একনজরে মহাভারতের কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র/স্থান ইত্যাদি

একনজরে মহাভারতের কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র/ স্থান ইত্যাদি

(বর্ণানুক্রমিক)

মহাভারতের কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র, কিছু বিশেষ বিশেষ জায়গা, কিছু বিশেষ বিশেষ পরিভাষা সম্বন্ধে এক নজরে যাতে কিছুটা ধারণা করা যায়, সে কথা মাথায় রেখেই এই বর্ণানুক্রমিক চরিত্র/স্থান ইত্যাদির পঞ্জীর অবতারণা।

গতির যুগে কৌতুহলী পাঠক মহাভারতের কোনও বিশেষ চরিত্র/স্থান সম্বন্ধে তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু যাতে সহজেই পেতে পারেন, সে চেষ্টা করা হয়েছে। খুব বাস্তব কারণেই সব চরিত্র, সব স্থান, সব বিশেষার্থবোধক পারিভাষিক শব্দকে এখানে তুলে ধরা গেল না। সে অতৃপ্তি পাঠকের যতটা, লেখকের ততোধিক। সুতরাং মার্জনা পাব, আশা রাখলাম।

॥ অক্ষক্রীড়া (দ্যূতক্রীড়া/পাশা খেলা) ॥

শাস্ত্র বিরোধী খেলা। ‘নল’ রাজা আর ‘যুধিষ্ঠির’ এই খেলা খেলেই সর্বস্বান্ত হন। শকুনির কপট চালের কাছে দু’দুবার হারতে হয় ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে। ব্রহ্মপুরাণ অনুসারে মহাদেব এ খেলার স্রষ্টা। পার্বতীর সঙ্গে তিনি পাশা খেলতেন।

॥ অক্ষৌহিণী ॥

এক অক্ষৌহিণী সেনা মানে পুরো একটা বাহিনী। যাতে থাকবে—

  
পদাতিক১,০৯,৩৫০ জন।
ঘোড়া৬৫,৬১০টা।
হাতি২১,৮৭০টা।
রথ২১,৮৭০টা।
মোট সংখ্যা২,১৮,৭০০টা।

॥ অঞ্জনপর্ব ॥

ঘটোৎকচের ছেলে। যুদ্ধের চোদ্দ দিনের দিন অশ্বত্থামার হাতে প্রাণ দেন।

॥ অণীমাণ্ডব্য ॥

ছোট বেলায় ফড়িং-এর মলদ্বারে দুর্বো ঢুকিয়ে দেওয়ায় এঁকেও শূলে বসে কাটাতে হয় অনেক দিন। নগরে চুরি করে চোর পালাচ্ছিল। ইনি তখন ধ্যানস্থ। নগরপাল এঁকে ‘চোর কোন্ দিকে গেছে?’ প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে রাজার কাছে নিয়ে যান। রাজা এঁকে শূলে চড়ান। বহুদিন পর রাজা অনুতপ্ত হয়ে শূল থেকে নামিয়ে ক্ষমা চান এঁর কাছে। কিন্তু শূলের মাথা আর শরীর থেকে বেরোল না। ছিলেন মাণ্ডব্য। অণী (শূলের ডগা) শরীরে থাকায় হলেন অণীমাব্য। যমকে শাপ দিলেন, ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়ায় আপনাকে মর্তলোকে জন্মাতে হবে।’ সেই শাপেই ধর্মরাজ যমের বিদুর-দেহ। ধারণ।

॥ অদৃশ্যম্ভী ॥

ব্যাসদেবের ঠাকুরমা। পরাশরের মা। রামের কুলগুরু বশিষ্ঠের ছেলে শক্তির স্ত্রী।

॥ অধিরথ ॥

কর্ণের পালক পিতা। পেশায় সারথি। তাই ‘সূত’ পদবী। ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু। গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে এঁর স্ত্রী রাধা এক পেটিকা ভাসতে দেখে টেনে আনেন। সেই পেটিকা খুলে কর্ণকে পান এঁরা। সন্তান-স্নেহে লালন-পালন করেন কর্ণকে। কুমারদের অস্ত্র পরীক্ষার সময় কর্ণ এঁকে প্রণাম করলে ভীম কর্ণকে ‘সূতপুত্র’ ‘সূতপুত্র’ বলে বিদ্রূপ করেন।

॥ অনিরুদ্ধ ॥

শ্রীকৃষ্ণের নাতি। প্রশ্ন এবং কুকুমতীর ছেলে। বাণ এর মেয়ে ঊষার বর।

॥ অনসূয়া ॥

ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহশ্বেরকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে পুত্র স্নেহে লালন-পালন করেছিলেন অনুসূয়া। তিন দেবতাই বর দিতে চাইলেন। অনসূয়া তিনজনকেই ছেলে হিসেবে পেতে চাইলেন। সেই মতো ব্রহ্মার অংশে জন্ম নিলেন সোম। বিষ্ণুর অংশে দত্তাত্রেয়। আর মহেশ্বরের অংশে দুর্বাসা। চিত্রকূট পর্বতে অত্রি ঋষির আশ্রমে রাম এলে এই অনসূয়াই সীতাকে দিব্য বরমাল্য, অঙ্গরাগ, গন্ধানুলেপন আর নানা অলংকার দিয়েছিলেন।

॥ অনুগীতা ॥

কুরুক্ষেত্রে ভগবান অর্জুনকে যে গীতা বলেছিলেন, যুদ্ধের শেষে তার অনেক কথাই ভুলে গিয়েছিলেন অর্জুন। কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় ফিরে যাচ্ছেন। অর্জুন কৃষ্ণকে আবার গীতা শোনাতে বললেন।

কৃষ্ণ বললেন, ‘তা আর সম্ভব নয়। তখন যোগস্থ হয়ে তোমায় যা বলেছি, এখন আর তা বলতে পারব না। তার বদলে সিদ্ধ ব্রাহ্মণ কশ্যপকে যা বলেছিলাম, তাই বলছি। শোন।’

এ কথা বলে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে ধর্মকথা শোনালেন, তাই অনুগীতা।

॥ অভিমন্যু ॥

সুভদ্রার গর্ভজাত অর্জুনের মহাবীর ছেলে। নির্ভীক এবং ‘মন্যুমান’ অর্থাৎ তেজস্বী। তাই নাম অভিমন্যু।

চাঁদের (সোম) ছেলে ‘বর্চাঃ’ অভিমন্যু হয়ে জন্মান। চাঁদ প্রিয় পুত্রকে মাত্র ষোল বছরের জন্যে ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন। তাই মাত্র ষোল বছর বয়সে অভিমন্যুকে পৃথিবী থেকে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নিতে হল।

অসামান্য বীর। বেঁচে থাকলে হয়তো মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হতেন। বিরাট রাজার মেয়ে উত্তরার গর্ভে এঁর ছেলে পরিক্ষিতের জন্ম হয়। এই পরিক্ষিৎই পাণ্ডবদের বংশরক্ষা করেন।

যুদ্ধের তের দিনের দিন দ্রোণের তৈরি চক্রব্যূহে কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা আর জয়দ্রথ, এই সপ্ত মহারথীর সাথে একা বীরের মতো লড়তে লড়তে প্রাণ দেন অভিমন্যু। সপ্তরথী নির্লজ্জের মতো যুদ্ধের সমস্ত শর্ত আর নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক কিশোরের ওপর সবাই মিলে একসাথে আক্রমণ চালান।

অভিমন্যুবধের খবরে ভেঙে পড়েন অর্জুনসহ পাণ্ডবশিবিরের সবাই। কৃষ্ণ অবশ্য জানতেন, অভিমন্যুর সময় হয়ে গেছে বাবা চন্দ্রের কাছে ফেরার। অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করেন। কারণ জয়দ্রথ চক্রব্যূহের মুখ আগলে রেখে পাণ্ডবদের কারুকে অভিমন্যুকে সাহায্য করার জন্যে ব্যূহের মধ্যে ঢুকতে দেননি।

কৃত্তিবাসী রামায়ণের তরণীসেনের সাথে অভিমন্যুর চরিত্রের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো।

॥ অম্বা ॥

কাশীরাজের তিন মেয়ের বড় মেয়ে। অসামান্যা সুন্দরী। তিন মেয়ের জন্যে স্বয়ংবর সভা বসালেন কাশীরাজ। খবর পেয়ে ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য পাত্রীর সন্ধানে ভীষ্মও গেলেন সেখানে।

অম্বা মনে মনে শাম্বরাজকে পতিরূপে বরণ করেন। ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যের জন্যে অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা— তিন কন্যাকেই জয় করে আনলেন। অম্বা পরে ভীষ্মকেই বিয়ে করতে চান। কারণ ভীষ্ম অম্বাকে হরণ করায় শাল্ব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। ভীষ্ম চিরকুমার থাকায় তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করেন। অম্বা গেলেন ভীষ্মের গুরু পরশুরামের কাছে। গুরুর আদেশেও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে অম্বাকে বিয়ে করতে চাইলেন না ভীষ্ম। তখন গুরু-শিষ্যে ভীষণ লড়াই হল। পরশুরাম নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে অম্বার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। অম্বা ভীষ্মকে শাপ দেন, পরের জন্মে তাঁর মৃত্যুর কারণ হবেন বলে। হলও তাই।

আগুনে আত্মাহুতি দেন অম্বা। পরের জন্মে তিনিই শিখণ্ডীরূপে জন্ম গ্রহণ করে ভীমের মৃত্যুর কারণ হন।

॥ অম্বিকা ॥

কাশীরাজের মেজ মেয়ে। অম্বা আর অম্বালিকার সাথে এঁকেও স্বয়ংবর সভ্য থেকে হরণ করেন ভীষ্ম। ভাই বিচিত্রবীর্যের সাথে বিয়ে দেন। বিচিত্রবীর্য অকালে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। শাশুড়ি সত্যবতীর নির্দেশে সত্যবতীর কানীন পুত্র ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলিত হন। মিলনকালে ব্যাসদেবের ভয়ংকর চেহারা দেখে ভয়ে চোখ বুজে থাকেন। তার ফলে যে সন্তান জন্মায়, সে জন্মান্ধ হয়। সেই সন্তানই ধৃতরাষ্ট্র। শাশুড়ি আবার ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হতে বলেন। এবার অম্বিকা নিজে না গিয়ে এক দাসীকে পাঠান। তাঁর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয়। শেষ জীবন সন্ন্যাসিনীর মতো কাটান অম্বিকা।

॥ অম্বালিকা ॥

কাশীরাজের ছোট মেয়ে। পাণ্ডুর মা। দুই দিদির সঙ্গে এঁকেও হরণ করেন ভীষ্ম। তারপর বাগ্‌দত্তা অম্বাকে মুক্তি দিয়ে অম্বিকা আর অম্বালিকার সঙ্গে বিয়ে দেন বিচিত্রবীর্যের।

নিঃসন্তান বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গেলে শাশুড়ির নির্দেশে ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলিত হন। মিলনকালে ব্যাসদেবের চেহারা দেখে ভয়ে ফ্যাকাশে (পাণ্ডুর) হয়ে যান। তাই গর্ভস্থ সন্তানের গায়ের রংও হয় পাণ্ডুবর্ণ। ছেলের নাম রাখেন পাণ্ডু। শেষ বয়েস কাটান সন্ন্যাসিনীর মতো।

॥ অর্জুন ॥

তৃতীয় পাণ্ডব। কুন্তীর গর্ভজাত পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ ছেলে। দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসজাত। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পাণ্ডব। কৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয় সখা এবং পিসতুতো ভাই। আসল নাম ‘কৃষ্ণ’। কারণ গায়ের রং ছিল কালো। পৃথার (কুন্তীর) ছেলে। তাই নাম ‘পার্থ’। দু’হাতে সমান দক্ষতায় গাণ্ডীব আকর্ষণ করতে পারতেন। তাই ‘সব্যসাচী’। প্রচুর রাজ্যজয় করে প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহ করেছিলেন। তাই ‘ধনঞ্জয়’। যুদ্ধ না জিতে ফিরতেন না। তাই ‘বিজয়’। উত্তরফল্গুনী নক্ষত্রে জন্ম। তাই ‘ফাল্গুন’। ইন্দ্র এক উজ্জ্বল কিরীট (মুকুট) দিয়েছিলেন। তাই ‘কিরীটী’। দুর্ধর্ষ বীর ছিলেন। তাই ‘জিষ্ণু’। শুভকর্মে রুচি ছিল। তাই ‘অর্জুন’। নিদ্রাকে জয় করেছিলেন। তাই ‘গুড়াকেশ’। (জিতেন্দ্রিয়)। দ্রোণাচার্যের প্রিয়তম শিষ্য। অর্জুনকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরের আসনে বসাতে দ্রোণ অন্যায়ভাবে একলব্যের ডান হাতের সবচেয়ে মূল্যবান বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি চেয়ে নিয়েছেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে।

গাছের ডালে বসানো কৃত্রিম পাখির দিকে তাক্‌ করার সময় শুধু পাখির মাথাই দেখেছেন অর্জুন। অন্যরা দেখেছেন আরও অনেক কিছু। প্রিয় শিষ্যের মনসংযোগে খুশি হয়েছেন দ্রোণ।

গঙ্গায় নেমেছেন দ্রোণ। কুমিরে কামড়ে ধরেছে পা। নিজেই ছাড়াতে পারতেন। তা না করে শিষ্যদের পরীক্ষা নিতে আর্তনাদ করে উঠলেন। বুদ্ধি হারিয়ে শিষ্যরা সবাই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অর্জুন তখন পাঁচ বাণে কুমিরকে টুক্‌রো টুক্‌রো করলেন। গুরুর গায়ে আঁচড়টিও লাগল না। খুশি হলেন দ্রোণ। ‘ব্রহ্মশির’ নামে এক দিব্যাস্ত্র দিলেন অর্জুনকে। কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা কেমন হল দেখতে চান সবাই। সবাই দেখালেন যাঁর যাঁর নৈপুণ্য। সেখানেও অর্জুন শ্রেষ্ঠ! একমাত্র কর্ণ তাঁর সমকক্ষতার দাবিদার।

দ্রোণের অপমানের প্রতিশোধ নিতে মূলত অর্জুনেরই নেতৃত্বে দ্রুপদকে বন্দী করে দ্রোণের কাছে নিয়ে এসেছেন কুমাররা।

দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় লক্ষ্যভেদ করে রথী মহারথীদের হারিয়ে দ্রৌপদীকে জিতে নিয়েছেন ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন। মায়ের অসতর্ক নির্দেশ মান্য করতে পাঁচ ভাইয়ে মিলে দ্রৌপদীর মালা নিয়েছেন গলায়।

এক ব্রাহ্মণের গরু চুরি করে পালাচ্ছিল চোর। চোর ধরতে অস্ত্রাগারে অস্ত্র আনতে ঢুকলেন অর্জুন। সেখানে তখন যুধিষ্ঠিরের নিবিড় আলিঙ্গনে ধরা পড়েছেন দ্রৌপদী। পূর্বশর্ত মতো ‘অন্য ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদী সহবাসে থাকা অবস্থায়’ ঘরে ঢুকে পড়ায় অর্জুনকে বার বছররের জন্যে ব্রহ্মচর্য পালন করতে বনে যেতে হয়েছে। কিছুটা বনবাস হয়েছে। তবে ব্রহ্মচর্য পালন সম্ভব হয়নি।

গঙ্গাস্নানের সময় একদিন নাগকন্যা উলূপী অর্জুনকে টেনে নিয়ে গেছেন পাতালে। বিবাহিতা উলূপী অর্জুনকে বিয়ে করতে চাইলে অর্জুন রাজি হননি। কিন্তু এক রাত কাটাতে হয়েছে উলূপীর সঙ্গে। জন্ম হয়েছে ইরাবানের।

মণিপুর-দুহিতা চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করেছেন অর্জুন। জন্ম হয়েছে বভ্রুবাহনের। মণিপুরে তিন বছর কাটিয়ে আবার তীর্থ-দর্শনে বেরিয়েছেন অর্জুন। রামায়ণ মতে এই সময় একদিন রাবণ অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। রাবণকে বেদম প্রহার করে শেষে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন অর্জুন। বন্ধুত্বও হয় শেষে।

নারীতীর্থে শাপগ্ৰস্তা পাঁচ নারীকে উদ্ধার করে আবার চিত্রাঙ্গদার কাছে ফিরে গেছেন। প্রভাসে কৃষ্ণের পরামর্শে সুভদ্রাকে হরণ করে বিয়ে করেছেন। দুই শ্বশুরবাড়িতে চার বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন অর্জুন।

যমুনাতে ঘরের বৌদের নিয়ে জলকেলি সেরে বিশ্রাম করছিলেন কৃষ্ণ আর অর্জুন। অগ্নিদেব এসে তাঁদের সাহায্য চাইলেন। বললেন, ‘আমি বহুদিন ধরে ক্ষুধার্ত। ইন্দ্রের বন্ধু তক্ষক এই খাণ্ডব বনে থাকে। আমি বন পোড়াতে গেলেই ইন্দ্র বৃষ্টি ঢেলে আগুন নিভিয়ে দেয়। তোমাদের সাহায্য চাই।’

সাহায্য তো করবেন কৃষ্ণার্জুন। কিন্তু অস্ত্র কোথায়? অগ্নি বরুণের কাছ থেকে চেয়ে এনে অর্জুনকে দিলেন ‘গাণ্ডীব ধনু’। আর দিলেন দুটো ‘অক্ষয়তুণীর’। কৃষ্ণকে দিলেন ‘সুদর্শন চক্র’ আর ‘কৌমোদকী গদা’।

তক্ষক তখন বনের বাইরে। মনের সুখে বন পুড়িয়ে খেলেন অগ্নি। দানব-শিল্পী ময়কে বাঁচালেন কৃষ্ণার্জুন। কৃষ্ণের কথায় কৃতজ্ঞ ময় ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের জন্যে এক আশ্চর্য প্রাসাদ বানিয়ে দিলেন। অর্জুনকে দিলেন দেবদত্ত শঙ্খ।

কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ তৎক্ষণাৎ না নিতে পেরে অপমানে আহত সর্পের মতো ফুঁসেছেন অর্জুন। কর্ণবধের প্রতিজ্ঞা করেছেন।

যুধিষ্ঠিরের পরামর্শে বাবা ইন্দ্রের কাছে গেছেন অর্জুন। ইন্দ্র বললেন মহাদেবের তপস্যা করতে। কিরাতের বেশে এলেন মহাদেব। এক বন্যবরাহ শিকারের দাবি নিয়ে ভক্ত ভগবানের লাগল তুমুল যুদ্ধ। সন্তুষ্ট মহাদেব ‘পাশুপত’ দিলেন অর্জুনকে।

গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নাচ গান শিখলেন। উর্বশী এলেন প্রেম নিবেদন করতে। ‘ছিঃ। তুমি আমার মায়ের মতো।’ বলে উর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করলেন অর্জুন। অর্জুনকে নপুংসক হবার অভিশাপ দিলেন উর্বশী। ইন্দ্র অভয় দিয়ে বললেন, ‘এতে শাপে বর হল। অজ্ঞাতবাসে সুবিধেই হবে।’

অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় ‘বৃহন্নলা’ নাম নিয়ে নারীর বেশে রাজকুমারী উত্তরাকে নাচ গান শেখাবার কাজ নিলেন অর্জুন। নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে তাঁর সাংকেতিক নাম রাখা হল ‘বিজয়’।

দুর্যোধনরা বিরাটের গরু চুরি করতে এলে রাজকুমার উত্তর বৃহন্নলাকে সারথি করে সদম্ভ আস্ফালন করতে করতে যুদ্ধে গেছেন। যুদ্ধে গিয়ে উত্তর ভয়ে পালাতে গেলে বৃহন্নলা অর্জুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বার বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাতবাস শেষ হয়েছে। আর ভয় নেই। অর্জুনের তীরেই প্রতিপক্ষ অর্জুনকে চিনতে পেরেছেন।

যুদ্ধে নেমে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছেন, ‘এই গুরুজনদের বধ করে আমি রাজ্যলাভ করতে চাই না কৃষ্ণ।’ কৃষ্ণ তখন তাঁকে গীতা বলেছেন। অর্জুনের ক্লীবতা, মোহ কেটে গেছে। যুদ্ধে অর্জুন একাই একশ’। অর্জুন যেন কৌরবপক্ষের ত্রাস! অভিমনুর মৃত্যু শেল বিঁধে দিয়েছে অর্জুনের বুকে। জয়দ্রথধের প্রতিজ্ঞা করেছেন। কৃষ্ণের কৌশলে সে প্রতিজ্ঞা পালন করতে পেরেছেন। নইলে আত্মাহুতি অবধারিত ছিল। কৃষ্ণের মতো সখা পেয়েছিলেন বলেই ভীষ্মকে শরশয্যায় শোয়াতে পেরেছেন। জয়দ্রথ আর কর্ণকে বধ করতে পেরেছেন।

দ্রোণকে অর্ধসত্য বলে হত্যা করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। গাণ্ডীবের অপমান করায় যুধিষ্ঠিরকে কাটতে গেছেন।

যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে অনুসরণ করেছেন অর্জুন। ছেলে বভ্রুবাহনের বাণে ধরাশায়ী হয়েছেন। ছেলেও জ্ঞান হারিয়েছেন। চিত্রাঙ্গদার কান্নায় উলূপী নাগলোক থেকে ‘সঞ্জীবন মণি’ এনে অর্জুনকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছেন।

দস্যুদের হাত থেকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া যদু বংশের এক বিধবা মহিলাকে বাঁচাতে গিয়ে অর্জুন বুঝতে পারলেন, দেহে আর সে বল নেই। দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ ভুলে গেছেন। এবার ফিরে যেতে হবে।

বরুণদেবকে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর দেওয়া গাণ্ডীব আর তুণীর।

এবার মহাপ্রস্থান। দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডব চললেন মহাপ্রস্থানের পথে। এক কুকুর চলার সঙ্গী হয়েছে। দ্রৌপদী, সহদেব আর নকুলের পর অর্জুনের পতন হল।

ভীম যুধিষ্ঠিরের কাছে অর্জুনের পতনের কারণ জানতে চাইলেন। ‘অর্জুন এক দিনেই সব শত্রুকে বিনাশ করবে প্রতিজ্ঞা করে সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। আর, “তার মতো ধনুর্ধর আর কেউ নেই”, এই অহংকারও তার ছিল। এই দুই কারণেই তার পতন হল।’ বললেন যুধিষ্ঠির।

অর্জুন এক বিস্ময়কর চরিত্র। বীরশ্রেষ্ঠ। আবার জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ। সেই কারণেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার শ্রোতা হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করেছেন। আবার নাচ-গান ইত্যাদি কলাবিদ্যাতেও তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। দাদার প্রতি তাঁর ছিল প্রশ্নাতীত আনুগত্য। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর সকলেরই অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। গুরুকে কি রকম সম্মান দিতে হয়, সে শিক্ষা অর্জুন দিয়ে গেছেন।

অর্জুনের তিন স্ত্রী। দ্রৌপদী, চিত্রাঙ্গদা আর সুভদ্রা। উলূপীর সাথে সহবাসের ফলে ইরাবান নামে এক ছেলের জন্ম হলেও উলূপী কিন্তু অর্জুনের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না। দ্রৌপদীর গর্ভে শ্রুতকর্মা, চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহন আর সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যু নামে তিন ছেলের জন্ম দেন অর্জুন।

অভিমন্যুর নাতি জনমেজয়। জনমেজয়ের নাতি অশ্বমেধদত্তই মহাভারতের শেষ পুরুষ। আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৭ বছর বেঁচেছিলেন অর্জুন।

॥ অশ্বসেন ॥

তক্ষকের ছেলে। খাণ্ডবদহনের সময় এঁর মা এঁকে মুখের ভেতরে লুকিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে অর্জুন এঁর মার মাথা কেটে ফেলেন। পালিয়ে প্রাণ বাঁচান অশ্বসেন।

কর্ণার্জুনের যুদ্ধের সময় মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সর্পবাণ হয়ে কর্ণের তুণীরে আশ্রয় নেন অশ্বসেন। কর্ণ অর্জুনকে সে বাণ ছুঁড়ে মারলে অন্তর্যামী কৃষ্ণ পায়ের চাপে অর্জুনের রথ এক হাত বসিয়ে দেন। ফলে অর্জুন সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান। যদিও তাঁর সোনার মুকুট এতে পুড়ে যায়।

অশ্বসেন আবার গেলেন কর্ণের কাছে। এবার নিজের পরিচয় দিলেন কর্ণ বললেন, ‘ধন্যবাদ অশ্বসেন। কিন্তু আমি তোমার সাহায্য নিতে পারছি না। কারণ— এক, আমি এক অস্ত্র দুবার ছুঁড়ি না। আর দুই, আমি অন্যের সাহায্যে কপালে জয়তিলক পরতে চাই না।’

হতাশ অশ্বসেন নিজেই চললেন মাতৃহন্তাকে শেষ করতে। কিন্তু মাতৃহন্তা অর্জুনের বাণে নিজেই শেষ হয়ে গেলেন।

॥ অশ্বত্থামা ॥

দ্রোণ এবং কৃপীর ছেলে। জন্মেই ঘোড়ার মতো ডেকেছিলেন বলে অশ্বত্থামা নাম। দশজন চিরজীবীর অন্যতম। বাবা-ই এঁর অস্ত্রগুরু। বাবার কাছে ব্ৰহ্মশির অস্ত্র পান। দ্রোণের মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত অশ্বত্থামা ভয়ংকর নারায়ণাস্ত্র ছুঁড়লে কৃষ্ণের পরামর্শে পাণ্ডব পক্ষের সবাই রথ থেকে নেমে অস্ত্র ফেলে দেন। অস্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

যুদ্ধের শেষে রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণ আর পাণ্ডবদের অনুপস্থিতিতে মামা কৃপ আর কৃতবর্মাকে নিয়ে শিবিরে ঘুমন্ত অবস্থায় দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ইত্যাদিকে বধ করেন অশ্বত্থামা। খবর পেয়ে ভীম তাড়া করেন। অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির ছোঁড়েন। অর্জুনও পাল্টা অস্ত্র ছোঁড়েন। শেষে শান্তি আনতে অশ্বত্থামার অস্ত্রে উত্তরার গর্ভস্থ অভিমন্যুর সন্তান মারা যায়। পরে কৃষ্ণ তাকে (পরিক্ষিৎ) আবার বাঁচান। মাথার মণি খুলে দিতে হয় অশ্বত্থামাকে। সেই মণি দ্রৌপদীর হাতে তুলে দেন ভীম। অশ্বত্থামা বনে যান।

॥ অশ্বমেধদত্ত ॥

মহাভারতের শেষ পুরুষ। এঁর পর আর কারও নাম মহাভারতে নেই। অর্জুনের নাতি জনমেজয়। জনমেজয়ের নাতি অশ্বমেধদত্ত। এঁর বাবা শতানীক। মা বিদেহরাজকন্যা।

॥ অশ্বিনীকুমারদ্বয় ॥

স্বর্গের বৈদ্য। বিশ্বকর্মার মেয়ে সংজ্ঞা আর সূর্যের যমজ ছেলে। সংজ্ঞা সূর্যের সাথে মিলনকালে ‘অশ্বিনী’র রূপ ধারণ করেন। তাই দুই ছেলের নাম হয় অশ্বিনীকুমার। কুন্তীর শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্রে মাদ্রী এঁদের ডাকেন। এঁদের সাথে মিলনের ফলে মাদ্রীরও দুই যমজ ছেলে হয়। নকুল আর সহদেব।

॥ ইন্দ্র ॥

দেবরাজ। অর্জুনের ধর্মপিতা।

দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্রে পাণ্ডুর অনুরোধে সন্তানলাভের জন্যে কুন্তী ডাকেন ইন্দ্রকে। ইন্দ্রের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম হয়।

অর্জুন দিব্যাস্ত্র আনতে স্বর্গে গেলে ইন্দ্র ছেলেকে আদর করে কাছে রেখে অস্ত্রবিদ্যা, নাচ-গান ইত্যাদি সবই শেখান।

অর্জুনকে বাঁচাতে ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কর্ণের কাছ থেকে তাঁর কবচকুণ্ডল চেয়ে নেন। বদলে কর্ণকে দেন ‘বৈজয়ন্তী-শক্তি’ অস্ত্র।

॥ ইন্দ্রপ্রস্থ ॥

যুধিষ্ঠিরের রাজধানী। দিল্লীর কাছেই।

॥ ইরাবান ॥

অর্জুনের উলূপীর গর্ভজাত ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অষ্টম দিনে শকুনির ছ’ভাইকে হত্যা করে রাক্ষস অলম্বুষের হাতে প্রাণ দেন। উলূপী অর্জুনের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না। সেই হিসেবে অর্জুন ইরাবানের স্বাভাবিক পিতা ছিলেন না। ছিলেন ধর্মপিতা!

॥ ইলা ॥

বৈবস্বত মনুর মেয়ে ইলা। ইলা বিষ্ণুর বরে পুরুষত্ব লাভ করে সুদ্যুম্ন নাম নেন। মহাদেবের অভিশপ্ত বনে প্রবেশ করার অপরাধে ইনি আবার স্ত্রী দেহ ফিরে পান। ইলার পুরোহিত বশিষ্ঠ শিবকে তুষ্ট করে এই বর শিবের থেকে আদায় করে নেন যে, ইলা একমাস পুরুষ এবং একমাস নারী হয়ে থাকতে পারবেন।

॥ উগ্রসেন (দ্রুমিল) ॥

যদুবংশীয় রাজা। আহুক আর কাশ্যার ছেলে। কংসের বাবা। কৃষ্ণের দাদামশাই দেবকের ভাই। কংস এঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। কৃষ্ণবলরাম কংসবধের পর এঁকে সিংহাসনে বসান।

॥ উত্তর ॥

বিরাট রাজার ছেলে। আর এক নাম ভূমিঞ্জয়। দুর্যোধনরা বিরাট রাজার গরু চুরি করতে এলে বৃহন্নলারূপিনী অর্জুনকে নিয়ে খুব আস্ফালন করতে করতে ইনি যুদ্ধে যান। শেষে যুদ্ধে গিয়ে ভয়ে পালাতে থাকেন। অর্জুন এঁকে চেপে ধরে সারথির আসনে বসান। নিজের পরিচয় দেন। ভয়ংকর যুদ্ধ করেন।

যুদ্ধের প্রথম দিনেই পাণ্ডবদের মামা শল্যের হাতে প্রাণ দেন সরলপ্রাণা রাজকুমার উত্তর।

॥ উত্তমৌজা ॥

দ্রুপদের ছেলে। দ্রৌপদীর দাদা। মহাবীর। যুদ্ধশেষে ঘুমন্ত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে এঁকে অন্য অনেকের সাথে হত্যা করেন অশ্বত্থামা।

॥ উত্তরা ॥

মৎস্যরাজ বিরাট আর সুদেষ্ণার মেয়ে। অভিমন্যুর স্ত্রী। বৃহন্নলাবেশে অর্জুন এঁকে নাচ-গান শেখাতেন। অভিমন্যু যখন মারা যান, পরিক্ষিৎ তখন এঁর গর্ভে। অশ্বত্থামার ছোঁড়া ব্ৰহ্মশির অন্ত্রে উত্তরার গর্ভের সন্তান মারা যায়। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় উত্তরা মৃত সন্তান প্রসব করলে কান্নাকাটি পড়ে যায়। পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো কৃষ্ণ সেই শিশুকে বাঁচান। সেই শিশুই পরিক্ষিৎ।

॥ উপপ্লব্য ॥

বিরাট রাজার রাজ্যের এক নগর। অজ্ঞাতবাসের শেষে এখান থেকেই যুদ্ধের আয়োজন করেন পাণ্ডবরা।

॥ উপকীচক ॥

বিরাট রাজার শ্যালক। কীচকের ভাই। একশ পাঁচজন উপকীচক ছিঁলেন। এঁরা কীচকের মৃতদেহের সঙ্গে চিতায় পোড়াবেন বলে দ্রৌপদীকে শ্মশানে নিয়ে যান। দ্রৌপদীর চিৎকার শুনে ভীম এসে এঁদের সবার ভবলীলা সাঙ্গ করে দ্রৌপদীকে মুক্ত করেন।

॥ উর্বশী ॥

স্বর্গের অপ্সরা। জন্ম নিয়ে নানা মত। কেউ বলেন, নারায়ণের উরু থেকে জন্ম। তাই উর্বশী। কেউ বলেন, সমুদ্র মন্থনের সময় উঠে এসেছেন। কেউ বলেন, সাতজন মনু মিলে এঁকে সৃষ্টি করেছেন।

নৃত্যরতা অবস্থায় পুরুরবার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন উর্বশী। নাচে ঘটল ছন্দপতন। ইন্দ্র শাপ দিলেন। মর্তে জন্মাতে হল উর্বশীকে। বিয়ে করলেন পুরুরবাকে। গন্ধর্বরা উর্বশীকে স্বর্গে ফিরে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করলেন।

উর্বশী স্বর্গে ফিরে গেলেও পুরুরবার অনুরোধে বছরে তাঁর সাথে একবার মিলিত হতে রাজী হলেন। এই মিলনের ফলে উর্বশীর গর্ভে পুরুরবার সাত ছেলে হয়। পরে গন্ধর্বদের বরে পুরুরবা আর উর্বশী ঠাঁই পান গন্ধর্বলোকে।

গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে স্বর্গে নাচগান শিখছিলেন অর্জুন। উর্বশী তাঁর সঙ্গ চান। উর্বশীকে বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন অর্জুন। বলেন, ‘আপনাকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি।’ অর্জুনদের বংশের আদি পুরুষ পুরুর ঠাকুর্দা আয়ুর মা উর্বশী। উর্বশী অর্জুনকে নপুংসক হয়ে থাকার অভিশাপ দিলেন। শাপে বর হল। অজ্ঞাতবাসে থাকবার সময় অর্জুনের বৃহন্নলা সাজতে সুবিধেই হল।

॥ উলুক ॥

শকুনির ছেলে। দুর্যোধনের মামাতো ভাই। পাণ্ডবদের কাছে দুর্যোধনের দূত হয়ে যান। দুর্যোধন যা বলতে বলেছেন, নির্ভয়ে তা বলে যান। খুব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের আঠের দিনের দিন সহদেবের হাতে মারা যান। সহদেবের প্রতিজ্ঞা ছিল, শকুনি আর উলুককে বধ করবেন।

॥ উলূপী ॥

নাগ কন্যা। কৌরব্য নাগের মেয়ে। বনবাসে থাকাকালীন এক দিন গঙ্গায় স্নান করছিলেন অর্জুন। উলূপী অর্জুনকে জাপটে ধরে পাতালে নিয়ে যান। বিয়ে করার জন্যে চাপ দিতে থাকেন। ব্রহ্মচর্য ভঙ্গের ভয়ে পরস্ত্রী উলূপীকে বিয়ে করতে রাজি হন না অর্জুন। কিন্তু উলূপীর চাপাচাপিতে একরাত কাটান তাঁর সঙ্গে। তাতেই ইরাবানের জন্ম হয়। সন্তান হলেও বিয়ে কিন্তু তাঁদের হয়নি। বভ্রুবাহনের তীরে অর্জুন মারা গেলে উলূপীই পাতাল থেকে ‘সজ্ঞীবনমণি’ এনে অর্জুনকে বাঁচান।

পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের সময় উলূপী ফিরে যান গঙ্গায়।

॥ একচক্রা ॥

জতুগৃহদাহের পর পাণ্ডবরা কিছুদিন এখানে কাটান। এখানেই অত্যাচারী রাক্ষস ‘বক’-কে বধ করেন ভীম।

॥ একলব্য ॥

ব্যাধ-রাজা হিরণ্যধনুর ছেলে। অসাধারণ ধনুর্ধর। দ্রোণের কাছে শিক্ষা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন।

একবার মৃগয়ায় গেলে রাজকুমাররা এক কুকুরের ডাকে আকৃষ্ট হন। কিছু পরেই দেখেন কেউ তীর ছুঁড়ে কুকুরের ডাক বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন ভাবে তীর ছোঁড়া হয়েছে যে, কুকুরের দুই চোয়াল আটকে গেছে। কিন্তু কোনও রক্তপাত হয়নি। কে এই অসামান্য ধনুর্ধর? সন্ধানী হলেন কুমাররা।

কুমাররা একলব্যকে দেখতে পেলেন। মাটি দিয়ে তৈরি দ্রোণের মূর্তির সামনে একমনে অস্ত্রবিদ্যা চর্চা করছেন। কুকুরের ডাকে মনসংযোগ নষ্ট হওয়ায় তার এই অবস্থা করেছেন।

অভিমানী অর্জুন দ্রোণকে বললেন, ‘আপনি না বলেছিলেন, আমাকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর করবেন? এ বিদ্যা তো আমাকে শেখাননি?’

দ্রোণ একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা চাইলেন। নির্দ্বিধায় আঙুল কেটে দ্রোণের চরণে রাখলেন ব্যাধপুত্র একলব্য। বিস্মিত হলেন সকলে।

অর্জুন এবং দ্ৰোণ দুজনেরই নীচতা প্রকাশ পেয়েছে এ ঘটনায়। ফুটে উঠেছে একলব্যের প্রশ্নাতীত গুরুভক্তি, উদারতা আর মহানুভবতা।

॥ কংস ॥

কৃষ্ণের মামা। দৈববাণী হয়েছিল দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তানই কংসের প্রাণ নাশ করবে। কংস একে একে কারারুদ্ধ দেবকীর সাত সন্তানকে হত্যা করেন। অষ্টম সন্তান কৃষ্ণকে কৌশলে নন্দ ঘোষের সদ্যোজাতা মেয়ে যোগমায়ার সঙ্গে বদল করা হয়। কংস তাকে হত্যা করতে গেলে সে শূন্যে মিলিয়ে যায়। যাবার সময় বলে যায়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ কংসের কৃষ্ণবধের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে কৃষ্ণ কংসকে, আর বলরাম কংসের আট ভাইকে হত্যা করেন।

॥ কঙ্ক ॥

অজ্ঞাতবাসকালে বিরাট রাজার সভায় যুধিষ্ঠিরের ব্যবহৃত ছদ্মনাম। ‘যুধিষ্ঠির’ দেখুন।

॥ কর্ণ (বসুষেণ) ॥

কুন্তীর কুমারী অবস্থার ছেলে। সূর্যের ঔরসজাত। কোনও পার্থিব পিতৃপরিচয় নেই। পালক-পিতা সূত অধিরথ। পালিকা মা রাধা।

শরীরে বসুর (সোনার) কবচ ছিল। তাই নাম ‘বসুষেণ’। বিক্রম, ধর্মনিষ্ঠা আর সত্যবাদিতার জন্যে নাম ‘বৃষ’। রাধার পালিত পূত্র। তাই ‘রাধেয়’। কুন্তীর গর্ভজাত। তাই ‘কৌন্তেয়’ এবং ‘পার্থ’।

একমতে, নরকাসুর কর্ণ হয়ে জন্মেছিলেন। তাই কর্ণার্জুনের আজন্ম ঝগড়া। জন্মের পরেই লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী এঁকে সুদৃশ্য পেটিকায় করে অশ্ব নদীতে ভাসিয়ে দেন। অশ্ব নদী থেকে চর্মম্বতী, যমুনা হয়ে পেটিকা এসে পড়ে গঙ্গায়। গঙ্গায় স্নান করছিলেন অধিরথ আর রাধা। তাঁরা শিশুকে তুলে এনে মানুষ করেন।

অসামান্য রূপবান ছিলেন সূর্যপুত্র কর্ণ। বাবার মতোই তেজ আর রূপের ছটা যেন গা থেকে ছিট্‌কে পড়ত। সাত হাত (প্রায় সাড়ে দশ ফুট) লম্বা ছিলেন কর্ণ।

দ্রোণ আর কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখে দ্রোণের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র বিদ্যা শিখতে চাইলে দ্ৰোণ প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ কর্ণ সূত্রপুত্র। আসলে দ্রোণের মনে ভয় ছিল। কর্ণ যদি অর্জুনকে ছাড়িয়ে যান। যদি রাষ্ট্রদ্রোহী হন! ঠিক এখান থেকেই কর্ণের মনে অর্জুন-বিদ্বেষ জন্ম নিল। কর্ণ প্রতিজ্ঞা করলেন, ব্ৰহ্মাস্ত্র সহ সব দিব্যাস্ত্র প্রয়োগে অর্জুনকে তিনি অতিক্রম করবেন।

ব্রাহ্মণবেশে পরশুরামের কাছে দিব্যাস্ত্রবিদ্যা শিখতে লাগলেন। প্রিয় শিষ্যের কোলে একদিন মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিলেন পরশুরাম। এক জোঁক কর্ণের উরু এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে ফেলল। গুরুর ঘুমের ব্যাঘাত হবে ভেবে নীরবে সে অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করলেন কর্ণ।

রক্তের স্পর্শে জেগে উঠলেন পরশুরাম। ধরা পড়ে গেল কর্ণের প্রকৃত পরিচয়। পরশুরাম শাপ দিলেন, ‘গুরুর সাথে প্রতারণা করেছ! মৃত্যু ঘনিয়ে এলে সব দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ ভুলে যাবে!’

অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাসের সময় না জেনে একদিন এক ব্রাহ্মণের হোমের গরুকে মেরে ফেলেন কর্ণ। ব্রাহ্মণ শাপ দিলেন, ‘যাঁকে হারাবার জন্যে এত প্রয়াস, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের সময় তোমার রথের চাকা মাটিতে বসে যাবে। সেই সুযোগে সে তোমার মাথা কাটবে।’ কুমারদের অস্ত্রবিদ্যার প্রদর্শনীতে কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে লড়তে চাইলে কৃপ তাঁর বংশ পরিচয় চেয়েছেন। লজ্জায় মাথা নিচু করেছেন কর্ণ। দুর্যোধন কর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিয়েছেন।

স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদী মালা দিতে চান নি সূতপুত্রের গলায়। সে অপমান কর্ণ কখনও ভুলতে পারেন নি। কুরুসভায় দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলে সম্বোধন করে এই অপমানের জ্বালা কিছুটা মিটিয়েছিলেন। কর্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘অর্জুনকে না মেরে অন্যের দ্বারা পা ধোওয়াব না। মদ-মাংস খাব না। কোনও প্রার্থীকে নিরাশ করব না।’

সূর্য ছেলেকে ইন্দ্র সম্বন্ধে আগে থাকতেই সাবধান করে দিয়েছেন। তবু কর্ণ প্রতিজ্ঞা রাখতে ছদ্মবেশী ইন্দ্রের হাতে তাঁর সহজাত কবচ আর কুণ্ডল তুলে দিয়েছেন। ইন্দ্রও তাঁকে মহাশক্তিশালী ‘বৈজয়ন্তী শক্তি’ দিয়েছেন।

নিজের হাতে কবচ কেটে দিয়েছিলেন। তাই নাম হল ‘বৈকর্তন’। কান (কর্ণ) থেকে কুণ্ডল কেটে দিয়েছিলেন। তাই ‘কর্ণ’।

কৃষ্ণ শান্তির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে গেলেন কর্ণের কাছে। কর্ণকে জানালেন তাঁর, অর্থাৎ কর্ণের, আসল পরিচয়। যোগ দিতে বললেন পাণ্ডবপক্ষে। বললেন, কর্ণই রাজা হবেন। অন্য পাঁচ ভাই তাঁর পদতলে বসে তাঁর সেবা করবেন। দ্রৌপদী কর্ণের গলাতেও মালা দেবেন। কর্ণ রাজি হননি।

কুন্তী গেছেন কর্ণের কাছে। নিজের পরিচয় দিয়ে কৃতকর্মের জন্যে অনুতাপ করেছেন। কর্ণকে ঘরে ফেরার মিনতি জানিয়েছেন। ঠিক তখনই সূর্য কর্ণকে দেখা দিয়ে কুন্তীর কথার সত্যতা স্বীকার করেছেন। কর্ণকে বলেছেন, ‘মার কথা শোন। তোমার অশেষ কল্যাণ হবে।’

দুর্যোধনের কাছে কৃতজ্ঞ এবং প্রতিশ্রুত কর্ণ কুন্তীকে শুধু এই আশ্বাস দিয়েছেন, ‘আপনার পাঁচ ছেলেই বেঁচে থাকবে। তবে কর্ণ আর অর্জুনের মধ্যে একজন বাঁচবে। আর একজনকে মরতেই হবে।’

ভীষ্ম সহ্য করতে পারতেন না অহংকারী কর্ণকে। কর্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ‘পিতামহ জীবিত থাকতে আমি অস্ত্র ধরব না।’

কর্ণই ছিলেন দুর্যোধনের আশা ভরসা। কর্ণও দুর্যোধনকে কৃতজ্ঞতা জানাতে নিজেকে নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছেন।

অভিমন্যুবধের দিন সপ্তরথীর মধ্যে কর্ণও ছিলেন। ঘটোৎকচকে মারতে গিয়ে অর্জুনের জন্যে তুলে রাখা ইন্দ্রের দেওয়া ‘বৈজয়ন্তী শক্তি’ প্রয়োগ করেছেন কর্ণ। আনন্দে তুড়ি লাফ লাফিয়েছেন কৃষ্ণ। কারণ, ঘটোৎকচ মারা গেলেও অর্জুন তো বেঁচে গেলেন! অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধের দিন শুরু পরশুরাম আর সেই ব্রাহ্মণের অভিশাপ ফলে গেল। মহাবীর কর্ণ অসহায়ভাবে অর্জুনের কৃপা ভিক্ষা করেও নিস্তার পেলেন না। কৃষ্ণ অর্জুনকে ‘দ্রৌপদীর অপমান’, ‘অভিমন্যুবধ’ ইত্যাদির কথা মনে করিয়ে দিলেন। উত্তেজিত অর্জুন যুদ্ধনীতির সমস্ত কথা ভুলে সব জ্বালা মেটালেন কর্ণের মাথা কেটে।

কর্ণ মহাভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র। তাঁর অহংকার আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘৃণ্য নীচতা বাদ দিলে তিনিই মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র হতে পারতেন। সত্যনিষ্ঠা, দানশীলতা, বীরত্ব, কোনওটাতেই তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না।

কর্ণের স্ত্রী পদ্মাবতীর গর্ভে কর্ণের ‘কৃষ্ণসেন’ ‘বৃষকেতু’ আর ‘চিত্রসেন’ নামে তিন ছেলে হয়।

॥ কর্ণিক ॥

ধৃতরাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী। এঁর কাজই ছিল পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে কথা বলে ধৃতরাষ্ট্রের মনকে বিষিয়ে তোলা।

॥ করেণুমতী ॥

নকুলের অন্যতমা স্ত্রী। চেদিরাজ শিশুপালের মেয়ে। ধৃষ্টকেতুর বোন। এঁর গর্ভজাত নকুলের ছেলের নাম ‘নিরমিত্র’।

॥ কামগীতা ॥

ভীষ্মের উদ্দেশ্যে তর্পণের পর বিষণ্ণতায় ডুবে যান যুধিষ্ঠির। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যে সব ধর্মকথা বলেন তাই ‘কামগীতা’।

॥ কালী ॥

ভীমের অন্যতমা স্ত্রী। মদ্ররাজ শল্যের বোন। অসামান্যা সুন্দরী। এঁর গর্ভজাত ভীমের ছেলের নাম ‘সর্বগত’।

॥ কিন্দম ॥

এক মুনি। মৃগরূপ ধরে এক মৃগীর সঙ্গে সঙ্গম করছিলেন। ওই অবস্থায় না জেনে তাঁকে বাণ মারেন পাণ্ডু। ইনি শাপ দেন পাণ্ডুকে, ‘তুমি কোনও স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলেই তোমার মৃত্যু হবে।’ এবং ঠিক তাই হয়েছিল। একদিন সুসজ্জিতা মাদ্রীকে দেখে সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল পাণ্ডুর। মাদ্রীর বাধা অগ্রাহ্য করে মাদ্রীর সঙ্গে মিলিত হলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ফলে গেল কিন্দমের শাপ। মারা গেলেন পাণ্ডু।

॥ কীচক ॥

বিরাট রাজার শ্যালক। সুদেষ্ণার আদরের ভাই। দুশ্চরিত্র কীচক অজ্ঞাতবাসকালে দ্রৌপদীকে অসম্মানজনক প্রস্তাব দিলে দ্রৌপদী তা প্রত্যাখ্যান করেন। দ্রৌপদীর আর এক প্রস্থ লাঞ্ছনা হয় কীচকের হাতে। ভীম কৌশলে এঁকে শমনসদনে পাঠান।

॥ কুন্তিভোজ ॥

কুন্তীর পালক পিতা। এঁর নাম অনুসারেই পৃথার ‘কুন্তী’ নাম। নিঃসন্তান কুন্তিভোজ মামাতো ভাই শূরসেনের মেয়ে পৃথাকে এনে লালন পালন করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে মারা যান।

॥ কুন্তী ॥

কর্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনের গর্ভধারিনী মা। নকুল আর সহদেবের সৎ মা। পাণ্ডুর স্ত্রী। শূরসেন আর মহিষীর মেয়ে। বসুদেবের বোন। কৃষ্ণের নিজের পিসি। শিশুপালের নিজের মাসি।

অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং বিদুষী।

আসল নাম ‘পৃথা’। শূরসেনের পিসতুতো ভাই কুন্তিভোজ নিঃসন্তান ছিলেন। মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে পৃথাকে চেয়ে নিয়ে পালন করেছিলেন। কুন্তিভোজের পালিতা মেয়ে। তাই নাম ‘কুন্তী’।

দুর্বাসার আশীর্বাদে কুন্তী যে কোনও দেবতাকে ডেকে তাঁর সাহায্যে সন্তান লাভ করতে পারতেন।

মন্ত্র ঠিক মতো কাজ করে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে কুন্তী একদিন সূর্যকে ডেকে বসলেন। তখন কুন্তী কুমারী। সূর্যও নাছোড়বান্দা। শেষে সূর্য সন্তান উৎপাদন করলেন। নবজাতককে এক পেটিকায় শুইয়ে সেই পেটিকা নদীতে ভাসিয়ে দিলেন কুন্তী। সেই শিশুই কর্ণ। পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন। বংশরক্ষার্থে পাণ্ডুরই পীড়াপীড়িতে কুন্তী ধর্মকে ডেকে যুধিষ্ঠিরকে, পবনকে ডেকে ভীমকে, আর ইন্দ্রকে ডেকে অর্জুনকে ছেলে হিসেবে পেলেন। পাণ্ডু এরকম আরও দেসন্তান চেয়েছিলেন। কুন্তী কিছুতেই রাজি হননি। পাণ্ডুর মাধ্যমে মাদ্রী কুন্তীর কাছ থেকে দেবতাদের ডাকার মন্ত্র শিখে দুই অশ্বিনী কুমারকে ডাকলেন। এতে তাঁর দুই যমজ ছেলে হল। মন্ত্র ভুলে যাওয়ায় আবার কুন্তীর শরণাপন্ন হলেন মাদ্রী। কুন্তী। কিন্তু ঈর্ষা বশত আর মন্ত্র শেখালেন না। কুন্তীর মনে ভয়ও ছিল। যদি মাদ্রী আবার যমজ ছেলে প্রসব করে? যদি মাদ্রীর ছেলেরা সংখ্যায় এবং শক্তিতে তাঁর ছেলেদের ছাড়িয়ে যায়?

কুমারদের অস্ত্রবিদ্যার পরীক্ষা নেবার সময় কবচ-কুণ্ডল দেখেই কর্ণকে চিনতে পেরেছেন কুন্তী। জ্ঞান হারিয়েছেন।

কুন্তীর অসাবধানী মন্তব্যেই দ্রৌপদীকে পাঁচ স্বামীর গলায় মালা দিতে হয়েছে। একচক্ৰায় বকবধের ব্যবস্থা কুন্তীই করেছেন।

পাণ্ডবরা তের বছরের জন্যে বনে গেলে কুন্তী বিদুরের বাড়িতেই ছিলেন।

ভীমের গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারী বাণপ্রস্থে গেলে কুন্তী, বিদুর আর সঞ্জয়ও তাঁদের সঙ্গী হয়েছেন।

নারদের মুখে একদিন যুধিষ্ঠির খবর পেলেন, হরিদ্বারের কাছে এক বনের দাবানলে ধ্যানস্থ অবস্থায় প্রাণ দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী আর কুন্তী। নারদ এ খবর শুনেছেন সঞ্জয়ের কাছে। ব্যথায় বুক ভেঙে গেছে যুধিষ্ঠিরের।

যুদ্ধের আগে কর্ণকে নিজের পরিচয় দিয়ে ফেরাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন কুন্তী। উল্টে কর্ণ প্রথমে কিছু কড়া কড়া কথা শুনিয়েছেন। পরে অবশ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে দুর্যোধনের কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে বন্ধ থাকার কারণে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতে অক্ষমতার কথা জানিয়েছেন। বুক ভরা আশা নিয়ে এসে শূন্য হাতে ফিরে গেছেন কুন্তী। নীরবে সইতে হয়েছে সে বেদনা। লোকলজ্জার ভয়ে কর্ণের কথা বলতে পারেননি পাণ্ডুপুত্রদের।

॥ কুরুক্ষেত্র ॥

ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধক্ষেত্র। প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক। পরশুরাম পৃথিবীকে একুশবার নিঃক্ষত্রিয় করে তাঁদের রক্তে এখানে পাঁচটা হৃদ তৈরি করেন। তারপর সেই রক্তে পূর্বপুরুষের তর্পণ করেন।

কুরু বংশের আদিপুরুষ এখানে তপস্যা করে এই বর পান যে এখানে তপস্যা করলে বা যুদ্ধে প্রাণ দিলে স্বর্গলাভ হবে। এইজন্যেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত সকলেই স্বর্গে গিয়েছেন।

॥ কৃতবর্মা ॥

ভোজবংশীয় রাজা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে রাতের অন্ধকারে পাণ্ডবশিবিরে ঘুমন্ত পাণ্ডব-বীরদের ওপর যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলে, তাতে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা, এই তিন জনেই অংশ নেন। যদুবংশ ধ্বংস হবার সময় সাত্যকি এঁকে হত্যা করেন।

॥ কৃপাচার্য ॥

জানপদী নামে অপ্সরাকে দেখে কামার্ত শুরদ্বানের রেতঃপাত হয়। তা থেকে এক ছেলে এবং এক মেয়ে শিশু জন্ম নেয়। শান্তনু কৃপা করে পরিত্যক্ত দুই শিশুকে তুলে আনেন। তাই ছেলেটির নাম হয় ‘কৃপ’। মেয়েটির নাম হয় ‘কৃপী’। পরে দ্রোণ কৃপীকে বিয়ে করেন। কৃপ অর্থাৎ কৃপাচার্য ছিলেন কুরুবংশের রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষাগুরু।

অভিমন্যু বধ আর রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে অশ্বত্থামার নেতৃত্বে নৃশংস নরহত্যা, এঁর দুই উল্লেখযোগ্য কুকীর্তি।

যুদ্ধশেষে পাণ্ডবরা কিন্তু এঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। মহাপ্রস্থানে যাবার সময় কৃপকে পরিক্ষিতের শিক্ষাগুরু হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ইনি দশজন চিরজীবীর অন্যতম।

॥ কৃপী ॥

দ্রোণের স্ত্রী। মহর্ষি শরদ্বাণের মেয়ে। কৃপাচার্যের বোন। অশ্বত্থামার মা। এঁর সম্বন্ধে অন্য তথ্যের জন্যে ‘কৃপাচার্য’ দেখুন।

॥ কৃষ্ণ (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) ॥

ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। মহাভারতের মহানায়ক এবং প্রাণপুরুষ। কংসবধ, কালীয় নাগ দমন, পুতনা বধ, গিরিগোবর্ধন ধারণা, শিশুপাল বধ ইত্যাদি অজস্র কীর্তি কৃষ্ণের। পাণ্ডবদের, বিশেষত অর্জুন এবং দ্রৌপদীর প্রাণসম প্রিয় ছিলেন কৃষ্ণ।

বস্ত্রহরণ, দুর্বাসার আতিথ্য ইত্যাদি থেকে কৃষ্ণই রক্ষা করেছেন তাঁর প্রিয় পাণ্ডবদের। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সারথি ছিলেন। গান্ধারীর শাপে এক ব্যাধের শরে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেন কৃষ্ণ কৃষ্ণ ছিলেন পাণ্ডবদের ‘গতিৰ্ভর্তা-সখা-হরি’। কৃষ্ণ ছাড়া মহাভারত ভাবাই যায় না।

বাবা বসুদেব। মা দেবকী। পালক-পিতা নন্দ ঘোষ। পালিকা-মা যশোদা। মামা কংস। দাদামশাই দেবক। দাদামশাইয়েরই ভাই উগ্রসেনের ছেলে হলেন কংস। কাজেই কংস কৃষ্ণের আপন মামা নন। মার খুড়তুতো দাদা। কুন্তী নিজের পিসি। দেবকীর বিয়ের সময় দৈববাণী হয়েছিল, দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান কংসকে বধ করবে। দৈববাণী শুনে ভয় পেলেন কংস। বোন দেবকী আর জামাই বসুদেবকে কারাগারে বন্দী করে রাখলেন।

দেবকীর পর পর ছ’টি সন্তানকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলেন কংস। সপ্তম সন্তানকে বিষ্ণু যোগমায়ার সাহায্যে পাঠালেন বসুদেবের আর এক স্ত্রী, দেবকীরই বোন রোহিণীর গর্ভে। রোহিণীর গর্ভজাত সেই ছেলের নাম হল ‘বলরাম’।

কংস এসব কিছুই জানতে পারলেন না। ভাবলেন দেবকীর গর্ভপাত হয়ে সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে।

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমী তিথিতে জন্ম হল দেবকীর অষ্টম সন্তান কৃষ্ণের। এদিকে নন্দ ঘোষের স্ত্রী যশোদাও সেদিনই জন্ম দিয়েছেন এক মেয়ের। সেই মেয়েই ‘যোগমায়া’।

দৈব নির্দেশে বসুদেব সেই দুর্যোগের রাতেই এই দুই নবজাত শিশুকে পাল্টাপাল্টি করে দিলেন। বিধাতার অমোঘ নির্দেশে অন্য কেউই জানতে পারল না এই পরিবর্তনের কথা। মহামায়ার কৌশলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল কারারক্ষীরা। পথ দেখালেন শেষনাগ। পথ করে দিলেন যমুনা।

কংস যোগমায়াকে দেবকীর সন্তান ভেবে আছাড় মারতে গেলে যোগমায়া কংসের হাত থেকে ছুটে শূন্যে উঠে গেলেন।

যোগমায়া কংসকে সতর্ক করে বললেন, ‘আমি যোগমায়া! তোমায় যে বধ করবে, সে অন্যের ঘরে বড় হচ্ছে। তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ ভীত সন্ত্রস্ত কংস মথুরার সব শিশুদের হত্যার আদেশ দিলেন। কিন্তু কৃষ্ণের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারলেন না।

কৃষ্ণ বলরাম একসঙ্গে বড় হতে লাগলেন। পুতনা রাক্ষসী, কালীয় নাগ ইত্যাদিকে বধের পর কংসকে বধ করে তাঁর কারারুদ্ধ বাবা উগ্রসেনকেই মথুরার সিংহাসনে বসালেন কৃষ্ণ। সান্দীপনী মুনির কাছে বেদ শিখলেন দু’ভাই। সমুদ্র-দানব পঞ্চজনকে বধ করে ‘পাঞ্চজন্য’ শঙ্খ পেলেন কৃষ্ণ।

বিদর্ভের রাজা ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণী ছিলেন চেদিরাজ শিশুপালের বাগ্‌দত্তা। কিন্তু মনে মনে কৃষ্ণকেই ভালবাসতেন রুক্মিণী। সে খবর পেয়ে রুক্মিণীকে হরণ করলেন কৃষ্ণ। যুদ্ধে গো-হারা হেরে পালালেন শিশুপাল। রুক্মিণীর গর্ভে ‘প্রদ্যুম্ন’ ইত্যাদি দশ ছেলে আর ‘চারুমতী’ নামে এক মেয়ে হল কৃষ্ণের।

রুক্মিণী বাদে কৃষ্ণের আরও চার প্রধানা মহিষী ছিলেন। জাম্ববতী, সুশীলা, সত্যভামা আর লক্ষ্মণা। এক মতে, এছাড়াও কৃষ্ণের আরও ষোল হাজার স্ত্রী ছিলেন। মহাভারতে কৃষ্ণ প্রথম দেখা দিলেন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায়। পিসতুতো ভাই অর্জুনকে চিনতে পেরেছেন কৃষ্ণ। মামাতো-পিসতুতো দুই ভাইয়ের এই দৃষ্টি বিনিময় থেকে যে প্রেমের জন্ম তা-ই মহাভারতের প্রধান উপজীব্য। সেই স্বার্থগন্ধহীন ভালবাসাই মহাভারতকে অমর করে রেখেছে।

কৃষ্ণেরই ইঙ্গিতে এবং সহায়তায় তাঁর বোন সুভদ্রাকে হরণ করেছেন অর্জুন। কৃষ্ণেরই পরামর্শে এবং কৌশলে ভীমের হাতে প্রাণ দিয়েছেন মগধের দুরাচার রাজা জরাসন্ধ।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য কৃষ্ণকে দেওয়া হলে কৃষ্ণেরই পিসতুতো ভাই চেদিরাজ শিশুপাল অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন কৃষ্ণকে।

শিশুপালের মাকে, অর্থাৎ নিজের পিসিমাকে কৃষ্ণ কথা দিয়েছিলেন, শিশুপালের একশ’ অপরাধ ক্ষমা করবেন। অপরাধের সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়ে গেছে কবেই। সুতরাং আর ক্ষমা না করে সুদর্শন চক্রে শিশুপালকে বধ করলেন কৃষ্ণ।

পাশা খেলায় হেরে পাণ্ডবরা বনে গেলে কাম্যক বনে কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে দেখা করে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। দ্রৌপদীকে কথা দিয়েছেন কৃষ্ণ, ‘আমি তোমাদের জন্যে যা করতে হয়, সব করব। তুমি শোক কর না। সত্যি বলছি, তুমি রাজরাণী হবে দ্রৌপদী।’ দশ হাজার ক্ষুধার্ত শিষ্য নিয়ে দুর্বাসা এসেছেন পাণ্ডবদের বনবাসের কুটীরে অতিথি হয়ে। দুর্যোধনের চক্রান্ত। সবার খাওয়া শেষ। কৃষ্ণগতপ্রাণা দ্রৌপদী কেঁদে পড়লেন, ‘হে কেশব! রক্ষা কর!’

এলেন কেশব! ‘থালার কানায় এক কণা ভাত ছাড়া আর কিছুই নেই যে!’ দ্রৌপদীর অকপট আত্ম-সমার্পণ।

‘ওতেই হবে। তাই দাও।’ এক কণাতেই তৃপ্ত হলেন জগন্নাথ। দুর্বাসা আর তাঁর দশ হাজার শিষ্যেরও তখন উদরপূর্তি হয়ে হেউ-ঢেউ অবস্থা। পালিয়ে মান বাঁচালেন সশিষ্য দুর্বাসা।

উত্তরা অভিমন্যুর বিয়ের পরদিন বিরাট রাজার বাড়িতে পাণ্ডবদের রাজ্য উদ্ধারের জন্যে আলোচনা করতে সভা বসেছে। হস্তিনাপুরে দূত পাঠাবার প্রস্তাব দিলেন কৃষ্ণ। ‘যুধিষ্ঠিরকে অর্ধেক রাজ্য ফেরৎ দিতে হবে, এ কথাই বলবেন দূত।’ বলরাম ছাড়া আর সবাই এতে সায় দিলেন। দ্রুপদের পুরোহিতকে পাঠানো হল দূত হিসেবে।

দুর্যোধন আর অর্জুন দুজনেই এসেছেন কৃষ্ণকে নিজেদের দলে পেতে। কৃষ্ণ ঘুমোচ্ছিলেন। দুর্যোধন আগে এসেছেন। বসলেন কৃষ্ণের মাথার দিকে। অর্জুন পরে এসেছেন। বসলেন পায়ের কাছটিতে।

কৃষ্ণ বললেন, ‘আমি চোখ খুলে আগে অর্জুনকেই দেখেছি। তা ছাড়া সে বয়সেও ছোট। আগে তার ইচ্ছে পূরণ করব। হয় আমাকে নিতে পার, নয় আমার এক অর্বুদ (দশ কোটি) নারায়ণী সেনাকে নিতে পার। আমি কিন্তু অস্ত্র ধরব না, বা যুদ্ধও করব না।’ অর্জুন কৃষ্ণকেই চাইলেন। দুর্যোধন অর্জুনের বোকামিতে বিস্মিত হয়ে খুশি মনে হস্তিনায় ফিরলেন।

যুদ্ধ বদ্ধের শেষ চেষ্টা করতে কৃষ্ণ এসেছেন হস্তিনায়। অসাধারণ বক্তব্য রেখেছেন। দুর্যোধন বললেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে একটি সূচের ডগায় যতটা মাটি ধরে, তাও বিনা যুদ্ধে দেব না পাণ্ডবদের।’

কৃষ্ণ নরমে গরমে বোঝালেন দূর্যোধনকে। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর এমন কি গান্ধারীও সভায় এসে বোঝালেন। কাজ হল না। উল্টে দুর্যোধন কৃষ্ণকে বন্দী করতে চাইলেন। কৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখালেন। কৃষ্ণের কৃপায় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও দেখতে পেলেন সে বিশ্বরূপ।

কর্ণের কাছে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেবার আবেদন নিয়ে গেছেন কৃষ্ণ। কর্ণের আসল পরিচয় জানিয়েছেন তাঁকে। কর্ণ বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অক্ষমতার কথা জানিয়েছেন। শূন্য হাতে ফিরে গেছেন কৃষ্ণ।

যুদ্ধ শুরু হবে। অর্জুনের রথের সারথি ‘পার্থসারথি’ কৃষ্ণ। উল্টোদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য ইত্যাদি গুরুজনকে দেখে অর্জুন বললেন, ‘আমার রাজ্যলাভে কাজ নেই। আমি যুদ্ধ করব না। এঁদের বধ করে আমি রাজ্যলাভ করতে চাই না।’

কৃষ্ণ অর্জুনকে সমগ্র মহাভারতের সার কথা ‘গীতা’ বললেন। অর্জুনের মোহ কেটে গেল। অস্ত্র হাতে নিলেন অর্জুন।

যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ভয়ঙ্কর ভীষ্মকে সংহার করতে প্রতিজ্ঞা ভুলে চক্র হাতে তেড়ে গেলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণভক্ত ভীষ্ম এতে যৎপরোনাস্তি খুশি হয়েছেন। যুদ্ধের নবম দিনেও একই ঘটনা ঘটেছে আবার।

কৃষ্ণের পরামর্শেই ভীষ্মবধের উপায় স্বয়ং ভীষ্মের মুখ থেকেই শুনেছেন পাণ্ডবরা। দ্রোণবধের জন্যে ‘অশ্বত্থামা হতঃ, ইতি কুঞ্জর।’ সূত্রও কৃষ্ণেরই দেওয়া। জীবনরক্ষার প্রয়োজনে মিথ্যে বললে তাতে পাপ নেই, এই ছিল কৃষ্ণের যুক্তি।

কর্ণের আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে চরম অপমানের জ্বালা নিয়ে যুধিষ্ঠির ফিরে এসেছেন তাঁবুতে। অর্জুনকে ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি আর সব শত্রুকে একাই বধ করার অহঙ্কার করো না। গাণ্ডীব ফেলে দাও। গাণ্ডীব তোমাকে শোভা পায় না।’ অর্জুন কাটতে গেলেন যুধিষ্ঠিরকে। কারণ তাঁর প্রতিজ্ঞাই ছিল, কেউ তাঁর গাণ্ডীবের নিন্দে করলে তাকে বধ করবেন।

কৃষ্ণ আটকালেন। তিরস্কার করলেন অর্জুনকে। তারপর পরামর্শ দিলেন অর্জুন যেন প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করেন। কারণ, গুরুজনকে তিরস্কার করাও যা, বধ করাও তা।

প্রায়শ্চিত্ত করতে এবার আত্মহত্যা করতে গেলেন অর্জুন। আবার কৃষ্ণের ভর্ৎসনা। আবার পরামর্শ, ‘নিজের মুখে নিজের প্রশংসা কর। তাই আত্মহত্যার সমান।’

কৃষ্ণ যে পাণ্ডবদের কত আপনার জন ছিলেন এ থেকেই তা বোঝা যায়।

অভিমন্যুবধের পর জয়দ্রথকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করলেন অর্জুন। এবং তা করবেন পরদিন সূর্যাস্তের আগেই। না পারলে আগুনে আত্মাহুতি দেবেন। হঠাৎ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে প্রায় অসম্ভব এক প্রতিজ্ঞা করে ফেলছেন। অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা করেননি। এবারেও ‘ত্রাহি মধুসূদন’ সেই কৃষ্ণ। সূর্যাস্তের আগেই মায়াবলে ঢেকে দিয়েছেন সূর্যকে। অর্জুনের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে দুর্ভেদ্য ব্যূহের ভেতর থেকে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এসেছেন সুরক্ষিত জয়দ্ৰথ। কৃষ্ণ মায়ামেঘ সরিয়ে দিয়েছেন। অর্জুন হত্যা করেছেন অসহায় জয়দ্রথকে।

কিন্তু জয়দ্রথের মাথা মাটিতে পড়লে যিনি মাথা মাটিতে ফেলবেন, তাঁর মাথাও সঙ্গে সঙ্গেই উড়ে যাবে, এই ছিল জয়দ্রথের বাবা বৃদ্ধক্ষত্রের ঘোষণা। তাই কৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন বাণে বাণে জয়দ্রথের কাটামুণ্ডকে নিয়ে ফেললেন সমন্তপঞ্চকের বাইরে, বহু দূরে তপস্যারত জয়দ্রথের বাবা বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে। চমকে উঠে ছেলের মাথা মাটিতে ফেলতেই নিজের মাথাও উড়ে গেল বৃদ্ধক্ষত্রের। নিজের শাপে নিজেই প্রাণ হারালেন। কৃষ্ণের সাহায্য না পেলে অর্জুনকে সেদিন প্রাণ দিতেই হত। আর অর্জুনকে বাদ দিয়ে পাণ্ডবদের জয় ছিল অসম্ভব।

কর্ণবধের দিন নানারকম উত্তেজক কথাবার্তা বলে অর্জুনের কর্ণবধের প্রতিজ্ঞাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কৃষ্ণ। কর্ণের রথের চাকা বসে গেছে মাটিতে। কর্ণ এক মুহূর্ত সময় ভিক্ষে করলেন অর্জুনের কাছে। বললেন, ‘এটাই ধর্ম। যুদ্ধশাস্ত্রের এটাই নীতি।’ কৃষ্ণ দেখলেন, কর্ণবধের এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। অর্জুনকে উত্তেজিত করতে কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, ‘কর্ণ! এখন যে বড় ধর্ম আর নীতিজ্ঞান নিয়ে উপদেশ দিচ্ছ? বিষ খাইয়ে ভীমকে মেরে ফেলার ঘৃণ্য চক্রান্তের সময়, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়, জতুগৃহে পাণ্ডবদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্রের সময়, বনবাসের শেষে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে না দেবার সময়, অন্যায়ভাবে অসহায় বালক অভিমন্যুকে বধ করার সময় তোমার এ সব নীতিজ্ঞান কোথায় ছিল?’

ব্যস! এতে যাদুর মতো কাজ হল। অর্জুন আর কিন্তু কিন্তু না করে কর্ণকে বধ করলেন।

কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে চিন্তাই করা যায় না।

দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকিয়ে থাকা দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আমাদের পাঁচ ভাইয়ের যে কোনও একজনকে গদাযুদ্ধে হারাতে পারলেই তোমাকে জয়ী বলে মেনে নেব।’

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘আপনার কি আবার বনবাসে যাবার সখ হয়েছে? দুর্যোধন যদি ভীম ছাড়া আর কারো সঙ্গে লড়তে চায়?’

অহঙ্কারী দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের দেওয়া সুযোগ নিলেন না। আবার একবার নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলেন পাণ্ডবরা। জানি না, এক্ষেত্রেও দুর্যোধনের বুদ্ধিকে কৃষ্ণই অহঙ্কারের মোড়কে ঢেকে রেখেছিলেন কিনা।

ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনের উরু ভাঙায় বলরাম তেড়ে মারতে এসেছেন ভীমকে। কৃষ্ণ না বাঁচালে ভীমকে সেদিন মরতেই হত।

যুদ্ধের শেষে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন কৃষ্ণ। অবতার যে স্বাভাবিক মানুষের মতোই আচরণ করেন, এ তারই এক প্রমাণ।

অশ্বত্থামা সেই রাতেই কৃষ্ণ আর পাণ্ডবদের অনুপস্থিতিতে রাতের অন্ধকারে দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ইত্যাদিকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছেন। ভীম সব শুনে তাড়া করেছেন অশ্বত্থামাকে। অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির নামে এক দিব্যাস্ত্র ছুঁড়লেন। অর্জুনও পাল্টা দিব্যাস্ত্র ছুঁড়লেন।

দুই দিব্যাস্ত্রের হাত থেকে সৃষ্টিকে বাঁচাতে অশ্বত্থামার অস্ত্রে মারা গেল উত্তরার গর্ভস্থ অভিমন্যুর সন্তান, পাণ্ডবদের একমাত্র বংশধর, পরিক্ষিৎ। কিন্তু কৃষ্ণের কৃপায় পরে ভূমিষ্ঠ হয়ে আবার সে প্রাণ ফিরে পেল। বিনিময়ে অশ্বত্থামাকে পাণ্ডবদের হাতে তুলে দিতে হল তাঁর ‘নয়নের মণি’ তাঁর সহজাত মাথার মণিকে।

ধৃতরাষ্ট্র আলিঙ্গন করতে চাইলেন ভীমকে। কৃষ্ণ জানতেন কী ঘটবে। তাঁর পরামর্শে লোহার ভীম আগে থেকেই তৈরি ছিল। তাকেই আলিঙ্গনের ছলে সত্যিকারের ভীম ভেবে ভেঙে চুরমার করলেন ধৃতরাষ্ট্র। আর একবার ভীমের জীবন বাঁচালেন কৃষ্ণ।

শোকে পাথর হয়ে যাওয়া গান্ধারী অভিশাপ দিলেন কৃষ্ণকে। ‘হে কৃষ্ণ! তুমি তো ইচ্ছে করলেই এই বিপর্যয় ঠেকাতে পারতে। আমি অভিশাপ দিচ্ছি আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পরে তোমার বংশও ধ্বংস হবে। বনে বনে ঘুরে বেড়াবে তুমি। শোচনীয়ভাবে মৃত্যু হবে তোমার। কুরুবংশের বিধবাদের মতো যদুবংশের বিধবাদের আর্তনাদেও আকাশ বাতাস মুখরিত হবে।’

কৃষ্ণ মুচকি হেসে বললেন, ‘এরকম যে হবে, তা আমি জানি।’

শরশয্যায় শুয়ে থাকা পরমভক্ত ভীষ্মকে শেষবারের মতো দেখা দিলেন কৃষ্ণ। দেখালেন তাঁর জ্যোতির্ময় রূপ! শান্তিতে দেহ ছাড়লেন ভীষ্ম।

দ্বারকায় ফিরে গিয়ে আবার যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে এসেছেন কৃষ্ণ। ঠিক তখনই মৃতপুত্র প্রসব করেছেন উত্তরা। সবাই কাঁদছেন। কৃষ্ণ আগের প্রতিজ্ঞা মতো বাঁচালেন সেই মৃতপুত্ৰ পরিক্ষিৎকে।

গান্ধারীর অভিশাপ দেবার পর পয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। যদুবংশ ধ্বংস হচ্ছে। বলরাম যোগবলে দেহ ছেড়েছেন।

বিষণ্ণ কৃষ্ণ ধ্যানস্থ ছিলেন এক গাছের তলায়। হরিণ ভেবে তীর ছুঁড়ল একব্যাধ। সেই তীর এসে বিদ্ধ হল কৃষ্ণের পায়ে। অবতারলীলা শেষ করে ভগবান ফিরে গেলেন বিষ্ণুদেহে। বিষ্ণুলোকে। আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৭ বছর নরদেহে থেকে অবতারলীলা করে গেছেন কৃষ্ণ।

কৃষ্ণ যে মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র এবং মহাভারতের প্রাণপুরুষ, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই।

কেন তাঁর এই মর্তলোকে দেহধারণ করা, তার উত্তর তো তিনিই দিয়েছেন—

‘যদা যদা হি ধর্মস্য

গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য

তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥

পরিত্রাণায় সাধুনাং।

বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্॥

ধর্মসংস্থাপনার্থায়

সম্ভবামি যুগে যুগে॥

(শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা, চতুর্থ অধ্যায়, সপ্তম এবং অষ্টম শ্লোক।’)

অর্থাৎ

‘হে ভারত (অর্জুন), ধর্ম যখনই গ্লানিযুক্ত হয়, অধর্মের যখন অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি দেহধারণ করি। দুষ্কৃতিদের বিনাশ করে সাধুদের রক্ষা করার জন্যে আর (অধর্মকে উচ্ছেদ করে আবার) ধর্মকে সংস্থাপন করতে আমি যুগে যুগে (অবতাররূপে এই মর্তলোকে) আবির্ভূত হই।’

॥ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ॥

‘ব্যাসদেব’ দেখুন।

॥ কৃষ্ণা ॥

‘দ্রৌপদী’ দেখুন।

॥ কৌমোদকী ॥

কৃষ্ণের গদা। খাণ্ডবদাহনের সময় বরুণের কাছ থেকে চেয়ে অগ্নি কৃষ্ণকে দিয়েছিলেন।

॥ কৌরব ॥

কুরুর বংশধর। এই হিসেবে পাণ্ডু এবং তাঁর ছেলেরাও কৌরব। কিন্তু তাঁরা নিজেদের বাবার নামে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করতেন।

॥ খাণ্ডব বন ॥

খাণ্ডবপ্রস্থের এক বন। অগ্নি ক্ষুধার্ত হয়ে এই বনকে পুড়িয়ে খেতে চাইলে কৃষ্ণ আর অর্জুন সাহায্য করেন। অগ্নি তাঁদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র উপহার দেন।

॥ গঙ্গা ॥

ভীষ্মের গর্ভধারিণী। শান্তনুর স্ত্রী। পরপর সাত সন্তানকে জন্মের পরেই গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। অষ্টম সন্তানকে জলে ফেলতে গেলে ক্ষুব্ধ শান্তনু বাধা দেন। পূর্বশর্ত ভঙ্গ করে জানতে চান তাঁর এরকম বিসৃদশ আচরণের ব্যাখ্যা। গঙ্গা সব খুলে বলেন শান্তনুকে। শাপভ্রষ্ট অষ্টবসু গঙ্গার গর্ভে জন্মেছিলেন। যাতে জন্মলগ্নেই আবার স্বর্গে ফিরতে পারেন, তাই গঙ্গার এই ব্যবস্থা।

শান্তনুর অনুরোধে অষ্টম বসু ‘দ্যু’-র অংশজাত দেবব্রতকে নিজের কাছে ছত্রিশ বছর রেখে উচ্চশিক্ষা দিয়ে আবার শান্তনুর হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন গঙ্গা।

॥ গান্ধারী ॥

কৌরবমাতা। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী। দুর্যোধন এবং তাঁর নিরানব্বই ভাই আর এক বোন দুঃশলার মা। গান্ধাররাজ সুবলের মেয়ে।

ব্যাসদেব গান্ধারীকে বর দিয়েছিলেন, ‘তুমি শত পুত্রের জননী হবে।’ কুন্তীর সুর্যতুল্য সন্তান যুধিষ্ঠিরের জন্ম হল। অথচ তাঁর সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে না। অধৈর্য হলেন গান্ধারী। গর্ভপাত করালেন। লৌহ কঠিন এক মাংসপিণ্ড বেরোল পেট থেকে। ব্যাসদেবের পরামর্শে প্রথমে ঠাণ্ডা জলে তারপর একশ’টা ঘি-ভরা কলসিতে রাখা হল সেই পিণ্ডের একশ’টা টুক্‌রো। অন্য আর একটা কলসিতে রাখা হল আরও এক টুক্‌রো। এক বছর পরে সেই পিণ্ডের টুক্‌রোগুলোর একটা থেকে জন্ম হল দুর্যোধনের। একই দিনে জন্মালেন ভীম। ধীরে ধীরে গান্ধারীর বাকি নিরানব্বই ছেলের জন্ম হল। সবার শেষে জন্মালেন দুঃশলা। ব্যাসদেবের বর সত্য হল। গান্ধারীর প্রজ্ঞা, ত্যাগ, মহত্বের তুলনা নেই।

॥ গাণ্ডীব ॥

অর্জুনের ধনুক। ব্রহ্মা তৈরি করেন এই ধনুক। ব্রহ্মার কাছ থেকে পান চন্দ্র। চন্দ্রের থেকে বরুণ। খাণ্ডবদাহের সময় অগ্নি বরুণের কাছ থেকে চেয়ে গাণ্ডীব দিয়েছিলেন অর্জুনকে। যুদ্ধে অপমানিত যুধিষ্ঠির অর্জুনকে গাণ্ডীব ত্যাগ করতে বললে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে কাটতে যান। কারণ, অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ছিল, কেউ গাণ্ডীবের অপমান করলে তাকে তিনি কাটবেন। মহাপ্রস্থানের পথে যাবার সময় অগ্নির নির্দেশে অর্জুন গাণ্ডীব আর অক্ষয় তুণীর বরুণের উদ্দেশ্যে জলে ফেলে দেন।

॥ গিরিব্রজ ॥

জরাসন্ধের রাজধানী। বর্তমান রাজগির।

॥ গীতা ॥

মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত আঠের পর্বে সমাপ্ত শ্রেষ্ঠ অংশ। করুক্ষেত্রের যুদ্ধে হতোদ্যম অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে যে মহার্ঘ উপদেশ দিয়েছেন, তাই গীতা।

সাতশ’ শ্লোক আছে বলে গীতার এক নাম ‘সপ্তশতী’। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, গীতার অর্থ হল, গীতাকে ওল্টালে যা হয়, তাই। তাগী (ত্যাগী)। ‘ত্যাগ’ এবং ‘তাগ্‌’ একই ‘তগ্‌’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন এবং সমার্থক।

॥ গুড়াকেশ ॥

নিদ্রাকে জয় করেছিলেন বলে জিতনিদ্র অর্জুনের এক নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ গ্রন্থিক ॥

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন নকুলের ছদ্মনাম। ‘নকুল’ দেখুন।

॥ ঘটোৎকচ ॥

হিড়িম্বার গর্ভজাত ভীমের ছেলে। বিশাল এবং বীভৎস চেহারা ছিল এঁর। মহাবলশালী। ঘটের মতো মাথা কচ (চুল) শূন্য ছিল বলে এঁর নাম ঘটোৎকচ।

স্মরণ করলেই পাণ্ডবদের সাহায্যে হাজির হতেন ঘটোৎকচ। দ্রৌপদীকে একবার পিঠে করে বয়ে নিয়ে গেছেন গন্ধমাদন পর্বতে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এক অক্ষৌহিনী ভয়ংকর রাক্ষস সেনা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে কর্ণকে উত্তেজিত করেছেন দুর্যোধন। অর্জুনকে মারবার জন্যে ইন্দ্রের দেওয়া যে ‘বৈজয়ন্তী শক্তি’ তুলে রেখেছিলেন কর্ণ, সেই অস্ত্রে সংহার করলেন ঘটোৎকচকে। ঘটোৎকচের মৃত্যুতে পাণ্ডবশিবিরে সবাই যখন শোকে ভেঙে পড়েছেন, কৃষ্ণ তখন খুশি। কারণ, কর্ণ আর অর্জুনকে বধ করতে পারবেন না।

মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ঘটোৎকচ মায়াবলে দেহকে আরও বিশাল করেছেন। তাঁর দেহের চাপে পিষ্ট হয়ে এক অক্ষৌহিণী কুরুসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।

॥ ঘৃতাচী ॥

স্বর্গের অপ্সরা। স্নানরতা অবস্থায় এঁকে দেখে রেতঃপাত হয় ভরদ্বাজ মুনির। সেই শুক্র এক কলসে ধরে রাখা হয়। সেই কলসেই (দ্রোণ) জন্ম হয় দ্রোণের।

॥ চক্ৰব্যূহ ॥

চক্রের আকারে দুর্ভেদ্য এক সৈন্য-সজ্জা। অভিমন্যুবধের দিন দ্রোণ এই চক্রব্যূহ রচনা করেছিলেন। পাণ্ডবপক্ষে একমাত্র অর্জুন এই ব্যূহে ঢোকার এবং ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় জানতেন।

অভিমন্যু শুধু ঢোকার উপায় জানতেন। বেরোবার উপায় জানতেন না। আর সে কারণেই তাঁকে সপ্তরথীর হাতে প্রাণ দিতে হয় অসহায়ভাবে।

॥ চিত্রসেন ॥

স্বর্গের এক গন্ধর্ব। নাচগানের শিক্ষক। অর্জুন এঁর কাছেই নাচগানের তালিম নেন। গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর ছেলে।

দ্বৈতবনে ‘ঘোষযাত্রা’-র নামে পাণ্ডবদের বনবাসের দুর্দশা দেখতে এসে এঁর হাতে বন্দী হন সপার্ষদ দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে গুরু চিত্রসেনের সাথে যুদ্ধ করে অর্জুন তাঁদের মুক্ত করেন।

॥ চিত্রাঙ্গদ ॥

সত্যবতীর গর্ভজাত শান্তনুর ছেলে। শান্তনুর মৃত্যুর পর রাজা হন। গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদের হাতে অল্পবয়সেই যুদ্ধে প্রাণ দেন।

॥ চিত্রাঙ্গদা ॥

অর্জুনের স্ত্রী। বভ্রুবাহনের মা। মণিপুরের রাজা চিত্ৰবাহনের মেয়ে। বার বছর ব্রহ্মচর্য পালনের নামে বেরিয়ে অর্জুন এঁকে বিয়ে করেন এঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে। এঁর গর্ভজাত অর্জুনের ছেলের নাম বভ্রুবাহন।

॥ চেকিতান ॥

যদুবংশীয় বীর।

॥ চেদি ॥

নর্মদা আর গোদাবরীর অন্তর্গত দেশ। শিশুপাল এখানকার রাজা ছিলেন। বর্তমান জব্বলপুরের কাছাকাছি।

॥ জতুগৃহ ॥

লাক্ষা, খড়, শন, পাট ইত্যাদি নানারকম সহজদাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি বাড়ি। বারণাবতে পাণ্ডবদের জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার চক্রান্তে দুর্যোধনরা এক জতুগৃহ তৈরি করান। বিদুর এক খনক পাঠিয়ে সতর্ক করেছেন যুধিষ্ঠিরকে। বেঁচে গেছেন পাণ্ডবরা।

জতুগৃহে আগুন লাগান ভীম। তারপর পালান খনকের কাটা সুড়ঙ্গপথে। এক নিষাদী তাঁর পাঁচ ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়েছিল জতুগৃহে। তারা ছ’জনই পুড়ে মরে। দুর্যোধনরা ভাবেন, কুন্তী আর পাঁচ পাণ্ডব পুড়ে মারা গেছেন। বাইরে নকল শোক দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে আনন্দিত হন তাঁরা।

॥ জনমেজয় ॥

অর্জুনের নাতি। পরিক্ষিৎ আর মাদ্রবতীর ছেলে। বপুষ্টমার স্বামী। এঁর ছেলে শতানীক। শতানীকের ছেলে অশ্বমেধদত্তই মহাভারতের শেষ পুরুষ।

শমিক মুনির গলায় মরা সাপ জড়াবার পাপে এঁর বাবার সার্পাঘাতে মৃত্যু হয়। তাই ইনি এক সর্পযজ্ঞ করেন। তাতে বহু সাপ যজ্ঞঅগ্নিতে দগ্ধ হয়। কিন্তু এঁর পিতৃহন্তা তক্ষক ইন্দ্র আর নাগরাজ বাসুকির ভাগ্নে আস্তীকের কৌশলে রক্ষা পান।

ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে জনমেজয় একবার বৈশম্পায়নের কাছে সমগ্র মহাভারত শোনেন।

॥ জয়দ্রথ ॥

দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী। বৃদ্ধক্ষত্রের ছেলে। সিন্ধুর রাজা। সুরথের বাবা। কাম্যকবনে থাকাকালীন দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে ভীমের হাতে বেদম প্রহার খান। যুধিষ্ঠির ক্ষমা না করলে ভীম মেরেই ফেলতেন। ভীম মাথা নেড়া করে ছেড়ে দেন।

অপমানের প্রতিশোধ নিতে মহাদেবের ধ্যান করেন। মহাদেব বর দেন, অন্তত একদিন অর্জুন ছাড়া আর চার পাণ্ডবকে তিনি হারাতে পারবেন। পাষণ্ড জয়দ্রথ সেই বরকে কাজে লাগান বালক অভিমন্যুকে বধ করার দিন। তিনি চক্রব্যূহের মুখ আগলে রাখায় অভিমন্যুর সাহায্যে কেউ ব্যূহে ঢুকতে পারেননি। অর্জুনকে অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছিলেন ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা। অর্জুন পরদিন সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথ বধ না করতে পারলে আগুনে আত্মাহুতি দেবার প্রতিজ্ঞা করেন।

কৃষ্ণ মায়া-মেঘে সূর্যকে ঢেকে দিলে ‘সূর্যাস্ত হয়ে গেছে’ ভেবে আনন্দে জয়দ্রথ ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসেন। কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন জয়দ্রথের মাথা কেটে সেই কাটা মাথাকে বাণে বাণে নিয়ে ফেলেন তাঁর বাবার কোলে। বাবা বৃদ্ধক্ষত্র সেই মাথা মাটিতে ফেলতেই তাঁর নিজের কথামতোই নিজের মাথাটি উড়ে যায়। বৃদ্ধক্ষত্র বলেছিলেন, ‘যে জয়দ্রথের মাথা মাটিতে ফেলবে, তার মাথা উড়ে যাবে।’

॥ জরাসন্ধ ॥

মগধের রাজা। বৃহদ্রথের ছেলে। এঁর জামাই কংস। কংস এঁর দুই মেয়ে অস্তি আর প্রাপ্তিকে বিয়ে করেন। এঁর ছেলে সহদেব।

বৃহদ্রথের সন্তান ছিল না। মহর্ষি চণ্ডকৌশিক এক মন্ত্রপূত আম দিয়ে বললেন এই আম তাঁর স্ত্রীকে খাওয়ালে এক অসামান্য ছেলে হবে।

বৃহদ্রথ দুই স্ত্রীকে সমান দু ভাগে ভাগ করে আমটা খাওয়ালেন। দুই স্ত্রী অর্ধেক দেহবিশিষ্ট দুই শিশু প্রসব করলেন। ধাত্রীরা সেই দুই দেহার্ধ শ্মশানে ফেলে এলেন। রাক্ষসী ‘জরা’ দু’ টুক্‌রোকে জুড়ে দিতেই নবজাতক বেঁচে উঠলেন। তাই ‘জরাসন্ধ’ নাম।

জামাই কংসের হন্তা কৃষ্ণকে হত্যা করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন জরাসন্ধ।

অত্যাচারী জরাসন্ধকে বধ করতে কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁর কাছে যান। ভীমের সাথে অনেকদিন ধরে লড়াই হয় জরাসন্ধের। শেষে কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম তাঁর দু’পা ধরে ‘জরা’র দেওয়া জোড় বরাবর টেনে ছিঁড়ে দু’টুকরো করে মেরে ফেলেন জরাসন্ধকে।

॥ তক্ষক ॥

প্রধান আট সাপের একজন। অন্য নাম ‘অনন্তনাগ’। বাসুকির ভাই।

অগ্নির খিদে মেটাতে খাণ্ডববন পোড়াতে সাহায্য করেন কৃষ্ণার্জুন। তক্ষক তখন বনের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। তাঁর স্ত্রী-পুত্র পালাতে গিয়ে অর্জুনের তীরে বিদ্ধ হন। পরিক্ষিৎ শমিক মুনির গলায় মরা শাপ জড়িয়ে দিলে মুনির ছেলে শৃঙ্গী শাপ দেন সাতরাতের মধ্যে তক্ষকের দংশনে পরিক্ষিতের মৃত্যু হবে। হলও তাই। তক্ষক স্ত্রী-পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিলেন।

॥ তন্তিপাল ॥

অজ্ঞাতবাসকালে সহদেবের ছদ্মনাম। ‘সহদেব’ দেখুন।

॥ তারা ॥

তারা ছিলেন দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী। এঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্র এঁকে হরণ করেন। তখনই তারার গর্ভে বুধের জন্ম হয়। ব্রহ্মার উদ্যোগে তারাকে ফিরে পান বৃহস্পতি।

॥ তুর্বসু ॥

যযাতি আর দেবযানীর ছেলে।

॥ দমঘোষ ॥

চেদিরাজ। শিশুপালের বাবা। কুন্তীর জামাইবাবু। কৃষ্ণের পিসেমশাই।

॥ দুঃশলা ॥

গান্ধারীর গর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রের মেয়ে। একশ’ এক সহোদর ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। জয়দ্রথের স্ত্রী। এঁর ছেলে সুরথ। দুঃশলা সম্বন্ধে মহাভারতে বিশেষ কোনও তথ্য জানা যায় না।

॥ দুঃশাসন ॥

গান্ধারীর গর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় সন্তান। দুর্যোধনের সব দুষ্কর্মে সঙ্গী। সার্থকনামা। ভীমকে বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দেওয়া, পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা, পাণ্ডবদের দু’দুবার কপট পাশায় হারিয়ে বনে পাঠানো, বনে তাঁদের দুর্দশা দেখতে যাওয়া, সভায় দ্রৌপদীর চুল ধরে টানা, দ্রৌপদীকে সবার সামনে বিবস্ত্রা করার চেষ্টা করা ইত্যাদি কুকর্মের শেষ নেই দুঃশাসনের। দাদার যোগ্য ভাই। ভীম প্রতিজ্ঞা রাখতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এঁর বুক চিরে এঁর রক্ত দিয়ে কুলকুচি করেছেন। গান্ধারীকে ভীম বলেছেন, তিনি প্রতিজ্ঞা রক্ষার্তে রক্ত ঠোঁটে ঠেকিয়েছেন মাত্র। খাননি।

॥ দুর্বার্সা ॥

অত্রি এবং অনসূয়ার ছেলে। ভয়ঙ্কর ক্রোধী মুন। কথায় কথায় শাপ দেন। এঁর বরেই কুন্তী দেবতাদের ডেকে সন্তান লাভ করেন।

দুর্বাসার শাপেই শকুন্তলাকে ভুলে গিয়েছিলেন দুষ্মন্ত। দুর্যোধনের কপট কৌশলে পাণ্ডবদের বনবাসকালে হঠাৎ দশ হাজার শিষ্য নিয়ে পাণ্ডবদের আতিথ্য নিয়েছিলেন দুর্বাস। দ্রৌপদীর প্রার্থনায় কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে দেওয়া সূর্যের বিশেষ থালা থেকে শাকান্নমাত্র খাওয়ায় সশিষ্য দুবার্সার পেট ভরে যায়। দলবল সমেত দুর্বাসা চম্পট দেন। কৃষ্ণের কৃপায় দুর্বাসার শাপ থেকে রক্ষা পান পাণ্ডবরা।

॥ দুর্যোধন ॥

গান্ধারীর গর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ছেলে। ভীম আর দুর্যোধন একই দিনে জন্ম গ্রহণ করেন। কলির অংশে জন্মেছেন দুর্যোধন। যুধিষ্ঠির তাঁর শুভবুদ্ধির উদয় কামনা করে তাঁকে সর্বদাই ‘সুযোধন’ বলে ডাকতেন।

ছোটবেলা থেকেই পাণ্ডবদের, বিশেষ করে ভীমকে, মনে প্রাণে ঈর্ষা করতেন। বিষপ্রয়োগে ভীমকে মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

অন্ধ বাবার বেয়াড়া আদরে ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন। বন্ধু কর্ণ, ভাই দুঃশাসন আর মামা শকুনির সাথে রাতদিন চলত পাণ্ডব-নিধনের শলাপরামর্শ।

পাণ্ডবদের জতুগৃহে পাঠানো, দু-দুবার কপট পাশা খেলায় হারানো, বনবাসে পাঠানো, সব দুষ্কর্মের অনুমোন ‘পুত্রস্নেহে অন্ধ’ ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করে ছেড়েছিলেন দুর্যোধন। বিদূষী মা গান্ধারী ছেলেকে চিনতেন। কখনও তাঁকে মনপ্রাণ খুলে আর্শীবাদ করতে পারেন নি। তবে ছেলের মঙ্গল কামনা করেছেন সর্বদাই।

দ্বারকায় কৃষ্ণের বাড়িতে গেছেন দুর্যোধন। অর্জুনও গেছেন একটু পরেই। কৃষ্ণ ঘুম থেকে উঠে পায়ের কাছে বসা অর্জুনকেই আগে দেখেছেন। সে কারণে অর্জুনকেই আগে কিছু চাইবার সুযোগ দিয়েছেন। অর্জুন নিরস্ত্র, নির্লিপ্ত কৃষ্ণকে চাওয়ায় দুর্যোধন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কৃষ্ণের চেয়ে তাঁর দশ লক্ষ নারায়ণী সেনাকে অনেক বেশি মূল্যবান মনে হয়েছে দুর্যোধনের কাছে।

কৃষ্ণ আর দুর্যোধন ছিলেন সম্পর্কে পরস্পরের বৈবাহিক। কৃষ্ণ-পুত্র ‘শাম্ব’ বিয়ে করেছিলেন দুর্যোধনের মেয়ে ‘লক্ষ্মণা’-কে।

বিরাট রাজার ষাট হাজার গরু চুরি করতে গিয়ে পাণ্ডবদের হাতে গো হারান হারেন দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের উদারতায় এর আগে গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাত থেকে পাণ্ডবরাই মুক্ত করেছিলেন দুর্যোধনকে।

অকৃতজ্ঞ অহঙ্কারী দুর্যোধন পাণ্ডবদের মাত্র পাঁচটা গ্রাম চাওয়ার জবাবে বলেছেন, ‘একটা সুচের ডগায় যতটা মাটি ধরে, তাও আমি বিনাযুদ্ধে পাণ্ডবদের দেব না।’

অবিশ্বাসী দুর্যোধন কখনও না কখনও ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কর্ণ, সবাইকেই অবিশ্বাস করেছেন। দুর্যোধন এবং ভীম একই সঙ্গে বলরামের কাছে গদাযুদ্ধ শিখেছেন। দুজনেই ছিলেন সম-প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্য অস্ত্রেও দুর্যোধন যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। কিন্তু দ্বৈপায়নে লুকিয়ে থাকাটা তাঁর মতো দাম্ভিকের পক্ষে চরম কাপুরুষতার লক্ষণ।

ভীম দুর্যোধনের উরু ভেঙেছেন শুধুই প্রতিজ্ঞা রাখতে। দ্রৌপদীকে সভায় উরু দেখানোর জ্বালা মেটাতে। বলরাম ছুটে গেছেন ভীমকে মারতে। কৃষ্ণ আটকেছেন বলরামকে। বলরাম বরাবরই দুর্যোধনকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দুযযাধনের পাল্লাই ভারী ছিল। বাঙ্গালী রাজারা সহ বেশির ভাগ রাজাই যুদ্ধ করেছেন দুর্যোধনের পক্ষে। এটা নিঃসন্দেহে দুর্যোধনের রাজনৈতিক সাফল্য। আমাদের হিসেব মতে প্রায় ৭২ বছর বেঁচেছিলেন দুর্যোধন।

॥ দুষ্মন্ত ॥

পুরু বংশের রাজা। মৃগয়ায় বেরিয়ে একদিন কণ্ব মুনির আশ্রমে এসে শকুন্তলাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। কথ মুনি তখন আশ্রমে ছিলেন না। গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেন শকুন্তলাকে। শকুন্তলা শর্ত দেন, তাঁর ছেলেকে রাজা করতে হবে। শকুন্তলার ছেলে ‘ভরত’ বড় হলে কণ্ব মুনির পরামর্শে শকুন্তলা যান দুষ্মন্তের কাছে।

দুবাসার অভিশাপে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ভুলে যান। রাগে, দুঃখে শকুন্তলা ফিরে চলেন পিত্রালয়ে। এমন সময় দৈববাণী হয়, ‘ভরতই দুষ্মন্তের ছেলে।’ ভরতসহ শকুন্তলাকে গ্রহণ করেন দুষ্মন্ত। ভরতের নাম অনুসারেই তাঁর রাজ্যের নাম হয় ‘ভারতবর্ষ’।

॥ দেবব্রত ॥

ভীষ্মের অন্য নাম। ‘ভীষ্ম’ দেখুন।

॥ দেবযানী ॥

দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য আর উর্জস্বতীর মেয়ে। দেবাসুরের যুদ্ধে অসুরদের হারাতে ‘মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা’ শিখতে দেবগুরু বৃহস্পতির ছেলে কচ আসেন শুক্রাচার্যের কাছে। দেবযানী কচের প্রেমে পড়েন। কচ বিয়ে করতে চান না। কারণ গুরুকন্যা অগম্যা। দেবযানী শাপ দেন, ‘প্রয়োজনে নিজের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে না তুমি এই বিদ্যে।’

কচ শাপ দেন, ‘কোনও ব্রাহ্মণ তোমাকে বিয়ে করবে না।’

দেবযানীর বান্ধবী শর্মিষ্ঠা একবার দেবযানীকে রাগ করে এক পাত্‌কোতে ফেলে দেন। আর্তনাদ শুনে রাজা যযাতি তাঁকে টেনে তোলেন। শাস্তিস্বরূপ শর্মিষ্ঠাকে দেবযানীর দাসী হয়ে থাকতে হয়।

দেবযানী যযাতিকে বিয়ে করলে শর্মিষ্ঠাও দেবযানীর সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়িতেই বাস করেন। দেবযানীর গর্ভে যযাতির ‘যদু’ আর ‘তুর্বসু’ নামে দুই ছেলে হয়। শর্মিষ্ঠার সঙ্গেও মিলিত হন যযাতি। ফলে ‘দ্রুহ্যু’, ‘অণু’ আর ‘পুরু’ নামে তিন ছেলের জন্ম হয়। এই যদু থেকেই ‘যদু বংশ’ আর পুরু থেকে ‘পুরু বংশে’র শুরু।

দেবযানী শর্মিষ্ঠার সাথে যযাতির অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বাবাকে জানান। শুক্রাচার্যের শাপে যাতি জরাগ্রস্ত হন। তবে শুক্রাচার্য বলেন, যযাতি কারও যৌবনের সঙ্গে জরা বিনিময় করতে পারেন। কেউ বিনিময়ে রাজি হয় না। শেষে শর্মিষ্ঠার ছেলে পুরু রাজি হন। যযাতি এক হাজার বছর ছেলের যৌবন ভোগ করে যখন বুঝলেন ভোগের কোনও শেষ নেই, তখন ছেলেকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে তপস্যা করে স্বর্গে চলে গেলেন।

॥ দেবিকা (১) ॥

বিদুরের স্ত্রী। দেবকের মেয়ে। বিদুর ‘পারসব’ ছিলেন বলে ভীষ্ম সেকালের নিয়ম মতো ‘পারসবী’ মেয়ে দেবিকার সঙ্গে বিদুরের বিয়ে দেন। সেকালে ব্রাহ্মণ বাবা এবং শূদ্রা মায়ের ছেলেকে ‘পারসব’ এবং মেয়েকে ‘পারসবী’ বলা হত। দেবিকার অনেক সন্তান ছিল। কিন্তু কারওই নাম জানা যায় না।

॥ দেবিকা (২) (মতান্তরে দেবকী) ॥

যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। গোবাসন শৈব্যের মেয়ে। স্বয়ংবর সভায় ইনি যুধিষ্ঠিরের গলায় মালা দিয়েছেন। এঁর গর্ভজাত যুধিষ্ঠিরের ছেলের নাম যৌধেয়।

॥ দ্বৈতবন ॥

সরস্বতী নদীর তীরে এক পবিত্র বন। বনবাসকালে পাণ্ডবরা অনেকদিন ছিলেন এখানে।

॥ দ্বৈপায়ন(১) ॥

মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ব্যাসদেব দেখুন।

॥ দ্বৈপায়ন (২) ॥

কুরুক্ষেত্রের কাছেই এক বিখ্যাত হ্রদ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে হার নিশ্চিত জেনে এখানেই লুকিয়ে ছিলেন দুর্যোধন।

॥ দ্রুপদ ॥

দ্রৌপদীর বাবা। পাঞ্চালের রাজা। ‘পৃষৎ’-এর ছেলে। অন্য নাম ‘রাজ্যসেন’, ‘যজ্ঞসেন’ ইত্যাদি। পাঁচ পাণ্ডব এঁর জামাই।

দ্রোণের বাল্যসখা। রাজা হয়ে দ্রোণকে অপমান করেন। দ্রোণ কুরুকুমারদের সাহায্যে তাঁকে বন্দী করে তার প্রতিশোধ নেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের মাথা কেটে বাবার অপমানের জ্বালা মেটান। যুদ্ধশেষে পাণ্ডব শিবিরে রাতের আঁধারে ধৃষ্টদ্যুম্নকে মেরে অশ্বত্থামা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন।

এঁর ছেলেমেয়েরা হলেন, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী।

॥ দ্রুমিল ॥

উগ্রসেনের অন্য নাম। (উগসেন’ দেখুন)।

॥ দ্রুহ্যু ॥

যযাতি আর শর্মিষ্ঠার ছেলে।

॥ দ্রোণাচার্য ॥

বিশ্বের প্রথম নলজাতক। হরিদ্বারে গঙ্গায় স্নানরতা অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন ভরদ্বাজ। জলেই তাঁর রেতঃপাত হয়। সেই শুক্র এক দ্রোণে (কলসিতে) রাখলেন ভরদ্বাজ। কালক্রমে তা থেকেই জন্ম হল দ্রোণের।

কুমারদের অস্ত্র শিক্ষার জন্যে এঁকে নিযুক্ত করেন ভীষ্ম। কুমারদের খেলার গোলক পাত্‌কোর ভেতর থেকে আশ্চর্য দক্ষতায় তুলে দিয়েছিলেন ইনি।

অর্জুনকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুল অন্যায়ভাবে চেয়ে নিয়েছেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। কর্ণকে অস্ত্রশিক্ষা দিলেও দিব্যাস্ত্র শিক্ষা দেন নি কর্ণ সূতপুত্র বলে।

বন্ধু দ্রুপদের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন দ্রোণ অর্জুনের নেতৃত্বে রাজকুমারদের সাহায্যে দ্রুপদকে বন্দী করে। পরে মুক্তি দিয়েছিলেন তাঁকে। গৌতমী কৃপীর গর্ভে এঁর ‘অশ্বত্থামা’ নামে এক ছেলে হয়। অসম্ভব ভালবাসতেন অশ্বত্থামাকে। সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই কৃষ্ণের পরামর্শে ‘অশ্বত্থামা’ নামে এক হাতিকে মারেন ভীম। তারপর যুধিষ্ঠির তাঁকে বলেন, ‘অশ্বত্থামা হতঃ ইতি কুঞ্জর।’ অস্ত্র ত্যাগ করেন দ্রোণ। ধৃষ্টদ্যুম্ন বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে দ্রোণের মাথা কেটে দেন। এভাবে না মারলে দ্রোণকে বধ করার ক্ষমতা পাণ্ডবপক্ষে কারওই ছিল না। কিন্তু পরম শ্রদ্ধেয় গুরুকে এ রকম অন্যায়ভাবে হত্যা করার জঘন্য ঘটনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি দ্রোণের প্রিয়তম শিষ্য অর্জুন। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন তিনি।

অভিমন্যুবধ, একলব্যের আঙুল চাওয়া, কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করা, দ্রৌপদীর অবমাননায় নির্লিপ্ত থাকা, গরু চুরি করতে যাওয়া ইত্যাদি কুকর্মে লিপ্ত থাকতে দ্রোণের বাধেনি। তবে তাঁর অস্ত্রবিদ্যায় জ্ঞানের গভীরতা আর অর্জুনপ্রীতি ছিল প্রশ্নাতীত।

দ্রোণ-অর্জুনের মিষ্টিমধুর গুরুশিষ্যের সম্পর্ক মহাভারতের এক অত্যন্ত উপভোগ্য উপাদান। একালের শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক এরকম হলে সমাজের ছবিটাই পাল্টে যেত। কোথায় সেই দ্রোণাচার্য! কোথায় বা সেই অর্জুন!

॥ দ্রৌপদী ॥

পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের যজ্ঞ থেকে উদ্ভূতা মেয়ে। পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী। ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী আর উত্তমৌজা এঁর দাদা। প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্যতমা। গায়ের রং কালো। তাই নাম ‘কৃষ্ণা’। দ্রুপদের মেয়ে। তাই ‘দ্রৌপদী’। যজ্ঞসেনের (দ্রুপদের আর একনাম) মেয়ে। তাই ‘যাজ্ঞসেনী’। পাঞ্চাল-দুহিতা। তাই ‘পাঞ্চালী’। অসামান্য রূপবতী দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় মালা দিয়েছেন স্বয়ংবর সভায়। কিন্তু কুন্তীর অসতর্ক নির্দেশে পাঁচ পাণ্ডবকেই স্বামীত্বে বরণ করতে হয়েছে তাঁকে।

কর্ণ লক্ষ্যভেদ করতে এলে বলেছেন, ‘সূতপুত্রের গলায় আমি মালা দেব না।’ এ অপমানের কথা কর্ণ কোনওদিনও ভোলেননি।

পাঁচ ভাই নিয়ম করে নিয়েছিলেন, দ্রৌপদীকে নিয়ে এক ভাই যখন কোনও ঘরে থাকবেন, বাকিরা তখন সে ঘরে ঢুকবেন না। ঢুকলে বার বছর বনে গিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। ঘটনাচক্রে দ্রৌপদীর প্রিয়তম স্বামী অর্জুনের কপালেই এই শাস্তি এসে জুটল। দ্রৌপদী যখন অস্ত্রাগারে যুধিষ্ঠিরের নিবিড় আলিঙ্গনে, ঠিক তখনই এক অসহায় ব্রাহ্মণকে সাহায্য করতে অর্জুনকে ঢুকতে হয় অস্ত্রাগারে। বার বছরের জন্যে বনবাসে যান অর্জুন।

পাশা খেলায় সর্বস্ব খোয়াবার পর দ্রৌপদীকেও হারিয়েছেন যুধিষ্ঠির। দুর্যোধন দূত পাঠিয়েছেন দ্রৌপদীর কাছে, তাঁকে সভায় নিয়ে আসতে। তীক্ষ্ণ মেধা নিয়ে দ্রৌপদী দূতের কাছে জানতে চেয়েছেন; যুধিষ্ঠির কাকে আগে বাজি রেখেছেন, নিজেকে না দ্রৌপদীকে? যদি আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরে গিয়ে থাকেন, তবে দ্রৌপদীর ওপর আর তাঁর কোনও অধিকারই নেই।

দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনা হয়েছে সভায়। তাঁর বীর স্বামীরা মাথা নত করে থেকেছেন নীরবে। দুঃশাসন তাঁর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করলে দ্রৌপদী স্বামীদের ওপর আস্থা হারিয়ে তাঁর গতিৰ্ভর্তাসখাহরি কৃষ্ণকে মনেপ্রাণে ডেকেছেন। সেই ব্যাকুল আর্তিতে সাড়া দিয়েছেন ভগবান। অনন্ত বস্তু জুগিয়েছেন দ্রৌপদীকে। বস্ত্র টেনে টেনে ক্লান্ত দুঃশাসন লজ্জায় বসে পড়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন বিকর্ণ। পাষণ্ড দুর্যোধনেরই এক ধর্মভীরু ভাই।

দ্রৌপদী সেদিন সভায় যে সব জ্ঞানগর্ভ প্রশ্ন রেখেছেন, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি ভীষ্ম-দ্রোণরা। মাথা নিচু করে শুনে গেছেন শুধু।

দুর্যোধনের চক্রান্তে দশ হাজার অভুক্ত শিষ্য নিয়ে অসময়ে অতিথি হলেন দুর্বাস। শাপ দিতে যাঁর আর দোসর নেই। এবারেও দ্রৌপদীর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কৃষ্ণ কৃষ্ণা সহ পাণ্ডবদের মহাবিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করলে ভীম জয়দ্রথকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছেন। যুধিষ্ঠির জয়দ্রথকে ক্ষমা করেছেন।

বিরাট রাজার বাড়িতে ‘সৈরিন্ধ্রী’ নামে রানি সুদেষ্ণার চুল বাঁধা আর অন্য কাজকর্মের দায়িত্ব নিয়েছেন।

কীচক হত্যায় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন দ্রৌপদী।

অশ্বত্থামার হাতে দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলেই নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। প্রতিবারের মতো এবারেও ভীমই দ্রৌপদীর প্রতিশোধস্পৃহা মিটিয়েছেন অশ্বত্থামার মাথার মণি এনে দিয়ে। অর্জুনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতের দুর্বোধ্য অপরাধে দ্রৌপদীর পতন ঘটেছে মহাপ্রস্থানের পথে। অর্জুনের মতো কন্দর্পনিন্দিতকান্তি সর্বগুণসম্পন্ন স্বামীর প্রতি দুর্বলতা থাকাটা কি দ্রৌপদীর মতো সর্বগুণ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না মেয়ের পক্ষে অপরাধ? বিশেষ করে যখন দ্রৌপদীকে জয়ের শতকরা একশ ভাগ কৃতিত্বই অর্জুনের একার?

পাঁচ মহাবীর দেশ-বিখ্যাত স্বামীর সঙ্গে মিলনে দ্রৌপদীর পাঁচ বীর ছেলে হয়। প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক আর শ্রুতসেন। এঁরা যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেবের ঔরসজাত ছেলে।

মহাপ্রস্থানের পথে পথ চলতে চলতে সবার আগে পতন হয়েছে দ্রৌপদীর। ভীম দ্রৌপদীর পতনের কারণ জানতে চেয়েছেন দাদার কাছে। যুধিষ্ঠির জানিয়েছেন, ‘অর্জুনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত’-ই দ্রৌপদীর পতনের কারণ।

আমাদের ধারণা, মহাপ্রস্থানের সময় দ্রৌপদীর বয়স ছিল কম-বেশি ১০০ বছর।

॥ ধনঞ্জয় ॥

অর্জুনের অন্য নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ ধর্মপুত্র ॥

যুধিষ্ঠিরের অন্য নাম। ‘যুধিষ্ঠির’ দেখুন।

॥ ধৃতবর্মা ॥

ত্রিগর্তরাজ কেতুবর্মার ছেলে। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া আটকালে অর্জুন এঁকে যুদ্ধে হারান।

॥ ধৃতরাষ্ট্র ॥

অম্বিকার গর্ভজাত বিচিত্রবীর্যের মরণোত্তর ক্ষেত্রজ সন্তান। ব্যাসদেবের ঔরসজাত। জন্মান্ধ। পূর্ব জন্মে ছিলেন অরিষ্টার ছেলে গন্ধর্বপতি হংসনামা।

ব্যাসদেবের ভয়ংকর চেহারা দেখে মিলনের সময় ভয়ে চোখ বুজে ছিলেন অম্বিকা। তাই ধৃতরাষ্ট্র হয়ে গেলেন জন্মান্ধ। আর জন্মান্ধ বলেই বয়সে বড় হয়েও তিনি রাজা হতে পারলেন না। রাজা হলেন ছোট ভাই পাণ্ডু। পাণ্ডু মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্রই রাজা হলেন।

অন্ধ পুত্রস্নেহে একের পর এক অন্যায় করে গেছেন ধৃতরাষ্ট্র। পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানো, কপট পাশা খেলার ব্যবস্থা করা, পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠানো ইত্যাদি দুর্যোধনের সব নীচ ষড়যন্ত্রেই সায় দিতে হয়েছে তাঁকে। ভীষ্ম, বিদুর, কৃষ্ণ, গান্ধারী, কারও সদুপদেশই তাঁর অন্ধ পুত্রস্নেহের লৌহকঠিন দেয়ালে ছিদ্র করতে পারেনি।

ব্যাসদেবের দেওয়া দিব্যদৃষ্টি নিয়ে তাঁর একান্ত অনুগত সঞ্জয় যুদ্ধের এক ‘বিস্ময়করভাবে নিরপেক্ষ’ ধারাবিবরণী শুনিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। শতপুত্রের শোকে বিদীর্ণ হয়েছে তাঁর বুক। যুদ্ধশেষে প্রতিহিংসায় লোহার ভীমকে চূর্ণ করেছেন। রাজ্যলাভের পর ভীম সুযোগ পেলেই তির্যক মন্তব্যে ধৃতরাষ্ট্রকে যন্ত্রণা দিয়েছেন। মনের দুঃখে গান্ধারীকে নিয়ে বাণপ্রস্থে গেছেন বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র। সঙ্গী হয়েছেন কুন্তী, বিদুর আর সঞ্জয়। ধ্যানস্থ অবস্থায় দাবানল তাঁকে গ্রাস করেছে।

মাঝে মধ্যেই বিবেক জেগে উঠেছে ধৃতরাষ্ট্রের। কিন্তু সর্বদাই অন্ধ পুত্রস্নেহ সেই বিবেককে আবার ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।

॥ ধৃষ্টকেতু ॥

শিশুপালের ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেন। জয়দ্রথধের দিন অসাধারণ বীরত্ব দেখান। দ্রোণের হাতে প্রাণ দেন।

॥ ধৃষ্টদ্যুম্ন ॥

দ্রুপদের যজ্ঞোদ্ভুত ছেলে। দ্রোণের শিষ্য। যুদ্ধে অন্যায়ভাবে দ্রোণকে হত্যা করেন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় লক্ষ্যভেদের নিয়ম ব্যাখ্যা করেন। অন্যায়ভাবে দ্রোণবধের জন্যে নিজের দলেরই সাত্যকি এঁকে মারতে যান। রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঘুম থেকে টেনে তুলে অশ্বত্থামা এঁকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন।

॥ ধৌম্য ॥

যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত। একমাত্র অজ্ঞাতবাসের এক বছর ছাড়া আর সর্বদাই ইনি সর্বকাজে পাণ্ডবদের সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী ছিলেন। অজ্ঞাতবাসের আগে পাণ্ডবদের মহার্ঘ এবং জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়েছেন।

॥ নকুল ॥

মাদ্রীর গর্ভজাত পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ ছেলে। দুই অশ্বিনীকুমারের একজনের ঔরসজাত। সহদেব এঁর যমজ ভাই। অসাধারণ রূপবান ছিলেন। আর এই রূপের অহংকারের জন্যেই মহাপ্রস্থানের পথে এঁর পতন।

বনে যাবার সময় গায়ে ধুলো মেখেছিলেন নকুল। যাতে তাঁর অসামান্য ওই রূপে স্ত্রীলোকেরা ভুলে গিয়ে তাঁর প্রতি প্রেম নিবেদন না করেন।

বিরাট রাজার বাড়িতে ‘গ্রন্থিক’ নামে রাজার ঘোড়াশালার দেখাশোনা করতেন। নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে তাঁর সাংকেতিক নাম রাখা হল ‘জয়ৎসেন’। যুদ্ধে মোটই সুবিধে করতে পারেননি নকুল। কর্ণের ছেলে বৃষসেনের কাছে হেরে পালান।

রাজা হবার পর যুধিষ্ঠির নকুলকে কর্মচারী আর সৈন্যদের দেখাশোনা করার আর মাইনেপত্তর দেবার দায়িত্ব দিয়েছেন।

মহাপ্রস্থানের পথে ‘আমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই’—এই অহংকারেই পতন হয়েছে নকুলের।

খুব শান্ত, অল্পভাষী আর দাদার অনুগত ছিলেন নকুল।

নকুলের দুই স্ত্রী। ‘দ্রৌপদী’ আর শিশুপালের মেয়ে ‘করেণুমতী’।

দ্রৌপদীর গর্ভজাত ছেলে ‘শতানীক’। করেণুমতীর গর্ভজাত ছেলের নাম ‘নিরমিত্র’।

আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৬ বছর বেঁচেছিলেন নকুল।

॥ নন্দ (ঘোষ) ॥

কৃষ্ণের পালক পিতা। গোকুলে থাকতেন। কৃষ্ণের জন্মের পরেই বসুদেব এঁর মেয়ে যোগমায়ার সঙ্গে নিজের ছেলে কৃষ্ণকে সবার অজান্তে বদল করে দেন। এঁর স্ত্রী যশোদা কৃষ্ণগতপ্রাণা ছিলেন। কংসের ভয়ে কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে নিয়ে যান নন্দ। কংসবধের সময় নন্দ কংসের যজ্ঞে উপস্থিত হবার জন্যে নিমন্ত্রিত হন। কৃষ্ণ-বলরামও নন্দের সঙ্গে মথুরায় গিয়ে কংসকে বধ করেন।

॥ নন্দিনী ॥

বশিষ্ঠের কামধেনু। এঁকে হরণ করার অপরাধেই বশিষ্ঠের শাপে অষ্টবসুকে গঙ্গার গর্ভে মানুষ হয়ে জন্মাতে হয়। সাত বসু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্গে ফেরেন। অষ্টম বসু ‘দ্যু’ এই হরণের নায়ক ছিলেন বলে তাঁকে ভীষ্মরূপে অনেকদিন পৃথিবীতে কাটাতে হয়।

॥ নর-নারায়ণ ॥

ধর্ম আর অহিংসার ছেলে। দুই উচ্চমার্গের ঋষি। দেবতারা এঁদের তপস্যা ভাঙতে অনেক অপ্সরা পাঠিয়ে ব্যর্থ হন। দেবতাদের জব্দ করতে নারায়ণ নিজের উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করেন। তারপর আরও কয়েক হাজার অপ্সরাকে সৃষ্টি করেন। দেবতাদের দর্পচূর্ণ হয়। দ্বাপরে ‘নর’-ই অর্জুনরূপে আর ‘নারায়ণ’ কৃষ্ণরূপে জন্ম নেন। এ মত অবশ্য বামন পুরাণের।

॥ নহুষ ॥

চন্দ্রবংশের রাজা। আয়ুর ছেলে। অগস্ত্যের শাপে নহুষ অজগর শাপ হয়ে যান। বনবাস কালে ভীমকে চেপে ধরেন। যুধিষ্ঠির ভীমের খোঁজে এসে দেখেন ভীম এঁর হাতে বন্দী। নহুষ যুধিষ্ঠিরকে অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন। যুধিষ্ঠির ঠিক ঠিক উত্তর দিলে ইনি ভীমকে মুক্তি দেন। অগস্ত্যের কথা মতো যুধিষ্ঠিরের দর্শনের পুণ্যে নিজেও মুক্ত হয়ে স্বর্গে যান নহুষ।

॥ নারায়ণী সেনা ॥

কৃষ্ণের নিজস্ব উচ্চশিক্ষিত অসাধারণ শক্তিধর সেনাবাহিনী। দুর্যোধন এ রকম দশ লক্ষ সেনা পেয়েছিলেন। অর্জুন সেনার বদলে সর্বশক্তির উৎস কৃষ্ণকেই চেয়ে নেন।

॥ নিবাতকবচ ॥

হিরণ্যকশিপুর ছেলে সংহ্লাদের বংশধর শক্তিশালী দানবকুল। অর্জুন এঁদের নিধন করেন।

॥ নিরমিত্র ॥

চেদিরাজ শিশুপালের মেয়ে করেণুমতীর গর্ভজাত নকুলের ছেলে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যান।

॥ পরাশর ॥

ব্যাসদেবের বাবা। শক্ত্রি এবং অদৃশ্যম্ভীর ছেলে। বশিষ্ঠের নাতি। ‘পরাশর-সংহিতা’র প্রণেতা।

মৎস্যগন্ধা সত্যবতীকে কুমারী অবস্থায় ভোগ করেন। এর ফলে ব্যাসদেবের জন্ম হয়। এঁর কৃপায় সত্যবতী আবার কুমারীত্ব ফিরে পান। তাঁর গায়ের মাছের গন্ধও দূর হয়ে যায়। বদলে দেহে আসে যোজনপ্রসারী সুগন্ধ। সত্যবতী মৎস্যগন্ধা থেকে হন যোজনগন্ধা।

॥ পরিক্ষিৎ ॥

উত্তরার গর্ভজাত অভিমন্যুর ছেলে। জনমেজয়ের বাবা। গর্ভে থাকাকালীন অশ্বত্থামার ছোঁড়া ব্ৰহ্মশিরে এঁর মৃত্যু হয়। মৃত অবস্থাতেই ভূমিষ্ঠ হন যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়। পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো কৃষ্ণ এঁকে পুনর্জীবন দেন। মহাপ্রস্থানে যাবার সময় যুধিষ্ঠির এঁকে রাজা করে যান।

শমিক মুনির গলায় মরা সাপ জড়িয়ে দেবার অপরাধে মুনির ছেলে শৃঙ্গীর অভিশাপে তক্ষক এঁকে দংশন করলে ইনি মারা যান। তক্ষক খাণ্ডবদাহের প্রতিশোধ নিয়ে তৃপ্ত হন।

॥ পাঞ্চজন্য ॥

কৃষ্ণের শঙ্খ। কৃষ্ণের হাতে নিহত পঞ্চজন দৈত্যের হাড়ে তৈরি এই শঙ্খ।

॥ পাঞ্চাল ॥

দ্রুপদের রাজ্য। পজ্ঞাব এবং সংলগ্ন অঞ্চল।

॥ পাঞ্চালী ॥

দ্রৌপদীর অন্য নাম। ‘দ্রৌপদী’ দেখুন।

॥ পাণ্ডব ॥

পাণ্ডুর ছেলেরা নিজেদের কৌরব না বলে পাণ্ডব বলে পরিচয় দিতেন। যদিও কুরুর বংশধর হিসেবে তাঁরাও ছিলেন কৌরব।

॥ পাণ্ডু ॥

অম্বালিকার গর্ভজাত বিচিত্রবীর্যের মরণোত্তর ক্ষেত্রজ সন্তান। ব্যাসদেবের ঔরসজাত। ব্যাসদেবকে মিলনের সময় দেখে ভয়ে ফ্যাকাশে (পাণ্ডুর) হয়ে যান অম্বালিকা। জন্ম দেন পাণ্ডুর বর্ণের এক শিশুর। সেই শিশুই পাণ্ডু।

মৃগরূপী কিম মুনিকে এক মৃগীর সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় বাণবিদ্ধ করেন পাণ্ডু। কিম অভিশাপ দেন, ‘কোনও স্ত্রীলোকের সঙ্গে সঙ্গম করলেই মৃত্যু হবে তোমার।’

কুন্তী আর মাদ্রী দুই স্ত্রী পার। কিন্তু মুনির অভিশাপে পাণ্ডু নিজে সন্তান উৎপাদন করতে পারছেন না। পুত্রলাভের জন্য কুন্তীকে দুর্বাসার দেওয়া বর কাজে লাগাতে বললেন পাণ্ডু। কুন্তী দুর্বাসার বরে দেবতাদের ডেকে যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুনকে পেলেন সন্তান হিসেবে। মাদ্ৰীও একইভাবে পেলেন যমজ সন্তান নকুল-সহদেবকে।

একদিন নির্জনে সুসজ্জিতা মাদ্রীকে দেখে কামার্ত হলেন পাণ্ডু। সেই কামই তাঁর কাল হল। কিমের অভিশাপে মৃত্যু হল পাণ্ডুর।

॥ পুরোচন ॥

দুর্যোধনের বিশ্বস্ত মন্ত্রী এবং স্থপতি। বারণাবতে পাণ্ডবদের যে-জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চক্রান্ত করেছিলেন দুর্যোধন, সেই জতুগৃহ এঁরই তৈরি। বিদুরের পাঠানো খনকের জন্যে পাণ্ডবরা অবশ্য সে যাত্রায় বেঁচে যান। বিধির বিধানে পুরোচন নিজেই নিজের বাড়িতে আগুনে পুড়ে মারা যান।

॥ পৃথা ॥

কুন্তীর অন্য নাম। ‘কুন্তী’ দেখুন।

॥ পৃষৎ ॥

অন্য নাম বাজ্জসেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের বাবা।

॥ পৌরব ॥

পুরু থেকে উদ্ভূত বংশের সকলেই ‘পৌরবা’ এই হিসেবে কৌরব এবং পাণ্ডব, সকলেই পৌরব।

॥ প্রতিবিন্ধ্য ॥

দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের ছেলে। শিবির হত্যায় অশ্বত্থামার হাতে হত।

॥ প্রদ্যুম্ন ॥

কৃষ্ণ-রুক্মিণীর ছেলে। এঁর স্ত্রী ‘কুকুদমতী’। এঁর ছেলে ‘অনিরুদ্ধ’। যদুবংশ ধ্বংস হবার সময় ইনি নিহত হন।

॥ প্রবীর ॥

মাহিষ্মতীর রাজা ‘নীলধ্বজ’ আর ‘জ্বালা’র ছেলে। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে আটকালে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দেন। এঁর স্ত্রী ‘জনা’ অর্জুনবধের সংকল্প নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন। বভ্রুবাহনের তূণীরে বাণ হয়ে থাকেন না। সেই বাণেই বভ্রুবাহন বাবাকে মেরে ফেলেন।

॥ ফাল্গুন ॥

অর্জুনের অন্য নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ বক ॥

ভয়ংকর রাক্ষস। অলম্বুষের ছেলে। একচক্ৰায় ভীম এঁকে বধ করেন।

॥ বজ্র ॥

কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যুম্নের নাতি। যদুবংশ ধ্বংস হলে পাণ্ডবরা এঁকে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা করেন।

॥ বজ্রদত্ত ॥

প্ৰাগ্‌জ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের ছেলে। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া আটকালে অর্জুন এঁকে যুদ্ধে হারান।

॥ বভ্রুবাহন ॥

অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার ছেলে। মণিপুরের রাজা। অশ্বমেধযজ্ঞের ঘোড়া আটকালে এঁর সঙ্গে এঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ করেন অর্জুন। প্রবীরের স্ত্রী জনার প্রতিজ্ঞা ছিল পরজন্মে অর্জুনকে মারবেন। বাভ্রুবাহনের তীর আশ্রয় করে জনা অর্জুনকে মেরে ফেলেন। চিত্রাঙ্গদার কান্নায় উলূপী পাতাল থেকে ‘মৃত সঞ্জীবনীমণি’ এনে অর্জুনকে বাঁচান।

॥ বরণ ॥

অন্যতম প্রধান দেবতা। খাণ্ডবদাহের সময় এঁর কাছ থেকেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সে সব কৃষ্ণার্জুনকে দেন অগ্নি। অর্জুনকে দেন ‘গাণ্ডীব’, দুটো ‘অক্ষয় তূণীর’ আর ‘কপিধ্বজ’ (বানরচিহ্নিত পতাকা) রথ কৃষ্ণকে দেন ‘সুদর্শন’ চক্র আর ‘কৌমোদকী’ গদা।

॥ বর্চাঃ ॥

চন্দ্রের প্রিয় ছেলে। মাত্র ষোলা বছরের জন্যে চন্দ্র এঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন পাণ্ডবদের হাতে। ইনিই অভিমন্যু হয়ে জন্মান। চক্ৰব্যূহের অকালমৃত্যুর পর ফিরে যান বাবার কাছে।

॥ বলন্ধরা ॥

ভীমের স্ত্রী। কাশীরাজের মেয়ে। ‘সর্বগ’ এঁর ছেলে।

॥ বলরাম ॥

বিষ্ণুর অবতার। কৃষ্ণের দাদা। রোহিণীর গর্ভজাত বসুদেবের ছেলে।

দেবকীর সপ্তম গর্ভজাত সন্তানকে যোগমায়া দেবকীরই সহোদরা এবং বসুদেবের স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে পাঠিয়ে দেন। গর্ভ সংকর্ষণ করে এঁকে গর্ভে রাখা হয়েছিল। তাই নাম ‘সংকর্ষণ’। এঁর অস্ত্র ‘হল’। তাই নাম ‘হলধর’ বা ‘হলাযুধ’ বা ‘হলীরাম’।

কংসের হাত থেকে বাঁচাতে এঁকেও গোকুলে নন্দ-যশোদার কাছে রাখা হয়। কৃষ্ণ-বলরাম এক সাথে বেড়ে ওঠেন। সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী হন। সান্দীপনি মুনি এঁর গুরু। ধেনুকাসুরকে বধ করেন। কংস বধে ইনিও অংশ নেন।

ভীম নিয়ম ভেঙে দুর্যোধনের উরু ভাঙলে ইনি ভীমকে হত্যা করতে যান। কৃষ্ণ আটকান। ভীম-দুর্যোধন দুজনেই এঁর কাছে গদাবিদ্যা শেখেন।

সুভদ্রাকে হরণ করায় অর্জুনকেও মারতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ এঁকে ঠাণ্ডা করেন। যদুবংশ ধ্বংসের সময় দ্বারকায় এক বট গাছের নিচে বসে ধ্যান করছিলেন বলরাম। একদিন এক সাদা সহস্রমুখী বিশাল সাপ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে সাগরে মিলিয়ে যায়। বলরামের অবতার লীলা সাঙ্গ হয়। এর ক’দিন পরেই কৃষ্ণও এক অসতর্ক ব্যাধের শরে বিদ্ধ হয়ে মর্তলীলা সংবরণ করেন।

॥ বল্লব ॥

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন ভীমের ছদ্মনাম। ‘ভীম’ দেখুন।

॥ বসুদেব ॥

কৃষ্ণের বাবা। শূরসেন আর মহিষীর ছেলে। কুন্তী আর শ্রুতশ্রবার ভাই। শিশুপালের মামা। দেবকের দেবকী আর রোহিণী সহ সাত মেয়েকেই বিয়ে করেন। দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণ আর রোহিণীর গর্ভে সুভদ্রা আর বলরামের জন্ম হয়। কংসের কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। কৃষ্ণ-বলরামের দেহত্যাগের পর অর্জুনকে কৃষ্ণের শেষ আদেশ জানিয়ে যোগস্থ অবস্থায় দেহ ছাড়েন।

॥ বাণ ॥

দৈত্যরাজ বলির ছেলে। এঁর মেয়ে ঊষার সঙ্গে কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধের বিয়ে হয়।

॥ বারণাবত ॥

বর্তমান প্রয়াগ। এখানে জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ব্যর্থ চক্রান্ত করেন কৌরবরা। বিদুরের পাঠানো এক খনকের কাটা সুড়ঙ্গপথে মা কুন্তী সহ পালান পঞ্চপাণ্ডব। ভীম নিজেই জতুগৃহে আগুন লাগালে এক নিষাদী আর তার পাঁচ ছেলে পুড়ে মরে। বেঁচে যান পাণ্ডবরা।

॥ বাসুকি ॥

নাগরাজ। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ থেকে ভাই তক্ষককে বাঁচাতে ভাগ্নে আস্তীককে পাঠান।

॥ বিচিত্রবীর্য ॥

শান্তনু-সত্যবতীর ছেলে। চিত্রাঙ্গদের ভাই। পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্রের বাবা, কিন্তু জন্মদাতা নন। দুই স্ত্রী। অম্বিকা আর অম্বালিকা। ভোগসুখে মত্ত হয়ে অকালে নিঃসন্তান অবস্থায় যক্ষ্মায় মারা যান।

॥ বিজয় ॥

অর্জুনের অন্য নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ বিজয়া ॥

সহদেবের অন্যতমা স্ত্রী। মদ্ররাজ শল্যের মেয়ে। বিজয়া স্বয়ংবর সভায় পিসতুতো দাদা সহদেবের গলাতেই মালা দেন। এঁর গর্ভজাত সহদেবের ছেলের নাম ‘সুহোত্র’।

॥ বিকর্ণ ॥

গান্ধারীর গর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে। অত্যন্ত সৎ এবং নীতিনিষ্ঠ। সভামধ্যে দ্রৌপদীর অবমাননার সময় একমাত্র ইনিই মুক্তকণ্ঠে সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। দুর্ভাগ্য বিকর্ণের। শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ করতে হয়েছে তাঁকে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীম তাঁকে বধ করেছেন।

॥ বিদুর ॥

মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রাজবাড়ির এক দাসীর গর্ভে এঁর জন্ম দেন। অণীমান্ডব্য নামে এক মুনির শাপে স্বয়ং ধর্মরাজই বিদুররূপে জন্মগ্রহণ করেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় সত্যবতী অম্বিকাকে আবার ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলিত হতে বলেন। ব্যাসদেবের ভয়ংকর চেহারার কথা ভেবে অম্বিকা ভয়ে নিজে না গিয়ে রানি সাজিয়ে এক দাসীকে পাঠান। সেই দাসীর গর্ভেই জন্ম হয় বিদুরের।

ব্যাসদেব দাসীকে বলেছিলেন, ‘তোমার গর্ভের সন্তান পৃথিবীতে সবথেকে বুদ্ধিমান আর ধার্মিক হবে।’ ব্যাস-বাক্য মিথ্যে হবার নয়। এবং হয়ওনি। বিদুরের স্ত্রীর নাম দেবিকা। দেবিকার গর্ভে কয়েকটি ছেলে হয় বিদুরের। তাদের কারোওই নাম জানা যায়নি। বিদুর পাণ্ডবদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনকে তিনি প্রতিটি অন্যায়ের জন্যে তিরস্কার করেছেন। বহু সৎ উপদেশ দিয়েছেন। কাজ হয়নি।

পাণ্ডবরা বনবাসে গেলে কুন্তী তের বছর বিদুরের বাড়িতেই কাটিয়েছেন। জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবদের বাঁচাতে বিদুরই এক খনককে পাঠিয়েছেন।

ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর সঙ্গে বিদুরও বাণপ্রস্থে বনে গেছেন। বিদুর সেখানে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়েছেন খবর পেয়ে যুধিষ্ঠির তাঁকে দেখতে গেলে ধর্ম স্বয়ং বিদুরের দেহ ত্যাগ করে ছেলে যুধিষ্ঠিরের দেহে প্রবেশ করেছেন। বিদুরের দেহ না পোড়াবার দৈববাণী হয়েছে। ধর্ম তাঁকে আশ্রয় করায় আরও বলীয়ান হয়েছেন যুধিষ্ঠির

॥ বিরাট ॥

মৎস্যরাজ। এঁর স্ত্রী সুদেষ্ণা। ছেলে শঙ্খ এবং উত্তর। মেয়ে উত্তরা। উত্তরার সাথে অভিমন্যুর বিয়ে হয়। সেই হিসেবে অর্জুনের বৈবাহিক। এঁর ভাই শতানীক। শ্যালক কীচক। অজ্ঞাতবাসকালে দ্রৌপদী সহ পাঁচ পাণ্ডব ছদ্মবেশে এবং ছদ্মনামে এঁর আশ্রয়ে থাকেন এক বছর। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, যুদ্ধের পনের দিনের দিন দ্রোণের হাতে প্রাণ দেন।

॥ বীভৎসু ॥

অর্জুনের অন্য নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ বৃকোদর ॥

ভীমের অন্য নাম। ‘ভীম’ দেখুন।

॥ বৃষকেতু ॥

কর্ণ-পদ্মাবতীর ছেলে। কৃষ্ণ ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণের বেশে কর্ণকে পরীক্ষা করতে বৃষকেতুর মাংস খেতে চান। পদ্মাবতী চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সে মাংস রান্না করেন। কৃষ্ণ কর্ণের সত্যনিষ্ঠায় এবং অতিথিপরায়ণতায় মুগ্ধ হন। বৃষকেতুকে আবার বাঁচিয়ে দেন। যুদ্ধ শেষে বৃষকেতুকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন তাঁর পাণ্ডব কাকারা।

॥ বৃষসেন ॥

কর্ণ-পদ্মাবতীর ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নেন।

॥ বৃহদশ্ব ॥

এক ঋষি। কাম্যক বনে যুধিষ্ঠিরকে নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান শোনান আর যুধিষ্ঠিরকে ‘অক্ষহৃদয় বিদ্যা’ শেখান।

॥ বৃহন্নলা ॥

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন অর্জুনের ছদ্মনাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ বেদব্যাস ॥

ব্যাসদেবেরই অন্য নাম। ‘ব্যাসদেব’ দেখুন।

॥ বৈকর্তন ॥

কর্ণের অন্য নাম। ‘কর্ণ’ দেখুন।

॥ বৈশম্পায়ন ॥

ব্যাসদেবের শিষ্য এক মুনি। জনমেজয়কে ইনি মহাভারত শুনিয়েছিলেন।

॥ ব্যাসদেব ॥

(মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস)

মহাভারত রচয়িতা। আসল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণ’। কারণ গায়ের কালো রং। মহর্ষি উপাধি পেয়ে তপোবলে চার বেদের ভাগ করেছিলেন। তাই ‘বেদব্যাস’ বা ‘ব্যাসদেব’। দ্বীপে জন্ম। তাই ‘দ্বৈপায়ন’।

মা মৎস্যগন্ধা সত্যবতী। বাবা পরাশর। ঠাকুর্দা রামের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের ছেলে শক্তি।

মায়ের কুমারী অবস্থার সন্তান। অর্থাৎ কানীন পুত্র। বেদব্যাস ‘পুরাণপ্রকাশক’, ‘মহাভারত’, ‘শ্রীমদ্‌ভাগবত’ ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক।

বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু হলে মায়ের অনুরোধে অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার গর্ভে পাণ্ড, আর রাজবাড়ির এক দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম দেন।

ঘোর কালো, মাথায় জটা, এক ভয়ংকর চেহারা ছিল তাঁর। তাঁকে দেখেই ভয়ে চোখ বুজেছিলেন অম্বিকা। তাই ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। ভয়ে পাণ্ডবর্ণ ধারণ করেছিলেন অম্বালিকা। তাই পার পাণ্ডুবর্ণ।

ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ধারাবিবরণী শোনাতে সঞ্জয়কে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে তাঁর কৃপাতেই ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধে হত সবাইকে দেখতে পেয়েছেন।

তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘মহাভারত’ সর্বকালের মহত্তম এবং দীর্ঘতম মহাকাব্য। এক লক্ষ শ্লোকে এই মহাকাব্য লিখেছেন ব্যাসদেব। মহাভারতের মধ্যে আবার ‘শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা’ অংশকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। শুধু মাত্র মহাভারত লেখার জন্যেই ব্যাসদেব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আর সম্ভবত এই কারণেই দশজন চিরজীবীর অন্যতম হিসেবে ব্যাসদেবকে গণ্য করা হয়।

॥ ভগদত্ত ॥

প্ৰাগ্‌জ্যোতিষপুরের রাজা নরকাসুরের ছেলে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে যুধিষ্ঠিরকে অমান্য করলে যুদ্ধ করে অর্জুন এঁকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বার দিনের দিন অর্জুনকে মেরে প্রতিশোধ নিতে বাবার দেওয়া ‘বৈষ্ণবাস্ত্র’ ছোঁড়েন। কৃষ্ণ বুক পেতে তা গ্রহণ করেন। বৈষ্ণবাস্ত্র ‘বৈজয়ন্তী মালা’ হয়ে কৃষ্ণের বুকে শোভা পায়। অর্জুন ভগদত্তকে বধ করেন।

॥ ভরদ্বাজ ॥

দ্রোণের বাবা। বৃহস্পতির ছেলে। অন্য নাম ‘বিতথ’।

ঘৃতাচীকে স্নানরতা অবস্থায় দেখে ভরদ্বাজ কামার্ত হয়ে পড়েন। এতে তাঁর রেতঃপাত হয়। সেই বীর্য একটা দ্রোণ অর্থাৎ কলসিতে সংগৃহীত হয়। সেই কলসিতেই জন্ম হয় বিশ্বের প্রথম নলজাতক মানুষ দ্রোণের।

বৃহস্পতির দাদা উতথ্য। উতথ্যের স্ত্রী মমতার গর্ভাবস্থায় বৃহম্পতি জোর করে মমতার সাথে মিলিত হতে যান। এতে মমতার গর্ভের সন্তান পা দিয়ে কাকাকে বাধা দেয়। বৃহস্পতির বীর্য পড়ে মাটিতে। সেই বীর্য থেকে যে শিশুর জন্ম হয়, তাকে বৃহস্পতি এবং মমতা দুজনেই ত্যাগ করেন। মরুদ্‌গণ সেই শিশুকে মানুষ করেন।

মরুদ্‌গণের দ্বারা ভূত হয়েছিলেন। তাই ‘ভর’। আর দুইয়ের শক্তিতে জাত। তাই ‘দ্বাজ’ অথাৎ সঙ্কর। দুয়ে মিলে ‘ভরদ্বাজ’। রামায়ণেও আছেন। মহাভারতেও আছেন। রাম-সীতা বনবাসে যাবার সময় এবং বনবাস থেকে ফেরার সময় এঁর আশ্রম হয়ে যান।

॥ ভানুমতী ॥

দুর্যোধনের স্ত্রী। স্বয়ংবরসভা থেকে এঁকে জোর করে হস্তিনাপুরে তুলে আনেন দুর্যোধন। কারণ, স্বয়ংবরসভায় অন্য অনেক রাজার সাথে দুর্যোধনকেও মালা না দিয়ে উপেক্ষা করেছিলেন অসামান্যা সুন্দরী ভানুমতী।

অহংকারী দুর্যোধনের পক্ষে এই অপমান চুপচাপ হজম করা অসম্ভব ছিল। কাজেই গায়ের জোরে স্বয়ংবরসভা থেকে তুলে নিয়ে এলেন ভানুমতীকে। একেবারে সোজা হস্তিনাপুর। সেখানেই হল মালাবদল।

ভানুমতীর বাবা ছিলেন কলিঙ্গের রাজা চিত্রাঙ্গদ। স্বয়ংবরসভাতে অনেক রাজা-মহারাজাকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। কাজেই দুর্যোধনের পক্ষে ভানুমতী-হরণের পালাটা খুব মধুর হয়নি। অনেক রাজা-মহারাজাকে লড়াইতে হারাতে হয়েছে।

ভানুমতীর নাম মহাভারতে কোথাও নেই। আছে ‘বেণীসংহার’ নাটকে।

ভানুমতীর গর্ভে দুর্যোধনের দুটি সন্তান হয়। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। ছেলেটির নাম ‘লক্ষ্মণ’। মেয়েটির নাম ‘লক্ষ্মণা’।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে কৌরবদের বিধবা স্ত্রীরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অনুমান করতে পারি, ভানুমতীর ব্যথা-বেদনা-শোক আর সকলের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না।

॥ ভীম (ভীমসেন) ॥

কুন্তীর গর্ভজাত পাণ্ডুর দ্বিতীয় ক্ষেত্রজ ছেলে। পবনের ঔরসজাত। যুধিষ্ঠিরের থেকে বয়সে মাত্র এক বছরের ছোট। দুর্যোধনের সমবয়সী। পবনের ছেলে। তাই ‘পবননন্দন’। ‘বৃক’ নামে অগ্নি পেটে থাকায় প্রচুর খেতে পারতেন। তাই ‘বৃকোদর’। বালক ভীমের হাতে নাজেহাল অবস্থা হত কৌরবদের। ভীমকে পায়েসের সাথে বিষ মিশিয়ে খাওয়ালেন কৌরবরা। অচেতন ভীমকে গঙ্গায় ফেলে দিলেন কৌরবরা। নাগরাজ বাসুকি তাঁর নাতি কুন্তিভোজের নাতি, ভীমকে প্রচুর অমৃত খাইয়ে দিলেন। আরও বলশালী হয়ে ফিরে এলেন ভীম। বিস্মিত হলেন কৌরবরা। আর সেই সঙ্গে জ্বলতে লাগলেন হিংসেয় । খুঁজতে লাগলেন পাণ্ডবদের জব্দ করার উপায়। জতুগৃহে ভীমই আগুন লাগিয়েছেন। মাকে কাঁধে, নকুল-সহদেবকে কোলে, আর অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে ভীম একাই সবাইকে নিয়ে দুর্গম বন পার হয়েছেন।

নরমাংসভোজী ‘হিড়িম্ব’কে বধ করে তাঁর বোন ‘হিড়িম্বা’কে বিয়ে করেছেন। হিড়িম্বার গর্ভে ‘ঘটোৎকচ’ নামে এক ছেলে হয়েছে ভীমের।

একচক্রা নগরে ‘বক’ রাক্ষসের অত্যাচারের কথা শুনে তাকেও বধ করেছেন ভীম। কৃষ্ণের পরামর্শে জরাসন্ধকে বধ করেছেন।

দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা দেখে ভীমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। যে হাতে যুধিষ্ঠির পাশা খেলেছেন, সে হাত পুড়িয়ে দিতে সহদেবকে আগুন আনতে বলেছেন।

দুর্যোধন দ্রৌপদীকে উরু দেখিয়ে সেখানে বসতে ইঙ্গিত করেছিলেন। ভীম প্রতিজ্ঞা করেন, গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের সেই উরু উনি ভাঙ্গবেনই ভাঙ্গবেন।

দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনে তাঁকে সভায় বিবস্ত্রা করার চেষ্টা করেছিলেন। ভীম প্রতিজ্ঞা করেন, দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করে দ্রৌপদীর এই লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেবেন। দ্রৌপদীকে যে-কোনওরকম লাঞ্ছনা বা বিপদ থেকে বাঁচাতে তাঁর পাঁচ স্বামীর মধ্যে ভীমই ছুটে এসেছেন সবার আগে। এবং একবার নয়। বার বার।

ধৃতরাষ্ট্রের (গান্ধারীর গর্ভজাত) একশ ছেলেকেই শমন সদনে পাঠাবার প্রতিজ্ঞা করেন ভীম। এবং বলাই বাহুল্য, সে প্রতিজ্ঞা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছেন।

দ্রৌপদীর জন্যে গন্ধমাদন পর্বতের এক সরোবর থেকে সহস্রদল পদ্ম আনতে গিয়ে দাদা হনুমানের সঙ্গে দেখা হয় ভীমের। হনুমান ভীমকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন। অর্জুনের ‘কপিধ্বজ’ রথের মাথায় বসে পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সাহায্য করেছেন হনুমান।’

জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে ভীমের হাতে ধরা পড়েন। ভীম জয়দ্রথকে বেধড়ক পেটান। যুধিষ্ঠির ক্ষমা না করলে সেদিনই জয়দ্রথবধ নিশ্চিত ছিল।

বিরাট রাজার বাড়িতে ‘বল্লব’ নামে পাচকের কাজ নিয়েছিলেন ভীম। নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে ভীমের সাংকেতিক নাম ছিল ‘জয়ন্ত’। রাজার দুশ্চরিত্র শ্যালক কীচক দ্রৌপদীর অপমান করলে ভীম কীচকের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন।

ভীম অশ্বত্থামা নামে এক হাতিকে মারেন। সেই হাতির মৃত্যু সংবাদই ‘অশ্বত্থামা হতঃ ইতি কুঞ্জর।’ বলে দ্রোণের কানে দেন যুধিষ্ঠির। দ্রোণবধ করা সহজ হয়ে যায়।

ভীম যখন দুঃশাসনের রক্তে মুখ ভর্তি করে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করছিলেন, তখন যুদ্ধক্ষেত্রে সবাই ভয়ে পালাতে থাকেন। তাঁরা ভয়ে চেঁচাতে থাকেন, ‘এ মানুষ নয়! নির্ঘাৎ কোনও রাক্ষস!’

গদাযুদ্ধের নিয়ম ভীম ভালমতোই জানতেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রক্ষার্ধেই তিনি দুর্যোধনকে উরুতে আঘাত করেন। দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেন।

ভীমের হাতে গান্ধারীর শতপুত্ৰই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। ভীম তাঁর সব প্রতিজ্ঞাই পালন করেছেন।

ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধশেষে ভীমকে আলিঙ্গন করতে চাইলে কৃষ্ণের পরামর্শে আগে থেকে তৈরি রাখা ‘লোহার ভীম এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধৃতরাষ্ট্র সে ভীমকে সত্যি-ভীম মনে করে ভেঙে চুরমার করলেন। পরে ভীম বেঁচে আছেন শুনে আশ্বস্ত হন ধৃতরাষ্ট্র।

ভীম আর অর্জুনই ছিলেন পাণ্ডবদের শক্তি। এই দুই ভাইয়ের জন্যেই সকলেই পাণ্ডবদের সমীহ করে চলতেন।

যুধিষ্ঠির রাজা হবার পর ভীম কথায় কথায় ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীকে খোঁচা দিতেন। প্রতিবারেই যুধিষ্ঠিরকে এর জন্যে ক্ষমা চাইতে হত। শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তপস্যার জন্যে বনে চলে যান। এবং সেখানেই দেহত্যাগ করেন।

মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল আর অর্জুনের পতনের সময় প্রতিবারেই বিস্মিত ভীম ধর্মরাজ দাদাকে তাঁদের পতনের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। সবার শেষে যখন তাঁর নিজেরই পতন ঘটছে, তখন নিজের পতনের কারণ জানতে চাইলেন দাদার কাছে।

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত ভোজন আর অন্যের শক্তি না জেনেই সদম্ভ আস্ফালন করার জন্যেই তোমার পতন হল।’

ভীম যে বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। তবে ‘দাদা আর গদা’ ছাড়া আর কিছুই জানতেন না তিনি, একথা ঠিক নয়। বনবাসকালে একদিন দ্রৌপদী, ভীম আর যুধিষ্ঠিরের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল তাতে ভীমের জ্ঞানের গভীরতার ছাপ আছে।

ভীমের চার স্ত্রী। ‘হিড়িম্বা’, ‘দ্রৌপদী’, ‘বলন্ধরা’ আর ‘কালী’ । হিড়িম্বার গর্ভজাত ছেলে ‘ঘটোৎকচ’। দ্রৌপদীর গর্ভজাত ছেলে ‘সুতসোম’। বলম্বয়া আর কালীর গর্ভে যথাক্রমে ‘সর্বগ’ আর ‘সর্বগত’ নামে দুই ছেলে হয় ভীমের।

আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৮ বছর বেঁচেছিলেন ভীম।

॥ ভীষ্ম (দেবব্রত) ॥

গঙ্গার গর্ভজাত শান্তনুর ছেলে। অষ্ট বসুর এক বসু ‘দু’। মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র। কৃষ্ণের পরেই দ্বিতীয় প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র। অন্যতম কৃষ্ণভক্ত। আকুমার ব্রহ্মচারী। সত্য এবং নীতিনিষ্ঠ । বেদ শিখেছেন বশিষ্ঠের কাছে। অস্ত্রগুরু পরশুরাম।

বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীকে চুরির অপরাধে বশিষ্ঠের শাপে বসু ‘দ্যু’ দেবব্রত নামে গঙ্গার গর্ভে মানুষ হয়ে জন্মালেন। জন্মের পর গঙ্গা এঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ছত্রিশ বছর নিজের কাছে রেখে নানাবিধ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত করে তুলে তাঁকে আবার ফিরিয়ে দিলেন স্বামী শান্তনুর কাছে।

এর চার বছর পরে দাসরাজকন্যা সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হলেন শান্তনু। দাসরাজকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। দাসরাজ শর্ত দিলেন। সত্যবতীর ছেলেকে রাজা করতে হবে। দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলেন শান্তনু। ‘সত্যবতীকে কি তাহলে পাব না?’

দেবব্রত সব শুনে গেলেন দাসরাজের কাছে। বললেন, ‘আমি কখনও রাজ সিংহাসনের দাবিদার হব না।’

‘কিন্তু আপনার ছেলেরা?’ দাসরাজ প্রশ্ন করলেন।

‘আমি আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করব। বিয়ে করব না।’ প্রতিজ্ঞা করলেন দেবব্রত। দাসরাজ রাজি হলেন। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। শান্তনু ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন ছেলেকে। ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে দেবব্রত হলেন ‘ভীষ্ম।’ সত্যই এঁর ব্রত। তাই নাম ‘সত্যব্রত’। গঙ্গার ছেলে। তাই ‘গাঙ্গেয়’।

সত্যবতীর গর্ভজাত চিত্রাঙ্গদ আর বিচিত্রবীর্য দুজনেই অল্পায় এবং নিঃসন্তান ছিলেন। শান্তনুর মৃত্যুর পর চিত্রাঙ্গদ, আর চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর বিচিত্রবীর্য রাজা হলেন। ভাইয়ের জন্যে কাশীরাজের তিন ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকাকে স্বয়ংবর সভা থেকে তুলে আনলেন ভীষ্ম।

অম্বা বললেন, শারাজের সাথে তাঁর গোপনে বিয়ে হয়েছে। অম্বাকে মুক্ত করে দিয়ে অম্বিকা আর অম্বালিকাকে ভাই বিচিত্রবীর্যের হাতে তুলে দিলেন ভীষ্ম।

অম্বাকে গ্রহণ করলেন না শাল্বরাজ। অম্বাও ভীষ্মের বীরত্বে মুগ্ধ। ভীষ্মকে বললেন, ‘আমার এ অবস্থার জন্যে আপনিই দায়ী। আমাকে আপনিই বিয়ে করুন।’ ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা বলে তাঁর অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। অম্বাও নাছোড়বান্দা। গেলেন ভীষ্মের গুরু পরশুরামের কাছে। গুরুর আদেশেও প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গতে রাজি হলেন না সত্যবদ্ধ সত্যব্রত। গুরু-শিষ্যে সাংঘাতিক যুদ্ধ হল। নারদ এবং অন্যরা এসে যুদ্ধ থামালেন। পরশুরাম ‘ভীষ্মকে হারানো অসম্ভব’ বলে অম্বার কাছে বিদায় নিলেন।

অম্বা ভীষ্মকে শাপ দিলেন, ‘আমি পরজন্মে আপনার মৃত্যুর কারণ হব।’ অগ্নিতে আত্মাহুতি দিলেন অম্বা। মহাদেবের বরে পরজন্মে দ্রুপদের নপুংসক সম্ভান শিখণ্ডী হয়ে জন্মালেন। কামাসক্ত বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মায় মারা গেলেন। সত্যবতী অম্বিকা আর অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে বললেন ভীষ্মকে। কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। সত্যবতীর কানীন পুত্র মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব সন্তান উৎপাদনে রাজি হলেন।

অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার গর্ভে পাণ্ডু আর রাজবাড়ির এক দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হল। ভীষ্ম এঁদের মানুষ করলেন। বিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় প্রথমে পাণ্ডুই রাজা হলেন। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলেন।

রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা দেবার জন্যে ভীষ্ম প্রথমে কৃপাচার্যকে, এবং পরে দ্রোণাচার্যকে নিয়োগ করলেন। রাজকুমারদের সবাইকেই ভীষ্ম খুবই স্নেহ করতেন। তবে অর্জুনকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। যুধিষ্ঠিরকে খুব স্নেহ করতেন তাঁর সত্যবাদিতার জন্যে।

যুদ্ধ, পাশাখেলা ইত্যাদি ঠেকাতে পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে অনেক বুঝিয়েছেন ভীষ্ম। কোনও লাভ হয়নি। কর্ণ দুযযাধনকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতেন বলে এবং দাম্ভিক ছিলেন বলে ভীষ্ম কর্ণকে সহ্য করতে পারতেন না।

হস্তিনাপুরের সিংহাসনকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম জানতেন, কৃষ্ণ যে পক্ষে আছেন সে পক্ষের জয় অনিবার্য। তিনি মনে মনে পাণ্ডবদেরই সমর্থন করেছেন।

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় বা কপট পাশা খেলা চলাকালীন ভীষ্মের ভূমিকা বিস্ময়কর। এবং অত্যন্ত অবাঞ্ছিত। তাঁর বজ্রকঠিন চরিত্রে ওই সভায় তাঁর উপস্থিতি এবং প্রায় নির্লিপ্ত ভূমিকা একেবারেই বেমানান।

বিরাটরাজার গরু চুরির অভিযানে অর্জুনের অস্ত্রপ্রহারে সংজ্ঞা হারান ভীষ্ম। সে যুদ্ধে গোজয় করতে গিয়ে গোহারান হারেন দুর্যোধন।

ভীষ্ম প্রতিদিন দশ হাজার পাণ্ডবসেনা নিধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দুর্যোধনকে। আর বলেছেন, তিনি পাণ্ডবদের কারওকে বা শিখণ্ডীকে বধ করবেন না।

যুদ্ধের সময় ভীমের বয়স ছিল প্রায় একশ’ বছর। অথচ রণক্ষেত্ৰ কাঁপিয়ে দাপটে যুদ্ধ করেছেন এই শতায়ু বৃদ্ধ!

যুদ্ধের তৃতীয় এবং নবম দিনে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে ‘সুদর্শন চক্র’ নিয়ে ভীষ্মের দিকে তেড়ে গেছেন কৃষ্ণ। অর্জুন তাঁকে নিরস্ত্র করেছেন। কৃষ্ণগতপ্রাণ ভীষ্ম কিন্তু এতে মনে মনে দারুণ খুশি। কারণ ভীষ্মের তীব্র ইচ্ছে ছিল, কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙবেনই ভাঙবেন। ভক্তের মান রাখতে ভগবান নিজের মান বিসর্জন দিলেন।

ভীষ্মকে বধ করা অসম্ভব। তাঁকে দমন করাও দুঃসাধ্য। কৃষ্ণের পরামর্শে পাণ্ডবরা ভীষ্মের কাছে গেছেন তাঁকে হারাবার উপায় জানতে। তিনিই বলে দিয়েছেন উপায়। পরদিন শিখণ্ডীকে সামনে বসিয়ে যুদ্ধ করেছেন অর্জুন। শিখণ্ডীকে দেখে অন্ত্র ত্যাগ করেছেন ভীষ্ম। শরে শরে ভীষ্মের জন্যে শরশয্যা রচনা করেছেন অর্জুন।

ভীষ্ম বালিশ চাইলে দুর্যোধন নরম বালিশ এনে দিয়েছেন। ভীষ্ম তা চাননি। অর্জুন এক বাণে ভীষ্মের ঝুলন্ত মাথা তুলে ধরেছেন। একই ভাবে জল চাইলে কৌরবদের আনা ঠাণ্ডা সুগন্ধি জল খাননি। অর্জুন ‘বরুণ’ বাণে মাটি থেকে ঠাণ্ডা জল তুলে সোজা পৌঁছে দিয়েছেন ভীষ্মের মুখে। তৃপ্তিতে ভরে গেছে ভীষ্মের মন। অকুণ্ঠ আশীবাদ করেছেন অর্জুনকে। শরশয্যায় শুয়ে কর্ণকেও ক্ষমা করেছেন। উপদেশ দিয়েছেন। আটান্নদিন শরশয্যায় ছিলেন ভীষ্ম। এর মধ্যে শেষ তিরিশ দিন ধরে যুধিষ্ঠিরকে তিনি নানা বিষয়ে যে সব মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন, তাই ‘ভীষ্ম গীতা’। তাঁর অসামান্য জ্ঞানের পরিচয় পাই আমরা ওইসব মহার্ঘ উপদেশে।

শেষ সময়ে বলেছেন, ‘যতো ধৰ্ম্মস্ততো জয়ঃ।’ অর্থাৎ ধর্ম যেখানে, জয়ও সেখানে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যোগযুক্ত হয়ে ইচ্ছামৃত্যুবরণ করলেন মহাভারতের মহানায়ক, শতায়ু ভীষ্ম।

॥ ভীষ্মক ॥

ভোজ রাজা। কৃষ্ণের শ্বশুর। রুক্মিণীর বাবা। এঁর ছেলে রুক্মী। জরাসন্ধের বন্ধু। সহদেব যুদ্ধ করে এঁকে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কর দিতে বাধ্য করেন।

॥ ভূমিঞ্জয় ॥

উত্তরের অন্য নাম। ‘উত্তর’ দেখুন।

॥ ভূরিশ্রবা ॥

কুরুরাজ সোমদত্তের ছেলে। মহাদেবের বরে এঁকে পান সোমদত্ত।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পঞ্চম দিনে সাত্যকির দশ ছেলেকে হত্যা করেন ভূরিশ্রবা। সাত্যকির ঠাকুর্দা যদুবংশের বীর শিনি বসুদেবের জন্যে দেবকীকে হরণ করলে কুরুবংশের বীর সোমদত্ত ক্ষেপে যান। শিনি লাথি মারেন তাঁকে। সেই অপমানের শোধ নিতে যুদ্ধের চোদ্দ দিনের দিন শিনির নাতি সাত্যকিকে লাথি মারেন সোমদত্তের ছেলে ভূরিশ্রবা। সাত্যকির মাথা কাটতে যান ভূরিশ্রবা। যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে এক বাণে ভূরিশ্রবার ডান হাত কেটে দেন অর্জন। এর প্রতিবাদে ভূরিশ্রবা দেহত্যাগের জন্যে যোগে বসেন। ওই অবস্থাতেই সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভূরিশ্রবার মাথা কাটেন সাত্যকি।

॥ মণিভদ্র ॥

জয়দ্রথ-দুঃশলার নাতি। সুরথের ছেলে। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড় নিয়ে অর্জুন সিন্ধু দেশে গেলে সুরথ ভয়েই মারা যান। জ্যাঠতুতো বোন দুঃশলা আর নাতি মণিভদ্রকে সান্ত্বনা দেন অর্জুন।

॥ মৎস্যগন্ধা ॥

সত্যবতীর অন্য নাম। ‘সত্যবতী’ দেখুন।

॥ মৎস্য দেশ ॥

বিরাটের রাজ্য। কারও মতে বর্তমান জয়পুর। কারওমতে রাজপুতানার ঢোলপুরের পশ্চিমাঞ্চল।

॥ ময় দানব ॥

দানব শিল্পী। দিতির ছেলে। খাণ্ডবদাহের সময় এঁকে বাঁচান কৃষ্ণার্জুন। সেই কৃতজ্ঞতায় কৃষ্ণের কথা মতো ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের জন্যে এক অসামান্য সভাঘর বানান ময়, যা দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরেন দুর্যোধন।

গৃহনির্মাণ শিল্পের ওপর ‘ময়মত’ নামে এক বই লিখেছিলেন ইনি।

ইন্দ্রের নিষেধ সত্ত্বেও অলরা হেমাকে বিয়ে করায় ইন্দ্ৰ বজ্রাঘাতে এঁকে মেরে ফেলেন।

॥ মাদ্রবতী ॥

পরিক্ষিতের স্ত্রী। জনমেজয়ের মা। অভিমন্যু এবং উত্তরার পুত্রবধু।

॥ মাদ্রী ॥

মদ্ররাজ অর্তায়নের মেয়ে। পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী। নকুল সহদেবের গর্ভধারিণী মা। মদ্ররাজ শল্যের বোন।

পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন কিন্দম মুনির শাপে। কুন্তী দুর্বাসার কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন, যে-কোনও দেবতাকে ডেকে তাঁর সাহায্যে মা হতে পারবেন তিনি। সেই মতো কুন্তীর তিন ছেলে হলে মাদ্রী পান্ডুকে ধরে বসলেন। পাণ্ডু যেন কুন্তীকে দেবতাদের ডাকার মন্ত্র মাদ্রীকে শিখিয়ে দিতে বলেন।

কুন্তীর শেখানো মন্ত্র প্রয়োগ করে দুই অশ্বিনীকুমারের ঔরসে দুই যমজ ছেলে নকুল-সহদেবের জন্ম দিলেন মাদ্রী। আবার সন্তান পেতে চাইলেন। কিন্তু মন্ত্র ভুলে গেছেন। কুন্তীর দ্বারস্থ হলেন। কুন্তী আর মন্ত্র সেখাতে রাজি হলেন না। খানিকটা ঈর্ষায়। সতীন কেমন একবারে যমজ ছেলে পেয়ে গেল। খানিকটা ভয়ে। কী জানি বাবা! যদি মাদ্রীর ছেলেরা আমার ছেলেদের থেকে সংখ্যায় বেশি হয়?

একবার এক বসন্তে নির্জনে সুসজ্জিতা মাদ্রীকে দেখে নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না পাণ্ডু। মাদ্রীর সাথে তিনি মিলিত হলেন। কিন্দম মুনির শাপে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দেহান্তর ঘটল।

কুন্তী পাণ্ডুর মৃত্যুর জন্যে মাদ্ৰীকেই দায়ী করে নিজে সহমরণে যেতে চাইলে মাদ্রী বাধা দিয়ে বলেন, ‘আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই মহারাজ প্রাণ হারালেন। কাজেই আমারই সহমরণে যাবার অধিকার বেশি। তুমি আমার ছেলে দুটোকে নিজের মতো করে মানুষ করো।’ এই বলে পাণ্ডুর চিতায় ঝাঁপ দিলেন মাদ্রী।

॥ যদু ॥

যযাতি এবং দেবযানীর ছেলে। এঁর থেকেই শুরু হল বিখ্যাত যদুবংশ। এই বংশের বংশধরদের বলা হত যাদব। কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা এই বংশেই জন্মেছিলেন।

॥ যযাতি ॥

দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য এবং তাঁর স্ত্রী উর্জস্বতীর মেয়ে দেবযানীর স্বামী। যযাতি শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করায় গুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে জরাগ্রস্ত হন। শুক্রাচার্য বলেন যযাতি ইচ্ছে করলে কারও যৌবনের সঙ্গে তাঁর জরা বদল করতে পারবেন। কিন্তু কেউ জরার ভার নিতে চাইল না।

শেষে ছেলে পুরু রাজি হলেন। ছেলের যৌবন নিয়ে আরও এক হাজার বছর ইন্দ্রিয় সম্ভোগ করলেন যযাতি। শেষে বুঝলেন, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত শান্তি। ছেলেকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন যযাতি। তারপর কঠোর তপস্যা করে স্বর্গে চলে গেলেন। আরও তথ্যের জন্যে ‘দেবযানী’ এবং ‘শর্মিষ্ঠা’ দেখুন।

॥ যশোদা ॥

কৃষ্ণের পালিকা মা। কৃষ্ণগতপ্রাণা। নন্দের স্ত্রী। এঁর গর্ভে যোগমায়ার আর কংসের কারাগারে দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয় একই রাতে। দৈব নির্দেশে বসুদেব দুই শিশুকে অদল-বদল করেন। কৃষ্ণ-বলরামকে অপার মাতৃস্নেহে মানুষ করেন যশোদা।

॥ যাজ্ঞসেনী ॥

দ্রৌপদীর অন্য নাম। ‘দ্রৌপদী’ দেখুন।

॥ যুধামন্যু ॥

পাঞ্চাল দেশের এক বীর। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করেন।

॥ যৌধেয় ॥

দেবিকার গর্ভজাত যুধিষ্ঠিরের ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অশ্বত্থামার হাতে প্রাণ দেন।

॥ যুধিষ্ঠির ॥

কুন্তীর গর্ভজাত পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ তিন ছেলের মধ্যে সবার বড়। ধর্মের ঔরসজাত। আজন্ম সত্যবাদী। অত্যন্ত ধীর, স্হির এবং আদর্শনিষ্ঠ। শুধু দু’বার মিথ্যে বা অর্ধসত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। একবার অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন বিরাট রাজার কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরের সভাসদ ‘কঙ্ক’ বলে। আর একবার দ্রোণ বধের সময়। ‘অশ্বত্থামা হতঃ’ জোরে বলে ‘ইতি কুঞ্জর।’ বলেছেন খুব আস্তে।

পাণ্ডব-কৌরবদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরই সবার বড় ছিলেন বলে তাঁকেই যুবরাজ করেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে দুর্যোধন কৌশলে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছেন জতুগৃহে।

কপট পাশা খেলায় সর্বান্ত হয়েছেন যুধিষ্ঠির দু’দুবার। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা দেখেছেন নিজের সামনে। তা সত্ত্বেও মাত্র পাঁচখানা গ্রাম নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিলেন, যদি লোকক্ষয়কারী মহাযুদ্ধ এড়ানো যায়, এই আশায়।

সর্পরূপী নহুষের কুটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাঁর হাত থেকে ভীমকে বাঁচান। নহুষও শাপমুক্ত হন। জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে হরণ করলে বোন দুঃশলার মুখ চেয়ে তাঁকে ক্ষমা করেন যুধিষ্ঠির। বকরূপীধর্মের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন অত্যন্ত উপভোগ্য। যুধিষ্ঠিরের জ্ঞান এবং মহানুভবতাও ফুটে উঠেছে সেখানে।

যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে যুধিষ্ঠির রথ থেকে নেমে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য, শল্য ইত্যাদির কাছে আশীবাদ ভিক্ষা করেছেন। এই বিনয়, এই ধর্মজ্ঞান শুধু যুধিষ্ঠিরকেই মানায়।

কর্ণের হাতে হতমান হয়ে ফিরে এসে অর্জুনকে ‘গাণ্ডীব’ ত্যাগ করতে বললে অর্জুন তাঁকে কাটতে এসেছিলেন। যুধিষ্ঠির নিজের ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়েছেন।

যুদ্ধ শেষে গান্ধারীকে প্রণাম করতে গেলে চোখের পটির ফাঁক দিয়ে গান্ধারীর রোষদৃষ্টি পড়ে যুধিষ্ঠিরের নখে। তাতেই বিকৃতবর্ণ হয়ে যায় তাঁর নখ। শরশয্যায় শুয়ে থাকা ভীমের কাছে তিরিশ দিন ধরে মহার্ঘ ‘ভীষ্মগীতা’ শোনেন যুধিষ্ঠির।

ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে পরিক্ষিতের হাতে শাসন ভার দিয়ে ভাইদের আর দ্রৌপদীকে নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে চললেন যুধিষ্ঠির। স্বয়ং ধর্ম কুকুরের রূপ ধরে তাঁদের সঙ্গী হলেন। একে একে চার ভাই এবং দ্ৰৌপদীর পতন হল।

ইন্দ্র রথ আনলেন তাঁকে নিয়ে যেতে। তিনি বললেন কুকুরকেও যেতে দিতে হবে। অনেক তর্ক বিতর্কের পর ধর্ম নিজের রূপ ধারণ করে যুধিষ্ঠিরকে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ করলেন। সশরীরে স্বর্গে গেলেন যুধিষ্ঠির।

সেখানে ভাইদের না দেখে বিস্মিত হয়েছেন। পরে তাঁকে দ্রোণবধের সময় অর্ধসত্য বলার জন্যে ‘মায়ানরক’ দর্শন করিয়ে আবার স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে ভাইদের দেখতে পান।

যুধিষ্ঠিরের দুই স্ত্রী। দ্রৌপদী’ আর ‘দেবিকা’। দ্রৌপদীর গর্ভজাত ছেলের নাম ‘প্রতিবিন্ধ্য’। দেবিকার গর্ভজাত ছেলে ‘যৌধেয়’।

আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৯ বছর এই মর্তলোক কাটিয়ে গেছেন যুধিষ্ঠির।

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন ‘কঙ্ক’ ছদ্মনামে সর্বত্র পরিচয় দিলেও নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে যুধিষ্ঠিরের সাংকেতিক নাম ছিল ‘জয়’।

॥ যুযুৎসু ॥

বৈশা দাসী সৌবলীর গর্ভজাত ধৃতরাষ্ট্রের ছেলে। বয়সে দুর্যোধনের ছোট। কিন্তু দুঃশাসনের বড়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ধৃতরাষ্ট্রের একশ’ এক ছেলের মধ্যে গান্ধারীর গর্ভজাত একশ ছেলেই ভীমের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। একমাত্র যুযুৎসুই জীবিত ছিলেন। যুদ্ধের ঠিক আগে যুধিষ্ঠিরের আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মপ্রাণ যুযুৎসু ধমশ্রিত পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেন।

যুধিষ্ঠির রাজা হয়ে এঁকে সভাসদ্‌ করেন। মহাপ্রস্থানে যাবার সময় পরিক্ষিৎকে রাজা করে এঁর হাতেই রাজ্য পরিচালনা করার ভার দিয়ে যান যুধিষ্ঠির।

গান্ধারী গর্ভবতী থাকাকালীন বৈশ্যা দাসী সৌবলী ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যা করতেন। তখনই সৌবলী গর্ভবতী হন। জন্ম হয় যুযুৎসুর।

‘যুযুৎসু’ শব্দের অর্থ ‘যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক’। কিন্তু যুযুৎসুর যুদ্ধ করার তীব্র ইচ্ছে বা সে রকম বীরত্ব কোনওটাই ছিল না।

॥ যোগমায়া ॥

যশোদার গর্ভজাত নন্দের মেয়ে। এঁর সাথেই কৃষ্ণকে পাল্টাপাল্টি করেন বসুদেব। কংস এঁকে দেবকীর সন্তান ভেবে তুলে আছাড় মারতে গেলে ইনি কংসের হাত ফসকে শূন্যে উঠে যান। বলেন, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’

॥ যোজনগন্ধা ॥

সত্যবতীর অন্য নাম। ‘সত্যবতী’ দেখুন।

॥ রাধেয় ॥

কর্ণের অন্য নাম। ‘কর্ণ’ দেখুন।

॥ রুক্মিণী ॥

কৃষ্ণের স্ত্রী। ভীষ্মকের মেয়ে। শিশুপালের সঙ্গে এঁর বিয়ে হচ্ছে জেনে কৃষ্ণ এঁকে হরণ করেন। এঁর গর্ভে কৃষ্ণের ‘প্রদ্যুম্ন’ ইত্যাদি দশ ছেলে এবং ‘চারুমতী’ নামে এক মেয়ের জন্ম হয়।

॥ রোহিণী ॥

বলরামের মা। বসুদেবের স্ত্রী। দেবকের মেয়ে। যদুবংশ ধ্বংসের সময় কৃষ্ণ-বলরামের দেহত্যাগের পর বসুদেবের সঙ্গে সহমরণে যান।

॥ লক্ষ্মণা (১) ॥

কৃষ্ণের স্ত্রী। অন্য নাম ‘কেকয়ী’।

॥ লক্ষ্মণা (২) ॥

দুর্যোধনের মেয়ে। কৃষ্ণপুত্র শাম্বের স্ত্রী। শাম্ব এঁকে হরণ করতে গিয়ে কৌরবদের হাতে বন্দী হন। শেষে বলরাম শাম্বকে মুক্ত করে এঁকে শাম্বের হাতে তুলে দেন।

॥ শকুন্তলা ॥

বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যা দেখে, ভয় পেলেন ইন্দ্র। বিশ্বামিত্র বুঝি তাঁর চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেলেন। স্বর্গের নর্তকী মেনকাকে পাঠালেন বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গের জন্যে। বিবসনা মেনকার রূপে কামার্ত হলেন বিশ্বামিত্র। মেনকার গর্ভে জন্ম দিলেন এক কন্যা-সন্তানের। মেনকাকে বিদায় দিয়ে আবার জপে বসলেন বিশ্বামিত্র। মেনকা ফিরে গেলেন ইন্দ্রসভায়। যাবার সময় সদ্যোজাতা মেয়েটিকে রেখে গেলেন মালিনী নদীর তীরে।

মহর্ষি কণ্ব দেখলেন এক শকুন্ত পাখি ডানা মেলে রক্ষা করছে এক পরিত্যক্ত সদ্যোজাত শিশুকে। তুলে আনলেন নিজের আশ্রমে। ‘শকুন্ত-রক্ষিতা’ বলে মেয়েটির নাম দিলেন ‘শকুন্তলা’। মহর্ষির স্নেহচ্ছায়ে বেড়ে উঠলেন শকুন্তলা।

॥ শকুনি ॥

দুযোর্ধনের মামা। গান্ধারীর দাদা। গান্ধাররাজ সুবলের ছেলে। উলুকের বাবা। অত্যন্ত কুচক্রী। ভীমকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা, জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র, কপট-পাশায় যুধিষ্ঠিরকে সর্বস্বান্ত করা ইত্যাদি দুর্যোধনের সব কুকর্মে ‘নাটের গুরু’ ছিলেন শকুনি।

কপট-পাশা খেলে ইনিই দু’দুবার হারিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। যুদ্ধে সহদেবের হাতে প্রাণ দেন।

শকুনির অন্য ভাইরা হলেন— গবাক্ষ, শরভ, বিভু, সুভগ, ভানুদত্ত, বৃষক এবং অচল।

॥ শতানীক ॥

দ্রৌপদী-নকুলের ছেলে। শিবির হত্যায় অশ্বত্থামার হাতে নিহত হন।

॥ শর্মিষ্ঠা ॥

অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে। যযাতির স্ত্রী। এঁর তিন ছেলে ‘দ্রুহ্য’, ‘অণু’ আর ‘পুরু’। এই পুরু থেকেই পৌরবদের সৃষ্টি। এই হিসেবে পাণ্ডব কৌরব সকলেই ‘পৌরব’।

এঁর সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্যে ‘দেবযানী’ দেখুন।

॥ শরদ্বান ॥

মহর্ষি গৌতমের অন্যতম শিষ্যা। অপ্সরা জানপদীকে দেখে ইনি অত্যন্ত কামার্ত হন। শরের ওপর এঁর শুক্র পড়ে তা দু’ভাগ হয়। তা থেকে দুই শিশুর জন্ম হয়। কৃপ আর কৃপী। এঁর প্রথম পরিচয়—ইনি কৃপাচার্যের বাবা। এবং দ্বিতীয় পরিচয়—ইনি দ্রোণের শ্বশুর। কৃপীকে বিয়ে করেছিলেন দ্রোণ।

॥ শরভ ॥

শিশুপালের ছেলে। অশ্বমেধযজ্ঞের ঘোড়া আটকেছিলে অর্জুন এঁকে যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।

॥ শল্য ॥

মদ্ররাজ। পাণ্ডবদের মামা। মাদ্রীর ভাই। পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতে আসার পথে দুর্যোধন কৌশলে এঁকে নিজের পক্ষে নিয়ে যান। কর্ণের সারথ্য করার নামে কর্ণকে উত্ত্যক্ত করে পাণ্ডবদেরই পরোক্ষে সাহায্য করেন। যুধিষ্ঠিরের হাতে যুদ্ধের শেষ দিনে মারা যান।

॥ শান্তনু ॥

গঙ্গা এবং সত্যবতীর স্বামী। প্রতীপের ছেলে। ভীষ্ম, চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের বাবা। স্বর্গে অন্যায় আচরণের জন্যে ইক্ষাকু বংশের ‘মহাভীষ’কে আবার মর্তে আসতে হয়। তিনিই শান্তনু।

গঙ্গাকে দেখে মুগ্ধ হন শান্তনু। বিয়ে করতে চান। গঙ্গা শর্ত দেন—গঙ্গার কোনও কাজে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না। তুললেই তিনি ফিরে যাবেন স্বর্গে।

একে একে শান্তনুর সাত সন্তানকে জন্মলগ্নেই গঙ্গায় বিসর্জন দিলেন গঙ্গা। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শান্তনু নীরবে সহ্য করলেন এই অমানবিক আচরণ। অষ্টম সন্তানের বেলায় আর থাকতে পারলেন না। রুখে দাঁড়ালেন শান্তনু। জানতে চাইলেন গঙ্গার এই নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাখ্যা। গঙ্গা বললেন, ‘বেশ! ব্যাখ্যা দিচ্ছি। আমি কিন্তু চলে যাব।’

গঙ্গা নিজের আর আট ছেলের পরিচয় দিলেন। অষ্টম সন্তানকে নিয়ে গঙ্গা চলে গেলেন। ছত্রিশ বছর পর তাকে উচ্চশিক্ষিত করে ফেরৎ দিলেন শান্তনুকে। সেই সন্তানই ভীষ্ম। দাসরাজের মেয়ে সত্যবতীকেও বিয়ে করতে চাইলেন শান্তনু। দাস রাজ শর্ত দিলেন—সত্যবতীর ছেলেকে রাজা করতে হবে। বিষণ্ণ শান্তনু ভীষ্মকে বঞ্চিত করে বিয়ে করতে চান না। ভীষ্ম দাস রাজের শর্তমতে দুই প্রতিজ্ঞা করলেন। এক, তিনি রাজা হবেন না। দুই, বিয়ে করবেন না। শান্তনু দেবব্রতকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন। দেবব্রত হলেন ভীষ্ম।

শান্তনু-সত্যবতীর বিয়ে হয়ে গেল। দুই ছেলেও হল। ‘চিত্রাঙ্গদ’ আর ‘বিচিত্রবীর্য’। কিন্তু নিয়তির এমনই খেলা, সত্যবতীর সন্তানদের দ্বারা বংশ রক্ষা হল না। অকালে মারা গেলেন তাঁরা।

॥ শাম্ব ॥

কৃষ্ণের ছেলে। জাম্ববতীর গর্ভজাত।

দুর্যোধনের মেয়ে লক্ষ্মণাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেন শাম্ব। কৌরবরা এঁকে বন্দী করে রাখেন। বলরাম খুব স্নেহ করতেন শাম্বকে। বলরাম কৌরবদের হাত থেকে শাম্বকে উদ্ধার করে শাম্ব-লক্ষ্মণার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। একবার বিশ্বামিত্র, কন্ব আর নারদ এসেছেন দ্বারকায়। শাম্ব আর তাঁর যাদব বন্ধুরা মুনিদের সাথে একুট মজা করতে চাইলেন। শাম্বকে গর্ভবতী স্ত্রী সাজিয়ে মুনিদের কাছে নিয়ে গিয়ে শাম্বর বন্ধুরা মুনিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, এর কি ছেলে হবে, না মেয়ে হবে’? মুনিরা গেলেন ভীষণ রেগে। শাপ দিলেন, ‘লোহার মতো কঠিন মুষল প্রসব করবে। আর তাতেই যদুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।’

মনি-বাক্য মিথ্যে হবার নয়। পরদিনই শান্ত সত্যি সত্যিই লোহার মতো কঠিন এক মুষল প্রসব করলেন। ভয় পেয়ে সবাই সে মুষল ফেলে দিলেন সমুদ্রের জলে। কিন্তু কালক্রমে তা থেকেই ঘাস জাতীয় মুষলগাছের বন হয়ে গেল। আর সেই গাছ নিয়ে পেটাপেটি করেই ধ্বংস হল যদুবংশ।

॥ শাম্ব (১) ॥

অম্বার প্রেমিক। ভীষ্ম অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকাকে হরণ করে আনার পর জানতে পারেন অম্বা মনে মনে শাল্বরাজাকে ভালবাসেন। উদারমনা ভীষ্ম অম্বাকে মুক্তি দেন। ভীষ্ম হরণ করায় শাম্ব প্রত্যাখ্যান করেন অম্বাকে। শাম্ব পূর্ব জন্মে বৃষপবার ভাই ‘অজক’ ছিলেন।

॥ শাম্ব (২) ॥

শিশুপালের বন্ধু। শিশুপালকে কৃষ্ণ বধ করলে রেগে যান। বলেন, ‘পৃথিবীকে যাদবহীন করব।’ দ্বারকা আক্রমণ করেন।

‘সৌভ’ নামে এক বিমানে করে কৃষ্ণের সাথে সাংঘাতিক যুদ্ধ করেন। কৃষ্ণের সুদর্শন বিমান সমেত শাম্বকে ধ্বংস করে। মহাভারতে বিমান যুদ্ধের এই বিবরণ আমাদেরকে বিস্মিত করে।

॥ শাম্ব (৩) ॥

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে লড়াই করেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতি এঁকে বধ করে।

॥ শিখণ্ডী ॥

অম্বা ভীষ্মের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পরজন্মে ভীষ্মবধের কারণ হবেন বলে আগুনে আত্মাহুতি দেন। পরে মহাদেবের বরে তিনি দ্রুপদের ঘরে দ্রুপদের মেয়ে হয়ে জন্মালেন। মহাদেবের বর ছিল, এই মেয়েই পরে ছেলে হয়ে যাবে। দ্রুপদ প্রচার করলেন, তাঁর ছেলে হয়েছে। হিরণ্যবর্মার মেয়ের সাথে শিখণ্ডীর বিয়ে দিলেন দ্রুপদ।

হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের প্রতারণার কথা জানতে পারেন মেয়ের কাছে। হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

বনে আত্মহত্যা করতে যান শিখণ্ডী। যক্ষ্ম স্থূনাকর্ণ তাঁকে নিজের পৌরুষ ধার দেন ক’দিনের জন্যে। বাবার হয়ে যুদ্ধ করে শিখণ্ডী স্থূনাকর্ণের কাছে ফিরে আসেন পৌরুষ ফিরিয়ে দিতে। স্থূনাকর্ণের প্রভু কুবের সব শুনে শাপ দেন, শিখণ্ডী পুরুষই থাকবেন, স্থূনাকর্ণ নারীই থাকবেন। শিখণ্ডীর জীবদ্দশায় এর পরিবর্তন হবে না।

ভীষ্ম এ সব বৃত্তান্ত জানতেন। পাণ্ডবরা ভীষ্মকে কিছুতেই হারাতে না পেরে কৃষ্ণের পরামর্শে ভীষ্মকে হারাবার উপায় জানতে ভীষ্মেরই শরণ নেন। অম্বার প্রতিজ্ঞার কথা মাথায় রেখে ভীষ্ম আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেন যে, অর্জনের রথে শিখণ্ডীকে দেখলে তিনি অস্ত্র ত্যাগ করবেন। সেই মতো শিখণ্ডীকে সামনে নিয়ে বৃদ্ধ ভীষ্মকে বাণে বাণে আঘাত করে শরশয্যায় শুইয়ে দেন অর্জুন।

শিবির হত্যাকাণ্ডে অশ্বত্থামার হাতে প্রাণ দেন শিখণ্ডী।

শিখণ্ডী দ্রুপদের ছেলে। দ্রৌপদীর দাদা। পাণ্ডবদের শ্যালক।

॥ শিশুপাল ॥

চেদিরাজ। বৃষ্ণি বংশের রাজা। দম ঘোষ আর শ্রুতশ্রবার ছেলে। কুন্তীর বোনপো। কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। শরভ এবং ধৃষ্টকেতুর বাবা। নকুলের শশুর।

নারায়ণের দ্বারী জয় সত্যযুগে ‘হিরণ্যাক্ষ’ ত্রেতায় ‘রাবণ’ আর দ্বাপরে ‘শিশুপাল’ রূপে জন্ম নেন।

তিন চোখ আর চার হাত নিয়ে জন্মেই গাধার মতো ডাকতে থাকেন। দৈববাণী হল, যাঁর কোলে উঠলে এর বাড়তি দুটো হাত আর একটা চোখ খসে যাবে, তাঁর হাতেই এঁর মৃত্যু হবে। ভয় পেলেন মা-বাবা।

কৃষ্ণ এসেছেন পিসির বাড়িতে। কৃষ্ণের কোলে দিতেই শিশুর বাড়তি চোখ আর হাত খসে গেল। ভয়ে আঁত্‌কে উঠলেন পিসি। শেষে কিনা ভাইপোর হাতে ছেলের মৃত্যু। কৃষ্ণ পিসিকে কথা দিলেন, শিশুপালের একশ’ অপরাধ ক্ষমা করবেন তিনি। বড় হয়ে এ কথা জেনেই শিশুপাল মনেপ্রাণে কৃষ্ণ-বিদ্বেষী হয়ে উঠলেন।

শিশুপালের সাথে রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক হলে কৃষ্ণ রুক্মিণীকে হরণ করলেন। শিশুপালের ক্রোধের আগুনে ঘি পড়ল।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য ভীষ্মের প্রস্তাবে কৃষ্ণকেই দেওয়া হল। ক্ষিপ্ত শিশুপাল অশ্রাব্য ভাষায় তিরস্কার করলেন ভীষ্ম আর কৃষ্ণকে।

কৃষ্ণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। বললেন, ‘এঁর মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, এঁর একশ’ অপরাধ ক্ষমা করব। তা এঁর অপরাধের সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়ে গেছে। আর ক্ষমার প্রশ্ন নেই।’ বলে তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে মাথা কেটে ফেললেন শিশুপালের।

॥ শুকদেব ॥

অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে কামার্ত ব্যাসদেবের শুক্রপাত হয় যজ্ঞের কাঠে। ভীতা অপ্সরা ঘৃতাচী শুক পাখির রূপ ধরে আকাশে উড়ে যান। কাঠে-কাঠে ঘষতে থাকেন ব্যাসদেব। জ্বলে ওঠে আগুন। সেই আগুন থেকে বেরিয়ে আসে এক দিব্যশিশু। সেই শুকদেব। ঘৃতাচীর শুক পাখি হয়ে উড়ে যাওয়ার ঘটনাকে স্মরণ রেখেই এঁর নাম রাখা হল ‘শুকদেব’।

গঙ্গা নিজে এসে স্নান করালেন শিশুকে। মহাদেব পৈতে দিলেন। ইন্দ্র কমণ্ডলু আর দিব্যাস্ত্র দিলেন। ব্যাসদেব, বৃহস্পতি, জনক, নারদ ইত্যাদি তাঁর শিক্ষাগুরু।

এত কামজয়ী ছিলেন যে অপ্সরারা এঁর সামনে নগ্ন হয়ে থাকতেন। যোগবলে ইনি ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করেন। ব্যাসদেবের চেয়েও জ্ঞানী ছিলেন ইনি।

॥ শূরসেন ॥

কৃষ্ণের ঠাকুর্দা। বাসুদেব, কুন্তী আর শ্রুতশ্রবার বাবা। এঁর স্ত্রী মহিষী। পিসতুতো ভাই কুন্তিভোজকে পালন করার জন্যে দান করেছেন মেয়ে পৃথাকে। কুন্তিভোজ তাঁর নামকরণ করেছেন কুন্তী।

॥ শৃঙ্গী ॥

শমিক মুনির ছেলে। পরিক্ষিৎ একদিন এক মরা সাপ জড়িয়ে দিয়েছিলেন শমিকের গলায়। শৃঙ্গী পরিক্ষিৎকে শাপ দেন, ‘সাত দিনের মধ্যে তক্ষকের কামড়ে আপনার ভবলীলা সাঙ্গ হবে।’ হলও তাই।

॥ শৌনক ॥

এক মহর্ষি। বার বছর ধরে এক যজ্ঞ করেছিলেন। সেখানে পুরাণ-কথক সৌতি সম্পূর্ণ মহাভারত কাহিনী বলে শোনান।

॥ শ্রুতকর্মা ॥

অর্জুন-দ্রৌপদীর ছেলে। শিবির হত্যাকাণ্ডে অশ্বত্থামার হাতে নিহত।

॥ শ্রুতশ্রবা ॥

কুন্তী এবং বসুদেবের বোন। শূরসেন-মহিষীর মেয়ে। চেদিরাজ দম ঘোষের স্ত্রী। শিশুপালের মা। কৃষ্ণের পিসি।

॥ শ্রুতসেন ॥

দ্রৌপদী-সহদেবের ছেলে। শিবির হত্যাকাণ্ডে অশ্বত্থামার হাতে নিহত।

॥ সংকর্ষণ ॥

বলরামের অন্য নাম। ‘বলরাম’ দেখুন।

॥ সঞ্জয় ॥

ধতরাষ্ট্রের পরম নির্ভর। সারথি, সখা, অমাত্য, একাধারে সব। সূত গবল্পনের ছেলে। যুদ্ধ বন্ধের জন্যে ইনি ধৃতরাষ্ট্রকে অনেক বোঝান। কিন্তু পুত্র-স্নেহে অন্ধ পিতাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও টলাতে পারেননি সঞ্জয়।

ব্যাসদেব দিব্যদৃষ্টি দেন সঞ্জয়কে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবিশ্বাস্য ধারাবিবরণী দিয়েছেন সঞ্জয়। সঞ্জয়ই সম্ভবত বিশ্বের প্রথম সাংবাদিক। বিস্ময়কর তাঁর নিরপেক্ষ বর্ণনা। যুদ্ধের শেষে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর এবং সঞ্জয় বাণপ্রস্থে বনে যান। বনের দাবানলে ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখের দেহত্যাগ হলে ইনি ব্যাসদেবের কথামতো হিমালয়ে গিয়ে তপস্যায় দেহ রাখেন।

সঞ্জয় চরিত্র মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর একটা। ত্রিকালজ্ঞ এই অমাত্য-সারথির কর্তব্যনিষ্ঠা অতুলনীয়।

॥ সত্যবতী ॥

শান্তনুর স্ত্রী। চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের মা। ভীষ্মের সৎমা। ব্যাসদেব এঁর কানীন পুত্র, অর্থাৎ কুমারী অবস্থার ছেলে।

চেদিরাজ ‘উপরিচয় বসু’ একদিন মৃগয়ায় থাকাকালীন সুন্দরী স্ত্রী গিরিকার কথা ভাবছিলেন। উত্তেজনার বাড়াবাড়িতে তৎক্ষণাৎ এঁর রেতঃপাত হয়। সেই শুক্র এক বাজকে দিয়ে তখনই পাঠালেন স্ত্রীর কাছে। অন্য এক বাজের আক্রমণে শুক্র পড়ে গেল যমুনার জলে।

অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা ব্রহ্মশাপে মাছ হয়ে থাকতেন যমুনায়। সেই শুক্র খেলেন অদ্রিকা । দশ মাসের মাথায় এক জেলের জালে ধরা পড়লেন অদ্রিকা।

অদ্রিকার পেট কেটে জেলে দুটি শিশুকে দেখতে পেলেন। একটি ছেলে। একটি মেয়ে। অদ্রিকা শাপমুক্ত হলেন।

জেলে ছেলেটির নাম রাখলেন ‘মৎস্য’। আর মেয়েটির নাম ‘সত্যবতী’। গায়ে মাছের গন্ধ থাকায় সত্যবতীর অন্য নাম হল ‘মৎস্যগন্ধা’।

যুবতী মৎস্যগন্ধা খেয়া পার করতেন। পরাশর এঁর নৌকোয় উঠলেন। সত্যবতীর প্রেমে পড়ে গেলেন পরাশর । নদীর মধ্যে কুয়াশা তৈরি করলেন পরাশর। সেখানেই মিলিত হলেন রূপবতী সত্যবতীর সঙ্গে। কাক-পক্ষীও টের পেল না।

এক দ্বীপে এক ঘোর কালো রঙের ছেলের জন্ম দিলেন সত্যবতী । সেই ছেলেই মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

পরাশরের কৃপায় আবার কুমারীত্ব ফিরে পেলেন সত্যবতী। গা থেকে মাছের গন্ধও চলে গেল। বদলে এল যোজনপ্রসারী সুগন্ধ। ‘মৎস্যগন্ধা’ হলেন ‘যোজনগন্ধা’। শান্তনু পড়লেন সত্যবতীর প্রেমে। সত্যবতীর পালক পিতা দাসরাজ শর্ত দিলেন। সত্যবতীর ছেলেকেই রাজা করতে হবে। ভীষ্মের দুই প্রতিজ্ঞায় শান্তনু-সত্যবতীর বিয়ে সম্ভব হল। দুই ছেলে অকালে মারা গেলে সত্যবতীর নির্দেশে দুই পুত্রবধুর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলেন তাঁরই আর এক ছেলে ব্যাসদেব। ভীষ্মকেই এ কাজ করতে বলেছিলেন সত্যবতী। ব্রহ্মচর্য এবং প্রতিজ্ঞা ভাঙতে রাজি হননি ভীষ্ম।

যুদ্ধ শুরুর আগেই ব্যাসদেবের পরামর্শে সত্যবতী বনে গিয়ে তপস্যা করতে থাকেন। সেখানেই তাঁর দেহ যায়।

॥ সত্যব্রত ॥

ভীষ্মের অন্য নাম। ‘ভীষ্ম’ দেখুন।

॥ সব্যসাচী ॥

অর্জুনের অন্য নাম। ‘অর্জুন’ দেখুন।

॥ সমন্তপঞ্চক ॥

কুরুক্ষেত্রের প্রাচীন নাম। ‘কুরুক্ষেত্র’ দেখুন।

॥ সর্বগ ॥

কাশীরাজের মেয়ে বলন্ধরার গর্ভজাত ভীমের ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যান।

॥ সর্বগত ॥

মদ্ররাজ শল্যের বোন কালীর গর্ভজাত ভীমের ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যান।

॥ সহদেব ॥

মাদ্রীর গর্ভজাত পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ ছেলে। দুই অশ্বিনীকুমার ভাইয়ের একজনের ঔরসজাত। নকুল এঁর যমজ এবং সামান্য বড় ভাই। অসাধারণ বুদ্ধিমান ছিলেন। আর সেই বুদ্ধির অহংকারেই মহাপ্রস্থানে যাবার সময় পতন হয় এঁর।

শকুনিবধের প্রতিজ্ঞা পালন করেন ইনি। কুন্তী সতীন মাদ্রীর এই ছেলেটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বনযাত্রার সময় লজ্জায়, অপমানে নিজের মুখে কালি মাখেন সহদেব। এ মুখ আর কাউকে দেখাতে চান না।

যোদ্ধা হিসেবে সহদেব নকুলের মতোই খুবই সাধারণ মানের যোদ্ধা ছিলেন। বিরাট রাজার বাড়িতে ‘তন্তিপাল’ নাম নিয়ে রাজার গোশালার দেখাশোনার ভার নেন সহদেব। নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে তাঁর সাংকেতিক নাম রাখা হয়েছিল ‘জয়দ্বল’।

সহদেবের স্বভাব ছিল ভীমের চেয়েও উগ্র। কৃষ্ণ যুদ্ধ বন্ধের জন্যে দূত হিসেবে হস্তিনায় যাবার সময় এমনকি ভীম-অর্জুনও যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা করতে বলেছেন কৃষ্ণকে। কিন্তু সহদেব আর দ্রৌপদী যুদ্ধই চেয়েছিলেন। প্রতিশোধের আগুন তাঁরা শান্তির ললিত বাণী দিয়ে নেভাতে চাননি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই চেয়েছিলেন তাঁরা।

শকুনি আর তাঁর ছেলে উলুক ছাড়া আর তেমন নামকরা কোনও যোদ্ধাকে মারতে পারেননি সহদেব।

মহাপ্রস্থানের পথে ‘আমার মতো বুদ্ধিমান আর কে থাকতে পারেন?’

—এই অহংকারেই পতন হয়েছে সহদেবের।

সহদেবের চার স্ত্রী ‘দ্রৌপদী’, মদ্ররাজকন্যা ‘বিজয়া’, ভানুমতী’ আর জরাসন্ধের মেয়ে। দ্রৌপদীর গর্ভে ‘শ্রুতসেন’ আর বিজয়ার গর্ভে ‘সুহোত্র’ নামে দুই ছেলে হয় সহদেবের। ভানুমতী আর জরাসন্ধদুহিতার গর্ভজাত সন্তানদের নাম জানা যায় না।

আমাদের হিসেব মতো প্রায় ১০৬ বছর বেঁচেছিলেন সহদেব।

॥ সাত্যকি ॥

যদু বংশীয় রাজা। সত্যকের ছেলে। শিনির নাতি। অন্য নাম ‘যুযুধান’। কৃষ্ণের সারথি। অর্জনের শিষ্য।

অভিমন্যুর বিয়ের পর শান্তিদৌত্যের সভায় বলরাম যুধিষ্ঠিরের কঠোর সমালোচনা করেন। সাত্যকি তার প্রতিবাদ করেন। সাত্যকি যুদ্ধই চেয়েছিলেন। ভূরিশ্রবা প্রতিজ্ঞা রাখতে এঁকে পদাঘাত করলে ইনি ভূরিশ্রবাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেন।

দ্রোণ-হত্যা ইনি সমর্থন করেননি। ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করতে যান। যদু-বংশ ধ্বংস হবার সময় উন্মত্ত সাত্যকি কৃতবর্মাকে হত্যা করেন। ভোজ আর অন্ধকরা থালা দিয়ে পিটিয়ে এঁকে মেরে ফেলেন। সাত্যকিকে বাঁচাতে এসে প্রাণ দেন কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যুম্ন।

॥ সুতসোম ॥

ভীম-দ্রৌপদীর ছেলে। শিবির হত্যায় অশ্বত্থামার হাতে নিহত।

॥ সুদেষ্ণা ॥

বিরাট রাজার স্ত্রী। উত্তর এবং উত্তরার মা। কীচকের দিদি। অভিমন্যুর শাশুড়ি। দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন ‘সৈরিন্ধ্রী’ ছদ্ম নামে এক বছর এঁর পরিচারিকার কাজ করেছেন।

॥ সুবল ॥

গান্ধাররাজা। গান্ধারী, শকুনি ইত্যাদির বাবা। ধৃতরাষ্ট্রের শ্বশুর। দুর্যোধনের দাদামশাই। উলুকের ঠাকুর্দা। শকুনি ছাড়া এঁর বাকি সাত ছেলের নাম হল—গবাক্ষ, শরৎ, বিভু, সুভগ, ভানুদত্ত, বৃষক এবং অচল।

॥ সুভদ্রা ॥

অর্জুনের স্ত্রী। কৃষ্ণ-বলরামের বোন। বসুদেব এবং রোহিণীর মেয়ে। অভিমন্যুর মা। রৈবতক পর্বত সুভদ্রাকে দেখে মুগ্ধ হন অর্জুন। কৃষ্ণের সহায়তায় অর্জুন হরণ করেন সুভদ্রাকে। বলরাম গর্জে ওঠেন। কৃষ্ণ ঠাণ্ডা করেন দাদাকে। সত্যভামার উৎসাহে দ্বারকায় দুজনের বিয়ে হয়। অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন সুভদ্রা। বার্ধক্যেও কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ ছিল তাঁর।

যুদ্ধের সময় সুভদ্রা আর দ্রৌপদী পাণ্ডবদের শিবিরেই থাকতেন। মহাপ্রস্থানে যাবার সময় নাতি পরিক্ষিতের কাছে স্ত্রী সুভদ্রাকে রেখে যান অর্জুন।

ব্যাসদেবের কৃপায় মৃত অভিমন্যুকে একবার দেখতে পেয়েছিলেন।

॥ সুযোধন ॥

দুর্যোধনকে এই নামেই ডাকতেন যুধিষ্ঠির। ‘দুর্যোধন’ দেখুন।

॥ সুরথ ॥

জয়দ্রথের ছেলে। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে অর্জুন সিন্ধু দেশে এসেছেন শুনে ভয়েই ইনি মারা যান।

॥ সুশর্মা ॥

ত্রিগর্তের রাজা। দুর্যোধনের বন্ধু।

বিরাট কীচককে নিয়ে একবার এঁর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। কীচক মারা গেলে সুশর্মা দুর্যোধনের সহায়তায় মৎস্যদেশ আক্রমণ করেন। বিরাট বন্দী হন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম বিরাটকে মুক্ত করে সুশর্মাকে লাথি মারেন। যুধিষ্ঠির সুশর্মাকে মুক্তি দেন।

অভিমন্যুবধের দিন পূর্বপরিকল্পনা মতো অর্জুনকে অনেক দূরে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখেন সুশর্মা। উদ্দেশ্য, অর্জুন যেন চক্রব্যূহে ঢুকতে না পারেন। অভিমন্যুকে হারিয়ে ক্রোধে এঁকে বধ করেন অর্জুন।

॥ সুহোত্র ॥

মদ্ররাজ শল্যের মেয়ে বিজয়ার গর্ভজাত সহদেবের ছেলে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যান।

॥ সূত ॥

কোনও ক্ষত্রিয় কোনও ব্রাহ্মণীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে সেই সন্তানকে বলা হত ‘সূত’। এঁরা মূলত সারথির কাজ করতেন।

॥ সূর্য ॥

হিন্দুদের অন্যতম প্রধান উপাস্য দেবতা। কশ্যপ আর অদিতির ছেলে। তাই নাম আদিত্য। এ ছাড়া অনেক নাম আছে।

দুর্বাসার শেখানো মন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে কুমারী অবস্থায় কিশোরী কুন্তী নিতান্তই কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে এঁকে ডাকেন। সঙ্গে সঙ্গে কুন্তীর একেবারে সামনে এসে হাজির হন সূর্য। কুন্তী সূর্যকে ফিরে যেতে বলেন। কারণ তিনি কুমারী। সূর্য নাছোড়বান্দা। সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয়। লোকজ্জার হাত থেকে বাঁচতে কুন্তী কর্ণকে অশ্ব নদীতে ভাসিয়ে দেন।

সূর্য ছেলেকে পদে পদে সাহায্য করেন। অর্জুনের ধর্মপিতা ইন্দ্রের ছদ্মবেশে কবচ-কুণ্ডল নিতে আসার আগাম খবর ছেলেকে দিলেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কর্ণ ইন্দ্রকে ফেরান নি।

॥ সৈরিন্ধ্রী ॥

অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন দ্রৌপদীর ছদ্ম নাম। ‘দ্রৌপদী’ দেখুন।

॥ সোমদত্ত ॥

কুরুবংশের রাজা বহ্লীকের ছেলে। ভূরিশ্রবার বাবা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধের চোদ্দ দিনের দিন সাত্যকির হাতে প্রাণ দেন।

॥ সৌতি ॥

পুরাণ কথক। লোমহর্ষনের ছেলে। জাতিতে সূত। জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে বৈশম্পায়নের কাছে মহাভারত শোনেন। পরে সে মহাভারত শৌনকের নৈমিষারণ্যের যজ্ঞে মুনিদের শোনান।

॥ সৌবল ॥

শকুনির অন্য নাম। ‘শকুনি’ দেখুন।

॥ সৌবলী ॥

বৈশ্যা দাসী। যুযুৎসুর গর্ভধারিণী মা। গান্ধারী গর্ভবতী থাকাকালীন সৌবলী ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যা করতেন। তখনই এঁর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মজ্ঞ সন্তান ‘যুযুৎসু’র জন্ম হয়। এঁর সম্বন্ধে মহাভারতে খুব বেশি কিছু জানানো হয়নি।

॥ স্থূনাকির্ণ ॥

হিরণ্যবর্মার মেয়ের সাথে শিখণ্ডীর বিয়ে হলে শিখণ্ডী যে পুরুষ নয়, স্ত্রী, তা জানাজানি হয়ে যায়। হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের প্রতারণায় যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শিখণ্ডী আত্মহত্যা করতে বনে গেলে কুবেরের এই অনুচর স্থূনাকর্ণ শিখণ্ডীকে নিজের পৌরুষ ধার দেন। যুদ্ধ শেষে শিখণ্ডী পৌরুষ ফিরিয়ে দিতে আসেন। কিন্তু কুবেরের শাপে স্থূনাকর্ণ স্ত্রী আর শিখণ্ডী পুরুষই হয়ে থাকেন।

॥ হনুমান ॥

রামায়ণেও আছেন। মহাভারতেও আছেন। পবন নন্দন। ভীমের দাদা। দশ চিরজীবীর অন্যতম। দ্রৌপদীর বায়না মেটাতে গন্ধমাদন পর্বতের এক সরোবর থেকে প্রেয়সীর জন্যে সহস্রদল পদ্ম আনতে যাচ্ছিলেন ভীম। হনুমান এঁর পথ আটকালেন।

ভীম বললেন, ‘পথ ছাড়ুন।’

হনুমান বললেন, ‘ছাড়ব না।’

ভীম বললেন, ‘হনুমানের সাগর পার হওয়ার মতো আমিও লাফ দিয়ে আপনাকে ডিঙিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আপনার, আমার, সবার মধ্যে নারায়ণ আছেন। তাই লাফালাম না।’

হনুমান বললেন, ‘হনুমান ? সে আবার কে?’

ভীম বললেন, ‘তিনি আমার দাদা।’

মুচকি হেসে হনুমান বললেন, ‘বেশ তো। আমার বয়স হয়েছে। নড়তে পারছি না। আমার লেজটা সরিয়ে চলে যাও।’

ভীম ব্যর্থ হলেন। বুঝলেন ইনি সামান্য কেউ নন। হনুমানের পরিচয় চাইলেন। পরিচয় পেয়ে সমুদ্র পার হবার সময় তাঁর যে রূপ ছিল, সেই অতিকায় রূপটি একবার দাদাকে দেখাতে বললেন ভীম। সে বিশাল রূপ দেখে ভীম তো অবাক! প্রণাম করলেন দাদাকে।

হনুমান সহস্রদল পদ্মের সন্ধান দিলেন। আর বললেন, ‘আমি রামকে সাহায্য করেছি। তোমাদেরও করব। অর্জুনের রথের পতাকার ওপর বসে এমন হাঁক ডাক লাগিয়ে দেব যে, তাতেই অনেকের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবে।’ পতাকায় হনুমান বসেছিলেন বলেই অর্জুনের রথের নাম হয়েছিল ‘কপিধ্বজ’।

॥ হলাযুধ ॥

বলরামের অন্য নাম। ‘বলরাম’ দেখুন।

॥ হস্তিনাপুর ॥

কৌরবদের রাজধানী। ভরতের বংশধর এবং পাণ্ডব-কৌরবদের পূর্বপুরুষ হস্তী এই নগরের পত্তন করেন তাই হস্তিনাপুর নাম।

দিল্লির পুব দিকে, গঙ্গার দক্ষিণ তীরে, মিরাটের কাছাকাছি হস্তিনাপুরের অবস্থান ছিল বলে মনে করা হয়।

॥ হিড়িম্বা ॥

ভীমের শ্যালক। কুখ্যাত রাক্ষস। নরখাদক। জতুগৃহ থেকে পালিয়ে বনের ভেতর দিয়ে যাবার সময় এই গেছো রাক্ষসের পাল্লায় পড়েন পাণ্ডবরা।

হিড়িম্ব নরমাংস খেতে চেয়ে বোন হিড়িম্বাকে পাঠায় এদের ধরে নিয়ে যেতে। ভীমের রূপে মুগ্ধ হয়ে হিড়িম্বা এক সুন্দরী নারী সেজে ভীমের কাছে গিয়ে দাদার চক্রান্তের কথা ফাঁস করে দেয়। বোনের দেরি দেখে হিড়িম্ব ছুটে আসে।

অন্যরা তখন ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁদের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে হিড়িম্বকে দূরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারেন ভীম। পরে মায়ের কথায় হিড়িম্বাকে বিয়ে করেন ভীম।

॥ হিড়িম্বা ॥

ভীমের স্ত্রী। এঁর ভাই হিড়িম্বকে মেরে ভীম এঁকেও মারতে যান। পরে যুধিষ্ঠির আর কুন্তীর কথায় এবং হিড়িম্বার মিনতিতে এই শর্তে হিড়িম্বাকে বিয়ে করেন যে, সন্তান হলেই হিড়িম্বাকে ছেড়ে ইনি ভাইদের সঙ্গে থাকবেন। হিড়িম্বার গর্ভে ভীমের ছেলে ‘ঘটোৎকচে’র জন্ম হয়।

॥ কিছু জায়গার পৌরাণিক নাম এবং বর্তমান নাম/অবস্থান ॥

রামায়ণ-মহাভারত বা অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী পড়তে গেলেই আমাদের খুবই জানতে ইচ্ছে করে যে, সেই সব পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত জায়গাগুলোর এখনকার নাম কী? কোথায় গেলেই বা সেইসব জায়গা/ নদী/ পাহাড়/ বনের দেখা পাওয়া যাবে? পাঠকের সেই জিজ্ঞাসাকে শ্রদ্ধা জানাতেই এই তথ্যপঞ্জীর অবতারণা। যদিও এ পঞ্জী অসম্পূর্ণই রয়ে গেল, তবু পিপাসা কিছুটা মিটতে পারে—এই প্রত্যাশা।

॥ কিছু জায়গার পৌরাণিক নাম এবং বর্তমান নাম/অবস্থান ॥

পৌরাণিক নামবর্তমান নাম/অবস্থান
অঙ্গদেশমুঙ্গের এবং ভাগলপুর জেলা
অন্ধ্রদেশউত্তর তামিলনাড়ু এবং বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ শহরের কিছুটা।
অবন্তীমালব দেশ। উজ্জয়িনী, মধ্যপ্রদেশ।
অমর কণ্টক (মেকল/ সোম/ আম্রকূট পর্বত)গাণ্ডোয়ানা পর্বত, নাগপুর।
অযোধ্যাঅযোধ্যা, ফয়জাবাদ জেলা
অশ্রুকদাক্ষিণাত্যের কোনও অঞ্চল।
অহল্যাশ্রম বা গৌতমাশ্রমজরাইল পরগণা। ত্রিহুতে। জনকপুর থেকে ২৪ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে।
ইন্দ্রপ্রস্থপুরনো দিল্লির কাছাকাছি শহর। যমুনার তীরে।
উত্তর কুরুউত্তর-পশ্চিম তিব্বত। মতান্তরে সাইবেরিয়া।
উপপ্লব্যমৎস্যরাজ্যের এক শহর। রাজপুতানা। (মতান্তরে জয়পুর, রাজস্থান।)
ঋষ্যমূক পর্বতপূর্বঘাট এবং নীলগিরি পর্বতের মধ্যবর্তী পর্বত। পম্পা সরোবর আর কাবেরী নদীর উৎস।
একচক্রা নগরীবিহারের আরা। (এ নিয়ে মতভেদ আছে।)
ওঘবতীচিত্ৰভ নদীর শাখা—আপগা।
কন্বমুনির আশ্রমরাজপুতানার কাছে। মালিনী (চুকা) নদীর তীরে।
কম্বোজউত্তর কাশ্মীর।
কলিঙ্গমহানদী থেকে গোদাবরী পর্যন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল।
কাম্যক বনকচ্ছ উপসাগরের কাছে, সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল।
কিষ্কিন্ধ্যাবেলারি জেলা। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণে। বিজয়নগরের কাছে। পম্পা সরোবরের অদূরে। কিছুটা কর্নাটকে, কিছুটা অন্ধ্রপ্রদেশে।
কুরুক্ষেত্রপঞ্জাবের আম্বালা এবং কর্নাল জেলা।
কুরুজাঙ্গলকুরুক্ষেত্র এবং তার উত্তর অঞ্চল।
কেকয়শতদ্রু এবং বিপাশা এই দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। (মতান্তরে সিন্ধু নদের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল। সম্ভবত শাহপুর জেলা।)
কেরলাদক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার এবং কানাড়া অঞ্চল। কেরালা।
কৈলাসকৈলাস। তিব্বতের মানস সরোবরের উত্তর-পশ্চিমের হিমালয় শৃঙ্গ।
কোশলউত্তর প্রদেশের অযোধ্যার কাছে ফয়জাবাদ, গঙ্গা এবং বরৈচ জেলা।
কোশল (উত্তর)কোশলের উত্তর অংশ।
কোশল (দক্ষিণ)মধ্যপ্রদেশের ছত্রিশগড় জেলা।
কৌশিকী নদীকুশী বা কেশী নদী।
খাণ্ডবদহইন্দ্রপ্রস্থ। দিল্লির কাছে।
গন্ধমাদন পর্বতরুদ্র-হিমালয়ের উত্তরে। পুরাণ মতে কৈলাসে।
গান্ধারসিন্ধু এবং কাবুল নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। (মতান্তরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।)
গিরিব্রজবিহারের রাজগির।
গৌতমী নদীরগোদাবরী নদী
গৌতমাশ্রমঅহল্যাশ্রমের অন্য নাম। ‘অহল্যাশ্রম’ দেখুন।
চর্মম্বতী নদীচম্বল নদী।
চেদিজব্বলপুরের কাছে। নর্মদা গোদাবরীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।
চোলকাবেরী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল।
জনস্থানঔরঙ্গাবাদ। গোদাবরী এবং কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।
তক্ষশীলা নগরীরাওয়ালপিণ্ডি জেলা। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।
ত্রিগর্তদেশপঞ্জাবের জলন্ধর জেলার কাংড়া উপত্যকা অঞ্চল। (মতান্তরে শতদ্রু নদীর পুব দিকের মরু অঞ্চল। মতান্তরে লাহোর বা তাহোর।)
দণ্ডকারণ্যদণ্ডকারণ্য, মধ্যপ্রদেশ।
দরদদর্দিস্তান। কাশ্মীরের কাছে।
দশার্ণ দেশমধ্যভারতের চম্বল এবং বেতোআ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।
দ্রবিড়দক্ষিণ-পূর্বভারত।
দ্বৈতবনপঞ্জাবের সরস্বতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ‘দেওবাঁদ’ বা ‘দেওবন্দ’। সাহারানপুর।
নিষেধ দেশমধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের পুব দিকে। (মতান্তরে উত্তরপ্রদেশের কুমায়ুনে।)
নৈমিবারণ্য‘নিমখারবন’ বা নিমসার’। উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলায়।
পঞ্চবটীনাসিক। গোদাবরীর তীরে।
পাঞ্চালগঙ্গাদ্বার (হরিদ্বার) থেকে চম্বল পর্যন্ত গঙ্গা আর যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল।
পাণিপ্রস্থপানিপথ। দিল্লির কাছে।
পাণ্ড্যদেশমাদুরা এবং তিনেভেল্লি জেলা। তামিলনাড়ু।
পুন্ড্র দেশউত্তরবঙ্গ।
প্রদ্যুম্ননগরপান্ডুয়া, হুগলি। পশ্চিমবঙ্গ।
প্রাভাসকাথিয়াবাড় অঞ্চলে সমুদ্রের তীরবর্তী তীর্থক্ষেত্র, ‘পভোসা’ বা ‘পাভোসা’।
প্রাগ্‌জ্যোতিষ দেশকামরূপ, আসাম।
প্রাচ্যসরস্বতী নদীর পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল।
ফল্গুগয়ার কাছে নীলাঞ্জনা এবং মোহনা নদীর মিলিত স্রোত। বিহার।
বঙ্গদেশবাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ)।
বৎস দেশপ্রয়াগের পশ্চিম এবং যমুনা নদীর উত্তর দিকের অঞ্চল।
বদরিকাশ্রম (নরনারায়ণাশ্রম)কাশ্মীরের কোনও অঞ্চলে।
বারণাবত‘বরণাওয়া’। মিরাট থেকে ১৯ মাইল উত্তর-পশ্চিমে।
বাল্মীকি-আশ্রমবিঠুর। কানপুর থেকে ১৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। উত্তর প্রদেশ।
বাহীক বা বাহ্লীকদেশসিন্ধু এবং পঞ্চনদ প্রদেশ। মতান্তরে বালখ অঞ্চল।
বিদর্ভ দেশবেরার।
বিদেহ দেশমিথিলা। উত্তর বিহার।
বিশ্বামিত্র-আশ্রমবেদগর্ভপুরী।
ব্রহ্মর্ষি দেশহরিদ্বার থেকে চম্বল পর্যন্ত গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং দিল্লির কাছাকাছি কুরুক্ষেত্র অঞ্চল।
ব্ৰহ্মাবর্তসরস্বতী এবং দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।
ভোজ দেশমালব এবং বিদর্ভের কাছাকাছি অঞ্চল। (মতান্তরে ভূপাল।)
ভৃগু আশ্রমবাগরা সেনি। বালিয়া। উত্তর প্রদেশ।
মগধপাটনা এবং গয়ার কাছাকাছি অঞ্চল।
মণিপুরবর্তমান মণিপুর রাজ্য নয়। মহাভারতের মণিপুর যে ঠিক কোথায় ছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
মৎস্যদেশরাজপুতানা। ঢোলপুরের পশ্চিম দিকে। (মতান্তরে জয়পুর। রাজস্থান।)
মদ্রদেশপঞ্জাব। চন্দ্রভাগা আর ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।
মধ্যদেশহিমালয় পর্বত এবং বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী, প্রয়াগের পশ্চিম এবং কুরুক্ষেত্রের পুব দিকের অঞ্চল।
মন্দার পর্বতভাগলপুর। বিহার।
মহেন্দ্র পর্বতপূর্বঘাট পর্বতমালা।
মালব দেশমালোআ। মধ্যভারত।
মাহিষ্মতী পুরীনিমার জেলা। নর্মদা নদীর তীরে, মধ্যপ্রদেশ।
মিথিলামুজঃফরপুর এবং দ্বারভাঙা জেলা। বিহার।
মেকল দেশঅমরকোটের কাছে। নর্মদা নদীর উৎসের কাছে।
মেরুসম্ভবত হিন্দুকুশ পর্বত।
রৈবতক পর্বতকাথিয়াবাড়, গির্নার।
লংকাশ্রীলংকা।
শাল্ব দেশসম্ভবত রাজপুতানার কোনও অঞ্চল।
সমস্তপঞ্চককুরুক্ষেত্রের অন্তর্গত পাঁচটা হ্রদবিশিষ্ট অঞ্চল।
সুমেরুসম্ভবত হিন্দুকুশ পর্বত।
সুহ্মদেশতমলুকের কাছাকাছি। মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ।
সৌবীর দেশরাজপুতানার দক্ষিণ দিকে। (মতান্তরে সিন্ধু প্রদেশ)।
সৌরাষ্ট্রকাথিয়াবাড় এবং গুজরাট।
হস্তিনাপুরদিল্লির পুব দিকে। মিরাটের কাছে গঙ্গার দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চল।

॥ কিছু আকর্ষণীয় পৌরাণিক/ অন্যান্য তথ্য ॥

(রামায়ণ মহাভারত বা অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থ পাঠ করার সময় পাঠককে প্রায়ই নানা শব্দের, বিশেষ করে সমষ্টিবাচক শব্দের অর্থ এবং তাৎপর্য জানতে হিমসিম খেতে হয়। এদিক ওদিক অজস্র পুঁথি ঘাঁটতে হয়। সে কথা মাথায় রেখেই এই তথ্যপঞ্জীর অবতারণা। সীমাবদ্ধ সাধ্যে যৎসামান্যই দিতে পারলাম। বহু তথ্য নিয়েই নানা মুনির নানা মত। যেখানে যেখানে সম্ভব হয়েছে, একাধিক মত তুলে ধরেছি।)

॥ কিছু আকর্ষণীয় পৌরাণিক/অন্যান্য তথ্য ॥

॥ এক মন্বন্তর ॥

এক মন্বন্তর=একজন মনুর রাজত্বকাল=৩০,৬৭,২০,০০০ বছর

(তিরিশ কোটি, সাতষট্টি লক্ষ, কুড়ি হাজার বছর।)

মোট ১৪ জন মনু আছেন। এঁদের প্রত্যেকে এক মন্বন্তরকাল ধরে রাজত্ব করেন।

॥ এক কল্পকাল ॥

এক কল্পকাল=ব্রহ্মার এক দিন

=১৪ জন মনুর রাজত্বকাল।

=১৪×৩০,৬৭,২০,০০০ বছর।

=৪২৯,৪০,৮০,০০০ বছর।

॥ একেশ্বরবাদ ॥

ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়—এই দার্শনিক মতবাদ।

॥ দ্বৈতবাদ ॥

ঈশ্বরের দুটি সত্তা—জীবাত্মা এবং পরমাত্মা অথবা প্রকৃতি এবং পুরুষ—এই দার্শনিক মতবাদ।

॥ দ্বৈরথ ॥

দুই রথারূঢ় যোদ্ধার যুদ্ধ।

॥ ত্রিকাল ॥

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।

॥ ত্ৰিকুল ॥

পিতৃকুল, মাতৃকুল, শ্বশুরকুল।

॥ ত্রিগুণ ॥

সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ।

॥ ত্রিতাপ ॥

আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক।

॥ ত্রিদণ্ড ॥

বাগ্‌দণ্ড, মনোদণ্ড, কায়দণ্ড।

॥ ত্রিদোষ ॥

বাত (বায়ু), পিত্ত, কফ।

॥ ত্রিধারা ॥

স্বর্গ, মর্ত, পাতাল—এই তিন লোকে গঙ্গার তিন ধারা। স্বর্গে—মন্দাকিনী, মর্তে—ভাগীরথী বা অলকানন্দা এবং পাতালে—ভোগবতী।

॥ ত্রিপাপ ॥

মহাপাতক, অতিপাতক, উপপাতক।

॥ ত্রিপিটক ॥

সূত্ত (সূত্র), অভিধম্ম (অভিধর্ম) এবং বিনয়—বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের এই তিন ভাগ।

॥ ত্রিফলা ॥

হরিতকী, আমলকী, বিভীতকী (বহেড়া)।

॥ ত্রিবর্গ ॥

ধর্ম, অর্থ, কাম।

॥ ত্রিবেণী ॥

গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী—এই তিন নদী বা তাদের মিলন/বিচ্ছেদের স্থান।

॥ ত্রিমূর্তি ॥

ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।

॥ ত্রিরত্ন ॥

বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ। (বৌদ্ধধর্মে)।

॥ ত্রিলোক ॥

স্বর্গ, মর্ত, পাতাল।

॥ ত্রিসন্ধ্যা ॥

প্রাতঃকাল (ভোরবেলা), মধ্যাহ্নকাল (দুপুরবেলা), অপরাহ্ন (সন্ধ্যেবেলা)।

॥ ত্র্যক্ষর ॥

অ+উ+ম=ওঁ, এই প্রণব মন্ত্র।

॥ চতুরঙ্গ ॥

হাতি, ঘোড়া, রথ এবং পদাতি—এই চার রকম শাখাই আছে, এমন সেনাবাহিনী।

॥ চতুরাশ্রম ॥

ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস।

॥ চতুর্বর্গ ॥

ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চার পুরুষার্থ।

॥ চতুর্বর্ণ ॥

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।

॥ চতুর্বেদ ॥

ঋক্, যজুঃ, সাম, অথর্ব।

॥ চতুষ্পাঠী ॥

(১) যে বিদ্যালয়ে চার বেদ পড়ানো হয়।

অথবা

(২) যে বিদ্যালয়ে ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি এবং দর্শন—এই চার শাস্ত্র পড়ানো হয়।

॥ চার দাশরথি ॥

রাম, ভরত, লক্ষ্মণ, শক্রঘ্ন। দশরথের ছেলে। তাই এঁরা সকলেই দাশরথি।

॥ চার মহর্ষি ॥

সনক, সনন্দন, সনৎকুমার, সনাতন।

॥ চারযুগ ॥

সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি।

॥ পঞ্চকন্যা ॥

অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দেদারী।

॥ পঞ্চকোষ ॥

অন্নময়কোষ, প্রাণময়কোষ, মনোময়কোষ, জ্ঞানময়কোষ, আনন্দময়কোষ।

॥ পঞ্চগঙ্গা ॥

ভাগীরথী, গৌতমী, কৃষ্ণবেণী, পিনাকিনী, কাবেরী।

॥ পঞ্চগব্য ॥

দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, গোমূত্র, গোময়।

॥ পঞ্চগুণ (পঞ্চ তন্মাত্র) ॥

রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ।

॥ পঞ্চতপা ॥

চারদিকে চার অগ্নিকুণ্ড আর মাথার ওপর সূর্য—এই পাঁচ আগুনের উৎসের তাপে বসে যে তপস্যা করা হয়, বা যিনি এই তপস্যা করেন। শ্রী শ্রীমা সারদাদেবী বেলুড়ে এই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেন।

॥ পঞ্চতীর্থ ॥

কুরুক্ষেত্র, গয়া, গঙ্গা, প্রভাস, পুষ্কর।

॥ পঞ্চদেবতা ॥

গণেশ, গৌরী, আদিত্য, রুদ্র, কেশব।

॥ পঞ্চনদ ॥

(১) শত, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা—এই পাঁচ নদী—বিধৌত দেশ (পঞ্জাব)।

(২) কিরণা, ধুতপাপা, সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনা—এই পাঁচনদীর সমাহার বা তাদের তীরবর্তী তীর্থক্ষেত্র।

॥ পঞ্চপল্লব ॥

আম, অশ্বত্থ, বট, পাকুড়, যজ্ঞডুমুর।

॥ পঞ্চপাণ্ডব ॥

যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব।

॥ পঞ্চপিতা ॥

জম্মদাতা, ভয়ত্ৰাতা, শ্বশুর, বিদ্যা বা দীক্ষাদাতা, অন্নদাতা।

॥ পঞ্চবটী ॥

অশ্বত্থ, বট, বেল, আমলকী, অশোক—এই পাঁচ রকম গাছের বন।

॥ পঞ্চবাণ (পঞ্চশর) ॥

(১) সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন, স্তম্ভন।

(২) অরবিন্দ, অশোক, আম্র (আম), নবমল্লিকা, রক্তোৎপল (লালপদ্ম)।

॥ পঞ্চবায়ু ॥

প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান—শরীরের ভেতরের এই পাঁচ বায়ু।

॥ পঞ্চভূত ॥

ক্ষিতি, অপ্‌, তেজঃ, মরুৎ ব্যোম।

॥ পঞ্চমকার ॥

মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন—তন্ত্রসাধনার এই পাঁচ অঙ্গ।

॥ পঞ্চমহাপাতক ॥

ব্রহ্মহত্যা, ব্রহ্মস্বাহরণ, গুরুপত্নীতে উপগমন, সুরাপান এবং এই চার রকম মহাপাপ কাজ যাঁরা করেন তাঁদের সংসর্গে বাস করা।

॥ পঞ্চ মহাযজ্ঞ ॥

ব্ৰহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ।

॥ পঞ্চরত্ন ॥

নীলকান্ত, হীরক, পদ্মরাগ, মুক্তা, প্রবাল।

॥ পঞ্চলক্ষ্মণী ॥

যে পাঁচ বিশেষ লক্ষ্মণ না থাকলে পুরাণ সম্পূর্ণ হয় না—সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত।

॥ পঞ্চ শস্য ॥

ধান, মাসকলাই, যব, তিল (বা সাদা সরষে), মুগ।

॥ পঞ্চামৃত ॥

দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু, চিনি।

॥ পঞ্চেন্দ্রিয় ॥

(১) জ্ঞানেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্‌।

(২) কর্মেন্দ্রিয়— বাক্‌, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

॥ পঞ্চায়ুধ ॥

তরবারি, শক্তি, ধনুঃ, পরশু, বর্ম।

॥ পঞ্চোপচার ॥

গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য।

॥ ষট্‌কর্ম ॥

যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান, প্রতিগ্রহ।

॥ ষট্‌চক্র ॥

মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপূরক (বা মণিপুর), অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা।

॥ ষড়ঙ্গ (ষড়্‌ অঙ্গ) ॥

(১) মাথা, কোমর, দুই হাত, দুই পা—দেহের এই ছয় অঙ্গ।

(২) শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ—বেদের এই ছয় অঙ্গ।

॥ ষড়ঋতু ॥

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত।

॥ ষড়গুণ ॥

সন্ধি, বিগ্রহ, যান, আসন, দ্বৈধ, আশ্রয়।

॥ ষড়দর্শন ॥

সাংখ্য, পাতঞ্জল, পূর্বমীমাংসা, উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত, ন্যায়, বৈশেষিক।

॥ ষড়দুর্গ ॥

নৃদুর্গ, মৃদ্দুর্গ, বনদুর্গ, গিরিদুর্গ, মহীদুর্গ, ধম্বদুর্গ—রাজাদের এই ছ’রকম দুর্গ।

॥ ষড় রস ॥

লবণ, অম্ল, কষায়, কটু, তিক্ত, মধুর।

॥ ষড়্‌ রিপু (ষড়বর্গ) ॥

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য।

॥ ষড়ৈশ্বর্য ॥

ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য।

॥ সপ্তজিহ্ব (অগ্নির সপ্তজিহ্বা) ॥

(১) কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধুম্রবর্ণা, ফুলিঙ্গিনী, বিশ্বনিরূপিনী ।

(২) আবহ, প্রবহ, উদ্বহ, সংবহ, বিবাহ, নিবহ, পরিবহ।

॥ সপ্তদ্বীপ ॥

জম্বু, কুশ, প্লক্ষ, শাল্মলী, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর।

॥ সপ্তদ্বীপপতি ॥

অগ্নিধ্র, মেধাতিথি, বপুষ্মান্‌, জ্যোতিষ্মান্‌, দ্যুতিমান, ভব্য, সবন।

॥ সপ্তপাতাল ॥

তল, অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল।

॥ সিপ্তমরুৎ ॥

আবহ, প্রবহ, বিবহ, পরাবহ, উদ্বহ, সংবহ, পরিবহ।

॥ সপ্তরথী ॥

যে সাত মহারথী সম্মিলিত আক্রমণে অসহায় বালক অভিমন্যুকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন, তাঁরাই সপ্তরথী। এঁদের নাম নিয়ে নানা মত আছে। কিছু মত আমরা এখানে তুলে ধরলাম—

(১) কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপাচার্য, দুর্যোধন, দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, জয়দ্রথ।

(২) দ্রোণাচার্য, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, শকুনি, দুর্যোধন, দুঃশাসন।

(৩) দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্ধল, কৃতবর্মা, দুঃশাসনের ছেলে।

(৪) দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, শকুনি, জয়দ্ৰথ, দুঃশাসন।

॥ সপ্তর্ষি ॥

মরীচি, অত্রি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু, অঙ্গিরা, ভৃগু (মতান্তরে বশিষ্ঠ)।

ওপরে যে সপ্তর্ষিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, এঁরা সকলেই প্রথম মনু ‘স্বায়ম্ভব’র মন্বন্তরে (অর্থাৎ স্বায়ম্ভুব মনুর রাজত্বকালে) ‘সপ্তর্ষি’ হয়েছিলেন।

সপ্তম মনু বৈবস্বতের মন্বন্তরের সপ্তর্ষিদের নাম হল—

অত্রি, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, গৌতম, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র এবং জমদগ্নি।

এখন এই বৈবস্বত মনুরই আমল চলছে।

প্রকৃতপক্ষে ‘সপ্তর্ষি’ শ্রেণীভুক্ত ঋষিদের সংখ্যা ৯৮। কারণ প্রত্যেক মনুই নিজ নিজ মন্বন্তরে আলাদা আলাদা করে দেবতা, ইন্দ্র, সপ্তর্ষি ইত্যাদি সৃষ্টি করেন। মনু আছেন ১৪ জন। কাজেই ‘সপ্তর্ষি’ পর্যায়ের ঋষির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৪×৭=৯৮ জন।

১৪ সেট ‘সপ্তর্ষির নামে মিল থাকলেও তাঁরা আলাদা আলাদা ঋষি। কারণ, প্রতি মনুই নিজের ৩০,৬৭,২০,০০০ বছর রাজত্বকালের শেষে নিজের সব সৃষ্টিকে বিনাশ করে ফেলেন।

বর্তমান মন্বন্তরের সপ্তর্ষিদের মধ্যে ভৃগু এবং বশিষ্ঠকে নিয়ে মতান্তর আছে। কেউ গ্রহণ করেছেন ভৃগুকে। আবার কেউ বশিষ্ঠকে। গীতায় স্বয়ং শ্রীভগবানের উক্তি অনুসারে ভৃগুর নির্বাচন যথাযথ বলে মনে করি।

॥ সপ্তর্ষিপত্নীদের নাম ॥

ঋষিস্ত্রী
মরীচিকলা
অত্রিঅনসূয়া
পুলহক্ষমা
পুলস্ত্যহবির্ভূ
ত্রুতুসন্নতি
অঙ্গিরাশ্রদ্ধা
*বশিষ্ঠঅরুন্ধতী
*ভৃগু(১) পুলোমা (রামায়ণ মতে)
(২) খ্যাতি (বিষ্ণুপুরাণ মতে)

(* সপ্তর্ষিদের মধ্যে ভৃগু এবং বশিষ্ঠকে নিয়ে মতান্তর আছে।)

॥ সপ্তস্বর্গ (সপ্তলোক) ॥

ভুঃ ভুবঃ স্বঃ, জন, মহঃ, তপঃ, সত্য।

॥ সপ্তসমুদ্র (সপ্তসিন্ধু) ॥

লবণ, ইক্ষুরস, সুরা, ঘৃত, দধি, ক্ষীর, স্বাদূদক।

অর্থাৎ

নুন, আখ-রস, মদ, ঘি, দই, দুধ, জল।

॥ সপ্তসাম ॥

রথন্তর, বৃহকৎসাম, বামদেব্য, বৈরূপ, পাবমান, বৈরাজ, চান্দ্রমস।

॥ সপ্তাঙ্গ ॥

স্বামী, অমাত্য, সুহৃৎ কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ, বল।

॥ সপ্তাশ্ব ॥

গায়ত্রী, উষ্ণিগ্‌, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙ্‌ক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী।

॥ সপ্তাহ (সপ্ত অহম্) ॥

রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি।

॥ অষ্টচণ্ডী ॥

মঙ্গলা, বিমলা, সর্বমঙ্গলা, কালী, রাত্ৰিকালিকা, বিকটা, কামাখ্যা, ভবানী।

॥ অষ্টকলাই ॥

কলাই, মুগ, ছোলা, মটর, তিল, খই, চিঁড়ে, চালভাজা (বা মুড়ি)।

॥ অষ্টতারিণী ॥

তারা, উগ্রা, মহোগ্রা, বজ্ৰা (মতান্তরে কলা), কালী, সরস্বতী, কামেশ্বরী, চামুণ্ডা।

॥ অষ্টদিকপাল ॥

ইন্দ্র, বহ্নি, যম, নৈর্ঋত, বরুণ, মরুৎ কুবের, ঈশান।

॥ অষ্টদিগ্‌গজ ॥

ঐরাবত, পুণ্ডরীক, বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পদন্ত, সার্বভৌম, সুপ্রতীক।

॥ অষ্টধর্ম ॥

সত্য, শৌচ, অহিংসা, অনসূয়া, ক্ষমা, আনৃশংস্য, অকার্পণ্য, সন্তোষ।

॥ অষ্টধাতু ॥

স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিত্তল, কাংস্য, ত্রপু, সীসক, লৌহ।

অথাৎ,

সোনা, রুপো, তামা, পেতল, কাঁসা, রাং, সিসে, লোহা।

॥ অষ্টনাগ ॥

অনন্ত, বাসুকী, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কট, শঙ্খ।

॥ অষ্টনায়িকা ॥

(১) মঙ্গলা, বিজয়া, ভদ্রা, জয়ন্তী, অপরাজিতা, নন্দিনী, নারসিংহী, কৌমারী।

(২) উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, অতিচণ্ডা, চামুণ্ডা, চণ্ডা, চণ্ডাবতী।

(৩) অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা, কলহান্তরিতা, স্বাধীনভর্তৃকা, প্রোষিতভর্তৃকা।

॥ অষ্টপাশ ॥

ঘৃণা, অপমান, লজ্জা, মান, মোহ, দম্ভ, দ্বেষ, পেশুন্য।

॥ অষ্টবজ্র ॥

আট জন দেবদেবীর আট রকম অস্ত্রকে একসঙ্গে বলা হয় অষ্টবজ্র। ওইসব বজ্রের নাম এইরকম

দেব/দেবীবজ্র
বিষ্ণুসুদর্শন চক্র।
শিবত্রিশূল।
ব্রহ্মাঅক্ষ।
ইন্দ্রবজ্র।
বরুণপাশ।
যমদণ্ড।
কার্তিকশক্তি।
দুর্গাঅসি।

॥ অষ্ট বসু ॥

অষ্ট বসু হলেন দক্ষের মেয়ে বসুর গর্ভজাত ধর্মের আট ছেলে। এঁদের নাম নিয়ে নানা মত। আমরা এখানে কয়েকটি মত তুলে ধরলাম:

(১) আপ, ধ্রুব, সোম, ধর, অনিল, অনল, প্রত্যূষ, প্রভাস।

(২) ধর, ধ্রুব, সোম, অনিল, অনল, সাবিত্র, প্রত্যূষ, প্রভাস।

(৩) (বিষ্ণু পুরান মতে— )

দ্রোণ (ইনি অর্জুনের গুরু দ্রোণ নন), প্রাণ, ধ্রুব, অর্ক, অগ্নি, দোষ, বাস্তু, বিভাবসু।

(৪) (মহাভারত মতে— ) বহুরূপ, ত্র্যম্বক, সাবিত্র, দ্যু, সুরেশ্বর, জয়ন্ত, পিনাকী, অপরাজিতা।

(৫) ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যূষ, প্রভব।

(৬) আপ, ধ্রুব, সোম, অনল, অনিল, ধর, প্রত্যূষ, প্রভব।

॥ অষ্টভৈরব ॥

আসিতাঙ্গ, রুক, চণ্ড, ক্রোধোন্মত্ত, ভয়ংকর, কপালী, ভীষণ, সংহার।

॥ অষ্টমঙ্গল ॥

(১) ব্রাহ্মণ, গো, হুতাশন, স্বর্ণ, ঘৃত, আদিত্য, জল, রাজা।

(২) সিংহ, বৃষ, হস্তী, জলকুম্ভ, ব্যজন, ধ্বজ, শঙ্খ দীপ।

(৩) চার খুর, লেজ, মুখ, বুক এবং পিঠ— এই আট জায়গায় সাদা দাগ আছে, এমন ঘোড়া।

॥ অষ্টমূর্তি ॥

(১) শিবের আট রূপ— সর্ব, ভব, রুদ্র, উগ্র, ভীম, পশুপতি, মহাদেব, ঈশান।

(২) পঞ্চভূত, সূর্য, চন্দ্র, যজমান।

॥ অষ্টমূত্র ॥

গরু, ভেড়া, ছাগল, মোষ, হাতি, ঘোড়া, গাধা আর উট—এই আট প্রাণীর মূত্র।

॥ অষ্টযোগিনী (মা দুর্গার অষ্টসখী) ॥

শৈলপুত্রী, চণ্ডঘণ্টা, স্কন্দমাতা, কালরাত্রি, চণ্ডিকা, কুষ্মাণ্ডী, কাত্যায়নী, মহাগৌরী।

॥ অষ্টরস ॥

শৃঙ্গার, বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র।

॥ অষ্টসিদ্ধি ॥

অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম, ঈশিত্ব, বশিত্ব।

॥ অষ্টাঙ্গ ॥

(১) দুই হাত, হৃদয়, কপাল, দুই চোখ, গলা (মতান্তরে বাক্য), মেরুদণ্ড (মতান্তরে মন)।

(২) দুই পায়ের দুই বুড়ো আঙুল, দুই হাঁটু, দুই হাত, বুক, নাক।

(৩) যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা, সমাধি।

॥ নবগ্রহ ॥

রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু, কেতু। এ হল পৌরাণিক মত। খুব সঙ্গত এবং স্বাভাবিক কারণেই আধুনিক বিজ্ঞান-সচেতন মানুষ নবগ্রহের এই পৌরাণিক তালিকা প্রত্যাখ্যান করবেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলবেন আমাদের সবচেয়ে কাছের ‘তারা’ সূর্য ‘গ্রহ’ হয়ে গেল কি করে? আমাদের পৃথিবীর সবেধন নীলমণি একমাত্র ‘উপগ্রহ’ চাঁদই বা ‘গ্রহে’র মর্যাদা পেয়ে গেল কেমন করে? রাহু, কেতুই বা কী বস্তু? ইত্যাদি ইত্যাদি।

পৌরাণিক যুগে জ্যোতির্বিদরা খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে যে সব তথ্য আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, তাই যথেষ্ট বিস্ময়কর। তাঁদের যুগে নানা কুসংস্কার তাঁদের নির্মোহ চিন্তাকে অবশ্যই আচ্ছন্ন করেছিল। আধুনিক যন্ত্রপাতি-নির্ভর গবেষণার কথা তাঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। তাই তাঁদের সীমাবদ্ধতার নিন্দে করার থেকে তাঁদের বিস্ময়কর সাফল্যের প্রশংসা করাই বোধহয় যথোচিত হবে।

তাঁদের ভুলগুলোকে তা বলে আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। অবশ্যই তাদের সংশোধন করব।

আধুনিক বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সূর্য থেকে দূরত্বের নিরিখে সৌর জগতের অসংখ্য গ্রহতুল্য বস্তুপিণ্ডের মধ্যে প্রধান ন’টি গ্রহের নাম হল যথাক্রমে— বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন এবং প্লুটো।

গ্রহণের সময় পৃথিবীর যে-ছায়ায় চাঁদ ঢুকে পড়ে, বা চাঁদের যে-ছায়ায় পৃথিবী ঢুকে পড়ে তাদের (অথাৎ ওই নিছক ছায়াদের) যদি কেউ এখনও ‘রাহু’ বা ‘কেতু’ নামে ডেকে আনন্দ পান, তো ডাকুন। কিন্তু রাহু কেতুর অস্তিত্ব ওই ছায়াতেই শুরু, ছায়াতেই শেষ। কায়াহীন এই দুই ছায়াসুর কখনই গ্রহের মর্যাদা পেতে পারে না।

॥ নবদুর্গা ॥

(১) পার্বতী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুম্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদা।

(২) কালী, কাত্যায়নী, ঈশানী, মুণ্ডমর্দিনী, চামুণ্ডা, ভদ্রকালী, ভদ্রা, ত্বরিতা, বৈষ্ণবী।

॥ নবদ্বার ॥

দুই চোখ, দুই কান, নাকের দুই ছিদ্র, মুখ, পায়ু, উপস্থ।

॥ নবধাতু ॥

সোনা, রুপো, পেতল, সিসে, তামা, রাং, লোহা, কাঁসা, ইস্পাত।

॥ নবপত্রিকা ॥

কলা, কচু, ধান, হলুদ, ডালিম, বেল, অশোক, জয়ন্তী এবং মানকচু—এই ন’রকম গাছের পাতা দিয়ে তৈরি স্ত্রী-মূর্তি বা ‘কলা বৌ’।

॥ নবরত্ন ॥

(১) মুক্তা, মাণিক্য, বৈদুর্য, গোমেদ, বজ্র, বিদ্রুম, পদ্মরাগ, মরকত, নীলকান্ত—এই ন’টা রত্ন।

(২) ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শংকু, বেতালভট্ট, ঘটকৰ্পর, কালিদাস, বরাহমিহির, বররুচি—রাজা বিক্রমাদিত্যের এই নয়জন সভাপণ্ডিত।

॥ নবলক্ষ্মণ (নবগুণ) ॥

আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপ, দান।

॥ নবশক্তি ॥

বিমলা, উৎকর্ষণী, জ্ঞানা, যোগা, ক্রিয়া, প্রহরী, সত্যা, ঈশানী, অনুগ্রা।

॥ নবশায়ক (নবশাক) ॥

তিলি, মালাকার, তাঁতী, সদ্‌গোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুম্ভকার, ময়রা।

॥ দশকর্ম ॥

গভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ।

॥ দশ চিরজীবী ॥

বিষ্ণু, কাক, মার্কেণ্ডেয়, অশ্বত্থামা, বলি, ব্যাস, হনুমান, বিভীষণ, কৃপ এবং পরশুরাম—এই দশজনের মৃত্যু নেই। এঁরা অমর।

॥ দশ দিক ॥

পৌরাণিক নামআধুনিক নাম
পূর্বপূর্ব (পুব)
অগ্নিদক্ষিণ-পূর্ব
দক্ষিণদক্ষিণ
নৈর্ঋতদক্ষিণ-পশ্চিম
পশ্চিমপশ্চিম
বায়ুউত্তর-পশ্চিম
উত্তরউত্তর
ঈশানউত্তর পূর্ব
ঊর্ধ্বঊর্ধ্ব (ওপর)
অধঃঅধঃ/নিম্ন (নিচ)

॥ দিশ দিকপাল ॥

দশ দিকের রক্ষাকর্তা দশ জন হলেন—

দিকদেবতা
পূর্বইন্দ্র
অগ্নিঅগ্নি
দক্ষিণযম
নির্ঋতনির্ঋত
পশ্চিমবরুণ
বায়ুমরুৎ
উত্তরকুবের
ঈশানঈশ
উর্ধ্বব্রহ্মা
অধঃঅনন্ত

॥ দশবল ॥

দান, শীল, ক্ষমা, বীর্য, ধ্যান, যজ্ঞ, বল, উপায়, প্রণিধি, জ্ঞান বুদ্ধদেব এই দশ বলে বলীয়ান ছিলেন।

॥ দশমহাবিদ্যা ॥

কালী, তারা, যোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা (মতান্তরে রাজরাজেশ্বরী)—আদ্যাশক্তি মহামায়া মা দুর্গার এই দশ রূপই ‘দশমহাবিদ্যা’।

॥ দশমূল (পাচনের উপকরণ) ॥

বেল, শ্যোনাক, গাম্ভারী, পাটলা, গণিকারিকা, শালপর্ণী, পৃশ্নিপর্ণী, বৃহতী, কণ্টকারী, গোক্ষুর।

॥ দশহরা ॥

দশবিধ পাপহারিণী মা গঙ্গা। মা গঙ্গা যে তিথিতে মর্তে অবতরণ করেছিলেন, সেই তিথিকেও (জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমী তিথি)। দশহরা বলে। শাস্ত্রমতে ওই দিন গঙ্গায় স্নান করলে এই দশ রকম পাপ ক্ষয় হয়। অথাৎ, এই দশ রকম পাপের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়—

(১) অদত্ত বস্তুর গ্রহণ (অর্থাৎ চুরি)

(২) অবৈধ হিংসা (শাস্ত্রনিষিদ্ধ জীবহত্যা),

(৩) পরদারগমন (পরস্ত্রীর সাথে অবৈধ মিলন),

(৪) পরুষ ব্যবহার (কর্কশ নিষ্ঠুর আচরণ),

(৫) মিথ্যা কথন (মিথ্যে কথা বলা),

(৬) ক্রূরতা (নির্দয়তা/হিংস্রতা),

(৭) অসংবদ্ধ প্রলাপ (পাগলের মতো কথাবার্তা),

(৮) অপরের বস্তুলাভে অভিলাষ (পরের জিনিস পাবার লোভ),

(৯) মনে মনে অন্যের অনিষ্টচিন্তা (পরের ক্ষতি করার ইচ্ছে),

(১০) মিথ্যা অভিনিবেশ (একাগ্রতার ভান/ ভণ্ডামী)।

এর মধ্যে প্রথম তিনটে হল ‘কায়িক পাপ’। পরের চারটে হল ‘বাত্ময় পাপ’ বা কথা ঠিকমতো না বলার পাপ। আর শেষ তিনটে হল ‘মানসিক পাপ’।

॥ দশা ॥

মানুষের মনের দশরকম অবস্থা—অভিলাষ, চিন্তা, স্মৃতি, গুণকীর্তন, উদ্বেগ, প্রলাপ, উন্মাদ, ব্যাধি, জড়তা, মরণ।

॥ দশাবতার (দশ অবতার) ॥

মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম কৃষ্ণ, (মতান্তরে বলরাম, মতান্তরে কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই) বুদ্ধ, কল্কি।

॥ একাদশ রুদ্র (একাদশ তনু) ॥

অজ, একপাদ, অহিব্রধ্ন, পিনাকী, অপরাজিত, এ্যম্বক, মহেশ্বর, বৃষাকপি, শম্ভু, হরণ, ঈশ্বর।

॥ দ্বাদশ আদিত্য ॥

দেবমাতা আদিতির গর্ভজাত কশ্যপের বার ছেলে। এঁরা হলেন—

(১) ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা, বিষ্ণু।

মতান্তরে,

(২) বিবস্বান্‌, অর্যমা, পূষা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ, ধাতা, বিধাতা, বরুণ, মিত্র, শত্রু, উরুক্রম।

॥ দ্বাদশ পুত্র ॥

ঔরস, ক্ষেত্রজ, দত্ত, কৃত্রিম, গূঢ়োৎপন্ন, অপবিদ্ধ, কানীন, সহোঢ়, ক্রীত, পৌণর্ভব, স্বয়ংদত্ত, শৌদ্র।

॥ দ্বাদশ মল ॥

বসা, শুক্র, রক্ত, মজ্জা, মূত্র, বিষ্ঠা, কর্ণকিট, নখ, শ্লেষ্মা, অস্থি, দৃষিকা, স্বেদ।

॥ দ্বাদশ মাস ॥

বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র।

॥ দ্বাদশ রাশি ॥

মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ, মীন।

॥ দ্বাদশাক্ষর (বিষ্ণু মন্ত্র) ॥

“ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়”—ভগবান বিষ্ণুকে ডাকার এই বার অক্ষর বিশিষ্ট মন্ত্র।

॥ চতুর্দশ বিদ্যা ॥

ছয় বেদাঙ্গ, চারবেদ, মীমাংসা, ন্যায়, ইতিহাস এবং পুরাণ

॥ চর্তুদশ ভুবন ॥

সপ্ত স্বর্গ, এবং সপ্ত পাতাল।

॥ চতুর্দশ মনু ॥

(১) স্বায়ম্ভুব, স্বারোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি, ইন্দ্রসাবর্ণি।

মতান্তরে

(২) (মৎস্যপুরাণ মতে— ) স্বায়ম্ভুব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবতঃ, চাক্ষুস বৈবস্বত, সাবর্ণি, রোচ্য, ভৌত্যঃ, মেরুসাবর্ণি, ঋভু, ঋতুভামা, বিষ্কক্‌সেন।

॥ ঘোড়শ মাতৃকা ॥

গৌরী, পদ্ম, শচী, মেধা, সাবিত্রী, বিজয়া, জয়া, দেবসেনা, স্বধা, স্বাহা, শান্তি, পুষ্টি, ধৃতি, তুষ্টি, কুলদেবতা, আত্মদেবতা।

॥ ষোড়শ দান ॥

ভূমি, আসন, জল, বস্ত্র, দীপ, অন্ন, তাম্বুল, ছত্র, গন্ধ, মাল্য, ফল, শয্যা, পাদুকা, গো, কাঞ্চন, রজত।

॥ যোড়শাঙ্গ (ধূপ) ॥

গুগগুল, সরল, দারু, পত্র, চন্দন, হ্রীবের, অগুরু, কাষ্ঠ, গুড়, সর্জরস, ঘন, হরিতকী, নখী, লাক্ষা, জটামাংসী, শৈলেয়।

॥ যোড়শোপচার ॥

(১) শক্তিপূজার ক্ষেত্রে— পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, স্নান, বসন, ভূষণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, আচমন, মদ্য, তাম্বুল, তর্পণ, নতি।

(২) অন্যান্য পূজার ক্ষেত্রে— আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, স্নান, বসন, আভরণ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, চন্দন।

॥ অষ্টাদশ মহাপুরাণ ॥

বিষ্ণু, নারদীয়, ভাগবত, গরুড়, পদ্ম, বরাহ, ব্রহ্মা, ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মবৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য, বামন, মৎস্য, কৃর্ম, লিঙ্গ, শিব (মতান্তরে বায়ু), স্কন্দ, অগ্নি।

এর মধ্যে প্রথম ছ’টি ‘সত্ত্বগুনী’, পরবর্তী ছ’টি ‘রজোগুণী’ এবং শেষ ছ’টি ‘তমোগুণী’ পুরাণ।

॥ অষ্টাদশ উপপুরাণ ॥

সনৎকুমার, নরসিংহ, নারদীয়, শিব, দুর্বাসা, কপিল, মানব, ঔষনস, বরুণ, কালিকা, শাম্ব, নন্দী, সৌর, পরাশর, আদিত্য, মহেশ্বর, ভাগবত, বশিষ্ঠ।

॥ অষ্টাদশ বিদ্যা ॥

চার বেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ, জ্যোতিষ, মীমাংসা, ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ব, অর্থশাস্ত্র।

॥ সাতাশ নক্ষত্র (চাঁদের সাতাশ স্ত্রী) ॥

অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফল্গুনী, উত্তরফল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদী, উত্তরভাদ্রপদী, রেবতী।

॥ আরও কিছু তথ্য ॥

কোন যুগ কতদিন স্থায়ী?

যুগস্থায়িত্ব 
সত্যযুগ১৭,২৮,০০০ বছর (কলিযুগের ৪ গুণ) 
ত্রেতাযুগ১২,৯৬,০০০ বছর (কলিযুগের ৩ গুণ) 
দ্বাপরযুগ৮,৬৪,০০০ বছর (কলিযুগের ২ গুণ) 
কলিযুগ৪,৩২,০০০ বছর 

জয়-বিজয় কোন্ জন্মে কী হয়েছিলেন?

নাম  যুগ
 সত্যক্রেতাদ্বাপর
জয়হিরণ্যাক্ষরাবণশিশুপাল
বিজয়হিরণ্যকশিপুকুম্ভকর্ণদন্তবক্র

॥ বেদ প্রসঙ্গে ॥

হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। অলিখিত বেদ যুগ যুগ ধরে শ্রুতির আকারে চলে এসেছে। ঋষিরা যোগপ্রভাবে স্বয়ং ভগবান ব্রহ্মার মুখ থেকে বেদ শুনেছেন। বেদের পরিধি ক্রমশঃই বিস্তারিত হয়েছে।

ব্যাসদেব বেদকে চারভাগে ভাগ করলেন। ঋক্‌, সান, যজুঃ আর অথর্ব। এই কাজটি করার জন্যেই তাঁর বেদব্যাস নাম। মহাভারতকে ‘পঞ্চম বেদ’ও বলা হয়। চার বেদের আবার বিজ্ঞান-নির্ভর চার ‘উপবেদ’ আছে। সেগুলো হল:

বেদউপবেদ
১। ঋক্আয়ুর্বেদ
২। সামগন্ধর্ববেদ
৩। যজুঃধনুর্বেদ
৪। অথর্বস্থাপত্যবেদ

॥ বেদাঙ্গ ॥

বেদকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্যে বেদেরই ছ’টা অঙ্গ। অঙ্গগুলো হল:১। শিক্ষা, ২। কল্প, ৩। ব্যাকরণ, ৪। ছন্দ, ৫। জ্যোতিষ আর ৬। নিরুক্ত।

॥ বেদান্ত। উপনিষদ ॥

বেদের অন্ত বা শেষ ভাগই বেদান্ত বা উপনিষদ। বেদের সারকথা ধরা আছে এতে।

॥ দর্শন ॥

হিন্দু দর্শনের ছ’ভাগ। সেগুলো হল:

দর্শনপ্রণেতা
১। সাংখ্যকপিল
২। যোগপাতঞ্জল
৩। বৈশেষিককণাদ
৪। ন্যায়গৌতম
৫। পূর্বমীমাংসা বা মীমাংসাজৈমিনী
৬। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্তব্যাসদেব

॥ পুরাণ প্রসঙ্গে ॥

পুরাণ হল সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান, ব্ৰহ্মতত্ত্ব ইত্যাদির সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে বিভিন্ন মুনি-ঋষিদের ভাষ্য। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর লোকশিক্ষামূলক কাহিনী।

পুরাণ দু’ধরনের। ‘মহাপুরাণ’ এবং ‘উপপুরাণ’ । দু’ ধরনের পুরাণেরই আঠেরটি করে ভাগ আছে। আবার সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ গুণ অনুসারে মহাপুরাণের আবার তিন ভাগ।

* মতান্তরে বায়ু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *