আলোর পথযাত্রী সলিল চৌধুরি
পাহাড়ের গা ছুঁয়ে চলা নদীর রূপকে সম্ভোগ করতে হলে পাহাড়ের ওপরে উঠে দেখতে হয়৷ আবার পাহাড়ের গায়ে বেঁচে থাকা সবুজকে, গা-বেয়ে নেমে আসা ঝর্নাকে দেখে মুগ্ধ হওয়া যায় তখনই, যখন পাহাড়কে দূর থেকে দেখা যায়৷ আবার পাহাড়ে উঠে উপলব্ধি করা যায় জীবনের গভীরতা৷ গাম্ভীর্য৷ ঔদার্য৷ দিগন্তের অসীমতা৷ আর নদী বা ঝর্নার কলধ্বনি, ভালবাসার বীণায় বাজে, কাছের অনির্বচনীয়তার সুর নিয়ে৷ তেমনি কাছের ও দূরের এই দুই হৃদয়-দৃষ্টি দিয়েই দর্শন করেছি আমার সুরকার জীবনের নাবিক সলিল চৌধুরিকে৷ আমার অপূর্ণ অনুভূতির অপরিসর ভূমিতে তার ফসল যা ফলাতে পেরেছি, তা, তাঁর মহীরূহ সৃষ্টিশীলতার নিরিখে একটি-দুটি চারাগাছ ছাড়া কিছু নয়৷ তাই প্রারম্ভিকেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি তাঁকে পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করার মেধা, প্রজ্ঞা, সংগীতবোধ— কোনওটাই আমার যথাযথ নেই৷ যেটুকু বুঝেছি, অনুভব করেছি সীমিত দক্ষতায় তারই কিছুটা আভাস দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব মাত্র৷ আমি কাজটা শুরু করলাম,গবেষণা চালাতে হবে দীর্ঘ দিন৷
বিচিত্রগামী প্রতিভা— প্রদীপ্ত জীবন পথিক৷ কেবল কিংবদন্তি সুরকার, গীতিকার, কবিই নন— সাহিত্য, নাটক প্রভৃতি সমস্ত পরিশীলিত রুচিবোধসম্পন্ন সংস্কৃতির প্রতীক৷ মানবতার পক্ষে অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ-যুক্ত, সত্য-সম্পৃক্ত জীবনবোধের বেদ-উদগাতা৷ বৈপ্লবিক সাংস্কৃতিক চেতনার জীবন্ত মশাল, কলা-তপস্যার সু-ধীমান ঋত্বিক৷ একদিকে ছন্দের জাদুকরী সৃষ্টি করে যৌবনকে দিয়েছেন প্রাণবন্ত রূপ, প্রগতিশীল চেতনার আবেগ— যা বর্তমান পপ সংস্কৃতির মতো উলঙ্গ জারজ-জারক রসের নেশায় আচ্ছন্ন করে না— অন্যদিকে, বাণীকে দিয়েছেন পারিজাতের সৌন্দর্য, শাশ্বত মানবিকতার আশ্রয়, নক্ষত্রের প্রভা৷ তাঁর বাণী জীবনগীতার অপরাজেয় শ্লোক৷ তাঁর সুর কেবল সুর নয়, জুঁই-বেল-গোলাপের সুরভিত নির্যাস— মানব মনের সামমন্ত্র৷
গণনাট্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের আলোয় গড়ে ওঠা সলিলদার সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক, মানবিক, সমস্ত মূল্যবোধের সংবেদে বিস্তৃত ফল, ফুল, ফসল৷ তাঁর সৃজনকর্মে বিকৃতি কখনও প্রশ্রয় পায়নি৷ বহুদিন আগে আমার প্রথম জীবনে একদিন বললেন, ‘দেখ বটের চারা পুঁতবি কিন্তু আগাছার জন্ম দিবি না৷’ এই কথাটা নিজে সারা জীবন মেনে গেছেন৷ ‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে মাতালের গান লিখতে গিয়েও লিখলেন এক অসাধারণ দার্শনিক লাইন, ‘ঘুরিয়ে দুনিয়ার লাট্টু, ভগবান হারিয়েছে লেত্তি’৷ একটি মাতালের মুখ দিয়ে এমন কথা বার করেননি যাতে সমাজ তাকে ঘৃণা করে— বরঞ্চ বিপথগামী এক মানুষের হয়ে শ্রোতার হৃদয়ে গড়ে দিলেন জীবন বেদনার ভাষা৷ তাঁর রুচিবোধের সাধনা জড় রক্ষণশীলতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল না৷ পরন্তু তাঁর প্রগতিশীলতা অচলায়তনের বন্ধ দরজা খুলে আলোর প্রবেশের পথ করেছে স্বচ্ছ৷ তাঁর আধুনিকতা ছিল ঐতিহ্যনিষ্ঠ, সর্বজনগ্রাহ্য৷ শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুগামীরা, জীবনচর্চা ব্যতিরেকে, যখন কেবল পর্দাচর্চা ও ওস্তাদির মধ্যে নিজেদের কারারুদ্ধ করল, সেই সময় থেকেই ইতিহাসের পাতায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে দাম বাড়ল ওস্তাদের৷ শিল্পী গেল হারিয়ে৷ এই থমকে থাকা শিল্পচর্চার সময়ে আধুনিক সংগীতের জগতে যখন সলিলদা প্রবেশ করলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের জাতশিল্পীরা অনেকেই তাঁকে জানালেন সাধুবাদ৷ প্রবাদপ্রতিম উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী শ্রদ্ধেয় তারাপদ চক্রবর্তী একটি সন্ধ্যা জুড়ে শুনলেন আমাদের কণ্ঠে সমবেত সলিল-সংগীত৷ পাল্টা উপহার দিলেন ঠুংরি ভাঙা সুরে রচিত তাঁর একটি গান, যার বিষয়বস্তু তাঁর প্রিয় সলিলের ভাবাদর্শের আনুগত্য মানা বাস্তুহারার জীবনকাহিনী৷ প্রবাদপ্রতিম জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-সহ বহু শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তাঁর সৃষ্টিকে মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ তখনকার দিনের দিকপাল সুরকার শ্রী অনুপম ঘটক, শ্রী শৈলেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ রেকর্ডের দু-পিঠ জুড়ে কাহিনী গান রচনা করলেন সলিলদার গাঁয়ের বধূর অনুপ্রেরণায়৷ শ্রী দিলীপ সরকার রচনা করলেন ‘রানার’ শুনে উদ্দীপ্ত হয়ে, সলিল-ভাবনার অনুসারী হয়ে মেহনতী মানুষের গান ‘রিক্সা চালাই মোরা রিক্সাওয়ালা’৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের পার্বণ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি৷ সে সময়কার দাপটে গায়ক শ্রীধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে গান গাওয়া ও একটি চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ৷ তিনি শুনলেন ‘ঝির ঝির ঝির বরষা’ গানটি৷ গানটি রচিত হয়েছিল সম্পূর্ণ বিদেশি সুরের আঙ্গিক কাঠামোয়৷ নির্ধারিত শিল্পী ছিলেন উৎপলা সেন৷ কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতের গভীর সাধক— সাবেকি রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী, শাস্ত্রীয় সুরের দরবারি শিল্পী, শ্রীধনঞ্জয় ভট্টাচার্য সেই গান শুনে বললেন, সলিলবাবু তো পাশের বাড়ির সংগীত পরিচালক— ওই ঝির ঝির বরষায় গানটি যদি তাঁকে ওই ছবিতে গাইতে দেন, তবেই তিনি ওই ছবিতে অভিনয় করবেন না—হলে না৷ ঐতিহ্যের বেড়া দেওয়া বাগানের সীমানা পেরিয়ে সেদিন ধনঞ্জয়দা কেবল মিছিলের গানের সংগীতস্রষ্টার কাছে পৌঁছে যাননি— সারা জীবন ছিলেন সলিলদার গুণগ্রাহী৷ ভারতবর্ষের আরও অনেক দিকপাল সংগীতজ্ঞ যাঁরা কখনও সংগীতকে দরবার থেকে পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় আনার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না তাঁরা সলিলদার গান শুনতেন এবং দিতেন তাঁর সৃজনশীলতার কদর৷ আমাদের প্রিয় হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলদা (চৌধুরি), ওমর শেখ, যাঁরা লোকসংগীতের এক এক দিকপাল তাঁরা সলিলদার গানের সুরে লোকসংগীতের প্রয়োগ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভালবেসেছেন অন্তরঙ্গভাবে৷ ঐতিহ্য ও শাশ্বতিক যাবতীয় মূল্যবোধ কীভাবে আধুনিকতার প্রজন্মে চিরায়ত দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে পারে তার জীবন্ত উদাহরণ সলিলদার কর্মকাণ্ড৷ বোম্বেতে এমন ছবি হয়েছে যাঁর গানের সুর সলিলদার নয়, কিন্তু ছবির দৃশ্যায়নকে পরিস্ফুটিত করবার জন্যে প্রজ্ঞা-প্রদীপ্ত সলিলদার মেধাকে ব্যবহার করতে হয়েছে আবহসংগীতে৷ চিত্রনাট্য রচনা, আলোচনাতেও পড়ত তাঁর ডাক৷ বোম্বেতে জীবন শুরুই নিজের কাহিনী ও তার চিত্রনাট্য ‘দো বিঘা জমিন’ রচনা নিয়ে৷
বাণিজ্যিক জগতে এসে সলিলদা Sex and Crime-এর অপসংস্কৃতির নালার জলে গা ভাসাননি— তিনি গঙ্গা-যমুনার মাটি গায়ে মেখে ডুব দিয়েছেন যমুনার জলে, পাড়ি দিয়েছেন উদার সমুদ্রে৷ বোম্বেতে গিয়েও গড়েছেন বৃন্দগানের দল৷ যার প্রভাবে এই প্রজন্মের কলকাতায় বহু সংস্থা গড়ে উঠেছে এই সমবেত সংগীতের ভিত্তিতে৷ বাণিজ্যিক গানেও এনেছেন রুচিবোধের সুস্থ চেতনায় প্রদীপ্ত জীবনবোধের ছোঁয়া৷ কেবল বাংলা নয়, হিন্দি জগতের গানের কথায়, সুরে, উপস্থাপনায় বজায় রেখেছেন মানবিক মূল্যবোধ৷ দো বিঘা জমিন, জাগতে রহো, আনন্দ, মধুমতির রুচিশীল সংগীত— হিন্দি সংগীত জগতে এক পরিশীলিত সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত৷ তাঁর সৃষ্টিতে জীবন কখনও ছোট হয়নি৷ অসম্মানিত হয়নি৷ হয়নি মানবতা বিপন্ন৷ আবহ সংগীত সৃষ্টিতে তিনি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ আবহ রচয়িতা আমার বিচারে৷
একটা ছবি আঁকতে হলে প্রথমেই ক্যানভাসের মাপ, রঙ নির্বাচন করতে হয়৷ স্রষ্টা সলিল চৌধুরির এগিয়ে আসার পটভূমিকার বিশ্লেষণ তাই প্রাথমিক ও জরুরি৷
এই বিশ্লেষণের দুটি দিকই ভাবতে হবে৷ এক তাঁর সংগীত-আঙ্গিকের শিক্ষার ক্রমবিকাশ আর তাঁর ব্যক্তি মননের ক্রমবৃদ্ধির মানসভূমির অবদান৷ কোন ইন্ধনে তিনি সংগীত রচয়িতা৷ কোন ইন্ধনে তিনি মানবদরদি, প্রেমিক, সূক্ষ্ম-কোমল অনুভূতির আন্তরিক অস্তিত্ব, এটা জানা থাকলে তার কর্মকাণ্ডের ধারা প্রকৃতি বোঝবার সুবিধা হবে৷
তাঁর নিজের আত্মজীবনীর কিছু কিছু অংশ এই বিষয়ে বিশেষ প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়৷ কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি৷ সঙ্গে সে সম্পর্কে আমার ভাবনাও মাঝে মাঝে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করব৷
সলিলদার বাবা ছিলেন আসামের চা বাগানের ডাক্তার৷ একদিন ম্যানেজার তাঁকে ‘কাম হিয়ার ডার্টি নিগার’ বলায়, তিনি সাহেবকে ঘুসি মেরে তিনটে দাঁত ফেলে দেন৷ তখন চা বাগানের সাহেব ডাক্তারদের প্রতিপত্তি, মানুষের জীবনের দামের চেয়েও বেশি৷ প্রয়োজনে গুলি করে মেরে গুম করেও দিতে পারতেন৷ সলিল-পিতা ডাঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরি জলের দরে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে ছেড়ে দিলেন আসাম অঞ্চল৷ কিন্তু একটিমাত্র জিনিস যা ছাড়লেন না সেটা তাঁর (সলিলদার ভাষায়) ‘চোঙা দেওয়া কুকুর মার্কা কলের গান আর শতখানেক ইংরিজি বাজনার রেকর্ড৷… জ্ঞান হওয়া থেকে এই সব সিম্ভনি রেকর্ড আর হঠাৎ হঠাৎ বাবার দরাজ গলায় আলাপ আমার চৈতন্যে মিশে আছে৷ আজ বুঝতে পারি আমার বাবা আমার জীবনের ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছেন৷ আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে আসামের কাজিরাঙা অরণ্য আর তার গাছপালা, পশুপাখি আর কীটপতঙ্গের অসাধারণ আরণ্যক সিম্ভনি৷ আমার বাবার দুঃসাহস আর আত্মসম্মান জ্ঞান, অন্যদিকে অসম্ভব সংগীত প্রীতি আমার পরবর্তী জীবনকে গড়ে তুলতে অনেকখানি সাহায্য করেছে৷’
আর একটি সলিল চৌধুরির স্মৃতিচারণ— যার প্রভাব সমস্ত জীবনের আনাচে-কানাচে বিধৃত ছিল৷ লিখছেন, ‘লতাবাড়ির চাকরি ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাবা পোশাক-আশাকে ছিলেন খাঁটি সাহেব৷ গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আর বিদেশি বয়কটের ঢেউ আসতে শুরু করলে বাবা দু-তিন ট্রাঙ্ক ভর্তি দামি স্যুট সব পোড়ালেন৷ গুজব রটল বাবাকে জেলে নিয়ে যাবে৷ আমার পরবর্তী জীবনে বাবার ওই বিলিতি কাপড় পোড়ানোর ঘটনা গানের মধ্যে এসেছে৷’ ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম’ গানটিতে আছে—
‘আমার বাবা বড় বোকা ছিল আমি তো তার ছেলে
সে বিলিতি কাপড় পুড়িয়ে গিয়েছিল জেলে৷’
পরবর্তীকালে ব্রিটিশ যখন তাদের পোষ্যপুত্রদের দিয়ে ভারতের হাতে পুতুল স্বাধীনতা দান করল আর তারা বামপন্থীদের ওপর অত্যাচার শুরু করল — সলিলদার ওই গানে তারও ছাপ এসে পড়ল৷
‘তোমরা কেমন দেশী সুতোয় বানালে গাঁটছড়া
তার এক কোণ বাঁধলে গাউনের সাথে
আর এক কোণ গলায় দিয়ে ঝুললুম৷’
সলিলদার পিতার সংগীত ছাড়া অন্য শখ ছিল নাটকের৷ হাতিকুলি চা বাগানে রীতিমতো বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটিয়ে কুলিদের পুরুষ ও নারী চরিত্রে পুরুষ ও নারী দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন৷ নিজেই নাট্য পরিচালক, নিজেরই সংগীত৷ সেই সময়েই চাঁদ সওদাগরের ওপর একটা নাটকে সলিলদার বাবা সলিলদাকে প্রস্তাব দিলেন অর্ধেক গানে সুর করার জন্যে৷ শেষে সলিলদার পঙ্কজ মল্লিক ঢঙের সুর শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্ত সংগীতের কাজটাই করতে বললেন সলিলদাকে এবং বাবার সহযোগী হয়ে সেই তাঁর প্রথম সংগীত পরিচালনার কাজে প্রবেশ৷
এত বড় জীবন এবং যে জীবনের বিশ্বাস ছিল— সুরস্রষ্টা হবে জীবনের পূর্ণ সময়ের কর্মী— আংশিক নয়— সেই জীবনের রসদও অজস্র— স্বল্প পরিসরে সে আলোচনার সুযোগ নেই৷ কিছু কিছু ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব৷
সংগীত জগতের যে যুগটা চিহ্নিত স্বর্ণযুগ বলে তার উদ্বোধনী সংগীতটি হচ্ছে ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা’— এই সংগীত দিয়ে গণসংগীতের চালচিত্রে বাণিজ্যিক সংগীতে নব ধারার প্রবাহ সৃষ্টি৷ তাই যে সব আন্দোলনের পটভূমিকায় সলিল চৌধুরী নিজেকে গড়েছিলেন তার সম্পর্কে একটু আলোচনা না করলে, সলিল চৌধুরির জাত চিনতে ভুল হবে৷ সলিলদা নিজেই একদিন তাঁর ছোট ভাই সুহাস চৌধুরিকে বলেছিলেন, ”গাঁয়ের বধূ লিখে যদি আমি মরে যেতাম—তাহলেও আমি এই সলিল চৌধুরিই হতাম৷” যে সময় তাঁর এই অভিব্যক্তি সেই সময় তিনি স্বনামে ধন্য বোম্বাই চিত্রজগতের এক প্রতিষ্ঠিত সংগীত পরিচালক৷
সোনারপুর বারুইপুর অঞ্চলে জল নিকাশের অভাবে বৃষ্টিতে বানভাসি হত৷ সুভাষগ্রাম, চাঁঙড়িপোতা প্রভৃতি স্টেশনের পূর্বদিকের অঞ্চল ছিল ভাসা অঞ্চল৷ সামাজিক, মানবিক বোধগুলি এতই সজাগ সংবেদনশীল ছিল সলিল চৌধুরির যে তিনি গান বাঁধলেন— ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে, অনাহারে দিবানিশি ভাসাই ডিঙা ওরে৷’ শোনা যায় এটাই নাকি তাঁর প্রথম রচিত গণচেতনার গান৷ (সজল রায়চৌধুরির কথা)
সলিল চৌধুরীর সংগীত সৃষ্টিকে তিনটি সময়ে ভাগ করতে হবে৷ (১) প্রাক-মার্কসিস্ট সময়-যখন তাঁর সুরে রবীন্দ্রনাথের গানের ছাপ৷ (২) মার্কসিস্ট হয়ে গণ-আন্দোলনে যুক্ত জীবন৷ সংগীতে দ্বন্দবাদের পর্দার চলন বলন৷ গণ-সংগীত সৃষ্টি৷ (৩) আন্দোলন বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক জীবন,—যেখানে প্রেম সংগীতেও আত্ম দ্বন্দের স্বর ব্যবহার৷
শ্রদ্ধেয় সজল রায়চৌধুরি অভিমত থেকে জেনেছি৷ ধান ও জমি দখলের লড়াই, মিছিল, ধর্মঘট, বন্দীদের অনশন, যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের উদ্দীপ্ত উর্বর ভূমিতে সংগীত ফসল সৃষ্টি করার এক সুদক্ষ সংগীতস্রষ্টা ছিলেন সলিল চৌধুরী৷ এই বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচিত্র পটভূমিকায় সলিল চৌধুরির জীবনের ছবি আঁকা৷ যে সব অনবদ্য গান এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জনমানসে পৌঁছেছে সেগুলি, বিচারপতি তোমার বিচার, ঢেউ উঠছে কারা টুটছে, তেভাগা আন্দোলনের গান হেই সামালো, শপথ কবিতা, শান্তির গান আমাদের নানান মতে, স্বাধীনতার গান মানব না এ বন্ধনে৷ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব আঙ্গিকে সৃষ্টি ‘ও মোদের দেশবাসীরে’—আরও আরও অজস্র সংগীত৷ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরিদের গানের ঢেউ সেদিন আছড়ে পড়েছিল স্বর্ণযুগীয় নতুন নতুন সুরকার, গীতিকার, এমনকি গায়কদের মধ্যে৷ এই প্রবন্ধ লেখক সহ বহু সংগীতকার জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের গর্ভ থেকে৷ আজ যারা সেই অবদান অস্বীকার করে চলে তারা ইতিহাসের পাতায় অপাংক্তেয়৷
পিতার দুঃসাহস, স্বদেশবোধ, আদর্শবোধ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সর্বোপরি সংগীত ও সিম্ভনি প্রীতি ও আসামের প্রকৃতির সিম্ভনি তাকে বিশেষ করে সিম্ভনির পথ ধরতে প্রেরণা জুগিয়েছে৷ তবু একটা কথা বলতেই হবে কিছুটা প্রত্যক্ষ এবং অনেকটাই হয়ত পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য৷ একদিকে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিশ্ববন্দিত মনীষীদের সঙ্গে যুদ্ধের বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোপীয় সিম্ভনির রাস্তা ধরে সংগীতের বাদী, সমবাদীদের সামন্ততান্ত্রিক চলাফেরার পথ ভেঙে চুরমার করে, পর্দা ব্যবহারেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জীবনবোধের ভাবের প্রয়োজনে যার প্রভাব রবিরশ্মির মতো বাংলা গানের আকাশকে আলো করে দিয়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা বইটা পাঠ করলে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরির পূর্বসূরিকে চিহ্নিত করা যাবে৷ তার মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গানে প্রত্যক্ষ প্রভাবের ছাপ আছে সেখানে সলিল চৌধুরির সৃষ্টি আরও বেশি মৌলিকভাবে প্রকাশিত, বিশেষ করে যন্ত্রসংগীত প্রয়োগের ক্ষেত্রে৷ সলিলদা একদিন ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বললেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মাটি না কোপালে সলিল চৌধুরির জন্ম হত না৷ অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের উত্তরসুরি হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হিসাবে সলিল চৌধুরি নিজেই নিজেকে চিহ্নিত করেছেন৷ শিল্পী নির্বাচনেও তিনি তাঁর এই ক্যানভাসের প্রভাবমুক্ত নন৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সমস্ত রবীন্দ্র গীতিনাট্যর নায়ক কণ্ঠ আর সলিল চৌধুরির জীবনের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিগুলি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সমৃদ্ধ৷ সলিলদা বলতেন, হেমন্তদা বা লতা যখন আমার শিল্পী তখন আমার কল্পনা দিগন্তকারী৷
Sky is my limit.
