মহাভারত – বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ১৯৯২ (বৈশাখ ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ)
.
মা ঁসুহাসিনী দেবী
এবং
বাবা ঁঅশ্বিনীকান্ত চক্রবর্তীর
পবিত্র স্মৃতিতে
॥ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণঃ শরণম্ ॥
॥ কেন এই বই ? ॥
যাঁদের হাতে সময় কম, যাঁরা চান খুব অল্প সময়ে মহাভারত সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা গড়ে তুলতে, আর মহাভারতের কৌতূহল উদ্দীপক বিভিন্ন তথ্যকে একনজরে দেখে নিতে—তাঁদের কথা মাথায় রেখেই এই বই।
আমি জ্ঞানীও নই, পণ্ডিতও নই। পাত্রে পাত্রে রাঁধা ছিল অমৃত-ব্যঞ্জন। তারই কিছু কিছু তুলে এনে পাঠকের পাতে দিলাম। পাঠকের রসনা তৃপ্ত হলে এই পরিবেশনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে মনে করব।
বরেণ্য, কবি-সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় শ্রীসুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার শিল্পনির্দেশক শ্রীঅমিয় ভট্টাচার্য, মুখ্য সহযোগী সম্পাদক শ্রীসমরজিৎ মিত্র, আনন্দমেলার সহযোগী সম্পাদক শ্রীশ্যামলকান্তি দাশ, শ্রীকাজল চক্রবর্তী প্রমুখ অনেক শুভানুধ্যায়ী এ বই প্রকাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। এঁদের সবার কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ এবং ঋণবদ্ধ। শ্রীরামকৃষ্ণ এদের সকলের মঙ্গল করুন।
বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী
উত্তরপাড়া,
১লা বৈশাখ, ১৩৯৯।
.
ভূমিকা
প্রবাদ অনুসারে বেদব্যাস এখনো জীবিত। ত্রিকালজয়ী শরীর নিয়ে তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীন লেখক সেই বেদব্যাস নিশ্চয়ই তাঁর রচনাটির নতুন করে জনপ্রিয়তা দেখে বিস্মিত ও পুলকিত হয়েছেন। এখন অনেকেরই মুখে মুখে মহাভারতের কথা। তবে ঐ মহাগ্রন্থখানির পাঠক তেমন বাড়েনি, যত বেড়েছে শ্রোতা। প্রাচীনকালেও মহাভারতের পাঠক বিশেষ ছিল না, প্রায় সকলেই অন্যের কণ্ঠে শুনতে। আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলির অপর নাম শ্রুতি। সমগ্র মহাভারতের কাহিনীটি আমরা পাই সৌতির মুখ থেকে, যাঁর পেশাই ছিল গল্প শোনানো, যাঁকে ঘিরে বসে অনেকে দিনের পর দিন এই বিশাল কাহিনীটি ধারাবাহিকভাবে শুনতে। একালে শ্রবণের সঙ্গে চিত্রও যুক্ত হয়েছে পর্দায় চলমান চিত্র দেখা যায়।
কিন্তু গভীর মনঃসংযোগে পাঠ না করলে এই জটিল, গভীর ও শাখাপ্রশাখা বহুল উপন্যাসটির সব কিছু বোঝা ও মনে রাখা সম্ভব নয়। মহাভারতের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করার জন্য চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক জেনে রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুযুৎসু সম্পর্কে ক’জনের ধারণা আছে ? অথচ চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। মহাভারতের যুদ্ধের সময় যুযুৎসুই কৌরবপক্ষের এবং ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র পুত্র, যিনি যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেন। এই যুযুৎসু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বটে, কিন্তু গান্ধারীর সন্তান নন, তাঁর মা ছিলেন দাসী। উচ্চ বংশজাতদের তুলনায় দাসী গর্ভজাত সন্তানদের প্রতি বেদব্যাসের বেশ দুর্বলতা ছিল। যেমন বিদুর পরম ধার্মিক। যুযুৎসুও ভীমের ক্রোধের শিকার হননি, শেষ পর্যন্ত কৌরব পক্ষের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তিনিই। প্রসঙ্গত একটা প্রশ্ন জাগে, দুর্যোধনের আপন ভাইদের মধ্যে একমাত্র একজন, বিকর্ণ, দ্যূত সভায় দ্রৌপদীর অবমাননার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেজন্য তিনি পাণ্ডবদের কাছে কোনো সমাদর পেলেন না কেন? এই সব প্রশ্ন এবং উত্তর সন্ধানই মহাভারত সম্পর্কে আগ্রহ জাগরুক রাখে।
সমগ্র মহাভারত পাঠ করার ধৈর্য কিংবা সময় যাদের নেই, তাদের জন্য শ্রীবিষ্ণুপদ চক্রবর্তী একটি বেশ প্রয়োজনীয় বই তৈরি করেছেন। এটাকে বলা যেতে পারে, হাতের মুঠোয় মহাভারত। মহাভারত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এতে সংগৃহীত হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে কাহিনীটি দেবার পর উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ও পরিণতি দেওয়া হয়েছে বেশ সুন্দরভাবে। এই লেখক যে গভীর অভিনিবেশে মহাভারত অনুশীলন করেছেন, তার প্রমাণ আছে এই রচনায়। তিনি যে মহাভারতীয় বংশ তালিকা প্রস্তুত করেছেন, তা নিশ্চিত অনেক পরিশ্রমের ফল। আমি মূল মহাভারত পাঠের আগ্রহ নিয়েই এই বইটি পড়ে গেছি।
মহাভারতের সবচেয়ে বড় গুণ এই যে তা কখনো পুরোনো হয় না। মহাভারত সম্পর্কিত যে-কোনো রচনাই বার বার পড়া যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Leave a Reply