ড্রাকুলা’স গেস্ট

ড্রাকুলা’স গেস্ট

এক.

মিউনিখে যাত্রা শুরুর দিন উজ্জ্বল রোদে উদ্ভাসিত ছিল চারদিক। গ্রীষ্মের শুরুতে বইছিল চনমনে হাওয়া। আমরা রওনা হতে যাচ্ছি, এমন সময় হের ডেলব্রুক (কোয়ার্জর সেইজোর’র মেতিওর ডি হোটেল, এখানেই আমি ছিলাম) নেমে এল নিচে। আমার ক্যারিজের কাছে এসে আমার যাত্রার জন্য শুভ কামনা জানাল। ক্যারিজ ডোরের হাতলের ওপর হাত রেখে কোচম্যানের সঙ্গে কথা বলল :

‘ভুলে যেয়ো না রাত নামার আগেই কিন্তু তোমায় ফিরতে হবে। আকাশ ঝকমকে দেখালেও উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া আভাস দিচ্ছে আকস্মিক ঝড়-বাদল শুরু হয়ে যেতে পারে। আশা করি তোমার দেরি হবে না।’ বলে হাসল সে। যোগ করল, ‘তুমি তো জানোই আজ কিসের রাত।’

জোরে মাথা ঝাঁকাল জোহান, ‘জা, মেইন হের।’ হাত দিয়ে মাথার হ্যাট স্পর্শ করে ছুটিয়ে দিল গাড়ি। শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে থামার ইঙ্গিত করে কোচোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম :

‘জোহান, আজ কিসের রাত?’

সে বুকে ক্রস চিহ্ন এঁকে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘ভালপারগিস নাখত, ‘ তারপর পকেট থেকে শালগম সাইজের, রুপোর তৈরি পুরানো জার্মান আদলের একটি ঘড়ি বের করে দেখল। দুই ভুরু কুঞ্চিত হলো তার, অধৈর্য ভঙ্গিতে কাঁধ নাচাল। বুঝলাম অপ্রয়োজনীয়, দেরি হলে সে এভাবেই তার বিরক্তি প্রকাশ করে। আমি গাড়ির কুশনে গা এলিয়ে দিয়ে ইশারা করলাম এগোতে। জোহান তীর বেগে ঘোড়া ছোটাল। হারানো সময়টা পুষিয়ে নিতে চায়। মাঝে মাঝেই ঘোড়াগুলো মাথা ঝাঁকাচ্ছে, বাতাসে নাক উঁচু করে সন্দেহের ভঙ্গিতে গন্ধ শুঁকছে। যেন কিছু টের পেয়েছে। আমি সতর্ক বোধ করে চারপাশে নজর বুলাই। জনহীন, বিবর্ণ চেহারার রাস্তা। আমরা এ মুহূর্তে উঁচু একটি মালভূমি দিয়ে চলেছি। শনশন হাওয়া বইছে। চলতে চলতে একটি রাস্তা চোখে পড়ল। দেখে মনে হলো খুব কমই ব্যবহার করা হয় রাস্তাটি। আঁকাবাঁকা উপত্যকার মাঝ দিয়ে এগিয়েছে। রাস্তাটি যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। জোহান বেজার হবে জেনেও ওকে থামতে বললাম।

ঘোড়ার লাগাম টেনে গাড়ি দাঁড়া করাল সে। বললাম আমি ওই রাস্তাটি দিয়ে যেতে চাই। সে নানারকম বাহানা খাড়া করল, ব্যাখ্যা দেয়ার সময় বারবার ক্রস চিহ্ন আঁকল বুকে। এতে আমার কৌতূহল বাড়ল বৈ কমল না। কাজেই ওকে নানান প্রশ্ন করলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার প্রশ্নের জবাব দিল জোহান এবং ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাল। অবশেষে আমি বললাম :

‘বেশ তো, জোহান, আমি এ রাস্তা ধরেই যেতে চাই। তোমার ইচ্ছে না হলে আসবে না। কিন্তু তুমি কেন যেতে চাইছ না সে কথাটি বলো তো!’ জবাবে সে ঝট করে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। তারপর হাত দুটো বাড়িয়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল আমি যেন না যাই। ইংরেজি আর জার্মান ভাষার মিশেলে ওর কথার তোড় বুঝতে আমার একটু বেগ পেতেই হচ্ছিল। তবে ওর অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল আমাকে এমন একটা কথা বলতে চাইছে যেটা বলতে সে নিজেই ভয় পাচ্ছে। তবে প্রতিবার কথা শেষের পরে সে ক্রস আঁকছিল বুকে এবং বলছিল ‘ভালপারগিস নাখত!’

ওর সঙ্গে তর্ক করতে চাইছিলাম আমি। তবে যে লোকের ভাষা বুঝি না তার সঙ্গে তর্ক করা কঠিন। জোহান ভাঙা ভাঙা, অশুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি ব্যবহার করছিল মাঝে মাঝে, তবে উত্তেজিত বলেই ফিরে যাচ্ছিল তার মাতৃভাষায় আর প্রতিবারই চোখ বুলাচ্ছিল ঘড়িতে। ঘোড়াগুলোকে দেখলাম কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। নাক শুঁকছে বাতাসে। অশ্বকুলের এহেন আচরণে কোচোয়ানের মুখ একেবারে শুকিয়ে গেল, ভীতসন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকাল চারপাশে, হঠাৎ লাফ মেরে চলে এল সামনে, ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরে ওগুলোকে কুড়ি ফুট দূরে টেনে নিয়ে গেল। আমি পেছন পেছন গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম এরকম করার মানে কী। প্রত্যুত্তরে জোহান ক্রস চিহ্ন আঁকল বুকে, যে জায়গাটা ছেড়ে আমরা এসেছি সেদিকে হাত তুলে দেখাল, তারপর ক্যারিজ নিয়ে গেল অপর রাস্তা অভিমুখে।

একটি ক্রুশ দেখিয়ে প্রথমে জার্মান ভাষায় তারপর ইংরেজিতে বলল, ‘তাকে কবর দেয়া হয়েছে—যে নিজেকে হত্যা করেছে।’

আমার মনে পড়ল চৌরাস্তায় আত্মহত্যাকারীদের কবর দেয়ার একটি পুরানো প্রথা রয়েছে বটে। ‘ও! সুইসাইড! তাই বলো!’ কিন্তু এ জন্য ঘোড়াগুলো এমন ভয় পেল কেন বুঝতে পারলাম না।

আমরা কথা বলছি এমন সময় একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তীক্ষ্ণ চিৎকার আর ঘেউ ঘেউয়ের মিলিত আওয়াজ। অনেক দূর থেকে এসেছে শব্দটা কিন্তু ঘোড়াগুলোকে দেখলাম বেদম অস্থির হয়ে উঠেছে। ওদের শান্ত করতে ঘাম ছুটে গেল জোহানের। সে মুখ শুকনো করে বলল, ‘নেকড়ের ডাকের মতো আওয়াজ। কিন্তু এখানে কোনো নেকড়ে নেই।’

‘নেই?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। ‘কিছুদিন আগেও না শহরের আশপাশে নেকড়ের পাল ঘুরঘুর করত? ‘

‘সে অনেক অনেক আগে,’ জবাব দিল জোহান। ‘বসন্ত আর গ্রীষ্মে কিন্তু তুষারপাত শুরুর পরে এদিকে অনেক দিন কোনো নেকড়ে আসে না।’

ঘোড়াগুলোর পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে ওদের স্থির রাখার চেষ্টা করছে কোচোয়ান, লক্ষ করলাম আকাশ ক্রমে কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। রোদ গিলে খেয়েছে কালো মেঘের ঝাড়, এক ঝলক শীতল দমকা হাওয়া আমাদের ঝাপটা মেরে চলে গেল। তবে একটু পরেই মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হেসে উঠল সূর্য। জোহান দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল, ‘তুষারঝড়। সে অনেক দিন পর আবার আসছে।’

আবার ঘড়ি দেখল সে, তারপর শক্ত হাতে লাগাম চেপে ধরে, কারণ তখনো ঘোড়াগুলো মাটিতে পা ঠুকছে এবং মাথা ঝাঁকাচ্ছে-নিজের বক্সে উঠে বসল, যাত্রার প্রস্তুতি নিল।

আমার জেদ চেপে গেছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে ক্যারিজে চাপলাম না।

‘রাস্তাটা যেদিকে চলে গেছে ওই জায়গাটা সম্পর্কে আমাকে বলো,’ বললাম আমি।

আবার বুকে ক্রস চিহ্ন আঁকল সে, জবাব দেয়ার আগে প্রার্থনা করল। ‘এটা অশুভ জায়গা।

‘কোনটা অশুভ?’ জানতে চাই আমি।

‘গ্রামটা।’

‘তাহলে ওখানে একটা গ্রাম আছে?’

‘না। না। ওখানে কয়েকশ বছর ধরে কেউ থাকে না।’

আমার কৌতূহল আরও বাড়ল।’ কিন্তু তুমিই তো বললে ওখানে একটা গ্রাম ছিল।’

‘ছিল তো।’

‘তাহলে ওটা এখন কোথায়?’

জার্মান এবং ইংরেজি মিশিয়ে জোহান যে লম্বা গল্প ফেঁদে বসল তার পুরোপুরি অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না, তবে মোটামুটি আঁচ করলাম যে অনেক আগে, শত বছর আগে, ওখানে মানুষজন মারা যাওয়ার পরে তাদের কবর দেয়া হতো, তবে মাটির নিচে থেকে শোনা যেত শব্দ, কবর খোলার পরে দেখা যায় নারী-পুরুষ সকলে তরতাজা হয়ে বেঁচে আছে এবং তাদের মুখে লেগে রয়েছে রক্ত। তখন সেখানে জীবিত যে কজন ছিল তারা তাদের জীবন বাঁচাতে (হাঁ, আর তাদের আত্মা এখানে ক্রস চিহ্ন আঁকল সে) তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যায় নানান জায়গায়, যেখানে জীবিতদের বাস আর মৃতেরা সেখানে মৃতই এবং অন্য কিছু নয়।

বর্ণনা দিতে গিয়ে লোকটা ক্রমে উত্তেজিত হয়ে উঠল। যেন কল্পনা তাকে গ্রাস করেছে, গল্পের শেষ দিকে এসে ভয়ের প্রবল বিস্ফোরণ ঘটল তার মাঝে—মুখটা কাগজের মতো সাদা, দরদর করে ঘামছে এবং কাঁপছে, বারবার তাকাচ্ছে চারপাশে যেন আশঙ্কা করছে খোলা মালভূমিতে এমন ঝকঝকে সূর্যালোকের মধ্যেও ভয়ংকর কিছু একটা এসে উপস্থিত হবে। অবশেষে হতাশ যন্ত্রণায় সে চিৎকার দিল :

‘ভালপারগিস নাখত!’ আমাকে ইশারা করল গাড়িতে উঠে পড়তে। আমার অহমিকায় বেশ লাগল, ইংরেজ রক্ত জেগে উঠল শরীরে। আমি সটান দাঁড়িয়ে থেকে বললাম :

তুমি ভয় পেয়েছ, জোহান-তুমি ভয় খেয়েছ। বাড়ি যাও, আমি একাই ফিরব; হাঁটাহাঁটি করতে আমার ভালোই লাগবে।’

ক্যারিজের দরজা খোলা। আমি আসন থেকে ওর কাঠের তৈরি আমার ছড়িখানা নিলাম-বাইরে কোথাও ছুটি কাটাতে গেলে ওয়াকিং স্টিকটি সব সময় সঙ্গেই রাখি-দরজা বন্ধ করে দিলাম। মিউনিখের দিকে হাত দেখিয়ে বললাম, ‘বাড়ি যাও, জোহান-ভালপারগিসের রাত ইংরেজদের জন্য কোনো গুরুত্ব বহন করে না।’

ঘোড়াগুলো এখন আগের চেয়ে আরও বেশি অস্থির। জোহান ওদের সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে করতে আমাকে অনুনয় করল আমি যেন বোকার মতো এ কাজটি না করি। বেচারার জন্য মায়াই লাগল আমার, তার ভেতরে আন্তরিকতার অভাব নেই; তবে একই সঙ্গে আমি না হেসেও পারলাম না। কারণ উত্তেজনার চোটে সে ইংরেজি বলতেই ভুলে গেছে। বিস্মৃত হয়েছে যে আমাকে কিছু বোঝাতে হলে ইংরেজিতে বলতে হবে, সে তার মাতৃভাষা জার্মানিতে হড়বড় করতেই থাকল। এবারে আমি একটু বিরক্তই হলাম। ওকে বাড়ির পথ ধরার হুকুম দিয়ে উপত্যকার চৌরাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।

হতাশার একটা ভঙ্গি করে জোহান তার ঘোড়াদের মুখ ঘুরিয়ে দিল মিউনিখের দিকে। আমি ছড়িতে হেলান দিয়ে ওর গমনপথে তাকিয়ে থাকলাম। খানিকটা পথ সে মন্থর গতিতে চলল। এমন সময় পাহাড়চুড়োয় রোগাপাতলা এবং লম্বা এক লোককে চোখে পড়ল আমার। দূর থেকেও তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। লোকটা ঘোড়াগুলোর কাছে আসতে ওরা যেন পাগল হয়ে গেল। লাফাচ্ছে, লাথি ছুড়ছে, তারপর আতঙ্কে হেম্বারব শুরু করে দিল। জোহান কিছুতেই ওদের শান্ত করতে পারছে না। ঘোড়াগুলো রাস্তা ধরে উন্মত্তের মতো ছুটল। ওরা চোখের আড়াল হলে আমি আগন্তুকের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালাম। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। সে-ও চলে গেছে।

ফুরফুরে মনে সাইড রোড ধরে উপত্যকার গভীরে পা বাড়ালাম আমি, যেদিকটাতে যেতে মানা করেছিল জোহান। ওর বারণ শোনার মতো কোনো যুক্তিই খুঁজে পাইনি আমি। ঘণ্টাকয়েক স্রেফ ঘুরে বেড়ালাম সময় কিংবা দূরত্বের কথা চিন্তা না করে। এর মধ্যে না কোনো মানুষজন না কোনো ঘর বাড়ি নজরে এল। একদম জনমানবশূন্য এলাকা। তবে রাস্তায় একটা বাঁক নিতে গিয়ে ওখানে ইতস্তত ছড়ানো গাছপালা দেখে উপলব্ধি করলাম এ জায়গাটির নির্জনতা অজান্তেই আমার মনে একটা ছাপ ফেলেছে।

আমি বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটু বসে চারপাশে চোখ বুলালাম। খেয়াল হলো হাঁটার সময় যতটা ঠান্ডা অনুভূত হয়েছিল তার চেয়ে বেশিই ঠান্ডা লাগছে এখানে—একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ যেন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার চারপাশে, হঠাৎ হঠাৎ, মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, কেমন ভোঁতা গর্জনের শব্দ। মুখ তুলে চাইতে দেখি বিরাট বিরাট ঘন কালো মেঘ উত্তর থেকে দক্ষিণে দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। বাতাসে আসন্ন ঝড়ের লক্ষণ। আমার একটু শীত শীত করছিল। ভাবলাম অনেকক্ষণ হাঁটার পরে বসে থাকার কারণে হয়তো ঠান্ডা লাগছে। আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম।

এখন যে এলাকা দিয়ে যাচ্ছি তার দৃশ্য বড়ই মনোহর। চোখে পড়ার মতো আলাদা কিছু নেই, তবু গোটা ব্যাপারটির মধ্যে রয়েছে একটি অদ্ভুত সৌন্দর্য। সময়ের দিকে লক্ষ না রেখে আমি হেঁটে চলেছি, হঠাৎ গোধূলির আলো ঘন হয়ে এলে চিন্তা করতে লাগলাম কীভাবে রাস্তা চিনে বাড়ি ফিরব। দিনের উজ্জ্বলতাও এখন নিঃশেষ। শীতল বাতাস। মাথার ওপরে ভাসমান মেঘের ভেলা আরও বেশি সুস্পষ্ট। দূর থেকে কেমন অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছে থেকে থেকে। সেই রহস্যময় চিৎকারের মতো আওয়াজ কোচোয়ান যাকে বলেছিল নেকড়ের ডাক।

এক মুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলাম। আমি বলেছিলাম পরিত্যক্ত গ্রামটি আমি দেখব। তাই হাঁটায় বিরতি দিলাম না। একটু পরেই এসে পড়লাম চারদিক থেকে পাহাড় দ্বারা অবরুদ্ধ সুপ্রশস্ত একটি খোলা জায়গায়। পাহাড়গুলোর ধার বা পাশগুলো গাছপালায় ঢাকা, ছড়িয়ে গেছে মালভূমির দিকে, কোথাও ছড়ানো-ছিটানো, কোথাও ঝাড় বাঁধা, এখানে-সেখানে অনুচ্চ ঢালসহ ফাঁকা জায়গা আছে। সর্পিল রাস্তাটি অনুসরণ করল আমার চোখ, ওটা একটা ঘন গাছের ঝাড়ের ধারে বাঁক নিয়ে পেছন দিকে মিলিয়ে গেল।

আমি ওদিকে তাকিয়ে আছি, অকস্মাৎ দমকা একটা শীতল বাতাস ধেয়ে এল। তার পরপরই শুরু হয়ে গেল তুষারপাত। এ উষর রাজ্যের মাইলের পর মাইল জনমানবশূন্য নির্জন পথের কথা মনে পড়ল আমার। সামনের জঙ্গলের দিকে দ্রুত এগোলাম আশ্রয় নিতে। আকাশ ক্রমে কালো হয়ে এলো, ভারী হয়ে উঠল তুষারপাত। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে এবং চারপাশের জমিন ধবধবে সাদা কার্পেটে মুড়ে গেল। চকচকে কার্পেটের দূরবর্তী কিনারা গিলে খেল কুয়াশা। এদিকের রাস্তাটির কিনারাগুলো ঠাহর করা দায়। ফলে শক্ত সারফেসের বদলে ঘাস আর শ্যাওলায় ডুবে গেল পা। বাতাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে ছুটতে লাগলাম। বরফের মতো ঠান্ডা বাতাস। নিয়মিত ব্যায়াম করা সত্ত্বেও আমার বেশ কষ্টই হতে লাগল। এত ঘন হয়ে এবং চক্রাকারে আমার চারপাশে বরফ পড়তে লাগল যে চোখ খুলে রাখাই দায়। খানিক পরপর আকাশ চিরে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ রেখা, তার পরিষ্কার আলোয় দেখতে পেলাম সামনেই গাছের ঘন একটা সারি, বেশির ভাগ ইউ এবং সাইপ্রেস, গায়ে বরফের পুরু চাদর নিয়ে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি গাছগুলোর নিচে গিয়ে শরণ নিলাম। এখানটা অপেক্ষাকৃত নীরব। তবে মাথার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ বইছে ঝোড়ো হাওয়া। ঝোড়ো অন্ধকার মিশে গেল রাতের আঁধারের সঙ্গে। ক্রমে মনে হচ্ছিল কমে আসছে ঝড়ের বেগ। এখন মাঝেমধ্যে কেবল শোনা যাচ্ছে দমকা বাতাসের শব্দ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার চারপাশের অসংখ্য চেনা শব্দের সঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলে বিকট গলায় ডেকে উঠল একটা নেকড়ে

আকাশে ভেসে যাওয়া ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে ধস্তাধস্তি করে চাঁদের বিক্ষিপ্ত আলো এসে পড়ছিল প্রকৃতিতে। সেই আলোয় দেখতে পেলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি সাইপ্রেস এবং ইউ গাছের জঙ্গলের কিনারায়।

তুষারপাত বন্ধ হলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তীক্ষ্ণ নজর বুলাতে লাগলাম চারপাশে। মনে হলো অনেক পুরানো স্থাপনাগুলোর মধ্যে এখনো একখানা বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, যদিও ধ্বংসপ্রাপ্ত। ওখানে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিতে এগিয়ে গেলাম। ঝোপঝাড়ের কিনারা ঘেঁষে এগোতে দেখি ওটাকে নিচু একটা পাঁচিল বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে। পাঁচিল অনুসরণ করে সামনে বাড়তে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। এখানে সাইপ্রেস গাছগুলো একটা গলির মতো তৈরি করেছে, যেটার বিস্তৃতি ঘটেছে এক ধরনের ভবনের কাঠামোর দিকে। ওটা মাত্র চোখে পড়েছে, মেঘ ঢেকে ফেলল চাঁদ, অন্ধকারে আমি পথটি পার হলাম। বাতাস নিশ্চয় এখন আরও শীতল, কারণ হাঁটতে গিয়ে আমার বেশ শীত লাগছিল। তবে আশ্ৰয় মিলবে এ আশায় আমি অন্ধের মতো এগিয়ে চললাম।

আকস্মিক এক নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। ঝড় থেমে গেছে এবং সম্ভবত প্রকৃতির নীরবতায় সমব্যথী হয়ে আমার হৃৎস্পন্দনও বুঝি থেমে গেল। তবে বিষয়টি মুহূর্তকালের জন্য; হঠাৎ মেঘ ভেঙে বেরিয়ে এল চাঁদ, জোসনায় দেখতে পেলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি কবরস্থানে এবং আমার সামনে চৌকোনা যে জিনিসটি দেখতে পাচ্ছি সেটি মার্বেল পাথরের একটি প্রকাণ্ড সমাধিস্তম্ভ, আমার চারপাশের বরফের মতোই ধবধবে সাদা। চাঁদের আলোর সাথে ভেসে এল ঝড়ের তীব্র দীর্ঘশ্বাস, মনে হলো অসংখ্য কুকুর অথবা নেকড়ে একটানা চাপা গর্জন করে চলেছে। আতঙ্কবোধ করলাম, শীতল একটা অনুভূতি আমার হৃৎপিন্ডটাকে যেন চেপে ধরল। চাঁদের আলোর বন্যায় মার্বেল পাথরের সমাধিটি ধুয়ে যাচ্ছে, আবার শুরু হয়ে গেল ঝড়। যেন ফিরে এল তার পথ ধরে।

এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমি এগিয়ে গেলাম মর্মর পাথরের তৈরি সমাধির দিকে। দেখতে চাই এমন সুন্দর একটা জিনিস এরকম একটা জায়গায় পড়ে আছে কেন। ওটার চারপাশে একটা চক্কর দিলাম। ডরিস প্রদেশের স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী নির্মিত দরজার ওপরের লেখাগুলো পড়লাম। জার্মান ভাষায় লেখা :

স্টিরিয়ার গ্রাৎসের কাউন্টেস ডলিন জেন
প্রার্থিত মৃত্যুকে পেয়েছে ১৮০১ সালে

কবরের ওপরে, নিরেট মর্মর পাথরের ভেতরে যেন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে লোহার মস্ত গজাল বা শূল, বড় বড় পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি কাঠামো। পেছন দিকটায় গিয়ে দেখি ওখানে রুশ অক্ষরে বড় বড় করে লেখা :

মৃতেরা দ্রুত পরিভ্রমণ করে

গোটা ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুতুড়ে এবং গা ছমছমে এমন একটা ব্যাপার রয়েছে যে আমার শরীরটা শিরশির করে উঠল, খুব দুর্বল লাগল। এই প্ৰথম মনে হলো জোহানের পরামর্শ শুনলেই বোধ করি ভালো করতাম। কথাটা মনে পড়ে গেল আমার, এহেন রহস্যময় পরিবেশে এবং বেশ একটা ঝাঁকি খেলাম। আজ ভালপারগিসের রাত!

ভালপারগিসের রাত। লাখ লাখ মানুষের বিশ্বাস এ রাতে শয়তান ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র-কবরগুলো খুলে গিয়ে বেরিয়ে আসে মৃতের দল। এ রাতে জল, স্থল ও বায়ুর সকল অশুভ জিনিস মেতে ওঠে আনন্দ উল্লাসে। কোচোয়ান এ জায়গাটিকে বিশেষভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। এ সেই শতবর্ষী পুরানো জনমানবহীন গাঁ। এখানেই কবরে শুয়ে আছে আত্মহত্যাকারী; আর এমন একটা জায়গায় আমি একদম একা-শীতে কাঁপছি, চারদিকে বরফের চাদর, উন্মত্ত ঝড় আবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পাঁয়তারা কষছে! তীব্র ভয়ে যাতে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলি সে জন্য আমার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করলাম, আমার সকল শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন একত্র করলাম আতঙ্কের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।

একটা প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমার গায়ে আছড়ে পড়ল। থরথর কেঁপে উঠল মাটি যেন হাজার হাজার ঘোড়া জমিনের ওপর দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এবারে ঝড় এল তার শীতল ডানায় চেপে, বরফ নয়, প্রকাণ্ড শিলা পড়তে লাগল এমন জোরে যে সাইপ্রেস গাছের পাতা ছিঁড়ে গেল, ডাল ভেঙে গেল। ওখানে আর আশ্রয় নেয়ার জো থাকল না। প্রথমে আমি সবচেয়ে কাছের গাছটির দিকে ছুটে গিয়েছিলাম; তবে শিগগির ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হলাম। আশ্রয় নেয়ার এখন একটি মাত্র জায়গা আছে মার্বেল পাথরের সমাধির ডরিস স্থাপত্যের দরজা। ব্রোঞ্জের প্রকাণ্ড দরজায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিলাবৃষ্টির কবল থেকে মুক্তি পেয়েছি। বিরাট বিরাট শিলাখণ্ড মাটিতে এবং মার্বেলের গায়ে পড়ে ছিটকে যাচ্ছে।

দরজায় হেলান দিয়েছি, ওটা সামান্য নড়ে উঠে ভেতর দিকে খুলে গেল। এই নির্মম ঝড়ের মধ্যে কোনো কবরের আশ্রয়ও আনন্দদায়ক, কিন্তু যেই আমি ভেতরে ঢুকতে গিয়েছি, সাপের জিভের মতো চেরা বিদ্যুতের ঝলকানি আলোকিত করে তুলল গোটা আকাশ। ওই মুহূর্তে দেখতে পেলাম কবরের অন্ধকার শবাধারে শুয়ে আছে এক অপূর্ব সুন্দরী নারী, গোলাকার মুখ, টসটসে লাল অধর, যেন ঘুমিয়ে আছে। মাথার ওপরে দানবীয় একটা হাত যেন আমাকে টান মেরে ওখান থেকে ছুটিয়ে এনে ছুড়ে ফেলে দিল ঝড়ের মধ্যে।

ব্যাপারটা এমন আকস্মিক ঘটে গেল, ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগেই দেখি আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে শিলা। একই সময় মনে হলো এখানে আমি ঠিক একা নই। সমাধির দিকে তাকালাম। আবার জ্বলে উঠল চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের আলো, যেন আঘাত হানল কবরের লোহার গজালে, আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আগুনের একটা হল্কা তৈরি করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল মার্বেল পাথর।

মৃত মহিলা সিধে হলো যন্ত্রণাকাতর এক মুহূর্তের জন্য, আগুনের শিখা তাকে স্পর্শ করেছে, তার আর্তনাদ ঢাকা পড়ে গেল বজ্রনিনাদে। আমি শেষ যে জিনিসটি শুনতে পেলাম তা এই ভয়ংকর মিশ্রিত আওয়াজ, আবার আমাকে চেপে ধরল দানব হাত এবং টেনে ছুড়ে ফেলে দিল। আমার গায়ে আঘাত হানছে শিলা, বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নেকড়ের ডাক। শেষ যে দৃশ্যটি আমার মনে পড়ে তা হলো আবছা সাদা রঙের চলমান একটা স্তূপ, যেন কবর থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাফনের কাপড় মোড়ানো অশরীরীর দল, তারা শিলাবৃষ্টির ধবল ধোঁয়া ভেদ করে ক্রমে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

দুই

আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে এল আমার; তারপর ভয়ানক ক্লান্তি লাগল। এক মুহূর্ত স্মরণে এল না কিছুই, তবে ধীরে ধীরে সজাগ হয়ে উঠল ইন্দ্রিয়গুলো। আমার পা ভীষণ ব্যথা করছে, যদিও নাড়াতে পারছি না। কেমন অবশ লাগছে। ঘাড়ের পেছনে এবং গোটা শিরদাঁড়া জুড়ে বরফশীতল একটা অনুভূতি, পায়ের মতো কান দুটোতেও কোনো সাড়া নেই, যদিও অনুভূত হচ্ছে যন্ত্রণা। তবে তুলনায় আমার বুকের ওপর যে উষ্ণ একটা অনুভূতি টের পাচ্ছি তা সত্যি চমৎকার। এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন-শারীরিক দুঃস্বপ্ন বললেই মানায় ভালো; আমার বুকের ওপর বিষম একটা ওজন। শ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

এই প্রায় তন্দ্রা ভাবটি দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী রইল। তারপর এটা ধীরে ধীরে উবে গেল। হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিংবা মূর্ছা গিয়েছি। তারপর বমি বমি ভাব হলো প্রথম সমুদ্র ভ্রমণে গেলে যেরকম হয়। নিজেকে অচেনা কিছু থেকে মুক্ত করে নিতে প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগল মনে। যদিও সেটা কী জানি না। স্থির, বিশাল এক নীরবতা আমার ওপর চেপে বসেছে, যেন গোটা পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে অথবা মারা গেছে—শুধু চাপা স্বরের হাঁপিয়ে ওঠার মতো একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি খুব কাছ থেকে। কোনো জন্তু হাঁপাচ্ছে। গলায় উষ্ণ স্পর্শ পেলাম এবং একটি ভয়ংকর সত্য উপলব্ধি করতে পেরে আমার হৃৎপিণ্ডে বইল বরফ জল এবং ঝাঁ ঝাঁ করে রক্তপ্রবাহ ছুটল মস্তিষ্কে। প্রকাণ্ড একটা জন্তু আমার বুকের ওপর শুয়ে আছে এবং জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে আমার গলা। ভয়ের চোটে আমি নড়াচড়াও করতে পারছি না, আমার ভেতর থেকে কেউ সাবধান করে দিল নিশ্চল থাকতে। তবে জানোয়ারটা নিশ্চয় আমার ভেতরে কোনো পরিবর্তন টের পেয়েছে। কারণ ওটা মাথা তুলল। চোখের পাপড়ির ফাঁক দিয়ে দেখি জ্বলজ্বলে বিরাট দুই চক্ষু মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে প্রকাণ্ড এক নেকড়ে। তার হাঁ করা লাল মুখে ঝলকাচ্ছে তীক্ষ্ণধার সাদা সাদা দাঁত। নাকে ওটার গরম এবং বিশ্রী নিঃশ্বাস ঝাপটা দিল।

আবারও কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন সবকিছু বিস্মৃত হয়ে গেলাম। তারপর চাপা একটা গর্জনের সঙ্গে কুকুরের তীক্ষ্ণ চিৎকার আমার চেতনা ফিরিয়ে আনল। এমন সময় অনেক দূর থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে যেন শুনতে পেলাম ‘হ্যালো! হ্যালো!’ ডাক। যেদিক থেকে শব্দটা আসছিল সেদিক পানে সাবধানে মাথা তুললাম। কিন্তু সমাধিস্তম্ভ আমার দৃষ্টিপথে বাধার সৃষ্টি করল। নেকড়েটা তখনো বিচিত্র ভঙ্গিতে চিৎকার করে চলেছে এবং লাল রঙের চোখ ধাঁধানো একটা আলো শব্দ অনুসরণ করে যেন সাইপ্রেসের বনে চক্কর দিতে লাগল।

কণ্ঠগুলো কাছিয়ে আসতে নেকড়ের ডাক দ্রুততর এবং উচ্চতর হয়ে উঠল। আমি নড়াচড়া করতে বা কোনোরকম আওয়াজ দিতে সাহস করলাম না। অত্যুজ্জ্বল লাল আলোটা চলে এল কাছে, শ্বেত শবাধারের ওপরে, যেটি আমাকে ঘিরে থাকা অন্ধকারে ছড়িয়ে রয়েছে।

অকস্মাৎ গাছগাছালির পেছন থেকে মশাল হাতে উদয় হলো অশ্বারোহীর একটি দল। আমার বুকের ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে গেল নেকড়ে। ছুট দিল গোরস্থানে। জনৈক ঘোড়সওয়ার (এরা যে সৈনিক তা তাদের মাথার টুপি এবং পরনের লম্বা সামরিক আলখাল্লা দেখেই চিনেছি) তার আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিয়ে লক্ষ্য স্থির করল। তার সঙ্গী তার হাতে ধাক্কা মারল। বাতাসে শিস কেটে আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল গুলি 1 অশ্বারোহী সৈনিক দূর থেকে আমাকে দেখে নেকড়ে ভেবে ভুল করেছিল। তবে জানোয়ারটাকে পালিয়ে যেতে দেখে আরেকজন গুলি চালাল। দলটি ঘোড়া নিয়ে ছুটে এল আমার দিকে। বরফাচ্ছাদিত সাইপ্রেসের বনভূমিতে অদৃশ্য হওয়া নেকড়ের পিছু নিল কয়েকজন

লোকগুলো কাছে আসতে আমি নড়াচড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিবীর্য আমি, যদিও কী ঘটছে তার সবই দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছি। দুই-তিনজন সৈনিক ঘোড়া থেকে লাফ মেরে নেমে আমার পাশে বসল হাঁটু মুড়ে। এদের একজন আমার মাথাটি তুলে ধরে বুকে রাখল হাত। ‘সুসংবাদ, বন্ধুগণ!’ চেঁচাল সে। ‘এর হার্টবিট এখনো চলছে!’

আমার মুখে খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে দেয়া হলো, এতে কিছুটা শক্তি ফিরে পেলাম আমি এবং পুরোপুরি চোখ মেলে তাকাতে পারলাম। চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখি গাছের ফাঁকে নড়াচড়া করছে আলো-ছায়া, কানে ভেসে এল মানুষজনের হৈ হল্লা। একজন আরেকজনকে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ডাকছে। ওরা একত্রিত হলো, ভয়ার্ত শব্দ করছে কেউ কেউ; ভূতগ্রস্তের মতো কয়েকজন লোক কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এল মশাল হাতে। দূরের মানুষজন আমাদের কাছে আসতে এরা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল :

‘ওকে পেলে?’

সমস্বরে জবাব এল :

‘না! না! জলদি চলো-জলদি! এখানে রাত কাবার করা যাবে না। সেরকম জায়গা নয় এটা!’

‘ওটা কী ছিল?’ ছুড়ে দেয়া হলো প্রশ্ন। জবাবে নানাজন ছাড়া ছাড়া কথা বলল। তবে তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল এরা কিসের ভয়ে যেন কথা বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে।

‘ওটা-সেটাই!’ অস্পষ্ট গলায় বলল একজন।

‘একটা নেকড়ে-আবার ঠিক নেকড়েও নয়,’ আরেকজন কম্পিত গলায় যোগ করল।

‘পবিত্র বুলেট ছাড়া ওকে খতম করা সম্ভব নয়,’ স্বাভাবিক সুরে মন্তব্য তৃতীয়জনের।

‘ভাঙা মার্বেল পাথরে রক্তের দাগ আছে,’ একটু বিরতি দিয়ে বলল আরেকজন-’বজ্রপাতের কারণে অমনটি হয়নি। আর এই লোক—উনি কি ঠিক আছেন? ওঁর গলা দেখো, বন্ধুরা। নেকড়েটা ওঁর ওপর শুয়ে থেকে ওঁর শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছিল।’

অফিসার আমার গলার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল :

‘উনি ঠিক আছেন, চামড়া ছিদ্র হয়নি। এসবের অর্থ কী? নেকড়েটার চিৎকার না শুনলে আমরা তো ওনাকে খুঁজেই পেতাম না।’

‘নেকড়েটার কী হলো?’ আমার মাথা ধরে থাকা লোকটা জিজ্ঞেস করল। গোটা দলের মধ্যে একেই মনে হলো একমাত্র ধীর-স্থির যে অন্যদের মতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েনি। কারণ আমাকে ধরে রাখা তার হাতজোড়া স্থির ও নিষ্কম্প। লোকটির জামার হাতায় অফিসারের পদমর্যাদাসূচক ফিতা লাগানো।

‘ওটা বাড়ি ফিরে গেছে,’ জবাব দিল ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া লোকটা। সে চারপাশে ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আর কাঁপছে। ‘এখানে কবরের অভাব নেই। যেকোনো একটার ভেতরে ওটা লুকিয়ে থাকতে পারে। এসো, বন্ধুরা-জলদি চলো! এই অভিশপ্ত জায়গাটা থেকে যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।’

অফিসার আমাকে তুলে বসিয়ে দিল। সে একটা নির্দেশ দিতেই তার লোকজন এসে আমাকে ধরাধরি করে একটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিল। অফিসার আমার পেছনে উঠে বসল। আমার হাত চেপে ধরে দলটিকে আগ বাড়ার হুকুম করল। সাইপ্রেসের জঙ্গল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমরা সামরিক কায়দায় সুবিন্যস্তভাবে দ্রুত চলতে লাগলাম।

আমার জিভে কোনো সাড়া নেই বলে কথাও বলতে পারছি না। চলতে চলতে বোধকরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জেগে দেখি দাঁড়িয়ে আছি, আমার দুই পাশে দুই সৈন্য আমাকে খাড়া করে রেখেছে। প্রায় ভোর হয়ে গেছে, উত্তরে সূর্যের লাল আলোক রেখা বরফের ওপর পড়ে রক্তাক্ত পথের মতো দেখাচ্ছে। অফিসার তার লোকদের বারণ করল তারা যা দেখেছে তা নিয়ে যেন মুখ না খোলে, শুধু বলতে পারে তারা এক ইংরেজ আগন্তুককে দেখেছে। তাকে একটা প্রকাণ্ড কুকুর পাহারা দিচ্ছিল।

‘কুকুর! ওটা কোনো কুকুর ছিল না!’ আপত্তি জানাল ভয়ে আধমরা সেই লোকটা। ‘আমি একটা নেকড়ে দেখেছি!’

তরুণ অফিসার শান্ত গলায় বলল: ‘আমি বলেছি কুকুর দেখেছি।’

‘কুকুর!’ অপরজন ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল। দিনের আলোয় তার ভয় কেটে যাচ্ছিল। আমাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, ‘ওনার গলা দেখুন। ওটা কি কুকুরের কাজ, প্রভু?’

সহজাত প্রবৃত্তিতে আমার হাত চলে গেল গলায়। কাটা চামড়ায় হাত লাগতে ব্যথায় চিৎকার দিলাম। দেখার জন্য লোকগুলো ঘিরে ধরল আমাকে, কেউ কেউ তাদের জিন থেকে ঝুঁকে পড়ল, আবার ভেসে এল তরুণ অফিসারের শান্ত কণ্ঠ :

‘কুকুর, বললামই তো। অন্য কিছু বললে হাসবে লোকে।’

আমাকে তারপর এক অশ্বারোহী সৈনিকের পেছনে বসিয়ে দেয়া হলো। আমরা মিউনিখের শহরতলিতে চলে এলাম। এখানে একটি জুড়িগাড়ি পেলাম। তাতে তুলে দেয়া হলো আমাকে। গাড়ি চলল কোয়ার্তর সেইজোঁ অভিমুখে—সঙ্গী সেই তরুণ সৈনিক কর্মকর্তা। এক অশ্বারোহী সৈন্য আমাদের পেছন পেছন এল। বাকিরা ফিরে গেল নিজেদের ব্যারাকে।

গন্তব্যে পৌঁছেছি, হের ডেলব্রুক এত দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল, বুঝতে পারলাম সে ঘরের ভেতরে বসে আমাদের লক্ষ করছিল। উৎকণ্ঠার সঙ্গে আমার হাত দুটো ধরে সে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। অফিসার আমাকে সেলুট ঠুকে ঘুরে দাঁড়াল। চলে যাবে। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অনুরোধ করলাম সেও যেন আমাদের সঙ্গে আসে। এক গ্লাস মদ পান করার পরে তাকে এবং তার বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য। সহজ গলায় জবাব দিল কাজটা করতে পেরে সে নিজেও অনেক খুশি। তবে হের ডেলব্রুকই নাকি সাৰ্চ পার্টি পাঠিয়েছিল। প্রত্যুত্তরে মেইতর ডি হোটেল হেসে বিড়বিড় করে কী যেন বলল ঠিক বোঝা গেল না। অফিসার একটু পরে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

‘কিন্তু হের ডেলব্রুক,’ জানতে চাইলাম আমি, ‘ওই সৈন্যদের কীভাবে এবং কেন আমার খোঁজে পাঠানো হলো?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে জবাব দিল :

‘আমার ভাগ্য ভালো যে রেজিমেন্টে আমি কাজ করতাম সেখানকার কমান্ডারের কাছ থেকে ছুটি পেয়েছিলাম। তাঁর কাছেই আমি কিছু ভলান্টিয়ার চাই।’

কিন্তু আপনি কী করে বুঝলেন যে আমি হারিয়ে গেছি?’

‘কোচোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারি ব্যাপারটা। তার ঘোড়াগুলো পালিয়ে গেলে সে ভাঙা গাড়িটি নিয়ে হাজির হয়েছিল।’

‘কিন্তু শুধু এ কারণে তো আপনি সৈন্যদের সার্চ পার্টি পাঠাননি?’

‘না! না!’ জবাব দিল সে। ‘কোচোয়ান আসার আগেই আমি বোয়ার থেকে একখানা টেলিগ্রাম পেয়েছিলাম যেখানে অতিথি হিসেবে আপনি ছিলেন।’ সে পকেট থেকে একটি টেলিগ্রাম বের করে আমাকে পড়তে দিল। ওতে লেখা :

বিসট্রিজ,

আমার অতিথির বিষয়ে সাবধান—তার নিরাপত্তা আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। যদি তাঁর কিছু হয় কিংবা তিনি হারিয়ে যান, যেভাবেই হোক তাঁকে খুঁজে বের করবে এবং তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তিনি জাতিতে ইংরেজ, তার ওপর আবার অভিযানপ্রিয়। বরফ, নেকড়ে এবং রাত নানান বিপদ বয়ে আনতে পারে। তাঁর কোনোরকম ক্ষতি হতে পারে এরকম কিছু সন্দেহ হওয়ামাত্র তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। তোমার এ পরিশ্রমের জবাব পাবে আমার সম্পদ দ্বারা।

ড্রাকুলা

টেলিগ্রামটি হাতে ধরে আছি, গোটা বাড়ি যেন চক্কর দিতে লাগল বনবন করে। মেইতর ডি হোটেল আমাকে ধরে না ফেললে নির্ঘাত পড়ে যেতাম। পুরো বিষয়টির মধ্যে এমন অদ্ভুত, উদ্ভট এবং কল্পনাতীত ব্যাপার রয়েছে, যা আমার ভেতরে একটি অনুভূতি এনে দেয় যেন বিপরীত শক্তির ঘূর্ণাবর্তে আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল-একটা আবছা ভাবনা যা আমাকে একরকম চলনশক্তিহীন করে দিয়েছে। নিশ্চয় কোনো রহস্যময় প্রটেকশনের অধীনে আমি ছিলাম। এক দূর দেশ থেকে যথাসময়ে এসেছিল এক বার্তা যা আমাকে বরফ-ঘুম এবং নেকড়ের কামড়ের কবল থেকে রক্ষা করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *