2 of 3

সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন

আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ভাস্কর সেন নিয়ে এসেছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়কে আমার কাছে। তখন দু’হাজার সালের শুরু। সে রাতে সবাইকে নিয়ে আহেলিতে গিয়েছিলাম বাঙালি খাবার খেতে। অনেকক্ষণ গল্প হয়েছিল সুমনের সঙ্গে। সুমন বলেছিলেন, তিনি হিন্দুদের ভিড়ে মুসলমান হতে আর মুসলমানের ভিড়ে হিন্দু হতে পছন্দ করেন। এভাবেই তিনি তাঁর সেকুলারিজমের লড়াই করেন। বলেছিলাম, এখানে হিন্দু ওখানে মুসলমান হওয়ার দরকার কী, সবখানে মানববাদী হলেই তো হয়! আমি যেমন! হিন্দু আর মুসলমানের বিরুদ্ধে যা কিছু বৈষম্য, মানববাদী হিসেবে আমি তার প্রতিবাদ করি! শেষ পর্যন্ত দেখলাম, সুমনের পদ্ধতিটাই সুমনের পছন্দ। যাবার সময় সুমন বলেছিলেন, ‘সেকুলারিজমের কসম, এই কলকাতায় আপনার নিরাপত্তার জন্য আমি যা কিছু করার করবো’।
কী যে মিথ্যে ছিল সেই প্রমিজ! এর কয়েক বছর পরেই সুমন, তখন কবীর সুমন, নিজেই ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে। সত্যি কথা বলতে কী, মৌলবাদিদের অত ভয়ংকর ফতোয়াকেও আমি অত বেশি ভয়ংকর মনে করিনি, যত করেছি সুমনের ফতোয়াকে। টিভিতে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি খুলে পয়গম্বর মুহম্মদকে অসম্মান করে কোথায় কী লিখেছি তা শুধু পড়েই শোনাননি, দেখিয়েওছেনও। ক্যামেরায় বইয়ের সেই পৃষ্ঠাগুলো ধরে রেখেছেন, যেন সবাই পড়তে পারে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান ‘তারা টিভি’র মতামত অনুষ্ঠান দেখছে তখন, পড়ছে সুমন যা পড়তে বলছেন। কোনও জঙ্গি মুসলমান সে রাতে আমাকে খুন করতে পারতো। নির্ঘাত পারতো। আমি থাকতাম মুসলিম অধ্যুসিত পার্ক সার্কাসের কাছেই রওডন স্ট্রিটে। সে রাতে ভয়ে আমার গা কেঁপেছে। সে রাতেই আমি প্রথম জানালা দরজাগুলো ভালো করে লাগানো হয়েছে কিনা পরখ করে শুয়েছি। সে রাতে আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। মৌলবাদীরা কোনোদিনই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি ইসলাম সম্পর্কে কোথায় আমি ঠিক কী লিখেছি, প্রমাণ দেখাতে পারেনি আমার ইসলাম-নিন্দার। কিন্তু সুমন সেই কঠিন কাজটা একটা বদ উদ্দেশে সহজ করে দিয়েছেলেন সে রাতে। –আমার বিরুদ্ধে এমন চরম শত্রুতা করলেন সাংস্কৃতিক জগতের নামি দামি এক শিল্পী! অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। কেমন যেন শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। যেন সুস্থ স্নিগ্ধ খোলা হাওয়া নেই আর কোথাও।
সুমন বলেছেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়াকে তিনি সমর্থন করেন। এমনিতে নব্য-মুসলিমদের সম্পর্কে বলাই হয় যে তারা মৌলবাদীদের চেয়েও দু’কাঠি বেশি মৌলবাদী। সুমন মুসলিম হয়েছেন বললেও মনে প্রাণে মুসলিম হয়েছেন বলে কিন্তু আমার কখনই মনে হতো না। ভাবতাম বোধহয় নিজের হিন্দু নাম ঝেরে ফেলে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে একধরণের প্রতিবাদ করেছেন। মৌলবাদী বলে ওঁকে ভাবার তো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তারা টিভির অনুষ্ঠানটি আমাকে বিস্মিত করে, নিজের চোখকে, কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। টিভিতে বারবারই সুমন বলেছেন, তাঁর পয়গম্বর সম্পর্কে আমি জঘন্য কথা লিখেছি, আমার শাস্তি প্রাপ্য। যে সুমনকে এতকাল নাস্তিক বলেই আমরা জানতাম, গানও লিখেছেন ভগবানকে কটাক্ষ করে, তিনি কিনা সমর্থন করছেন ধর্মীয় মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়া, আমার বিরুদ্ধে ধার্য করা মাথার মূল্য !
শুরু থেকেই সুমন আমার বই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। কলকাতা হাইকোর্ট আমার বইটির ওপর থেকে একসময় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। এটি মুক্তচিন্তার মানুষদের কাছে সুখবর হলেও সুমনের কাছে সুখবর ছিল না। কলকাতা বইমেলাতেও মুসলিম মৌলবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে আমার অনুরাগী পাঠকদের গালিগালাজ করেছেন সুমন। কেউ কেউ বলে, মৌলাবাদীদের কাছ থেকে নানান সুযোগ সুবিধে পান তিনি। আমি জানিনা কী সেই সুযোগ সুবিধে যার জন্য তিনি বাক স্বাধীনতার বিপক্ষে যান, মুসলিম সন্ত্রাসীদের পক্ষে তর্ক করেন। আমার বিশ্বাস হয় না সুমন সত্যিই মুহম্মদকে পয়গম্বর মানেন, বা ইসলামে সত্যিই বিশ্বাস করেন। যখন যেটা তাঁর প্রয়োজন, সেটায় বিশ্বাস করেন। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে গান বেঁধেছেন, যখন ডানপন্থীদের আশ্রয় তাঁর দরকার। মুসলিম মৌলবাদীদের সব সরকারই পেন্নাম করে। সুতরাং ওই মৌলবাদী দলে ভিড়লে তাঁর লাভ বৈ ক্ষতি হবে না, সম্ভবত জানতেন।
সুমনের গানের কথাগুলো খুব ভালো। সেসব কথা বাংলার লক্ষ মানুষ বিশ্বাস করলেও সুমন বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। গানে উদারতার কথা বললেও বাস্তবে তাঁকে হিংসুক আর ক্ষুদ্র মনের মানুষ হিসেবে দেখেছি। একবার উত্তম মঞ্চে নন্দিগ্রামের গান গাইছিলেন, আমি ছিলাম দর্শকের সারিতে। দর্শকদের মধ্য থেকে কে একজন মনে নেই কী মন্তব্য করেছিলো, সুমন এমনই ক্রুদ্ধ হলেন, এমনই ক্রুদ্ধ যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিচ্ছিরি গালি দিতে লাগলেন। লোকটা বেরিয়ে না গেলে তিনি হয়তো তাকে মঞ্চে টেনে এনে মারতেন।
সুমন বলেছেন তিনি পলিগ্যামাস লোক। বহুনারীর সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর। সে থাক, কিন্তু তিনি যে বড্ড নারীবিরোধী লোক। তাঁর জার্মান বউ মারিয়াকে তিনি শুধু মানসিক ভাবে নয়, শারীরিক ভাবেও নির্যাতন করতেন। মারিয়া মামলা করেছিলেন সুমনের বিরুদ্ধে। পুলিশ সুমনকে গ্রেফতার করেছিলো ১৯৯৯ সালে। বধুনির্যাতন মামলায় সহজে কেউ জামিন পায় না, কিন্তু সুমন পেয়েছিলেন। শুনেছি ক্ষমতার লোকেরা তাঁকে জামিন পেতে সাহায্য করেছিলেন। মারিয়ার ফ্ল্যাট, জিনিসপত্র–কিছুই নাকি সুমন তাঁকে ফেরত দেননি। মারিয়া শেষ পর্যন্ত খালি হাতে জার্মানিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তা খানিকটা কমতে শুরু করলে তিনি ঘন ঘন বাংলাদেশে যেতে থাকেন। বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে গেলে শুধু রুদ্রর গান গাইলেই চলে না, ভীষণ রকম তসলিমা বিরোধী হতে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদারের মতো এই তথ্যটি সুমনও জেনেছিলেন। আর, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলে তো আর কথাই নেই। সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান মাথায় তুলে নাচবে।
এই সেদিন বর্ধমানে মুসলিম মৌলবাদীদের বোমা হামলার পরিকল্পনা ধরা পড়ার পর সুমন একে বিজেপির কীর্তি বলেছেন, লোকে বলে মুসলিম মৌলবাদীদের আশ্রয়দাত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সুদৃষ্টি পাওয়ার আশায় এটি করেছেন। ক্ষমতার বড় লোভ সুমনের। টাকা পয়সারও লোভ প্রচণ্ড। অথচ কী ভীষণ আদর্শবাদী বলে ভাবতাম মানুষটাকে। এখনও অবশ্য প্রচুর লোককে বোকা বানিয়ে চলছেন। অভিনয় ভালো জানেন বলে এটি সম্ভব হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *