2 of 3

এই বাংলাদেশ আমার অচেনা

আজ বাইশ বছর নেই দেশে। দেশের অবস্থার কথা যা শুনছি, যা পড়ছি তা ভয়ঙ্কর। দিন যত যাচ্ছে, ততই যুক্তিবাদী আর প্রগতিশীল মানুষ খুন হচ্ছে। একসময় ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বললে মৌলবাদীরা পথে নামতো, যুক্তিবাদীদের ফাঁসি দাবি করতো। এখন ধারালো ছুরি দিয়ে কোরবানির গরু ছাগল যেভাবে জবাই করে, সেভাবে যুক্তিবাদীদের জবাই করে। গরু ছাগল যেমন সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে জবাই করে, মানুষগুলোকেও তাই করে। খুনির সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকম বেড়ে গেছে দেশে। মানুষ কী করে বাংলাদেশে নিজেদের নিরাপদ মনে করে, আমি জানি না। আপস করে চললে অথবা মুখ বুজে চললে অথবা সন্ত্রাসে সমর্থন জানালেই সম্ভবত নিরাপত্তা মেলে। দেশে যখন ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, ব্লগার একের পর এক খুন হচ্ছে, তখন মানুষ কিন্তু খুনের প্রতিবাদ করছে না, রুখে দাঁড়াচ্ছে না, বরং যে যার জীবনযাপন করে যাচ্ছে, যেমন করছিল। না, এই বাংলাদেশকে আমি চিনি না।

আমার বরং চেনা মনে হয়েছে অন্য একটি বাংলাদেশকে যে বাংলাদেশে শত শত মানুষ শ্যামলকান্তি ভক্ত নামের এক ইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এই প্রতিবাদ দেখে দেশ নিয়ে আমার মরে যাওয়া আশাগুলো ফের জীবন ফিরে পেয়েছে। শাহবাগের আন্দোলন যেমন আমার দীর্ঘ বছরের হতাশাকে বাঁচিয়েছিল একবার। কিন্তু এই যে প্রতিবাদ, তা কি নির্যাতিত প্রধান শিক্ষকটিকে বাঁচাতে পারবে? ভয়ঙ্কর আরও যেসব খবর পাচ্ছি, আমার তো মনে হয় না বাঁচাতে আদৌ পারবে। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা হচ্ছে শ্যামলকান্তির। মেডিকেলে ঢুকে শ্যামলকান্তিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে কিছু জঙ্গি দল। এবং করছে প্রকাশ্যেই। ফেসবুকে। সবাইকে জানিয়েই। এখন হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাতে সন্ত্রাসীরা আর রাতের আঁধারের জন্য অপেক্ষা করে না। ঝাড় জঙ্গলও খোঁজে না। ছুরি ধারিয়ে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়েই কারও বাড়িতে ঢুকে কাউকে কুপিয়ে বুক ফুলিয়েই হেঁটে হেঁটে সবার সামনে দিয়ে চলে যায়। তাদের রোধ করে কার সাধ্য বাংলাদেশে?

খবরে পড়লাম, “নারায়ণগঞ্জ ইস্কুলের লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তর বিরুদ্ধে ‘ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামকে গালিগালাজ’ করার অভিযোগ এনে তাকে হত্যার টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে তার প্রাথমিক পরিকল্পনা করে ফেসবুকে একাধিক পেজ থেকে দেওয়া হয়েছে উস্কানিমূলক পোস্ট। শুধু তাই নয়, ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ ও ‘নবী-সা. এর কটূক্তির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ নামের পেজ ইভেন্ট খুলে শ্যামলকান্তিকে হত্যার টার্গেট লক করে দেওয়া হয়েছে এবং ঘোষণা দেওয়া হয়েছে— শ্যামলকান্তি ভক্ত এখন ঢাকা মেডিকেলে আছে। কে আছো শ্যামলকে ঢাকা মেডিকেলের ভিতরই বিজ্ঞানী বানাবে? ঢাকা মেডিকেলের ভিতর বিজ্ঞানী বানালে লাশ পরিবহনের জন্য সরকার ও পুলিশের সময় ও খরচ অনেক কমে যাবে। ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ নামের পেজ থেকে শ্যামলকান্তিকে হত্যা করার ১১টি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়। ‘নবী-সা. এর কটূক্তির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ থেকে শ্যামলকান্তির নাম পরিচয় দিয়ে অপরাধ হিসেবে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলামকে গালিগালাজকারী উল্লেখ করা হয় এবং তাকে বিজ্ঞানী বানানো হোক। তারা হত্যা করার সংকেত-শব্দ হিসেবে ‘বিজ্ঞানী বানানো’ ব্যবহার করে থাকেন। ”

আমার আশঙ্কা, শ্যামলকান্তিকে এক দিন কুপিয়ে মেরে ফেলা হবে। এ কিন্তু এই কারণে নয় যে ইসলাম নিয়ে শ্যামলকান্তি কটূক্তি করেছেন। শ্যামলকান্তি ইসলাম নিয়ে কোনও কটূক্তি করেননি। রিফাত নামের যে ছাত্রটির সামনে কটূক্তি করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেই ছাত্রই বলেছে শিক্ষক কটূক্তি করেননি। অবশ্য রিফাত তার মত বদল করেছে হেফাজতিদের অনুষ্ঠানে। মত বদল না বলে বরং মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছে বলা চলে। শ্যামলকান্তিকে মেরে ফেলা হবে কারণ শ্যামলকান্তিকে হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাসীরা খুনের জন্য টার্গেট করেছে। বাংলাদেশের মৌলবাদীদের শক্তি এবং সাহস বাংলাদেশের সরকারের চেয়েও অনেক বেশি। সরকারও সন্ত্রাসীদের সমীহ করে চলতে বাধ্য হয়।

এই বাংলাদেশটি আমার অচেনা, যে বাংলাদেশে কোরবানির গরু ছাগল জবাই করার মতো বুদ্ধিজীবী জবাই করা হয়, যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের ছাড়া আর কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। আমার এক পরিচিত ব্লগার জুলিয়াস সিজারের কিছু কথা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। উনি লিখেছেন, ‘সালাহউদ্দিনের ঘোড়া’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে হত্যা করা যাবে তার পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়েছে। এখন সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কি ভূমিকা নিয়েছে এই ব্যাপারে? আইসিটি অ্যাক্ট ৫৭ ধারা নীরব কেন?— এই ব্যাপারে সরকার নীরবই থাকবে। কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। এই প্রসঙ্গে কিছু পুরনো বিষয় আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি।

নয়ন চ্যাটার্জি, অনিমেষ রায়, বখতিয়ারের ঘোড়া, সালাহউদ্দিনের ঘোড়া, দস্তার রাজদরবার, বাঁশেরকেল্লা এরকম ডজনখানেক পেইজ ফেসবুকে আছে যেগুলো থেকে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী উসকানি দেওয়া হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য এসব পেইজ থেকে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তাঁদের সবাই-ই খুন হয়েছেন। বাঁশেরকেল্লা পেইজ থেকে অভিজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তিনি ইসলাম বিদ্বেষী বলে। প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলি দেবীকে নিয়েও। এই দুইজনকেই নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসলামী মৌলবাদীরা। এই কাজটি ফারাবিও তার আইডি থেকে করেছিল। ফারাবি যে কাজগুলো করতো যেমন- কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া; ঠিক একই কাজ বর্তমানে করছে ‘নয়ন চ্যাটার্জি’ এবং ‘অনিমেষ রায়’ নামের পেইজ দুইটি।

সম্প্রতি অনিমেষ রায় পেইজটি থেকে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া হয়। তার পরপরই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু খুন হন।

কি জানি এইসব পেইজের সাথে এই হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পর্কিত কি না। সব সম্ভবের বাংলাদেশে সবই সম্ভব।

এরকম নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার পরেও, কোনো ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া কিংবা হত্যার জন্য প্ররোচিত করার পরেও এই পেইজগুলোর বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উপরন্তু মৌলবাদীদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকারীদের ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ আখ্যা দিয়েছে সরকার এবং প্রশাসন।

বিপরীতে আল্লাহ কিংবা নবী-রসুল নিয়ে দেশের কোন গলিতে বসে কে পেইজ চালাচ্ছে তাঁদের ঠিকই গ্রেফতার করা হয়েছে। এমনকি ফেসবুকে মন্তব্য করার জন্যও গ্রেফতার হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। স্রেফ পাশের বাড়ির শয়তানকে ঢিল মারার কথা লিখে ৫৭-ধারায় গ্রেফতার হয়েছেন মোহন কুমার মণ্ডল। ‘শয়তান’ এবং ‘ঢিল’ লিখলেও অপরাধী! অথচ প্রকাশ্যে মানুষকে হত্যার হুমকি দেওয়া, সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া, নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানোর পেইজগুলোর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

জুলিয়াস সিজার প্রশ্ন করেছেন, বাংলাদেশ তুমি কার? এই প্রশ্নটি আমারও। অবশ্য প্রশ্ন করার কোনও হয়তো প্রয়োজন নেই। উত্তরটি, আমরা আশঙ্কা করছি, আমরা হয়তো জানিই। বাংলাদেশ যদি ওই সন্ত্রাসীদের, ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করছে, তাদেরই হয় শেষ অবধি, সেই বাংলাদেশকে আমি চিনি না। চিনতে চাইও না।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ মে, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *