রাজা সলোমনের আংটি
এক
জুলাই মাসের সেই সন্ধ্যাবেলায় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। কর্নেলের ড্রয়িংরুমে পাঁপরভাজা আর কফি খেতে-খেতে আড্ডাটা দারুণ জমে উঠেছিল।
তবে আড্ডার যা নিয়ম। এক কথা থেকে অন্য কথা, তা থেকে আরেক কথা–এইভাবেই চলে। এটুকু মনে পড়ছে, দাড়ি রাখার সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। রিটায়ার্ড জজসায়েব অনঙ্গমোহন হাটিই কর্নেলের দাড়ি নিয়ে কথাটা তুলেছিলেন। তারপর সেই আলোচনা এক মুখ থেকে অন্যমুখে ঘুরতে ঘুরতে কেনই বা বাদুড়ে এসে পৌঁছুল বুঝতে পারলুম না। মিঃ হাটিকে বলতে শুনলুম,–বহরমপুরে যখন আমি সেশান জাজ ছিলুম, তখন কোর্টরুমের জানালা দিয়ে দেখতে পেতুম, একটা প্রকাণ্ড গাছে অসংখ্য বাদুড় ঝুলে আছে। আচ্ছা কর্নেলসায়েব! আপনি তো বিজ্ঞ মানুষ। বাদুড় কেন উলটো হয়ে ঝুলে থাকে বলুন তো?
কর্নেলকে মুখ খোলার সুযোগ দিলেন না হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মহেন্দ্র ঘোষদস্তিদার। তিনি বললেন,–বইয়ে পড়েছিলুম, ব্রাজিলে আমাজন নদীর অববাহিকায় দুর্গম জঙ্গলে রক্তচোষা বাদুড় আছে। তাদের পাল্লায় পড়লে রক্ষা নেই। মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত চুষতে-চুষতে–
ডাক্তার তারক চক্রবর্তী তার কথার ওপর কথা চাপিয়ে দিলেন,–ভ্যাম্পায়ার! বুঝলেন? ওদের বলা হয় ভ্যাম্পায়ার। সেই সূত্রেই তো ইউরোপে ড্রাকুলার গল্প লিখেছিলেন–কে যেন?
ব্রাম স্ট্রোকার।–মিঃ হাটি বলে উঠলেন। তবে আমাদের দেশেও রক্তচোষা ডাইনিদের গল্প আছে। আমি মালদায় থাকার সময় আদিবাসীরা একজন বৃদ্ধাকে ডাইনি বলে মেরে ফেলেছিল। পুলিশ দশজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণের গণ্ডগোলে ন’জনকে খালাস দিয়েছিলুম। একজনকে ফাঁসি।
ডাঃ চক্রবর্তী চমকে উঠে বললেন,–ফাঁসি? তারপর? তারপর?
–তারপর আর কী? হাইকোর্ট আমার রায়ে সম্মতি দিয়েছিল। লোকটার ফাঁসি হয়েছিল।
মিঃ ঘোষদস্তিদার হাসতে-হাসতে বললেন,–মিঃ হাটি! আপনি যা-ই বলুন, এ কেসে গণ্ডগোল আছে। আমি আসামীর পক্ষে দাঁড়ালে বেচারা মারা পড়ত না। চার্জশিটে দশজনের যদি নাম থাকে, তাহলে
মিঃ হাটি কী বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দিয়ে ডাঃ চক্রবর্তী সকৌতুকে বললেন,–ফাঁসিতে মৃত্যুও তো অপঘাতে মৃত্যু। আর অপঘাতে মৃত্যু হলে মানুষ প্রেত হয়ে যায়। ভূতও বলতে পারেন। সেই লোকটা ভূতপ্রেত হয়ে আপনাকে জ্বালাতন করেনি তো?
মিঃ হাটি গম্ভীরমুখে বললেন,–ভূতপ্রেতে আমার কস্মিনকালে বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! আমার জজিয়তি-জীবনে ওই একবারই একজনের প্রাণদণ্ড দিয়েছিলুম। বাকি জীবনে যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই একটা অদ্ভুত ঘটনা বারবার ঘটেছে। নাঃ, স্বপ্ন নয়! প্রত্যক্ষ ঘটনা। রাতবিরেতে জানালার ওধারে-ওঃ! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
তার চাপা গম্ভীর কণ্ঠস্বরে এতক্ষণে আড্ডায় কেমন একটা গা-ছমছম করা আবেশ সঞ্চারিত হল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই সম্ভবত রহস্যের গন্ধ পেয়ে গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন,–কী দেখছিলেন স্যার?
একটা লোক। সেই ফাঁসির আসামীর মতো চেহারা। বেঁটে। কালো কুচকুচে গায়ের রং। এক মাথা ঝাকড়া কোঁকড়ানো চুল।মিঃ হাটি শ্বাস ছেড়ে বললেন : ফাঁসির হুকুম শুনে লোকটা যে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সেইরকম দৃষ্টি। আদিম হিংস্র দুটি চোখ! শুতে যাওয়ার সময় কোনও-কোনও রাত্রে ইচ্ছে করেই ভোলা জানালার বাইরে তাকাতুম! অমনই তাকে দেখতে পেতুম। তার চেয়ে সাংঘাতিক দৃশ্য, তার গলায় মোম দেওয়া সেই দড়ির ফঁস! একদিন তো আমি আমার লাইসেন্সড পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়েছিলুম। হইচই পড়ে গিয়েছিল। আমার আর্দালি রহিম বশ টর্চের আলোয় কোয়ার্টারের চৌহদ্দি তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল। কাকেও দেখতে পায়নি। তারপর বদলি হয়ে গেলুম কৃষ্ণনগর। সেখানেও কোনও-কোনও রাত্রে একই দৃশ্য!
হালদারমশাই বললেন, এখনও কি আপনি তারে দেখতে পান?
গোয়েন্দাপ্রবরকে নিরাশ করে মিঃ হাটি বললেন,–নাঃ! রিটায়ার করার পর আর তাকে দেখতে পাইনি।
মিঃ ঘোষদস্তিদার বললেন, হ্যালুসিনেশন! বলছিলুম না আপনার ওই কেসে গণ্ডগোল ছিল। আপনার অবচেতন মন নিশ্চয় ফাঁসির হুকুমের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তাই
ডাঃ চক্রবর্তী তাকে বাধা দিয়ে বললেন,–ভূতপ্রেত নিয়ে যতই জোক করি না কেন, ভূতপ্রেত আছে। বছর চল্লিশ আগের কথা। তখন আমি ডাক্তারি পড়ছি। লাশকাটা ঘরে মড়া কাটাকুটি করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, অস্থি ইত্যাদি বিষয়ে হাতেকলমে শিখতে হচ্ছে। একদিন দুপুরবেলায় পথদুর্ঘটনায় মৃত একটা লোকের টাটকা লাশ মর্গে এসেছে। সেই আমলের বিখ্যাত অ্যানাটমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আমি তার ছাত্রপ্রোফেসর চার্লস গ্রোভার পুলিশের অনুরোধে দ্রুত শবব্যবচ্ছেদের দায়িত্ব নিলেন। আমি তার প্রিয় ছাত্র। তাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আসলে এক বড়লোকের লাশ। তো ডাঃ গ্রোভার নিজে ব্যবচ্ছেদ করছেন এবং তাঁর নির্দেশমতো আমিও ছুরি চালাচ্ছি। বললে বিশ্বাস করবেন না, হঠাৎ লাশের মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিঃশব্দ হাসি। কিন্তু সে কী বীভৎস হাসি, তা বলে বোঝাতে পারব না। ডাঃ গ্রোভারের মতো মানুষও স্তম্ভিত হয়ে বুকে ক্রস আঁকলেন। তারপর লাশের মুখটা অন্যপাশে কাত করে দিলেন। কী সর্বনাশ! আবার মুখটা চিত হল। আবার সেই হাসি! নিঃশব্দে ভয়ঙ্কর হাসি। আর চোখদুটো–ওঃ!
অ্যাডভোকেট মিঃ ঘোষদস্তিদার বলে উঠলেন,–হ্যালুসিনেশন! হ্যালুসিনেশন!
সেই সময় তোরবেল বেজে উঠল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন,–ষষ্ঠী!
এদিকে যেন ডোরবেলের শব্দেই জমাটি আড্ডা নিমেষে ভণ্ডুল। ডাঃ চক্রবর্তী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ওঠা যাক। বৃষ্টিটা বেড়ে গেলে সমস্যা হবে। চেম্বারে এতক্ষণ রুগিরা এসে ভিড় করেছে।
মিঃ ঘোষদস্তিদার ঘড়ি দেখে বললেন,–এই রে! পৌনে আটটা বাজে। সাড়ে সাতটায় একজন বড়ো মক্কেল আসবার কথা ছিল। কর্নেলসায়েব! চলি। কথায়-কথায় দেরি করে ফেলেছি!
মিঃ হাটিও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,–আমার মিসেস চটে যাবেন। আটটায় তাকে সঙ্গে নিয়ে একখানে যাওয়ার কথা। চলি কর্নেলসায়েব!
ওঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পর হালদারমশাই বাঁকা হেসে চাপা স্বরে বললেন,–অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক ঠিক কইছেন। হ্যালুসিনেশন! চোখের ভুল। চৌতিরিশ বৎসর পুলিশলাইফে রাত্রে ঘুরছি। কিছু দেখি নাই।
এতক্ষণে ষষ্ঠীচরণ এক ভদ্রলোককে নিয়ে এল। বুঝলুম, তিন-তিনজন প্রকাণ্ড মানুষের ফাঁক গলিয়ে ষষ্ঠীচরণ এঁকে আনতে অসুবিধেয় পড়েছিল।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের বেশি বলেই মনে হল। পাতাচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে গায়ের রঙ। মাথায় কঁচাপাকা সিথিকরা লম্বা ঘাড় ছুঁইছুই চুল। খাড়া নাক। বসা চোয়াল চোখদুটি টানাটানা। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। পরনে ছাইরঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর অগোছাল ধুতি। তার কাঁধে একটা কাপড়ের নকশাদার ব্যাগ। বাঁ-হাতের আঙুলে একটা পলাবসানো সোনার আংটি। তিনি করজোড়ে কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন,–বসতে পারি?
কর্নেল তাকে লক্ষ করছিলেন। বললেন,–অবশ্যই।
ভদ্রলোক সোফায় বিনীতভাবে বসে বললেন, আমার নাম গোপীমোহন হাজরা। আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলুম। পেয়েছেন কি না জানি না। তবে ওই যে একটা কথা আছে, গরজ বড়ো বালাই!
আপনার চিঠি আমি পেয়েছি।-বলে কর্নেল আবার হাঁক দিলেন : কফি!
অমন একটা জমজমাট আড্ডা ভেঙে দিতেই যেন এই লোকটির আবির্ভাব! আমার একটু খারাপ লাগছিল। হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালুম। তিনি যেন আমার মনের কথা টের পেয়ে কেমন চোখে ভদ্রলোককে দেখে নিলেন এবং নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন।
গোপীমোহনবাবু আমাদের দেখে নিয়ে বললেন,–কথাবার্তা একেবারে প্রাইভেট কর্নেলসায়েব।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–আলাপ করিয়ে দিই! উনি বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ এবং প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মিঃ কে. কে. হালদার। আর এর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। দুজনই আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আমার কোনও কথা এই দুজনের কাছে গোপন থাকে না। তার চেয়ে বড়ো কথা, আপনার নিজের মুখে আপনার সমস্যার কথা এঁরা শুনলে আমার এবং আপনার দুজনকারই সুবিধে হবে। আপনি তিন-তিনটি মস্তিষ্কের সাহায্য পাবেন। তাই না?
গোপীমোহনবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনার যা অভিরুচি কর্নেলসায়েব! তবে ওই যে কথাটা বললুম। গরজ বড়ো বালাই! গ্রাম্য কথা। কিন্তু কথাটা কত খাঁটি তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই আপনার উত্তরের অপেক্ষায় বসে না থেকে এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছি। বিপদের ওপর বিপদ। ট্রেন লেট করার জন্য সন্ধ্যা সাতটায় শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছেছি। তিন ঘণ্টা লেট! ফেরার ট্রেন রাত বারোটা পঁচিশে। আর লেট না করলে পাক্কা তিন ঘণ্টার জার্নি! কী সাংঘাতিক রিস্ক নিয়ে এসেছি বুঝুন!
-বুঝলুম। ফেরার ট্রেন লেট না করলে আপনি রাত তিনটে পঁচিশে বা সাড়ে তিনটে নাগাদ স্টেশনে নামবেন। তারপর ভোরবেলা পর্যন্ত আপনাকে স্টেশনেই বসে থাকতে হবে। সম্ভবত ছোটো স্টেশন। শেষ রাত্রে নিঝুম খাঁ-খাঁ অবস্থা। আপনি প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা করবেন, এই বুঝি সেই ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা এসে আপনার সামনে দাঁড়াল!
হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। কর্নেলের কথা শেষ হতেই বলে উঠলেন,–কী কইলেন? কী কইলেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন,–প্রেতাত্মা। চলতি কথায় ভূত।
হাসতে-হাসতে বললুম,–আবার সেই ভূত?
গোপীমোহনবাবু আমার প্রতি যেন ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, –আপনারা কলকাতার মানুষ। আমাদের মতো গ্রামের মানুষদের সমস্যার কথা বুঝবেন না।
এবার গম্ভীর হয়ে বললুম,–সমস্যাটা খুলে বললে নিশ্চয়ই বুঝব। দরকার মনে করলে খবরের কাগজেও লিখব। তবে সমস্যাটা ভূতপ্রেতসংক্রান্ত হলে অন্য কথা।
গোপীমোহনবাবু তেমনই ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা কলকাতায় সারাক্ষণ ভিড়ের মধ্যে থাকেন। চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পান। রাতবিরেতে আলো জ্বলে। পাখা ঘোরে। কিন্তু গ্রামের অবস্থা এর উলটো।
–কেন, আজকাল গ্রামেও তো বিদ্যুৎ গেছে। এই তো সেদিন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা সাংবাদিকদের জানালেন, বিদ্যুৎ এত উদ্বৃত্ত যে
থামুন স্যার!–গোপীমোহনবাবু চটে গেলেন : বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হলে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের অমন অবস্থা কেন? পাখা ঘোরে, হাওয়া পাই না। পাঁচশো পাওয়ারের বালব জ্বালালেও আলো থাকে না। হ্যারিকেন জ্বালতে হয়। তার ওপর বিদ্যুতের ভূতুড়ে লুকোচুরি খেলা। এই একটুখানি ঝিলিক দিয়েই চলে গেল তো গেল। ব্যস! আর দেখা নেই। সত্যিকার ভূতের উপদ্রবের চেয়ে গ্রামের বিদ্যুৎ আরও সাংঘাতিক ভূতুড়ে। এ সব লিখবেন কাগজে? পারবেন না। লিখবেন না। কারণ এ সব কথা লিখলে কাগজে বছরে লাখ-লাখ টাকার বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সাদা দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন। এই সময় ষষ্ঠীচরণ কফি নিয়ে এল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন,–কফি খান গোপীমোহনবাবু!
গোপীমোহন হাজরা কফির কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন,–আসলে আমার সমস্যার সঙ্গে আমাদের কঁপুইহাটির বিদ্যুতের সমস্যাও জড়িয়ে গেছে। রাতবিরেতে উজ্জ্বল আলো থাকলে ব্যাটাচ্ছেলের কখনও আমার ঘরের জানালায় উঁকি মারার সাধ্য ছিল না।
কর্নেল বললেন, আপনার চিঠিতে ভূতের উপদ্রবের কথা ছিল। কিন্তু আমি তো ভূতের ওঝা নই। তাই উত্তর দেব কি না ঠিক করতে পারিনি। যাই হোক, আপনি নিজে এসে গেছেন যখন, তখন ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন। শোনা যাক। তারপর দেখব কী করতে পারি।
গোপীমোহনবাবু বললেন,–চিঠিতে তো সব কথা খুলে লেখা যায় না। তা ছাড়া ঝপুইহাটির সাবেক জমিদারবংশের কর্মচারী আমি। কর্তাবাবুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে তার কথামতো চিঠিটি লিখেছিলুম।
–আপনার কর্তাবাবুর নাম কী?
–আজ্ঞে, জয়কুমার রায়চৌধুরি। বয়স প্রায় আশি বছর হবে। কিন্তু এখনও শক্তসমর্থ মানুষ।
–আপনি কি তার বাড়িতেই থাকেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। বিয়ে-টিয়ে করিনি। কর্তাবাবুর অন্নজলে বেঁচে আছি। মাইনেও যা পাই, দিব্যি চলে যায়।
–আপনার কাজটা কী?
-বাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করা। কর্তাবাবুর জরুরি চিঠিপত্র লিখে দেওয়া। আমাকে ওঁর বাড়ির কেয়ারটেকার-কাম-প্রাইভেট সেক্রেটারিও বলতে পারেন। ওঁর জমিজমার ব্যাপারটা দেখাশুনা করে একজন। তার নাম কালীনাথ। সে এক পালোয়ান।
–কর্তাবাবুর স্ত্রী বা সন্তানাদি–
গোপীমোহনবাবু কর্নেলের কথার ওপর বললেন,–স্ত্রী বেঁচে নেই। দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বড়ো ছেলে থাকে আমেরিকায়। ছোটো ছেলে বোম্বেতে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়। কর্তাবাবু একা থাকেন। কখনও-সখনও ছেলেমেয়ে, জামাই আর নাতি-নাতনিরা আসে। তাদের পাড়াগাঁয়ে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু কর্তাবাবু পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে এক পা নড়তে চান না। বলতে গেলে, আমরাই ওঁর ফ্যামিলির লোক। আমি, কালীনাথ, ভোলা আর তার বউ শৈল–তাছাড়া আছে রান্নার ঠাকুর নকুল মুখুজ্জে। মুখুজ্জেমশাই গৃহদেবতা রুদ্রদেবের সেবায়েত।
হালদারমশাই শুনতে-শুনতে এবার ধৈর্য হারিয়ে বলে উঠলেন,–ভূতের কথাটা আগে কইয়া ফ্যালেন মশয়! ভূত আপনার কী প্রবলেম বাধাইছে, তা-ই কন।
কর্নেল, কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–গোপীমোহনবাবু ভূতটাকে ব্যাটাচ্ছেলে বলছিলেন। তার মানে সে পুরুষভূত। হা–এবার আপনি সেই ব্যাটাচ্ছেলে ভূতটার কথা বলুন!
গোপীমোহনবাবু বললেন,–ব্যাটাচ্ছেলে বলছি কি কম দুঃখে? বেঁচে থাকলে আপনি-আজ্ঞে করতুম। রাতবিরেতে আমার ঘরের জানালার ধারে এসে সে ফিসফিস করে বলে, আংটি দে! আংটি দে! কীসের আংটি, কার আংটি তা-ও তো জানি না।
–আহা, ভূতটা বেঁচে থাকতে অর্থাৎ জীবদ্দশায় কে ছিল, তাই বলুন!
–কর্তাবাবুর দূরসম্পর্কের এক ভাইপো ফেলারাম মুখুজ্জে। গতবছর এমনি বর্ষার রাত্রে কর্তাবাবু তাকে খুব বকাবকি করেছিলেন। কেন করেছিলেন তা জানি না। কর্তাবাবু এমন রাশভারী মানুষ! বেশি প্রশ্ন করলে খুব চটে যান। তো সেই রাত্রে কখন ফোরাম মুখুজ্জে বাড়ির পিছনে বটগাছের ডালে গলায় দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করেছিলেন। ভোরবেলা শৈল ব্যাপারটা দেখে চ্যাঁচামেচি করেছিল। ওঃ! সে এক বীভৎস দৃশ্য!
–ফেলারামবাবুর ভূত প্রথম কবে আপনার জানালায় এসে উঁকি মেরেছিল?
–গতমাসে। তারিখ মনে নেই। খেয়েদেয়ে এসে শুতে যাচ্ছি, হঠাৎ লোডশেডিং! বিদ্যুৎ থাকলেও যে পাখার হাওয়ায় সুখে ঘুমুব, তার জো নেই। তবে পাখা ঘুরছে দেখলেও মনের শান্তি। তো প্রচণ্ড গরম। তাই ভাবলুম, বারান্দায় মাদুর পেতে শোব। মাদুর নিয়ে বেরুতে যাচ্ছি, হঠাৎ উত্তরের জানালার ওদিকে কে ফিসফিস করে বলে উঠল, আংটি দে! আংটি দে! আংটি দে! আমরা পাড়াগাঁয়ের মানুষ। বিদ্যুৎ না হয় ক’বছর আগে এসেছে। আগে তো অন্ধকারে দিব্যি দেখতে পেতুম।
অধীর হয়ে গোন্দোপ্রবর বললেন,–ফেলারামকে জানালার ধারে দেখলেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–অন্ধকারে?
–ওই যে বললুম পাড়াগাঁয়ের মানুষ। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখলুম সেই ফেলারাম মুখুজ্জেই বটে! গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো আছে।
–তখন আপনি কী করলেন?
–তখন তো আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি। ভয়ে দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে কালীনাথকে ডাকলুম। সে সাহসী। গায়ের জোরও আছে। সে দৌড়ে এসে আমার কথা শুনেই লাঠি আর টর্চ নিয়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল। কাকেও দেখতে পেল না। সে হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিল। তার কয়েকদিন পরে রাত্রিবেলা আবার জানালার ধারে ফেলারাম! গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো। আর ফিসফিস করে সেই একই কথা : আংটি দে! আংটি দে! আংটি দে!
কর্নেল বললেন, আপনার কর্তাবাবুর এ ব্যাপারে কী বক্তব্য?
গোপীমোহনবাবু গম্ভীরমুখে বললেন,–প্রথম-প্রথম উনি আমার কথা গ্রাহ্য করেননি। একদিন উনি নিচের তলায় লাইব্রেরিঘরে বসে বই পড়ছেন। তখন রাত্রি প্রায় এগারোটা। উনি রোজ রাত্রে লাইব্রেরিতে এসে অনেক রাত্রি পর্যন্ত বই পড়ে তারপর দোতালায় শুতে যান। উনি যতক্ষণ লাইব্রেরিতে থাকেন, ততক্ষণ কালীনাথ বারান্দায় দরজার কাছে বসে থাকে। তো হঠাৎ কর্তাবাবু শুনতে পেলেন, জানালার ওধারে কে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলছে–আংটি দে! আংটি দে! আংটি দে! কর্তাবাবু তাকিয়ে দেখেন গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো সেই ফেলারাম মুখুজ্জে! কর্তাবাবু রাগী মানুষ। কালীনাথকে ডেকে বললেন, ধর তো ফেলারামকে! হতভাগা মরে গিয়েও জ্বালাচ্ছে! কালীনাথ খুঁজে হন্যে হয়ে ফিরে এসেছিল।
–তাহলে আপনি আর আপনার কর্তাবাবু ছাড়া আর কেউ ফেলারাম মুখুজ্জের ভূতকে দেখতে পায়নি?
–আজ্ঞে না। কিন্তু ক্রমে-ক্রমে ব্যাটাচ্ছেলের সাহস বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহে তিনরাত্রে তিনবার সে দেখা দিয়েছে। আংটি চেয়েছে। বুদ্ধি করে টর্চ রেখেছিলুম। টর্চ জ্বাললে কিন্তু তাকে দেখতে পাইনে। টর্চ যেই নিভিয়ে দিই, অমনি সে আংটি চায়। এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিনে। বলবেন, ওঝা ডাকিনি কেন? ডেকেছিলুম। নকুল মুখুজ্জেমশাই ধার্মিক মানুষ। শান্তিস্বস্ত্যয়ন যাগযজ্ঞ সব করেছেন। এমনকী কদিন আগে গয়ায় গিয়ে ফেলারামের পিণ্ডিও দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! ব্যাটাচ্ছেলে এখনও জ্বালাচ্ছে রাত-বিরেতে। গতরাত্রেও একই কাণ্ড। অগত্যা আপনার কাছে ছুটে আসতেই হল।
–তাহলে আমি কী করতে পারি বলে আপনার ধারণা? গোপীমোহনবাবু চাপাগলায় বললেন,–কর্তাবাবু খুলে কিছু বলছেন না। তবে উনিই কার কাছে আপনার পরিচয় পেয়ে আমাকে চিঠি লিখতে বলেছিলেন। আজ ওঁর হুকুমেই এসেছি। ওই আংটির ব্যাপারটা নিয়ে আমারও বেজায় খটকা বেধেছে।
হালদারমশাই এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন,–হঃ! খটকা আমারও বাধছে। ভূত আংটি চায় ক্যান? কর্নেলস্যার! হেভি মিস্ত্রি!
.
দুই
এর পর বরাবর যা হয়ে থাকে তা-ই হল। ‘হেভি মিস্ত্রি’-র প্রবল আকর্ষণে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে. কে. হালদার কঁপুইহাটির গোপীমোহন হাজরার সঙ্গী হলেন। গোপীমোহনবাবুর এতে আপত্তির কারণ ছিল না! বরং রাতের ট্রেনজার্নিতে এমন একজন গোয়েন্দা সঙ্গী পেয়ে তিনি খুশিই হলেন। দু’জনের মধ্যে কথা হল, গোপীমোহনবাবু শেয়ালদা স্টেশনে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হালদারমশাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। হালদারমশাই তার বাড়ি থেকে তৈরি হয়ে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।
তবে গোপীমোহনবাবু কর্নেলকেও কঁপুইহাটি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেলেন। কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে জানিয়ে দিলেন, তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছুবেন।
প্রথমে গোয়েন্দাপ্রবর, তার কিছুক্ষণ পরে গোপীমোহনবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল চোখবুজে চুপচাপ চুরুট টানছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন,–মাই গুডনেস। ঝাঁপুইহাটির জয়কুমার রায়চৌধুরির কথা আমাকে বাবুগঞ্জের হেমেন্দ্র সিংহরায় বলেছিলেন! গত বছর শীতকালে আমি হেমেনবাবুর আমন্ত্রণে বাবুগঞ্জ গিয়েছিলুম। ওখানে গঙ্গার অববাহিকায় বিস্তীর্ণ একটা জলাভূমি আছে। সেখানে শীতের সময় অসংখ্য প্রজাতির হাঁস আর সারস আসে। একটা জলটুঙ্গির অদ্ভুত নাম! ডাকিনীতলা।
বললুম,–ডাকিনীতলা? সর্বনাশ! ডাকিনী মানেই তো ডাইনি। দেখেছিলেন নাকি?
কর্নেল হাসলেন,–ডাইনিরা নাকি কামরূপ কামাখ্যা থেকে আস্ত উড়ন্ত গাছে চেপে রাতবিরেতে নানা দেশে যায়। জায়গা পছন্দ হলে সেখানেই গাছটা মূলসুদ্ধ বসিয়ে দেয়। আর সেই গাছের ডালে বসে চুল এলিয়ে বাতাসের সুরে গান গায়। সেই গাছ সে-এলাকার লোকে চিনতে পারে না! বাবুগঞ্জের লোকেরা জলাভূমির একটা জলটুঙ্গিতে গাছটাকে চিনতে পারেনি। আমার মতে, ওটা ডাইনির স্পেসশিপ বা প্লেনও বলতে পারো! হয়তো কলকজা বিগড়ে যায় বলেই ডাইনি বেচারিকে সেখানেই ল্যান্ড করতে হয়। যাই হোক, এবার ডাইনি বেচারির দুঃখটা বুঝতে চেষ্টা করো ডার্লিং! সে আসলে নির্বাসিত। দেশে ফেরার উপায় নেই। তাই সে গান গায় না। কাঁদে। বাতাসের সুরে কাঁদে। এই হল আমার সিদ্ধান্ত।
কর্নেলের কথা শুনে হেসে আমি অস্থির। বললুম,–ঠিক বলেছেন। ডাকিনীতলার ডাইনিবেচারির কান্না আপনি তাহলে শুনেছিলেন?
–শুনেছিলুম বইকী। বিস্তীর্ণ বিলে নৌকোয় চেপে পাখিদের ছবি তুলে ফিরে আসছিলুম। সঙ্গে হেমেনবাবু। তারও আমার মতো পাখিটাখির বাতিক আছে। ডাকিনীতলার জলটুঙ্গির পাশ দিয়ে আসবার সময় কুয়াশামেশানো জ্যোৎস্নায় মনে হল, কে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হেমেনবাবুকে কথাটা বললুম। উনি বললেন, হ্যাঁ। এই শব্দটা কীসের, তা বোঝা যায় না। আমি বহুবার শব্দটা শুনেছি।
–সত্যি?
–নির্ভেজাল সত্যি ডার্লিং! বড়ো রহস্যময় সেই সুরেলা কান্না। নৌকোর মাঝিরা বিড়বিড় করে ‘জয় মা জয় মা’ বলতে-বলতে নৌকোর গতি বাড়িয়ে দিল।
–আশ্চর্য! আপনি ওই রহস্যটার সমাধান করে এলেন না?
কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মিটিমিটি হেসে বললেন,–সমাধান করেছিলুম বইকী!
–কীসের শব্দ ওটা?
–বললুম তো! নির্বাসিতা ডাইনির সুর ধরে কান্না! বেহালার সুরের মতো!
–ভ্যাট! আপনি রসিকতা করছেন।
কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন,–রসিকতা নয়। ডাকিনীতলার জলটুঙ্গিটার দক্ষিণে বাবুগঞ্জ। দূরত্ব প্রায় আধ কিলোমিটার। আর ওটার পূর্বে ঝপুইহাটি। ঝাঁপুইহাটির দূরত্ব জলটুঙ্গিটা থেকে বড়োজোর তিনশো মিটার। ঝাঁপুইহাটির একটা অংশ লেজের মতো এগিয়ে এসেছে বিলের দিকে। তো হেমেনবাবুকে কথাপ্রসঙ্গে আমি সেই রহস্যময় শব্দটাকে বেহালার সুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলুম। তখন উনি বলেছিলেন, ঝাঁপুইহাটির জমিদারবংশে বরাবর গানবাজনার চর্চা ছিল। এখন ওদের বংশে যিনি আছেন, তার নাম জয়কুমার রায়চৌধুরী। এখন আর তিনি গানবাজনার চর্চা করেন না। তবে ওঁর একজন কর্মচারীকে এখনও বহাল রেখেছেন। কারণ কর্মচারীটি চমৎকার বেহালা বাজায়। হেমেনবাবুর এইসব কথা শুনে বলেছিলুম, সেই বেহালাবাদক কর্মচারী ডাকিনীতলায় রাতবিরেতে এসে বেহালা বাজান সম্ভবত। হেমেনবাবু হেসে অস্থির হয়ে বলেছিলেন, কিছু বলা যায় না। লোকটা বড্ড খেয়ালি স্বভাবের। সবসময় সঙ্গে বেহালা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
কর্নেল চুপ করলে বললুম,–তাহলে ডাকিনীতলায় শীতের রাতে সেই লোকটাই গিয়ে বেহালা বাজায়? কেন বাজায়?
কর্নেল আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। চুরুট কামড়ে ধরে চোখ বুজলেন। সুতোর মতো নীল আঁকাবাঁকা ধোঁয়া তার টাকের ওপর এলোমেলো হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল।
ফের বললুম,–লোকটার মাথায় তাহলে ছিট আছে!
কর্নেল একেবারে ধ্যানমগ্ন বেগতিক দেখে আমি উঠতে যাচ্ছি। ডোরবেল বাজল। অমনি কর্নেলের ধ্যানভঙ্গ হল। যথারীতি হাঁক দিলেন,–ষষ্ঠী!
কর্নেলের এই ড্রয়িংরুমে বাইরে থেকে ঢুকতে হলে ছোটো একটা ওয়েটিং রুমের মতো ঘর পেরিয়ে আসতে হয়। কর্নেল কোনও কাজে ব্যস্ত থাকলে ষষ্ঠীকে বলে রাখেন,–কেউ এলে ও ঘরে কিছুক্ষণ বসতে বলবি। সময়মতো আমি ডেকে নেব।
ডোরবেল বাজার কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠীচরণ ড্রয়িংরুমে ঢুকে একগাল হেসে বলল,–কী কাণ্ড দেখুন বাবামশাই! একেবারে মাথাখারাপ যাকে বলে!
কর্নেল বললেন,–সেই ভদ্রলোক এসেছিলেন?
–আজ্ঞে। ও-ঘরে উনি–
–বেহালা রেখেছিলেন। কিন্তু যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন?
–আজ্ঞে বাবামশাই! মজার লোক। দরজা খুললুম। উনি আমার পাশ কাটিয়ে ঢুকে চেয়ার থেকে নীল কাপড়ের মোড়কে ঢাকা কী একটা তুলে নিয়ে চলে গেলেন। এখন মনে হচ্ছে, ওটা বেহালাই বটে! আশ্চর্য ব্যাপার! একটা কথাও বললেন না। আমি তো হতভম্ব! পরে মনে পড়ল, প্রথমবার আসবার সময় ওটা ওঁর হাতে দেখেছিলুম।
ষষ্ঠীচরণ হাসতে-হাসতে ভেতরে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে বললুম,–গোপীমোহন হাজরা তা হলে ঝাঁপুইহাটি জমিদারবাড়ির সেই বেহালা-বাজিয়ে কর্মচারী?
কর্নেল বললেন,–গোপীমোহনবাবুর সিথিকরা লম্বা চুল দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক সম্ভবত যাত্রা-থিয়েটার বা গানবাজনা করেন। গ্রাম্য বেহালা-বাজিয়েদের ওই রকম টিপিক্যাল চেহারা হয়। হেমেনবাবুর কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বুঝেছিলুম, গোপীমোহন হাজরাই সেই বেহালা-বাজিয়ে কর্মচারী। কিন্তু ওঁর সঙ্গে বেহালা দেখিনি বলে দ্বিধায় পড়েছিলুম।
বললুম,–কিন্তু এই ভদ্রলোক শীতের রাতে ডাকিনীতলার জলটুঙ্গিতে বেহালা বাজাতে যান। কেন?
কর্নেল হাসলেন,–হয়তো ডাকিনীতলার মাহাত্ম্য বজায় রাখতে চান। রাতবিরেতে বিলে জেলেরা মাছ ধরতে যায়। তাদের মুখে-মুখে মাহাত্ম্য রটে যায় ডাকিনীর। পুজোআচ্চা হয়। মানতের পয়সাকড়ি পড়ে।
–বুঝলুম। কিন্তু ওঁর কথাবার্তা-হাভভাবে কোনও পাগলামির লক্ষণ তো দেখলুম না। দিব্যি সুস্থ মানুষ। টনটনে জ্ঞানবুদ্ধি।
–হ্যাঁ। তবে গলায় দড়ির ফাঁস এঁটে ফেলারাম মুখুজ্জের ভূত কেন ওঁকে আংটি চাইতে আসে, এটাই অদ্ভুত। দেখা যাক, হালদারমশাই কতটা এগোতে পারেন।
–আপনি কবে ঝপুইহাটি যাবেন তাহলে?
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমার কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছে, তা টের পাচ্ছি। অপেক্ষা করে থাকো! সময় হলেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।
সত্যি বলতে কী, আংটি চাইতে আসা গলায়-দড়ি ভূতটার চেয়ে জলটুঙ্গিতে ডাকিনীতলায় গোপীমোহন হাজরার রাতবিরেতে বেহালা বাজানোর ব্যাপারটা আমার কৌতূহল তীব্র করেছিল। পরদিন বিকেলে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে বসে পুলিশসূত্রে পাওয়া দুটো ডাকাতি আর তিনটে ছিনতাই কেসের খবর লিখছি, সেই সময় কর্নেলের টেলিফোন এল,–জয়ন্ত! বাড়ি ফেরার পথে আমার ডেরায় এসো!
বললুম,–ঝাঁপুইহাটিতে নতুন কিছু কি ঘটেছে?
–ফোনে কিছু বলা যাবে না। রাখছি।
তাড়াতাড়ি খবরগুলো লিখে চিফ রিপোর্টারের টেবিলে রেখে বেরিয়ে পড়লুম। তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। কাল সন্ধ্যার মতোই টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। ইলিয়ট রোডে কর্নেলের বাড়ির লনে একপাশে গাড়ি রেখে যখন তিনতলায় তার অ্যাপার্টমেন্টের ডোরবেলের সুইচ টিপলুম, তখন উত্তেজনায় আমার আঙুল কঁপছিল।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলল,–টিকটিকিবাবুর অবস্থা দেখুনগে দাদাবাবু!
সে হালদারমশাইকে আড়ালে টিকটিকিবাবু বলে। দ্রুত ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলুম, হালদারমশাই মাথার মাঝখানে একটা পট্টি বেঁধে বসে আছেন। বললুম,–কী সর্বনাশ! আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন হালদারমশাই?
হালদারমশাই বিমর্ষমুখে হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–তেমন কিছু না। কোন ব্যাটায় ঢিল ছুড়ছিল। একখান ঢিল আইয়া মাথায় পড়ল।
–কবে? কখন?
–আইজ দুপুরবেলায়। কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ছড়ায় আছে না? ঠিক দুপ্পুর বেলা/ভূত মারে ঢেলা।
গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–ভূত না। মাইনষের কাম। জমিদারবাড়িতে লাঞ্চ খাইয়া বাড়ির আশপাশ দেখতে বারাইছিলাম। গ্রামের শেষদিকটায় বাড়ি। পশ্চিমদিকে ঝোঁপ-জঙ্গল। হাঁটতে-হাঁটতে কতকদূর যাইয়া দেখি ব্যাবাক জল। আমাগো পূর্ববঙ্গের মতো বিশাল বিল। একটা ঝাকড়া গাবগাছের তলায় খাড়াইয়া ছিলাম। হঠাৎ ঢিল পড়তে থাকল। রিভলভার রেডি ছিল। কইলাম, গুলি করুম। অমনি একখান ঢিল আইয়া মাথার মধ্যিখান পড়ল। এইটুখানি ছিল। কিন্তু মাথার চামড়া কাইট্যা রক্ত পড়তে থাকল। রাগে এক রাউন্ড ফায়ার করলাম। তখন ঢিল পড়া বন্ধ হইয়া গেল।
জিগ্যেস করলুম,–গাবগাছের ওপর থেকে কি ঢিল পড়ছিল?
–নাঃ! ঝোঁপের দিক থেকে ব্যাটায় ঢিল ছুড়ছিল। ফায়ার করছি সেই দিকেই। কিন্তু গুলি লাগলে ট্যার পাইতাম।
–তারপর আপনি জমিদারবাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন?
–হঃ!
–ব্যান্ডেজ কে বেঁধে দিল?
–জয়কুমারবাবুর ফাস্টএডের বাকসো ছিল। বুড়া হইলে কী হইব? সব কামে উনি পাকা। নিজের হাতে ব্লেডে মাথার এক ইঞ্চি চুল উঁছলেন। ওষুধ দিয়া ব্যান্ডেজ করলেন। তো উনি কইলেন, বিলের ধারে ওই গাবগাছের খুব বদনাম আছে। দিনদুপুরেও পারতপক্ষে কেউ একা সেখানে যায় না।
–তাহলে ঝপুইহাটি দেখছি খুব রহস্যময় জায়গা। আনাচে-কানাচে ভূতেরা ঘুরে বেড়ায়। হালদারমশাই খিখি করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,–কর্নেলস্যারের লগে পরামর্শ করা দরকার। তাই ফেরত আইলাম। আরও খান দুই মিসটিরিয়াস ঘটনা ঘটছে।
ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। কর্নেল বললেন,–আবার এক পেয়ালা গরম কফি খান হালদারমশাই! আপনার নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে।
খামু? তা আপনি যখন কইতাছেন, খাই। –বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কফির পেয়ালা তুলে অভ্যাসমত ফুঁ দিয়ে তারপর চুমুক দিলেন।
কর্নেল বললেন, তাহলে জয়ন্ত, বুঝতেই পারছ ঝাঁপুইহাটি কী সাংঘাতিক জায়গা ঝোঁপজঙ্গল থেকে আচমকা কেউ ঢিলের বদলে মারাত্মক কিছু ছুঁড়ে মারলেই বিপদ।
হালদারমশাই বললেন,–কইলাম ঢিল। কিন্তু মাটির ঢিল নয়, পাটকেল কইতে পারেন। অথচ ওখানে ইট-পাটকেল দেখি নাই। নরম মাটি। কোন ব্যাটায় পাটকেল ছুড়ছিল। তার মানে, আমারে সে ফলো করছিল। অনেকগুলি পাটকেল সঙ্গে নিছিল।
কর্নেল বললেন, আপনি এক রাউন্ড ফায়ার করে ভালোই করেছেন হালদারমশাই। ভূত হোক, আর মানুষ হোক, ফায়ার আর্মসকে ভয় পায়। এবার সে সতর্ক হবে।
বললুম,–আর দুটো রহস্যময় ঘটনা কী হালদারমশাই?
হালদারমশাই বললেন,–জয়কুমারবাবু দোতলার একখান ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করছিলেন। তখন রাত্রি প্রায় চাইরটা। বৃষ্টি ছিল। সবে পোশাক বদলাইয়া চেয়ারে বসছি। আর সেই পালোয়ান কাশীনাথ মশারি লইয়া ঘরে ঢুকছে। বিদ্যুৎ ছিল লো ভোল্টেজ। উত্তরের জানালা দিয়া হঠাৎ দেখি আবছা আলোতে বৃষ্টির মধ্যে বটতলার দিকে কেউ যাইতাছে। তখনই টর্চের আলো ফোকাস করলাম। এক সেকেন্ডের জন্য চোখে পড়ল, সেই লোকটার গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো।
–তারপর? তারপর?
–তারপর সে ভ্যানিশড। কাশীনাথ কইল, ও কিছু না। কিন্তু আমি ট্রেনজার্নিতে টায়ার্ড। সারা রাত্র জাগছি। ঘুম আসতাছে। তাই শুইয়া পড়লাম।
–আর-একটা রহস্যময় ঘটনা কী?
–আইজ সকাল দশটায় ব্রেকফাস্ট করছিলাম। তারপর সেই বটগাছের কাছে তদন্ত করতে গেলাম। গিয়া দেখি, গাছটার গুঁড়ির উল্টোদিকে কাদার কয়েকখান ছাপ। কেউ গাছে চড়ছিল। রাত্রিবেলা–মানে কাইল শেষরাত্রে যারে দেখছিলাম সেই গাছে চড়ছিল। ক্যান? হেভি মিস্ত্রি।
–হেভি মিস্ত্রি তো বটেই। ভূতের পায়ে কাদা লাগবে আর সেই পায়ের ছাপ গাছের গুঁড়িতে দেখতে পাওয়া যাবে, এ কেমন ভূত?
গোয়েন্দাপ্রবর মাথা নেড়ে বললেন,–ভূত না। মাইনষের কাম। কথাটা আমি জয়কুমারবাবুর লগে আলোচনা করলাম। উনি কইলেন, মাইনষের কামই বটে। কিন্তু উনি স্বচক্ষে যারে জানালার বাইরে দেখছিলেন, সে সেই ফেলারাম ছাড়া আর কেউ না। অথচ চিতায় তার ডেডবডি পুইড়া কবে ছাই হইয়া গেছে। আমি কইলাম, আপনার চোখের ভুল হইতেও পারে। উনি কইলেন, না। উনি নাকি ঠিকই দেখছিলেন।
–আপনি আংটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি?
–করছিলাম। উনি কইলেন, আংটির কথা উনি জানেন না। ফেলারামের আঙুলে উনি আংটি দেখেন নাই। আংটি সে পাবে কোথায়? উড়নচণ্ডী নেশাখোর চালচুলোহীন লোক। দয়া কইর্যা বাড়িতে আশ্রয় দিচ্ছলেন। প্রায়ই সে নাকি বাড়ির দামি জিনিসপত্র চুরি করত। কোথায় কারে বেইচ্যা আসত। জয়কুমারবাবুর লাইবেরির কত দামি বই সে চুরি কইর্যা কোথায় কারে বেচছিল। তবে এইজন্য উনি ফেলারামবাবুরে শুধু বকাবকি করতেন। তার বেশি কিছু না।
বলে হালদারমশাই কর্নেলের দিকে ঘুরলেন,–কর্নেলস্যার! আমি এবার যাই গিয়া। যা-যা কইছেন, সেই-সেইমতো কাম হইব।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। চোখ না খুলেই বললেন,–হ্যাঁ। আপনি বাসেই সোজা বাবুগঞ্জে চলে যান। আমার চিঠিটা হেমেনবাবুকে দেবেন। আপনার কোনও অসুবিধে হবে না। আজ দুপুরে আমি হেমেনবাবুকে ট্রাংককল করে আমার যাওয়ার কথা বলেছি।
একটু অবাক হয়ে বললুম,–বাবুগঞ্জে টেলিফোন আছে নাকি?
–বাবুগঞ্জ মফস্বল শহর হয়ে উঠেছে। সেখানেই বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, থানা, হাসপাতাল, বাজার। পাশের গ্রাম কঁপুইহাটির বিশেষ উন্নতি হয়নি। তবে রেললাইনের কাছাকাছি গ্রাম ঝাঁপুইহাটিতে একসময় রায়চৌধুরি বংশের জমিদারি দাপট ছিল বলেই স্টেশনের নাম কঁপুইহাটি থেকে গেছে।
হালদারমশাই বললেন,–আমি ঝোঁকের মাথায় অন দা স্পটে গিয়ে ঠিক করি নাই। বাইরে কোথাও শেল্টার লইয়া জমিদারবাড়িতে লক্ষ রাখলে কাম হইত। কর্নেলস্যার! যাই গিয়া।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেইসময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন।…হ্যাঁ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…হেমেনবাবু? এইমাত্র আপনার কথা হচ্ছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার যাচ্ছেন। …কী? কী?… সর্বনাশ! কখন?.. আপনি কী করে খবর পেলেন?…কে এসেছিল? একটু জোরে বলুন প্লিজ!… হ্যাঁ। আমি মর্নিংয়ে যাব। … জোরে বলুন! লাইন ডিসটার্ব করছে!… হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
বুঝলুম, লাইন কেটে গেল। ট্রাংককলে এত বেশি কথা বলার সময় পাওয়া যায় না। একটা কথা। এই ঘটনা যখন ঘটেছিল, তখন মফস্বলে এস টি ডি লাইন চালু হয়নি। সে যাই হোক, রিসিভার রেখে কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন,–গোপীমোহনবাবুর ডেডবডি পাওয়া গেছে বিলের ধারে। একদল জেলে যথারীতি সূর্যাস্তের পর বিলে মাছ ধরতে যাচ্ছিল। তারাই দেখতে পায় গোপীমোহন হাজরা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। মাথার পিছনটা রক্তাক্ত। আততায়ী অতর্কিতে পিছন থেকে শক্ত কিছু দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করেছিল। এর পর জয়কুমারবাবুর বাড়ি থেকে কেউ বাবুগঞ্জ থানায় খবর দিতে গিয়েছিল। সে-ই হেমেন্দ্র সিংহরায়কে খবরটা জানিয়ে গেছে। এর বেশি কিছু বুঝতে পারলুম না।
কর্নেলের কথা শেষ হওয়ার পরই হালদারমশাই কোনও কথা না বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে শুনছিলুম। এবার বললুম,–মনে হচ্ছে, হালদারমশাই হঠাৎ চলে এসে ভুল করেছেন। উনি ওখানে থাকলে খুনি যে-ই হোক, সে হতভাগ্য গোপীমোহনবাবুকে মেরে ফেলার ঝুঁকি নিত না।
কর্নেল দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেলে বললেন,–একটা ব্যাপার স্পষ্ট হল। ভূতের ভয় দেখিয়ে কাজ হচ্ছে না এবং কলকাতা থেকে গোয়েন্দা আনা হয়েছে। কাজেই ভূতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
.
তিন
পরদিন কর্নেল এবং আমি বাসে চেপে বাবুগঞ্জ পৌঁছুলুম। তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আকাশ মেঘলা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বাস থেকে নেমে দু’জনে বাসস্ট্যান্ডের ছাউনির তলায় গিয়ে রেনকোট পরে নিলুম। কর্নেল তার পিঠে আটকানো কিটব্যাগ হাতে নিলেন। আমি একটা বড়সড় নীলরঙের পলিথিন ব্যাগ নিয়েছিলুম। তাতে কর্নেলের কিছু পোশাক-আশাক ঠাসা ছিল।
কর্নেল বললেন,–শর্টকাটে হেমেনবাবুর বাড়ি এখান থেকে তত কিছু দূর নয়। চলো! হেঁটে যাওয়াই ভালো। সাইকেলরিকশোতে যেতে হলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে।
বাসস্ট্যান্ডের চারদিকে বাজার। বৃষ্টির মধ্যেও ছাতি মাথায় মানুষজন ভিড় জমিয়েছে। ট্রাক-বাস-টেম্পো-সাইকেলরিকশোর ভিড়ও যথেষ্ট। জল-কাদাও চারদিকের চত্বরে থকথক করছে। এর মধ্যে দিয়ে কর্নেল পায়ে হেঁটে যেতে চাইছেন শুনে বিব্রত বোধ করছিলুম।
কিন্তু আমরা বাসস্ট্যান্ডের ছাউনি থেকে সবে বেরিয়েছি, একটা মাঝবয়সি লোক এসে সেলাম দিল। কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন,–আরে অনিল যে! তুমি বাজারে এসেছিলে বুঝি?
অনিল নামে লোকটা বলল,–না স্যার! বাবু আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন! ওই দেখুন গাড়ি। বাবু বলেছেন, বাস লেট করলে বৃষ্টিতে সায়েব ভিজে যাবেন। চলুন স্যার!
বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চওড়া রাস্তার পাশে একটা সাদা অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। আমরা সেই গাড়িতে উঠে বসলুম। অনিলই ড্রাইভার। কিছুদূর দুধারে দোকানপাট। তারপর ডাইনে ঘুরে সুন্দর ছবির মতো একতলা-দোতলা বাড়ি এবং সাজানো ফুলবাগিচা। অনিল বলল,–বাবু এই নিউ টাউনশিপে এক বিঘে জায়গা কিনে রেখেছিলেন। নতুন বাড়ি করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সাবেক বাড়ি ছেড়ে আসতে পারলেন না। জায়গাটা দশলাখ টাকায় বেচে দিয়েছেন।
কর্নেল বললেন, আমার মতে, ভালোই করেছেন। গঙ্গার ধারে পৈতৃক বাড়ি ফেলে এখানে চলে আসার মানে হয় না। পশ্চিমে গঙ্গা, উত্তরে বিল। অমন জায়গা ছেড়ে আসতে আছে?
–আজ্ঞে তা অবিশ্যি ঠিক। তবে যা দিনকাল পড়েছে, ওদিকটায় জল-ডাকাতদের বড় উপদ্রব। নৌকোয় চেপে ডাকাতরা এসে কতবার হামলা করেছে। বাবুপাড়ার সব পয়সাওয়ালা লোক টাউনের ভেতরদিকে ক্রমে-ক্রমে চলে এসেছেন। শুধু আমার বাবুমশাই সাহস করে আছেন।
–আচ্ছা অনিল, বাসে আসবার সময় শুনলুম, কঁপুইহাটিতে জমিদারবাড়ির কে নাকি খুন হয়েছে?
অনিল এবার বাঁদিকে সংকীর্ণ পিচরাস্তায় গাড়ি ঘোরাল। তারপর বলল,–ও বাড়িতে গৃহদেবতার অভিশাপ লেগেছে স্যার! গতবছর এমনি বর্ষার রাতে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল ফেলারাম মুখুজ্জে। এবার বর্ষায় আবার অপঘাতে মরল গোপীবাবু। আমি দেখতে যেতুম না। আমার বাবুর সঙ্গে জমিদারবাড়ির কর্তাবাবুর মেলামেশা আছে। তাই বাবু আমাকে বললেন, গাড়ি বের করো অনিল। ঝাঁপুইহাটি যাব। বর্ষায় রাস্তার মোরাম কাদা হয়ে গেছে। সাবধানে গাড়ি চালিয়ে গেলুম। গাড়ি জমিদারবাড়ির কাছে রেখে বাবুর সঙ্গে বিলের ধারে গিয়ে দেখি, পুলিশ এসে গেছে। গোপীবাবুর লাশ স্ট্রেচারে বয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালের লোকেরা। শুনলুম, মাথার পেছনে ডাণ্ডা মেরেছে কেউ। বাবুমশাই থানার অফিসারদের সঙ্গে কীসব কথাবার্তা বললেন। তারপর ওঁরা জমিদারবাড়ি এসে ঢুকলেন। আমি গাড়িতে বসেছিলুম। গোপীবাবুর মতো লোককে কেউ মেরে ফেলবে এ কথা ভাবাই যায় না।
কর্নেল বললেন,–গোপীবাবু নাকি ভালো বেহালা বাজাতেন?
-আজ্ঞে, হ্যাঁ। জমিদারবাড়িতে একসময় গানবাজনার চর্চা ছিল। তাছাড়া আমাদের বাবুগঞ্জে ফাংশান হলেই গোপীবাবুকে বেহালা বাজানোর জন্য খাতির করে ডেকে আনা হতো। একটু খামখেয়ালি লোক ছিলেন। হঠাৎ-হঠাৎ চটে যেতেন। কিন্তু বেজায় নিরীহ লোক। তাকে কে খুন করল, কেনই বা খুন করল বোঝা যায় না।
-বাসে আসবার সময় শুনছিলুম, জমিদারবাড়িতে নাকি গলায়-দড়ি ভূতের উপদ্রব আছে?
অনিল হাসল,–কথাটা ইদানীং বাবুগঞ্জেও রটেছে স্যার। পাশাপাশি গ্রাম। ঝাঁপুইহাটির লোকেরা বাজারে আসে। কাজেই কঁপুইহাটিতে কিছু ঘটলে বাবুগঞ্জে তার খবর আসতে দেরি হয় না।
–তোমার কী ধারণা?
–আজ্ঞে স্যার, ভূত-পেরেত নিশ্চয় আছে। অপঘাতে মানুষ মরলে তার আত্মার মুক্তি হয় না। কাজেই ফেলারামবাবুর আত্মা জমিদারবাড়ি ছেড়ে যেতে পারছে না।
এবার আর এক বাঁক ঘুরে গঙ্গার বাঁধের সমান্তরাল রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে একটা পুরোনো বিশাল বাড়ির গেটে গাড়ি পৌঁছল। গেটে দারোয়ান ছিল। হর্ন শুনে গেট খুলে দিল। নুড়িবিছানো রাস্তায় এগিয়ে গাড়ি দাঁড়াল পোর্টিকোর তলায়। একজন শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ গড়নের প্রৌঢ় ভদ্রলোক করজোড়ে নমস্কার করে সহাস্যে বললেন,–সুস্বাগতম!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,–কী সৌভাগ্য! আপনার এই তরুণ সাংবাদিক বন্ধুর কথা শুনেছিলুম! আসুন জয়ন্তবাবু!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জয়ন্তের কথা কি আপনাকে আমি বলেছিলুম?
-আপনি বলেননি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা বলেছে।
কর্নেল বললেন–জয়ন্ত! ইনিই হেমেন্দ্রকুমার সিংহরায়। আমি বাইনোকুলারের সাহায্যে পাখি চিনতে পারি। হেমেনবাবু খালি চোখেই চিনে ফেলেন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ!
হেমেনবাবু হাসতে-হাসতে আমার কাঁধে হাত রেখে হলঘরে ঢুকলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে-উঠতে বললেন,–দূরদৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছি কর্নেলসায়েব। কাল বিকেলেই আমি নৌকো করে বিলে গিয়েছিলুম। জেলেদের মুখে খবর পেয়েছিলুম, ফ্লুইস গেটের পাশে অশ্বত্থা গাছে নাকি দুটো গগনবেড় পাখি এসেছে। গিয়ে তাদের পাত্তা পেলুম না। ফেরার সময় ডাকিনীতলা জলটুঙ্গির পশ্চিমদিক হয়ে আসছিলুম। তখন সূর্য মেঘের আড়ালে ডুবে গেছে। যে গাব গাছের তলায় গোপীবাবুর লাশ পাওয়া গেছে, সেদিকে আমি নিশ্চয়ই তাকিয়ে থাকব। অথচ গোপীবাবুকে দেখতে পাইনি। দেখতে পেলে উনি বেঁচে যেতেন। আমার হাতে বন্দুক ছিল। অথচ সময়ের হিসেবে দেখছি, ঠিক ওই সময় গোপীবাবু বিলের ধারে এসেছিলেন।
কর্নেল বললেন,–ডাকিনীতলার জলটুঙ্গিতে যাওয়াই ওঁর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত।
-ঠিক ধরেছেন। গত শীতকালে আপনার কাছে আভাস পেয়ে আমি মজাটা দেখার জন্যে একদিন ওখানে গিয়ে ওত পেতেছিলুম। হঠাৎ দেখি সন্ধ্যার একটু আগে কঁপুইহাটির চরণজেলে ছোটো একটা নৌকা বেয়ে এল জেলেপাড়ার ঘাট থেকে। তারপর গোপীবাবুকে ডাকিনীতলায় পৌঁছে দিতে গেল। আপনি ঠিকই ধরেছিলেন। রাতবিরেতে গোপীবাবু ডাকিনীতলায় বেহালা বাজাতে যেতেন। চরণ ছিল তার সঙ্গী।
দোতলার বারান্দায় হাঁটতে-হাঁটতে বললুম,–অদ্ভুত ব্যাপার! কেন ওঁরা–
আমার কথার ওপর হেমেনবাবু বললেন,–এই কেনটা আমাকেও বহুদিন জ্বালিয়েছিল। একদিন চরণকে হুমকি দিতেই সে রহস্যটা ফাঁস করে দিল। গোপীবাবুর নাকি গাঁজা খেলে বেহালার হাত ভালো খুলে যায়। রায়চৌধুরিমশাই টের পেলে বিপদ ঘটবে। তাই গোপনে ডাকিনীতলায় গিয়ে গাঁজা খেয়ে মনের সুখে গোপীবাবু বেহালা বাজাতেন। চরণও গাঁজার ভক্ত। মাঝে-মাঝে গাঁজা চটকে ছিলিম সাজিয়ে গোপীবাবুকে দেয় এবং তার প্রসাদ পায়। দুই গেঁজেলের কীর্তি! তবে শুনেছি, গাঁজা খেলে নাকি সত্যিই মনের কনসেন্ট্রেশন আসে। সাধুসন্ন্যাসীরা ধ্যানে বসার আগে সেইজন্য নাকি গাঁজা খান!
উত্তরদিকে শেষপ্রান্তের ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জানালা দিয়ে পশ্চিমে বাঁধের গাছপালার ফাঁকে বর্ষার উত্তরঙ্গ গঙ্গা এবং উত্তরের বিস্তীর্ণ জলাভূমি দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল বাইনোকুলারে একবার দেখে নিয়ে বললেন, শীতকালের চেয়ে এখন বর্ষাকালেই প্রকৃতির রূপ বেশি খোলে।
হেমেনবাবু বললেন, প্রকৃতির রূপ পরে দেখবেন। স্নান করতে হলে করে নিন। তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে বেরুবেন। না–এই অসময়ে কফি নয় কর্নেলসায়েব! আমারও খিদে পেয়েছে। আপনাদের সঙ্গে খাব বলে অপেক্ষা করছিলুম।
এতক্ষণে আমার হালদারমশাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। বললুম,–প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদারের খবর কী? ওঁর তো গতরাত্রেই এখানে আসবার কথা।
হেমেনবাবু একটু হেসে বললেন,–উনি গতরাত্রে বারোটা নাগাদ এসেছেন। কাল কর্নেলের ট্রাংককল পেয়ে আমি ওঁর জন্য অপেক্ষা করছিলুম। আজ ভোরে উনি বললেন, ওঁর পক্ষে ঝাঁপুইহাটির কাছাকাছি কোথাও থাকলে সুবিধে হয়। তাই ইরিগেশন বাংলোয় ওঁকে নিয়ে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাংলোটা বাবুগঞ্জের উত্তর-পূর্ব কোণে শেষপ্রান্তে। নিচেই বিল। চমৎকার জায়গা। ওদিকে ঝপুইহাটিও খুব কাছে। একটা আমবাগান আর জটাবাবার থান পেরিয়ে নাকবরাবর সিধে হাঁটলে জমিদারবাড়ি আরও কাছে। সেচবাংলোয় টেলিফোন আছে। কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করে ওঁর খোঁজ নিলুম। কেয়ারটেকার শচীন বলল, মিঃ হালদার ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছেন।
কর্নেলের তো সামরিক জীবনের অভ্যাস। সপ্তাহে দু’দিন অন্তর স্নান করেন। তবে এটা এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। নভেম্বর থেকে মার্চ সপ্তাহে মাত্র একদিন। তবে গরম জলে শরীর স্পঞ্জ করেন মাঝে-মাঝে। আমি একা স্নান করতে বাথরুমে ঢুলুম।
তারপর পোশাক বদলে বেরিয়ে এসে দেখি, হেমেনবাবুর সঙ্গে কর্নেল কথা বলছেন। হেমেনবাবুর একটা কথা কানে এসেছিল। ‘জয়কুমারদা আংটির ব্যাপারটা এতদিনে বুঝতে পেরেছেন। আমাকে দেখে হেমেনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। রতন এসে আপনাদের ডেকে নিয়ে যাবে।
তিনি চলে গেলে কর্নেলকে বললুম,–আংটি রহস্য নিয়ে আপনাদের কথা হচ্ছিল। একটু আভাস অন্তত দিন!
কর্নেল হাসলেন,–”আংটি এখনও রহস্য হয়েই আছে। জয়কুমারবাবু আংটির ব্যাপারে কী বুঝেছেন, তা হেমেনবাবুকে খুলে বলেননি। কাজেই তোমাকে কোনও আভাস দিতে পারছিনে।
বলে তিনি আমার ব্যাগ থেকে তার একপ্রস্থ পোশাক আর তোয়ালে বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। আমি পশ্চিমের জানালা দিয়ে গাছপালার ফাঁকে গঙ্গা দেখতে থাকলুম।
খাওয়ার ঘর নিচের তলায়। হেমেনবাবুর স্ত্রী সুষমা দেবী আমাদের খুব আদর-যত্ন করে খাওয়ালেন। কর্নেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। কর্নেলকে সুষমা দেবী পরিহাস করে বললেন,–কর্নেলসায়েব সেবার এসে বলেছিলেন, শিগগির আবার আসব। তো এমন সময় এলেন, বেড়াতে বেরুনোর উপায় নেই। আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি আর বৃষ্টি! বাবুগঞ্জের ইলিশ খেলেও পোষাত। এবার এখনও ইলিশের দেখা নেই।
হেমেনবাবু বললেন,–এবার বর্ষায় আশ্চর্য ব্যাপার! গঙ্গায় ইলিশ নেই! সেবার কর্নেলসাহেয়বকে শীতের সময়ও ইলিশ খাইয়েছিলুম।
এইসব কথাবার্তার মধ্যে খাওয়া শেষ হল। দোতলার সেই ঘরে এসে কর্নেল ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে চুরুট ধরালেন। আমি অভ্যাসমতো ভাতঘুমের আশায় বিছানায় শুয়ে পড়লুম। কর্নেল বললেন,–আধঘণ্টা জিরিয়ে নাও। তারপর আমরা বেরুব।
বললুম,–বৃষ্টি তো বন্ধ হয়নি।
–হয়েছে। মেঘও কেটে যাচ্ছে। আশা করি বিকেলে একটুখানি রোদ্দুর ফুটবে।
কর্নেলের কথা সত্যি হল। তিনটে নাগাদ হেমেনবাবুর সঙ্গে তাঁর গাড়িতে যখন চাপলুম, তখন আকাশ প্রায় পরিষ্কার। উজ্জ্বল রোদ্দুরে গাছপালা ঝলমল করছে। অনিল গাড়ি চালাচ্ছিল। বাজার পেরিয়ে সেই ব্যাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁদিকে মোরামবিছানো লাল রাস্তায় গাড়ি বাঁক নিল। দুধারে সরকারের বনদফতরের তৈরি নানারকম গাছের জঙ্গল। তারপর ঝপুইহাটি গ্রামে ঢুকল গাড়ি। টালি বা টিনের চালের বাড়ির পাশে ইটের বাড়িও চোখে পড়ল। একখানে সংকীর্ণ গলি রাস্তা দিয়ে ঘুরে অবশেষে উঁচু প্রকাণ্ড এবং জরাজীর্ণ একটা দেউড়ির কাছে গাড়ি থামাল অনিল। আমরা নেমে গেলুম। হেমেনবাবু বললেন, এখানকার মাটির এই গুণ। শিগগির জল শুষে নেয় বলে তত কাদা হয় না। আজ রাত্রে যদি আর বৃষ্টি না হয়, মাটির রাস্তা শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাবে।
দেউড়ি আছে। কিন্তু কপাট নেই। হাট করে খোলা। অনিল হর্ন বাজিয়েছিল। একটু পরে একজন কালো দানবের মতো মানুষ, পরনে খাটো ধুতি এবং গায়ে ফতুয়া, করজোড়ে একটু ঝুঁকে প্রণাম করে বলল,–আসুন দাদাবাবু! কর্তামশাই আমাকে এখনই বলছিলেন, আপনার বাড়ি গিয়ে খবর নিয়ে আসি। তা ইনি সেই কর্নেলসায়েব? প্রণাম স্যার! আপনাকে দূর থেকে শীতের সময় দাদাবাবুর সঙ্গে নৌকোয় দেখেছিলুম। আসুন! ভেতরে আসুন!
হেমেনবাবু বললেন,–কালীনাথ! গোপীবাবুর বডি দাহ হয়ে গেছে তো?
–আজ্ঞে, সকালে আমরা পাড়ার কজনকে নিয়ে কেষ্টনগরে গিয়েছিলুম। ম্যাটাডোর ভাড়া করে বডি এনে আপনাদের বাবুগঞ্জের শ্মশানঘাটে দাহ করেছি। একটু আগে গঙ্গাস্নান করে ফিরেছি। গোপীদার ভাগ্য দাদাবাবু! শ্মশানে খুব ভিড় হয়েছিল। কতজনে ফুলের মালা দিয়ে ভক্তি জানাল।
–হ্যাঁ। গোপীবাবু জনপ্রিয় ছিলেন। ফাংশানে বা যাত্রা-থিয়েটারে বেহালা বাজাতেন। তো আমাকে একটু খবর দাওনি কেন?
–আজ্ঞে, মাথার ঠিক ছিল না। এখনও নেই। মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। সবাই বলছে, খুনি ভুল করে কাকে মারতে কাকে মেরেছে!
বাউন্ডারি ওয়ালের অবস্থাও শোচনীয়। দোতলা প্রাসাদতুল্য বাড়িটা অবশ্য অটুট আছে। একতলা এবং দোতলায় সারবন্দি মোটা থাম। প্রাঙ্গণের অনেকটা জুড়ে ঝোঁপজঙ্গল গজিয়েছে। বাড়ির সামনে কিছু অংশ পরিষ্কার। সেখানে বারান্দার একটা অংশ অর্ধবৃত্তাকারে বেরিয়ে এসেছে। কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওখানে উঠতে হয়। সেই অর্ধবৃত্তাকার জায়গায় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পরনে পাজামা আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। মাথার চুল সাদা। গোঁফও সাদা। ফর্সা রং। চেহারায় বনেদি আভিজাত্যের ছাপ আছে।
আমাদের দেখে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। তারপর ছড়িসুদ্ধ হাতে কর্নেলের হাত জড়িয়ে ধরে ধরাগলায় বললেন,–সেই তো এলেন। কিন্তু বড় দেরি করে এলেন কর্নেলসায়েব!
কর্নেল বললেন,জয়কুমারবাবু! আমি জানি, আপনি বিদ্বান মানুষ। আপনি এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ব্যাপারটা ভৌতিক বলেই আমি তত গুরুত্ব দিইনি। অবশ্য আংটির ব্যাপারটা শুনে আমি মনে-মনে একটা অঙ্ক কষেছিলুম। অঙ্কটা দেখা গেল ঠিক ছিল না। গোপীমোহনবাবু আমাকে নিশ্চয় সব কথা খুলে বলেননি। বললে আমার অঙ্ক হয়তো ঠিকই মিলে যেত।
জয়কুমারবাবু বললেন,–কালী! এই রোয়াকে কয়েকটা চেয়ার পেতে দে। এখানে ছায়া পড়েছে। খোলামেলা হাওয়ায় এঁদের বসাই। এই গ্রামে বিদ্যুতের যা দুরবস্থা!
অর্ধবৃত্তাকার রোয়াকে আমরা বসার পর জয়কুমারবাবু বললেন,–গোপী কি আপনাকে বলেনি ফেলারাম গতবছর এমনি জুলাই মাসের নিশুতি রাতে ওই মন্দিরের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল।
কর্নেল বললেন–না তো?
–আশ্চর্য! কালীনাথ কীভাবে টের পেয়ে ফেলারামকে হাতেনাতে মন্দিরের ভেতর ধরে ফেলেছিল। আমাদের গৃহদেবতা রুদ্রদেবের বেদি ধরে সে টানাটানি করছিল। সেই জন্যই তো আমি তাকে দড়ি দিয়ে থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলুম। আর কীভাবে দড়ির বাঁধন খুলে ফেলারাম মনের দুঃখে পেছনের বটগাছে উঠে সেই দড়ির ফাস গলায় আটকে ঝুলে পড়েছিল।
–গোপীবাবু এ কথা তো বলেননি। উনি বলেছিলেন কী ব্যাপারে আপনি তাকে বকাবকি করেছিলেন। সেই জন্য তিনি আত্মহত্যা করেন।
হেমেনবাবু বললেন,–রুদ্রদেবের বেদি ধরে কেন টানাটানি করেছিল ফেলারাম?
জয়কুমারবাবু রুষ্টমুখে বললেন,–বিগ্রহ ওপড়াতে পারেনি। তাই বেদিসুদ্ধ উপড়ে নিতে চেষ্টা করেছিল। তুমি ভালোই জানো হেমেন! আজকাল বিগ্রহ চুরি করে বিদেশে পাচার করে বদমাশ লোকেরা প্রচুর টাকাকড়ি পায়! কিন্তু আমার অবাক লাগছে। গোপীকে আমি এই কথাটা কর্নেলসায়েবকে গুরুত্ব দিয়ে বলতে বলেছিলুম। অথচ সে বলেনি। এ তো অদ্ভুত ব্যাপার!
হেমেনবাবু বললেন,–জয়কুমারদা! আপনি কি বলতে চাইছেন গোপীবাবু ফেলারামের সঙ্গে বিগ্রহ পাচারের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল?
-না। তা বলছি না। কিন্তু আমার খটকা লাগছে। এই আসল কথাটা না বললে কর্নেলসায়েব ভাবতেই পারেন, আমি বা আমার হুকুমে কালীনাথ কোনও বহুমূল্য আংটির লোভে তাকে ফাস আটকে মেরে বটগাছে লটকে দিয়েছিলুম!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ঠিক বলেছেন। আমার অঙ্কটা এইরকমই ছিল।
জয়কুমারবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন,–শুনছ? শুনছ হেমেন? গোপী ইচ্ছে করেই কর্নেলসায়েবকে ভুল পথে চালাতে চেষ্টা করেছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে অবশ্য এ ঘটনাটা আমি বলিনি। তবে আমার সন্দেহ, ওঁকে লক্ষ করে ঢিল ছুঁড়েছিল হতভাগা গোপীমোহনই। আর কেউ না। মিঃ হালদারকে সে তাড়াতে চেয়েছিল। বেঁচে থাকলে সে কর্নেলসায়েবকেও তাড়ানোর চেষ্টা করত।
হেমেনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, তাহলে গোপীবাবু কর্নেলসায়েবের কাছে যাবেন কেন?
–আমার হুকুম মানতে সে বাধ্য। যদি সে ফিরে এসে বলত, কর্নেলসায়েবের দেখা পেলুম না, তাহলে আমি তোমাকে ট্রাংককল করতে বলব, গোপী তা ভালোই জানত।
এই সময় একটা গোলটেবিল এনে রাখল কালীনাথ। তারপর একটা নোক ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চা বা কফির পট ও কাপপ্লেট ট্রেতে বয়ে এনে টেবিলে রাখল। হেমেনবাবু বললেন,–কি ভোলা? এখনও তোমার পায়ের হাড় বসেনি?
ভোলা বলল,–আজ্ঞে না। কলকাতার ডাক্তারবাবু একমাস অন্তর যেতে বলেছিলেন। কিন্তু কর্তামশাইয়ের সংসার ফেলে যাই কী করে?
জয়কুমারবাবু চটে গিয়ে কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল জিগ্যেস করলেন,তোমার পা ভাঙল কী করে?
ভোলা বলল,–আজ্ঞে, পেছনকার বটগাছের একটা ডাল এসে দালানে ধাক্কা মারত। রাত্তিরে অদ্ভুত শব্দ হতো। কর্তামশাই ডালটা কাটতে বলেছিলেন। ডাল কেটে নামবার সময় পা ফসকে নিচে পড়েছিলুম।
–কতদিন আগে?
–আজ্ঞে গতবছর। তার কদিন পরে ফেলাবাবু আত্মহত্যা করেছিল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জয়কুমারবাবু! ওই বটগাছটাই আসলে ভূত।
.
চার
কর্নেলের কথা শুনে হেমেনবাবু হেসে ফেললেন। কিন্তু জয়কুমারবাবু গম্ভীরমুখে বললেন,–বটগাছটা সম্পর্কে ছোটোবেলা থেকেই অনেক ভূতুড়ে গল্প শুনেছি। কিন্তু আমার ঠাকুরদার হাতে লাগানো গাছ। তার মানে প্রায় দুশো বছর গাছটার বয়স। আমাদের পরিবারে তাই বটগাছটা সম্পর্কে শ্রদ্ধাভক্তি ছিল। গাছটা কেটে ফেলার প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। তবে মাঝে-মাঝে গাছটার ডালপালা এই দালানের ওপর চলে আসত।
ভোলা বলল,–ভূতুড়ে শব্দ শোনা যেত দালানে ধাক্কা লেগে। তা ঠিক। তবে সেজন্য নয়। চোরডাকাত বাইরে থেকে পাঁচিলে উঠে ডাল বেয়ে দোতলায় নামতে পারে ভেবেই ওইসব ডাল কেটে ফেলা হতো।
কালীনাথ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল,–তাছাড়া বটগাছটায় কাকের বড়ো উপদ্রব হয়। কাকের স্বভাব তো জানেন! দালানের ওপর কোনও ডাল এগিয়ে এলে সেখানে বাস করত। আর রাজ্যের সব কুচ্ছিত জিনিস এনে বাসায় রাখত। ছাদে সেগুলো পড়ে যেত। ছাদ নোংরা হতো।
কর্নেল বললেন,–বুঝেছি। তবে ও কথা থাক। জয়কুমারবাবু! এবার বলুন, ফোরাম মুখুজ্জের প্রেতাত্মাকে কি আপনি সত্যি দেখেছিলেন?
জয়কুমারবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন,–খালিচোখে আমি দিনের বেলা সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই। শুনলে অবাক হবেন, আমার চোখে এই আশিবছর বয়সেও ছানি পড়েনি। তবে বই বা কাগজপত্র–মানে লেখাপড়া করতে রিডিং গ্লাস দরকার হয়। রাত্রিবেলা বই পড়ার সময় জানালার ধারে ফিসফিস করে কে তিনবার ‘আংটি দে’ বলায় আমি চমকে উঠে তাকিয়েছিলুম।
–তখন আপনার চোখে রিডিং গ্লাস ছিল?
–ছিল। আবছা দেখেছিলুম গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো কেউ উঁকি দিচ্ছে! অমনি টর্চের আলো ফেলেছিলুম। তারপর তাকে দেখতে পাইনি।
–তাকে আপনি ফেলারাম মুখুজ্জে বলে চিনতে পেরেছিলেন?
জয়কুমারবাবু গলার ভেতর বললেন, আসলে তার গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো দেখেছিলুম একটু স্পষ্ট। তাই ধরেই নিয়েছিলুম সে ফেলারাম! তাছাড়া মুখে গোঁফদাড়ি ছিল।
কর্নেল বললেন,–ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। রাতবিরেতে আবছা আলোতে অন্য কেউ গলায় দড়ির ফঁস আটকে উঁকি দিলেও স্বভাবত সে ফেলারাম বলেই সাব্যস্ত হতো।
–গোপী তাকে নাকি স্পষ্ট দেখেছিল। ফেলারাম বলে চিনতে পেরেছিল।
–গোপীবাবু আর বেঁচে নেই। কাজেই আপনি এবার বলুন, আংটির ব্যাপারটা কী?
জয়কুমারবাবু চাপাস্বরে বললেন,–হেমেনকে বলেছি সে কথা। আসলে আংটির কথাটা আমার মনেই ছিল না। কালী কাল কথাপ্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিল। ঝাঁপুইহাটিতে বিদ্যুৎ এসেছিল বছর তিনেক আগে। তখন তোল্টেজ স্বাভাবিক ছিল। তাই কুয়োর জল ছাদে একটা ট্যাঙ্কে ভোলার জন্য পাম্পিং মেশিন কিনেছিলুম। দোতলায় বাথরুম তৈরি করেছিলুম। কলের মিস্তিরি ডেকে পাইপ কিনে বেসিন আর শাওয়ারের ব্যবস্থা করেছিলুম। কিন্তু পরের বছর থেকে ভোল্টেজ কমে গেল বিদ্যুতের। পাম্পে জল ওঠে না। অগত্যা পুনর্মূষিক ভব। নিচের তলায় সাবেক বাথরুম আবার ব্যবহার করতে হল।
জয়কুমারবাবু একটু চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরি খুব পুরোনো। ঠাকুরদার বই সংগ্রহের বাতিক ছিল। তাছাড়া নানা বিষয়ে বই থেকে নোট করে রাখতেন একটা নোটবইয়ে। সেই নোটবইয়ের একটা পাতায় লাল কালিতে লেখা ছিল–দেখাচ্ছি। একমিনিট! কালী! আমার সঙ্গে চল!
বলে উনি ছড়িহাতে উঠে গেলেন। একতলার একটা ঘরের তালা খুলতে কালীনাথকে চাবির গোছা দিলেন। কালীনাথ তালা খুলে দিলে ঘরে ঢুকে গেলেন। হেমেনবাবু মুচকি হেসে বললেন,–কর্নেলসায়েব! এবার মনে হচ্ছে আপনি জমিদারবাড়ির ভূতরহস্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ কু পাবেন!
জয়কুমারবাবু একটু পরে এসে গেলেন। তার হাতে একটা জীর্ণ মোটাসোটা ডায়রি বই। তিনি পকেট থেকে রিডিং গ্লাস অর্থাৎ চশমা বের করে চোখে পরলেন। ডায়রি বা নোটবইটার বিবর্ণ পোকায় কাটা পাতা সাবধানে উলটে কর্নেলকে দিলেন। বললেন,–এই দেখুন। ঠাকুরদা লালকালিতে কী লিখেছেন।
আমরা ঝুঁকে পড়লুম পাতাটা দেখতে। কর্নেল বিড়বিড় করে পড়তে থাকলেন, ‘আমার বংশধরদের উদ্দেশ্যে এই গুপ্তকথা লিখিয়া রাখিতেছি। আমাদিগের গৃহদেবতা শ্রী শ্রী রুদ্রদেবের আশীবাদধন্য একটি অতীব প্রাচীন স্বর্ণ-অঙ্গুরীয় ক/১৮৪ সংখ্যক পুস্তকের ভিতরে লুকাইয়া রাখিয়াছি। উহা অঙ্গুলিতে ধারণ করিলে গৃহদেবতার কৃপায় অমঙ্গল দূর হইবে। তবে সাবধান, অঙ্গুরীয় যেন কদাচ জল স্পর্শ করে না। স্নান আচমন প্রভৃতি প্রাত্যহিক কৃত্যাদি সম্পন্ন করিবার সময় উহা খুলিয়া রাখিতে হইবে।..’
কর্নেল মুখ তুলে বললেন, আপনি আংটিটি খুঁজে বের করে আঙুলে পরেছিলেন?
জয়কুমারবাবু বললেন, হ্যাঁ। কীরকম বেঢপ গড়নের আংটি। ওপরে কোনও রত্ন-টত্ন বসানো ছিল না। সেখানে ডিম্বাকৃতি নিরেট সোনার টুকরো বসানো ছিল। আমি ঠাকুরদার নির্দেশমতো আংটি পরে থাকতুম। তো গতবছর গ্রীষ্মকালে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলুম আংটিটা আঙুল থেকে কখন কোথায় খুলে পড়েছে। একটু ঢিলে ছিল আংটিটা। তন্নতন্ন খুঁজে কোথাও পেলুম না। ফেলারামের প্রতি সন্দেহ হল। সে কুড়িয়ে বেচে দিয়েছে হয়তো। কিন্তু সে কান্নাকাটি করে রুদ্রদেবের নামে শপথ করে কেলোর কীর্তি বাধাল। গোপী, কালী, ভোলা, ভোলার বউ শৈল আর নকুলঠাকুরকে ফেলারামের দিকে লক্ষ রাখতে বলেছিলুম। বাড়ির দামি জিনিস বিক্রি করলে ফেলারামের হাতে পয়সাকড়ি আসত। তখন তার চেহারা হাব-ভাব বদলে যেত। কিন্তু ওরা তেমন কোনও পরিবর্তন লক্ষ করেনি। অগত্যা আংটির আশা ছেড়ে দিলুম। এদিকে আমার জমিজমা নিয়ে হাজারটা সমস্যা। আংটিটার কথা মন থেকে বিসর্জন দিলুম। কিন্তু কথা হচ্ছে, উলটে ফেলারামের প্রেতাত্মা আমার বা গোপীর কাছে সেই আংটি চাইতে রাতবিরেতে হানা দেবে কেন? আংটিটা তো আমারই ছিল।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–যা ও কথা। মর্গের রিপোর্টে গোপীবাবুকে কী দিয়ে খুন করা হয়েছিল জানতে পেরেছেন?
হেমেনবাবু বললেন,–ভোতা শক্ত কোনও জিনিস দিয়ে খুনি তার মাথার পেছনে আঘাত করেছিল। থানার ও.সি. বলেছেন, লোহার রড বা লোহার মুগুরই মার্ডার উইপন।
-গোপীবাবুর বেহালা পাওয়া গেছে?
কালীনাথ বলল,–গাবতলায় ঝোঁপের ভেতর পাওয়া গেছে। কেউ বেহালাটা যেন শক্ত জিনিস দিয়ে ঠুকে ভেঙে টুকরো-টুকরো করেছে। বেহালার কাপড়ের খাপটা কাছেই পড়ে ছিল। পুলিশ সব নিয়ে গেছে।
কর্নেল হঠাৎ একটু নড়ে বসলেন,–হা! জয়কুমারবাবু! বাথরুমের কথা বলছিলেন আপনি। কেন বলছিলেন?
জয়কুমারবাবু বললেন,–বলতে ভুলে গেছি। আমি বাথরুমে স্নান করতে ঢোকার পর আংটিটা খুলে উঁচু জানালার ধারে রাখতুম, যাতে জলস্পর্শ না হয়। আংটিটা হারিয়ে যাওয়ার এতদিন পরে হঠাৎ কাল স্নান করতে ঢুকে দেখলুম, একটা কাক উঁচু জানলার ওপরে বসে কিছু ঠোকরাচ্ছে। অমনি মনে হল, কাক আংটিটা নিয়ে যায়নি তো?
কালীনাথ সায় দিয়ে বলল,–কর্তামশাইয়ের কথা শুনে আমি কাল বটগাছটাতে উঠে কাকের কয়েকটা বাসা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙে দিয়েছি। আংটি খুঁজে পাইনি।
আমি বললুম,–কর্নেল! হালদারমশাই তাহলে কালীনাথের পায়ের ছাপ দেখেছিলেন বটগাছের গুঁড়িতে।
হেমেনবাবু বললেন,–হালদারমশাই, মানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার?
হাসলেন,–হ্যাঁ। বুঝতেই পারছেন গোয়েন্দারা সবকিছু সন্দেহের চোখে দেখেন। ওঁর কথা থাক। জয়কুমারবাবু যা বলছেন, তাতে যুক্তি আছে। কাকের এই অদ্ভুত স্বভাব আমার সুপরিচিত। কারণ কলকাতায় আমার ছাদের বাগানের নিচে একটা নিমগাছে কাকের বড্ড উপদ্রব। আমি ওদের বাসায় মেয়েদের চুলের ফিতের টুকরো, ভাঙা চুড়ি, এমনকী লোহার ছোট্ট স্প্রিংও দেখেছি।
কালীনাথ বলল,বাকি বাসাগুলো কালই ভেঙে দিয়ে খুঁজে দেখব।
জয়কুমারবাবু বললেন,–যে কাক আমার আংটি চুরি করেছিল, একবছর পরে সে বেঁচে আছে বা বটগাছে এখনও আছে কি না ঠিক আছে কিছু? কাকেরা জায়গা বদলায় না? গ্রামের কাকেরা আজকাল শহরে গিয়ে জুটেছে শুনেছি। আমাদের বটগাছে আগের মতো অত কাক তো আর দেখি না।
হেমেনবাবু বললেন,–কথাটা ঠিক। বাবুগঞ্জে ক্রমে কাকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। শহরে কাকেঁদের প্রচুর খাবার মেলে কাজেই গ্রামে কালক্রমে আর কাক দেখাই যাবে না!
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা বসুন। আমি একবার বটগাছটার অবস্থা দেখে আসি।
কালীনাথ তাঁর সঙ্গে যেতে পা বাড়িয়েছিল, কর্নেল তাকে নিষেধ করে বাড়ির পূর্বদিক ঘুরে উত্তরে অদৃশ্য হলেন। একটু পরে দক্ষিণে আগাছার জঙ্গলের ওধারে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে একটা মন্দিরে কাসরঘণ্টা বেজে উঠল। একটি মেয়ে সম্ভবত ভোলার বউ শৈল শাঁখে ফুঁ দিল। জয়কুমারবাবু চেয়ারে বসেই মন্দিরের দিকে ঘুরে করজোড়ে প্রণাম করে বললেন,–সন্ধ্যারতি দিচ্ছে নকুলঠাকুর। আজকাল আমি আর সন্ধ্যারতির সময় মন্দিরে উপস্থিত থাকি না। হেমেন! তুমি এঁকে বিগ্রহদর্শন করিয়ে আনো!
হেমেনবাবু একটু হেসে বললেন,–কি জয়ন্তবাবু? যাবেন নাকি?
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,–চলুন! রুদ্রদেবের বিগ্রহ কখনও দর্শন করিনি। দেখতে আগ্রহ হচ্ছে।
হেমেনবাবুকে অনুসরণ করে প্রাঙ্গণের একখানে দেখলুম, আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ পায়েচলা পথ আছে। পথের মাঝামাঝি গিয়ে হেমেনবাবু বাঁদিকে আঙুল তুলে বললেন,–ওখানে একটা ফোয়ারা ছিল। ছোটোবেলায় এ বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছি বাবার সঙ্গে। তখন এই সব ঝোঁপঝাড় ছিল না। ফুলের বাগান ছিল। ওই ফোয়ারাটাও আস্ত ছিল। পাথরের থামটা দেখতে পাচ্ছেন? ওখানে একটা অপ্সরার মূর্তি বসানো ছিল।
মন্দিরটার চত্বর উঁচু, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। নিচে জুতো খুলে চত্বরে উঠে দরজার কাছে উঁকি দিলুম। করজোড়ে প্রণাম করলুম হেমেনবাবুর দেখাদেখি। আবছা-অন্ধকারে একটা প্রদীপ জ্বলছে। বেঁটে তামাটে রঙের এবং পট্টবস্ত্রপরা ঠাকুরমশাই পুজো করছেন। কাঁসর বাজাচ্ছে একটি ছোট্ট ছেলে। হেমেনবাবু বললেন,–নকুলঠাকুরের ছেলে। স্কুলে পড়ে।
বললুম,–নকুলবাবুর ফ্যামিলি কি এ বাড়িতে থাকেন?
-না। নকুলবাবুর ফ্যামিলি থাকে বাবুগঞ্জে। নকুলবাবু জমিদারবাড়িতে চাকরি করেন। চাকরি মানে, রান্নাবান্না-পুজোআচ্চা এইসব কাজ। এবার বিগ্রহটা লক্ষ করুন। কী মনে হচ্ছে দেখে?
খুঁটিয়ে দেখে বললুম,–কী আশ্চর্য! অবিকল যেন বুদ্ধমূর্তি।
–ঠিক ধরেছেন। বুদ্ধমূর্তি রুদ্রদেব হয়ে গেছেন। কিন্তু এ কথা যেন ভুলেও জয়কুমারবাবুকে বলবেন না! খুব প্রাচীন মূর্তি। কষ্টিপাথরে তৈরি। বেদিটাও কষ্টিপাথরের।
–ফেলারামবাবু সম্ভবত বিগ্রহটা চুরি করতে চেয়েছিলেন!
হেমেনবাবু বললেন,–আসুন। ব্যাপারটা বলছি।
মন্দির-চত্বর থেকে নেমে জুতো পরে সেই পথ দিয়ে ফিরছিলুম। হেমেনবাবু বললেন,–বেদিটা তো দেখলেন। বড়জোর দুফুট লম্বা দেড়ফুট চওড়া। লাইমকংক্রিটের সঙ্গে গাঁথা আছে। বেদি ওপড়ানো কি সম্ভব? কী মনে হল আপনার?
বললুম,–তাই তো! শাবল বা ওইরকম কিছু দিয়ে ঘা মেরেও ওপড়ানো কঠিন।
হেমেনবাবু মুচকি হেসে চাপাস্বরে বললেন,–বিগ্রহ যে চুরি করবে, সে বেদি ওপড়ানোর চেষ্টা করবে কেন? তাই না?
–ঠিক বলেছেন।
–আমার ধারণা ফেলারাম বেদিটার কোনও গোপন কথা জানতে পেরেছিল।
অবাক হয়ে বললুম,–কী গোপন কথা?
–বেদিটা সহজেই হয়তো সিন্দুকের ডালার মতো ভোলা যায়।
–আপনি কি গুপ্তধনের কথা বলছেন?
–দেখুন জয়ন্তবাবু! প্রাচীনযুগে মন্দিরে ধনরত্ন নানা কারণে লুকিয়ে রাখা হতো। কাজেই যদি গুপ্তধনের কথা বলেন, আমি তাতে অবিশ্বাস করব না।
–তাহলে জয়কুমারবাবু বা তাঁর পূর্বপুরুষের নিশ্চয়ই তা জানার কথা।
–জয়কুমারদা কিছু নিশ্চয়ই জানেন। তা না হলে ফেলারাম মুখুজ্জেকে থামের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন কেন? উদ্দেশ্য ছিল, ভোরবেলা পুলিশের হাতে তাকে তুলে দেওয়া। যে বেদি ওপড়ানো অসম্ভব, তার জন্য লোকটাকে অত কড়া শাস্তি দেওয়ার কারণ কী? কালীনাথকে আমি চিনি। সে নিশ্চয়ই ফেলারাম মুখুজ্জেকে প্রচণ্ড মারধরও করেছিল। ওই লোকটাকে এলাকার সবাই বলে কালী পালোয়ান। ঠাট্টা করে অনেকে বলে কেলে-দত্যি। কালীর স্বাস্থ্য তো দেখলেন। ওর হাতের একটা থাপ্পড়ে রোগা মানুষ ফোরামের অক্কা পাওয়ার কথা।
চমকে উঠেছিলুম। বললুম,–হেমেনবাবু! তাহলে কি কালীর মার খেয়ে ফেলারামবাবু মারা পড়েছিলেন। আর তার গলায় ফাঁস আটকে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
হেমেনবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। আস্তে বললেন,–ঝাঁপুইহাটি পাড়াগাঁ। আত্মহত্যার কেসে যে পুলিশকে খবর দিতে হয়, তা ক’জন জানে? তাছাড়া ফেলারাম মুখুজ্জের হয়ে থানায় যাবেটা কে? সকালেই সাত তাড়াতাড়ি তাকে দাহ করা হয়েছিল বলে শুনেছি।
কথাগুলো বলেই তিনি হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। জমিদারবাড়িতে বিদ্যুতের অবস্থা বড় করুণ। বাগুলোর ভেতর লালরঙের সূক্ষ্ম তার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কালীনাথ একটা হ্যাঁজাগ জ্বালছিল। সে হ্যাঁজাগটা বারান্দার ওপর ঝুলন্ত একটা হুকে আটকে দিল।
কর্নেল ততক্ষণে ফিরে এসেছেন। জয়কুমারবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। আমরা গিয়ে বসলুম। জয়কুমারবাবু আমাকে বললেন,–বিগ্রহদর্শন করলেন? কর্নেলসায়েবকে বলছিলুম। উনি বললেন, বরং সকালে এসে দর্শন করবেন।
কর্নেল বললেন,–জয়কুমারবাবুর গান শোনার ইচ্ছা ছিল। শুনেছি, উনি অসাধারণ ধ্রুপদী সঙ্গীত গাইতে পারেন। কিন্তু গোপীবাবু নেই। কে বেহালা বাজাবেন? তবলা কে বাজায় অবশ্য জানি না।
জয়কুমারবাবু বললেন,–সঙ্গীতচর্চা এ বয়সে আর করতে পারি না। আমি তানপুরা বাজিয়েই গাইতুম। এখন হাত কাঁপে। তবলা সঙ্গত করত ভোলা। তবলায় ওর হাত খুব ভালো।
ভোলা চায়ের কাপপ্লেট নিতে এসেছিল। সে বলল,–কর্তামশাইকে কতবার বলেছি, তবলার বাঁয়া ফেঁসে আছে। সারিয়ে আনি। উনি বলেন, থাক গে!
কর্নেল বললেন,–তবলা কবে ফেঁসে গেল?
–প্রায় একবছর ধরে ফেঁসে পড়ে আছে স্যার।
–তবলা কি নিজে থেকেই ফেঁসে যায়?
–আজ্ঞে, যায়। কর্তামশাইকে জিগ্যেস করুন।
জয়কুমারবাবু বললেন, হ্যাঁ। ওয়েদারে টেম্পারেচারের ওঠানামার দরুণ তবলা এমনিই ফেঁসে যায়। গত বছর জুন মাসে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তারপর হঠাৎ বৃষ্টি। অনেকদিন পরে ইচ্ছে হয়েছিল, বৃষ্টির রাতে গানবাজনার আসর বসাই। তো ভোলা তবলা-বাঁয়া নিয়ে এসে বলল, বাঁয়া ফেঁসে গেছে!
কর্নেল আমাকে অবাক করে ওকে জিগ্যেস করলেন,–ভোলা, বটগাছের ডাল কাটার পর কি বায়াতবলাটা ফেঁসেছিল?
ভোলা কেমন যেন একটু হকচকিয়ে গেল। বলে,–আজ্ঞে!
জয়কুমারবাবু একটু হেসে বললেন,–বটগাছের ডাল কাটার সঙ্গে কি বায়াতবলা ফেঁসে যাওয়ার সম্পর্ক আছে কর্নেলসায়েব?
কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন,–বটগাছ স্বয়ং বৃক্ষদেবতা। অঙ্গছেদন করলে তার ক্রোধ স্বাভাবিক। ভোলার ওপর প্রথমে, তারপর তার ক্রোধটা তার তবলার ওপর পড়েছিল মনে হচ্ছে।
সবাই হেসে উঠলেন। জয়কুমারবাবু বললেন,–কর্নেলসায়েব এসে আমাদের মুখে হাসি ফোঁটালেন। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কাল রাত্তির থেকে বাড়ি একেবারে শ্মশান হয়ে উঠেছিল।
কর্নেল বললেন,–এবার উঠব। তার আগে একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।
–করুন প্রশ্ন!
–আপনার বাবা কিংবা ঠাকুরদা কিংবা আপনার কি এমন কোনও ফোটো আছে, যাতে আঙুলে সেই আংটির–মানে, আমি আংটি পরা ছবিই দেখতে চাই।
জয়কুমারবাবু বললেন,–আছে। আমার সঙ্গে লাইব্রেরিতে আসুন। দেখাচ্ছি। কালী! হ্যাঁজাগটা খুলে নিয়ে আয়।
বারান্দা দিয়ে এগিয়ে সেই ঘরের তালা খুললেন জয়কুমারবাবু। কালীনাথ আগে হ্যাঁজাগ নিয়ে ঢুকল। তারপর একে-একে আমরা ঢুলুম। বিশাল ঘর। চারদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা প্রকাণ্ড আলমারিতে পুরোনো বই ঠাসা আছে। কাঁচের ভেতর বইগুলো দেখা যাচ্ছিল। একখানে উঁচুতে একটা প্রকাণ্ড ছবি দেখিয়ে জয়কুমারবাবু বললেন,–আমার ঠাকুরদার অয়েলপেন্টিং। এক সায়েব শিল্পীর আঁকা। ওই দেখুন, ওঁর বাঁ-হাতের আঙুলে সেই আংটি।
কর্নেল টর্চের আলো ফেললেন। আংটিটা সত্যিই বেটপ। ডিম্বাকৃতি একটা নিরেট সোনার আব যেন বসানো আছে। ছবির আয়তনের অনুপাতে আংটিটার ওই ডিম্বাকৃতি অংশটা প্রায় একইঞ্চি লম্বা এবং মাঝখানটা প্রায় আধইঞ্চি চওড়া। এই আংটি সারাক্ষণ আঙুলে পরে থাকা অস্বস্তিকর মনে হল।
কর্নেলের গলায় যথারীতি বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছিল। তিনি তার ক্যামেরায় সম্ভবত আংটির ছবিটা তুললেন। ফ্ল্যাশবাল্ব ঝিলিক দিল।
ঠিক এইসময় বাইরে কেউ ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল,–বাঁচাও! বাঁচাও!
কর্নেল দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। তারপর কালীনাথ হ্যাঁজাগ নিয়ে বেরুল। আলোটা সে রেখে মেঘের মতো হাঁক ছেড়ে বলল,–কী হয়েছে ঠাকুরমশাই?
দেখলুম ঠাকুরমশাই নকুল মুখুজ্জে বৃত্তাকার রোয়াকের নিচে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। তার সেই ছেলেকে দেখতে পেলুম না।
.
পাঁচ
কিছুক্ষণ পরে নকুলঠাকুর ধাতস্থ হয়ে বললেন,–মন্দিরে সন্ধ্যারতি শেষ করে তালা এঁটে বিন্দুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলুম। তারপর আমি এদিকে এগিয়ে আসছি, হঠাৎ পেছনে কে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘আংটি দে! আংটি দে!’ ঘুরে দেখি দড়ির ফঁস আটকানো ফেলারাম। সে দু-হাত বাড়িয়ে আমার গলা টিপে ধরতে এল। আমি অমনি চাঁচাতে-চাঁচাতে পালিয়ে এলুম। ওরে বাবা! কী সাংঘাতিক দৃশ্য! সেই ফেলারাম!
কালীনাথ ততক্ষণে লাঠি আর টর্চ নিয়ে মন্দিরের দিকে ছুটে গেছে। জয়কুমারবাবু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু মাথায় ঢুকছে না!
কর্নেল বললেন,–আচ্ছা ঠাকুরমশাই! মন্দিরের কাছে আর ওই আগাছার জঙ্গলে তো আলো নেই। মন্দিরের মাথায় যে বাটা জ্বলছে, তার আলো খুব মিটমিটে। আপনি অন্ধকারে ভুল দেখেননি তো?
নকুল মুখুজ্জে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন,–তত কিছু অন্ধকার নয়। আমি স্পষ্ট দেখছি।
–ফেলারামকে দেখেছেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। গলায় ফাঁস আটকানো। ওরে বাবা! সেই ফেলা মুখুজ্জে!
–একটু ভেবে বলুন। আগে গলার ফাঁস দেখতে পেয়েছিলেন, নাকি তার মুখ দেখতে পেয়েছিলেন?
–আজ্ঞে? স্যার, গলার ফাঁসের দিকে প্রথমেই চোখ পড়েছিল! তারপর মুখের গোঁফদাড়ি!
–ধরুন, যদি অন্য কেউ গলায় দড়ির ফাঁস আটকে ফিসফিস করে আংটি চায়?
–তা কী করে হবে? আমি যে ফেলারামকেই দেখলুম। চোখ জ্বলছিল। দুটো হাত বাড়িয়ে–ওঃ!
জয়কুমারবাবু বললেন,–নকুল! তুমি বিশ্রাম নাও এ বেলা–শৈল বরং রান্না করুক। ভোলা! ও ভোলা! কোথায় গেলি তুই?
বারান্দার থামের আড়াল থেকে ভোলা বেরিয়ে এল। বলল,–গোয়ালঘরে ছিলুম। মশার কামড়ে গরুগুলো ছটফট করে। ঘাসের তলায় ঘুঁটের আগুন দিচ্ছিলুম। ধোঁয়ায় চোখের অবস্থা সাংঘাতিক।
–ঠাকুরমশাইকে তার ঘরে নিয়ে যা। শৈলকে বল, গরম-গরম চা করে দেবে। আর আমাদের জন্যও আরেক দফা চা।
কর্নেল বললেন,–থাক জয়কুমারবাবু! আমরা এবার চলি। একটু সাবধানে থাকবেন।
কালীনাথ এসে বলল,–কেউ কোথাও নেই। মানুষ হলে হেমেনবাবুর ড্রাইভারের চোখে পড়ত। দেউড়ি দিয়ে না পালানো ছাড়া উপায় ছিল না তার। অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোনোর সাধ্যি নেই কারও। খিড়কির দোর ভেতর থেকে বন্ধ।
জয়কুমারবাবু বললেন, আমার বন্দুক আর দুটো কার্টিজ এনে দে। এই নে চাবি। ফেলারামের ভূত হোক আর যে-ই হোক, গুলি করব। আর এই বদমাইশি সহ্য হচ্ছে না।
জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে দেউড়ির কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন,–বটগাছটা ভিন্ন প্রজাতির। এ দেশে এমন বটগাছ কোথাও দেখিনি।
হেমেনবাবু বললেন,–কেন?
–সব বটগাছের প্রচুর ঝুরি নামে। জমিদারবাড়ির বটগাছটার ঝুরি নেই। এ ধরনের বটগাছ আমি ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরের দেশগুলোতে দেখেছি। ফিগট্রি বলতে আমাদের দেশে ডুমুর গাছ বোঝায়। ডুমুর গাছও অবশ্য বটগাছেরই জ্ঞাতি। কিন্তু এই বটগাছটা ওইসব অঞ্চলের সত্যিকার ফিগট্রি। এখন বর্ষায় প্রচুর ফল ধরেছে। পাখিরা হল্লা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফলগুলো খাচ্ছে। আমি একটা ফল কুড়িয়ে স্বাদ নিলুম। বেশ মিষ্টি। এদেশের বটফলও পাখিদের কাছে সুখাদ্য। কিন্তু এই বটফল মানুষও খেতে পারে।
হেমেনবাবু বললেন,–বলেন কী! দিনের বেলা এসে খেয়ে দেখব তাহলে!
গাড়িতে ঢুকে কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, রায়চৌধুরিবাবুদের পূর্বপুরুষদের কেউ পশ্চিম এশিয়া থেকে এই গাছের চারা এনেছিলেন।
আমি বললুম,–বটগাছটা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কেন বলুন তো?
হেমেনবাবু একটু হেসে বললেন,ফেলারামের ভূতরহস্যের সঙ্গে কর্নেল নিশ্চয়ই গাছটার কোনও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন!
অনিল গাড়ি স্টার্ট দিল। হেডলাইটের আলোয় জনহীন রাস্তা আর গাছপালা ঝলসে যাচ্ছিল। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন হেমেনবাবু! জয়কুমারবাবুর ঠাকুরদার আঙুলে যে আংটি দেখলুম, সেটাকে তুর্কিরা বলে, কিং সলোমন’স রিং!
–আঁ? বলেন কী!
-বাইবেলের সেই রাজা সলোমনের আংটি। আমি এক তুর্কি ভদ্রলোকের কাছে শুনেছিলুম, ওই আংটির ডিম্বাকৃতি অংশের ভেতর মারাত্মক বিষ ভরা থাকত। কোনও শত্রুকে মেরে ফেলতে চাইলে তার সঙ্গে শত্রুতার মিটমাট করে নিয়ে প্রাচীনযুগের তুর্কিরা তাকে সরাইখানায় আমন্ত্রণ করত। তারপর তার অজ্ঞাতসারে আংটির বিষ শত্রুর পানীয়ে মিশিয়ে দিত।
হেমেনবাবু হেসে বললেন,–জয়কুমারদার ঠাকুরদার আংটিতে মারাত্মক বিষ ভরা ছিল না তো? আমার সত্যি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শুনে!
কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে মন দিলেন। কিছুক্ষণ পরে সরকারি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে আমি বললুম,–হালদারমশাই কোথায় গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াচ্ছেন কে জানে!
কর্নেল বললেন,–হালদারমশাইকে নিয়ে তোমার উদ্বেগের কারণ নেই। উনি পূর্ববঙ্গের মানুষ। স্থলের চেয়ে জলই ওঁর প্রিয়। এই এলাকাটা কতকটা পূর্ববঙ্গের মতোই। নদী বিল খাল! এখন সর্বত্র জল।
হেমেনবাবু বললেন,–কর্নেলসায়েব! জয়ন্তবাবুকে মন্দিরে রুদ্রদেবের বিগ্রহ দর্শন করিয়েছি। জয়কুমারদা বলছিলেন, ফেলারাম বিগ্রহের বেদি ওপড়াচ্ছিল। জয়ন্তবাবু তো দেখেছেন। বিগ্রহের বেদি ওপড়ানো অসম্ভব। ফেলারাম মুখুজ্জে মন্দিরে ঢুকে এমন কী করছিল। যে জয়কুমারদা ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন?
কর্নেল সে কথায় কান না দিয়ে বললেন,–জয়ন্ত বিগ্রহদর্শন করে পুণ্যার্জন করেছে। এবার সাধুসন্ন্যাসী দর্শন করুক। আরও পুণ্য হবে।
বললুম,–কোথায় সাধুসন্ন্যাসী!
কথাটা বলেই হেডলাইটের আলোয় দেখলুম, একজন জটাজুটধারী কৌপীনপরা সন্ন্যাসী এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে মড়ার খুলি আর কাঁধে ঝোলানো গেরুয়াঝুলি নিয়ে সামনের দিক থেকে আসছিলেন। গাড়ির হেডলাইট থেকে চোখ বাঁচাতে মড়ার খুলিটা চোখের সামনে তুলে রাস্তার বাঁদিকে ঘাসের ওপর সরে দাঁড়ালেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলুম, সন্ন্যাসী খুলিটা নামিয়ে কর্নেলকে যেন দেখে নিলেন। কর্নেল বললেন,–সাক্ষাৎ অবধূত। অবশ্য কাঁপালিকও হতে পারেন।
হেমেনবাবু বললেন,–… জলটুঙ্গিতে মাঝে-মাঝে সন্ন্যাসীদের এসে ডেরা পাততে দেখেছি।
–ইনিও সেখানে যাচ্ছেন সম্ভবত।
আমি সন্ন্যাসীকে চিনতে পেরেছিলুম। গোয়েন্দাপ্রবর হালদারমশাই ছাড়া কেউ নন। উনি এই ছদ্মবেশটা ধরতে খুব পটু। কথাটা চেপে গিয়ে বললুম,–আকস্মিক যোগাযোগটা বিস্ময়কর। কর্নেল সন্ন্যাসীর কথা বলামাত্র সন্ন্যাসীদর্শন হয়ে গেল!
কর্নেল বললেন, তুমি সামনে দূরে তাকালে সন্ন্যাসীকে অনেক আগেই দেখতে পেতে!
হেমেনবাবু সকৌতুকে বললেন,–জয়ন্তবাবু সাংবাদিক। আপনি বলছেন, জয়ন্তবাবুর দূরদৃষ্টি নেই?
কর্নেল হাসলেন,–জয়ন্তকে আপনি তাতিয়ে দিচ্ছেন হেমেনবাবু!
এইসব হাসি-পরিহাসের দিকে আমার মন ছিল না। আমি ভাবছিলুম, নকুলঠাকুরের কথা! আমরা ও-বাড়িতে থাকার সময়ই ফেলারামবাবুর ‘গলায়-দড়ি’ ভূতটা ওঁকে দেখা দিল কোন সাহসে? ওঁর হাবভাব দেখে বুঝতে পারছিলুম, সত্যিই উনি ভয় পেয়েছেন।
অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, কর্নেল একা বাড়ির পিছনদিকে বটগাছটা দেখতে গিয়েছিলেন। ওঁকে ভূতটা দেখা দেয়নি! ফেলারামবাবুর প্রেতাত্মা কর্নেলকে আংটি চাইলেও পাবে না বলেই কি দেখা দেয়নি? হ্যাঁ–অ্যাংটিই ভূতটার টার্গেট। এদিকে কর্নেল বলছেন, ওই আংটি পশ্চিম এশিয়ায় তুর্কিরা ব্যবহার করে। কিং সলোমন’স রিং। এমন অদ্ভুত রহস্যের পাল্লায় কর্নেল কখনও পড়েছেন বলে মনে পড়ে না।
বাবুগঞ্জের বাজার পেরিয়ে যাওয়ার সময় শুনলুম, হেমেনবাবু ফেলারাম মুখুজ্জেকে কালীনাথের প্রচণ্ড প্রহারের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছেন। আমাকে যা সব বলছিলেন। মৃত ফেলারামবাবুকে বটগাছে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর ওপর হেমেনবাবু গুরুত্ব দিচ্ছেন। কর্নেল একটু পরে বললেন,–সেটা অসম্ভব নয়। তবে ফেলারামবাবুর মন্দিরে ঢোকার উদ্দেশ্যটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। শুধু এটুকু অনুমান করা যায়, ওই আংটির সঙ্গে সম্ভবত মন্দিরের বিগ্রহ রুদ্রদেবের সম্পর্কের সম্ভাবনা আছে।
হেমেনবাবু বললেন,–আমি জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আলোচনার সময় গুপ্তধনের সম্ভাবনার কথা বলেছিলুম। এমন হতেই পারে, জয়কুমারদা জানেন না ওই আংটির মধ্যে মন্দিরে লুকিয়ে রাখা তাঁর পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের সূত্র আছে। কী মনে হয় আপনার?
কর্নেল বললেন, আপনার কথায় যুক্তি আছে। দেখা যাক, এই সম্ভাবনাটার কোনও ক্ল পাওয়া যায় নাকি।
হেমেনবাবু বললেন,–থানার ও. সি. তপন বিশ্বাস আপনার সঙ্গে আলাপের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। ডি.আই.জি. সায়েবের মুখে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা তিনি শুনেছেন!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ডি.আই.জি. মানে শচিন রুদ্র?
–হ্যাঁ। চেনেন তাকে?
–শচিন কলকাতার লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ট্রাফিকে ডি.সি. ছিল। সেখান থেকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে কিছুকাল থাকার পর পায় ডবল প্রমোশন। একটা আন্তর্জাতিক চোরা মাদক চালানচক্রকে সে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উচ্চশিক্ষিত ছেলে। পুলিশে এ ধরনের প্রতিভাবান উচ্চশিক্ষিত ছেলে যত বেশি ঢুকবে, তত পুলিশের বদনাম ঘুচবে। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে?
–হয়েছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় না কিছু। বয়স তিরিশ-বত্রিশ বলে মনে হয়েছে।
–এই প্রমোশনে শচিন খুশি হয়নি। বুঝতেই পারছেন, কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ ওকে প্রমোশনের নামে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
হেমেনবাবু বললেন,–অনিল! থানার সামনে গাড়ি দাঁড় করাবে।
বাবুগঞ্জ থানার অফিসার-ইন-চার্জ তপন বিশ্বাস কর্নেলকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকতে যাচ্ছিলেন! কর্নেল খপ করে তাঁর হাত ধরে ফেলে করমর্দন করলেন। বললেন, আপনাদের ডি.আই.জি. শচিন রুদ্র আমাকে “ফাদার খ্রিসমাস বলে। অবশ্য সেটা শীতকালে।
তপনবাবু বললেন,–বসুন স্যার। রুদ্রসায়েবের কাছে শুনেছি আপনি কফির ভক্ত। তবে এখানে খাওয়ার মতো কফি পাওয়া যায় না।
কর্নেল খুশি হয়ে বললেন,–হ্যাঁ। এই মুহূর্তে কফি আমার দরকার। নার্ভ ঝিমিয়ে পড়েছে। ঝাঁপুইহাটির জমিদারবাড়ি গিয়ে ভূতের গল্প শুনে ক্লান্তও হয়েছি।
তপনবাবু কফি আনতে বললেন একজন কনস্টেবলকে। তারপর বললেন, আমার কোয়ার্টার থেকেই কফি আসবে। হেমেনবাবু টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, সন্ধ্যার পর যে-কোনও মুহূতে আপনি এসে যাবেন।
কর্নেল বললেন,–গোপীমোহন হাজরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর কী কারণ বলা হয়েছে?
তপনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–ভূতের হাতে মারা পড়েননি ভদ্রলোক। এমনিতেই ওঁর হার্টের একটা ভালভ খারাপ ছিল। তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, বেঁচে থাকলে শিগগির ওঁর লাং-ক্যান্সার হতো। শক্ত ভোতা কোনও ভারী জিনিস দিয়ে মাথার পেছনে খুনি এত জোরে আঘাত করেছিল, মাথার খুলি ফেটে মগজ বেরিয়ে পড়েছিল। সমস্যা হল, অমন নিরীহ এক আর্টিস্ট লোককে খুনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার, খুনি প্রচণ্ড রাগে ওঁর বেহালাটা ভেঙে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বেহালার খাপ ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করেছে। ঘটনাটা প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ বলে আপাতদৃষ্টে মনে হয়। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে ওঁর তেমন কোনও শত্রু ছিল বলে জানা যায়নি। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার এস. আই. মনোরঞ্জন পাল এখনও হাল ছাড়েননি।
হেমেনবাবু বললেন,–খুনির গায়ে জোর প্রচণ্ড বলতে হবে।
-হ্যাঁ। এক ঘায়ে মাথার পিছনটা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দিতে হলে প্রচণ্ড শক্তি দরকার। বিশেষ করে মানুষের মাথার পিছনদিকটা অন্য অংশের চেয়ে শক্ত।
হেমেনবাবু একটু হেসে বললেন,–ওরকম গায়ের জোর জমিদারবাড়ির কালীনাথেরই আছে। কিন্তু কালী পালোয়ানের দুটো হাতই যথেষ্ট। গোপীবাবু তার এক ঘুসিতেই মারা পড়তেন। তাছাড়া কালী পালোয়ান ওঁকে মারবে কেন?
কফি এসে গেল। তার সঙ্গে কাজুবাদাম, পটেটো চিপস। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, –অসাধারণ! কফির স্বাদ নির্ভর করে হাতের ওপর। যার হাত এই কফি করেছে, তার প্রতিভা আছে!
তপনবাবু সহাস্যে বললেন,–আমার গৃহিণী আপনার ফ্যান। জয়ন্তবাবুরও ফ্যান। সত্যি কথাটা এবার বলি কর্নেলসায়েব! ডি.আই.জি. সায়েব আপনার পরিচয় দেওয়ার বহু আগে থেকেই আমার গৃহিণীর সূত্রে আপনার এবং জয়ন্তবাবুর পরিচয় আমার জানা হয়ে গেছে। কেয়া বলে, ‘দা মাস্টার ট্রায়ো।‘ কিন্তু ‘ট্রায়ো’-র তৃতীয়জন প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে রেখে এলেন কেন?
হেমেনবাবু বলে দিলেন, তিনিও আছেন। গত পরশু রাত ১২টা থেকে দুপুর পর্যন্ত মিঃ হালদার আমার গেস্ট ছিলেন। তারপর
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন,–হালদারমশাই খেয়ালি আর হঠকারী প্রকৃতির মানুষ। আপনাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ইন্সপেক্টর ছিলেন। পুলিশজীবনের প্রায় সবটাই ওঁর মফস্বলে কেটেছে। কাজেই পাড়াগাঁয়ের নাড়ি-নক্ষত্র চেনেন। বাই দা বাই, জমিদারবাড়িতে ‘গলায়-দড়ে’ ভূতের উপদ্রবের কথা কি আপনি শুনেছেন?
তপন বিশ্বাস হেসে উঠলেন,–শুনেছি। সর্বত্র রটে গেছে। জমিদারবাড়ির ফেলারাম মুখুজ্জের আত্মহত্যার সময় আমি এ থানায় ছিলুম না। আগের ও.সি. চন্দ্রমোহনবাবু ঘটনাটা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তার কাছে শুনেছিলুম, ফেলারামবাবুর অনেক ধারদেনা ছিল। ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন।
–আশ্চর্য ব্যাপার, সেই ফেলারামবাবু ভূত হয়ে জমিদারবাড়ির লোকেদের খুব জ্বালাতন করছেন।
তপনবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আমাদের সোর্সে শুনেছি, ফেলারামবাবুর ভূত আংটি চাইতে আসে। ওদিকে জয়কুমারবাবুর নাকি একটা সোনার আংটি কবে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই আংটি ফেলারামবাবুর প্রেতাত্মা চাইতে আসে কেন? আংটি তো তার নয়। যাই হোক, কর্নেলসায়েব বলুন, কিছু আঁচ করতে পেরেছেন নাকি?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–নাঃ! বড্ড গোলমেলে কেস। গোলকধাঁধায় ঢুকে গেছি। কথা দিচ্ছি, আপনার প্রয়োজন হলে সবরকম সাহায্য আপনি পুলিশের কাছে পাবেন।
আমরা ও.সি. তপনবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে গাড়িতে চাপলুম। তারপর হেমেনবাবুর বাড়িতে ফিরলুম।
তখন রাত প্রায় সওয়া আটটা। কর্নেল বললেন,–আরেক দফা কফি খাব রাত নটা নাগাদ। অসুবিধে না হলে ডিনার খাব রাত দশটায়।
হেমেনবাবু বলে গেলেন, আপনার যা অভিরুচি!
বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর থেকে গুমোট গরম টের পাচ্ছিলুম। বাবুগঞ্জে বিদ্যুতের অবস্থা ভালো। ফ্যানের নিচে বসে বললুম,–আমি একটা অঙ্ক কষেছি কর্নেল!
কর্নেল টুপি খুলে ইজিচেয়ারে বসে বললেন,–বলো! শোনা যাক।
-জয়কুমারবাবুর ঠাকুরদার তুর্কি আংটির ভেতর এমন কোনও সূত্র লুকোনো আছে, যার সাহায্যে মন্দিরে রুদ্রদেবের বেদির তলায় লুকোনো গুপ্তধন উদ্ধার করা যায়।
–ধরো, তোমার অঙ্কটা ঠিক। তাহলে আংটি যে পেয়েছে বা হাতিয়ে নিয়েছে, সে গুপ্তধন আত্মসাৎ করে কেটে পড়ত। ফেলারারামের প্রেতাত্মা তা নিশ্চয়ই টের পেত। সে এখনও আংটি চাইতে হানা দিত না।
–আংটি এখনও কেউ পায়নি। কারণ নিচের তলার বাথরুমের জানালা থেকে কোনও কাক আংটি নিয়ে গিয়ে তার বাসায় রেখেছিল। আংটি হয়তো এখনও কাকের বাসাতেই আছে।
–আংটি কাক তুলে নিয়ে গেছে গতবছর জুন মাসে। কাকেরা প্রতিবছর নতুন করে বাসা বানায়। বাসা বদলাতেও দেখেছি আমি।
–তাহলে কোথাও ঝোঁপজঙ্গলে পড়ে আছে। কিংবা কাদার তলায় চলে গেছে। বরং বটতলাটা ভালো করে খুঁজলে আংটিটা এখনও খুঁজে পাওয়ার চান্স আছে।
কর্নেল জ্বলন্ত চুরুট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হলেন। তারপর চোখ খুলে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–গোপীমোহনবাবুর সব সময় বেহালা সঙ্গে রাখা এবং তার মৃত্যুর পর সেই বেহালা গুড়ো হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা এই কেসে খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, জয়ন্ত!
একটু চমকে উঠে বললুম, তাহলে কি গোপীবাবুর বেহালার ভেতর আংটি লুকোনো ছিল?
-খুনির বেহালার ওপর রাগের কী কারণ থাকতে পারে? উত্তেজিতভাবে বললুম,–কর্নেল! তাহলে আজ রাত্রে খুনি মন্দিরে ঢুকবে!
–খুনি অত বোকা নয়। সে হালদারমশাইকে গতকাল এবং আমাদের আজ জমিদারবাড়িতে দেখেছে। আমাদের কথাবার্তাও শুনেছে। তাই সে সতর্ক হতে বাধ্য। আর তার ওই সতর্কতার আভাস আমরা পেয়েছি নকুলঠাকুরের সামনে ফেলারামের প্রেতাত্মার আবির্ভাবে। প্রেতাত্মা আংটি চাইছিল ওঁর কাছে। ওটা খুনির একটা চাল। আমাদের সে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।
–কর্নেল! তাহলে খুনি কি জমিদারবাড়িরই কেউ?
কর্নেল আবার চোখবুজে হেলান দিলেন। তারপর আস্তে বললেন,–অবশ্যই।
–সেই লোকটাই কি গলায় দড়ির ফাঁস আটকে ফেলারামবাবুর ভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে? আবার কে?-বলে কর্নেল ধ্যানমগ্ন হলেন।
.
ছয়
রাত্রে খাওয়ার সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। খাওয়ার পর দোতলায় আমাদের ঘরে এসে কর্নেলকে বলেছিলুম,–হালদারমশাই সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে আছেন। এই বৃষ্টিতে ওঁর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠবে।
কর্নেল বলেছিলেন–একালের সন্ন্যাসীরা রিস্টওয়াচ পরেন। গাড়ি চাপেন। রেলগাড়ি, বাসমোটর বা প্লেনেও চাপেন দেখেছি। বৃষ্টিতে তারা রেনকোট পরতেও পারেন। যাই হোক, ওসব চিন্তাভাবনা না করে শুয়ে পড়া যাক। বৃষ্টির রাতে বিছানা খুব আরামদায়ক হয়ে ওঠে।
বিছানা সত্যি আরামদায়ক হয়েছিল। ঘুম ভেঙেছিল কারও ডাকাডাকিতে। চোখ খুলে দেখি, একটা লোক আমার জন্য বেড-টি এনেছে।
নিশ্চয়ই কর্নেলের নির্দেশ। উঠে, বসে চায়ের কাপপ্লেট নিয়ে বললুম,–কর্নেলসায়েব কি বেরিয়েছেন?
লোকটি বিনীতভাবে বলল,–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার বাবুমশাই আর সায়েব ভোরবেলা গঙ্গার বাঁধে বেড়াতে গেছেন।
জিগ্যেস করলুম,–তোমার নাম কী?
–আজ্ঞে, আমার নাম বেচারাম। সবাই বেচু বলে ডাকে।
-–আচ্ছা বেচু, তুমি ঝাঁপুইহাটির ওদিকে ডাকিনীতলায় কখনও গেছ?
–চৈত্র সংক্রান্তির রাত্তিরে ওখানে এ তল্লাটের অনেকে মানত দিতে যায়। আমিও যাই।
–ডাকিনীতলা মানে কি কোনও গাছ?
বেচু মুখে ভয়-ভক্তির ভাব ফুটিয়ে বলল, স্যার! ওই গাছটার নাম অচিন গাছ। অমন গাছ আমি কোথাও দেখিনি। চৈত্র-সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলা ঢাকঢোল, কাসির বাজনা শুরু হলেই গাছটার ডালপালা থরথর করে কাঁপে। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। জেলেদের মুখে শুনেছি, রাতবিরেতে ওই গাছে ডাকিনীর কান্না শোনা যায়।
–ডাকিনীতলার জলটুঙ্গিতে অন্যসময় মানুষজন যায় না?
–কার বুকের পাটা? একাদোকা গেলে মুখে রক্ত উঠে মারা পড়বে যে! একবার ঝাঁপুইহাটির একটা লোক সাহস করে গিয়েছিল। তারপর তার আর পাত্তা নেই। তখন দলবেঁধে অনেক লোক নৌকোয় চেপে ডাকিনীতলায় তাকে খুঁজতে গেল। গিয়ে দেখে, নোকটা ডাকিনীতলায় পড়ে আছে। রক্তবমি করে মারা পড়েছে।
–কতদিন আগের কথা এটা?
–এই তো গতবছর। বাবুগঞ্জের লোকও ঝপুইহাটিতে গিয়ে তার মড়া দেখতে ভিড় করেছিল।
এই সময় নিচের তলা থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকল। বেচারাম তখনই চলে গেল। বুঝলুম সে আরও কিছু সাংঘাতিক ঘটনার কথা বলত। সুযোগ পেল না।
কর্নেল ফিরলেন সওয়া নটায়। সহাস্যে সম্ভাষণ করলেন,–মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
বললুম,–মর্নিং কর্নেল! আশা করি আপনি সুইস গেটের কাছে অশ্বত্থ গাছে সেই গগনবেড় পাখির দর্শন পেয়েছেন?
টুপি, পিঠে-আঁটা কিটব্যাগ, ক্যামেরা আর বাইনোকুলার টেবিলে রেখে কর্নেল বললেন, –আমার দুর্ভাগ্য! ক্যামেরায় টেলি-লেন্স ফিট করার সময় দুষ্টু পাখিটা তার প্রকাণ্ড ঠোঁট ফাঁক করে আমাকে গালাগালি করে উড়ে গেল। বাইনোকুলারে দেখলুম, উড়তে-উড়তে সে ডাকিনীতলার জলটুঙ্গির জঙ্গলে চলে গেল। সম্ভবত সেখানে ওর জুটি আছে। বাসা থাকাও সম্ভব। বাসাতে ওদের কাচ্চাবাচ্চা থাকার মরশুম এটা।
–আপনারা কি গঙ্গার বাঁধে হাঁটতে-হাঁটতে গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। এবার যাব হেমেনবাবুর পানসি নৌকোতে।
–সাবধান কর্নেল! কিছুক্ষণ আগে বেচু বেড-টি দিতে এসে বলল, গতবছর ডাকিনীতলায় একটা লোক গিয়ে রক্তবমি করে মারা পড়েছিল।
কর্নেল হাসলেন,–লোকেরা একটু বাড়িয়ে বলে। হেমেনবাবুর কাছে শুনেছি, একটা লোক চুরি করে কাঠ কাটতে গিয়েছিল ডাকিনীতলার জঙ্গলে। সাপের কামড়ে মারা পড়েছিল।
শিউরে উঠলুম,–সর্বনাশ! সন্ন্যাসীবেশী হালদারমশাই কোনও কারণে ওখানে রাত কাটাতে গেলে সাপের পাল্লায় পড়বেন!
কর্নেল বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,–হালদারমশাই একসময় জাঁদরেল দারোগাবাবু ছিলেন। রাতবিরেতে বনবাদাড়ে চোর-ডাকাতের খোঁজে বিস্তর হানা দিয়েছেন। সাপ সম্পর্কে তার সতর্কতা স্বাভাবিক। যাই হোক, আমরা নটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে বেরুব।
হেমেনবাবুর বাড়ির উত্তরে বাঁধানো ঘাটে একটা পানসি নৌকো বাঁধা ছিল। আমরা সেই পানসিতে চাপলুম। পেছনে হালের মাঝি, সামনে দাঁড়ের মাঝি। হেমেনবাবুর হাতে দোনলা বন্দুক। তাঁকে জিগ্যেস করলুম,–বিলের জলে শানবাঁধানো ঘাট কীভাবে তৈরি করেছেন?
হেমেনবাবু বললেন,–কোনও-কোনও বছর গ্রীষ্মকালে বিলের জল কমে যায়। ওই ঘাট থেকে দূরে সরে যায়। বছর দশেক আগে এলাকায় ভীষণ খরা হয়েছিল। সেই সুযোগে পাকাঘাট তৈরি করেছিলুম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জয়ন্ত একটু চিন্তা করলেই কথাটা বুঝতে পারত। সত্যি হেমেনবাবু! জয়ন্ত কীভাবে সাংবাদিকতা করে, আমার কাছে এটা এখনও রহস্য।
মনে-মনে চটে গিয়ে বললুম, ইঞ্জিনিয়াররা জলভরা নদীতে ব্রিজ তৈরি করেন। তাই আমি ভেবেছিলুম, সেইভাবেই ঘাটটা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। তাই
আমার কথা চাপা পড়ল কর্নেলের কথায়। বাইনোকুলারে তিনি দূরে একটা জলটুঙ্গি দেখতে-দেখতে বলে উঠলেন,–কী আশ্চর্য! সেই সন্ন্যাসী একটা গাছের তলায় ধুনি জ্বেলে বসে আছেন দেখছি! ওখানে একটা ছোটো ছিপনৌকো বাঁধা আছে। কোনও শিষ্য নৌকোটা গুরুদেবের সেবার জন্য দিয়েছেন হয়তো!
হেমেনবাবু বললেন,–নৌকোটা তাহলে ঝাঁপুইহাটির চরণ-জেলের। গাঁজার প্রসাদ পেতে এবার চরণ সন্ন্যাসীর সঙ্গ ধরেছে।
বিলের জল উত্তাল বাতাসে দুলে উঠছিল। যত পানসি নৌকো এগোচ্ছে, ঢেউ ক্রমশ বাড়ছে। কর্নেল ছইয়ে হেলান দিয়ে টাল সামলাচ্ছিলেন। আকাশে আজ ভাঙাচোরা মেঘ। মাঝে-মাঝে উজ্জ্বল রোদ্দুর ঝলসে উঠছে। জলটুঙ্গিটা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। খালিচোখে চাপ-চাপ সবুজের পুঞ্জ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ কর্নেল বললেন,–হেমেনবাবু! মাঝিদের বলুন, আমরা সোজা উত্তরে এগিয়ে ডাকিনীতলার পশ্চিমদিকে নামব। সন্ন্যাসীর ধ্যানভঙ্গ করা উচিত হবে না। তাছাড়া গগনবেড় পাখিটাকে ওইদিকেই জলটুঙ্গিতে যেতে দেখেছি।
হেমেনবাবু সেইমতো নির্দেশ দিলেন। তারপর আমাকে বললেন,–বুঝলেন জয়ন্তবাবু, আজকাল আইন হয়েছে, পাখি বা বন্য জীবজন্তু মারা চলবে না। তবে আমি বহুবছর আগে পাখি শিকার করা ছেড়ে দিয়েছি। বন্দুকটা নিয়েছি অন্য কারণে। বিলের কোনও-কোনও জলটুঙ্গিতে ডাকাতদের ডেরা থাকে। জেলেদের ওরা কিছু বলে না। জেলেদের সঙ্গে ওদের শর্ত হল, জেলেরা ওদের কথা গোপন রাখবে। তাহলে জেলেরা নিরাপদে মাছ ধরতে পারবে। কিন্তু আমাকে জলডাকাতরা শত্রু মনে করে। ওদের হাতেও আজকাল ফায়ার আর্মস থাকে।
বললুম,–সর্বনাশ! আপনাকে দেখলে তাহলে ওরা যদি গুলি ছোড়ে?
হেমেনবাবু হাসলেন,–ডাকিনীতলার জলটুঙ্গিতে ডাকাতরা ডেরা পাতে না। কারণ ওই জলটুঙ্গিটা ঝাঁপুইহাটি গ্রামের কাছে। খালিচোখেই পুলিশ ওদের দেখতে পাবে। তাছাড়া ডাকাতরাও গ্রাম্য লোক। ডাকিনী সম্পর্কে ওদের মনে আতঙ্ক আছে। তাই চৈত্র সংক্রান্তির রাতে গোপনে ডাকিনীতলায় মানত দিতে আসে।
বাতাস বইছিল পূর্বদিক থেকে। তাই আমাদের নৌকো উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারছিল। কাছে ও দূরে জেলেনৌকো দেখতে পাচ্ছিলুম। ডাকিনীতলার জলটুঙ্গির পশ্চিমে গিয়ে এবার সামনে থেকে বয়ে আসা বাতাসের চাপে নৌকোর গতি কমে গেল। কর্নেল বাইনোকুলারে এখন সম্ভবত গগনবেড় পাখি খুঁজছিলেন।
ডাকিনীতলার জলটুঙ্গির পশ্চিমদিকে পানসি যখন ভিড়ল, তখন প্রায় বারোটা বাজে। হেমেনবাবু দাঁড়ের মাঝিকে বললেন,–পবন! তোমার খুড়ো পানসিতে বসে বিশ্রাম নিক। তুমি দা আর লাঠি নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলো। এখানে ঝোঁপঝাড় কম। দায়ে কেটে পথ করতে হবে। লাঠি বাঁ-হাতে রেডি রাখবে। সাপের উপদ্রব আছে শুনেছি।
পবন বলিষ্ঠ গড়নের যুবক। কষ্টিপাথরে গড়া যেন তার শরীর। গলায় শখ করে রুপোর সরু হার ঝুলিয়েছে। তাতে একটা ছোটো লকেটে কোনও সাধুবাবার ছবি দেখলুম। বাঁ-বাহুতে একটা তামার মাদুলি লাল সুতোয় বাঁধা আছে। সে এক লাফে লাঠি আর লম্বাটে দা হাতে নিয়ে নেমে একটা গাছের গুঁড়িতে নৌকোর কাছি শক্ত করে বেঁধে দিল। তারপর বলল,–বাবুমশাই! ওই দেখুন ঝোঁপঝাড়ের ভেতর পায়ে-চলা পথ। এ তো আশ্চর্য ব্যাপার! এদিকে নৌকো ভিড়িয়ে কারা চলাচল করে। ডাকাতরা এখানে ঘাঁটি করেনি তো?
কর্নেল নৌকো থেকে নেমে বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, সামনে ঘন জঙ্গল দেখছি। পথটা চলে গেছে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে। দেখা যাক, ডাকাতরা কীভাবে আমাদের অভ্যর্থনা করে।
হেমেনবাবু বললেন,–কর্নেল! অকারণ ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী?
পবন বলল,–জঙ্গলের আড়াল থেকে ডাকাতরা গুলি ছুঁড়তে পারে স্যার!
কর্নেল বললেন,–তাহলে আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। আমি চুপিসাড়ে গিয়ে দেখে আসি কোথায় পথটা শেষ হয়েছে।
কর্নেল হেমেনবাবু বা পবনের নিষেধ শুনলেন না। অগত্যা আমরা তিনজনে তাকে অনুসরণ করলুম। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল ঘুরে ঠোঁটে আঙুল রেখে ইঙ্গিতে বললেন–কথা বলা চলবে না।
উঁচু গাছের পর ঝোঁপঝাড়ের ভেতর পথটা ডাইনে ঘুরেছে। সেই ঝাকের মুখে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে কর্নেল থামলেন। এবার কাদের চাপাগলায় কথাবার্তা শোনা গেল। আমরা কর্নেলের কাছে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসলুম। স্যাঁতসেঁতে ঘাসে ঢাকা মাটি। রাতের বৃষ্টির জল ঝোঁপের নিচের পাতায় আটকে ছিল। আমাদের ভিজিয়ে দিল। কিন্তু তখন আমাদের কান কাদের কথাবার্তার দিকে। এইসব কথা কানে আসছিল :
-–ফেলারামবাবুর কথা মিথ্যা হতেই পারে না। গতরাত্রে বৃষ্টির সময় সুযোগ ছিল।
–কিন্তু কালী ব্যাটাচ্ছেলে যে সারা রাত জেগে থাকে। ওর চোখে এড়িয়ে বাড়ি ঢোকা কঠিন।
–কালী করবেটা কী? পাইপগানের গুলিতে ওর মুণ্ডু উড়িয়ে দেব।
–তা না হয় দিলুম। কিন্তু বুড়োকর্তা দোতলা থেকে বন্দুকের গুলি ছুড়বে যে! কাল তোরা বৃষ্টির সময় পাঁচিল ডিঙোতে চাইছিলি। অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে পড়ে থাকতে হবে।
–হ্যাঁ রে! গুপীবাবুও তো বলেছিল মন্দিরে মেঝেতে সাত রাজার ধন লুকোনো আছে।
–আছে তো বটেই। তা না হলে কি ফেলারামবাবু মারা পড়ে? গুপীবাবুরও একই দশা হয়?
–গুপীবাবু আমাকে বলেছিল, কালীর এক ঘুসিতেই ফেলারাম পটল তুলেছে! হাঃ হাঃ হাঃ!
–হাসিস নে! রাগে আমার মাথা খারাপ হয়ে আছে। তারপর গুপীবাবুও মারা পড়ল।
–মাইরি! গুপীবাবুকে গাবতলায় কে মারল কে জানে! কেন মারল বুঝি না!
–ন্যাকা! বুঝিস না কিছু? ফেলারাম মুখুজ্জে বুড়োকর্তার ঠাকুরদার কী বই পড়ে জানতে পেরেছিল মন্দিরে সাত রাজার ধন লুকোনো আছে। গুপীবাবুকে ফেলারামবাবু জুটি করতে চেয়েছিল। দু’জনই মারা পড়ল। পুলিশ মাইরি বুড়োকর্তার টাকা খেয়ে সব জেনেও চুপ করে আছে।
–ফেলারামবাবুর ভূতের গুজব রটেছে। ব্যাপারটা বোঝা যায় না। হা রে! আমাদের কেউ রাতবিরেতে ভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে না তো?
–বলা যায় না। ঘরের শত্রু বিভীষণ থাকতেই পারে। ভেবেছে, জমিদার বাড়িতে ভয় দেখিয়ে একা মন্দিরের ধনরত্ন বাগিয়ে নেবে।
–আমরা ছ’জন আছি দলে। ছ’জনই এখানে আছি। ডাকিনীমায়ের দিব্যি খেয়ে প্রত্যেকে বল–
–চুপ! সেই সাধুবাবা এদিকে আসছে। শোন। লোকটা সাধু নয়। সাধু সেজেছে! কিছু মতলব আছে।
–উঠে পড় সবাই। কুতুবপুরের জলটুঙ্গিতে মঘাদা আসবে বলেছে। মঘাদা যা বলে, তা-ই করব। আর সাধুবাবার কথা বলছিস? যাওয়ার সময় ওকে ল্যাং মেরে দেখি, সত্যি-সত্যি সাধু নাকি।
–আই! ওদিকে যাসনে। নৌকো এদিকে রেখেছি। বাবুগঞ্জের হেমেনবাবুর পানসি দেখেছি ওদিকে কোথায় যাচ্ছে।
-চুপ! উঠে পড়। আর নয়। আরে! সাধুবাবা কি লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিল নাকি? তবে রে!
তারপর আর কোনও কথা শোনা গেল না। এলোমেলো উত্তাল বাতাসে গাছপালার শব্দ অন্য কোনও শব্দ ঢেকে দিল। কর্নেলের ইশারায় আমরা ওই অবস্থায় বসে রইলুম। মিনিট পাঁচেক পরে হেমেনবাবু চাপাস্বরে বললেন,–চিনতে পেরেছি। ওরা মঘাড়াকাতের চেলা। আমার মনে হচ্ছে, ফেলারামবাবু গোপীবাবু মন্দিরের গুপ্তধনের আশায় মঘাডাকাতের দলের সাহায্য নিতে চেয়েছিল।
কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন,–সন্ন্যাসীর ওপর ওরা হয়তো হামলা করেছে! সন্ন্যাসী একা। ওরা ছ’জন। চলুন। ব্যাপারটা দেখি!
ঝোঁপের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে-যেতে কর্নেল আবার চাপাস্বরে বললেন,–হেমেনবাবু! দরকার হলে ওদের মাথার ওপর দিয়ে ফায়ার করবেন! জয়ন্ত! তোমার ফায়ার আর্মস বের করো! পবন! তুমি আমাদের পেছনে থাকবে।
উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছিলুম। হালদারমশাইয়ের কাছে তার রিভলভার থাকার কথা। কিন্তু রিভলভার বের করার সুযোগ পাবেন কি? ছ’জন ডাকাতের সঙ্গে একা লড়বেন কী করে? ওরা ওঁকে প্রাণে মেরে ফেলতেও পারে।
এবার একটুকরো ফাঁকা ঘাসের জমি। তারপর উঁচু-নিচু গাছের ঘন জঙ্গল। বর্ষায় জঙ্গল দুর্ভেদ্য হয়ে আছে। তার ওদিকে কোথাও হালদারমশাইয়ের গর্জন শোনা গেল,–হালাগো গুলি কইরা মারুম! ছাড়। ছাড় বলছি। খাইসে! হালারা সত্যই ডাকাত। আমারে বান্ধিস ক্যান তোরা?
কর্নেল ইশারায় হেমেনবাবুকে শূন্যে ফায়ার করতে বললেন। তারপর ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তিনি ছুটে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করলুম আমরা। পবন গর্জে উঠল,–মুণ্ডু কেটে বলি দেব। আমার বাবাও ডাকাত ছিল। আমি গগন ডাকাতের ছেলে!
এতক্ষণে দেখলুম, হালদারমশাই একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা আছেন। কিন্তু তার জটাজুট খসে পড়েনি। ডাকাতরা তাঁর দাড়িও ওপড়ায়নি। সম্ভবত সে-সুযোগ পায়নি। অতর্কিতে ঝোঁপ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বেঁধে ফেলেছে। তারপর হেমেনবাবুর গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
হেমেনবাবু বললেন,–পবন! তুমি তোমার খুড়োকে গিয়ে দ্যাখো। তার বিপদ দেখলে ডাকবে।
পবন চলে গেল। কর্নেল ততক্ষণে কিটব্যাগ থেকে তার জঙ্গল-নাইফ বের করে দড়ি কেটে গোয়েন্দাপ্রবরকে মুক্ত করলেন। বললেন, আপনার ঝুলি কোথায়?
হালদারমশাই বললেন,–ভুল করছি। ঝুলি সঙ্গে লই নাই। ঝুলিতে আমার ফায়ার আর্মস আছে। কিন্তু আপনারা আইয়া পড়লেন কীভাবে? নাকি স্বপ্ন দেখতাছি?
হেমেনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–কী আশ্চর্য! মিঃ হালদার যে!
হালদারমশাই বললেন,–হঃ! আর কইবেন না। চরণ কইছিল, ডাকিনীতলায় একদল ডাকাত ঘাঁটি করছে। কিন্তু ডাকাতগো পিছনে লাগার ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল অন্য। এক মিনিট! ডাকিনীতলায় আমার ত্রিশুল আর ঝুলি আছে। লইয়া আসতাছি। আপনারা এদিকে আউগাইয়া যান। ডাকাতগো ঘাঁটি দেখবেন!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল উলটোদিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুদূর চলার পর দেখলুম, ওলটানো মস্ত নৌকোর মতো একটা কুঁড়েঘর। উলুকাশ দিয়ে চাল তৈরি করা হয়েছে। কাঠমোটা গাছের ডাল কেটে বানানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এই ডেরাটা বেশিদিনের নয়।
উঁকি মেরে দেখলুম, ভেতরে ব্যানাখড়ের ওপর কয়েকটা চট বিছানো আছে। আর কিছু নেই। জিনিসপত্র সবই নিয়ে পালিয়েছে ডাকাতেরা।
কর্নেল বললেন,–হেমেনবাবু! পুলিশকে জানিয়ে দেবেন, আজ সন্ধ্যার পর যেন কুতুবপুরের জলটুঙ্গি পুলিশ ঘিরে ফেলে।
হেমেনবাবু বললেন,–তা আর বলতে? মঘাডাকাতের দল গতমাসে বাবুগঞ্জে দুটো বাড়িতে ডাকাতি করেছে। আমার বাড়িতে হামলা করতে এসেছিল। উত্তরের জানালা দিয়ে দু’রাউন্ড ফায়ার করে ভাগিয়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু ওরা এবার জয়কুমারের গৃহদেবতার মন্দিরে হামলার চক্রান্ত করেছে। খুব ভাবনার কথা।
হালদারমশাই সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ছেড়ে প্যান্টশার্ট পরে আবির্ভূত হলেন। ছদ্মবেশের সঙ্গে গেরুয়া ঝুলি ওঁর পলিথিনের ব্যাগে ঢুকেছে। কিন্তু ত্রিশূলটা নেই। তিনি বললেন,–চরণ কইছিল এই কুঁড়েঘরের কথা। সে গোপনে দেখছিল একদিন। তো কাইল রাত্রে বৃষ্টির সময় টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে এখানে আইলাম। দেখলাম, কেউ নাই। হালারা আইজ ভোরবেলা আইছিল। আমি আরামে রাত কাটাইয়া খুব ভোরে ডাকিনীতলায় গিছলাম।
বললুম,–আপনার ত্রিশূল কোথায় গেল হালদারমশাই?
গোয়েন্দাপ্রবর হাসলেন,–ত্রিশূল অর্ডার দিয়া বানাইয়া লইছি। পার্ট বাই পার্ট খুইল্যা ব্যাগে রাখা যায়। মড়ার খুলিটা প্লাস্টিকের।
কর্নেল বললেন, আপনি ডাকিনীতলায় রাত্রি জাগতে এসেছিলেন কেন? হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন,–চরণ কইছিল, গোপীবাবুরে সে গাঁজার লোভে কোনও-কোনও রাত্রে ডাকিনীতলায় লইয়া আইত। তারপর গোপীবাবু ডাকিনীর গাছের ডালে উঠতেন। বেহালা বাজাতেন! গোপীবাবুর গাছের ডালে বইস্যা বেহালা বাজানোর কথায় আমার খটকা বাধছিল। তাই কাল সন্ধ্যার পর ডাকিনীতলায় আইছিলাম। কথামতন চরণ নৌকা লইয়া খাড়া ছিল। তার লোভ গাঁজার। আমি তারে পাঁচ টাকা দিয়ে কইলাম, তুমি যেখানে হইতে পারো, গাঁজা লইয়া আও। আমি ধ্যানে বসি। চরণ গাঁজা কিনতে গেল। তখন আমি গাছে চড়লাম। যে-ডালে বইয়া গোপীবাবু বেহালা বাজাতেন, চরণ দেখাইয়া দিছিল। টর্চের আলোয় দেখি, ডাল যেখানে গাছের কাণ্ড হইতে বারাইছে, সেই জোড়ের মুখে কালো এক ইঞ্চি পিচের মতো জিনিস ঠাসা। ছুরির ডগা দিয়া উপড়াইয়া দেখি–এই দেখেন, কী লুকানো ছিল!
হালদারমশাই প্যান্টের পকেট থেকে যা বের করলেন, তা দেখে আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম, –এই তো সেই কিং সলোমন’স রিং। রাজা সলোমনের আংটি!
.
সাত
হেমেনবাবুর পানসি নৌকোয় চেপে আমরা তাঁর বাড়ি পৌঁছলুম। তখন দুটো বেজে গেছে। খাওয়ার পর হালদারমশাই বললেন,–ইরিগেশন বাংলো হইতে কাইল লাঞ্চ খাইয়াই চেক আউট করছি। অরা কইল, পেমেন্ট হেমেনবাবু করবেন। আপনি শুধু বিলে সই করেন। এটা কেমন কথা?
হেমেনবাবু বললেন,–ও নিয়ে চিন্তা করবেন না মিঃ হালদার! আপনি আমার গেস্ট।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে সেই তুর্কি আংটি ‘কিং সলোমন’স রিং’ আতশ কাঁচ দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। একটু পরে তিনি কিটব্যাগ থেকে একটা খুবই ছোটো ভ্রু-ডাইভারের মতো জিনিস বের করলেন। তারপর একটা খবরের কাগজ টেবিলে বিছিয়ে তার ওপর আংটিটা রেখে তিনি সেই জিনিসটা দিয়ে আংটির ডিমালো অংশের একপাশে চাপ দিলেন। অমনি ডিমালো অংশের খাপ খুলে গেল। ভেতরে বিষের গুঁড়ো থাকবে ভেবেছিলুম। তেমন কিছু দেখলুম না। কর্নেল আংটিটা উপুড় করে ঠুকতেই ইঞ্চিটাক লম্বা সরু একটা চাবি কাগজে পড়ল। অমন খুদে চাবি এ যাবৎ কোথাও দেখিনি।
গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। বললেন,–ওইটুকখান চাবি কী কামে লাগবে?
কর্নেল বললেন,–সেকালের কারিগরের দক্ষতা দেখলে অবাক হতে হয়। এই খুদে চাবিটা কোনও বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি। ধাতু বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, এটা কোন-কোন ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছিল।
হেমেনবাবু বললেন,–ওটা নিশ্চয় কোনও তালা খোলার চাবি?
–ঠিক ধরেছেন। খুদে চাবিটা আংটিতে ঢুকিয়ে আগের মতো আটকে দেওয়া যাক। ততক্ষণে আপনি থানার ও.সি.-কে ফোন করে জানিয়ে দিন, আমরা এখনই যাচ্ছি। সঙ্গে পুলিশ ফোর্স এবং অফিসার নিয়ে উনি যেন তৈরি থাকেন। গোপীবাবুর হত্যাকারীর জন্য অবশ্যই ওঁকে হাতকড়া নিয়ে যেতে হবে। আর মঘার দলকে আজ কুতুবপুরের জলটুঙ্গিতে পাকড়াও করার কথাও ও.সি.-কে বলবেন।
হেমেনবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হালদারমশাইয়ের গোঁফ যথারীতি তিরতির করে কঁপছিল। তিনি চাপাগলায় বললেন,–খুনিরে চিনলেন ক্যামনে কর্নেলস্যার?
কর্নেল হাসলেন,–খানিকটা তথ্য-প্রমাণ, খানিকটা অঙ্ক। দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে পেরেছি। আপনারা দুজনে তৈরি হয়ে নিন। আমি তৈরি আছি।
সাড়ে তিনটেতে হেমেনবাবুর গাড়িতে চেপে আমরা বেরোলুম। কর্নেল প্রকাণ্ড মানুষ। অনিল-ড্রাইভারের বাঁদিকে বসলেন। আমি, হালদারমশাই আর হেমেনবাবু পেছনে বসলুম।
থানার সামনে গিয়ে দেখলুম, ও.সি. তপন বিশ্বাস পুলিশ-জিপের পাশে বেটন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। জিপের পেছনে ঠাসাঠাসি করে সশস্ত্র পুলিশেরা বসে আছে। ও.সি.-র পাশে এক পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কর্নেলের উদ্দেশে সেলাম ঠুকলেন। তপনবাবু বললেন,–ইনি গোপীবাবুর মার্ডারকেসের আই.ও-ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন পাল।
কর্নেল বললেন, আমরা জমিদারবাড়িতে ঢোকার মিনিট কুড়ি-পঁচিশ পরে আপনারা ঢুকবেন। ততক্ষণ একটু তফাতে অপেক্ষা করবেন। আমবাগানের কাছে রাস্তার মোড়ে আপনারা থাকলে জমিদারবাড়ি থেকে কেউ দেখতে পাবে না।
আধঘণ্টা পরে জমিদারবাড়ির গেটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কনেল বললেন,–হালদারমশাই! আমরা এগোচ্ছি। কালীনাথ আমাদের দেখতে পেয়েছে। আপনাকেও চিনতে পারবে। আপনি বলবেন, ওই বটগাছটার ফল খুব মিষ্টি। আমি কয়েকটা পাকা ফল নিয়ে আসি। বলে আপনি বটতলায় থাকবেন।
হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন,–ওখানে খাড়াইয়া থাকুম! ক্যান?
–যথাসময়ে জানতে পারবেন। কুইক!
কালীনাথ এসে করজোড়ে প্রণাম করে বলল,–কর্তামশাই আপনার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। কাল রাত্রে বৃষ্টির সময় উনি লাইব্রেরি ঘরের জানালায় আবার ফেলারামবাবুকে দেখেছেন।
হালদারমশাই বটগাছটার দিকে তাকিয়ে বললেন,–এমন বটগাছ কোথাও দেখি নাই! কর্নেলস্যার! দেখছেন ফলগুলি কত মোটা আর লাল টুকটুকে। আমি খাইয়া দেখছিলাম। খুব মিঠা।
বলে তিনি বাড়ির উত্তরে কম্পাউন্ড ওয়ালের কাছে বিশাল বটগাছটার দিকে চলে গেলেন। কর্নেল, আমি আর হেমেনবাবু কালীনাথকে অনুসরণ করলুম। সেই অর্ধবৃত্তাকার উঁচু বোয়াকে জয়কুমারবাবু কালকের মতো ছড়ি-হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কালীনাথ আর ভোলা কয়েকটা চেয়ার এনে দিল। জয়কুমার বললেন,–ভোলা! শিগগির গিয়ে। কফির ব্যবস্থা কর।
ভোলা ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে বারান্দা দিয়ে চলে গেল। আমরা বসার পর জয়কুমারবাবু গতরাতে বৃষ্টির সময় লাইব্রেরি ঘরের জানালায় গলায় দড়ির ফাঁস আটকানো ফেলারামের আবির্ভাবের কথা বললেন। কর্নেল জিগ্যেস করলেন, আপনি গুলি করবেন বলেছিলেন। গুলি করেননি?
জয়কুমারবাবু বললেন, বন্দুকের নল ওঠাবার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেলসায়েব! এর একটা বিহিত করুন। আর কত উপদ্রব সহ্য করা যায়?
–বিহিত করতেই এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভূতটা ধরা পড়বে। তবে এবার আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন।
–বলুন!
–আপনার ঠাকুরদার নাম কী ছিল?
–অভয়কুমার রায়চৌধুরি। আমার বাবার নাম অক্ষয়কুমার রায়চৌধুরি।
–আপনার ঠাকুরদা কি কখনও বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বাধ্য হয়ে ওঁকে স্বেচ্ছাসৈনিক হতে হয়েছিল। কথাটা অদ্ভুত শোনাবে। কিন্তু দেশীয় রাজা জমিদারদের ওপর ব্রিটিশ সরকার প্রচুর যুদ্ধ-করের বোঝা চাপিয়েছিল। অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ঠাকুরদার ছিল না। তাছাড়া তার অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল। তাই তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পক্ষে তুরস্ক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। সেই সব কথা তাঁর লেখা ‘আমার জীবন’ বইয়ে ছিল।
–ছিল, মানে এখন বইটা কি নেই?
–ওই বদমাশ নেশাখোর ফেলারাম বইটা চুরি করে কোথায় কাকে বেচে দিয়েছিল।
–আপনি তো বইটা পড়েছিলেন?
–পড়েছি। অনেকবার পড়েছি।
–তাতে কি সেই আংটির কথা ছিল না?
জয়কুমারবাবু চাপাস্বরে বললেন,–ছিল। আংটিটা তিনি একজন মৃত তুর্কি সেনার আঙুল থেকে কৌতূহলবশে খুলে নিয়েছিলেন। পরে জানতে পারেন, ওতে সাংঘাতিক বিষ ভরা আছে। তাই আংটি খুলে বিষের গুঁড়ো ফেলে দিয়েছিলেন।
–আপনার ঠাকুরদা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ধনী তুর্কি বণিক আজিজ কোকার বাড়ি লুঠ করেছিলেন?
জয়কুমারবাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি কি বইটা পড়েছেন? বইটা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পাওয়া যেতে পারে। দুষ্প্রাপ্য বই।
এবার আমাকে অবাক করে হেমেনবাবু বললেন, আপনার ঠাকুরদার এককপি ‘আমার জীবন আমার ঠাকুরদা অজিতেন্দ্র সিংহরায়কে উপহার দিয়েছিলেন। আজ সকালে কর্নেলসায়েবকে বইটা দিয়েছিলুম।
জয়কুমারবাবু বললেন, তাহলে লুকিয়ে লাভ নেই। আমার ঠাকুরদা আজিজ কোকার বাড়ি লুঠের সময় একছড়া নানা রত্নখচিত হার হাতিয়েছিলেন। সেই হারে যে সূক্ষ্ম নকশা ছিল, তাকে বলা হয় অ্যারাবেক্স। এ আর এ বি ই এক্স! অর্থাৎ আরবদেশের সূক্ষ্ম নকশা! বইয়ে লেখা ছিল, –‘হারছড়া আমি গোপনে এনেছিলুম। কখনও ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটলে তা স্বাধীন ভারত সরকারের কোষাগারে উপহার দেব।‘ আমার মুখস্থ আছে। কিন্তু হেমেন! তুমি তো কখনও আমাকে এ কথা বলোনি যে, তোমাদের বাড়িতে–
বাধা দিয়ে হেমেনবাবু বললেন, আপনি তো জিগ্যেস করেননি, তাই বলিনি। ফেলারামাবাবু এই বইটাই চুরি করে কোথাও বেচেছে, তা কি আপনি আমাকে বলেছিলেন?
জয়কুমারবাবু বললেন, হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছ।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, বইয়ের শেষপাতায় শেষ বাক্যের নিচে দু’লাইন ছড়া আছে। পড়েছেন?
–হ্যাঁ। ‘রুদ্রদেবের পায়ের তলে/লক্ষ হীরামানিক জ্বলে’
এই সময় কালীনাথ চা আনল ট্রেতে। ভোলা ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে এসে বলল,–গরুগুলো আজ খাবে কী কর্তামশাই? এখনও গ্যাদা ঘাস দিয়ে গেল না। দেখে আসব নাকি?
কর্নেল বললেন,–আচ্ছা ভোলা! তোমার স্ত্রী শৈলর হাতে তৈরি চা কি নকুলঠাকুর খান? কাল তোমাদের কর্তামশাইকে বলতে শুনলুম, ঠাকুরমশাইকে শৈল গরম চা করে দেবে। তাই জিগ্যেস করছি।
জবাব দিলেন জয়কুমারবাবু। বললেন,–খাবে না কেন? স্বজাতি যে। এ বাড়িতে তিন মুখুজ্জে ছিল। নকুল মুখুজ্জে, ফোরাম মুখুজ্জে আর এই ভোলারাম মুখুজ্জে। ফেলারাম লেখাপড়া শিখেছিল। চাকরি পেয়েছিল। ঘুষ খেতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়ে চাকরি গেল। তখন এসে আমার কাছে আশ্রয় নিলে। ভোলাকে বাবা লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। ওরা দু’ভাই। ওদের বাবা-ঠাকুরদা আমাদের জমিদারি সেরেস্তায় কর্মচারী ছিল। ভোলা টেনেটুনে নাম সই করতে পারে!
ভোলা গাল চুলকোচ্ছিল। মুখে বিব্রত হওয়ার ছাপ। এবার বলল,–গ্যাঁদাকে দেখে আসি।
কালীনাথ বলল, ওই গাদা ঘাসের বোঝা মাথায় নিয়ে আসছে।-বলেই সে পা বাড়াল। ফের বলল,–কর্তামশাই! থানা থেকে পুলিশের গাড়ি এসেছে। বড়ো দারোগাবাবু আসছেন। সঙ্গে ছোটো দারোগাবাবু।
একজন হাফপ্যান্টপরা উদোম গা বালক মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে বারান্দার নিচে দিয়ে চলে গেল। ভোলা বলল,–এত দেরি কেন রে? গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে হবে।
সে বারান্দা থেকে নামছিল। কর্নেল বললেন,–ভোলা! শোনো! তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ভোলা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আমার সঙ্গে স্যার?
–হ্যাঁ। তুমি বারান্দায় একটু বসো।
ভোলা বারান্দায় একটা থামের কাছে বসল। ও.সি. তপন বিশ্বাস, এস.আই. মনোরঞ্জন পাল এবং চারজন কনস্টেবল এল। দু’জন কনস্টেবলের হাতে রাইফেল। অন্য দু’জনের হাতে দুটো ছোটো লাঠি। জয়কুমারবাবু তাঁদের আপ্যায়ন করে কালীনাথকে বললেন,–লাইব্রেরিঘরে গিয়ে বসা যাক। কালী! লাইব্রেরি খুলে দে।
লাইব্রেরিঘরে যাওয়ার সময় কর্নেল ভোলাকে ডাকলেন, তুমিও এসো ভোলা। তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব।
ভোলা তবু নড়ছে না দেখে কালীনাথ তার হাত ধরে টানল। –এসো ভোলারামবাবু! তোমাকে সায়েব ডাকছেন। হাজার হলেও বামুনের ছেলে। সায়েব তোমাকে খাতির করে ডাকছেন। এসো!
লাইব্রেরিঘরে আমরা ঢুকলুম। দরজায় কনস্টেবলরা এসে দাঁড়াল। ভোলা গম্ভীরমুখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন,–আচ্ছা ভোলা! তুমি গতবছর জুন মাসে কর্তাবাবুর হুকুমে বটের ডাল কাটতে উঠেছিলে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–পা ফসকে পড়ে গিয়ে তোমার পায়ের হাড় ভেঙেছিল?
–আজ্ঞে ।
–হঠাৎ তোমার পা ফসকে গেল কেন? কোনও কারণে নিশ্চয় অন্যমনস্ক হয়েছিলে। তুমি তো আগেও কতবার বটের ডাল দালান ছুঁলে কর্তার হুকুমে কেটেছিলে। কোনওবার পা ফসকায়নি। তাই মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই তুমি কিছু দেখে চমকে উঠেছিলে। আর তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে
হঠাৎ ঘুরে কর্নেল জয়কুমারবাবুকে বললেন, তার আগেই আপনার আংটি হারিয়েছিল। তাই না?
জয়কুমারবাবু বললেন, হ্যাঁ। কাল কাকের স্বভাবের কথা আপনি বলছিলেন!
কর্নেল হাসলেন–হ্যাঁ। একটা কাক বাথরুমে উঁচু জানালায় রাখা আপনার আংটি তুলে নিয়ে গিয়ে বটগাছে তার বাসায় রেখেছিল। প্রসঙ্গত বলি, আংটিতে জলস্পর্শ বারণ ছিল। তার কারণ, আংটির ভেতরে একটা লুকোনো জিনিসে মরচে ধরার সম্ভাবনা ছিল। যাই হোক, ভোলা ডাল কেটে নামবার সময় কাকের বাসায় আংটি দেখে চমকে উঠেছিল। তার দাদা ফেলারামের কাছে সে ওই আংটির গোপনকথা শুনেছিল। তাই উত্তেজনায় সে কেঁপে উঠেছিল। আংটিটা হাতিয়ে উত্তেজনার চোটে সে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিল। কি ভোলা? তাই না?
ভোলা মুখ নামিয়ে গাল চুলকোতে থাকল।
কর্নেল বললেন,–আংটিটা তুমি অন্য কোথাও রাখতে সাহস পাওনি। তার আগে বলি–তুমি আছাড় খেয়ে পড়ার সময় কে সবার আগে তোমার কাছে গিয়েছিল?
কালীনাথ বলল,–শৈলবালা স্যার! শৈলবালা বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চ্যাঁচামেচি শুনে আমি দৌড়ে গিয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন,–আংটি ভোলা তার স্ত্রী শৈলবালার হাতে দিয়েছিল। শৈলবালাকে ও.সি. তপনবাবু পরে জেরা করবেন। আমার অঙ্কটা লক্ষ করুন। হাসপাতাল থেকে ফিরে ভোলা তার দাদা ফেলারামের তাগিদে–কিংবা অন্য কোনও কারণে আংটিটা বাঁয়াতবলা ফাঁসিয়ে দিয়ে তার ভেতর রেখেছিল। এদিকে গোপীমোহন হাজরা বেহালা-বাজিয়ে মানুষ। তবলা কেন ফেঁসেছে
তার কথার ওপর জয়কুমারবাবু বললেন,–গোপী তবলা সারিয়ে আনত বরাবর। তাকে তবলাটা শিগগির সারিয়ে আনতে বলেছিলুম।
কর্নেল বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে গোপীবাবু তবলার ভেতর আংটিটা দেখে তখনই আত্মসাৎ করেছিলেন। ইতিমধ্যে ফেলারামবাবু গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছেন। গোপীবাবু শিক্ষিত লোক। তিনি নিশ্চয়ই অভয়কুমার রায়চৌধুরির ‘আমার জীবন’ পড়েছিলেন।
জয়কুমারবাবু বললেন,–হ্যাঁ। গোপীকে আমি লাইব্রেরি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলুম। কারণ ফেলারাম প্রায়ই বই বা অন্যান্য জিনিস চুরি করে কোথায় বেচে আসত।
–বোঝা যাচ্ছে, গোপীবাবু গুপ্তধনের লোভেই আংটি বেচে দেননি। আজ দুপুরে আমরা মঘাডাকাতের চেলাদের কাছে ডাকিনীতলার জঙ্গলে শুনেছি, গোপীবাবু তাদের মন্দির লুঠ করার চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। ওই ডাকাতদের ফেলারামবাবুই বলেছিলেন, মন্দিরে গুপ্তধন আছে। যাই হোক, ভোলা নিশ্চয় টের পেয়েছিল, মঘাডাকাতের সঙ্গে গোপীবাবুর চক্রান্ত হয়েছে। ভোলা! তাই না?
ভোলা ফুঁসে উঠল,–আমি স্বচক্ষে দেখেছি মঘার সঙ্গে গোপীবাবু গাবতলায় বসে কথা বলছে।
–তাই তুমি সাহস পাওনি গোপীবাবুকে চ্যালেঞ্জ করতে। অথচ তুমি ঠিক বুঝেছিলে কে বাঁয়াতবলার ভেতর থেকে আংটি হাতিয়েছে। তাছাড়া তোমার এক পায়ে জোর নেই। তাই
অবশেষে তুমি তোমার দাদার ভূত সেজে ভয় দেখাতে শুরু করলে!
জয়কুমারবাবু বললেন,–ফেলারামের মুখে গোঁফদাড়ি ছিল!
কর্নেল হাসলেন,–ভোলা নকল গোঁফদাড়ি পরলে তাকে দাদার মতো দেখাবে। তাই না?
জয়কুমারবাবু ছড়ি তুলে গর্জন করলেন,–ওরে বজ্জাত! ওরে নেমকহারাম!
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি এখনই আসছি। কাল বিকেলে বটতলায় ঘোরাঘুরি করে আমি কিছু জিনিস আবিষ্কার করেছি। নিয়ে আসছি।
জয়কুমারবাবু বললেন,–আর কি তা আছে? ভোলার দজ্জাল বউ শৈল এতক্ষণে তা লুকিয়ে ফেলেছে।
হেমেনবাবু বললেন,–বটতলায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার পাহারা দিচ্ছেন।
কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। লাইব্রেরি ঘরে কিছুক্ষণ ঘোর স্তব্ধতা এল। কালীনাথ ভোলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় চারজন কনস্টেবল। সেই স্তব্ধতা না এলে জানালা দিয়ে মেয়েলি গলার কর্কশ চ্যাঁচামেচি আমরা শুনতে পেতুম না। জয়কুমারবাবু বললেন,–কালী! শৈল কাকে গালাগালি করছে দেখে আয়!
ও.সি. তপনবাবু বললেন,–কালী নয়। মনোরঞ্জনবাবু! আপনি যান। ভোলার স্ত্রীকে এখানে ডেকে আনুন।
ডাকবার দরকার হল না। কর্নেল জলকাদা মাখা একটা ছোটো চটের থলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হালদারমশাইও এসে গেলেন। তাদের পিছনে মধ্যবয়সিনী রোগা ফর্সা এক মহিলাও চাঁচাতে-চাঁচাতে ঘরে ঢুকল। সে হালদারমশাইয়ের দিকে আঙুল তুলে বলল,–ওই বাঙাল মিনসের কী সাহস! বামুনের মানতের থলেয় হাত দেয়। শাপ লাগবে না? মুখে রক্ত উঠে মরবে না? আমি আমার ভাসুরের আত্মার মুক্তির জন্য মানত দিয়েছিলুম। সেই থলে ছুঁয়ে দিল? ও বুড়োসায়েব! মানতের থলে খুললে মুখে রক্ত উঠবে বলে দিচ্ছি।
কালীনাথ হাঁকল,–চো-ও-প! তুলে বিলের জলে ছুঁড়ে ফেলব।
ততক্ষণে থলে খুলে কর্নেল প্রথমে বের করেছেন একটা ছেঁড়া দড়ির ফঁস। তারপর বের করলেন কাগজের মোড়ক। তা থেকে বেরুল নকল গোঁফদাড়ি। তারপর কর্নেল নিরেট লোহার ছোটো একটা প্যাচালো রড বের করলেন। একটু হেসে তিনি বললেন, এটাই মার্ডার উইপন। ধুয়ে ফেললেও আতশ কাঁচে দেখেছিলুম, খাঁজে-খাঁজে রক্তের চিহ্ন আছে। এই থলেটা পাঁচিলের কাছে মানকচুর ঝোঁপের ভেতর লুকোনো ছিল। নকল গোঁফদাড়ি গত রাতে বৃষ্টির সময় পরার জন্য ভিজে গিয়েছিল। এখনও ভিজে আছে। থলেতে ঘটা করে সিদুরের ছোপ দেওয়া হয়েছে। মানতের জিনিস কিনা! আসলে ফেলারাম মুখুজ্জের ভূতের হামলা চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল।
কালীনাথ বলে উঠল,–ওই লোহার ডাঙস দিয়ে গাইগরুর খুঁটি পোতা হয়। গোপীবাবু খুন হওয়ার দিন বিকেলে ভোলা গাবতলার কাছে গরুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল।
মনোরঞ্জনবাবু উঠে গিয়ে ভোলার দু-হাত পিছনে টেনে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। জয়রামবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন,–ভোলার হাতে এত জোর যে গোপীর খুলি ফাটিয়ে মেরেছে?
কর্নেল বললেন,–প্রতিদিন যাকে গাইগরু নিয়ে গিয়ে এই লোহার রড দিয়ে খুঁটি বসাতে হয়, তার হাত এই ওজনদার দুরমুসের ঘা মারতে পোক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কথা বলতে-বলতে আচমকা ভোলারাম গোপীবাবুর মাথার পেছনে দুরমুসের ঘা মেরেছিল। আংটি হরণের প্রতিশোধ নয়। খুনের উদ্দেশ্য ছিল গোপীবাবুর বেহালার ভেতর লুকিয়ে রাখা আংটি উদ্ধার। কিন্তু আংটি বেহালার ভেতর ছিল না।
.
উপসংহার
ও.সি. তপন বিশ্বাসের নির্দেশে সাবইন্সপেক্টর মনোরঞ্জনবাবু সেই থলেসহ ভোলাকে এবং দুজন কনস্টেবল শৈলবালাকে নিয়ে গেল। তপনবাবু বললেন, আমি হেমেনবাবুর গাড়িতে ফিরব। জায়গা হবে তো?
হেমেনবাবু বললেন,–নিশ্চয়ই হবে।
জয়কুমারবাবুর হাত কঁপছিল। আস্তে বললেন,–কী সাংঘাতিক কাণ্ড! কর্নেলসায়েব! আপনি কি আংটির খোঁজ পেয়েছেন?
কর্নেল পকেট থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করে খুললেন। মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। বিদ্যুতের আলো ক্ষীণ! কালীনাথ হ্যাঁজাগ জ্বালতে গেল। টর্চের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল অভয়কুমার রায়চৌধুরির সংগৃহীত ‘রাজা সলোমনের আংটি। কর্নেল সংক্ষেপে ডাকিনীতলার ঘটনা শুনিয়ে বললেন,–এই আংটি উদ্ধার করেছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার। আমাদের প্রিয় হালদারমশাই!
হালদারমশাই বললেন,–আংটির কথা ভাবি নাই। চরণ কইছিল, কোনও-কোনও রাত্রে গোপীবাবু গাঁজা খাইয়া একটা ডালে গিয়া বইতেন। সেখানে উনি বেহালা বাজাইতেন। এই কথায় আমার খটকা বাধছিল। ক্যান ওই ডালে বইয়া গোপীবাবু বেহালা বাজাইতেন?
কর্নেল বললেন,–এবার ভোজবাজি দেখুন! আংটির মধ্যে একটা খুবই ছোটো আর সূক্ষ্ম চাবি লুকানো আছে। এই চাবি দিয়ে সম্ভবত রুদ্রদেবের বিগ্রহের বেদি খোলা যায়। সন্ধ্যারতি শেষ হোক। তারপর আমরা মন্দিরে যাব।
জয়কুমারবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–ঠাকুরদা তার বইয়ের শেষে ছড়া লিখেছিলেন : ‘রুদ্রদেবের পায়ের তলে। লক্ষহীরা মানিক জ্বলে।‘ হ্যাঁ–সেই রত্নহার বেদির তলায় লুকানো ছিল। আমার জামাই সুভদ্র কলকাতায় একটা ট্রেডিং কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়েছিল। ঋণের দায়ে কোম্পানি নীলাম হওয়ার মুখে আমার মেয়ে নীলা এসে আমাকে ধরল। জমিজমা বেচে সুভদ্রের ঋণ শোধ করে তাদের কাছে গিয়ে আমাকে থাকতে হবে। ছেলেদুটো তো বিদেশে। কদাচিৎ আসে। চিঠিপত্র লিখেও বাবার খোঁজ নেয় না। নীলা আর সুভদ্র প্রায়ই আসে। খোঁজখবর নেয়। তো আমি সেই রত্নহার গোপনে বের করে নীলাকে দিয়েছিলুম। বলেছিলুম–এই রত্নহার আমার ঠাকুরদার লুঠের জিনিস। রুদ্রদেবের তাই অভিশাপ লেগেছে এ বাড়িতে। এটা নিয়ে তোরা আমাকে অভিশাপ থেকে বাঁচা। তোরাও বাঁচ। রুদ্রদেবের কৃপা হয়েছিল। সে বছর জমিতে ফসলও প্রচুর পেয়েছিলুম। আমার জামাইয়ের কোম্পানি ঋণের ধাক্কা সামলে মোটামুটি ভালোই চলছে।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–তাই ‘রাজা সলোমনের আংটি সম্পর্কে আর আপনার মাথাব্যথা ছিল না?
–ঠিক বলেছেন। এই আংটিতে বড়োজোর একভরির মতো সোনা আছে। তার দাম আর কতটুকু? গোপীটা বোকা। বেচে দিয়ে কোথাও পালিয়ে গেলে প্রাণে বাঁচত। গুপ্তধনের লোভে পড়েছিল হতভাগা!
ও.সি. তপন বিশ্বাস বললেন,–জয়কুমারবাবু! খুনের মামলার স্বার্থে এই আংটিটা আমি সিজ করতে বাধ্য হচ্ছি। কর্নেলসায়েবরা আছেন। আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হেমেনবাবু আছেন। আমি তাদের সামনে আংটিটা নিচ্ছি। থানায় গিয়ে সিজার লিস্টের কপি পাঠিয়ে দেব।
আপনার অভিরুচি!–বলে জয়কুমারবাবু কালীর দিকে ঘুরলেন। সে হ্যাঁজাগ জ্বেলে এনেছিল। জয়কুমারবাবু হঠাৎ আর্তকণ্ঠে বলে উঠলেন : ওরে কালী! আমরা দুজন এই পোড়োবাড়ি পাহারা দেব। এ কী হয়ে গেল রে কালী?
নকুলঠাকুর ঘরে ঢুকে বললেন,–কর্তামশাই! আমিও তো আছি। আমার কথা ভুলে গেলেন? কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–চলি জয়কুমারবাবু! আশা করি, আর আপনার বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হবে না।