2 of 3

চীনের অভিজ্ঞতা

চীনের শহরগুলোয় যখন বেড়াচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোনও দেশে অথবা দক্ষিণ আমেরিকার কোনও রাজ্যে আছি। চীনের অর্থনীতি এমনই উন্নত যে, শহরে-নগরে গরিব লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। গোয়ানজো, চাংশা, ইইয়াং, ঝাংজিয়াজি, বেইজিং-এ ঘুরেছি, সাত দিনে গরিব বলতে দুটো লোককে শুধু দেখেছি, যারা প্লাস্টিকের বোতলের জন্য ডাস্টবিন ঘাঁটছিল। বোতল খোঁজার লোক অবশ্য নিউইয়র্ক শহরে এর চেয়েও বেশি দেখা হয়েছে। অনেকে বলে নেক্সট ‘সুপার পাওয়ার’ চীন। চীন ঘুরে আসার পর এ কিন্তু আমার কিছুটা বিশ্বাসও হচ্ছে।

চীনে দারিদ্র যে নেই তা নয়। এক সময় পঁচাশিভাগ লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতো। এখন সেই পঁচাশি সম্ভবত পাঁচ টাচে এসে দাঁড়িয়েছে। গরিব সাধারণত গ্রামগঞ্জে বাস করে। চীনে, কোনও একটা গবেষণায় দেখলাম, ১৫ কোটির মতো লোক গরিব। ১৩৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে ১৫ কোটি হয়তো খুব বেশি নয়। এখন প্রশ্ন হলো, চীনকে সম্পূর্ণ দারিদ্রমুক্ত করার পরিকল্পনা কি সরকারের নেই? এই পরিকল্পনা, সমাজতান্ত্রিক সরকার মাত্রই থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু পুঁজিতন্ত্রকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছে চীন, তাতে শিওর নই সমাজতন্ত্রের ঠিক কতটুকু তারা বিসর্জন দিয়েছে।

ইউরোপ-আমেরিকার ‘চায়না টাউন’গুলোয় ঘুরে বেড়িয়ে চৈনিক আচার-আচরণ যা দেখেছি, তা আমাকে কখনই খুব একটা মুগ্ধ করেনি। কিন্তু চীন দেশে যে ক’জন চৈনিক শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, সকলেই দেখলাম অমায়িক, আন্তরিক এবং অতিথিবৎসল। আমি তো রীতিমত উচ্ছ্বসিত। হ্যাঁ আমি রীতিমত উচ্ছ্বসিতই।

চীনে আমার খুব ইচ্ছে ছিল চীনের ‘গ্রেট ওয়াল’ দেখবো। ‘গ্রেট ওয়াল’ দেখার আগে অবশ্য চীনের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’ দেখা হয়ে গিয়েছে। হোটেলগুলোয় ওয়াইফাই আছে, কিন্তু জিমেইলে যেতে পারছি না, জরুরি মেইল পাঠাতে পারছি না কোথাও, কোনও মেইল পড়তেও পারছি না। টুইটার ফেসবুকেও যেতে পারছি না। গুগলেও কিছু সার্চ করতে পারছি না। এমন অবস্থা আজ অবধি আমার হয়নি কোথাও। ভীষণ অস্থিরতায় কাটে আমার দিন, রাত। চীনে যতদিন ছিলাম, পৃথিবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ সবচেয়ে ক্ষীণ ছিল। চীনের সরকার নাকি এই-ই চায়। চীনের মানুষের যেন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকে, যেন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করার প্রেরণা কোথাও থেকে কেউ না পায়। চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও যেন আবার কোনও ফাঁক ফোকের দিয়ে জেনে না ফেলে। প্রায়ই মনে হয়েছে, এ পৃথিবীরই একটি দেশ, অথচ যেন পৃথিবীর দেশ নয়।

বেইজিং-এ আমি ক্যাপিটাল হোটেলে ছিলাম। হোটেল থেকে তিয়ানানমেন স্কোয়ার হেঁটেই যাওয়া যায়। প্রতিদিন গিয়েছি তিয়ানানমেন স্কোয়ারে। যাওয়ার পথে পুলিশের ফাঁড়ি পড়তো। ওই ফাঁড়ির সামনেই ফুটপাথে প্রতিদিনই কিছু লোককে বসে থাকতে দেখেছি। একদিন চোখে পড়লো একজন পুরুষ আর মহিলা বসে আছেন, ওঁরা দুটো বড় কাগজ উঁচু করে ধরে আছেন, কাগজে কিছু লেখা। ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা যেই না আমি বের করছি, অমনি দেখলাম একটা পুলিশ কোত্থেকে ছুটে এসে ওদের হাত থেকে কাগজ দুটো ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললো আর আমার পাশের চৈনিক সঙ্গীটিকে বললো একে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাও। চেন, আমার চৈনিক সঙ্গীটি, আমাকে দ্রুত ওই জায়গা থেকে সরিয়ে নিল। পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের নীরব প্রতিবাদের কোনও প্রমাণ রাখা যাবে না, সুতরাং ছবি তোলা যাবে না। আমি ছবি তুলিনি, তবে কিছুটা দূরে গিয়ে দেখলাম আরও একজন মহিলা মাথায় আর বুকে লিখিত কাগজ তুলে ধরে হুইল চেয়ারে বসে আছেন। আশপাশে পুলিশ নেই। মহিলার ছবি তুললাম। মহিলা চাইছিলেন তার ছবি তুলি। সম্ভবত চাইছিলেন ছবি তুলে ছবিটা ইন্টারনেটের কোথাও সেঁটে দিই, যেন মানুষ জানতে পারে কী হচ্ছে চীনে। ছবি তোলার পর পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি খুব দ্রুত সরে গেলাম, হাঁটতে হাঁটতেই আশপাশের বাড়িঘরের আর গাছপালার ছবি তুলতে লাগলাম আর আমার চৈনিক সঙ্গীটিকে প্রশ্ন করে করে জেনে নিতে লাগলাম কী লেখা ছিল ওদের কাগজে। চেন বললো, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ লেখা ছিল। কী অভিযোগ, কেন অভিযোগ— সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা চেন করতে পারেনি। আমি সেদিন পেছন ফিরে আর তাকাইনি পুলিশটা কতদূর এসেছে দেখতে। শুনেছি পুলিশ খুব বর্বর। পরদিন অবশ্য পুলিশের বর্বরতার একটি দৃশ্য আমার দেখা হয়েছে। তিয়ানানমেন স্কোয়ার থেকে দুপুরের দিকে হোটেলে ফিরছি, দেখি পুলিশ ফাঁড়িটার সামনে কুড়ি পঁচিশজন লোক বসা, চারদিকে পুলিশ। হঠাৎই আমাকে স্তম্ভিত করে দিল একটি দৃশ্য। কুড়ি পঁচিশজনের দল থেকে একটি মেয়েকে টেনে এনে ঠেলে ধাক্কিয়ে একটা কালো গাড়িতে ওঠালো সাত আটজন পেশিবহুল পুরুষ-পুলিশ। মেয়েটিকে এখন কী করবে ওরা, চেনের কাছে জানতে চাইলাম। চেন সরকারপন্থি লোক, খুব বেশি কিছু বলতে চাইলো না।

সেদিনই ডিনার করতে গিয়ে যখন হুইল চেয়ারে বসে থাকা মহিলাটির ছবি দেখালাম চেনকে, চেন ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। বললো, এক্ষুনি ডিলিট করো এই ছবি। কেন, কেন ডিলিট করতে হবে? ডিলিট করতে হবে কারণ মহিলার পেছনে যে কাচের দেওয়াল, চেন বললো, ওতে চেন আর আমাকে দেখা যাচ্ছে। চেন বললো, এই ছবি যদি কোথাও ছাপা হয়, তাহলে আমাকে ‘সার্চ’ করা হবে। আমি হাঁ হয়ে গেলাম। বললাম, কী লেখা আছে কাগজ দুটোয়, আবার একটু পড়ে নিয়ে বলো তো আমায়। চেন বললো, মহিলাটির মোবাইল চুরি হয়ে গেছে, চোরকে যেন পুলিশ খুঁজে বের করে দেয়, এই অনুরোধই সে করেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই সামান্য কথা যে মহিলা লিখেছে, তার ছবি তুললে তোমার পেছনে লাগবে সরকার, তোমাকে খুঁজে বার করবে, অ্যারেস্ট করবে? চেন বললো সে চায় না তাকে পুলিশ খুঁজুক। কিন্তু খুঁজলে এত ভয় কেন? নিশ্চয়ই যাদের খুঁজেছে, তারা খুব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, অথবা হতেও পারে তারা আর ফেরত আসেনি। জিজ্ঞেস করলাম, চেন তুমি নিজে মাওবাদী, কলেজে মার্ক্সবাদ পড়াও, এই সরকারকে তুমি সমর্থন করো, তোমার কেন এত ভয়, তোমার কি অধিকার নেই ফুটপাথে বসে থাকা একজন মহিলার ছবি তোলার, যে মহিলাটি তার সমস্যা সমাধানে পুলিশের সাহায্য চাইছে? চেন কোনও উত্তর দেয়নি। আমি চৈনিক ভাষা জানি না, জানি না কী লেখা ছিল মহিলার কাগজে। জানি না চেন ঠিক ঠিক অনুবাদ করেছে কি না। মহিলার ছবিটি আমি টুইটারে দিয়েছি, তবে পেছনের কাচের দেওয়াল থেকে চেন এর ছবি কেটে দিয়ে। আমি চাই না চেন-এর কোনও অসুবিধে হোক।

তিয়ানানমেন স্কোয়ারে সাতাশ বছর আগে যা ঘটেছিল, তা বারবারই মনে পড়েছে যখন ওই স্কোয়ারে চেন-এর সঙ্গে আমি হাঁটছিলাম। চেন ওই দিনের কথা বলতে চায় না। বার বার জিজ্ঞেস করেও মুখ খোলাতে পারিনি। কী ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে জুনের চার তারিখে? ঠিক ক’জন স্টুডেন্টসকে হত্যা করা হয়েছিল? চেন বললো, আমরা কিছু জানি না, আমরা কিছু শুনিনি, আমরা কিছু দেখিনি।

কমিউনিস্ট পার্টির এক রিফর্মারের মৃত্যুর পর চীনের স্টুডেন্টসরা বেইজিং-এর তিয়ানানমেন স্কোয়ারে আন্দোলন শুরু করেছিল ১৯৮৯ সালে, সেটি গণতন্ত্রের জন্য বিশাল কোনও আন্দোলন ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা উন্নত করা, ডরমিটোরির পরিবেশ আরও ভালো করা, শিক্ষা ব্যবস্থার আরও পরিবর্তন— মূলত এসব দাবিই ছিল স্টুডেন্টসদের। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো সারা চীনে। সাধারণ মানুষও যোগ দিল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে। লক্ষ লোকের জমায়েত হলো তিয়ানানমেন স্কোয়ারে, হাঙ্গার স্ট্রাইকও করতে শুরু করলো ছাত্রছাত্রীরা। দু’মাস যাবৎ আন্দোলন চলছে। অবশেষে জুনের চার তারিখে ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ করে শুরু হলো সরকারি সেনাদের গুলিবর্ষণ। ছাত্রছাত্রীদের, সরকারি নির্দেশে, মেরে ফেলা হলো। কেউ বলে কয়েকশ’ মানুষ মরেছে সেদিন। কেউ বলে, কয়েক হাজার। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সেদিনের কথা ভাবলে।

আমি তিয়ানানমেন স্কোয়ারের রূপ দেখতে যাইনি তিয়ানানমেন স্কোয়ারে প্রতিদিন, আমি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছি সেই প্রতিবাদী স্বপ্নবান তরুণ-তরুণীদের, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে ওঠে, প্রতিবাদ করে। আমি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছি তাদের, যাদের বুকের রক্তে ভেসে গেছে স্কোয়ার। আমি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছি সেই সাহসী তরুণকে, যে তরুণ তিয়ানানমেন স্কোয়ারে একাই এক সারি ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাংকের যাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছিল, যে তরুণ ট্যাংক চালকদের বলেছিল, আর মৃত্যু নয়। এবার থামাও, থামাও তোমাদের হত্যাযজ্ঞ।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *