লাফাং চু দ্রিদিম্বা রহস্য

লাফাং চু দ্রিদিম্বা রহস্য

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার সোফায় হেলান দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ সোজা হয়ে বসে চমকে-ওঠা ভঙ্গিতে বললেন, “খাইছে!”

জিজ্ঞেস করলুম, “কে কাকে খেল হালদারমশাই?”

গোয়েন্দা ভদ্রলোক উত্তেজিতভাবে বললেন, “লাফাং চু!”

“তার মানে?”

“দ্রিদিম্বা!” বলেই কাগজটা যেমন-তেমন করে দুমড়ে রেখে হালদারমশাই সটান বেরিয়ে গেলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিস্যু বোঝা গেল না।

এ-কথা ঠিকই যে, হালদারমশাই মাঝে-মাঝে বেমক্কা কিছু-কিছু উদ্ভুট্টে কাণ্ড করে ফেলেন। সেটা সম্ভবত ওঁর ছিটগ্রস্ত স্বভাবের দরুনই বটে। তা ছাড়া সব-তাতে নাক গলানোর অভ্যাসও আছে। একসময় পুলিশে চাকরি করতেন। রিটায়ার করার পর একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। কালে-ভদ্রে দু-একজন মক্কেল জোটে, অর্থাৎ’কে’ হাতে পান। সেই কেস জটিল হলে সুখ্যাত রহস্যভেদী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের এই জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে পরামর্শ নেওয়ার জন্য হাজির হন এবং ঘনঘন নস্যি নেন। এদিন সাতসকালে ওঁর আবির্ভাব দেখে অবশ্যি তেমন কিছু অনুমান করতে পারিনি। কিন্তু ওই দুর্বোধ্য দুটি শব্দ আওড়ে ওঁর আকস্মিক প্রস্থানের কারণটা কী?

“কী হল ডার্লিং? তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?”

ঘুরে দেখি এতক্ষণে ছাদের বাগান থেকে নেমে এসেছেন কর্নেল। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “লাফাং চু।”

বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “হুঁ। তো হালদারমশাই কোথায় গেলেন?”

“দ্রিদিম্বা।”

কর্নেল অট্টহাসি হেসে এগিয়ে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন। “বোঝা যাচ্ছে খবরটা কাগজেও বেরোবে, সেটা আঁচ করতে পারেননি হালদারমশাই।”

“খবর? কীসের খবর?”

মুখে কপট ভর্ৎসনার ছাপ ফুটিয়ে কর্নেল বললেন, “তুমি একজন সাংবাদিক, জয়ন্ত! সাংবাদিক হিসেবে তোমার যথেষ্ট সুনামও আছে। অথচ আমার অবাক লাগে, নিজের পেশার প্রতি তুমি একেবারে উদাসীন।”

একটু হেসে বললুম, “হঠাৎ আমাকে নিয়ে পড়লেন কেন? হালদারমশাই…”

আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, “তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক’ পত্রিকায় খবরটা বেরিয়েছে।”

“কত খবর বেরোয় কাগজে, সব খবর পড়তেই হবে, তার মানে নেই।” বলে হাত বাড়িয়ে কাগজটা টেনে নিলুম। হালদারমশাইয়ের ব্যাপারটা বোঝার জন্যই।

ষষ্ঠীচরণ কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে এনে টেবিলে রাখল। তারপর চোখে ঝিলিক তুলে চাপা স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “টিকটিকিবাবু বাথরুমে নাকি?”

“নাহ! ওঁর কফিটা বরং তুমিই গিলে ফেলো গে ষষ্ঠী।”.

ষষ্ঠী ডিটেকটিভ বলতে পারে না, কিংবা হয়তো ইচ্ছে করেই ‘টিকটিকি’ বলে। কারণ সে হালদারমশাইয়ের ভাবভঙ্গি লক্ষ করে প্রচুর আমোদ পায়। কর্নেল তার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকাতেই সে বিব্রতভাবে বলল, “খামোকা অতটা দুধ নষ্ট। আজকাল দুধের যা আকাল। টিকটিকিবাবু বেশি দুধ ছাড়া কফি খান না।”

বলে সে আমার পরামর্শমতো অতিরিক্ত দুধ-মেশানো কফির পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “ষষ্ঠী হালদারমশাইকে টিকটিকিবাবু বলে। জয়ন্ত, আশা করি টিকটিকি কথাটা জানো। পুলিশের গোয়েন্দাদের একসময় টিকটিকি বলা হত। সেটা ডিটেকটিভ শব্দটার ব্যঙ্গাত্মক বিকৃতি।”

“কিন্তু খবরটা কোথায়?”

“ছয়ের পাতায় আট নম্বর কলামের মাথায়।”

খবরটা এবার চোখে পড়ল।

.

রায়গড়ে ভৌতিক উপদ্রব

রায়গড়, ২৩ মার্চ–সম্প্রতি এখানে এক অদ্ভুত উপদ্রব শুরু হয়েছে। গভীর রাতে অনেক বাড়ির জানলায় কে বা কারা খটখট শব্দ করে ভুতুড়ে গলায় বলে, ‘লাফাং চু দ্রিদি। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজে কাউকে দেখা যায় না। এমনকি বাড়ির চারপাশে আলো জ্বললেও এই ঘটনা ঘটছে। সাহসী যুবকরা দলবেঁধে পাহারা দিয়েও এর কিনারা করতে পারেনি। পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশও এ রহস্য ফাঁস করতে ব্যর্থ হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার, ২০ মার্চ রাতে থানার বড়বাবুর কোয়ার্টারেও এই ভুতুড়ে ঘটনা ঘটেছে। তিনি রিভলভার থেকে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন। তাতেও কাজ হয়নি। তার ঘণ্টাটাক পরে ‘বনশোভা নার্সারি’র প্রোপ্রাইটর সাধুচরণ লাহার বাড়ির জানলায় ‘লাফাং চু দ্রিদিম্বা’ শোনা যায়। শ্রীলাহা এবং তার পরিবার প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রথমত উল্লেখ্য, এখানে গঙ্গার ধারে শ্মশানের কাছে যে প্রাচীন শিবমন্দির আছে, সেটি ঐতিহাসিক। রায়গড়ের রাজা কীর্তিমান রায় ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের বর্তমান সেবাইত পঞ্চানন আচার্য মহাশয়ের মতে, রায়গড়বাসীদের অনাচারে ক্রুদ্ধ দেবতা মহাদেব তার ভূতগণকে লেলিয়ে দিয়েছেন। অবিলম্বে তার তুষ্টিসাধনের জন্য মহাযজ্ঞ, বলিদানাদি পুণ্যকৃত্য আবশ্যক।

খবরটা খুঁটিয়ে পড়ার পর হাসতে হাসতে বললুম, “বোগাস! আসলে অনেক সময় কাগজের পাতা ভরার জন্য আজেবাজে বা উদ্ভট খবর দরকার হয়। যাঁরা খবর জোগাড় করেন, তাঁরাও এই কম্মটি করে থাকেন। তা ছাড়া তিলকে তাল না করলে খবর হয় না। বিশেষ করে লোকে তো মুখরোচক খবরই চায়।”

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, “খবরটা পড়ার পর মনে হচ্ছিল, হালদারমশাইয়ের আবির্ভাব আসন্ন। কারণ ক’দিন আগে উনি ফোনে দুঃখ করে বলছিলেন, কেস-টেস একেবারে পাচ্ছেন না। জীবনটা একঘেয়ে লাগছে। দেশ থেকে রহস্য-টহস্য কমে গেলে ওঁর এজেন্সিই যে তুলে দিতে হবে। ভেবে দ্যাখ জয়ন্ত, গণেশ অ্যাভিনিউয়ে তেতলার ছাদে ছোট্ট একখানা ঘরের ভাড়া পাঁচশো টাকা! হালদারমশাইয়ের মতো রিটায়ার্ড মানুষের পক্ষে কী সাঙ্ঘাতিক সমস্যা তা হলে!”

“কাজেই হালদারমশাই রায়গড়ের ট্রেন ধরতে গেলেন।” কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম, “কিন্তু উনি আপনার সঙ্গে পরামর্শ না করে অমনভাবে বেরিয়ে গেলেন, এটাই আশ্চর্য ব্যাপার।”

“একটু আগেই বলেছি, রহস্যটা যে কাগজের খবর হবে সেটা আঁচ করতে পারেননি, কর্নেল অভ্যাসমতো হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। “হু, তুমি ঠিকই বলেছ। ওঁর হঠাৎ চলে যাওয়াটা আমাকেও অবাক করেছে।”

“কিন্তু কর্নেল, তা-ই বা আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন? এমন হতে পারে, হালদারমশাই নেহাত আড্ডা দিতেই এসেছিলেন। খবরটা পড়েই রহস্যের টানে ছুটে গেলেন। ওঁর পাগলামির কথা আমরা ভালোই জানি।”

কর্নেল হাসলেন। “তুমি আসার আগেই হালদারমশাই এসেছিলেন কি না?”

“হ্যাঁ। কিন্তু ওঁর মধ্যে কোনো উত্তেজনা দেখিনি।”

“তুমি লক্ষ করোনি, ডার্লিং! উনি এসেই ষষ্ঠীকে ছাদে পাঠিয়েছিলেন আমাকে খবর দিতে। নিজেই যেতে পারতেন। যাননি, তার কারণ তোমার জানা উচিত। তুমিও এসে সোজা ছাদে চলে যেতে। কিন্তু যাওনি।”

“ছাদের দরজায় কী সব সাঙ্ঘাতিক ক্যাকটাস রেখেছেন যে!”

“হুঁ। অ্যাপোরোক্যাকটাস ফ্ল্যাজেলিফর্মিস। এই সিরিউস প্রজাতির ক্যাক্টি ব্যালকনিতে রাখার উপযুক্ত। এরা বৃষ্টি সইতে পারে না। অথচ ঠাণ্ডা পরিবেশ চাই। ভীষণ কাটায় ভরা, কতকটা অক্টোপাসের গড়ন। কিন্তু কী অসাধারণ লাল ফুল ফোটে। উঁকি মেরে দেখে এসো বরং।”

“প্লিজ কর্নেল!” বিরক্ত হয়ে বললুম, “হালদারমশাই এবং লাফাং চু দ্রিদিম্বা…”

হাত তুলে কর্নেল বললেন, “ওই ক্যাক্টিগুলো ছাদে ওঠার মুখে রেখেছি, যাতে কেউ হুট করে গিয়ে আমাকে বিরক্ত করতে না পারে। ক্যাক্টি আর অর্কিড অনেক বেশি মনোযোগ ও সেবা দাবি করে ডার্লিং!”

“এইজন্যই সেদিন এক ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, আপনার ওই কর্নেল ভদ্রলোক…”

“নিঃসঙ্কোচে বলো ডার্লিং! আজ আমার মুড খাসা। ওপালটিয়া বাসিলারিস ক্যাক্টির একটা কাটিং মেক্সিকোর সোনোরা থেকে আনিয়েছিলুম। দারুণ ফুল উপহার দিয়েছে। অবিশ্বাস্য!”

“ভদ্রমহিলার মতে, আপনি খুব ন্যাকো।”

কর্নেল হা-হা হো-হো হেসে বললেন, “ব্রিলিয়ান্ট! ভদ্রমহিলা যথার্থ বলেছেন। ন্যাকা কথাটার মানে বলো তো?”

“যে জেনেও না-জানার ভান করে।”

“হুঁ। তবে কথাটা এসেছে আরবি নেক থেকে। নেক মানে পুণ্যবান, ভালোমানুষ। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় ঢুকে বিকৃত হয়ে যায়। মানেও বদলে যায়। নেক থেকে নেকা। এ ক্ষেত্রে উচ্চারণ এবং ব্যঙ্গাত্মক অর্থবিকৃতি ঘটেছে। একা যেমন অ্যাকা।”

প্রায় আর্তনাদ করলুম, “আহ কর্নেল!”

কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। একটা নম্বর ডায়াল করে বললেন, “সুপ্রভাত রায়সায়েব! কর্নেল সরকার বলছি। …আচ্ছা, আপনার বাগানে যে একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনিয়ে দেখেছিলুম…হঁ, আপনি চমৎকার নাম দিয়েছেন কুমিণ্ড ক্যাক্টি..কী বললেন? অকালকুষ্মাণ্ড? হাঃ হাঃ হাঃ! এনিওয়ে, ওগুলো তো রায়গড় থেকে..বনশোভা নার্সারি? আই সি!…কী অবাক! আমি কল্পনাও করিনি আপনি রায়গড়ের ঐতিহাসিক রাজাদের বংশধর। আসলে রাজবংশধররা কুমারবাহাদুর বা প্রিন্স…হুঁ, আপনি পছন্দ করেন না তা হলে। …শুনুন, ওই অকালকুণ্ড আমার দরকার। কীভাবে…ধন্যবাদ। রাখছি।”

কর্নেল ফোন রাখার পর হাই তুলে বললুম, “কোনো এক রায়গড়ে ভূতের পেছনে দৌড়লেন এক ভদ্রলোক। এদিকে আর-এক ভদ্রলোক মনে হচ্ছে অকালকুষ্মণ্ডের পেছনে দৌড়তে চলেছেন। তবে এই যোগাযোগটা অদ্ভুত রকমের আকস্মিক।”

প্রকৃতিবিদ এতক্ষণে মাথার আঁটো-টুপি খুলে টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। বললেন, “রহস্য জিনিসটার সঙ্গে আকস্মিকতার সম্পর্ক অনিবার্য, জয়ন্ত!”

“আপনার এই অকালকুষ্মণ্ডে কোনো রহস্য আছে বুঝি?”

“আছে। প্রকৃতির চেয়ে বেশি রহস্য আর কোথায় আছে?”

“নাকি রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই সেরে নিতে চান?”

কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সোফার কাছে এগিয়ে নীচে থেকে একটা নোটবুক কুড়িয়ে বললেন, “বলেছি, তুমি হালদারমশাইকে লক্ষ করোনি। করলে চোখে পড়ত, খবরটা পড়ার পর ভদ্রলোক এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে, নোটবইটার কথা ভুলে গেছেন। সম্ভবত ওটা আমাকে দেখানোর জন্য হাতে রেখেছিলেন। কর্নেল নোটবইটার পাতা ওলটাতে থাকলেন। “তারপর আমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে কাগজ পড়ার জন্য এটা সোফায় রাখেন। এত বড় নোটবই পকেটে ঢোকানো যায় না। এটা ওঁর ডিটেকটিভ এজেন্সির নোটবই মনে হচ্ছে। যাই হোক, খবরটা পড়ার পর হঠাৎ উঠে দাঁড়ানো এবং চলে যাওয়ার সময় নোটবইটা নীচে পড়ে যায়।…হঁ! এই তো! একটা বেনামী চিঠির কপি ছাড়া এটা আর কী হতে পারে? মূল চিঠিটা…জয়ন্ত! ফোনটা ধরো।”

টেলিফোন বাজছিল। সাড়া দিতেই হালদারমশাইয়ের গলা ভেসে এল। “জয়ন্তবাবু নাকি? কর্নেলস্যারকে দিন না, প্লিজ!”

“আপনি কোত্থেকে ফোন করছেন?”

“হাওড়া স্টেশন। আর কইবেন না! নোটবই ফ্যালাইয়া আইছি।”

“ওটা আপনার কর্নেলস্যারের হাতে রয়েছে।”

“ওঁকে ফোনটা দিন! ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।”

হালদারমশাই পূর্ববঙ্গীয় ভাষাতেও কথা বলেন মাঝে-মাঝে। বিশেষ করে উত্তেজনার সময়। ফোন কর্নেলকে দিলুম। কর্নেল বললেন, “হুঁ, বলুন হালদারমশাই!…বলেন কী!…মক্কেলের নিষেধ? ঠিক আছে। সব পেশাতেই কিছু এথিক্স বা নীতি মেনে চলা হয়। আপনি ডিটেকটিভ। কাজেই…না, না! আপনার কাজ আপনি করুন।..গোপনে যোগাযোগ রাখবেন? বেশ তো!…ঠিক আছে উইশ ইউ গুড লাক!…”।

ফোন রেখে কর্নেল গম্ভীর মুখে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললুম, “কী ব্যাপার?”

কর্নেল নোটবইয়ের একটা পাতা আমার সামনে তুলে ধরলেন। হালদারমশাইয়ের হস্তাক্ষরে লেখা আছে :

২৬ মার্চ রাত বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। তার মধ্যে ত্র্যম্বক না পেলে আদরের নাতি বিশু বলিদান হবে। আবার বলা হচ্ছে, ত্র্যম্বক রেখে আসবে শ্মশানবটের গোড়ায় চৌকো পাথরটার ওপর। পুলিশকে জানালে শিবেরও সাধ্য নেই তোমাকে বাঁচায়। আর-একটা কথা। লাফাং চু দ্রিদিম্বা দিয়ে কাজ হবে না। ওই ভূতটাকে আমরা চিনি। তাকে ফঁদ পেতে ধরব। সাবধান।

পড়ার পর বললুম, “সর্বনাশ! কিডন্যাপ কেস মনে হচ্ছে যে!”

কর্নেল আস্তে বললেন, “হ্যাঁ। পঞ্চানন আচার্যের নাতি বিশুকে কারা গুম করে রেখেছে।”

“এ্যম্বক তা হলে নিশ্চয় কোনো দামি জিনিস?”

“এ্যম্বক শিবের এক নাম। তবে কথাটার মানে, যে-দেবতার তিনটে চোখ আছে।” কর্নেল নোটবইটা নিয়ে তার ইজিচেয়ারে বসলেন। “আমাদের হালদারমশাই নিজের পেশার ব্যাপারে খুব মেথডিক্যাল। ফোনে আমাকে ওঁর মক্কেলের নাম জানাতে চাইলেন না। বললেন, নিষেধ আছে। কিন্তু নোটবইয়ে নাম-ঠিকানা সবই লেখা আছে দেখছি।”

“ওঁর মক্কেল সেই শিবমন্দিরের সেবাইত পঞ্চানন আচার্য, সে তত বোঝাই যাচ্ছে!”

“নাহ জয়ন্ত!” কর্নেল একটু হাসলেন। “নাতি কিডন্যান্ড্রু হয়েছে যাঁর, তিনি মোটেও হালদারমশাইয়ের কাছে আসেননি। সম্ভবত তার জানার কথাও নয় যে, কে. কে. হালদার নামে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ আছেন। হালদারমশাইয়ের মক্কেল হলেন রায়সায়েব, যাঁর সঙ্গে একটু আগে ফোনে কথা বললুম। বালিগঞ্জ লেনের প্রমোদরঞ্জন রায়। ভদ্রলোক ইন্টারন্যাশনাল হর্টিকালচার সোসাইটির একজন মেম্বার।”

অবাক হয়ে বললুম, “ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে হয়ে গেল দেখছি!” কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন, “অবশ্য এমনও হতে পারে, রায়সাহেব তাদের রায়গড় শিবমন্দিরের সেবাইতমশাইয়ের নাতিকে সদিচ্ছাবশেই উদ্ধার করতে চেয়েছেন। হয়তো পঞ্চাননবাবুই ছুটে এসেছেন তার কাছে। তাই…” কর্নেল হঠাৎ থেমে গিয়ে হেলান দিলেন ইজিচেয়ারে। চোখ বন্ধ করে রইলেন।

“কিন্তু কর্নেল রায়সায়েব কেন হালদারমশাইকে নিজের নাম গোপন রাখতে বলবেন?” কর্নেল চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, “ঠিক, ঠিক। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।”

“রায়সায়েব কি হালদারমশাইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা জানেন?”

“না জানলেও হালদারমশাই জানিয়ে থাকবেন। তাই…” কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন।”, রায়সায়েব চান না আমি এতে নাক গলাই। তখন ফোনে বললেন, একিনোক্যাকটাস

সিনিয়ি–সেই অকালকুষ্মণ্ডের জন্য কষ্ট করে রায়গড়ে আমার যাওয়ার দরকার নেই। উনিই শিগগির পাঠিয়ে দেবেন।”

“তা হলে হালদারমশাই ওঁর অজ্ঞাতে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিলেন?”

“হুঁ।” কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হালদারমশাই খুব মেথডিক্যাল। কিন্তু বড্ড হঠকারী। বহুবার নিজেই নিজের সাঙ্ঘাতিক বিপদ ডেকে এনেছেন, তা তো তুমিও দেখেছ। লাফাং চু দ্রিদিম্বা ভৌতিক রহস্যে আমার মাথাব্যথা ছিল না। অকালকুষ্মণ্ডও আমি ঘরে বসে পেয়ে যাব। কিন্তু হালদারমশাইয়ের জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে, জয়ন্ত! এই দ্যাখো না! নিজের নোটবইটাই ফেলে গেলেন এবং স্টেশনে গিয়ে সেটার কথা খেয়াল হল। এদিকে রায়সায়েবের এমন লুকোছাপারই বা কারণ কী? তিনি তো আমার পরিচয় ভালোই জানেন। নাহ ডার্লিং! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এটা আমার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ।”

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললুম, “আপনি কি এখনই রওনা দেবেন নাকি?”

“বনশোভা নার্সারিতে আমি বারতিনেক গেছি, জয়ন্ত! প্রোপ্রাইটর সাধুচরণ লাহা আমার চেনা লোক। গঙ্গার ধারে প্রায় তিরিশ একর জমি জুড়ে ওঁর বিশাল নার্সারি। নন্দনকানন বললেই চলে। এমন নার্সারি এদেশে আর দুটি নেই। লাহাবাবু দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড আর ক্যাক্টি গ্র্যাফটিং করে নানা জায়গায় চালান দেন।”

“ঠিক আছে। উইশ ইউ গুড লাক।”

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, “তুমিও যাচ্ছ।”

“সে কী! আমাকে যে আজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে যেতে হবে।”

“চিফ রিপোর্টারকে বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দাও, মুখ্যমন্ত্রীমশাইয়ের ভাষণের চেয়ে লাফাং চু দ্রিদিম্বা রহস্য পাঠকরা বেশি খাবে। বরং ফোনটা আমাকে একবার দিও। বুঝিয়ে দেব।…”

.

দুই

রায়গড়ে পৌঁছতে প্রায় পৌনে চারটে বেজে গেল। গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো গঞ্জের গায়ে একালের ছাপ পড়েছে। নতুন-পুরোনোতে মিলে অদ্ভুত একটা চেহারা। ভিড়ভাট্টা হইচইয়ে তুলকালাম অবস্থা। আমরা একটা সাইকেলরিকশা নিলুম। বসতি এলাকা ডাইনে রেখে রিকশা যে পথে এগোল, তার দু’ধারে ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গল। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল হঠাৎ বলে উঠলেন, “রোখকে! রোখকে! শিবমন্দিরে প্রণাম করে আসি। এক মিনিট।”

রিকশাওয়ালা বলল, “বেশি দেরি করবেন না স্যার! নার্সারি থেকে আমাকে একা ফিরতে হবে। বেলা গড়িয়ে যাবে। সুনসান নিরিবিলি রাস্তা।”

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, “চোর-ছিনতাইয়ের ভয় আছে নাকি?”

রিকশাওয়ালা তুম্বো মুখে বলল, “না স্যার! ইদানীং এখানে বাবার চেলাদের খুব উপদ্রব শুরু হয়েছে।”

“তুমি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছ?”

রিকশাওয়ালা বুকে-কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, “আজ্ঞে, ঠিকমতো সেবাযত্ন না হলে বাবা রাগেন! পেখম রাগ পড়েছিল ঠাকুরমশাইয়ের গিন্নির ওপর। রাত্তিরে খিড়কির দোরের কাছে ঘাড় মটকে দিয়েছিলেন। এই তো দু’মাস আগের কথা! ডাক্তার বলল, হার্টফেল! আজকাল ডাক্তারদের এই এক কথা, হার্টফেল। তবে কেউ-কেউ বলেছিল বটে মার্ডারকেস। আমি বিশ্বাস করিনে স্যার!”

কর্নেল ভুরু কুঁচকে কথা শুনছিলেন। বললেন, “তুমি কার কথা বলছ?”

“আজ্ঞে এই মন্দিরের যে ঠাকুরমশাই আছেন, তেনার ওয়াইফ ছিলেন।”

“বুঝেছি। তা…”

“আর দেরি করবেন না স্যার! শিগগির প্রণাম করে আসুন।” কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “মন্দিরে এখন ঠাকুরমশাই আছেন তো?”

“থাকার তো কথা।”

“ওঁর বাড়িতে আর কে আছেন?”

“ওঁর নাতি বিশু। মা-বাপ মরা ছেলে স্যার! ঠাকুরমশাই মানুষ করছেন। ইস্কুলে পড়ে।”

“বিশুও নিশ্চয় আছে এখন? স্কুলের তো ছুটি হয়ে গেছে।”

রিকশাওয়ালা হাসল। “বিশুকে পাওয়া কঠিন। এই আছে তো এই নেই। কোথায়-কোথায় ঘোরে টোটো করে। তবে ছেলেটা বড্ড ভালো স্যার!”

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আচ্ছা, এই লাফাং চু দ্রিদিম্বা ব্যাপারটা..” রিকশাওয়ালা আঁতকে উঠে ফের কপালে-বুকে হাত ঠেকিয়ে বলল, “ওসব কথা বলবেন না স্যার! যান, যান! প্রণাম করে আসুন। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

রাস্তা থেকে একফালি পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে শিবমন্দিরের জরাজীর্ণ ফটক পর্যন্ত। দু’ধারে ধ্বংসস্তূপ ঢেকে রেখেছে ঝোঁপঝাড় আর কিছু উঁচু গাছ। কর্নেল যেতে যেতে চাপা স্বরে বললেন, “বোঝা গেল, বিশু কিডন্যাল্ড হওয়ার কথা এখানে এখনও সম্ভবত কেউ জানে না।”

সায় দিয়ে বললুম, “আরও একটা কথা জানা গেল, সেবাইত ভদ্রলোকের স্ত্রীর মৃত্যুটা অনেকের কাছে সন্দেহজনক।”

কর্নেল বাইনোকুলার তুলে পাখি দেখার চেষ্টা করছিলেন। বললেন, “একটা নিষেধাজ্ঞা রইল জয়ন্ত, তুমি সবসময় মুখটি বুজে থাকবে–বিশেষ করে যখন আমি কারও সঙ্গে কথা বলব।”

অভিমান চেপে বললুম, “ও কে বস!”

কর্নেল হাসলেন। “না, না। অন্যান্য কথা বলবে। শুধু এই ঘটনাসংক্রান্ত কোনো কথা বাদে। তবে যখন তুমি-আমি একা থাকব, তখন যথেচ্ছ কথা বলার বাধা নেই।”

ফটক দিয়ে ঢুকে একটা চত্বর দেখা গেল। এখানে-ওখানে দেশি ফুল-ফলের গাছ। সামনে প্রকাণ্ড শিবমন্দির। ধাপ বেয়ে উঠতে হয়। ডাইনে একতলা কয়েকটা ঘর। ঘরগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। জুতো খুলে আমরা মন্দিরের দরজায় উঠে গেলুম। ভেতরটা আবছা অন্ধকার। কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করে জ্বাললেন। সেই আলোয় একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ দেখা গেল। সিঁদুরের ছোপ পড়েছে আগাগোড়া। কিছু মিইয়ে যাওয়া ফুল আর বেলপাতা পড়ে আছে। হঠাৎ কর্নেল টর্চ নিভিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “প্রণাম করো ডার্লিং! ঝটপট প্রণাম!”

উনি হাঁটু মুড়ে বসে মাথা ঠেকালে আমি অবাক হয়েছিলুম। কারণ এ যাবৎ আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে কোথাও এমন ভক্তি প্রদর্শন করতে দেখিনি। ওঁর দেখাদেখি আমাকেও মাথা ঠেকাতে হল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে দেখি, নীচের চত্বরে এক প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বাটে গড়ন। পরনে খাটো করে পরা ধুতি আর হাফ ফতুয়া। কপালে লাল তিলক। গলায় রুদ্রাক্ষমালা। খালি পা।

কর্নেল বিনীতভাবে বললেন, “আমার আন্তরিক ইচ্ছে, পুজো দিই। তা আপনিই কি এই মন্দিরের পুরোহিত?”।

“আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি!”

“বনশোভা নার্সারিতে অথবা লাহাবাবুর বাড়িতে…”

“উঁহু। গঙ্গার ধারে। আপনার গলায় সেই যন্তরটাও ঝুলছে দেখছি। কী দ্যাখেন ওই দিয়ে?”

“পাখি-টাখি দেখি। পাখি দেখতে আমার ভালো লাগে ঠাকুরমশাই!” ।

এর ঠাকুরমশাই তা হলে সেই পঞ্চানন আচার্য। মুচকি হেসে বললেন, “আমার নাতি বিশেটারও ওই নেশা। বুঝলেন? একটা টিয়াপাখি পুষেছিল। রাগ করে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিয়েছি। তাতে হতভাগার এমন রাগ যে না-খাওয়া না-দাওয়া, কোথায় উধাও। যা না যেখানে যাবি। কদিন কে খেতে দেয় দেখব’খন। আবার এই শর্মার পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই হবে।”

কর্নেল এবং তার পিছনে আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলুম চত্বরে। কর্নেল বললেন, “আপনার নাতির বয়স কত? কোন ক্লাসে পড়ে?”

ঠাকুরমশাই বললেন, “বারো-তেরো হবে। ক্লাস সিক্সে গাড়া খেয়ে পড়ে আছে। আর বলবেন না মশাই! বিশু নয়, বিচ্ছু। বুঝলেন? কী বুঝলেন?”

“বিচ্ছু।”

ঠাকুরমশাইয়ের চোখ দুটি কেমন ঢুলুঢুলু এবং মুখে অমায়িক ভাব। চোখ নাচিয়ে হেসে বললেন, “মশাইদের কি কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” কর্নেল এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বললেন, “ছোট ছেলের এই নিরিবিলি জায়গায় একা থাকতে ভালো লাগবে কেন? তাই হয়তো মাঝে-মাঝে কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি চলে যায়। আপনি খোঁজ নিচ্ছেন না কেন?”

পঞ্চানন আচার্য এবার একটু বিরক্ত হলেন। “ধুর মশাই! আত্মীয়স্বজন বলতে ওর কেউ কোথাও আছে নাকি? রায়গড়েই কারও বাড়ি গিয়ে থাকে। এবারও তা-ই আছে।”

“তা আপনি ওর পাখি খুলে দিলেন কেন?”

“অত কৈফিয়ত দিতে পারব না মশাই!”

কর্নেল পকেট থেকে পার্স বের করে বললেন, “আগামীকাল পুজো দেব। জিনিসপত্র কেনাকাটার জন্য কত অ্যাডভান্স লাগবে বলুন। আমি লাহাবাবুর নার্সারিতে আছি।”

ঠাকুরমশাই পার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছোট, না মাঝারি, না বড়পুজো?”

“আজ্ঞে?”

“ছোটপুজোর রেট পঞ্চাশ। মাঝারি পাঁচশো। বড় সাড়ে সাতশো।”

“এত তফাত কেন?”

ঠাকুরমশাই হাসলেন। “ছোটতে নিরিমিষ। মাঝারিতে কেজি দশেক, বড়তে কেজি পনেরো থেকে বিশ। পাঁঠার যা দাম বেড়েছে, আর বলবেন না মশাই! ওই তো হাড়িকাঠ দেখতে পাচ্ছেন। অবস্থা দেখুন না ঘুণ ধরে নড়বড় করছে। মাঝারি বা বড়পুজো হলে কেতোকে খবর দিতে হবে। তাকেও মজুরি দিতে হবে।”

কর্নেল পার্স থেকে দুটো দশ টাকার নোট ঠাকুরমশাইয়ের পায়ের কাছে রেখে বললেন, “ছোটই দেব। রক্তক্ত আমার ধাতে সয় না। এই রইল অ্যাডভান্স।”

ঠাকুরমশাই নোট দুটো দেখতে দেখতে বললেন, “আর-একটা চাই। পুজোসামগ্রীর বেজায় দর।”

কর্নেল আর-একটা দশ টাকার নোট রাখলেন। তারপর বললেন, “কখন আসব বলুন?”

“দাঁড়ান। পাঁজি দেখে আসি।”

টাকা তুলে নিয়ে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে হেঁটে গেলেন ঠাকুরমশাই। একতলা একটা ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। ভেতরে ঢুকে গেলেন।

চাপাস্বরে বললুম, “সত্যিই কি পুজো দেবেন নাকি?”

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, “মাঝে-মাঝে একটু ধর্মকর্ম করলে মনে শান্তি আসে ডার্লিং!”

ঠাকুরমশাই বেরিয়ে আসছিলেন। এবার চোখে চশমা। হাতে পাঁজি। বারান্দা থেকে নামার সময় একটা শূন্য পাখির খাঁচায় মাথার টোক্কর লাগল। অমনি ‘হ্যাত্তেরি’ বলে খাঁচাটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ছুঁড়ে ফেললেন।

তারপর পাঁজির পাতা ওলটাতে-ওলটাতে এগিয়ে এলেন। “হা! কালবেলা গতে ছয় ঘঃ তেত্তিরিশ মিঃ চুয়াল্লিশ সেঃ মাহেন্দ্রযোগ-আপনারা সূর্য ওঠার আগেই চলে আসুন।”

কর্নেল করজোড়ে প্রণাম করে পা বাড়িয়ে বললেন, “আচ্ছা, আপনি যে খাঁচাটা ফেলে দিলেন, আপনার নাতি এসে রাগ করবে না?”

“বয়ে গেল!” ঠাকুরমশাই বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দেখালেন। “গত সপ্তায় পাখি উড়িয়ে দিয়েছি। এ-সপ্তায় খাঁচা উড়িয়ে দিলুম। পাখি ফিরে এসে থাকবে কোথায়?” টেনে-টেনে হাসতে লাগলেন পঞ্চানন আচার্য।

“আপনার নাতি চলে গেল কবে?”

“আজ রোববার। বেতবার ইস্কুল থেকে বিকেলে এসে বইখাতা রেখে চলে গেল।”

“বলে যায়নি কোথায় যাচ্ছে?”

“বলল, কেতো ওর পাখি দেখতে পেয়েছে। ধরতে যাচ্ছে।”

“কেতে কে?”

“আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এক কোপে একশো পাঁঠা কাটে মশাই! বড়পুজো দিলে দেখতেন!”

রিকশাওয়ালাকে দেখা গেল ফটকের বাইরে। মুখে তিতিবিরক্ত ভাব। ডাকল, “বড্ড লেট হয়ে গেল স্যার! এমন করলে চলে? এতক্ষণ ফিরে গিয়ে আরও কয়েক খেপ পেসেঞ্জার টানতুম ইস্টিশনে।”

ঠাকুরমশাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে আমরা গিয়ে রিকশায় উঠলুম। রিকশাওয়ালা গজগজ করতে থাকল। “পাঁচুঠাকুরের পাল্লায় পড়তে আছে? সবসময় ভাং-এর নেশায় চুর হয়ে থাকেন। কিন্তু পুজো দিতে চাইলেই টনটনে হুশ। শুনেছি, রায়রাজাদের যখের ধন আগলাচ্ছেন সাতপুরুষ ধরে। তবু টাকার লোভ গেল না!”

কর্নেল বললেন, “বলো কী! যখের ধন?”

রিকশাওয়ালা প্যাডেলে পায়ের চাপ দিয়ে বলল, “আজ্ঞে স্যার, আপনারা শিক্ষিত লোক। আপনাদের কি অজানা আছে? শিবঠাকুরের মাথায় থাকেন সাপ। সেই সাপের মাথায় আছে এক মণি। সাতরাজার ধন কি না বলুন স্যার?”

“এই মন্দিরের শিবের মাথায় তো সাপ দেখলুম না হে! ন্যাড়া শিবলিঙ্গ আছে বটে। সাপ তো নেই।”

রিকশাওয়ালা দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলল, “আছে। ছিল। কে দেখা পায়, কে পায় না। আর মণির কথা যদি বলেন, তা-ও আছে। ছিল। যে জানার সে ঠিকই জানে।”

“কে সে?”

“পাঁচুঠাকুর। আবার কে!”

ডাইনে গঙ্গা দেখা গেল এতক্ষণে। সামনে কিছুটা দূর বনশোভা নার্সারির গেট। দেওয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। রিকশাওয়ালা রায়রাজাদের গল্প শোনাচ্ছিল। এসব গল্পের কাঠামো দেখেছি একইরকম। ধার্মিক রাজার সামনে সশরীরে দেবতার আবির্ভাব, পুজোর নির্দেশ, বর দান এবং একটি মন্দির নির্মাণ। এই গল্পে দেবতা নিজের মাথার সাপের মণিটিও দান করেছিলেন রায়রাজাকে।

ফিসফিস করে কর্নেলকে বললুম, “এ্যম্বক!”

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালেন শুধু।

নার্সারির গেটে আমরা রিকশা থেকে নামতেই কে ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যালো, কর্নেল সরকার!”

কালো তাগড়াই চেহারা, থুতনিতে দাড়ি, পরনে লাল শার্ট, জিনস আর পায়ে গামবুট, পিঠে সম্ভবত কীটনাশকের খুদে ট্যাঙ্ক বাঁধা, হাতে স্প্রের নল। এক ভদ্রলোক ফুলের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। কর্নেল তাকে সম্ভাষণ করে বললেন, “হ্যালো মিঃ বাগ! কেমন আছেন? আপনার কর্তাবাবু কোথায়?”

মিঃ বাগ মুচকি হেসে বললেন, “সাধুদা ভূতের ভয়ে বাড়ি থেকে নার্সারিতে আসছেন না। কাগজে খবর পড়েননি? আজই তত বেরিয়েছে। এনি ওয়ে, ওয়েলকাম! মালিক নেই তো কী হয়েছে? নোকর আপনার সেবার জন্য হাজির।”

কর্নেল বললেন, “আমার কয়েকটা একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনিয়ে চাই। রায়সায়েবের বাগানে দেখে দৌড়ে এসেছি।”

মিঃ বাগকে হঠাৎ যেন চমকে উঠতে দেখলুম। নাকি আমার চোখের ভুল? তখনই অবশ্য সহাস্যে বললেন, “আসুন। আসুন। সে হবে ‘খন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বিশ্রাম করুন।…”

.

তিন

নার্সারির একটেরে গঙ্গার ধারে বাংলোধাঁচের সুন্দর একটা বাড়ি। ম্যানেজার অরিন্দম বাগ একা থাকেন সেখানে। ভদ্রলোক একজন হর্টিকালচার-বিশেষজ্ঞ। রায়সায়েবের সুপারিশে সাধুবাবু ওঁকে বছর দেড়েক আগে বহাল করেছেন। সাধুবাবু তাই এখন রাতে রায়গড়ের বাড়িতে গিয়ে থাকেন। আগে এই বাংলোতেই থাকতেন। মান্যগণ্য অতিথি এলে তাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নার্সারির বেশির ভাগ কর্মী স্থানীয় লোক। তারা সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যান। জনাতিনেক থাকেন উলটো দিকের একতলা সারবন্দি ঘরগুলোতে। সেখানেই নার্সারির অফিস আছে। গেটের কাছাকাছি ট্রাক

ও টেম্পোর গ্যারাজ আছে। রাতের পাহারার জন্য বন্দুকধারী গার্ডও আছে জনা দুই।

কফি খেতে-খেতে কর্নেল এবং মিঃ বাগ ক্যাক্টি নিয়ে দুর্বোধ্য আলোচনা চালিয়ে গেলেন। তারপর আমার কথা বেমালুম ভুলে দু’জনে বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত ক্যাক্টি পরিদর্শনে।

বেলা পড়ে এসেছে। জানলা দিয়ে গঙ্গাদর্শনেই মন দিলুম অগত্যা। এইসময় চোখে পড়ল, কর্নেলের বাইনোকুলারটা টেবিলে পড়ে আছে। তুলে নিয়ে চোখে রাখলুম। লেন্স অ্যাডজাস্ট করার পর গঙ্গার ওপার-এপার চমৎকার খুঁটিয়ে দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, শিবমন্দিরের দিকে একটা প্রকাণ্ড বটের গাছ এবং সেটাই হয়তো সেই শ্মশানঘাট, তার তলা থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার।

গঙ্গার ধারে নিচু বাঁধে ঘন ঝোঁপঝাড়। সেখানে ঢুকে ঘাপটি পেতে বসে পড়লেন।

মিনিট পাঁচেক পরে একটা ডিঙি নৌকো এসে শ্মশানবটের কাছে ভিড়ল। ঝোঁপের আড়াল পড়ায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হালদারমশাইকে গুঁড়ি মেরে এগোতে দেখলুম সেদিকে।

একটা কিছু ঘটতে চলেছে নিশ্চয়। হালদারমশাই অদৃশ্য হয়ে গেলে বাইনোকুলার নিয়ে পুবের দরজা খুলে বের হলুম। কিন্তু নিরাশ হতে হল। এদিকের গেটে তালা আঁটা আছে। বেরনো যাবে না। সবুজ রঙের লোহার কপাট অন্তত ফুট ছয়েক উঁচু। তার মাথায় গ্রিল এবং গ্রিলের ওপর কাঁটাতার। নার্সারি না দুর্গ?

ঘরের মেঝে উঁচুতে বলে জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। তাই ঘরে ফিরে আবার বাইনোকুলারে চোখ রাখলুম।

সেই নৌকো তরতর করে চলে যাচ্ছে। কোথাও হালদারমশাইকে দেখতে পাওয়া গেল না। আলোর রং ধূসর হয়ে গেছে। সব আবছা হয়ে পড়েছে এবার।

একটু পরে কর্নেল এবং মিঃ বাগের সাড়া পেলুম। কথা বলতে বলতে দু’জনে ঘরে ঢুকলেন। মিঃ বাগ সুইচ টিপে আলো জ্বেলে বললেন, “জয়ন্তবাবু হয়তো লক্ষ করেননি আমরা মাঠেঘাটে থাকলেও সিটিলাইফের আরাম ভোগ করি।”

কর্নেল বললেন, “জয়ন্ত মাঝে-মাঝে নেচারকে কাছে পেতে চায়। আমারই সঙ্গদোষে।”

মিঃ বাগ হাসলেন, “সমস্যা হল, নেচার খুব একটা নিরাপদ কিছু নয়। এই নার্সারিতে বেজায় সাপের উৎপাত হয়। অবশ্য এখন মার্চের শেষাশেষি, সাপেদের ঘুমের শেষ প্রহর। এপ্রিলের মাঝামাঝি একবার পাশ ফিরে শশাবে। তারপর মে মাসে বেরোতে শুরু করবে। জুনে তো সাঙ্ঘাতিক অবস্থা। নার্সারি ওদের কামোফ্লেজের পক্ষে চমৎকার জায়গা। গত জুনে ক্যাক্টি ভেবে একটা-নাহ, জয়ন্তবাবু ভাবলেন ওঁকে ভয় দেখাচ্ছি!”

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, “জয়ন্ত অলরেডি ভয় পেয়ে গেছে।”

মিঃ বাগ জিভ কেটে বললেন, “সরি! আচ্ছা, আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি একটু কাজ সেরে নিইগে ততক্ষণ। আর-এক দফা কফিও বলে দিচ্ছি। কর্নেলসায়েব তো ভীষণ কফিভক্ত।”

উনি চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, “তোমাকে এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন ডার্লিং? অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কী ভাবছিলে?”

চাপা স্বরে হালদারমশাইয়ের ব্যাপারটা বললুম। নৌকোটার কথাও।

শুনে কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “হালদারমশাইয়ের কাছে রিভলভার আছে। তুমি গুলির শব্দ শুনেছ কি?”

“নাহ।”

“অবশ্য এত দূর থেকে রিভলভারের শব্দ শোনা অসম্ভব। তবে তোমার বর্ণনা শুনে মনে হল, নৌকোতে ওঁর প্রতিপক্ষের লোক-টোকই ছিল। যদি ওঁর কোনো বিপদ না হয়ে থাকে, শিগগির আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।”

“উনি কি জানেন আপনিও এখানে এসেছেন?”

“উনি আমাকে আসতে বলেছেন। বনশোভা নার্সারিতে থাকতে বলেছেন।”

“তখন স্টেশন থেকে টেলিফোনে তা-ই বলছিলেন বুঝি?”

“হুঁ।“

কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি টানছিলেন। বললুম, “এই বাগভদ্রলোককে আমার সুবিধের মনে হচ্ছে । আপনি লক্ষ করেছেন কি না জানি না, তখন গেটে ক্যাক্তির কথা বলামাত্র উনি যেন চমকে উঠলেন।”

“হুঁ।”

“একটু আগে সাপের ভয় দেখাচ্ছিলেন।”

“কী খালি হুঁ-হুঁ করছেন? খুলে আলোচনা করুন।”

কর্নেল সেই পাঁচুঠাকুরের মতো ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “আমি ছোটপুজোর কথা ভাবছি, জয়ন্ত! আগামীকাল প্রত্যূষে ছয় ঘঃ তেত্তিরিশ মিঃ চুয়াল্লিশ সেঃ মাহেন্দ্রযোগ।”

“আমি কিন্তু যাচ্ছি না।”

“ত্র্যম্বক দর্শনের পুণ্য মিস করা উচিত নয়, ডার্লিং! না, না–আমি মহাদেবের মাথার সাপের মণি-টনির কথা বলছি না। ত্র্যম্বক স্বয়ং মহাদেব।”

আমরা চাপাস্বরে কথা বলছিলুম। এই সময় একটা লোক ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। এই লোকটা আগেরবার কফি এনেছিল। কর্নেল বললেন, “এসো হরি! তোমার জন্য হা-পিত্যেশ করছিলুম!”

হরি ট্রে রেখে সেলাম ঠুকে বলল, “একটু দেরি হয়ে গেল স্যার! বাগসায়েবকে কর্তামশাই ডেকে পাঠিয়েছেন। জিপগাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন বাগসায়েব। গণেশড্রাইভারকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন। তা গণেশের এদিকে জ্বর। অগত্যা…”

“আচ্ছা হরি, এদিকের গেটের চাবি কার কাছে? একটু গঙ্গার ধারে ঘুরতে যেতুম।”

হরি জিভ কেটে বলল, “এঃ হে! একটু আগে বললে-গেটের চাবি বাগসায়েবের কাছে থাকে। তবে স্যার, আমার মতে, রাতবিরেতে না বেরনোই ভালো। অবস্থা আর আগের মতো নেই। লোকে সন্ধ্যার পর আর বাইরে বেরোচ্ছে না ইদানীং।”

“ভূতপ্রেতের ব্যাপার নাকি?”

হরি মুখে ভয়ের ছাপ ফুটিয়ে বলল, “আজ্ঞে তা-ই বটে! রাতবিরেতে জানলার বাইরে কে খোনাগলায় কী যেন বলে। আমিও শুনেছি।”

“বলো কী? কবে শুনেছ?”

“এই তো গত রাত্তিরে। ভয়ে কাউকে বলিনি।”

কর্নেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, “কিন্তু কী বলে ভূতটা?”

হরি বলার আগে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “লাফাং চু দ্রিদিম্বা?”

“তা-ই বটে, তা-ই বটে!” হরি আড়ষ্টভাবে হাসল। “তবে আমার মনে হয়, উনি বুড়িঠাকরুনের আত্মা। আজ্ঞে স্যার, অপঘাতে মরণ বলে কথা। খিড়কির দোর থেকে আর মাত্তর কয়েক-পা নামলেই মা গঙ্গা। জলে পড়লেই আত্মার উদ্ধার হত। কিন্তু বডি পড়েছিল দোরগোড়ায়।”

কর্নেল বললেন, “তুমি কার কথা বলছ হরি?”

“আজ্ঞে পাঁচুঠাকুরের গিন্নি ছিলেন তিনি। বেজায় দজ্জাল মেয়ে ছিলেন। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে। মারা গিয়েও লোককে জ্বালাচ্ছেন।”

‘অপঘাতে মরণ বলছ কেন?”

হরি সতর্ক ভঙ্গিতে চাপা স্বরে বলল, “কাউকে যেন বলবেন না স্যার! ভেতর-ভেতর কথাটা সবাই জানে। পাঁচুঠাকুর নেশাভাং করেন। রোজ একভরি আফিং তার চাই। ঠাকরুনের গয়নাগাঁটি, সোনাদানা সব লুকিয়ে বেচে দিতেন। এই নিয়ে দু’জনকার ঝামেলা। শেষে নাকি দেবতার ধন পর্যন্ত বেচতে চেয়েছিলেন পাঁচুঠাকুর। বেগতিক দেখে ঠাকরুন রাতদুপুরে দেবতার ধন লুকিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন। পাঁচুঠাকুর ঘড়েল লোক। তক্কেতক্কে ছিলেন। যে-ই ঠাকরুন বেরিয়েছেন, অমনি পেছন থেকে গলা টিপে ধরে…”

হরি ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে থেমে গেল। কর্নেল বললেন, “কার কাছে শুনেছ এসব কথা?”

“কর্তামশাই আর বাগসায়েব বলাবলি করছিলেন। দয়া করে ওঁদের যেন বলবেন না আমি এসব কথা বলেছি। গরিব মানুষ স্যার! ঘরে একদঙ্গল পুষ্যি।”

“হুঁ।” কর্নেল আস্তে বললেন, “তা হলে দেবতার ধন বেচে দিয়েছেন পাঁচুঠাকুর? কিন্তু

দেবতার ধন কিনল কে? কিনলে তো মহাপাপ। তাই না হরি?”

হরি একটু ইতস্তত করে বলল, “আজকাল পাপের ভয় কেউ করে না স্যার। আমার আবার মন্দ…”।

বাইরে কেউ হেঁড়েগলায় ডাকল, “হরি! হরি! অ্যাই হোরে!”

হরি বিরক্ত হয়ে বলল, “আমার মরারও সময় নেই। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এই হরি-হরি আর হেরে! পরে বলব স্যার!”

বলে সে বেরিয়ে গেল। বললুম, “দেবতার ধন নিশ্চয় সেই ত্র্যম্বক। কিন্তু কর্নেল, পাঁচুঠাকুর যদি তা কাউকে বেচে দিয়ে থাকেন, তাঁর কাছে তা-ই দাবি করে তার নাতিকে কিডন্যাপ করা হল কেন? উড়োচিঠিটা তাকে উদ্দেশ করেই লেখা।”

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, “একটা চিঠি নয়। দুটো।”

অবাক হয়ে বললুম, “কী করে বুঝলেন দুটো?”

“হালদারমশাই নোটবইয়ে টোকা চিঠিটা দ্বিতীয় চিঠির কপি। কারণ ওতে ‘আবার বলা হচ্ছে’ এই কথাটা আছে।” কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন। কিন্তু ঠাকুরমশাইকে দেখে মনে হল, কোনো উড়োচিঠি পাননি এবং নাতিকে গুম করে রাখা হয়েছে, তা-ও জানেন না। আমার অবাক লাগছে এটা।”

“সম্ভবত খুব ধূর্ত লোক। গভীর জলের মাছ।”

কর্নেল হাসলেন। “চিঠিতে ‘আদরের নাতি’কথাটা আছে কিন্তু! তা ছাড়া ত্র্যম্বক যে ওঁর কাছেই এখনও আছে, কিডন্যাপার যে বা যারাই হোক, তারা এতে নিঃসন্দেহ। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, রিকশাওয়ালার কথা শুনে এবং এই নার্সারিতে আসার পর বুঝতে পেরেছি, বিশু কিডন্যাপড হওয়ার কথা এখানে এখনও জানাজানি হয়নি।”

“কর্নেল! পাঁচুঠাকুর বলছিলেন, বিশু কেতোর বাড়ি যাচ্ছে বলে বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। কে কেতো সেটা জেনে নেওয়া উচিত। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার।”

“তার আগে ছোটপুজো ডার্লিং!”

বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। পুবের বারান্দায় গিয়ে বসব ভেবে দরজার কাছে গেছি, হঠাৎ আলো নিভে গেল। কর্নেল বললেন, “চুপচাপ ঘরেই বসে থাকো জয়ন্ত। ঠাকরুনের প্রেতাত্মার আবির্ভাব যে-কোনো মুহূর্তে হতে পারে।”

ঘরে-বাইরে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস না থাকলেও এমন কথা শুনে গা ছমছম করা স্বাভাবিক। নিজেকে সাহস দিতে শুকনো হাসি হাসলুম। কিন্তু চেয়ার খুঁজতে গিয়ে শোবার খাটের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। হাসতে হাসতে বললেন, “সাবধান জয়ন্ত! প্রেতাত্মা এসব চান্স মিস করে না।”

এইসময় বাইরে কে হেঁড়ে গলায় চেঁচাল, “হরি! মুকুন্দকে বল জেনারেটর চালিয়ে দিক।”

হরি ডাকছিল, “মুকুন্দবাবু! মুকুন্দবাবু।”

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর আবার চেঁচামেচি শোনা গেল। এবার অন্যরকম চিৎকার-চেঁচামেচি। তারপর বন্দুকের শব্দ। কর্নেল টর্চ জ্বেলে বেরোলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলুম। অন্ধকার নার্সারিতে এদিকে-ওদিকে টর্চের আলোর ঝলকানি এবং “চোর! চোর! চোর!” বিকট হাঁকডাক ছুটোছুটি চলেছে।

এতক্ষণে কাছাকাছি কোথাও জেনারেটর চালু হল। আলো জ্বলে উঠল। লনে আমাদের দেখে হরি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, “চোর ঢুকেছিল স্যার! একটা চটের থলে ফেলে পালিয়ে গেছে। কাটাতার কেটে পাঁচিল টপকে ঢুকেছিল। কী সাহস দেখুন!”

কর্নেল গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, “চটের থলে?…”

.

চার

নার্সারিতে চোর পড়ার খবর পেয়ে ম্যানেজার বাগসায়েব হন্তদন্ত ফিরে এসেছিলেন রায়গড় থেকে। এসেই প্রথমে গার্ডদের একচোট নিলেন। উত্তর দিকের পাঁচিলের মাথায় কাঁটাতারের বেড়া কেটে চোর ঢুকেছিল। তখনই সেখানটা জোড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। চটের থলেটা পড়ে ছিল যেখানে, সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ক্যাক্টির অজস্র টব। বাগসায়েব ফেরার আগেই কর্নেল থলেটা দেখে এসেছেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর। আস্তে বললেন, “চলো জয়ন্ত, ঘরে গিয়ে বসি।”

বাগসায়েবের হম্বিতম্বি আর ছোটাছুটি দেখে হাসি পাচ্ছিল। ঘরে ঢুকে বললুম, “একেই বলে মশা মারতে কামান দাগা। ওইটুকু একটা চটের থলে দেখে বোঝা যাচ্ছে নেহাত ছিঁচকে চোর।”

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে টানছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, “কিন্তু তারকাটা চোর!”

“আজকাল এটা কোনো ব্যাপার নয়। আগের দিনে চোরেরা সিঁদকাঠি ব্যবহার করত। এখন তারকাটা প্লাস ব্যবহার করে। হার্ডওয়্যার স্টোরে কিনতে পাওয়া যায়। দামও তত কিছু বেশি নয়।”

“থলেতে কী চুরি করতে এসেছিল বলে তোমার ধারণা?”

“দামি কোনো প্ল্যান্টের কাটিং।”

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে হাসলেন। “ঠিক ধরেছ। এই নার্সারিতে অনেক বিদেশি আর দুষ্প্রাপ্য প্ল্যান্টের কাটিং মজুত রয়েছে। তবে এত ঝুঁকি নিয়ে নার্সারিতে ঢুকেছে যে, সে ওইটুকু থলে এনেছিল কেন, এটাই প্রশ্ন।” বলে একটু চুপ করে থাকলেন কর্নেল। তারপর বললেন, “দ্বিতীয় প্রশ্ন, ওই সময়ই হঠাৎ লোডশেডিং।”

বাইরে জেনারেটরের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এতক্ষণে বন্ধ হল এবং এবার আলো লাল হতে-হতে নিভে গেল। আবার সেই গাঢ় অন্ধকার। তার আধমিনিটটাক পরে উজ্জ্বলতর হয়ে আলো জ্বলে উঠল। বললুম, “কলকাতা হলে অন্তত দু ঘণ্টার আগে কারেন্ট আসত না!”

বাগসায়েব ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে বললেন, “ভারি অদ্ভুত ব্যাপার, কর্নেল!”

কর্নেল বললেন, “মেন সুইচ কেউ অফ করে দিয়েছিল নাকি?”

মিঃ বাগ চমকে উঠে বললেন, “হাঃ!”

“চোরকে সুইচবোর্ডের তালা ভাঙতে হয়েছে তা হলে?”

“আপনি দেখেছেন বুঝতে পারছি!”

“নাহ মিঃ বাগ! আমার অনুমান।”

মিঃ বাগ অবাক হয়ে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এর আগেও নার্সারিতে চোর পড়েছে শুনেছি। তাই পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছিলেন সাধুদা। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, এবার সুইচবোর্ডের তালা ভেঙে মেন সুইচ অফ করে এবং কাঁটাতারের বেড়া কেটে চোর কী চুরি করতে এসেছিল?”

“সম্ভবত অকালকুষ্মণ্ড।”

“কী বললেন? কী বললেন? অকালকুষ্মাণ্ড?” মিঃ বাগ হো-হহা করে হেসে উঠলেন।

কর্নেল গম্ভীর মুখেই বললেন, “ওইটুকু চটের থলেতে বড় জোর ওইরকম জিনিসই চুরি করে নিয়ে যাওয়া যায়।”

“আপনার রসিকতার তুলনা হয় না।” মিঃ বাগ দামি বিদেশি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “যাই হোক, আমি বুঝতে পেরেছি, চোরের সহকারী এই নার্সারিতেই আছে।”

“বাগের ঘরে ঘোগের বাসা আর কি! সরি–বাঘের ঘরে।”

বাগসায়েব আবার একচোট হাসলেন।”একটু রিলিফ পাওয়া গেল। আপনি না থাকলে মেজাজ এখনও কতক্ষণ বিগড়ে থাকত।” বলে একটু ঝুঁকে এলেন কর্নেলের দিকে। চাপা গলায় বললেন, “আমার সন্দেহ হচ্ছে গণেশ ড্রাইভারকে। সাধুদা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। জিপ ড্রাইভিং আমার এখনও তত সড়গড় হয়নি। গণেশকে ডাকতে পাঠালুম। হরি এসে বলল, গণেশের নাকি জ্বর। ব্যাটাচ্ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দেব কি না ভাবছি।”

“তার আগে দেখা উচিত, সত্যি-সত্যি জ্বর কি না।”

“ঠিক বলেছেন। দেখে আসি।”

মিঃ বাগ তখনই বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। গঙ্গার দিকের দরজা খুলে বললেন, “এসো জয়ন্ত! এদিকের বারান্দায় বসা যাক।”

বেরিয়ে গিয়ে বললুম, “এই ঠাণ্ডার মধ্যে বসার কোনো মানে হয় না। মার্চের শেষেও এখানে দেখছি শীত চলে যায়নি।”

ছোট্ট বারান্দায় সুন্দর সব নানারকম ক্যাক্তি আর মরসুমি ফুলের টব সাজানো রয়েছে। গেট পর্যন্ত লনের দু’ধারেও পুষ্পসজ্জা, কেয়ারি করা ঝোঁপ। এদিকটাতেও যথেষ্ট আলো। বেতের চেয়ারে বসে বললুম, “আপনি মিঃ বাগকে অকালকুষ্মণ্ড বললেন। উনি কথাটা বুঝতে পারেননি।

“তুমি পেরেছ?”

 “হ্যাঁ। সকালে ফোনে রায়সায়েবের সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার মুখে শুনেছি। তা ছাড়া সেই অকালকুম্মাণ্ড নেওয়ার ছলেই আপনি এখানে এসেছেন।”

“হুঁ, একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনিয়ি।” বলে কর্নেল আঙুল তুললেন একটা টবের দিকে, “ওই দ্যাখো ডার্লিং, অকালকুষ্মণ্ড!”

বারান্দার কোনার দিকে টবে অজস্র তীক্ষ্ণ কাটায় ভরা গোলাকার একটা ক্যাক্টি দেখতে পেলুম। হঠাৎ কর্নেল উঠে গেলেন টবটার কাছে। টর্চের আলো ফেলে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। বললুম, ‘অতক্ষণ ধরে কী দেখছেন?”

“ফুল ফোটেনি কেন? আশ্চর্য তো!”

“আপনিই বলছিলেন প্রকৃতিতে প্রচুর রহস্য আছে।”

“আছে।”

কর্নেল আরও কিছুক্ষণ টর্চের আলোয় খুঁটিয়ে দেখার পর উঠে এলেন। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললুম, “কী ব্যাপার?”

“তুমি ঠিকই বলেছ। বারান্দায় ঠাণ্ডাটা বড্ড বেশি। গঙ্গার ধারে বলেই এদিকটা এত ঠাণ্ডা।”

কর্নেল কথাটা বলেই ঘরের দরজার দিকে ঘুরেছেন এবং আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি, কাছাকাছি কোথাও বিদঘুঁটে নাকিস্বরে কে বলে উঠল, “লাফাং চু দ্রিদিম্বা! লাফাং চু দ্রিদিম্বা!”

আমার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। উত্তেজিতভাবে ফিসফিসিয়ে উঠলুম, “কর্নেল!”

কর্নেল প্রায় লাফ দিয়ে বারান্দার নীচে নেমে গেলেন। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। এপাশে-ওপাশে উঁচু গাছপালার আড়ালে অন্ধকার থেকে কে যেন আমাদের দেখছে। এই অস্বস্তিকর অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসেছিল। কর্নেল এদিকে-ওদিকে টর্চের আলো ফেলছিলেন। আর প্রেতাত্মার সাড়া পাওয়া গেল না।

একটু পরে কর্নেল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মিটিমিটি হেসে বললেন, “গুড লাক, ডার্লিং! রায়গড়ে আসা তা হলে সার্থক হল বলো!”

“গলার স্বরটা আমার কিন্তু মেয়েলি বলেই মনে হল।”

“ঠাকরুনের প্রেতাত্মার গলা। কাজেই মেয়েলি হওয়া স্বাভাবিক।”

“ভূত-প্রেত বলে কিছু থাকতে পারে না।”

“কিন্তু তুমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলে!”

“আচমকা ওইরকম নাকিস্বরে কেউ উদ্ভুট্টে কীসব বলে উঠলে মানুষ একটু চমকে উঠতেই পারে।”

মিঃ বাগ ফিরে এলেন এতক্ষণে। বললেন, “গণেশের সত্যি জ্বর। তবে জ্বর গায়ে সুইচবোর্ডের তালা ভাঙাটা ওর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। গ্যারাজঘরের পাশেই ট্রান্সফর্মার আর সুইচবোর্ড আছে। সাধুদার সঙ্গে পরামর্শ না করে পুলিশে খবর দেওয়া ঠিক হবে না। আবার রায়গড় যেতে হবে। কী ঝামেলা দেখুন তো! আপনার সঙ্গে জম্পেশ করে আড্ডা দেব, তার উপায় নেই। আমার ফিরতে দেরি হলে আপনারা খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বেন। হরিকে বলে যাচ্ছি।”

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, “মিঃ বাগ! একটু আগে আমরা বাইরে কোথাও লাফাং চু দ্রিদিম্বা শুনতে পেয়েছি।”

“কী, কী?” মিঃ বাগ ভুরু কুঁচকে বললেন, “লাফাং চু দ্রিদিম্বা? আশ্চর্য ব্যাপার তো!”

“হরিও নাকি গত রাতে শুনেছে। আপনাকে বলতে সাহস পায়নি।”

মিঃ বাগ রুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন, “সাধুদাও শুনেছিলেন। এমন ভিতু লোক দেখা যায় না। ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। কদিন ধরে বাড়িতে যাগ-যজ্ঞ শান্তি-স্বস্ত্যয়নের ধুম চলেছে। যাই বলুন কর্নেল, মফস্বলের লোকেরা এখনও বড় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তবে দেখুন, আমাকে উত্যক্ত করতে এলে ভূত হোক আর যে-ই হোক, গুলি করে মারব।”

বলে বাগসায়েব জোরে বেরিয়ে গেলেন। বললুম, “ভদ্রলোক কেমন যেন গোঁয়ার-গোবিন্দ টাইপ।”

“হুঁ! তবে হর্টিকালচার বিদ্যায় এমন এক্সপার্ট আমি এ-পর্যন্ত দেখিনি। বিশেষ করে ক্যাক্টি সম্পর্কে উনি আস্ত এনসাইক্লোপিডিয়া!” কর্নেল স্বগতোক্তি করার মতো মিঃ বাগের প্রশস্তি শুরু করলেন। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। ওই বারান্দার একিনোক্যাকটাস গ্রুসিনিয়িতে কেন ফুল ফোঁটাতে ব্যর্থ হলেন? পরীক্ষা করে দেখলুম, ফুল ফোঁটানোর জন্য বেচারা তৈরি। অথচ–এক মিনিট!”

কর্নেল পুবের দরজা খুলে আবার বেরোলেন। আমি চুপচাপ বসে রইলুম। আমার প্রকৃতিবিদ বন্ধুর অজস্র বাতিকের সঙ্গে আমি পরিচিত।

প্রায় পাঁচ মিনিট পরে উনি ঘরে ফিরলেন। মুখে প্রশান্ত হাসি। বললেন, ‘ফুল না ফোঁটার কারণ বুঝতে পেরেছি। সত্যিই প্রকৃতি বড় রহস্যময়ী, ডার্লিং! শুধু বুঝতে পারছি না, এই মূল্যবান অকালকুষ্মটা কেন ওখানে হেলাফেলায় রাখা হয়েছে? কেন?” চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চুরুট ধরালেন কর্নেল। চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। আস্তে বলে উঠলেন, “মাই গুডনেস! তা হলে কি চোরের কবল থেকে বাঁচাতেই এমন হেলাফেলা করে রাখা এবং পিছনের দিকের খোলাবারান্দায়? চোর যদি বিশেষ একটা অকালকুষ্ম চুরি করতেই আসে, স্বভাবত সে ঢুকবে ক্যাক্টির বাগানে। সেখানেই সে ওটা খুঁজবে। এবং ঠিক তা-ই ঘটেছে। চোর ক্যাক্টির বাগানেই ঢুকেছিল। দৈবাৎ কারও চোখে পড়ায় থলে ফেলে পালিয়ে গেছে। অথচ যেটা সে চুরি করতে এসেছিল, সেটা এখানে থাকার খবর সে জানত না।”

না বলে পারলুম না, “ব্যাপারটা কী, খুলে বলুন তো?”

কর্নেল চোখ নাচিয়ে বললেন, “ব্যাপার যাই হোক, ভোরবেলা ছোটপুজো দিতে যাচ্ছি। বিছানা থেকে হিড়হিড় করে টেনে ওঠাব, জয়ন্ত। বাবা ভোলানাথ পুজো দেওয়ার আগেই প্রসন্ন হয়ে বর দিয়েছেন মনে হচ্ছে।”

ভাবনায় পড়ে গেলুম। ভোরে ওঠা অভ্যাস নেই। তা ছাড়া এখানে এখনও শীত চলে যায়নি। কপালে ভোগান্তি আছে মনে হচ্ছে।

রাত দশটা বেজে গেল। তখনও বাগসায়েব ফিরলেন না। হরির তাগাদায় আমরা খেতে গেলুম। খাওয়ার পর হরি আমাদের ঘরে এল বিছানা সাজাতে। মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে সে বলল, “বড্ড মশা হয়েছে ইদানীং। আর-একটা কথা বলি স্যার, রাতবিরেতে যেন বেরোবেন না।”

কর্নেল বললেন, “লাফাং চু দ্রিদিম্বা?”

হরি সেই রিকশাওয়ালার মতো কপালে হাত ঠেকিয়ে চাপাস্বরে বলল, “দোর ধন যতদিন দোর কাছে ফেরত না যাচ্ছে, ততদিন ঠাকরুনের আত্মা শান্তি পাবে না।”

“দেবতার ধন গেল কোথায়, হরি?”

হরি ফিসফিস করে বলল, “তখন বলতে-বলতে বলা হল না। আমার সন্দ স্যার, পাঁচুঠাকুর আমাদের কর্তামশাইকেই বেচে দিয়েছে।”

“কেন তোমার এ সন্দেহ হচ্ছে?”

“পাঁচুঠাকুর ইদানীং প্রায়ই কর্তামশাইয়ের কাছে আসত। দু’জনে চুপিচুপি কীসব কথাবার্তা হত। তারপর তো দিদিঠাকরুন রাতবিরেতে বাড়ির আনাচে-কানাচে এসে সাড়া দিতে লাগলেন। অমনই কর্তামশাইয়ের তরাস বাজল। ভয়ে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বুঝুন স্যার! ভয় তো সব্বাই পেয়েছে। কিন্তু কর্তামশাইয়ের ভয়টা এত বেশি কেন?” হরি একটু হাসল। “কর্তামশাইয়ের বাড়ি রোজ পুজোআচ্চা, অষ্টপ্রহর সঙ্কীর্তন চলেছে। কিন্তু পাঁচুঠাকুরকে পুজোআচ্চায় ডাকেননি। বুঝুন তা হলে!”

“দেবতার ধন জিনিসটা কী, জানো হরি?”

হরি কপালে ফের হাত ঠেকিয়ে বলল, “বাবার মাথায় থাকেন সাপ, সেই সাপের মাথার মণি।”

“তুমি দেখেছ?”

“না স্যার, শুনেছি।”

হরি চলে গেলে কর্নেল বললেন, “দরজা বন্ধ করে দাও, জয়ন্ত! আর শোনো, হরির কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন কোরো। রাতবিরেতে বাইরে বেরিও না–যা কিছু ঘটুক। সাবধান!”

কর্নেল হাসিমুখে কথাটা বললেও মনে হল, সত্যিই সাবধান করে দিচ্ছেন আমাকে। দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়লুম। নতুন জায়গায় গেলে সহজে ঘুম আসতে চায় না। তা ছাড়া একটা জমজমাট রহস্যের মধ্যে এসে পড়লে তার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করাও আমার বরাবর অভ্যাস। কর্নেলকে টেক্কা দেওয়ার ইচ্ছে মাথাচাড়া দেয়। কিন্তু এ এমন এক রহস্য, যার কোনো খেই খুঁজে পাচ্ছি না।

কখন চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছিল ঘুমের টানে। হঠাৎ ঘুমটা ছিঁড়ে গেল। বাইরে পুবের বারান্দায় কী খুটখাট শব্দ হচ্ছে। জানলা খোলা আছে। কিন্তু উঠে গিয়ে উঁকি মেরে দেখার সাহস হল না। শব্দটা থেমে গেলে চুপিচুপি ডাকলুম, “কর্নেল! কর্নেল!” কর্নেলের নাক ডাকা থামল না। তারপর ঘুম আর আসতেই চায় না।

একসময় কর্নেলের ডাকাডাকিতে চমকে উঠে দেখি, সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। কর্নেল বললেন, “উঠে পড়ো, ডার্লিং! ছোটপুজো দিতে যেতে হবে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। আর শোনো, ব্যাগট্যাগ সব গুছিয়ে নাও। আমরা সম্ভবত আর নার্সারিতে ফিরছি না।”

.

পাঁচ

বাইরে গাঢ় কুয়াশা জমে আছে। সদর গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁ দিকে একটা পোড়ো জমি পেরিয়ে গঙ্গার ধারে নিচু বাঁধে উঠলুম। তারপর গতরাতে বাইরের সেই সন্দেহজনক শব্দটার কথা বললুম কর্নেলকে। কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, “চোরের ওপর বাটপাড়ি হয়ে গেছে বলা চলে। তবে এ চোর অন্য চোর।”

“হেঁয়ালি করার অভ্যাস আপনার গেল না!”

“পুবের বারান্দার সেই অকালকুষ্মাণ্ড টবসমেত উধাও।”

“বলেন কী!”

“জানতুম, টবটা এ-রাতেই উধাও হতে পারে। তাই ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে ওদিকে বেরিয়েছিলুম। দেখলুম, টবটা নেই। যাই হোক, এখন পুজো দিতে যাচ্ছি। আর ও-সব মন্দ কথা নয়। মনকে পবিত্র রাখা উচিত, ডার্লিং!”

হালদারমশাইকে যেখানে বসে থাকতে দেখেছিলুম, তার একটু তফাতে শ্মশানবট। কর্নেলকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলুম। কিন্তু উনি গ্রাহ্য করলেন না। বটতলায় গিয়ে দেখি, অজস্র ঝুরি আর শেকড়বাকড়ে ঢাকা মাটিতে পাথরের টুকরো পড়ে আছে। কোনো পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সম্ভবত। বিশুর কিডন্যাপাররা এই বটগাছের গোড়ায় যে চৌকো পাথরে ‘ত্র্যম্বক’ রেখে আসতে বলেছে, কর্নেল সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পাথরটা বেশ লম্বা-চওড়া। কতকটা বেদির মতো দেখতে। নীচে প্রচুর ছাই পড়ে আছে। সাধুসন্ন্যাসীরা এসে খুনি জ্বেলে বসে থাকেন মনে হল।

চারদিকে কুয়াশা। বটতলায় আবছা আঁধার জমে আছে তখনও। পাথরটা দেখে কর্নেল পা বাড়িয়েছেন, হঠাৎ বটগাছটার আড়াল থেকে দুটো লোক বাঘের মতো কর্নেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি মাত্র হাত তিনেক পিছনে ছিলুম। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। কর্নেল টাল সামলে নিয়ে কী একটা করলেন কে জানে। মাত্রা দু-তিন সেকেন্ডের ঘটনা। লোক দুটো দুধারে ছিটকে পড়ে ককিয়ে উঠল। কর্নেল ডান দিকের নোকটার পিঠে একটা পা চাপিয়ে দিলেন। এবার আমার হুঁশবুদ্ধি ফিরল। বাঁ দিকের লোকটার ওপর লাফ দিতে গেলুম। সে আমাকে এক ধাক্কায় ধরাশায়ী করে নিমেষে উধাও হয়ে গেল। ভাগ্যিস, পাথর বা শেকড়ের ওপর পড়িনি। উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, কর্নেলের হাতে রিভলভার। লোকটার পিঠে পায়ের চাপ দিতেই সে আবার ককিয়ে উঠল। কর্নেল ঝুঁকে তার জামার কলার ধরে টেনে দাঁড় করালেন।

আন্দাজ বছর পঁচিশেক বয়সের এক যুবক। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে যেমন-তেমন একটা প্যান্ট আর নোংরা শার্ট। মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। গলায় একটা তক্তি। খালি পা। কারণ চপ্পল দুটো ছিটকে পড়েছে।

কর্নেল তার কানের পাশে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বললেন, “নাম কী?”

সে হাত দুটো জোড় করে বলল, “আর কখনও এমন করব না স্যার। এবারকার মতো ছেড়ে দিন।”

“নাম কী?”

“ভু-ভু-ভু…

“ভুতো?”

“হ্যাঁ স্যার। দয়া করে ছেড়ে দিন স্যার। আর কখনও এমন হবে না। নাক-কান মলছি স্যার!”

কর্নেল তাকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে চললেন। সে কাকুতি-মিনতি করতে থাকল। শিবমন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে সে ভঁা করে কেঁদে উঠল। কর্নেল বললেন, “ছোটপুজোর বদলে বড়পুজোই দেওয়া যাবে, জয়ন্ত! কী বলো? বাবা মহাদেবের সামনে একে বলি দেব। কেতো এ-সব কাজে নাকি খুব পাকা। ঠাকুরমশাই বলছিলেন, শোনোনি?”

ভুতো হেঁড়ে গলায় কেঁদে উঠল। “ওরে বাবা! কেতো আমাকে পেলে সত্যি বলিদান দেবে। স্যার! স্যার! আপনার পায়ে পড়ি স্যার!”

স্যার তাকে পায়ে পড়ার সুযোগ দিলেন না। মন্দিরের সেই ফটক দিয়ে আমরা চত্বরে ঢুকলুম। ঢুকেই দেখি, পাঁচুঠাকুর তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে পলক নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “এ ব্যাটাকে কোথায় পেলেন আপনারা?”

কর্নেল বললেন, “বড়পুজোই দেওয়া যাক তা হলে। কী বলেন ঠাকুরমশাই?”

পাঁচুঠাকুর আকৰ্ণ হেসে বললেন, “কী রে ভুতো? কেতোকে ডেকে আনি তা হলে?”

ভুতো বেজায় কান্নাকাটি জুড়ে দিল। কর্নেল বললেন, “কেতোকে খুব ভয় পায় মনে হচ্ছে?”

পাঁচুঠাকুর বললেন, “সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। কেতো ওকে পেলে এক্ষুনি বলি দেবে।”

“কেন বলুন তো?”

“কেন, তা কেতোই জানে। চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই। যাকগে, পুজোর সময় হয়ে এল। যান, গঙ্গায় চান করে আসুন। আপনিও যান মশাই!” বলে পাঁচুঠাকুর আমাকেও চোখের ইশারায় খিড়কির দরজা দেখিয়ে দিলেন।

আঁতকে উঠে বললুম, “চান করতে হবে নাকি?”

“গঙ্গায় চান না করে এলে পুজো দেবেন কী করে? নিয়ম মেনে চলতে হবে না?”

কর্নেল বললেন, “কিন্তু এই ভুতোর কী হবে? এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বটতলায় আমার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর সঙ্গে আর একজন ছিল।”

পাঁচুঠাকুর ভুতোকে বললেন, “সঙ্গে কে ছিল রে? সত্যি করে বল। তা হলে ছাড়া পাবি। নইলে খ্যাচাং করে বলিদান হয়ে যাবি। কেতো তক্কেতক্কে আছে।”

ভুতো নাক ঝেড়ে বলল, “ব্যাঙাদা ছিল।”

পাঁচুঠাকুর চোখ কপালে তুলে বললেন, “ব্যাঙা তোর মতো ছিনতাইবাজ হল কবে থেকে? সে তো লাহাবাবুর নার্সারিতে চাকরি করে। ভালো মাইনেকড়ি পায়।”

ভুতো ফেস-ফোঁস করে বলল, “তা জানি না ঠাকুরমশাই! মাইরি, বাবা মহাদেবের দিব্যি। শেষ রাত্তিরে আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিল। এই বুড়ো সায়েবের কাছে কী দামি জিনিস আছে, ছিনতাই করতে হবে। ব্যাঙাদা বলল, তুই জাপটে ধরবি। আমি জিনিসটা ছিনতাই করব।”

পাঁচুঠাকুর গুম হয়ে গেলেন এবার। আস্তে বললেন, “ক’টা বাজল। দেখুন তো মশাই?”

কর্নেল বললেন, “ছ’টা।”

“সময় আছে। আমি কেতোকে ডেকে নিয়ে আসি। এর একটা বিহিত করা দরকার। ব্যাটাকে ছাড়বেন না যেন।” বলে পাঁচুঠাকুর হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।

ভুতো আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, “ভুতো! তোমাকে ছেড়ে দেব, যদি একটা কথার সত্যি জবাব দাও।”

ভুতো কান্না থামিয়ে বলল, “বলব স্যার! বাবা মহাদেবের দিব্যি।”

“কেতোর সঙ্গে তোমার কীসের বিবাদ?”

ভুতো ফিসফিস করে বলল, “কেতো লাহাবাবুর নার্সারিতে চুরি করতে যাবে বলেছিল। আমি যেন ওর সঙ্গে থাকি। কিন্তু ব্যাঙাদা আমার মাসতুতো দাদা, স্যার। তাই ভাবলুম, ব্যাঙাদাকে দলে টানতে পারলে ভালো হয়। আমি তো জানতুম না ব্যাঙাদার সঙ্গে কেতোর আদায়-কাঁচকলায় সম্প। ব্যাঙাদাকে কথাটা বললুম। অমনই ব্যাঙাদা পইপই করে আমাকে বারণ করল। তারপর এক কেলেঙ্কারি। সেদিনই বিকেলে লাহাবাবু আর ম্যানেজারবাবু পুলিশ নিয়ে কেতোর বাড়ি হাজির। বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দিলুম। দারোগাবাবু কেতোকে থানায় নিয়ে গিয়ে ভোলাই দিয়ে ছেড়ে দিলেন। সেই থেকে কেতোর আমার ওপর রাগ।”

“গত রাতে নার্সারিতে চোর ঢুকেছিল জানো তো?”

ভুতো পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, “ব্যাঙাদা বলছিল। এতক্ষণ কেতোকে ধরতে পুলিশ বেরিয়েছে।”

“তা হলে আর কেতোর ভয় করছ কেন?”

“কিছু বলা যায় না স্যার। এবার কেতো কোথাও লুকিয়ে আছে। ঠাকুরমশাই নিশ্চয় জানেন। তাই ওকে ডাকতে গেলেন।” বলে ভুতো কর্নেলের পা ধরার চেষ্টা করল। “আমাকে ছেড়ে দিন স্যার! আর কক্ষনো এমন কাজ করব না।”

কর্নেল তাকে ছেড়ে দিতেই সে খিড়কির দরজা খুলে গুলতির বেগে উধাও হয়ে গেল। পাঁচুঠাকুরও এসে গেলেন তক্ষুনি। মুখটা বেজায় তুম্বো। সঙ্গে কেউ নেই। বললেন, “ব্যাটাটা কই?”

কর্নেল বললেন, “হাত ফসকে পালিয়ে গেল।”

পাঁচুঠাকুর প্রায় ভেংচি কেটে বললেন, “পালিয়ে গেল! আপনার হাতে পিস্তল ছিল। তবু পালিয়ে গেল? খেলনা পিস্তল নাকি?”

“ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আপনার কেতো কই?”

“নেই। ওর বউ বলল, গত রাত্তিরে বেরিয়েছে। এখনও বাড়ি ফেরেনি। মরবে হতচ্ছাড়া।”

“আপনার নাতির খবর কী?”

“আছে কোথাও।” পাঁচুঠাকুর তাড়া দিলেন, “যান। চান করে আসুন। পুজোর জোগাড় করি। আর শুনুন, ওই ম্লেচ্ছ বস্ত্র পরে থাকলে তো চলবে না। সঙ্গে ধুতি পট্টবস্ত্রাদি আছে তো?”

“তা তো নেই!”

“ঠিক আছে। কলিতে সবই জলচল। আর দশটা টাকা ধরে দেবেন।”

গতিক বুঝে বললুম, “আচ্ছা ঠাকুরমশাই, কলিতে বিনা স্নানেও কি চলবে না? যদি আর দশটা টাকা ধরে দিই?”

পাঁচুঠাকুর মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে বললেন, “তা হলে অন্তত আচমনটা করে আসুন। হ্যাঁ–হিসেবটা বুঝিয়ে দিই। পুজোর বাকি পাওনা হল গে কুড়ি। বস্ত্রের দশ। চানের বাবদ দশ। একুনে চল্লিশ।”

খিড়কির দরজার নীচেই পুরোনো ঘাট ধাপে-ধাপে নেমে গেছে গঙ্গায়। শ্যাওলা আর ঘাস গজিয়ে আছে। গঙ্গার জলে লাল আভা ছড়িয়ে রয়েছে। ওপারে কুয়াশাঢাকা গাছপালার মাথায় লালচে ছটা। কর্নেল বাইনোকুলারে ওপারটা দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “মাই গুডনেস!”

“কী হল?”

“ওটা দেখছি একটা দহ।”

“তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?”

“আছে। কারণ এই ঠাণ্ডা হিম জলে সাঁতার কেটে এপারে আসছেন,–হুঁ, আমাদের হালদারমশাই-ই বটে। পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার মানুষ। তাতে পুলিশে চাকরি করতেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না, শেষ মার্চের এই ভোরবেলা ওঁর সাঁতার কাটার ইচ্ছে হল কেন?”

এতক্ষণে দূরে কালো একটি বস্তুর নড়াচড়া দেখতে পেলুম। বাতাস বন্ধ। তাই জল নিস্তরঙ্গ। বললুম, “কী সর্বনাশ!”

“সর্বনাশের কী আছে? এর আগেও বহুবার হালদারমশাইকে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে দেখেছি। তুমিও নিশ্চয় দেখেছ। কেন? গতবার সেই কাটরার মাঠে তুলারাম দণ্ডীমশাইয়ের ফার্মে কাকতাড়ুয়া রহস্যের কথা ভুলে গেলে?”

আমি কিছু বলার আগেই পিছনে পাঁচুঠাকুরের সাড়া পেলুম। “কী? এখনও আচমন হয়নি?” কর্নেল বললেন, “সাঁতার কাটা দেখছি ঠাকুরমশাই!”

“আঁ! সাঁতার কাটা? এদিকটায় অথৈ দহ। কার সাধ্যি সাঁতার কাটে?”

“ওই দেখুন, কালো একটা মুণ্ডু।”

পাঁচুঠাকুর কিছুক্ষণ চেষ্টার পর দেখতে পেয়ে বললেন, “মরবে! একেবারে মারা পড়বে। তা মরুক গে! গঙ্গায় ডুবে মলে মোক্ষ। আপনারা আসুন। মাহেন্দ্রযোগ বেশিক্ষণ থাকে না।”

“আপনি পুজোয় বসুন। যাচ্ছি।”

পাঁচুঠাকুর চলে গেলেন। হালদারমশাই কোনাকুনি সাঁতার কেটে আসছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘাটে পৌঁছে গেলেন। উনি ধাপে উঠে বসতে দেখলুম, পরনে প্যান্টশার্ট লেপটে আছে। পায়ে জুতো নেই। মুখ থেকে জল মুছতে থাকলেন। কর্নেল ডাকলেন, “হালদারমশাই!”

“ক্কী?” বলে ঘুরলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার। তারপর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আবার চোখ দুটো মুছে তাকালেন গুলিগুলি চোখে। “ওটা কেডা? জয়ন্তবাবু না?”

বললুম, “আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না হালদারমশাই?”

“লাগলে আর কী করুম! এটু রেস্ট লই। জাস্ট আ মিনিট!”

কর্নেল বললেন, “জয়ন্ত, তোমার ব্যাগে কাপড়চোপড় আছে। বের করো। আগে তোয়ালেটা!”

হালদারমশাই উঠে এলেন ধাপ বেয়ে। তারপর কোনো কথা না বলে দৌড়ে চললেন ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। উনি উধাও হয়ে গেলে বললুম, “ওঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?”

কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে ওঁর গতিবিধি দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, “অসাধারণ! এই না হলে ডিটেকটিভ? জয়ন্ত, হালদারমশাই শ্মশানবটে প্রকৃত টিকটিকির মতোই উঠে যাচ্ছেন। আই সি! ওঁর কিটব্যাগটা লুকনো ছিল দেখছি।”

পাঁচুঠাকুর এলেন আবার। “বিনি যজমানেই পুজো হয়ে গেল। কই, চল্লিশ টাকা দিন।”

কর্নেল বললেন, “চলুন, দিচ্ছি। আমাদের এক বন্ধু আসছেন। একটু অপেক্ষা করুন।”

পাঁচুঠাকুর বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে হালদারমশাই আর-এক প্রস্থ প্যান্টশার্ট পরে কাঁধে কিটব্যাগ ঝুলিয়ে এসে পড়লেন। বাঁ হাতে ভিজে নিংড়ানো কাপড়চোপড়। পায়ে রবারের স্যান্ডেল। মুখে প্রসন্ন হাসি। বললেন, “কর্নেল স্যারের সঙ্গে কনট্যাক্ট করার সুযোগ পাইনি রাত্তিরে। ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলুম। নৌকোয় করে ওই চরে নিয়ে গিয়ে তারপর লোকটা ‘আসছি’ বলে নিপাত্তা। রাত্তিরে গঙ্গায় সাঁতার কাটার সাহস হল না। তাই দিনের আলো ফুটলে–আরে! ভদ্রলোক গেলেন কোথায়? উনিই তো আমাকে…খাইছে!”

ঘুরে দেখি, পাঁচুঠাকুর নেই। মন্দির চত্বরে ঢুকেও ওঁর পাত্তা পাওয়া গেল না। ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে।

.

ছয়

হালদারমশাই বিড়বিড় করছিলেন, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”

কর্নেলের প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই : এখানে এসে মক্কেলের নির্দেশমতো হালদারমশাই পাঁচুঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কারণ পাঁচুঠাকুরই দুটো বেনামী চিঠি পেয়ে সেই মক্কেল ভদ্রলোককে অনুরোধ করেছিলেন, নাতিকে যেন উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন। হালদারমশাইকে পাঁচুঠাকুর বলেন, তার ধারণা গঙ্গার ওই চরে তার নাতিকে আটকে রেখেছে কারা। সন্ধের মুখে নৌকোয় সেখানে পৌঁছে দেবেন হালদারমশাইকে। তবে চুপিচুপি যেতে হবে। হালদারমশাই শ্মশানবটের ওদিকে অপেক্ষা করবেন। পাঁচুঠাকুর নৌকো ভাড়া করে আনবেন। কথামত নৌকো এল। পাঁচুঠাকুরও এলেন। তারপর নৌকো চরে পৌঁছলে পাঁচুঠাকুর মাঝিদের অপেক্ষা করতে বলে হালদারমশাইকে নিয়ে চরের জঙ্গলে ঢোকেন। একখানে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ‘আসছি’ বলে পাঁচুঠাকুর চলে যান। তারপর আর তার পাত্তা নেই। নৌকোর খোঁজে এসে দ্যাখেন, নৌকোও নেই। কিটব্যাগটা কী ভেবে সঙ্গে নিয়ে যাননি। বটগাছের গুঁড়ির ওপর লুকিয়ে রেখেছিলেন। শুধু টর্চ আর রিভলভার সম্বল। সারারাত চরের জঙ্গলে কী কষ্টে যে কাটান, বলার নয়। ভোরবেলা রিভলভার আর টর্চটা নরম বালিতে পুঁতে রেখে ‘জয় মা’ বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। এখন আবার নৌকো ভাড়া করে ওই জিনিস দুটো আনতে যেতে হবে। কিন্তু কথা হল, পাঁচুঠাকুর কেন এমন অদ্ভুত ব্যবহার করলেন, গোয়েন্দা ভদ্রলোক বুঝতে পারছেন না।

হালদারমশাই কথা শেষ করে পা বাড়ালেন। “মক্কেলকে গিয়ে বলি। একটা নৌকোর ব্যবস্থা করতে হবে।”

“এক মিনিট হালদারমশাই!” কর্নেল বললেন, “আপনার নোটবই!”

“হঃ!” বলে ঘুরে হাত বাড়ালেন ডিটেকটিভ।

কর্নেল তার পিঠে আটকানো ব্যাগ থেকে নোটবইটা বের করে দিয়ে বললেন, “আমার একটা ভুল হয়েছিল। স্বীকার করা উচিত। নোটবইয়ে রায়সাহেবের নাম ঠিকানা টোকা দেখেই আমি ভুলটা করেছি। এখন বুঝতে পারছি, আপনার মক্কেল রায়গড়ের সাধুচরণ লাহা।”

“হঃ!” বলে হালদারমশাই হন্তদন্ত চলে গেলেন।

আমি এবার হালদারমশাইয়ের ভঙ্গিতে বললুম, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”

“আশ্চর্য হওয়ার সময় পরে আরও পাবে, ডার্লিং! পাঁচুঠাকুর আর এবেলার মতো ডেরায় ফিরবেন না মনে হচ্ছে। ততক্ষণে ওঁর ঘরটা একটু দেখা দরকার।” বলে কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে যে জিনিসটা বের করলেন, সেটা সম্ভবত ‘মাস্টার-কি’ ওই যন্ত্রটি দিয়ে যে-কোনো সাধারণ তালা খোলা যায়।

জানলাগুলো খোলা ছিল। ঘরের ভেতর একটা সেকেলে প্রকাণ্ড খাট। নোংরা বিছানা পাতা আছে। দেওয়াল-আলমারিতে পাঁজিপুঁথি ধর্মশাস্ত্রের বই ঠাসা। তলার তাকে স্কুলের বই, খাতাপত্তর, অনেক ডটপেন। আলমারির কাঁচ কবে ভেঙেচুরে গেছে। কোনার দিকে একটা কাঠের সিন্দুক। দড়িতে কিছু কাপড়চোপড় ঝুলছে। বিশুর প্যান্টশার্ট দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারাকে কারা কোথায় আটকে রেখেছে। এখনও অবশ্য প্রায় ৪৫ ঘণ্টা সময় আছে হাতে। এই সময়ের মধ্যে এ্যম্বক না পেলে কিডন্যাপাররা তাকে…

মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “ওঃ!”

কর্নেল বিশুর খাতাপত্তর ঘাঁটছিলেন। বললেন, “হুঁ, বড্ড মশা!”

“মশা নয়। বেচারা বিশুর কথা ভাবছি।”

কর্নেল খাতাগুলো রেখে খাটের কাছে গেলেন। বালিশের তলা খুঁজলেন, তারপর গদির তলায় হাত ভরলেন। বললেন, “তুমি একটু বারান্দায় যাও, জয়ন্ত! কাউকে আসতে দেখলে জানাবে।”

বারান্দায় গিয়ে নজর রাখলুম। কেউ কোথাও নেই। সেই পাখির খাঁচাটা তেমনই পড়ে আছে জঞ্জালের গাদায়। একটু পরে কর্নেল বেরিয়ে বললেন, “পাঁচুঠাকুর লোকটি সত্যিই বড় অদ্ভুত। হরির কথা ঠিক। উনি লাহাবাবুকে ত্র্যম্বক বেচেছিলেন। রায়সাহেবের কয়েকটা চিঠি থেকে বোঝ গেল, পূর্বপুরুষের দেবতার ধন হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে রায়সাহেব পাঁচুঠাকুরের ওপর বেজায় খাপ্পা। তারও সন্দেহ, পাঁচুঠাকুরই ওটা কাউকে বেচে দিয়েছেন। ওটা না পেলে এবার পুলিশকে জানাবেন। বেগতিক দেখে ঠাকুরমশাই অগত্যা একটা চাল চেলেছেন মনে হচ্ছে। জয়ন্ত, এখনই আমাদের লাহাবাবুর কাছে যাওয়া দরকার।”

দরজার তালাটা কোনোরকমে আটকে কর্নেল বারান্দা থেকে নামলেন। ফের বললেন, “কুইক! এখানে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না।”

রাস্তায় কিছুক্ষণ হেঁটে একটা সাইকেলরিকশা পাওয়া গেল। লাহাবাবুর বাড়ি রায়গড় বাজার এলাকা ছাড়িয়ে গঙ্গার ধারে। মাইকে সঙ্কীর্তনের ঘটা শুনেই বুঝলুম, লাহাবাবুর বাড়ি এসে গেছি। দোতলা বিরাট বাড়ি। ভেতর দিকে সঙ্কীর্তন চলেছে। গেটেই হালদারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। “আসুন! আসুন!” বলে সম্ভাষণ করে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। যেন হালদারমশাইয়েরই বাড়ি।

সোফায় ছড়ি হাতে বেঁটে প্রকাণ্ড এক ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কপালে লাল তিলক। কর্নেলকে দেখে তার মুখে একটু করুণ হাসি ফুটল। বললেন, “এ-সবই আমার পাপের ফল স্যার! আর বেশি কী বলব? ওই বদমাশ পাঁচুঠাকুরের পেটে এত কুবুদ্ধি তা কি জানতুম?”

একটু চুপ করে থেকে লাহাবাবু বললেন, “আপনার মনে পড়তে পারে। বলেছিলুম, নার্সারিতে একটা শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করব। গত শিবচতুর্দশীতে তার ভিত হয়ে গেছে। তারপর ত্র্যম্বক আমার হাতে এল। নার্সারিতে নিয়ে গিয়ে দেবতার ধন যত্ন করে রাখলুম। একটু অসাবধান হয়েছিলুম। দেবতার ধনে কে আর হাত দেবে? ব্যস! রাতারাতি চুরি গেল আলমারি থেকে। অথচ আলমারির তালাও কেউ ভাঙেনি।”

“সে রাতে আপনি নার্সারিতে ছিলেন না?”

“না। যাই হোক, রায়রাজাদের সম্পত্তি। গোপনে কিনেছিলুম। গোপনে শিবমন্দিরেই রাখতুম। চুরি গেলে তাই তা নিয়ে হইচই করিনি। হঠাৎ ওই রাতবিরেতে ভৌতিক উপদ্রব। লোকে বলত। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। সে রাতে আমার ঘরের জানলার বাইরে–দোতলায়, বুঝলেন? একেবারে মেয়েলি গলায় বলছে, লা…”।

কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন, “বলছে, লাহাবাবু আমি বিশুর দিদিমা!”

লাহাবাবু নড়ে বসলেন। “ঠিক, ঠিক। সবাই শুনছে লাফাং চু দ্রিদিম্বা। কিন্তু আমি শোনামাত্র বুঝতে পারলুম কে কী বলছে।” লাহাবাবু চোখ বুজে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করে করজোড়ে দেবতার উদ্দেশে প্রণাম করলেন।

হালদারমশাই খাইছে’ বলে একটিপ নস্যি খুঁজলেন নাকে।

কর্নেল বললেন, “তারপর কী হল বলুন?”।

লাহাবাবু বললেন, “তার পরদিন পাঁচুঠাকুর এসে হাজির। ওর হাতে দুটো বেনামী চিঠি। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ত্র্যম্বকের টাকা শোধ দেবে কিস্তিতে। ওর নাতিকে বাঁচাতে হবে। বিপদে পড়ে গেলুম। ত্র্যম্বক তো চুরি গেছে। সম্প্রতি কাগজে এই ডিটেকটিভদ্রলোকের বিজ্ঞাপন দেখেছিলুম। কাটিং রাখা ছিল। চুরি যাওয়া ত্র্যম্বক উদ্ধার করার কথা ভেবেই ওটা রেখেছিলুম। এবার ভাবলুম, ত্র্যম্বক এবং বিশু উভয়কেই ভালোয়-ভালোয় উদ্ধার করা যায় কি না। তাই চুপিচুপি গত পরশু কলকাতা চলে গেলুম। ব্যাপারটা গোপন রাখার জন্য নাম-ঠিকানা কাউকে জানাতে নিষেধ করলুম। কিন্তু তখনও কি জানি, আপনিও একজন আরও পাকা ডিটেকটিভ? এইমাত্র হালদারবাবু সব বললেন।”

হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন, “আপনারা কথা বলুন। আমি দেখি, নৌকো পাই নাকি।”

কর্নেল বললেন, “সেই চিঠি দুটো কি আপনি হালদারমশাইকে দিয়েছেন?”

হালদারমশাই বললেন, “না কর্নেল সাব! আমি শুধু শেষ চিঠিটার কপি রেখেছি। আচ্ছা চলি! উইপন হাতে না থাকলে কাজে নামা রিস্কি।”

উনি বেরিয়ে গেলে লাহাবাবু পাঞ্জাবির তলায় ফতুয়ার ভেতরকার পকেট থেকে দু’টুকরো ভজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল চিঠি দুটো খুলে পড়ার পর বললেন, “হু, শ্রীমান বিশুর খাতা থেকে ছেঁড়া কাগজ। আর হাতের লেখাটাও শ্রীমান বিশুর।”

লাহাবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, “আঁ! তা হলে দাদু-নাতি মিলে আমার কাছ থেকে ত্র্যম্বক আদায়ের ফন্দি? ওরে বাবা! ছেলেটাকে সবাই যে বিচ্ছু বলে, ঠিকই বলে দেখছি।”

“বিশু হয়তো দাদামশাইয়ের কথা শুনে মজা পেয়েই এমনটা করেছে। তার দেখা যতক্ষণ না পাচ্ছি, ততক্ষণ তাকে দোষী করা উচিত হবে না।” কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন ফের, “গত রাতে আপনার ফার্মে চোর পড়েছিল শুনেছেন নিশ্চয়?”

“হ্যাঁ। বাগ রাত্তিরে এসে সব বলল। পাঁচুঠাকুরের স্যাঙাত ওই কেতোর কাজ। বাগ পুলিশকে জানিয়েছে। এর আগেও কেতো চুরির প্ল্যান করেছিল। ক্যাক্টি বা বিদেশি প্ল্যান্টের খদ্দের প্রচুর। আজকাল সবাই গার্ডেনিংয়ের নেশায় পড়ে গেছে। কম দামে পেলে তো কথাই নেই।”

“ব্যাঙা নামে আপনার নার্সারিতে একটা লোক আছে?”

“চোর। এক নম্বর চোর। বাগের অনুরোধে ওকে তাড়াচ্ছি না।”

“বাগসায়েব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”

লাহাবাবু হাসলেন, “বাগ আমার ছেলের মতো। আমার ছেলেপুলে তো নেই। ও অবশ্য আমাকে সাধুদা বলে ডাকে। রায়সায়েবকে একজন হর্টিকালচার-এক্সপার্ট দেখে দিতে বলেছিলুম। আমার বয়স হয়েছে আর অত ছোটাছুটি করতে পারিনে। তো..” লাহাবাবু জিভ কেটে উঠে দাঁড়ালেন।”আপনাদের খালিমুখে বসিয়ে রেখেছি। একটু বসুন। গোপাল! হারাধন! কই রে সব? কেত্তনে মেতে আছে, বুঝলেন?”

উনি ডাকতে-ডাকতে ছড়ি খুটখুট করে চলে গেলেন ভেতরে। এতক্ষণে বললুম, “বিশুর হাতে লেখা চিঠি! তা হলে বিশু কিডন্যাপড হয়নি। তাই না কর্নেল?”।

কর্নেল এ-কথার জবাব না দিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, “মাথার মণি হারিয়ে সাপটা এখন পাগল হয়ে উঠেছে। দেখলেই ছোবল দেবে। শুধু বোঝা যাচ্ছে না, কেতো কেমন করে জানল এ্যম্বক কোথায় লুকননা আছে? ব্যাঙা তার শত্রু। অতএব নার্সারিতে অন্য কেউ আছে, যে কি না কেতোকে খবরটা পাচার করেছে। এটা ঠিক, সে জানত না জিনিসটা ঠিক কোনখানে কীভাবে লুকননা আছে। শুধু জানত, কোনো একটা ক্যাক্টির মধ্যেই আছে। হয়তো মণিচোরকে দৈবাৎ মণিটা লুকনোর ব্যবস্থা করতে দূর থেকে দেখেছিল। সেই ক্যাকিটা ছোট্ট থলেয় ঢোকানো যায়। অথচ তীক্ষ্ণ কাটার জন্য চটের পুরু থলে চাই।”

অবাক হয়ে বললুম, “আঁ?”

কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ!”

“তার মানে সেই অকালকুষ্মাণ্ডটা? সেটা তো আপনি…”

“চুপ। চুপ। দেওয়ালের কান আছে।”

উত্তেজনা চেপে বললুম, “ওক্কে বস।”

.

লাহাবাবুকে আশ্বাস দিয়ে কর্নেল বেরোলেন। তখন প্রায় ন’টা বেজে গেছে। কর্নেল একটা সাইকেলরিকশা ডাকলেন। বললেন, “রায়রাজাদের শিবমন্দির দর্শনে যাব।”

রিকশায় যেতে-যেতে বললুম, “আবার ওখানে কেন?”

“শ্রীমান বিশুকে খুঁজে বের করা দরকার।”

শিবমন্দির এলাকা এখনও তেমনই নিরিবিলি সুনসান। সাইকেলরিকশাটা চলে যাওয়ার পর কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে আস্তে বললেন, “পাঁচিলের এপাশে গুঁড়ি মেরে এগোতে হবে। সাবধান।”

কথা না বাড়িয়ে ওঁকে অনুসরণ করলুম। একতলা বাড়ির দিকটায় পাঁচিলে একটা প্রকাণ্ড ফোকর দেখা গেল। সেখানে গিয়ে কর্নেল উঁকি দিলেন। আমিও উঁকি দিলুম। কিছুক্ষণ পরে দেখি, পাঁচুঠাকুর এদিক-ওদিকে তাকাতে-তাকাতে মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন। হাতে একটা ছোট্ট রেকাবি। পুজোর নৈবেদ্য ছাড়া আর কী হতে পারে?

কর্নেল ফোকর দিয়ে ঢুকলেন। আমিও ঢুকলুম। তারপর পা টিপেটিপে হেঁটে মন্দিরের পেছনে চলে গেলুম দু’জনে। চত্বর থেকে মন্দিরের মেঝে প্রায় ফুট পাঁচেক উঁচু। এদিকে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি। লোহার গরাদ আছে। কর্নেল উঁকি মেরে কিছু দেখার পর চোখের ইশারায় আমাকেও দেখতে বললেন। কর্নেলের মুখে মিটিমিটি হাসি। ঘুলঘুলিতে চোখ রাখতেই দেখলুম, অন্যদিকের ঘুলঘুলি থেকে রোদ ঢুকেছে এবং স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পাতালঘরের মেঝেয় একটা যেমন-তেমন বিছানা পাতা। সেই বিছানায় বসে পাঁচুঠাকুর একটা বছর দশ-বারো বয়সের ছেলেকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন। দু’জনের চাপাস্বরে কথাবার্তাও কানে এল।

“আর আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে থাক। কাল ভোরবেলা দু’জনে তোর মাসির বাড়ি চলে যাব। দেখি না ত্র্যম্বক দেয় নাকি লাহাবাবু?”

“এখানে আমার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না দাদামশাই! বড্ড ভয় করছে।”

“আঃ! কাঁদে না। আমি তো রাত্তিরে তোর কাছে থাকি। না কি? ভয় কীসের?”

“ত্র্যম্বক লাহাবাবু যদি না দেয়?”

“না দিলে রায়সায়েব আমাকে খুন করে ফেলতেন। ওই কেতো হারামজাদাটা কী লাগিয়ে এসেছে ওঁর কানে। না হলে উনিই বা কেমন করে জানবেন?”

“তুমি আমার পাখি উড়িয়ে দিলে কেন বলো?”

“সাধে কি তোকে বোকা বলি? তুই খেয়ে নে। আমি একবার শ্মশানতলা দেখে আসি, ত্র্যম্বক রেখে গেছে নাকি।”

কর্নেল আমাকে টেনে সরিয়ে আনলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “কুইক! চলে এসো।”

দু’জনে সাবধানে সেই ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেলুম। হাঁটতে-হাঁটতে শ্মশানবটের কাছে পৌঁছে কর্নেল বললেন, “তুমি ওই ঝোঁপের আড়ালে চলে যাও।”

ঝোঁপের আড়াল থেকে দেখলুম, কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা কালো কাগজে মোড়া ছোট্ট কী একটা জিনিস গুঁড়ির নীচে সেই চৌকো পাথরটার ওপর রাখলেন। তারপর চলে এলেন আমার কাছে। কিছুক্ষণ পরে দেখি, পাঁচুঠাকুর আসছেন। চঞ্চল চাউনি। পা টিপেটিপে এসে থমকে দাঁড়ালেন। চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “জয় বাবা! জয় বাবা!” বলে করজোড়ে চৌকো পাথরটার সামনে এসে ভূমিষ্ঠ হলেন। দেখলুম, দু’চোখে জল গড়াচ্ছে।

কিন্তু যেই দু’হাতে কাগজে মোড়া জিনিসটা উনি তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়েছেন, গুঁড়ির আড়াল থেকে বাগসায়েব বেরিয়ে এলেন।”অ্যাই বিচ্ছু! দে ওটা। নইলে গুলিতে খুলি ছাদা করে দেব।”

বাগসায়েবের হাতে রিভলভার। পাঁচুঠাকুর ককিয়ে উঠে মোড়কটা ওঁর হাতে দিতে যাচ্ছেন, এমন সময় বটগাছের ডাল থেকে কে বাগসায়েবের কাঁধে পড়ল। বাগসায়েবের রিভলভার থেকে গুলি বেরিয়ে গেল। পাখিরা চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল। দু’জনে ধস্তাধস্তি চলেছে, পাঁচুঠাকুর সেই সুযোগে কেটে পড়ার তালে ছিলেন। হঠাৎ এক সুটপরা স্মার্ট চেহারার ভদ্রলোককে মন্দিরের দিক থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। পাঁচুঠাকুর তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, “রায়সায়েব! রায়সায়েব! এই নিন আপনাদের ত্র্যম্বক!”

কর্নেল বেরিয়ে গিয়ে বললেন, “হ্যাল্লো রায়সায়েব!”

রায়সায়েব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। এতক্ষণে বাগসায়েবের কাঁধে ঝাঁপিয়ে-পড়া লোকটাকে চিনতে পারলুম। আমাদের হালদারমশাই বাগসায়েবের পিঠে চেপে বসে আছেন। বললেন, “ঘুঘু দ্যাখছে, ফাঁদ দ্যাখে নাই!”

কর্নেল বললেন, “ঘুঘু নয় হালদারমশাই! টিয়ে! ওই শুনুন!”

গাছের উঁচ ডালপালার ভেতর থেকে শোনা গেল, “লাফাং চ দ্রিদিম্বা।”

হালদারমশাই ভড়কে গেলেন। অমনই তাকে উলটে দিয়ে ধরাশায়ী করে অরিন্দম বাগ ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। হালদারমশাই চেঁচিয়ে উঠলেন, “পাকড়োয় পাকড়ো!”

কর্নেল বললেন, “ছেড়ে দিন। বাগসায়েবের চাইতে লাফাং চু দ্রিদিম্বা-বলা পাখিটাকে ধরার চেষ্টা করুন।”

পাঁচুঠাকুর আকৰ্ণ হেসে বললেন, “আমার নাতি ওই বুলি শিখিয়েছিল স্যার। লাহাবাবুকে ভয় দেখিয়ে ত্র্যম্বক আদায় করতে চেয়েছিল। তবে দোষটা আমারই।”

কর্নেল বললেন, “এখন আপনি নাতিকে মন্দিরের পাতালঘর থেকে বের করে আনুন। বেচারা বড় মুষড়ে পড়েছে।”

রায়সায়েব বললেন, “এটা আমার পূর্বপুরুষের ধন, কর্নেল! একে বলে ক্যাটস আই। বৈদূর্যমণি। কেতোকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দেখি, ওকে বাঁচানো যায় কি না।”

পাঁচুঠাকুর দৌড়ে মন্দিরের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে বিশুকে বের করে আনলেন পাতালঘর থেকে। বিশু বেরিয়ে এসে শিস দিতেই টিয়াপাখিটা ওর কাঁধে এসে বসল। বিশু খিকখিক করে হেসে বলল, “লাহাবাবু খুব ভয় পেয়েছিল। ওকে ভয় দেখাতেই পাখিটাকে শিখিয়েছিলুম, ‘লাহাবাবু, আমি বিশুর দিদিমা!’ লোকে ভাবত লাফাং চু দ্রিদিম্বা।”..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *