পদ্মার চরে ভয়ঙ্কর

পদ্মার চরে ভয়ঙ্কর

ডানপিটে বেপরোয়া মানুষদেরও অদ্ভুত অদ্ভুত কুসংস্কার থাকে। দুর্দান্ত শিকারি জিম করবেট মানুষখেকো বাঘ মারতে গিয়ে আগে একটা সাপ মারতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আগে একটা সাপ

পারলে তিনি কিছুতেই বাঘটা মারতে পারবেন না। ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ধুরন্ধর গোয়েন্দা কিলবার্ন কোনো হত্যা রহস্যের কিনারা করার আগে একটা ঘুঘু পাখি কিনে আকাশে উড়িয়ে দিতেন। তার বিশ্বাস ছিল, আগে একটা ঘুঘু পাখিকে মুক্তি না দিলে তার গোয়েন্দাগিরি ব্যর্থ হবে।

আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ডানপিটে তো বটেই, তিনি শিকারেও যেমন দক্ষ, গোয়েন্দাগিরিতেও তেমনি ধুরন্ধর! কাজেই তাঁর ওই রকম একটা কুসংস্কার থাকা স্বাভাবিক।

হ্যাঁ, স্বাভাবিক। কিন্তু এতকাল তার সঙ্গে ঘোরাফেরা করেও সেটা টের পাইনি, এটাই আশ্চর্য! আসলে আমি এখনও ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট বোকা, মুখে যতই চালাকির ভান করি না কেন।

ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টে তেমন কিছু চমকপ্রদ নয়। কোঠারিগঞ্জ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা পদ্মার চরগুলোর খবর নিচ্ছিলুম। ক্যাপ্টেন নটবর সিং বলছিলেন, এই ম্যাপটা বরং সঙ্গে রাখুন আপনারা। চিহ্ন দেওয়া এই চরগুলো আমাদের ভারতের। দিনের বেলা নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারেন। তবে কখনও রাতবিরেতে যাবেন না। ডাকাত আর স্মাগলারদের তখন গতিবিধি শুরু হয়। আমাদের জওয়ানদের সঙ্গে অনেক সময় সংঘর্ষ বাধে।

কর্নেল মন দিয়ে ম্যাপটা দেখছিলেন। দেখার পর বললেন, আচ্ছা হাবিলদার সায়েব, এই একটা প্রকাণ্ড চর আঁকা আছে দেখছি। এর গায়ে লাল চিহ্ন দেওয়া কেন?

নটবর সিং একটু হেসে বললেন, ওটা ডিসপুটেড, অর্থাৎ বিতর্কিত চর। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ওই চরটা নিয়ে ঝগড়া আছে। অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু মীমাংসা হয়নি এখনও। শুনছি আগামী মে মাসে দিল্লীতে আবার দু’দেশের মধ্যে বৈঠক বসবে। তখন ‘পীরের চর’ নিয়ে কথা উঠবে।

কী চর বললেন? ‘পীরের চর’ না কী যেন? কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন!

নটবর সিং বললেন, হ্যাঁ। পীরের চর। চরটা বেশ বড়। প্রায় সবটাই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গলের ভেতর এক পীর বাবার কবর আছে। কবরের ওপর ভাঙাচোরা একটা দালান বাড়ি রয়েছে। আগে ওখানে পদ্মার ওপার-এপার দুই পারের হিন্দু-মুসলিম ভক্তরা মানত করতে যেত। তারপর নাকি কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। ভয়ে লোকেরা পীরের থানে যাওয়া ছেড়ে দিল। জঙ্গল গজিয়ে গেল।

কর্নেল ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, অদ্ভুত ঘটনাটা কী?

নটবর সিং হাসতে লাগলেন–একজোড়া বাঘ।

বাঘ! কর্নেল অবাক হয়ে বললেন। বাঘ তো জঙ্গলেই থাকে। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা বলছেন কেন?

অদ্ভুত এ কারণে যে, ওই একজোড়া বাঘ মাঝে মাঝে মানুষের গলায় শাসাতো। নটবর সিং তামাশার ভঙ্গিতে বললেন। আমি স্যার পীরের চরে গোপনে বার দুই গেছি, কিন্তু বাঘ তো দূরের কথা, একটা শেয়ালও দেখিনি। এ তল্লাটের লোকের কাছেই ব্যাপারটা শুনেছিলাম। অথচ এ কিন্তু সত্যি, পীরের চরে আরও ভুলে কেউ পা বাড়ায় না।

আমি এতক্ষণ কান খাড়া করে শুনছিলুম। এবার বললুম, কেউ বাঘের চামড়া পরে বাঘ সেজে হয়তো তোককে ভয় দেখাত।

নটবর সিং বললেন, সে কথা আমিও ভেবেছি। স্মাগলারদের ঘাঁটির কথাও ভেবেছি। তারাই হয়তো ওভাবে ভয় দেখাত। কিন্তু লোকের মনে একবার আতঙ্ক ঢুকলে আর তো বেরোয় না! পীরের চরে যাওয়া সেই থেকে বন্ধ। আর এখন তো দু’দেশের সরকারই মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত পীরের চরে কাউকে যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন।

কর্নেল ম্যাপ থেকে মুখ তুলে কী দেখছিলেন। গঞ্জের বাইরে এই ক্যাম্প। আমবাগানের ভেতর কয়েকটা তাঁবু। নীচে পদ্মা বয়ে যাচ্ছে। বসন্তকালের সকালের রোদে নদীর জল আর মাঝে মাঝে ধূ-ধূ চর, কোথাও চরে ধূসর ঘাসবন, একটা বিরাট বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্র আর মরুভূমি পাশাপাশি শুয়ে আছে।

কর্নেল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ওহে! শোনো–শোনো!

ক্রাচে ভর করে একটা ভিখারি গোছের নোংরা ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকের লোক যাচ্ছিল গঞ্জের বাইরের দিকে। কর্নেলের ডাকে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর আমাদের দিকে আসতে থাকল।

খোঁড়া লোকটি তো হতবাক। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কর্নেল পকেট থেকে পার্স বের করে আস্ত একটা দশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিলেন। লোকটার চোখ আরও বড় হয়ে গেল। কর্নেল তার হাতে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, গুড বাই, মাই ফ্রেন্ড! আবার দেখা হবে।

লোকটি ক্যাপ্টেন সিং আর সেপাইদের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে যেভাবে টাট্ট ঘোড়ার মতো ক্রাচ খটমটিয়ে দ্রুত চলে গেল, বুঝলুম-এত বেশি টাকা সে জীবনে ভিক্ষে পায়নি এবং ভেবেছে, হাবিলদার আর সেপাইদের এ ব্যাপারে মনঃপুত নয়-এক্ষুনি তাই ভাগ চেয়ে বসতেও পারে। অতএব কেটে পড়াই ভাল।

নটবর সিং আমার মতো, অবাক হয়েছিলেন। বললেন, ওই বজ্জাতটাকে দশ টাকা ভিক্ষে দিলেন স্যার, ও তো এবার নেশা-ভাঙ করবে আর জুয়ো খেলতে যাবে। ওকে আপনি চেনেন না!

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, ও কিছু না। আচ্ছা হাবিলদার সায়েব, বেলা বাড়ছে। আমরা তাহলে আসি। এস জয়ন্ত!

ক্যাম্পের সবাই কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমরা চলতে থাকলুম পদ্মার পাড়ে। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কর্নেল বললেন, সচরাচর কেউ ভিখিরিকে দশ টাকা দেয় না। তাই ওরা অবাক হয়েছে। বুঝলে জয়ন্ত?

বললুম, অবাক আমিও কম হইনি।

ডার্লিং! কর্নেল সস্নেহে আমার একটা হাত হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তুমি ভালই জানো, ইচ্ছে থাকলেও খুব একটা দান-ধ্যানের ক্ষমতা আমার নেই। তবে কোনো শুভ কাজে বেরুনোর আগে হঠাৎ কোনো প্রতিবন্ধীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সেটাকে আমি শুভ লক্ষণ বলে মনে করি। বহুবার বহু ব্যাপারে ঠিক বেরুনোর মুখে অন্ধ, খোঁড়া কিংবা বিকলাঙ্গ মানুষ দেখতে পেলেই সে কাজটা সফল হয়েছে। তাই আমি এসব সময়ে তেমন কোনো মানুষ দেখতে পেলে দশ টাকা কেন, আরও বেশি দান করতে রাজি।

এ কিন্তু আপনার নিছক কুসংস্কার।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কু’ কিংবা ‘সু’ জানি না–তবে এটা আমার সংস্কার। তাছাড়া এটা আমার বহুবার পরীক্ষিত।

হাসতে হাসতে বললুম, বাংলা প্রবাদ কিন্তু উল্টোটাই বলে। বলে কী জানেন? প্রতিবন্ধী দর্শনে যাত্রা নাস্তি। যাত্রারম্ভে হাঁচি টিকটিকির বাধার মতো।

কর্নেল চুপচাপ হাঁটছিলেন। তাঁর মাথায় এখন ধূসর রঙের টুপি। কড়া রোদে টাক জ্বলে যাবে। সাদা দাড়ি পদ্মার জোরালো হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে। পিঠে হ্যাঁভারস্যাক, গলায় ঝুলছে সেই অদ্ভুত ক্যামেরা-যা অন্ধকারেও ছবি তুলতে ওস্তাদ এবং একটি বাইনোকুলার।

আমার পিঠে বন্দুক, পকেটে কয়েকটা গুলিও আছে। জলের বোতল, চায়ের ফ্লাস্ক কাঁধে ঝুলিয়েছি। পিঠে একটা কিটব্যাগে কিছু জামাকাপড়, ফার্স্ট এডের সরঞ্জাম ইত্যাদি।

বরাবর এভাবেই কর্নেলের সঙ্গে আমি বেরোই। এবার মার্চের শেষাশেষি মুর্শিদাবাদ সীমান্তে পদ্মার পাড় ধরে এই অভিযানের উদ্দেশ্য, বুনো হাঁস শিকার। নীতিগতভাবে পশুপাখিকে গুলি করে মারার আমি বিরোধী। কিন্তু হিমালয় পারের লক্ষ লক্ষ যাযাবর হাঁসের দু-চারটিকে মেরে সুস্বাদু মাংস ভোজনে এমন কিছু পাপ হবে বলে মনে করি না।

কর্নেলের উদ্দেশ্য চিরাচরিত। বিরল প্রজাতির পক্ষী দর্শন এবং ফটো ভোলা। পদ্মার চরে কী এক প্রজাতির জলচর পাখি আসে নাকি–যা হাঁস এবং বকের মাঝামাঝি গড়নের। ঠোঁট এবং মাথা হাঁসের মতো, পা এবং শরীর বকের মতো। এই কিস্তৃত বিদঘুঁটে পাখির নাম দিয়েছি বখা। বক ও হাঁসের সন্ধি। কিন্তু কর্নেল তামাশায় কান দেননি।

আমবাগান, ঝোঁপঝাড়ে ভরা জমি, কোথাও চষা ক্ষেত আর বাঁ দিকে পদ্মা রেখে আমরা হাঁটছিলুম। পাড় বরাবর একটা সরু পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চাষাভুষো লোকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তারা সবাই যাচ্ছে কোঠারিগঞ্জ বাজারে আনাজপাতি বেচতে।

একটা পুরনো মন্দির পড়ল পথের পাশে। একটু তফাতে একটা বসতি। মন্দিরের চত্বরে কয়েকজন লোক জাল বুনছে-কেউ জাল শুকোতে দিয়েছে। আমাদের দেখে তারা কাজ ফেলে তাকিয়ে রইল। কর্নেল ওদের উদ্দেশে ভদ্রতাসূচক হেসে একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন। ওরা হাত জোড় করে নমস্কার করল। বুঝলুম, আস্ত সায়েব দেখে ওরা ভড়কে গেছে। কর্নেলকে দেখে এমন ভুল ত সবাই করে! কিন্তু কর্নেল যখন বললেন, পদ্মায় কেমন মাছ হচ্ছে টচ্ছে? ওরা সায়েবের মুখে বাংলা শুনে তখন খুশি হয়ে একসঙ্গে কলকল করে জবাব দিতে থাকল।

তা স্যার, মাছ হচ্ছে বই কিছু কিছু। কিন্তু আজকাল বর্ডারের সেপাইরা বেশি দূরে যেতে দেয় না। তার ওপর চোর-ডাকাতও ওপার থেকে এসে হামলা করে। মাছ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

কর্নেল বললেন, শুনেছি পীরের চরের ওদিকে পদ্মার একটা পুরনো খাদ আছে। সেখানে তো খুব মাছ পাওয়া যেতে পারে। তাই না?

ওদের সর্দার চোখ বড় করে মাথাটা জোরে দোলাল। তারপর ভয় পাওয়া গলায় বলল, না স্যার। সে বড় ভয়ঙ্কর জায়গা! পীরের চরের থেকেও ভয়ঙ্কর।

কেন বলো তো?

জেলে সর্দার বলল, ওই খাদের নাম রাক্ষুসির বাঁওড়। লোভে পড়ে ওখানে মাছ ধরতে গিয়ে আমাদের গাঁয়ের অনেক লোক নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমার বড় ছেলে নাম ছিল গণেশ। ইয়া বড় বুকের ছাতি-পেল্লায় চেহারা। তিন বছর বাদে বারণ না মেনে রাক্ষুসির বাঁওড়ে গেল–আর ফিরে এল না।

জেলে সর্দার ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে কান্না সামলে নিল। কর্নেল ম্যাপটা খুলে জায়গাটা দেখতে দেখতে বললেন, হুম! ভারি ভয়ঙ্কর জায়গা তাহলে।

ওদের একজন জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

আমরা আপাতত যাব ‘মহিমবাবুর চরে’, কর্নেল বললেন। সেখানে নাকি প্রচুর বুনো হাঁস দেখা যায়।

তা যায় বটে! জেলে সর্দার বলল। কিন্তু হাঁসের দেখা বেশি মেলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে। শীত পর্যন্ত এত হাঁস দেখা যায়, পদ্মার জল কালো হয়ে ওঠে যতদূর চোখ যায়। এখন তো স্যার শীত ফুরিয়েছে, এখন তত বেশি নেই। তবে আছে–সারা বছর যারা থাকে, তারা আছে। তাদের সংখ্যাও কম নয়। দেখবেন গিয়ে?

কর্নেল বসলেন, হুম! সে কথা আমিও শুনেছি। পদ্মার চর এলাকায় বারো মাস শুধু হাঁস কেন, কত রকমের পাখির আড্ডা। তাই না?

আজ্ঞে ঠিকই বলেছেন।

লোকগুলোকে সিগারেট বিলি করলুম কর্নেলের আদেশে। কর্নেলের তো চুরুট ছাড়া চলে না, চুরুট ধরিয়ে আরও কিছুক্ষণ খবরাখবর নিলেন। কথা আছে, মহিমবাবুর চরে গিয়ে ডেরা পাতব। ওখানে আগে থেকে একটা নৌকো নিয়ে লোক থাকবে।

নির্জন রাস্তা। বড় বড় গাছপালায় জঙ্গল হয়ে আছে। একটা বটগাছের তলায় পৌচেছি, পেছনে ক্রিং ক্রিং সাইকেলের ঘন্টি শুনতে পেলুম।

ঘুরে দেখি, কোঠারিগঞ্জে রাতে যার বাড়িতে ছিলুম, সেই সদাশিববাবুর নাতি মোহনবাবু আসছেন সাইকেলে চেপে। পিঠে বন্দুক। ব্যাপার কী! উনি না আজ ভোরবেলায় কলকাতা যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন!

কর্নেল খুশি হয়ে বললেন, হ্যাল্লো মোহন! আমি জানতুম, তোমার কলকাতা যাওয়া হবে না।

মোহনবাবু বললেন, আপনি কি অন্তর্যামী কর্নেল!

কতকটা। কর্নেল সহাস্যে বললেন। রাতে তোমার দাদুর সঙ্গে তোমার কথাবার্তায় বেশ বুঝতে পারছিলুম, আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে তোমার যতটা টান, দাদুর কাজে কলকাতা যাওয়ায় ততটা নেই। কাজেই ধরেই নিয়েছিলুম, তুমি ট্রেন ফেল করবে।

মোহনবাবু আমার সমবয়সী যুবক। খুব হাসিখুশি স্বভাবের। সাহসী বলেও মনে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন এই এলাকায় পাটকাঠি থেকে কাগজ তৈরির কারখানা গড়ার চেষ্টা করছেন। এ এলাকায় প্রচুর পাট চাষ হয়।

মোহনবাবু বললেন, দেখুন কর্নেল, দাদুর কাজ দুদিন পরে হলেও চলবে। কিন্তু আপনাদের সঙ্গ তো আর পাব না! আপনাদের দু’জনের কীর্তিকথা এতকাল কাগজে পড়েছি। হঠাৎ কপালগুণে আপনারা যে এই জঙ্গলে পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় এসে পড়বেন, কল্পনাও করিনি। তা আবার আমাদের বাড়িতেই!

কর্নেল সস্নেহে ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার বাবা এ জেলার প্রখ্যাত শিকারি ছিলেন। ওড়িশার জঙ্গলে যখন মানুষখেকো বাঘ শিকারে গিয়ে প্রমথনাথ মারা যান, আমি তার সঙ্গী ছিলুম। তোমার বয়স তখন খুব কম। তোমাদের কলকাতার বাড়িতে মাঝে মাঝে গেছি অবশ্য।

মোহনবাবু বললেন, মায়ের কাছে সব শুনেছি। দাদুও বলছিলেন।

কথা বলতে বলতে আমরা আরও মাইলটাক এগিয়ে মহিমবাবুর চরের এলাকায় পৌঁছলুম। বাঁ দিকে পদ্মার জল অনেকগুলো বালির ঢিবির আনাচ-কানাচ ঘুরে বয়ে যাচ্ছে। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বুঝি মহিমবাবুর চর খুঁজছিলেন। সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে মোহনবাবু একটা খাড়ির ধারে গিয়ে কাদের ডাকতে থাকলেন।

একটু পরে ফিরে এসে বললেন, চলুন, নৌকো রেডি।

বালি-কাদা ভরা পিছল খাড়িতে একটা পানসি নৌকো নিয়ে মাঝিরা অপেক্ষা করছিল। নৌকো চেপে আমরা চললুম সেই চরের দিকে। চরটা দেখা যাচ্ছিল না। শুনেছি, মহিম হালদার নামে কেউ বহুকাল আগে ওই চরে গিয়ে বসতি করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবার বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে যেত। তারপর থেকে চরটা জনহীন হয়ে পড়ে আছে। শুধু মহিমবাবুর পুরনো একতলা হঁটের বাড়িটা রয়ে গেছে। সেখানে মাঝে মাঝে সীমান্ত বাহিনী গিয়ে ক্যাম্প করে থাকে। এখন সীমান্ত এলাকা শান্ত বলে তারা ওখানে নেই।

ঘণ্টা তিনেক লাগল পৌঁছুতে।

মাঝিরা নৌকোয় থাকল। তারা রান্নাবান্না করবে এখন। আমরা যতক্ষণ থাকব, ওদেরও থাকতে হবে।

ঘন কাশবন আর ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা চর। উঁচু গাছের সংখ্যা খুব কম। সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা একটা জীর্ণ দালান বাড়ি। সীমান্তবাহিনীর ফেলে যাওয়া কয়েকটা খাঁটিয়া রয়েছে ঘরে। জানালা-দরজা ফেটে রয়েছে। বারান্দায় একটা উনুন দেখতে পেলুম। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বললেন, ওটাই বুঝি সেই পীরের চর?

খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল, মাইলটাক দূরে পদ্মার বুকে একটা ঘন সবুজ দ্বীপ। চারদিকে জল। মোহনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ, কর্নেল, ওখানেই নাকি দুটো বাঘ মানুষের গলায় কথা বলত।

আর রাক্ষুসির বাঁওড় কোন্টা?

মোহনবাবু আঁতকে ওঠার ভান করে বললেন, তাও কানে গেছে? ওই দেখুন-পীরের চরের ডান দিকে পদ্মা খানিকটা ঢুকে গেছে বিলের মতে-দেখতে পাচ্ছেন? ওটাই সেই ভূতুড়ে বাঁওড়।

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে হঠাৎ বললেন, আশ্চর্য তো!

আমরা দুজনে এক গলায় বললুম, কী?

একটা স্পিড-বোট।

মোহনবাবু কর্নেলের কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলেন বাইনোকুলার। দেখতে দেখতে বললেন, তাই তো! আমাদের সীমান্ত বাহিনীর গোটা দুই স্পিডবোট আছে বটে, সে তো সেই লালগোলা ক্যাম্পে। তাছাড়া এ স্পিডবোটের গড়নও অন্যরকম।

আমি বললুম, বাংলাদেশের নয় তো?

কর্নেল বললেন, না। কারণ স্পিডবোটে একটা স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা আছে। আর একটা মড়ার খুলি এবং তার তলায় আড়াআড়ি দুটো হাড়ও আঁকা। তার মানে, সাবধান! আমি সাক্ষাৎ মৃত্যু!

বলেন কী! অজানা ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল আমার।

মোহনবাবু বললেন, স্পিড-বোটে জনা চার লোক বসে আছে। ওরে বাবা! একটা সাব মেশিনগান ফিট করা আছে দেখছি। কর্নেল! কর্নেল! ওরা পীরের দিকে এগোচ্ছে।

কর্নেল বললেন, যা যার যেখানে খুশি। আমরা তো পাখির ব্যাপারে এসেছি! ইয়ে–ডার্লিং জয়ন্ত! তাহলে এবার সঙ্গের খাদ্যগুলোর সত্ত্বার করে নিয়ে বেরুনো যাক। রোদ্দুরটা খাসা। আবহাওয়াও মোলায়েম। ওই দেখ, কত পাখি! জয়ন্ত! বিশ্বাস করো, একসঙ্গে এত জলচর পাখি কখনও দেখিনি! অভূতপূর্ব। বিস্ময়কর!

.

দুই

অভূতপূর্ব এবং বিস্ময়করই বটে। এমন লক্ষ লক্ষ, নাকি কোটি কোটি জলচর পাখির সমাবেশ কোথাও দেখিনি। যতদূর চোখ যায়, খালি পাখি আর পাখি। তাদের চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। জল থেকে এখানে ওখানে বালির চর জেগে রয়েছে। সেইসব চরে অসংখ্য পাখি বিশ্রাম করছে। ঝাঁকে ঝাকে আকাশে উড়ছে। আবার ছল-ছলাৎ শব্দে জলে নামছে। মনে হচ্ছে একটা দীর্ঘ চাবুক আকাশ থেকে কেউ সপাং করে জলে মারল।

বন্দুকের আওয়াজ করলে কর্নেলের সেই ‘বখাঁস’ দর্শন হবে না। তাই উনি আমাকে আর মোহনবাবুকে দক্ষিণে যেতে বলে একা গেলেন চরের উত্তর দিকে। কাশবনের আড়ালে ওঁর টুপিটি দেখা যাচ্ছিল। আমরা চরের দক্ষিণ দিকে ঢালুতে নেমে আর ওঁকে দেখতে পেলুম না।

কিছুক্ষণের মধ্যে মোহনবাবুর সঙ্গে এত ভাব হয়ে গেল যে, আমরা পরস্পরকে তুমি বলতে শুরু করলুম এবং নাম ধরে ডাকাডাকি চলল।

মোহন বলল, আজকাল এত বেশি জলচর পাখি নির্ভয়ে এ তল্লাটে এসে জুটছে কেন জানো? এদিকে কেউ পা বাড়ায় না বলে। এসব পাখি মারা বেআইনি। কিন্তু সেজন্য নয়। প্রথম কথা, বর্ডার বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা আছে। দ্বিতীয় কথা হল, পীরের চর আর রাক্ষুসির বাঁওড় সম্পর্কে লোকের ভীষণ আতঙ্ক। যারা এদিকে একা-দোকা এসেছে, তারা কেউ ফিরে যায়নি।

চরের একদিকটা ঢালু হয়ে জলে নেমেছে। সমুদ্রের বেলাভূমির মতো। একেবারে ফাঁকা এদিকটা শুধু ধু-ধু বালি। আমাদের দেখামাত্র বুনো হাঁসের ঝাঁক উড়ে দূরে গিয়ে বসল। বন্দুকের পাল্লার বাইরে। অনেক ঘোরাঘুরি করেও গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পেলুম না।

দেখতে দেখতে রোদ কমে এল। তারপর টের পেলুম, হাওয়াটা বেজায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মোহন বলল, আমাদের বরাত মন্দ জয়ন্ত! পাখিগুলো দেখছি মহা ধড়িবাজ! কী আর করা! কাল ভোরবেলা অন্যদিকে বেরনো যাবে। এখন ফেরা যাক।

মহিমবাবুর চর বেশ লম্বা-চওড়া। লম্বায় মাইলটাক না হয়ে যায় না। চওড়াতেও মনে হল প্রায় পৌনে এক মাইল। কাশবন, বালিয়াড়ি, কাঁটাঝোঁপের ভেতর ঘোরাঘুরি করে ধূর্ত পাখিগুলোকে যখন কিছুতেই বন্দুকের নাগালে পেলুম না, তখন ডেরায় ফিরে গেলুম।

কর্নেল ফিরলেন সন্ধ্যা নাগাদ। তখন পুবে মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে। আজ পূর্ণিমা তাহলে। জ্যোৎস্না ফুটতে ফুটতে আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেল। নৌকোর মাঝিরাও এসে জুটল। ওরা নৌকোয় রাত কাটাতে নারাজ। আগের ব্যবস্থা মতো লণ্ঠন আর রান্নার সরঞ্জাম নৌকোয় ছিল। সব বয়ে নিয়ে এল। ভেবেছিলুম, বুনো হাঁসের মাংসের ঝোল খেয়ে পদ্মার এই বেমক্কা ঠাণ্ডাটা ঠেকাব। হল না। তবে মাঝিরা বুদ্ধি করে জাল ফেলে কিছু মাছ ধরেছিল।

কর্নেলেরও আমাদের মতো মন ভাল নেই। অনেক হাঁটাহাঁটি আর জল-কাদা-বালিতে উপুড় হয়ে ‘বখাঁস’ দেখার চেষ্টা করেছেন। থাকলে তো!

কর্নেলের মতে, নিশ্চয় আছে। এক পক্ষীবিদ সায়েবের বইতে পড়েছেন। বোম্বাইয়ের নামকরা পক্ষীবিদ্ সেলিম আলিও লিখেছেন পদ্মার চরের এই আশ্চর্য জলচর পাখির কথা।

রাত আটটার মধ্যে শালপাতায় মোটা চালের ভাত আর মাছের ঝোল খাওয়া হয়ে গেল। সায়েব মানুষ কর্নেলও খুব তারিয়ে তারিয়ে চেটেপুটে খেলেন এবং মাঝিদের রান্নার সুখ্যাতি করলেন।

তারপর এক অদ্ভুত প্রস্তাব করলেন। এখনই পীরের চরে যেতে চান। ইচ্ছে করলে আমরাও ওঁর সঙ্গে যেতে পারি।

কিন্তু যেতে হলে নৌকো চাই। মাঝিরা আতঙ্কে কাঠ হয়ে বলল, তারা প্রাণ গেলেও পীরের চরে যাবে না। দিনেই যাবে না, তো এই রাতের বেলায়! সায়েবের কি মাথা খারাপ! ওদিকে যে যায়, সে আর ফেরে না।

মোহন বলল, ঠিক আছে। আমি নৌকো বাইতে জানি। এ দেশের ছেলে। এ কাজটা ভালই পারি। জয়ন্ত, তুমি নৌকো বাইতে পারো তো?

জোরে মাথা নেড়ে বললুম, মোটেও না। কর্নেলও পারেন না।

কর্নেল বললেন, তুমি কি ভুলে গেলে জয়ন্ত? ভারত মহাসাগরের টোরা দ্বীপ থেকে একবার একা ভেলায় পাড়ি জমিয়েছিলুম প্রাণের দায়ে! আর এ তো পদ্মা!

তাও বটে। এ বুড়োর অসাধ্য কাজ কিছু থাকতে নেই। কিন্তু দ্বিধাজড়ানো গলায় বললুম, এই রাত-বিরেতে ওই জঙ্গুলে চরে কি না গেলেই চলে না! বরং সকালে যাওয়া যাবে।

একজন মাঝি ভয় দেখিয়ে বলল, স্যার, পীরের চরের জোড়া বাঘ এখনও শুনেছি আছে। তাছাড়া প্রচণ্ড সাপের উৎপাত আছে। কেউটে-গোখরো তো আছেই, আর আছে অজগর সাপ। স্যার, আমি দূর থেকে একবার দেখেছি, অজগর সাপটা মাথায় মণি নিয়ে বেড়াচ্ছে। আর চারদিকে আলো ঠিকরে পড়ছে। জঙ্গল আলো হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন।

কর্নেল কানে নিলেন না। মোহনের মুখেও দ্বিধার চিহ্ন নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। সঙ্গে টর্চ আছে। প্রত্যেকের পায়ে গামবুট আছে। দুটো বন্দুক আছে। কর্নেলও নিশ্চয় তার রিভলভারটা সঙ্গে এনেছেন।

জ্যোৎস্নার রাতে পদ্মায় নৌকো করে যাওয়ার আনন্দ আছে। বারবার মনে পড়ছে সেই ভয়ঙ্কর স্পিড-বোটটার কথা। কারা ওরা! ওদের কাছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র আছে। ওরা যে ভাল মানুষ নয়, তা তোবোঝাই গেছে। বোটের গায়ে মড়ার খুলি আঁকার মানে একটাই–তা হল, “আমরা সাক্ষাৎ মৃত্যু! কর্নেল-দাঁড়ে বসেছেন। মোহন একা আলতো হাতে বৈঠা বাইছে। আমরা যাচ্ছি স্রোতের ভাটিতে। তাই নৌকো তরতর করে এগোচ্ছে। আমি পানসির ছাদে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একদিকে উঁচু পাড়, অন্যদিকটায় জল। কিছু দূর যাবার পর নৌকো কোনাকুনি চলতে থাকল। পাড় থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলাম।

জ্যোৎস্নায় চারদিক কেমন ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছিল, ভুল করে বাংলাদেশের সীমানায় গিয়ে পড়ব না তো!

কর্নেলকে না বলে পারলুম না-পীরের চর তো দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজে অন্য কোথাও নৌকো নিয়ে গেলেই মুশকিল!

কর্নেল পানসির পেছন থেকে জবাব দিলেন, এবার নাক বরাবর। তাছাড়া ওই দেখ আলো!

আলো মানে! চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলুম।

মোহনও মুখ ফেরাল। বলল সর্বনাশ! ওটা তাহলে সেই স্পিড-বোটের আলো।

কর্নেল বললেন, না। আলোটা উঁচুতে। তার মানে পীরের চরের জঙ্গলে।

আলোটা দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। বললুম, কর্নেল, জনমানুষহীন পীরের চরে কেউ নিশ্চয় আলো হাতে আমাদের বরণ করার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু বরণ কীভাবে করবে, সেটাই একটু ভাবনার কথা।

কর্নেল কোনো জবাব দিলেন না। ওদিকে আলোটা নড়তে নড়তে হঠাৎ যেন নিবে গেল। বন্দুকটা শক্ত করে চেপে ধরলুম।

তারপর টের পেলুম, আমাদের নৌকো বিশাল এক ঝাঁক পাখির দিকে এগিয়ে চলেছে। হাজার হাজার পাখি ভয় পেয়ে উড়তে শুরু করল। অনেক বেপরোয়া পাখি তরতর করে জল কেটে দূরে সরে যেতে থাকল। চারদিকে প্রচণ্ড একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। জলের শব্দ, ডানার শব্দ, আঁক-আঁক টা-টা চিৎকার। একটু পরে সামনে কালো পাহাড়ের মতো আবছা ভেসে উঠল পীরের চর।

জলে ঝোঁপঝাড় ঝুঁকে আছে। ঘন কালো তাদের রঙ। অন্ধকার ওত পেতে আছে যেন আমাদের জন্য। নৌকো ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে এক জায়গায় ফাঁকা বালির তট পাওয়া গেল। সেখানে নৌকো বেঁধে রাখা হল একটা ঝোঁপের সঙ্গে। পাহাড়ের মতো আবছা ভেসে উঠল পীরের চর।

জলে ঝোঁপঝাড় ঝুঁকে আছে। ঘন কালো তাদের রঙ। অন্ধকার ওত পেতে আছে যেন আমাদের জন্য। নৌকো ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে এক জায়গায় ফাঁকা বালির তট পাওয়া গেল। সেখানে নৌকো বেঁধে রাখা হল একটা ঝোঁপের সঙ্গে। তারপর আমরা ঢালু পাড় বেয়ে উঠে গেলুম পীরের চরে।

কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, কোনো কথা নয়। চুপচাপ আমার পেছন পেছন এস। দরকার হলে আমিই টর্চ জ্বালব–তোমরা জ্বেলো না যেন!

ওপরে মাটিটা শক্ত। ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে বড় বড় গাছ আছে। চাঁদের আলো পড়েছে চকরা-বকরা হয়ে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছে, এই বুঝি সাপের সে শুনতে পাব! কিন্তু কিছুটা এগিয়ে ভয়টা কেটে গেল। বিষধর সাপ পায়ে ছোবল মেরে সুবিধে করতে পারবে না, পায়ে গামবুট রয়েছে আমাদের।

সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখা গেল। সেখানে যেতেই আমরা থমকে দাঁড়ালুম। ডাইনে সম্ভবত একটা বটগাছ। জ্যোৎস্নায় অজস্র ঝুরি দেখা যাচ্ছে মনে হল। ঝুরিগুলোর ভেতর একখানে জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো বাঘ আপন মনে খেলা করছে। তাদের লেজ দুটো খুব নড়াচড়া করছে। পরস্পর কামড়াকামড়ি আর জড়াজড়ি করে ওরা খেলছে।

কর্নেলের ইশারায় আমরা বসে পড়লুম। বন্দুক এগিয়ে বাগিয়ে রইলুম, যদিও জানি, পাখি-মারা কার্তুজে বাঘের একটুও ক্ষতি করা যাবে না। অবশ্য আওয়াজে ভড়কে যেতেও পারে।

বাঘ দুটোর খেলা আর শেষ হয় না। কতক্ষণ পরে এবার যা দেখলুম, চোখে বিশ্বাস করা কঠিন। সম্ভবত যে আলোটা দেখেছিলুম, সেইটেই হবে। দুলতে দুলতে কোত্থেকে এল। তারপর আলোর ছ’টায় আবছা দেখা গেল একটা অদ্ভুত চেহারার মানুষকে। কালো আলখাল্লায় ঢাকা আপদমস্তক। নাকটা বাঁকা বাজপাখির ঠোঁটের মতো। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। সে বাঘ দুটোর কাছে এসে লণ্ঠন নামিয়ে রাখল। তখন বাঘ দুটো তার পায়ে মাথা ঘষতে থাকল।

লোকটা বাঘ দুটোর পিঠে থাপ্পড় মেরে বলল, খুব হয়েছে! এবার নিজের কাজে যাও বাবারা! চারিদিকে চক্কর মেরে নজর রাখবে। হুশিয়ার!

বাঘ দুটো পেছনের দু’পা গুটিয়ে সামনের দু’পা সোজা রেখে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। আলখাল্লাধারী ফের বলল, হাঁ করে দেখছ কী বাবারা? আজ শয়তান কাশিম খাঁকে দেখেছি মোটর-বোটে রাক্ষুসির বাঁওড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খবরদার! শয়তানটা যেন এ পবিত্র মাটিতে পা রেখে নোংরা করে না!

বাঘ দু’টো দুদিকে চলে গেল। ভাগ্যিস, আমাদের দিকে এল না। এলে কী হত, ভাবতেও গা শিউরে উঠল।

আলখাল্লাধারী আলো নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢোকা মাত্র কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, চলে এস। সাবধানে কিন্তু।

জঙ্গলের ভেতর জায়গায় জায়গায় জ্যোৎস্না পড়েছে। গাছগুলো সবই উঁচু। তাই এবার হাঁটতে অসুবিধে নেই। আলখাল্লাধারী আলো নিয়ে যেখানে ঢুকল, সেটাই তাহলে পীরের মাজার। একতলা জীর্ণ একটা বাড়ি। দরজা বন্ধ করে দিল সে।

আমরা বাড়িটা ঘুরে পেছনের দিকে গেলুম। ভাঙা জানলা দিয়ে ভেতরের আলো দেখা যাচ্ছিল। প্রথমে কর্নেল সেখানে উঁকি দিলেন। তারপর আমাকে ইশারা করলেন। ফাটলে চোখ রেখে দেখি, ঘরের মেঝেয় সেই আলখাল্লাধারী লোকটা বসে আছে। তার সামনে একটা কবর। কবরে পুরনো আমলের ভেঁড়াখোঁড়া একটা লাল ভেলভেট কাপড় ঢাকা। কবরের অন্যদিকে বসে রয়েছে তিনজন হিংস্র চেহারার লোক। তাদের পরনে প্যান্ট-শার্ট এবং প্রত্যেকের হাতে একটা করে রাইফেল, বুকে কার্তুজের মালা।

আলখাল্লাধারী বলল, হ্যাঁ, শয়তানটা আজ আবার এসেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে লড়াই করে এঁটে ওঠা যাবে না। কারণ এবার হারামজাদা কাশিম খাঁ সঙ্গে একটা সাব-মেশিনগান এনেছে। কাজেই ওর সঙ্গে লড়তে যাওয়া বোকামি। বরং বাদশা-বেগমকে লেলিয়ে দিয়েছি। ওরা ওদের ভিড়তে দেবে না চরে।

ইতিমধ্যে কর্নেল আর মোহনও আমার পাশে মাথা গুঁজে ফাটলে চোখ রেখেছেন। আমরা থ’ বনে গিয়ে শুনছি ওদের কথাবার্তা। বুঝতে পারছি বাদশা-বেগম সেই বাঘ দু’টোর নাম। কিন্তু ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না!

একজন অনুচর বলল, কিন্তু বাদশা-বেগমকে ওরা যদি গুলি করে মারে?

আমার এ জানোয়ার দু’টোর বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর একটু আস্থা রেখো জনার্দন! আলখাল্লাধারী লোকটা বলল। তার মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। তুমি কি জানো না, এ পর্যন্ত কত জন ওদের পেটে হজম হয়ে গেছে?

দ্বিতীয় অনুচর বলল, তারা নেহাত মাছমারা জেলে–নিরীহ মানুষ! কিন্তু কাশিম খাঁ–

কথা কেড়ে আলখাল্লাধারী বলল, হুঁশিয়ার রহিম বখশ! তোমার দেখছি ওদের ওপর বড় দরদ। তুমি জানো! ওরা সবাই কাশেমের টাকা খেয়ে পীরের চরে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিল মাছধরার ছলে? জেলেপাড়ার গণেশ নামে এক ছোকরাকে বাদশা কামড় বসিয়েছিল। আমার খেয়াল হল বাঘের পেটে যাবার আগে ওকে জেরা করে দেখি, সত্যি সত্যি মাছ ধরতে এসে পীরের চরে পা দিয়েছে নাকি! জেরা করে জানলুম, ওপার থেকে কাশেমের লোক গিয়ে ওকে টাকা খাইয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠিয়েছে।

তৃতীয় অনুচর বলল ওস্তাদজী! মহিমবাবুর চরে কারা এসেছে দেখেছি। তাদের মধ্যে একটা বুড়ো সায়েব আছে। সে চোখে দূরবীন লাগিয়ে পাখি দেখে বেড়াচ্ছিল।

ওস্তাদজী হাসল-সায়েবদের পাখি দেখার নেশা আছে, গদাই। বুঝলে তো? পদ্মার চরে কঁহা-হা মুল্লুক থেকে শিকারিরাও আসে। কাজেই ও নিয়ে ভেবো না।

তৃতীয় অনুচর গদাই চেহারাতেও তদ্রপ। নাদুসনুদুস গড়ন। প্রকাণ্ড মাথা। অন্য সময়ে তাকে দেখলে হাসি পেতে পারে। কিন্তু এখন ওর হাতে অটোমেটিক রাইফেল।

গদাই বলল, ওদের সঙ্গে কোঠারিগঞ্জের সদাশিববাবুর নাতি মোহনবাবুকেও দেখেছি।

ওস্তাদজী খিকখিক করে হেসে বলল, মোহন! মোহন বড় ভাল ছেলে। ছোটবেলায় কোঠারিগঞ্জে থাকার সময় ওকে দেখেছি। এখন খুব বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়!

জনার্দন বলল, এখন একটু চা পেলে মন্দ হত না ওস্তাদজী! বাইরে ঠাণ্ডাটি বাড়ছে। তাছাড়া সারা রাত জেগে কাজ করতে হলে মাঝে মাঝে চা দরকার।

ওস্তাদ ডাকল, ভুতো! অ্যাই ভুল!

ওদিক থেকে সাড়া এল।–চা হয়ে গেছে ওস্তাদজী!

নিয়ে আয় ঝটপট!

চায়ের কেটলি আর গোটাকতক গ্লাস হাতে যে লোকটা ঘরে ঢুকল, তাকে দেখেই চমকে উঠলুম। আরে! এ তো সেই সকালে বর্ডার বাহিনীর ক্যাম্পে দেখা খোঁড়া লোকটা! বগলে ক্রাচ এখনও রয়েছে। কর্নেলকে চিমটি কাটলুম। সাড়া পেলুম না।

ওরা চা খেতে থাকল। তারপর দূরে কোথাও বাঘের ডাক শুনতে পেলুম। কয়েকবার ডেকেই চুপ করে গেল। ভেতরের লোকগুলো নিশ্চয় শুনতে পায়নি। ওরা নিশ্চিন্ত মনে কথা বলছে পরস্পর। কান পেতে শুনতে থাকলুম। মাঝে মাঝে পেছনে ঘুরে দেখেও নিলুম, বাদশা বা বেগমের জন্য মনে আতঙ্ক রয়েছে। পেছনের দিকটা ফাঁকা না হলেও উঁচু গাছের সংখ্যা কম। তাই পরিষ্কার নজর হচ্ছে অনেকটা দূর পর্যন্ত।

ওস্তাদ বলল, শয়তান কাশেম আসলে ভেবেছে, বুলবন পেশোয়ারীর সোনাদানায় তার ভাগ আছে। কেন? না, সে পেশোয়ারীর কর্মচারী ছিল। ভেবে দেখ তোমরা! ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে যখন ওপারে হাঙ্গামা লাগল, অবাঙালি মুসলিম বড়লোকেরা অনেকেই এই বর্ডার পেরিয়ে পালিয়ে আসছে–বুলবন পেশোয়ারী আর থাকবে কোন্ সাহ? পাকিস্তান স্টেট ব্যাঙ্কের লকার ভেঙে প্রায় পঞ্চাশ কিলোগ্রাম সোনার বাট নিয়ে ভাগলো। হ্যাঁ, কাশেম খাঁ বলতে পারে বটে, সে বর্ডার পেরুতে তার ওই স্পিড-বোটটা দিয়ে পেশোয়ারীকে সাহায্য করেছিল। তাতে কি পেশোয়ারীর সোনার হিস্যে তার পাওনা হয়!

করিম বখশ বলল, পেশোয়ারী এই পীরের চরেই যে সোনা পুঁতে রেখেছিল, তার প্রমাণ?

ওস্তাদ চোখ পাকিয়ে বলল, করিম বখশ! তুমি বরাবর বড্ড সন্দেহপ্রবণ লোক!

করিম আমতা আমতা হেসে বলল, না ওস্তাদজী! ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার! নইলে খামোকা যেখানে-সেখানে মাটি খুঁড়ে লাভ কি?

জনার্দনও সায় দিয়ে বলল, ঠিক, ঠিক।

খোঁড়া লোকটা–ভুতো, চায়ের এঁটো গ্লাসগুলো নিয়ে চলে গেল। গদাই বলল, হ্যাঁ ওস্তাদজী। সবটা আপনার মুখে শুনতে চাই। আর কতদিন ভুল পথে ছোটাছুটি করে মরব!

ওস্তাদ বলল, পেশোয়ারীকে তার মালপত্তর সমেত কাশেম এই চরে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমাকে বলে যায়, ওকে যেন নিরাপদে লালগোলা পৌঁছে দিই। রাতে আমার এই আস্তানায় যত্ন করে পেশোয়ারীকে রাখলুম। আমি ভাবতেই পারিনি, ওর কাছে অত সোনা আছে। তবে হ্যাঁ, দেখে মনে হয়েছিল বটে বেজায় বড়লোক। টাকাকড়িও আছে সঙ্গে। ভাবলুম, ঘুমোলে স্যাঙাতকে শেষ করে সবটা হাতাব। লাশটা বাদশা-বেগমকে খাইয়ে দেব। কিন্তু ব্যাটা কীভাবে সব টের পেয়েছিল জানি না। না কি কাশেমই আমার পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছিল। রাতে আমি মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে উঠে দেখি পেশোয়ারী নেই। তখন সন্দেহ হল, ব্যাটা আমাকে মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। গ্লাস পরীক্ষা করে দেখলুম, সাদা গুঁড়ো কী সব জিনিস রয়েছে গ্লাসের তলায়।

গদাই বলল, বলেন কী! তারপর?

ওস্তাদ বলল খুব রাগ হল। বুলবনকে খুঁজতে বেরুলুম। এ চর থেকে সাঁতার কেটে পালাতে পারে বটে, কিন্তু সঙ্গের বাক্সপেটরা? খুঁজতে খুঁজতে একখানে দেখি, আমার বাদশা আর বেগম বুলবন হতভাগাকে থাবার ঘায়ে আধমরা করে ফেলেছে। ঘাড়ে কামড় বসাতে যাচ্ছে, আমি চেঁচিয়ে উঠলুম। বাঘ দুটো আমাকে দেখে সরে দাঁড়াল। বুলবনের তখন মুমূর্ষ অবস্থা। কাছে গিয়ে বসতেই অতি কষ্টে বলল, “আমার পাপের ফল। পঞ্চাশ কিলোগ্রাম সোনার বাট। পীরের তলায় সোনাটা–” শুনেই চেঁচিয়ে উঠলুম, কোথায়? বুলবনের দম আটকে গেল। তখন কী আর করি! বাঘ দুটোকে ডেকে বললুম, শীগগির এ ব্যাটাকে গিলে খা। পীরের চরে মড়া পড়ে থাকার বিপদ আছে। কখন বর্ডার পুলিস এসে দেখে ফেলবে!

জনার্দন বলল, ওস্তাদজী! আমার মাথায় একটা কথা এসেছে।

কী তা বলেই ফেলো বাপু। ওস্তাদ বিরক্ত হয়ে বলল।

পেশোয়ারী নিশ্চয় কোথাও বালির মধ্যে সোনাটা পুঁতে রেখেছিল, জনার্দন বলল। এ জঙ্গলের ভেতর মাটিতে পুঁতলে তো আপনি খুঁজে পেতেন। সদ্য মাটি খোঁড়ার চিহ্ন থাকত। কাজেই বালিতে পুঁতেছিল ব্যাটা।

ওস্তাদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, এ কথাটা তো এত দিন মাথায় আসেনি! তুমি ঠিকই বলেছ। জনার্দন! বালিতে পুঁতলে জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। কী বোকা আমরা! এতকাল জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে হন্যে হলুম, অথচ–

কথা থামিয়ে আলখাল্লাধারী উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্তভাবে বলল, চলো তাহলে! আগে পুবের বালির চড়ায় যাই। একদিক থেকে খোঁড়া শুরু করি। যতদিন লাগে লাগুক–মাস, বছর লাগুক।

এবার দেখলুম, কয়েকটা কোদাল আর ঝুড়ি রয়েছে ঘরের কোনায়। সেগুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে তিন রাইফেলধারী আর ওস্তাদ বেরুল। ঘরে লণ্ঠনটা রইল। ওস্তাদের গলা শোনা গেল ওদিক থেকে–অ্যাই ভুতো! কোথাও যাবিনে। চুপচাপ ঘরে শুয়ে থা!

ক্রাচে ভর করে ভুতো ঘরে ঢুকল। তারপর সটান শুয়ে পড়ল। লোকটার একটা পা হাঁটুর কাছ থেকে কাটা। সে সেই কাটা পা নাচাতে থাকল শুয়ে শুয়ে। চোখ দুটো বোজা। নিশ্চয় গাঁজা টানছিল এতক্ষণ। এখন নেশায় চুর হয়ে গেছে।

.

তিন

আমরা নিঃশব্দে ওদের অনুসরণ করছিলুম। শুধু আতঙ্ক ওই বাঘ দুটোর জন্য। আমাদের দৈবাৎ দেখে ফেললে প্রচণ্ড বিপদে পড়তে হবে।

ওস্তাদ দলবল নিয়ে পুবের বালিয়াড়িতে চলেছে। এদিকে ফাঁকা বলে জ্যোৎস্নায় তাদের ছায়ামূর্তি নজর হচ্ছে। কিন্তু এতক্ষণে ঠান্ডাটা বেজায় বেড়ে গেছে। কাঁপুনি হচ্ছে। একখানে একটু থেমে কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, রাক্ষুসির বাঁওড় পশ্চিমে। আমরা যাচ্ছি পুবে। কাজেই মনে হচ্ছে, বাঘ দু’টোর আচমকা হামলার ভয় আর নেই। কারণ ওদের রাক্ষুসির বাঁওড়ের দিকটায় পাহারা দিতে বলা হয়েছে। কাশেম খাঁ স্পিড-বোট নিয়ে ওদিক থেকেই আসবে কিনা!

একটা বালির ঢিবির ওপর ওস্তাদ আর তিন অনুচরের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল। তারা ওধারে নেমে অদৃশ্য হলে আমরা সেই ঢিবিতে গিয়ে বসে পড়লুম। বালির ঠান্ডা পোশাকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তার ওপর পদ্মার হু-হুঁ হাওয়া। নিচে ওস্তাদদের দেখা যাচ্ছে। এবার খোঁড়ার আয়োজন চলেছে।

আমরা ঘাপটি মেরে বসে রইলুম। মোহন বলল, ওদের বোকামি দেখে হাসি পাচ্ছে। ওরা কি গোটা বালিয়াড়ি খুঁজে সোনা আবিষ্কারের মতলব করেছে! তাহলে তো এক বছর লেগে যাবে।

বললুম এ তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার শামিল।

কর্নেল বললেন, ওরা আসলে মরিয়া হয়ে উঠেছে সোনার লোভে। আচ্ছা মোহন, লোকগুলোকে কি চিনতে পেরেছ? তোমাদের এলাকার লোক বলেই মনে হচ্ছে।

মোহন বলল, চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। চিনতে পারলুম না।

হুম! আমার ধারণা, এরা আসলে একদল ডাকাত। আর আলখাল্লাধারী ওদের সর্দার, সেটা তো ‘ওস্তাদজী’ বলা শুনে বোঝাই যাচ্ছে, কর্নেল বললেন, কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছে না, বাঘ দুটো কীভাবে ওর পোষ মানল? বাঘ সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানা আছে। কম বয়সে বাঘ মানুষের পোষ মানে বটে, কিন্তু বয়স হলে তারা তাদের বন্য হিংস্র স্বভাব ফিরে পায়। তখন তাদের আর পোষ মানিয়ে রাখা যায় না। তার ওপর বাঘ দুটো মানুষখেকো।

বললুম, কর্নেল! পীরের জঙ্গলে বাঘ দুটো খায় কী? কী খেতে দেয় ওস্তাদ?

কর্নেল বললেন, মানুষ।

মোহন ও আমি শিউরে উঠলুম। বললুম, মানুষ খেতে দেয়!

তাই বোঝা যাচ্ছে। কর্নেল বললেন। শুনেছি এই এলাকায় এ যাবৎ অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। তাই না মোহন?

মোহন উত্তেজিতভাবে বলল, হ্যাঁ কর্নেল! এতদিনে তাহলে সে রহস্যের কিনারা হল।

কর্নেল বললেন প্রাণীবিদদের লেখা বইয়ে পড়েছি, সারা জীবন ধরে কোনো বাঘ যদি শুধু মানুষের মাংস খায় বা তাকে খাওয়ানো হয়, তাহলে এক সময় তার অবস্থা হয়ে ওঠে আফিংগোর মানুষের মতো। অর্থাৎ সারাক্ষণ নেশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ওই অবস্থায় তার স্বাভাবিক হিংসা লোপ পায়। আক্রমণবৃত্তি নষ্ট হয়ে যায়। গৃহপালিত নেড়ি কুকুর হয়ে ওঠে বেচারা। অবশ্য জানি না, বাদশা-বেগমের সেই অবস্থাটা এসেছে কি না! এখনও না এসে থাকলে ভবিষ্যতে আসবে। তখন ওদের তাড়া করলে বা ঘুষি মারলেও দাঁত বের করে থাবা তুলে আক্রমণ করবে না।

সকৌতুকে বললুম, গজরাতে পারবে না?

কর্নেল বললেন, ওটা তো তার মাতৃভাষা। কাজেই জয়ন্ত, গর্জনটা তাকে করতেই হবে।

বলে কর্নেল ঢিবির আড়ালে উঠে দাঁড়ালেন। ফের বললেন, ওরা সম্ভবত শেষ রাত পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি করবে। কাজেই অকারণ এখানে বসে থেকে লাভ নেই। এস, আমরা পীরের মাজারে যাই। ভুতো এতক্ষণ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।

কেনই বা তাহলে ওদের অনুসরণ করে আসা, কেনই বা ফের পীরের মাজারে যাওয়া–কিছুই বুঝলুম না। কর্নেলের গতিবিধির অর্থ খোঁজা বৃথা। কোনো কথা না বলে ওঁকে অনুসরণ করলুম। জঙ্গলে ঢুকে আবার বাঘ দুটোর জন্য আতঙ্ক জাগল।

কিন্তু কিছুটা এগোতেই পড়বি তো পড় একেবারে সেই বাঘ দুটোরই মুখোমুখি। সেই ঝুরিওয়ালা বটগাছটার তলায় ফাঁকা জায়গায় যেখানে চাঁদের আলো পড়েছে, সেখানেই। তেমনি করে খেলা জুড়েছে হতচ্ছাড়ারা।

এবার কিন্তু আমাদের দেখতে পেল। পেয়েই পিলে চমকানো ঘড়ঘড় গর্জন করে তেড়ে এল। কর্নেল চাপা গলায় বলে উঠলেন, গাছে ওঠো! গাছে উঠে পড়ো।

সামনে যে ঝুরিটা ছিল, সেটা বেয়ে প্রাণপণে উঠতে শুরু করলুম। একটা বাঘ নিচে দাঁড়িয়ে সমানে ঘড়ঘড় করতে থাকল। মাটিতে লেজ বারবার আছড়ে আমাকে শাসাতে থাকল।

মোহনকে এক পলক দেখেছিলুম, দিশেহারা হয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। আরেকটা বাঘ একটু তফাতে আমার ডাইনে গজরাচ্ছে শুনে বুঝলুম, মোহন ওখানেই একটা গাছে উঠতে পেরেছে।

কিন্তু কর্নেল কোথায় গেলেন?

গামবুট পরে গাছে ওঠা সহজ কথা না। লাখ টাকা বাজি ধরলেও পারতুম না। কিন্তু এ হল গিয়ে প্রাণের দায়! কে যেন ঠেলে বটগাছের উঁচু ডালে তুলে দিয়েছে। বেচারা কর্নেলের জন্য ভয় হচ্ছিল। বুড়ো বয়সে গামবুট পরে গাছে চড়া কি সহজ কথা! আমরা যুবক বলেই পেরেছি!

বাঘটা নিচে ঝুরির চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে আর ওপর দিকে মুখ তুলে যেন বেজায় গালমন্দ করছে। পস্তানি হচ্ছিল, যদি বুদ্ধি করে রাইফেলটা আনতুম! বন্দুকের ছররা গুলিতে ওর গায়ে আঁচড় পড়বে না। তবু বন্দুকের নল তাক করে আমিও বাঘটাকে ভয় দেখাতে শুরু করলুম।

মোহন বোকামি করে ছররা গুলি ছুঁড়ে বসবে না তো! তাহলে ওস্তাদরা টের পেয়ে দৌড়ে আসতে পারে।

মোহনের বন্দুকের আওয়াজ ভাগ্যক্রমে শোনা গেল না। ও বুদ্ধিমান ছেলে।

কতক্ষণ পরে বাঘটা একবার চাপা হালুম শব্দ করল। তখন দেখি, তার জোড়াটাও হালুম করে এসে গেল। দুটিতে আবার খেলা শুরু করল। গাছের ডালে বসে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এবার কর্নেলের মুণ্ডুপাত করছিলুম! কেন যে ওঁর সঙ্গে এমন করে চলে আসি যেখানে সেখানে, এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, বুড়ো গোয়েন্দাপ্রবর মোটেও বখাঁস দেখতে পদ্মার চরে আসেননি। ভেতরে অন্য উদ্দেশ্য ছিল।

এক এক সময় পশ্চিমে দূরে সম্ভবত রাক্ষুসির বাঁওড়ে কাশেম খাঁর স্পিড-বোটের গরগর শব্দ শোনা গেল। অমনি বাঘ দুটো তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কান খাড়া করে দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে সেদিকে চলে গেল।

সুযোগ বুঝে সাবধানে নেমে এলুম। জামা আর হাতের তালু ছিঁড়ে গেল। নেমেই চাপা গলায় ডাকলুম, মোহন! মোহন!

মোহনের সাড়া পাওয়া গেল একটু তফাতে গাছের ডগায়–এই যে আমি!

কাছে গিয়ে দেখি, একটা লম্বা গুঁড়িওয়ালা গাছের মগডালে প্রকাণ্ড হুতুমপাচার মতো বসে আছে সে। বললুম, নেমে এস শিগগির! অল ক্লিয়ার!

মোহন করুণ স্বরে বলল, নামতে পারছি না। পা পিছলে যাচ্ছে। লাফ দাও বরং!

ওরে বাবা! হাড়গোড় ভেঙে যাবে যে!

ভাঙবে না। ঝটপট লাফ দাও। মাটিটা নরম।

মোহন বলল, একটা মই খুঁজে আনো জয়ন্ত!

মই! অবাক হয়ে বললুম। এই বনবাদাড়ে কোথায় পাব! চড়তে পেরেছ যখন, নামতেও পারবে।

পারছি কই? চেষ্টা তো করছি!

খাপ্পা হয়ে বললুম, তাহলে থাকো! আমি কর্নেলের খোঁজে চললুম।

মোহন কঁদো কাঁদো গলায় বলল, যেও না জয়ন্ত, যেও না! ওরে বাবা! আমার বড় ভয় হচ্ছে।

ওকে না ডানপিটে ভেবেছিলুম! এত ভীতু, তা তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া গ্রামের ছেলে। গাছে চড়ার অভ্যাস থাকা উচিত। তার চেয়ে বড় কথা, গাছে চড়াটাই কঠিন, নামা, তো খুব সোজা।

রাগ করে কয়েক পা এগিয়েছি, পেছনে সড় সড় সড় ধপাস্ করে একটা শব্দ শুনে বুঝলুম মরিয়া হয়ে বেচারা নেমে পড়েছে।

মোহন এসে সঙ্গ নিল। বলল, বাস্! খুব শিক্ষা হল বটে! জীবনে এমন করে কখনও গাছে চড়িনি।

দু’জনে চারপাশে নজর রেখে হাঁটছিলুম। আর মাঝে মাঝে চাপা গলায় কর্নেলকে ডাকছিলুম। সাড়া নেই। তাহলে গাছে না চড়ে বুড়ো ঘুঘুমশাই পীরের বাড়িটায় গিয়ে ঢুকেছেন!

পীরের বাড়ির দরজা খোলা। ভাঙাচোরা অবস্থা। ভেতরে একটা উঠোন। খাপচা খাপচা জ্যোৎস্না পড়েছে। বারান্দায় উঠে দেখি, সেই ভুতো ঘরের ভেতর তেমনি চিত হয়ে পড়ে আছে। তবে কাটা ঠ্যাংটা নড়ছে না। তার নাক সমানে ডাকছে। লণ্ঠনটা তেমনি জ্বলছে।

লাল ভেলভেটে জরির কাজ করা একটা প্রকাণ্ড চাদরে পীরের কবর ঢাকা। হঠাৎ দেখি, কাপড়টা নড়ছে একপাশে। ভীষণ নড়তে শুরু করলে আঁতকে উঠে এতক্ষণে টর্চ জ্বাললুম। মোহন অস্ফুট স্বরে ‘ও কী’ বলেই চুপ করেছে। ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। আমারও। টর্চের আলোয় এই তাজ্জব কাণ্ড দেখলে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। কবরটা কি জ্যান্ত হয়ে উঠেছে? ভয়ে দম আটকে গেল।

তারপর ঢাকনাসুদ্ধ কবরের মাথার দিকটা মৃদু ঢঙ শব্দ করে বাক্সের ডালার মতো উঠে গেল। তারপর একটা টুপি পরা মাথা বেরুলো। তারপর যিনি বেরুলেন, তিনি আমার বহু বছরের গুরু ও বন্ধু মহাপ্রাজ্ঞ কর্নেলসায়েব! তবে তাঁর সাদা দাড়ি কবরের গুপ্ত সুড়ঙ্গের ময়লায় কালো হয়ে গেছে। তাকে যুবক দেখাচ্ছে। প্রথমে বললেন, আলো নেভাও ডার্লিং! চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তারপর কবরের ঢাকনা আগের মতো ঠিকঠাক করে দিয়ে বললেন, বুলবন পেশোয়ারীর পঞ্চাশ কিলো সোনার বাঁট ঠিক জায়গাতেই আছে। আপাতত ওখানেই থাক। কাল নটবর সিং তার বাহিনী নিয়ে এসে বরং এর কিনারা করবেন।

আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

কর্নেল বললেন, এখন সমস্যা হল ভুতোকে নিয়ে। ভুতো ঘুমের ভান করে পড়ে আছে কি না জানা দরকার। ওকে কাতুকুতু দাও তোমরা। দেরি কোরো না।

আমি আর মোহন কাছে যেতেই ভুতো তড়াক করে উঠে বসে হাউমাউ করে বলল, ওরে বাবা! কাতুকুতু দিলে আমি মরে যাব! দোহাই হুজুররা! ওই কাজটি করবেন না।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, দেখেছ! ওকে লক্ষ করে এ রকমই সন্দেহ হয়েছিল। আমরা। চলে গেলে ও কবরের গুপ্ত সুড়ঙ্গে ঢুকত আর সোনাটা হাতিয়ে কেটে পড়ত।

ভুতো নাক-কান মলে বলল, ছি ছি! সে কী কথা। সায়েব আমাকে সকালে দশ টাকা ভিক্ষে দিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন, বাবা ভূতো! আরও বখসিস পাবে, আমাদের সঙ্গে চলো!

ভুতো ভয় পাওয়া মুখে বলল, কোথায় যাব হুজুর? আমাকে তাহলে বাদশা-বেগমের পেটে পাঠিয়ে দেবে কাল্লু খাঁ!

কাল্লু খাঁ! মোহন চমকে উঠল। কালু ডাকাত? এই পীরের থানের সেবককে বছর দশেক আগে সে খুন করে ফেরারি হয়েছিল না?

কর্নেল, কালু খায়ের কথা দাদুর কাছে শুনেছি। আগে নাকি সে সার্কাসের দলে খেলোয়াড় ছিল। বাঘের খেলা দেখাত। আশ্চর্য, ব্যাপারটা অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল।

কর্নেল বললেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কালু খাঁর পক্ষেই দুটো বাঘ পোষা সম্ভব। পীরের থানের সেবককে খুন করে সে এখানেই আস্তানা গেড়েছে এতকাল। বাঘ দু’টোর ভয় দেখিয়ে ভক্তদের থানে আসা বন্ধ করেছে সে। দারুণ এলেমদার লোক! একটা বিতর্কিত চরে নিরাপদে ঘাঁটি গেড়ে বাস করছে।

বললুম, কিন্তু এই কবরের ভেতর গুপ্ত ঘর বা সুড়ঙ্গের কথা সে টের পেল না কেন?

কর্নেল বললেন, টের পায়নি, তা তো বুঝতেই পারছি। আসলে সে এমনটা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু বুলবন পেশোয়ারী যেভাবেই হোক টের পেয়েছিল, কবরের তলায় গুপ্ত ঘর আছে। সোনাটা সেখানে রেখে সে পালাচ্ছিল। বাদশা-বেগমের পাল্লায় পড়ে বেচারার প্রাণ যায়। মরার সময় সে শেষবার বলতে পেরেছিল-’পীরের তলায় সোনাটা…..। তাই শুনে কাল্লু খাঁ ভেবেছে, পীরের চরের কোথাও পোঁতা আছে। পীরের কবর কথাটা মুখে আসেনি পেশোয়ারীর। যাক গে, এবার কেটে পড়া যাক্। ভুতো আমাদের সঙ্গে এস।

ভুতোর আপত্তি টিকল না। আমি আর মোহন তাকে টেনে নিয়ে চললুম। শাসালুম, চেঁচালে বন্দুকের গুলিতে মুণ্ডু উড়ে যাবে। ভয়ে সে চুপ করে থাকল।

পানসি নৌকোয় উঠে বসলুম আমরা। এখন রাত বারোটা পনেরো। নৌকো ছাড়ার সময় পশ্চিমের জঙ্গলে বাঘ দুটোর প্রচণ্ড গর্জন শোনা যাচ্ছিল।

এক সময় আমরা পীরের চর ছাড়িয়ে পদ্মার স্রোতের উজানে পড়লুম। ভুতো আমার কষ্ট দেখে বলল, মেজ হুজুর! আমাকে দিন বরং। ঠ্যাং-ট্যাং কাটা গেলেও হাত দুটো তো আছে! আর বৈঠা আমি দু বেলা বাই।

ভুতো আর মোহন বৈঠা বাইতে থাকল। মনে হল, ভুতো লোকটা আসলে ভাল। পেটের দায়ে কালু খাঁর দলে ইনফরমার হয়ে ঢুকেছিল। রান্নাবান্না কাজকর্মও করে দিত। ভুতো সারা পথ সে কথা বলতে থাকল। শেষে বলল, একখানা ছিপ নৌকো লুকোনো আছে হুজুর। পশ্চিমের জঙ্গলের নীচে খাড়ির মধ্যে আছে। পুলিসকে বলবেন, খুঁজে বের করবে। আর হুজুর, দেখবেন, আমার যেন জেল না হয়। তাহলে আমার বউ ছেলেমেয়েরা বড় কষ্টে পড়বে। বরং, আমাকে বড় হুজুর একটা চাকরি জুটিয়ে দেবেন। তাহলেই হল।

মহিমবাবুর চরের কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা কর্নেল, আপনি কীভাবে জানলেন কবরের তলায় গুপ্ত ঘর আছে?

কর্নেল বললেন, কাল্লু খাঁ বুলবনের মরার সময়কার কথাটা যখন বলল, তখনই সন্দেহ হয়েছিল। ‘পীরের তলায় সোনাটা’–এর মানে কী হতে পারে? পীর যেখানে শুয়ে আছেন অর্থাৎ পীরের কবর, তার তলায়।

ধন্য আপনার বুদ্ধি! মোহন তারিফ করে বলল।

মহিমবাবুর চরে পৌঁছুতে রাত তিনটে বেজে গেল। যাবার সময় স্রোতের ভাটিতে গিয়েছিলুম। ফেরার সময় উজানে বলে এত বেশি সময় লাগল।

উদ্বেগে মাঝিরা ঘুমোতে পারেনি। আমাদের দেখে উঠে বসল। বলল, পীরের জঙ্গলে বাঘের ডাক শুনে আমরা খুব ভয় পেয়েছিলুম হুজুর। এখন ওই শুনুন! বন্দুকের আওয়াজও হচ্ছে। সবই ভূতপেরেতের কাণ্ড।

কর্নেল কান খাড়া করে কী শুনছিলেন। বললেন, খুব গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে পীরের চরে। তাহলে কি কাশেম খাঁর সঙ্গে কালু খাঁর লড়াই বেধে গেল?

আবছা গুলির শব্দ আর মাঝে বাঘের গর্জন ভেসে আসছিল পীরের চর থেকে। জ্যোৎস্নায় ওদিকটা ধূসর। পদ্মার বুকে ঘন কুয়াশা জমেছে। এক সময় কর্নেল বললেন, শুয়ে পড়া যাক। মোহন, তুমি সকাল সকাল বেরিয়ে যাবে। সাইকেল করে ঝটপট নটবর সিংয়ের ক্যাম্পে যাবে। আমার চিঠি নিয়ে যেও।

সকালে আবার আমরা পীরের চরে গেলুম। এবার বর্ডার বাহিনীর মোটর লঞ্চে চেপে। গিয়ে যা দেখলুম, গা শিউরে উঠল। এমন বীভৎস দৃশ্য কখনও দেখিনি।

কালু খাঁ, জনার্দন, গদাই, রহিম বকশ মড়া হয়ে পড়ে আছে পুবের বালিয়াড়িতে। সারা গা গুলিতে ক্ষতবিক্ষত। পশ্চিমের জঙ্গলে বাঘ দুটো-বাদশা আর বেগমও তেমনি ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে। কাশেম খাঁ কাকেও রেহাই দেয়নি। বেচারা ভুতো জোর বেঁচে গেছে!

কবরের ঢাকনা তুলে পঞ্চাশ কিলোগ্রাম সোনার বাঁট উদ্ধার করা হল। সোনাটা প্রাক্তন পাকিস্তান স্টেট ব্যাঙ্কের ঢাকা শাখার। কাজেই ওটা ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে ফিরিয়ে দেবেন।

মহিমবাবুর চরে আমরা আরও দিন দুই ছিলুম। কর্নেল ‘বখাস’, না আবিষ্কার করে কলকাতা ফিরবেন না। তাঁর বক্তব্য, এবার পদ্মার চরে সত্যি সত্যি বিরল প্রজাতির ওই পক্ষী দর্শনেই এসেছি। স্বপ্নেও ভাবিনি, পীরের চরে এত সব রহস্য আছে! দৈবাৎ গিয়ে পড়েছিলুম এবং সোনার কথা জানতে পারলুম কালু খাঁর মুখে। তবে হ্যাঁ; নটবর সিংয়ের কাছে তো বটেই, সদাশিববাবুর কাছেও কালু খাঁর গল্প শুনেছিলুম। সে সার্কাসে ছিল এক সময়, তাও শুনেছিলুম। তাই যখন পীরের জঙ্গলে জোড়া বাঘের গুজব শুনলুম, তখন মনে হল একটা যোগসূত্র থাকতেও পারে। সেজন্যে পীরের জঙ্গলে উঁকি মারতে গিয়েছিলুম। আমি কিন্তু আজও এ-কথা বিশ্বাস করিনি। এই ধুরন্ধর বৃদ্ধ গোয়েন্দাপ্রবরের সব ব্যাপারই রহস্যময়। এমন তো হতে পারে, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে হারানো সোনার জন্য ভারত সরকার গোপনে তদন্ত করছিলেন এবং সুযোগ্য ঘুঘুমশাইটিকেই এ ব্যাপারে পদ্মার চরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন!

আরও একটা কথা। খঞ্জ মানুষ ভূতোকে বেমক্কা দশ টাকা দান করাও কি কর্নেলের কুসংস্কার না কোনো গোপন অভিসন্ধি ছিল, বলা কঠিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *