আ ড্রিম অব রেড হ্যান্ডস

আ ড্রিম অব রেড হ্যান্ডস

জ্যাকব সেটলকে দেখে প্রথমেই যে শব্দটি আমার মনে এল তা হলো ‘গোমড়ামুখো’। তবে তার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তাকে আমি কখনো কারো প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে দেখিনি যদিও নারী এবং শিশুরা ওকে বিশ্বাস করত। অথচ এদেরকে একরকম এড়িয়েই চলত জ্যাকব শুধু অসুস্থজন ছাড়া। সে অসুস্থ লোককে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যেত চুপিচুপি। সে একাকী জীবনযাপন করত, ছোট একটি কটেজে থাকত যাকে কুঁড়েঘর বললেই মানায় ভালো। পতিত জমির ধারে, মাত্র এক কামরার ঘর। এমন বিষণ্ণ এবং একা জ্যাকব যে ওকে আমার আনন্দ ফুর্তিতে রাখতে ইচ্ছা করত। এ জন্য যখন অ্যাকসিডেন্টে আহত হওয়া কোনো শিশুর সেবাযত্ন করত জ্যাকব, ওকে আমি বই ধার দিতাম পড়ার জন্য। সে খুশিমনেই বইগুলো নিত। এবং পড়া শেষে সময়মতো ফেরতও দিত। এভাবে আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। রোববারে মুরল্যান্ডের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে ওর ঘরে উঁকি দিই। কিন্তু ও আমাকে দেখে এমন লজ্জায় পড়ে যায় এবং সংকুচিত হয়ে ওঠে যে আমার নিজেরই সংশয় জাগে ওকে ডাকব কিনা। ও কখনো কোনো কারণে আজতক আমার নিবাসে পা রাখেনি।

রোববারের এক বিকেলে আমি মুরল্যান্ড ধরে হেঁটে আসছি, জ্যাকবের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দরজায় থামলাম ওকে ‘হ্যালো’ বলতে। কিন্তু দরজা বন্ধ দেখে ভাবলাম ও বাইরে। যদিও অনেক সময় ঘরে থাকলেও সাড়া দেয় না জ্যাকব। তবে অবাক হয়ে গেলাম শুনে ভেতরে মৃদু গোঙানির আওয়াজ। যদিও কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। আমি তক্ষুনি ঘরে ঢুকলাম। দেখি আধাআধি পোশাক পরা জ্যাকব চিৎ হয়ে আছে বিছানায়। চেহারা মরার মতো সাদা, ঘাম গড়াচ্ছে মুখ বেয়ে। জলে ডুবে মরতে বসা মানুষ যেমন মরিয়া হয়ে খড়কুটো যা পায় চেপে ধরতে চায়, জ্যাকবও তেমনি অচেতনভাবে বিছানার চাদর খামচে ধরে রেখেছে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে উঠে বসার চেষ্টা করল। বুনো, তাড়া খাওয়া শিকারের চাউনি বিস্ফারিত চোখে, যেন ভীতিকর কিছু দেখেছে সামনে। তবে আমাকে চিনতে পেরে আবার শুয়ে পড়ল খাটিয়ায়। স্বস্তির ফোঁপানি বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। বুজল চোখ। আমি খানিকক্ষণ ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও বেদম হাঁপাচ্ছে। তারপর চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু এমন মরিয়া এবং যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টি আমি আগে কখনো দেখিনি। চাউনিতে পরিষ্কার ভয়। আমি ওর পাশে বসে শরীর স্বাস্থ্যের খবর নিলাম। কিছুক্ষণ ও জবাব দিতে পারল না। শুধু বলল সে অসুস্থ নয়। তবে আমাকে তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করে নিয়ে কনুইতে ভর চাপিয়ে উঁচু হলো এবং বলল :

স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। তবে আপনাকে সত্যি কথাই বলছি লোকে যেরকম অসুস্থতার কথা বলে আমি তা নই। যদিও ঈশ্বর জানেন এর চেয়ে বাজে রোগ আর হতে পারে না। ডাক্তাররাও হয়তো এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না। আপনাকে আমি সব কথা বলব কারণ আপনার মনে অনেক দয়া। তবে আমি বিশ্বাস করি আপনি আমার কথা কাউকে বলবেন না। তাহলে আমার দুর্দশা বাড়বে বৈ কমবে না। আমি একটা দুঃস্বপ্নের শিকার।

‘দুঃস্বপ্ন!’ বললাম আমি। ওকে চাঙা করে তুলতে চাইলাম। কিন্তু দিনের বেলা স্বপ্নটপ্ন থাকে না-ঘুম থেকে জেগে উঠলেই সব পালিয়ে যায়।’ কিন্তু আমাকে থেমে যেতে হলো ওর বাধা পেয়ে। জবাব দেয়ার আগে চারপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টি বুলাল সে।

‘না! না! লোকে যেসব স্বপ্ন দেখে তা নয়। যারা একা থাকে এবং দুঃস্বপ্ন দেখে এটি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়ানক। এখানে যখন মাঝরাত্তিরে জেগে যাই রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে, এই মুরল্যান্ডেন্ড—হাজারো শব্দ এবং মুখ দেখতে পাই, এর চেয়ে খারাপ স্বপ্ন আর কী হতে পারে? আপনাকে যেন কখনো এরকম নির্জন পরিবেশে থাকতে না হয় সে প্রার্থনাই করি।

একটু বিরতি দিয়ে আবার শুরু করল জ্যাকব : ‘গত দুই রাত ধরে স্বপ্নটা দেখছি আমি। প্রথম রাতের স্বপ্নটাই সহ্য করা কঠিন ছিল, তবু নিজেকে সামলে নিই আমি। গত রাতে আবারও স্বপ্নটা দেখি আমি। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি ওই স্বপ্নের কথা। ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত জেগে ছিলাম। তারপর ওটা আবার আসে আমার স্বপ্নে। আমার এমন যন্ত্রণা হতে থাকে যে মনে হচ্ছিল মরেই যাব।’

জ্যাকব বাক্য সমাপ্ত করার আগেই আমি বলে উঠলাম, আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাবার চেষ্টা কোরো-সন্ধ্যা হওয়ার আগেই। ঠিকমতো ঘুমালে চাঙা লাগবে শরীর। আশা করি আজ রাতের পরে আর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখবে না তুমি।’ সে অসহায়ভাবে মাথা নাড়ল। আমি ওর শিয়রে আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর চলে এলাম।

বাড়ি ফিরে আমি রাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ রাতে জ্যাকব সেটলের কুটিরে ওকে পাহারা দেব। ও যদি সূর্যাস্তের আগেই ঘুমিয়ে যায়, মাঝরাতের আগে ঘুম ভাঙবে ওর। তাই রাত এগারোটা নাগাদ হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে জ্যাকবের কুটিরের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে গেলাম। ব্যাগে আমার রাতের খাবার আছে, সঙ্গে কফিভর্তি বড়সড় একটি ফ্লাস্ক, খানকয়েক মোমবাতি এবং একটি বই নিয়েছি।

ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ, আলোকিত করে রেখেছে গোটা মুরল্যান্ড, যেন দিনের মতো ফকফকা। তবে মাঝে মাঝেই কালো মেঘের দল উড়ে আসছে আকাশে, চাঁদ ঢেকে দিয়ে আঁধার করে ফেলছে প্রকৃতি। যদিও গাঢ় নয় সে অন্ধকার। চোখে ঠাহর করা চলে।

আস্তে করে জ্যাকবের কুটিরের দরজা খুললাম। ওকে না জাগিয়েই ঢুকলাম ভেতরে। সাদা, ফ্যাকাশে মুখটা উঁচিয়ে রেখে গভীর নিদ্রায় সুপ্ত সে। শরীরটা স্থির। ঘামে ভিজে জবজবে গা। আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম ওই নিদ্রিত চোখের পাতার আড়ালে কী দৃশ্য চলছে, যা ওকে এমন দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে এবং তার ছাপও চেহারায় সুস্পষ্ট। কিন্তু সেরকম কোনো কল্পনা মস্তিষ্কে খেলল না। ওর কখন ঘুম ভাঙবে সেই অপেক্ষায় রইলাম।

হঠাৎ জ্যাকবের ফ্যাকাশে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল। সে শোয়া অবস্থায় অর্ধেকটা উঠে বসল এবং পরমুহূর্তে আবার শুয়ে পড়ল।

‘ও যদি স্বপ্নের ঘোরে এটা করে থাকে’, ‘আপন মনে বললাম আমি, ‘নিশ্চয় ভয়ানক কোনো স্বপ্ন দেখছে। ও গুঙিয়ে উঠে কী বলতে চেয়েছে?’

ঘুম ভেঙে গেল জ্যাকবের। চোখ মেলে তাকিয়েই আমাকে দেখতে পেয়ে আনন্দসূচক একটি চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ঘামে ভেজা হাতে আমার হাত চেপে ধরল। ওর হাতজোড়া কাঁপছে, যেন ভীত কোনো শিশু তার প্রিয়জনের হাত আঁকড়ে ধরেছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম :

‘সুস্থির হও! সুস্থির হও! সব ঠিক আছে। আমি আজ রাতে তোমার সঙ্গে থাকব। দুজনে মিলে শয়তান স্বপ্নটার বিরুদ্ধে লড়াই করব।’ ও আমার হাত ছেড়ে দিল। বিছানায় এলিয়ে পড়ে নিজের হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরল।

‘লড়াই করব?’-ওই দুঃস্বপ্নের বিরুদ্ধে! আহ, না, স্যার, না! কোনো মানুষের পক্ষে ওই স্বপ্নের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়, কারণ ওটা আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে-এবং এখানে এসে পুড়ে যায়।’ সে কপালে বাড়ি মারল। তারপর বলে চলল :

‘সেই একই স্বপ্ন বারবার দেখি আমি। প্রতিবার এর শক্তি বেড়ে চলছে এবং যখনই স্বপ্নটা আসে আমাকে অত্যাচার করে।’

‘স্বপ্নটা কিসের?’ জানতে চাই আমি। ভাবি কথা চালিয়ে গেলে ও হয়তো খানিকটা স্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু আমার কাছ থেকে সরে গেল জ্যাকব। দীর্ঘ বিরতি শেষে বলল :

‘না, আমি স্বপ্নের কথা বলতে পারব না। না বলাই ভালো হবে। তাহলে ওটা হয়তো আর আসবে না।’

পরিষ্কার হয়ে গেল ও আমার কাছে কিছু লুকাতে চাইছে-স্বপ্নের বাইরে কিছু। আমি বললাম :

‘ঠিক আছে। আশা করি স্বপ্নটা তোমাকে আর দেখতে হবে না। শেষবার ওটা দেখে নিয়েছ তুমি। কিন্তু ওটা যদি আবার আসে তাহলে তুমি স্বপ্নটার কথা আমাকে নিশ্চয় বলবে, বলবে না? আমি স্রেফ কৌতূহলের কারণে ব্যাপারটা জানতে চাইছি না। আমার ধারণা সব কথা খুলে বললে তোমার বুকটা হালকা হবে, একটু স্বস্তি পাবে।

গম্ভীর গলায় জ্যাকব বলল, ‘ওটা যদি আবার আসে বলব আমি আপনাকে।’

আমি ব্যাপারটা ওর মন থেকে দূর করে দিতে এটাসেটা নিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। ব্যাগ খুলে বের করলাম রাতের খাবার। ওকে খেতে দিলাম। কফিও খাওয়ালাম। ও খানিকটা সুস্থির হয়ে ওঠার পরে নিজে একটি সিগার ধরিয়ে, আরেকটি ওকে দিয়ে দুজনে মিলে টানা এক ঘণ্টা ধূমপান করলাম এবং নানা বিষয় নিয়ে কথা বললাম। আস্তে আস্তে ওর আড়ষ্ট দেহ শিথিল হয়ে এল, মনটাকে দখল করল শারীরিক আয়েশ। লক্ষ করলাম ঘুমে ভারী হয়ে আসছে ওর চোখের পাতা। জ্যাকবও বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বলল এখন সে সুস্থির বোধ করছে। কাজেই আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি যেতে রাজি হলাম না। বললাম বাকি রাতটুকু ওর সঙ্গেই থাকছি। আরেকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম আমি। ও ঘুমিয়ে পড়লে বই পড়তে লাগলাম।

বইটিতে মজা পেয়ে ক্রমে এর মধ্যে ডুবে যেতে থাকলাম আমি। এমন বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম পড়ায়, বইটি হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গেলে রীতিমতো চমকে যাই। তাকিয়ে দেখি গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে জ্যাকব। খুশি লাগল দেখে ওর চেহারায় অনির্বচনীয় আনন্দ ফুটে আছে। তবে ঠোঁট জোড়া নড়ছে। বিড়বিড়িয়ে কী যেন বলছে। আমি আবার ফিরে গেলাম নিজের কাজে। তবে খানিক বাদে সচেতন হয়ে উঠলাম জ্যাকবের গলার স্বর শুনে। শিরদাঁড়া দিয়ে বরফজল নামাল ওর কণ্ঠ :

‘ওই লাল হাত দিয়ে নয়! কক্ষনো নয়! কক্ষনো নয়!’ তাকিয়ে দেখি এখনো অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। তবে হঠাৎ জেগে গেল জ্যাকব এবং আমাকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো না মোটেই। আমি বললাম, ‘সেটল, এবারে তোমার স্বপ্নের কথা বলো। নিশ্চিন্তে সব কথা বলতে পারো তুমি। কারণ তোমার এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’

জবাবে জ্যাকব বলল, ‘আমি বলেছিলাম আপনাকে সব বলব। তবে স্বপ্নের কথা বলার আগে আরও কিছু বৃত্তান্ত আপনাকে দেয়া দরকার। তাহলে আপনি ভালোভাবে ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন। তরুণ বয়সে আমি ছিলাম স্কুলমাস্টার। পশ্চিমা দেশের ছোট একটি গাঁয়ের গির্জার স্কুল। তার নাম না বললেও ক্ষতি নেই। আমার ভালোবাসার পাত্রী, এক তরুণীর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এটি অবশ্য গতানুগতিক সেই সেকেলে কাহিনী। আমরা অপেক্ষা করছিলাম কবে সেই সময় আসবে যখন দুজনে মিলে বাঁধব ঘর। ওই সময় এক লোকের আবির্ভাব ঘটে আমাদের জীবনে। আমার মতোই তরুণ সে এবং সুদর্শন। আর একজন ভদ্রলোক। আমাদের শ্রেণীর মধ্যে তরুণীদের আকৃষ্ট করার জন্য একজন ভদ্রলোকের যা যা গুণাবলি প্রয়োজন সবই তার মধ্যে ছিল। সে যখন মাছ ধরতে যেত ওই সময় আমার প্রেমিকা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করত। আমি তখন স্কুলে ছাত্র পড়ানোয় ব্যস্ত। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে ওই লোকের প্রসঙ্গ নিয়ে তর্ক করি, ওকে অনুনয় করি লোকটিকে যেন সে ত্যাগ করে। আমি ওকে তক্ষুনি বিয়ে করার প্রস্তাব দিই এবং বলি দুজনে মিলে পালিয়ে গিয়ে অচেনা কোনো দেশে গিয়ে গড়ে তুলব সংসার। কিন্তু আমার কোনো কথাই সে শোনেনি। ওই তরুণের জন্য তার চোখে-মুখে মুগ্ধতা দেখতে পাই আমি। তখন আমি নিজেই ওই লোকের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং বলি মেয়েটির সঙ্গে সে যেন ভালো আচরণ করে। আমি ভেবেছিলাম লোকটি হয়তো ম্যাবেলের ব্যাপারে সৎ এবং এ নিয়ে তার সঙ্গে অন্য কোনো কথা বলে ফায়দা হবে না। আমি সেদিন একাই গিয়েছিলাম লোকটির সঙ্গে দেখা করতে।’ এখানে একটু বিরতি দিল জ্যাকব, তার গলায় যেন কিছু ডেলা পাকিয়ে গেছে, প্ৰায় হাঁপিয়ে ওঠার মতো শব্দ করল। তারপর বলতে লাগল :

‘স্যার, ঈশ্বর মাথার ওপর আছেন, সেদিন কোনো স্বার্থপর চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আমি আমার সুন্দরী ম্যাবেলকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম। ওকে আমি সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। তবে ওই লোকটির আচরণ ছিল অত্যন্ত উদ্ধত। তার কাছে আমি যখন জানতে চাই সে কবে ম্যাবেলকে বিয়ে করবে, সে এমন বিশ্রীভাবে হেসে ওঠে যে রীতিমতো অপমানবোধ করি আমি। আমার মেজাজ চড়ে যায় এবং তাকে বলি আমি স্রেফ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ম্যাবেলকে অসুখী দেখব না। এতে সে-ও রেগে যায় এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ম্যাবেল সম্পর্কে এমন সব কুৎসিত কথা বলে যে তক্ষুনি আমি বলে উঠি লোকটার এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো যোগ্যতাই নেই, কারণ সে ম্যাবেলের ক্ষতি করতে পারে। ঈশ্বর জানে আমার মাথায় কী গন্ডগোল হয়েছিল, আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। ওর ওপর কখন ঝাঁপিয়ে পড়েছি মনেও নেই। সংবি ফিরে পেতে দেখি আমি লোকটার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুহাত রক্তে রঞ্জিত। ওর দুই ফাঁক হওয়া গলা দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা খুন। আমরা ওখানে শুধু দুজনেই ছিলাম। আর লোকটার খোঁজখবর নেয়ার মতো কোনো আত্মীয়স্বজনও ছিল না। আমি নদীর ধারে তার লাশ ফেলে রেখে চলে আসি। তার অনুপস্থিতি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না- শুধু বেচারি ম্যাবেল ছাড়া। আর সে কোনো কথা বলতে সাহসও পাচ্ছিল না। তবে আমার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায় যখন কয়েক মাস পরে নিজ আস্তানায় ফিরে এসে জানতে পারি ম্যাবেল আত্মহত্যা করেছে। আমি এর আগ পর্যন্ত ভেবেছি হত্যাকান্ডটি ম্যাবেলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করেছে কিন্তু ফিরে এসে দেখি অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমার ভালোবাসা ওই লোকটার পাপের দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। তীব্র অপরাধবোধ আমাকে পেয়ে বসে এবং আমি ওখান থেকে পালিয়ে যাই। স্যার, আপনি তো এমন পাপ কখনো করেননি, তাই বুঝতে পারবেন না এর জ্বালা কী। ভাবতে পারেন সময়ের আবর্তনে সব সয়ে যায় কিন্তু আসলে তা হয় না। প্রতি ঘণ্টায় এ যন্ত্রণা বেড়ে চলে, শেষে অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং এর এমন বৃদ্ধি ঘটে যা কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। এ যন্ত্রণা যে কী আপনি বুঝবেন না এবং প্রার্থনা করি কখনো যেন এমন জ্বালা আপনাকে সইতে না হয়।

‘আমি স্বপ্নে দেখি আমি স্বর্গের ফটকে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারছি না। ফটকে ইস্পাতের তৈরি বড় বড় আর ইয়া মোটা গরাদ। মেঘ ঢেকে ফেলছে সেই ফটক। ফটকের ওপারে স্ফটিকের কৃত্রিম গুহা। সেখানকার চকচকে দেয়ালে সাদা পোশাক পরা অনেক মানুষের আনন্দে জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি। আমি যখন ওই ফটকে দাঁড়াই, আমার বুকের মধ্যে থাকে সম্পর্ক ছেদের বেদনা। ফটকে দাঁড়িয়ে থাকে পিঠে বিরাট ডানাঅলা বিশালদেহী দুই দেবদূত। তাদের এক হাতে জ্বলন্ত তরবারি, অপর হাতে রশি, সেটি সামান্যতম স্পর্শেই এদিক- ওদিক দুলছে। কাছে পিঠে যেসব লোকজন আছে তাদের পরনে কালো পোশাক, মাথায় ঘোমটা টানা, ফলে চোখ ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। দেবদূতদের মতো সাদা পোশাক পরা যারাই ফটকে আসছে তাদেরই বলা হচ্ছে নিজেদের রোব পরে নিতে। তবে তাতে যেন মাটি লেগে না থাকে। তাহলে দেবদূতরা ভেতরে ঢুকতে দেবে না এবং তরবারি দিয়ে আঘাত করবে। আমি আমার পোশাক পরে দ্রুত ফটকের দিকে এগোই। কিন্তু ফটক খোলা হলো না। দেবদূতরা হাতের রশি ঢিলে করে আমার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। কারণ গোটা আলখাল্লা রক্তে রঞ্জিত। আমার হাতও লাল হয়ে আছে রক্তে। টপটপ করে হাত থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, যেভাবে পড়েছিল নদীর তীরে। তখন এক দেবদূত হাতের জ্বলন্ত তরবারি তুলে আমাকে আঘাত করে এবং আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। বারবার এ স্বপ্নটাই দেখছি আমি। জানি না এ স্বপ্ন দেখার মানে কী। আমার মনে হয় এটা ঈশ্বরের তরফ থেকে আমার জন্য শাস্তি। আমি কোনোদিনই স্বর্গের ওই ফটক পার হতে পারব না, কারণ আমার রক্তাক্ত হাতে দেবদূতদের পোশাকে নোংরা লেগে যায়!

জ্যাকব সেটলের গল্প আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। ওর গলার স্বর যেন দূর থেকে ভেসে আসছিল—চাউনি কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন এবং রহস্যময় যেন আমাকে ভেদ করে যাচ্ছে-এমন একটা ব্যাপার ওর মধ্যে আছে যা ঠিক শ্রমিকের ছেঁড়া, নোংরা পোশাক পরা এ মানুষটাকে মানায় না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি।

আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলাম। আমি বরাবরই আমার সামনের লোকটিকে বিস্মিত চোখে দেখছিলাম। তার স্বীকারোক্তি সমাপ্ত, তার আত্মা যা প্রায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, যেন স্থিতিস্থাপক শক্তির সাহায্যে আবার ঋজু হয়ে ফিরে এসেছে। ভেবেছিলাম ওর গল্প শুনে ভয় পাব। পাইনি। ওর জন্য আমার বরং মায়া লাগছিল। ওকে আমার সান্ত্বনা দিতে মন চাইছিল। তাই বললাম, ‘হতাশ হয়ো না, জ্যাকব সেটল। ঈশ্বর মহান এবং তাঁর দয়ার সীমা নেই। কাজ করে যাও। একদিন দেখবে আপনাআপনি অতীতের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে।’

থেমে গেলাম আমি, কারণ দেখতে পাচ্ছি এবারে প্রাকৃতিক ঘুম নেমে আসছে ওর চোখে।

‘ঘুমিয়ে পড়ো,’ বললাম আমি। ‘আমি এখানে বসে তোমাকে পাহারা দেব। আজ রাতে আর দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে না।’

শরীরটা বিছানা থেকে টেনে তুলল জ্যাকব। ‘আজ রাতের বদান্যতার জন্য আপনাকে কীভাবে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। তবে আপনি এখন স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারেন। আমি এ ব্যাপারটি মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করব। আপনাকে সব কথা খুলে বলার পরে মনে হচ্ছে কাঁধ থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেল। ওই লোকটার কোনো স্মৃতি আমার ভেতরে থাকলেও তা একাই ফাইট করার চেষ্টা করব।’

‘তুমি যখন বলছ আমি তাহলে চলেই যাই,’ বললাম আমি। তবে আমার কথা শোনো। একাকী এরকম নির্জন জায়গায় আর বাস কোরো না। লোকজনের কাছে যাও। তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করো। ওদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হও। তাতে এ ব্যাপারটা তোমাকে ভুলতে সাহায্য করবে। এমন নির্জনতা তোমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।’

‘আচ্ছা তাই করব আমি।’ বলল জ্যাকব আধা ঘুম আধা সচেতনতার মাঝে। তাকে গ্রাস করতে লেগেছে নিদ্রা

আমি চলে যেতে ঘুরে দাঁড়ালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। দরজার ছিটকিনিতে হাত লাগিয়েও ফিরে এলাম ওর বিছানার কাছে। বাড়িয়ে দিলাম হাত। সে দুই হাতে আমার হাত আঁকড়ে ধরে ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়। আমি ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে মন ভালো করতে বললাম :

‘জাগো, ভাই, জাগো! পৃথিবীতে করার মতো অনেক কাজ পড়ে আছে, জ্যাকব সেটল। তুমি ওই সাদা রোব পরে ইস্পাতের ফটক এখনো পার হতে পারবে।’

তারপর আমি চলে এলাম।

হপ্তাখানেক পরে দেখি ওর কুটিরে কেউ নেই। ওর কর্মস্থলে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম সে ‘উত্তরে চলে গেছে’। তবে ঠিক কোন জায়গায় জানে না কেউ।

বছর দুই বাদে গ্লাসগোতে আমার ডাক্তার বন্ধু মুনরোর বাড়ি গেলাম বেড়াতে। সে খুব ব্যস্ত মানুষ। আমাকে তেমন সময় দিতে পারছিল না। তাই আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ট্রসকাস, লক কাট্রিন এবং ক্লাইড এলাকায়। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় আমি একটু দেরি করেই বন্ধুর বাসায় ফিরলাম। দেখি সে তখনো বাড়ি ফেরেনি। পরিচারিকা জানাল বন্ধুটি হাসপাতালে গেছে-গ্যাসজনিত একটি দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করতে। ডিনার প্রস্তুতে আরও ঘণ্টাখানেক বিলম্ব হবে জেনে পরিচারিকাকে বললাম তার মনিবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। তাকে নিয়েই ফিরব। আমি হাসপাতালে পৌঁছে দেখি মুনরো হাত-মুখ ধুচ্ছে। বাড়ি ফিরবার জন্য প্রস্তুত। ঘটনা কী জানতে চাইলে সে বলল :

‘নতুন কোনো ঘটনা নয়। এরকম আকছার ঘটছে। দুজন লোক গ্যাসোমিটারে কাজ করছিল এমন সময় যে রশিটা দিয়ে ওদের ভারা বাঁধা ছিল সেটা ছিঁড়ে যায়। রশিটা ছিল পচা। ভারার ওজন আর সইতে পারেনি। তখন ডিনারের সময়। কেউ ওই দুজনের অনুপস্থিতি লক্ষ করেনি। ফিরে এসে তারা ব্যাপারটা জানতে পারে। গ্যাসোমিটারে সাতফুট পানি ছিল। বেচারাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এদের একজন শুধু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে তাকে পানি থেকে তুলতে আমাদের জান বেরিয়ে গেছে। তার সহকর্মীর দয়ায় সে প্রাণে রক্ষা পায়। শুনেছি ওরা দুজন পানির মধ্যে সাঁতার কাটছিল। সাঁতার কাটতে কাটতে দুজনেরই শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। লোকজন রশি নিয়ে এসেছিল ওদেরকে তুলবার জন্য। কিন্তু তুলতে পারেনি। তখন ওই দুজনের একজন পানির নিচে মাথা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার সঙ্গীকে কাঁধে তুলে নেয়। সঙ্গীটি তখন ওপরে উঠতে পারলেও পানির নিচে থাকা লোকটি দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। দুজনকেই যখন ওপরে তোলা হয় সে বড়ই হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছিল, কারণ গ্যাস এবং আলকাতরায় মাখামাখি হয়ে পানি ঘন বেগুনি রং ধারণ করেছিল। প্রথমে যে লোকটিকে তোলা হয় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে রক্তস্নান করে এসেছে। এহ্!’

‘আর দ্বিতীয় জন?’

‘তার দশা ছিল আরও শোচনীয়। তবে মানুষটার কলিজা অনেক বড় স্বীকার করতেই হয়। পানির নিচে তার ধস্তাধস্তি নিশ্চয় ভীতিকর একটি ব্যাপার ছিল। লোকটির দিকে তাকানো যায় না এমনই ভয়ানক তার অবস্থা। তবে তুমি লেখক মানুষ। তুমি ইচ্ছে করলে দেখতে পারো।’ কথা বলতে বলতে মুনরো আমাকে হাসপাতালের মরচুয়ারিতে নিয়ে এল।

লাশ রাখার কাঠের পাটাতনের ওপর আমি একটি মৃতদেহ দেখতে পেলাম সাদা কাপড়ে মোড়ানো। মুনরো লাশের মুখের কাপড়টি সরিয়ে ফেলল। সত্যি ভয়ানক দৃশ্য! যেন রক্ত মেখে গোসল করেছে। তবে আমি দেখেই চিনতে পারলাম মৃত মানুষটিকে। এ সেই জ্যাকব সেটল। আমার বন্ধু কাপড়টি আরও নিচে নামিয়ে আনল।

বেগুনিরঙা বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা হাত। সঙ্গে সঙ্গে সেই দুঃস্বপ্নটির কথা মনে পড়ে গেল। এই বেচারি, সাহসী মানুষটির হাতে এখন কোনো দাগ নেই, বরফের মতো ধবধবে সাদা হাত।

ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো সেই দুঃস্বপ্নের অবশেষে অবসান ঘটেছে। জ্যাকবের মহান হৃদয় অবশেষে ফটকে পৌছাবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। সাদা আলখেল্লায় আর কোনো ময়লা দাগ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *