ক্রুকেন স্যান্ডস

ক্রুকেন স্যান্ডস

মি. আর্থার ফার্নলি মারকাম পেশায় লন্ডনের সওদাগর, একজন খাস লন্ডনি। মেইনস অব ক্রুকেনের রেড হাউস তিনি কিনে নিয়েছেন। স্কটল্যান্ডে গ্রীষ্মাবকাশ কাটাতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল বাড়িটি ক্রয় করা তাঁর জন্য জরুরি তাই তিনি ওটা কিনে নেন। বাড়ি এবং তার আশপাশের ছবির মতো নিসর্গ তাঁকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। বাড়িটি ক্রুকেন বেতে। অ্যাবারডিন এবং পিটারহেডের মাঝখানে এটি একটি চমৎকার জায়গায়। পাহাড়ঘেরা অন্তরীপের ঠিক নিচেই ওটা। ওখানে দ্য স্পারস নামে দীর্ঘ, বিপজ্জনক রিফ তার বাহু ছড়িয়ে রেখেছে উত্তর সাগর অভিমুখে। এর মাঝখানে এবং ‘মেইনস অব ক্রুকেন’-এ রয়েছে উত্তরে পাহাড়ঘেরা একটি গ্রাম। এই ক্লিফ বা পাহাড়গুলো শুয়ে আছে গভীর উপসাগরে, সেখানে অসংখ্য বালিয়াড়ি। এ জায়গায় হাজার হাজার খরগোশের বিচরণ। উপসাগরের মাথায় পাথুরে উপকূলরেখা। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তে পাথরের ওপর যখন চলে লাল আবিরের খেলা সে এক মনোহর দৃশ্যের সৃষ্টি করে বৈকি। বে বা উপসাগরের মসৃণ বালু এবং স্রোতের বিস্তৃতি বহুদূর পর্যন্ত। এখানে প্রচুর স্যামন মাছ মেলে। বে-র এক প্রান্তে রয়েছে পাথরের ছোট ছোট স্তূপ যেগুলো জোয়ারের সময়েও মাথা উঁচিয়ে থাকে। শুধু ঝড়ের সময় ঢেউ ওগুলো ডুবিয়ে দেয়। ভাটার টানে পাথুরে স্তূপের তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। এখানকার বালুকাময় অংশ বেশ বিপজ্জনক। পাথরগুলোর মাঝখানে, পঞ্চাশ ফুট ফাঁকা জায়গাটিতে রয়েছে চোরাবালি। তবে গুডউইনসের মতো এটিও কেবল আসন্ন স্রোতের সময়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এটি বাইরের অংশে বিস্তৃত থাকে সাগর একে গ্রাস না করা পর্যন্ত এবং ভেতরের দিকেও এর বিস্তার ঘটে তবে আপার বিচে শক্ত বালুর আস্তরণ একে ঢেকে দেয়। বালিয়াড়ির পেছনে খাড়া হয়ে থাকা পাহাড়ের ঢালে, স্পারস এবং পোর্ট অব ক্রুকেনের ঠিক মাঝখানটায় রেড হাউস গড়ে উঠেছে। একসারি ফার গাছের মাঝ দিয়ে বাড়িটি মাথা উঁচিয়েছে। বৃক্ষরাজি তিন দিক থেকে রেড হাউসকে সুরক্ষা দিচ্ছে, শুধু সামনের অংশটা ফাঁকা। ওদিকে সমুদ্র। পুরানো কেতার ছিমছাম একটি বাগান রাস্তার দিকে এগিয়ে গেছে, ক্রস করেছে একটি ঘেসো পথ, যেখানে কেবল হালকা যানবাহনই চলাচল করতে পারে। তারপর ওটি পথ খুঁজে পেয়ে, বালু পাহাড়গুলোর মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে পৌছে গেছে সৈকতে।

মারকাম পরিবার ছত্রিশ ঘণ্টা যাত্রা শেষে পৌঁছাল রেড হাউসে। এ জন্য তাদেরকে ব্ল্যাকওয়াল থেকে অ্যাবারডিনগামী ব্যান রাই স্টিমারে চাপতে হয়েছে, তারপর ইয়েলনগামী রেলগাড়িতে চেপেছে এবং কয়েক ডজন মাইল পাড়ি দিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছাল, সকলেই স্বীকার করল এমন অদ্ভুত সুন্দর জায়গা তারা কদাপি অবলোকন করেনি।

অবশ্য সকলেরই সন্তুষ্ট বা মুগ্ধ হওয়ার কারণ ওই সময় পরিবারের কারোরই নানান কারণে স্কটিশ সীমান্তের ওপারে তেমন দর্শনযোগ্য কিছু দেখার প্রতি খুব বেশি ঝোঁক বা প্রবণতা ছিল না। পরিবারটি আয়তনে বৃহৎ হলেও ফুলে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে তারা সকলেই ব্যক্তিগতভাবে বিলাসী জীবনযাপন করার সুযোগ পেয়েছে, এর মধ্যে পোশাক আশাকের প্রতি তাদের আগ্রহটি বেশি। মারকাম পরিবারের মেয়েদের নতুন নতুন ফ্রক তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মনে ঈর্ষা জাগানোর কারণ ছিল আর তারা তাদের নিজেদের জন্য ছিল আনন্দের সূত্র।

আর্থার ফারনলি মারকাম নিজের নতুন পোশাকটি সম্পর্কে তাঁর পরিবারকে জানাতে তেমন ভরসা পাননি। উপহাসের কবল থেকে মুক্তি পাবেন কিনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না তিনি। নিদেন শ্লেষোক্তি তো জুটতেই পারে কপালে এবং যেহেতু তিনি এ বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল, তাই ভেবেছেন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হোক তারপর না হয় সকলের কাছে ঘটনা ফাঁস করা যাবে।

হাইল্যান্ড কস্টিউমের জন্য তাঁকে বিমা করার যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। তিনি বহুবারই ‘দ্য স্কচ অল-উল টারটান ক্লদিং মার্ট’-এ গিয়েছেন। এটির প্রতিষ্ঠাতা মেসার্স ম্যাককালাম মোর এবং রডরিক ম্যাকডু। ফার্মটির অবস্থান কস্টহল কোর্টে। এর প্রধান ম্যাককালাম মোর। পোশাকটি নিয়ে এ লোকের সঙ্গে সলাপরামর্শও করেছেন মি. মারকাম। এ প্রতিষ্ঠানে ড্রেসের সমস্ত বাকল, বোতাম, স্ট্র্যাপ ক্রচ, অর্নামেন্ট ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে দেখা হয়। শেষে ড্রেসটিতে ইগলের একটি পালক বসানোর পরে দেখা যায় এর চেহারার আরও খোলতাই হয়েছে এবং পোশাকটি পরিপূর্ণতাও পেয়েছে। তৈরি পোশাকটি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ মারকাম সাহেব। ছককাটা পশমি কাপড়ে রঙের সূক্ষ্ম তারতম্য যেন সিলভার ফিটিংস, কেয়ার্নগম ব্রুচ, ফিলিবেগ, ডার্ক (এক প্রকার ছোরা-অনুবাদক) এবং পশমি ছোট থলে বা বটুয়ার সমন্বয়ের তুলনামূলকভাবে দারুণ এক ঐকান্তিকতা সৃষ্টি করেছে। তিনি ড্রেসটি পরে বালমোরাল যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ম্যাককালামের পরামর্শে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। কারণ তাঁকে বোঝানো হয় এ পোশাকে বালমোরালে গেলে তাতে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। ম্যাককালাম ককনি বা আদি লন্ডনি উচ্চারণে তাঁকে অন্য ধরনের উত্তরীয় পরিধানের পরামর্শ দেয়। মি. মারকাম দূরদৃষ্টি দিয়েই যেন দেখে নেন এ পোশাকে তাঁকে স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে দেখা গেলে ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ ওদের ড্রেসের রং তিনি চুরি করেছেন। তাঁর খরচে ম্যাককালাম একটি বিশেষ নকশা করে দেন যাতে টারটান বা পশমি কাপড়টি বর্তমানের মতো হুবহু দেখা না যায়। এটি তৈরি করা হয় রয়াল স্টুয়ার্টের ওপর ভিত্তি করে, তবে নকশার আইডিয়া গ্রহণ করা হয় ম্যাকালিস্টার এবং ওজিলভি ক্ল্যান বা সম্প্রদায় থেকে, রং ধার করা হয় বুচানান, ম্যাকবেথ, চিফ অব ম্যাকিনটশ এবং ম্যাকলিয়ড থেকে। যখন নমুনা দেখানো হয়েছিল মারকামকে, তিনি শঙ্কিত হয়ে ভেবেছিলেন তাঁর পরিচিত মহলের কাছে এটি ক্যাটকেটে, রুচিহীন চকমকে রঙিন মনে হতে পারে। তবে রডনিক ম্যাকডু যখন পোশাকটির সৌন্দর্যে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে তিনি তখন আর এটি সম্পূর্ণ করার বিষয়ে কোনো আপত্তি তুলতে পারেননি। তিনি ভেবেছেন ম্যাকডুর মতো একজন প্রকৃত স্কচম্যানের যদি এটি পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে তো ড্রেসটি ঠিকই আছে— বিশেষ করে জুনিয়র পার্টনারটি আকার আকৃতিতে তাঁর মতোই দেখতে। ম্যাককালাম মোটা অঙ্কের চেকখানা নেয়ার সময় মন্তব্য করে :

‘আমি এরকম ড্রেস আরও কয়েকটি বানিয়েছি, যদি আপনার কিংবা আপনার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন হয়।’ মারকাম কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন তিনি খুবই খুশি হবেন যদি সুন্দর এ ড্রেসটি সকলের পছন্দের জিনিস হয়ে দাঁড়ায় এবং তিনি নিশ্চিত এটি হবেই। ম্যাককালাম ইচ্ছে করলে সেসব ড্রেসও বিক্রি করে দিতে পারে।

কর্মচারীরা সবাই বাড়ি চলে যাওয়ার পরে মারকাম একদিন সন্ধ্যায় অফিসে বসে পোশাকটি গায়ে চড়ালেন। আয়নায় নিজেকে দেখে তিনি বড়ই প্রীত হলেন। বেশ মানিয়েছে তাঁকে। ম্যাককালাম চমৎকার বানিয়েছে ড্রেস। সিদ্ধান্ত নিলেন স্কটল্যান্ডে পা রাখার দিনই তিনি এটি পরবেন।

ব্যান রাই স্টিমার যেদিন সকালে গার্ডল নেম বাতিঘরের কাছে নোঙর করেছে, অপেক্ষা করছে জোয়ারের জন্য, জোয়ার এলেই অ্যাবারডিন বন্দরে ঢুকে পড়বে, মি. মারকাম তাঁর নতুন রং ঝলমলে পোশাকটি পরে কেবিন থেকে উদয় হলেন। প্রথম মন্তব্যটি শুনলেন তাঁর ছেলের কাছ থেকে। সে তার বাবাকে প্রথম দর্শনে চিনতেই পারেনি।

‘এই দ্যাখো, একজন স্কট! এ দেখছি গভর্নর!’ বলেই সে ছুটে সেলুনে ঢুকে মুখে কুশন চাপা দিল। হাসি চাপবার চেষ্টা করছে। মারকাম একজন দক্ষ জাহাজি এবং জাহাজের অগ্রভাগের ক্রমাগত দোল তাঁকে মোটেই কাবু করতে পারেনি। তাই এ মন্তব্য শুনে তাঁর স্বাভাবিক রক্তাভ চেহারা আরও রাঙা হলো যখন টের পেলেন তিনি সকলের আকর্ষণের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কারণ তারা আড়চোখে তাঁকে দেখছে। এবং নানারকম মন্তব্য শুরু করেছে। তিনি বুক ফুলিয়ে অচেনা লোকগুলোর মুখোমুখি হলেন। তাঁদের মন্তব্য কানে এলেও তিনি আপসেট হলেন না মোটেই।

‘লোকটা মাংসের দলা,’ ককনি ইংরেজিতে বলল একজন।

‘ওর গায়ে মাছি পড়ছে,’ মন্তব্য করল রোগা, লম্বা এক ইয়াংকি, সি সিকনেসের কারণে ফ্যাকাশে চেহারা।

‘বেশ বলেছ! চলো, আমাদের মদ খাওয়ার পাত্তর ভরতি করি গে। এখনই সুযোগ,’ বলল ইনভারনেসগামী এক তরুণ, অক্সফোর্ড থেকে এসেছে। তবে সকলের কণ্ঠ ছাপিয়ে যার গলা শুনতে পেলেন মি. মারকাম, সে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাটি।

‘সে কোথায়? সে কোথায়?’ বলতে বলতে কাঁদতে কাঁদতে মাথার হ্যাট পেছনে ফেলে রেখে ছুটে এল সে। চেহারায় উদ্বেগ কারণ তার মা মাত্রই তাকে বলছিলেন তাঁর বাবার অবস্থার কথা। তবে বাবাকে দেখামাত্র সে এমন হাসিতে ফেটে পড়ল দেখে মনে হলো মৃগী রোগে পেয়েছে। অন্যান্য সন্তানদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। তাদের হাসাহাসি শেষ হলে মি. মারকাম নিজের কেবিনে ফিরে গেলেন এবং তাঁর স্ত্রীর কাজের বুয়াকে পাঠালেন পরিবারের সকল সদস্যকে ডেকে আনার জন্য। তিনি ওদের সঙ্গে কথা বলতে চান। সবাই হাজির হলো। তারা প্রাণপণে তাদের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

মি. মারকাম ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত শান্ত গলায় বললেন :

‘প্রিয় পুত্রকন্যাগণ, আমি কি তোমাদের যথেষ্ট পরিমাণ হাতখরচ দিই না? ‘দাও, বাবা,’ গম্ভীর হয়ে জবাব দিল সকলে। ‘তোমার মতো এত হাতখরচা কেউ দেয় না।’

‘তোমরা যে যা পোশাক কিনতে চাও আমি কি তা কিনে দিই না?’

‘অবশ্যই দাও, বাবা!’ এবারে লাজুক এবং নম্র শোনাল সবার কণ্ঠ।

‘তাহলে, আমার প্রিয় পুত্রকন্যাগণ, তোমাদের কি মনে হয় না আমি যাতে অস্বস্তিতে পড়ে না যাই সেরকম কোনো কাজ থেকে তোমাদের বিরত থাকা উচিত? সেটা যদি এমন কোনো ড্রেস হয়ে থাকে যা তোমাদের চোখে হাস্যকর, যদিও আমরা যেখানে বেড়াতে যাচ্ছি সেখানকার অত্যন্ত কমন একটি পোশাক এটি, এরকম কোনো ড্রেস আমি পরলে তা নিয়ে কি হাসাহাসি করা উচিত?’ প্রত্যুত্তরে কেউ কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাঁকাল সায় দেয়ার ভঙ্গিতে। ওরা সবাই জানে তাদের বাবাটি একজন ভালো মানুষ। তিনি ওদের মাথা দোলানো দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন :

‘যাও, এখন গিয়ে তোমরা মজা করো গে। এ বিষয় নিয়ে আমরা আর কোনো কথা বলব না।’

তারপর তিনি আবার ডেকে চলে গেলেন এবং আশপাশের মানুষজনের ট্যারা চাউনি বা তির্যক মন্তব্য গ্রাহ্য না করে ওখানে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তবে কেউ কিছু বললেও চুপিচুপি বলল যাতে তাঁর কানে না যায়।

ব্যান রাইতে আর কী ঘটেছে, অ্যাবারডিনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো আরও বেশি। স্টিমার ঘাটে নেমে মারকাম পরিবার যখন রেলওয়ে স্টেশনের দিকে চলল, ঘাটের ছাউনির নিচে অপেক্ষমাণ ছেলেপিলে, মহিলা, শিশু, বখাটেরা সবাই মিলে দল বেঁধে ওদের পিছু নিল। এমনকি কুলির দল যারা গ্যাংপ্লাঙ্কের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকে পর্যটকদের মাল-সামানা বইবার জন্য তারাও ফুর্তি পেয়ে মারকাম পরিবারের পেছন পেছন চলতে শুরু করল। তবে ভাগ্যই বলতে হবে তখন পিটারহেড ট্রেনটি ছাড়ার সময়ও হয়ে গিয়েছিল ফলে মি. মারকামের যন্ত্রণা আর প্রলম্বিত হলো না।

ক্যারিজে জাঁকজমকপূর্ণ হাইল্যান্ডিয় কস্ট্যুমটি কারও চোখে পড়ল না আর ইয়েলনের স্টেশনে মানুষজন কমই ছিল। কাজেই সেখানে কোনোরকম ঝামেলা হলো না। তবে ঘোড়ার গাড়ি যখন মেইনস অব ক্রুকেনের কাছাকাছি এসেছে, জেলেরা ছুটে গেল তাদের বাড়ির দোরগোড়ায় মি. মারকামকে এক নজর দেখতে। জেলে সম্প্রদায়ের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই ছুটে চলছিল অশ্বশকট। মি. মারকামকে দেখে তারা যারপরনাই আনন্দিত। শিশুরা মাথার টুপি হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে এবং চিৎকার করতে করতে গাড়ির পেছন পেছন ছুটল। জেলে পুরুষেরা হাতের জাল ইত্যাদি ছুড়ে ফেলে দিয়ে গাড়ির পিছু নিল। মহিলারাও তাদের বাচ্চাকাচ্চার হাত ধরে ছুটেছে। দীর্ঘ যাত্রায় ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর পাহাড়টিও ছিল খাড়া ফলে গাড়ির নাগাল পাওয়া গ্রামবাসীদের পক্ষে সহজই হলো। এমনকি একপর্যায়ে তারা গাড়ির সামনে সামনে চলতে লাগল।

লোকজনের চেহারায় উপহাসের ভঙ্গি দেখে নিতান্তই বিরক্ত বোধ করে মিসেস মারকাম এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যারা আপত্তি জানিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল আপাত দৃশ্যমান হাইল্যান্ডারের অবয়বে দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ দেখে। তাঁর টাক মাথা ছাপিয়ে জেগে থাকা ইগলের পালক, চর্বিবহুল কাঁধের ওপর কেয়ার্নগর্ম ব্রুচ এবং ব্রুেমোর, ডার্ক ও পিস্তলে সজ্জিত মারকাম সাহেবকে সাহস এবং শৌর্যবীর্যের ভয়ানক এক প্রতীক বলেই মনে হচ্ছিল।

ওরা যখন রেড হাউসের ফটকে পৌঁছাল, ওখানে ক্রুকেনের অধিবাসীরা ভিড় করে অপেক্ষা করছিল। তাদের কারও মাথায় টুপি নেই এবং সকলেই নীরব। নীরবতা ভেঙে গেল এক লোকের গমগমে কণ্ঠে :

‘দ্যাখো! ওনার মুখে পাইপ নেই!’

ভৃত্যের দল কয়েকদিন আগেই চলে এসে সবকিছু রেডি করে রেখেছিল। কঠিন একটি ভ্রমণ শেষে পেট পুরে দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে পরিবারের সদস্যরা পথের ক্লান্তি ভুলে গেল এবং পরিবার-প্রধানের পোশাক নিয়ে লোকের ব্যঙ্গ বিদ্রূপজনিত যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি হয়েছিল তাও তারা বিস্মৃত হলো।

সেদিন বিকেলে মারকাম সাহেব, তখনো পূর্ণ পোশাকে সুসজ্জিত, মেইনস অব ক্রুকেনে হাঁটতে বেরুলেন। তবে তাঁর সঙ্গী কেউ নেই। অদ্ভুতই বলতে হবে তাঁর স্ত্রী এবং দুই কন্যার একসঙ্গে মাথা ধরেছে এবং তারা ভ্রমণক্লান্তিতে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। মারকাম সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্রটি, বয়সে কিশোর, এলাকাটি ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে। অপর ছেলেটিকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন মি. মারকাম। কিন্তু শুনলেন সে নাকি জলের পিপার মধ্যে আছাড় খেয়েছে। কাকভেজা অবস্থা তার। জামাকাপড় না শুকানো পর্যন্ত বেরুতেও পারবে না। কারণ বাক্সপেটরা এখনো খোলা হয়নি বলে ভিজে কাপড়েই তাকে থাকতে হচ্ছে।

একা একা হাঁটতে ভালো লাগছে না মি. মারকামের। কোনো পড়শির সঙ্গে এখন পর্যন্ত তাঁর দেখা হয়নি। এমন নয় যে এ এলাকায় লোকসংখ্যা খুব কম; বরং দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটি বাড়িতেই মানুষজন ভর্তি, কিন্তু বাড়ির সামনে লোকজন কিংবা রাস্তার ধারের মানুষজন কেন জানি তাঁকে এড়িয়ে চলছে, একটা দূরত্ব বজায় রাখছে। হাঁটার সময় তিনি বাড়িঘরের দরজার কিনারে অথবা জানালায় হ্যাটের মাথা কিংবা চোখের সাদা অংশ দেখতে পেলেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো কেবল একটি বুড়ো মানুষের সঙ্গে। এ লোককে কেউ কখনো কথা বলতে দেখেনি, কেবল মিটিং হাউসে ‘আমেন’ বলা ছাড়া। বুড়ো সকাল আটটা থেকে ডাকঘরে বসে থাকে ডাক আসা পর্যন্ত। চিঠির ঝুলিটি নিয়ে যায় পাশের ব্যারনের প্রাসাদে। দিনের বাকি সময়টা তার কেটে যায় পোর্ট বা বন্দরের শীতল, বায়ুপূর্ণ অংশে একটি বেঞ্চিতে। ওখানে মাছের বর্জ্য, বাড়িঘরের আবর্জনা ইত্যাদি ছুড়ে ফেলা হয়। হাঁসের পাল এ জায়গাটিতে প্যাঁক প্যাঁক শব্দে বেশ আনন্দ উল্লাসে কাটায়।

মারকাম সাহেবকে আসতে দেখে বুড়ো স্যাফট ট্যামি চোখ তুলে তাকাল। এমনিতে তার দৃষ্টি সাধারণত তার আসনের বিপরীত দিকের রাস্ত ায় নিবদ্ধ থাকে। মারকাম সাহেবকে দেখে সে অত্যন্ত বিস্মিত, মনে হলো আকস্মিক সূর্যকিরণে তার চোখ ঝলসে গেছে। সে চোখ ঘষে হাত দিয়ে আড়াল করল। তারপর সিধে হয়ে হাত বাড়িয়ে বাইবেল থেকে দ্রুত কিছু স্রোতবাক্য ঝেড়ে দিয়ে আবার নিজের আসনে বসে পড়ল চেহারায় উদাস, ভাবলেশহীন ছাপ ফুটিয়ে তুলে।

এই দীর্ঘ, ক্রোধোদ্দীপ্ত বক্তৃতা খানিকটা আপসেট করে তুলল মি. মারকামকে। তাঁর মনে হলো ওই বুড়োটা একটা পাগল। লোকটাকে তিনি বকা দেবেন ভেবেও নিবৃত্ত করলেন নিজেকে। যদিও তিনি সংকল্প করেছিলেন কেউ উপহাস করলে দাঁতভাঙা জবাব দেবেন কিন্তু এখনতক স্কটল্যান্ডে এমন কিছু চোখে পড়েনি যা কিল্ট বা পুরুষদের পরিধেয় ঝালরঅলা ঘাগরার কথা স্মরণে আনতে পারে। আধঘণ্টাও তিনি বাইরে কাটালেন না, চলে এলেন বাড়িতে। দেখলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা, যাদের নাকি মাথা ধরেছে, তারা সবাই হাঁটতে বেরিয়েছে। ওদের অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি ড্রেসিংরুমে ঢুকে হাইল্যান্ড ড্রেসটি খুলে ফেললেন এবং ফ্ল্যানেলের সুট গায়ে চড়ালেন। একটি সিগার ধরালেন এবং একটু পরে নিদ্রা গেলেন। তাঁর ঘুম ভাঙল পরিবারের সদস্যদের ফিরে আসার শব্দে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের ড্রেসটি পরে ড্রইংরুমে হাজির হলেন চা পান করার জন্য।

সেদিন বিকেলে তিনি আর বেরুলেন না; ডিনার শেষে আবার পোশাকটি গায়ে চড়ালেন এবং সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে গেলেন। এ সময়ে তিনি এই উপসংহারে এলেন যে তিনি ক্রমে হাইল্যান্ড ড্রেসটি পরিধানে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন। এক সময় এটি তাঁর সাধারণ পোশাকে পরিণত হবে।

আকাশে চাঁদ উঠেছে। বালু পাহাড়গুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন মি. মারকাম। শিগগির চলে এলেন সৈকতে। এখন জোয়ার নেই, পাথরের মতো জেগে আছে বালুকাবেলা। তিনি দক্ষিণমুখী হয়ে হাঁটতে হাঁটতে উপসাগরের প্রায় প্রান্তে চলে এলেন। এখানে দুটি শিলাখণ্ড তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, বালিয়াড়ির কিনারে ঘেঁষে পাথর দুটো মাথা উঁচিয়েছে। তিনি কদম বাড়ালেন ওগুলোর দিকে। সবচেয়ে কাছের শিলাখণ্ডটিতে এসে তিনি ওটা বেয়ে চুড়োয় উঠে গেলেন। ভেজা বালু থেকে পনের কুড়ি ফুট উঁচু পাথরখণ্ডটি। ওখানে বসে শান্তিময়, চমৎকার নিসর্গ উপভোগ করতে লাগলেন মি. মারকাম। পেনিফোল্ডের অন্তরীপের পেছন দিয়ে মুখ তুলছে চাঁদ, আলো স্পর্শ করছে পৌনে এক মাইল দূরের স্পারস-এর পাহাড়চুড়ো। বাকি পাহাড়গুলো গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। চাঁদমামা অন্তরীপের মাথায় উঠে এলে প্রথমে স্পারস-এর পাহাড়গুলো তারপর সমুদ্র সৈকত আস্তে আস্তে আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় বসে রইলেন মি. মারকাম। দেখছেন চাঁদ এবং তার আলোয় ক্রমে উদ্ভাসিত হতে থাকা এলাকাগুলো। এরপর তিনি পুবমুখো হয়ে ঘুরে বসলেন। হাতের ওপর থুতনি রেখে তাকিয়ে থাকলেন সাগরের দিকে। কী অপূর্ব সুন্দর সাগর! চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এখানে লন্ডন শহরের গোলমাল, আওয়াজ, উদ্বেগ কোনো কিছুই নেই। নিজেকে তাঁর দারুণ মুক্ত মনে হচ্ছে। চকমকে জলের দিকে তিনি তাকিয়ে আছেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে পানি। জোয়ার এসেছে। হঠাৎ অনেক দূর থেকে, সৈকত থেকে ভেসে এল দূরাগত চিৎকার।

‘জেলেরা একে অপরকে ডাকছে,’ আপনমনে বললেন তিনি। তাকালেন চারপাশে। আর তখন দারুণ একটা নাড়া খেলেন। যদিও ওই সময় এক খণ্ড মেঘ চাঁদের ওপর দিয়ে ভেসে গিয়ে অন্ধকার তৈরি করেছিল কিন্তু তার মধ্যেই তিনি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। এক মুহূর্তের জন্য দেখলেন বিপরীত শিলাখণ্ডের মাথায় বসে আছেন দ্বিতীয় মারকাম। অবিকল তাঁর মতোই টাকু এবং গ্লেনগারি ক্যাপে ইগলের পালক গোঁজা। ভয়ানক চমকে যাওয়ার কারণে তিনি যে শিলাখণ্ডের ওপর বসে ছিলেন, সেখানে পিছিয়ে যেতে তাঁর পা গেল পিছলে এবং তিনি দুটো শিলাখণ্ডের মাঝখানের বালুতে পপাতধরনিতল হতে শুরু করলেন। শিলাখণ্ডের উচ্চতা বেশি ছিল না বলে তিনি এ নিয়ে চিন্তিতও ছিলেন না। তাঁর মস্তিষ্কজুড়ে শুধু ছিল একটু আগে দেখা নিজের অবিকল প্রতিরূপ। যদিও ওটা এখন আর নেই। বালুর ওপর লাফ দেবেন ভেবেছিলেন মারকাম। গোটা ব্যাপারটিই ঘটে গেল এক সেকেন্ড সময়ের মধ্যে, যদিও তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছিল দ্রুত এবং এমনকি তিনি লাফানোর জন্য প্রস্তুতও হয়ে গিয়েছিলেন নিচের বালুর ওপর। কিন্তু বালুটা যেন কেমন তিরতির করে কাঁপছিল। একটি আকস্মিক ভয় জেঁকে বসল মারকামকে; তাঁর হাঁটু কেঁপে গেল এবং লম্ফ প্রদানের বদলে তিনি হড়হড়িয়ে পিছলে যেতে লাগলেন শিলাখণ্ডের গা বেয়ে, নগ্ন পা ঘষা খেল পাথরে। তাঁর পদযুগল স্পর্শ করল বালু-যেন সেঁধিয়ে গেল পানির মধ্যে-তিনি বুঝে ওঠার আগেই দেখেন চোরাবালির মধ্যে হাঁটু জোড়া গেড়ে গেছে।

আরও যাতে ডুবে না যান সেজন্য উন্মত্তের মতো হাত বাড়ালেন শিলাখণ্ডের দিকে ওটাকে আঁকড়ে ধরার আশায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে শিলাখণ্ডের গা ফুঁড়ে একটি স্পার বা কিনারা বেরিয়ে ছিল, সেটিই তিনি চেপে ধরলেন সহজাত প্রবৃত্তিতে। এবং ঝুলে থাকলেন মরিয়া হয়ে।

চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলেন মারকাম সাহেব। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না। প্রাণপণ চেষ্টায় অবশেষে একখানা গগনবিদারী চিৎকার দিতে সমর্থ হলেন। আবারও চেঁচালেন। নিজের গলার স্বর তাঁকে যেন সাহস জুগিয়ে চলছিল, কারণ তিনি পাথরখণ্ডটি অনেকটা সময় ধরে আঁকড়ে রাখতে পারছেন যা পারবেন বলে ভাবেননি। স্রেফ মরিয়ার মতো, খড়কুটো ধরার মতো তিনি ওটা ধরে আছেন। তবে টের পেলেন মুঠো ক্রমে আলগা হয়ে আসছে। কিন্তু কী আনন্দ! তাঁর চিৎকার কেউ শুনতে পেয়েছে। সাড়া দিচ্ছে!

‘ঈশ্বররে শুকরিয়া! আশা করি দেরি কইরা ফালাই নাই!’ উরু পর্যন্ত লম্বা বুট পরা এক জেলেকে দেখা গেল শিলাখণ্ড বেয়ে ওপরে উঠছে। সে মুহূর্তে বিপদের মাজেজা উপলব্ধি করতে পারল এবং চেঁচিয়ে বলল, ‘এট্টু খাড়ান, ভাইসাব। অহনই আইতাছি!’ সে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নামতে লাগল এবং পাথরের গায়ে একটি ফুট হোল্ড বা পা রাখার মতো জায়গা খুঁজে পেল। সেই খাঁজে পা রেখে সে শক্তিশালী একটি হাতে শিলাখণ্ড আঁকড়ে ধরে ঝুঁকল এবং অপর হাতে মারকাম সাহেবের কব্জি চেপে ধরে হেঁকে বলল, ‘এট্টু, ভাইসাব। আপনেরে অহনই তুলতাছি।’

প্রচণ্ড শক্তিতে সে মারকাম সাহেবকে আস্তে আস্তে চোরাবালির গ্রাস থেকে টেনে তুলে শিলাখণ্ডের ওপর নিরাপদ একটি জায়গায় বসিয়ে দিল। তারপর তাঁকে দম নেয়ার সময়ও দিল না এক টান মেরে এবং ধাক্কা মেরে শিলাখণ্ডের যেদিকটাতে শক্ত বালু রয়েছে সেখানে ফেলে দিল। তবে একবারের জন্যও মারকাম সাহেবের হাত ছাড়েনি জেলে লোকটা। তাঁকে বালুর ওপর বসিয়ে দিল সে। তখনো বিপদের ধাক্কা সুস্থির হতে দেয় নি মি. মারকামকে। থরথর করে কাঁপছেন।

জেলে এবারে বলল, ‘ভাগ্যিস! ঠিক সময়ে আইসা পড়ছিলাম। দেরি করলে এতক্ষণে চোরাবালিতে ডুইবা শ্বাস বন্ধ হইয়া মইরা পইড়া থাকতেন। উলি বিয়াগরির ধারণা আপনে একটা ভূত। টম ম্যাক ফেইল বলে আপনে নাকি পিশাচ। কিন্তু আমি কইলাম, ‘না! আপনে মাথামোডা ইংলিশ-একটা পাগল-পাগলাগারদ দিয়া পলাইছেন।’ পাগল না হইলে কেউ চোরাবালির কাছে যায়! আপনেরে সাবধান করার লেইগা কত ডাকাডাকি করছি কিন্তু আপনে হুনলে তো! তারপর দৌড় পাড়লাম দরকার হইলে আপনেরে টাইনা ধইরা রাখুম। ঈশ্বররে শুকরিয়া আপনে নির্বোধ হন বা মাথা খারাপ, আমার বেশি দেরি হয় নাইক্কা!’ বলতে বলতে সে মাথা থেকে ক্যাপটা উঁচু করে ধরল সশ্রদ্ধচিত্তে।

ভয়ংকর মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়ে লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছিলেন মি. মারকাম। তবে তার বিশেষণগুলো মারকাম সাহেবের গায়ে রীতিমতো হুল ফোটাচ্ছিল। তিনি রেগেমেগে একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সেই আধ পাগল ডাকপিয়নের কথাটা মনে পড়তে বুকটা হিম হয়ে গেল। তিনি নিশ্চুপ থাকলেন। লোকটা বন্দরে বসে তাঁকে উদ্দেশ্য করে গাঁক গাঁক করে চেঁচাতে চেঁচাতে বাইবেলের স্রোত থেকে যে কথাগুলো বলছিল তার মধ্যে এরকম একটি সাবধানবাণী ছিল : ‘বেশি দেমাগি হইয়েন না। দেমাগ ভালা জিনিস না। একদিন আপনে নিজের মুখোমুখি হইবেন আর আপনারে যহন গিইল্যা খাইব চোরাবালি তখন আপসোস করবেন।’

তিনি খানিক আগেই এখানে নিজের প্রতিমূর্তি দেখেছেন এবং তার পরপরই চোরাবালিতে ডুবে মরার দশা হয়েছিল তাঁর। তিনি দীর্ঘ এক মিনিট চুপ থেকে বললেন, ‘ভাই রে, তুমি আজ আমার জান বাঁচালে। আমাকে চির ঋণী করলে!’

জেলে জবাবে বলল, ‘না! না! আপনি ঋণী ওপরঅলার কাছে। আমি তো তাঁর দয়ার পাত্ৰ মাত্ৰ।’

‘কিন্তু তোমাকে অন্তত ধন্যবাদ দিতে দাও।’ বলে জেলের প্রকাণ্ড হাত দুটি শক্ত করে চেপে ধরলেন মি. মারকাম। ‘আমার মাথা এখনো কাজ করছে না, বুক কাঁপছে ত্রাসে, যে জন্য আমি বেশি কিছু বলতেও পারছি না। তবে বিশ্বাস করো, আমি সত্যি অত্যন্ত, অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’ তাঁর কথা জেলেকে এমনভাবে ছুঁয়ে গেল যে তার গাল বেয়ে জল পড়তে লাগল।

সে কাঠখোট্টা গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, স্যার। আমারে ধন্যবাদ দিলে যদি আপনার মন ভালা হয় তাইলে দিয়েন। আমিও আপনার জায়গায় হইলে কৃতজ্ঞ থাকতাম। তয় স্যার, আমার ধন্যবাদ ফন্যবাদের কোনো দরকার নাই। আপনেরে জানে বাঁচাইতে পারছি তাতেই আমি খুশি।’

তবে আর্থার ফার্নলি মারকাম জেলেটির প্রতি যে কত কৃতজ্ঞ তার প্রমাণ মিলল কয়েকদিন পরেই। এক সপ্তাহ বাদেই পোর্ট ক্রুকেনে চলে এল একটি অপূর্ব সুন্দর মাছ ধরার পালতোলা নৌকা। পিটারহেডের জেটিতে এমন সুন্দর জেলে নৌকা কেউ কোনোদিন দেখেনি। মাছ ধরার সমস্ত সরঞ্জামে সজ্জিত নৌকাটি। সবচেয়ে সেরা জালও রয়েছে এটিতে। জেলের বৌর কাছে নৌকার মালিকানার সমস্ত কাগজপত্র তুলে দিয়ে এর মালিক তাঁর লোকজন নিয়ে বিদায় হলেন।

মি. মারকাম জেলেকে নিয়ে সৈকতে বেড়াতে গেলেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গীকে অনুরোধ করলেন সে যেন সেদিনের ঘটনার কথা কাউকে না বলে। সেই ভয়ানক বিপদের কথা শুনলে তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যারা বিপন্নবোধ করবে। বললেন তিনি ওদেরকে চোরাবালিটি সম্পর্কে সাবধান করে দেবেন। জেলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় মারকাম সাহেব জানতে চাইলেন সে সেদিন অপর শিলাখণ্ডের ওপর মারকামের মতো পোশাক পরা দ্বিতীয় কাউকে দেখেছিল কিনা।

‘না, না!’ জবাব এল। ‘ওইখানে অন্য কেউ নাই। জেমি ফ্লিম্যানের পরে ওইখানে আর কেউ যায় না। আপনে যে কোন আক্কেলে ওইদিন পাথরডার উপর বইসা ছিলেন! আপনেরে তো বাতরোগে ধরতে পারত। এমন বোকামি কেউ করে!’ বলে সে বকর বকর শুরু করে দিল। তবে তাকে কিছু বললেন না মি. মারকাম। তিনি বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন। জেলেকে এক গ্লাস হুইস্কি পানের প্রস্তাব দিলেন। সে প্রস্তাব গ্রহণ করল। তারপর বাড়ির পথ ধরল। মারকাম সাহেব তাঁর পরিবারের লোকদের চোরাবালি সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন। বললেন তিনি নিজেও বিপদে পড়তে যাচ্ছিলেন।

সেই রাতে তাঁর ঘুম এল না। ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি বেজে চলল একের পর এক কিন্তু তিনি দুচোখের পাতা এক করতে পারছেন না কিছুতেই। বারবারই চোরাবালির ভয়ানক ঘটনাটি মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্যাফট ট্যামি তাঁকে বাইবেলের স্রোত শুনিয়ে সাবধান করে দিয়েছিল তিনি যেন অহংকারের পাপের বিষয়ে সতর্ক থাকেন।

ভোরের দিকে তাঁর একটু তন্দ্রামতো এল। স্বপ্নেও তিনি চোরাবালি দেখলেন। তাঁর স্ত্রীর নাড়া খেয়ে জেগে গেলেন। স্ত্রী বলছেন, ‘একটু শান্তিতে ঘুমাও! ওই হাইল্যান্ড ড্রেসটাই তোমার মাথা খেয়েছে। ঘুমের মধ্যেও তো দেখছি কথা বলছ!’ তিনি জানতে চাইলেন ঘুমের মধ্যে কী বলেছেন। তার স্ত্রী জবাব দিলেন :

‘কী সব হাবিজাবি বলছিলে-’মুখোমুখি নয়! আমি টাক মাথার ওপর ইগলের পালক দেখেছি! এখনো আশা আছে! মুখোমুখি নয়!’ এইসব আর কী! এখন ঘুমাও! ঘুমাও বলছি!’ তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন এটি উপলব্ধি করে যে পাগলা লোকটার ভবিষ্যদ্বাণী এখনো পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি। এত কিছু ঘটনার পরেও তিনি নিজের মুখোমুখি হতে পারেননি।

তাঁর ঘুম ভাঙাল বাড়ির পরিচারিকা। জানাল এক জেলে এসেছে। মি. মারকামের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পোশাক পরে নিলেন-এখনো হাইল্যান্ড ড্রেসটি দ্রুত পরার অভ্যাস করে নিতে পারেননি। ঝটপট নেমে এলেন নিচে, জেলেকে অপেক্ষায় রাখতে চান না। তিনি বিস্মিত হলেন এবং একই সঙ্গে অখুশি হলেন দেখে তাঁর দর্শনার্থী সেই জেলে নয়, স্যাফট ট্যামি। মারকাম সাহেবকে দেখে তার মুখ দিয়ে আগুন ঝরতে লাগল। সে যা বলল তার সারমর্ম হলো- সে আজ ডাকঘরে না গিয়ে সরাসরি মি. মারকামের বাড়ি এসেছে দেখতে তিনি এখনো ঠাঁটবাট নিয়ে চলছেন কিনা। এবং সে দেখতে পাচ্ছে মারকাম সাহেবের শিক্ষা হয়নি (মি. মারকাম যে হাইল্যান্ড ড্রেসটি পরেন এটিই ট্যামির গাত্রদাহের কারণ- এটি তিনি দেরিতে হলেও বুঝেছেন। এ জন্যই ট্যাম তাঁকে দেমাগি, অহংকারী ইত্যাদি বলে গালাগাল দেয়)।

ট্যামি যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল মি. মারকামের সময় আর বেশি নেই। তিনি নির্ঘাত চোরাবালির গ্রাসে পড়বেন এবং সেখান থেকে শয়তানের খপ্পরে।

ট্যামি গটমট করে চলে গেল। তাঁর কথা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন মারকাম সাহেব। ভেবেছিলেন আজ সাধারণ ড্রেস পরবেন কিন্তু স্যাফট ট্যামি তাঁর মেজাজটাই দিল বিগড়ে। সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে দেখিয়ে দেবেন তিনি কাপুরুষ নন, কারও হুমকি-ধমকিতে ডরান না এবং যেভাবে চলছেন সেভাবেই চলবেন—ফলাফল যাই হোক।

তিনি নাশতা করতে এলেন চাকচিক্যময় পোশাকটি পরেই। তাঁকে দেখে তাঁর ছেলেমেয়েরা মাথা নিচু করে বসে রইল, সম্ভ্রম দেখাতে নয়, হাসি চাপতে। কেউই জোরে হাসল না, শুধু ছোট ছেলে টাইটাস বাদে। সে

বগবগ করে হেসে ফেলল এবং তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের করে দেয়া হলো-এ জন্য অবশ্য কাউকে দোষ দেয়া যায় না।

দুর্ভাগ্যই বলতে হবে মারকাম সাহেবের স্ত্রী তাঁর স্বামীকে চা দিতে গিয়ে তাঁর র‍্যাপারের সঙ্গে মি. মারকামের আস্তিনের বোতাম আটকে গেল এবং ফলে কাপ থেকে গরম চা ছলকে পড়ল মারকামের নগ্ন হাঁটুতে। তিনি খেঁকিয়ে উঠলে স্ত্রীর কাছ থেকে পাল্টা মুখ ঝামটা খেলেন।

‘আর্থার, তুমি ওইরকম হাস্যকর একটা পোশাক পরে থেকে নিজেকে বোকা সাজিয়ে রাখলে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করো? তুমি এখনো পোশাকটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারনি- কোনোদিন পারবেও না!

জবাবে মি. মারকাম রুষ্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শুধু ‘ম্যাডাম’ বলেই ক্ষান্ত দিলেন। তবে স্ত্রীর কথায় তাঁর জেদ চেপে গিয়েছিল বলে তিনি সংকল্প করলেন স্কটল্যান্ডে যতদিন আছেন এ ড্রেস ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরবেন না।

অশ্রুসজল চোখে মিসেস মারকাম বললেন, ‘বেশ, আর্থার! তোমার যা খুশি তুমি করো। লোকের চোখে তোমার মতো আমাকেও হাস্যাস্পদ করে তোলো। এবং আমাদের মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দাও। তোমার মতো ইডিয়েটকে কোনো তরুণ শ্বশুর হিসেবে পেতে চাইবে না। তবে তোমাকে সাবধান করে দিলাম-তোমার এই অহংকারই তোমাকে একদিন ডোবাবে—তবে তার আগে না তোমার জায়গা হয় পাগলাগারদে কিংবা স্বর্গে।’

কয়েকদিন পরে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে গেল যে মি. মারকামকে বেশির ভাগ সময় একা একাই বাইরে যেতে হবে। তাঁর মেয়েরা এখন মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে বেরোয় খুব সকালে কিংবা সন্ধ্যার পরে অথবা কোনো বৃষ্টিভেজা দিনে যখন রাস্তাঘাটে কারও থাকার সম্ভাবনা নেই। তারা অবশ্য সবসময়ই বাপের সঙ্গে বেরুতে চায় কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠে না। ছেলেদের তো এসব সময়ে পাওয়াই যায় না। আর মিসেস মারকাম স্বামীর সঙ্গে বেরুতে আগ্রহী নন তার কিম্ভুত পোশাকটির জন্য।

মি. মারকাম রোববারে গির্জায় যান সাধারণ পোশাক পরে কারণ ওইদিন তিনি কাউকে চটাতে চান না। অবশ্য পরদিন সকালেই তাঁকে আবার হাইল্যান্ডিয় লেবাসে দেখা যায়। তাঁর দুর্দমনীয় ব্রিটিশ জেদই তাঁকে পোশাকটির কবল থেকে মুক্তি দেয় না। স্যাফট ট্যামি প্রতিদিন সকালে তাঁর বাড়ির সামনে এসে হাঁক চিক্কুর পাড়ে কিন্তু তাঁর দেখা পায় না কিংবা তাঁকে কোনো খবরও পৌঁছাতে পারে না। বিকেলে, চিঠিপত্র বিলি শেষে সে মি. মারকামকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে পিছু ডাকে এবং যথারীতি উপদেশ খয়রাত করে এবং সাবধান করে দেয় অহংকার ত্যাগ করার জন্য। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পরে লোকটাকে দেখলেই মারকাম সাহেবের মনে হতে থাকে ও একটা চাবুক এবং তাঁকে চাবকাচ্ছে।

বাধ্য হয়ে আংশিক একাকী জীবন যাপন এবং টানা বিরক্তি ও হতাশাবোধ, সেই সঙ্গে অবিরাম বিষণ্ণতা অসুস্থ করে তুলল মি. মারকামকে। তিনি এতটাই আত্ম অহমিকায় ভোগেন, পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কোনো কিছু শেয়ার করেন না, তাদেরকে গোপন কথা বলার মতো আস্থাও রাখেন না। এর কারণ তার দৃষ্টিতে, তারা তাঁর সঙ্গে মোটেই ভালো ব্যবহার করে না। এরপরে আবার তাঁর নতুন উপসর্গ দেখা দিল রাতে ভালো ঘুম হয় না এবং ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি সাহস বা তেজ হারাননি এটি প্রমাণ করতে প্রতিদিন অন্তত একবার চোরাবালি দর্শনে যান। এ অভ্যাসের কারণ সম্ভবত এই যে বিরতিহীন যে দুঃস্বপ্ন তিনি দেখে চলেছেন তা চোরাবালির সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক। স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে এমনই বাস্তব ঠেকে যে জেগে উঠে অনেক সময় বুঝতেই পারেন না ওই ভয়ানক জায়গাটায় তিনি সশরীরে যাননি। কখনো কখনো তিনি ভাবেন তাঁকে নিশিতে পেয়েছিল এবং তিনি ঘুমের ঘোরে ওখানে গেছেন।

এক রাতে স্বপ্নটি এমন জীবন্ত মনে হলো জেগে উঠে মারকাম সাহেবের বিশ্বাসই হতে চাইল না তিনি আসলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন। বারবার তিনি চোখ বুজলেন কিন্তু প্রতিবারই দৃশ্যটি, যদি এটি দৃশ্য হয়ে থাকে কিংবা বাস্তবতা, (যদি এটি বাস্তবতা হয়ে থাকে), তার সামনে এসে হাজির হলো।

তিনি দেখেছেন চোরাবালির ওপর ঝলমলে হলদে আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। মারকাম সাহেব ওদিকে এগোচ্ছেন। চোরাবালির কাছাকাছি যেতে দেখলেন বিপরীত দিক থেকে আরেকজন লোক তাঁর মতো পা ফেলে এগিয়ে আসছে। অবিকল তাঁর মতো দৈহিক আকৃতি, যেন ওটা তিনি নিজেই। নীরবে আতঙ্কে, কী এক অজানা শক্তি তাঁকে বাধ্য করছে জানেন না মারকাম সাহেব-যেন সাপ সম্মোহন করেছে পাখিকে-তিনি সম্মোহিত বা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই অপরজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এগিয়ে চললেন। যখন টের পেলেন চোরাবালির বালু তাঁকে চেপে ধরছে, মৃত্যু-যন্ত্রণার অনুভূতি নিয়ে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে কাঁপছেন তিনি অথচ কী অদ্ভুত ব্যাপার এই সময়েই কিনা সেই অদ্ভুত লোকটার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর! সে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছিল, ‘দম্ভ! দম্ভ! সব অসাড় দম্ভ! নিজেরে দ্যাখো আর চোরাবালিতে খাড়াইয়া অনুতাপ করো। চোরাবালি তোমারে গিইল্যা খাইব!’

এটি কোনো স্বপ্ন নয়, এতটাই দৃঢ় বিশ্বাস হলো তাঁর যে তিনি বিছানা থেকে নেমে পড়লেন এবং স্ত্রীকে না জাগিয়ে জামাকাপড় পরে চললেন সাগর সৈকতে। তাঁর বুক ধক করে উঠল দেখে বালুতে অনেকগুলো পদচিহ্ন ফুটে আছে এবং সেগুলো তাঁর নিজের পায়ের ছাপ। সেই একই চওড়া হিল, একইরকম চৌকোনা আঙুল; তাঁর মনে কোনোই সন্দেহ রইল না যে তিনি এখানে এসেছিলেন। আধা ভয় তরাস আর আধা স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো তিনি পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করে চললেন এবং দেখলেন চোরাবালির ধারে এসে ওগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। মারকাম সাহেব দারুণ চমকে গেলেন কারণ বালুতে প্রত্যাবর্তনের কোনো পদক্ষেপের চিহ্ন ফুটে নেই। তিনি বুঝতে পারলেন এ এমন এক ভয়ানক রহস্য যাতে তিনি সেঁধুতে পারছেন না এবং ভয় হলো এ রহস্যের মধ্যে ঢুকতে গেলে তাঁর সর্বনাশ হতে পারে।

এ পর্যায়ে মি. মারকাম দুটি ভুল করে বসেন। প্রথমত, তিনি নিজের সমস্যার কথা কাউকে বলেন না এবং পরিবারের কেউ জানতে পারে না তিনি কী ঝামেলার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বপ্নরহস্য এবং মানসিক সমস্যা জাতীয় বইপত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ফলে এসব বইয়ের ছাইপাঁশ লেখাগুলো তাঁর বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কের উর্বর মাটিতে জ্যান্ত জীবাণুর মতো সেঁটে থাকতে শুরু করে। এভাবে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুভাবেই সবকিছু তাঁর মধ্যে কাজ করতে থাকে। তাঁকে অবশ্য স্যাফট ট্যামিও সমানে বিরক্ত করে চলছিল। আজকাল সে নির্দিষ্ট একটি সময়ে মারকাম সাহেবের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি লোকটি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন ট্যামি এক ভূ- স্বামীর পুত্র ছিল। সে যাজকবৃত্তি নিয়ে কিছুটা পড়ালেখা করেছে। কিন্তু হঠাৎ‍ করে কেন সে পড়াশোনা ছেড়ে পিটারহেডে এসে তিমি শিকারি জাহাজে কাজ নিয়েছিল তা কেউ জানে না। এখানে বছর কয়েক ছিল সে। ক্রমে মৌনস্বভাবের হয়ে পড়ে এবং মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় বাদই দিয়ে দেয়। তার শিপমেটরা এমন রাকবিমুখ লোকের সঙ্গ ঠিক পছন্দ করছিল না। এরপরে ট্যামি উত্তরের নৌবহরের মাছ ধরার নৌকায় কাজ খুঁজে নেয়। অনেকদিন সে মাছ ধরার কাজটা করেছে এবং লোকে তাকে ‘হাবা’ বলে সম্বোধন করত। ক্রমে সে ক্রুকেনে থিতু হয়ে বসে এবং জমিদার বংশের ছেলে বলে এখানে তাকে একটি চাকরি দেয়া হয় এবং বর্তমানে সে অবসর ভাতা পাচ্ছে। যে যাজকটি মারকাম সাহেবকে এসব তথ্য দিয়েছে সে এই বলে তার কথা শেষ করে :

‘লোকটার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে বলে মনে হয়। ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। আমরা স্কচরা বিষয়টি বিশ্বাস করি। সে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে তা নাকি ফলে গেছে বলে অনেকেই। সে বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ পেলে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে!

এসব কথা শুনেও কোনোরকম সতর্ক বা উদ্বেগ বোধ করলেন না মি. মারকাম। বরং ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয়টি তার মনে আরও গভীরভাবে প্রোথিত হলো। তিনি যেসব বই পড়েছেন তার মধ্যে Die Doppleganger নামে একটি জার্মান বই তাঁকে খুব আকৃষ্ট করেছে এক নতুন বিষয়ের জন্য। লেখক ড. হেনরিক ভন আশেনবার্গ। এ বই পড়ে মারকাম সাহেব প্ৰথম জানতে পারলেন মানুষের দ্বৈত অস্তিত্বের কথা—যেখানে একজনের প্রবৃত্তি অপরজন থেকে সম্পূর্ণই আলাদা-যে শরীরে আত্মা একটি এবং একজন অপরজনের হুবহু প্রতিমূর্তি। বলাবাহুল্য মি. মারকাম উপলব্ধি করলেন এ তত্ত্ব হুবহু তাঁর সঙ্গে মিলে যায়। তিনি নিশ্চিত হলেন তিনি যাকে সেদিন চোরাবালিতে দেখেছেন সে তাঁরই ডুপলগেঞ্জার। তিনি দ্বৈত জীবনযাপন করছেন এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠলেন মি. মারকাম। নিজের সন্তুষ্টির জন্য বিষয়টি প্রমাণ করা প্রয়োজন। তাই এক রাতে, বিছানায় যাওয়ার আগে তিনি তাঁর জুতোর সোলে নিজের নামটি লিখে রাখলেন চক দিয়ে। সেই রাতে চোরাবালির স্বপ্ন দেখলেন, ওখানে তিনি গেছেন—স্বপ্নটি এমনই জীবন্ত ছিল যে খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তিনি ওখানে যাননি। স্ত্রীকে টের পেতে না দিয়ে চুপিচুপি তিনি বিছানা থেকে নামলেন জুতোর খোঁজে

জুতোর সোলের চক দিয়ে লেখা নিজের নামটি একদম ঠিকঠাক আছে! তিনি জামাকাপড় পরে নিঃশব্দে বেরোলেন ঘর থেকে। এখন সাগরে জোয়ার চলছে। তিনি বালিয়াড়ি পার হয়ে চোরাবালির দূরপ্রান্তের সৈকত ধরে হাঁটতে লাগলেন এবং মহা আতঙ্কিত হয়ে দেখলেন ভেজা বালুতে তাঁর পায়ের ছাপ!

মি. মারকাম অত্যন্ত মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁর কাছে গোটা ব্যাপারটাই কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। তিনি, একজন বৃদ্ধ ব্যবসায়ী যাঁর লম্বা একটি ঘটনাবিহীন জীবন কেটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের পেছনে জনবহুল লন্ডন শহরে, সেই তাঁকে এখন রহস্য এবং আতঙ্কের জালে জড়িয়ে পড়তে হলো! তিনি জানতে পারলেন তাঁর দুটো অস্তিত্ব রয়েছে!! নিজের এ সমস্যার কথা স্ত্রীকেও বলা যাবে না। তাহলে সে মি. মারকামের অপর জীবনটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইবে এবং শুরুতেই না জেনে না বুঝে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনবে।

মারকাম সাহেবের বিষণ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলল। একদিন সন্ধ্যায়, জোয়ার তখন যাই যাই করছে, আকাশে পূর্ণচন্দ্র- তিনি ডিনারের অপেক্ষা করছেন, এমন সময় কাজের বুয়া এসে বলল স্যাফট ট্যামি বড্ড ঝামেলা করছে বাইরে। কারণ মনিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ট্যামির কথা শুনে বেজায় রুষ্ট হলেন মি. মারকাম। তবে পাছে বুয়া ভেবে বসে তিনি ট্যামিকে ভয় পাচ্ছেন বলে দেখা করতে চাইছেন না, এজন্য মহিলাকে বললেন লোকটাকে যেন ভেতরে আসতে দেয়া হয়। ট্যামি গটগটিয়ে ঘরে ঢুকল, উচ্চ শির, চাউনিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারার তেজস্বিতা, যদিও তার চোখে সবসময় হতাশা লক্ষ করা যায়। সে ঘরে ঢুকেই বলল :

‘আমি আরেকবার আপনেরে দ্যাখবার আইলাম। আপনে দেখি এহনও দাড়ে বসা কাকাতুয়ার মতো ঘাড় বেঁকাইয়া রাখছেন। তয়, আপনেরে আমি মাফ কইরা দিছি। মনে রাইখেন মাফ কইরা দিছি।’ এরপর আর একটিও কথা না বলে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং ঘরের কর্তাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নৈশভোজ শেষে মি. মারকাম ঠিক করলেন তিনি আরেকবার চোরাবালিতে যাবেন-তিনি যে যেতে ভয় পাচ্ছেন তা মোটেই আমলে নিলেন না। রাত নটার দিকে সেজেগুজে লম্বা লম্বা পা ফেলে সৈকতে চলে এলেন তিনি এবং কাছের একটি শিলাখন্ডের প্রান্ত ঘেঁষে বসলেন। তাঁর পেছনে বিশাল রুপোলি চাঁদ আলো বিলোচ্ছে এবং আলোকিত করে তুলেছে উপসাগর। সাগরের ঢেউয়ের মাথায় ফেনা, অন্তরীপের গাঢ় আউটলাইন, স্যামন মাছ ধরার জাল ইত্যাদি সবই পরিষ্কার দৃশ্যমান। ঝলমলে হলদে আলোয় ক্রুকেন বন্দরের জানালার বাতিগুলো জ্বলজ্বল করছে, দূরে, ভূস্বামীদের প্রাসাদগুলো যেন আকাশের তারার মতো কাঁপছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে তিনি দৃশ্যটির সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। তাঁর মন ভরে উঠল অনির্বচনীয় শান্তিতে। গত কয়েক সপ্তাহের ভয়-ভীতি-শঙ্কা সব যেন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল, নতুন এবং পবিত্র এক শান্তি শূন্য জায়গাটি দখল করল। তিনি ঠান্ডা মাথায় তাঁর বিগত দিনগুলোর কর্মকাণ্ডের কথা ভাবলেন এবং নিজের অহমিকা, দাম্ভিকতা ও একগুঁয়েমি আচরণের কথা স্মরণ করে বড়ই শরমিন্দা হলেন। তক্ষুনি মনস্থির করে ফেললেন এ পোশাকটি আর জীবনেও গায়ে চড়াবেন না, যেটির কারণে তিনি তাঁর প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এবং যেটি তাঁকে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু হতাশা, বিষণ্নতা, বিরক্তি আর যন্ত্রণাই দিয়েছে।

কিন্তু তিনি যেই মুহূর্তে এরকম একটি উপসংহারে পৌঁছেছেন ঠিক তখন তাঁর ভেতর থেকে কে যেন কথা বলে উঠল এবং ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করল তিনি ওই পোশাকটি আবার আদৌ পরার সুযোগ পাবেন কিনা—কারণ ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে-তিনি নিজের পথ বেছে নিয়েছেন এবং তাঁকে বিষয়টি মেনে চলতেই হবে।

‘খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি,’ চটজলদি জবাব এল তাঁর ভেতর থেকে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ি যাবেন এবং এই বিশ্রী পোশাকটা ছুড়ে ফেলবেন।

কিন্তু শিলাখণ্ড ছেড়ে সৈকতে পা বাড়ানো মাত্র একটা প্রচণ্ড ভয় তাঁকে নাড়া দিয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য যেন সমস্ত রক্ত তাঁর মস্তিষ্কে প্রবাহিত হলো। তিনি আবারও দেখতে পেয়েছেন নিজের সেই ভয়ংকর প্রতিমূর্তি। সৈকতের বিপরীত দিকের শিলাখণ্ড হয়ে এগিয়ে আসছে। শিলাখণ্ডটির পরেই সেই চোরাবালি।

নিজের প্রতিমূর্তিকে দেখে প্রায় চলনশক্তিহীন হয়ে পড়লেন মি. মারকাম। দেখলেন চোরাবালি মোচড় খাচ্ছে, বালু গড়াচ্ছে যেন তার নিচে শুয়ে থাকা কারও প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে। এবারে আর ভুল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই, যদিও মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ছায়া ফেলেছে চাঁদ তবু মি. মারকাম তাঁর প্রতিমূর্তিকে পরিষ্কারই দেখতে পাচ্ছেন। সেই একই রকম কামানো গাল, ঠোঁটের ওপর কয়েক সপ্তাহের ঝুপো ছোট গোঁফ। চৌকো ছককাটা পশমি কাপড়ের গায়ে আবার জোসনা ছড়ানো চাঁদের আলো, ইগলের পালক এমনকি গ্লেনগ্যারি ক্যাপটির ফাঁকা অংশটিও চকচক করছে, কাঁধের কেয়ার্নগ্রম ব্রুচও তাই, সেই সঙ্গে রুপোলি বোতামগুলো। তিনি তাকিয়ে আছেন, মনে হলো তাঁর হাঁটু সামান্য ডুবে গেল, কারণ তিনি চোরাবালির বলয়ের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। পিছু হটলেন মারকাম সাহেব। তাঁকে পিছিয়ে যেতে দেখে সামনের মানুষটা কদম বাড়াল। দুজনের মাঝখানের দূরত্ব সমানই রইল।

ওরা দুজন এখন মুখোমুখি যেন সম্মোহিতের মতো একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। মস্তিষ্কে রক্তস্রোতের ছোটাছুটির মধ্যেও মারকাম যেন শুনতে পেলেন ভবিষ্যদ্বাণীর কথাগুলো : ‘নিজেরে দ্যাখবেন মুখোমুখি এবং চোরাবালি যহন গিইল্যা খাইব তহন আফসোস হইব।’ তিনি তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন, তিনি অনুতাপও করেছেন-এখন চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন! সাবধানবাণী এবং ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাচ্ছে।

তাঁর মাথার ওপরে তারস্বরে চিৎকার করল সি গাল, সমাগত জোয়ারের প্রান্তে চক্কর দিচ্ছে, শব্দটা যেন সংবিৎ ফিরিয়ে আনল মারকাম সাহেবের। তিনি কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামনের জন এগিয়ে এল। চোরাবালির ভয়াল থাবায় পড়ে গেল সে। ডুবে যেতে লাগল। মারকাম সাহেবের মনে হলো তিনি দেখছেন নিজেই তাঁর নিয়তি ডেকে এনেছেন। তিনি প্রচণ্ড এক চিৎকার দিলেন। অপরজনের মুখ দিয়েও বেরিয়ে এল একইরকম চিৎকার। মি. মারকাম হাত ছুড়তে সে-ও তাই করল। আতঙ্কভরা চোখে তিনি দেখলেন ওই লোকটা ক্রমে চোরাবালির গভীরে ডুবে যাচ্ছে। তারপর কে জানে কোন শক্তির বশে তিনি সামনে এগোলেন চোরাবালিতে নিজের নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁর পা যখন বালুর মধ্যে ঢুকে যেতে লাগল সি গালের পুনর্বার চিৎকার আবার তাঁর ভোঁতা অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তুলল। বিপুল চেষ্টায় তিনি বালু থেকে বের করে আনলেন পা। চোরাবালি যেন পা-খানা চেপে ধরেছিল, ছাড়তে চাইছিল না। তবে পায়ের জুতো তাঁকে বিসর্জন দিতে হলো। নির্জলা আতঙ্ক নিয়ে তিনি ঘুরলেন এবং ছুট দিলেন। এক মুহূর্তের জন্যও থামলেন না যতক্ষণ তাঁর শ্বাস এবং শক্তিতে কুলাল। শেষে বালুপাহাড়গুলোর মাঝে ঘেসো পথের ওপর এসে তিনি প্রায় মূর্ছা গেলেন।

দুই

আর্থার মারকাম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি তাঁর ভীতিকর অভিযানের কথা পরিবারের কাউকে বলবেন না-যতদিন পর্যন্ত না নিজে ধকলটা সামলে উঠতে পারেন। তাঁর ভয়ংকর ডাবল-তাঁর অপরজনকে গিলে খেয়েছে চোরাবালি। মারকাম সাহেব শান্তি অনুভব করছেন মনে।

সেই রাতে তিনি অঘোরে ঘুমালেন এবং কোনো স্বপ্ন দেখলেন না। সকাল বেলা আবার তাঁকে পুরানো চেহারায় ফিরে পাওয়া গেল। তাঁর নতুন এবং বাজে চেহারাটা চিরতরে দূর হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় স্যাফট ট্যামি ওইদিন সকাল থেকে তার কাজে অনুপস্থিত এবং ওখানে সে আর কোনোদিন ফিরে গেল না। বসে থাকল পুরানো জায়গায় সেই ভাবলেশশূন্য চেহারায়, যেন কিছুই দেখছে না। চাউনিতে কোনো দীপ্তি নেই। মি. মারকাম সংকল্প অনুযায়ী তাঁর হাইল্যান্ড পোশাকটি আর পরলেন না। ওটাকে দলা পাকিয়ে, ছোরা, পিস্তল ইত্যাদি সবসহ নিয়ে ফেলে দিয়ে এলেন চোরাবালিতে। পোশাকটি চোরাবালিতে ডুবে যেতে দেখে তিনি অত্যন্ত আমোদ অনুভব করলেন। তারপর হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে পরিবারের সকলের সঙ্গে সান্ধ্য প্রার্থনায় বসে বললেন :

‘তোমরা শুনলে খুশি হবে আমি হাইল্যান্ড ড্রেস পরা বাদ দিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি ওই পোশাকটিতে আমাকে কেমন বোকার মতো লাগত এবং সবার কাছে নিজেকে কেমন হাসির পাত্র করে তুলেছিলাম। তোমরা ওই পোশাকটি আর কোনোদিন দেখতে পাবে না।’

‘ওটা কোথায়, বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মারকাম সাহেবের এক মেয়ে। তার বাবা মেয়ের প্রশ্নের জবাব এত মিষ্টি করে দিলেন যে সে নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে পিতাকে চুম্বন করল।

তিনি বললেন, ‘ওটা চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে এসেছি, সোনা! আশা করি আমার মেজাজের বাজে দিকগুলোও সেই সঙ্গে চিরদিনের জন্য কবর হয়ে গেছে!’

ক্রুকেনে গ্রীষ্মের বাকি দিনগুলো পরিবারটির খুব আনন্দে কাটল। শহরে ফিরে মি. মারকাম চোরাবালির ঘটনা প্রায় বিস্মৃতই হয়ে গেলেন। একদিন ম্যাককালাম মোর থেকে তিনি একখানা চিঠি পেলেন। তবে এ চিঠির কথা তিনি তাঁর পরিবারকে জানালেন না সংগত কারণেই। এবং চিঠির জবাবও দিলেন না। চিঠিতে লেখা ছিল :

দ্য ম্যাককালাম মোর অ্যান্ড রডরিক ম্যাকডু
‘দ্য স্কচ অল-উল টারটান ক্লথিং মার্ট
কপ্টহল কোর্ট, ই.সি.
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২

ডিয়ার স্যার-আপনাকে চিঠি লেখার জন্য মার্জনা করবেন, তবে একটি বিষয়ে অনুসন্ধানের অভিলাষে পত্রখানা লিখতে হলো। শুনেছি আপনি গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে অ্যাবারডিন শায়ারে (স্কটল্যান্ডএনবি) আছেন। আমার পার্টনার, মি. রডরিক ম্যাকডু-যার আসল নাম ইমানুয়েল মোজেস মার্কস-গত মাসের প্রথম দিকে একটি ট্যুরে স্কটল্যান্ডে (এনবি) গিয়েছিলেন। তবে তিনি যাওয়ার পরে তাঁর কাছ থেকে মাত্র একবারই আমি সংবাদ পেয়েছি। আমি ভেবে উদ্বিগ্ন যে তাঁর কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কিনা। আমি আমার ক্ষমতা খাটিয়ে সমস্ত খোঁজখবর করেও তাঁর কোনোরকম সন্ধান পেতে ব্যর্থ হওয়ায় আপনার দ্বারস্থ হলাম। তিনি যে পত্রখানা লিখেছিলেন তাতে তীব্র হতাশার কথা ব্যক্ত ছিল। তিনি ওতে উল্লেখ করেন তিনি ভয় পাচ্ছেন ভেবে স্কটিশ মাটিতে একজন স্কচম্যানের বেশভূষায় হাজির হওয়ার কারণে তাঁর হয়তো অন্তিম সময় উপস্থিত। তিনি ওখানে যাওয়ার আগে নিজেকে হাইল্যান্ড কস্ট্যুমে সজ্জিত করে নেন, যে পোশাকটি আমরা আপনার কাছে বিক্রি করেছিলাম। আপনার হয়তো স্মরণে আছে এ পোশাকটির প্রতি মি. ইমানুয়েলেরও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি পোশাকটি আগে কখনো পরেননি, যদ্দূর জানি, পোশাকটি পরিধানের বিষয়ে তাঁর মাঝে সংশয় কাজ করত। তিনি আমাকে বলেছিলেন পোশাকটি পরলেও ওটি গভীর রাতে কিংবা খুব সকালে পরবেন এবং তাও প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চলে গিয়ে। পোশাকটিতে অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই পরতে থাকবেন। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো তিনি আমাকে জানাননি কোন পথ ধরে যাচ্ছেন। ফলে তিনি কোথায় আছেন, আমি কিছুই জানি না। তাই আপনার কাছে জিজ্ঞাসা- আপনার এলাকার আশপাশে আপনার মতো পোশাক পরা কোনো লোককে কদাপি দেখেছেন কিনা। শুনেছি আপনি সম্প্রতি ওই এলাকায় একখানা বাড়ি কিনেছেন অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। এ প্রশ্নের জবাব আপনার কাছ থেকে আমি পাব এমনটি আশাও করছি না, যদি কিনা আমার বন্ধু এবং পার্টনারের বিষয়ে আপনি কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। কাজেই প্রয়োজন ছাড়া চিঠির জবাব দেয়ার দরকারও নেই। আমি আশা করি আমার বন্ধুটি হয়তো আপনার এলাকার আশপাশেই কোথাও আছেন, যদিও তাঁর চিঠিতে কোনো দিন-তারিখ উল্লেখ নেই, তবে খামের ওপর ‘ইয়েলন’-এর ডাকঘরের ছাপ রয়েছে। এটি অ্যাবারডিনশায়ারে এবং মেইনস অব ক্রুকেন থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

আপনার বিশ্বস্ত

জোওয়া শিনি কোহেন বেনজামিন (দ্য ম্যাককালাম মোর) )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *