জার্মান প্রটেস্টান্ট প্যাস্টরের মার্টিন নিয়েমুলারের কথা নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। মার্টিন হিটলার বিরোধী ছিলেন। এবং সাত বছর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন। মার্টিনের বিখ্যাত কবিতাটি বার বার আওড়ালাম বাংলাদেশে নাজিমুদ্দিন সামাদ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী আর জুলহাস মান্নান খুন হওয়ার পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে নািসরা এক এক করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল জিপসিদের, কমুনিস্টদের, ইহুদিদের, তখন যারা জিপসি নয়, কমুনিস্ট নয়, ইহুদি নয়— তারা প্রতিবাদ করেননি। মার্টিন লিখেছিলেন :
‘ওরা যখন সোশালিস্টদের জন্য এলো,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি সোশালিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ইহুদিদের জন্য,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।
তারপর তারা আমার জন্য এলো, এবং কেউ ছিল না আমার জন্য কথা বলার…। ’
নাজিমুদ্দিন, রেজাউল, জুলহাস— কেউ নাস্তিক ছিলেন না, ইসলামের সমালোচক ছিলেন না, ব্লগারও ছিলেন না। অথচ তাঁদের নৃশংসভাবে খুন হতে হলো। মানুষ জানতো সন্ত্রাসীরা শুধু ইসলামের সমালোচকদের খুন করবে, শুধু নাস্তিক ব্লগারদের খুন করবে। কিন্তু কেউ জানতো না তারা একসময় প্রগতিশীল মুসলমানদেরও খুন করবে। ধর্ম বিশ্বাসীদেরও খুন করবে, শুধু প্রগতিশীল হওয়ার অপরাধে। নাজিমুদ্দিন সামাদ কোনও নাস্তিক ব্লগার ছিলেন না, ছাত্র ছিলেন, প্রগতির পক্ষে ছিলেন, ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে ছিলেন। রেজাউল করিম সিদ্দিকী সেতার বাজাতেন, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন, সাংস্কৃতিক কাজকর্মে উৎসাহী ছিলেন। তিনি ধর্মকে গালি দেননি। কিন্তু তাঁকে খুন হতে হলো সংস্কৃত মনা হওয়ার অপরাধে। জুলহাজ মান্নানকে খুন হতে হয়েছে উদার হওয়ার অপরাধে। জুলহাজ সমকামীদের সমর্থনে ‘রূপবান’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেটিই ছিল তার অপরাধ।
যখন ব্লগারদের এক এক করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করেনি। হয়তো মনে করেছিল, ‘আমরা ধর্মের সমালোচনা করছি না, আমরা নিরাপদে আছি। যারা সমালোচনা করেছে, তাদের মারা হচ্ছে, এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই’।
ব্লগাররা অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। দেশে যাঁরা আছেন, লুকিয়ে আছেন, লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন, অথবা লিখলেও ছদ্মনামে লিখছেন। সন্ত্রাসীদের পক্ষে ব্লগার পাওয়াও এখন মুশকিল। তাই এখন ব্লগার নয়, কিন্তু গান গায়, কবিতা লেখে, উদারপন্থী মানুষকেই তারা বেছে নিয়েছে খুন করার জন্য। এখনও যদি মানুষ চুপ থাকে, এখনও প্রতিবাদ না করে, এখনও খুনের শাস্তি না জোটে খুনির, তাহলে কিন্তু খুন আরও বাড়বে, এবং সেই খুন শুধু প্রগতিশীল উদারপন্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আস্তিকরাও খুন হবেন। সাধারণ মুসলমানরাও খুন হবেন। খুন হবেন কট্টরপন্থী না হওয়ার অপরাধে।
মার্টিনের কবিতার মতো আমার লিখতে ইচ্ছে করছে নতুন একটি কবিতা।
‘ওরা যখন হিন্দুদের জন্য এলো,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি হিন্দু ছিলাম না।
তারপর তারা এলো নাস্তিকদের জন্য,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি নাস্তিক ছিলাম না।
তারপর তারা এলো সমকামীদের জন্য,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি সমকামী ছিলাম না। প্রগতিশীল ছিলাম না।
তারপর তারা এলো প্রগতিশীলদের জন্য,
আমি কথা বলিনি—
কারণ আমি প্রগতিশীল ছিলাম না।
তারপর তারা আমার জন্য এলো, এবং কেউ ছিল না আমার জন্য কথা বলার…। ’
এ-ই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইসিস যেভাবে খুন করছে মুসলমানদের, সেভাবে খুন করতে শুরু করেছে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে আমার বক্তৃতায় গত সপ্তাহে আমি বলেছি এই সমস্যার কথা। মানুষ খুন হচ্ছে ভিন্ন মত প্রকাশের কারণে, কিন্তু কারও বিচারের ব্যবস্থা হচ্ছে না। এতে সন্ত্রাসীরা পরম উৎসাহে নতুন খুনের দিকে এগোচ্ছে। পার্লামেন্ট সদস্যারা আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘সিভিল সোসাইটি কী করছে?’ কিছুক্ষণ আমি কিছু বলতে পারিনি। একবার মনে হচ্ছিল বলি, ‘বসে বসে আঙুল চুষছে’। এত যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, আমি তো কোনও প্রতিবাদ মিছিল-মিটিং এর কথা শুনিনি! আসলে একটা সমাজ ভয়ংকর নয় যদি সেই সমাজ ভয়ংকর সন্ত্রাসীর জন্ম দেয়, অথবা সেই সমাজ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কোনও সরকারকে জন্ম দেয়— কিন্তু ভয়ংকর হয় তখনই যখন নাগরিক সমাজ সন্ত্রাস দেখেও বা নৈরাজ্য দেখেও চুপ থাকে। যখন হত্যাযজ্ঞ দেখেও কোনও কথা বলে না। যখন অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে গোটা দেশকে, দেখেও শব্দ করে না।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ এপ্রিল, ২০১৬