যন্ত্রসংগীত ব্যবহারে সলিল চৌধুরি একেবারে রাজা৷ তাঁর প্রয়োগে যন্ত্র কথা বলে৷ ‘বাঁশি কেন গায়’তে বাঁশির অংশ পরের বার বাজছে তারসানাইতে— কোনও সংগীতকার কল্পনা করতে পারবে না, ওই music তারসানাইতে বাজানো যায়৷ রবীন্দ্রনাথ মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, প্রকৃতি উপলব্ধি, ধর্ম জীবনের উত্তাপ, ঝড় সমস্ত দ্বন্দ্ববাদকে রূপ দিয়েছিলেন পর্দার বাদী-সমবাদী অনুবাদী-বিবাদীর রাজতন্ত্র থেকে, ভাবের প্রয়োজনে পর্দাকে গণতন্ত্রে মুক্তি দিয়ে সলিলদা তাকে বর্ধিত করেছেন যন্ত্রসংগীত পর্যন্ত৷ আমাদের দেশে ব্যথিত হৃদয়ের গানকে যখন যন্ত্রসংগীতের সাহায্যে যতিকে ভরাতে একক বেদনা মিশ্রিত সুরের যন্ত্র বাঁশি, সেতার, এস্রাজ প্রভৃতির চলনকে গ্রহণ করা হয়, সেখানে তিনি সিম্ভনিভিত্তিক যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগে, ব্যথার কারণের পশ্চাতে যে দ্বন্দ্ববাদ আছে তাকে চিহ্নিত করেছেন৷ দৃষ্টান্ত সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘কত নিশি গেছে নিদহারা’-তে, Prelude, interlude-এ সারেঙ্গির শুধুই ব্যথিত কান্নার Music আর সলিল চৌধুরির গান? লতা মঙ্গেশকর গীত ‘কী যে করি’, হিন্দিতে ‘আজ কই নেই আপনাতে interlude, prelude অর্ন্তদ্বন্দ্বের বাজনা বাজিয়ে প্রকাশিত৷ আরও আরও হিন্দি ও বাংলা গান নিয়ে সলিল চৌধুরি ও সিম্ভনি এই শিরোনামে একটি আলাদা গবেষণা হওয়ার প্রচেষ্টা খুবই জরুরি৷ চলচ্চিত্রের জগতে বহু খুঁটিনাটি ঘটনা আছে যা নিয়ে একটি যদি আলাদা প্রবন্ধ রচনা করা যায় যা বিধৃত হয়ে আছে বোম্বাইয়ের বহু ছায়াছবির আবহসংগীত সৃষ্টিকে ঘিরে তবে তা হবে একটা অনবদ্য কাজ৷ সলিল চৌধুরির সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে যদি শিক্ষিত, চেতনাযুক্ত সঙ্গীতবিদরা গবেষণা করে তার সার বর্তমান প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারেন তবে সঙ্গীত সমাজ পাবে এক অমূল্য সম্পদ— যা ঐতিহ্য, আধুনিক ও ভবিষ্যৎ সৃষ্টিশীলতায় জোগাতে পারবে সত্যিকার পুষ্টি৷ ঐতিহ্য, আধুনিক ও প্রগতির প্রতীক সলিল-সৃষ্টি৷
একটা কথা আমি বারবার উচ্চারণ করে এসেছি, আসছি— প্রয়োগ শিল্পের উৎকর্ষ কেবল ভাষার ওপর নির্ভর করে বোঝানো যায় না, সম্ভব না৷ তবু চেষ্টা করতে হয় এবং তখন সব থেকে বড় ভরসা তার আঙ্গিক বিচার করা, প্রয়োগ কৌশলকে বোঝার চেষ্টা করা৷ যাঁরা প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ তাঁরা বিষয়ের উৎকর্ষ বোঝেন কিন্তু প্রয়োগ জাদুকরিটা বুঝতে পারে না— কিন্তু যাঁরা দক্ষ কারিগর বা আঙ্গিক বোদ্ধা তাঁরা অন্তত বুঝতে পারেন এই সব কালের সীমানা অতিক্রম করা স্রষ্টারা কতটা প্রতিভাধর, গুণী৷ তবে যাঁরা শুধু ওই আঙ্গিক দক্ষতা দিয়ে বিচার করেন তারাও জাদুকরিটা ঠিক বুঝতে পারেন না৷ কারণ সলিল চৌধুরির গান বিষয় ও আঙ্গিকের আন্তরিক সহবাসে জন্ম৷ সলিলদার একটি গান সামনে রাখছি— যা শুনতে শুনতে কেউ যদি আমার অভিমত বিচার করেন হয়ত আমার সঙ্গে সহমত হবে৷ গানটি, ‘ও মোদের দেশবাসীরে’
সাম্রাজ্যবাদ তার আগ্রাসনের অভিযানকে চলমান রাখতে যুগে যুগে পাল্টেছে তার কৌশল৷ যেমন বর্তমানের বিশ্বায়ন— বিশ্ববোধের মুখোশ পরে ব্যবসায়নের কারসাজি৷ এর মধ্যে আগ্রাসী একটি কৌশল আজও অপরিবর্তিত রেখেছে সেটা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অস্ত্র৷ তাদের হাতে এই অশুভ আয়ুধ আজও বিস্ময়করভাবে কার্যকরী— দাঙ্গার মতো সহজ সাবলীল ধারালো অস্ত্র তাদের হাতে খুব কমই আছে৷ এই হাতিয়ারকে তারা বারবার ব্যবহার করেছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী কৌশল হিসেবে৷ এরই প্রেক্ষিতে বিশ্বমানবতার বিশ্বস্ত ঋত্বিক সলিল চৌধুরি এই গানের মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছেন মানব বন্ধনের সেতু৷ সংহতির সেতু বাঁধবার আহ্বান জানিয়েছেন আর সেই নির্মাণের যে প্রক্রিয়া তারই একটি স্বচ্ছ সাবলীল চিত্র এই সঙ্গীত৷ এক বিস্ময়কর নির্মাণ৷ ২০১০ সালের শেষপ্রান্তে এসেও এমন একটি নির্মাণ আজও সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ একটি সেতু নির্মাণের আদলে গড়া এই গানটি৷
চিত্রটি এমনই— দুটি গ্রামের মধ্যে দিয়ে যখন একটি বিভেদের নদী বয়ে যায়৷ যে নদীর বাঁকে বাঁকে কুমির লুকিয়ে থাকে তখন সে নদী দুটি গ্রামকে বিভেদের বিচ্ছিন্নতার তফাত করে দেয়৷ এই গানটি নির্মাণ তেমনই এক আঙ্গিক দক্ষতায়৷ যেন একটি গ্রাম রামবাসীদের আর অন্য গ্রামটি রহিমবাসীদের— মধ্যে বইছে সাম্প্রদায়িকতার বিভেদের কালো নদীর বান৷ সলিল চৌধুরি সেই দুই গ্রামকে এক সেতু বন্ধনের মাধ্যমে এক মিলিত জীবনের গ্রামে পরিণত করতে কারিগরি নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ পাঠকবর্গ গানটি শুনতে শুনতে আমার এই বিশ্লেষণকে যদি বিচার করেন তবে মনে হয় গানটির নির্মাণের যথাযথ প্রক্রিয়া আস্বাদন করতে পারবেন৷
গানের প্রথম অংশে, ও ওদের দেশ বাসীরে তে একটা call– যেন সেতু বাঁধা হবে বলে বহু মানুষকে আহ্বান করা হচ্ছে৷ তারপর ধীর ছন্দে শুরু হল নির্মাণ কাজ— যেখানে বাণী আসছে৷ ‘হেইয়া ও হেইয়া, মার জোয়ান বাঁধ সেতু এবার’— এই তালের পুরো অংশে মনে হয়, রাজমিস্ত্রিরা ইট গাঁথছে আর মাথায় করে জনমজুররা ইট, বালি, সিমেন্ট মাখা দিয়ে কড়া করে এনে ঢেলে দিচ্ছে৷ শেষ অংশে যখন হেঁইয়া হৈ মার জো বাঁধি সেতু বাঁধি রে, বাঁধি সেতু বাঁধিরে’ অংশ খুব দ্রুততালে কণ্ঠ শিল্পীরা গাইছেন, মনে হচ্ছে সেতুটি নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায় এসে পড়েছে— আর কোনও মন্ত্রী বা গণ্যমান্য ব্যক্তি এসে সেতুটির উদ্বোধন করবেন, তাই অন্তিম কাজে সবাই তৎপর, দ্রুত৷ আর সঙ্গে আবার যখন একক শিল্পী মূল গানের সঙ্গে ও মোদের দেশবাসীরে গাইছে— মনে হচ্ছে একদল দ্রুত কাজ শেষ করার জন্যে ব্যস্ত— আর তাদেরই মধ্যে একজন ঢ্যাঁড়া দিয়ে অঞ্চলের অন্য সব মানুষদের জড়ো করার জন্যে আহ্বান করছে৷ এক বিস্ময়কর নির্মাণ, নির্মাণের structure৷ ভারতবর্ষে আজও এরকম কোনও দ্বিতীয় নির্মাণ অছে বলে আমার জানা নেই৷ সারা পৃথিবীর সংগীত সৃষ্টিতেও এর সমগোত্রীয় বা এই মাপের নির্মাণ একটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ৷ আজও ভারতবর্ষে গুজরাটের দাঙ্গার মতো সাম্প্রদায়িক উস্কানির খেলা চলছে৷ বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো কাজ হচ্ছে, আবার সাম্প্রদায়িক বিভেদের সেতু নির্মাণের কাজ সমভাবে চলছে৷ বাঁকে বাঁকে কুমির লুকিয়ে থাকা কালো নদী আজও প্রবহমান, সেতু বাঁধার কারিগররাও থেমে নেই৷ সাম্রাজ্যবাদী আজও স্বদেশি বিদেশি অনুচরদের পৃষ্ঠপোষকতার এই ঘৃণ্য স্রোতস্বিনীকে বহমান রেখেছে৷ তাই এই গানটি আজও প্রাসঙ্গিক৷ ঈশ্বরের কল্যাণ হস্তের সক্রিয় প্রয়োগে যদি কখনও, ‘ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে, ‘সমানো মন্ত্র সমিতি সমানির’ মন্ত্র সত্য হয়ে ওঠে— সেদিনও এই ‘ও মোদের দেশবাসী’ গানটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের আকাশে এক দীপ্যমান নক্ষত্র হিসাবে বেঁচে থাকবে৷
এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি বাণীর পুনরুচ্চারণ করছি— তিনি লিখছেন, ‘আমাদের দেশের বর্তমান কালের জীবন কেবল গ্রাম্য নয়৷ তার ওপরেও আর একটা বৃহৎ লোকস্তর জমিয়া উঠিতেছে যার সঙ্গে বিশ্ব পৃথিবীর যোগ ঘটিল৷ চিরাগত প্রথার খোপখাপের মধ্যে সেই আধুনিক চিত্তকে আর কুলায় না৷ তারা নূতন নূতন উপলব্ধির পথ দিয়ে চলিতেছে৷ আর্টের যে সব আদর্শ তার সঙ্গে এর গতির যোগ রইল না৷ বিচ্ছেদ বাড়িতে লাগিল৷ এখন আমরা দুই যুগের সন্ধিস্থলে৷ আমাদের জীবনের গতি যেদিকে জীবনের নীতি সম্পূর্ণ সেদিকের মত হয় নাই৷ দুটিতে ঠোকাঠুকি চলিতেছে৷ যেটা সচল তারই জিৎ হইবে৷ এই যে আমাদের নূতন জীবনের চাঞ্চল্য, গানের মধ্যে কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে৷’ সলিলদা এই সামাজিক সঙ্কটের পটভূমিকায় সংগীত রচনা করে রবীন্দ্র ভাবনার অনুসারী চলমানতা ও নাগরিক সংগীত সৃষ্টির চিন্তাকেই রূপায়িত করেছেন৷ গণনাট্য সঙ্ঘের বোম্বাই conference-এ হেমাঙ্গদার সঙ্গে intraction-এ বলেছিলেন, ‘ আপনি বম্বে এসেছেন Electric Train-এ—গরুর গাড়িতে এলেন না কেন?
আমায় একটা চিঠি দেন যাতে লিখেছিলেন ‘দ্যাখ urban Music আমাদেরই করে যেতে হবে৷’ কথাটা পরে আমার দৃষ্টি খুলে দেয় তাঁর আরও কিছু কথায় ও কাজে৷ একদিন বললেন, দ্যাখ নগরায়ণ হচ্ছে— নাগরিক জীবন ক্রমবর্ধমান৷ আমরা নতুন নতুন শব্দের অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করছি৷ ট্রামের আওয়াজ, ট্রেনের আওয়াজ, জনজীবনের আওয়াজ, মিছিলের পদধ্বনি, কলকারখানার আওয়াজ, কারখানার ভোঁ— সব মিলিয়ে একটা নতুন ধ্বনি বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতা৷ এগুলো জনজীবনের বাঁকে, নতুন চলায় কাজে লাগবে৷ এই নাগরিক বোধ তাঁর গানে নাগরিক বোধে বারবার ধরা পড়েছে৷ নাগরিক জীবনের অনুভব ও জটিলতা, কাব্যময়তা সবই ধরা পড়েছে৷ যেমন সুর নির্মাণে তাঁর Urban Music fantasticভাবে প্রকাশ পেয়েছে ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ গানটিতে৷ কবি বিমল ঘোষ রচিত বড় একটি কবিতার সম্পাদিত কিছু অংশ সুর করে গানে রূপান্তরিত করেন সলিলদা৷ কবিতাটির মধ্যে বাণী আছে, পারাবতকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘এক ফালি নাগরিক আকাশে’— অর্থাৎ পায়রা, যার অস্তিত্ব প্রাক নাগরিক জীবন থেকেই— সে-ও আজ নাগরিক, এই নাগরিক জীবনের আকাশে উড্ডীয়মান৷ সুরের prelude থেকে রূপকল্পটিকে ধরা হয়েছে নাগরিক নব সুর মন্ত্রের আঙিনায়৷ Urban music হিসেবে এটাকে একটা প্রতীকী সঙ্গীত হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে৷ কারণ রবীন্দ্রনাথ যে ইউরোপীয় সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছিলেন তা সিম্ভনি ধাঁচের, সলিলদাও তাই৷ কিন্তু পরবর্তী কালে যখন মার্কিন সভ্যতার আঙিনায় যে বিদেশি সুর গড়ে উঠল, যাকে বলা যায় pop- তা যে জীবনকে এসে স্পর্শ করল তাকে নাগরিক সভ্যতার বিকাশ বলা যাবে না— সেগুলো মূলত নাগরিক জীবনের যে বিকৃতি ও রুচিহীনতা, অবক্ষয় তাকেই প্রকাশ করল৷ রবীন্দ্রনাথ, সলিল চৌধুরি, জাতীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিকবোধের প্রাঙ্গণে উন্মুক্ত করেছিলেন যে ধারাতে তা ছিল symphony গোত্রীয়৷ যা পরে ভারতীয় ঐতিহ্য বিনাশী যে সঙ্গীত সূচি হল তা cacophony গোত্রীয়৷ এই সুস্থ অসুস্থতার লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক নাগরিক সঙ্গীত হিসেবে ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’, প্রায় উদ্বোধনী সঙ্গীত বলা যায়৷ এটি একটি আদর্শ নাগরিক কাব্য সঙ্গীত৷ সলিলদা তো সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমিকা থেকে উঠে আসা প্রতিভা, মেহনতী মানুষের অন্দরমহলে পৌঁছে তাদের সুখদুঃখ হাসিকান্না মায়া মমতার সঙ্গী৷ যেমন গ্রামীণ অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু কৃষক, গ্রাম, মাঠঘাট, তেমনি নগরভিত্তিক অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় কলকারখানা, যেখানের কুশীলব শ্রমিক, যাদের জীবন শ্রমের ভিত্তিতে বাঁধা মুনাফার মিটারে৷ আগেই বলেছি আসামের চা বাগানের প্রকৃতি থেকে সলিলদা যে Symphony-র কান তৈরি করেছিলে—সেই কানে পৌঁছে গেল কারখানার ভোঁ—, আর শ্রমিকদের কান্নার সুর৷ নানা গানে সেই বোধকে প্রকাশ করতে করতেই ২৯ শে জুলাইকে কেন্দ্র করে যে শ্রমিক হরতালের গান রচনা করলেন ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’— তার প্রতিটি চলনে ধরা পড়ল নাগরিক জীবনে শ্রম বেচা-কেনার জটিলতার মুহূর্তের সুর বিন্যাস, সুর ব্যঞ্জনা৷ বিস্ময়কর এই নির্মাণ৷ প্রশ্ন উঠেছিল এই সুরে সরলতা নেই কেন? সলিলদা চটজলদি উত্তর নতুন জীবন, নতুন মেহনত, নতুন exploitation-এর নতুন অভিজ্ঞতা— যা জটিল, অসম্ভব সংগ্রামী৷ এই সংগীতটির নির্মাণ কৌশল আমায় বিস্মিত করে — যখন দেখি গানটির ছন্দে, কারখানা বন্ধের কোনও স্তব্ধতার বা নীরবতার আভাস নেই —বরঞ্চ আছে ঢেউ উঠছে কারা টুটছে শব্দের তালে তালে কারখানা চলারই গতি৷ তখন বুঝি সলিলদা কারখানায় হরতাল ডেকে কারখানা বন্ধের ডাক দেননি— তিনি কারখানা চালু রেখে ছন্দে ছন্দে— তাঁর হরতালের ডাক দিয়েছেন exploitation-এর বিরুদ্ধে, কারখানা চলার বিরুদ্ধে নয়৷ এ এক জীবনের সত্যবোধের পক্ষে গড়ে ওঠা আদর্শ নাগরিক শ্রম সংগীত— এ এক নিছক হরতালের গান বললে অবমূল্যায়ণ হবে৷ এ গান শ্রমিকের কাজের তালে, ছন্দে, সত্যবোধে মিশ্রিত হয়ে, নাগরিক শব্দ ঝংকারে গ্রথিত৷ শ্রমিক শোষণ বিরোধী সংগ্রামী জীবনের কুচকাওয়াজের মন্ত্রধ্বনির তাঁর রচিত গান, সংগীতের বিষয় নিয়ে আলাদা গবেষণা ও বিশ্লেষণ জরুরি৷ আমি তাঁর নাগরিক সংগীত নির্মাণের দুটি নমুনা দিলাম মাত্র৷ যেমন বিস্ময়কর তাঁর রচিত বিদায়বেলার গান, ‘এই পৃথিবীর গাড়িটাও থামাও’ গরু গাড়ি, নৌকোযানের সময় অতিক্রম করা ট্রেনের সময়কার শব্দধ্বনি৷ তাঁর রচিত গানে তিনি যেমন পাল্কিকে এনেছেন তাঁর গ্রামীণ মনস্কতায়, তেমনি এনেছেন কলকারখানা, ট্রেন৷ মজা হচ্ছে স্বর শব্দ ব্যবহারে তিনি কেবল বস্তুনিষ্ঠ নন— বোধ ও আদর্শনিষ্ঠ৷
সলিল চৌধুরির মতো বিরাট মাপের composer-কে পূর্ণাঙ্গ ভাবে জানতে হলে অনেক অনেক গান নিয়ে খুঁটিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন৷ আমি শুধু তাঁর নির্মাণের বিভিন্ন দিকগুলো একটু ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি৷ তার নির্মাণে যে সব বিভিন্ন সংগীতের ধারা ব্যবহার হয়েছে তার মধ্যে লোকগীতির নানা form আছে৷ কখনও ভাটিয়ালি, কখনও তরজা ঢং, কখনও বা কীর্তনদের আঙ্গিক কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতোই কোনও আঙ্গিকের দাসত্ব নেই — আছে ভাব প্রকাশের প্রয়োজনীয় আকুতি৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়— অনুকরণ নেই আছে স্বীকরণ৷ লোকসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর নির্মাণ কৌশল কেমন তা বোঝাবার জন্যে গণনাট্য সঙ্ঘের সক্রিয় সভ্য, সংগঠক, নেতা ও লোকসংগীত বিশেষজ্ঞ ও সুর নির্মাতা শ্রী কঙ্কণ ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণ অনুধাবনযোগ্য৷ যার সঙ্গে আমিও সহমত পোষণ করি৷ কঙ্কণ লিখছেন,
‘লোকসংগীতের আঙ্গিক গ্রহণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সলিল চৌধুরি৷ ইতিপূর্বে এবং সমসাময়িক কালে লোকসংগীতের সূরের উপর কথা বসিয়ে সৃষ্টি বেশ কিছু গানের সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম৷ [হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সৃষ্টি] কিন্তু তাঁর [সলিল চৌধুরির] সৃষ্ট ‘তোমার বুকের চিহ্ন খুঁজি’ গানটি সে ক্ষেত্রে নতুনত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷…. এই গানটি রচনা মোটেই লোকসংগীতধর্মী নয় কিন্তু প্রয়োগের গুণে তা বলিষ্ঠতার সঙ্গে মূল ভাব প্রকাশ সাহায্য করে৷ [শ্রবণে লোকসংগীত ভিত্তিক সুর বলে মনে হয়] এখানেও এক অসাধারণ প্রয়োগ যা আধুনিক হয়েও সুরকে (অর্থাৎ লোকসংগীতের বোধকে] ব্যাহত করে না৷ এখানেই রচনার চমক এবং সার্থকতা৷ এই প্রসঙ্গে তাঁর অতি জনপ্রিয় ‘হেই সামালো’ গানটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে৷ গানটি আগাগোড়া ভাটিয়ালি সুরে বসানো৷ কিন্তু ‘হেই সামালো’ কোনও বিশেষ সুরাশ্রয়ী নয়, তা সত্বেও কিন্তু লোকসংগীতের পরিচয় বহন করে প্রবলভাবে৷ এই গানেই শেষাংশে ‘মোরা তুলবো না ধান পরের গোলায়’ থেকে সুর অন্য রাস্তা ধরে কিন্তু অবলীলায় তা মুখে ফিরে এসে নতুন সুর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে৷ এ সব একজন মহৎ সংগীত স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব৷’
লোকসংগীতের আশ্রয়কে নতুন চেহারায় ব্যবহার করার উদাহরণ তাঁর গানে আরও পাওয়া যায়৷ একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ:
হেঁইয়ো হো হো হেঁইয়ো
ও মাঝি বাইয়ো
বাঁইয়ো রে নাও বাইয়ো—
খর নদীর ওপারে স্বপ্নের দেশে যাইয়ো…’
সাধারণভাবে নৌকা বাওয়ার গান ত্রি মাত্রিক বা চতুর্মাত্রিক তালে দ্রুত লয়ে গাওয়া হয়৷ উপরোক্ত গানটি আপাতদৃষ্টিতে সারি গানের কাছাকাছি মনে হলেও বিষম মাত্রিক তেওড়া তালে ৩/২/২ প্রয়োগে তা সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা আনে৷ সুর প্রযোগেও তা সারি গান বা ভাটিয়ালির কাছাকাছি যায় না কিন্তু অদ্ভুতভাবে লোকসংগীতের পরিচয় বহন করে৷’
কঙ্কণের সঙ্গে আমি একমত যে সংগীত নির্মাণ সলিল চৌধুরি রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীটির অনুসারী, যে, ‘সংগীতে এতোখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়৷’ সত্যিই তো মানুষ, বিশেষ করে যারা সৃষ্টিশীল তাঁদের প্রাণশক্তিই তো চলমানতার বেগ আবেগের স্রোতে প্রবহমান৷ বৈষ্ণবের অভিসারী অনুসন্ধানের মতো, রবীন্দ্রনাথের ‘হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোন খানে’র মতো তারা এগোয়, এগোয় এগোয়৷ তারা থেমে থাকতে পারে না৷ পশুপাখির মানসিক চলমানতা নেই, —ভাবের নেই অতিক্রম৷ মানুষ একদিন গাছের ডালে বাস করতো, আজ বহুতল বাড়িতে বাস করে৷ সময়ের হাত ধরে যুগের পট পরিবর্তন করে মানুষের সৃষ্টিশীলতার চলমানতার বোধ৷ তাই মানুষের সৃষ্টিতে পড়ে তাই গতিশীলতার ছাপ৷ রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷’ এই ভাব তো স্থবির নয়,— প্রগতিময়৷ বিখ্যাত সংগীতবোদ্ধা শ্রী রাজ্যেশ্বর মিত্র একটি প্রবন্ধে ইঙ্গিত দিয়েছেন, কবি জয়দেব ‘গীত গোবিন্দ’ রচনার সময় ভাবের প্রয়োজনে পরিকাঠামো ভাঙতে চেষ্টা করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথও আঙ্গিক অনুবর্তন, অনুকরণের কথা বলেননি— বলেছেন আত্মবিকাশের স্বীকরণ কবতে৷ ঐতিহ্যবাহী আধুনিকতা৷ রবীন্দ্রনাথের গানে বাউল, কীর্তন, মার্গ সংগীত, পাশ্চাত্য সংগীত যেমন নবরূপে প্রকাশিত— সলিল চৌধুরির সৃষ্টিতেও তাই৷ সলিল চৌধুরী যেন রবীন্দ্রনাথের ভাবসত্তা কিন্তু প্রয়োগে উভয়ের মধ্যে ব্যবধান বহু৷ রবীন্দ্রনাথ স্থিতধী সলিল চৌধুরী অস্থির৷ একজন বৃহস্পতির জাতক ব্রাহ্মণ, অন্যজন মঙ্গলের জাতক— ক্ষত্রিয় যোদ্ধা৷ রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে— যেমন বাউল না-বাউল সুর উদ্দীপিত রবীন্দ্রসংগীত— হেঁই সামালো তেমনি লোকসংগীত না-লোকসংগীত প্রেরণাদীপ্ত সলিল সংগীত৷ বারবারই বলব প্রতিটি গানে নির্মাণ আলাদাভাবে গবেষণার বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথ সংগীতে যে মিশেলের কথা, আধুনিকতার কথা বলেছেন— সলিল চৌধুরি তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিস্ময়করভাবে৷ রবীন্দ্রনাথের ছুৎমার্গ ছিল না— সলিলদা সহ সমস্ত আধুনিক গানের নির্মাতাদেরও সেই ছুৎমার্গের স্পর্শ নেই৷ তবে পরিবর্তন ও নতুনত্বের নিরিখে রবীন্দ্রনাথ যেমন যুগস্রষ্টা— সেই যুগ পরিবর্তনকারী হিসাবে আবার আমরা সলিল চৌধুরিকেই পাই৷ রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সলিল চৌধুরি নতুন সমাজ ভাবনায়, জীবন চিন্তায় মেঘলা মেয়েকে প্রেমের আঙিনা থেকে তপ্তরোদের বেলায় ক্ষুধার্তভাবে দ্বারে দ্বারে অন্ন মেগে ফিরতে দেখেছেন৷
সলিল চৌধুরি যেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা ‘ঐকতান’কে শ্রদ্ধাবনতভাবে প্রণাম জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপে সাড়া দিয়ে নিজে তাঁর রচনায় নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়েছেন৷ ‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন তাঁর কবিতার অপূর্ণতা৷ স্বীকার করেছেন তাঁর কবিতা বিচিত্র পথে সর্বত্রগামী হয়নি৷ কৃষাণের শরিক হতে পারেননি৷ তবু বলব— রবীন্দ্রনাথের প্রায়শ্চিত্তের ধনঞ্জয় বৈরাগীর ‘রইল বলে রাখলে কারে’ গানটি অন্য ভাষায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে ‘হেঁই সামালো ধান’ গানটিতে৷ উপেনের দুই বিঘা জমির দরদ রবীন্দ্রনাথের বুকে যে বেদনার ভাষা জাগিয়েছিল সে সুর সলিল চৌধুরির ‘লাঙল যাহার জমি তাহার’ অভিব্যক্তিতেই পরিণতি লাভ করেছে৷ তেভাগা আন্দোলনে চাষীর যে হক দাবি তা ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে স্বীকৃত৷ রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার পরিণত পরিণতি আমরা সলিল চৌধুরি রচিত ‘দো বিঘা জমি’ কাহিনীতে পাই৷ কৃষকের rural life এসে urban city life-এ মিশে গেল৷
স্বাদে গন্ধে বৈচিত্র্যে সলিল সংগীত জীবনের এক অন্যরকম অনির্বচনীয় আস্বাদন৷ ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’— গানটিতে আখর যুক্ত কীর্তনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন এত নৈপুণ্যের সঙ্গে যে বুঝতে অসুবিধা হল না সনাতন সংগীত, ঐতিহ্য সংগীত, কীভাবে আধুনিক সংগীতকে পুষ্টি জোগাতে পারে৷ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কীভাবে তাঁর গানে সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার প্রমাণ ছত্রে ছত্রে৷
ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে গেল কিন্তু গেল না৷ হাতে তুলে দিল dominion status-এর মোয়া৷ দেশি শোষণের মুখোশের আড়ালে বিদেশির ষড়যন্ত্র রয়ে গেল৷ জাতীয় নেতৃত্ব সেই গোলামি মেনেও নিল৷ ‘ঝিলাম নদীর তীরে’ গ্রন্থটিতে কাশ্মীর সমস্যা সৃষ্টির ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে৷ এই গ্রন্থ পাঠ করলে কাশ্মীরের যুদ্ধের উৎস, যুদ্ধের বিবরণ ও অনভিপ্রেত সময়ে যুদ্ধবিরতির পক্ষে জাতীয় নেতৃত্বের ইংরেজের কাছে আত্মসমর্পণের কী অন্যায় ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা জানা যাবে৷ এই dominion status-এর রূপ বর্ণনা করতেই সলিলদার রচনা—
‘নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম
আর জান দিয়ে জানোয়ার পেলুম লাগলো দেশে ধুম৷’
এই গানটির একটি অংশে আছে—
‘আমার বাবা বড় বোকা ছিল আমি তো তার ছেলে
(সে) বিলিতি কাপড় পুড়িয়ে গিয়েছিল জেলে
(আর) তোমরা যেমন দেশী সুতোয় বানালে গাঁটছড়া
তার এক কোণ বাঁধলে গাউনের সাথে৷
আর কোণ গলায় দিয়ে ঝুললুম
নাকের বদলে নরুন পেলাম টাক ডুমা ডুম ডুম৷’
এই বিদেশি মদতে দেশি শোষণের যে লাগাতার প্রক্রিয়া আজও ভারতবর্ষকে গোলাম করে রেখেছে তাকে সলিলদা সংগীতে বারবার আঘাত করেছেন৷ ঠিক গ্রামীণ চারণের মত৷ তেভাগা আন্দোলনের গান, ‘হেঁই সামালো’ গানেও দেশি শোষক রূপী শাসককে উদ্দেশ্য করে লাইন লিখছেন ‘সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি না?’ বলার ভঙ্গিতেও আমাদের লোকগীতির আঙ্গিক ব্যবহৃত অথচ প্রকাশের বুননে urban Music-এর ভাব ভাষা সমৃদ্ধ আধুনিক প্রকাশ৷ সমাজ জীবনের চলমানতার সঙ্গে সঙ্গেই শিল্প সংস্কৃতি সংগীত এগিয়ে চলছে— সমাজ জীবনকে পুষ্টি জোগাচ্ছে৷ সমকালীন সমাজ হচ্ছে শিল্পসৃষ্টির canvas আর মানুষের অভিব্যক্তিই হচ্ছে তার ছবি৷ যেমন চৈতন্যযুগের যে বৈপ্লবিক আবির্ভাব তা বহু কবিতা, সাহিত্য সংগীত রচনার উৎস— তেমনি মানুষ ব্রাহ্ম আন্দোলনের মধ্যে থেকে পেয়েছে ব্রহ্ম সংগীত৷ স্বদেশি আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে বিখ্যাত সব গান, কবিতা, ও নানান বিভাগের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও প্রকাশ৷ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘সর্বখর্বতারে দহে,’ যতীন দাস গত হওয়ার প্রেক্ষিতে৷ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’— বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিকায়৷ সলিলদার গণসংগীত রচনার পাশাপাশি জাতীয় আন্দোলনের মেজাজেও বিষয়ে রচিত, ‘নবারুণ রাগে রাঙেরে অন্ধকারার বন্দী দেশ’ ‘মানবো না এ বন্ধনে, মানবো না এ শৃঙ্খলে’৷ কেবল সুরের ক্ষেত্রে ‘নবারুণ রাগে’ যেমন জাতীয় আন্দোলনের সংগীতের অনুসারী ‘মানবো না এ বন্ধনে’ গানটিতে গণসংগীতে Folk blend সৌরভ বিধৃত৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের স্রোতই এসে আছড়ে পড়েছিল গণসংগীতের সৃষ্টির ওপর৷ কিন্তু গণসংগীতের আন্তর্জাতিক বোধই গণসংগীতকে বিশ্বসংগীতের রূপে রূপান্তরিত করেছিল ভাষা, ভাবনা ও সংগীতায়নে৷ যার আদর্শ রূপ আমরা পাই, সলিল সংগীতের সেই লাইনে ‘বিশ্বের নব মানচিত্রের স্রষ্টাযে আমাদের কোটি কোটি প্রাণ৷’ রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্ববীণা রবে’— গানের বিশ্ববোধের ধ্বনি বৃহত্তর মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রকাশিত হল, ‘বিশ্বের নব মানচিত্রের স্রষ্টা যে আমাদের কোটি কোটি প্রাণ’-এর ভাষায় ভাবে, উদ্দীপনায়, উৎসাহে, বিকাশে, প্রকাশে৷
সলিলদার সৃষ্টিতে ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি একটা সহজাত প্রকাশ৷ একটা আড্ডায় বসে মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাউকে নিয়ে একটা রসাল গল্প ফেঁদে ফেলতে পারতেন৷ Humour তাঁর স্বভাবের সত্তার মধ্যেই সম্পৃক্ত৷ তাঁর কবিতায়, গানে এই ব্যঙ্গ বার বার উঠে এসেছে৷ সলিলদা রচিত ‘কানকাটার ছড়া’ পাঠ করলে বোঝা যাবে কৌতুক কত উচ্চমানের হতে পারে৷ এই জীবনমুখী গান এই অভিধায় যখন প্রথম ক্যাসেট প্রকাশিত হল, চারদিক থেকে রব উঠল, শিল্পসৃষ্টিকে কখনও জীবন বাদ দিয়ে হয়? আজ পর্যন্ত সব শিল্পই উঠে এসেছে মানুষের, সমাজের চিত্র থেকে৷ সংগীত মহলে ‘জীবনমুখী গান’ নিয়ে তরজা যখন চরমে, সলিলদা তখন চার লাইনের একটি ছড়া লিখলেন৷
‘আলু খুঁইজ্যা পাইলাম না তাই
খাইলাম কচুমুখী
সুর খুঁইজ্যা পাইলাম না তাই
গাইলাম জীবনমুখী৷’
এইভাবে শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে গান রচনা করেছেন ‘শোন ভাই ইস্কাবনের দেশে৷’ বিলাসী দেশ প্রেমিককে ব্যঙ্গ করে৷ ‘ও ভাইরে ভাই মোর মতো দেশপ্রেমিক নাই৷’ আবার জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েও যে রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে থাকতে চায় তাকে নিয়ে রচনা করলেন ‘আমি রাজনীতি ফিতির ধার ধারিনে৷’ এই সব গান প্রায় সবই লোকগীতির আঙ্গিকে রচিত৷ শেষোক্ত গানটি পুরো তরজা আঙ্গিকের৷ ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম’ গানটি শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গরচনা৷ অন্নদাশঙ্কর রায়ের দেশ বিভাগের ওপর ছড়া ‘তেলের শিশি’ও এই একই ভাবনার ফসল৷ গাঁয়ের বধূ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং আয়রে ও আয়রে (ধান কাটার গান) ও অন্যান্য গণসংগীত জগৎ যখন বাংলার সংগীত প্রেমিক হৃদয়কে স্পর্শ করল সেই সময় কিছু মানুষ সংগীতে এই শ্রম, মেহনতকে আনার বিরোধিতা শুরু করলেন৷ মনে আছে, শ্রদ্ধেয় গীত রচয়িচা কবি শ্রীপ্রণব রায় দৈনিক কাগজে এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, যার উত্তরে আর এক প্রখ্যাত গীতরচয়িতা শ্রদ্ধেয় মোহিনী চৌধুরি এই শ্রম, মেহনত গানে যুক্ত হওয়াকে সমর্থন করেন৷ তখন একটা অভিব্যক্তি কিছু শিল্পীর মধ্যে থেকে গড়ে উঠল, যার মর্মকথা art for art shake. সলিলদা তাকে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় আক্রমণ করে লিখলেন একটি গান—
‘আমরা গান গাই
কেন না গান গাই
যেহেতু গান গাই
কাজেই গান গাই
যুক্তিতর্কের সকল সীমাই
পেরিয়ে এলেম এই দেশে ভাই৷
কেউ বা তাথৈ নাচে
কেউ বা কি চায় জানে না তাও
দু’হাত তুলে যাচে
অকারণে আনন্দে কেউ
বিভোর হয়ে আছে৷
শিল্পী মোদের পিতা
কল্পলোকের সিঁড়ি মোরা
বস্তুলোকের চিতা
কে, কি, কেন, কবে, কোথায়?
প্রশ্ন মোদের বালাই৷
প্রতিভার সাক্ষাৎ মেলা যতটা সহজ যুগস্রষ্টার সন্ধান পাওয়া ততটা সহজ নয়৷ সংগীত জগতে আমরা বহু প্রতিভার প্রকাশ দেখেছি কিন্তু যুগস্রষ্টা মাঝে মাঝে৷ এঁরা এক একটি বিশেষ ধারার প্রবর্তক৷ যেমন এস ডি বর্মন একজন ক্ষণজন্মা অসাধারণ সুরকার কিন্তু তাঁর স্রোতে বয়ে আসা কোনও প্রতিভাধর সুরকার আমরা পাইনি,— যদিও তিনি নিজে তাঁর স্বকীয়তায় একেবারে মৌলিক৷ কিন্তু আর ডি বর্মন এমন একটি আঙ্গিকের প্রবর্তক যার প্রভাব আজও বর্তমান সুরকারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে৷ সলিল চৌধুরি এমনই এক সুর-সূর্য, যাঁর প্রদীপ্তিতে সমস্ত বাংলা গানের একটা মোড় ঘুরে গেছে৷ সৃষ্টি হয়েছে স্বর্ণযুগের গান৷
একটা যুগে এসে একক সম্রাটের মতো সুরের জাল বিস্তার করে সংগীত জগতের চুনোপুঁটি থেকে বোয়াল মাছ পর্যন্ত তুলে নিতে সক্ষম হয়েছেন সলিলদা৷ প্রথম ছবিতে গান গাওয়ার পরই লতা মঙ্গেশকর কাগজে লিখেছিলেন, তাঁর প্রিয় সুরকার সলিল চৌধুরি৷ ময়দান, মিছিল, গণসংগ্রামের উর্বর সৃষ্টিভূমি থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের উচ্চসাধকদের দরবার পর্যন্ত ছিল তাঁর বিস্তৃতি ও স্বীকৃতি৷ আগেই বলেছি আমরা নিজেরাই (সলিলদা-সহ) এক সন্ধ্যায় শ্রদ্ধেয় তারাপদ চক্রবর্তী মশাইকে বহু সলিল সংগীত শুনিয়েছিলাম এবং তিনিও সলিলদাকে পাল্টা সলিলের মতো বিষয়বস্তু নিয়ে একটি উচ্চাঙ্গ সুরভাঙা বিরাট গান শুনিয়েছিলেন৷ বাস্তুহারা জীবন নিয়ে৷
সলিল চৌধুরির গান কেবল গান নয়, মানবতার জীবনবেদ এবং আঙ্গিকে যুগ-পথিকৃৎ৷ সাক্ষাৎ আলোচনায় দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত তুলে সারারাত ধরে দেখিয়ে দিতে পারি তাঁর সুর-সংযোজনার কৌশল নিয়ে এবং সংগীতের বিষয়বস্তুর মধ্যে জীবন-দর্শনের বিস্তার নিয়ে সেমিনার করা যায়৷ আমি আমার সুরসৃষ্টির বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বুঝেছি, তাঁর চিন্তার নতুনত্বকে অতিক্রম করে কিছু করতে পারিনি৷ তবু যেটুকু আমাকে মৌলিকভাবে গড়ে তুলেছে তা তাঁর কৌশলকেই সুকৌশলে ব্যবহার করে৷
মানবপ্রেমের আন্তর্জাতিক সুর অনুভূতি তাঁকে কতটা উজ্জীবিত করত এক একটা গান নয়, এক একটা বাক্যের মধ্যে তার উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে৷ যেমন, ‘বিশ্বের নব-মানচিত্রের স্রষ্টা যে আমাদের কোটি কোটি প্রাণ৷’ বা ‘বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান/কোটি প্রাণ একই প্রাণ/একই স্বপ্নে বলিয়ান৷’ নিঃস্ব মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনি বেজেছে তাঁর বুকে ‘দুই শতাব্দীর নাগপাশে বন্ধন/নিঃস্ব হল কত অগণিত প্রাণমন৷’ বা ‘মাতা শিশু কাঁদে ঘরে ঘরে আনাহার’ ইত্যাদি৷ রক্তপুঁজ মাখা ছাত্রবন্ধু-শহিদের বিরহে বিষণ্ণ অন্তরাত্মা যখন কলম ধরেছেন, বন্ধু প্রীতিতে কলম থেকে তখন নির্গত হয়েছে হৃদয় নিঙড়ে নেওয়া বাণী ‘তোমার বুকের খুনের চিহ্ন খুঁজি ঘোর আঁধারের রাতে৷’ তাতে সুরকে বিচ্ছেদের বহ্নিশিখায় যেমন পুড়িয়ে ব্যথিত করেছেন, তেমনি অনুভূতিকে শপথের শিখায় করেছেন প্রজ্বলিত৷ সলিল চৌধুরির ব্যক্তিপ্রেম মানবপ্রেমের দিগন্তে মুক্তি পেতে চেয়েছে৷ তাই যখনই তার ব্যক্তি প্রেম সত্য হয়েছে তখনই তা সম্ভব হয়েছে, অর্থাৎ যখন তাঁর লেখনি বলে উঠেছে, ‘কী হল চাঁদ কেন মেঘে ঢেকে গেল মুখ কেন ভার’ বা ‘তোমার আমার এমনই এ খেলা/দুকূলে দুজনে বেয়ে যাব ভেলা/কখনও সহসা ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলে/কিছু ছোঁয়া যদি পাই’, তখনই৷ আবার মুক্ত ভালবাসাকে জীবনের দৈনন্দিন বা সংসারী খুঁটিনাটির হীনমন্যতা যখন পিছন থেকে টানবার চেষ্টা করেছে, তখন বদ্ধতার গণ্ডিতে হাঁপিয়ে বলে উঠেছেন, ‘বাঁধা পশুর মত/ঘুরি আপন সীমানায়/চলে দিন রজনী যায়’ বা ‘পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেবে যাবো৷ আমার টিকিট কাটা অনেক দূরের/এ গাড়ি যাবে না আমি অন্য গাড়ি নেব৷’
সুরকার সলিল চৌধুরির সমগ্র জীবন এক বিপ্লবের প্রতীক৷ পুঁজিবাদী শক্তির কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে পৃথিবীর ধনবাদীরা মহা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে তিনটি অমোঘ অস্ত্র,— প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ভদ্রতার মুখোশ পরা উগ্র জাতীয়তাবাদ৷ এর দ্বারা মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করার খুব সহজ উপায় পাওয়া গেছে৷ আজও পৃথিবীর মুষ্টিমেয় ওপরতলার মানুষের অন্ধ প্রাদেশিকতা, অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধ জাতীয়তাবাদের উগ্রতার শিকার সাধারণ মানুষ৷ এই বিভেদ সৃষ্টি করবার বিরুদ্ধে মানব সংহতির জন্য ওই গণসংগীতের ইতিহাসে আজও সলিলদার সৃষ্টি গণসংগীতের ধারার বাইরে এসে কেউ কিছু সৃষ্টি করেছে বলে আমার জানা নেই৷ হরতালের গান গাইতে গিয়ে যেমন ছন্দকে ধর্মঘটের বাক্সে বন্ধ করে গড়ে তোলেনি, — ছন্দকে দিয়েছেন মেশিনের মর্মধ্বনির— ধ্বনি ও গতি, তেমনি বিভিন্ন লোকসংগীতকে মাঠ থেকে তুলে এনে বুদ্ধিজীবীর আসর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন৷ যেমন ‘মানব না এ বন্ধনে’৷ পাল্কি চলের ‘সামাল হেঁকে থেকে ঐ যে গাঁয়ের ঐ সীমানা’ পর্যন্ত সুর একটা মারাঠি লোকসংগীতের সুরে রচিত৷ লোকশিল্প ও আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে একটা অনাবিল মেলবন্ধন সৃষ্টির প্রয়াস শুধু নয়, এক অভিনব সিদ্ধি৷ যেমন রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা পাই লোকসংগীতের সুর নিয়ে তিনি যখন গান বেঁধেছেন তখন তা পূর্ণভাবে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠেছে৷ ‘জাগো মোহন প্যারে’ একটি বিখ্যাত খেয়াল গান৷ তার কায়দায় রবীন্দ্রনাথ গান বাঁধলেন, ‘মন জাগো মঙ্গললোকে৷’ তাকেই আবার সম্মেলক সুরের অপূর্ব ব্যাপ্তির মধ্যে সলিলদা করলেন প্রয়োগ ‘জাগো মোহন প্রিতম’ গানে৷ ছোট ছোট ক্ষেত্রে আঙ্গিকের প্রয়োগ এমন সুন্দর যা সামনাসামনি বসে উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হয়, না হলে বোঝানো যায় না৷ তাঁর গানের মাধুর্য, চমৎকারিত্ব, প্রয়োগ কৌশল, যন্ত্রানুষঙ্গ, সামগ্রিক পরিবেশনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনুভব তাঁর গানে এতটাই পরিপুষ্ট যে তাকে ব্যাখ্যার দ্বারা তার অপূর্বতাকে গড়ে তোলার কথা ভাবা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়৷ তাঁর সৃষ্টি ও জনমানস বোধ কেবল পরিপূরক নয় একাত্ম৷
আর একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হয় তাঁর যন্ত্র ব্যবহার৷ তিনি যন্ত্রকে কথা বলাতে পারতেন৷ যন্ত্রের মুখে কেবল সঠিক ভাষা তুলে দিতে পারতেন তা নয়— ভারতীয়দের মুখে ফরাসি ভাষা ব্যবহারের মতো এক যন্ত্রের ভাষায় তুলিয়েছেন অন্য যন্ত্রের ভাষা৷ যন্ত্র সঙ্গীতের প্রয়োগ অসাধারণভাবে পাই আমরা তাঁর রচিত আবহ সংগীতে৷ দু’একটা উদাহরণ দিলেই বোঝানো যাবে৷
‘পরখ’ ছবিতে একটি সৎ মানুষ, — যার মূল্যবোধ ও স্বপ্ন আছে দারিদ্র্যে তাঁর বাড়ি নিলাম হয়ে যাচ্ছে৷
সলিলদার সঙ্গে, একসঙ্গে বসেই ছবিটা দেখছি৷ দৃশ্যটার আবহসংগীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে যখন আমার পরিতৃপ্তির বিষয় জানালাম— খুশি হয়ে আমায় বোঝালেন৷ একটি পর্দা দিয়ে অনেকগুলো কর্ড হয়৷ মনে কর ওই একটি পর্দা Mechanical Process of life এবং যতগুলো কর্ড আসতে পারে সব dreams of life. এখন ওই নির্দিষ্ট পর্দাটা hammer করতে করতে তার আওয়াজ জীবনে বৃহত্তর রূপ নিয়েছে আর কর্ডগুলো আসছে কিন্তু ওই hammer-এ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ Mechanical Process of life, ‘dreams’ of life-কে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে৷ আর একটি ছবি লালপাথরের একটি দৃশ্যে স্ত্রীকে চাবুক মারল স্বামী৷ স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ এই দৃশ্যের পরিস্ফুটন করতে গিয়ে Composition-টা অনেক যন্ত্রের Symphony-র মধ্যে দিয়ে এমনভাবে সলিলদা করলেন যাতে স্ত্রীর বেদনাটা একটা বিচ্ছিন্ন কান্না বলে মনে হল না৷ মনে হল স্বামীর স্ত্রীর সম্পর্কের মূল melody যখন চাবুক মারায় Shattered হয়ে গেল তখন যৌথবোধের dreams and melody ভেঙে চুরমার হয়ে গেল৷ এসব ইউরোপীয় সিম্ভনির পথ ধরে করা— যার মানে আন্তর্জাতিক৷ তুল্য বিচারে পথের পাঁচালীতে দুর্গার মৃত্যু সংবাদের প্রতিক্রিয়া তারসানাইতে একক বেদনায় ছিন্নভিন্ন৷ কিন্তু তাতে স্বপ্ন বা আশাভঙ্গের ইঙ্গিত নেই৷ বিচ্ছিন্ন বেদনা যার কোনও Life canvas নেই৷ পাশাপাশি দুটি আবহ রচনায় রবিশঙ্কর দেশজ, সলিল চৌধুরি আন্তর্জাতিক৷ এই ধরনের অসাধারণ প্রয়োগে, মানসিক দ্বন্দ্বকে যেভাবে সুর চিত্রায়িত করা হয়েছে, এ তাঁর প্রতি ছবিতেই প্রায় পাওয়া যায় অথচ ভারতীয় ছবিতে এ প্রয়োগ বিরল৷ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় রাগ রাগিণীকে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সংগীতের বাদী, সম্বাদী মানা রাজতন্ত্রের পরিকাঠামোয় পর্দাকে যেভাবে সমাজতন্ত্রে মুক্তি দিয়েছেন, সলিলদা সেই মুক্তিকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন৷ তাঁর কথা লিখে বা বলে প্রকাশ করা যায় না৷ দীর্ঘ অনুশীলন ও সাধনা দ্বারা তার শিল্প সৃষ্টি-কৌশল আয়ত্ত করতে হয়৷ আগামী প্রজন্ম বহুদিন ধরে তাঁর কাছে ঋণী থাকবে— কেবল তাই নয় মহাকাল এখনও তাঁর বিচার শুরু করেননি, দীর্ঘ গবেষণার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে বাধ্য করাবেন সলিলদার সৃষ্টির মূল্যায়ন করতে৷ সেদিন বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতে তাঁর অবদান স্থান পারে Classic হিসেবে৷
অতুলপ্রসাদের গান অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের গান কান্তকবির গান, নজরুলের গান নজরুলগীতি, রামপ্রসাদের গান রামপ্রসাদী, কিন্তু এঁদের সারথি করে কোনও যুগের প্রবর্তন হয়নি৷ যা হয়েছে রবীন্দ্রনাথে, রবীন্দ্রোত্তর সময়ে যুগটা রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্য, রবীন্দ্রোত্তর সংগীত এভাবেই চিহ্নিত৷ এই পরিবর্তন আবার আমরা পেয়েছি সলিল চৌধুরির গানে ও গণসংগীতে৷ সলিল চৌধুরির গান কেবল সলিল সংগীত হয়ে থেমে থাকেনি, তাঁর গান যুগের হাতে তুলে দিয়েছে নতুন ভাবধারা, নতুন বিষয়বস্তু, নতুন আঙ্গিক, যা বৈপ্লবিক বললেও অত্যুক্তি হবে না৷ ব্যক্তিজীবনের অনুভূতির সূক্ষ্ম তন্ত্রীর বাজনা যে মানুষের মেহনত, পেটের জ্বালা, সামাজিক অসহায়তা, বিপন্নতা, বিষণ্ণতার সঙ্গে জড়িত তা মানুষ বুঝতে শুরু করল সলিল চৌধুরি ও গণচেতনার সংস্কৃতি থেকে৷ চৈতন্যযুগ, ব্রাহ্মযুগ, রবীন্দ্রযুগের মতো গণনাট্যের যুগও ইতিহাসের চকচকে পাতা৷ সলিল চৌধুরির নেতৃত্বে সংগঠিতভাবে সংগীতের ভাষা, ভাব ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ সেই আন্দোলনের যে জায়গা করে দিয়েছে তাতে সংগীত জগৎ সূর্যরশ্মির মতো আলো পেয়েছে, এই সময়ে ভারতের সমস্ত প্রদেশের লোকসংগীত, এমনকি বিদেশের সুর পর্যন্ত নিয়ে ভারতীয় ও বাংলা গানকে পুষ্টি জোগনো হয়েছে৷ আজ যা কিছু আধুনিক গানের শুভ প্রচেষ্টা আমরা দেখছি তা সলিল চৌধুরি যুগেরই অবদান৷ ও মোদের দেশবাসীরে গানটিতে অসমিয়া বিহুকে নিয়ে যে আঙ্গিকে সলিল চৌধুরি সম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যের সংগীত রচনা করেছেন তা পৃথিবীর বিস্ময়৷ ভারতের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম এমনকি প্রাচ্যের সুরকে নিয়েও আন্তরিকভাবে দেশজ করে সলিল চৌধুরি আধুনিক গানের সমৃদ্ধি বাড়িয়েছেন৷ আমাদের যুগ সুরে ও ভাষার যে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে তার প্রেরণা প্রদীপটির নাম সলিল চৌধুরি৷ সলিল চৌধুরিকে প্রেরণা-প্রদীপ না বলে প্রেরণা-মশাল বলা আরও ভাল৷ কারণ তাঁর সংগীতে বলিষ্ঠতার ছাপ ছত্রে ছত্রে৷ ধর্মজগতে Spiritual বাদ দিয়ে যেমন Rituals নিয়ে মাতামাতি করে ধর্মকে অসুন্দর করে তুলছে৷ সংগীতের ব্যাকরণ নির্ভর আঙ্গিক সর্বস্বতা তেমনি সংগীতকে ভাববিহীনতায় পর্যবসিত করেছে৷
কবি সন্ন্যাসী শ্রী পরমানন্দ সরস্বতী লিখেছেন, ‘জীবন যদি বড় না হয়, তার সৃষ্টি কি করে সার্থক মহান হতে পারে?— আর্ট যে জীবনেরই শিল্প-শিখা৷ তাই শিল্পীকে হতে হবে সাধক, জীবন পূজারী৷’ সেই আত্মদীপ্ত সত্য, যাঁর ইন্ধনে সেই সলিল চৌধুরি মানুষের সৌন্দর্য সাধনার প্রতিষ্ঠার জন্য সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছেন৷ আমি তাঁর ভালবাসার ছায়ায় বসে উপলব্ধি করেছি, এক বড় মাপের জীবনবোধ ছিল তাঁর৷ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির উৎস-সূত্র তাঁর সুন্দর উচ্চমূল্যবান মানব প্রেম৷ ময়দানের কৃষকের বেদনা, কারখানার শ্রমিকের দুঃখ যেমন প্রতিবাদী ও অনুরাগী যুগপৎ স্বরে ধ্বনিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে, তেমনি ব্যক্তিজীবনে আমরাও পেয়েছি সেই হৃদয়ের আশ্রয়৷ বড় মন, বড় জীবন৷ উদার বাউল অন্তর ছাড়া এই শরণ্য রূপ ফুটে উঠতে পারে ন৷ দু’একটি ঘটনার উল্লেখ করছি৷
বোম্বেতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সর্বভারতীয় সম্মেলন৷ সারা ভারতবর্ষের প্রতিনিধিরা আসবেন, যে যার প্রাদেশিক সংস্কৃতির সম্ভার নিয়ে৷ পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা থেকে আমাকে, প্রবীরদাকে, অনলকে প্রতিনিধি করা হল না৷ সলিলদা তখন কলকাতায় রিকশাওয়ালা ও বোম্বেতে তারই হিন্দি দো বিঘা জমিন ছবি করছেন৷ সলিলদা আমাদের বললেন, সারা ভারতবর্ষের লোক-সংস্কৃতির সমাবেশ হবে৷ এখানে তোরা নিশ্চয় যাবি, বলে রিকশাওয়ালার পারিশ্রমিক নিয়ে সেই অর্থে পাঠালেন সম্মেলনে যোগ দিতে৷ ফেরত পাঠালেন পাঁচজনকে দো-বিঘা জমিনের অর্থ দিয়ে৷ কেবল তাই নয় শরীর খারাপ থাকায় আমি যেতে চাইছিলাম না বলে সলিলদা প্রায় কাঁদ কাঁদভাবে বললেন, ‘তুই বুঝতে পারছিস না, সারা ভারতের লোকসংগীতের সমাবেশ হবে— তোর ওখানে যাবার বড্ড দরকার৷’ আজ ভাবি— পিতা মাতা ছাড়া এমন দায়বদ্ধ চৈতন্য কি অন্য কোনও সম্পর্কের মধ্যে প্রকাশ পায়? আমাদের ভাল হবে—সংগীতজীবনে কল্যাণ হবে এই চিন্তাই তাঁকে বেশি করে ভাবিয়েছে৷ কেবল তাই নয় যে সময়ে তিনি এতটা আর্থিক দায় বইলেন সে সময় কিন্তু তাঁর অর্থনৈতিক আনুকূল্য ছিল না৷ বড় মাপের মানুষ ছাড়া অন্নচিন্তা বিসর্জন দিয়ে পরহিতব্রত পালন করতে পারে না৷ কবি-সন্ন্যাসী পরমানন্দ সরস্বতীর দু’টি বাণীর মূর্ত প্রকাশ ঘটতে দেখেছি সলিলদার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিন্যাসে, ব্যঞ্জনায়৷ (১) ‘সর্বাত্মক কল্যাণ ছাড়া কারও কল্যণ হতে পারে না’, (২) ‘আনন্দকে একা পাওয়া যায় না— সকলের পূর্ণতা ও প্রকাশের মধ্যে আনন্দকে পেতে হয়৷’— এই মর্মবোধ থেকেই সলিল চৌধুরি কেবল সুরকার না হয়ে একজন যুগস্রষ্টা হয়েছেন৷ সমসাময়িক প্রতিভাদের সমাবেশ ঘটিয়ে সেই পটে অঙ্কন করেছেন আপনার সাংস্কৃতিক চিত্রকলা৷ স্বার্থদুষ্ট মন নিয়ে এ কাজ করা যায় না৷ মনকে আকাশের মতো বড় করে, পাহাড়ের মতো দৃঢ় করে, নির্ঝরণীর মতো শীতল তরঙ্গময় করেই এই ধরনের অভিব্যক্তিকে বহন করা যায়৷ শ্রীসুধীন দাশগুপ্ত তাঁর বহু আনুকূল্য লাভ করেছেন৷ গ্রামোফোন কোং-তে আমাদের এনে ঠিক বাবার দপ্তরে ছেলেকে বসিয়ে দেবার মতো করে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন৷ প্রবীরদার তখন পাশের বাড়িতে সলিলদার সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন৷ প্রবীরদা প্রায় বলেন, ‘তোমাকে সলিলদা নিয়ে যেতে বলেছেন৷’ একদিন গেলাম৷ কসবার বাড়ির ছাদের ঘরে একটা আরাম কেদারায় বসে বসে আমার সুরারোপিত গান শুনেছেন৷ সলিলদা আত্মমগ্ন— আমি গাইলাম ‘ছিপখান তিন দাঁড়’— শুনেই তিনি স্থির করলেন এ গান রেকর্ড করতে হবে৷ যেমন চিন্তা, পরের দিনই তিনি আমায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়ে সব ব্যবস্থা পাকা করলেন৷ যদিও আমার গাফিলতিতে কাজটা হয়েছিল বেশ কিছুদিন পরে৷ সেই গানটা রেকর্ডের সময় পুরো গানে সলিলদা অর্গান বাজিয়েছিলেন এমনকি শ্যামলদাকে গানটিও নিজেও শিখিয়ে দিয়েছিলেন৷ কেবল আমাদের তিনজনই না৷ সতীনাথদা বোম্বে গেছেন— সলিলদার মধ্যস্থতায় প্রথম বাংলা গান গাওয়ালেন লতাজিকে দিয়ে৷ সুধীনদা শঙ্খবেলাতে লতাজিকে দিয়ে গান করাবেন— যোগাযোগ, ব্যবস্থা করে দিলেন কে? না, সলিলদা৷ দ্বিজেনদা শ্যামলদাদেরও হিন্দি ছবিতে গাইয়েছেন৷ কৃষক, শ্রমিক মধ্যবিত্তের বেদনা তাঁর বুকে বাজত৷ মনুষত্বের বিপন্নতায় তাঁর মন হত বিষণ্ণ৷ এই জীবন সমর্পিত বিশ্ববোধই তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা যা একটা সত্যিকারের মানুষ ছাড়া অনুভবের অনুগত হয় না৷ জীবনকে নিয়ে কেউ কোথাও অপদস্থ করতে অগ্রসর হলেই তাঁর কলম-বীণা তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে সোচ্চার করেছেন অথচ ব্যক্তিগত অপমান, অসম্মানের সময় নীরবে ব্যথিত হয়েছেন কিন্তু কোনও পাল্টা আক্রমণ করেননি৷ পরনিন্দা, পরচর্চা তাঁর স্বভাবে ছিল না৷ তিনি মহৎ, তিনি উদার, তিনি বাউল৷ তাঁর ভালবাসাকে সংসার স্বার্থদুষ্ট কুক্ষিগত করতে চাওয়াতেই তাঁর জীবনের ট্রেন বদলের প্রয়োজন হয়েছিল৷ বাস্তবিকই তাঁর টিকিট কাটা দ্বিজোত্তম মর্মবোধের মূল্যে পরম বৈষ্ণবের মত মানব প্রেম বিচ্ছিন্ন জীবন তাঁর কাছে অবহ ছিল৷ কিন্তু তাঁর সহযাত্রীদের গন্তব্য ছিল সীমার মধ্যে৷ তাই শেষ জীবনে তাঁকে মনে হয়েছে একা৷ তাই কবির ভাষাতেই বলতে হয় ‘তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ৷’ আরও বলি, হে নিখিল হৃদয়ের মর্মসাধক, তোমার ভাষাতেই বলি— ‘তুমি বিশ্বের নব মানচিত্রের অন্যতম স্রষ্টা৷’ কিন্তু তোমার জীবন তোমার একার৷
আর একটা গানের উল্লেখ করে আমি বোঝাব সময়কে ধরে একটা সুর কীভাবে একটা কুঁড়ি অবস্থা থেকে বিকশিত, প্রস্ফুটিত পুষ্পে পরিণত হল৷ শাস্ত্রীয় সংগীতে ভৈঁরোর ওপর একটা বন্দিশ৷ ‘জাগো মোহন প্যারে’ রবীন্দ্রনাথ সেই সুর অবলম্বন করে পূজা পর্বের গান রচনা করলেন, ‘মন জাগো মঙ্গলালোকে’৷ সলিলদা সেই সুরকে অবলম্বন করে তাকে সমবেতভাবে বৃন্দগানে রূপান্তরিত করলেন৷ ভৈঁরো আমাদের ভোরের রাগ৷ শাস্ত্রীয় সংগীতে রবীন্দ্রনাথের গানে যে সুর morning হয়ে প্রকাশিত ছিল, তা সলিল চৌধুরির সৃষ্টিতে upsurge, হয়ে বিস্তৃত হয়ে গেল৷
সলিলদা একটা গানের মধ্যে ভোর শব্দটিকে একবার morning করে ব্যবহার করেছেন, একবার up surge হিসাবে৷ যেমন ‘রানার চলেছে বুঝি ভোর হয় হয়’— ভাষা অনুযায়ী ব্রহ্ম মুহূর্ত— অর্থাৎ এখনও ভোর হয়নি— সলিলদা কোমল ধ ব্যবহার করলেন— আর যখন ‘রানার রানার ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল’ ব্যবহার করলেন তখন শুদ্ধ ধ৷ একই tonic অর্থাৎ ‘সা’কে কেন্দ্র করে একটা তার minor chord একটি তার major অর্থাৎ গানটি যদি ‘B’ Flat Tonic হয় তবে কোমল ধ তে— ভোর হয় হয় হয়নি-তে E Flat minor আর ‘ধ’— ভোর তো হয়েছে E Flat major.
কবি সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতী লিখছেন, ‘কল্যাণকৃতকে অন্তহীন অশ্রু নিঝরে সৃষ্টি করতে হয়৷’ সেক্ষেত্রে সলিলদাও ব্যতিক্রমী নয়৷ রবীন্দ্রনাথকেও আঘাত বহু সইতে হয়েছে৷ সলিলদাকেও৷ কিছু স্মৃতিচারণ করছি৷ স্মৃতিচারণ মানেই কিছু কিছু মিষ্টি মিষ্টি কথা আর স্বপ্নালু Nostalgic গল্প, তা নয়৷ সৃষ্টিশীল শিল্পীর প্রসব বহু সময়েই Caesarean Baby. এ অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ সহ ছোট বড় সব মাপের নির্মাতাদেরই প্রায় সবারই আছে৷ সজনীকান্ত দাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বহু বিরাট মাপের মানুষই রবীন্দ্রনাথকে অবমূল্যায়ন করেছেন৷ আজ বলব সলিল চৌধুরির কথা৷ প্রগতির পতাকা হাতে নতুন পথের সন্ধানী সমস্ত আলোর পথ যাত্রীদেরই এই বেদনা বরণ করতে হয়৷ কবি সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতী খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, ‘এই সভ্যতার হৃদয়হীন মরুভূমিতে কল্যাণকৃতকে অন্তহীন অশ্রুনির্ঝরে সৃষ্টি করতে হয় শান্তির উদ্যান৷ সত্যপথ ধরে চলতে গেলে তোমাকে শত বাধার সম্মুখীন হতে হবে৷ একান্তভাবে যে সত্যকে আশ্রয় করে তার জয় সুনিশ্চিত৷ বিশ্বদেবের দরবারে আলো জ্বালাবার জন্যে দিতে হবে আত্মাহুতি৷’ আলোর পথযাত্রী সলিল চৌধুরি আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁর সত্যের বেদিতলে৷ ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা পদ্ধতিতে নিন্দা করে তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকে খাটো করার চেষ্টা হয়েছে৷ তাতে কি? কবি-সন্ন্যাসী পরমানন্দজির অন্য এক বাণীও তাই মনে পড়ছে, ‘নিন্দুকের সকল কথা একদিন শূন্যে হারিয়ে যাবে৷ একদিন তারা নিজেই মুছে যাবে তাদের আপন মনের কুটিল অন্ধকারে৷’ ইতিহাস তাই করেছে— ‘স্তব্ধ করে দিয়েছেন ভাঙা কাঁসির আওয়াজ৷ সলিলদা ঐ প্রচেষ্টার মুখে জল ঢেলে রবীন্দ্রনাথের গানের বাস্তব রূপ দিয়েছেন,
”দেখেছিলাম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি
গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি’
অপমানের পথের মাঝে তোমার বীণা নিত্য বাজে
আপন সুরে আপনি নিমগন৷”
কোনও দলগত, গোষ্ঠীগত প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টার মতলববাজি সলিলদার বীণার ধ্বনি স্তব্ধ করতে পারেনি৷ তিনি আপন সুরে আপনি ‘নিমগন’৷ কবি সন্ন্যাসীর বাণী তাঁর জীবনে যথার্থ রূপ পেয়েছে৷
”শত দুঃখেও যে সত্যের করে যায় স্তব
সত্য তাকে দেয় চির জয়ের গৌরব৷”
সলিল চৌধুরি escapist, Carrerist ব্যক্তিগত সুখবিলাসে গা ভাসিয়ে লড়াই থেকে পালিয়েছে৷ ময়দান থেকে স্থান নিয়েছে মস্ত মহলে৷ এইসব উক্তির লিখিত স্বাক্ষর নেই— কিন্তু রিপু কাজের মতো করে সূক্ষ্ম সুতোয় কাজ করে মনে মনে একে গ্রথিত করা হয়েছে৷ যার পরিণামে আজও গণসংগীতের মঞ্চ থেকে সলিল চৌধুরির গানকে অভিপ্রেত অনুষ্ঠানে সংযোজিত করা হয় না৷ এ আমার একাধিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি৷ আর এ কাজ বাণিজ্যিক জগতের মানুষেরা করেন না— করেন তাঁর প্রাণের প্রতিষ্ঠান গণনাট্য সঙ্ঘের চিন্তাবিদ তাত্ত্বিক নেতারা৷ পিতৃ বিয়োগের পারিবারিক বিপর্যয়ের পাশে দাঁড়াবার প্রয়োজনে তাঁকে জীবিকা নির্ভর হতেই হয়েছে৷ কিন্তু তিনি জীবন বা আদর্শকে বিপন্ন করেছেন জীবিকার অন্বেষণে— এই অভিযোগকারীদের উত্তর দেওয়া আমার নীতিগত দায় কারণ তিনি আমার সৃষ্টিশীল জীবনের নক্ষত্র দিশারি৷ এইসব তাত্ত্বিক প্রবক্তা আমাদেরও ছেড়ে কথা বলেন না৷ আমরা সুরস্রষ্ট্রা সলিল চৌধুরির যশ করলে আমাদের ধান্দাবাজ ভাবেন৷ সলিলদার এক ঘনিষ্ঠ মানুষ লিখছেন, ‘সলিল চৌধুরির প্রয়াণের পর তাঁর সংগীত সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু কিছু বক্তব্য রাখা হয়েছে৷ সে সব কিছুর মধ্যে সাধারণভাবে সৃষ্টির গুণাগণ বর্ণিত হয়েছে৷ কোন কোন ক্ষেত্রে কার কতখানি সাহায্য তাঁর এই এগিয়ে যাওয়াকে সফল করতে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে এমন সব কথাও জানা গেছে৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই সব সাহায্যের বর্ণনার আতিশয্য তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে অযথা নিষ্প্রভ করে ফেলেছে subjective thinking-এর দৌলতে৷’ আমি এর একটা জবাব দিতে ইচ্ছে করি৷ কেবল প্রবীর, অনল, অভিজিৎ নয় আমাদের সময়ের এক ঝাঁক সহযোদ্ধার সঙ্গে নিয়েই তিনি তার রুচিশীল নতুন ভাবনার, নতুন সংগীতের সৃষ্টি অভিযান চালিয়েছেন৷ কিন্তু আমার প্রশ্ন যিনি আমাদের সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন তিনি কী জানেন বা বলতে পারেন দাঙ্গাবিরোধী ও মোদের দেশবাসীরে গানটার সৃষ্টি কৌশলের মধ্যে Progressional art form-টা বিশ্লেষণ করতে? ময়দানে না খেলে দূর থেকে ঢিল ছুঁড়লে হবে না৷ এই গান, ঢেউ উঠছে প্রভৃতি গানের বিভিন্ন পটভূমিকার ও সৃষ্টিশীলতার ব্যাখ্যা আমি করে থাকি, Demonstration সহ৷ কিন্তু তা কেবল ইতিহাসের ‘ডাটা’ দেওয়া মানুষ কি তা পারবেন? আমি ব্যক্তিগতভাবে সলিল চৌধুরির নির্মাণ কৌশল নিয়ে নিত্য বিশ্লেষণ করে থাকি, যা নির্মাতাদের পক্ষেই সম্ভব৷ যেমন ”সেই বাঁশিওয়ালা” গ্রন্থে করেছে কল্যাণ সেন বরাট৷ সলিল চৌধুরিকে নিয়ে যাঁরাই কাজ করছে— দেবজ্যোতি মিশ্র, আমার পুত্র অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, যন্ত্র শিল্পীদের মধ্যে তাপস ভৌমিক, বাপি উকিল, আগের মধ্যে Y.S. Moolkey, হিন্দি জগতের সংগীত পরিচালক ইল্লাই রাজা, এরকম অজস্র মানুষ— তারা সবাই গণসংগীত রচয়িতার পটভূমি সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকেন৷ সেই বাঁশিওয়ালা গ্রন্থেই সলিল চৌধুরির সৃষ্টিশীল জীবনবোধের সম্পর্কে pin point বক্তব্য আমি রেখেছি৷ তাঁর সৃষ্টি নিয়ে বিচার গবেষণা হচ্ছে৷ ভি বালসারার মতো মানুষ তাঁকে ‘Prophet of Music’ বলছেন৷ নৌশাদ সাহেবের মতো মানুষ বলছেন “Composer of Composers”৷ লতা মঙ্গেশকর বলেছেন, ”আমি সলিল চৌধুরির মতো সুরকার আগে দেখিনি৷” এ সব কি নিছক স্তুতি? যত বুদ্ধি, শিক্ষা, জ্ঞান, শুধু তাদেরই আছে যারা সলিল চৌধুরিকে আপন বৃত্তের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চেয়েছেন, পারেননি? আসলে সৃষ্টিশীলতার বোধ যে সলিল চৌধুরির computer brain-এর মতো৷ প্রয়াণের কিছুদিন পূর্বে আমায় একদিন বললেন ‘দ্যাখ, পৃথিবীর সমস্ত music with all variations সৃষ্টি হয়েছে keeping the octave constant৷ কিন্তু এই constant-কে যদি variable করা যায় তবে সৃষ্টির কাউন্ট কী হবে?’ এর উত্তর আমি কী দেব? মনে মনে বললাম, ‘only computer can answer’৷ সৃষ্টিশীল মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে বিচার না করে কেবল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বিচার করলে ঠিক হবে না৷ এসব বিচারের উত্তর মনে হয় সুন্দর হবে শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসুর কথার প্রতিধ্বনি করলে— ‘ঐতিহাসিক ভুল’৷ এই শব্দটি ভারতবর্ষের তথা সারা পৃথিবীর ইতিহাসে বামপন্থীদের অনেকবার উচ্চারণ করতে হয়েছে ও অনেকবার অনুচ্চারিত থাকলেও ভাষাটা তাই হবে৷ সৃষ্টিশীল মানুষ কী তারই মাশুল গুনবে? তাহলে এই মুহূর্তে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আমি জানতে চাইব, সারা পৃথিবীর বামপন্থী অবস্থানের প্রেক্ষিতে আমার আজকের সৃষ্টিশীল কাজের বর্তমান বিষয়বস্তু কী হবে? তখনও হয়ত সলিল চৌধুরিই বাঁচাবেন৷ বলবেন ‘ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না৷’ বলতে হবে ‘পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা৷’
আচ্ছা পাঠকবর্গ বলুন তো গণনাট্য সঙ্ঘের উৎপল দত্ত, তাপস সেন, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু ভট্টাচার্য, খালেদ চৌধুরি, জ্ঞানেশ মুখার্জি এঁরা তাহলে সবাই কি carrerist, excapist? কিন্তু তাদের এই সংজ্ঞার তালিকায় আনার ঘাড়ে মাথা কারও নেই৷ ‘মধুমতী’ ছবির সুরকার সলিল চৌধুরি carrerist আর সেই ছবির গল্প ও চিত্রনাট্যকার ঋত্বিক ঘটক আগমার্কা— এ চিন্তা কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ৷ ঋত্বিক ঘটক সিনেমাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, সিনেমাকে একটা নতুন যুগের মুখ দেখিয়েছেন, অভিযানের মোটরগাড়ি—ওয়াহিদা রহমানের অস্তিত্ব ছাপিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি কিন্তু অযান্ত্রিকের ভাঙাগাড়ি হাসিকান্নায় জড়িয়ে জীবন্ত নায়ক হয়ে উঠেছে৷ এ এক নতুন সিনেমা৷ তেমনি জনসাধারণ, সংগীতের একটা সময়কে নামকরণ করল স্বর্ণযুগ বলে যার উদ্বোধনী সংগীতটির নাম ‘গাঁয়ের বধূ’৷ এই গাঁয়ের বধূ শুনে অনুপম ঘটক, শৈলেশ দত্তরা দু পিঠের গান রেকর্ড করলেন৷ মেহনতি মানুষের কথা সোজাসুজি লিপিবদ্ধ হতে থাকল সংগীতে, রানার, রিকশাওয়ালাতে৷ এলো বিপ্লবের কথা সোজাসুজি, বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে৷ নতুন আঙ্গিক নতুন ভাষা৷ নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হল৷ উজ্জ্বল দিন, চার দেওয়াল মধ্যে, হাজার মনের ভিড়ে, নগরজীবন, উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা— ও আরও কত ঝাঁক ঝাঁক গানে— তৈরি হল urban music-এর উর্বরভূমি৷ কিন্তু ওই গাঁয়ের বধূর জন্যে কত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হল সলিল চৌধুরিকে সেই ইতিহাসও মানুষ জানুক৷
‘গাঁয়ের বধূ’ সংগীতটির অন্তিম অংশ— আজও যদি তুমি কোনও গাঁয়ে দ্যাখো ভাঙা কুটিরের সারি জেনো সেইখানে সে গাঁয়ের বধূর আশা স্বপনের সমাধি৷ সমকালীন সত্য-চিত্র আঁকার অপরাধে তাত্ত্বিক নেতাদের বিরাগ ভাজন হলেন সলিল চৌধুরি৷ যাঁরা তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তাদের হয়ত অনেকে সংগীত নির্মাণকারীও নয়৷ জমির মালনিকরা কৃষক জীবনে যে করুণ চিত্র এঁকে দিতেন তারই ছবি আঁকলেন সলিল চৌধুরি৷ সব গানে সব কিছু কেবল তত্ত্বের জোরে সংযোজন করা যায় না৷ যেমন ধন্য আমি জন্মেছি, গৌরীশৃঙ্গ, শান্তির গান, আলোর পথযাত্রী এ সব গানে একটা সম্মিলিত সংগীত সূত্রটানা গেছে৷ সেটা যে, সব গানে টানা যাবে, তা হয় না৷ পরিমিতি বোধটা আর্ট-এর একটা জরুরি বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আর্ট-এ থামবার জায়গাটা অত্যন্ত জরুরি— art is never an exibition but a revelation. বাস্তবিকই রবীন্দ্রনাথের ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ গানটির শেষে হঠাৎ ‘এখন আর দেরি নয়’ গানটা জুড়ে দিলে সৃষ্টি সৌন্দর্য যেমন ব্যাহত হত, তেমনি গাঁয়ের বধূতে সে রকম কিছু করলেও তাই হত৷ যেমন হিন্দি ছবিতে সুন্দর চেহারার নায়ক এক ঝাঁক কুৎসিত গুন্ডাদের খতম করে আসে তাদের ডেরায় গিয়ে তেমনই হত৷ সলিলদা যে ঠিক ঠিক জায়গায় থেমে ছিলেন, গাঁয়ের বধূর যুগসৃষ্টিকারী সাফল্যই তার প্রমাণ৷ তিনি পেলেন বিপরীত ব্যবহার৷ ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’— গানটিতে ‘হায় বিধি বড়ই দারুণ’ এবং ‘আর নাইরে ধান খামারে মোর কপালগুণে’— এই বিধি ও কপাল গুণে শব্দ দুটির ব্যাখ্যা হল সলিল চৌধুরি, চাষীদের সংগ্রাম বিমুখ নিয়তিবাদী করেছেন৷ যাঁরা এ সব বলছেন তাঁদের কিন্তু আল্লা মেঘ দে বা নৌকো বাওয়ার গানে বদর বদর বা গাজি পীর ব্যবহারে প্রতিবাদ নেই৷ আপত্তি নেই তাদের মুখবন্ধ সংগীত এসো মুক্ত করো গানে বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করতে— আপত্তি নেই গাইতে, উঠেছে যে জীবনের লক্ষ্মী৷ যে চাষী রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত হয়ে ধানচোরদের চিনে ফেলেছে সে-ও খরাতে, বন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানায়৷ যাঁরা ভারত আত্মার আধ্যাত্ম প্রাণদীক্ষাকে উপেক্ষা করে ভারতীয় সংস্কৃতির রূপ দেওয়ার কথা ভাবছেন তাঁরা খেয়াল করুন, ভাবুন আপনারা মীরাবাঈ, তুলসীদাস, ব্রহ্মানন্দ, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ইত্যাদি, ইত্যাদি ইত্যাদিদেরও বাতিল করতে পারবেন তো? একটা বহুতল গৃহ নির্মাণ করতে soil test করতে হয়, একটা জমি কত ফসলি বুঝতে soil test করতে হয় আর ভারতবর্ষের মতো বিরাট দেশে বাইরে থেকে বয়ে আনা জীবন দর্শনের ভিত্তিতে সংস্কৃতির ফসল ফলাতে soil test করতে হবে না? গণনাট্য সঙ্ঘের মুখবন্ধ সংগীতের রচয়িতা— শ্রদ্ধেয় শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র— গানে বিশ্বকর্মা লক্ষ্মীকে বিগ্রহ স্বরূপ ব্যবহার করলেন এবং এটা যে তাঁর সংস্কারগত সেটা বোঝা যায় তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের গান record করলেন৷ তার এক পিঠ এ ভারতে রাখো নিত্য প্রভু তব শুভ আশীর্বাদ৷ এটা নিয়তিবাদী নয়? তবু গণনাট্য সঙ্ঘের গণসংগীতের তালিকায় তাঁর নাম লিপিবদ্ধ করেছেন সাংগঠনিকরা— কিন্তু সেখানে সলিল চৌধুরি বাদ৷ বড় দুঃখ হয়— আমার এক অতিপ্রিয় মানুষ শ্রীমতী রত্না ভট্টাচার্য, বর্তমান গণনাট্য সঙ্ঘের সভাপতি শ্রদ্ধেয় হীরেন ভট্টাচার্যের সহধর্মিণী, যিনি অতি উচ্চশিক্ষিতা এবং সংগীতের তাত্ত্বিক প্রবক্তা তিনি একটি প্রবন্ধে গণসংগীত সমৃদ্ধিশালী করার সার্থক নির্মাতাদের নামের তালিকা দিয়েছেন তাতেও সলিল চৌধুরির স্থান হয়নি৷ আর প্রয়াত গণসংগীত সেনাপতি শ্রীদিলীপ সেনগুপ্ত যিনি এক প্রবন্ধে স্বীকার করছেন ঢেউ উঠছের ঢেউয়ের সঙ্গে তার সংগীত জীবনের দিকদর্শন স্থির হয়ে গেছিল এবং আজীবন সেই মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হলেন, থাকলেন, থাকবেন, তাঁরও তালিকায় সেই মন্ত্রগুরুর নাম নেই৷ এই উভয়েরই সার্থক গণসংগীত রচয়িতাদের তালিকায় যাঁদের নাম, তাঁরা হচ্ছেন জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হারীন চট্টোপাধ্যায়, অমর শেখ, প্রেম ধাওয়ান, সাধন দাশগুপ্ত, হৃদয় কুশারী ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এখন পাঠকবর্গ নিজেরাই বিচার করুন এঁদের কার নামের সঙ্গে আপনারা সলিল চৌধুরির নামের চেয়ে বেশি পরিচিত৷ আপনারাই বলুন গণসংগীত শিরোনামটি আপনাদের সামনে বেশি প্রতিষ্ঠা করেছে কার রচিত গণসংগীত৷ আমিও কিছু ফালতু, ফ্যালনা লোক নয়— সামান্য প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছি বাংলা গান নির্মাতা হিসেবে৷ আমি কি প্রশ্ন করতে পারি সোনারপুরের বানভাসিদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে, ছেচল্লিশের ডাক তার শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ঐক্যসেতু বাঁধার আহ্বানে, শহিদের বেদনায় বেদনার্ত হয়ে, বিশ্বযুব আন্দোলনের সমর্থনে, শান্তি যুদ্ধর স্বপক্ষে, তেভাগার ভাগচাষীদের সংগ্রামের সমমর্মিতায়, আজও বেঁচে থাকা গান ওইসব নির্মাতাদের মধ্যে কজন লিখেছেন৷ প্রতি রাজনৈতিক লড়াইয়ে সংগীত সঙ্গীন হাতে বীরযোদ্ধা সলিল চৌধুরি হাজির৷ অন্যদেরও কিছু বিখ্যাত গান আছে কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসের পূর্ণচিত্র তাতে ধরা যায় না যা সলিল চৌধুরির গানে আছে৷ গণনাট্য সঙ্ঘ একটি প্রগতিশীল সংস্থা— এবং তারা কেবল স্বদেশি নয়, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে মানবতার পক্ষে কাজ করতে দায়বদ্ধ৷ তাঁরা সময়কে উপেক্ষা করে চলতে পারেন না৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় গণনাট্যের মুখবন্ধ সংগীত আজ আর এসো মুক্ত করো গানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আমেজ ধরে রাখবার দিন নয়— আজকের আহ্বান অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে দুটি গানে— (১) ও আলোর পথ যাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না৷ (২) পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা৷ কিন্তু জানি গণনাট্য সঙ্ঘ এখন স্থাবর সম্পত্তি আগলে বসে থাকতেই বেশি চাইবেন৷ অস্থাবরের উন্নতি করা তাদের আন্তরিক কোনও ইচ্ছা নেই৷ চলবে গানের স্কুল, চলবে পিট সিগারকে নিয়ে মাতমাতি, চলবে না নতুন প্রতিভার অন্বেষণ, অবশ্য কেই বা খুঁজে বের করবে? সলিল চৌধুরি তো নেই— অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে অভিপ্রেত বিচার করে ধরে আনবে প্রবীর, অনল, অভিজিৎ, সুধীন দাশগুপ্ত, কল্যাণ সেন বরাট, ভাস্কর বসু শুভ দাশগুপ্তদের— উদ্বুদ্ধ করবে, বাধ্য করবে বাণিজ্যিক জগতের দিকপালদের, গণসংগীত রচয়িতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে৷ প্রতিভা সন্ধান করতে হলেও তো প্রতিভা চাই৷ বিনয় রায়ের মতো প্রণম্য সাম্যবাদী সংগীতকার গায়ককে নিজের গান গাওয়ানোর প্রেরণা দীপ্ত করবে কোন গণসংগীত রচয়িতা৷ যা সলিল চৌধুরি করেছিলেন৷ আমি নিজেকে একজন গণনাট্য সঙ্ঘের সভ্য বলে মনে করি, আমি জানতে চাই সলিল চৌধুরি ছাড়া কোন গণসংগীত রচয়িতা সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে এত দক্ষ মানুষ তুলে এনেছেন৷ বাণিজ্যিক জগতের শিল্পীদের কণ্ঠে কজন গণসংগীত রচয়িতা, গণসংগীত তুলে দিয়েছেন৷ যুগপৎ বামপন্থী আন্দোলন ও বাণিজ্যিক সংগীতজগৎকে কে সেবা করেছেন সলিল চৌধুরি ছাড়া? কেবল তাই নয় চাষীকে ভূমিহীন করার চক্রান্তের ভারতবর্ষের যে ইতিহাস, বম্বের মতো আধা-মার্কিনী মিডিয়াতেও দো বিঘা জমিনের মতো গল্প লিখে সেই জগতে আলোর পথ যাত্রী মশাল হাতে প্রবেশ করেছেন৷ পরখ, মিনু ও আরও অনেক মাদ্রাজের ছবি (রণবীর নিয়োগীর কাছে পূর্ণ তালিকা আছে) এ সব গল্প কি তাঁর আদর্শ ভ্রষ্টের নমুনা৷ ছানিপড়া চোখ নিয়ে ইতিহাস পড়লে ইতিহাস বিকৃত হয়— তখন তা সত্য হয় না— হয় সত্যের অপলাপ৷ গণসংগীত সম্মেলনে সলিল চৌধুরি মঞ্চ করা হল সে কি সলিল চৌধুরির অবদানের স্বীকৃতি দানের পরিপ্রেক্ষিতে? সেই বাঁশিওয়ালা, ‘বলে একটা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশিত হল সে-ও কি এতদিন পর সলিল চৌধুরির যোগ্য মূল্যায়ন হওয়ার কারণে? না…এর কারণ সলিল চৌধুরি ছাড়া আর কোনও গণসংগীত রচয়িতা নেই যার নামে মঞ্চ উৎসর্গিত হলে, দলকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করা যেত৷ আর গ্রন্থটি প্রকাশের কারণ আর কোনও নির্মাতার এত ব্যাপ্ত কর্মকাণ্ড নেই, যা দিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই হতে পারে৷ ওইদিন অনুষ্ঠানে যে শিল্পীরা এসেছিলেন সব বাণিজ্যিক জগতের এবং সলিল চৌধুরির প্রেরণাদীপ্ত হয়ে৷ এবং ওই সব শিল্পী ছাড়া সাধারণ মানুষকে কাছে টানার আর কে এমন আছে যারা গণসংগীত শিল্পী৷ পশ্চিমবাংলার মানুষ তো তাত্ত্বিক নেতাদের মতো শিক্ষিত নন, তাই তাঁরা বাংলা গানের মধ্যে সলিল চৌধুরির অবদানকে যতটা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন তা প্রণম্য পিট সিগারকেও হয়ত পারেন না৷ এই মঞ্চ ও গ্রন্থ সম্পর্কে আমি উপরোক্ত মন্তব্য করলাম কেন, কী ভিত্তিতে, তার উত্তর দিচ্ছি৷ সাম্প্রতিক গণনাট্যের একটা কাজে আমাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে নিয়ে যাওয়া হল— সেখানেও সেই একই পুনরাবৃত্তি৷ কোলকাতা শাখার অনুষ্ঠানে গানের সূচিতে সলিল চৌধুরির স্থান হয়নি পিট সিগারের হয়েছে৷ সলিল চৌধুরিকে বাদ দিয়ে বাংলায় তথা ভারতের গণসংগীত কী চেহারা নেয়— ইতিহাস তার স্বাক্ষর বারবার রাখছে তবু অন্ধ বিরোধিতায় ধৃতরাষ্ট্র মনের চেতনা ফিরছে না৷ এইসব কাহিনীর সূত্রপাত অনেকদিনের, প্রায় chronic disease-এর মতো৷ সলিদার কর্মকাণ্ড বিচিত্রপথে ব্যাপ্ত৷ একবার ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রিটে গণনাট্য সঙ্ঘের কার্যালয়ে নতুন প্রতিভা অন্বেষণকে সামনে রেখে সলিলদা ব্যবস্থা করেছিলেন নতুন গানের আসর৷ সেই আসরে একদিন আমি সাতমাত্রার তালে মামুলি একটা গান শোনাই— যে গানটা আজ আমার মনেও নেই— সেই আসরে সলিলদা শোনালেন ‘পাল্কী চলে’ অথচ সেদিন আমার গানটা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হল৷ আমার খটকা সেদিন থেকেই৷ এই খটকা বারবার সলিল বিরোধীদের কার্যকলাপে আমার ঝটকা লেগেছে৷ যে গানটি অর্থাৎ পাল্কী চলে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হল না সেটা যে কত ঐতিহ্যনিষ্ট গণসংগীত তার একটা নির্মাণ চিন্তার ব্যাখ্যা আমি দিচ্ছি এবং পাঠকবর্গ বিচার করবেন আমার বিচার ঠিক না সংগীত সৃষ্টির চেয়ে দলগত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ৷ সত্যেন দত্ত অপূর্ব একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন পাল্কী চলেছে— অতুলনীয়, অতুলনীয় তার ছন্দ ও ছবি আঁকা, তাঁর প্রতিযোগ্য সম্মান দিয়েই বলব মোরগ, ন্যাংটা, খোকা, ময়রামুদি, গরু সবাই তাঁর চোখে নন্দন দৃশ্যকে উপস্থিত করে দিয়েছে তবু যেটা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে সেটা বাহকদের মেহনত৷ পাল্কি বেহারার ‘হুম না’ সলিলদা মৌলিক কবিতাটির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ সুকান্ত ভট্টাচার্য রানারকে ছোটানোর সময় ভেবেছেন, পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া— সত্যেন দত্তর বাহকদের দৃশ্যকল্পের সাথী না করা৷ কবিতার মাধুরী অক্ষুণ্ণ রেখে সলিলদা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো মেহনতের বেদনাকে চিহ্নিত করেছেন বাহকদের মেহনতকে চিহ্নিত করে পাল্কি চলে গানে৷ সোভিয়েট প্রতিনিধিরা ওই গান বাহকদের মেহনতের আওয়াজ শুনে অনুভব করলেন জমিদার দৃশ্য সৌন্দর্য উপলব্ধি করছেন বাহকদের শ্রমের বিনিময়ে৷ তবু সেই গানকে পিছিয়ে দেবার চেষ্টা৷ পরেশ ধর ছিলেন আমাদের প্রিয় এক প্রণম্য ব্যক্তি তাঁকেও নিয়ে সলিলদার সমান্তরাল নির্মাতা হিসাবে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু সত্যের সাধনা সত্যকে স্বীকার করে নিয়েই করতে হয়, না করলে যা হয় তাই হয়েছে৷ পর পর প্রতি বছর সলিল-হেমন্ত Combination রেকর্ডে Top Seller৷ ক্ষিতিশবাবু এইচ এম ভি-র প্রতিনিধি, আবার গণনাট্য সঙ্ঘের সহ-সভাপতি৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে পুজোর জুটি ভাঙলেন৷ পরেশদা করলেন হেমন্তদার গান (শান্ত নদীটি) আর সলিলদার সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা ও গণনাট্য প্রত্যাখ্যাত আয় বৃষ্টি ঝেঁপে৷ সেই বছর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় Top Seller৷ হেমন্তদা শুধু একবার ক্ষিতীশদাকে বললেন, ‘কই কি হলো ক্ষিতিশবাবু, পক্ষীরাজ ঘোড়া তো এবার পিছিয়ে পড়ল৷ তাই বলছি Diseaseটা Chronic৷ কিন্তু বাণিজ্যিক জগতের শিল্পী সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ব্যক্তিরা হীরে চিনতে ভুল করেননি৷ আর যাঁরা মহান প্রতিভাকে বুঝতে না পেরে নিজেদের বৃত্তের মধ্যে তাকে বন্দী করবার অপপ্রয়াস করেছিলেন তাদের পরিণতি তাঁরাই মুল্যায়ন করুন৷
হেমন্তদা নিজে লিখে গেছেন গাঁয়ের বধূ কোম্পানির কাছে তিনি নিজে পেশ করেছেন৷ প্রয়াত দিলীপ সেনগুপ্ত লিখলেন ক্ষিতীশবাবুর সহযোগিতা ও আর্থিক আনুকূল্যে গাঁয়ের বধূ জায়গা পেয়েছে৷ কী মিথ্যাচার৷
ব্যক্তিস্বার্থে সলিল চৌধুরি বাণিজ্যিক জগতে প্রবেশ করে বামপন্থী আন্দোলন থেকে মনস্কতা সরিয়েছিলেন এই উক্তি আপাদমস্তক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ নৌশাদ সাহেবের পুরো উক্তিটি এরকম “Salilbabu was a member of the Communist Party and he stuck to its principles. নৌশাদ সাহেব কী করে বুঝলেন? রাতে ভগবানের দেওয়া স্বপ্ন থেকে না নিজের বিদ্যা, শিক্ষা, রুচি, সংগীতবোধ দিয়ে? তাঁর মতো মাপের এক সংগীতকার হয়ে লিখলেন, He was composer of the composers. সলিলদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে লিখলেন One of the seven notes of music has been lost. পাঠকবর্গ ভাবতে পারেন এই মূল্যায়ন? সংগীতের সাত পর্দার এক পর্দার নাম সলিল চৌধুরি? বিশ্বের কোন তকমা আছে, পুরস্কার আছে, যা এর থেকে দামি! দেখুন বামপন্থী আন্দোলনের থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক সচেতন সংগীত রচয়িতাকে কীভাবে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আর বাণিজ্যিক জগতের দিকপালরা কীভাবে সেই পথে ফেলে দেওয়া ফুলকে বুকে তুলে নিয়েছেন৷
এ প্রসঙ্গে ‘গুনগুন’ পত্রিকায় প্রকাশিত সলিল চৌধুরির শ্রদ্ধার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সর্ব প্রণম্য শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিচ্ছি৷ সলিলদার স্নেহধন্য অধ্যাপক প্রণব দাশগুপ্তের অনুলেখন৷
পুরনো আখরগুলি
সুচিত্রা মিত্র
দিনক্ষণ মনে নেই, তবে সম্ভবত ১৯৪৩ সালে৷ সলিল খুব ভাল রবীন্দ্রসংগীতও গাইত৷ বাঁশি বাজাত খুব৷ লীলা দেশাই, সাধনা বসুর নাচের সঙ্গে, উদয়শঙ্করের ব্যালের সঙ্গে তিমিরবরণের অর্কেস্টায়ও ডাক পেয়েছিল৷ তখনকার IPTA-তে গান, আবৃত্তি, নাটক করার সময় শিল্পীদের শিরায় শিরায় একটা কিছু দরদরিয়ে উঠত, ওটার নাম বোধহয় commitment, peoples artist হবার স্বপ্ন— নির্যাতিত মানুষের সুখদুঃখের অংশীদার হব, সহযোদ্ধা হব এটাই মনে জেগে থাকত৷ নিজেদের সার্থক মনে করতাম৷ careerism, বাণিজ্যিক সাফল্য, পেশাদারি অর্থনীতি এ সব মাথায় থাকত না৷
সলিলের মতো প্রাণবন্ত শিল্পী খুব কমই দেখেছি৷ ওর প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতাম৷ ওর লেখা তেভাগা আন্দোলনের ওপর কবিতা ‘শপথ’ সারা দেশে মুখে মুখে ফিরত৷ IPTA-তে ‘অহল্যা’ ব্যালে হয়েছিল তার ওপর৷ শুনেছিলাম, সে শুধু সংগ্রামী শিল্পীই নয়, পার্টির সক্রিয় সংগঠকও৷ ওর ওপর একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল৷ তাই ওকে প্রায়ই আত্মগোপন করে থাকতে হত৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড হয়েছিল গীতিকার সুরকার সলিলের অনুপস্থিতিতেই৷ শুনলেই বোঝা যাবে— সলিলের অর্কেস্ট্রেশন নেই তাতে৷ সলিলের গলায় হারমোনিয়াম বাঁধা, আর দু’পাশে আমি, হেমন্ত, দেবব্রত মিছিলে গান গাইছি৷ এ দৃশ্য কলকাতার অনেকেই দেখেছেন— দিন ভুলে গেছি৷ অসংখ্য অনুষ্ঠানে একসঙ্গে গেয়েছি৷ রিহার্সালে এলে হারমোনিয়ামটা পেলেই হল৷ পাঁচটা আঙুল পাঁচ প্রাণীর মতো ছোটাছুটি করত৷ তিন সপ্তক জুড়ে সেই দাপাদাপি থেকে নিত্যনূতন সুরের কাঠামো বেরিয়ে আসত৷ কখনও দুটো আঙুল Counterpoint-এ আটকে থাকত, harmony-র Part তৈরি হত৷ ছোট-বড় নামী-অনামী সবাইকে ওর দরকার ছিল৷ গাওয়ার সময় প্রত্যেকটা রিড, প্রত্যেকটা স্বর যেন প্রাণ পেয়ে জেগে উঠত৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো দলটা Solo-chorus মিলে charged হয়ে যেত৷ কী সব Expressive সুর! কখনও কান্নায় ভেঙে পড়েছে, কখনও রুখে দাঁড়াচ্ছে, ব্যঙ্গ বিদ্রুপের চাবুক মারছে, কখনও সমুদ্রের মতো গজরাচ্ছে, কখনও বাজ হয়ে ভেঙে পড়ছে সর্বনাশের অভিসম্পাতের মতো, কখনও ইশারা পেয়ে ছুটে যাচ্ছে রাইফেল হাতে লড়াকু সৈনিকের মতো, কখনও বা নীল আকাশে শান্তির পাখির ডানায় ভাসছে৷ আমি রবীন্দ্রসংগীত গাই, তাই Visual imagery এত স্পষ্ট করে visualize করতে পারতাম৷ গানের বাণী যেন নির্ভুল নিশানায় অস্ত্রের মতো ছুটে যেত— এখানেই সলিলের গানের প্রাণশক্তি৷ সলিলের গানের রিহার্সাল— শিল্পীদের সংগীতের নিপুণ কুচকাওয়াজ— একটা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব৷ ‘ও আলোর পথযাত্রী’তে melody-র সঙ্গে তিন-চারটে harmony-র পার্ট গাওয়ার সময় দেখেছি— কী স্বতঃস্ফূর্ত অথচ সংযত৷ চোখে মুখে সারা শরীরে কী একটা প্রচণ্ড তেজ টগবগ করে ফুটছে— এ একেবারে নতুন aesthetic exprience.
কালো মেয়েরা দুঃখ না পেয়ে বরং গর্ব করে বলতে পারেন ‘আমাকে নিয়ে বিশ্বকবি ‘কৃষ্ণকলি’ লিখেছেন৷ পল্লী বাংলার সেই শ্যামশ্রীকে রবীন্দ্রনাথ অমর করে রেখেছেন কৃষ্ণকলিতে৷ আর তখন দুর্ভিক্ষের কবি সলিল দেখেছে কীভাবে ময়নাপাড়ার মেয়েরা তিলে তিলে মরছে৷ শহরের রাজপথে কঙ্কালের সারি পড়ে থাকত৷ রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন কৃষ্ণকলি যুগল ভুরু তুলে ঘনকালো মেঘের ঘটা দেখছে৷ সলিল দেখছে জঠোরের আগুনের সঙ্গে আকাশের নির্মম সূর্য দারুণ তেজে ঝলসে মারছে ময়নাপাড়ার মেয়েকে৷ আমাদের কাব্যসংগীতে সলিল নিয়ে এসেছিল Socialist realism৷ আমাকেই গানটা গাওয়ার জন্য নির্বাচন করেছে শুনে ভীষণ খুশি হলাম৷ এর আগে হেমন্তকে দিয়ে গাঁয়ের বধূ-র মতো epoch-making song গাইয়ে সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল৷ ‘সেই মেয়ে’ গাওয়ার পর চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল৷ রবীন্দ্রভক্তরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ৷ আমাকে আক্রমণ করলেন, অপমান করলেন, আমাকে দেখিয়ে আমার ডিস্কটা ভাঙলেন৷ আমি কেন এক দাগি কমিউনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির parody গাইলাম৷ আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি— ‘সেই মেয়ে’ কৃষ্ণকলির parody নয়৷ সলিলের প্রতিভাকে আমি ঠিকই চিনেছিলাম৷ ওঁরাই চেনেননি৷ রবীন্দ্রনাথ যে কবির জন্য কান পেতে ছিলেন৷ কিষাণের জীবনের শরিক সলিলের মতো কত জন ছিলেন জানি না৷ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সংগীত প্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন এতে আমার সন্দেহ নেই৷ অনেকে জানেন না, সলিলের রবীন্দ্রভক্তি কত গভীর ছিল৷ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সলিল অশৌচ পালন করেছিল স্বেচ্ছায়৷ তখনও ওর মা-বাবা জীবিত৷ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে এ যুগের শ্রেষ্ঠ সংগীতকার নিজেকে পিতৃহীন ভেবেছিলেন৷ ভাবা যায়!
যখন সঙ্কীর্ণমনা সমালোচকরা ভাবতেন কমিউনিস্টরা যথেষ্ট মাতৃভক্ত নয়, দেশকে বলে fatherland, বন্দেমাতরম মুখে আনতেন না, তখন সলিল লিখেছিল— ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে’৷ নিগ্রো মুক্তি আন্দোলনের নেতা John Brown ও তাঁর ছেলেদের প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসি দিয়েছিল আমেরিকার ক্রীতদাস ব্যবসায়ী সরকার৷ নিগ্রোরা মনে করে John Brown ছিলেন কালো মানুষের যিশু খ্রিস্ট৷ Halleluiah বলে ধ্বনি দেয়, বিশ্বাস করে John Brown-এর আত্মা ওদের সঙ্গে রক্ষাকর্তার মতোই থাকে৷ John Brown glory-র সুরে সলিল গানটি লিখল ভারতের পটভূমিকায়৷ কাঁদবার জন্য নয়, জাগবার জন্য৷ ‘হিমালয় আর নিদ্রা নয়, কোটি প্রাণ চেতনায় বরাভয়, জাগো ক্রান্তির হয়েছে সময়, আনো মুক্তির খর বন্যা’৷ সে ক্ষেত্রে গানটি ব্যতিক্রমী, একটা নতুন message-এ গানটি গেয়েও আমি তৃপ্তি পেয়েছি৷ দেশের সব সম্পদে খেত-খামার-কলেখাটা মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার গান এটা৷
একটি বিরল ঘটনা৷ একবার টপ্পা আঙ্গিকের একটি গান আমাকে দিয়ে গেল ‘সে গান আমি যাই যে ভুলে’৷ প্রত্যেকটি দানায়, জমজমায় দরদ ঝরে পড়ছে৷ সুর রাবীন্দ্রিক টপ্পার মতো হলেও কথা আধুনিক৷ গানটা যতবার পড়ি, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আবেগে গলা choked হয়ে আসে৷ এমন অনবদ্য গান, প্রাণপণ চেষ্টা করছি কত সুন্দর করে গাইতে পারি, কিন্তু কিছুতেই গলা খুলে গাইতে পারছি না৷ সলিল যখন জানতে এল গানটি কেমন লেগেছে, কেমন তোলা হল, আমি surrender করলাম৷ সলিল, তুমি কী গান দিয়ে গেছ, যতবার গাইতে গেছি কেঁদে ফেলেছি৷ গাইতে চেয়েও গাইতে পারছি না, এত আবেগ এসে যাচ্ছে৷ আমারই জন্য লেখা গান আমি রেকর্ড করতে পারলাম না৷ পরে একদিন রাত্রে ছবিতে কথা কিছুটা পাল্টে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে প্লে-ব্যাক করানো হয়েছে৷ অসাধারণ সেই গানটা আজকাল আর শুনি না৷ টপ্পা আঙ্গিকে সলিলের সুরের এক অসাধারণ উদাহরণ হয়ে থাকবে গানটি৷ বিশেষ কেউ অনুরোধ করলে সলিল খালি গলায় গানটি গেয়ে উঠত৷
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে দু’খানা গান রেকর্ড করাল সলিল৷ ‘কিছু মনের আশা’ আর ‘প্রান্তরের গান আমার’৷ টেস্ট প্রিন্টও পেয়ে গিয়েছিল সলিল, কিন্তু অনবদ্য সেই গান দুটো বাজারে ছাড়া হল না৷ চোখের জলে অর্ধেক মুছে যাওয়া একটি চিঠিতে মোহর লিখল, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে৷ কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই৷’ শান্তিকামী মোহর অশান্তির ভয়ে গান দুটো গাইল না বলে আক্ষেপ রয়ে গেল৷ অগত্যা উৎপলা সেন রেকর্ড করলেন৷ শুনলে মনে হয় কী তরতাজা একটি গান৷ কী স্নিগ্ধ শান্ত দরদ ঝরে পড়ছে৷ প্রান্তর নিয়ে, ঊষর মাটির কান্না নিয়ে এমন একটা ever green গান আর হল না৷
এ কথা বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই— রবীন্দ্রোত্তর যুগে শ্রেষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ সংগীতকার সলিল চৌধুরি৷ এ দেশের লোকসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত আর পাশ্চাত্য সংগীতে স্ব-শিক্ষিত হয়ে, সাম্যবাদী জীবন দর্শন আত্মস্থ করে তীব্র জীবন সংগ্রামের মধ্যে যে সংগীত সে সৃষ্টি করেছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হবে একশো বছর ধরে৷ গীতরচনার আধুনিকতায় সুরের বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্যে তার সংগীত শুধু বাংলায় নয়, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সারা ভারতে একটি জ্বলন্ত মশাল৷ যুগ যুগ ধরে আমাদের সংগীতকে পথ দেখাবে৷ আবির্ভাবের স্মৃতি এখনও আমাকে নাড়া দেয়৷ একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো আসত সে৷ কথায় গল্পে হাসি ঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে ছোট বড় সবাইকে electrify করার ক্ষমতা এমন আর দেখিনি৷ কথা-ভাব-সুর কী তীব্রভাবে গেঁথে দিত৷ ওর মতো orchestration আর হবে? সুরের এমন আন্তর্জাতিক সংমিশ্রণ— দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের এমন ব্যঞ্জনাময় নান্দনিক প্রয়োগ এর আগে কেউ করেছেন? পরে কেউ করবেন?
আমি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কলম বন্ধ করার আগে বলছি—epicycle কথাটার অর্থ অভিধান যা বলছে তা কতকটা এ রকম৷ একটি কেন্দ্র থেকে ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্তাঙ্কন করে সেই বৃত্তের কোনও বিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর বৃত্ত আঁকলে তাই epicycle৷ আমি মনে করি সলিলদা, ঋত্বিকদা, তাপসদা, কালীদা, শম্ভুদারা যে সব কাজ করেছেন তাই Epicycle৷
‘গণনাট্য’ সলিলদার প্রয়াণের পর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত করে, তাতে সজল রায়চৌধুরি, সুধীন সেন, অজিত চক্রবর্তী, সুধী প্রধান প্রভৃতি অনেকেই সলিলদার রাজনৈতিক জীবনের পটূমিকায় রচিত ঐতিহাসিক সংগীতগুলোর সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন৷ সে সব রচনা যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী এবং গবেষণার মূল্যবান দলিল৷ কিন্তু এই সার্থক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পরও বিরাট দায় থাকে এত বড় মহান সুরকারের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার কাজ৷ যদিও নির্মাতারাই এই কাজ করতে পারে তবু বলব তাঁকে মূল্যায়ন করতে গেলে যত বড় প্রতিভার দরকার, তত বড় প্রতিভা বোধহয় আমাদের মধ্যে এখনও পাওয়া যাবে না৷ কারণ তাঁকে বা তাঁর সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করতে হলে কেবল সংগীত জানলে হবে না— আবার কেবল রাজনৈতিক সচেতনতা থাকলেও হবে না৷ তাই সলিল চৌধুরির সাংগীতিক মূল্যায়ন সম্ভব নিরবচ্ছিন্নভাবে নিরপেক্ষ মন নিয়ে গবেষণা করা৷ নতুন প্রজন্মের কাছে আমার নিবেদন, ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না৷ আহ্বান শোনো/বলব, পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা৷
আর্থসামাজিক অবক্ষয়ে সারা ভারত আক্রান্ত— বীর পরাক্রমে প্রবেশ করছে অপসংস্কৃতি— যার নিশান ধরা আছে বিত্তবান ওপরতলার মানুষদের হাতে৷ অসহায় অবস্থা নিচুতলার মানুষদের, তাদের সভ্যতার৷ বিপন্ন তাদের জীবন৷ তাদের সংস্কৃতি৷ মুম্বই বাংলার চিত্রজগতে এই সাংস্কৃতিক আক্রমণ তীব্রভাবে ও নগ্নভাবে দেখা দিয়েছে৷ এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সলিলদা ত্রিশ বছর আগে আভাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখবি একদিন আসবে সাধারণ শ্রোতারা বলবে, অমুকবাবু আপনি ন্যাংটো হয়ে মঞ্চে নাচুন— সেই শিল্পী তাই করবে৷’ বহুদিন আগেই সলিলদা যা ভেবেছিলেন তার উলঙ্গ প্রকাশ হয়েছে অনায়াস, সাধারণ মানুষের স্বভাবের সঙ্গে স্বাভাবিক৷ সম্ভ্রান্ত শিল্পীরা বিচারকের আসনে বসে প্রতিযোগীদের গান শুনতে শুনতে মঞ্চে এসে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করছে৷ বাবা-মা ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে বসে অসভ্য দৃশ্যানুষ্ঠান আমরা দেখছি অথচ এর মুকাবিলা করে প্রতিকারের কোনও প্রচেষ্টাই চালাই না৷ কিন্তু বোধিসত্ত্ব জীবন পথিক, সলিল চৌধুরি বুকের এই যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এলেন বাংলার মাটিতে— তাঁর ধারণা তিনি সেই বাক্য সফল করতে পারবেন, What Bengal thinks today India will think tomorrow, হায়৷ সলিলদা তো জানতেন না, যে জমি তিনি চাষ করে গিয়েছিলেন তার মাটি আর সেই গৃহবধূ রূপ নিয়ে বেঁচে নেই— সে-ও পরেছে গাউন৷ গাউন নয়— ম্যাক্সি৷ ম্যাক্সি নয়— মিডি৷ মিডি নয়— মিনি৷ কত বেশি নগ্ন শরীর প্রকাশ করা যায় তার আপ্রাণ প্রতিযোগিতা৷ তবু চেষ্টা করলেন৷ ‘অধিকার কেড়ে নিতে হয়’, ‘সেই দিন আর কত দূরে’, ‘পুরনো দিন পুরনো সব কিছু পিছু ফেলে’ প্রভৃতি গান রচনা করে আবার বাংলার আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে দিতে৷ কিন্তু দুঃখ, তাঁর সে স্বপ্ন সফল হল না৷ পশ্চিম বাংলা, যেখানে এক মুখ্যমন্ত্রীর পরিচালনায় বামপন্থী সরকার কাজ করছে ২৫ বছর, পঞ্চায়েত বন্দোবস্তে ভারতবর্ষের এই একটি জায়গায় চাষী চাষ করে যেখানে ধান ঘরে তুলছে, কুটির শিল্প যাকে শেষ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, তাকে ভারতবর্ষের শীর্ষে এনে দাঁড় করানো গেছে, তখন সাংস্কৃতিক কর্মীরা সে সম্পর্কে উদাসীন৷ তারা Technical Harmony নিয়ে পড়ে আছে, আর বিষয়বস্তু? পরিত্যক্ত হয়ে গরু চরা মাঠে বসে কাঁদছে৷ আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করে কিন্তু সলিল নির্মাণকে ঠিক ঠিক বোঝা যাবে না যতক্ষণ না এই রচনার সূত্র ধরে সৃষ্টিগুলো সঙ্গে নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা হবে৷
তেভাগা আন্দোলন সফল না হলেও সার্থক৷ তার ওপর রচিত হয়েছিল গান, কবিতা, নৃত্যনাট্য, নাটক৷ কিন্তু আজকের বামপন্থী অগ্রগতির কোনও সৃষ্টিশীল ছাপ নেই আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে৷ সলিল চৌধুরি মানে এক বোধিসত্ত্ব জীবন পথিক— যাঁর আদর্শ, মানবতাবোধ, সংগীত, শিল্প, কর্মকাণ্ড, জীবনের সার্বিক প্রকাশ পরম সাধনায় বোধিসত্ত্ব, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ৷ কিন্তু নেই তার উত্তরসূরি৷ আসুন, আজ এই দুঃসময়ে আমরা সলিল চৌধুরির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাই—
‘সেই দিন আর কত দূরে
যখন প্রাণের সৌরভে, সবার গৌরবে
ভরে রবে এই দেশ ধনধান্যে, শিক্ষায় জ্ঞানে মান্যে,
আনন্দের গানে গানে সুরে সুরে৷’