বার্থডে কার্ড

বার্থডে কার্ড

আমি চিঠিপত্রের থলেটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ডাকঘর থেকে। থলেটি বেশ ভারী। অনেকগুলো চিঠি ডেলিভারি দিতে হবে আমাকে। তবে মনে আমার ফূর্তিই আছে। সকাল সাতটা বাজে। ঝকমকে রোদ ছড়াচ্ছে গ্রীষ্মের সূর্য। আজ বেশ গরম পড়বে মনে হচ্ছে।

হিলউইকের রাস্তা ধরে, চনমনে মনে লম্বা হাঁটা দিলাম। সুন্দর একটি সকালের জন্যই শুধু আমার মন খুশি খুশি নয়। আমরা-আমি এবং আমার স্ত্রী লন্ডনে থাকতাম। ওখানে দীর্ঘদিন ডাকপিয়নের কাজ করেছি। তারপর হিলউইকে পোস্টম্যানের একটি চাকরির সুযোগ জুটে যায় এবং সিদ্ধান্ত নিই কাজটি করব। বহুবারই ভেবেছি সিদ্ধান্তটি সঠিক হলো কিনা। যে এলাকায় আপনি বহুদিন ধরে আছেন, যেখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে আপনি অভ্যস্ত সেটি ছেড়ে চলে যাওয়া সব সময় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে এখানে আসার মাস দেড়েক বাদে বুঝতে পারি আমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। আমরা বাগানসহ একটি আরামদায়ক বাড়ি পেয়েছি। এই নিরিবিলি, ঘুমন্ত শহরটির পরিবেশ আমাদের দুজনেরই বেশ পছন্দ হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্বও পাতিয়ে ফেলেছি। হিলউইকের জীবন নিয়ে আমরা দুজনেই আনন্দিত। জানি এখানে বসবাস উপভোগ্যই হয়ে উঠবে।

আমি আমার কাজটিকে সর্বদাই পছন্দ করি। আমি তাজা বাতাস এবং অনুশীলন পছন্দ করি। আর একজন ডাক হরকরা এ দুটি জিনিসই যথেষ্ট পরিমাণে পেয়ে থাকে। অফিসে বসে ডেস্কের কাজ করতে হলে আমার মোটেই ভালো লাগত না। সারাদিন ডেস্কে বসে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না।

আর আমি মনে করি আমার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকের চিঠিপত্র নিরাপদে বহন করার জন্য পোস্টম্যানের দরকার। কোম্পানিগুলো পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই তাদের অর্ডার পাঠায় এবং অর্ডার পায়। চিঠিপত্র ডেলিভারি করা না হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যই স্থবির হয়ে যেত।

তবে লোকের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পৌঁছে দেয়ার কাজটি আমার সর্বাধিক পছন্দ। বাণিজ্যিক চিঠিপত্রের গুরুত্বও অপরিসীম, তবে লোকের বাড়ি বাড়ি পৌছে তাদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বিলি করাটা সবচেয়ে ভালো লাগে আমার। আমি চিঠিপত্র এবং কার্ড তাদের লেটার বক্সে ফেলে দিই। এবং আশা করি ওইসব চিঠি এবং কার্ডে সুসংবাদই রয়েছে। ব্যক্তিগত এসব চিঠিপত্র মানুষকে অনেক আনন্দ দিতে পারে। পুরানো বন্ধুরা একে অপরকে চিঠি লিখতে পারে। তরুণ ছেলেমেয়েরা চিঠি লেখে তাদের বাবা-মাকে। ছেলেরা প্রেমে পড়লে মেয়েদের চিঠি লেখে। আর এসব চিঠিপত্র বহন করে আমি মজা পাই।

তবে ব্যক্তিগত পত্রাবলি সব সময় সুখেরও হয় না বটে। জানি না আমি সব সময় সুসংবাদ ডেলিভারি করছি না। কোনো কোনো চিঠিতে দুঃসংবাদও থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ মানুষই চায় ডাকপিয়ন তাকে এসে চিঠি দিয়ে যাবে। তারা লেটার বক্সের শব্দ শুনতে পছন্দ করে। তারা চিঠি পেতে ভালোবাসে।

সেদিন ঝকমকে সকালে গোল্ড স্ট্রিট ধরে হাঁটার সময় এসব কথাই ভাবছিলাম আমি। গোল্ড স্ট্রিটের বেশির ভাগ ভবনে দোকানপাট আর অফিস। আমি এদের সবার কাছে চিঠি পৌঁছে দিই। রাস্তার শেষ মাথায় যখন পৌঁছালাম আমার চিঠির থলেটি তখন আর অত বেশি ভারী নেই। বেশ কিছু চিঠি বিলি করার কারণে হালকা হয়ে গেছে ওজনে। আমি বামে, চার্চ রোডে মোড় নিলাম। সকালের ব্যস্ততম অংশটুকুর অবসান ঘটেছে। বাকি সময়টুকু কাটবে নির্জন রাস্তাগুলোর বাড়িঘরে চিঠি বিলি করে। এদিককার আধডজন রাস্তায় আমাকে আরও চিঠি বিলি করতে হবে। তারপর ফিরব ডাকঘরে।

চার্চ রোডের খুব বেশি বাড়ির ঠিকানায় আজ চিঠি আসেনি। কাজেই শেষ বাড়িটিতে শিগগির পৌঁছে গেলাম। এ বাড়িটির নম্বর ৯২। এ ঠিকানায় তিনখানা চিঠি আছে আমার ঝুলিতে। বাগানের সামনের ফটকটি খুলতেই একটি কণ্ঠ ভেসে এল।

‘আমার চিঠিটি দিতে তুমি ভুলে গেছ, পোস্টম্যান।’

৯১ নম্বর বাড়ির বাগান থেকে আমাকে লক্ষ করে বলা হয়েছে কথাটি। ওই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রমহিলা। দুটি বাড়িকে পৃথক করে রাখা নিচু বেড়ার উপর দিয়ে তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।

‘এক মিনিট,’ প্রত্যুত্তরে বললাম আমি। ‘৯২-তে এই চিঠিগুলো ডেলিভারি দিয়েই আমি আসছি।’

৯২ নম্বর বাড়ির লেটার বক্সে চিঠিগুলো ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর বাগানের পথ পেরিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগোলাম ৯১ নং বাড়িটির দিকে। চিঠির ঝুলি খুঁজেও ৯১ নং, চার্চ রোড, হিলউইক-এর ঠিকানায় কোনো চিঠি পেলাম না।

ভদ্রমহিলা ওখানে ঠায় দাঁড়িয়েই আছেন। অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। মুখে মৃদু হাসি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিশ্চিত আমার কাছে তাঁর জন্য চিঠি আছে। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনে। তাঁর আঙুলে বড়সড় একটি সোনার আংটি। তাঁর মাথার চুলগুলো ধূসর, রোদ পড়ে চকচক করছে। বৃদ্ধার পরনে গাঢ় সবুজ রঙের একটি পোশাক, পায়ের জুতো জোড়াও বেশ চকমকে। তাঁকে এমন খুশি খুশি দেখাচ্ছিল যে আমি আরেকবার আমার ঝুলি খুঁজে দেখলাম। কারণ ওনার মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছা করছিল না।

‘হয়তো কার্ড আসতে পারে আমার নামে,’ বললেন তিনি। ‘ও মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি পাঠায় আবার কার্ডও পাঠায়।’

ভদ্রমহিলার গলার স্বর নরম এবং ভদ্র। বড় বড় বাদামি চোখ মেলে তিনি আমাকে লক্ষ করছিলেন।

‘কার্ড,’ বললেন তিনি। ‘কার্ড অথবা চিঠি। আমার ছেলে পাঠাবে। সে থাকে আমেরিকায়। ওখানে চাকরি করে। অনেক বছর ধরেই আমার ছেলে আমেরিকায় থাকে। তবে আমার জন্মদিনের কথা কখনো ভুলে যায় না। আজ আমার জন্মদিন, পোস্টম্যান।’

‘আশা করি আপনার জন্মদিন সুখের…’ আমি বলার চেষ্টা করলাম তাঁকে। ওনাকে আমি সুখী দেখতে চাই। চাই ওনাকে ওনার চিঠি দিতে কিন্তু তাঁর ঠিকানায় কোনো চিঠিই নেই আমার থলেতে।

‘আরেকবার দ্যাখো, পোস্টম্যান। নিশ্চয় তোমার ঝুলিতে ওটা খুঁজে পাবে। মিসেস রজার্সের জন্য চিঠি কিংবা কার্ড। ৯১, চার্চ রোডের মিসেস রজার্সের জন্য।’

আমি আবার আমার ঝুলি খোঁজার ভান করলাম। তলায় খানকয়েক চিঠি পড়ে ছিল। ওগুলো তুলে নিয়ে ঠিকানা পড়ার ভান করলাম। কিন্তু মিসেস রজার্সের জন্য কোনো চিঠিপত্র নেই। তবে ভদ্রমহিলার মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে করছিল না আমার।

হারানো চিঠি খোঁজার ভান করার সময় বৃদ্ধার ছেলের ওপর আমার বড্ড রাগ হচ্ছিল। সে কী করে তার মায়ের জন্মদিনের কথা ভুলে গেল? তবে এ কথা তো আর ওনাকে বলা যায় না। মনে মনে ভাবাই যায় কেবল।

অবশ্য কথা বললাম আমি। কারণ সারাদিন তো এখানে ওনার চিঠি খোঁজার ভান করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমার আরও কাজ আছে। পোস্ট অফিসে যেতে হবে।

‘আমি দুঃখিত, মিসেস রজার্স। আপনার জন্য এখানে কিছু নেই। পরে হয়তো কার্ড বা চিঠি আসবে। হয়তো আগামীকাল…আমি দুঃখিত… আমি…’

খুশির হাসিটি মুছে গেল বৃদ্ধার মুখ থেকে। তাঁর চোখে জল দেখতে পেলাম। হঠাৎ তাঁকে আকারে খুব ছোট মনে হলো এবং মনে হলো তিনি অকস্মাৎ ভীষণ বুড়িয়ে গেছেন।

‘আপনি বোধহয় অসুস্থ,’ বললাম আমি। ‘চলুন, আপনাকে ঘরে নিয়ে যাই।’

‘না,’ বললেন তিনি। ‘না,’ তাঁর গলার স্বর অত্যন্ত দুর্বল। ‘না,’ আবার বললেন বৃদ্ধা। ‘আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমি ভাবছি আমার ছেলের কথা। আমার প্রিয় পুত্র। ওর হয়তো কিছু হয়েছে। নইলে এর আগে তো কখনো আমার জন্মদিনের কথা ভুলে যায়নি।’

তিনি ঘুরলেন। আমি বাগানের পথ ধরে মন্থরগতিতে ফিরে চললাম। ফটকের সামনে এসে তাকালাম পেছনের দিকে। ৯১ নং বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য হয়ে গেলেন মিসেস রজার্স।

.

আমি বাকি চিঠি এবং কার্ডগুলো বিলি করে ফিরে এলাম ডাকঘরে। আজ সকালের মতো কাজ শেষ। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত আমার আর কোনো কাজ নেই। ওই সময়ে আবার পোস্ট অফিসে যেতে হতো। হিলউইকে পোস্ট করা চিঠিপত্র নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেয়া ছিল আমার কর্তব্য। ট্রেনে চিঠিগুলো চাপিয়ে দিতাম। তারপর কয়েক ঘণ্টা ফ্রি। এখন আমি বাড়ি ফিরতে পারি বিশ্রাম নিতে। তারপর বাগানে কিছু কাজ আছে।

শিপ স্ট্রিট ধরে বাইসাইকেলে চেপে রওনা হলাম। তবে বেশি দূর গেলাম না। ছোট একটি রেস্টুরেন্টে থেমে ভেতরে ঢুকলাম কফি খেতে। আসলে কফির দরকার নেই, আমার প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় কিছু চিন্তাভাবনা করা। তাই টেবিলের ধারে বসলাম। রাস্তার লোকজনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এদিকে আমার কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।

মিসেস রজার্সের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। সারা সকাল ধরে তাঁর কথাই ভাবছিলাম। বেচারি! তাঁর অশ্রুসজল চোখ এখনো ভাসছে আমার সামনে। বেচারির জন্মদিনটা কেমন বাজে গেল। আমার জন্য কত উত্তেজনা নিয়েই না তিনি অপেক্ষা করছিলেন! অথচ আমি গিয়ে তাঁর মনটাই দিলাম খারাপ করে। অবশ্য এজন্য আমি দায়ী নই। সব দোষ তাঁর ছেলের। সে তার মায়ের জন্মদিনের কথা ভুলে গেছে। সে-ই তার মায়ের মন খারাপ করে দিয়েছে। ছেলেটা একদমই দায়িত্বহীন। না, তার চেয়েও খারাপ-অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ সে।

কিন্তু বৃদ্ধার বিষণ্ণ, করুণ মুখখানার কথা ভুলতে পারছি না কিছুতেই। ছেলেকে দোষারোপ করেও তো মিসেস রজার্সের কোনো লাভ হচ্ছে না। দোষটা তার ছেলের, জানি আমি, কিন্তু উনি তো এখনো বেজায় মন খারাপ করে আছেন। ওনার জন্য কী করতে পারি?

হঠাৎ একটি বুদ্ধি এল মাথায়। খুব চতুর আইডিয়া বলা যাবে না একে, তবে এর চেয়ে ভালো কোনো মতলব মাথায় খেলছে না। আমি ঠান্ডা হওয়া কফি টেবিলে রেখেই দ্রুত বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সাইকেলে চেপে গোল্ড স্ট্রিটের দিকে যত দ্রুত সম্ভব ছুটলাম। ওখানে একটি খবরের কাগজের দোকানে ঢুকলাম। ওরা ছবির পোস্টকার্ড এবং বার্থডে কার্ড বিক্রি করে। আমি একটি কার্ড পছন্দ করলাম মিসেস রজার্সের জন্য।

জন্মদিনের কার্ডটি বাছাই করলাম খুব সাবধানে। এখানকার বেশির ভাগ কার্ডই বাচ্চাদের জন্য। বড়দের জন্য তৈরি করা কার্ডও আছে। তবে এগুলো মিসেস রজার্সকে দেওয়া যাবে না। কারণ ভদ্রমহিলাকে মাত্র একবার দেখলেও মনে হয়েছে উনি খুব বুদ্ধিমতী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাঁকে হাসিঠাট্টার জন্মদিনের কার্ড দিলে মোটেই মানাবে না। এসব কার্ড দেখে মিসেস রজার্স হাসবেনও না। কার্ডগুলো কুকুর-বেড়াল-ঘোড়া ইত্যাদি ছবিতে বোঝাই। এসব দেখে দেখে হয়রান হয়ে গেলাম। ফটোগ্রাফ এবং ড্রয়িংগুলোও বিশ্ৰী। জন্তু- জানোয়ারগুলোকে মোটেই আসল মনে হচ্ছে না। এদের আবার পোশাকও পরানো হয়েছে! বিড়াল হাসছে… কুকুর কাঁদছে… ঘোড়া কথা বলছে.. ধেত! এসব কার্ড মিসেস রজার্সকে কিছুতেই দেওয়া যাবে না।

অবশেষে পছন্দসই একটি বার্থডে কার্ড পেয়ে গেলাম। প্রখ্যাত ইংরেজ চিত্রকর টার্নারের আঁকা একটি ছবি। ছবিতে রঙের কারুকাজ বেশ সুন্দর। ভেতরে খুব সাধারণ একটি মেসেজ লেখা—’শুভ জন্মদিন’-ব্যস।

আমি এই মেসেজটির নিচে লিখলাম : ‘মিসেস রজার্সের জন্য। আশা করি, আগামীকাল আপনার ছেলের তরফ থেকে একখানা কার্ড দিতে পারব।’ তারপর আমার নাম সই করে লিখলাম ‘আপনার পোস্টম্যান। ‘

কাজটি করে বেশ ভালো লাগল আমার। যা হোক, মিসেস রজার্স অবশেষে একখানা জন্মদিনের কার্ড পাবেন। যদিও অচেনা এক লোকের কাছ থেকে কার্ড পাওয়া কিছুতেই সন্তানের তরফ থেকে পাওয়া জন্মদিনের কার্ডের বিকল্প হতে পারে না, জানি আমি। তাঁর ছেলে তাঁকে যতটা খুশি করতে পারত আমি তা পারব না। কিন্তু সে তো তার মাকে জন্মদিন উপলক্ষে কোনো কার্ড পাঠাল না। আমি দিচ্ছি। অন্তত উনি এটুকু জানবেন কেউ তাঁর জন্য ভাবে। আশা করি এতে ওনার মন খারাপ অনেকটাই কেটে যাবে।

আমি বাইসাইকেল নিয়ে এবার চলে এলাম চার্চ রোডে। একটি বাড়ির সামনে মস্ত একটি লরি দাঁড়িয়ে আছে। ফলে রাস্তায় বেঁধে গেছে জ্যাম। অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।

জ্যামে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আমি কেন এসব ঝামেলা পোহাচ্ছি? আমার তো এখন বাড়িতে বসে বিশ্রাম নেওয়ার কথা। বাগানে কাজ করার কথা। আমি কেন মিসেস রজার্সকে নিয়ে এত ভাবছি? আজকের আগে তো ওনাকে কখনো দেখিওনি। অবশ্য হিলউইকে আমি কাজ করছিই মাত্র ছয় সপ্তাহ হলো। চার্চ রোডে দেড় মাস ধরে বিলি করছি চিঠি। কিন্তু ৯১ নং বাড়ির ঠিকানায় কোনো চিঠিপত্র আসেনি। কোনো কিছুই ওই বাড়িতে ডেলিভারি করিনি আমি। মিসেস রজার্সকে আজকের আগে তাঁর বাড়ির সামনে বা বাগানে কোথাও দেখতে পাইনি।

ব্যাপারটি অদ্ভুত, ভাবলাম আমি। তবে এ রহস্যের জবাব আমার কাছে নেই। জ্যাম ছুটে গেল। নড়েচড়ে উঠল গাড়ি ঘোড়া। আমি মিসেস রজার্সের বাড়ি অভিমুখে ছুটলাম।

তাঁর বাগানের ফটকে নামলাম সাইকেল থেকে। বাগানের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, ‘আমি কার্ডখানা লেটারবক্সে রেখে দিয়ে চলে আসব? নাহ্, কাজটা ঠিক হবে না। আজ ওনার জন্মদিন। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলে তাঁর ভালো লাগবে।’

আমি ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তাঁর মন ভালো করে দিতে চাই। তাঁর হাতে কার্ডটি নিজেই দিতে চাই। তাঁকে জানাতে চাই আমি তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল।

মিসেস রজার্সের দরজায় জোরে কড়া নাড়লাম। তারপর পিছিয়ে গেলাম। হাতে কার্ডখানা। জানালায় তাকিয়ে থাকলাম কখন দরজা খুলবে তার অপেক্ষায়।

‘ওই বাড়িতে কেউ সাড়া দেবে না, পোস্টম্যান।’

ঘুরলাম আমি। ৯২ নং বাড়ির বাগান থেকে বলা হয়েছে কথাটি। ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা। তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। একে আমি আগেও দেখেছি। ইনি ৯২ নং বাড়িটির বাসিন্দা, নাম স্পারসন। চিঠি বিলি করার সময় এঁকে জানালা দিয়ে উঁকি মারতে দেখেছি আমি।

এই মহিলার সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলার মুড নেই আমার’ তবু কথা বলতে হলো। ইনি হয়তো মিসেস রজার্স সম্পর্কে কিছু জানেন।

‘ঠিক বুঝলাম না—’ বললাম আমি।

‘বললাম তো, পোস্টম্যান, ওখানে কারও সাড়াশব্দ তুমি পাবে না।’

‘কিন্তু ৯১ নং বাড়ির ঠিকানায় একটি কার্ড আছে।’

‘বাড়িটি খালি।’ বললেন তিনি।

‘আমার কাছে একটি কার্ড আছে,’ আবার বললাম আমি। ‘মিসেস রজার্সের জন্মদিনের কার্ড। আজ তাঁর জন্মদিন।’

‘জানি আমি।’ বললেন তিনি। ‘মানে জানতাম আর কী।’

‘জানতেন?’ বললাম আমি। ‘মানে?

‘মানে হলো ৯১ নং বাড়িতে কেউ থাকে না। মিসেস রজার্স ওখানে থাকেন

না। কেউই ওখানে থাকে না। গত বছর ধরে ওখানে কেউ থাকছে না।

‘কিন্তু আজ সকালেই তো মিসেস রজার্সকে দেখলাম।’

‘তুমি স্বপ্ন দেখেছ।’ বললেন মিসেস স্পারসন।

‘উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁর ছেলের কাছ থেকে জন্মদিনের কার্ড পাবার আশা করছিলেন তিনি। সে আমেরিকায় থাকে।’

‘সে আমেরিকায় থাকত,’ উঁচু গলায় বললেন মিসেস স্পারসন। ‘শোনো, পোস্টম্যান। এক বছর আগে, আজকের এই দিনে মিসেস রজার্স তাঁর ছেলের কাছ থেকে জন্মদিনের কার্ড পাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ছেলেটি সব সময় তাঁকে জন্মদিনের কার্ড পাঠাত। তবে কার্ড আসেনি, ওইদিন বিকেলে একটি টেলিগ্রাম আসে ৯১ নং বাড়ির ঠিকানায়। তিনি জানতে পারেন তাঁর ছেলে গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।’

‘বেচারি মিসেস রজার্স!’ বললাম আমি। ‘কী ভয়ানক খবর! তাও তাঁর জন্মদিনের সময় এমন ভয়ংকর একটি খবর পেতে হলো!’

‘ঠিক তাই,’ বললেন মিসেস স্পারসন। ‘মিসেস রজার্স ওই দিন সন্ধ্যায় মারা যান। এক বছর আগে তাঁর জন্মদিনের দিন মৃত্যুবরণ করেন ভদ্রমহিলা। হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়।’

আমি এক মুহূর্ত স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মিসেস স্পারসন একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর নিজের বাড়ির দরজার দিকে হাঁটা দিলেন।

‘আমি সারাক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না,’ বললেন তিনি। ‘আমার কাজ আছে।’

তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। আমি মিসেস রজার্সের জন্মদিনের কার্ডখানা পকেটে রেখে ঙ্খলিত পায়ে বাগানের ফটকের দিকে এগোলাম।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *