রুম নাম্বার সেভেন

রুম নাম্বার সেভেন

এ গল্প আমি বহু দিন কাউকে বলিনি। রহস্যের ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই তাই ভেবেছি লোকে হয়তো আমার কথা বিশ্বাসই করবে না। এখন অবশ্য কেউ আমার কথা বিশ্বাস করুক বা না করুক তাতে কিছু আসে যায় না। আমি একটি সত্যি ঘটনাই বলছি। আপনারা হয়তো ভূতে বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। আমিও যে বিশ্বাস করি তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। সেই রাতে সত্যি ভূত দেখেছিলাম কিনা তাও জানি না। যদি ওটা ভূত না হয়ে থাকে তাহলে কী দেখেছিলাম জানি না।

ইংল্যান্ডের উত্তরে গিয়েছিলাম ব্যবসায়িক কাজে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। আমি লন্ডনের কাছেই থাকি। তখন শীতকাল। আবহাওয়া ছিল বৈরী। আমি সকাল সকালই রওনা হয়েছিলাম, তবে বেশি দ্রুত গাড়ি চালাতে পারিনি। রাস্তাঘাট বরফে ঢাকা। তাই মন্থরগতিতে এবং সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। যখন ঘনিয়ে এল সন্ধ্যা, বাড়ির পথ তখনো বহু দূর। আমার গাড়ির বাতি প্রায় নিভু নিভু। গাড়ি নিয়ে মেইন রোডে অবস্থান খুবই বিপজ্জনক। কারণ ওই রাস্তায় বেশ গাড়ি চলাচল করছিল। আমি মূল রাস্তা ছেড়ে শান্ত, নির্জন একটি গাঁয়ের পথে মোড় নিলাম।

মাইল খানেক এগোবার পরে রাস্তার পাশে একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। মিলহ্যাম লেখা রোড সাইনে। পাঁচ মিনিট বাদে আমি একটি সরু রাস্তায় উঠে এলাম। দুপাশে ঘরবাড়ি। দোকানপাটও নজরে এল। আলো জ্বলছে। রাস্তার মাথায় একটি গ্যারেজ। আমি সেখানে গিয়ে গাড়ি দাঁড়া করালাম। গ্যারেজ মালিককে আমার গাড়ির সমস্যার কথা বললাম। সে গাড়ির বাতি পরীক্ষা করে দেখল। তারপর ইঞ্জিন দেখল। মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনার গাড়ির ডায়নামো ভেঙে গেছে। কাল সকালে মেরামত করে দিতে পারব। তবে আজ রাতে আর গাড়ি না চালানোই ভালো। নিরাপদ হবে না।

‘মিলহ্যামে কোনো হোটেল আছে?’ জানতে চাই আমি।

‘জি, আছে,’ জবাব দিল লোকটি। ‘রাস্তার ওই মাথায় ‘দ্য গোট’ নামে একটি হোটেল আছে। আপনি হোটেলটি মাত্রই পার হয়ে এসেছেন। শীতকালে মিলহ্যামে খুব বেশি মানুষজন আসে না বাইরে থেকে। মি. রিচার্ডসকে বলবেন আমি আপনার ডায়নামো মেরামত করে দিচ্ছি। উনি আপনাকে আদর-যত্নের কোনো ত্রুটি করবেন না।’

আমি গ্যারেজ মালিককে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ি থেকে আমার সুটকেসটি বের করে নিলাম, তারপর হাঁটা দিলাম ‘দ্য গোট’ অভিমুখে। এটি পুরানো একটি ভবন। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম ছোট ডাইনিংরুমের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। সদর দরজার পরেই হোটেল অফিস। আমি ডেস্কের গায়ে লাগানো বেল টিপলাম।

অফিসের পেছন দিক থেকে আবির্ভূত হলো বিশালদেহী এক লোক। তার এক হাতে কাপড়, অপর হাতে আধ গ্লাস বিয়ার। আমার দিকে তাকিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি উপহার দিল সে।

‘মি. রিচার্ডস?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ডেস্কের ওপর বিয়ারের গ্লাস নামিয়ে রাখল সে।

‘জি। আপনার জন্য কী করতে পারি?’

আমি জানালাম আমার গাড়ি গ্যারেজে রেখে এসেছি। বললাম রাতে থাকার মতো একটি রুম এবং খাবারদাবার চাই।

‘খাবার পেতে সমস্যা নেই,’ বলল সে। ‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে ডিনার। তবে রুম পাওয়াটা একটু কঠিন। দেখতেই পাচ্ছেন এটি একটি ছোট হোটেল। আমাদের মাত্র ছয়টি বেডরুম। সবগুলোতেই লোক আছে। শীতকালে অবশ্য খুব কমই আমাদের হোটেল ভর্তি হয়ে যায়। আমি দুঃখিত।’

তাহলে এখন কী করা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম তাকে এমন সময় দরজাটি আবার খুলে গেল। ছোটখাটো চেহারার এক ভদ্রমহিলা দ্রুত হেঁটে এলেন ভেতরে।

‘ইনি আমার স্ত্রী,’ বলল মি. রিচার্ডস। তার দিকে ফিরল। ‘এই ভদ্রলোককে বলছিলাম আজ রাতে আমাদের কোনো কামরা খালি নেই, লিজ। ওনার গাড়ি গ্যারেজে মেরামতির জন্য তাই উনি আজ রাতে এখানে থাকতে চেয়েছিলেন। ডিনারও করবেন।’

‘সাত নাম্বার রুমটা খালি আছে, টম,’ বললেন মহিলা।

‘কিন্তু ওটা তো—’ বাক্য শেষ করল না সে। বিয়ারের গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে তার স্ত্রীর কথা শুনতে লাগল।

‘ভদ্রলোককে এভাবে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না,’ বললেন ভদ্রমহিলা। ‘আমি সাত নাম্বার রুমটি রেডি করে দিচ্ছি।’

‘আপনাদের বোধ হয় ঝামেলাতেই ফেলে দিলাম, ‘

‘না, না। কোনো ঝামেলা নয়, মি—’

‘সন্ডার্স,’ বললাম আমি। ‘আমি জন সন্ডার্স।’

‘আমাদের কোনো ঝামেলা হচ্ছে না মি. সন্ডার্স। সাত নাম্বার কক্ষটি আমরা তেমন ব্যবহার করি না। আপনি ওখানে আরামেই থাকতে পারবেন। ওটাতে কোনো সমস্যা নেই।’ মহিলা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করলেন। তার স্বামী ভাবলেশহীন হয়ে রইল।

‘আসুন, মি. সন্ডার্স,’ বলল সে। ‘আমাদের ঘরে তৈরি বিয়ার এক গ্লাস চেখে দেখুন। এর চেয়ে সুস্বাদু বিয়ার আপনি ইংল্যান্ডের কোথাও পাবেন না। আপনার সুটকেসটি আপাতত অফিস রুমেই থাক। এই ফাঁকে আপনার ঘরটি রেডি হয়ে যাবে।’

‘সে আমাকে নিয়ে বার-এ চলে এল। এখানে লোকজন মদপান এবং গল্পগুজব করছে। কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। এরা বাইরের শহর থেকে এসেছে। কয়েকজন আবার মিলহ্যামের বাসিন্দা। বার-এ এসেছে সান্ধ্যকালীন বিয়ার পান করতে। আমি এখানে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করছিলাম। মি. রিচার্ডস তার বিখ্যাত বিয়ার এক গ্লাস খেতে দিল আমাকে। ঠিকই বলেছে সে, দারুণ স্বাদ। কিছুক্ষণ পরে আমাকে জানানো হলো আমার ঘর রেডি করা হয়েছে। তখন অবশ্য এ আড্ডা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না! তবু একটু পরে উঠতে হলো। অফিস ঘর থেকে আমার সুটকেস নিয়ে সাত নাম্বার রুমে চলে এলাম। এটি টপ ফ্লোরে, অন্যান্য বেডরুমগুলোর মাথার ওপরে। এখানে বেশ ঠান্ডা তবে মি. রিচার্ডস ছোট একটি ফায়ারপ্লেস জ্বালিয়ে রেখেছে। ঘর কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম হয়ে যাবে, ভাবলাম আমি। আর কামরাটিও বেশ নিরিবিলি। আজ রাতে জম্পেশ ঘুম দেয়া যাবে।

কামরাটি আয়তনে তেমন বড় নয়। একটি খাট, কাপড়চোপড় রাখার আলমারি এবং দরজার পেছনে মুখ-হাত ধোয়ার জন্য একটি বেসিন। ওয়াশ বেসিন এবং আলমারির মাঝখানে দেয়াল ঘেঁষে খাড়া পিঠের একখানা চেয়ার চোখে পড়ল। আর ফায়ারপ্লেস। ব্যস এই-ই। তবে ঘরটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমি খুশিই হলাম। সুটকেস খুলে জামাকাপড় বের করে, হাত-মুখ ধুয়ে চললাম ডিনারে।

মিসেস রিচার্ডস ভালো রাঁধুনি। খাবারটি বেশ উপভোগ করলাম। এক বোতল রেড ওয়াইনও দিয়েছে। খাওয়া শেষে আমি বার-এ চলে এলাম। মি. রিচার্ডস এবং তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খানিক আড্ডা দিলাম। একটু পরে ভ্রমণক্লান্তিতে ঘুমে বুজে আসতে লাগল চোখ।

‘আমি ঘুমাতে যাব,’ বললাম মি. রিচার্ডসকে। ‘আমাকে একটু সকাল সকাল নাশতা দেয়া যাবে? গাড়ি রেডি হয়ে গেলেই রওনা হতে চাই।’

‘আটটার সময় দিলে চলবে?’

‘হ্যাঁ, চলবে। ধন্যবাদ। মনে হয় না সকাল নয়টার আগে ডায়নামো মেরামতির কাজ শেষ হবে।’

‘তাহলে শুভ রাত্রি, মি. সন্ডার্স।’ আপনাকেও ধন্যবাদ সুন্দর একটি সন্ধ্যার জন্য।’

অগ্নিচুল্লির কারণে ঘরটি বেশ গরম। আমি বিছানায় বসে কিছুক্ষণ বই পড়লাম। কিন্তু বারবার চোখ ঘুমে ঢলে আসছে দেখে বই পড়া বাদ দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে টানটান হলাম বিছানায়। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

জানি না কতক্ষণ ঘুমিয়েছি। তবে কিছু একটা আমাকে জাগিয়ে তুলল। কোনো শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙেনি। বেডরুম নীরব। তবে অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে। আমার বিছানার পাশের টেবিলের বাতিটি নেভানো, তবু ঘরটি আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে আসছে কামরার একটি অংশ। আমার বিছানা ডুবে আছে আঁধারে। আমি আলমারি কিংবা মুখ ধোয়ার বেসিন কোনোটিই দেখতে পাচ্ছি না, শুধু দুটোর মাঝখানে বড় চেয়ারখানা নজরে আসছে। ওটার হাতল, পায়া, খাড়া পিঠ সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছে।

আমি শক্ত করে চোখ বুজলাম। ভয়টয় পাইনি। অন্তত তখন নয়। ভয়টা এল পরে। না, আমি ভয় পাইনি তবে চিন্তা করতে চাইছিলাম। ওই অদ্ভুত আলোটা নিভিয়ে দিয়ে একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করাতে চাইছিলাম নিজের কাছে। আমি চেয়ারটি দেখতে পাচ্ছি তা সত্যি হতে পারে না। রুমের বাকি অংশ অন্ধকার। আমি আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম। নিশ্চয়! ডিনারের পরে বার- এ বসে একটু বেশিই গিলেছিলাম, যার কারণে স্বপ্ন দেখছিলাম। খুব ধীরে ধীরে পঞ্চাশ পর্যন্ত গুনব ঠিক করলাম। পঞ্চাশ গোনা শেষ করে আমি চোখ খুলব এবং দেখব ঘর অন্ধকার। ঘর পুরো অন্ধকার থাকলেই হবে।

‘…চল্লিশ, একচল্লিশ….’ আমি খুব আস্তে আস্তে গুনছি এমন সময় কানে এল শব্দটা। কেউ ঘরের ভেতরে শ্বাস করছে। আমি স্থির হয়ে শুয়ে কান পাতলাম। হ্যাঁ, কেউ শ্বাস করছে! ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। তাহলে এটা স্বপ্ন নয়। কে নিশ্বাস ফেলছে? চোর?

চোখ মেললাম। চেয়ারটি যথাস্থানেই রয়েছে এবং এখন ওখানে বসে আছে এক লোক। লোকটা বুড়ো। মাথার চুল পাকা। শিরদাঁড়া টানটান করে বসে আছে সে। চেয়ারের হাতল ধরে রেখেছে শক্ত হাতে। উজ্জ্বল নীল চোখ জোড়া আমার ওপর স্থির।

আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না। আমি বলতে চাইছিলাম : ‘কে আপনি? এখানে কী করছেন? আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান।’ আবার মুখ খুলতে চাইলাম। লাভ হলো না। আমি ওখানে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিজেকে বললাম ভয় না পেতে। লোকটা খুব বুড়ো। আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে বুড়োর চাউনি বড্ড ভীতিকর। পলকহীন চোখে সে তাকিয়েই আছে।

‘লোকটা কিছু একটা নিশ্চয় করছে,’ ভাবলাম আমি। ‘নিদেন কথা তো বলবেই।’

লোকটা বোধহয় আমার চিন্তাটা শুনে ফেলল। সে বাম হাত তুলে তাক করল আমার দিকে। এবারে তার চোখে খুব করুণ, বিষাদময় চাউনি হঠাৎ, আমার আর ওকে ভয় লাগল না। লোকটা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা

করছে। যখন কথা বলল গলার স্বর বড্ড করুণ শোনাল।

‘আমি কখনো সন্ধান পাইনি,’ বলল সে। ‘কিন্তু তুমি পেয়েছ।’

তার হাত ঝপাৎ করে পড়ে গেল নিচে। আমি বলে উঠলাম, ‘আমি কিসের সন্ধান পেয়েছি? আপনি কে? কী—?’ তবে প্রশ্ন শেষ করার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘর আবার পুরো অন্ধকার।

একটি কণ্ঠ আমাকে জাগিয়ে তুলল। ‘আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি, মি. সন্ডার্স। আপনার নাশতা আধ ঘণ্টার মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে।’ মি. রিচার্ডস বেডসাইড টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রেখে বেরিয়ে গেল দ্রুত।

আমি গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম। আমার অদ্ভুত দর্শনার্থীটি চলে যাওয়ার পরপরই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অথবা সত্যি কি আমি ঘুমিয়েছি? আমি কি গোটা ব্যাপারটাই স্বপ্নে দেখেছি? বিষয়টি নিয়ে কি রিচার্ডস দম্পতির সঙ্গে কথা বলব? নাহ, এ নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। অদ্ভুত আগন্তুকের রহস্য ভেদ করতে না পারলে তারা বড়ই বিব্রত হবে। ওরা আমার খুব যত্ন-আত্তি করেছে। আমি ওদের কোনোরকম ব্রিত করতে চাই না।

নাশতা খেয়ে হোটেল অফিসে ঢুকলাম বিল শোধ করতে। মিসেস রিচার্ডস বসে আছেন ডেস্কে। আমার যত্ন-আত্তি করার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বিল দিলেন।

‘এ আমাদের সৌভাগ্য, মি. সন্ডার্স। আমরা চাই আমাদের হোটেলে যাঁরা আসেন তাঁরা যেন আরামে থাকতে পারেন। আপনার ভালো ঘুম হয়েছিল তো?’

আমি বিল পরিশোধের জন্য টাকা গুনছিলাম। জবাব দেয়ার জন্য মুখ তুলে তাকাতে মহিলার পেছনের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবিতে আটকে গেল চোখ। সাদা চুল, চওড়া, শক্ত মুখ এবং ঝকঝকে নীল চোখের লোকটাকে আমার খুব চেনা লাগল।

ছবিটির দিকে ইঙ্গিত করলাম। ‘উনি কে?

মিসেস রিচার্ডস ছবির দিকে একবার তাকিয়ে চট করে আমার দিকে ফিরলেন। ‘উনি টমের বাবা। আমাদের সঙ্গে এ হোটেলেই থাকতেন। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। আপনি কাল যে কামরায় ছিলেন ওখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। এজন্যই টম আপনাকে সাত নম্বর কামরায় থাকতে দিতে চায়নি।’

‘কিন্তু আপনারা-’ থেমে গেলাম আমি। সাবধানে শব্দচয়ন করতে হবে। জানি না ভদ্রমহিলা এ ব্যাপারে কতটুকু জানেন কিংবা আমাকে কতটুকুই বা বলতে চাইবেন। তবে আমি কিছু বলার আগেই মিসেস রিচার্ডস আবার বলতে লাগলেন :

‘সাত নম্বর কামরা নিয়ে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে, মি. সন্ডার্স | দুএকজন অতিথি বলেছেন ওই রুমে তাঁদের ভালো ঘুম হয়নি। রাতের বেলা তাঁরা নাকি ভয় পেয়েছেন। যদিও কেন ভয় পেয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তাঁরা বলেছেন ঘরটি নাকি ভুতুড়ে। হোটেলঅলাদের জন্য ভূতটুত খুব খারাপ ব্যাপার। তাই টমের বাবা ঠিক করেন তিনি নিজেই সাত নম্বর কামরায় রাত কাটাবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে ওটা ভুতুড়ে ঘর। বলেছিলেন ওই ঘরে মানুষ ঘুমাতে কেন ভয় পায় সেই রহস্য উদ্ঘাটন করবেন। তাঁর ভূতে বিশ্বাস ছিল না, আমারও নেই। তো, তিনি ওই ঘরে এক রাতে ঘুমাতে গেলেন সুস্থ দেহে, সুস্থ মনে। কিন্তু…‘

‘বলুন!’ বললাম আমি। ‘তারপর কী হলো বলে যান।’

‘আমি আমার শ্বশুরকে খুব পছন্দ করতাম,’ বললেন মিসেস রিচার্ডস। ‘তাঁর কথা মনে পড়লে এখনো খারাপ লাগে। আমি পরদিন সকালে তাঁর জন্য চা নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ওখানে তিনি মরে পড়ে আছেন। বড় চেয়ারটিতে বসে আছেন তিনি। সারা গা বরফের মতো ঠান্ডা এবং প্রাণহীন। তিনি বুড়ো মানুষ ছিলেন। বুড়ো মানুষরা হঠাৎ করে মরে যেতেই পারেন। ডাক্তার বলেছিলেন এরকম হতেই পারে। তাঁর হার্ট ফেইল করেছিল হঠাৎ, বলেছেন ডাক্তার।’

মিসেস রিচার্ডস টাকা নিয়ে আমাকে ভাংতি ফেরত দিলেন। আমি পকেটে ভাংতিটা রেখে সুটকেস তুলে নিলাম হাতে।

‘মিসেস রিচার্ডস,’ বললাম আমি, ‘একটা কথা বলতে-’

তিনি আমার কথা শুনছেন না। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘কাজেই বুঝতেই পারছেন, মি. সন্ডার্স, সাত নম্বর কামরার রহস্য আমরা কোনোদিন ভেদ করতে পারিনি। কেউ কোনোদিন পারবে বলেও মনে হয় না। ওটা আসলে স্রেফ একটা ভুয়া গল্প।’

আমি বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। রাস্তা ধরে দ্রুত পদক্ষেপে চললাম গ্যারেজে।

বুড়োর কথা যেন আমাকে অনুসরণ করছিল

‘আমি কোনোদিন সন্ধান পাইনি,’ বলেছিল সে, ‘আমি কোনোদিন জানতে পারিনি সাত নম্বর কামরা ভুতুড়ে কিনা। কিন্তু তুমি এখন জানতে পারলে ব্যাপারটা। এখন তুমি জানো, তাই না?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *