2 of 3

তারপর কী হলো

সেদিন, এ মাসের ন’ তারিখে, একটা পুরস্কার পেলাম। সুইডেনের মানববাদী সংস্থা থেকে হেডেনিউস পুরস্কার। পুরস্কারটি সুইডেনের দার্শনিক ইঙ্গমার হেডেনিউসের নামে। হেডেনিউস ছিলেন সুইডেনের প্রখ্যাত উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক। তিনি ক্রিশ্চান ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে যে কোনও সুস্থ তর্ক সম্ভব নয়, এই বিষয়ে বইও লিখেছেন। হেডেনিউস পুরস্কার তাঁদের দেওয়া হয় যারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়েছেন। ইওরোপ, আমেরিকা থেকে মানবাধিকার পুরস্কার বেশকিছু পেয়েছি। এতকাল মানবতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লেখালেখি করে, এই যে স্বীকৃতিটুকু পাই, এ আমার নির্বাসনের কষ্ট অনেকটাই দূর করে। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে এত এত পুরস্কার রয়ে গেলো, এগুলো কোথায় থাকবে আমি মরে গেলে! আমার তো কোনও ঘর নেই, দেশ নেই! হারিয়ে যাবে সম্ভবত। এর মধ্যেই অনেক হারিয়েছি। যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি আজ কুড়ি বছর। নিজের মতো করে নিজের একটা বাড়ি সাজানোর ইচ্ছে সেই ছোটবেলা থেকে। সে আর হলো কই! এখন আর আগের মতো কোথাও স্থির হওয়ার স্বপ্ন দেখি না। বয়স যত বাড়তে থাকে, তত কমে যেতে থাকে বাড়ি-ঘর, সহায় সম্পদের স্বপ্ন। সব ফেলে যে শীঘ্র চলে যেতে হবে, সেই ভাবনাটি আসে, জীবনের সবকিছু এমনকী জীবনটাই যে ক্ষণস্থায়ী সেটিও ঘন ঘন মনে পড়ে।

হেডেনিউস পুরস্কারটি শুধু যে সুইডিশরাই পেতে পারে। আমি যেহেতু সুইডিশ নাগরিক, এটি পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। একজন কালো চুলের বাদামি রঙের মেয়ে সুইডিশ!এ আমিও বিশ্বাস করি না। সুইডিশ বলতেই আমরা বুঝি সোনালী চুলের লম্বা চওড়া সাদা নারী পুরুষ। আমি আপাদমস্তক বাঙ্গালি। কিন্তু যেহেতু নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমার পাসপোর্ট পুণরায় নবায়নকরণ করে না বাংলাদেশ, সে কারণে বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে সুইডিশ পাসপোর্ট। পাসপোর্ট এলে নাগরিকত্ব আসে। আর নাগরিকত্ব এসেছে বলেই হেডেনিউস পুরস্কার এলো। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা ভাষায় না লিখে ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় যদি লিখতে পারতাম, তাহলে অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারতাম সরাসরি। সেটি কি আর এই পঞ্চাশোত্তর বয়সে সম্ভব! এসব এখন স্বপ্নেরও ঊর্ধ্বে।

সুইডেনের সঙ্গে আমার একটা লাভ এন্ড হেইট এর সম্পর্ক আছে। দেশটিকে ভালোবাসি, আবার ভালোও বাসি না। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। অনেকটা ফ্রান্সের মতো।

তারপর কী হলো, সে রাতে আরও একজন মানববাদী এবং হেডেনিউস পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে দেখা হল, তিনি বিওর্ন উলভায়াস। সুইডেনের বিখ্যাত গানের দল আবা’র গায়ক, চারজনের একজন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২- মাত্র দশ বছর টিকে ছিলো আবা, অথচ বিশ্বব্যাপী কী ভীষণই না জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আবা ভেঙে যাওয়ার বিওন আর বেনি এণ্ডারসন, দলের আরেক গায়ক, গান টান গাইতেন। ভালই করতেন, কিন্তু আবার জনপ্রিয়তার সামনে ও কিছুই না। আবা আবার নতুন করে জেগে উঠেছে, মিউরিয়ালস ওয়েডিং, দ্য কুইন অব দ্য ডেসার্ট, অ্যাডভেঞ্চার অব প্রিসিলা, মামা মিয়া- এসব চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ার পর। এসবে আবা’র গানগুলো আবার নতুন করে শুনছে মানুষ। বিওর্নের সঙ্গে জাপানিজ খাবার খেলাম সে রাতে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমেরিকার মানববাদী লেখক রেবেকা গোল্ডস্টাইন। আরও দুতিনজন মানববাদী ব্রিটিশ এবং সুইডিশ। ডিনার খেতে খেতেই বিওর্নের সঙ্গে অনেক কথা হয়। আবা’র কথা একটিও নয়, যা বলেছি সবই মানববাদের কথা। তিনি মুক্তচিন্তার মানুষ, ধর্মে তার বিশ্বাস নেই। ফ্রিতাংকে নামে তাঁর একটা মুক্তচিন্তার প্রকাশনী সংস্থা আছে। ওখান থেকে এর মধ্যেই সুইডিশ ভাষায় প্রচুর মুক্তচিন্তকের বই বেরিয়েছে। বলবো না প্রকাশনীটি খুব লাভজনক। নাস্তিকতা, মানববাদ, বিজ্ঞানের ওপর লেখা বেশি লোকে পড়ে না। একটা দেশে যদি পঁচাশি ভাগ লোক নাস্তিক হয়, তবে বিজ্ঞানের বই পাঠ করার সংখ্যা কম হলেও কিন্তু খুব কম নয়। বিওর্নের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, ভাবছিলাম, এই ভয়ংকর জনপ্রিয় মানুষটা কোনও দ্বিধা করেননি জানাতে যে তিনি নাস্তিক। সাধারণত জনপ্রিয়রা বা উঁচুতলার নামী লোকেরা সমাজের কাঠামো ধরে নাড়া দিতে চান না। তাঁরা ধর্ম আর পিতৃতন্ত্রের অনুরাগী সেবক হিসেবেই চিহ্নিত হতে চান সারা জীবন। বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চান। সবাই কি আর জন লেনন বা মন্টি পাইথন হতে পারে! সবাই কি আর বিওর্ন উলভায়াস?

মানবাধিকারের আর নারীর অধিকারের জন্য পৃথিবীর সর্বোত্তম দেশ সুইডেন। এ দেশে নারী বলুন, নাস্তিক বলুন, সমকামী বলুন, লিঙ্গান্তরিত বলুন, কালো বলুন,বাদামী বলুন- দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসায় কোনও বাধা নেই। অন্য অনেক দেশে যত ছুৎমার্গ আছে, তত ছুৎমার্গ সুইডেনে নেই। সুইডেনে আমি থাকি না বটে, তবে সুইডেন নিয়ে আমার গৌরব হয়। আমার দেশটি কি কখনও সুইডেনের মতো হতে পারবে? হয়তো, তবে জানি, আমি আপনি কেউ বেঁচে থাকতে নয়। হাজার বছর পর হলেও দেশটি সভ্য হয়েছে — আমি এই স্বপ্নটি দেখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *