দ্য স্ক

দ্য স্ক

এক

সে সময় তেমন একটা রমরমে অবস্থা ছিল না নুরেনবার্গের। পর্যটকদের মধ্যে খুব কম লোকই জানত এই পুরানো শহরটা সম্পর্কে। আমরা বেরিয়েছিলাম হানিমুনে। তখন দ্বিতীয় সপ্তা চলছে, স্বভাবতই এই অচেনা জায়গায় তৃতীয় কারও সঙ্গ কামনা করছিলাম। ঠিক এ সময় হাসিখুশি আগন্তুক এলিয়াস পি. হাচিসনের সাথে দেখা। ব্লিডিং গাশের ইস্থমেইন সিটি থেকে এসেছে সে। জায়গাটা ম্যাপল ট্রি কাউন্টিতে। ফ্রাঙ্কফোর্ট স্টেশনে আমাদের পরিচয়। কথা প্রসঙ্গে টের পেলাম, ইউরোপের একটি শহরের সবচেয়ে প্রাচীন জায়গা পরিদর্শন করতে যাচ্ছে সে। আর আকারে- ইঙ্গিতে এলিয়াস এটাও বোঝাল, একটা লোক যতই বুদ্ধিমান আর কর্মঠ হোক, একাকী দীর্ঘ ভ্রমণে বেরোলে একটা পর্যায়ে বিষণ্ণতা ছেঁকে ধরে তাকে। তার ইঙ্গিতটাকে লুফে নিলাম আমরা এবং প্রস্তাব দিলাম, সে ইচ্ছে করলে যোগ দিতে পারে আমাদের সাথে। দলটা ভারী হবে আমাদের।

শুরুতে কথাবার্তায় আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। কিংবা জড়তাও বলা যায় একে। কিন্তু উভয়ের আন্তরিকার গুণে কেটে যায় এই জড়তা। এবং এলিয়াস পি. হাচিসন আমাদের দলেরই একজন হয়ে যায়। এতে অ্যামেলিয়া আর আমার বেশ লাভই হলো। হাচিসনের কল্যাণে আনন্দমুখর হয়ে উঠল আমাদের সময়। আমার আর ওর মধ্যে শেষদিকে যে ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছিল, তৃতীয় পক্ষের আগমনে অবসান ঘটল তার। যেসব ব্যাপার নিয়ে অ্যামেলিয়া আর আমার মধ্যে মতের মিল হতো না, হাচিসন আসার পর থেকে দেখলাম ওসব ব্যাপারে চমৎকার বোঝাপড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর। একসময় অ্যামেলিয়া তো ঘোষণাই দিয়ে বসল, যে দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ও ফিরে যাচ্ছে, ওর সব বন্ধুকে পরামর্শ দেবে, হানিমুনে গেলে তারা যেন কোনো বন্ধুকেও সাথে নিয়ে যায়।

পুরো নুরেনবার্গ একসঙ্গে ঘুরলাম আমরা। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসা বন্ধুটির প্রাণচাঞ্চল্য চাঙা করে তুলল আমাদের। বাকপটু হাচিসন অ্যাডভেঞ্চারের বিস্ময়কর এক ভান্ডার। এটুকু জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে।

নুরেনবার্গে আমাদের শেষ পরিদর্শনের জায়গা হিসেবে নির্ধারিত ছিল দ্য বার্গ। যথাসময়ে তিনজন বেরিয়ে পড়লাম শহরের পুব দিকের দেয়াল বরাবর বাইরের পথ ধরে।

দ্য বার্গ। শহরের পাহাড়ি এলাকায় জায়গাটা। উত্তর দিকে গভীর এক খাদ। নুরেনবার্গের মানুষ একটা দিক দিয়ে সুখী যে এখানে লুটতরাজ হয়নি কখনো। যদি সেরকম অরাজকতামূলক কিছু ঘটত, তা হলে আর এখনকার মতো নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারত না এ শহর। খাদটা দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ছিল। তা কয়েকশ বছর তো হবেই। এখন সুন্দর চা বাগান গড়ে উঠেছে খাদটাতে। বেড়া দেওয়া ফলের বাগানও ছড়িয়ে পড়েছে বেশ। এখানকার কিছু গাছপালা খুবই দামি। জুলাইয়ের তেজি রোদ মাথায় নিয়ে নগর দেয়ালের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই আমাদের থমকে দাঁড়াতে হচ্ছিল অপার মুগ্ধতা নিয়ে।

আমাদের সামনে যে দৃশ্যাবলি একের পর এক আছে, তা সত্যি অপরূপ! বিশেষ করে সুবিশাল সমতলজুড়ে গড়ে ওঠা শহর আর গ্রামগুলো। সেগুলো আবার নীল রেখার মতো পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ঠিক যেন ক্লদ লরিয়েনের আঁকা ল্যান্ডস্কেপ। রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। নতুন এক আনন্দে ভরে উঠল মনটা। জমির পর জমিজুড়ে সারি সারি বাড়ি। একই ধাঁচের। একের পর এক কারুকাজ করা লাল ছাদের সমাবেশ। আমাদের অল্প একটু ডান ধারেই দ্য বার্গ-এর টাওয়ারগুলো দাঁড়িয়ে। আর সেই ভীমদর্শন অটল অবিচল টর্চার টাওয়ারটাও বেশ কাছে। এটাই এ শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। আগেও ছিল, এখনো আছে। টর্চার টাওয়ারের মূল প্রাণ হচ্ছে আয়রন ভার্জিন। অত্যাচারের জীবন্ত প্রতীক এই শাস্তি। শত শত বছর ধরে জিইয়ে আছে নুরেনবার্গের এই আয়রন ভার্জিনের ঐতিহ্য। নাম শুনলেই নিষ্ঠুরতার একটা আতঙ্ক তাৎক্ষণিকভাবে নাড়া দিয়ে যায় সবাইকে। একটা মানুষের পক্ষে যতটুকু হজম করা সম্ভব, ততটুকুই এই আতঙ্কের তীব্রতা। আমরা দীর্ঘ সময় ধরে উদগ্রীব আয়রন ভার্জিনকে দেখার জন্য। এবং অবশেষে তার বাড়িতে এসে পৌঁছেছি।

চলার পথে মাঝেমধ্যে থেমে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। যাত্রাবিরতিতে একবার খাদের প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়ানো দেয়ালের উপর দিয়ে তাকালাম নিচের দিকে। বাগানটা আমাদের কাছ থেকে পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট নিচে। গনগনে সূর্যের আলো জ্বলন্ত চুলোর মতো তাপ ছড়াচ্ছে বাগানটাতে। ধূসর এবং ভারি অসম্ভব উঁচু দেয়ালটি। ডান আর বাঁ দিকে দুটি বুরুজের মাঝে হারিয়ে গেছে। নিচে বিলীন হয়েছে ঢালু পার্শ্বদেশে। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে প্রায় ঢেকে আছে দেয়ালটা। এরই মাঝ দিয়ে আবার দেখা যাচ্ছে উঁচু উঁচু দালান, সেগুলোর গুরুগম্ভীর সৌন্দর্যকে ধরে রেখেছে দীর্ঘ সময়। এ মুহূর্তে গরমটাও যেমন পড়েছে, তেমনি আলিস্যিতেও পেয়ে বসেছে আমাদের। প্রচুর সময় আমাদের হাতে। এবং সময়টা হেলায় ফেলায় কাটাচ্ছি। ঝুঁকে আছি দেয়ালের উপর।

ঠিক আমাদের নিচেই-সুন্দর একটি দৃশ্য। বিশাল এক কালো বেড়াল লম্বা হয়ে শুয়ে আছে রোদে গা পেতে। তার চারদিকে তিড়িংবিড়িং নেচে বেড়াচ্ছে ছোট্ট এক বেড়ালছানা। এটাও কালো। অর্থাৎ মা আর তার দুষ্টু খোকা আমাদের মতোই অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে। ছানাটিকে খেলায় উৎসাহ দেয়ার জন্য লেজ নাড়াচ্ছে মা। আর যখন ওটা একদম মায়ের কাছে চলে আসছে, তখন পা দিয়ে ছানাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে মা, যাতে ছানাটি আবার একইভাবে কাছে আসে। দেয়ালের একদম কাছ ঘেঁষেই রয়েছে বেড়াল আর তার ছানাটি। তাদের কাণ্ড দেখে এলিয়াস পি. হাচিসনের মাথায়ও দুষ্ট বুদ্ধি গজাল। পথ থেকে ছোট একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিল সে।

‘দেখো!’ বলল সে। ‘এই পাথরটা ঠিক আমি বেড়ালছানার সামনে ফেলব। মা আর বাচ্চা দুটোই বেশ চমকে উঠবে। অবাক হয়ে ভাববে- আরে এটা আবার এল কোত্থেকে?’

‘তবে খুব সাবধান,’ বলল আমার স্ত্রী। ‘সুন্দর ওই বেড়ালছানার মাথায়ও কিন্তু লাগতে পারে পাথর!’

‘আরে না, ম্যাডাম,’ বলল এলিয়াস। ‘অত কাঁচা ভাববেন না আমাকে। অত্যন্ত সতর্ক লোক আমি। দেখবেন ঈশ্বরের দয়ায় সামান্য ভড়কে দেয়া ছাড়া একটুও আঘাত করব না ওই বেড়ালছানাটিকে। এ ব্যাপারে আপনি আপনার রঙিন মোজা জোড়া দিয়ে বাজি ধরতে পারেন। দেখুন, এই যে পাথরের টুকরোটা ফেলছি আমি। এটা আমি ওদের যথেষ্ট দূর দিয়ে ফেলব, কাজেই আঘাত করার প্রশ্নই ওঠে না। হে ঈশ্বর, আঘাত যেন না লাগে। ছু মন্তর ছুঁ!’

এই বলে দেয়ালের উপর ঝুঁকে নিচের দিকে সজোরে পাথরটা ছুড়ে মারল সে। জানি না এই ঢিলের ভিতর অজানা কী আকর্ষণ শক্তি ছিল, যা ছোট্ট একটি ব্যাপারকে মুহূর্তেই গুরুতর করে তুলল। খুব সম্ভব দেয়ালটি খাড়া না হয়ে নিচের দিকে খানিকটা ঢালু হয়ে যাওয়ায় নিশানা ঠিক রাখতে পারেনি হাচিসন। ওই ঢালু অংশটি উপর থেকে দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় পাথরটা ওখানে লেগে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তা যাই হোক, গরম বাতাস ভেদ করে নিচ থেকে যে শব্দটা এল, তা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। পাথরটা সোজা গিয়ে আঘাত হেনেছে বেড়ালছানাটির মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে চৌচির। ছোট্ট মগজটা ছড়িয়ে ছত্রখান।

কালো বেড়ালটি চকিতে উপরের দিকে তাকাল। ওটার চোখ দুটি সবুজ আগুনের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল আমাদের সামনে। মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি স্থির হলো এলিয়াস পি. হাচিসনের ওপর। পরমুহূর্তে চোখ দুটি নামিয়ে নিল ওটা। স্থির হলো বাচ্চার উপর। মৃত্যু-যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠছে ওটার খুদে শরীর। মাথার ক্ষতের হাঁ থেকে বয়ে চলেছে রক্তের সরু নহর। ঠিক একটা মানুষের মতোই চাপা আর্তনাদ ছেড়ে ছানাটির উপর ঝুঁকে পড়ল বেড়ালটি। গোঙাতে গোঙাতে চাটতে লাগল ছানার ক্ষত। সহসা যেন সে টের পেয়ে গেল, তার বুকের ধন আর বেঁচে নেই। এবং আবার চোখ তুলে তাকাল আমাদের দিকে। দৃষ্টিতে নিখাদ ঘৃণা। জীবনে কোনোদিন ভুলব না এই দৃশ্য। প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করছে এক জোড়া সবুজ চোখে রক্তমাখা মুখ আর গোঁফের ফাঁক দিয়ে ঝিলিক দিচ্ছে সুতীক্ষ্ণ সাদা দাঁত

দাঁত খিঁচিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করতে লাগল কালো বেড়ালটি। প্রতিটি থাবা থেকে বেরিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ নখর। সহসা বেড়ালটি সবেগে ছুটে এল দেয়ালের দিকে। উপরের দিকে ঝেড়ে দিল লাফ, যেন আমাদের পাকড়াও করতে চায় ওটা। কিন্তু লাভ হলো না কোনো। বরং উল্টো পড়ে গেল বেড়ালটি। পরমুহূর্তে আরেক বীভৎস দৃশ্যের অবতারণা করল আক্রোশে অন্ধ বেড়ালটি। সোজা মৃত ছানাটির উপর পড়ে গিয়েছিল ওটা। যখন উঠে দাঁড়াল, পিঠের রোমগুলো মগজ আর রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে।

এদিকে বেড়ালের কাণ্ড দেখে একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে অ্যামেলিয়া। ওকে দেয়াল থেকে সরিয়ে আনলাম আমি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছগুলোর ছায়ায় একটা বসার জায়গায় নিয়ে গেলাম। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল ও। এবার ফিরে গেলাম আবার হাচিসনের কাছে। একদম নট নড়ন চড়ন হয়ে দেয়ালের উপর ঝুঁকে আছে সে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিদ্বেষী বেড়ালের দিকে।

পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই হাচিসন বলল :

‘জানেন, ঠিক এরকম চরম বিদ্বেষ দেখেছিলাম এক অ্যাপাচি মেয়ের মাঝে। স্প্লিন্টার্স নামে একজনের মাকে পুড়িয়ে মেরেছিল অ্যাপাচিরা। লোকটা হাফব্রিড। তো এই স্প্লিন্টার্স এক রেইড থেকে চুরি করল ওই অ্যাপাচি মেয়ের শিশুকে। মেয়েটি মনের ভেতর গেঁথে রাখল স্পিস্নন্টার্সের চেহারা। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মেয়েটি ধাওয়া করল স্প্রিন্টার্সকে। তারপর যখন খোঁজ পেল, অ্যাপাচিরা গিয়ে পাকড়াও করল তাকে। তুলে দিল ওই বিদ্বেষিণীর হাতে। সবাই বলে, সাদা বা কালো যেই হোক না কেন, এর আগে কাউকে এমন নির্মম শাস্তি ভোগ করে মরতে হয়নি অ্যাপাচিদের হাতে। ওই বিদ্বেষিণীকে শুধু একবারই আমি মৃদু হাসতে দেখেছি, যখন তাকে শেষ করে দিই। আর আমি ওই ক্যাম্পে যখন পৌঁছাই, তখন স্প্লিন্টার্সেরও শেষ সময় হাজির। বিশ্বাস করুন, স্প্লিন্টার্সকে যে নরক যন্ত্রণা দেয়া হয়, তার চিহ্নস্বরূপ তার গা থেকে খসে পড়া এক টুকরো চামড়া রেখে দিয়েছি আমি। আমার সাথে পকেট বুকের ভেতর আছে ওটা!’ কোটের বুক পকেটে চাপড় মেরে দেখাল সে।

হাচিসন যখন আমাকে এসব বলছে, তখন কিন্তু থেমে নেই প্রতিশোধপরায়ণ বেড়াল। দেয়াল টপকে উপরে ওঠার জন্য উন্মত্তের মতো লাফিয়ে চলেছে ওটা। প্রথমে কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে, তারপর সবেগে ছুটে এসে দিচ্ছে লাফ সর্বশক্তিতে। মাঝেমধ্যে অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চতায় উঠে আসছে ওটা। প্রতিবারই দড়াম করে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মালুম করছে না। পড়েই আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ছুটে আসছে আরেকবার লাফ দিতে। আর ক্রমেই যেন ভয়ংকর হয়ে উঠছে ওটার লম্ফ। হাচিসন মানুষটা দয়ালু। আমার স্ত্রী এবং আমি দুজনেই তার এই গুণটির ছোটখাটো প্রমাণ পেয়েছি জীবজন্তু এবং মানুষের প্রতি আচরণ দেখে। বেড়ালটির বেপরোয়া ভাব দেখে উদ্বিগ্ন মনে হলো তাকে।

‘মনে হচ্ছে,’ বলল হাচিসন। ‘মাথাটা একেবারে বিগড়ে গেছে বেচারির। আহ, বেচারি, এটা তো নিছকই একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু ব্যাপারটা ওকে বোঝাই কী করে? ওর বাচ্চাটাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। বলুন, কর্নেল, এরকম অঘটন আমি চেয়েছিলাম! কেমন অপদার্থ লোক আমি- সামান্য এক বেড়ালের সাথে খেলতে পারি না! বলুন, কর্নেল, বলুন!’ এটা একটা ভালো দিক যে স্বচ্ছন্দে আমার কাছে খেদ প্রকাশ করতে পারছে সে। ‘আশা করি, আপনার স্ত্রী আমার প্রতি কোনো রাগ পুষে রাখবেন না। দেখলেনই তো, এটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করিনি আমি।’

অ্যামেলিয়ার কাছে এসে করজোড়ে মাফ চাইল হাচিসন। অ্যামেলিয়া ওর স্বভাবসুলভ দয়া দেখাতে কার্পণ্য করল না। সঙ্গে সঙ্গে হাচিসনকে নিশ্চিত করল, ব্যাপারটা যে নিছক দুর্ঘটনা-এটা ভালো করেই জানে ও।

আমরা সবাই আবার ফিরে গেলাম দেয়ালটার কাছে। উঁকি দিলাম নিচে।

হাচিসনকে দেখতে না পেয়ে পেছনে ফিরে গিয়ে এমনভাবে বসে আছে বেড়ালটা, যেন আবার লাফ দেয়ার জন্য উদগ্রীব। এবং হাচিসনকে দেখা মাত্র লাফ দিল ওটা। অন্ধ একটা অযৌক্তিক আক্রোশ। অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু এটাই একমাত্র বাস্তব। ভয়ংকর বাস্তব! বেড়ালটা এখন আর আগের মতো তেড়ে আসছে না দেয়ালের দিকে। ওখানে বসে বসেই আক্রোশ ঝাড়ছে। যেন ঘৃণা আর বিদ্বেষ দুটো পাখা ধার দিয়েছে বেড়ালটাকে। আর সে পাখা দুটোতে ভর করে হাচিসনের উপর ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে ওটা।

মেয়েদের মন এমনিতেই নরম, বেড়ালের কাণ্ড দেখে অ্যামেলিয়া বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। হাচিসনকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘খুব সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে। বাগে পেলে আপনাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করবে না ওই জানোয়ার। খুনের নেশায় জ্বলছে ওটার চোখ দুটো!’

হো হো করে হেসে উঠল হাচিসন। বলল, ‘মাফ করবেন, ম্যাডাম। আমি হাসলাম ঠিকই কিন্তু আপনাকে হাসাতে পারছি না। কল্পনা করুন তো একবার, যে লোক গ্রিজলি ভালুক মেরেছে, ইন্ডিয়ানদের সাথে ফাইট করেছে, এটা সামান্য বেড়ালের থাবায় মারা পড়ার ভয়ে তার সাবধান হওয়া কি সাজে!’

হাচিসনের হাসি শুনে বেড়ালটির আচরণ যেন বদলে গেল সহসা। আগের মতো আর দেয়ালের দিকে তেড়ে আসার কোনো চেষ্টা করল না বা লাফ দিল না। শান্তভাবে ফিরে গেল নিজের মৃত বাচ্চাটির কাছে। বাচ্চাটির গা চেটে চেটে এমনভাবে আদর করতে লাগল, যেন এখনো বেঁচে আছে ওটা।

‘সত্যিকারের পৌরুষ থাকলে যা হয় আর কী,’ বললাম হাচিসনকে। ‘চূড়ান্ত রকমের আক্রোশ নিয়েও জন্তুটা ঠিকই চিনতে পেরেছে ওস্তাদ লোকের কণ্ঠ, এবং হাল ছেড়ে দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করেছে!’

‘হ্যাঁ, করেছে-আমার দেখা সেই অ্যাপাচি বিদ্বেষিণীর মতো!’ শুধু এটুকু মন্তব্যই বেরোল এলিয়াস পি. হাচিসনের মুখ থেকে। আবার রওনা হলাম আমরা। নগর দেয়াল ধরে এগোতে লাগলাম ধীরে ধীরে। চলার পথে যখনই মাঝেমধ্যে দেয়ালের উপর দিয়ে উঁকি দিলাম, দেখি—আসছে বেড়ালটি। অনুসরণ করছে আমাদের।

দুই

প্রথম দিকে অনুসরণের ধরনটা ছিল এমন-কিছু দূর এসে আবার এক ছুটে মৃত ছানাটির কাছে চলে যেত ওটা। তারপর দূরত্ব যখন বেড়ে চলল, ওটা ছানাটিকে মুখে তুলে নিল একসময়। এরপর আর ফেরাফেরি নেই, একটানা অনুসরণ। খানিক পরে ছানাটি উধাও হয়ে গেল তার মুখ থেকে, নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। এখন শুধু একাকী পিছু নিয়েছে আমাদের।

বেড়ালের জেদ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল অ্যামেলিয়া। বারবার হাচিসনকে সতর্ক করে দিতে লাগল। কিন্তু আমেরিকানটা প্রতিবারই হেসে উড়িয়ে দিল অ্যামেলিয়ার কথা। শেষে যখন দেখল, অ্যামেলিয়া সত্যিই ভীষণ শঙ্কিত, বলল, ‘আমি আপনাকে অভয় দিচ্ছি, ম্যাডাম, ওই বেড়াল নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনোই কারণ নেই আপনার। এই যে, দেখুন, ওটাকে মেরামত করার জিনিস আছে আমার কাছে!’ কোমরের পেছনে পিস্তলের খাপে চাপড় মারল সে। ‘সেরকম বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালে, গুলি করব ওটাকে। যদিও একজন আমেরিকাবাসী হিসেবে এখানে অস্ত্র বহন করা আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আইনের প্যাচে ফাঁসিয়ে দিতে পারে পুলিশ।’

এভাবে কথা বলতে বলতে হাচিসন আবার যেই ঝুঁকেছে দেয়ালের ওপর, দেখে দিব্যি আছে বেড়ালটি, একদম তার দিকে তাকিয়ে। হাচিসনের চোখে চোখ পড়ায় ‘গরর’ করে বিদ্বেষ ঝাড়ল ওটা, পরমুহূর্তে গা ঢাকা দিল লম্বা এক ধরনের ফুলগাছের ঝোপে। হাচিসন বলে চলল, ‘এখন বেড়ালটির মাথায় শুভবুদ্ধির উদয় হলেই ভালো। মনে হচ্ছে, বেড়ালটির সাথে এটাই আমাদের শেষ দেখা! আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বেড়ালটি এখন ফিরে যাবে মৃত বাচ্চাটির কাছে। নিজস্ব পদ্ধতিতে পালন করবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।’

অ্যামেলিয়া কোনো কথা বলল না। পাছে হাচিসন বেড়ালটিকে সত্যিই নির্দয়ভাবে গুলি করে বসে, এ ভয়েই হয়তোবা তাকে ঘাঁটাল না সে। কাঠের ছোট্ট সেতু পেরিয়ে গেটওয়ের দিকে এগোলাম আমরা। ওখান থেকে নুড়ি বিছানো রাস্তা খাড়া চলে গেছে দ্য বার্গ আর পঞ্চভুজ আকৃতির টর্চার টাওয়ারের দিকে। সেতু পেরোবার সময় নিচে আবার বেড়ালটাকে দেখা গেল। আমাদের দেখামাত্র আক্রোশ ফিরে এল ওটার এবং খাড়া দেয়াল পেরোবার জন্য উন্মত্তের মতো লাফালাফি শুরু করল আগের মতো। হাচিসন ওটার কাণ্ড দেখে হেসে বলল, বিদায়, বুড়ো খুকি। তোমার মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করার জন্য আমি দুঃখিত। তবে একসময় এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে তুমি। বিদায়!’

লম্বা, অনুজ্জ্বল খিলান ঢাকা পথ পেরিয়ে দ্য বার্গের প্রবেশপথে এসে গেলাম আমরা।

অত্যন্ত চমৎকার একটি পুরাকীর্তি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেরিয়ে এলাম তিনজন। চল্লিশ বছর আগে পুনরুদ্ধার করা এই পুরাকীর্তি গথিক স্থাপত্যের নির্দশন। কোনো যত্ন আত্তি না থাকায় আগের সেই জৌলুশ আর নেই। অথচ একসময় এটা ছিল ঝকমকে সাদা। দ্য বার্গের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এতই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম, সকালের দুঃখজনক ঘটনাটির কথা ভুলেই গেলাম একরকম।

দেখার মতো অনেক কিছুই আছে এখানে। একটি লেবুগাছ আছে প্ৰায় নয়শ বছর আগের। বিশাল ওটার গুঁড়ি। তাতে আবার কালের সাক্ষী হয়ে আছে গ্রন্থিল জট। পাহাড়ের ঠিক মাঝবরাবর রয়েছে গভীর এক কূপ। পুরানো দিনের বন্দীদের দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কূপটা। নগর দেয়াল থেকে এই সুন্দর দৃশ্য দেখার কথা এর আগে শুনেছিলাম আমরা, এবার প্রাণ ভরে উপভোগ করতে লাগলাম। প্রায় মিনিট পনেরো এখানেই কাটিয়ে দিলাম তিনজন। আর দ্য বার্গের এই বিচিত্র সৌন্দর্য আমাদের মন থেকে পুরোপুরি মুছে দিল বেড়ালছানাটির অপমৃত্যুর ঘটনা।

এরপর টর্চার টাওয়ারে ঢুকলাম তিনজন। এই সকালে আমরাই শুধু এর দর্শনার্থী—অন্তত দেখভালের কাজে নিয়োজিত বুড়ো লোকটার ভাষ্য অনুযায়ী তাই। ফলে গোটা জায়গাটাই যেন এক মিনিটের মধ্যে আমাদের দখলে চলে এল। আর যেহেতু এ মুহূর্তে আমরাই শুধু দর্শনাথী, কাজেই অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখনকার পরিদর্শন আমাদের জন্য একটু সহজতর হয়ে উঠেছে।

টর্চার টাওয়ার সত্যিকার অর্থেই একটি ভয়ংকর জায়গা। এমনকি এখনো, এই যে হাজার হাজার দর্শনার্থীর পা পড়ছে এখানে, বয়ে যাচ্ছে উচ্ছল প্রাণের বন্যা, এরপরেও চূড়ান্ত রকমের একটা ভয় লুকিয়ে আছে জায়গাটার মধ্যে। অন্তত এ মুহূর্তে পরিবেশটা ঠিক তাই। যুগ যুগ ধরে জমে থাকা ধুলোর স্তর যেন গ্যাঁট হয়ে বসেছে জায়গাটায়। প্রগাঢ় অন্ধকারের সাথে আতঙ্কের সেই স্মৃতিগুলো এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায়।

নিচের কুঠুরিতে আছি আমরা। এটার স্বাভাবিক যা চেহারা, তাতেই হিম হয়ে আসে বুক, আর যখন শাস্তির জন্য ব্যবহৃত হতো, তখন না জানি কত করালদর্শন ছিল এটা! পুরো প্রকোষ্ঠজুড়ে এমন অন্ধকার, যেন মুঠি করলে ধরা যাবে নিরেট কালো পিণ্ড। দরজা দিয়ে গরম রোদ আসছে ঠিকই, কিন্তু মালুম হচ্ছে না। কুঠুরির দেয়ালগুলোর ব্যাপক পুরুত্ব শুষে নিচ্ছে যেন সব আলো। এরপরেও দালানের নিখুঁত কারুকাজ নজর এড়াল না। অল্প একটু খুঁত যা আছে, রাজমিস্ত্রীরা কাজ শেষে তাদের মাচা নামানোর পর টুকটাক যা মেরামত করেছে-তাই। দেয়ালের এখানে-ওখানে ধুলো জমে থাকা কালো কালো ছোপ। যদি দেয়ালগুলো কথা বলতে পারত, তাহলে ওগুলো রোমন্থন করতে পারত ভয় আর যন্ত্রণার ভয়াবহ সেই স্মৃতি।

আমরা এবার হৃষ্টচিত্তে কাঠের সিঁড়িটার দিকে এগোলাম। একগাদা ধুলো জমে আছে সিঁড়িটায়। তত্ত্বাবধায়ক লোকটা বাইরের একটা দরজা খোলা রাখল খানিকটা আলো আসার জন্য। দেয়ালের এক জায়গায় একটা বাতিদানে মোম জ্বলছে। কিন্তু ওটার অপর্যাপ্ত আলো আধার দূর করার বদলে আরও ভুতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশ।

হাঁটতে হাঁটতে যখন আমরা একটা ট্র্যাপ ডোর দিয়ে উপরে চলে এলাম, অ্যামেলিয়া আমাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরল, পরিষ্কার শুনতে পেলাম ওর হৃৎকম্পন। নিচ থেকেই জানালার একটা খাপছাড়া ব্যাপার লক্ষ করে আসছি। মধ্যযুগীয় প্রতিরোধব্যবস্থায় প্রাচীন দুর্গগুলোতে যেমন সরু ধাঁচের ছোট ছোট জানালা দেখা যায়, ঠিক তেমনি এই টাওয়ারের জানালাগুলো আকারে বেশ ছোট। তাও হাতে গোনা অল্প কটি রয়েছে। জানালা না বলে বরং সরু একটি আলো আসার পথ বললেই ভালো মানায়। আর জানালাগুলো দেয়ালের এত উঁচুতে-ওগুলো ভেদ করে আকাশ দেখার কোনো উপায় নেই। দেয়ালের তাকে এবং এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে জল্লাদের একগাদা তলোয়ার। প্রতিটি তলোয়ার এমন ভারী, দু’হাত ছাড়া চালানোর জো নেই। আর বেশ ধারালোও বটে। কাছেই কয়েকটি শিরশ্চেদের ব্লক, যেখানে ভিক্টিমদের ঘাড়গুলো পেতে দ্বিখণ্ডিত করা হতো। ব্লকগুলোর কাঠের গায়ে গভীর কাটা মাংস ভেদ করে এসে লাগার ফলেই দাগগুলোর সৃষ্টি। এ ছাড়া গোটা কুঠুরিজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শাস্তিদানের আরও হরেক রকমের উপকরণ।

এই কুঠুরিতে আতঙ্ক সৃষ্টির যত রকমের উপকরণ রয়েছে, এগুলোর শিরোমণি হচ্ছে আয়রন ভার্জিন। যন্ত্রটি ঘরের প্রায় মাঝখানে। কর্কশ আদলে তৈরি একটি নারীমূর্তি। অনেকটা ঘণ্টার মতো গড়ন। তুলনাটা আরেকটু জোরাল হয় ছোটদের খেলনা পুতুল মিসেস নোয়ার সাথে দাঁড় করালে। তবে নোয়ার মতো ক্ষীণ কটি এবং সুগঠিত নিতম্ব নেই এটার। আসলে এটা যে একটা নারীমূর্তি, চিনে নেয়া বড় কষ্টের ব্যাপার। মরচে ধরা যন্ত্রটার উপর ধুলো জমে আছে একগাদা। মূর্তিটির যেখানে কোমর থাকার কথা, সেখানে একটা রিঙের সাথে দড়ি বাঁধা। আর দড়িটা একটা কপিকলের মাধ্যমে চলে গেছে একটা কাঠের পিলারে।

টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক লোকটি দড়ি টেনে দেখাল, আয়রন ভার্জিনের সামনের একটা অংশ কব্জা লাগানো ডালার মতো খোলা যায়। পরে দেখলাম, যন্ত্রটির ভেতরটা নিরেট নয়। একটা মানুষ ঢোকা যাবে-এমন পরিসর নিয়ে তৈরি। আর ডালাও একখান বটে। দড়ি টেনে ওটা তুলতে গিয়ে বারোটা বেজে গেল তত্ত্বাবধায়কের। কপিকলের সুবিধে থাকা সত্ত্বেও সর্বশক্তি খাটাতে হলো তাকে। ডালাটি ভারী রাখা হয়েছে বিশেষ কারণে। যখন দড়িতে ঢিল দেয়া হবে, সঙ্গে সঙ্গে ওটা নিজের ভারেই নেমে আসবে নিচে 1

যন্ত্রটার ভেতর মৌচাকের মতো বাসা বেঁধেছে মরচে। সময়ের প্রবাহে গভীরভাবে খেয়ে দিয়েছে দেয়ালগুলো। মরচের নিষ্ঠুর দাগগুলো ফুটে আছে প্রকটভাবে।

আমরা যখন যন্ত্রের ভেতরটা ভালো করে দেখার জন্য দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, এটার নারকীয় উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি ধরা পড়ল আমাদের চোখে। কয়েকটি বড় বড় লোহার কাঁটা রয়েছে যন্ত্রটার ডালায়। পুরু কাঁটাগুলো গোড়া থেকে বর্গাকার হয়ে উঠে এসেছে। তারপর ক্রমশ সরু হতে হতে একদম ছুঁচাল হয়ে থেমেছে ডগায়। কাঁটাগুলো ডালাতে এমনভাবে সাজানো, ভিক্টিমকে ভেতরে রেখে ডালাটা ছেড়ে দিলে উপরের কাঁটা দুটো সরাসরি চোখে গিয়ে বিঁধবে। এরপর যে কাঁটাগুলো রয়েছে, এগুলো ছেদ করবে হৃৎপিন্ডণ্ড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দুর্বলচিত্ত অ্যামেলিয়ার কাছে দৃশ্যটা এতই অসহ্য লাগল যে সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেল বেচারি।

অ্যামেলিয়াকে পাঁজাকোলা করে নিচে নিয়ে গেলাম। বাইরে এনে শুইয়ে দিলাম একটা বেঞ্চিতে। রাখলাম ওভাবেই জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত। পরে অবশ্যি জানা গেছে অ্যামেলিয়ার এই তাৎক্ষণিকভাবে মূর্ছা যাওয়ার কারণ। আমার বড় ছেলে জন্ম নেয় বুকে বিকট এক জন্মদাগ নিয়ে। বাড়ির সবার ধারণা, এটা নুরেনবার্গ ভার্জিনের অশুভ প্রভাবেই হয়েছে। অ্যামেলিয়া যখন মূর্ছা যায়, তখুনি ওর দেহাভ্যন্তরে ঢুকে যায় এই প্রভাব।

আমরা সবাই যখন আবার সেই কুঠুরিতে এলাম, হাচিসন তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আয়রন ভার্জিনের মুখোমুখি। এবার সে নিষ্ঠুর যন্ত্রটা নিয়ে তার দার্শনিক চিন্তাভাবনা আমাদের কাছে ঝেড়ে দিল একটা ভূমিকার মাধ্যমে।

‘ম্যাডাম যখন মূর্ছার ধকলটা কাটিয়ে উঠছিলেন, তখন কিছু একটা খেলে গেছে আমার মাথায়। আসলে সত্যিকারের রোমাঞ্চ থেকে অনেকটা দূরে আছি আমরা। আমাদের মতো একজন মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য ইন্ডিয়ানদের যে তৎপরতা, আইনকানুনের নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতার তুলনায় ওসব কিছুই নয়। স্প্রিন্টার্স তবু নিখুঁতভাবে ধোঁকা দিয়েছিল ওই অ্যাপাচি বিদ্বেষিণীকে, কিন্তু এখানে এই লৌহকুমারীকে ফাঁকি দেয়ার বিন্দুমাত্র জো নেই। এদের অত্যাচারের অধ্যায় শেষ হয়েছে সেই কতকাল আগে, অথচ এখনো এখানকার বাতাসকে ধারাল করে রেখেছে মরচে পড়া এই লোহার কাঁটাগুলো।

‘আমাদের দেশে ইন্ডিয়ানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য যে বিভাগটি রয়েছে, ওরা যদি এখান থেকে অল্প কিছু নমুনা সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে বুঝতে পারবে এই বর্বরতার তুলনায় ইন্ডিয়ানরা কতটা নস্যি। তাছাড়া অ্যাপাচিরাও এসব দেখে বুঝতে পারবে, বর্বরতার কত প্রাচীন ঐতিহ্যকে চূড়ান্তভাবে ধারণ করে আছে তারা। তা যাই হোক, আমি এখন এক মিনিটের জন্য ঢুকব এই বাক্সে। স্রেফ মজা আর কী। দেখব কেমন লাগে!’

‘হায়, হায়, না-না!’ আঁতকে উঠল অ্যামেলিয়া। ‘খুবই বিপজ্জনক এটা!’

‘দেখুন, ম্যাডাম, অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে কোনো কিছুই অতটা বিপজ্জনক নয়। আপনি জানেন না, কিছু কিম্ভুত জায়গায় গিয়ে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। মন্টানা টেরিটোরিতে একবার যখন আগুন লাগল প্রেয়ারি অঞ্চলে-ওরে-ব্বাস, সে কী ধাওয়া খেলাম আগুনের! প্রাণ বাঁচাতে কী করেছি তখন, জানেন? পুরো একটি রাত কাটিয়েছি এক মৃত ঘোড়ার ভেতর। আরেকবার খেলাম কোমাঞ্চিদের ধাওয়া। উপায়ান্তর না দেখে শেষে ঢুকলাম এক মৃত মোষের পেটে। ওই মোষের পেটেই ঘুমালাম এক রাত। আরও শুনুন। নিউ মেক্সিকোতে একবার বিলি ব্রঙ্কো সোনার খনিতে কাজ করার সময় দুদুটো দিন আটকা পড়ে ছিলাম সুড়ঙ্গে।

‘আরেকবার বাফেলো ব্রিজের ফাউন্ডেশন গড়ার সময় পানিতে আমরা আটকা পড়লাম চারজন। একটা দিনের চার ভাগের তিন ভাগ সময় ছিলাম ওখানে। এই যে এতগুলো বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কখনো ভড়কে যাইনি আমি। কাজেই এখনো পিছিয়ে যাব না!’

বেশ বুঝতে পারলাম, পরীক্ষাটা না করে ছাড়বে না সে। তাই বললাম, ‘ঠিক আছে, শিগগির তা হলে শুরু করে দিন আপনার এক্সপেরিমেন্ট। ‘

‘হ্যাঁ, করছি,’ বলল সে। ‘কিন্তু আমার প্রস্তুতি এখনো খানিকটা বাকি রয়ে গেছে। যন্ত্রটার ভেতরে যখন ঢুকবই, একটু কড়াভাবেই ঢুকি না কেন তত্ত্বাবধায়ক আমাকে একেবারে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলুক। তারপর ঠিক সত্যিকারের বন্দীর মতো ঢুকে যাই ভেতরে। কী বলেন? ‘

কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক লোকটা হাচিসনকে বাঁধতে রাজি হলো না প্রথমে শেষে চাপাচাপিতে কাজ হলো। তার উপর হাচিসন তাকে একটি সোনার মোহর দিয়ে কিছু তোষামুদে মিষ্টি বুলি ঝাড়ল, ব্যস, অমনি কাত হয়ে গেল তত্ত্বাবধায়ক।

কোত্থেকে পুরানো কিছু দড়ি জোগাড় করে হাচিসনকে বাঁধতে শুরু করল বুড়ো লোকটা। উপরের অংশ বাঁধা শেষ হলে হাচিসন বলল, ‘এবার একটু থামুন দয়া করে। এখুনি পা বাঁধলে আমাকে যন্ত্রটায় ঢোকাবেন কী করে? এত বড় দেহ তো বয়ে নিতে পারবেন না। এর চেয়ে আমি আগে ভেতরে ঢুকি, তারপর নিচের অংশ বাঁধুন ভালো করে।’

যন্ত্রটার ভেতর ঢুকে গেল হাচিসন। যন্ত্রটা যেন তার দেহের মাপেই তৈরি। একেবারে খাপে খাপে পূরণ হয়েছে জায়গা। এদিকে দু চোখে রাজ্যের ভয় নিয়ে হাচিসনের কাণ্ডকারখানা দেখছে অ্যামেলিয়া। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। বোঝাই যাচ্ছে, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর।

বুড়ো এবার পা বাঁধার কাজ শেষ করল হাচিসনের। আমাদের আমেরিকান বন্ধুটি সত্যিই এখন অসহায়। এবং তার স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণের কাজও শেষ। ভাবেসাবে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছে হাচিসন। তার ঠোঁটে স্বভাবসুলভ মৃদু বাঁকা হাসি। এবং সে সত্যি সত্যি ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে, এখানকার ঈভকে গড়া হয়েছিল কোনো বামনের পাঁজর থেকে। বাপরে, এই যন্ত্রের যা সাইজ-বাড়তি একটুও জায়গা নেই ভেতরে! একদম হাঁসফাঁস অবস্থা! আর আমাদের ওখানে, ইডাহো টেরিটোরিতে যে কফিনগুলো গড়া হয়, সেগুলো এটার চেয়ে বড় বড়! হ্যাঁ, এবার-বুড়ো বাবা, ডালাটা খুব আস্তে আস্তে নামিয়ে আনুন। দেখি, কাঁটার ঘা খাওয়ার আগে সেই বন্দীদের মনের অবস্থা কী হতো!’

‘মা গো-না! না! না!’ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার দিয়ে উঠল অ্যামেলিয়া। ‘ভয়ংকর! আমি কিছুতেই এ দৃশ্য সহ্য করতে পারব না! কিছুতেই না! কিছুতেই না!

কিন্তু আমেরিকানটি দিব্যি অটল।

‘বলুন তো, কর্নেল,’ আমাকে বলল সে। ‘ম্যাডাম কেন এই ব্যাপারটাকে আমাদের প্রমোদ ভ্রমণের একটা অংশ হিসেবে নিচ্ছেন না? আমি তার মনে কোনো দুঃখ দিতে চাই না। কিন্তু আমার কথা একবার ভেবে দেখুন। সুদীর্ঘ আট হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ঘুরতে এসেছি এখানে। এমন দুর্লভ অভিজ্ঞতা নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা সম্ভব আমার পক্ষে? খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হবে এই কৌতুকপর্ব। তারপর আমরা একসঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে খুব মজা করব, আর হাসব।’

বুড়ো তত্ত্বাবধায়ক এবার লোহার ডালার পিঠে লাগানো দড়িটা ঢিল দিতে লাগল ইঞ্চি-ইঞ্চি করে। অ্যামেলিয়া আমার এক বাহু আঁকড়ে ধরেছিল প্রবলভাবে। ভয়ে এবার কাঁপতে শুরু করল ও। এদিকে লোহার কাঁটাগুলো প্রথমবার নড়ে উঠতেই চোখমুখ পরিষ্কার উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাচিসনের। আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘নিউইয়র্ক ছেড়ে আসার আগে যে জম্পেশ ভোজ হয়েছিল, আমি মনে করি, এই মুহূর্তের উত্তেজনার কাছে ওই আনন্দটুকু কিছুই নয়। ওটা ছিল বারে বসে এক ফরাসি নাবিকের সাথে গণ্ডেপিণ্ডে পানভোজন। বড় জোর পিকনিক বলা যায় ওটাকে। এরকম একটি নীরস জায়গায়, যেখানে কোনো বার নেই, ইন্ডিয়ানদের তাড়া নেই, লোকজনের ছুটোছুটি নেই-সেখানে এরকম একটি জীবন্ত প্রদর্শনীর প্রকৃত আনন্দ উপভোগ-উফ, তুলনা হয় না এর!’

‘আস্তে, বুড়ো বাবা!’ তত্ত্বাবধায়ককে বলল হাচিসন। ‘এত শিগগির খেল খতম করবেন না! আমি চাই, টাকার বিনিময়ে মজার একটা খেলা উপভোগ করতে-আর করছিও তাই!’

এই মৃত্যুপুরীতে আগে যারা এরকম বন্দীদের প্রাণ সংহারের কাজ সারত, তাদের কিছু রক্ত অবশ্যই আছে তত্ত্বাবধায়কের শরীরে। তা নইলে এরকম ঠান্ডা মাথায় যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতিতে দড়ি ঢিল দিতে পারত না। যেখানে এতক্ষণে কয়েক ইঞ্চি নেমে আসার কথা ডালাটির, সেখানে এর অর্ধেকও নেমে এসেছে কিনা সন্দেহ। ইতিমধ্যে উত্তেজনার ধকল কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে অ্যামেলিয়া। আমার বাহুতে ওর হাতের বজ্রআঁটুনি শিথিল হয়ে এসেছে। তবে ঠোঁট জোড়া বড় সাদা দেখাচ্ছে ওর। কোথাও ওকে শোয়াতে পারলে ভালো হতো।

চকিতে ঘরের চারদিকে সেরকম একটা জায়গা খুঁজে বেড়ালাম। নেই। আবার যখন অ্যামেলিয়ার উপর আমার দৃষ্টি ফিরে এল, দেখি, ওর চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে আয়রন ভার্জিনের এক জায়গায়। তাকালাম ওদিকে। ছ্যাৎ করে উঠল বুকটা। সেই কালো বেড়াল! হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। আঁধারের পটভূমিতে ওটার সবুজ চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে বিপদ সংকেতের মতো। চোখেমুখে রক্ত লেগে থাকায় এই বিপদ সংকেতের দীপ্তি যেন বেড়ে গেছে আরও।

আমি সহসা চিৎকার দিয়ে উঠলাম, ‘বেড়াল! ওই যে-দেখো, সেই কালো বেড়াল!’

অমনি ঝট করে উঠে দাঁড়াল বেড়ালটি। এ মুহূর্তে ঠিক একটা পিশাচের মতো লাগছে ওটাকে। উল্লসিত পিশাচ! প্রচণ্ড হিংস্রতা নিয়ে জ্বলছে চোখ দুটি। দাঁড়িয়ে গেছে গায়ের সবগুলো রোম। ফলে স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে এখন দ্বিগুণ লাগছে ওটাকে। আর লেজটাকে নাড়ছে, বাঘ শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ঠিক আগে যেভাবে নেড়ে থাকে।

এলিয়াস পি. হাচিসন বেড়ালটিকে দেখে একটুও ঘাবড়াল না। বরং কৌতুকের ঝিলিক দেখা গেল তাঁর চোখে। বলল, ‘বেড়ালটি যদি যুদ্ধংদেহী মনোভাব না ছাড়ে তাহলে ওটাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হোক। এখন ওটা আক্রমণ করে বসলে বিপদে পড়ে যাব। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এ মুহূর্তে একদম নিরুপায় আমি। বুড়ো বাবা, ব্যাপারটাকে আপনি সহজভাবে নিন! ঘাবড়ে গিয়ে দড়িটা আবার ছেড়ে দেবেন না যেন! তাহলে কিন্তু আমি শেষ!’

ঠিক এমন সময় জ্ঞান হারাল অ্যামেলিয়া। সময়মতো ওর কোটি জড়িয়ে না ধরলে ঠিক পড়ে যেত মেঝেতে। এভাবে আমি যখন অ্যামেলিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন কালো বেড়ালটি লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এবং দিয়েও ফেলল লাফ।

ভেবেছিলাম, হাচিসনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ওটা। আর এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারকীয় গর্জন ছেড়ে বেড়ালটি ঝাঁপ দিল মুখোমুখি দাঁড়ানো তত্ত্বাবধায়ক বুড়োর মুখের উপর। চীনাদের চিত্রকর্মে যেমন পেছনের দুপায়ে ভর করা আক্রমণরত ড্রাগনের ছবি দেখা যায়, ঠিক তেমনি করে বুড়োর মুখের ওপর আক্রমণ চালাল বেড়ালটি। ধারাল নখর দিয়ে চোখমুখ খামচে একাকার করে দিল। ফিনকি দিয়ে ছুটল তাজা রক্ত। ভেসে যেতে লাগল বুড়োর মুখ।

তীব্র আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠল বুড়ো। এমনকি তার যন্ত্রণা অনুভবের বোধশক্তির চেয়েও দ্রুত বেরোল এই চিৎকার। লাফিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল সে। হাত থেকে ছুটে গেল লোহার ডালাটির দড়ি। শেষ মুহূর্তে আমি লাফ দিলাম দড়িটা ধরার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ গতিতে কপিকল দিয়ে ছুটে গেল দড়িটা। নিজের ভারেই লোহার ডালাটি দড়াম করে গিয়ে আছড়ে পড়ল আয়রন ভার্জিনের উপর।

লোহার যন্ত্রে বন্দী হাচিসনের মুখটা তাৎক্ষণিকভাবে ভেসে উঠল চোখে। নিশ্চয়ই আতঙ্কে জমে গেছে সে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো কথা সরছে না।

কিন্তু ডালাটা যখন টেনে তুললাম, সে এক নারকীয় দৃশ্য! লোহার কাঁটাগুলো নিখুঁতভাবেই কাজ শেষ করেছে। একদম উপরের দুই কাঁটা হাচিসনের দুই চোখ ভেদ করে একেবারে খুলির ওপাশটাতে গিয়ে আটকে আছে। কাঁটাগুলো সত্যিকার অর্থেই ছিঁড়েখুঁড়ে চুরমার করে দিয়েছে হাচিসনকে। যেহেতু তার পুরো শরীরটা এখনো বাঁধা, কাজেই টান মারতেই খাড়া এসে ধপ করে মেঝেতে পড়ল লাশটা। এবং পড়ার সময় ঘুরে চিৎ হয়ে গেল।

আমি ছুটলাম অ্যামেলিয়ার দিকে, মেঝেতে পড়ে আছে ও। পাঁজাকোলা করে ওকে বাইরে নিয়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর যদি এ দৃশ্য দেখে ও, তাহলে আরও ভয়াবহ হবে পরিণতি। অ্যামেলিয়াকে একটা বেঞ্চিতে শুইয়ে উপরে ফিরে এলাম আবার। কাঠের পিলারে ঠেস দিয়ে যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে বুড়ো তত্ত্বাবধায়ক। চোখে চেপে ধরা রুমালটা লাল হয়ে উঠেছে রক্তে।

এদিকে হতভাগ্য আমেরিকানটির কপালের উপর এসে বসেছে সেই কালো বেড়াল। হাচিসনের ফাঁকা দুই চোখের কোটরে টইটুম্বুর হয়ে থাকা রক্ত পান করছে ওটা। সশব্দে-চুক চুক করে।

চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে সাজানো জল্লাদের পুরানো তলোয়ারগুলো থেকে একটা উঠিয়ে নিলাম দ্রুত। তারপর সোজা গিয়ে তলোয়ারটা চালিয়ে দিলাম বেড়ালটির উপর। বসা অবস্থায়ই দ্বিখণ্ডিত হলো ওটা। আশা করি, আমার এই কাজটির জন্য আমাকে পাষণ্ড বলে ভর্ৎসনা করবে না কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *