ভূতুড়ে এক কাকতাড়ুয়া

ভূতুড়ে এক কাকতাড়ুয়া

এমন যদি হয়, বেগুনখেতের কাকতাড়ুয়াটি নিঝুম জ্যোৎস্নায় রাতে ক্ষীণ সুরে গান গাইতে গাইতে চলাফেরা করে বেড়ায়, তা হলে সত্যিই ব্যাপারটা বড্ড ভয়-ভূতুড়ে হয়ে ওঠে। কিন্তু তার গায়ের জামায় আর বেগুনপাতায় রক্তের ফোঁটা থাকলে সে-একটা সাঘাতিক রহস্যই!

কাকতাড়ুয়াটি বানিয়েছিল ফান্টু, তুলারাম দণ্ডীমশাইয়ের ভাগনে। স্কুল ফাইনালে তিন-তিনবার ফেল করায় যাকে গঙ্গার পাড়ে মামার সাধের ফার্মে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ফান্টুর মেধা খেত-খামারেই ভাল খুলেছে। খামোকা কাগজে ছাপানো কথাবার্তা মুখস্থ করে জীবন বরবাদ করে ফেলছিল। কাটরার মাঠে দণ্ডীমশাইয়ের পনেরো একর খেতে মরসুমি ফসল আর ফুল-ফলের ফলন দেখার মতো! এক টুকরো নার্সারির লাবণ্য তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। গত শীতে কালীগঞ্জে কৃষি-প্রদর্শনী মেলায় তিন কিলো ওজনের বেগুন সরকারি মেডেল পাইয়ে দিল, এও একটা বড় ঘটনা।

তবে সবই নাকি ঈশান কোণে পোঁতা কাকতাড়ুয়াটির জোরে, এটা ফান্টুর নিজের মত। গঙ্গার ধারে ওই যে পুরনো শিবমন্দির আর বটের গাছ, সেখানে কখনও-না-কখনও সাধু-সন্নেসি এসে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকেন। তাঁদেরই একজনকে তুষ্ট করে পরামর্শটি পায় সে। পৃথিবীতে সবকিছু নাকি জোড়ায়-জোড়ায় সিধে আর উল্টো থাকার নিয়ম। যেমন, দিন আর রাত, মাটি আর জল, গরম আর ঠান্ডা, মামা আর মামি–ফান্টুর দেওয়া নমুনা। মামা যেমন কুচুটে বদরাগী, মামি তেমনি শান্ত, মিঠে, নরম। তো লক্ষ্মীর উলটো অলক্ষ্মী। অলক্ষ্মীর দৃষ্টি সবসময় কু। বিশেষ করে বেগুনখেতের দিকে তার নজর বেশি। পোকায় পোকায় বেগুন জেরবার। শেষে যেই কাকতাড়ুয়াটি তৈরি করে ঈশাণ কোনায় পোঁতা হল, একজিবিশনে মেডেল! আর কী প্রমাণ চাই?

কাকতাড়ুয়া বানানো খুব সোজা। পলকা দু’টুকরো বাঁশ আড়াআড়ি বেঁধে ক্রুশ তৈরি করো। তাতে খড় জড়িয়ে কষে বাঁধে। দু’ধারে দু’হাত বাড়ানো একঠেঙে মানুষটির আকার হল। এবার একটা ঘেঁড়াখোঁড়া পাঞ্জাবি পরিয়ে দাও। মাথায় বসিয়ে দাও, একটা কেলে মাটির হাঁড়ি। চুন দিয়ে ওতে চোখ-মুখ এঁকে দাও, দাঁতশুন্ধু। দেখবে কী বিকট চেহারা হল! অলক্ষ্মী অবশ্য শুধু এতেই ভয় পাবার নয়, সেই সনেসি কাকতাড়ুয়াটির মাথায় মন্ত্র ফুঁকে দিয়েছিলেন, যেটা ফান্টুর মুখস্থ হয়ে গেছে: ‘ঔং হ্রীং ক্লীং ফট ফটু মারয় মারয় তাড়ায় তাড়য় স্বাহা!’

হুঁ, পাঞ্জাবিটি মামার। মামির কাছে গোপনে চেয়ে আনা। মামা হাড়কেপ্পন, হিসেবি মানুষ। তবে একটাই সুবিধে, বড্ড ভুলো মন। পাঞ্জাবিটি চিনতে দেরি হয়েছিল এবং তখন একজিবিশনে মেডেল জুটেছে। ফান্টু একগাল হাসি আর আশীর্বাদই পেল। তারপর থেকে মামার মন ফার্মের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সন্ধেটি হলেই গঙ্গা পেরিয়ে কাটরার মাঠে ছোট্ট একতলা ফার্মহাউসে রাত কাটান। খুব ‘নেচার, নেচার করেন। বলেন, “নেচারেই শান্তি আছে রে বাবা! সাধুসগ্নেসিরা সেটা জানেন বলেই তো নেচারের ভেতর ঘুরে বেড়ান।” ফাল্গুনের জ্যোৎস্নারাতে ঘুম ভেঙে মামাকে ভোলা বারান্দায় হেঁড়ে গলায় গান গাইতেও শুনেছিল ফান্টু।

কিন্তু এ-গান সে-গান নয়। নিশুতি রাতে চলন্ত কাকতাড়ুয়ার খোলা সুরের ভয়-জাগানো গান। মামা-ভাগনে দু’জনেই আতঙ্কে কাঠ। ফার্মহাউসে বিদ্যুৎ আছে। ঘটনার সময় রহস্যময় লোডশেডিং। টর্চের আলো ফেলতেই কাকতাড়ুয়াটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। গানও গেল থেমে।

ফার্মে আরও দুজন লোক আছে। মুকুন্দ আর রমজান। মুকুন্দ পাওয়ার টিলার চালায়। রমজান কীটনাশক ওষুধ ছড়ায়। দণ্ডীমশাইয়ের সন্দেহ, দু’জনেই গাঁজাখোর। ওঠানো গেল না। সকালে দেখা গেল, কাকতাড়ুয়াটি নিজের জায়গা ছেড়ে অন্তত হাত-তিরিশেক এগিয়ে বেগুনখেতের মাঝামাঝি পোঁতা আছে। বেগুনের গাছে যথেচ্ছ কাঁটা। ফান্টু সাবধানে কাকতাড়ুয়াটিকে আগের জায়গায় পুঁতে রেখে এল।

পরের রাতে আবার একই ঘটনা।

বদরাগী দণ্ডীমশাই এ-রাতে বন্দুকে গুলি ভরে তৈরিই ছিলেন। ধুধু জ্যোৎস্নায় কাকতাড়ুয়াটি জ্যান্ত হয়ে ঠ্যাঙ বাড়িয়ে ধোঁনা সুর ভাজছে কি, বন্দুক চিকুর ছাড়ল। ফট্টাস শব্দ এবং কাকতাড়ুয়া বেগুনখেতের ভেতর কুপোকাত!

কিন্তু না, তখনও রক্তের ফোঁটা দেখা যায়নি। ভোরে ফান্টু গেল অবস্থা দেখতে। মামা তখনও জয়ের আনন্দে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ফট্টাস শব্দটি ছিল কাকতাড়ুয়া বেচারার মুণ্ডুর, মানে–সেই কেলে হাঁড়িটি গুলি লেগে চৌচির হওয়ার। মন্ত্রপড়া মুণ্ডুর দশা দেখে ফান্টুর মন খারাপ হয়ে গেল। কবন্ধ কাকতাড়ুয়াকে পুঁতে রাখল অগত্যা।

সেদিনই দ্বিতীয় রহস্যের সূত্রপাত।

তুলারাম দণ্ডীর সঙ্গে তুলাদণ্ডের সম্পর্ক আছে। কালীগঞ্জের বাজারে পশুখাদ্য খোল-ভুসির বড় আড়ত তাঁর। দুপুরে ঔরঙ্গবাদ থেকে এক ট্রাক টাটকা গমের ভুসি এসেছিল। বাঁধা খদ্দেররা ধরলে টাটকা ভুসি বেচতে হয়। একটা বস্তার ভেতর থেকে বেড়িয়ে পড়ল একটা মড়ার খুলি। হইচই পড়ে গেল চারদিকে। এ কী বিদঘুঁটে ব্যাপার!

সাপ্লায়ার দণ্ডীমশাইয়ের মাসতুতো ভাই চণ্ডীচরণ। খবর গেল তার কাছে। খুলিটি ওজনদার, প্রায় ন’শো গ্রাম। সেই নশো গ্রাম ভুসি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি এল চণ্ডীচরণের কাছ থেকে। চিঠির বক্তব্য হল, সম্ভবত যে-গমখেতের গম থেকে এই ভুসির উৎপত্তি, তার শিয়রে একটি কাকতাড়ুয়া ছিল এবং খুলিটি সেটির মাথায় বসানো ছিল। কোনও আমুদে চাষির রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। দাদা যেন ক্ষমাঘেন্না করে দেন এবারকার মতো। এবার থেকে সব মাল বিশদ খতিয়ে দেখে পাঠানো হবে না।

দণ্ডীমশাই বিশেষ তুষ্ট হলেন। বেগুনখেতের কাকতাড়ুয়াটির মাথা তিনি গত রাতে ফাটিয়েছেন। ফান্টু কেলে হাঁড়ির খোঁজে সারাদিন হন্যে হচ্ছে, খবর পেয়েছেন। আজকাল আর মাটির হাঁড়িতে রান্নার চল নেই। দৈবাৎ একটা পেয়ে গিয়েছিল সেই সন্নেসির দয়ায়, যিনি মৃৎপাত্রে রান্না করা ছাড়া অন্ন অশুচি গণ্য করতেন।

সন্ধে হতে-না-হতে গঙ্গা পেরিয়ে দণ্ডীমশাই কাটরার মাঠে তার ফার্মে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন মড়ার খুলিটি। একগাল হেসে বললেন, “ফান্টু, এই দ্যাখ, কী এনেছি তোর জন্যে।”

ফান্টু আঁতকে উঠে বলল, “ওরে বাবা! এ আমি কী করব মামা?”

“ধুর বোকা!” দণ্ডীমশাই বললেন। “দেখিসনি কাকতাড়ুয়ার মাথায় মড়ার খুলিও থাকে। নে, ব্যাটাচ্ছেলেকে পরিয়ে দে। ন্যাড়া লাগছে বড্ড। আর শোন, সাধুবাবার কাছে কী মন্ত্র শিখেছিলি, ফুকে দিতে ভুলিসনে যেন।”

ফান্টু খুলিটা কাকতাড়ুয়ার ঘাড়ে আটকে দিয়ে মন্ত্রটা পড়ল, “ঔং হ্রীং ক্লীং ফট ফটু মারয় মারয় তাড়য় তাড়ায় স্বাহা!”

তারপর মামার কাছে ফিরে বলল, “ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না মামা। যদি–”।

দণ্ডীমশাই চোখ কটমট করে বললেন, “কী যদি? যদি-টদি কিছু নয়। তাঁদড়ামি করলেই গুলি খাবে।”

রমজান বলল, “বাবুমশাই, মনে হচ্ছে, এ-ব্যাটা একটু বেশি তাঁদড়ামিই করবে।”

“কেন, কেন?”

“যার খুলি, সে শুক্কু এসে যোগ দেবে। ছিল এক, হবে দুই।”

দণ্ডীমশাই বাঁকা হেসে বললেন, “আমার বন্দুকও দোনলা। একসঙ্গে দুটো ঘোড়াই টিপে দেব।”

মুকুন্দ কিছু না বুঝেই বলল, “খুব জমে যাবে মনে হচ্ছে। খুলিতে গুলিতে জমজমাট।”

দণ্ডীমশাই ভেংচি কেটে বললেন, “যাই হোক, তোমাকে তো আর ডেকেও পাওয়া যাবে না।”

মুকুন্দ জিভ কেটে বলল, “কী যে বলেন স্যার! কিছু বাধলে ডেকেই দেখবেন, কী করি!”

কী করে, যথারীতি দেখা গেল সে-রাতে। গাঁজা খাক নাই খাক, দুই বন্ধুর ঘুমটাও বড্ড বেশি। ফান্টু চুপি চুপি ডাকতে গিয়ে ফিরে এল। পূর্ণিমা তিথি। জ্যোৎস্না ফেটে পড়ছে কাটরার মাঠে। কাকতাড়ুয়াটি, রমজানের হিসেব অনুসারে, দুনো জ্যান্ত হয়েছে। খোঁনাসুরে কী গাইছে, কথাগুলো বোঝা যায় না, হাওয়ার তোলপাড় খুব। বন্দুকের নল জানালার বাইরে, ট্রিগারে আঙুল, হ্যাঁমার দুটোই ওঠানো, দণ্ডীমশাই তৈরি। শুধু একটু কৌতূহল জেগেছে, শেষ পর্যন্ত কী করে কাকতাড়ুয়া হতচ্ছাড়া, তাই দেখবেন।

তেমন কিচ্ছুটি করছিল না। শুধু গুনগুনিয়ে সুর ভাজা আর দু’ধারে চিতানো লম্বা হাতদুটো সমেত একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘোরা, ট্যাঙস ট্যাঙস করে এ কোনা থেকে ও কোনো পায়চারি। গত রাতে গুলি খেয়েই যেন রেগে আছে, এমন বেপরোয়া ভঙ্গি। শেষে ঘরটার দিকে মুখ করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। অমনি খাপ্পা দণ্ডীমশাই একসঙ্গে দুটো ট্রিগারই টেনে দিলেন।

ফলে উলটো ধাক্কাটা যথেষ্ট দিল বন্দুকের কুঁদোটা এবং পড়ে গেলেন দণ্ডীমশাই। পড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আলো! আলো!”

হুঁ, এ রাতেও বিদ্যুৎ অদ্ভুতভাবে বন্ধ! সাড়ে-বারোটা বাজে। টর্চের আলো ফেলে কাকতাড়ুয়াটিকে বেগুনখেতের ভেতর কাত অবস্থায় দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মামা-ভাগনে সাহস করে বেরোতে পারলেন না। আগের দুটো রাতের মতোই। তারপর বিদ্যুৎ এল আধঘন্টা পরে-এও আগের দু’রাতের মতোই।

ভোরে কাকতাড়ুয়া পাঞ্জাবিতে একটু রক্তের ছোপ, তারপর বেগুনগাছের পাতায় খুঁজতে খুঁজতে আরও পাওয়া গেল। শেষ দিকটায় ঝোঁপঝাড় ও কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত রক্তের দাগ রেখে গেছে কেউ। বেড়ার সঙ্গে বুনো লতার ঝালর থাকায় আগে ধরা পড়েনি। এদিন ঝালর সরাতেই বেরিয়ে পড়ল কাঁটাতারের খানিকটা অংশ কাটা। একটা বড় ফোকর। গুলিখোরটি যেই হোক, ভূত কি মানুষ, ওই পথেই পালিয়েছে।

ফান্টু চাঁচাতে থাকল “মামা, মামা, মামা!”

.

দুই

“এই আপনার তেরো নম্বর কেস?”

“হঃ আনলাকি থারটিন।” গোয়েন্দা কৃতান্তকুমার হালদার ওরফে কে কে হালদার ওরফে আমাদের হালদারমশাই নাকে নস্যি গুঁজে নাকি-স্বরে বললেন। মুখে তেতো ভাব, অনিশ্চয়তার।

কিছুদিন থেকে আমার ফ্রেন্ড-ফিলজফার গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার ছাদের বাগানে নিপাত্তা হয়ে আছেন। এদিকে পৃথিবীতে কত রহস্যময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! কাগজে ছাপা হচ্ছে তার খবর। কালীগঞ্জের তুলারাম দণ্ডীর বেগুনখেতে ভূতুড়ে কাকতাড়ুয়ার খবর আমাদের দৈনিক সত্যসেবক’ পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতার পাঠানো। তবে বিশদ কিছু ছিল না। কাটরার মাঠে জনৈক তুলারাম দণ্ডীর বেগুনখেতের কাকতাড়ুয়াটি নাকি রাতবিরেতে জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়, এটুকুই ছাপা হয়েছিল। কর্নেলের আশা ছেড়ে অগত্যা গিয়েছিলুম হালদারমশাইয়ের আপিসে। গণেশ অ্যাভিনিউতে একটা চারতলা বাড়ির চিলেকোঠায় তাঁর ‘হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি’। প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড বোর্ড রাস্তা থেকে দেখা যায়।

ঘরে ঢুকে দেখি, সামনে নোটবই আর নস্যির খোলা কৌটো, আঙুলের টিপে নস্যি, গোঁফ বেয়ে সেই নস্যি ঝরছে, অর্থাৎ সিরিয়াস কেস হাতে পেয়েছেন! মুখও গুরুগম্ভীর। নোটবইয়ের পাতায় কোনও কোনও শব্দ লাল রঙের খোপে ঢোকাচ্ছেন। উলটো দিক থেকে তিনটে শব্দ বন্দী দেখতে পেলুম, ‘তুলা’, ‘দণ্ড’, ‘মুণ্ড’।

সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলুম, “তুলারাম দণ্ডীর ব্যাপারটা নয় তো?”

এবার মুখ তুলে ফিক করে হাসলেন হালদারমশাই। “হঃ!” বলে বিচিত্তির রুমালে, ন্যাতা বলাই উচিত, নাক ও গোঁফ মুছলেন। রীতিমত আপিস যখন, তখন একজন বেয়ারাও বহাল আছে। তার নাম রামধারী। হালদারমশাই পুলিশে চাকরি করতেন। রামধারীও করত। পেল্লায় চেহারা। কেটলি নিয়ে চা আনতে বেরোল কর্তার ইশারায়।

তারপর হালদারমশাই সবিস্তারে রহস্যের জালটি আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন, নিজের ভাষায় যেটি আগেই মোটামুটি বর্ণনা করেছি। দিয়ে বললেন, “মিনিট দশেক আগে দণ্ডীমশাই গেলেন। রাত জেগে ট্রেনে এসেছিলেন। সাড়ে ন’টার বাস ধরে ফিরে যাবেন। কারবারি মানুষ। কিন্তু

“কিন্তুটা কী?”

“ওই যে কইছিলাম, আনলাকি থারটিন।” একটু গুম হয়ে থাকার পর ফের বললেন, “আপনে কী কন?” হালদারমশাই সমস্যাগ্রস্ত, সেটা বোঝাতে মাঝে মাঝে পূর্ববঙ্গীয় মাতৃভাষায় কথা বলে ফেলেন।

“কেস তো নিয়েছেন।”

“নিয়েছি। কথাও দিয়েছি।”

“তা হলে আর কথা কী? চলুন, আমিও সঙ্গ দেব।”

হালদারমশাইকে একটু উত্তেজিত দেখাল। চাপা স্বরে এবং ভুরু নাচিয়ে বললেন “কর্নেল স্যার কী বলেন শুনে আসি চলুন! কেসটা শুনে যদি কোনও কু দেন, মন্দ হবে না। ওল্ড ম্যানরা এমনিতেই ওয়াইজ, তার ওপর কর্নেল স্যারের মতো ওয়াইজ ম্যান কে কোথায় দেখেছে?”

“কর্নেল তার শূন্যোদ্যানে ঢুকে গেছেন। গাছ হয়ে গেছেন। নড়াচড়া চোখে পড়বে। তবে বোবা।”

হালদারমশাই খিখি করে হাসতে লাগলেন।”না, না, এই কেসে রক্ত টক্ত আছে, বুঝলেন না? স্রেফ ভূতুড়ে ব্যাপার হলে কথা ছিল! কর্নেল স্যার হলেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। রক্তের গন্ধ পেলেই ঝাঁপিয়ে আসবেন।”

চা খাওয়ার পর হালদারমশাইয়ের টানাটানিতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের ডেরায় আবার গেলাম। শূন্যোদ্যান থেকে নেমে ব্রেকফাস্ট করে সবে চুরুট ধরিয়েছেন। আমাদের দেখে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, “বসার আগে দুজনেই একবার ছাদে গিয়ে দেখে আসুন ষষ্ঠী কী করছে। না, না ডার্লিং, হালদারমশাইয়ের সঙ্গে তুমিও যাও। দেখে এসো। এতদিন যে কেন আইডিয়াটা আমার মাথায় আসেনি, আশ্চর্য!”

হালদারমশাই ততক্ষণে ছাদে পৌঁছে গেছেন। আমি সোফায় বসে পড়লাম। ষষ্ঠী কী করছে দেখার মুড নেই। কর্নেল তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আপনমনে বললেন, “এতদিন ধরে অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করছি। অথচ মাথায় এই সামান্য ব্যাপারটা আসেনি। এবার ব্যাটাচ্ছেলেরা দেখবে কি, তল্লাট ছেড়ে পালাবে!” বলে স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাস্য করতে থাকলেন।

অট্টহাসি থামলে বললুম, “কাক?”

“ঠিক ধরেছ, ডার্লিং!”

“ষষ্ঠী কাকতাড়ুয়া তৈরি করছে বুঝি?”

“হুঁউ। তুমি বুদ্ধিমান।”

“কাগজে কালীগঞ্জের কাকতাড়ুয়ার খবর পড়েছেন বুঝি?”

কর্নেল নড়ে বসলেন। “আমাকে সত্যিই বাহাত্তুরে ধরেছে, জয়ন্ত। কাকতাড়ুয়া জিনিসটা যে এত কাজের, কতবার কত জায়গায় দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসেনি। আসলে কলকাতা বহু জরুরি জিনিস ভুলিয়ে দেয়। হরিয়ানায় আমার এক বন্ধু কর্নেল কেশরী সিংয়ের ফার্মে একটিমাত্র কাকতাড়ুয়া বহু একর জমির গম রক্ষা করেছিল-না, কাকের মুখ থেকে নয়, হরিণের মুখ থেকে। জিনিসটাকে আমরা বাংলায় কাকতাড়ুয়া বলি বটে, কিন্তু ওটা সমস্ত প্রাণীকে ভয় পাইয়ে দেয়। মানুষকে, ডার্লিং, মানুষকেও। বিশেষ করে রাতবিরেতে তো বটেই!”

হাসি চেপে বললুম, “ভয় পেয়ে গুলিও চালায় অনেক মানুষ!”

“স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক।” বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ সায় দিলেন। “জ্যোৎস্নারাতে বাতাস দিলে কাকতাড়ুয়াকে জ্যান্ত মনে হয়। কাজেই চমকে উঠে গুলি চালানো অসম্ভব কিছু নয়, হাতে ফায়ার আর্মস্ যদি থাকে।”

“তারপর যদি সকালে কাকতাড়ুয়ার গায়ে…”

কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, “রক্তের দাগ থাকলে তাতে কিছু প্রমাণ হয় না জয়ন্ত।”

জোর গলায় বললুম, “প্রমাণ হয় না? কী বলছেন আপনি!”

“রক্তের দাগ বলে যেটা ভাবা হচ্ছে, সেটা রক্তেরই দাগ কি না যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছ, ততক্ষণ কিছু প্রমাণ হয় না।”

“কালীগঞ্জের তুলারাম দণ্ডীর বেগুনখেতে কাকতাড়ুয়ার জামায় আর বেগুনগাছের পাতায় রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।”

কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে তারপর মিটিমিটি হাসলেন। “হালদারমশাই সম্প্রতি যে হারে কাগজে তাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, এই কেস তার হাতে আসা স্বাভাবিক। যাই হোক, তুমি আবার এসেছ এবং হালদারমশাই তোমার সঙ্গে। বোঝা যাচ্ছে, তুমি এতে খুব আগ্রহী।”

“নিশ্চয়। কাগজের রিপোর্টাররা আজকাল অন্ততদন্ত লেখে। আমিই বা সুযোগ ছাড়ি কেন?”

কর্নেল হঠাৎ কেন যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। জ্বলন্ত চুরুট কামড়ে ধরে চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন, “হালদারমশাই সম্ভবত কাকতাড়ুয়াটির গঠনকৌশল লক্ষ করছেন মন দিয়ে। উনি গ্রামাঞ্চলে পুলিশের দারোগা ছিলেন। ষষ্ঠী বর্ধমানের গ্রামের লোক। সে কাকতাড়ুয়া বোঝে। আসলে হালদারমশাইয়ের বরাবর দেখে আসছি বুদ্ধিসুদ্ধি উৎসাহ, সাহস, অভিজ্ঞতা সবকিছুই প্রচুর আছে। শুধু একটু অনুসন্ধিৎসা আর একটু পর্যবেক্ষণ এই দুটো জিনিসের ঘাটতি আছে।” চোখ খুলে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন হঠাৎ, “আমি বলি কি, তুমি কালীগঞ্জে যেও না।”

“কেন বলুন তো?”

“তুমি যে ছদ্মবেশ ধরতে একেবারে আনাড়ি।” গম্ভীর মুখেই কর্নেল বললেন। “আশা করি, লোহাগড়ার ঘটনাটা ভুলে যাওনি। তোমার গোঁফ খুলে পড়ে গিয়ে কী কেলেঙ্কারি ঘটেছিল!”

ঝটপট বললুম, “কালীগঞ্জে ছদ্মবেশ ধরার দরকারটা কী!”

“দরকার হবে, যদি হালদারমশাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে চাও।” বলে কর্নেল হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের ওপর একটা সুইচ গোছের কিছু টিপে দিলেন।

অমনি খড়খড়-খসখস বিবিধপ্রকার শব্দ শোনা গেল। তারপর কাকের চাঁচামেচি। সেইসঙ্গে এইসব কথাবার্তা: “হ্যাঁ হ্যাঁ…ব্যস…হয়েছে….খাসা! এবার মন্তরটা পড়ে দিই মাথায়। ওং হ্রীং ক্লীং ফটু ফটু মারয় মারয় তাড়ায় তাড়ায় স্বাহা!”

হালদারমশাইয়ের গলা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে কনেল বললেন, “ছাদের বাগানে কী ঘটছে, ঘরে বসে খোঁজখবর নেবার জন্য এই যান্ত্রিক ব্যবস্থা করেছি, জয়ন্ত! মন্ত্রতন্ত্র পাঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, হালদারমশাই ছদ্মবেশ ধরেই কালীগঞ্জে যাবেন–অবশ্যই সাধুবাবা সেজে। যাবার সময় চিৎপুর হয়েই যাবেন, ওখানে যাত্রা থিয়েটারের ড্রেস-সাপ্লায়ার প্রচুর। কাজেই ভেবে দ্যাখো, কী করবে!”

ষষ্ঠীচরণ ভক্তিমাখা মুখে ছাদ থেকে নেমে এসে ঘোষণা করল, “বাবামশাই কাজ পাক্কা।”

কর্নেল শুধু বললেন, “কফি।” ষষ্ঠী গুম হয়ে চলে গেল ভেতরে। একটা প্রশংসা আশা করেছিল বেচারা!

হালদারমশাই যথারীতি ষষ্ঠীকে মনে করিয়ে দিলেন “দুধটা একটু বেশি করে, ভাইটি!” তারপর এসে সোফায় বসলেন। হ্যান্ডব্যাগ থেকে নোটটা বের করে একটু হেসে বললেন, “কর্নেল স্যারকে, বুঝলেন জয়ন্তবাবু এই জন্যেই অন্তর্যামী বলি। ওপরে গিয়ে তো চক্ষু ছানাবড়া। বড়ই আশ্চর্য। ভাবা যায় না!”

কর্নেল বললেন, “হালদারমশাই কি সন্নেসি সেজে কালীগঞ্জে যাচ্ছেন?”

“অ্যাঁ!” হালদারমশাই অবাক হয়ে আমার দিকে ঘুরে ফিক করে হেসে বললেন, “হঃ বুঝছি। জয়ন্তবাবু সব কইয়া দিছেন স্যাররে।”

বললুম, “পুরোটা বলিনি। আপনি বলুন। দেখুন কী কু পান!”

হালদারমশাই সোফার কোনায় পিছলে গেলেন, কর্নেলের ইজিচেয়ারের পাশে। তারপর চাপা স্বরে মন্ত্রপাঠের মতো নোট-বই থেকে রহস্যজনক ঘটনাটির বিবরণ দিতে থাকলেন। ইতিমধ্যে ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে হালদারমশাই দ্বিগুণ উদ্যমে বাকি বৃত্তান্ত শেষ করে বললেন, “আমি যে প্ল্যান ছকেছি, আগে বলে দিই কর্নেল স্যার।”

কর্নেল বললেন, “সাধুবাবা সেজে গঙ্গার ধারে মন্দিরতলায় ধুনি জ্বেলে বসবেন তো?”

জবাবে হালদারমশাই ‘খিখি-খিখি’ করলেন। অর্থাৎ সেটাই ইচ্ছে।

“জয়ন্তবাবুকে তা হলে চেলা সাজতে হবে।”

আপত্তি করে বললুম, “মোটেও না। আমি ফার্মে কৃষি-সংবাদদাতা হয়ে থাকব। দৈনিক ‘সত্যসেবকে’ কৃষির একটি পাতা বেরোয় ফি সপ্তায়।”

“সাধু সাজার সুবিধে এ-ক্ষেত্রে আছে।” কর্নেল বললেন। “সাধুসগ্নেসিরা গাঁজা খেয়ে ধ্যানে বসেন। তাই এলাকার গাঁজাখোরদের চেলা হিসেবে পাওয়ার আশা আছে। বিশেষ করে রমজান আর মুকুন্দকে সবার আগে পাওয়ার কথা। হালদারমশাই তাদের মুখ থেকে কিছু তথ্য পেতেও পারেন।”

হালদারমশাই ব্যস্তভাবে নোট করে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ এটা একটা বড় পয়েন্ট।”

“আবার নাও পেতে পারেন!”

“সে কী!” বলে হালদারমশাই নোটবইতে একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন দেগে দিলেন।

“যদি তারাও চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত থাকে—”

“কীসের চক্রান্ত, কর্নেলস্যার?” হালদারমশাই করুণ মুখে প্রশ্নটা করলেন।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “ভূত হোক বা মানুষ তোক, কেউ বা কারা চায় না তুলারাম দণ্ডী ফার্মে রাত্রিবাস করেন–শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছে আপাতত। জয়ন্ত, যাচ্ছ, যাও। কিন্তু সাবধান!”

জেদ ধরে বললুম, “যাচ্ছি।”

“কাকতাড়ুয়াটি বিপজ্জনক, ডার্লিং! তবে আরও বিপজ্জনক জিনিস তুলাদণ্ড।”

হালদারমশাই নোটবইতে ‘তুলাদণ্ড লালকালিতে বন্দী করে আমার পক্ষ হয়ে বললেন, “বুঝাইয়া কন!”

কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন, “তুলারাম দণ্ডীর সঙ্গে তুলাদণ্ডের যোগ আছে। কারণ খোলভুসি ওজন করে বেচতে হয়। দণ্ডী পদবির কী ব্যাখ্যা উনি দেন জানি না। তবে দণ্ডী বলতে প্রাচীন যুগে রাজবাড়ির দারোয়ান বোঝাত। কালীগঞ্জে গুপ্তযুগের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে শুনেছি।”

হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, “গুপ্তধন! গুপ্তধন!”

“সমস্যা হল,”– কর্নেল বলতে থাকলেন, “বরাবর দেখে আসছি, ‘‘ এই যুক্তবর্ণটি সর্বত্র গণ্ডগোলের প্রতীক। হুঁ, গণ্ডগোলেও ‘শু’ লক্ষ করুন। তারপর দেখুন, দণ্ড, মুণ্ড, ভাণ্ড, পিণ্ড, চণ্ড, ষণ্ড, লণ্ডভণ্ড…..। যাই হোক, এবার কাকতাড়ুয়া কথা ভাবুন। দণ্ডের ওপর মুণ্ডু দেখতে পাচ্ছেন। দণ্ডমুণ্ড সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! তা ছাড়া দণ্ডমশাইয়ের বেগুন খেতে মুণ্ডটি আস্ত মড়ার খুলি!”

গোয়েন্দামশাই খসখস করে নোট করছিলেন। বললেন, “একটা কথা জিগানো বাকি, কর্নেল স্যার। কাটরার মাঠ। কাটরাটা কী কন তো?”

বিরক্ত হয়ে বললুম, “সেখানে গিয়েই জানা যাবে!”

হালদারমশাই আমাকে পাত্তা দিলেন না। বললেন, “দণ্ডীবাবু বলছিলেন, সেখানে নাকি মোগল-পাঠানে খুব কাটাকাটি হয়েছিও। তাই কাটরা। আপনি কী কন?”

কর্নেল ফের একটা অট্টহাসি হাসলেন। “হয়েছিল। তবে কাটরা কথাটা আসলে কাঠরা। মানে, রবিশস্য। কোথাও-কোথাও কাঠখন্দও বলা হয় রবিশস্যকে।” বলে আমার দিকে তাকালেন। “কাঠরা বলতে কাঠগড়াও বোঝায়, জয়ন্ত। না, না, কাঠগড়ার ভয় তোমার কীসের? শুধু একটা ব্যাপার সাবধান করে দিই। কাটরার শ্মশানে নাকি পিশাচ আছে।”

শুনে একটু ভড়কে গেলুম নিশ্চয়। পিশাচ’ শব্দটা লিখে হালদারমশাই নোটবই বুজিয়ে তাড়া দিলেন। “উঠে পড়া যাক, জয়ন্তবাবু। বারোটা পাঁচে ট্রেন।” বলে সহাস্যে কর্নেলকে ধন্যবাদ দিলেন। “অনেক কু দিয়েছেন। থ্যাংকস, থাউজ্যান্ড থ্যাংকস কর্নেল স্যার!”

.

তিন

গুরুজনের চোখে ছেলেপুলের বয়স বাড়ে না। ফলে দণ্ডীবাবুর বর্ণনা অনুসারে তৈরি হালদারমশাইয়ের নোটবুকের বৃত্তান্ত থেকে ফান্টুর যে মূর্তি বানিয়েছিলুম, মিলল না। বরং ওকে দেখলেই কেন যে হাসি পায়! বেঢপ গড়ন বলেই হয়তো কার্টুনচিত্র মনে হয়। গোলগাল, বেঁটে, মুখটি প্রকাণ্ড–তবে এক্ষেত্রে ‘গু’ বর্ণ বিপজ্জনক কদাচ নয়। বড় বড় দাঁত, খোলা হাসি সবসময় মুখে টাঙানো। নিরীহ গোবেচারা বলাই উচিত। পরনে কালো রঙের শর্টস আর নীলচে স্পোটস্ গেঞ্জি। পায়ে গামবুট। ধুলো কাদায় নোংরা। মাথায় আঁটোসাঁটো টুপি দিনশেষেও আঁটা দেখে দণ্ডীবাবু ধমক দিলেন, “রোদ্দুর আছে? আবার আমাকে বলা হয় ভুলো মন! যা, ওই নোংরা মেঠো পেন্টুল-ফেন্টুল খুলে আয়।”

ফান্টু আমাকে বোঝাচ্ছিল, কী কৃৎকৌশলে উদ্ভিদের কাছে অনেক বেশি আদায় করা যায় এবং সে সত্যিই কৃষিবিজ্ঞানীর কান কাটতে পারে। মামার কথায় জিভ কেটে বিব্রতভাবে পাম্প ঘরের সামনে চৌবাচ্চাটির দিকে গেল। পনেরো একর ফার্মের চারদিকে ঝোঁপঝাড়, কিছু গাছের জটলা। পুবে পোড়ো শিবমন্দির আর বট, দ্রুত আবছা হয়ে আসছে। হু হু করে বাতাস দিচ্ছে। বেগুনখেতের এক কোণে, খানিকটা দূরে কাকতাড়ুয়াটি কালো হয়ে দাঁড়িয়ে দুলছে আর দুলছে। গা ছমছম করছিল। ফার্ম-ঘরের খোলামেলা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে দণ্ডীবাবু তেরাত্তিরের রহস্যময় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। নতুন কোনও কথা শুনলুম না। হালদারমশাই গঙ্গার ওপারে কালীগঞ্জে দণ্ডীবাবুর বাড়িতে আছেন। নিশুতি রাত্তিরে তার অভিযান শুরু হবে। প্ল্যানমাফিক আমি কলকাতার কাগজের কৃষি বিষয়ক রিপোর্টার। রমজান আর মুকুন্দ কলকাতার কাগজে তাদের ছবি ছাপা হবে শুনে আমাকে খাতিরের চূড়ান্ত করছিল। শেষে মুকুন্দ গঙ্গা পেরিয়ে আমার সরেস রকম সকারের জন্য মাছ-মাংস-রসগোল্লা-দই আনতে গেল বাজার থেকে। রমজান চায়ের সঙ্গে দাগড়া-দাগড়া বেগুনী আর ‘পটাটো-চিপস’ আনাল। গর্বে হেসে বলল, “সবই আমাদের এই মাটির উৎপন্ন স্যার। এই বেগুন বলুন, বেগুন। আলু বলুন, আলু!”

দণ্ডীবাবু কৌতুকে বললেন, “ব না চায়ের পাতাও ফলিয়েছিস! কাগজে তাও ছাপা হবে!”

কর্তাবাবুর কথায় রমজান দমল না। বলল, “সেও আমাদের ভাগনেবাবুর পক্ষে অসাধ্য কিছু নয়, বাবুমশাই। দেখবেন, কবে চায়ের বাগান করে বসে আছে। লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি–সবই ফলাতে পেরেছে, চা এমন কী জিনিস?”

দণ্ডীবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “আলো জ্বেলে দে! খালি বড় বড় কথা আর রাতটি এলেই ঘুমিয়ে পড়া!”

রমজান সুইচ টিপে দরজার ওপরে কার্নিশের নিচের বালটি জ্বেলে দিল। আমার উদ্দেশে বলল, “কিছু দরকার হলেই ডাকবেন, স্যার! আমি ধাঁ করে একচক্কর মাঠে ঘুরে আসি। গম পেকেছে। সন্ধ্যার দিকেই গম-চোরদের উৎপাত হয়।” সে চলে গেলে দণ্ডীবাবু বললেন, “আমার এই লোক দুটো রমজান আর মুকুন্দ, খুব বিশ্বাসী। অনেস্ট। শুধু একটাই দোষ। রাত দশটার পর গাঁজার নেশায় মড়া হয়ে পড়ে থাকে।”

ফান্টু চায়ের গেলাস হাতে এল। টুপিটা নেই এই যা! পরনে সেইরকম পোশাক–শর্টস আর গেঞ্জি। মুখে কার্টুন-হাসি টাঙানো। একটা চেয়ার টেনে একটু তফাতে বসে বলল, “চান করার সময়। একটা কথা মাথায় এল মামা। বলি কাগজের দাদাকে?”

দণ্ডীবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন ভাগনের দিকে।

ফান্টু বলল, “গতরাত্তিরে কাকতাড়ুয়া দুষ্টুমি করেনি। মামা ছিলেন না, তাই। আজ রাত্তিরে মামা । আছেন। দেখবেন, ঠিক গণ্ডগোল বাধাবে। যত রাগ যেন মামার ওপর!”

দণ্ডীবাবু ঊরুতে ঠেস দিয়ে রাখা দোনলা বন্দুকটি তুলে নিয়ে বললেন, “খুলি উড়িয়ে দেব। আমার ওপর রাগ! আমি কোন্ ব্যাটাচ্ছেলের পাকা ধানে মই দিয়েছি? বুঝলেন জয়ন্তবাবু! এ স্রেফ কারুর জেলাসি। কেউ বা কারা চায় না আমার ফার্মে তিন কিলো বেগুন ফলুক। একজিবিশানে মেডেল পাক্।”

ফান্টু বলল, “না মামা, তোমাকে বারবার বলেছি, তুমি কানেই নিচ্ছ না–”

তাকে থামিয়ে দিয়ে দণ্ডীবাবু বললেন, “থাম তো! খালি এক কথা।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু কথাটা কী?”

দণ্ডীবাবু ফাঁচ করে বড়ই বেমানান হাসিটি হাসলেন। আসলে তার রুক্ষ কেঠো চেহারার জন্য সবসময় মুখে তিতকুটে জিনিস গেলার ভাব। হাসলে মনে হয়, খ্যাক করে কামড়ে দিলেন। বললেন, “ভূত! যে সে ভূত নয়, গঙ্গার মড়াখেকো পিশাচ! ছেলেটা কাটরার মাঠে থাকতে থাকতে কী একটা হয়ে গেছে যেন। সব সময় উদ্ভুট্টে কথাবার্তা! বলে কী জানেন! গাছপালা, পাখপাখালি, পোকামাকড় সবকিছুর কথা বুঝতে পারে।”

“পারি তো!” ফান্টু বলল, “সাধুবাবা আমাকে বলে গেছেন, যার প্রাণ আছে সেই কথা বলে। চেষ্টা করলেই বোঝা যায়, কী বলছে।”

বললুম, “কিন্তু তুমি ভূত-প্রেত-পিশাচ এসব বিশ্বাস করো কি?”

ফান্টু বলল, “করি। দেখেছি যে!”

“কী দেখেছ, বলো।”

দণ্ডীবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, “খুব হয়েছে আর নয়। সাধুবাবা না, এই রমজান আর মুকুন্দ ওর মাথাটি খেয়েছে। জয়ন্তবাবু, দোহাই আপনাকে। ফিরে গিয়ে যেন এইসব উদ্ভুট্টে কথাবার্তা কাগজে ছাপবেন না! একে তো আপনাদের কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতা গঞ্জুবাবু জ্যান্ত কাকতাড়ুয়ার ভৌতিক খবর ছাপিয়ে হুলস্থুল বাধিয়েছেন। আড়তে অসংখ্য জায়গার নোক এসে আমাকে জেরায়-জেরায় জেরবার করে দিচ্ছে। এবার আপনিও যদি ভূত-প্রেত-পিশাচের খবর ছাপেন, তিষ্টানো যাবে না। আমাকে আড়তের কারবার ছেড়ে, এই ফার্ম ছেড়ে হিমালয়ে পালাতে হবে।”

ফান্টু বড় আকারে নিঃশব্দে হেসে বলল, “হিমালয়ে গেলে সাধুবাবার দেখা পেয়ে যাবে, মামা।”

“যাচ্ছি!” দণ্ডীবাবু ভেংচিকাটা মুখ করে বললেন, “বলিস তোর পিশাচব্যাটাচ্ছেলেকে, দণ্ডীবাবু লড়ে যাচ্ছে, লড়বে। কাকতাড়ুয়া নই, দু’ঠেঙে মানুষ। হাতে বন্দুক। খুলি উড়িয়ে দেব।”

এ-সব কথার নিশ্চয় একটা মানে আছে, আমার বুঝে নেওয়ার দরকার। তাই বললুম, “দণ্ডীমশাই, পিশাচটি আপনার মতে মানুষ?”

আমার কথা শেষ করার আগেই দণ্ডীবাবু বললেন, “আলবাত মানুষ। নইলে রক্তের ছাপ কেন? বেগুনখেতের পেছনকার কাঁটাতারের বেড়ায় খোদল ছিল কেন? বুঝলেন না! প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড বেগুনগাছ। ঝকড়া ইয়াব্বড় পাতা। ব্যাটাচ্ছেলে করে কি, বেড়ার খোদল দিয়ে গুঁড়ি মেরে বেগুনখেতে ঢোকে। ঢুকে কাকতাড়ুয়ার নিচেটা ওপড়ায়। গুঁড়ি মেরে সেটাকে নাচাতে নাচাতে খেতময় ঘোরে আর ভূতুড়ে সুর ভাঁজে, ওই দেখেই ভয় পেয়ে আমি ফার্মহাউসে রাত্রিবাস ছেড়ে দেব। দিচ্ছি! যাও-বা কোনও-কোনও রাতে বাড়িতে থাকতুম, আর থাকছি না। দেখি তোমার দৌড়!”

বললুম, “ব্যাপারটা পরিষ্কার হল এতক্ষণে। কিন্তু কে সে?”

দণ্ডীবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, “সেটাই তো বোঝা গেল না!” তারপর চাপা স্বরে ফের বললেন, “সেজন্যই ডিটেকটিভ এজেন্সিতে যাওয়া। বুঝলেন না?”

“হুঁ, এ তো স্পষ্ট, কেউ বা কারা আপনার ফার্মহাউসে রাত্তিরে থাকা পছন্দ করছে না।”

“করছে না?”

“কিন্তু কেন?” দণ্ডীবাবু এবার আমার ওপর চটলেন। “আহা, সেজন্যই তো ডিটেকটিভ ভাড়া করা। আপনাদের কাগজের লোকেরা খালি প্রশ্ন করতেই জানেন। তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেন না।” বলে ফের আগের মতোই বেমানান একটি ফাঁচ করলেন, অর্থাৎ হাসলেন। “সরি, আপনি আমার গেস্ট। কিছু মনে করবেন না। ব্যাপারটা যত ভাবছি, তত প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। আমি মশাই টি, আর দণ্ডী, এ তল্লাটের বাঘ বলে আমাকে। আর আমাকে ওই বিটকেল কাকতাড়ুয়ার নাচ দেখিয়ে ভড়কাননার চেষ্টা! বড্ড অপমানজনক ব্যাপার নয়? বলুন আপনি!”

সায় দিয়ে বললুম, “সত্যি অপমানজনক। তবে আপনি বলছিলেন, জেলাসি!”

দুঃখিত মুখে অর্থাৎ আরও তেতো গেলার ভলিতে দণ্ডীবাবু বললেন, “আপাতদৃষ্টে জেলাসিই মনে হচ্ছে। এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। দেখি, ডিটেকটিভদ্রলোক কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করতে পারেন কি না!”

ফান্টু আমাদের দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ কথা শুনছিল। এতক্ষণে বলল, “রিপোর্টারদা ক’টা বাজছে দেখুন তো?”

ঘড়ি দেখে বললুম, “ছ’টা তেতাল্লিশ!”

“আর সতেরো মিনিট পরে প্রিন্স অ্যালবার্ট ফুটতে শুরু করবে। যাই, কাছে গিয়ে বসে থাকি।”

ফান্টু উঠে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করলুম, “কী ফুল ফান্টু!”

ফান্টু বলল, “গোলাপ। দেখবেন তো আসুন না।”

দণ্ডীমশাই বললে, “দিনে দেখবেন জয়ন্তবাবু। ফান্টু বসে থাকতে হয় তো তুই থাকবি। খালি বাতিক।”

ফান্টু বলল, “রিপোর্টারদা, সকালে কিন্তু ফোটো তুলতে হবে। পুরো ফুটতে ভোর হয়ে যাবে। দেখবেন কত্ত বড় গোলাপ।”

সে চলে গেলে কর্নেলের কথা মনে পড়ল। হায় বৃদ্ধা প্রকৃতিবিদ! না এসে কী হারালেন, জানেন না। এই ফান্টুচন্দ্রের মধ্যে যেন কর্নেলের আদল। ছাদের বাগানে কোনও অর্কিডের ফুল ফোঁটার পথ চেয়ে উনি এমনি করে পাশে বসে রাত কাটান!

একটু পরে পূর্ব দিকে গঙ্গার ওপারে বিশাল লালরঙের জিনিসটি যে চাঁদ, বুঝতে সময় লাগল। রঙ বদলে চাঁদটা ছোট হলে মুকুন্দ গান গাইতে গাইতে দু’হাতে ব্যাগ নিয়ে ফিরল। রমজান তার সঙ্গে। দণ্ডীবাবু বললেন, “নন্দী-ভৃঙ্গী! বুঝলেন জয়ন্তবাবু? একজন গেল বাজারে একজন জমি দেখতে। ফিরবে জোড় বেঁধে। যত্ত সব!”

ওঁর চটে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলুম না। মুকুন্দ মুচকি হেসে বলল, “স্যার, শিবমন্দিরে আবার এক সাধু এসে ধুনি জ্বেলেছেন দেখে এলুম। মাথায় পেল্লায় জটা।”

দণ্ডীবাবু বললেন, “তাহলে তো এ-রাতে শিবমন্দিরে তোদের মড়া গড়াবে।”

দু’জনেই জিভ কাটল। মুকুন্দ বলল, “বাবা ধ্যানে বসছেন। দেখে মনে হল ধ্যান ভাঙতে ভোর হয়ে যাবে। তাছাড়া স্যার, ঘরে গেস্ট। রাঁধাবাড়া ফেলে সাধুসঙ্গ করা কি উচিত?” সে হন্তদন্ত হয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।

রমজান পকেট থেকে একটুকরো ভাঁজ করা কাগজ বের করে চণ্ডীবাবুর হাতে দিল। বলল, “গেটের কাছে পড়ে ছিল। মুকুন্দ বলল, ফেলে দে। ফেলে দিলে চলে? যদি বেনামী চিঠি হয়! যা ভূতুড়ে কাণ্ড চলেছে রাতবিরেতে।”

দণ্ডীমশাই ব্যস্তভাবে পড়ে বললেন, “ধুস, পদ্য লিখেছে কেউ। ফান্টুও হতে পারে, কিচ্ছু বলা যায় না। নেচারের মধ্যে থাকলে মনে কত ভাব জাগে মানুষের!”

ওঁর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দেখি, লাল আঁকাবাঁকা হরফে লেখা আছে :

নিঝুম রাতে গাছগাছালির মাথার ওপর
উঠলে চাঁদ,
বেগুনখেতে পাততে যাব শেয়াল ধরার
ফিচেল ফাঁদ।

বললুম, “দণ্ডীবাবু পদ্যটা হয়তো নিছক পদ্য নয়। কেউ যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে! শেয়াল-ধরা ফঁদ পাততে আসবে বেগুনখেতে এবং ‘ফিচেল’ কথাটাও কেমন সন্দেহজনক!”

ঠিক এই সময় কোথায় বিকট শব্দে সত্যিই শেয়াল ডেকে উঠল। আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। দণ্ডীমশাই ভুরু কুঁচকে বললেন, “কাটারার মাঠে এখনও শেয়াল আছে তা হলে?”

রমজান বলল, “কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে দু’একটা আছে। কখনও-সখনও ডাকে শুনেছি।”

বারকতক হোয়া-হোয়া করে ডেকে শেয়ালটা চুপ করে গেল। কেমন একটা ভয়-জাগানো অনুভূতি আর গা ছমছম করা ভাব পেয়ে বসল আমাকে। আবছা জ্যোৎস্নায় নিঝুম পরিবেশের ভেতর ফান্টুর দেখা পিশাচটার সবে ঘুম ভাঙল বুঝি! একটা প্যাচা ক্রাও-ক্রাও করে ডাকতে ডাকতে শিবমন্দিরের দিকে চলে গেল।

মুকুন্দের ডাকে রমজান চলে গেল। দণ্ডীমশাই আস্তে বললেন, “চ্যালেঞ্জ না কী বলছিলেন যেন?”

“হ্যাঁ। পদ্যটা কেমন যেন রহস্যজনক!”

দণ্ডীমশাই কাগজটা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মন দিয়ে পড়লেন। তারপর বাঁকা মুখে বললেন, “খুলি উড়িয়ে দেব। ফিচলেমি করে দেখুক না! ঢের ফাঁদ আমার দেখা আছে।”

বলে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁধে বন্দুক, এক হাতে লম্বা টর্চ। বেগুনখেতের দিকে আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে গেলেন। সাহসী মানুষ, সন্দেহ নেই। চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতেই গেলেন নিশ্চয়!

একটু পরে কাকতাড়ুয়াটির ওপর তার টর্চের আলো পড়লে আঁতকে উঠলুম। পাঞ্জাবি পরে কাকতাড়ুয়ার খুলি-মুণ্ডুটি দাঁত বের করে আঁধার চোখে তাকিয়ে যেন হিহি করে হাসছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিলুম সঙ্গে সঙ্গে।

ফান্টু এসে গেল। “রিপোর্টারদা, প্রিন্স অ্যালবার্ট মুখ খুলেছে। মামা কোথায়?

বললুম, “তোমার মামা বেগুনখেতে ঢুকেছেন।”

ফান্টু জোরালো হেসে বলল, “এই রে, কাঁটায় আটকে ফঁদে পড়ার অবস্থা হবে সেদিনকার মতো। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেগুনখেতে ঢুকলে কী হয়, এখনও শিক্ষা হয়নি মামার?”

“আচ্ছা” ফান্টু, তুমি পদ্য লেখো কি?”

ফান্টু কান পর্যন্ত হাসি টেনে একটু পরে বলল, “লিখতে ইচ্ছে করে রিপোর্টারদা। পারি না। বেগুনের সঙ্গে মিল দিতে গেলে সেগুন আনতে হয়। কিন্তু বেগুন আর সেগুনে কত তফাত, বলুন!”

“আহা, তুমি পদ্য লিখেছ কি না জানতে চাইছি।”

“নাঃ, পোষায় না। ততক্ষণ সয়েল টেস্ট করতে মাথা ঘামানো ভাল।” ফান্টু ঠিক কর্নেলের মতোই চুল থেকে একটা পোকা বের করে উড়িয়ে দিল। দিয়ে বলল, “তবে এই এরিয়ায় পদ্য লিখতে পারে একজনই। কাগজে ছাপাও হয়।”

“কে তিনি?”

“ভাণ্ডারী মাস্টারমশাই!” ফান্টু প্রশংসা করে বলল। “আমাদের স্কুলে বাংলা পড়াতেন। রিটায়ার করেছেন গতবছর। বিকেলে গঙ্গার ধারে একলা ঘুরে বেড়ান। মাথায় লম্বা চুল, চিবুকে তেমনি লম্বা একগোছা ছুঁচলো দাড়ি। ওঁকে দেখে আপনি হেসে সারা হবেন। কিন্তু গুণী মানুষ।”

এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে ফান্টু চাপা স্বরে ফের বলল, “মামা জানতে পারলে বকবেন। কিন্তু লুকিয়ে ফার্মের এটা-সেটা দিয়ে আসি। খুব গরিব হয়ে গেছেন ভাণ্ডারীমশাই! সেদিন একটা বেগুন পেয়ে দেখুন না, একখানা পদ্য দিয়েছেন। দারুণ পদ্য।”

ফান্টু ঘরে ঢুকে পদ্যটা নিয়ে এল। ভাণ্ডারী-তে ‘ণ্ড’ আছে। শুনেই অস্বস্তি লেগেছিল। এবার হাতের লেখা দেখে অস্বস্তিটা বেড়ে গেল এবং রহস্যটা জটিল হয়ে পড়ল।

একই ছাঁদের হরফ। তবে নীলচে কালিতে লেখা।

কেল্লাবাড়ির দারোয়ানের বংশ
তাই পদবী দণ্ডী
তারই এক মাসতুতো ভাই চণ্ডী
চোর-জোচ্চোর দেশটা করছে ধ্বংস
হস্তে তৌল দণ্ড
পাষণ্ড আর ভণ্ড
বেচছে ভেজাল ভুসি ও খোল সর্ষের
ষণ্ডদুটি আছে বড়ই হর্ষে
অ্যায়সা দিন নেহি রহেগা বাপ
বস্তার ভেতর রাস্তা ঢুঁড়ছে সাপ!

পদ্যটা পড়ে বললুম, “এর মানে কী বলো তো? ‘বস্তার ভেতর রাস্তা টুড়ছে সাপ। একথা কেন লিখেছেন ভাণ্ডারীমশাই?”

ফান্টু বলল, “পদ্যের আবার মানে থাকে নাকি? পদ্য পদ্য। কই, দিন। লুকিয়ে রেখে আসি। মামা দেখলেই হয়েছে!”

“এটা আমার কাছে থাক, ফান্টু।”

“রাখবেন, রাখুন। কিন্তু সাবধান রিপোর্টারদা, মামার চোখে যেন পা পড়ে!”

“না, না। তুমি ভেবো না।” বলে পদ্যটা ভাঁজ করে জ্যাকেটের ভেতর পকেটে চালান করে দিলুম। শিগগির হালদারমশাইকে দেখানো দরকার। মুকুন্দের কথায় টের পেয়েছি, শিবমন্দিরের সাধুটি কে!

এইসময় বেগুনখেতের দিক থেকে দণ্ডীবাবুর ডাক শোনা গেল, “ফান্টু, ফান্টু।”

ফান্টু বলল, “এই রে! যা ভেবেছিলুম। মামা আটকে গেছেন কাঁটায়!” সে ঘরে ঢুকে একটা কাটারি বের করে নিয়ে দৌড়ে গেল।

অবস্থাটা দেখার জন্য এগিয়ে গেলুম। বেগুনখেতের অনেকটা ভেতরে আবছা জ্যোৎস্নায় একটা কালো মূর্তির বুক থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। খুব নড়াচড়া করছেন দণ্ডীমশাই। ফান্টু বুক সমান উঁচু বেগুনগাছের জঙ্গলে দিব্যি ঢুকে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, টর্চ কী হল মামা?”

দণ্ডীবাবু চি চি করুণ স্বরে বললেন, “কাটা ছাড়াতে গিয়ে কোথায় পড়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছিনে!”

“বন্দুক পড়ে যায়নি তো?”

“না, না! খালি কথা বাড়ায়। অ্যাই যাঃ! গেল, নতুন জামাকাপড় পর্দাফাই হয়ে গেল। কী…কী সাঙ্ঘাতিক বেগুনগাছ রে বাবা! যেন জ্যান্ত! নড়লেই খিমচি”উঃ! ইঃ!”

আমার কাছে টর্চ আছে। কিন্তু দণ্ডীবাবুর দুর্দশা উপভোগ করার চেয়ে এই সুযোগে ঝটপট ভাণ্ডারীমশাইয়ের পদ্যটা শিবমন্দিরে সাধুবেশী গোয়েন্দার কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি মনে হল। ফার্মের মাঝ-বরাবর একচিলতে রাস্তা। দু’ধারে সুন্দর কেয়ারি-করা বেড়া-গাছ। গেট খুলে গঙ্গার ধারে ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে সাবধানে পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে দক্ষিণ পূর্ব কোণে শিব মন্দিরের দিকে চললুম। কানে ভেসে এল, ‘ঔং হ্রীং ক্লীং ফটু ফটু মারয় মারয় তাড়ায় তাড়ায় স্বাহা!’ তারপর ধুনির আলোও চোখে পড়ল।

তারপরেই আচমকা উলটে পড়ে গেলুম।

হোঁচট খেয়ে পড়িনি। কে বা কারা পেছনে ঝোঁপের আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপর। টু শব্দটি করার সুযোগ পেলুম না। আমার মুখে টেপ সেঁটে দিল। তারপর আমার হাতদুটো পিঠমোড়া করে বাঁধতে বাঁধতে কেউ ফিসফিসিয়ে বলল, “চুপচাপ না থাকলে শ্বাসনলি কেটে যাবে।” কাজেই চুপচাপ থাকতেই হল। শ্বাসনলি কাটা মড়া হয়ে এখানে পড়ে থাকার মানে হয় না।

.

চার

কিন্তু তারপর সত্যিই আমাকে মড়া হতে হল, শ্বাসনলি কাটা না হলেও। অর্থাৎ জ্যান্ত মড়া। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলুম, একটা খাঁটিয়া এল। চারটে ছায়ামূর্তি এসে খাঁটিয়ায় আমাকে তুলে চিতপাত শুইয়ে দিল। তারপর খাঁটিয়া কাঁধে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, “বলো হরি! হরি বো-ও-ল!”

মন্দির চত্বরে ধুনির আলোয় জটাজুটধারী হালদারমশাইকে স্পষ্ট দেখলুম, উঁচুতে থাকার দরুন। চোখ বুজে ধ্যানস্থ। মাত্র হাত-দশেক পাশ দিয়ে খাঁটিয়ায় শুয়ে শ্মশানযাত্রার পথে মনে-মনে ওঁর মুণ্ডুপাত করছিলুম তাকিয়ে তো দেখবেন কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! বিকট স্বরে হরিধ্বনি কানে যাচ্ছে, একবার অন্তত মুখ তুলে চোখ ভোলা উচিত ছিল না কি?

বটতলার পর ফাঁকা মাঠ। এখানে-ওখানে ঝোঁপঝাড়, কিছু গাছ। এতক্ষণে প্রচণ্ড ভয়ে সিটিয়ে গেলুম। রসিকতা বলে মনে হচ্ছে না। আর, মড়ার খাঁটিয়ায় তোলার সময় যদিও তাই ভেবেছিলুম। এরা নির্ঘাত আমাকে চিতায় শুইয়ে আগুন জ্বেলে দেবে, তাই যত হরিধ্বনি দিচ্ছে, তত চমকে-চমকে উঠছি। হৃৎপিণ্ড তুমুল লাফালাফি করছে।

অন্তত আধ-কিলোমিটার পরে খাঁটিয়া মাটিতে নামল। চাঁদটা গঙ্গার ওপর থেকে ফান্টুর মতো কার্টুনহাসি হাসছে আমার দুশা দেখে। এবার ছায়া মূর্তি চতুষ্টয় আমাকে খাঁটিয়ার সঙ্গে সেঁটে আগাগোড়া বাধল। একজন শিশি শব্দে হেসে ভূতুড়ে গলায় বলল, “জলে ফেলে দে রে, তলিয়ে যাক।”

অন্যজন বলল, “পাঁজাটাক কাঠ থাকলে চিতেয় দিতুম।”

আরেকজন বলল, “অ্যাই, আর এখানে নয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

ভূতুড়ে গলাটি সেইরকম শিশি করে হেসে বলল, “পিশেচবাবা এসে কড়মড়িয়ে খাবে বরং। চ, এবার সাধুবাবার একটা ব্যবস্থা করি।”

একজন হঠাৎ নড়ে উঠল। “অ্যাই! পিশেচবাবা আসছে!”

চারজন বিকট স্বরে’”বলো হরি! হরি বো-ও-ল” বলতে বলতে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। জায়গাটা যে শ্মশান, পোড়া কাঠের গন্ধে অনুমান করতে পারছিলুম। খাঁটিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে বাঁধায় এখন আমার নড়াচড়ার সাধ্যি নেই। অতি কষ্টে চোখের তারা কোণস্থ করে জ্যোৎস্না ঝিলমিল জল এবং একটা উঁচু ন্যাড়া গাছ দেখতে পাচ্ছিলুম। শিমুলগাছই হবে। সেখান থেকে অলক্ষণে পাচার ডাক শোন গেল। তারপর দূরে ডেকে উঠল একটা শেয়াল–সেই শেয়ালটাও হতে পারে। শেয়ালের ডাক থামলে শুকনো পাতায় খড়খড় মসমস শব্দ শোনা গেল। পিশেচবাবা বলতে নিশ্চয় পিশাচ, যাকে ফান্টু দেখেছে এবং সেই পিশাচ নরমাংসভোজী হওয়াই সম্ভব! এখন কথা হল, আসছে, দুষ্টু-চতুষ্টয় তাকে আসতে দেখে পালিয়ে গেল। খড়মড়, খসখস শব্দ ক্রমাগত শুনছি। সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তাও বুঝতে পারছি। পিশাচ বলে যদি কিছু সত্যিই থাকে, তার জ্যান্ত মাংসে অরুচি হলে তবেই আমার বাঁচার চান্স অন্তত নব্বই শতাংশ। নইলে তো গেছিই!

ভেবে ঠিক করলুম, গোঁ-গোঁ আওয়াজ দিয়ে জানিয়ে দেব, আমি মড়া নই, জ্যান্ত। খড়খড় খসখস শব্দটা আমার বাঁদিকে ঝোঁপের ওধারে এসে থেমে গেল। চোখ কোণস্থ করে ঝোঁপের ওধারে লম্বাচওড়া পিশাচবাবার ছায়ামূর্তিও দেখতে পেলুম।

অমনি নাকে যথাসাধ্য দম টেনে নিয়ে সেই দম টেপআঁটা মুখ দিয়ে জোর ওঁ কিংবা গোঁ ধ্বনিসহযোগে ঠেলে দিলুম। ফুটুত করে একটা শব্দ হল এবং টেপটির একদিক উপড়ে গেল।

টের পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম, “পিশাচবাবা, আমি মড়া নই, জ্যান্ত মানুষ!”

অমনি বিদঘুঁটে গলায় পিশাচবাবা বলল, “হাউ মাউ খাঁউ! মানুষের গন্ধ পাঁউ!” তারপর ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে খাঁটিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল এবং হা-হা-হা-হা করে অট্টহাসি হাসল।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, অট্টহাসিটা চেনা ঠেকছে। তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, পিশাচবাবার মুখে সাদা দাড়ি। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পরনে জ্যাকেট ও পাতলুন। গলা থেকে ঝুলন্ত ক্যামেরা ও বাইনোকুলার। মাথায় টুপি। পিঠে কিটব্যাগ আঁটা। হাতে একটি ছড়িও দেখতে পাচ্ছি। হু, ‘হ্যালুসিনেশন’ বলে এরকম অসুখ আছে! সেই অসুখে ধরলে মানুষ ভুলভাল দেখে শুনেছি।

অথবা মৃত্যুকালীন সুখস্বপ্ন! অবশ্য, যক্ষ-ক্ষ-ভূত-প্রেত-পিশাচ নানারকম রূপ ধরতেও পটু। এই শ্মশানের মানুষখেকো পিশাচবাবা আমাকে কামড়ে খাওয়ার সময় যাতে বেশি চাচামেচি, কান্নাকাটি না করি, সেজন্যই আমার সুপরিচিত রূপটি ধরেই দেখা দিয়েছে এবং কোন্ জায়গা থেকে খেতে শুরু করবে, তাই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। মরিয়া হয়ে চোখ বুজে ফেললুম।

তারপর টের পেলুম, দড়িগুলো ঢিলে হয়ে যাচ্ছে! পায়ের দড়ি খুলে গেল এবং ছদ্মরূপধারী পিশাচবাবা আমাকে ঠেলে অন্যপাশে কাত করে হাতের দড়িও খুলে দিল। এমন সুযোগ ছাড়া উচিত নয়। তড়াক করে উঠেই পালানোর চেষ্টা করলুম।

কিন্তু পারলুম না। আমার কাঁধে থাবা পড়ল এবং আবার সেই হা-হা-হা-হা অট্টহাসি। “জল ডার্লিং! এ-মুহূর্তে খানিক জল দরকার। চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিলে ঘিলু চাঙ্গা হবে। ওঠো, উঠে পড়ো।”

কয়েক হাত নিচেই গঙ্গা। বেগড়বাঁই না করে হুকুম তামিল করলুম। তারপর সত্যিই ঘিলু চাঙ্গা হল এবং রুমাল বের করে মুখ মুছতে-মুছতে বললুম, “তা হলে স্বপ্ন নয়!”

“নয়, সেটা এখনও বুঝতে না পারলে আরও খানিকটা জলের ঝাঁপটা দাও।”

“দরকার হবে না। কিন্তু আমাকে উদ্ধারের জন্য আপনি কি মন্ত্রবলে উড়ে এলেন কলকাতা থেকে?”

“মন্ত্রবলে নয়, ডার্লিং! চার চাকার মোটরগাড়িতে–এক্সপ্রেস বাসে।”

“কিন্তু রাতবিরেতে এই শ্মশানে ছুটে আসার কারণ কী? “পিশাচবাবার হুকুমে। তার সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেছে।”

প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, দূরে বিকট চাঁচানি শোনা গেল, “বলো হরি! হরি বো-ওল! বলো হরি! হরি বো-ও-ল!” কর্নেল আমাকে টানতে-টানতে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেলেন। কঁধ ধরে ঠেলে বসিয়ে দিলেন। কিন্তু নিজে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলুম, “ওরা নির্ঘাত হালদারমশাইকে আমার মতো বেঁধে আনছে। উনি শিবমন্দিরে সাধু সেজে-”

“চুপ! স্পিকটি নট।”

চুপ করে থাকলুম। হরিধ্বনি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সাবধানে উঁকি মেরে দেখলুম, একটু দূরে চার ছায়ামূর্তি কী একটা বয়ে আনছে! তবে খাঁটিয়া নয়। কাছাকাছি আসামাত্র কর্নেল বিদঘুঁটে গলায় একখানা হুঙ্কার ছাড়লেন, কতকটা বাঘের গজরানির মতো।

শোনামাত্র ওরা থমকে দাঁড়াল। তারপর কাঁধের লম্বাটে জিনিসটা ফেলে দিয়ে পিটটান দিল। কর্নেল দৌড়ে গেলেন। আমিও।

হ্যাঁ, জটাজুটধারী হালদারমশাই-ই বটে। মুখে টেপ সাঁটা আমারই মতো। আগাগোড়া দড়ি জড়ানো গায়ে। আশ্চর্য ব্যাপার, জটা ও দাড়ি খুলে যায়নি এবং কাঁধ থেকে ফেলে দেওয়ায় চোটও খাননি। কর্নেল বাঁধন খুলে দিতেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দুই ঠ্যাঙে সিধে দাঁড়ালেন এবং জটা-দাড়ি নিজেই খুললেন। দেখলুম, টেপটি নকল গোঁফদাড়ির সঙ্গে সেঁটে থাকায় ওঁর সুবিধে হয়েছে বেশি। সহজেই খুলে গেল।

তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার, আলখাল্লাধারী হালদারমশাই অবাক হলেন না কর্নেলকে দেখে। মুখ দিয়ে যে ধ্বনি বেরোল, তা হল, “খি-খি-খি-খি….!”

কর্নেল বললেন, “আছাড় খেয়ে ব্যথা লাগেনি তো হালদারমশাই?”

“হঃ কি যে কন! সয়েল না, স্যান্ড। বালু, বালু!” বলে খালি পায়ে বুড়ো আঙুলে নরম মাটির অবস্থাটা বুঝিয়ে দিলেন।

কর্নেল বললেন, “মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে নিন বরং–”

“ক্যান?”

“আপনার ওপর এমন একটা সাঙ্ঘাতিক ধকল গেল। মনে হচ্ছে, এখন আপনি ধাতস্থ হতে পারেননি।”

“অ্যাঁ! হালদারমশাই এতক্ষণে চমকালেন। কর্নেল এবং আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে লম্বা পায়ে জলের ধারে গেলেন।

একটু পরে আলখাল্লায় মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এসে বললেন, “ক্কী…..ক্কী আশ্চর্য ঘটনা। কর্নেল স্যার, আপনি? এতক্ষণ তাই চেনাচেনা ঠেকছিল। আপনি কখন এলেন? আর এই শ্মশান-মশান জায়গায় কী…কী অবাক!”

কর্নেল বললেন, “সব কথা পরে হবে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয় হালদারমশাই! যে-কোনও সময়ে পিশাচবাবার আবির্ভাব ঘটতে পারে। চলুন, কেটে পড়া যাক।”

হালদারমশাই বললেন, “পিশাচবাবা! সে আবার কে?”

“ভুলে গেছেন দেখছি। নোটবইতে টুকেছিলেন না?”

হালদারমশাই চুপ করে গেলেন।

জ্যোৎস্না খানিকটা ঝলমলে হয়েছে। কোথাও গমখেত, কোথাও ধবধবে সাদা ন্যাড়া চষা-মাটি, কোথাও ঝোঁপঝাড় আর গাছের জটলা। মাঠের মধ্যে দূরে বা কাছে বিদ্যুতের আলো দুলদুল করছিল। বাঁ দিকে পশ্চিমে সোজা এগিয়ে সামনে কালো চাপ-চাপ উঁচু-নিচু পাঁচিলের মতো জিনিসটা দেখিয়ে কর্নেল বললেন, “কেল্লাবাড়ির ধ্বংসাবশেষ।”

জিজ্ঞেস করলুম, “ওখানে গিয়ে কী হবে? বরং দণ্ডীবাবুর ফার্মে যাই চলুন।”

কর্নেল আস্তে আস্তে বললেন, “এসো তো।” তারপর পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বেলে নাড়তে থাকলেন।

কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্কৃপের দিকে একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোটা এদিকে-ওদিকে নড়াচড়া করে নিবে গেল। কর্নেলও টর্চ নেবালেন। আলখাল্লাধারী হালদারমশাই বললেন, “এক মিনিট! এক মিনিট! জটা-দাড়ি না পরলে এ পোশাকে বড্ড বিচ্ছিরি দেখাবে। জয়ন্তবাবু, একটু হেল্প করুন। বিটকেল টেপটা ছাড়ানো যাচ্ছে না।”

টেপটা ছাড়িয়ে দিলুম। কিন্তু কিছু গোঁফ আটকে থাকল তাতে। হালদারমশাই সেটা ফেলে দিয়ে কষে জটা-দাড়ি আঁটলেন। তারপর বললেন, “চলুন, আই অ্যাম রেডি অ্যান্ড স্টেডি।”

পায়ের কাছে আলো ফেলে কর্নেল আগে হাঁটছিলেন। একটু পরে শুকনো খাল অর্থাৎ গড়খাইয়ের সামনে পৌঁছলুম। সাবধানে নেমে গেলুম। নরম দূর্বাঘাসে গড়খাইটা ভরে আছে। ওপারের ঢালে একফালি পায়ে-চলা রাস্তা। উঠতে অসুবিধে হল না। রাস্তার ওপর ঝোঁপঝাড় ঝুঁকে রয়েছে। সামনে আবার সেই রহস্যময় টর্চের আলো জ্বলে উঠল। কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, “সঙ্গে গেস্ট আছে নন্দবাবু! আগে চা দরকার! হবে তো?”

অবাক কাণ্ড! জবাব পদ্যে এল :

খাবেন নেহাত চা
সে আর এমন কী।
কুকারে কেটলিটাও
চাপিয়ে রেখেছি।
গেস্ট পেলে তো ধন্যই
প্রস্তুত সেজন্য।।

কর্নেল থামিয়ে না-দিলে পদ্যটা চলত। তবে মজাটা হল, কর্নেলও পদ্যেই থামলেন :

যথেষ্ট যথেষ্ট
খামোকা কেন কষ্ট।।

একটা লণ্ঠন জ্বালানো হচ্ছিল। জবাব এল ফের পদ্যেই এবং সঙ্গে সঙ্গে চাপা খিকখিক হাসি :

পদ্য বলা কষ্ট নয় বদভ্যাস
ব্রেনে যদি বসত করেন বেদব্যাস।।

হ্যাঁ আমার অনুমান সঠিক। ফান্টুর কাছে শোনা সেই ভাণ্ডারী মাস্টারমশাই। কিন্তু দেখলে হাসি পাবে বলেছিল, পেল না। একটু রোগা, টিঙটিঙে, একটু কুঁজো, প্রচণ্ড লম্বা নাক। চিবুক থেকে অন্তত আট ইঞ্চি লম্বা গোঁফের মতো দাড়ি ঝুলছে, আর মাথায় লম্বা সন্নেসি-চুল। মুখে অমায়িক হাসি। পরনের পাঞ্জাবি এত লম্বা যে, ধুতি ঢেকে ফেলেছে প্রায়।

গাছ ও ঝোঁপের ভেতর কোনওরকমে টিকে থাকা, দরজা জানালার কপাট লোপাট হওয়া, হাঁ-হাঁ করা একটা ঘর। ছোট্ট গেরস্থালি পাতা। ফান্টু বলেনি এখানেই কবি ভাণ্ডারীমশাইয়ের ডেরা। হয়তো সে জানে না এই ডেরার খবর। ভাণ্ডারীমশাই সাধুবেশী হালদারমশাইকে দেখে চোখ নাচিয়ে বললেন,

হচ্ছে সন্দেহ
সাধু নন অন্য কেহ।

হালদারমশাই নিশ্চয় পদ্য বানাতে পারেন না। কারণ তিনি জবাবে তার প্রসিদ্ধ “খি-খি-খি-খি” উপহার দিলেন। কর্নেল বললেন, “ঠিক ধরেছেন নন্দবাবু, ইনিই সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে কে হালদার।”

“তা হলে নমস্কার।” বলে কবিবর মিষ্টি হাসলেন।

ডিটেকটিভ এনেছে দণ্ডী।
খবর পেয়েই চণ্ডী।
কালীগঞ্জে প্রেজেন্ট।
একটা ইনসিডেন্ট
বাধতে পারে শেষটা–”

হালদারমশাই বলে উঠলেন, “কী এই কেসটা?”

কবি নন্দ ভাণ্ডারী কেটলিতে ফুটন্ত জলে চা-পাতা ফেলে, সেটা নামিয়ে রেখে দুধ গরম করতে দিলেন। তারপর তক্তাপোশের তলা থেকে কাপ-প্লেট বের করে বাইরে ধুতে গেলেন। হালদারমশাইয়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন, “শেষটার সঙ্গে কেসটা বেশ মিলেছে হালদারমশাই।”

হালদারমশাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি হাসতে হাসতে বললুম, “কেসটা বুঝতে দরকার একটু চেষ্টা।”

হারদারমশাই একটু চটে গেলেন।”ধুর মশাই! খালি পদ্য। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। পদ্য-দ্য আমার আসে না। ওদিকে এতক্ষণ কী হচ্ছে কে জানে! বেগুনখেতে”

বাইরে থেকে কবিবর বললেন–

বেগুনখেতে রাতবিরেতে নাচত কাকতাড়ুয়া।
চুপিসাড়ে ঝোপেঝাড়ে বলত শেয়াল ক্যা হুয়া।
দণ্ডীবাবু ফন্দি করে যেই আনল ডিটেকটিভ।
চণ্ডীচরণ বুঝল তখন এবার সে ইনএফেকটিভ।

তারপর ঘরে ঢুকে দুধের পাত্র নামিয়ে কুকার নেবালেন। চা তৈরি করতে করতে ফের ভাণ্ডারীমশাই আপনমনে আস্তে বললেন,

“হচ্ছে ভয়।
কী হয়, কী হয়।
ছেলেটা যে বোকা।
জিনিয়াস একরোখা।
 ওরে পোড়ামুখো।
তোর হাতেই হুঁকো।
খেয়ে যাচ্ছে ভূত—”

হালদারমশাই চটেই ছিলেন। বলে উঠলেন, “কী অদ্ভুত!”

কর্নেল তারিফ করার ভঙ্গিতে বললেন, “আসছে হালদারমশাই, আসছে!”

হালদারমশাই চমকে উঠে বললেন, “ক্কী!”

“পদ্য।”

আমি ফোড়ন না কেটে পারলুম না। “এবং ছন্দও।”

হালদারমশাই গুম হয়ে বসে রইলেন। মনে হল, যা ঘটছে সেটা তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছেন। কবি নন্দ ভাণ্ডারীর মুখেও সেই আমুদে ভাবটা নেই। হাতে-হাতে চা এগিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড একটা ধকলের পর গরম চা আমাকে চাঙ্গা করতে থাকল। হালদারমশাইকেও বটে। কারণ তার সন্নেসি-মুখে প্রশান্তি ফুটতে শুরু করল। ভাণ্ডারীমশাই চা শেষ করে বললেন,

অনারেবল গেস্ট।
নাউ টেক রেস্ট।
ওয়ান থিং টু ক্লিয়ার।
ইফ ইউ হিয়ার
দা জ্যাকল হাউলস।
সামথিং ইজ ফাউল।

তক্তপোশের তলা থেকে তিনি একটা পুটুলি বের করলেন। তারপর সেটা বগলদাবা করে কর্নেলের দিকে চোখ নাচিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন।

দেখলুম, হালদারমশাই কর্নেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল লণ্ঠনের দম কমিয়ে দিলেন। বললেন, “কী বুঝলেন বলুন হালদারমশাই!”

“প্রচুর–প্রচুর রহস্য।”

“হ্যাঁ, রহস্য প্রচুরই। আপনাকে বলেছিলুম, ‘ণ্ড’ বর্ণটি যেখানে, সেখানেই গণ্ডগোল। কবি নন্দলাল ভাণ্ডারীকেও দেখলেন। ণ্ড বর্ণটি তার নামেও আছে। কাজেই কিছু গণ্ডগোল তারও আছে, তবে সেটা মাথায়।”

আমি বললুম, “কিন্তু আপনার সঙ্গে এর পরিচয় হল কীভাবে?”

কর্নেল একটু হাসলেন। “গত একমাস যাবৎ নন্দবাবু আমাকে পদ্যে চিঠি লিখে আসছেন। পাগলের পাগলামি ভেবে গ্রাহ্য করিনি। তারপর কাগজে সত্যিই ভূতুড়ে কাকতাড়ুয়ার খবর বেরোল। আজ সকালে হালদারমশাই আর তুমি গেলে। হালদারমশাইয়ের কাছে দণ্ডীবাবুর আসার খবর পেলুম। তখন নন্দলালবাবুর পদ্যগুলোকে গুরুত্ব দিতেই হল। উনি লিখেছিলেন :

ভাঙা কেল্লাবাড়ি আমার ইদানীংকার আস্তানা।
মুখে দাড়ি দুজনকারই সেটাই চেনার রাস্তা না?

“অতএব পরস্পর চেনাচিনির অসুবিধে হয়নি।”

“শ্মশানে গিয়েছিলেন কেন?”

“হরিধ্বনি শুনেই নন্দবাবু আমাকে শ্মশানে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন দণ্ডীবাবুকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। তো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলুম। আমাকে দেখে পিশাচবাবা ভেবে লোকগুলো খাঁটিয়া ফেলে পালিয়ে গেল। তখনও ভাবিনি, তোমাকে ওরা ধরে এনেছে! তোমার কান্নাকাটি শুনে তবে বুঝলুম”।

“মোটেও কান্নাকাটি নয়” প্রতিবাদ করলুম। “আমি যে জ্যান্ত মানুষ, সেটাই জানাতে চাইছিলুম।”

হালদারমশাই প্রচণ্ডভাবে খি-খি-খি-খি করলেন এতক্ষণে। তারপর বললেন, “খাইছে আর কি!”

বললুম, “কিন্তু পিশাচবাবার ব্যাপার কী? ফান্টুও বলছিল, তাকে দেখেছে।”

কর্নেল বললেন, “কাটরার মাঠের নরমাংসভোজী পিশাচবাবার থান তোমাকে বলেছিলুম, মনে নেই? শুনলুম দণ্ডীবাবু আর চণ্ডীবাবু দুজনেরই দিকে নাকি তার নজর।”

হালদারমশাই বললেন, “জিনিয়াস ছেলেটার হাতে ভূতের হুঁকো খাওয়ার কথা বললেন পোয়েটমশাই। বড়ই রহস্যজনক! কর্নেল স্যার কি কিছু কু পেলেন?”

“কীসের?” কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন। কারণ তিনি যেন কিছু শোনার চেষ্টা করছিলেন।

হালদারমশাই বললেন, “হুঁকোর।”

কর্নেল কী বলতে যাচ্ছেন। সেই সময় শেয়ালের ডাক শোনা গেল। অমনি উঠে দাঁড়ালেন। “ইফ দ্য জ্যাক্স হাউলস/ সামথিং ইজ ফাউল” বলে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় দৌড়েই গেলেন বলা উচিত।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, “খাইছে! পোইদ্য। বুঝলেন না? পোইদ্য–পইট্টি! কর্নেলসারেরে খাইছে!” ওই-কারের মতো একটা আঙুল উঁচিয়ে ধরলেন গোয়েন্দাবর। তারপর গেরুয়া আলখাল্লার ভেতর থেকে নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন। শেয়ালটা থেমে গেল হঠাৎ। তার একটু পরে বন্দুকের গুলির শব্দ ভেসে এল দূর থেকে। পরপর দু’বার। হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। এখানে বসে থাকার মানে হয় না আর। চলুন জয়ন্তবাবু, কী ঘটছে দেখে আসি!” বলে আমাকে টেনে ওঠালেন।

সেই গড়খাই পেরিয়ে মাঠে পৌঁছানোর পর শ্মশানের দিক থেকে হরিধ্বনির শব্দ ভেসে এল। অমনি হালদারমশাই দম-আটকানো গলায় বললেন, “আবার কারে বাঁধল?”

বলে আচমকা টাট্ট ঘোড়ার মতো গমখেত ভেঙে উধাও হয়ে গেলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর গা ছমছম করতে থাকল। জ্যোৎস্নার রাতে কাটরার মাঠে একা পড়ে গিয়ে এখন প্রতি মুহূর্তে ভয়, হুঁ–সেই নরমাংসভোজী পিশাচবাবারই! কে জানে, সামনে বা পেছনে কোনও গর্ত থেকে বা ঝোঁপঝাড় ফুঁড়ে আবির্ভূত হলেই গেছি।

দণ্ডীবাবুর ফার্মটা কোনদিকে ঠাহর করার চেষ্টা করলুম। বাঁ দিকে একটু দূরে বিদ্যুতের আলো জুলজুল করছে। ওইটেই হবে। মরিয়া হয়ে সেইদিকে নাক-বরাবর হাঁটতে থাকলুম।

.

পাঁচ

ফার্মহাউস এলাকা একেবারে সুনসান নিশুতি। বেগুনখেতে কালো হয়ে কাকতাড়ুয়াটি দাঁড়িয়ে আছে। মড়ার খুলি এমনিতেই দেখতে বিটকেল, তার ওপর সময়টা এরকম। শেয়ালের ডাক শুনে কর্নেলের দৌড় এবং শ্মশানের হরিধ্বনি শুনে ডিটেকটিভদ্রলোকের নিমেষে অন্তর্ধান, ওদিকে। নরমাংসভোজী পিশাচবাবার ব্যাপারটাও কম সাঙ্ঘাতিক নয়। কাজেই কাকতাড়ুয়াটির দিকে এখন তাকানো উচিত।

খোলা বারান্দায় ফান্টু দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছিল, তার হাতে দোনলা বন্দুক। সেই বন্দুকটাই হবে। কিন্তু ইনি তো দণ্ডীবাবু নন, তার বিপরীত। নাদুস, নুদুস, বেঁটে। মুখের ভাব অমায়িক। প্রথমে ফান্টুই আমাকে দেখতে পেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, “রিপোর্টারদা, কোথায় গিয়েছিলেন হঠাৎ? আমি তো আপনার জন্য ভেবে-ভেবে সারা। শেষে বড়মামা খুঁজতে গেলেন আপনাকে।”

বেঁটে ভদ্রলোক একটু যেন চমকে গিয়েছিলেন। তারপর মিঠে হাসলেন। আসুন-আসুন! এতক্ষণ ফান্টু আপনার কথাই বলছিল। কাগজে ওর ছবি বেরোবে শুনে খুব ভাল লাগল।”

ফান্টু বলল, “আপনি পিশাচবাবার পাল্লায় পড়েননি তো রিপোর্টারদা!’

“নাঃ।” বলে বেতের চেয়ারে বসে পড়লুম। বেজায় ক্লান্ত। শুতে পেলে বাঁচি, এমন অবস্থা। শরীরের গিটে গিটে ব্যথা, যা বাঁধা বেঁধেছিল ব্যাটাচ্ছেলেরা! মাথা ঝিমঝিম করছে রহস্যের চোটে।

ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। “আমার নাম চণ্ডীচরণ খাঁড়া। তুলোদা আমার মাসতুতো দাদা। আর বলবেন না স্যার! ভুসির বস্তায় মড়ার খুলি ঢুকিয়ে দিয়েছিল কেউ। নেহাতই রসিকতা। কিন্তু তুলোদর আবার সবতাতে বড় বাড়াবাড়ি। বেগুনখেতের কাকতাড়ুয়ার মাথায় সেটি বসিয়ে দিয়ে কেলেঙ্কারি বাধিয়েছেন। খবর পেয়ে ছুটে এলুম। হচ্ছেটা কী, হাতে নাতে দেখে তারপর ব্যবস্থা।”

ফান্টু বলল, তোমাকে দেখে কিন্তু আর নড়ছে না, দেখছ ছোটমামা!

“নড়ুক না। তুলোদা’র চেয়ে আমার হাতের টিপ কেমন দেখিয়ে ছাড়ব!”

“কিন্তু বন্দুকে তো আর কার্টিজ নেই, ছোটমামা। বড়মামা দুটোই ফায়ার করে ফেলেছেন!” চণ্ডীবাবু বন্দুক মোচড় দিয়ে খালি কার্তুজ দুটো বের করে দেখে ফেলে দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “তুলোদার একটুতেই বাড়াবাড়ি।”

ফান্টুও খুব হাসতে লাগল। “উড়ো পদ্য পেয়ে শেয়াল-ধরা ফাঁদ খুঁজতে জামাকাপড় ফাফাই হয়ে গেছে বড়মামার। বের করে আনতে সে এক ঝামেলা! মেজাজ খাপ্পা হয়েই ছিল, আরও খাপ্পা করে দিল।”

“কে?”

“আবার কে? কাকতাড়ুয়া।”

“নড়াচড়া করছিল নাকি?”

“তুমি শুনলে কী এতক্ষণ? পর পর দুটো ফায়ার করেও বড়মামার রাগ পড়তে চায় না। মুকুন্দদা আর রমজানদা এসে অনেক করে বোঝাল। তারপর মাথা ঠাণ্ডা হল। তারপর এই রিপোর্টারদার কথা বললুম। তখন বড়মামা রিপোর্টারদাকে খুঁজতে বেরোলেন টর্চ নিয়ে।

“হ্যাঁ রে ফান্টু, তুলোদা পিশাচবাবার পাল্লায় পড়েনি তো?”

ফান্টু একটু ভেবে বলল, “একটা কথা মাথায় আসছে ছোটমামা!”

“কী কথা বল তো?”

“বড়মামাকে পিশাচবাবা কিছু বলবে না। কেন জানো? আজ সন্ধে থেকে শ্মশানে তিনটে মড়া গেল।”

“গেল বটে। হরিধ্বনি দিচ্ছিল।”

“পিশাচবাবা এখন ওই তিনটে মড়া খেতেই ব্যস্ত। পেট ফুলে ঢোল হবে।”

‘ঠিক বলেছিস। বলে চণ্ডীবাবু আমার দিকে ঘুরলেন। “সওয়া দশটা বাজে প্রায়। স্যারকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ফান্টু, ওঁর খাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোদের নন্দী-ভৃঙ্গীর সাড়া নেই–দ্যাখ, গাঁজা টেনে পড়ে আছে নাকি?

ফান্টু চলে গেল কিচেনের দিকে। চণ্ডীবাবু গুলিশূন্য বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করে বললেন, “খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন স্যার। আমি তুলোদাকে খুঁজে নিয়ে আসি। মাঠে তুলকালাম করে বেড়াচ্ছে হয়তো!”

চণ্ডীবাবু চলে গেলেন গেটের দিকে। একটু পরে ফান্টু ফিরে এসে বলল, “রিপোর্টারদা, ওরা নেই। না মুকুন্দদা, না রমজানদা!” সে একটু রাগ করেছে বোঝা যাচ্ছিল। ফের বলল, “বড়মামা আসুন, এবার সব বলে দেব।”

“কী বলে দেবে ফান্টু!”

ফান্টু পাচার মতো মুখ করে বলল, “ওরা বোজ রাত্তিরে চুপিচুপি কোথায় যায়! আমাকে বলতে বারণ করছিল, তাই বলিনি মামাকে। এবার দেখছি বলতেই হবে।”

একটু অবাক হয়ে বললুম, “তা হলে ওরা সত্যি গাঁজা খেয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়ে থাকে না বলছ?”

“হ্যাঁ!” বলে ফান্টু হাই তুলল। “চলুন রিপোর্টারদা, আমরা খেয়ে নিই।”

“তোমার মামারা ফিরে আসুন। একসঙ্গে খাব বরং।”

ফান্টু হঠাৎ হাসল। “তা হলে চলুন রিপোর্টারদা, প্রিন্স অ্যালবার্টকে দেখে আসি। একা যেতে ভয় করছে। আজ রাতে বড্ড বেশি শেয়াল ডাকছে। শেয়াল ডাকলেই বুঝতে পারি পিশাচবাবা বেরিয়েছে।”

ফার্মহাউসের পাশ দিয়ে একফালি পায়ে চলা রাস্তা। কয়েক পা এগিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। বললুম, “কী হল?”

ফান্টু বলল, “টর্চ? আমার টর্চটা বড়মামা নিয়ে গেছেন। আপনার কাছে টর্চ নেই?”

“ছিল,” বলতে গিয়ে সামলে নিলুম। কারণ, তা হলে ওকে সব কথা খুলে বলতে হয়। বলার মুড নেই। তাই বললুম, “নেই।”

“নার্সারির ওখানে একটা চালাঘর আছে। আলোটা জ্বেলে দেব, চলুন। একটু দূরে অবশ্যি–তা হলেও দেখা যাবে।” বলে ফান্টু হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকল। ওর সঙ্গ ধরতে বারকতক পা হড়কে আছাড় খাওয়ার উপক্রম। তারপর সামনের দিকে গমখেত পড়ল। আঁকাবাঁকা আলপথে অনেকটা যাওয়ার পর ফান্টু বলল, “নার্সারির এরিয়ায় এসে গেছি রিপোর্টারদা! এই দেখুন, কতরকম ক্যাকটাস, পাতাবাহার আর ঝাউ লাগিয়েছি। ওইখানে গোলাপবাগান। পাঁচ রকমের গোলাপ আছে। প্রিন্স অ্যালবার্ট”।

ফান্টু থেমে গেল। খানিকটা দূরে হঠাৎ আলো জ্বলল। বিদ্যুতের আলো। সেই আলোয় দেখলুম, চণ্ডীবাবু একটা চালাঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে মুকুন্দ ও রমজানের সঙ্গে কথা বলছেন। ফান্টু খুব অবাক হয়ে বলল, “ছোটমামা ওখানে কী করছেন?”

সে দৌড়তে যাচ্ছিল, টেনে ধরে আটকে দিলুম। বললুম, “চুপ! বরং দু’জনে আড়ালে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝে নিই, চলো!”

ফান্টুর মনে ধরল কথাটা। ঝাউ, ক্যাকটাস, পাতাবাহারের ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে কাছাকাছি এক জায়গায় বসে পড়লুম। হাত-বিশেক দূরে চালাঘরটা, সবকিছুই দেখা ও শোনা যাচ্ছে। চণ্ডীবাবু দুটো ছোট্ট প্লাস্টিকের থলে পাঞ্জাবির দুই পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, “বন্দুকটা তুলোদার ঘরে রেখে দিয়ে যাও! আর এই নাও, পাঁচ টাকা করে বাড়িয়েই দিলুম।”

রমজান ও মুকুন্দ টাকাগুলো পকেটে ঢোকাল। তারপর মুকুন্দ ফিক করে হেসে বলল, “পিশাচবাবা এতক্ষণ দণ্ডী-স্যারের হাড় চুষছে। খুব রাগী লোকের হাড়ে টক-ঝালটা বড্ড বেশি থাকে।”

চণ্ডীবাবুও ভুড়ি নাচিয়ে হাসলেন। রমজান বলল, “কাগজের বাবুটিকে আমার কেমন সন্দেহ হয়। বাবুমশাই।”

চণ্ডীবাবু বললেন, “ঠিক বলেছ হে! শ্মশান থেকে দিব্যি ফেরত এল দেখে আমি তো তাজ্জব! পিশাচবাবা ওকে খেল না কেন? তা ছাড়া বাঁধন খুলে পালিয়ে এল কী করে?”

মুকুন্দ বলল, “আপনার লোকগুলো কোনও কম্মের নয়। বরাবর দেখে আসছি, সবতাতেই বড্ড তাড়াহুড়ো করে। কাকতাড়ুয়া নাচাতে গিয়ে গুলি খেয়ে রক্তারক্তি হল।”

“ধুস, রক্ত নয়, কুমকুমের ছোপ।” চণ্ডীবাবু মুখ বাঁকা করে বললেন।”ওদিন দোলপূর্ণিমা ছিল! হোলির কুমকুম-পটকা। বোটা অতি চালাক। কে ওকে বলেছিল, কাকতাড়ুয়ার গলায় কুমকুম-পটকা বাঁধতে? জানা কথা, তুলোদা আগের রাত্তিরের মতো মুণ্ডু তাক করেই গুলি ছুঁড়বে। হাঁদারাম!”

মুকুন্দ ও রমজান বেজায় হাসতে লাগল। মুকুন্দ বলল, “তাই বলুন! পটকা ফেটে রঙবেরঙ!”

চণ্ডীবাবু বললেন, “রঙবেরঙ করতে গিয়ে আমাকেও বিপদে ফেলেছিল আর কি! তুলোদার তো হাড়ে-হাড়ে বুদ্ধি। কলকাতা থেকে গোয়েন্দা এনে–যাকগে, আলো নেবাও। আর শোনো, গোয়েন্দাবাবু তো পিশাচবাবার পেটে গেছে। কাগজের বাবুটিকেও ফের শ্মশানে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। বেন্দার দল তোমাদের হেল্প করবে।”

রমজান বলল, “এক কাজ করা যাক। কাগজবাবুর খাবারে আফিমের রস মিশিয়ে দিলেই, ব্যস, মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়বে। তখন ওকে চ্যাংদোলা করে শ্মশানে রেখে আসা যাবে।”

মুকুন্দ সায় দিয়ে বলল, “পিশাচবাবার শেষরাত্তিরে নিশ্চয় খিদে পাবে! তখন ওকে খাবে।”

কথাগুলো শুনে শিউরে উঠেছিলুম। ফান্টু আমাকে চিমটি কাটলে ফিসফিসিয়ে বললুম, “চুপ।”

আলো নিবে গেল। তারপর কাছেই কোথাও শেয়ালের ডাক শোনা গেল। চণ্ডীবাবু চালাঘর থেকে নেমে জ্যোৎস্নায় দাঁড়ালেন। বললেন, “ফার্মের জমি তুলোদা ফান্টুর নামে উইল করে রেখেছে। ফান্টু তো আমারও ভাগনে। আশা করি, বেগড়বাঁই করবে না।”

“মুকুন্দ বলল, না, না। ফান্টু তো জানেই না কীসের চাষ করছে! চণ্ডী-স্যার বীজ এনে দিতেই সয়েল টেস্ট করে কতরকমের সার দিয়ে ফুলে ফুলে ছয়লাপ করে দিয়েছে। মাথা আছে বটে!”

চণ্ডীবাবুর বন্দুক রমজানের কাঁধে। সে আর মুকুন্দ আমাদের দিকে, চণ্ডীবাবু উল্টোদিকে সবে কয়েক-পা হেঁটেছেন, অমনি কোথাও একটা অমানুষিক গর্জন শোনা গেল। কতকটা এইরকম, “খ্রাঁ-ও-ও! খ্রাঁ -ও-ও! খ্রাঁ -ও!”

তারপর চণ্ডীবাবুর সামনাসামনি ঝোঁপ ফুড়ে কালো একটা মূর্তি বেরোল। চণ্ডীবাবু টর্চ জ্বেলেই “বাবা রে” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন। টর্চটা বোধ করি আতঙ্কের চোটে হাত থেকে পড়ে নিবে গেল। কিন্তু ওই এক পলকের আলোয় দেখতে পেলুম দু’ঠেঙে কালো গরিলার মতো একটি প্রাণীকে। ভয়ঙ্কর মুখ থেকে সাদা দুটো কষদাঁত বেরিয়ে আছে। দু’হাতে বড়-বড় নখ।

ফান্টু আমাকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করল, “পিশাচবাবা। পিশাচবাবা!”

রমজান ও মুকুন্দের এক-গলায় আর্তনাদ শুনলুম। তারপর তারা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়েই পালিয়ে গেল। চণ্ডীবাবু পালাতে যাচ্ছেন, সেই সময় চালাঘরের পেছন থেকে কেউ এসে তাকে জাপটে ধরল। জ্যোৎস্নায় আবছা যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, তাতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ধস্তাধস্তি বেধেছে মনে হচ্ছে। তারপরেই, কী আশ্চর্য, কর্নেলের গলা শুনতে পেলুম, “হালদারমশাই, চালাঘরের আলোটা জ্বেলে দিন! শিগগির।”

আলো জ্বলল।

কর্নেলকে দেখলুম, সবে ধরাশায়ী দশা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। টুপিটা পড়ে গেছে। টাক ঝকমক করছে। চণ্ডীবাবু অদৃশ্য। হাত ফসকে পালিয়ে গেছেন বোঝা গেল।

পিশাচবাবা দাঁড়িয়ে আছে। আলখাল্লা ও জটাজুটধারী হালদারমশাই চালাঘর থেকে নেমে খি-খি-খি-খি করলে। পিশাচবাবার ভয়ঙ্কর মুখ থেকে মানুষের ভাষায় পদ্য বেরোল, সঙ্গে ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস।

গঙ্গায় দিল দণ্ডী ঝম্প
চণ্ডীও দিল লম্বা লম্ফ।।

পদ্য শুনেই ফান্টু লাফিয়ে উঠল এবং ‘মাস্টারমশাই’ বলে চিকুর ছেড়ে দৌড়ে গেল।

আমিও গেলুম। ভয়ঙ্কর মুখোশ এবং কালো কাপড়ে তৈরি মনুষ্যাকৃতি খোলসের টিপ-বোতাম পুট পুট করে খুলে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন কবি নন্দলাল ভাণ্ডারী। সহাস্যে ফান্টুকে বললেন,

ওরে বাবা ফান্টুস
একটুকু চাই হুঁশ
বললেও ইঙ্গিতে
পারিসনি বুঝে নিতে
মামা এনে দিল বীজ
যত্ন করে চষেছিস
জানিস এইগুলো কী
ওপিয়াম পপি রে!

বলে পায়ের কাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে ফেললেন। ফান্টু বলল, এগুলো তো ফুল মাস্টারমশাই, পপিফুল!”

কবি ভাণ্ডারীমশাই চটে গেলেন।

এই দ্যাখো ছেলেটা
কী যে ভেলভেলেটা
বোঝালেও বোঝে ভুল
বলে কিনা পপিফুল!

ফান্টু অবাক হয়ে বলল, “তা হলে কী এগুলো?”

ভাণ্ডারীমশাই বললেন,

শোন্ তবে আগাগোড়া
সব সাপ নয়, ঢোঁড়া
কোনওটার থাকে বিষ
এইবার বুঝেছিস
এই পপি ডেঞ্জারাস
আফিং এরই নির্যাস।”

ফান্টু একটু গুম হয়ে থাকার পর বলল, হু, বুঝেছি। তাই মুকুন্দদা রমজানদা গাছগুলোর ডগা চিরে রাখত। রস বেরিয়ে আঠার মতো জমে থাকত আর ওরা চুপিচুপি রাত্তিরে এসে সেগুলো খুলে নিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরত। আমাকে বলত, মামাকে যেন না বলি। আমি অত কি জানি, বলুন

ভাণ্ডারীমশাই তাঁর পৈশাচিক ছদ্মবেশ গুটিয়ে পুঁটলি বানালেন এবং সেটি বগলদাবা করে বললেন,

ওরে সোনা গুড বয়
করে ফ্যাল ডেস্ট্রয়
বিলম্ব নয় বাপ
হাতে দেবে হ্যান্ডকাপ
আবগারি দারোগা
তব তেরা ক্যা হোগা
ব্রিং সাম গুড বিষ
আভি করে দে ফিনিশ।।

ফান্টু বলল, “এখনই বিষ স্প্রে করে দিচ্ছি। কর্নেল বললেন, আসুন নন্দবাবু, ফান্টু ওপিয়াম পপি জ্বালিয়ে দিক। আমরা ফার্মহাউসে গিয়ে দেখি, দণ্ডীবাবু সাঁতার কেটে ফিরতে পারলেন নাকি!”

ভাণ্ডারীমশাই হাই তুলে বললেন,

রাত নিঝুম
পাচ্ছে ঘুম
উঠছে হাই
ডেরায় যাই।।

তারপর সটান ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলেন। জ্যোৎস্নায় তার ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল! সেদিকে। অদ্ভুত মানুষ!

হালদারমশাই ততক্ষণে চালাঘরে গিয়ে ছদ্মবেশ ছেড়েছেন এবং সেটি তিনিও পুটুলি বানিয়ে বগলদাবা করে বেরোলেন। প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গোটানো ছিল। বোঝা গেল, আলখাল্লার ভেতর প্যান্ট-শার্ট পরেই ছিলেন। অবশ্য পা-দুটো খালি। বললেন “কী কাণ্ড! পোইদ্যের লগে পিশাচ আর শৃগালের সম্পর্ক আছে শুনি নাই। এক্কেরে শৃগালের ডাক!”

বললুম, “উনি শেয়াল ডাকতে পারেন নাকি?”

“ওই তো ডাকছেন! শুনছেন না?”

কর্নেল বললেন, “আমার টর্চটা খুঁজে বের করতে হবে। দণ্ডীবাবুর বন্দুকটাও।”

খোঁজাখুঁজি করতে করতে ফান্টু এসে পড়ল। হাতে স্প্রে। হাসতে-হাসতে বলল, “ওদিকে এক কাণ্ড। বড়মামা এসে গেছেন। কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। বললেন, গঙ্গাস্নান করে এলুম। আমি তো জানি, পিশাচবাবার ভয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন! বলতে গেলে রেগে যাবেন। তাই সে-কথা বললুম না। তবে পপিফুলের ব্যাপারটা আর যা-যা হয়েছে এখানে, সব বলেছি। শুনে মামা হতভম্ব।”

বললুম, “তোমার মামা জানেন না এগুলো আফিংগাছ!”

ফান্টু বলল, “না। বড়মামাকে তো চণ্ডীমামা–মানে, ছোটমামা ফুলের বীজ বলে কোত্থেকে এনে দিয়েছিলেন! বড়মামা আপনাদের জন্য ওয়েট করছেন। শিগগির যান। মামার অবস্থা শোচনীয়। কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকলে কী হবে? রাত্তিরে গঙ্গার জল যা ঠাণ্ডা!”

কর্নেল টর্চ খুঁজে পেলেন। তারপর বন্দুকটাও পাওয়া গেল। হালদারমশাই বন্দুক কাঁধে এবং পুটুলি বগলদাবা করে মার্চের ভঙ্গিতে পা বাড়ালেন। কর্নেল হাঁটতে-হাঁটতে বললেন,

কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটা
বেগুনভাজা আর পরোটা
কিংবা লুচি অর্ধডজন
ইচ্ছে হয় করি ভোজন
দিচ্ছে কেডা
রাত বারোটায়

হালদারমশাই খি-খি সহযোগে বললেন, “খাইছে! পোইদ্যে পাইছে!”

বললুম, “আপনাকেও, হালদারমশাই! পদ্যে পেয়েছে। সাবধান!”

হালদারমশাই সম্ভবত সাবধানতাবশেই চুপ করে গেলেন। পদ্যের সঙ্গে পিশাচ ও শেয়ালের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন উনি। পিশাচ যদি বা সাজতে পারেন, শেয়ালের ডাক ডাকতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে!

.

ছয়

দণ্ডীবাবু ঘরের ভেতর তক্তপোশের বিছানায় সত্যিই কম্বল মুড়ি দিয়ে বসেছিলেন। আমাদের দেখে করুণ মুখে বললেন, “আসুন, আসুন! ফান্টুর মুখে সব শুনলুম। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। ওই চণ্ডীপাষণ্ড ষণ্ড, ভণ্ড আমার মাসতুতো ভাই! আমাকে ফাসাবার কী ষড়যন্ত্র করেছিল, দেখুন! তারপর লোকে বলত, চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই! উঃ কী সাঘাতিক ঘটনা!”

দেখলুম, বারান্দার বেতের চেয়ারগুলো ঘরে ঢোকানো হয়েছে এবং তা আমাদেরই খাতির করে বসতে দেওয়ার জন্যে তো বটেই! আমরা বসলুম। হালদারমশাই বললেন, “দণ্ডীবাবু, কর্নেল স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই! ইনি–”

কথা কেড়ে দণ্ডীবাবু বললেন, “কী আশ্চর্য, শ্মশানে ইনিই আমার বাঁধন খুলে দিলেন মনে পড়ছে, দাড়ি দেখেই চিনতে পারছি। নমস্কার স্যার, নমস্কার! বুঝতেই পারছেন, ওই অবস্থায় শত্রু-মিত্র চেনা কঠিন। আমি ভাবলুম, পিশাচবাবার চেলা-টেলা হবে। পিশাচ বাবার খাওয়াদাওয়ার সুবিধে করে দিচ্ছে।” বলে সেই অদ্ভুত ‘ফাঁচ’ শব্দটি বের করলেন মুখ থেকে। অর্থাৎ দুর্লভ হাসিটি হাসলেন।

হালদারমশাই বললেন, “ইনি স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার গুরুদেব কইতে পারেন এনারে। ইনি না আইয়া পড়লে কী যে হইত, কওন যায় না।”

আবেগে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “অমন করে জলে ঝাঁপ দেওয়া উচিত হয়নি দণ্ডীবাবু! আপনি বিচক্ষণ মানুষ। ভাল করে তাকিয়ে দেখবেন তো?”

দণ্ডীবাবু বললেন, “ওই যে বললুম, শত্রু-মিত্র চেনার অবস্থা ছিল না। গেলুম জয়ন্তবাবুকে খুঁজতে, আর আচমকা কারা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। তারপর চ্যাংদোলা করে তুলে হরি বোল বলতে-বলতে শ্মশানে ফেলে পালিয়ে গেল। এদিকে ইদানীং পিশাচবাবার গল্পটা প্রচণ্ড রটেছিল। আপনি আমার বাঁধন খুলছেন, তখন সাক্ষাৎ পিশাচবাবা এসে আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে আচে। হাঁউ মাউ খাউ করে হুঙ্কারও দিচ্ছে। ওই অবস্থায় জলে ঝপ না দিয়ে উপায় কী, বলুন স্যার?”

কর্নেল বললেন, “যাই হোক, গতস্য শোচনা নাস্তি। আমার কিছু প্রশ্ন আছে, দণ্ডীবাবু।

“বলুন, বলুন!”

“আপনার ফার্মে পপিফুলের খেতটা যে আসলে ওপিয়াম পপির খেত সেটা কি আপনি জানতেন না?”

“বিশ্বাস করুন। ওপিয়াম কী থেকে হয়, আমি জানতুম না। একটু আগে ফান্টু সব বলে গেল। আমি জানতুম ফুল, তো ফুল! পপিফুল! ফান্টুর ফুলের বড্ড শখ। চণ্ডী যে সেই সুযোগ নেবে, কে জানত! গত অক্টোবরে চণ্ডী নিজের হাতে একটা বীজের প্যাকেট দিয়ে গেল। বলল, “ফান্টুকে দিও। এগুলো পপিফুলের বীজ। দারুণ ফুল ফুটবে। গন্ধে মউমউ করবে। বদমাস! জোচ্চোর! পরের হাতে হুঁকো খাওয়ার ফন্দিটা কেমন দেখুন?”

“ইদানীং আপনি ফার্মে এসে রাত্রিবাস করছিলেন কেন, দণ্ডীবাবু?”

দণ্ডীবাবু একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে শ্বাস ফেলে বললেন, “সারাটা দিন আড়তে কাজ-কারবারে ব্যস্ত থাকি। বড্ড একঘেয়ে লাগে। ছেলেমেয়েও নেই বাড়িতে, শুধু গিন্নি আর আমি। তাই অনাথ ভাগনেটাকে এনে রেখেছিলুম। সে থাকে ফার্মে। ছেলেমানুষ তো! রাতবিরেতে কী হয়, যা অবস্থা আজকাল! এও একটা কথা। তবে আরেকটা কথা হল, খটকা।”

“কীসের খটকা?”

ফান্টু বলেছিল, চণ্ডী আজকাল প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে ফার্মে আসে। বুঝুন ব্যাপারটা। কোথায় ঔরঙ্গাবাদ, আর কোথায় কাটরার মাঠ! চণ্ডী আসে, অথচ আমার সঙ্গে দেখা করে যায় না। তার চেয়ে বড় কথা, সন্ধ্যাবেলায় কেন? ফান্টুটার এগ্রিকালচারে মাথা আছে। আর সব ব্যাপারে আস্ত বোকা। এদিকে চণ্ডী লোক ভাল নয়। কাজেই খটকা লেগেছিল। সন্ধ্যার আগেই ফার্মে এতে রাত কাটাতে শুরু করলুম। ব্যস! কাকতাড়ুয়া নাচিয়ে আমাকে ভয় দেখানোর খেলা আরম্ভ হল।”

ফান্টু এসে গেল। বড় করে হেসে বলল, “জ্বালিয়ে দিয়েছি মামা। ফিনিশ!”

চণ্ডীবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। “গেস্টদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ফান্টু! অনেক রাত হয়ে গেছে।”

ফান্টু বলল, “মুকুন্দদা রান্না করে রেখেছে মামা!”

চণ্ডীবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, “চোর! চোর! চোরদের রান্না গেস্টদের খাওয়াব কী রে হাঁদারাম! তা ছাড়া তুই তো বললি, খাবারে আফিমের রস মিশিয়ে দেবার চক্রান্ত করছিল। কাল সকালে সব খাবার শ্মশানে ফেলে দিয়ে আসব। মড়াখেকো শেয়াল-কুকুরের পেটে যাক। তুই এক কাজ কর বরং। বেগুনখেতে যা। বেগুন নিয়ে আয়। আমি ময়দা ছেনে পরোটা বানাচ্ছি। লুচি করতে হলে রাত পুইয়ে যাবে। তার চেয়ে পরোটা ইজ ইজি। কী বলেন স্যার? কর্নেল সায় দিলেন। হালদারমশাই উৎসাহে দাঁড়ালেন। তারপর “চলুন, আমিও হাত লাগাই” বলে পা বাড়িয়েছেন এমন সময় বাইরে কাছেই শেয়াল ডেকে উঠল, “হেয়ো হোয়া হোয়া!”

একটু থমকে দাঁড়ালেন চণ্ডীবাবু ও হালদারমশাই। তারপর বেপরোয়া ভঙ্গিতে কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন। বললুম, “কর্নেল, আপনার ইচ্ছেই পূর্ণ হল তাহলে! রাত বারোটায় পরোটা আর বেগুনভাজা। খাসা। কিন্তু শেয়ালের ডাক শুনে মনে হচ্ছে আরেকজন গেস্ট আসছেন হয়তো!”

তারপরই হঠাৎ বাইরে ফান্টুর চিৎকার শোনা গেল। “মামা মামা!”

সব্বাই বেরিয়ে গেলাম। দণ্ডীবাবু হাঁক দিলেন, কী হয়েছে রে?

বেগুনখেতের দিকে হাত তুলে আবার বলল, “কাকতাড়ুয়াটা আবার নাচছে–ওই দ্যাখো।”

চমকে উঠতেই হল। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাছে, কাকতাড়ুয়া দু’হাত ছড়িয়ে নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে। দণ্ডীবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, বন্দুক! বন্দুক! বন্দুক নিয়ে আয় ফান্টু!”

অমনি কাকতাড়ুয়া পদ্যে বলে উঠল :

বেগুনখেতে কাকতাড়ুয়া
নিশুত রেতে নাচ করে
ডাকে শেয়াল কেয়া হুয়া
ভূরিভোজন আঁচ করে
দণ্ডীভায় এ কী বিচার
করবে গুলি বন্দুকে
উপকারী বন্ধুকে?

দণ্ডীবাবু সহাস্যে বললেন, “ভাণ্ডারীভায়া নাকি? আরে, এসো, এসো! সুস্বাগতম! তবে এ কেমন আসা হে? বেগুনখেতে বড্ড কাটা। জামাকাপড় আটকে ফর্দাফাই হয়ে যাবে যে!”

কবি নন্দলাল ভাণ্ডারী কাকতাড়ুয়াটির আড়াল থেকে বেরোলেন।

না, বেরোলেন বলা ভুল হচ্ছে। দেখা দিলেন। তারপরই আর্তনাদ করলেন,

“ওরে ওরে ফান্টা
সত্যিই কাটা রে
আগে কে জানত
শেয়ালের ফাঁদ তো
হয় এইরকমই
কণ্টকে জখমই
আঃ উঃ বাবা রে
বাঁচা রে বাঁচা রে

ফান্টু কাটারি এনে উদ্ধার করতে গেল তাঁকে। হালদারমশাই ক্রমাগত খি-খি-খি-খি করছিলেন। শেষে বললেন, “কী কাণ্ড! বাইগনখ্যাতখান এক্কেরে লণ্ডভণ্ড!”

বললুম, “সাবধান হালদারমশাই! আবার আপনাকে পদ্যে পেয়েছে।”

অমনি হালদারমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “না, না। কথার কথা!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *