরালালের মতো ওই জন্তুটাকে ভয় পাচ্ছ।

রামপ্রসাদ বলছিল, এখানকার সব মানুষই ওর ভয়ে গড়ের জঙ্গলে ঢোকে না।

কিন্তু আদিবাসীরা ওখানে শিকার করতে ঢোকে। মন্টুবাবুর লাশ তারাই দেখতে পেয়েছিল।

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, জন্তুটা আদিবাসীদের দেখা দেয় না। কেন দেখা দেয় না, তার কারণ অনুমান করা যায়। আদিবাসীদের বিষাক্ত তীরকে ভয় পায় জন্তুটা। তাদের লক্ষভেদও অব্যর্থ। জন্তুটা যেভাবেই হোক, এটা বোঝে।

হাঁটতে-হাঁটতে সেই উঁচু টাড় জমিটার কাছে পৌঁছে কর্নেল বললেন, আজ আমরা গড়ের পশ্চিম দিকটা দেখব। আমার ধারণা, দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ গড়খাইয়ের জলে পড়ে সম্ভবত ওদিকে একটা রাস্তা তৈরি করেছে। কারণ, এই পথটা এঁকেবেঁকে পাহাড়ের নিচে একটা আদিবাসীদের গ্রামে পৌঁছেছে। ওদিক থেকে গড়ের জঙ্গল অনেক কাছে। ওরা হয়তো ওদিক দিয়েই জঙ্গলে ঢোকে।

কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল, কাঁচা রাস্তাটা বাঁদিকে হঠাৎ বাঁক নিয়ে গড়ের জঙ্গলের কাছে গেছে। তারপর ডাইনে বাঁক নিয়ে চড়াইয়ে উঠে একটা ছোট্ট গ্রামে ঢুকেছে। গ্রামটা একটা টিলার কাঁধে। কিন্তু বাংলো থেকে চোখে পড়ে না।

কর্নেল রাস্তার বাঁক থেকে দক্ষিণে ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি মাঠের দিকে হাঁটতে থাকলেন। একটু পরে আমরা পশ্চিমের গড়খাইয়ের ধারে পৌঁছুলুম। কর্নেলের অনুমান সত্য। দুর্গপ্রাসাদের খাড়া পাঁচিলের একটা অংশ এখানে দেখা যাচ্ছে। পাথরের ইটের ফাঁকে গুল্ম লতা গজিয়েছে। গড়খাইয়ে প্রচুর পাথর পড়ে আছে বটে, কিন্তু সেগুলোতে পা ফেলে যাওয়া অসম্ভব। কর্নেল আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, বাহ! এইরকম কিছুই আশা করেছিলুম।

একটা পাথরের বিশাল পাঁচিল আড়াআড়ি ভাবে গড়খাইয়ে ভেঙে পড়েছে। পাঁচিলটার দৈর্ঘ্য গড়খাইয়ের চেয়ে বেশি। তবে জায়গায়-জায়গায় একটু অংশ জলে ডুবে আছে। ব্যালান্স রেখে হাঁটলে সহজে ওপারে পৌঁছানো যায়। কর্নেল পায়ের কাছটা দেখিয়ে বললেন, এই দেখ। দিব্যি একটা পায়ে চলা পথের চিহ্ন আছে। শরৎকাল বলে পথটা ঘাসে কিছুটা ঢাকা পড়েছে। এপথেই আদিবাসীরা শিকার করতে ঢোকে।

পাঁচিলটা প্রস্থে অন্তত পাঁচ-ছ’ফুট। কিন্তু দুটো পাশ ভেঙে মাত্র এক-দেড় ফুট জলের ওপর উঁচিয়ে আছে। কর্নেল আগে এবং আমি পেছনে ব্যালান্স রেখে সাবধানে ওপারে গেলুম। তারপর চওড়া একটা ফাটলের মতো পাথরের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে হঠাৎ কর্নেল গুঁড়ি মেরে বসলেন এবং আমাকেও বসিয়ে দিলেন।

তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখলুম, হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরা একটা মোটাসোটা লোক বেঁটে একটা গাছের ছায়ায় বসে সিগারেট টানছে। তার মুখোমুখি আর একটা লোক বসে হাত নেড়ে কিছু বলছে। এই লোকটা ওর চেয়ে লম্বা। পরনে প্যান্ট আর খয়েরি রঙের শার্ট। হাতে একটা বন্দুক এবং কাঁধে একটা ব্যাগ।

প্রায় হাত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ দূরে এবং আমাদের থেকে অনেকটা নিচে ওরা বসে আছে। কিছুক্ষণ পরে বন্দুকধারী লোকটা উঠে দাঁড়াল। সে আমাদের দিকে উঠে আসছে দেখে কর্নেল ফাটল থেকে সরে আমাকে ইশারায় উল্টোদিকের আড়ালে লুকোতে বললেন। কর্নেল লুকিয়ে পড়লেন ঘন ঝোঁপের আড়ালে। লোকটা কাঁধে বন্দুক নিয়ে শিস দিয়ে গান করতে-করতে ফাটল পথে নেমে গেল এবং গড়খাইয়ে পড়ে থাকা পাঁচিলের ওপর দিয়ে দ্রুত ওপারে পৌঁছুল। একটু পরে পশ্চিমের মাঠে ঝোঁপঝাড় আর পাথরের আড়ালে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কর্নেল আবার ফাটলের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আমিও ওঁকে অনুসরণ করলুম। নিচের লোকটাকে এবার হেঁটে যেতে দেখলুম উত্তর-পশ্চিম কোণে টিকে থাকা ভাঙা ঘরটার দিকে। ততক্ষণে কর্নেল ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে তার ছবি তুলে নিয়েছেন। আমার কানের কাছে মুখ এনে উনি ফিসফিস করে বললেন, চিনতে পারলে কি ব্যাঙবাবুকে?

চমকে উঠে বললুম তাই তো। মোটা বেঁটে গোলগাল চেহারা। মাথায়—

চুপ।–বলে কর্নেল বাইনোকুলারে উত্তর-পশ্চিম দিকে দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, চল। এই যথেষ্ট, ফেরা যাক খিদে পেয়েছে।

কাঁচা রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললেন, বন্দুকওয়ালা লোকটা ওই টাড়ে গুঁড়ি মেরে বসে আছে।

একটু ভয় পেয়ে বললুম, আমাদের লক্ষ করে গুলি ছুঁড়বে না তো?

কর্নেল হাসলেন। না। লোকটা লালঘুঘু শিকার করতে চায়। দেখা যাক। লালাঘুঘুরা বেজায় ধূর্ত।

কর্নেল হন্তদন্ত হয় হাঁটতে থাকলেন। টাড় জমিটার একটু দূরে পৌঁছেছি, সেইসময় লোকটা বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ল। এক ঝাক লালঘুঘু উড়ে গড়ের জঙ্গলের দিকে চলে গেল। কর্নেল ক্যামেরা বাগিয়ে একটা ফুলেভরা ঝোপে প্রজাপতির ছবি তুলতে গেলেন। তখন লোকটা আমাদের দেখতে পেল। সে ব্লাড় থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়াল।

কর্নেল কোনও প্রজাপতিকে অনুসরণ করছেন, এই ভঙ্গিতে ক্যামেরা তাক করে গুঁড়ি মেরে বসলেন। দেখলুম, ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করাই আছে। তার মানে লোকটার ছবি তোলাই তার উদ্দেশ্য।

একটু পরে শাটার টিপলেন কর্নেল পরপর দুবার। লোকটা অবাক হয়ে তাকে দেখছিল। কাছে গেলে সে বলল, ক্যা সাব? আপ ফাটরাঙ্গাকি তসবির উঠাতা হ্যায়?

কর্নেল কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতি ধরা জাল বের করে বললেন, বহতন হুঁশিয়ার ফাটরাঙ্গা। নেটমে নেহি পাকড় যাতি তো ক্যা করেগা?

ইসমে ক্যা ফায়দা?

হবি হ্যায় ভাই, হবি। আপকা ব্যয়সা শিকার কি হবি হ্যায়।

আপ কাঁহাসে আতা হ্যায় সাব?

কলকত্তাসে। আপ হেঁয়াকা রহনেওয়ালা হ্যায়?

হাঁ।

আমরা তার সঙ্গে হাঁটছিলুম। কর্নেল তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। তারপর গড়ের জঙ্গলের কিচনির কথা তুললেন। সে ভয় দেখিয়ে বলল, কিচনি দেখলে লোক পাগল হয়ে যায়। কিচনি মানুষকে আছড়ে মারে। সরকারি বাংলোর কাছে পৌঁছে কর্নেল তার নাম জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলল, মগনলাল। তারপর বন্দুক কাঁধে নিয়ে শিস দিয়ে গান করতে-করতে চলে গেল।…

স্নানাহারের পর কর্নেল চুরুট শেষ করে বললেন, তুমি গড়িয়ে নাও জয়ন্ত। আমি বাথরুমকে ডার্করুম করে ফিরে একটা অংশ কেটে ওয়াশ ডেভলাপ করে ফেলি। বাকি ফিল্মগুলো বাঁচিয়ে কাজটা করতে হবে।

রোদে হেঁটে ক্লান্ত ছিলুম। স্নানাহারের পর ভাতঘুম আমাকে পেয়ে বসল। সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। উনি বললেন, উঠে পড়ো জয়ন্ত চারটে বাজে।

ব্যাঙবাবু আর মগনলালের ছবি চমৎকার উঠেছে। দেখবে এস।

ছবিগুলো দেখে বললুম, মিঃ পাণ্ডেকে এবার জানানো উচিত।

জানাব। কফি আসুক কফি খেয়ে বেরুব।

রামপ্রসাদ কফি দিয়ে গেল। কফি খেয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা বেরুলুম। কর্নেল সাবেক বসতি বাঙালিটোলার দিকে যাচ্ছেন দেখে জিগ্যেস করলুম, ঝন্টুবাবুর বাড়ি গিয়ে কী হবে? পুলিশকে জানাতে দেরি হলে ব্যাঙবাবু কেটে পড়তে পারে।

কর্নেল বললেন, পুলিশ পরে। আগে ঝন্টুবাবুকে দরকার।

অমরজিৎ সিংহের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে গেল। উনি কর্নেলের কাছে আসছিলেন। কর্নেল নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রথমে তাকে মগনলালের ছবি দেখালেন। অমরজিৎ বললেন, এর ছবি কোথায় তুললেন? এর নাম মগনলাল। সাংঘাতিক লোক। পুলিশও একে সমীহ করে চলে। এখানকার এক রাজনৈতিক নেতার ডান হাত।

কর্নেল এবার ব্যাঙবাবুর ছবিটা বের করে বললেন, এঁকে চেনেন কি?

অমরজিৎ অবাক হয়ে বললেন, আরে। ইনি তো কমলবাবু, ডাক্তার। মাধবের বাবা।

কর্নেল হাসলেন। এঁর হরিদ্বারে থাকার কথা। অথচ ইনি এখানেই আছেন। এঁর আরেকটা নাম ব্যাঙবাবু। জানেন কি?

অ্যাঁ? বলে অমরজিৎ নড়ে উঠলেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়ছে। ছোটবেলায় আমরা ওঁকে ব্যাঙবাবু বলে আড়ালে ঠাট্টা করতুম। ব্যাঙের মতো হাঁটাচলা দেখে এ পাড়ায় অনেকেই কমলজেঠুকে ব্যাঙ ডাক্তার বলতেন বটে।…

.

সাত

অমরজিৎ সিংহকে কর্নেল আর কোনও কথা খুলে বললেন না। তার সব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে শুধু বললেন, যথাসময়ে জানতে পারবেন। এবার বলুন আমার কাছে কী বিশেষ কারণে যাচ্ছিলেন?

অমরজিৎ ওরফে ঝন্টুবাবু বললেন, বনবিহারী থানার হাজত থেকে দিদিকে খবর পাঠিয়েছিল। দিদি যায়নি। আমি গিয়েছিলুম। ফেরার পথে বাংলোয় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনেছিলুম আপনারা বেরিয়েছেন।

কর্নেল বললেন, তা হলে বংলোয় চলুন। সেখানে বসে কথা হবে।

ঝন্টুবাবু বললেন, থাক। দেখা যখন হয়ে গেল, তখন কথাটা বলে চলে যাই। দিদি মন্টুর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে। তাকে একা রেখে এসেছি। তো কথাটা বলি। থানার হাজতে আমাকে দেখে বনবিহারী কান্নাকাটি করে বলল, দাদা, আমাকে বাঁচান। বিনা দোষে আমাকে পুলিশ ধরেছে। ওকে জিগ্যেস করলুম, তুমি নাম বদলেছ কেন? বনবিহারী বলল, আগের দুষ্কর্মের জন্য সে অনুতপ্ত। সৎ ভাবে বেঁচে থেকে ব্যবসাবাণিজ্য করার জন্য কোর্টে অ্যাফিডেভিট করে সে নাম বদলেছে। এখানে এসেছিল সে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে অর্ডার সংগ্রহ করতে মাধব তাকে আশ্বাস দিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে সময়মতো সে দেখা করতে যেত।

গড়ের জঙ্গলে কেন গিয়েছিল বলেনি?

বনবিহারী বলল যে, আগে এখানে এসে সে কিচনির গল্প শুনেছিল। এখন তার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস আছে। তাই সাহস করে সেখানে কিচনি খুঁজতে গিয়েছিল। কিচনির দেখা সে পেয়েছে। চারটে গুলি ছুঁড়েও চিনিকে সে মারতে পারেনি। আমি বললুম, এ বয়সে ছেলেমানুষি এখনও যায়নি তোমার? মন্টুর সাংঘাতিক মৃত্যুর কথাও তাকে বললুম। তা শুনে সে বলল, এর প্রতিশোধ সে নেবে, যদি আমি তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে পারি। তখন ওকে জিগ্যেস করলুম, কে মন্টুকে খুন করেছে সে কি জানে? বনবিহারী বলল যে, সে জানে। কিন্তু তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনলে তবেই সে সব কথা খুলে বলবে। আমি পুলিশকে অনেক অনুরোধ করলুম। জামিন হতে চাইলুম। কিন্তু পুলিশ তাকে ছাড়বে না। মন্টুর খুনের অন্যতম আসামী করা হয়েছে তাকে। তাই কাল তাকে কোর্টে তুলবে।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলেছে সে?

ঝন্টুবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ। একটা কথা বনবিহারী বলছিল। কথাটা বুঝতে পারিনি। কে নাকি তাকে ঠকিয়েছে। তার অনেকগুলো টাকা গচ্চা গেছে। এর প্রতিশোধ সে নেব। পুলিশ তার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে দিল না। তাই এ ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করার সুযোগ পাইনি।

ঠিক আছে। আপনি বাড়ি যান। আমি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখি, কী করা যায়।

ঝন্টুবাবু চলে গেলেন। আমরা বাংলোতে ফিরলুম। কর্নেল বললেন, তুমি ঘরে গিয়ে বোসো। আমি মিঃ পাণ্ডেকে টেলিফোনে পাই কি না দেখি।

দোতলায় আমাদের রুমের দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, রমেশ পাণ্ডে আসছেন। একসঙ্গে কফি খাওয়া যাবে।

তখনও দিনের আলো ছিল। কর্নেল বাইনোকুলারে গড়ের জঙ্গল দেখতে-দেখতে বললেন, মগনলাল আবার শিকারে বেরিয়েছে। সেই টাড় জমিতে লালঘুঘুর ঝক খুঁজছে। লালঘুঘুর মাংস নাকি সুস্বাদু। কিন্তু ওই পাখিগুলো মগনলালের চেয়ে ধূর্ত। ব্যস। উড়ে পালিয়ে গেল। ওকে গুলি ছোঁড়ার সুযোগই দিল না। মগললাল হতাশ হয়ে কঁচা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে।

বললুম, ব্যাঙবাবুর কাছে যাচ্ছে।

কর্নেল বাইনোকুলার রেখে হাসলেন। সিংহ রাজাদের বিগ্রহ উদ্ধারে ব্যাঙবাবু মগনলালের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর পূর্বপুরুষ সিংহ রাজাদের কর্মচারী ছিলেন। কাজেই ওই বিগ্রহের কথা বংশপরম্পরায় তাদের জানার কথা।

আমার ধারণা, বিগ্রহ গড়ের জঙ্গলেই লুকানো আছে।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বিগ্রহের রত্নালঙ্কার বিক্রি করেছিলেন ঝন্টুবাবুর ঠাকুরদার বাবা। তাই বলে বিগ্রহ লুকিয়ে রাখবেন কেন? লুকিয়ে রাখার পিছনে কোনও যুক্তি নেই।

তাহলে সেই বিগ্রহ গেল কোথায়?

এর সোজা এবং যুক্তিসঙ্গত উত্তর হল, বিগ্রহ ধ্বংস্তূপে চাপা পড়েছিল।

চিন্তা করো জয়ন্ত। ঝন্টুবাবুর ঠাকুরদার বাবা দুর্গপ্রাসাদ ছেড়ে চলে এসেছিলেন কেন? মেরামতের অভাবে প্রাসাদ ভেঙে পড়েছিল। তার মৃত্যুর পর ঝন্টুবাবুর ঠাকুরদার পক্ষে ওই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বিগ্রহ উদ্ধারের ক্ষমতা ছিল না। অমন বিশাল ধ্বংস্তূপ-কল্পনা করো, তখন জঙ্গল গজায়নি। শুধু বিশাল দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ একটা টিলার মতো উঁচু হয়ে আছে। তা সরাতে প্রচুর টাকা খরচ করে মজুর লাগানো দরকার। শুধু মজুর নয়, দক্ষ উৎখননকর্মী এবং ক্রেন দরকার ছিল। গত একশ বছরে প্রাকৃতিক কারণে গড়ের জঙ্গলের সেই চেহারা বদলে গেছে। বিশেষ করে ১৯৩৪ সালে বিহারে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল। তার ফলে ভূপ্রকৃতির গঠন বদলে গিয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের চিহ্ন গড়ের জঙ্গলে লক্ষ করেছি। এখানে থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত এলাকা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধারিয়া নদীর গতিপথ বদলে গিয়েছিল।

কর্নেল ভূমিকম্প নিয়ে সমানে বকবক করতে থাকলেন। ওঁর এই স্বভাব। আমি অসমতল সবুজ প্রান্তর আর দিগন্তে পর্বৰ্মলার দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছিলুম। এসময় দরজায় কেউ নক করল। কর্নেল বললেন, কম ইন।

দরজা ভেজানো ছিল। দেখলুম, সাদা পোশাকে রমেশ পাণ্ডে ঢুকলেন। কর্নেল বললেন, এখানে চলে আসুন মিঃ পাণ্ডে। এখনই কফি এসে যাবে নিচে বলে এসেছি ছ’টা নাগাদ কফি পাঠাতে।

পাণ্ডে এসে ব্যালকনিতে বসলেন। একটু হেসে বললেন, আপনি অফসেট বা লেজার প্রিন্টিং প্রেসের কথা জিগ্যেস করছিলেন। আমাদের সোর্স খবর দিয়েছে, পাটনায় মাধববাবুর শ্যালক চন্দ্রনাথবাবুর ওই প্রেস আছে।

কর্নেল পকেট থেকে খামে ভরা সেই ন’খানা চিঠি বের করে দিলেন পাণ্ডেকে। পাণ্ডে চিঠিগুলো দেখে বললেন, বাংলা বলতে পারলেও আমি পড়তে পারি না। এগুলো কী?

কর্নেল তাকে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানিয়ে একটা চিঠি পড়ে শোনালেন।

পাণ্ডে বললেন, ঝন্টুবাবু আমাদের জানাননি। তাহলে এতদিনে ধরে ফেলতুম কে ওঁর গেটে চিঠি রেখে আসে। শুনেছি, ঝন্টুবাবু সাহসী লোক।

কর্নেল বললেন, ঝুঁকি নিতে সাহস পাননি। দিদি এবং পাগল ভাইয়ের কথা ভেবেই চুপচাপ ছিলেন। লক্ষ করুন, এগুলো সবই পুরু আর্টপেপারে ছাপা ফটো কপি। প্রত্যেকটা মূল একটা চিঠির কপি।

আপনার কি সন্দেহ মাধববাবুর শ্যালকের প্রেসে এগুলো ছাপা হয়েছে?

সম্ভবত।

পাণ্ডে হাসলেন। আপনি নিশ্চয় কোনও বিশেষ কারণে এই সন্দেহ করেছেন?

হ্যাঁ। ব্যাঙবাবুর কারণে।

রমেশ পাণ্ডে অবাক হয়ে বললেন, ব্যাঙবাবু? তাকে কি আপনি চেনেন?

কর্নেল জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, এইসময় রামপ্রসাদ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স আনল। সে চলে গেলে কর্নেলের ইশারায় আমি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলুম।

কর্নেল তিনটে কাপে কফি ঢালতে-ঢালতে বললেন, ব্যাঙবাবু গড়ের জঙ্গলে ডেরা পেতেছে। সম্ভবত ওখানে উত্তর-পশ্চিম কোণে কোনও একটা ঘর এখনও টিকে আছে। সেই ঘরে ব্যাঙবাবু মাঝে-মাঝে গিয়ে থাকে, তা স্পষ্ট। আজ দুপুরে ব্যাঙবাবুর এই ছবিটা টেলিলেন্সের সাহায্যে দুর থেকে তুলেছি। আপনি দেখুন। তারপর বলুন মগলনালকে আপনি আপনার প্রয়োজনে গ্রেফতার করতে পারবেন কি না। কারণ, সে নাকি স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার ডানহাত।

ছবিটা দেখে পাণ্ডে বললেন, বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মগনলালের সঙ্গে ব্যাঙবাবু তাহলে যোগাযোগ করেছে?

হ্যাঁ। দুজনে মুখোমুখি বসে কথা বলছিল। পরে মগললালের ছবিও তুলেছি। এই দেখুন।

রমেশ পাণ্ডে একটু চুপ করে থেকে বললেন, মগললালকে গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু তাকে আটকে রাখা যাবে না। তবে-কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, বলুন?

রমেশ পাণ্ডে গলার ভেতর থেকে বলেন, মগনলালের গার্জেনের এক প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। তিনিও প্রভাবশালী। তিনি একবার বলেছিলেন, কোনও সুযোগে এনকাউন্টারে মগনলালের মৃত্যু ঘটানো হোক। কিন্তু আমার বিবেকে বাধে। যদি সত্যিই কোনও সাংঘাতিক ক্রাইমের সময় সুযোগ মেলে, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু মগনলাল ধূর্ত লোক। সে ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা আদায় করে। অনেক সময় ডাকাতিও করে। কিন্তু ঘটনাস্থলে সে থাকে না। তার নামে তিনটে খুনের অভিযোগ আছে। তাকে জামিন দেওয়া হয়েছে। যদি খুনের সময় মুখোমুখি তাকে পেতুম, গুলি করে মেরে এনকাউন্টারে মৃত্যু বলে চালানো যেত।

কর্নেল বললেন, না-না। নরহত্যার প্রশ্ন ওঠে না। অপরাধীর আইনমাফিক বিচারই কাম্য। আমি আপনাকে কখনই এমন প্রস্তাব দেব না। বরং এমন কাজের বিরোধিতাই করব। যাই হোক, ব্যাঙবাবুর গড়ের জঙ্গলে মাঝে-মাঝে গিয়ে থাকার উদ্দেশ্য, সিংহ রাজাদের পূর্বপুরুষের বিগ্রহ খুঁজে বের করে তা বিদেশে পাচার করা। বিগ্রহ ওই জঙ্গলে ধ্বংসস্তূপের তলায় কোথাও চাপা পড়েছিল।

রমেশ পাণ্ডে বললেন, আমার মতে আজ রাতেই গড়ের জঙ্গলে হানা দিয়ে ব্যাঙবাবুকে গ্রেফতার করা দরকার। তার নামে এখনও হুলিয়া ঝুলছে।

কর্নেল হাসলেন। অথচ ব্যাঙবাবু মাথায় পরচুলা আর মুখে নকল দাড়ি পরে দিব্যি ধার্মিক সাধুসন্তের চেহারা নিয়ে সিংহগড়ে বাস করেন। মাঝে মাঝে তীর্থযাত্রায় বাইরে যাবার ছলে গড়ের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন। বিগ্রহের খোঁজে সেখানে ব্যর্থ খোঁড়াখুঁড়ি করেন। তবে না। রাতে ওঁর ডেরা যদি খুঁজে পান আপনারা, জঙ্গলে উনি গা-ঢাকা দিয়ে পালিয়ে যাবেন। তার চেয়ে কাল সকাল সাতটা নাগাদ হানা দেওয়াই ভালো। প্রচুর ফোর্স দরকার। সারা গড়ের জঙ্গল ঘিরে রেখে হানা দিতে হবে।

পাণ্ডে চিন্তিত মুখে বললেন, সিংহগড় থানায় বেশি ফোর্স নেই। এস. পি. সায়েবকে বলে ধরমপুরা আর লখিমপুরা থানা থেকে ফোর্স আনাতে হবে। রাতের মধ্যে ফোর্স আসা দরকার। শুধু একটু অসুবিধা। গড়ের জঙ্গলের একটা রাফ ম্যাপ আগে তৈরি করে রাখা উচিত ছিল।

আমি করেছি। বলে কর্নেল ঘরে ঢুকে কিটব্যাগ থেকে একটা ভাজকরা কাগজ নিয়ে এলেন। সেটা খুলে বললেন, স্মৃতি থেকে আজ দুপুরে খাওয়ার পর এটা এঁকেছি। একেবারে নির্ভুল না হলেও মোটামুটি একটা রাফ ম্যাপ এটা। যেখানে মন্টুবাবুর বডি পাওয়া গিয়েছিল এবং যেখানে তাকে হত্যা কর হয়েছিল, সেই জায়গাটা ম্যাপে আছে।

পাণ্ডে ম্যাপটা দেখতে-দেখতে বললেন, পশ্চিমেও একটা প্রবেশ পথ দেখছি।

হ্যাঁ। ও পথে আদিবাসীরা শিকারে যায়।

আচ্ছা কর্নেল সরকার, যেখানে মন্টুবাবুকে খুন করা হয়েছিল, ওখানে স্টার চিহ্ন কেন?

ওখানে একটা পাঁচকোনা পাথর আছে লক্ষ্য করেননি? একটা কোনা অবশ্য ভাঙা।

না। লক্ষ করিনি। আসলে তখন খুনের মোটিভ নিয়েই চিন্তাভাবনা করছিলুম।

ওটা মোগল আমলের চবুতরার ছাদের অনুকরণে তৈরি। এমনভাবে ধসে পড়েছে যে কোণগুলো সহজে চোখে পড়ে না। ঘাস আর ঝোপে ঢাকা পড়েছে কিছুটা।

রমেশ পাণ্ডে উঠে দাঁড়ালেন। তা হলে চলি। ফিরে গিয়ে এস. পি. সায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা রাতের মধ্যেই করে ফেলছি। আপনি এবং জয়ন্তবাবু আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

কর্নেল তাকে বিদায় দিতে গিয়ে বললেন, আর একটা কথা মিঃ পাণ্ডে। এস. পি. সায়েবকে বলবেন, কাল পাটনার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের অধিকর্তাকে বলে শিগগির একটা টিম পাঠানোর ব্যবস্থা যেন করেন।

কেন বলুন তো?

ধ্বংসস্তূপে চাপাপড়া প্রাচীন একটি বিগ্রহ তারা উদ্ধার করে জাদুঘরে রাখবেন।

পাণ্ডে অবাক হয়ে বললেন, বিগ্রহের খোঁজ তাহলে আপনি পেয়েছেন।

হ্যাঁ পেয়েছি। কিন্তু আগে ব্যাঙবাবুকে পাকড়াও করার পর বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ শুরু হবে। দেরি করা চলবে না।

রমেশ পাণ্ডে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল দরজা বন্ধ করে এসে বসলেন। বললুম, বিগ্রহের খোঁজ কী করে পেলেন আপনি?

কর্নেল চাপা গলায় সুর ধরে আওড়ালেন–

পঞ্চভূতে ভূত নাই
মুখে ঈশ ভজ ভাই
তালব্য শ পালিয়ে গেলে
যোগফলে অঙ্ক মেলে
হর হর বোমভোলা
খাও ভাই গুড়ছোলা…

বললুম, হেঁয়ালি না করে খুলে বলুন না কর্নেল।

কর্নেল বললেন, আপাতদৃষ্টে উদ্ভট মনে হলেও খুব সোজা একটা ছড়া। এতে একটা গোপন তথ্য লুকানো আছে। তাই ঝন্টুবাবুর ঠাকুরমা দুই ভাইকে ছোটবেলায় এটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বড় হয়ে ছড়া থেকে তথ্য বের করে তার পৌত্রেরা যদি বংশের প্রাচীন বিগ্রহ উদ্ধার করতে পারে, তাই তিনি এই ছড়া বানিয়েছিলেন।

.

বলে কর্নেল পকেট থেকে তার খুদে নোট বই বের করে ডট পেনে লিখতে শুরু করলেন। প্রথম লাইনে বলা পঞ্চভূতে ভূত নাই। তার মানে ভূত বাদ দিলে রইল ‘পঞ্চ’। এবার, মুখে ঈশ তালব্য শ গেলে রইল ‘ঈ’। পরের লাইন যোগফলে অঙ্ক মেলে। তার মানে মুখের সঙ্গে ঈ যোগ করলে দাঁড়ায় ‘মুখী’। এবার দাঁড়াল ‘পঞ্চমুখী। হর হর ব্যোমভোলা বলতে ‘শিব’।’পঞ্চমুখী শিব। গুড় আর ছোলা তার প্রসাদ। শিবের পঞ্চমুখী বিগ্রহ বহু জায়গায় আছে। পঞ্চমুখী শিব ছিলেন সিংহ রাজাদের আসল গৃহদেবতা। তার মন্দিরের ছাদও ছিল পঞ্চমুখী। আমরা যে পাথরটা গড়ের জঙ্গলে দেখছি, তা সেই মন্দিরের ছাদ। তার তলায় বিগ্রহ চাপা পড়ে গিয়েছিল। ঝন্টুবাবুর ঠাকুরদার সেই জনবল বা অর্থবল ছিল না যে তিনি খোঁড়াখুঁড়ি করে বিগ্রহ উদ্ধার করেন। কারণ, শুধু খুঁড়লে তো চলবে না। ওই পাঁচকোনা পাথরের ছাদটা সরাতে হবে। ক্রেনের সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভবই নয়। তবে হ্যাঁ, সুড়ঙ্গ খুঁড়েও বিগ্রহ উদ্ধার করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সঠিক স্থান না জানলে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে লাভ নেই। তাছাড়া ওপরে ভারী পাথর। সুড়ঙ্গ ধ্বসে পড়ারও ঝুঁকি ছিল।

বললুম, আমার ধারণা মন্টুবাবু হয়তো জানতেন, কোনদিকে সুড়ঙ্গ খুঁড়লে বিগ্রহ পাওয়া যাবে।

কর্নেল আস্তে বললেন, ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে।’ডেডস্ ডু নট স্পিক। মৃতেরা কথা বলে না। কাজেই ওটা নিছক ধারণাই থেকে যাচ্ছে।

কিন্তু মন্টুবাবু পড়ে গিয়ে পাগল হয়েছিলেন কেন। এটা খুব অদ্ভুত না?

কর্নেল বললেন, কমল বোস ওরফে ব্যাঙবাবু ছিলেন হাতুড়ে ডাক্তার। তাকে জেরা করলে জানা যেতে পারে, ছেলে মাধবের সাহায্যে মন্টুবাবুকে গড়ের জঙ্গলে ডেকে এনে কথা আদায় করার জন্য কোনও নার্ভের ওষুধ জোর করে খাইয়ে দিয়েছিলেন কি না? নার্ভকে আচ্ছন্ন করে সাইকিয়াট্রিস্টরা রোগীর অবচেতন মনের গোপন কথা জেনে নেন। ব্যাঙবাবু হাতুড়ে ডাক্তার। হিতে বিপরীত হয়ে গিয়েছিল। দেখা যাক, আগে অপারেশন সাকসেসফুল হোক। তখন জানা যাবে।…

.

উপসংহার

কর্নেলের তাড়ায় ভোর ছটায় আমাকে উঠতে হয়েছিল। বেড-টি খেয়ে সেজেগুজে বেরুতে-বেরুতে সাড়ে ছ’টা বেজে গেল। কর্নেল বাংলোর লন পেরিয়ে গিয়ে বললেন, রমেশ পাণ্ডে বুদ্ধিমান। বাইনোকুলারে তন্নতন্ন খুঁজে গড়ের জঙ্গলের দিকে পুলিশ দেখতে পাইনি। ক্যামোফ্লেজ করে ঝোঁপের আড়ালে পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করেছেন। অবশ্য একটা পুলিশ ভ্যান কাঁচা রাস্তা দিয়ে আদিবাসীদের গ্রামের দিকে যেতে দেখেছি।

কর্নেল যথারীতি তার প্রাতঃভ্রমণের ভঙ্গিতে হাঁটছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ব্লাড় জমিটায় উঠে আমরা গড়ের পূর্বদিকে পৌঁছুলুম। কোথাও পুলিশের টিকিও দেখতে পেলুম না।

ধসে পড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে গড়ে ঢোকার সময় কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। কোনও পাখি শিস দিচ্ছিল। কর্নেল পালটা শিস দিলেন। তারপর একটা ধ্বংস্তূপের আড়ালে রমেশ পাণ্ডের টুপি দেখা গেল। উনি পুলিশের পোশাক পরে অপারেশনে এসেছেন। কর্নেল তাকে ইশারায় অনুসরণ করতে বললেন।

তারপর উনি বাইনোকুলারে চারদিকে খুঁটিয়ে দেখে এগিয়ে গেলেন উত্তর-পশ্চিম কোণে। উঁচুতে সেই ভাঙা ঘরের অংশটা লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে একটুকরো পাথরের ওপর দাঁড়ালেন। শরৎকালের সকালবেলার রোদে সবুজ বৃক্ষলতা গুল্মে শিশির ঝলমল করছিল। পাখির ডাকে মুখর চারদিক। এমন একটা সুন্দর নিসর্গে মনোরম সকালবেলায় কমল বোস ওরফে ব্যাঙবাবুকে পাকড়াও করার জন্য অভিযান বড় বিসদৃশ ঘটনা।

হঠাৎ কর্নেল আমার উদ্দেশে একটু চড়া গলায় বললেন, জয়ন্ত সর্বনাশ। ওই বুঝি সেই সাংঘাতিক জলের পেত্নি কিচনি। ওরে বাবা! কী ভয়ঙ্কর চেহারা।

আমি কিছু দেখতে না পেলেও আঁতকে উঠে বললুম, পালান কর্নেল। শিগগির পালিয়ে যাই আসুন।

কর্নেল বললেন, ওরে বাবা। কিচনিটা যে আমাদের দিকেই আসছে।

এতক্ষণে একটা ধ্বংস্তূপের আড়াল থেকে বিদঘুঁটে জন্তুটাকে বেরুতে দেখলুম। প্রকাণ্ড একটা কালো ব্যাঙের মতো দেখতে। মুখটাও ব্যাঙের মতো। কিন্তু ধারালো সাদা দাঁত আছে মুখে। চোখ দুটো লাল এবং ঠেলে বেরিয়ে আসছে। থপথপ শব্দে জন্তুটা হাঁ করে এগিয়ে এল। তারপর গলার ভেতর ভূতুড়ে শব্দ করতে থাকল।

আমি পিছিয়ে গিয়ে প্রাণের দায়ে চেঁচিয়ে উঠলুম, মিঃ পাণ্ডে। মিঃ পাণ্ডে।

জন্তুটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর দেখলুম, কর্নেল পাথর থেকে লাফ দিয়ে নেমে জন্তুটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরাশায়ী করলেন। ততক্ষণে রমেশ পাণ্ডে এবং একদল সশস্ত্র পুলিশ ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কর্নেলের বিশাল শরীরের তলায় পড়ে জন্তুটা হাত-পা ছুড়ছিল। কর্নেল ডাকলেন, মিঃ পাণ্ডে। চলে আসুন এখানে। ব্যাঙবাবুকে কিচনির খোলস ছাড়িয়ে বের করুন এবার।

পাণ্ডের আদেশে কনস্টেবলরা গিয়ে জন্তুটাকে মাটিতে ঠেসে ধরল। কর্নেল বললেন, আর কী ব্যাঙবাবু। এবার খোলস ছেড়ে দেখা দিন। কালো রেক্সিনে ফোম ভরে সেলাই করে খাসা কিচনির খোলস তৈরি করেছেন।

এবার মানুষের গলায় কিচনিটা কেঁদে উঠল, বেরুচ্ছি সার। আমাকে একটু উঠে বসতে দিন।

কনস্টেবলরা হাসতে-হাসতে তাকে টেনে ওঠাল। পিঠের দিকে চেন টেনে কর্নেল খোলস থেকে একটা লোককে বের করলেন। তারপর অবাক হয়ে বললেন, এ কী! এ তো ব্যাঙবাবু নয়।

আমি অবাক। লোকটা রোগা। মালকোচা করে ধুতি পরা। গায়ে একটা নোংরা গেঞ্জি। সে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, বাবু আমাকে এই পোশাক পরিয়ে আপনাদের ভয় দেখাতে বলে রাতেই চলে গেছেন সার। আমি জানতুম না কিছু।

পাণ্ডে তার পেটে বেটনের পুঁতো মেরে বললেন, তুই কে?

আজ্ঞে হুজুর, আমার নাম কেষ্টচরণ। আমি বাবুর বাড়িতে কাজ করি।

তোর বাবুর নাম কী?

আজ্ঞে, কমলবাবু। আগে ডাক্তারি করতেন। তিনিই।

পাণ্ডে বললেন, সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। এই ব্যাটা! তোর বাবু কোথায় গেছে?

কাল সন্ধ্যাবেলা মগললালকে দিয়ে বাবু খবর পাঠিয়েছিলেন আমাকে। আমি তাই এসেছিলুম হুজুর। বাবু বলে গেছেন, বাড়ি যাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর আসবেন। দিনে কেউ এলে যেন ভয় দেখাই।

কর্নেল বললেন, মিঃ পাণ্ডে। এই কেষ্টচরণকে নিয়ে আপনি এখনই কমলবাবুর বাড়ি সার্চ করুন। একজন অফিসার আর জনা দুই কনস্টেবল আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিন। ব্যাঙবাবুর ডেরা আমি দেখতে পেয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখা দরকার, ওটা চোরাই বিগ্রহ লুকিয়ে রাখার ঘাঁটি কিনা।

কেষ্টচরণ হাউমাউ করে আরও কী বলার চেষ্টা করছিল। বলার সুযোগ দিলেন না পাণ্ডে। দ্রুত চলে গেলেন।

একটু পরে একজন পুলিশ অফিসার এবং দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল এল। কর্নেল তাদের নিয়ে এগিয়ে চললেন। আমি পেছনে হাঁটছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ হল এবং একজন কনস্টেবল আর্তনাদ করে পড়ে গেল। দেখলুম, তার কাঁধে রক্ত ঝরছে।

পুলিশ অফিসার তখনই হুইসেল বাজালেন এবং অর্ডার দিলেন, ফায়ার।

সকালের গড়ের জঙ্গল বারুদের কটু গন্ধ আর পাখিদের আর্ত চিৎকারে ভরে গেল। এতক্ষণে দেখলুম, একটু উঁচুতে একটা গুহার মতো ফোকর লক্ষ করে ঝুঁকে-ঝকে গুলি ছুঁড়ছে পুলিশ। সেই ফোকর থেকে আধখানা ঝুলে আছে একজন মানুষের রক্তাক্ত দেহ।

কর্নেল চিৎকার করে বললেন, স্টপ। স্টপ ইট। মগনলাল ইজ ডেড। তাহলে মগনলালকে ডেরায় পাহারায় রেখেই ব্যাঙবাবু বাড়ি গিয়েছিলেন। সেই ডেরায় পৌঁছে দেখি, ওটা একটা টিকে থাকা পাথরের ঘর। শেষদিকে একটা ঘুলঘুলি আছে। মগললালের মৃতদেহ পুলিশ টেনে নিচে নামাল। তার বন্দুকটা নিচে পড়ে গিয়েছিল।

ঘরটার ভেতর একটা কাঠের বাক্সে কয়েকটা বিগ্রহ পাওয়া গেল। একপাশে একটা খাঁটিয়ায় বিছানা পাতা এবং মশারি খাটানো আছে। কুঁজো ভর্তি জল, গ্লাস এবং একটা টিফিন কেরিয়ার দেখতে পেলুন। কর্নেল কাঠের বাক্স থেকে বিগ্রহগুলো দেখতে-দেখতে তলা থেকে একটা কালো রঙের রিভলভার এবং একটা বুলেটের বাক্স তুলে নিলেন। পুলিশ অফিসারটি বললেন, আরে, ব্যাঙবাবুকা ফায়ার আর্মস?

কর্নেল বললেন, ইয়ে হ্যায় মার্ডার উইপন। পাগল মন্টুবাবুকো মার ডালা ব্যাঙবাবু। কিছুক্ষণ পরে আমরা গড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেলুম। পুলিশবাহিনীর একটা অংশ সেখানে থেকে গেল আহত কনস্টেবলকে তার সহকর্মীরা ততক্ষণে নিয়ে গেছে পুলিশ ভ্যানের কাছে। পাণ্ডের আয়োজন এতক্ষণে চোখে পড়ল। গড়ের জঙ্গলের চারদিক থেকে দলে-দলে পুলিশ মার্চ করে চলেছে সিংহগড়ের দিকে।…

বাংলোয় ফিরে ব্রেকফাস্ট করার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়েছেন, এমনসময় রামপ্রসাদ এসে জানাল, কর্নিলসাবকা ফোন। শুনেই কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। মিনিট পনেরো পরে উনি ফিরে এসে হাসিমুখে বললেন, ব্যাঙবাবু ধরা পড়েছে। মাথায় পরচুলা, মুখে নকল গোঁফ দাড়ি, পরনে গেরুয়া লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে সাইকেল রিকশাতে সবে উঠে বসেছে, রমেশ পাণ্ডে গিয়ে হাজির। চল, এবার সিংহবাড়ি যাওয়া যাক। ঝন্টুবাবু এবং তার দিদিকে খবরটা দিলে ওঁরা মনে একটু শান্তি পাবেন। হ্যাঁ, আর একটা কথা। বনবিহারী কবুল করেছে, বিগ্রহ কেনার জন্য সে মাধববাবুর বাবাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাঙবাবু তাকে ঠকিয়েছেন। সে রাগে ফুঁসছে। কিন্তু কিছু করার নেই তার।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *