বাংলা গানের পথচলা – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ – মাঘ ১৪১৭, জানুয়ারি ২০১০
প্রচ্ছদ – দেবব্রত ঘোষ
প্রকাশক – জ্যোতিপ্রকাশ খান
আজকাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
এই গ্রন্থ আমার সংগীত পরিচালক জীবনের ধ্রুবতারা
শ্রী সলিল চৌধুরির ও আমার সৃষ্টিশীলতার প্রথম প্রেরণা এবং দিশারী আমার অগ্রজ শ্রী অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণে অর্পণ করে ধন্য হলাম৷
প্রাককথন
ঈশ্বর আমার প্রতি কৃপালু— মনুমেন্টের পাদদেশে দাঁড় করিয়ে স্তম্ভটির বিরাটত্ব আমায় অনুভব করিয়েছেন৷ এই সৌধের লাগোয়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে অনেক রহস্য হয়তো ভেদ করা যায়, দূর দর্শনও হয়, কিন্তু রহস্যকে রহস্যময়ভাবে পাবার আনন্দ ও তৃপ্তি আলাদা৷
বাংলা গানের মনুমেন্টের আমি পাদদেশে দাঁড়িয়েই তাঁদের কাজ দেখে পুলকিত, রোমাঞ্চিত হয়েছি৷ গবেষণা করতে করতে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের মধ্যে তাঁদের আকাশের সঙ্গে লীলা করা দেখেছি, তাতেই আমি আপ্লুত— আর সেই অনুভবকে নথিভুক্ত করেছি৷ আরও জানার বা চেনার প্রয়োজন নেই এমন নয়, তবে সে কাজ একার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এমনকি এক প্রজন্মেরও কাজ নয়৷ আমি কেবল চেষ্টার ট্রেনটাকে যাত্রা করিয়ে দিলাম— যা ভবিষ্যতে অনেক স্টেশন পার হতে হতে অজানা থেকে আরও অজানার পথে ছুটবে৷ এই শুভযাত্রার অন্তিম বা গন্তব্য নেই৷ চলমানতার গতিবেগই এর ঐশ্বর্য৷ আগামী প্রজন্ম হয়ত আরও কত জানবে, যা হয়ত আমার দেখা বা জানা হয়নি৷ তবু আমার তৃপ্তি আমি বাংলা গানের ট্রেনটাকে একটি বিশেষ সময়ের স্টেশন থেকে সামনের স্টেশনের দিকে যাত্রা করিয়ে দিয়েছি৷
রবীন্দ্রনাথ কেবল ভারতবাসি বা বাঙালি নন, সারা পৃথিবীর সংস্কৃতি মাপনের একক পরিমাপ (Unit measurement), তিনিই বাংলা আধুনিক গানের নবজীবনের জনক৷ তা বিস্তারিতভাবে আমার সীমিত জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছি৷ এই গ্রন্থে এবার প্রতি ছত্রে ছত্রে তাঁর চিন্তার আলোয় আধুনিকতার উৎকর্ষ মাপার চেষ্টা করেছি৷ যদিও তিনি বলেছেন, সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাবপ্রকাশ করা, তবু আমি কোনও স্রষ্টার ভাব গর্ভের গভীরতার আলোচনায় যায়নি কেবল সাঙ্গীতিক নির্মাণ ঐশ্বর্য ও ব্যুৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি৷ যাঁরা বিস্তারিতভাবে গবেষণা করবেন, তাঁদের গান ধরে ধরে তার ভাব, বিষয় ও সাঙ্গীতিক নির্মাণ-সার্থকতা আবিষ্কার করে করেই সত্য সিদ্ধান্তে আসতে হবে৷ কারণ, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সংগীতের উদ্দেশ্যই হল ভাব প্রকাশ করা৷
একটা বড় কৈফিয়ত দিতেই হবে বা বলা যায় আমি সে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য, সেটা হচ্ছে কেন আরও অনেক বড় বড় পিলারের সম্পর্কে কোনও রচনা নেই— যেমন সর্বশ্রী রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনুপম ঘটক, কমল দাশগুপ্ত, সুবল দাশগুপ্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, সংগীত Institution জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ সর্বোপরি কাজি নজরুল ইসলামের কথাও নেই৷ আমি এর জবাবে বলব— রবীন্দ্রনাথের কথা লিখতে গিয়েই কাজি সাহেবের নির্মাণ সম্পর্কে গবেষণামূলক লেখার উপাদানের অভাব এ কথা স্বীকার করে নিয়েছি৷ আর বাকিদের সম্পর্কেও ওই একই কারণে লেখা হয়ে ওঠেনি৷ এর মধ্যে রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও অনুপম ঘটক আমার সংগীত নির্মাণ অনুভবে তিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে তাঁদের নির্মাণ সম্পর্কে লেখায় আপ্রাণ চেষ্টা করব৷ তবু বলি, সব কাজটা আমার একার পক্ষে সম্ভবও নয়, আর কাজটা তাতে ভালও হবে না৷ আমার চেষ্টা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ যদি তার দায়বদ্ধতার কথা ভাবে, সেটাই হবে আমার শ্রমের সার্থকতা৷ আমি মনে করি এ কাজ সমবেত কাজ, তাই গান গাইলাম—
‘আমাদের যাত্রা হল শুরু
ওগো কর্ণধার
তোমায় করি নমস্কার৷
এখন বাতাস ছুটুক তুফান উঠুক
ফিরবো না’ গো আর৷’
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply