বলে গেছেন রাম শন্না
সেদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের জাদুঘর-সদৃশ ড্রয়িংরুমে ঢুকে একটু হকচকিয়ে গেলুম। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বেজায় গম্ভীরমুখে কোনার দিকে বসে আছেন এবং ভুরু কুঁচকে জানালার বাইরে কার উদ্দেশে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। ওঁর ঋষিতুল্য সাদা দাড়িতে একটা কালো চকরাবকরা প্রজাপতি নিশ্চুপ বসে আছে, নিশ্চয় ওঁর সংগ্রহশালার কোনো দুর্লভ প্রজাতি। কিন্তু কর্নেলের এ-ব্যাপারে কোনো দৃকপাত নেই।
ওই জানালার বাইরে এক বিশাল নিমগাছ। সেখানে ঝাঁকে-ঝকে শীতের কুচকুচে কালো কাক তুমুল চ্যাঁচামেচি করছে। সেটাই কি আমার বৃদ্ধ বন্ধুর বিরক্তির কারণ? উনি কি ওদের শাপমন্যি করছেন? করারই কথা। ওই কদাকার পাখিগুলো ছাদের যত্নলালিত প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডের দুষ্প্রাপ্য অর্কিড এবং ক্যাকটাসের ওপর প্রায়ই হামলা করে।
‘গুড মর্নিং’ সম্ভাষণের জবাব না পেয়ে একটু ইতস্তত করার পর সোফায় বসে পড়লুম। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ নিঃশব্দে কফির পেয়ালা রেখে গেল। তার মুখখানাও বেশ তুম্বো। অনুমান করলুম –তাহলে নির্ঘাত এই সুন্দর শীতের সকালে প্রভু-ভৃত্যে কোনো মনকষাকষি হয়ে থাকবে এবং প্রভু-ভদ্রলোক পেয়ারের ভৃত্যের উদ্দেশেই গোপনে শাপান্ত করছেন।
কিন্তু কী করে থাকতে পারে ষষ্ঠীচরণ? কোনো প্রজাপতির ঠ্যাং ভেঙে ফেলেছে? নাকি টোরা দ্বীপ থেকে সংগৃহীত তিনপেয়ে অলুক্ষুণে বাদুড়টির খাঁচা খুলে দিয়েছে? যতদূর জানি, ষষ্ঠী ওই কিস্তৃত স্তন্যপায়ী উড়ুকু জন্তুটিকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না।
কফিতে চুমুক দিয়ে আড়চোখে দেখলুম কর্নেল এবার টেবিলের দিকে ঝুঁকে কী যেন লিখছেন। মিনিট দুই পরে উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন এবং পায়চারির ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তখন বললুম,–ষষ্ঠীচরণটা বড্ড বাজে।
আমার বৃদ্ধ বন্ধু গলার ভেতর বললেন,–ষষ্ঠীর চেয়ে বাজে লোক জগমোহন বোস।
–জগমোহন আবার কে?
কর্নেল একটা ভারী শ্বাস ছেড়ে বললেন,–আসলে লোকটা প্রচণ্ড অর্থপিশাচ। দেখো জয়ন্ত, টাকার চেয়ে দামি জিনিস হল মুখের কথা। কথা দিয়ে যে কথা রাখে না তার মতো পাপী আর কে?
–ঠিক, ঠিক। কিন্তু কী কথা দিয়ে কথা রাখেনি আপনার এই জগমোহন?
দুঃখিত স্বরে কর্নেল বললেন,–আগেও লোকটা ঠিক এরকম করেছিল। এম্মানুয়েল দ্য সামসার লেখা ‘দা ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অফ ক্রিসো আইল্যান্ডস’ বইটার দরদাম ঠিক করে এলুম। পরদিন আনতে গিয়ে শুনি, বেশি দাম পেয়ে কাকে বেচে দিয়েছে। ১৭৮৪ সালের বই। অতি দুষ্প্রাপ্য। আমার ক্ষোভের কারণ শুধু তাই নয়, জগমোহন দাঁত বের করে হাসছিল। ভাবতে পারো?
সহানুভূতি দেখিয়ে বললুম,–ভীষণ অন্যায়।
ফোঁস করে ফের শ্বাস ছেড়ে কর্নেল বললেন, তুমি কি এই প্রবাদ শুনেছ ডার্লিং? যত হাসি তত কান্না-বলে গেছেন রাম শন্না।
–শুনেছি। সত্যি তো হাসি ভালো নয়। জগমোহন কেঁদে কূল পাবে না পরে।
কর্নেল বললেন,–রাম শন্না অর্থাৎ রামশংকর শর্মা ১৮৫৯ সালে ‘আত্মচরিত’ নামে নিজের জীবনী লেখেন। খুব রোমাঞ্চকর তার জীবন। কম বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে সি-বয়ের চাকরিতে ঢোকেন। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান। বৃদ্ধ বয়সে নদীয়ার গ্রামে ফিরে পৈতৃক ভিটেতে প্রকাণ্ড বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। রামশংকর গোপনে বিদ্রোহীদের অর্থসাহায্য করতেন। তার ফলে ইংরেজ শাসকদের কোপে পড়েন এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। ফাঁসিসেলে থাকার সময় তিনি ওই আত্মচরিতখানি লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সরকারের অনুমতি নিয়ে তাঁর ভাই শ্যামশংকর বইটি ছেপে বের করেন। বইটি সত্যি মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য। জগমোহনকে কিছুদিন যাবত তাগিদ দিচ্ছিলুম, বইটি যদি জোগাড় করতে পারে।
বাধা দিয়ে বললুম,–জগমোহনের কি বইয়ের দোকান আছে?
–হুঁ। কলেজ স্ট্রিটে গেলে দেখতে পাবে, সাইনবোর্ডে লেখা আছে : ‘হারানো বই’। ঘুপচি ঘরের ভেতর আগাপাশতলা পুরোনো বইতে ঠাসা। দাঁড়াবার জায়গা পর্যন্ত নেই। ফুটপাথ থেকে কথা বলতে হবে। তবে জগমোহনকে তুমি পুরোপুরি দেখতে পাবে না। বইয়ের গাদার ফাঁকে ওর নাকটুকু ছাড়া আর কিছু চোখে পড়বে না। শরীরের বাকি অংশ দেখতে হলে তোমাকে টাকা বের করতে হবে। তখন দেখবে বইয়ের সুড়ঙ্গ থেকে ফ্যাকাশে একটা হাতের তালু বেরিয়ে আসছে।
কর্নেল করুণ হাসলেন। ফের বললেন,–গতকাল সন্ধ্যায় সে ফোনে বলল : শিগগির চলে আসুন। বইটা পাওয়া গেছে। কিন্তু এদিকে হতচ্ছাড়া ষষ্ঠী এমন কীর্তি করে বসে আছে যে তখন আমার মরবারও ফুরসত নেই। পাগল হয়ে খুঁজছি।
–কী?
–বৈজ্ঞানিক নাম হল ভ্যানেসা আর্টিসি। বাংলায় বলতে পারো কাছিম-প্রজাপতি। কারণ দূর থেকে দেখলে মনে হবে লিলিপুট কাছিম। উড়লেই কিন্তু ঝলমলে পরী। আমার বিশ্বাস, নচ্ছার ষষ্ঠী ওটাকে ওড়াতে চেয়েছিল। অমনি হাত ফসকে পালিয়েছে। ওঃ জয়ন্ত! কী কষ্ট করে না ওটা জোগাড় করে এনেছিলুম। তুমি জানো, এই শীতে ওদের ঘুমোবার সময়! বেচারাকে ঘুম থেকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে ব্যাটাচ্ছেলে ষষ্ঠীচরণ…
ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,–রাম শন্নার বইটা আর পাবেন কি না জানি না, তবে আপনার প্রজাপতিটা আপনি পাবেন–যদি স্থির হয়ে একটু দাঁড়ান।
ওঁকে ভীষণ চমকে দিয়ে ওঁর দাড়ি থেকে খপ করে প্রজাপতিটা ধরে ফেললুম। কর্নেল বিস্ময় ও আনন্দে এক চিক্কর ছেড়ে আমার হাত থেকে প্রিয় প্রজাপতিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে দৌড়ে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,–ডার্লিং! এবেলা তোমার লাঞ্চে নেমন্তন্ন।
কিছুক্ষণ বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ যেন শিশু হয়ে গেলেন। ষষ্ঠীচরণকে ক্ষমা করে দিলেন। মুখ টিপে হেসে সে ঝটপট ফের দুপেয়ালা কফি এবং প্লেটভর্তি স্ন্যাক্স রেখে গেল। কফি খেতে-খেতে কর্নেলকে স্মরণ করিয়ে দিলুম, এত হাসি হয়তো ভালো না। কারণ রাম শন্না বলে গেছেন, যত হাসি তত কান্না।
কর্নেল বললেন : হ্যাঁ–জগমোহনের আচরণে সত্যি দুঃখ পেয়েছি, জয়ন্ত। কাল রাত নটায় দোকান বন্ধ করার সময় ফোন করে বলেছে, আমি যাইনি বলে অন্য এক খদ্দেরকে বইটা বেচে দিয়েছে। দেখো ওর কাণ্ড। সন্ধ্যা সাতটায় বইটা পেয়েছে বলে খবর দিল। তার দু’ঘণ্টা পরে জানাল, অন্য একজনকে বেচে দিয়েছে। আবার সেই সঙ্গে ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসি।
কর্নেল হঠাৎ কোনার সেই টেবিলটার দিকে উঠে গেলেন। তারপর একটুকরো কাগজ হাতে নিয়ে ফিরলেন। কাগজটার দিকে তাকিয়ে একটুখানি বিড়বিড় করার পর বললেন,–আচ্ছা জয়ন্ত, এমন পাঁচটা পাখির নাম করো তো, যা ক অক্ষর দিয়ে শুরু।
ভেবে নিয়ে বললুম,–কাক, কোকিল, কাঠঠোকরা, কাকাতুয়া, কাদাখোঁচা…
–খাসা জয়ন্ত, খাসা! দিশি মতে ক অক্ষর খুব পয়মন্ত। ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথম অক্ষর। হিন্দুদের দেবতা কৃষ্ণের নাম এই অক্ষর দিয়ে শুরু। ভক্ত প্রহ্লাদের গল্পে আছে, পাঠশালায় বালক প্রহ্লাদ ক পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলত। তো জয়ন্ত, তুমি যে পঞ্চপাখির নাম বললে,–প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপিতে তারা ছিল পাঁচটি পবিত্র শব্দের প্রতীক। স্যাটর, আরেপো, টেনেট, অপেরা, রোটাস। মিশরে রোমানদের রাজত্বকালে এই শব্দগুলো দিয়ে এক আশ্চর্য ধাঁধা বানানো হয়েছিল। এই দেখো।
তাহলে তখন আমার বিজ্ঞ বন্ধু কাগজে এই ধাঁধা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। কাগজটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলুম। তাতে লেখা আছে :
চুপ করে আছি দেখে কর্নেল বললেন,–কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ছে না?
-হ্যাঁ। যেদিক থেকে যে অক্ষর ধরে পড়ি, পাঁচটা একই শব্দ পাচ্ছি। মিশরীয়রা মাথা খাঁটিয়ে অদ্ভুত সাজিয়েছে তো!
–শুধু তাই নয়। ছকটা চারদিকে SATOR শব্দ দিয়ে ঘেরা। রোমানরা একে বলত Cirencester Word Square এবং এ নাকি এক রহস্যময় শব্দবর্গ। সম্ভবত খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে প্যাপিরাসে মিশরীয় চিত্রলিপিতে এই শব্দবর্গ লেখা হয়। উনিশ শতকে এটি উদ্ধার করা হয়। হিড়িক পড়ে যায় এই ধাঁধার জট ছাড়াতে। আপাতদৃষ্টে রোমান ভাষায় শব্দগুলো পর পর রেখে মানে করলে দাঁড়ায় : The Sower Arepo holds the wheels carefully. অর্থাৎ সোজা কথায় : ‘আরেপো নামে একটা লোক শস্যের বীজ ছড়ানোর সময় বীজ ছড়ানো যন্ত্রের চাকাগুলো সাবধানে ধরে থাকে। কিন্তু এ কথায় কী বলতে চাওয়া হয়েছে? নানা জনে নানা মানে বের করলেন। তারপর ১৮৪৭ সালে এক ইংরেজ আবিষ্কার করলেন একটা অদ্ভুত জিনিস। সিন্দুকের ভেতর পাঁচটা চামড়ার মোড়ক। মোড়কের ভেতর একটা করে প্রকাণ্ড পেরেক। আর মোড়কগুলোর গায়ে রোমান হরফে লেখা আছে SATOR, AREPO, TENET, OPERA, ROTAS। প্রতিটি পেরেকে নাকি রক্তের দাগ এবং রোমান ভাষায় কিছু খোদাই করা বাক্য। ইউরোপে আরও হইচই পড়ে গেল। পণ্ডিতরা একবাক্যে রায় দিলেন, তাহলে এই হচ্ছে সেই পাঁচটা পেরেক, যা বিধিয়ে যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ভ্যাটিকানে যিশুর পবিত্র রক্তমাখা পেরেকগুলো রাখার আয়োজন হল। বিশেষ জাহাজ গেল সেই উদ্দেশে। কিন্তু ফেরার পথে ভূমধ্যসাগরে জাহাজটা ডুবে গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগে। ব্যস, সেখানেই এই ঘটনার শেষ।
বললুম,–তাহলে বোঝা যাচ্ছে শব্দগুলো পাঁচটা পেরেকের নাম। কিন্তু এতকাল পরে ওগুলো আপনার মগজে বিধিয়ে দিল কে?
–রামশংকর শর্মা ওরফে রাম শন্না।
–সে কী!
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–গতকাল ভৈরবগড় রাজবাড়িতে ওঁদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে বইটা দেখি। ২০৪ পৃষ্ঠার বই। খুব জীর্ণ অবস্থা। একরাতেই পড়ে শেষ করি। এক অসাধারণ বাঙালি অ্যাডভেঞ্চারিস্টের আশ্চর্য কীর্তিকলাপ। কিন্তু এক জায়গায় রামশংকর লিখেছেন : ত্রিনিদাদের গ্রামে বাস করার সময় ঝড়জলের রাতে একজন রুগ্ন স্প্যানিশ পাদ্রি তার ঘরে আশ্রয় নেন। শেষরাতে তিনি মারা যান। তার আলখাল্লার মধ্যে চামড়ার একটা মোড়ক ছিল। স্থানীয় গির্জায় পাদ্রির জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার আগে কৌতূহলবশে রামশংকর মোড়কটা খোলেন। তার ভেতর ফুটখানেক লম্বা কালো মোটা একটা লোহার পেরেক ছিল, তার গায়ে রোমান হরফে কীসব লেখা ছিল। পেরেকটাতে একটুও মরচে ধরেনি এবং আশ্চর্য ব্যাপার, তাতে রক্তের দাগ ছিল। চামড়ার মোড়কেও রোমান হরফে লেখা ছিল SATOR; কী ভেবে ওটা রামশংকর ফেরত দেননি। পরে এক বিশপের কাছে কথাটার মানে জিজ্ঞেস করে রহস্যটা টের পান। তাহলে জাহাজডুবির সময় অন্তত একটা পেরেক কেউ বাঁচাতে পেরেছিল–হয়তো সেই রুগ্ন পাদ্রিই।
জিজ্ঞেস করলুম,–রাম শন্না কী করলেন পেরেকটা?
সেটাই প্রশ্ন। আত্মচরিতে কোথাও সেকথা লেখা নেই। এমনকি, পরে ওটার উল্লেখ পর্যন্ত নেই।-কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বললেন, বইটা রাজাবাহাদুরকে উপহার দিয়েছেন রামশংকরেরই এক বংশধর প্রণবশংকর বাঁড়ুজ্জে। খুব দুষ্প্রাপ্য বই। সঙ্গে মাইক্রোফিল্মের সরঞ্জাম ছিল না। ভাবলুম সময়মতো এসে মাইক্রোফিল্ম কপি করে নেব। তো আমার বরাত। কদিন আগে রাজাবাহাদুর ট্রাংককলে জানালেন, বইটা চুরি গেছে। তার সন্দেহ, রাজবাড়ির আশ্রিত এক ভদ্রলোকের জুয়াড়ি নেশাখোর ছেলে হরিসাধনই একাজ করেছে। কারণ ইতিপূর্বে তার লাইব্রেরি থেকে কিছু দুষ্প্রাপ্য বই চুরি গেছে।
–তাই আপনি কলেজ স্ট্রিটে জগমোহনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন?
–তা তো বটেই! বইটা ফেরত পেলে রাজাবাহাদুর খুশি হতেন, আমারও মাইক্রোফিল্ম কপি হয়ে যেত।
–এবং পেরেক-উদ্ধারে অবতীর্ণ হতেন!
আমার মন্তব্য শুনে গোয়েন্দাপ্রবর একটু হাসলেন। ব্যাপারটা বোধ করি অত সহজ নয়, ডার্লিং! তবে আত্মচরিতের পরিশিষ্ট অংশটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল, কথাগুলোর মধ্যে কী যেন ইঙ্গিত আছে। তো…
ষষ্ঠীচরণ এসে বলল,–এক ভদ্রলোক এয়েছেন! খুব হাঁফাচ্ছেন। চোখ-মুখ লাল হয়ে রয়েছেন।
কিন্তু ভদ্রলোক অনুমতির অপেক্ষা না করেই ভেতরে ঢুকে আমার পাশে ধপাস করে বসে পড়লেন। ষষ্ঠীচরণ কড়াচোখে তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। ভদ্রলোকের গড়ন নাদুসনুদুস। পরনে দামি স্যুট। হাতে ব্রিফকেস। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পুরু কঁচাপাকা গোঁফ আর মাথায় অল্প টাক আছে। রুমালে মুখ ঘষে বললেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার! দু’লক্ষ টাকার মাল সাপ্লাইয়ের অর্ডার বাতিল হতে চলেছে! আমায় বাঁচান!
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ করছিলেন ভদ্রলোককে। বললেন,–কে আপনি?
–আজ্ঞে, আমার নাম রামদুলাল সিনহা। আরবমুলুকে ইলেকট্রনিক গুডস রফতানির কারবার আছে। স্যার, পার্ক স্ট্রিটে আমার সিনহা ট্রেডিং কোম্পানির পাশের চেম্বারে আপনি যাতায়াত করেন।…
–হুঁ, ডক্টর বৈদ্য আমার বন্ধু।
–তিনিই পরামর্শ দিলেন আপনার কাছে আসতে।
–কিন্তু সাপ্লাই অর্ডার বাতিল হওয়ার ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?
–না স্যার, না! সেজন্য আসিনি। একখানা বই চুরি গেছে।
ভুরু কুঁচকে তাকালেন গোয়েন্দাপ্রবর।–বই? কী বই?
এক মিনিট স্যার! বলছি।–রামদুলালবাবু ব্রিফকেস খুলে একটুকরো কাগজ বের করলেন। কর্নেলের হাতে দিয়ে বললেন, এই দেখুন বইটার নাম-টাম সব লেখা আছে। কলেজ স্ট্রিটের জগমোহন বোস আমার সম্পর্কে বেয়াই হন। তাকে বলে রেখেছিলুম বইটার জন্য। কাল সন্ধ্যাবেলা উনি ফোন করলেন, বইটা পাওয়া গেছে। পাঁচশো টাকার এক পয়সা কমে হবে না। পার্টি দাঁড়িয়ে আছে বই নিয়ে। দু-লাখ টাকার ডিল স্যার! দৌড়ে গেলুম টাকা নিয়ে।
–দাঁড়ান! এই হাতের লেখা কার?
–যাঁকে প্রেজেন্ট করতুম, তার স্যার। ওনার মাধ্যমেই তো অর্ডারটা পেয়েছি স্যার!
–ইংরেজিতে লেখা কেন?
–উনি যে বাংলা জানেন না স্যার!
–কী নাম?
–এক রোডরিগ। গোয়র লোক স্যার! থাকেন বোম্বেতে।
–উনি বাংলা বই কী করবেন?
রামদুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন,–তা তো জানি না স্যার! কদিন আগে বোম্বে গেলুম, তখন এই কাগজে লিখে দিয়ে বললেন, বইটা জোগাড় করে দিলে দু’লাখ টাকার অর্ডার পাইয়ে দেবেন।
–বেশ। এবার বলুন–বইটা কীভাবে চুরি গেল?
রামদুলালবাবু বললেন,–এক গেলাস জল খাব স্যার।
ষষ্ঠীচরণ ভেতরের পর্দা তুলে দৃশ্যটা উপভোগ করছিল। কর্নেল বলার আগেই জল দিয়ে গেল। রামদুলালবাবু জলটা ঢকঢক করে খেয়ে রুমালে মুখ মুছে বললেন,–বইটা অফিসেই টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বাড়ি গিয়েছিলুম। অফিসে কিছু কাজ ছিল। সারতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। আজ সওয়া বারোটার ফ্লাইটে বোম্বে যেতুম বইটা সঙ্গে নিয়ে। অফিসের কিছু কাগজপত্রও নেওয়ার দরকার ছিল। তাছাড়া থাকি সেই বেহালায়। ভেবেছিলুম, যাওয়ার পথে অফিস হয়ে সব নিয়ে যাব। তো অফিসে এসে দেখি, বইটা নেই। তন্নতন্ন খুঁজে অফিসের সব্বাইকে জিজ্ঞেস করে কোনো হদিশ পেলুম না।
–ড্রয়ারে তালা দেওয়া ছিল?
–ঠিক খেয়াল হচ্ছে না স্যার! এসে দেখলুম তালা দেওয়া নেই। ড্রয়ারের তালা কিন্তু ভাঙা নেই।
–চাবি আপনার কাছে থাকে তো?
–হ্যাঁ স্যার! তবে অফিসের চাবি দারোয়ানের কাছে থাকে। কিন্তু দারোয়ান কেন বই চুরি করবে?
–অফিসে রাতে দারোয়ান ছাড়া আর কে থাকে?
রামদুলালবাবু চমকে উঠলেন।–আর কেউ থাকে না। তবে গত রাতে… স্যার! তাহলে কি সেই নোকটাই?
–কোন্ লোকটা?
–রোডরিগ সায়েবের রিপ্রেজেন্টেটিভ। কাল বিকেলে বোম্বে থেকে ভদ্রলোক এসেছিলেন। কার্ড দেখালেন। বললেন, রাত্তিরটা থেকে গৌহাটি যাবেন ভোরের ফ্লাইটে। আমি বললুম, তাহলে কষ্ট করে হোটেলে গিয়ে লাভ কী? অফিসে দুখানা ঘর–মাঝখানে পার্টিশান। ওঁকে পাশের ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করে দিলুম। সকালে অফিসে এসে দারোয়ানের কাছে জিজ্ঞেস করলুম। বলল,–ভদ্রলোক ভোরে চলে গেছেন।
–কী নাম?
একটু ভেবে নিয়ে রামদুলালবাবু বললেন,–কী যেন–আর মৈত্র, নাকি এস মৈত্র। তবে স্যার, অবিশ্বাস করব কেমন করে? রোডরিগ সায়েবের কত রিপ্রেজেন্টেটিভ তো মাঝে-মাঝে কলকাতা আসে। আমার অফিসে রাত কাটিয়ে যায়।
–কেমন চেহারা?
–ছিপছিপে গড়ন। ফর্সা রং। মুখে দাড়ি।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে। আপনি এখন আসুন। আমি দেখছি।
রামদুলালবাবু কর্নেলের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার সাংঘাতিক ক্ষতি হবে স্যার, বইটা না পেলে। বেয়াই বলেছে ও বই মাথা ভাঙলেও আর পাওয়া যাবে না কোথাও। মাত্র ওই একটা কপি ছিল। তাছাড়া, আমি আবার বেয়াইয়ের দোকানে গিয়েছিলুম স্যার! সেখান থেকেই আসছি। জগমোহন বোস একই কথা বলল।
আরও কিছুক্ষণ সাধাসাধি করে রামদুলালবাবু বিদায় নিলেন।
কর্নেল গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বললুম,–জগমোহন এর পেছনে নেই তো? হয়তো বইটার আরও শাঁসালো খদ্দের জুটে গেছে।
কর্নেল বললেন,–অনেক ক্ষেত্রে জগমোহন বইচোরের সাহায্যে দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করে বটে, কিন্তু এ-ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত তো। রোডরিগ নামে একটা লোকের এ বই কেন দরকার হল! জয়ন্ত, সময় আছে তোমার?
–আজ আমার অফ-ডে। কেন?
–চলো তো একবার কলেজ স্ট্রিট ঘুরে আসি।
.
দুই
কলেজ স্ট্রিট-মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। লোকে লোকারণ্য। আমার গাড়ি আটকে গেল জটে। মিছিল কিংবা পথসভা নাকি? এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলুম,–কী ব্যাপার দাদা?
দাদা-ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে বললেন,–আর বলবেন না মশাই! দিনে দিনে এ হচ্ছেটা কী? প্রকাশ্য দিবালোকে একগাদা লোকের চোখের সামনে খুনখারাপি! উঃ আমার মাথাটা কেমন করছে। স্ট্রোক না হলে বাঁচি।
আরেক পথচারী তাকে জিজ্ঞেস করলেন,–কে খুন হল? কোথায় খুন হল?
-ওই যে, দেখুন গে না স্বচক্ষে। একটা মুখোশপরা লোক বইয়ের দোকানদারকে গুলি করে পালিয়েছে।
পাশে দাঁড়িয়ে পেন বেচছিল এক হকার। সে মন্তব্য করল,–জগাইদাটা মরবে আমি জানতুম। কার বই চুরি করে কাকে বেচত। দেখেশুনে ওর দোকানের সেলসম্যানগিরি ছেড়ে রাস্তায় নেমেছি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
কর্নেল গাড়ি থেকে মুখ বের করে দেখে বললেন,–জগাইদা মানে জগমোহন মনে হচ্ছে, জয়ন্ত! ওর দোকানের সামনেই ভিড়টা বেশি দেখছি। তুমি গাড়িটা কাছাকাছি রেখে অপেক্ষা করো। আসছি।
এতক্ষণে আমার পিলে চমকাল। বললুম,সর্বনাশ! জগমোহন খুন হয়ে গেল তাহলে?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বেরিয়ে গেলেন। পেনওয়ালা হকার আমার কথাটা শুনতে পেয়েছিল। বলল,–হা স্যার! নাকি জিপগাড়ি চেপে একটা লোক এসেছিল। এসেই ঢিস্যুম-টিস্যুম করে দুই গুলি!
লোকটা আমার দিকে তাক করছিল কয়েকটা কলম নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ ট্রাফিকজট খুলতে শুরু করল। হর্নের শব্দে কান ঝালাপালা হতে থাকল। বাঁ-পাশে খালি পেয়ে একটু এগিয়ে গাড়ি দাঁড় করালুম। তারপর আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকলুম।
কিছুক্ষণ পরে দেখি, গোয়েন্দাপ্রবর আসছেন। এসে হাসতে-হাসতে বললেন,–চলো! ফেরা যাক!
উনি গাড়ির ভেতর ঢুকে আরাম করে বসলে, বললুম,হাসছেন যে? বডি দেখলেন–নাকি নিয়ে গেছে হাসপাতালে?
–কার বডির কথা বলছ ডার্লিং? জগমোহনের?
–হ্যাঁ। আবার কার?
লোকটা অসম্ভব ধূর্ত। কর্নেল চুরুট ধরালেন। গাড়ি মোড় ঘুরে এবার মহাত্মা গান্ধী রোডে পৌঁছেছে। কর্নেল বললেন,–তবে একথা সত্যি যে একটা মুখোশধারী লোক এসে ওর দোকানে হানা দিয়েছিল। তারপর ফটফট আওয়াজও শোনা গেছে। কিন্তু জগমোহন বহাল তবিয়তেই আছে।
আশ্বস্ত হয়ে বললুম,–তাহলে খুব জোর বেঁচে গেছে বেচারা।
খুব ভয় পেয়ে গেছে জগমোহন।-কর্নেল হাসতে থাকলেন। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বলল, ভাগ্যিস বইয়ের আড়ালে ছিল সে, নইলে রক্তারক্তি হয়ে পড়ে থাকত।
–কিন্তু এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! প্রথম চোটে গুলি ফসকেছে বলে বারবার ফসকাবে না।
কর্নেল কোনো কথা বললেন না। চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে মৃদু-মৃদু টান দিতে থাকলেন চুরুটে। সেইসঙ্গে একটা-একটা করে ওপড়ানোর ভঙ্গিতে দাড়ি টানতে থাকলেন। বরাবর দেখেছি, রহস্যের গোলকধাঁধায় ঢুকে যখন বেরুবার পথ পান না, তখন এমন দাড়ি ছেঁড়ার তাল করেন।…
ওঁর ফ্ল্যাটে আমার আজ লাঞ্চের নেমন্তন্ন। ষষ্ঠীচরণ আয়োজন করেছিল প্রচুর। ঘুঘুমশাই সেই যে চুপ করেছেন তো করেছেন। কথাবার্তা বিশেষ বলছিলেন না। খাওয়ার পর ছাদে চলে গেলেন ওঁর প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে’। আমার ভাত-ঘুমের অভ্যাস প্রবল। সোফায় হেলান দিয়ে চমৎকার একটা ভাত-ঘুম হয়ে গেল। শীতের বেলা কখন ফুরিয়ে গিয়েছিল। চোখ মেলে দেখি, ঋষিসুলভ চেহারা নিয়ে এবং প্রসারিত হাতে কফির পেয়ালা নিয়ে বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। সস্নেহে বললেন,–নাও ডার্লিং! জড়তা ঘুচিয়ে দিতে কফির তুল্য পানীয় আর নেই। আর শোনো, ও-ঘরে জগমোহন এসে বসে আছেন। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি ওঁকে। এবার ডাকা যেতে পারে।
ষষ্ঠী জগমোহনকে ডেকে আনল কর্নেলের নির্দেশে। সেইসঙ্গে তাকেও কফি দিয়ে গেল। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলুম, কী অবস্থা হয়েছে মনের। যেন ব্লটিংপেপারে আঁকা স্কেচ। মোটাসোটা নাদুসনুদুস গড়নের মানুষ। মাথায় এলোমেলো একরাশ চুল। চশমা নাকের ডগায় আটকে আছে কোনোরকমে। কপালে একটা টাটকা সিঁদুরের ফোঁটা–সম্ভবত কালীঘাটে দৌড়েছিলেন পুজো দিতে। সেখান থেকেই হয়তো আসছেন। কফির দিকে তাকিয়ে খাবেন কি না ঠিক করতে পারলেন না কয়েক সেকেন্ড। শেষে সিদ্ধান্ত করলেন খাবেন এবং এক চুমুকে পেয়ালা অর্ধেক শুষে বলবেন,–আমি গেছি। এক্কেরে গেছি!
কর্নেল চোখ পাকিয়ে বললেন,–আপনি যাবেন না তো আর কে যাবে?
জগমোহন হাত নেড়ে আর্তনাদ করলেন,–আর কখনও এমন হইব না স্যার! যদি হয়, আমার কানদুটো কাইটা কুত্তার গলায় লটকাইয়া দিয়েন!
কর্নেল ধমক দিলেন,–তাহলে বুঝতে পারছেন, কীসের গর্তে হাত ভরেছিলেন?
পারছি না স্যার? খুব পারছি।–জগমোহন করুণস্বরে বললেন, আপনের কাছে মিথ্যা কওনের সাধ্যি নাই। হ, বইখান ভৈরবগড় রাজবাড়ির। ওই পোড়াকপাইলা হরিসাধন আমার এ সর্বনাশ করল! আপনে যেমন অর্ডার দিছলেন, আমার বেয়াইমশয় সিঙ্গিবাবুও দিছিল। তো কথা হইল…
কর্নেল বললেন,–সিঙ্গিমশায়ের অফিস থেকে বইটা চুরি গেছে।
জগমোহন ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। তারপর গলায় কাকুতিমিনতি ফুটিয়ে বললেন,–যা লইয়া দিব্যি করতে বলবেন, করুম স্যার! আর যার লগে করি, বেয়াইমশয়ের লগে তঞ্চকতা করুম না।
–শুনুন জগমোহনবাবু! যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কখনও রামশংকর শর্মার আত্মচরিতের ধারেকাছে যাবেন না। কেউ লক্ষ টাকা দিতে চাইলেও ও বই জোগাড় করার চেষ্টা করবেন না। সোজা বলে দেবেন, পাওয়া যাবে না।
–আবার? মুখোশপরা লোকটাও হেই কথা কইয়া গুলি ছুড়ছিল না? বইয়ের গাদায় গুলি লাগল। হেই না বাঁইচ্যা গেলাম স্যার!
-–ঠিক আছে। আপনি আসুন।
জগমোহন দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরলেন। কর্নেল বললেন,–কিছু বলবেন?
যে কথাটা জিগাইতে আইছিলাম, হেই কথাটাই বাদ। –জগমোহন একটু হাসলেন। রেয়ার বুকসের কারবার করিয়া চুল পাকাইলাম স্যার! কিন্তু রামশংকর শর্মার আত্মচরিত কী এমন বই যে এত গণ্ডগুল বাধছে? এদিকে আপনিও কইলেন, সাপের গর্তে হাত ভরছিলাম। ক্যান একথা কইলেন স্যার?
জগমোহনবাবু!-কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, বইখানা আসলে ভীষণ অপয়া। ওই বই নিয়ে বেশি মাথা না ঘামালেই ভালো। জানেন তো? যত হাসি তত কান্না-বলে গেছেন রাম শন্না। ইনি হলেন সেই রাম শন্না। অতএব যা বললুম-মনে রাখবেন।
হ, বুঝছি।–বলে জগমোহন চলে গেলেন। কী বুঝলেন, তিনিই জানেন। হয়তো বুঝলেন, হাসতে মানা।
ঘরের ভেতর দিনশেষের ছায়া গাঢ় হচ্ছিল। কর্নেল সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিলেন। তারপর পায়চারি করতে-করতে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন জট পাকিয়ে গেল, জয়ন্ত! বোম্বের কে এক রোডরিগ সায়েব রামশর্মার আত্মচরিতের খবর রাখেন। রামদুলাল সিংহকে বইটা জোগাড় করে দিতে বলেছিলেন তিনি। জগমোহন হল সিঙ্গিমশায়ের বেয়াই। ভৈরবগড় রাজবাড়ি থেকে হরিসাধন এর আগে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই চুরি করে এনেছে। কাজেই জগমোহন তার শরণাপন্ন হল। হরিসাধন বই চুরি করে এনে বেচল। তারপর দুটো ঘটনা ঘটল। রামদুলালের অফিস থেকে সেই বই চুরি এবং জগমোহনের দোকানে মুখোশধারীর হামলা। সত্যিকার পিস্তল ছোড়েনি সে। বইয়ের গাদায় গুলির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাইনি। তার মানে, থিয়েটারের পিস্তল নিয়ে এসেছিল। হুঁ–জগমোহনকে ভয় দেখাতেই এসেছিল।… জয়ন্ত, আমার অনুমান সত্য। সে আসলে জগমোহনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, এই বই আর যেন বেচাকেনা না করে জগমোহন।… কিন্তু কেন?
–তাহলে তার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না।
–কী ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না বলতে চাইছ তুমি?
–পবিত্র ঐতিহাসিক পেরেকের–যার দাম হয়তো বিদেশে কোটি-কোটি ডলার।
কর্নেল হাসলেন।–তুমি বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ, ডার্লিং! একজ্যাক্টলি তাই। কেউ বা কারা টের পেয়েছে, রামশর্মার আত্মচরিতের ভেতর স্যাটর নামে ঐতিহাসিক পেরেক লুকিয়ে রাখার কোনো সূত্র আছে।…হুঁ, রোডরিগেরও উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তাকে টেক্কা দিয়ে বইটা হয়তো অন্য একজন হাতিয়ে নিল।
–সিঙ্গিমশায়ের অফিসে আর. মৈত্র না এস. মৈত্র নামে যে লোকটা এসেছিল, সে নয় তো?
গোয়েন্দাপ্রবর সায় দিলেন। ঠিক, ঠিক। এখন কথা হচ্ছে, এই মৈত্র লোকটা যেই হোক, সে রোডরিগের পরিচিত। তার পরিচিত নয় শুধু, তার অন্তরঙ্গ বলে মনে হচ্ছে। সে রোডরিগের সঙ্গে সিঙ্গিমশায়ের যোগাযোগের কথা জানতে পেরেছিল। তারপর ছুটে এসেছিল কলকাতায়।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন। চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর আপনমনে বললেন, কিন্তু কোথায় আছে সেই পেরেক? মিশরীয় চিত্রলিপিতে পাঁচটা পাখি! তার একটা অর্থ : The Sower Arepo holds the wheels carefully. প্রথমে গলগথা বধ্যভূমি থেকে যিশুর দেহ কবরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন পেরেক পাঁচটা কেউ খুলে নিয়েছিল ক্রশ থেকে। তাহলে কি আরেপো নামে এক চাষির চতুষ্কোণ শস্যক্ষেত্রে সেগুলো পুঁতে রাখা হয়েছিল?… তারপর কেউ উদ্ধার করে ইথিওপিয়ার দুর্গে নিয়ে যায়।… একটা পেরেক পেলেন রামশংকর শর্মা।… SATOR, AREPO, TENET, OPERA, ROTAS? রহস্যময় শব্দবর্গ! শব্দগুলোতে লেগেছে R O A T S E P মোট সাতটা বর্ণ। এই সাতটা বর্ণে কতগুলো অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরি করা যায়, দেখা যাক।
হঠাৎ উঠে গিয়ে কোণের টেবিলে বসলেন কর্নেল। তারপর প্যাডের ওপর কলম নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। বুঝলুম, বুড়োকে এবার ভূতে পেয়েছে। এ ভূত ঘাড় থেকে নামতে রাত পুইয়ে যেতেও পারে। তাই ষষ্ঠীচরণের কাছে গিয়ে চুপিচুপি বললুম,–তোমার বাবামশাইকে বলে দিও, আমি গেলুম।
ষষ্ঠী ঘাড় নাড়ল। মুখে মুচকি হাসি।..
সেদিনই অনেক রাতে টেলিফোনের বিরক্তিকর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সাংবাদিক হওয়ার এই এক জ্বালা। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কোনো কর্তাব্যক্তি না হয়ে যান না। হয়তো কোথায় গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, মন্ত্রীর ওপর বোমা, কিংবা কোনো ধাদ্ধাড়া-গোবিন্দপুরে কী গণ্ডগোল। হয়তো শুনব, এখনই রওনা হও অকুস্থলে। জ্বালাতন!
খাপ্পা হয়ে ফোন তুলে বললুম,কী হয়েছে? তারপর আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর গলা শুনতে পেলুম।
–ডার্লিং! রাত দুটোয় তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য খুবই দুঃখিত।
বুড়োমানুষরা অনিদ্রায় ভোগেন, অন্যদেরও ভোগান।
–বলুন।
–জয়ন্ত! সেই সাতটা অক্ষর থেকে এইমাত্র একটা নতুন শব্দ বেরিয়ে এসেছে। বিস্ময়কর যোগাযোগ, ডার্লিং! নদীয়া জেলার যে গ্রামে রামশর্মার বাড়ি ছিল, তার প্রাচীন নাম কি ছিল জানো? সাতপুর।
বেশ তো। সেজন্য এত রাতে ফোন করার কী দরকার হল?
–জয়ন্ত, জয়ন্ত! সাতপুরকে বিদেশি উচ্চারণে রোমান হরফে পেয়েছি। SATPORE!
–খুব ভালো কথা। তাতে কী হয়েছে?
SATOR, AREPO, TENET, ROTAS, OPERA C167 at oppas rotas CC 90 SATPORE? প্রাচীন পৃথিবী রহস্যময়, জয়ন্ত! আর শোনো, কাল সকাল নটায় তৈরি থেকো। আমরা সাতপুর অর্থাৎ বর্তমান রামশংকরপুরে যাচ্ছি। সাড়ে নটায় শেয়ালদায় ট্রেন।
–কাল আমার অফ-ডে নেই। সপ্তাহে মাত্র একদিন অফ-ডে পাই।
–জয়ন্ত, একটু আগে রামশংকরপুর থেকে রাম শন্নার বংশধর প্রণবশংকর বাঁড়ুজ্জে ট্রাংককল করেছিলেন। ভৈরবগড়ের রাজাবাহাদুর ওঁর কুটুম্ব। রাজাবাহাদুরের পরামর্শে আমাকে ট্রাংককল করা। রাত দশটায় প্রণবশংকরের বাড়ির পেছনের বাগানে ওঁর নিরুদ্দিষ্ট ভাই উমাশংকরের ডেডবডি পাওয়া গেছে। বুঝতে পারছ? তিনমাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন উমাশংকর। হঠাৎ ওঁর ডেডবডি…
কথা কেড়ে বললুম, ঠিক আছে। সকাল ৯টায় তৈরি থাকব। তারপর ফোন রেখে চিত হয়ে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। টের পেলুম, আমার মাথার ভেতর ঘুঘু ডাকছে।…
.
তিন
শহরে-গ্রামে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেলে যা দাঁড়ায়, তার নাম রামশংকরপুর। গঙ্গার ধারে একেবারে শেষপ্রান্তে রাম শন্নার তৈরি বিরাট ঐতিহাসিক দালানবাড়ি। নিরিবিলি জায়গা বলা যায়। ঘন গাছগাছালি আর এন্তার ঝোঁপজঙ্গল গঙ্গাতীরের উর্বর মাটিতে যথেষ্ট গজিয়ে রয়েছে। কিন্তু এই বাঁড়ুজ্জেবাড়ি থেকে উত্তরে একটুখানি এগোলেই অন্যরকম দৃশ্য। বাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, থানা, কোর্টকাছারিতে জমজমাট। শহরের মতো লোকের ভিড় আর যানবাহনের দাপট।
একর-সাতেক জায়গার ঠিক মাঝখানে দোতলা প্রকাণ্ড সেকেলে বাড়ি। চারদিকে কোথাও ফাঁকা ঘাসজমি, কোথাও সবজিখেত, কোথাও ফুলফলের ক্ষয়াটে বাগান। একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সারা চৌহদ্দি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু সে-পাঁচিলের অবস্থা বাড়িটার চেয়ে জরাজীর্ণ। কোথাও ভেঙেচুরে গেছে; কোথাও পাঁচিল ছুঁড়ে গাছও গজিয়েছে। পশ্চিমে গঙ্গার ধারে বাঁধানো ঘাটের দশাও করুণ। গঙ্গা ঘাট থেকে একটু দূরে সরে গেছে কালক্রমে। এই দেউড়ির কপাট কবে লোপাট হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে ঢুকলে বর্মি বাঁশের একটা ঝাড়। তার পাশে পুরোনো এক ফোয়ারা। কবে মরেহেজে গেছে ফোয়ারাটা। তার পাথুরে গা ফাটিয়ে আগাছা গজিয়েছে। মাঝখানে টুটাফাটা স্তম্ভের ওপর একটু ঝুঁকে যেন ঝরিতে জল ভরছে এক অপ্সরা। কিন্তু তার মাথাটাই নেই।
মুণ্ডুকাটা অপ্সরার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে কর্নেল বললেন,–রাম শর্মা দেশে ফিরে রাজা-রাজড়ার মতো জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। তার একটা নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছ। এই অপ্সরামূর্তি কিন্তু মোটেও দিশি নয়। ত্রিনিদাদের বাড়ি থেকে বহু ঝক্কি পুইয়ে বয়ে এতদূরে এনেছিলেন শর্মামশাই। উনি বেঁচে থাকলে অপ্সরার মুণ্ডু নেই দেখে খুব কষ্ট পেতেন।
প্রণবশংকর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন,–১৯৪২ সালের ঝড়ে ওখানে একটা প্রকাণ্ড শিরীষগাছ ভেঙে পড়েছিল। একটা ডালের ধাক্কায় মুণ্ডুটা ভেঙে গিয়েছিল।
কর্নেল বললেন,–ফোয়ারাটা পাঁচকোনা দেখছি!… হু, ভেনিসের গো স্কোয়ারে ঠিক এমনি একটা ফোয়ারা দেখেছিলুম। তবে তার কেন্দ্রে পেতলের যে মূর্তি আছে, সেটা সম্ভবত দেবী ইস্তারের। ইস্তার ছিলেন প্রাচীন সুমেরের যুদ্ধদেবী। কিন্তু তার মূর্তির পায়ের তলায় পাঁচকোনা ফোয়ারা হল খ্রিস্টীয় পবিত্র নক্ষত্রের প্রতীক। ওই নক্ষত্র দেখে পুবদেশের জ্ঞানীরা টের পেয়েছিলেন যিশু জন্মেছেন। তারা নক্ষত্রের দিকে চোখ রেখে বেথেলহেমের আস্তাবলে পৌঁছান। বলে কর্নেল পায়ের কাছে ঘাস থেকে কী একটা কুড়িয়ে নিলেন। হলদে রঙের ছেঁড়া কাগজকুচি মনে হল। সেটা ভালো করে দেখে পকেটে রেখে দিলেন। তারপর চারপাশের ঘাসে কিছু খুঁজতে থাকলেন। ঘাসফড়িং হতে পারে। ঘাসফড়িংও ওঁর চর্চার বিষয় বলে জানি। প্রণবশংকর কিন্তু কর্নেলের ব্যাপার-স্যাপার দেখে বোধ করি মনে-মনে বিরক্ত হয়েছেন। বারোটা নাগাদ পৌঁছুনোর পরেই উনি আমাদের হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ফোয়ারার কাছেই ওঁর নিরুদ্দিষ্ট ভাই উমাশংকরকে খুন করা হয়েছে। বডি সকালে পুলিশ মর্গে নিয়ে গেছে। আচমকা কেউ উমাশংকরের মাথায় সম্ভবত লোহার রড দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। এক আঘাতেই মৃত্যু হয়–কারণ শরীরে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।
কর্নেল ওসব বিবরণে একটুও কান করেননি। শুধু রাম শর্মার কথা নিয়েই বকবক করছেন। এতে আমারও বিরক্তি আসছিল। কর্নেল এবার গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার চোখে রেখে গাছের পাখি দেখছেন। প্রণবশংকরকে সহানুভূতি দেখানোর জন্য ওঁর ভাইয়ের প্রসঙ্গে কথা বললুম,–উমাশংকর কতদিন আগে নিখোঁজ হন, মিঃ ব্যানার্জি?
–তা মাস তিনেক হবে।
–কোনো ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?
কোনো ঝগড়াঝাটির প্রশ্নই ওঠে না। তবে ছোটকু একটু জেদি প্রকৃতির ছিল। মাঝে-মাঝে তুচ্ছ কথায় ভীষণ রেগে যেত। কিন্তু হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার আগের রাতে ওর মেজাজ অত্যন্ত শান্ত দেখেছিলুম। রাতে একসঙ্গে দু-ভাই মিলে খাওয়াদাওয়া করলুম। দিব্যি স্বাভাবিকভাবে গল্পগুজব করল। শুতে গেল। সকালে গঙ্গাধর ওর ঘরে চা নিয়ে গিয়ে দেখে, নেই। ভাবল, বাথরুমে আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার পাত্তা নেই।…
প্রণবশংকর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, আমার ছেলেপিলে নেই। স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুই আগে। আমার বয়স ৬৫ বছর হতে চলল। ওই ছোটকুই ছিল আমার বেঁচে থাকার সম্বল। অথচ কী দুর্ভাগা আমি, দেখুন জয়ন্তবাবু! হঠাৎ অমন করে সেই ছোটকু নিপাত্তা হয়ে গেল। কত খোঁজখবর করলুম। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলুম। তারপর এতদিনে ওর ডেডবডি ফিরে পেলুম।
–ডেডবডি প্রথম কে দেখেছিল?
গঙ্গাধর।–প্রণবশংকর রুমালে চোখ মুছলেন।–গঙ্গাধর এ-বাড়িতে ছেলেবেলা থেকে আছে। ছোটকুকে সে ছেলের মতো ভালোবাসত। গতরাতে, তখন আটটা-সাড়ে আটটা হবে, গঙ্গাধর তার ঘর থেকে একটা আবছা চিৎকার শুনেছিল। ও ভেবেছিল, চোর ঢুকেছে বাগানে প্রায়ই রাতবিরেতে চোর আসে। গোবিন্দ-মালি হয়তো তাই চেঁচিয়ে তাকে ডাকছে। জ্যোৎস্না ছিল। গঙ্গাধর পশ্চিমের এই বারান্দায় বেরিয়ে আসে। তারপরই দেখতে পায় কে পালিয়ে যাচ্ছে। তাড়া করে এখানে এসেই ছোটকুর বডিতে ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যায় গঙ্গাধর। তারপর…
কর্নেল এগিয়ে এসে বললেন,–মিঃ ব্যানার্জি, এখানে আপাতত আর কিছু দেখার নেই। এবার চলুন, উমাশংকরবাবুর ব্যাগটা আমি দেখতে চাই।
প্রণবশংকর পা বাড়িয়ে বললেন,–চলুন। দেখাচ্ছি।
যেতে-যেতে কর্নেল বললেন,–পুলিশের কী ধারণা মিঃ ব্যানার্জি? কিছু জানতে পেরেছেন?
–হুঁ। পুলিশের ধারণা, উমাশংকর কোনো শত্রুর ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। সেই শত্রু তাকে তাকে ছিল। তা না হলে সে পিছনের ফটক দিয়ে বাড়ি ঢুকবে কেন?
–আপনার কী মনে হয়?
-–আমারও তাই মনে হচ্ছে। শুধু আশ্চর্য লাগছে যে, ছোটকুর শত্রু ছিল, অথচ আমায় কেন বলেনি?
-–আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জি, নিখোঁজ হওয়ার আগে উমাশংকরবাবুর হাবভাবে কোনো গণ্ডগোল চোখে পড়েনি?
–তেমন কিছু তো দেখিনি। তবে কিছুদিন থেকে একটু আনমনা হয়ে থাকত যেন। চুপচাপ একা বসে কী যেন ভাবত। রাত জেগে কী সব করত। অনেক রাতে ওর ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করলে হেসে বলত, কিছু না।
–কিন্তু উমাশংকরবাবুর সঙ্গে শত্রুতা থাকতে পারে কার?
–সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। তবে একালের ছেলে। কিছু বলা যায় না। হয়তো ভেতর-ভেতর রাজনৈতিক দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য ওকে প্রকাশ্যে কোনোদিন
রাজনৈতিক ব্যাপারে দেখিনি। আমার সঙ্গে কোনোরকম রাজনৈতিক আলোচনাও করত না।
বাড়ির নীচের তলায় দক্ষিণের একটা বড় ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেই ঘরে পৌঁছে দিয়ে প্রণবশংকর তার ভাইয়ের ব্যাগটা আনতে গেলেন।
কর্নেল গম্ভীরমুখে আরামকেদারায় বসে চুরুট ধরালেন। বললুম,–ফোয়ারার ওখানে সম্ভবত একটা কু সংগ্রহ করেছেন। একটু শুনি, কী ধরনের ব্লু।
কর্নেল ঠোঁটের কোনায় হাসলেন।–গোয়েন্দারা ব্লু খুঁজলেই নাকি পেয়ে যায়। এটাই সাবেকি পদ্ধতি, ডার্লিং! হ্যাঁ–আমিও একটা কিছু পেয়েছি। তবে সেটা ক্ল কি না জানি না। একটুকরো ছেঁড়া ময়লা কাগজ–মাত্র একবর্গ ইঞ্চি মাপের। তবে কাগজটুকুর বৈশিষ্ট্য হল, তা খুব পুরোনো এবং একটু চাপ লাগলেই গুঁড়ো হয়ে যায়।
প্রণবশংকর একটা সাধারণ কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বললেন,–ব্যাগটা একটু তফাতে পড়েছিল ঝোঁপের ভেতর। আপনারা আসবার কিছুক্ষণ আগে গোবিন্দ ওটা কুড়িয়ে পেয়েছে। ব্যাগটা ছোটকুরই বটে। কারণ এই দেখুন ওর প্যান্ট, শার্ট, তোয়ালে, আর সব টুকিটাকি জিনিস।… আরে! এটা আবার কী?
জিনিসগুলো বের করে টেবিলে রাখছিলেন প্রণবশংকর। চৌকো জিনিসটা দেখে কর্নেল বললেন, এটা একটা ব্যাটারিচালিত মেটাল-ডিটেক্টর। কোথাও কোনো ধাতব জিনিস লুকোনো থাকলে এর সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
চমকে উঠেছিলুম। বললুম,–তাহলে কি উমাশংকরবাবু…
গোয়েন্দাপ্রবর এমন কটমটিয়ে তাকালেন যে মুখ বন্ধ করলুম তক্ষুনি। প্রণবশংকর অবাক হয়ে বললেন,–মেটাল-ডিটেক্টর দিয়ে কী করত ছোটকু?
সে-কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল ব্যাগের ভেতর হাতড়ে বললেন,–হুঁ, বুঝেছি। আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জি, ভৈরবগড়ের রাজাবাহাদুরকে রামশংকর শর্মার আত্মচরিত কবে আপনি উপহার দিয়েছিলেন?
প্রণবশংকর স্মরণ করার চেষ্টা করে বললেন,–গত অগস্ট মাসে। এ অঞ্চলে কী একটা কাজে উনি এসেছিলেন। এদিকে এলেই আমার বাড়িতে ওঠেন। বৈবাহিকসূত্রে ওঁদের সঙ্গে আমাদের কুটুম্বিতার সম্পর্ক।
–রাজাবাহাদুরকে বইটা দেওয়ার জন্য উমাশংকরবাবু কি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, হা। ভীষণ খাপ্পা হয়েছিল আমার ওপর। আমি ওকে বুঝিয়ে বললুম, বইটা এখানে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। বরং রাজাবাহাদুরের লাইব্রেরিতে থাকলে যত্ন হবে। তাছাড়া রাজাবাহাদুরও বলেছিলেন, বইটা আবার উনি ছাপার ব্যবস্থা করবেন।
–রাজাবাহাদুরের সঙ্গে উমাশংকরের সম্পর্ক কেমন ছিল?
প্রণবশংকর একটু ইতস্তত করে বললেন,–এটুকু বলতে পারি, রাজাবাহাদুর এ-বাড়ি এলে ছোটকু ওঁকে এড়িয়ে থাকত। আড়ালে ওঁর হামবড়াই ভাবের জন্য খুব ঠাট্টা-তামাশা করত। বলত, যাত্রাদলের রাজা। আসলে ছোটকুটা বরাবর একটু বিদ্রোহী-টাইপের মানুষ ছিল। সবাই যাকে সম্মান করছে, ও তাকে তুচ্ছ করবেই করবে।
–উনি কি ভৈরবগড় রাজবাড়িতে যেতেন?
কে? ছোটকু? –প্রণবশংকর মাথা নাড়লেন।সেই ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যা গেছে- টেছে। বড় হয়ে আর যায়নি। বলত, রাজাগজাদের যা গুমোর, গেলে চাকর ভেবে পা টিপতে বলবে। দরকার নেই গিয়ে।
কর্নেল মন্তব্য করলেন,–হুঁ, উমাশংকরবাবুর মানসিক গঠনটা বুঝতে পারছি।–তারপর ব্যাগের তলা থেকে একটা কাগজকুচি বের করে পরীক্ষা করতে থাকলেন।
প্রণবশংকর অন্যমনস্কভাবে টেবিলের ওপর রাখা ছোটভাইয়ের শার্টটা ভাজ করছিলেন। বললেন,–ব্যাগে কী আছে ভালো করে এখনও দেখিনি। মানিব্যাগটা অবশ্য পাওয়া গেছে। যে প্যান্টটা পরেছিল, তার হিপ পকেটে ওটা পাওয়া গেছে। টাকাকড়ি বিশেষ ছিল না।
কর্নেল বললেন,–মানিব্যাগটা একটু কষ্ট করে নিয়ে আসবেন?
এনে দিচ্ছি।–বলে প্রণবশংকর চলে গেলেন।
কর্নেল এবার ব্যাগ রেখে প্যান্ট ও শার্টটা নিয়ে পড়লেন। শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে খুলে দেখলেন। চুপচাপ বসে ঘুঘুমশাইয়ের কাণ্ডকারখানা দেখছিলুম। চোখে চোখ পড়লে বললেন,–জন্মান্তরবাদে আমার বিশ্বাস নেই জয়ন্ত! কিন্তু কোনো-কোননা ক্ষেত্রে এই অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে দেখেছি। যেমন ধরো, রামশংকর শর্মা! এক দুর্দান্ত সাহসী মানুষ। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। যে-কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত সবসময়। তিনিই যেন তার বংশধর উমাশংকরের মধ্যে পুনর্জন্ম নিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।…
প্রণবশংকর মানিব্যাগটা নিয়ে এলে কর্নেল কথা থামিয়ে সেটা নিলেন। বললেন,–কিছু বের করা হয়নি তো মিঃ ব্যানার্জি?
–না, না! বের করার প্রশ্নই ওঠে না।
কর্নেল মানিব্যাগের ভেতর থেকে কয়েকটি মুদ্রা বের করে বললেন,–, যা ভেবেছিলুম। এই মুদ্রাগুলোর মধ্যে দুটো মুদ্রা ত্রিনিদাদের।
প্রণবশংকর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললুম, ত্রিনিদাদের মুদ্রা কোত্থেকে পেলেন উমাশংকর?
কর্নেল বললেন,–ত্রিনিদাদে। আবার কোথায় পাবেন?
প্রণবশংকর অবাক হয়ে বললেন,–সে কী! ছোটকু ত্রিনিদাদ গিয়েছিল নাকি?
–হ্যাঁ, মিঃ ব্যানার্জি! ওঁর নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
প্রণবশংকর বললেন, আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে। রাম শর্মা শুনেছি ত্রিনিদাদ মুলুকে ছিলেন। সেখানে ঘরবাড়িও করেছিলেন। ওঁর আত্মচরিত ভালো করে পড়িনি অবশ্য। তবে ছোটকু… হ্যাঁ, হ্যাঁ! মনে পড়েছে বটে, ছোটকু মাঝে-মাঝে বলত, রাম শর্মার ভিটে দেখতে যাবে। কিন্তু সে তো সেই সাউথ আমেরিকার মাথায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে।
আমি বললুম,–তাহলে পাসপোর্ট থাকা উচিত সঙ্গে। পাসপোর্ট কোথায়?
কর্নেল বললেন,–বোঝা যাচ্ছে না পাসপোর্টটা কী হল। যাই হোক, মিঃ ব্যানার্জি, একটা জিনিস হাতানো খুনির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। সেটা সে হাতাতে পেরেছে। কারণ, ব্যাগের ভেতর এবং ফোয়ারার কাছে আমি দুকুচি নমুনা খুঁজে পেয়েছি।
প্রণবশংকর বললেন, কী বলুন তো?
রামশংকর শর্মার আত্মচরিত। বলে কর্নেল এবার পকেট-নোটবইটার পাতা ওলটাতে থাকলেন।—পাসপোর্টের নাম্বার টোকা আছে। তার মানে পাসপোর্ট ছিল।… এখানে দেখছি gitarisco Tongat GATIT I ‘Reported to Police. Trabanka P.S. Case No. P.F. 223 dated 15.10.80.’ তার মানে পাসপোর্টটা নিশ্চয়ই চুরি গিয়েছিল। ত্রাবাংকা নামে কোনো জায়গার থানায় ডাইরি করেছিলেন। কোন্ তারিখে উনি নিপাত্তা হন মিঃ ব্যানার্জি?
-সাতই অক্টোবর
–হুঁ–আরে। এখানে দেখছি : Appointment with F. Rodrigue at 6 PM.’ সেই রোডরিগ! রামদয়াল সিঙ্গিকে যে বইটা জোগাড় করে দিতে বলেছিল!–কর্নেল মুখ তুলে বললেন, মিঃ ব্যানার্জি, আপনার ভাই ত্রিনিদাদ গিয়ে পাসপোর্ট এবং সম্ভবত টাকাকড়িও চুরি গিয়ে বিপদে পড়েন। সেখানে রোডরিগ নামে একটা লোকের সঙ্গে আলাপ হয়। এটুকু বুঝতে পেরেছি, রোডরিগ পয়সাওলা ব্যবসায়ী। নানা দেশে তার ব্যাবসা-বাণিজ্য আছে। উমাশংকরবাবু তাঁর সাহায্য পেয়েছিলেন এবং তার সাহায্য পেয়েই ত্রিনিদাদে তিন মাস তিনি থাকতে পেরেছিলেন। শুধু একটা ভুল করেছিলেন। রোডরিগকে আত্মচরিতের কথাটা বলা ঠিক হয়নি। জিনিসটার দাম কোটি-কোটি ডলার–যদি উদ্ধার করা হয়।… হুঁ, জট অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। কিন্তু রোডরিগ তো এখন বোম্বেতে। এতদূরে ঠিক সময়মতো লোক পাঠিয়ে উমাশংকরের কাছ থেকে আত্মচরিত হাতানো… নাঃ! এখনও জট থেকে যাচ্ছে।
প্রণবশংকর হাঁ করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। এই সময় গঙ্গাধর এসে বলল,–খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে বড়বাবু। পিসিমা বললেন, দুটো বাজতে চলল। ওঁদের খবর দে।
প্রণবশংকর উঠলেন।–তাই তো! ছি, ছি–বড্ড দেরি হয়ে গেল খেতে। দয়া করে এবার আসুন কর্নেল! কথাবার্তা যা হওয়ার পরে হবে। আমাদের তো অরন্ধন। নেহাত আপনাদের জন্য দু-মুঠো ডাল ভাতের ব্যবস্থা করেছি।
কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত, স্নান করবে নাকি? আমি অবশ্য ভোরে ও-কাজ সেরেই বেরিয়েছি।
আঁতকে উঠে বললুম,–এই হাড়কাঁপানো শীতে মফস্বলের জলে স্নান? বাস্য! কী ঠান্ডা এখানে!
গঙ্গাধর বলল,–গরম জল করে দেব স্যার?
-থাক।
কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই আগের জন্মে বেড়াল ছিলে ডার্লিং! তাই জলকে এত ভয়।
বললুম,–আপনি তাহলে আগের জন্মে উদবেড়াল ছিলেন। তাই শীতের ভোরে জল মাখতে ভালোবাসেন।
.
চার
খাওয়ার সময় তদারক করছিলেন এক বৃদ্ধা। প্রণবশংকর আলাপ করিয়ে দিলেন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। উনি ছাড়া আর কোনো মহিলা এ-বাড়িতে নেই। ওঁর নাম কুমুদিনী। খুব স্নেহপ্রবণ মহিলা। আদরযত্ন করে খাওয়াচ্ছিলেন। কথায়-কথায় দুঃখ করে বললেন,–ছোটকু বেঁচে থাকলে অতিথিদের জন্য কী যে ছুটোছুটি করত! পরিতোষকে বললুম ব্যবস্থা করতে। পরিতোষের হাজারটা কাজ। তবে বাবা, আজ তো অরন্ধন বাড়িতে। আপনাদের জন্য নিয়মভঙ্গ করতে হল।
প্রণবশংকর বললেন,–পরিতোষ বেচারার দোষ নেই, কাল সারারাত জেগেছে। থানা-পুলিশের হাঙ্গামা তো কম নয়। সকালে আবার দৌড়ল থানায়। সেখান থেকে মর্গে। যতক্ষণ
বডি নিয়ে আসবে, ততক্ষণ হয়তো ওর শান্তি নেই। তারপর আর আসেনি পরিতোষ? কুমুদিনী বললেন,–এসেছিল একটু আগে। আবার বেরুল।
–আজ আর ওর ফার্মে যাওয়া হল না। কী যে হচ্ছে সেখানে কে জানে! পরিতোষের ভয়ে কেউ ফসলে হাত দিতে সাহস পায় না!
কর্নেল বললেন,–পরিতোষ কে?
প্রণবশংকর বললেন,–এ বাড়ির কেয়ারটেকার বলতে পারেন, ম্যানেজারও বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে এ-বাড়িতে আছে। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মাঠে কৃষিখামার করেছি। তাও দেখাশোনা করে। বাড়িরও সবকিছু তদারক করে। ও না থাকলে আমাকে পথে বসতে হত। ছোটকু তো বরাবর নিষ্ক্রিয়–কোনো বৈষয়িক ব্যাপারে সে থাকেনি। বলত, নুটু থাকতে আবার আমায় কেন! নুটু একা একশো। সত্যি তাই। তবে পরিতোষ বেচারার মুখের দিকে এখন তাকানো যায় না। ছোটকুর ব্যাপারে সে একেবারে ভেঙে পড়ার দাখিল। ছেলেবেলা থেকে দুটিতে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে। একসঙ্গে খেলাধুলো করেছে। পড়াশুনা করেছে। দুটিতে খুব অন্তরঙ্গতা ছিল। ছোটকু নিরুদ্দেশ হলে পরিতোষ সারা ভারত ওর খোঁজে ছোটাছুটি করেছিল। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। সে এক অবস্থা!
–পরিতোষবাবু এলে একটু পাঠিয়ে দেবেন? ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
–আসুক। বলব’খন।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে কর্নেল বললেন, আপনার টেলিফোন কোন্ ঘরে আছে মিঃ ব্যানার্জি?
–নীচের ঘরে। ওখানে পরিতোষ অফিসমতো করেছে। সবই ওর দায়িত্বে। আমার বয়স হয়েছে–কিছু দেখাশোনা করতে পারিনে।
–আমি একটা ট্রাংককল বুক করতে চাই।
–স্বচ্ছন্দে। আসুন, আসুন।
আমি ওঁদের সঙ্গে গেলুম না। ভাতঘুমের টান ধরেছে সঙ্গে-সঙ্গে। একতলায় নেমে সটান আমাদের আস্তানায় ফিরে এলুম। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ার আগে বারান্দার রোদ্দুরে বসে মৌজ করে সিগারেট টানতে থাকলুম। বরাবর এটাই অভ্যাস। সিগারেট শেষ করে ঘরের ভেতর বিছানায় কম্বলটার দিকে লোলুপদৃষ্টে তাকাচ্ছি, কর্নেল এসে গেলেন। এসেই চোখ পাকিয়ে বললেন,–উঁহু! দিনদুপুরে ঘুমোনো মোটেই ভালো কথা নয়। আয়ুক্ষয় হয়। বরং চলো, আমরা একবার ঝটপট ভৈরবগড় ঘুরে আসি।
–ভৈরবগড়! সে আবার কোথায়?
–বেশি দূরে নয়। গঙ্গা পেরুলে বাস। বাসে চেপে মাইল-পাঁচেক মাত্র।
মনে-মনে বুড়োর মুণ্ডপাত করতে-করতে পা বাড়ালুম। বাজার এলাকার দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বললুম-হঠাৎ ভৈরবগড়ে কী ব্যাপার বলুন তো?
–রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা করে আসি–এত কাছে এসে পড়েছি যখন। তাছাড়া হরিসাধনেরও খোঁজখবর নেব।
–হরিসাধন-মানে সেই নেশাখোর বইচোর! তাকে কি রাজাবাহাদুর আর বাড়ি ঢুকতে দিয়েছেন?
–চলো তো, দেখি।
বাজার এলাকার ভিড় ঠেলে আমরা গঙ্গার ঘাটে পৌঁছলুম। একটা নৌকো ভাড়া করে ওপারে পৌঁছতে প্রায় একটা ঘণ্টা লেগে গেল। কিন্তু খুব সুন্দর এই জার্নি। কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে পড়ন্ত শীতের বেলায় জলপাখি দেখে নিলেন।
বাসের ভিড় দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কলকাতার বাসে ভিড় হয় বটে, কিন্তু এর তুলনায় সে-ভিড় কিছুই না। বাসটার আগাপাশতলা লোক ভর্তি। তবু কন্ডাক্টার চাঁচাচ্ছে,–চলে আসেন। চলে আসেন! ছেড়ে গেল! ছেড়ে গেল ভৈরবগড়-দাঁইহাট-কাটোয়া-আ-আ!
হয়তো কর্নেলের সায়েবি চেহারা ও বেশভূষা, কিংবা দাড়িটাড়ি দেখে কন্ডাক্টার ড্রাইভারের ডান ও বাঁ-পাশ থেকে দুই বেচারাকে হিড়হিড় করে নামিয়ে আমাদের জায়গা করে দিল। হতভাগা যাত্রীদ্বয়কে সে কোথায় জল কে জানে! আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন,–পৃথিবীটা যে নিছক সুখের জায়গা, মাঝে-মাঝে এটা টের পাওয়া দরকার ডার্লিং!
–কিন্তু অন্যদের বঞ্চিত করে এভাবে জায়গা নেওয়া কি উচিত হল?
ড্রাইভার একগাল হেসে বলল,–ওদের কথা ভাববেন না স্যার। ওরা আমার নিজের লোক। বিনিপয়সায় যাচ্ছে। ভৈরবগড়ে আপনারা নামলে ওদের ডেকে নেব।
দুধারের গাছপালাঘেরা পিচের রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলেছে। পাঁচ মাইল যেতে অন্তত বারপাঁচেক বাস থামল। কিছু যাত্রী নামল, উঠল তার দ্বিগুণ। আমাদের নামিয়ে যখন বাসটা চলে গেল, তখন তাকে দেখাচ্ছিল যেন চলন্ত মৌচাক–তবে মৌমাছিগুলো মানুষ এই যা।
বাস-রাস্তার মোড় থেকে সাইকেলরিকশা করে এগিয়ে আমরা রাজবাড়ির ফটকের কাছে। নামলুম। একজন দারোয়ান কর্নেলকে দেখামাত্র মিলিটারি সেলাম ঠুকল। বুঝলুম কর্নেলকে সে চিনতে পেরেছে। ওপাশের একতলা সারিবদ্ধ ঘরের বারান্দায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। হাতে চায়ের পেয়ালা। তিনি দৌড়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
একটু পরে রাজবাড়ির বিশাল ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করতে-করতে রাজাবাহাদুর এসে গেলেন। প্রণবশংকরের বয়সি মানুষ। পরনে সাদাসিধে পাঞ্জাবি-পাজামা। চোখে পুরু লেন্সের কালো চশমা। কিন্তু রোগা টিঙটিঙে গড়ন। বললেন, খুব শিগগির এসে পড়েছেন আপনারা। আমি ভেবেছিলুম, ছটার আগে পৌঁছতে পারবেন না। তবে দেখুন কর্নেল, আমার কিন্তু কোনো অপরাধ নেই। আমি জিপ পাঠাতে চাইলুম, আপনি বারণ করে দিলেন।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, আমার এই তরুণ বন্ধু একজন সাংবাদিক। ওকে দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একটুখানি অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিয়েছি। এবার কলকাতা ফিরে দৈনিক সত্যসেবকে মফস্বলের বাসযাত্রীদের কথা লিখবে, আশা করি।
এইসব কথাবার্তার মধ্যে বুঝতে পারলুম, কর্নেল রামশংকরপুরে প্রণবশংকরের বাড়ি থেকে, ফোন করে আসার কথা জানিয়েছেন। আলাপ-পরিচয় এবং কফি খাওয়ার পর উমাশংকরবাবুর হত্যাকাণ্ডের কথা উঠল। রাজাবাহাদুর গম্ভীরমুখে বললেন,–ঘটনাটা ভারি অদ্ভুত। উমাশংকর একটু তেজি স্বভাবের ছিল বটে; কিন্তু ওকে কেউ খুন করবে ভাবাও যায় না। তাছাড়া তিন মাস গা-ঢাকা দিয়েই বা কেন রইল, আমার কাছে সবটাই একটা রহস্য। তাই গত রাতে প্রণবদা ফোনে ঘটনাটা যখনই আমাকে জানালেন, আমার মনে হল, আপনার শরণাপন্ন হওয়া উচিত। পুলিশ এ-ব্যাপারে কতদূর কী করবে ভরসা হয় না। তো, আমি নিজেও বহুবার আপনার লাইন পাওয়ার চেষ্টা করলুম। এখানকার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ওয়ার্থলেস। কলকাতা ধরতেই পারল না। তখন প্রণবদাকে ফের ফোন করে বললুম, আপনি দেখুন চেষ্টা করে। নাম্বার দিচ্ছি।
কর্নেল বললেন,–হরিসাধনবাবুর খবর কী?
হরিসাধন?-–রাজাবাহাদুর বাঁকামুখে বললেন, বইটা চুরি করে ব্যাটাচ্ছেলে আর এ বাড়ি ঢোকেনি। বুঝে গেছে, এবার ত্রিসীমানায় দেখলেই মাথাটি ন্যাড়া করে দেব।
-–আচ্ছা, একটা কথা রাজাবাহাদুর! রাম শর্মার আত্মচরিত প্রণবশংকরের কাছে আপনি উপহার পান গত আগস্ট মাসে। আপনার লাইব্রেরিতে রাখার পর আর কাউকে কি পড়তে দিয়েছিলেন।
রাজাবাহাদুর মাথা নেড়ে বললেন,–না। লাইব্রেরিতে বইটা রেখেছিলুম দুষ্প্রাপ্য বইয়ের শেলফে। আপনি বাদে কাউকে পড়তে দিইনি। বইটার কথা আর কেউ জানে বলেও মনে হয় না। নইলে যাঁরা উনিশ শতক নিয়ে রিসার্চ করেন, তারা নিশ্চয়ই খোঁজখবর করতেন। তাছাড়া আমি তো বিস্তর বইটই পড়ি। কোথাও এ বইয়ের কোনো উল্লেখ পর্যন্ত পাইনি। এর একটাই কারণ থাকতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের কোপে পড়ে যাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছে, তার ভাই শ্যামশংকর সাহস করে বইটা ছাপলেও বোধ করি এক কপিও কেউ সাহস করে কেনেননি। জগমোহন বোসের মতো লোক, যে এ ধরনের দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজখবর রাখে, সে পর্যন্ত বইটার নাম শোনেনি। কিন্তু হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন বলুন তো কর্নেল?
কর্নেল একটু হাসলেন। উমাশংকর খুন হওয়ার সঙ্গে বইটার যোগাযোগ রয়েছে।
–সে কী!
–উমাশংকর বইটা নিয়ে বহুদিন ধরে মাথা ঘামাচ্ছিলেন।
–বলেন কী! কেন?
–অক্টোবরে এসে বইটা পড়ার পর আপনার সঙ্গে পবিত্র ঐতিহাসিক পেরেক ‘স্যাটর’ নিয়ে আলোচনা করেছিলুম, মনে আছে তো?
–হ্যাঁ–হ্যাঁ খুব মনে আছে। বলেছিলেন, পেরেকটা সম্পর্কে রামশংকর কেন হঠাৎ চুপ করে গেলেন!
–প্রণবশংকর হঠাৎ আপনাকে বইটা উপহার দেওয়ায় উমাশংকর ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কারণ, উনি পেরেকটার হদিস বই থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরে যেভাবেই হোক, ওঁর মাথায় ঢুকেছিল, রামশংকর ত্রিনিদাদে ত্রাবাংকা নামে একটা জায়গায় যে বাড়ি করেছিলেন, সেই বাড়িতেই কোথাও ওটা লুকানো আছে। তাই উনি ত্রিনিদাদে পাড়ি দেন। দাদাকে বলেননি। কারণ, দাদা তাকে কিছুতেই যেতে দিতেন না।
–কিন্তু ত্রিনিদাদে গিয়েও তো জানাতে পারত। এদিকে সবাই ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
–প্রণবশংকরকে তো জানেন। আমার ধারণা হয়েছে, ভদ্রলোক কোনো ব্যাপারে গোপনীয়তা কাকে বলে জানেন না। খুব ভোলা মনের মানুষ। পাঁচকান করবেন বলেই হয়তো জানাননি উমাশংকর।
–ঠিক বলেছেন। প্রণবদার পেটে কথা থাকে না।
–উমাশংকর ত্রিনিদাদে যাওয়ার পর ওঁর পাসপোর্ট আর টাকাকড়ি চুরি গিয়ে বিপদে পড়েন। সেই সময় রোডরিগ নামে গোঁয়ার এক বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। অনুমান করা যায়,
রোডরিগকে তিনি হতাশা ও ব্যর্থতার চাপে তার ত্রিনিদাদে আসার উদ্দেশ্য খুলে বলেছিলেন। পেরেকটার দাম কোটি-কোটি ডলার এখন! এটা কোন্ বড়লোক না সংগ্রহশালায় রাখতে চাইবে। বহু দেশের সরকারও চাইবেন, এটা তাদের জাদুঘরে থাক। ভ্যাটিকানে রাখার জন্যও খ্রিস্টীয় ধর্মগুরুরা এই পবিত্র জিনিসটি দাবি করবেন।
রাজাবাহাদুর সায় দিয়ে বললেন,–হা–আপনি সেবারও এসব কথা বলেছিলেন।
–রোডরিগের সাহায্যে উমাশংকর রাম শর্মার বাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। বিস্তারিত কিছু জানি না। তবে বোঝা যায়, কী ঘটেছিল। পেরেক আবিষ্কার করতে না পেরে রোডরিগের সঙ্গে উমাশংকর ফিরে আসেন। তারপর আমরা কিছু ঘটনা ঘটতে দেখেছি। রোডরিগ বোম্বে এসেই কলকাতার ব্যবসায়ী রামদয়াল সিঙ্গিকে বইটা জোগাড় করতে বলে। তার বদলে সিঙ্গিমশাইকে দু’লক্ষ টাকার অর্ডার পাইয়ে দেবার লোভ দেখায়। যেভাবেই হোক, সেটা জানতে পেরে উমাশংকর সতর্ক হয়ে যান। কলকাতায় ছুটে আসেন। ঘটনাচক্রে সেই দিনই সিঙ্গিমশাই বইটা জোগাড় করেছেন জগমোহনের কাছে।
–ঠিক, ঠিক। ব্যাটাচ্ছেলে হরিসাধনকে দিয়েই জগমোহন এ-কর্মটি করেছিল–এখন বুঝতে পারছি।
–উমাশংকর জনৈক মৈত্র নাম নিয়ে রোডরিগের ব্যবসার প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিয়ে সিঙ্গিমশায়ের অফিসে রাত কাটান এবং বইটা পেয়ে যান। তারপর মুখোশ পরে জগমোহনের দোকানে ঢুকে টয়পিস্তল দেখিয়ে তাকে শাসিয়ে যান, যেন এ বইয়ের বেচাকেনা আর না করে। সেই বই নিয়ে সন্ধ্যার পর চুপি-চুপি পেছনের ফটক দিয়ে উনি বাড়ি ঢুকছিলেন। কেউ ওত পেতে ছিল। তার মাথায় বাড়ি মেরে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
–নিশ্চয়ই রোডরিগের লোক?
কর্নেল মাথা নাড়লেন,–বোঝা যাচ্ছে না। চুপিচুপি বাড়ি ঢোকার কারণ–উমাশংকর সম্ভবত দাদার বকুনি খাওয়ার ভয়ে সরাসরি প্রথমেই দাদার মুখোমুখি হতে চাননি। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বয়স হলেও উমাশংকর একটু খেয়ালি ছিলেন। ছেলেমানুষি করতেন বিস্তর। কুমুদিনী দেবীর কাছে এসব কথা শুনলুম।
–তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু রোডরিগ ছাড়া আর কার পেরেক নিয়ে মাথাব্যথা থাকা সম্ভব! সে জানবেই বা কী করে যে ছোটকু ওই সময় পেছনের ফটক দিয়ে বাড়ি ঢুকবে?
কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন,–একজ্যাক্টলি! এটাই হল আদত প্রশ্ন। সেইজন্যে আমি গোপনে আপনার কাছে জানতে এসেছি, রামশংকরপুরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন কেউ কি আপনার কাছে বইটার খোঁজে এসেছিল?
কেউ আসেনি। রাজাবাহাদুর চিন্তিত মুখে বললেন।
–একটু স্মরণ করে দেখুন তো!
কিছুক্ষণ চুপচাপ চিন্তা করার পর রাজাবাহাদুর বললেন,–নাঃ! মনে পড়ছে না তেমন কিছু।
–বইটা আপনি আবার ছেপে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন?
রাজাবাহাদুর বললেন, হ্যাঁ। মার্চ নাগাদ বের করব ভেবে রেখেছিলুম। আপনাকে তো বলেওছিলুম সে কথা। এ মাসেই কলকাতা গিয়ে ভালো একটা প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করতুম। এই তো কিছুদিন আগে প্রণবদা ফোন করে জানতে চাইলেন, কবে বইটা ছাপছি।…
কর্নেল নড়ে বসলেন। ওঁর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল,–প্রণবশংকর জানতে চাইছিলেন?
–হ্যাঁ।
–কেন হঠাৎ একথা জানতে চাইলেন প্রণবশংকর? উনি তো বইটই নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মানুষ নন। সব ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকেন।
রাজাবাহাদুর হাসলেন। হ্যাঁ–আমি ওঁকে ঠাট্টা করে বললুম, এতকাল ধরে বইটা যে নষ্ট হচ্ছিল, আপনাদেরই ছাপানো উচিত ছিল। পূর্বপুরুষের লেখা বই। দৈবাৎ আমার চোখে না পড়লে তো নষ্ট হয়েই যেত।… প্রণবদা বললেন, ঠিকই বলেছ। তখন বইটার মূল্য বুঝিনি।
–প্রণবশংকর তাই বললেন?
রাজাবাহাদুর কর্নেলের উত্তেজনা লক্ষ করে অবাক হলেন। আপনি কি প্রণবদাকে…
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, না, না। তা নয়। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। তবে এই কথাটাই জানতে চেয়েছিলুম অবশ্য। যাই হোক, রাজাবাহাদুর, আমি এখনই রামশংকরপুরে ফিরতে চাই। এবার কিন্তু আপনার জিপগাড়িটা চাইছি।
–অবশ্য, অবশ্য। এক মিনিট, আমি রমেনকে বলে দিচ্ছি। আপনাদের একবারে প্রণবদার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। গঙ্গায় জিপ পার করার নৌকা আছে। অসুবিধে হবে না।
ফেরার পথে কর্নেলকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করিনি। জিপে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছুতে মিনিট কুড়িরও কম লাগল। নৌকোয় জিপসুদ্ধ পেরুতে মোটে মিনিট-দশেক। যন্ত্রচালিত নৌকোয় গাড়ি পার করার ব্যবস্থা আছে।
বাঁড়ুজ্জেবাড়ির ফটকে আমাদের নামিয়ে দিয়ে রাজাবাহাদুরের জিপগাড়ি চলে গেল। সাতটা বেজে গেছে। বাড়িটা একেবারে নিশুতি নিঝুম হয়ে রয়েছে। জ্যোৎস্না ও কুয়াশায় চারদিকে কেমন ঝিমন্ত দশা।
প্রণবশংকর দাঁড়িয়েছিলেন বসার ঘরের বারান্দায়। বললেন,–ফিরে এলেন ভৈরবগড় থেকে? দেখা হল রাজাবাহাদুরের সঙ্গে?
কর্নেল বললেন,–হা। উমাশংকরবাবুর বডি ফেরত আসেনি মর্গ থেকে?
–চারটেয় এল। সব রেডি ছিল। দাহ হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। এই মিনিট-কুড়ি হল শ্মশান থেকে ফিরছি।
কথা বলতে-বলতে আমরা দক্ষিণের সেই ঘরে গেলুম–যে ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। একটু পরে গঙ্গাধর চা দিয়ে গেল। একথা-ওকথার পর কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন,–আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জি, কিছুদিন আগে আপনি রাজাবাহাদুরকে ফোনে রাম শর্মার আত্মচরিত ছাপানোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন?
প্রণবশংকর হঠাৎ এ-কথায় হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,–হ্যাঁ-হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেছিলুম। কে বলুন তো? জিজ্ঞেস করা কি ভুল হয়েছে?
না, না। ভুল নয়।–কর্নেল হাসলেন, আমার জানবার উদ্দেশ্য, হঠাৎ কেন আপনি কথাটা জানতে চাইলেন রাজাবাহাদুরের কাছে?
প্রণবশংকর বিব্রতভাবে বললেন,–দেখুন, ও-সব বই-টইয়ের আমি কিছু বুঝিও না। ইন্টারেস্টও নেই। কোনো ব্যাপারেই নেই। ওই পরিতোষ একদিন বলল যে, বইটা আমাদেরই বের করা উচিত ছিল। আফটার অল, এ-বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং আমাদের পূর্বপুরুষ। রাজাবাহাদুর সত্যি-সত্যি ছাপবেন কি না কে জানে! তাই শুনে আমি বললুম, দেখছি খোঁজ নিয়ে।
–পরিতোষবাবুকে একবার ডাকবেন?
প্রণবশংকর ব্যস্ত হয়ে বললেন,–ওকে আপনার সঙ্গে দেখা করার কথা বলেছি। কিন্তু এত ধকলে বেচারার জ্বর এসে গেছে। শ্মশান থেকে ফিরেই শুয়ে পড়েছে লেপমুড়ি দিয়ে। চলুন বরং, ওর ঘরেই যাওয়া যাক।
আমরা বাড়ির দক্ষিণ ও পূর্বদিক ঘুরে উত্তর-পূর্ব কোণের একটা ঘরের সামনে পৌঁছলুম। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে। প্রণবশংকর ডাকলেন,–নুটু! ও নুটু! তারপর দরজায় টোকা দিলেন। সাড়া না পেয়ে দরজা ঠেললেন এবার। দরজাটা ভেজানো ছিল। খুলে গেল।
বিছানায় আপাদমস্তক লেপ মুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে। প্রণবশংকর আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন,–সর্বনাশ! জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি? নুটু, ও নুটু! বলে তিনি মাথার দিকের লেপ খানিকটা সরালেন।
কিন্তু সেখানে বালিশের ওপর পরিতোষবাবুর মাথার বদলে একটা লম্বা পাশবালিশের একটু অংশ দেখা গেল। প্রণবশংকর চমকে উঠেছিলেন। কর্নেল এক টানে লেপটা সরিয়ে দিতেই দেখলুম, বিছানায় পাশবালিশটা মানুষের মতো লম্বালম্বি শোয়ানো রয়েছে। প্রণবশংকর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন,–এর অর্থ?
কর্নেল বললেন,–পরিষ্কার। পরিতোষবাবু গতিক বুঝে গা ঢাকা দিয়েছেন।
অসম্ভব! এ হতেই পারে না। বলে প্রণবশংকর খাপ্পা হয়ে বেরুলেন। বাইরে তার হাঁকডাক শোনা গেল। গঙ্গাধরকে ডাকাডাকি করছেন। বলছেন,–দ্যাখ তো গঙ্গু, নুটু কোথায় গেল?
আমি প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকালুম। উনি ঘরের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখছেন। বালিশ তোশক উলটে টেবিলের কাছে গেলেন। ড্রয়ার টেনে দেখলেন, খোলা। ভেতরে কী সব হাতড়ালেন। তারপর টেবিলের ওপাশে বইয়ের র্যাকের কাছে গেলেন। পকেট থেকে টর্চ বেরুল এবার। বললেন,–মাই গুডনেস! এ-সব কী! দেখছ জয়ন্ত, কী কাণ্ড?
বুঝতে না পেরে বললুম,–না তো। কিচ্ছু ঢুকছে না মাথায়।
–জয়ন্ত, এই বইগুলো দেখতে পাচ্ছ না? মোরহেডের লেখা ‘মিশরীয় চিত্রলিপির রহস্য।’লর্ড কারনারভনের লেখা ‘মমিপ্রথার ইতিহাস। আর এই দেখো, ‘মিশরে রোমানযুগের ইতিহাস। এটা হল বিখ্যাত বই–যিশুখ্রিস্ট এবং হারানো পাঁচটি পেরেক। পরিতোষের ভারি অদ্ভুত ব্যাপার!
বলে গোয়েন্দাপ্রবর টেবিলের তলা থেকে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট টেনে বের করলেন। তারপর দলাপাকানো কাগজ, অ্যাশট্রে থেকে ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো, এইসব আবর্জনা ঘাঁটতে শুরু করলেন।
একটু পরে দেখি, কয়েকটা দলাপাকানো কাগজ টেনে সমান করে ফেললেন এবং পকেটে ভরতে দেরি করলেন না। তারপর কাগজকুচি কুড়িয়ে মেঝেয় ফেলে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলেন। প্রণবশংকর হন্তদন্ত এসে বললেন,–পরিতোষের এ-আচরণের মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। কেন সে এমন অদ্ভুত কাজ করল?
সে কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–মিঃ ব্যানার্জি, গতকাল সকালে কিংবা আগের রাত্রে কলকাতা থেকে কোনো ট্রাংককল এসেছিল কি?
-এসেছিল। তখন সবে আমি ঘুম থেকে উঠেছি। গঙ্গু বলছিল, নুটুবাবুর কল এসেছে কলকাতা থেকে।
-কী কথাবার্তা হচ্ছিল শোনেননি? গঙ্গাধর দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। বলল,–নুটুবাবু কাউকে বারবার বলছিল, বড়বাবু রেগে আছেন। লুকিয়ে সন্ধ্যার পর এসো। আর বলছিল, চোরের ওপর বাটপাড়ি? খুব হাসছিল। ওই দুটো কথা মনে আছে স্যার।
কর্নেল বললেন,–উমাশংকরের দ্বিতীয় ভুল এটা।…
.
পাঁচ
আমাদের আস্তানায় ফিরে কর্নেল টেবিলের ওপর কাগজগুলো বিছিয়ে বললেন,–এবার দেখো, জয়ন্ত! অবাক হবে। দেখে সত্যি অবাক হলুম। কর্নেলের কাছে যে শব্দবর্গ দেখেছিলুম, একটা কাগজে সেটা লেখা রয়েছে।
SATOR
AREPO
TENET
OPERA
ROTAS
পরের কাগজগুলোতে লেখা আছে :
কাক, কোকিল, কাঠঠোকরা, কাকাতুয়া, কাদাখোঁচা…
AEORPST SATPORE-সাতপুর…
রমাকান্ত কামার/সুবল বসু/রায়মণি ময়রা/সদা দাস…
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–এই বাংলা নামগুলো সম্ভবত নিছক খেলা। ডাইনে-বাঁয়ে যেদিকে থেকে পড়বে, নামগুলো একই থাকে। খেলা বলার কারণ, ওর তলায় লেখা আছে : কনক/জলজ/নতুন/নন্দন/কণ্টক, চামচা/মলম… খুব জটিল ধাঁধা নিয়ে মাথা ঘামানোর পর এই একটু রিলিফ আর কি!
প্রণবশংকর ওঁর মুখের দিকে ব্যাকুল চোখে তাকিয়েছিলেন। বললেন,–কর্নেল! দোহাই আপনার! দয়া করে বলুন, পরিতোষই কি ছোটকুকে খুন করেছে?
কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ। পরিতোষের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বই হাতানো। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী খতম।
তাহলে কথাটা পুলিশকে এখনই জানানো দরকার। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলুম–সেই সাপের বিষদাঁত ভাঙা দরকার।
প্রণবশংকর রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন। কর্নেল তাকে শান্ত করতে বললেন,–প্লিজ, আর-একটু ধৈর্য ধরুন। এখনও মোক্ষম প্রমাণ আমরা উদ্ধার করতে পারিনি।
–কী সেটা?
–মার্ডার উইপন–যা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।
–সে কি কেউ রাখে? ওই তো পা বাড়ালেই গঙ্গা। ফেলে দিয়েছে। ফেলে দিলেই বরং ধরা পড়ার চান্স ছিল। কারণ গোবিন্দ-মালি…এক মিনিট। আসছি। বলে কর্নেল হঠাৎ হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।
প্রণবশংকর অবাক হয়ে বললেন,–কোথায় গেলেন অমন করে, বলুন তো জয়ন্তবাবু?
–মনে হচ্ছে, গোবিন্দ মালির কাছে।
প্রণবশংকর গুম হয়ে একটুখানি দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে-আস্তে বেরিয়ে গেলেন।
ক্রমশ শীত বাড়ছিল। মফস্বলে এত বেশি শীত আন্দাজ করতে পারিনি। যেমন-তেমন একটা জ্যাকেট চড়িয়ে এসেছিলুম। বিছানা থেকে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে আরামকেদারায় বসতে যাচ্ছি। আলো নিভে গেল। নিশ্চয়ই লোডশেডিং। বাড়ির ওপরতলায় প্রণবশংকরের ডাকাডাকি শুনলুম। গঙ্গাধরকে হ্যারিকেন জ্বালতে বলছেন।
বাইরে জ্যোৎস্নায় কুয়াশা জমেছে। প্রাঙ্গণ এবং গাছগাছালির দিকে তাকিয়ে গা ছমছম করছিল। মিনিট-পাঁচেক হয়ে গেল, তবু গঙ্গাধর আলো দিয়ে গেল না। ভাবলুম, ওকে ডেকে অন্তত একটা মোমবাতি দিতে বলি। দরজায় গিয়ে ‘গঙ্গাধর’ বলে ডেকেছি, সেইসময় আবছা একটা শব্দ হল ঘরের ভেতর। ভেতরের দিকের দরজাটাও খোলা রয়েছে। ঘুরে দেখি, আবছা একটা মূর্তি কী যেন করছে–খসখস শব্দ হচ্ছে। বাইরের ময়লা জ্যোৎস্না এদিকের দরজা দিয়ে যেটুকু ছটা পাঠাতে পেরেছে, তা অন্ধকারেরই মতো। বললুম,–কে? কে ওখানে?
অমনি হিসহিস করে কে গলার ভেতর বলে উঠল,–চুপ। খতম করে ফেলব।
কেন যে ছাই টর্চটা বের করে রাখিনি অ্যাটাচি থেকে! তবে আমিও দমবার পাত্র নই।’গঙ্গাধর! গঙ্গাধর! চোর! চোর!’বলে যেই চিৎকার ছেড়েছি, চোর হতচ্ছাড়া আমাকে এক ধাক্কায় কুপোকাত করে বেরিয়ে গেল। কম্বলজড়ানো অবস্থায় মেঝেয় পড়ে আমার দশা হল ফাঁদে পড়া শেয়ালের মতো। কম্বল থেকে বেরিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালুম, তখন গঙ্গাধরের সাড়া এল। সে হ্যারিকেন নিয়ে দৌড়ে আসছিল।
গঙ্গাধর হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল,–কী হয়েছে স্যার? চোর ঢুকেছিল?
গম্ভীরভাবে ‘‘ বলে টেবিলের দিকে তাকালুম। সেই কাগজগুলো নেই। বুঝলুম, আড়াল থেকে চোর নজরে রেখেছিল তাহলে। কিন্তু ওগুলো নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী? প্রমাণ লোপ করার চেষ্টা? তাছাড়া আর কী হতে পারে?
গঙ্গাধর গোমড়ামুখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। বলল,–ওদিকে আরেক কাণ্ড। সেজন্যে আলো আনতে দেরি হল। নুটুবাবুর ঘরেও চোর ঢুকেছিল।
–বলো কী! কিছু চুরি গেছে নাকি?
–বইয়ের র্যাক খালি করে বইগুলো নিয়ে গেছে।
–হুঁ, প্রমাণ লোপের চেষ্টা।
গঙ্গাধর বুঝতে না পেরে বলল,–আজ্ঞে?
–কিছু না। তুমি আর-একবার কড়া করে চা খাওয়াতে পারো গঙ্গাধর?
আনছি স্যার।–বলে সে চলে গেল।
এবার চোর পালিয়ে বুদ্ধি বেড়েছে আমার। টর্চ আর খুদে ২২ ক্যালিবারের রিভলভারটা বের করে ফেললুম। কতক্ষণ পরে গঙ্গাধর চা দিয়ে গেল। বলে গেল,–বড়বাবুর শরীর খারাপ করেছে। উনি শুয়ে রয়েছেন। বললেন, ওনারা যেন কিছু না মনে করেন।…
ঘণ্টা-দুই পরে কর্নেল ফিরে এলেন। হাসতে-হাসতে বললেন,–-গঙ্গাধরের মুখে সব শুনলুম। আশা করি, বহাল তবিয়তে আছ ডার্লিং!
–আছি। কিন্তু চোর সেই কাগজগুলো নিয়ে পালিয়েছে। ওদিকে পরিতোষবাবুর ঘর থেকে…
হাত তুলে গোয়েন্দামশাই বললেন, শুনলুম। তাতে কী?–বলে বসলেন এবং আস্তেসুস্থে চুরুট ধরালেন।
জিজ্ঞেস করলুম,–কোথায় গিয়েছিলেন?
কর্নেল হেলান দিয়ে বসে বললেন, আমার বাহাত্তুরে ধরতে যে বেশি বাকি নেই, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে টের পেয়ে যাই। এ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো লোক গোবিন্দ দাস। না ডার্লিং, পদাবলি রচয়িতা সেই কবি নন, ইনি মালি। আমার দোসর বলতে পারো। কারণ ক্যাকটাস চেনে। অর্কিড চেনে। এ বাড়ির সব পুরোনো গাছের গুঁড়ির ওপর এবং বিভিন্ন ডালে আশ্চর্য সুন্দর এক জাতের অর্কিড আছে। গোড়ার দিকটা লাল, ডগা নীল। এই শীতে তারা ফুল ফোঁটায়। সাদা থোকা-থোকা ফুল। গোবিন্দ বলল, রাম শন্না কোন্ মুলুক থেকে এনেছিলেন। পাঁচ পুরুষ ধরে তারা এ-গাছ। সে-গাছে জন্মাচ্ছে। মরছে, আবার জন্মাচ্ছে।
–সেই অর্কিডের গল্প শুনছিলেন গোবিন্দের কাছে?
–হ্যাঁ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গোবিন্দ এ-বাড়িতে অপ্রয়োজনীয় সেকেলে আসবাবের মতো। দয়া করে তাকে এখনও আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হয়নি। তার খুরপিতে মরচে ধরে ভেঙে গেলে তাকে আর নতুন খুরপি এনে দেওয়া হয় না। বড়বাবু তো থেকেও নেই। ম্যানেজারবাবুর যত ঝোঁক চাষবাসে। এমনকি, ওই ক্ষয়াটে ফুলফলের বাগানে নাকি আলু ফলাবেন বলে শাসিয়েছেন।
-ম্যানেজার কে?
নটুবাবু–মানে, পরিতোষ।–কর্নেল চোখ বুজে চুরুটে মৃদু টান দিয়ে বললেন, বেচারা গগাবিন্দের ছোট শাবলটা আজ সকাল থেকে উধাও। গোরুছাগলের অত্যাচারে অস্থির। সে একটা বেড়া দেবে ভাবছিল। কিন্তু গর্ত খোঁড়ার শাবলটাও কে চুরি করে নিয়ে যায়। কখন চুরি গিয়েছিল সে জানে না। গতকাল বিকেলেও দেখেছিল।
-কর্নেল! আপনি কি…
প্রাজ্ঞ গোয়েন্দা বললেন,–আনন্দের কথা, শাবলের জন্য বড়বাবুর কাছে নালিশের আগেই সেটা সে যথাস্থানে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হয়েছে। হা ডার্লিং, ওটা আর ফিরে না এলে গোবিন্দ বড়বাবুকে নালিশ করত। শাবলটা হঠাৎ ওভাবে নিপাত্তা হওয়া নিয়ে জল্পনাকল্পনা হত–বিশেষ করে উমাশংকরের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে।
কর্নেল ফুঁ দিয়ে চুরুটের ধোঁয়া সরিয়ে ফের বললেন, কিন্তু শাবলটা যথাস্থানে ফিরে পেয়ে গোবিন্দ খুশি। তার আর নালিশ জানাবার কারণ রইল না। হ্যাঁ-পরিতোষ তাই শাবলটা গঙ্গায় ফেলে দেয়নি। জানত, গোবিন্দ ও-নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ নয়। বরং আর ফিরে না পেলেই মাথা ঘামাত। অন্যদের বলত।
–শাবলটা দেখলেন?
মাথা দুলিয়ে কর্নেল বললেন,–নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে শাবলটার কথা আমাকে বলল গোবিন্দ। নইলে ওটা তার কাছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়–অন্তত হারানিধি ফিরে পাওয়ার পর। এখন কথা হচ্ছে, লোহার শাবল দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করলে শাবলে রক্ত লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে। রক্ত ছিটকে বেরোতে যত কম হোক, একটু সময় লাগে। ভোতা জিনিস দিয়ে চুলের ওপর আঘাত। ধরো, রক্ত ছিটকে বেরোতে অন্তত তিন-চার সেকেন্ড দেরি হবে। তার মধ্যে জিনিসটা সরে এসেছে। কাজেই রক্ত নাও লাগতে পারে। কিংবা যদি লাগে, অনেকসময় খালি চোখে তা দেখা নাও যেতে পারে। এক্ষেত্রে ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। গোবিন্দের শাবলের ওপর এই জোরালো টর্চের আলো ফেলে আতশ কাঁচ দিয়ে দেখলুম, রক্তের সূক্ষ্ম ছিটে লেগে রয়েছে।
বলে কর্নেল তার ওভারকোটের ভেতর থেকে কাগজে মোড়া ফুটদেড়েক লম্বা একটা জিনিস বের করে টেবিলে রাখলেন। তারপর বের করলেন একটা বই। চামড়ায় বাঁধানো হলেও সেটার অবস্থা জরাজীর্ণ। অবাক হয়ে বললুম,–ওটা কী? কোথায় পেলেন ওটা?
–তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নে বোঝা যাচ্ছে, তুমি এটা কী বই বুঝতে পেরেছ। ডার্লিং, এই সেই হারানো বই–রামশংকর শর্মার আত্মচরিত।
-কোথায় পেলেন আগে বলুন?
কর্নেল নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললেন,–গোবিন্দ অর্কিড চেনে। রাম শর্মার আনা অর্কিডের বংশধরদের ওপর তার খুব লক্ষ। ফুল ফুটলে তো কথাই নেই, সে আনন্দে নেচে ওঠে। অর্কিডের কথায় খুশি হয়ে বলল, কোণের শিরীষ গাছটার গুঁড়ির ওপর যে অর্কিডগুলো আছে, ওবেলা তাতে ফুল ফুটেছে। দেখবেন নাকি হুজুর? আমি কেন, সাহেবি-পোশাকপরা সবাই ওর কাছে হুজুর। তো আমার টর্চ খুব জোরালো। ফুল দেখতে-দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল, অর্কিডের ঝালরের ভেতর কী যেন রয়েছে। পাখির বাসা? গোবিন্দকে বললুম, মই আছে কি? গোবিন্দ বলল, আনছি হুজুর।
বাধা দিয়ে বললুম,–অর্কিডের ভেতর বইটা লুকনো ছিল তাহলে?
ধুরন্ধর বৃদ্ধ কোনো জবাব দিলেন না। বইটা টেনে নিলুম হাত থেকে। চোখ বুজে চুরুটে টান দিয়ে বললেন, আগে পরিশিষ্টটা পড়ো, শুনি।
পড়তে শুরু করলুম। জায়গায়-জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। সবটা পড়া যায় না।
…ভবিষ্যৎ বংশধরদিগের প্রতি উপদেশদান নিমিত্ত কহি যে, সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করিবেক। বিশেষত কহি যে যিশুখ্রিস্টও ঈশ্বরের অবতার বলিয়া অস্মদেশে স্বীকৃত হইয়াছেন। তাঁহার শোণিতে মনুষ্যজাতির পাপ ধৌত হইয়াছে। অপিচ যে ২ জড়বস্তুসমুদয় তাহার শোণিতপ্রাপ্ত হইয়াছে, উহারা জড়ত্বনাশ হেতু ধন্য হইয়াছে।… উদ্যানে পক্ষীসকল বিচরণ করে। উহারা পঞ্চ প্রকার পঞ্চরূপের প্রতীক। সেই পঞ্চরূপ হইল পঞ্চবাণ। খ্রিস্টের শোণিতপ্রাপ্ত পঞ্চবাণ.. উদ্যানের শোভাস্বরূপিণী অপ্সরার রক্ষণাবেক্ষণ নিমিত্ত কহি যে উহার অনিন্দ্যসুন্দর আননে আত্মবলিদানের স্পর্শগুণ বিধায় উহা ধন্য। বহু প্রযত্নে উহাকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।…
কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। বইটা আমার হাত থেকে নিয়ে পরিশিষ্ট পড়তে শুরু করলেন। তারপর বললেন,–জয়ন্ত, সম্ভবত এখানেই রাম শর্মা কী যেন আভাস দিয়েছেন।… অপ্সরামূর্তি–মানে নিশ্চয় ফোয়ারার মাথায় ওই মূর্তিটা। পাঁচকোণা ফোয়ারা।… রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ বংশধরদের।… উহার অনিন্দ্যসুন্দর আননে আত্মবলিদানের স্পর্শগুণ… জয়ন্ত! একথায় কি যিশুর ক্রুশে আত্মবলিদান বোঝাচ্ছে না?… কিন্তু কথাটা লক্ষ করো। আননে। তার মানে মুখে। মুখে মানে মাথার ভেতর…!
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন উত্তেজিতভাবে। আমারও মাথার ভেতর একটা সাড়া জাগল। বললাম,–কিন্তু ফোয়ারার ওই অপ্সরার মাথাই তো নেই। কবে ঝড়ের সময় গুঁড়ো হয়ে গেছে। প্রণবশংকর বলছিলেন না?
কিন্তু তাহলে পেরেকটা নিশ্চয় কেউ পেয়েছিল। দেখেও কিছু টের পায়নি। কর্নেল অস্থির হয়ে বললেন। একটা মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিস!
বাইরে জুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তারপর টর্চের আলো দেখলুম। কেউ ভারী গলায় বলল,–কোন ঘরে?
গঙ্গাধরের কথা শোনা গেল,–ওই যে স্যার, হ্যারিকেন জ্বলছে।
কর্নেল দরজায় উঁকি মেরে বললেন,–মিঃ সান্যাল নাকি? চলে আসুন।
হ্যাল্লো ওল্ড ডাভ! একজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকে কর্নেলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। আরও চারজন পুলিশ অফিসার তার পেছন-পেছন ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝলুম গত দু-ঘণ্টা ধরে গোয়েন্দাপ্রবর শুধু গোবিন্দের সঙ্গে আড্ডা দেননি, এঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন।
কর্নেল বললেন,–মিঃ সান্যাল, আলাপ করিয়ে দিই। আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। আর জয়ন্ত, ইনি পুলিশ সুপার মিঃ অজিতেশ সান্যাল।
অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের পর কাজের কথা শুরু হল। থানা অফিসার ইন্দ্রজিৎ ভদ্র বললেন,–পরিতোষকে মাঠে মিঃ ব্যানার্জির ফার্মে পাওয়া গেছে। কর্নেল, আপনার অনুমান কাঁটায়-কাঁটায় মিলে গেছে। এইমাত্র ওকে পাকড়াও করে সোজা আসছি। আসামি এতক্ষণ থানার লক-আপে।
কর্নেল বললেন,–এই নিন মার্ডার উইপন। ফরেনসিকে পাঠাতে হবে। ওতে রক্ত আর খুনির হাতের ছাপ আছে। পাকা সাক্ষী গোবিন্দ-মালিও।
কাগজের মোড়কে ভরা শাবলটা একজন অফিসার সাবধানে নিয়ে গেলেন। এতক্ষণে প্রণবশংকর নেমে এলেন। হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–রাস্কেল খুনিটা ধরা পড়েছে? ধরা পড়েছে কালসাপটা?
মিঃ সান্যাল হাসতে-হাসতে বললেন,–কিছুক্ষণ আগে। আপনার ফার্ম হাউসে গিয়ে রাত কাটাবে ভাবছিল। আগে থেকে ওত পেতে ছিল আমাদের লোকজন। ভাববেন না, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোন গিয়ে।
প্রণবশংকর বসলেন। বললেন,–চায়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। আপনারা একটু বসুন দয়া করে।
কর্নেল বললেন,–এই দিকটা আমি এখানে আসার পরও ভাবিনি। বোম্বের রোডরিগেরই লোক এখানে আছে ভেবেছিলুম। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলুম না, বোম্বে থেকে ওর পক্ষে এত দ্রুত এখানে যোগাযোগ–তাছাড়া বইটা চুরির খবর পাওয়া, সবই কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছিল। বিকেলে ভৈরবগড় গিয়ে রাজাবাহাদুরের কাছে যখন জানতে পারলুম, মিঃ ব্যানার্জি বইটা ছাপার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছেন, তখনই টের পেলুম মিঃ ব্যানার্জির পেছনে থেকে কেউ তাগিদ দিচ্ছে। বহু ভাবনা-চিন্তার পর বইটা এবার তার খুব দরকার হয়েছে। যাই হোক, পরিতোষ মরিয়া হয়ে প্রমাণ লোপের চেষ্টা করছিল লোডশেডিংয়ের সুযোগে। বইটাও শিরীষ গাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু আমি সেখানে থাকায় পারেনি। ভেবেছিল পরে একসময় এসে নিয়ে যাবে। এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করি মিঃ ব্যানার্জিকে।
প্রণবশংকর বললেন,–বলুন কর্নেল।
–ফোয়ারার অপ্সরার মাথা ১৯৪২ সালের ঝড়ে ভেঙে গিয়েছিল। তখন আপনার বয়স কত?
–তা চব্বিশ-পঁচিশ হবে।
–তাহলে তো আপনার মনে থাকা উচিত। অপ্সরার মাথা ভেঙে যাওয়ার পর কোনো পেরেক জাতীয় কিছু দেখেছিলেন ওর ভেতর?
–হ্যাঁ–হ্যাঁ। গলার ভেতর লোহার শূল মতো বসানো ছিল-মুণ্ডটা জোড়া দেওয়ার জন্য। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন,–না মিঃ ব্যানার্জি, ওটাই সেই পবিত্র ঐতিহাসিক পেরেক।
বলেন কি!–প্রণবশংকর অবাক হয়ে বললেন। তাই বুঝি ওটার গায়ে খুদে হরফে কীসব লেখা ছিল যেন।
-সেটা তারপর কী হল মনে আছে?
গঙ্গাধর দরজার কাছ থেকে বলল,–কেন বড়বাবু, সেটা গোবিন্দের বউ উপড়ে এনেছিল না? ছাগল বাঁধার খুঁটি করেছিল। গোঁজের মতো জিনিসটা। পায়ে নকশাকাটা ছিল।
কর্নেল বললেন, তাহলে সেটা গোবিন্দের ঘরে থাকা উচিত।
গঙ্গাধর মাথা নেড়ে বলল,–গোঁজটা ভারি অপয়া ছিল স্যার। গোবিন্দের বউ যে-ছাগল ওতে বাঁধত, হয় তাকে শেয়ালে নিয়ে যেত, নয়তো রোগে ভুগে মারা পড়ত। শেষে বউটাও মরে গেল। তখন গোবিন্দ একদিন ওটা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে এসেছিল। তারপর আর কোনোরকম ক্ষতি হয়নি স্যার!
কর্নেল হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,–গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল?
এতক্ষণে দেখলুম দরজার কাছে একটা ভীষণ বুড়োমানুষ তুলোর কম্বল জড়িয়ে বসে রয়েছে। সে খকখক করে কাশল প্রথমে। তারপর বলল,–হুঁজুর, ওই নকশাকাটা মন্তর লেখা গোঁজই এ বাড়ির সব্বোনাশ করছে। বড়বাবুর ছেলেপুলে নেই। একটা ভাই ছিল, সেও বেঘোরে খুন হলেন। ইদিকে আমার দশা দেখুন। কোনোরকমে বেঁচে আছি। কোনো সুখশান্তি নেই হুজুর। সেই থেকে কোনো সুখশান্তি নেই। ওই যে কথায় বলে, যত হাসি তত কান্না/ বলে গেছে রাম শন্না! লোহার গোঁজে মন্তর খোদাই করে রেখেছিল কেউ। তাইতে ওনারও ফাঁসিতে পেরান গিয়েছিল।
ঘরে সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর আলো জ্বলে উঠল। প্রণবশংকর বললেন,–গ! চা কোথায় রে?
আনি বড়বাবু!-বলে গঙ্গাধর চলে গেল।
কর্নেলের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, গালে হাত রেখে বসে আছেন চুপচাপ। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। পবিত্র ঐতিহাসিক জিনিসটা উদ্ধার করতে পারলে সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে পারতেন তুমুল উত্তেজনায়।…
সকালের ট্রেন ধরব বলে আমরা তৈরি হয়েছিলুম। কর্নেল বললেন,–এসো জয়ন্ত! একবার ফোয়ারার বিদেশিনী অপ্সরাকে বিদায় জানিয়ে আসি।
ফোয়ারার কাছে গিয়ে বললেন,–আমায় সত্যি বাহাত্তুরে ধরেছে ডার্লিং। নইলে কাল দুপুরে এই পাঁচকোণা ফোয়ারা দেখেই অনুমান করা উচিত ছিল, এখানেই রহস্যের চাবি লুকিয়ে রয়েছে। ওটা দেখামাত্র খ্রিস্টীয় পবিত্র নক্ষত্রের কথা মাথায় এসেছিল। অথচ পেরেকটার সঙ্গে এর স্বাভাবিক যোগাযোগ থাকা উচিত। SATOR, AREPO, TENET, OPERA, ROTAS!–এক মিনিট!
বলে কর্নেল ফোয়ারার ভেতর নেমে ফাটলধরা চুন-কংক্রিটের স্তম্ভের একদিকে ঘাস ও আগাছা সরালেন। একটা ছুরি বের করলেন পকেট থেকে। ছুরি দিয়ে ঘষতে থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ।
তারপরই মুখ তেতো করে সরে এলেন। দেখি, স্তম্ভের গায়ে একটা কাকের টেরাকোটা মূর্তি ফুটে বেরিয়েছে। তাহলে অন্যদিকে কোকিল, কাকাতুয়া, কাঠঠোকরা আর কাদাখোঁচাও নিশ্চয় আছে।
কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু আর ঘুরে দাঁড়াতে রাজি নন। বললেন,–ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। চলে এসো জয়ন্ত।
বুঝলুম, ওই কাকটাই গণ্ডগোল বাধিয়েছে। কাক ওঁর দুচোখের বিষ।..