2 of 3

নিজের গোলা শূন্য

১.

একটি মেয়ে। বাবা মরে যাবার পর ভাইয়ের সংসারে মানুষ। ভাইটি তাকে বেচে দিয়ে গেল পতিতালয়ে। পতিতালয় থেকে মেয়েটি পালিয়ে বাঁচতে চাইল। সেটিও হতে দিল না আমাদের সাধু পুরুষেরা। রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে তাকে ধর্ষণ করল। গণধর্ষণ। মেয়েটি রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। তার হাসপাতালের বেড ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সাংবাদিকরা, তার দুঃখের গল্প শুনছে, ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ জ্বলছে সারা দিন। বাহ কী মজা! ক্যামেরাম্যানের মজা, সাংবাদিকের মজা, পত্রিকাঅলার মজা, হকারের মজা এবং পাঠকেরও মজা নিশ্চয়।

‘নারী নিয়ে কিছু কেলেঙ্কারি’ ছাপা না হলে আজকাল পত্রিকা তেমন জমে না। অনেকে, আমি লক্ষ্য করেছি, পত্রিকা খুলেই নারী বিষয়ক ঘটনাগুলো বেশ খুঁটিয়ে পড়ে। জানি না এতে ওরা আনন্দ পায় কী বিমর্ষ হয়। অবশ্য বিমর্ষ হবার কোনও লক্ষণ দেখি না সমাজের কোনও স্তরে। সকলে লুটছে, সকলে খাচ্ছে, সকলে চাইছে ‘নারী সম্পদ’। নারী অনেকটা দোপিঁয়াজা মাংসের মতো, একে খেতেও আনন্দ, অনেকটা আমের আচারের মতোও নারী, একে চেটেও আনন্দ।

২.

নারী এমনই এক মজাদার বস্তু এদেশে, পুরুষেরা এই মজা দেবার বস্তুটিকে বিগড়ে যেতে দেখলেই দেবে চড়, দেবে লাথি, দেবে তার গলা টিপে, মারবে দা দিয়ে কুপিয়ে। আমাদের গ্রামগুলোয় যৌতুক না দেবার অপরাধে বধূ হত্যা ডাল ভাতের মত। মেরে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া, মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া এখন খুব একটা দক্ষ হাতেরও কাজ নয়। পুলিশ দু’একদিন খোঁজাখুঁজি করে। খোঁজাখুঁজি অবশ্য আসামি ধরবার তাগিদে যত না, তার চেয়ে বেশি কিছু টাকা পয়সা নেবার আশায়। খুনখারাবির মামলা মোকদ্দমায় নাকি নানারকম টাকাপয়সার খেলা চলে।

কিন্তু যৌতুক সমস্যার কী হবে? যৌতুক দেবে বলে মেয়েটিকে কারও কাছে গছিয়ে দরিদ্র পিতা যদি ব্যর্থ হয় যৌতুকের টাকা, মোটরসাইকেল, টেলিভিশন জোগাড় করতে? শুনেছি যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই নাকি আইনত নিষিদ্ধ। একথা কেবল শুনেছিই। অথচ এই নিষিদ্ধ কাণ্ডটি ঘটেই যাচ্ছে নিরন্তর। মেয়ের বাবার কাছ থেকে ধন সম্পদ পাবার আশায় পুরুষেরা উত্সাহী হয় বিবাহে। দেনমোহরের টাকাও দেয় কমিয়ে। কারণ যখন খুশি তখন তালাকের পথটি মসৃণ করা চাই যে! মেয়ের বাবা গড়িমসি করলে পুরুষেরা মেয়ের বুকের খাঁচা থেকে প্রাণটি বের করে নেয়।

৩.

লোকে বলে পুরুষেরা খাটে বেশি। এই বাক্যটি যে কত বড় মিথ্যে একটি বাক্য তা অনেকেই জানে না। আমি একদিন নিজের চোখে দেখেছিলাম একটি গ্রামের একটি বাড়িতে কী হচ্ছে। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠলো বাড়ির ‘মেয়েমানুষ’টি, উঠোন ঝাঁট দিলো, একাই মাটির ঘরগুলো লেপলো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চুলো ধরালো। লাকড়ি ছিলো না, কুড়োলে লাকড়ি কেটে নিয়ে তবে ধরালো। চুলোয় ভাত চড়ালো ডাল তরকারি। এসবের আয়োজন করতে হলো তাকে একাই। এই কাজ সারবার মধ্যে দেখা গেলো বাড়ির পুরুষটি একটি দাঁতন হাতে নিয়ে দাওয়ায় বসলো। রোদ পোহালো, বাড়ির পুরুষ-আত্মীয়দের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করলো। গরুগুলো গোয়াল ঘর থেকে বার করলো। বার করে এসে পিঁড়িতে বসলো।

মেয়েমানুষটি পুরুষটির থালায় ভাত বেড়ে দিল, ডাল তরকারি দিল, নুন দিল, কাঁচা লংকা দিল, জল দিল গ্লাসে! পুরুষটি খেয়ে ঢেঁকুর তুলে চলে গেলো ক্ষেতে। ক্ষেতে গিয়ে পুরুষটি ধান কাটলো, সেই ধান বাড়ি নিয়ে এলো। বাড়ির মেয়েমানুষটি সেই ধান রোদে শুকোতে দিল, কিছু ধান সেদ্ধ করল, কিছু ঢেঁকিতে ছাঁটল, কিছু গোলায় রাখল। মেয়েমানুষটি ধান মাড়াই ও সেদ্ধর ভারি ভারি কাজের ফাঁকে এসে চুলোয় ভাত বসালো। মাছ তরকারি রান্না করলো। আর পুরুষটি পুকুর থেকে স্নান সেরে মাথায় শর্ষের তেল মেখে পিঁড়িতে বসে। তৃপ্তি করে খায়।

পুরুষটি খেয়েদেয়ে দাওয়ায় বসে হুঁকো খায়। গল্পগুজব হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। এরপর বাইরে বেড়াতে যায়। বাড়ির মেয়েমানুষটি গোয়ালের গোবর সাফ করে। গরুর খাবার জন্য ভাতের মারের সঙ্গে নুন গুলে দেয়, খড় কেটে দেয়। সেই সকালে দু’মুঠো পান্তা মুখে দিয়েছিল, সন্ধ্যে নেমে আসে, তার আর খাবার সময় হয় না। আবার সন্ধ্যের পর কুপি বা হারিকেন জ্বালিয়ে খাবার দাবারের আয়োজন করা, থালাবাসন মাজা, ঘর উঠোন ঝাঁট দেওয়া। মেয়েমানুষের সময় নেই খায়, সময় নেই চুল বাঁধে, শাড়ি পাল্টায়। বিকেল সন্ধ্যে হেঁটে বেড়িয়ে বাড়ির পুরুষটির আবার ক্ষিধের উদ্রেক হয়। সন্ধ্যের পর পরই আবার খেয়ে দেয়ে সে বিছানায় শোয়। মেয়েমানুষটি সব কাজ সেরে ঘুমোতে আসে, পুরুষটি তখন তার ক্লান্ত, জীর্ণ, ঘর্মাক্ত শরীরটিকে ভোগ করে। নারী অবশ্য জানে না এই সম্ভোগে তার প্রাপ্য কী, জানে এতে কেবল পুরুষেরই তৃপ্তি।

পরিশ্রম নারীই করে বেশি। পুরুষের ঘরের গোলায় নারী ধান ভরে দেয়। তার নিজের গোলা থাকে শূন্য।

৪. নারী শিক্ষিত। স্বনির্ভর। কিন্তু স্বামী নামক পুরুষের দাসি। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া বা কিছু করার অনুমতি তার নেই। যদি অনুমতি না নিয়ে কিছু করে, স্বামী রাগ করবে, চিত্কার করবে, গালি দেবে, সন্দেহ করবে, কে জানে হয়তো তালাকও দিয়ে দিতে পারে। এই ভয়ে স্বামীর অনুগত হয় সে, এই ভয়ে স্বামী সেবায় সে ব্যস্ত। জব থেকে যা উপার্জন, সবই সে স্বামীর হাতে তুলে দেয়। কারণ স্বামীই বলেছে মেয়েমানুষরা টাকা পয়সা কী করে কী খাতে খরচ করতে হয় জানে না, আর হিসেব টিসেবও মেয়েমানুষরা করতে জানে না। স্বামী টাকা পেয়ে খুশি হয়। সংসারে ঢালে। অথবা নিজের একাউন্টে জমা রাখে।

স্বামীর মঙ্গলের জন্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য, এই নারী সবরকম কুসংস্কার পালন করে।   তার নিজের মঙ্গলের জন্য, তার নিজের সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বামী কিন্তু কিছু পালন করে না। এরকম কোনও নিয়মই সমাজে নেই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *