আধুনিক বাংলা গানের দিশারী রবীন্দ্রনাথ
বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও নজরুল গীতির প্রতিভাধর ও প্রাজ্ঞ শিল্পী শ্রদ্ধেয় ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র বহুদিন আগে একটা বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, ‘বাংলা গানের দুটি ধারা — একটি ধ্রুপদী, অন্যটি ইসলামিক৷ প্রথম ধারার নেতা রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিতীয় ধারার নেতা নজরুল৷’ নজরুল গীতির ওপর আমি কোনও প্রমাণ-সিদ্ধ স্থির বক্তব্য রাখবো এমনপ্রত্যক্ষ চর্চা বা জ্ঞান আমার ওনার গান সম্পর্কে নেই৷’ তথাপি তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রসঙ্গ একটু ছুঁয়ে যেতে চাই, আমার সীমিত নজরুল-বোধ দিয়ে৷ কারণ বাংলা গানে নজরুলের অবদান কালাতীতভাবে বিস্তৃত৷ অথচ রবীন্দ্র-অনুসারী নয়, যেমন খুব জোর দিয়ে বলতে পারি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও, পদকর্তাদের পর তাঁর মত শ্যামসঙ্গীত, কৃষ্ণসঙ্গীত কেউ লেখেননি৷ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও সাম্প্রদায়িক অসুস্থতা তাঁর ছিল না৷ কাজি নজরুল সৃষ্ট রাসলীলার গান বিস্ময়কর৷ যেমন তার বাণী তেমনি তার সুর৷ একেবারে ‘কীর্তনের সুর’-জাত প্রয়োগ৷ আর শ্যামাসঙ্গীত ত মনে হয় সর্বশ্রেষ্ঠ৷ আর তাঁর দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের উত্তাপ তো স্বদেশী গানের স্বার্থক সৈনিকের কুচকাওয়াজ৷ বাংলায় গজল তাঁর আর এক মহিমার কীর্তি৷ তাই প্রণম্য কবি-সুরস্রষ্টা কাজি নজরুল ইসলামের গান সম্বন্ধে সামান্য কিছু লেখবার চেষ্টা করবো৷ এতে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অবদানের চেহারা অর্থাৎ ধ্রুপদী নির্মাণ ও নজরুলের অবদান ও তাতে ইসলামিক সুরের প্রভাবের প্রতিফলন কতটা ঘটেছে আধুনিক বাংলা গানে তা বুঝতে হয়তো কিছুটা সহজ হতে পারে৷ যদিও আমি মূলত রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা নিয়েই আলোচনা করবো৷ প্রথমেই আমি ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের একটি কথার বিরোধিতা করবো৷ যে, নজরুলের গান কেবলমাত্র ইসলামিক গান, এটা ঠিক নয়৷ তাঁর গানে অনেক কিছু আরও আছে৷ মার্গ সঙ্গীত, বাউল, ভাটিয়ালি, গজল, ঠুংরী সমস্ত ধরনের সঙ্গীতের প্রভাব ও প্রতিফলন ঘটেছে নজরুল গীতিতে — এমনকি বিদেশি সুরেরও আঁচ পাওয়া যায় নজরুলের গানে৷ এগুলো নিয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না৷ কারণ, ওই একই কথা, তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে তেমনভাবে গবেষণা কিছু করিনি৷ তবু আমি রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতার বিষয় বলার আগে নজরুল সম্পর্কে দুটো কথা বলবো, যেটা আমার সৃষ্টিশীল মননের মধ্যে ধরা পড়েছে৷ যেটা দুই মহান স্রষ্টার প্রয়োগ তারতম্য৷
(১) রবীন্দ্রনাথ যখন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত, বাউল, কীর্তনকে ব্যবহার করেছেন তখন সেই সব সুরের সমস্ত ভাব ও আবেগকে ব্যবহার করে তাকে একটা নতুন মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন৷ সেইজন্যে তাঁর বেহাগভিত্তিক সৃষ্টিকে বা ইমনভিত্তিক সৃষ্টিকে কখনও বেহাগ বা ইমন বলা যাবে না৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিরোনামেই সেই সব গান, এক মৌলিক সংজ্ঞায় পর্যবসিত৷ বাউলের ‘একলা নিতাই একলা নিতাই’ গানটা যখন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে তখন তার জাত, প্রকাশ, ভাব, একেবারে স্বকীয় মহিমায় রূপ নিয়েছে৷ সেখানে নজরুলের রাগ-ভিত্তিক গানে রাগরাগিনীর ব্যবহার অনেকটাই শাস্ত্রীয় সুরের অনুভবের মধ্যে অনুরণিত৷ ফলে অনেক সময় নজরুলের রচিত অনেক আধুনিক বাংলা গানকেও কাব্যমূল্যে সুর ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় সহজ কিছু অন্য ধরনের রাগপ্রধান বলে মনে হয়৷ রাগ রাগিনীর আবেগ ও পরিকাঠামো সেখানে এতটাই সরাসরি প্রকাশিত, যাতে অনেকে মনে করেন আধুনিক গানে নজরুলের অবদানকে গ্রহণ করতে হলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজনীয়৷ যেটা রবীন্দ্রনাথের গানে নয়৷ সম্মানীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পারদর্শী ব্যক্তিদের অনেকের মতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার শেখার কি আছে৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদেরও অনেকের ধারণা সঠিকভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় স্বরস্থান তৈরি করার জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষার তেমন কোনও প্রয়োজন নেই এবং অনেকেই সেভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেনও না৷ যেগানে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শ্রদ্ধেয় সুবিনয় রায়ের মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব — সেই সঙ্গীতের অনুগামীরা কী করে এমন ভাবনা ভাবেন, ভাবতে আশ্চর্য লাগে৷ আসলে নজরুলের গানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রয়োগ প্রত্যক্ষ ও চিরাচরিত অনুভূতিভিত্তিক — কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, ঐতিহ্য থেকে যা গ্রহণ করেছেন তা তাঁর মৌলিক ভাবনা দিয়ে সঙ্গীতে তথা তাঁর সৃষ্টিতে তার স্বকীয় রূপ দিয়েছেন৷ নজরুলের আধুনিকতার ঐতিহ্য চলিত চিন্তার প্রত্যক্ষ প্রকাশের মধ্যে চিত্রিত আর রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিকতা প্রগতিশীলতার আলোয় একেবারে মৌলিক৷ নজরুলের ‘রাঙা মাটির পথে লো’ সাঁওতালি আবেগেই সৃষ্ট৷ সেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’, সমস্ত জীবন সাধনার ভারতীয় বৈরাগ্য বোধের অনুভবে, একেবারে স্বকীয় ও আত্মবোধের উজ্জ্বলতার প্রকাশে একটা নতুন অভিদ্যোতনা৷
নজরুল ভারতীয় ঐতিহ্য সঙ্গীতকে প্রয়োগ করেছেন আর রবীন্দ্রনাথ করেছেন, আত্মীকরণ৷ প্রকাশে তাই দুজন দুরকম৷ ঐতিহ্যের অনুসারী হয়ে মৌলিক হওয়ার কথাই বারবার উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং এইটাই আধুনিকতা ও প্রগতির প্রতি সঠিক নির্দেশ৷ আর এই ঐতিহ্যের প্রয়োগে তিনি শিল্পনন্দনচিত সংযমী হবার কথা বারবার বলেছেন৷ বিষয়কে সঠিক অনুভবে প্রকাশই হচ্ছে শিল্প সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য৷ শিল্পে-বাহুল্য বর্জিত প্রয়োগকৌশলই অবলম্বন করতে হবে, যাতে সৃষ্টি বিষয়নিষ্ঠ হয়৷ উপলব্ধি ও বোধকে অতিক্রম করে আঙ্গিকের দাপট এড়াতে বলেছেন৷ বলেছেন, ‘আর্ট জিনিসটাতে সংযমের প্রয়োজন সব চেয়ে বেশি৷ কারণ, সংযমই অনন্তলোকে প্রবেশের সিংহদ্বার৷ মানব জীবনের সাধনাতেও যাঁহারা আধ্যাত্মিক সত্যকে উপলব্ধি করতে চান, তাঁহারাও বাহ্য উপকরণকে সংক্ষিপ্ত করিয়া সংযমকে আশ্রয় করেন৷ আর্টের চরম সাধনা ভূমার সাধনা৷ প্রবল আঘাতের দ্বারা হৃদয়কে মাদকতার দোলা দেওয়া আর্টের সত্য ব্যবসায় নহে৷ সংযমের দ্বারা তাহা আমাদিগকে অন্তরের গভীরতার মধ্যে লইয়া যাইবে৷ এই তাহার সত্য লক্ষ্য৷’ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র ”সঙ্গীত চিন্তা” গ্রন্থ পাঠ করলে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, শিল্প অর্থাৎ art ওস্তাদের বা পণ্ডিতের প্রাঙ্গণে বা দরবারে পূর্ণ বিকাশপ্রাপ্ত নয়— নন্দনবোধের মাধুরী মার্জিত সংযমী নৈসর্গিক জীবন বোধের মাধুর্যেই তার যথার্থ আবির্ভাব ও লালন-পালন৷ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশকদের মধ্যেও যাঁরা ওস্তাদী বা পাণ্ডিত্য বর্জন করে শিল্পত্বকে গ্রহণ করেছেন, তাঁরাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যথার্থ সেবক৷ রবিশঙ্করজি বা আমজাদ আলি খাঁকে কি ওস্তাদ বা পণ্ডিত বলা যায়? ওঁরা তো সাধকের চেয়ে বেশি৷ ওঁদের বলা যায় সঙ্গীতযোগী৷
(২) আর একটা প্রামাণ্য কথা, যার স্রষ্টা স্বয়ং ইতিহাস এবং বিদগ্ধ মনন৷ রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরবর্তী যুগের শিল্প, সংস্কৃতি, কাব্য, সাহিত্য, সমাজ, সঙ্গীত সবই রবীন্দ্রোত্তর বলে চিহ্নিত৷ শ্রদ্ধেয় কবি কাজি নজরুল, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, কারোর নামেই পরের যুগ চিহ্নিত হয়নি, অথচ সঙ্গীতকার হিসেবে সবাই দিকপাল৷ এই বিচারেও রবীন্দ্র আলোয় বিচার হবে সংস্কৃতি সংগীতের আধুনিকতার৷
এখন দেখা যাক, রবীন্দ্রনাথের গানে তথা আধুনিক বাংলা গানের সৃষ্টির মধ্যে কোন কোন ঐতিহ্যের দিক কি ভাবে মোটামুটি ব্যবহৃত৷
উত্তাঙ্গ সঙ্গীত, বাউল, কীর্তন প্রভৃতি লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন শাখা, ইউরোপীয় সুর, তাল, কবিতার সুর, গদ্য কবিতার সুর, কবিতা ও গীতি কবিতার পার্থক্যজনিত সুরের প্রয়োগ ইত্যাদি সমস্ত সুর বৈচিত্রের সম্ভার নিয়েই রবীন্দ্রনাথের নির্মাণ মৌলিক৷ আর একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, সারা পৃথিবীর সুর-স্রষ্টাদের কেউই মনে হয় না, তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রেরণার দিকগুলো নিজেই গ্রন্থবদ্ধ করে গেছেন, যা আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘সঙ্গীত চিন্তা’-বই থেকে পাই৷ ভাবতে অবাক লাগে কত আগে কত ঐতিহ্যনিষ্ঠ প্রগতিশীল ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতে প্রবেশ করিয়েছেন সচেতনভাবে৷
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ”নামবদ্ধ রাগরাগিণীতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বন্ধন, নিয়মের মধ্যে বাস৷ আর্টে যা শ্রেষ্ঠ তা অনুকরণজাত নয়৷ ধ্রুবপদ্ধতি অর্থাৎ ক্ল্যাসিকাল হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ঘনিষ্ঠ পরিচয় নিতান্তই আবশ্যক কিন্তু তা অনুশীলনের জন্যে অনুকরণের জন্যে নয়৷”
‘সঙ্গীত সুরের রাগরাগিণী নয়, ভাবের রাগরাগিণী৷ আমাদের দেশে যখন বিভিন্ন ঋতু ও বিভিন্ন সময়ের ভাবের সহিত মিলাইয়া বিভিন্ন রাগরাগিণী রচনা করা হইত, যখন আমাদের রাগরাগিণীর ভাবব্যঞ্জক চিত্র পর্যন্ত ছিল, তখন স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে যে, আমাদের দেশে রাগরাগিণী ভাবের সেবাতেই নিযুক্ত ছিল৷ সঙ্গীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷
”নামবদ্ধ রাগরাগিণীতে আর যাহা করুক না করুক, সংগীতের প্রতিভা জন্মাইবার বিষম ব্যাঘাত করে৷ প্রথমত আষ্ঠেপৃষ্ঠে বন্ধন৷ নিয়নের মধ্যে বাস; দ্বিতীয়ত যত পরিশ্রম করিয়াই গান রচনা করা যাউক না, পুরাতন রাগরাগিণীর নামে তাহার নামকরণ করা হয়৷ ওহে ওটা কি রচনা করিলে? এটা ভৈঁরো’! বটে! ভৈঁরো’ অতি প্রাচীন রাগ৷ একটা সাধারণের সম্পত্তি৷ আমি ব্যবহার করিতেছি মাত্র৷ ভৈঁরো’ রচনা করিয়া আমার কোনো নাম নাই৷ আজ গান শুনলেই সকলে দেখিতে চান, জয় জয়ন্তী, বেহাগ বা কানাড়া বজায় আছে কিনা৷ আরে মহাশয়, জয় জয়ন্তীর কাছে আমরা এমনকি ঋণে বদ্ধ, যে, তাহার নিকটে অমনতরো অন্ধ দাস্য বৃত্তি করিতে হইবে? যদি স্থল বিশেষে মধ্যমের স্থানে পঞ্চম দিলে ভাল শুনায় কিংবা মন্দ শুনায় না, আর তাহাতে বর্ণনীয় ভাবের সহায়তা করে তবে জয় জয়ন্তী বাঁচুন বা মরুন, আমি পঞ্চমকেই বহাল রাখিব না কেন-আমি জয় জয়ন্তীর কাছে এমন কি ঘুষ খাইয়াছি যে তাহার এত গোলামি করিতে হইবে?”…
”এখন সংগীত বেত্তারা যদি বিশেষ মনোযোগ সহকারে আমাদের কী কী রাগিণীতে কী কী ভাব আছে তাহাই আবিষ্কার করিতে আরম্ভ করেন৷ তবেই সংগীতের যথার্থ উপকার করিবেন৷ আমাদের রাগরাগিণীর একটা ভাব আছে তাহা যাইবে কোথায়৷…” ”হিন্দুস্থানি সংগীত আমরা ভাল করে শিখলে তা থেকে আমরা লাভ না করেই পারব না৷ তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্মসাৎ করে তাকে আপনরূপ দিতে পারব৷ তর্জমা বা ধার করে সত্যিকারে সৃষ্টি হয় না৷”
এই সব বাণী থেকে আমরা উপলব্ধি করি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে চলমানতার প্রেক্ষিতে কত সম্মানজনক স্থান দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ৷ কিন্তু তাঁর সমস্ত বিচারের মাপকাঠি ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিকতায়— নব সৃষ্টির গতিশীলতায়৷ শাস্ত্রীয় সংগীত বাঁচবে ইতিহাসের আর ব্যাকরণের নিরিখে তা হয় না— শাস্ত্রীয় সংগীত যা চিরকালের সত্য অনুভবকে বহন করছে, তা প্রজন্মে প্রজন্মে পুষ্টি জোগাবে আধুনিক জীবনকে— আগামীকে— আগামীর আগামীকে এই বিশ্বাসকে নানাভাবে নানা ভাষায় বুঝিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ৷ এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আরো কিছু কথা৷
(শ্রদ্ধেয় শ্রী দিলীপ কুমার রায়কে লিখিত পত্র)
‘সারাজীবন ধরে একটা নির্দিষ্ট মতের অনুবর্তন করে চলাটা মনের স্বধর্মের পরিচায়ক নয়৷
একটা কথা আমি ভেবে দেখেছি— গানের ক্ষেত্রে, শুধু গানের ক্ষেত্রে কেন, সমস্ত চারুশিল্পের ক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টির পথ যদি খোলা নাই রইল তবে তা কিছুতেই শিল্পের পাঙক্তেয় হতে পারে না৷ শিল্পী নিজের পথ নিজে করে নেবে, প্রাচীন সংগীতের কণ্ঠে ঝুলে থাকাটা তার সইবে কেন? পুরাতনকে বর্জন করতে বলি নে, কিন্তু নতুন সৃষ্টির পথে তাতে যদি কাঁটার বেড়া দেখা দেয় তবে তা নৈব নৈব চ৷
আকবর শা-র দরবারে তানসেন মস্ত বড় গাইয়ে ছিলেন, কেননা তাঁর শিল্পপ্রতিভা নিত্য নতুন সৃষ্টির খাতে রসের বান ডাকিয়াছিল— আকবর শা-র যুগে ছিল সে ঘটনা অভিনব৷ কিন্তু, এ কালের মানুষ আমরা, আমরা কেন এখনো তানসেনের গানের জাবর কেটে চলব অন্ধ অনুকরণের মোহে? এই যে সমস্ত হিন্দুস্থানি ওস্তাদ দেখতে পাও এদের হয়ত কারও কারও প্রতিভা আছে, কিন্তু এদের যেটুকু প্রতিভা সেটা নিঃশেষিত হয়ে যায় বাঁধা পথের অনুবর্তন করতে করতেই৷ সুতরাং নতুন সৃষ্টির কোনও জায়গা সেখানে থাকে না৷” রবীন্দ্র ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমারও মনে হয় শাস্ত্রীয় সংগীত খাঁচার পাখি নয়— মুক্ত আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ— তার স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ চাই৷ রবীন্দ্রনাথ আরও ”লিখছেন বাংলা গানের অপূর্ব সম্ভাবনার কথা ভাবতেই আমার রোমাঞ্চ হয়৷ বাংলা গানে নিত্য নতুন স্বকীয়তার পথ তোমরা সৃষ্টি করতে থাকো, তাতেই বাংলা গান খুঁজে পাবে সার্থকতা৷ তুমি তো অনেক দিন য়ুরোপে ছিলে, তাদের সংগীতের ভালো ভালো জিনিস দিয়ে যদি বাংলা গানের সাজি ভরাতে পারো তবে সেটা সত্যিকারের কাজ করা হবে৷ অন্ধ অনুকরণ দোষের, কিন্তু স্বীকরণ নয়৷”
রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র লিখছেন, ‘আমাদের দেশের গানে, গায়কের রুচি ও শক্তিকে সে দরাজ জায়গা ছেড়ে দেয়৷ কিন্তু, সর্বত্র এ কথা খাটে না৷ খাটে কোথায়? যেখানে গানের চেয়ে রাগিণী প্রধান৷ রাগিণী জিনিসটা জলের ধারা; বস্তুত সেই রকম আকৃতি-পরিবর্তনের দ্বারাই তার প্রকৃতির পরিচয়৷ কিন্তু আমি যাকে গান বলি সে হচ্ছে সজীব মূর্তি, যে যেমন-খুশি তার হাত পা নাক চোখের বদল করতে থাকলে জীবনের ধর্ম ও মূর্তির মূল প্রকৃতিকেই নষ্ট করা হয়৷ সে হয় কেমন? যেমন, চাঁপা ফুল পছন্দ নয় বলে তাকে নিয়ে স্থলপদ্ম গড়বার চেষ্টা৷ সে স্থলে উচিত চাঁপার বাগান ত্যাগ করে স্থলপদ্মের বাগানে আসন পাতা৷ কারণ, যে জিনিস জীবধর্মী তাকে উপেক্ষা করলেও চলে, কিন্তু উৎপীড়ন করলে অন্যায় হয়৷’ যথার্থ আর্টের মধ্যে সহজ প্রাণ আছে বলেই তার বৃদ্ধি আছে, গতি আছে, কিন্তু যেহেতু কারুনৈপুণ্যটা অলংকার, সেহেতু তাতে প্রাণের ধর্ম নেই, তাই তাকে প্রবল হতে দিলেই আভরণ হয়ে ওঠে শৃঙ্খল; তখন সে আর্টের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বন্ধ করে দেয়, তার গতিরোধ করে৷ তখন সেটা বাহাদুরি করতে থাকে৷ আত্মিক নয়, সেটা বৈষয়িক, অর্থাৎ তার মধ্যে প্রাণগত বৃদ্ধি নেই, সেটায় বস্তুগত সঞ্চয় আছে৷’
ভারতীয় ঐতিহ্য সংগীতই যে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছের বীজ প্রেরণা তা তাঁর রচনা থেকে বোঝা যায়৷ যেমন লিখছেন—
”উৎকৃষ্ট হিন্দুস্থানি সংগীত আমি ভালোবাসি বলেছি বহুবারই৷ কেবল আমি বলি যে, ভালো জিনিসকেও ভালোবাসতে হবে কিন্তু মোহমুক্ত হয়ে৷ সব রকমের মোহ সর্বনেশে৷ তাজমহল আমার ভালো লাগে বলেই যে তাজমহলের স্থাপত্যশিল্পের অনুকরণে প্রতি বসতবাটীতে গম্বুজ ওঠাতে হবে এ কখনোই হতে পারে না৷ হিন্দুস্থানি সংগীত ভালো লাগে বলেই যে ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি করতে হবে এ একটা কথাই নয়৷ অজন্তার ছবি খুবই ভালো কে না মানবে? কিন্তু তাই বলে তার ওপর দাগা বুলিয়ে আমাদের চিত্রলোকে মুক্তি খুঁজতে হবে বললে সেটা একটা হাসির কথা হয়৷ তবে প্রশ্ন ওঠে; অজন্তা থেকে তাজমহল থেকে হিন্দুস্থানি সংগীত থেকে আমরা কী পাব? না, প্রেরণা— ইনসপিরেশন৷ সুন্দরের একটা মস্ত কাজ এই প্রেরণা দেওয়া৷ কীসের? না, নবসৃষ্টির৷ তানসেন আকবর শা মরে ভূত হয়ে গেছেন কবে, কিন্তু আমরা আজও চলতে থাকব তাঁদের সুরের শ্রাদ্ধ করে? কখনোই না৷ তানসেনের সুর শিখব, কিন্তু কী জন্যে? না, নিজের প্রাণে যাকে তুমি বলছ renaissance— নবজন্ম— তারই আবাহন করতে৷ আমিও এই কথাই বলে আসছি বরাবর যে, নবসৃষ্টির যত দোষ যত ত্রুটিই থাকুক-না কেন, মুক্তি কেবল ওই কাঁটাপথেই— বাঁধা সড়ক গোলাপফুলের পাপড়ি দিয়ে মোড়া হলেও সে পথ আমাদের পৌঁছিয়ে দেবে শেষটায় চোরা গলিতেই৷ আমরা প্রত্যেকেই মুক্তিপন্থী, আর মুক্তি কেবল নবসৃষ্টির পথেই— গতানুগতিকতার নিষ্কলঙ্ক সাধনার পথে নৈব নৈব চ৷ বাংলা গানে দেখো হিন্দুস্থানি সুরই তো পনেরো আনা৷ কাজেই কেমন করে মানব যে বাংলা গানের সঙ্গে হিন্দুস্থানি সংগীতের দা-কুমড়ো সম্বন্ধ? বাংলা গানে হিন্দুস্থানি সুরের শাশ্বত দীপ্তিই যে নবজন্ম পেয়েছে এ কথা ভুললে তো চলবে না৷ আমরা যে বিদ্রোহ করেছি সে হিন্দুস্থানি সংগীতের আত্মপ্রসাদের বিরুদ্ধে, গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে, তার আনন্দদানের বিরুদ্ধে না— কেননা, আমাদের গানেও তো আমরা হিন্দুস্থানি গানের রাগরাগিণীর প্রেরণাকেই মেনে নিয়েছি৷ হিন্দুস্থানি সংগীতকে আমরা চেয়েছি, কিন্তু আপনার ক’রে পেলে তবেই না পাওয়া হয়৷ হিন্দুস্থানি সুরবিহার প্রভৃতি শুনে আমি খুশি হই, কিন্তু বলি, বেশ, খুব ভালো, কিন্তু ওকে নিয়ে আমি করব কী? আমি চাই তাকে যে আমার সঙ্গে কথা কইবে৷’
এই প্রেক্ষিতে আমরা আলোচনা করবো রবীন্দ্রনাথের এই ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিকতার মহার্ঘ্য চলমানতার ও গতিশীলতার পথে অর্থাৎ জঙ্গম জীবনের পক্ষে ও প্রেক্ষিতে যে অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও অসাধারণ অবদান, তা আমাদের সংগীতকে কী দিল? কোন ঐশ্বর্য, কোন চেতনা? তাঁর প্রয়োগ কৌশল কীভাবে বিস্তৃত কিছু নমুনা তার তুলে ধরবার চেষ্টা করছি৷
ইমনের গাইবার সময় সন্ধ্যা৷ চলনে গভীর, গম্ভীর অনুভবে মনে হয় কোনও একদিন, কোনও এক সাধক কি সাধিকা এই ছবি এঁকেছিলেন সুরে সুরে, শঙ্খধ্বনির মন্ত্রে, তুলসী মঞ্চের আলোর দীপাবলিতে, পূজারি বা পূজারিণী মন নিয়ে, সেই ইমন একদিন ভাব-খোঁজা সৃষ্টিশীল, অন্বেষক, মনন সৃজনের সংগীত স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের কাছে ধরা দিল বর্ষাচঞ্চল এক ময়ূর মনের উপলব্ধির প্রাণোচ্ছলতায়, গেয়ে উঠলেন, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে৷’ শাস্ত্রীয় সংগীতের সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো বাদী সমবাদীর কারাগার থেকে সব পর্দার সমান অধিকারের গণতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে মুক্তি দিলেন ঐতিহ্যের ইমনকে৷ ইমনের প্রতিটি পর্দা, যাকে যেমন দরকার, ভাব প্রকাশের তাগিদে তাকে সেভাবেই ব্যবহার করলেন৷
এই ইমনকে রবীন্দ্রনাথ জীবনের কত ভিন্ন ভিন্নভাবের অনুভবে মুক্তি দিয়েছেন, তার অজস্র নিদর্শন আছে৷ যাঁরা ইমনকে চেনেন তাঁরা যদি ইমনকে নিম্নলিখিত গানের মধ্যে সন্ধান করেন তবে বুঝবেন রবীন্দ্রনাথ ইমনকে কত উন্মুক্ত অঙ্গনে মুক্তি দিয়েছেন৷
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে [ভালোবাসার নিবিড়তা] (২) ডেকো না আমারে ডেকো না [ভালবাসার অভিমান] (৩) নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে [জাগতিক ভাবনা] (৪) বিপদে মোরে রক্ষা কর [ঈশ্বর ভাবনা]
এই সব সংগীত ডালির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যেমন আধুনিকতার নিদর্শন পাওয়া যাবে তেমনি প্রমাণ পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই বাণীর সার্থক প্রয়োগ, ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷ সংগীত সুরের রাগ রাগিণী নয় ভাবের রাগ রাগিণী৷’ অর্থাৎ পর্দার কারাগারে এরা বন্দী নয়৷ অনুভবের মুক্ত আকাশে এরা উড়ন্ত বলাকার দল— ছুটছে রবীন্দ্রনাথের বাণীকে সত্য করে-‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে৷’
প্রাকৃত ও সাধু বাংলার মিশেলের দৃষ্টান্ত দিয়ে এ কথাটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দেন হিন্দুস্থানি সুরে মিশেল আনতে আমাদের বাধা নেই— বাধা থাকবে কেন? এই ‘মিশেল’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নির্মাণে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন এবং সমস্ত রক্ষণশীলতার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বিস্ময়কর আধুনিক রূপ দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন, যা চলমান জীবনের দৃশ্য-দৃশ্যান্তরের অসংখ্য সত্য ছবি৷ আসুন এই নির্মাণ কৌশল নিয়ে আরও একটু আলোচনা করা যাক৷
‘ইমন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ, জীবনসম্মত, রুচিশীল মাধুর্যময় ধ্যান গম্ভীর রাগ৷ তার পরিকাঠামোয় অজস্র বৈচিত্র্য আছে ও গায়নে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা যায়৷ সেই রাগকে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ একটি গান সৃষ্টি করলেন৷ ‘এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি’৷ গানটির প্রথম অন্তরার শেষ লাইন, ‘সুখ রজনী সম মেলুক মনে৷’ এই ‘মেলুক মনে’তে এসে তিনি শুদ্ধ ‘ধ’তে দাঁড়িয়ে গেলেন— ভাঙলো রাগের শৃঙ্খল৷ ইমনের বাদী গা, সমবাদী নি,— তিনি ‘ধ’কে prominent করলেন এবং একটা incomplete emotion-এ ছাড়লেন৷ মনে হল ‘মেলুক মনে’ শব্দটি একটা ভাললাগা বোধ এ (!) চিহ্ন দিয়ে থেমে গেল— যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল— আবার গানের মুখে এসে স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগল৷ এই বাদী সমবাদীর পরিকাঠামো ভাঙলেন কেন? অচলায়তনের মহাপঞ্চক বা তাসের দেশের রাজার মাথায় কেন মারলেন ডান্ডা? রক্ষণশীল পরিকাঠামো ভেঙে নির্মাণের রহস্য সেটাই, যা আমরা অনুসন্ধান করব৷
চলমানতাই রবীন্দ্রনাথের জীবন বৈশিষ্ট্য৷ অচলায়তনের মহাপঞ্চকরা তাদের বাতায়নকে মুক্ত করতে চায় না— তাসের দেশে রাজা জীবনের পায়ে শৃঙ্খল দিতে চায়— তার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছেন অচলায়নের দাদা ঠাকুর, তাসের দেশের রাজপুত্র৷ রবীন্দ্রনাথ ওই দাদা ঠাকুর আর রাজপুত্তুরদের সম্প্রদায়ের৷ ভারতীয় মার্গ সংগীতের রসপূজারী রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অন্ধ রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী নন৷ জীবনের এক পথ এক বোধ ধরে যে শাস্ত্রীয় সুরের জন্ম— তার লালন দরকার— তার নব নব পথে চলার যে শক্তি আছে তার প্রকাশ দরকার— জীবনের নতুন নতুন বোধকে পুষ্টি জোগানো দরকার— এমনই তাগিদে রবীন্দ্রনাথের গানের সৃষ্টি প্রেরণা৷ জীবন যখন অচল নয়, সচল— জীবনের বোধ থেকে সৃষ্টি সংগীত কী করে স্থাবর হবে— সে তো পূর্ণ ভাবে জঙ্গম৷
রবীন্দ্রনাথ অনুভব করলেন ভারতীয় সংগীতের এই বাদী, সমবাদী, অনুবাদী, বিবাদীর সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো, জমিদার, নায়েব, পার্ষদ ও বিবাদীযুক্ত ভারতীয় সংগীতের রাজতন্ত্র, তার থেকে এই সংগীতকে মুক্তি দিতে হবে প্রজাতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে, গণতন্ত্রে, তাই তিনি এই প্রথা ভেঙে মুক্তি দিলেন সপ্তকের সাতটি পর্দাকে৷ যে পর্দাকে যখন প্রয়োজন তখনই তাকে ব্যবহার করলেন ভাবের প্রয়োজনে৷
‘যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে/সে কাঁদনে সেও কাঁদিল’— গানটির সঞ্চারীর আগে পর্যন্ত কড়ি হ্ম ব্যবহার করলেন, সঞ্চারীর ‘ফিরিল না আর তরীতে’-র লাইনে ব্যবহার করলেন শুদ্ধ মধ্যম৷ যারা chord জানেন তারা খেয়াল করবেন— গানটি যদি ‘B’ Flat এ গীত হয়— ‘হ্ম’ মধ্যম এ C Major ব্যবহার হবে— সেই অর্থে ‘ম’ এলে ‘E Flat’ হওয়া উচিত৷ কিন্তু আমার মনে হয়েছে যেহেতু ‘মা’ এর পর ‘নি’ আসছে— chordটি হওয়া উচিত F 7th৷ এ ভাবনা ইউরোপীয় সিম্ভনির পথে এসেছে৷ আর এই পদ্ধতি গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐতিহ্যসুরকে তার সামন্ততান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক বাদী সমবাদীর পরিকাঠামো থেকে পর্দার গণতন্ত্রে মুক্তি দিয়ে কেবল পর্দাকে দাসত্বে হাত থেকে বন্ধন ছিন্ন করিয়ে দিয়েছেন তা নয়, সুরকে স্বরকে মানুষের প্রতি মুহূর্তের সাথী করে মানুষের বোধের দিয়েছেন মর্যাদা, সম্মান৷ এই দেশীয় সুরকে আন্তর্জাতিক সূত্রে গ্রথিত করে তিনি আমার মতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ Composer হয়েছেন৷ কারণ দেশজ সুরকে ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক রসে বৈপ্লবিক বিনিময় পৃথিবীর আর কোনও Composer করেছেন বলে আমার জানা নেই৷ রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যদি আন্তরিক সত্যনিষ্ঠ, শিক্ষিত, রবীন্দ্র ভাবনায় ভাবিত হয়ে কেউ গবেষণা করেন তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন কত যুগ আগে এই রকম আধুনিকতা কীভাবে তিনি সৃষ্টি করলেন৷ তাঁর বোধের দীপ্তি কত সুদূর প্রসারিত ছিল, যার জন্যে তিনি যুগকে সময়কে, এতটা এগিয়ে দিতে পেরেছিলেন৷ ‘এই উদামী হাওয়ায় পথে পথে’ গানটিও ইমনের পর্দায় রচিত, তাতে ইমনের পুরো রস আছে, কিন্তু দাসত্ব নেই৷ ইমনের বাদী ‘গ’ সমবাদী নি৷ প্রথম লাইনের সরগমের দিকে দৃষ্টি দিলেই অনুধাবন করা যাবে রাগের মূল আবেগ রক্ষা করে রাগটির রস নিয়ে, বেদনার্ত না হয়ে, romantic mood-কে কী সুন্দরভাবে পুষ্টি জুগিয়ে পর পর যে সব পর্দায় দাঁড়িয়েছেন তা যথাক্রমে ধ, প, হ্ম— তারপর ‘গ’ লেগেছে just touch note-এর মতো৷ এই ইমনের মধ্যে তাঁর পর্দা ব্যবহার, প্রায় সময়েই, এমন Socialisum of notes, Democracy of notes একেবারে নির্দিষ্ট ও motivated ভাবে বিধৃত৷ আবার বিস্ময়কর ভাবে সঞ্চারিতে কোমল ঋকে খাড়া ভাবে লাগিয়ে একাধারে মিশেলকে রোমাঞ্চিত করেছেন৷ অন্যধারে এই পরিবর্তনের স্টাইল-এ একেবার chord প্রয়োগের চরম মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন৷ সঙ্গীত সৃষ্টিতেও তাঁর এই বোধ ঐশিক ভাবে বিধৃত৷ রবীন্দ্রনাথের বেহাগ ভিত্তিক গানগুলো এক একটা, এক এক ভাবের, রসের, আঙ্গিকের অথচ বেহাগ যেভাবে মনকে সমৃদ্ধ করতে পারে সেই সৃষ্টিশীলতা কোথাও ব্যাহত নয়৷ এভাবেই ভারতীয় ঐতিহ্য সংগীতকে বা বলা ভাল যেখানে যা সুর শুনে আত্মস্থ করেছিলেন তাকে, যখন নিজের গানে ব্যবহার করে একটি রূপ দিয়েছিলেন তখন পর্দার ক্রম প্রয়োগে ইউরোপীয় সিম্ভনিকে অবলম্বন করেছেন৷ যাঁরা, বর্তমানে দেখি চালের দোকানে চালের বস্তার চালের নমুনা পরীক্ষা করার জন্যে বস্তার পেটে যেমন বোমার খোঁচা দেয় চাল বের করবার জন্যে, তেমনিভাবে রবীন্দ্রসংগীতের পেটে বোমা মেরে রবীন্দ্রসংগীতের পেট থেকে রাগ-রাগিণী, বিদেশি সুর, কীর্তন বাউলকে বের করতে চেষ্টা করছেন— যেন রবীন্দ্রনাথ স্রষ্টা নয়— সংগীত সম্পাদক বা সঙ্কলক— এঁরা রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর মৌলিক অবদানকে অসম্মান করছেন৷ কারণ যেমন নদীর নাম স্বনামে বেঁচে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ না তা সাগরে গিয়ে মেশে— সাগরে মিশলে তার সত্তাবিলীন হয়ে যায় সাগরের নাম, রূপ, কূল, স্রোত, বিরাটত্বের কাছে, তেমন বিভিন্ন সুরের মৌলিক সুরের মৌলিক সত্তা যখন রবীন্দ্র সাগরের মিশেলে এসে পতিত হয়, মিশ্রিত হয়, তা রবীন্দ্রসংগীত সাগরেরই নাম রূপ, সত্তা— কোনও সুরের নদীর নয়৷ এর মধ্যে যুগপৎ শাশ্বত চিন্তা ও আধুনিক ভাবের রয়েছে যথার্থ ভাব অনুভূতির রসায়ন৷ বেহাগ রাগে সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গান নিয়ে যদি demonstrative গবেষণা করা যায় বোঝা যাবে এক সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে তাঁর আন্তরিক অন্বেষণের ফসল৷ যা স্রষ্টার নিজস্ব সংস্কারের, অনুভূতির রসে জারিত তার আপন অস্তিত্বের অনন্ত অন্বেষণ৷ সেই অর্থে বেহাগ তো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সঙ্গীতে, দিগন্ত বিস্তৃত মুক্ত বলাকা৷ সেই অন্বেষণের পথে তিনি বেহাগ, বাহার, ইমনকে নবাবের দরবারে বা নাচঘরে মুজরা সংগ্রহে ব্যবহার করেননি৷ প্রকৃতিকে প্রেমকে, জীবন দেবতাকে অন্বেষণ করেছেন৷ খুঁজে পেয়েছেন৷ দুঃখীর সমমর্মী হয়েছেন— আনন্দ পথিকের হয়েছেন সহযাত্রী৷ পঞ্চভাবরস রঞ্জিত বৈষ্ণবের মতো অভিসার করে রস সম্ভোগ করেছেন ভাবকে৷ তাই এই সব রাগ রাগিনীর অনুভব রবীন্দ্রনাথের কাছে সাংগীতিক ব্যাকরণ না— জীবন পূজার নৈবেদ্য৷ দৃষ্টান্ত- ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’৷ ‘তুমি রবে নীরবে৷’ ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি৷ প্রতিটি বেহাগ ভিত্তিক গানে তিনি বিবাদী পর্দা কোমল নি-কে কৌশলে ব্যবহার করেছেন যা বেহাগড়া নয় অথচ কোমল নি লাগছে৷ আমার নির্মাণ বুদ্ধি থেকে রবীন্দ্রনাথের ওই কোমল নি-কে মনে হয়— খাম্বাজের দুই নি ব্যবহারের মতো রস প্রযুক্ত৷ বেহাগকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সাঙ্গীতিক অনুভূতির উপনিষদ আর তার থেকে যে সঙ্গীত রসামৃত ঝরে পড়ছে তা গীতামৃতের মতো৷ গীতায় যেমন আছে—
‘সর্ব্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপাল নন্দন:৷
পার্থো বৎস: সুধীর্ভোজা দুগ্ধং গীতা মৃতং মহৎ৷৷
রবীন্দ্রনাথও যেন স্বয়ং গোপাল নন্দন৷ শাস্ত্রীয় সংগীতের গাভীর রসামৃত নিয়ে, সঙ্গীত-ধর্ম পথিক অর্জ্জুনদের সেই সঙ্গীত রসামৃত পান করাচ্ছেন৷
যেমন পুরাণ, লোকগাথা৷ ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির মধ্যে বেদ বেদান্তের নির্যাস ক্রমাগত লোকায়ত করে শাস্ত্রকে চলমান রেখেছে৷ ধর্মকে, ভগবানকে সাধারণ মনুষ্য জীবনে ও সমাজের আন্তরিক বোধের আঙিনায় পৌঁছে দিয়েছে৷ ধর্মীয় কাহিনীও প্রচুর ভাবে যেমন ধর্মকে সহজাত করতে সাহায্য করছে৷ রবীন্দ্রনাথও সেরকম এই সহজিয়া পথকে চলমান রাখতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও আধুনিক সঙ্গীতের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন৷ এ নিঃসন্দেহে জীবকোটি ও ঈশ্বর কোটির মধ্যের ভাব সোপানের মতো৷ বিবেকানন্দও তাঁর গান গাইতেন৷ তাই রবীন্দ্রনাথ দেহে থাকলে তাঁকে গিয়ে বলতাম— আপনার ‘গীতবিতান’ নামটি ঠিক হয়নি৷ এর নাম হওয়া উচিত ছিল ‘গীতাবিতান’— বা সঙ্গীত গীতা৷ গীতা যেমন সমস্ত শাস্ত্রের সারমর্ম— রবীন্দ্রসঙ্গীত তেমনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাবসমৃদ্ধ নির্যাস৷ উপনিষদ থেকে যেমন গীতার শাস্ত্রীয় চলমানতা আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার তেমনি চলমানতায় উজ্জ্বল সাঙ্গীতিক গীতা৷
পরবর্তী যুগে আধুনিক বাংলা গানের রূপকারদের মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই ধরনের ব্যবহারের ছাপ বারবার এসে পৌঁছেছে৷ যেমন ‘সুধীন দাশগুপ্ত রচিত’ একটু চাওয়া একটু পাওয়া গানটিতে ইমনের ব্যবহার লক্ষ্য করি তখন বুঝি এখানে ইমনের দাসত্ব নেই৷ ইমনের নির্যাসে যা প্রকাশিত তা চাওয়া পাওয়ার ব্যর্থতায় নিমজ্জিত বেদনার অভিদ্যোতনা৷ এই ইমনের আলোয় সলিল চৌধুরী সৃষ্ট ‘কী যে করি’ ও তার সঙ্গে dialactical prelude, interlude বিস্ময়কর৷ এ রবীন্দ্রনাথেরই অবদান৷ আমার নিজের রচিত ‘ও পাখি উড়ে আয়’ গানটির মধ্যে ‘শ্যামকল্যাণ’ ও ‘খাম্বাজ’কে সেই চতুরালি দিয়েই নির্মাণ করেছি৷ পাশ্চাত্য সঙ্গীতের Tonic Change পদ্ধতিও ব্যবহার করে দুটি রাগকে এক মর্মবোধে ও ভাবে গাঁথা সম্ভব হয়েছে৷ ওই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ও সলিল চৌধুরির কাছে পেয়েছি৷ সামনাসামনি গায়ন দৃষ্টান্ত দিলে বোঝা যাবে ‘ও পাখি উড়ে আয়’তে শ্যামকল্যাণ ও খাম্বাজের রসায়ন কিভাবে করেছি৷ ভাবকে প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের আবেগ কতটা নিষ্ঠ, প্রবল ও সূক্ষ্মতা জড়িত ছিল তা বোঝাতে তার একটি বাণীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি৷
লিখছেন, ‘সঙ্গীত বেত্তাদের প্রতি আমার নিবেদন যে, কী কী সুর কি রূপে বিন্যাস করিলে কী কী ভাব প্রকাশ করে, আর কেনই বা তা প্রকাশ করে, তাঁহার বিজ্ঞান অনুসন্ধান করুন৷ মূলতান, ইমন-কল্যাণ, কেদারা প্রভৃতিতে কী কী সুর বাদী আর কী কী সুরবিসমবাদী তাহার প্রতি মনোযোগ না করিয়া, দুঃখ-সুখ, রোষ বা বিস্ময়ের রাগিনীতে কী কী সুর বাদী, কী কী সুর বিসম্বাদী তাহার আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হউন৷’ এ বিষয়ে নিজে তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন তার একটা দৃষ্টান্ত দিই৷ ‘সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে/ কে তারে বাঁধলো অকারণে?’ এই গানটিতে সেই মনের হরিণ কতটা চঞ্চল ছিল এই ভাবকে একটি রাগের নামে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে, তিনি কোনও বিশেষ রাগ রাগিনীকে সন্ধান করে পেলেন না, যাতে তাঁর সেই আবেগের বেগকে, প্রকাশ করা যায়৷ তাই তিনি তখন লিখলেন, ‘গতি রাগের সে ছিল গান৷’ ভাবকে রাগের অধীন করে শিল্পের পরাধনীতা মেনে নেওয়া যেতে পারে না৷ এই তাঁর অভিমত৷
বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে’ — এই সাংগীতিক আন্তর্জাতিক বোধকে আত্মীকরণ করেই রবীন্দ্রসংগীতকে বিচার করা দরকার৷ ‘বিশ্বকবি’ সংজ্ঞাটি তিনি নিজে দেননি — বিশ্ব থেকেই উঠে এসেছে৷ তাঁর এই এক পৃথিবী বোধ এতটাই সংবেদনশীল যে তাঁর জীবন দেবতাকেও তিনি তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন৷ ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো৷’ আরও বলেছেন ‘তোমার লাগিয়া কারেও হে প্রভু/পথ ছেড়ে দিতে বলনাত কভু/যত প্রেম আছে সব প্রেম মোরে তোমা পানে রবে টানিতে৷’ এর সঙ্গে আমরা আরও একটু সংযোজন করলে বক্তব্যের স্বপক্ষে জোর বাড়ে—
‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার
সেথা হতে সবে আনে উপহার
দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে
এই ভারতের মহামানবের
সাগর তীরে৷’
তাঁর জীবনবোধের মূল স্পন্দনই ছিল বিশ্ববোধ— তিনি সব কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটা ‘মহা’ শব্দের মন্ত্রধ্বনিকে শুনতে পেতেন, মানুষকে শোনাতে চাইতেন৷ তাঁর সংগীত এই মহাবোধের আঙিনায় বিচার না করলে, বিচারের ছবিটার ক্যানভাস সত্য রঙে চিত্রিত হতে পারবে না — পারে না৷ তাঁর সংগীত সৃষ্টির ভাবনা যখন তার একটি মৌলিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তখন সেই ভাবনায় ভাবিত হয়ে তার সৃষ্টি সংগীতকে বিচার করাই সত্যনিষ্ঠ গবেষণা, — নিজের চিন্তায়, রক্ষণশীলতার মন নিয়েও নয় — আবার আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খল উপস্থাপনাতেও নয়৷ তাঁর সৃষ্টিকে তাঁরই দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করতে হবে৷ আমি জানি না পৃথিবীতে এমন কোনও Composer আছেন কিনা যিনি তাঁর সমস্ত সংগীত নির্মাণ কর্মকাণ্ডকে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে তাঁর আত্মবিশ্লেষণের বা বলা ভাল স্বীয় বিশ্লেষণের কাজ করে গেছেন, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে করে গেছেন৷ একটা উদ্ধৃতি দেব৷ রবীন্দ্রনাথ ‘জীবন স্মৃতি’তে একটি কথা লিখেছেন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ— বিশেষ করে এসরাজি ঘরানার রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের ধ্যানধারণার প্রেক্ষিতে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন৷ প্রত্যহই তাঁহার অঙ্গুলি নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত৷ আমি এবং অক্ষয়বাবু তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম৷ গান বাঁধিবার শিক্ষানবিসি এইরূপে আমার আরম্ভ হইয়াছিল৷’ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সৃষ্টি যদি পিয়ানোর গর্ভ থেকে প্রসব হয়ে থাকে তা এসরাজের লালনে ব্যবহার হতে পারে, বিকশিত হতে পারে, কিন্তু জন্ম সংস্কারটি কি নষ্ট হতে পারে? সৃষ্টি তত্ত্ব এমন কথা বলে না৷ বরঞ্চ সংগীত চিন্তা গ্রন্থে আরও এমন কিছু বক্তব্য আছে যাতে কর্ড ও হার্মনিকে মেনে নেওয়ার পক্ষেই আছে সবল যুক্তি৷ যা উপেক্ষা করা মানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই রবীন্দ্রসংগীতে উপেক্ষা করা — অর্থাৎ সত্যমুখী না হয়ে স্বীয় মনমুখী চলা — আর তাতেই গানে রবীন্দ্রচিন্তার রস হচ্ছে বিলুপ্ত আর ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা রুচির হাতিয়ারে খুন হচ্ছে রবীন্দ্রভাবনা, রবীন্দ্র সংগীত৷ প্রাণে আর গানে ফারাক সৃষ্টি হচ্ছে৷ ব্যক্তিবিশেষের মনে যা হল বা যা এল তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের থেকে বেরিয়ে আসার সংগীতের অনেক সময় মিল হচ্ছে না৷ রবীন্দ্র ভাবনার অনুভব শিল্পীর মনে রবীন্দ্রবোধ গড়ে উঠতে পারছে না বলেই এই বিপর্যয়৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আসল কথা, প্রাণের সঙ্গে যোগ না থাকিলে বড় শিল্পও টিঁকিতে পারে না৷’ — সেই প্রাণের সঙ্গে যোগ না থাকা রবীন্দ্রসংগীত যথাযথ রূপ পাচ্ছে না অনেক শিল্পীর কণ্ঠে৷ এই প্রসঙ্গে আরও কিছু বাণীর উপস্থাপনা করলে বিষয়টি আরও স্বচ্ছ হয়ে আসবে৷
‘সরস্বতীকে শিকল পরাইলে চলিবে না, সে শিকল তাঁর নিজের বীণার তারে তৈরি হইলেও নয়৷ কেন না মনের বেগই সংসারে সব চেয়ে বড়ো বেগ৷ তাকে ইনটার্ন করিয়া যদি সলিটারি সেলের দেওয়ালে বেড়িয়ে রাখা যায় তবে তাহাতে নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা হইবে৷ যারা বড়ো, যারা ভূমাকে মানে, তারা সৃষ্টি করিতেই চায়, দমন করিতে চায় না৷ …আর্টের পায়ের বেড়িটাই দোষের৷ কিন্তু তার চলার বাঁধা পথটায় তাকে বাঁধে না৷’
‘আমরা শাসন মানিব তাহা বলিয়া অত্যাচার মানিব না৷ কেন না যে নিয়ম সত্য, সে নিয়ম বাহিরের জিনিস নয়৷ তাহা বিশ্বের বলিয়াই তাহা আমার আপনার৷ যে নিয়ম ওস্তাদের, তাহা আমার ভিতরে নাই৷ বাহিরে আছে, সুতরাং তাহাকে অভ্যাস করিয়া, ভয় করিয়া বা দায়ে পড়িয়া মানিতে হয়৷ এইরূপ মানার দ্বারাই শক্তির বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়৷ আমাদের সংগীতকে এই মানা হইতে মুক্তি দিলে তবেই তার স্বভাব তার স্বরূপকে নব নব উদ্ভাবনের ভিতর দিয়া ব্যক্ত করিতে থাকে৷ সঞ্চয় করাও নহে৷ ভোগ করাও নহে৷’ বুঝতে হবে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যনিষ্ঠতা ও প্রগতিশীলতার, বলা যায় চলমানতার মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য আছে৷ মনে রাখা দরকার অনাদিকালের উৎস হতে যাঁর প্রেম উৎসারিত, তার চলমানতার প্রেরণা ‘হেয়া নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনো খানে৷’
তিনি লিখেছেন, ‘আপনাকে প্রকাশ করিবার যে প্রেরণা তাহাতেই আপনার বিকাশ৷ প্রকাশের যতরকম ভাষা আছে সমস্তই মানুষের হাতে দিতে হইবে৷’ রবীন্দ্রনাথ মুক্ত হৃদয়ে তাই সংগীতের সমস্ত অঙ্গন ছুঁয়েছেন, আপন ভাবের প্রকাশের জন্যে৷ এ প্রসঙ্গে দুই দিকপাল শাস্ত্রীয় সংগীতকারের দুটি কাজের উল্লেখ করি৷ সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও সমাদৃত সংগীত ঋত্বিক সংগীত যোগী আমজাদ আলি খান তাঁর একটি Composition-এর emage concept করেছেন, তাঁর প্রিয়তমা সহধর্মিণীকে আর রাগটি তৈরি করে নাম দিয়েছেন, ‘শুভলক্ষ্মী’, তার মানে বিশেষ একটি রাগের মধ্যে তাঁর অনুরাগের আকাশের রঙকে রাঙাতে পারেননি৷ ভাব প্রকাশের জন্যে বৈষ্ণবের অন্বেষণের মতো পর্দা খুঁজে বের করেছেন৷ একই অনুভব রবিশঙ্করজির সৃষ্টি ‘পরমেশ্বরী’তে৷ দু’জনেই ঐতিহ্য সুরকে বাহন করে দিগন্তচারী পথিক, আবেগতাড়িত জীবন অন্বেষক৷ What next-এর সন্ধান যে স্রষ্টার মধ্যে নেই সে মৃত৷ রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘হিন্দুস্থানী সংগীত ভালো করে শিখলে তা থেকে আমরা লাভ না করেই পারব না৷ তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্মসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারবো৷ তর্জমা করে বা ধার করে সত্যিকার রসসৃষ্টি হয় না৷ সাহিত্যেও নয়, সংগীতেও না৷’ আমজাদ আলি খান বা রবিশঙ্করজি রাগকে আত্মস্থ করে, তার রসাস্বাদন করে, সেই রস শ্রোতার অনুভবে সঞ্চারিত করেছেন — পর্দা বা ব্যাকরণের দাসত্ব করেননি৷
বিশ্ববোধের অনুভব ও জীবন দর্শন নিয়ে ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘গ্রামে, হপ্তায় একদিন হাট বসে, বৎসরে একদিন মেলা হয়৷ সেই দিন পরস্পরের পণ্য বিনিময় করিয়া যাহার যাহা অভাব আছে তাহা মিটাইয়া লয়৷’ আমরা ‘কুম্ভমেলা’ ‘গঙ্গাসাগর মেলা’ প্রভৃতি ধর্মার্থী সমাগমেও জানি এই মেলার সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য মত ও মন বিনিময়ের মিলন তীর্থ৷ সেই বিনিময়ের উদ্দেশ্যই মেলার তাৎপর্য৷ তাই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানুষের ইতিহাসেও তেমনি এক একটা যুগে সৃষ্টির দিন আসে৷ সেদিন যে যার আপন আপন সামগ্রী ঝুড়িতে করিয়া আনিয়া পরের সামগ্রী সংগ্রহ করিতে পারেন৷ সেদিন মানুষ বুঝিতে পারে, একমাত্র নিজের উৎপন্ন জিনিসে মানুষের দৈন্য দূর হয় না৷ বুঝিতে পারে ‘নিজের ঐশ্বর্যের একমাত্র সার্থকতা এই যে, তাহাতে পরের জিনিস পাইবার অধিকার জন্মে৷’
বিশ্ববোধের ঋষির মর্মে বারবার ধ্বনিত হয়েছে এই বিশ্ব বিনিময়ের সুর৷ বিশ্বও তাঁর প্রভাব অনুভব করে নিজেরাই তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিশ্বকবি বলে৷ রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধে দিবের সঙ্গে নিবের— মিলাবের সঙ্গে মিলিবার উচ্চারণ৷ এই দেওয়া নেওয়ায় শোনা যায় মানবিক সম্পর্কের ঐশ্বর্যকে গড়ে তোলার আহ্বান— আত্মিক বোধের আন্তর্জাতিক হৃদয়ের ডাক— যা ব্যবসায়নের বিশ্বায়ন না৷ যা আন্তর্জাতিক মানবতার সংস্কৃতি৷ এতে মানুষ তার মানস বিকাশের প্রশস্ত পথ দেখতে পায়৷ গড়ে ওঠে ভৌগোলিক, জাতিভিত্তিক চেতনার ঊর্ধ্বে অন্তরের সম্পর্ক— যার দ্বারা মানবকল্যাণ হবে, সংস্কৃতির সামনে খুলে যাবে সিংহদ্বার৷ বিশ্বকবির সংগীত সৃষ্টির বীজ মন্ত্রই হচ্ছে ‘বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে’৷ রবীন্দ্রনাথের এই সাঙ্গীতিক বিশ্ববোধ সমস্ত বিশ্ববোধের মনীষীর মর্মবোধকে ঐকতানে একত্রিত করেছে৷ রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বসংগীত দেশজ সংগীতকে বাদ দিয়ে নয়৷ ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে বিশ্বসংগীতের সঙ্গে মিশিয়ে দেবার সার্থক নির্মাণে৷ সঠিক নির্মাণ— আন্তরিক নির্মাণ৷ রবীন্দ্রনাথের গানই যথার্থ world music কেবল শাস্ত্রীয় সংগীত নয়, বাউল, কীর্তন প্রভৃতি ভারতীয় সংগীতের সমস্ত নির্যাস নিয়েই তাঁর এই আধুনিক সংগীত সম্ভারের সৃষ্টি৷ যার ধারা বহন করেই স্বর্ণযুগ পর্যন্ত আধুনিক সংগীত হেঁটেছে, হাঁটছে৷ কিছু কিছু আভাস দিচ্ছি৷
বাউল সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন৷ কেবল ছোট একটি অভিব্যক্তির কথা জানাব৷
কবি লিখছেন, ‘আমার লেখা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন বাউল পদাবলীর প্রতি অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি৷ শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত৷ আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে৷’ সাংগীতিক বোধের ছুৎমার্গ রবীন্দ্রনাথের ছিল না৷ তাঁর সমস্ত নিবেদন, আবেদন, আনন্দ, বেদনা, প্রেম, পূজা, অভিমানের চিত্র নির্মাণেরই প্রেরণা ছিল তার সৃষ্টি উৎস৷ তাই বাউলের ‘কোথায় পাবো তারে’, এই ঈশ্বর অন্বেষণের সুরকে দেশপ্রেমের রসে ছাপিয়ে যখন আমার ‘সোনার বাংলা’ সুর করেন তখন বোঝা যায় সত্যবোধ, যেখানে পড়বে তাকেই সঠিকভাবে দেখবে৷ সে দেখার সময় ঈশ্বরের প্রেম, দেশপ্রেম বা ব্যক্তি প্রেমের কোনও বিরোধ নেই৷ বিশ্ববোধের অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভব দিয়েই রবীন্দ্রনাথ সংগীতকে গ্রহণ করেছেন৷ তাঁর সঙ্গীত ‘ভূমা’ বোধের রসে জারিত৷
বাউল সংগীতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালবাসা যে কত গভীর তা বহু প্রবন্ধে বিধৃত তো আছেই৷ তাঁর সংগীত নির্মাণেও প্রভূত প্রকাশ আছে৷ তবু আরও একটি ছোট উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রতি প্রলোভন সম্বরণ করতে পারছি না৷ লিখছেন, ‘অন্তরতম যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের (বাউলদের) মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলাম, আমার মনে বড় বিস্ময় জেগেছিল৷ এর অনেক কাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, এমন বাউল গান শুনেছি৷ ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না— তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব, তেমনি কাব্য রচনা৷ তেমনি ভক্তির রস মিশেছে৷ লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে৷’ রবীন্দ্রনাথের এই বাণী পাঠ করে আমার মনে পড়ছে ডাকহরকরা ছবির গানের কথা৷ রবীন্দ্রনাথের বাউলধর্মী গানের এক পরিণত আধুনিক প্রয়োগ সুধীনদা করেছেন এ ছবির গানে৷
রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ, আধুনিকতা গোড়া কেটে আগায় জল নয়৷ তিনি নিজে লিখছেন, ‘তুমি জান সংগীতে আমি নির্মমভাবে আধুনিক৷ অর্থাৎ জাত বাঁচিয়ে আচার মেনে চলিনে কিন্তু একেবারেই ঠাঁট বজায় না রাখি যদি তবে সেটা পাগলামি হয়ে দাঁড়ায়৷’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন প্রকৃত ‘ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিক’৷ তিনি বিশ্বাস করতেন যে কোনও art-এ ইতিহাসের অনুবর্তন বা ব্যাকরণের কচকচানি, সৃষ্টির চলার পায়ে শিকল পরায়৷ বলেছেন, ‘অলঙ্কার শেষে হয় শৃঙ্খল৷’ তিনি প্রগতিবাদী, কিন্তু তাঁর মতো ঐতিহ্যপূজারী কতজন?
জীবন তরঙ্গের ওঠা পড়াই তাঁর সংগীত সৃষ্টির প্রেরণা, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধুর মিলন ঘটেছে৷ তাঁর সংগীত নানা ধারায় তরঙ্গ তুলেছে৷
কীর্তনও রবীন্দ্রনাথকে অসম্ভব আকর্ষণ করেছিল এবং তিনি তাঁর গানে তারও প্রয়োগ করেছেন৷ যার প্রভাব পরবর্তী আধুনিক গানকেও সৃষ্টিশীলতায় সাহায্য করেছিল৷ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে তিনি বাঙালির আত্মপ্রকাশের আবেগ বলে চিহ্নিত করেছিলেন৷ ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লেখা আছে৷ তিনি লিখেছেন কীর্তন কেন তাঁর প্রেরণা হয়েছিল৷ লিখছেন, ‘কীর্তন সংগীত আমি অনেক কাল থেকেই ভালবাসি৷ ওর মধ্যে ভাব প্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আরও কোনও সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানিনে৷’ এখানে নাট্যশক্তির কথাটা বোঝা দরকার৷ লিখছেন ‘কখনও কখনও কীর্তনে ভৈঁরো প্রভৃতি ভোরাই সুরের আভাস লাগে৷ কিন্তু তার মেজাজ গেছে বদলে— রাগ রাগিণীর রূপের প্রতি তার মন নেই৷’ ভাবের রসের প্রতি রবীন্দ্রনাথের টান বেশি হওয়ায় তাঁর সংগীত সৃষ্টিকে তাঁরই ভাষায় বলতে হয়, ‘সংগীতের উদ্দেশ্য ভাব প্রকাশ৷ যে সব নবজোয়ার আসে তা প্রলয় নয়, সৃষ্টির উদ্যম’৷ তাঁর সংগীতের চলমানতা, গতিশীলতা বিশ্ববিস্ময়কর৷ এই অন্বেষণই সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখে৷ তালের ক্ষেত্রে বলেছেন, ‘মৃদঙ্গের মধ্যে তাল নাই, গানের সুরের প্রয়োজনে তালকে বশ্যতায় রাখতে হবে৷ গান মানে—গানের ওস্তাদ আর তালের ওস্তাদের লড়াই নয়৷ কীর্তন যেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে রূপ পেয়েছে, ‘ঐ আসন তলে’ গানের মধ্যে, তেমনি প্রয়োজনভিত্তিক তাদের যতি, তাল ফেরতা এসব সাংস্কৃতিকভাবে সজীব হয়েছে ‘আনন্দধ্বনি জাগাও’ গানটিতে৷ এই কীর্তন ও তাল নিয়ে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া কীভাবে রবীন্দ্রোত্তর যুগকে প্রেরণাদীপ্ত করেছিল তাঁর দু’একটি প্রমাণ দিচ্ছি৷ কীর্তনের সুর এসেছে— রাইচাঁদ বড়ালের সুরে— ‘সাথী’ ছবিতে ‘তোমারে হারাতে পারি না’র চন্দন বনে অংশে৷ ‘শুকসারী’ ছবিতে হেমন্তদার সৃষ্টি ‘ওগো চন্দ্র বদনী’ গানে৷ আমার সুরে দ্বিজেন মুখার্জির গাওয়া ‘ভেবে তো পাই না’ গানে৷ সলিল চৌধুরি রচিত গণসংগীতের ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ এই গানটির মধ্যে৷ এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে৷ তালের তাঁবেদারি না করে তালকে নানান ভাবে ভেঙে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’, গানটির নির্মাণে ‘ওগো চন্দ্রবদনী’র সঞ্চারীতে, এই তাল ভাঙার প্রক্রিয়া আমাদের লোকসংগীতের মধ্যে যে পূর্ব থেকেই বিধৃত ছিল, তা বুঝেছিলাম বিজয় সরকারের গান শুনে৷ এমনকি উচ্চাঙ্গ সংগীতেও এই তালকে মাথায় না তুলে, তার সাংগীতিক হিসাবের বশ্যতা স্বীকার করেও আলাপ বিস্তারের মধ্যে এই মুক্তির আভাস পাওয়া যায়৷ তালকে একটি Basic জায়গায় বেঁধে জীবনের যে কোনও কথাকে ব্যক্ত করা সম্ভব৷ ওস্তাদির কাঠামো থেকে সংগীতকে শিল্প-নন্দন তত্ত্বের সীমানায় নিয়ে এলে দেখা যাবে সুর ও তালের মধ্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই৷ তবে সবই বুঝতে চাই অভিপ্রেত শিক্ষা এবং নন্দন বোধ সমৃদ্ধি নিয়ে, ওস্তাদির কারাগার থেকে সঙ্গীতকে ভাবের আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ করতে পারলে৷
কীর্তনের প্রাণপুরুষ শ্রীমন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অনুভব— ‘চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণব ধর্ম যে হিল্লোল তুলিয়াছিল সে একটা শাস্ত্র ছাড়া ব্যাপার৷ তাহাতে মানুষের মুক্তি-পাওয়া চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে আত্মপ্রকাশ করিতে ব্যাকুল হইল৷ সেই অবস্থায় মানুষ কেবল স্থাবরভাবে ভোগ করে না, সচলভাবে সৃষ্টি করে৷ এই জন্য সেদিন কাব্যে ও সংগীতে বাঙালি আত্মপ্রকাশ করিতে বসিল৷ তখন পয়ার ত্রিপদীর বাঁধা ছন্দ প্রচলিত বাঁধা কাহিনী পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা আর চলিল না৷ বাঁধন ভাঙিল— সেই বাঁধন [ভাঙা] বস্তুত প্রলয় নহে, তাহা সৃষ্টির উদ্যম৷ আকাশে নীহারিকার যে ব্যাপকতা তার একটা অপরূপ মহিমা আছে৷ কিন্তু সৃষ্টির অভিব্যক্তি এই ব্যাপকতায় নহে৷ প্রত্যেক তারা আপনাতে আপনি স্বতন্ত্র হইয়া নক্ষত্রলোকের বিরাট ঐক্যকে যখন বিচিত্র করিয়া তোলে, তখন তাহাতেই সৃষ্টির পরিণতি৷ বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব কাব্যেই সেই বৈচিত্র্যচেষ্টা প্রথম দেখিতে পাই৷ সাহিত্যে এইরূপ স্বাতন্ত্র্যের উদ্যমকেই ইংরেজিতে রোম্যান্টিক মুভমেন্ট বলে৷
এই স্বাতন্ত্র্যচেষ্টা কেবল কাব্যছন্দের মধ্যে নয়, সংগীতেও দেখা দিল৷ সেই উদ্যমের মুখে কালোয়াতি গান আর টিঁকল না৷ তখন সংগীত এমন-সকল সুর খুঁজিতে লাগিল যাহা হৃদয়াবেগের বিশেষষত্বগুলিকে প্রকাশ করে, রাগরাগিণীর সাধারণ রূপগুলিকে নয়৷ তাই সেদিন বৈষ্ণবধর্ম শাস্ত্রিক পণ্ডিতের কাছে যেমন অবজ্ঞা পাইয়াছিল, ওস্তাদদের কাছে কীর্তন গানের তেমনিই অনাদর ঘটিয়েছে৷
আজ নূতন যুগের সোনার কাঠি আমাদের অলস মনকে ছুঁয়েছে৷ কেবল ভোগে আর আমাদের তৃপ্তি নাই, আমাদের আত্মপ্রকাশ চাই৷ সাহিত্যে তার পরিচয় পাইতেছি৷ আমাদের নূতন জাগরূক চিত্রকলাও পুরাতন রীতির আবরণ কাটিয়ে আত্মপ্রকাশের বৈচিত্র্যের দিকে উদ্যত৷ অর্থাৎ, স্পষ্টই দেখিতেছি আমরা পৌরাণিক যুগের বেড়ার বাহিরে আসিলাম৷ আমাদের সামনে এখন জীবনের বিচিত্র পথ উদ্ঘাটিত৷ নূতন নূতন উদ্ভাবনের মুখে আমরা চলিব৷ আমাদের সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন চিত্রকলা সবই আজ অচলতার বাঁধন হইতে ছাড়া পাইয়াছে৷ এখন আমাদের সংগীতও যদি এই বিশ্বযাত্রার তালে তাল রাখিয়ে না চলে তবে ওর আর উদ্ধার নাই৷
হয়তো সেও চলিতে শুরু করিয়াছে৷ এশিয়ার প্রায় সকল দেশেই আজ পাশ্চাত্য ভাবের সঙ্গে প্রাচ্যের ভাবের মিশ্রণ চলছে৷ এই মিশ্রণে নূতন সৃষ্টির সম্ভাবনা৷ এই মিলনের প্রথম অবস্থায় দুই ধারার রঙের তফাতটা থেকে যায়৷ অনুকরণের জোটটা মরে না কিন্তু আন্তরিক মিলন পরে ঘটে, যদি সে মিলনে প্রাণশক্তি থাকে৷’
সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বদল হয়েছে, হচ্ছে৷ গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে৷ নাগরিক সভ্যতার প্রকাশ ক্রমবর্ধমান৷ সলিলদা আমায় একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, Urban Music আমাদেরই করে যেতে হেবে৷ কিন্তু আমি জানি এ ভাবনাও রবীন্দ্রনাথের৷ লিখেছেন, ‘আমাদের সংগীতও রাজসভা সম্রাটসভায় পোষ্যপুত্রের মতো আদরে বাড়িতেছিল৷ সে-সব সভা গেছে, সেই প্রচুর অবকাশও নেই, তাই সংগীতের সেই যত্ন আদর সেই হৃষ্টপুষ্টতা গেছে৷ কিন্তু গ্রাম্যসংগীত, বাউলের গান, এ-সবের মার নাই৷ কেন না, ইহারা যে-রসে লালিত সেই জীবনের ধারা চিরদিনই চলিতেছে৷ আসল কথা, প্রাণের সঙ্গে যোগ না থাকিলে বড় শিল্পও টিকিতে পারে না৷
কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান কালের জীবন কেবল গ্রাম্য নহে৷ তার উপরেও আর একটা বৃহৎ লোকস্তর জমিয়া উঠিতেছে যার সঙ্গে বিশ্বপৃথিবীর যোগ ঘটিল৷ চিরাগত প্রথার খোপখাপের মধ্যে সেই আধুনিক চিত্তকে আর কুলায় না৷ তাহা নূতন নূতন উপলব্ধির পথ দিয়ে চলিতেছে৷ আর্টের যে সকল স্থাবর, তার সঙ্গে এর গতির যোগ রহিল না৷ বিচ্ছেদ বাড়িতে লাগিল৷ এখন আমরা দুই যুগের সন্ধিস্থলে৷ আমাদের জীবনের গতি যেই দিকে, নীতি সম্পূর্ণ সেদিকের মত নাই৷ দুটোতে ঠোকাঠুকি চলিতেছে৷ কিন্তু যেটা সচল তারই জিৎ হইবে৷
এই যে আমাদের নূতন জীবনের চাঞ্চল্য৷ গানের মধ্যে ইহার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিয়াছে৷’
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও বাংলা কাব্য, সাহিত্য, শিল্পে তাঁর অভিনব প্রভাব যে সংস্কৃতিকে কত গতিশীল করেছে রবীন্দ্রনাথ বারবার স্বীকার করেছেন নানা ভাষায়৷ চৈতন্য ভাগবত তিনি একাধিকবার পাঠ করেছেন৷ বৈষ্ণব উদ্বোধন ও উচ্চারণ তাঁর কাছে কত আন্তরিক তা ভানুসিংহের পদাবলীতেই মাধুর্যময়ভাবে স্ফীকৃত৷ বৈষ্ণব পদাবলীর রস ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে ভানুসিংহের পদাবলীর মধ্যে৷ কীর্তনকে তাঁর অত্যন্ত গতিশীল কাব্য সমৃদ্ধ সংগীত বলে বোধ হয়েছে৷ কীর্তন সম্পর্কে আরও কিছু মন্তব্য আছে— যা আধুনিক বাংলা গানের প্রাণের স্রোতে এক গতিময় আবেগের হাল ধরেছে৷ লিখছেন,
‘কীর্তনের আরও একটি বিশিষ্টতা আছে৷ সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই৷ বাংলায় একদিন বৈষ্ণবভাবের প্রাবল্যে ধর্মসাধনায় বা ধর্মরসভোগে একটা ডেমোক্রাসির যুগ এল৷ সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কণ্ঠে প্রকাশ পেতে চেয়েছিল৷ সে প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তায় ঘাটে৷ বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছ্বাস গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল৷ এটা বাংলাদেশের ভূমি প্রকৃতির মতোই৷ এই ভূমিতে পূর্ববাহিনী দক্ষিণবাহিনী বহু নদী এক সমুদ্রের উদ্দেশে পরস্পর মিলে গিয়ে বৃহৎ বিচিত্র একটি কলধ্বনিত জলধারার জাল তৈরি করে দিয়েছে৷’ বাংলা গানের ইতিহাসেও গণসংগীতে এই সমবেত উচ্চারণের আবেগ ও বলিষ্ঠতাকে খুঁজে পাই৷ চৈতন্যদেব কীর্তন দিয়েই শুরু করেন গণআন্দোলন৷
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন— ‘কীর্তনে, বাঙালির গানে, সংগীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই৷
‘শুকসারী’ ছবির হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত মান্না দে-র গাওয়া ‘ওগো চন্দ্র বদনী’— গানটা যখন কেউ শুনবেন আত্মস্থ হয়ে, তখন আধুনিককালের চলচ্চিত্রেও সংগীতে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি গড়া সম্ভব তার প্রমাণ মিলবে৷ কীর্তনের ঐতিহ্য নিয়ে এই আধুনিক নির্মাণ সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের বাণীরই যথার্থ প্রকাশ ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা’৷ কীর্তন ও চৈতন্যদেবের নবযুগ সৃষ্টি করা ও ধর্মীয় অচলায়তন আঁকড়ে শাস্ত্রবোধের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে চলমানতার ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশের প্রেক্ষিতে আরও রবীন্দ্রনাথের বাণী— লিখছেন— ‘চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলাদেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল৷ তখন একখণ্ডবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গহিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নতুন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল৷ তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল৷ বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নতুন কীর্তন উঠিল৷ যেমন ভাব তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর— অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্রন্দনধ্বনি৷ বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরহিণীর বৈঠকি কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া নীলাকাশের তলে দাঁড়াইয়া সমস্ত বিশ্বজগতের ক্রন্দনধ্বনি৷’
রবীন্দ্রনাথের এই সব বাণী থেকে ও তাঁর সৃষ্টি থেকে বোঝা যায় স্বদেশি ঐতিহ্যের সমস্ত সংগীত ও ভাব উপাদানকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন, ব্যবহার করেছেন, সৃষ্টিতে প্রয়োগ করেছেন কিন্তু তা ভাবের বিকাশের প্রয়োজনে৷ জীবন ও সংগীতের নব সৃষ্টির প্রয়োজনে, সার্থক আর্টের প্রেরণায়৷ জীবনের সত্যবোধের বিকাশের সাংগীতিক স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে৷ লিখছেন— ‘হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারার বিকাশ যেভাবে হয়েছে, আমাদের বাংলা সংগীতের ধারা সেভাবে বিকাশ লাভ করেনি৷ এ দুটোর মধ্যে প্রকৃতিভেদ আছে৷ বাংলার সংগীতের বিশেষত্বটি যে কী তার দৃষ্টান্ত আমাদের কীর্তনে পাওয়া যায়৷ কীর্তনে আমরা যে আনন্দ পাই সে তো অবিমিশ্র সংগীতের আনন্দ নয়৷ তার সঙ্গে কাব্যরসের আনন্দ একাত্ম হয়ে মিলিত৷’
এতো কাব্যের কথা, কিন্তু সুর? লিখছেন
‘কীর্তনে সুরও অবশ্য কম নয়৷ তার মধ্যে কারুনিয়মের জটিলতাও যথেষ্ট আছে৷ কিন্তু, তা সত্ত্বেও কীর্তনের মুখ্য আবেদনটি হচ্ছে তার কাব্যগত ভাবের, সুর তারই সহায় মাত্র৷ এ কথাটা আরও স্পষ্ট বোঝা যায় যদি কীর্তনের প্রাণ অর্থাৎ আঁখর কী বস্তু সেটা একটু ভেবে দেখা যায়৷ সেটা শুধু কথার তান নয় কি? হিন্দুস্থানী সংগীতে আমরা সুরের তান শুনে মুগ্ধ হই, সংগীতের সুরবৈচিত্র্য তানালাপে কেমন মূর্ত হয়ে উঠতে পারে সেইটেই উপভোগ করি— নয় কি? কিন্তু, কীর্তনে আমরা পদাবলীর মর্মগত ভাবরসটিকেই নানা আঁখরের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে নিবিড়ভাবে গ্রহণ করি৷ এই আঁখর, অর্থাৎ বাক্যের তান, অগ্নিচক্র থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো কাব্যের নির্দিষ্ট পরিধি অতিক্রম করে বর্ধিত হতে থাকে৷ সেই বেগবান অগ্নিচক্রটি হচ্ছে সংগীত সম্মিলিত কাব্য৷’
কাব্য ও সংগীতের মধ্যে এই হরপার্বতী সম্পর্ক যে দাম্পত্য নিবিড়তার ভাব তা বারবার রবীন্দ্রনাথের বাণীতে ধ্বনিত হয়েছে৷ অনেক সময় আধুনিক নির্মাণে আমরা লক্ষ্য করেছি কথার যেন কোনও দায় নেই কেবল একটা সুর বসালেই হল৷ তাতে তো communication হয় না৷ Art-এর মূল দায় communicatoin. ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ের’ বদলে কেবল ছন্দে মিলে গেল বলে তার বদলে গাওয়া যাবে কি ‘বাড়িতে মেথর এলো ঝ্যাঁটা হাতে’— এ রকম তো হয় না৷ বাণীর ভাবটিই সুরে প্রকাশিত করতে হবে৷ তাই বাণীর ঐশ্বর্য, মাধুর্য, জীবনবোধ সবটাই ভাবতে হবে সুর সংযোগের সময়৷ আবার বাণীর বাহাদুরিতেই যে একটা সংগীত সৃষ্টি সার্থক হবে— তাও নয়৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বাংলা পড়িবার সময় অনেক পাঠক অধিকাংশ স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করিয়া টানিয়া টানিয়া পড়েন৷ নচেৎ সমমাত্র হ্রস্বস্বরে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ কুলাইয়া উঠে না৷ বাংলার শব্দের মধ্যে এই ধ্বনির অভাববশত বাংলায় পদ্যের অপেক্ষা গীতের প্রচলনই অধিক৷ কারণ, গীত সুরের সাহায্যে প্রত্যেক কথাটিকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ নিবিষ্ট করিয়া দেয়৷ কথায় যে অভাব আছে সুরে তা পূর্ণ হয়৷ এবং গানে এক কথা বারবার ফিরিয়া গাহিলে ক্ষতি হয় না৷ যতক্ষণ চিত্ত না জাগিয়া উঠে ততক্ষণ সংগীত ছাড়ে না৷ এই জন্য প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে গান ছাড়া কবিতা নাই বলিলে হয়৷ ইউরোপীয় সাহিত্যে এক শ্রেণীর কবিতাকে ‘লিরিক’ নাম দেওয়া হয়েছে৷ তার থেকেই বোঝা যায় সেগুলি গান গাওয়ার যোগ্য৷ এমনকি, কোনও এক সময়ে গাওয়া হত৷ মাঝখানে ছাপাখানা এসে শ্রাব্য কবিতাকে পাঠ্য করেছে৷ বর্তমানে গীতিকাব্যের গীতি অংশটা হয়েছে উহ্য৷’
বাংলা আধুনিক গানের যে যুগটা স্বর্ণযুগ বলে সাধারণ মানুষ বেছে নিলেন— তার পরবর্তী সময়ের গানের বাণীতে বারবার উঠে এল আধুনিক কবিতার বিষয়৷ তাদের ধারণা কবিতায় সুর সংযোজন করলেই ভাল একটি সংগীত নির্মাণ হবে৷ কবিরা গীতিকবিতার কবিদের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করল৷ তাদের ধারণা কবিতার চলন বলন উপাদন গানের বাণীতে সংযোজিত করলে গানের মান উৎকৃষ্ট হবে৷ নির্মাতা ও কিছু শিল্পীদের এমনই এক ধারণা সৃষ্টি হল৷ কিন্তু তার অনেক গান মগজে পৌঁছলেও কেন হৃদয়ে পৌঁছল না তা তারা ভেবে দেখেন না৷ এর ব্যাখ্যাও রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঋষিতুল্য অস্তিত্ব— তার অপরিসীম দূরদর্শিতা— আর তাই বোধহয় রবীন্দ্র পরবর্তী যুগকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে এই ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন৷ নির্ণয় করে দিয়েছেন, বাণী ও সুরের মিলনের পথকে যাতে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণের সময় রক্ষণশীলরা যেন উদার হন আর প্রগতিশীলরা স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারী না হন৷ কবিতার মধ্যেও যে জাতের তফাত আছে সেই বোধকে কাজে না লাগিয়ে পদ্যে সুর দেওয়া যে ভুল তা তিনি ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘গানের কবিতা, সাধারণ কবিতার সঙ্গে কেহ যেন এক তুলাদণ্ডে ওজন না করেন৷ সাধারণ কবিতা পড়িবার জন্য ও সংগীতের কবিতা শুনিবার জন্য৷ উভয়ে যদি এতখানি শ্রেণীগত প্রভেদ হইল, তবে অন্যান্য নানা ক্ষুদ্র বিষয়ে অমিল হইবার কথা৷ অতএব গানের কবিতা পড়িয়া বিচার না করা উচিত৷ খুব ভাল কবিতাও গানের পক্ষে হয়ত খারাপ হইতে পারে এবং খুব ভাল গানও হয়ত পড়িবার পক্ষে ভাল না হইতে পারে৷’ আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ সুকান্ত ভট্টাচার্যর রচিত কবিতা ‘অবাক পৃথিবী’ ও ‘রানার’ সলিল চৌধুরি সুরারোপিত হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ইতিহাস হয়ে গেল৷ আমি ঠিকানা কবিতা নিয়ে সুর করতে চেষ্টা করি৷ কিন্তু কবিতাটির শুরুর দিকের Lyric ধর্ম শেষ দিকে poetry হয়ে গেছে— বুঝলাম এটা সুর দিলে শেষরক্ষা হবে না৷ পরে সেই চিন্তা সত্য হল৷ একই কবি— একই সুরকার, একই শিল্পী অথচ ঠিকানা— অবাক পৃথিবী ও রানারের মত সার্থকতা পেল না৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘গানের কবিতা পড়া যায় না, গানের কবিতা শুনা যায়৷ গুন গুন করিতে করিতে যখনই একটা লাইন লিখিলাম, ‘তোমার গোপন কথাটি, সখী, রেখো না মনে,’ তখনই দেখিলাম সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া পৌঁছতে পারিল না৷’ সংগীতবোধকে বাদ দিয়ে কেবল বিচ্ছিন্নভাবে বাণীর ওপর বিশেষ আধিপত্য বিস্তার রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেননি৷ বলেছেন, সংগীত বাদ দিয়ে বাণী-ভাবনা, গণেশকে বাদ দিয়ে তাঁর ইঁদুর পূজা করার সামিল৷ বাংলা গানে বাণী ও সুরের সম্পর্ক সার্থক দাম্পত্য জীবনের মতো৷ সেখানে পুরুষ শাসিত বা নারী শাসিত আধিপত্য চলবে না৷ এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘দিনের শেষে’ ‘তুমি কি কেবলি ছবি’ এ সব তো কবিতা তা সংগীতে রূপান্তরিত হয়েছে কী করে? তার উত্তর যেটা সেটাই আজকের যারা কবিতাকে গানে আনতে চাইছেন তাদের ভাবনার জায়গা৷ সেটা হচ্ছে যে এমন কবিতাতেই সুর সংযোজন করা যাবে যার মধ্যে গীতিকবিতার উপাদান আছে৷ যেমন ‘রানার’, ‘পাল্কি চলে’, ‘ছিপখান তিনদাঁড়’, ‘সাগর থেকে ফেরা’, ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’৷
কাব্যে সুর সম্পর্কে আরও একটা কথা বলব—
কবিতায় সুর সৃষ্টি এ-ও রবীন্দ্রনাথেই আমরা প্রথম পাচ্ছি, তাই নয়, পরবর্তীকালে আধুনিক বাংলা গানে গদ্য কবিতায় যে সুর হয়েছে, তারও সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথে৷ একটা দৃষ্টান্ত—
”আমি চাই তারে
আমারে দিলেন যিনি সেবিকার সম্মান
ঝরে পড়া ধুতরো ফুল
ধুলো হতে তুলে নিলেন যিনি দক্ষিণ করে৷”
কোথায় অন্তর্মিল? পুরো গদ্য কবিতা৷
রবীন্দ্রনাথের গান যত অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছি ততই অনুভব করেছি রবীন্দ্রনাথের সেই বাণী৷ ‘আমাদের মুক্তি মোক্ষ নয়, আমাদের মুক্তি প্রেম৷ যা চৈতন্যদেবের বাণীরই প্রতিধ্বনি৷ রবীন্দ্রনাথ জীবনকে, প্রকৃতিকে, ব্যক্তি প্রেমকে, ঈশ্বর প্রেমকে একই প্রেমের হৃদয় দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন৷ শ্রদ্ধেয় চিত্র পরিচালক শ্রীতরুণ মজুমদার তাঁর ছবিতে বারবার পূজা পর্যায়ের গান এনে ব্যক্তি প্রেমের আঙিনায় ব্যবহার করে, আমার গুরুদেব সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতীর বাণী ‘প্রেমই ঈশ্বর, প্রেম পূজা’কে জীবন্তভাবে প্রমাণ করেছেন৷ স্বর্ণযুগের সময়ে একটা কথা খুব চালু ছিল৷ হেমন্তদার ‘তুমি’ শব্দটির উচ্চারণে Divinity আছে৷ আর শ্যামলদার ‘তুমি’ উচ্চারণে earthly বোধের মর্মস্পর্শ আছে৷ মৃন্ময়ীকে পূজা করেই যে চিন্ময়ীকে পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার সত্য হয়ে ধরা পড়েছে৷ তাই তো দাদার কীর্তি ছবিতে ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’, কাঁচের স্বর্গে ‘আগুনের পরশমণি’-তে পূজার রূপ ধরে প্রেমের দৃশ্যকে তরুণ মজুমদার প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছেন৷ স্বর বিতান ২৩ খণ্ডের প্রতিটি গান পূজা পর্যায় কেবল একটি বাদে সেটা হচ্ছে ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনে ধ্রুবতারা৷ এটি প্রেম পর্যায়ের সেই শাশ্বত বাণী প্রিয়রে করেছে দেবতা আর দেবতারে করেছি প্রিয়-বাণীর জীবন্ত স্বাক্ষর৷
প্রেম যে পঞ্চভাবরস রঞ্জিত৷ হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা, মান অভিমান, বিরহ মিলনের বিচিত্র দ্বন্দ্ববোধ নিয়েই তো প্রেমের দৃশ্যে প্রেমের গানের বিন্যাস৷ সেই অর্থে সব গানই তো প্রেম সংগীত৷ ব্যক্তি প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, দেশ প্রেম ঈশ্বর প্রেম ইত্যাদি৷ তাছাড়া মানুষের জীবনও তো বিচিত্র তরঙ্গময়৷ তার চলনে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া থাকবেই৷ থাকবেই ছয় ঋতুর মতো জীবনের তাপ, ঝড়, বৃষ্টি, ভাললাগা, মন্দলাগা, কষ্ট-দুঃখ, আনন্দ, হাসি ইত্যাদি নানা তরঙ্গ৷ আর এই দ্বন্দ্ব আছে বলেই তো ভগবানের লীলার এত বৈচিত্র্য৷ তাই সংগীত যদি জীবনসম্মত করতে হয়— তবে সমস্ত জীবনের সুরগুলোকে তার দ্বন্দের বোধের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে৷ যা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন৷ কিন্তু ভারতীয় সংগীতের অনন্ত ভাব রূপ থাকা সত্ত্বেও এই দ্বন্দ্ব প্রকাশের আঙ্গিকগত মুক্তি নেই৷ ভারতীয় সংগীত, ভারতীয় সামন্ত প্রথায় গঠিত৷ বাদী [রাজা] সমবাদী [মন্ত্রী] অনুবাদী [পারিষদ] বিবাদী [বিরোধী পক্ষ]৷ বিবাদি পক্ষ অবশ্য বিবাদ করে না রাজনৈতিক মঞ্চের বিবাদীদের মতো, বরঞ্চ আভরণযুক্ত করে, তবু পরিকাঠামোয় তার রাজা বা জমিদারের কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে হয়৷ কিন্তু এই শৃঙ্খলিতভাব— সংগীতের চলমানতার স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে৷ যেমন আমি যদি একজনকে ভালবাসি, তাঁর সঙ্গে আমার যে প্রেম বিন্যাসের আনন্দ বেদনা, মিলন বিরহ তার সমস্যা নিয়ে আমায় যদি বাদী [রাজা বা জমিদারের] দুয়ারে উপস্থিত হতে হয় তা অস্বাভাবিক৷ আমার ভালবাসার তরঙ্গকে আমি আমার শিল্প নন্দন বোধ দিয়ে যদি গড়ে তুলতে চাই— তখন আমার সামন্ত পরিকাঠামো ভাঙতেই হবে, আমার ভাব বিকাশের প্রয়োজনে— তা না হলে আমি আমার জীবনের সত্য ছবি আঁকতে কিছুতেই পারব না৷ সৃষ্টিকে মিথ্যার ওপর রচনা করা যায় না৷ বিখ্যাত সংগীত বোদ্ধা শ্রী রাজ্যেশ্বর মিত্রের একটি রচনায় পড়েছি— কবি জয়দেব গীতগোবিন্দ রচনার সময়েই এই পরিকাঠামো ভাঙার তাগিদ অনুভব করেন ভাবের প্রয়োজনে৷ রবীন্দ্রনাথও এই ভাবের তাগিদ থেকেই বুঝতে পারেন আমাদের এই বাদী সমবাদী নির্ভর যে ঐশী সুর তার ভাবের বৈচিত্র্যকে যদি আমরা ইউরোপীয় সংগীতের দ্বন্দ্ববাদী সুর, সিম্ভনির পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারি— তবেই এই সাংগীতিক মিলনে আমাদের সংগীতকেই নবজন্ম দেবে৷ তাই তো এটাই রবীন্দ্রনাথের ভাবধারা— ‘আমাদের শিল্পকলায় সম্প্রতি যে উদবোধন দেখা যাইতেছে তাহার মূলেও য়ুরোপের প্রাণশক্তির আঘাত রহিয়াছে৷ আমার বিশ্বাস সংগীতেও আমাদের সেই বাইরের সংস্রব প্রয়োজন হইয়াছে৷ তাহাকে প্রাচীন দস্তুরের লোহার সিন্দুক হইতে মুক্ত করিয়া বিশ্বের হাটে ভাঙাইতে হইবে৷ য়ুরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ভাল করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সংগীতকে আমরা সত্য করিয়া বড় করিয়া ব্যবহার করিতে শিখিব৷ য়ুরোপীয় সভ্যতা আমাদের দুয়ারে এসেছে— আমরা কি পাথর না বর্বর যে তার উপহারের ডালি প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়াই আমাদের ধর্ম হয়ে উঠবে? যদি একান্ত অবিমিশ্রতাকেই গৌরবের বিষয় করা হয়, তাহলে বনমানুষের গৌরব মানুষের গৌরবের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়৷ কেন না মানুষের মধ্যেই মিশল আছে, বন মানুষের মধ্যে মিশল নেই৷
‘গীত ও হার্মনির যে মিলিবার দিন আসিয়াছে সেই মিলনের আয়োজনও শুরু হইয়াছে৷’ লিখছেন বিশ্বকবি৷ আরও লিখছেন,
‘একটা প্রশ্ন… য়ুরোপীয় সংগীতে যে হার্মনি আমাদের সংগীতে তাহা চলিবে কি না৷ প্রথম ধাক্কাতেই — ‘না ওটা আমাদের গানে চলিবে না ওটা য়ুরোপীয়৷ কিন্তু হারমণি য়ুরোপীয় সংগীতে ব্যবহার হয় বলিয়াই যদি তাকে একান্তভাবে য়ুরোপীয় বলিতে হয় তবে একথাও বলিতে হয় যে, দেহতত্ত্ব অনুসারে য়ুরোপে অন্ত্র চিকিৎসা চলে সেটা য়ুরোপীয়, অতএব বাঙালির দেহে ওটা চালাইতে গেলে ভুল হইবেই৷ হার্মনি যদি দেশ বিশেষের সংস্কারগত কৃত্রিম সৃষ্টি হইত তবে তো কথাই ছিল না৷ কিন্তু যেহেতু এটা সত্যবস্তু৷ ইহার সম্বন্ধে দেশকালের নিষেধ নাই৷’
এই সমস্ত বাণী থেকে নিশ্চয় এটা পরিষ্কার যে রবীন্দ্রসংগীত এসরাজি কারাগারে বন্দী নেই৷ যিনি এসরাজ সহযোগে গাইতে চান তার যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনি যে পিয়ানো নিয়ে গাইতে চায় তাকে নিন্দা করাটা সভ্যতার, প্রগতি ও সজীবতার পরিপন্থী৷ ওই জন্যেই বলেছেন চাঁপাফুলের বাগানে স্থলপদ্মের চাষ না করে স্থলপদ্মের বাগানে চাষ করতে৷ তবে বলেছেন, ‘হার্মনি অতিমাত্রায় প্রবল হইলে ‘গীতটিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফ্যালে৷’ এ বিষয়টা সজাগ হওয়া জরুরি৷ যে কোনও সৃষ্টিই তার বিষয়কে অতিক্রম করে আঙ্গিক সর্বস্ব হয়ে উঠলে শিল্পের যে মূল উদ্দেশ্য— Communication সেটাই ব্যর্থ হবে৷ যা ইদানীং বহু কাজে ঘটছে৷ কারণ অনেকে সংগীতায়োজন করছেন সংগীত শিখে কিন্তু রবীন্দ্র জীবন দর্শনের শিক্ষার ধার ধারছেন না৷ রবীন্দ্র জীবন চিন্তার সঙ্গে একাত্ম না হয়ে কেবল তাঁর সংগীতকে বিচ্ছিন্নভাবে আঙ্গিকগত রূপে চিনতে চেষ্টা করলে সেই সৃষ্টি জারজ ছাড়া কিছু না৷ আবার সংগীতে সেভাবে শিক্ষিত না হয়ে শুধু রবীন্দ্র ভাবধারাকে বুঝে সংগীতকে প্রকাশ করতে গেলে, তা-ও হবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অবিচার— কারণ দুটি বিষয়— জীবন ও সংগীত— দুটিই রবীন্দ্রনাথের স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মীকরণ হয়েছিল৷ সাধক শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস ব্রাত্য হয়ে গেলেন এই কারণেই৷ তিনি জীবন দর্শন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সুরে দন্দ্ববাদকে আবিষ্কার করলেন কিন্তু যন্ত্র সংগীত ব্যবহার করলেন রবীন্দ্র চিন্তাহীন যন্ত্রসংগীতবিদদের ওপর নির্ভর করে, রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশিত হয় তাঁর মর্জিমাফিক৷ স্রষ্টার চিন্তার তিনি ধার ধারেন না৷ আরও একটা কথা বোঝা জরুরি৷ রবীন্দ্রনাথ বলছেন art-এ সংযমের কথা: লিখছেন— ‘Art is never an exhibition৷ but a revelation-exhibition-এর গর্ব তার অপরিমিত বহুলত্বে, revelation-এর গৌরব তার পরিপূর্ণ ঐক্যে৷ সেই ঐক্যে থামা বলে একটা পদার্থ আছে, চলার চেয়ে তার কম মূল্য নয়৷ সে থামা অত্যন্ত জরুরি৷ ওস্তাদি গানে সেই জরুরি নেই৷ সে কেন যে কখনোই থামে তার কোনও অনিবার্য কারণ দেখি নে৷ অথচ সকল আর্টেই সেই অনিবার্যতা আছে, এবং উপাদান প্রয়োগে তার সংযম ও বাছাই আছে৷’
এই গ্রহণ-বর্জনের প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে দুটি ঘটনা৷ দুটিই দুই স্বনামখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর৷ একজন একদিন ‘সংগীত চিন্তা’ নিয়ে আলোচনা সভায় রবীন্দ্রনাথের গানের নির্মাণ আলোচনা হচ্ছে— বললেন দেখুন ভাই আমি কিন্তু puritan— গানটা যেন তাঁর—রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশিত হয় তাঁর মর্জিমাফিক৷ স্রষ্টার চিন্তার তিনি ধার ধারবেন না৷ আর একজন তিনিও স্বনামখ্যাত বললেন, গীতবিতানে নতুন করে আপনাদের সুর দেওয়া উচিত তাতে রবীন্দ্রসংগীতের নবজন্ম লাভ হবে৷ কী সাংঘাতিক বিকৃত উচ্চারণ৷ দুজনের অভিব্যক্তিই আমার মনে হয়েছে চট্টগ্রামের ঘোড়ার গাড়ির সংলাপ৷ ‘কত্তা কইয়েন না, ঘোড়ায় হাসব৷’ আসলে দুজনের কেউই রবীন্দ্র আনুগত্য না মেনে নিজেদের রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বে বসিয়েছেন৷ আর আমরা যারা আধুনিক সংগীত নির্মাতা তারা এই পদ্ধতির সাহায্য নিয়েই আধুনিক বাংলা গানকে ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিক করেছি৷ যেমন সলিল চৌধুরি সুরারোপিত রানার গানটিতে, রানার রানার এ বোঝা টানার দিন করে শেষ হবে? এই শব্দটি— কোমল গান্ধারে দাঁড়ানো, রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে দাঁড়ানো শুদ্ধ ‘রে’তে— এই দাঁড়ানোগুলোয় প্রশ্নবোধক ভাবই প্রকাশিত হচ্ছে৷ চুরমার করে দিচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক বাদী সমবাদীর অস্তিত্ব৷ এই প্রশ্নবোধক সুর আমরা আগে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে-‘এ কী গভীর বাণী?’ বাণী শব্দটির ‘নি’-তে দাঁড়িয়ে বাদী অনুবাদীর শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছে— জীবন প্রশ্নে সমৃদ্ধ৷ তাই সলিল চৌধুরি প্রথম নয় প্রথম রবীন্দ্রনাথই সমস্ত প্রথা ভেঙেছেন৷ কেবল তাই নয় Tonic Change অর্থাৎ সা পরিবর্তনের পথও রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখিয়েছেন, য়ুরোপীয় সংগীতের পদ্ধতিতে ভারতীয় মার্গসংগীতের পরিকাঠামোর মধ্যে বিচরণ করে৷ দৃষ্টান্ত চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে৷ মদন গাইলেন মণিপুর নৃপ দুহিতার পুরো সংলাপ— প্রত্যুত্তরে চিত্রাঙ্গদা যখন ধরলেন ‘পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা’— তখন তার রে টা সা ধরে প্রায় দেশ রাগের চলনের মতো গানটা এল৷ এ ছাড়া যেটি বিশেষভাবে বলতে হবে— যে শিল্প জীবনসম্মত তার ওটাপড়া দ্বন্দ্ব থাকবেই৷ তিনি ভারতীয় পর্দাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যেখানে Melody যদি বিষয়বস্তুর দ্বন্দ্ব বুঝে সেই অনুযায়ী chord বদ্ধ করা যায় তবে বোঝা যাবে পর্দাগুলো কীভাবে হৃদয়ের তরঙ্গকে তরঙ্গায়িত করেছে৷ এই সব Chord নিয়ে যদি obligato ব্যবহার করা হয় তবে বোঝা যাবে কি অসাধারণ নির্মাণ— যা আদৌ ভারতীয় তো নয়ই পরন্তু য়ুরোপীয় সিম্পনি music-এর সমগোত্রীয়৷ আসলে হার্মনি সত্যবস্তু— ইহার অভাবে আমাদের সংগীতে যে অসম্পূর্ণতা সেটা অস্বীকার করলে কণ্ঠের বা গায়ের জোর দেখানো হবে৷ আবার এ-ও বলেছেন আমাদের গানে তাকে ব্যবহার করার একটা আলাদা পদ্ধতি থাকতে হবে৷ লিখছেন৷
‘তবে কিনা ইহাও নিশ্চিত যে, আমাদের গানে হার্মনি ব্যবহার করিতে হইলে তার ছাঁদ স্বতন্ত্র হইবে৷ অন্তত মূল সুরকে সে যদি ঠেলিয়া চলিতে চায় তবে সেটা তার পক্ষে আস্পর্ধা হইবে৷ আমাদের দেশে ওই বড়ো সুরটা চিরদিন ফাঁকায় থাকিয়া চারিদিকে খুব করিয়া ডালপালা মেলিয়াছে৷ তার সেই স্বভাবকে ক্লিষ্ট করিলে তাকে মারা হইবে৷ শীতদেশের মতো অত্যন্ত ঘন ভিড় আমাদের ধাতে সয় না৷ অতএব আমাদের গানের পিছনে যদি স্বরানুচর নিযুক্ত থাকে, তবে দেখিতে হইবে তারা যেন পদে পদে আলো হাওয়া না আটকায়৷’
য়ুরোপীয় সংগীত আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী মনে এসে ঢেউ তুলছে, ‘য়ুরোপীয় সংগীতে তালের বোধটা মৃদঙ্গের মধ্যে নাই, তা হার্মনি বিভাগে গানের অন্তরঙ্গ রূপেই একাসনে বিরাজ করে৷’ এ সম্পর্কে আমার নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে আমার একটা বোধ গড়ে উঠেছে পাখোয়াজ— জ্ঞানের প্রতীক ধ্বনি, তবলা— মেহফিলের প্রতীক ধ্বনি আর খোল প্রেমের প্রতীক ধ্বনি৷ রবীন্দ্রনাথের গান বাগানে মন্দিরে, sofisticated mind-এ বিচরণ করেছে কিন্তু গৌর প্রেমের অভিসারী বৈরাগীর মতো একতারা হাতে মাঠে মাঠে অনেক সময় ঘুরতে পারেনি যদিও রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে যেভাবে উদাস করে তাতে আকাশই তার আশ্রয়৷ শব্দ ও দৃশ্যের দিক থেকে তাই আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ গানে তবলা প্রায় অচল বললেই চলে৷ দাদবা কাহারবাও পাখোয়াজে বাজালে তার জীবন বোধের যে কোনও দিকের গভীরতা অনুভব করা যায় অথচ বিষয়টিই বোধগ্রাহ্য হয়৷ আর খোল ব্যবহারে অনুভূত হয় এক পরম বৈষ্ণব রবীন্দ্রনাথের মধ্যে লুকিয়ে আছেন৷ তবু ‘Scan of lyric’ এ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে য়ুরোপীয় পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন৷ যেমন ‘উতল ধারা বাদল ঝরে’ এবং ‘দক্ষিণ হাওয়া জাগো জাগো’ দুটি গানই কাহারবা কিন্তু Scan-এ ৮ মাত্রা থেকে উঠছে৷ ভাগটা ৮৷ ১২৩৪৷ ৫৬৭ এবং গানের বাণীর ঝোঁকে ৮ নং মাত্রাটি প্রাধান্য পেয়েছে৷ এখন শাস্ত্রীয় রীতি অনুযায়ী তবলার ঠেকা করলে এর মজা নষ্ট হবে৷ যদি কেউ ৮ মাত্রায় তবলার থুন ও ডুগি ব্যবহার করে এবং ছন্দটাকে গানের বাণীর মতো ৮৷১২৩৪৷৫৬৭৷ এভাবে থুমবা ও গিটার-সহ তবলাকে ওই ছন্দে ব্যবহার করেন দেখতে পাবেন এক অতি আধুনিক ছবি বেড়িয়ে আসবে৷ এই পদ্ধতিতে দক্ষিণ হাওয়া গানটির মুখরা নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গীত, শচীনদেব বর্মনের সুরে একটি জনপ্রিয় হিন্দি গান আছে— ‘তেরি দুনিয়া মেরে’
এখন তাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কিছু মন্তব্য লিপিবদ্ধ করছি৷
‘সংগীতের একটা প্রধান অঙ্গ তাল৷ আমাদের আসরে সব চেয়ে বড়ো দাঙ্গা এই তাল লইয়া৷ গানবাজনার ঘোড়দৌড়ে গান জেতে কি তাল জেতে এই লইয়া বিষম মাতামাতি৷ দেবতা যখন সজাগ না থাকেন তখন অপদেবতার উৎপাত এমনি করিয়াই বাড়িয়া ওঠে৷ স্বয়ং সংগীত যখন পরবশ তখন তাল বলে ‘আমাকে দেখো’ সুর বলে ‘আমাকে’৷ কেননা, দুই ওস্তাদে দুই বিভাগ দখল করিয়াছে— দুই মধ্যস্থের মধ্যে ঠেলাঠেলি— কর্তৃত্বের আসন কে পায়— মাঝে হইতে সংগীতের মধ্যে আত্মবিরোধ ঘটে৷
তাল জিনিসটা সংগীতের হিসাব বিভাগ৷ এর দরকার খুবই বেশি সে কথা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু দরকারের চেয়েও কড়াক্কড়িটা যখন বড়ো হয় তখন দরকারটাই মাটি হইতে থাকে৷ তবু আমাদের দেশে এই বাধাটাকে অত্যন্ত বড়ো করিতে হইয়াছে, কেননা মাঝারির হাতে কর্তৃত্ব৷ গান সম্বন্ধে ওস্তাদ অত্যন্ত বেশি ছাড়া পাইয়াছে, এইজন্য সঙ্গে সঙ্গে আর এক ওস্তাদ যদি তাকে ঠেকাইয়া না চলে তবে তো সে নাস্তানাবুদ করিতে পারে৷ কর্তা যেখানে নিজের কাজের ভার নিজেই লন সেখানে হিসাব খুব বেশি কড়া হয় না৷ কিন্তু নায়েব যেখানে তাঁর হইয়া কাজ করে সেখানে কানাকড়িটার চুলচেরা হিসাব দাখিল করিতে হয়৷ সেখানে কনট্রোলার আপিস কেবলই খিটিখিটি করে এবং কাজ চালাইবার আপিস বেজার হইয়া ওঠে৷
য়ুরোপীয় গানে স্বয়ং রচয়িতার ইচ্ছামতো মাঝে মাঝে তালে ঢিল পড়ে এবং প্রত্যেকবারেই সমের কাছে গানকে আপন তালের হিসাব-নিকাশ করিয়া হাঁফ ছাড়িতে হয় না৷ কেননা, সমস্ত সংগীতের প্রয়োজন বুঝিয়া রচয়িতা নিজে তার সীমানা বাঁধিয়া দেন, কোনো মধ্যস্থ আসিয়া রাতারাতি সেটাকে বদল করিতে পারে না৷ ইহাতেই সুরে তালে রেষারেষি বন্ধ হইয়া যায়৷ য়ুরোপীয় সংগীতে তালের বোলটা মৃদঙ্গের মধ্যে নাই তা হার্মনি-বিভাগে গানের অন্তরঙ্গরূপেই একাসনে বিরাজ করে৷ লাঠিয়ালের হাতে রাজদণ্ড দিলেও সে তাহা লইয়া লাঠিয়ালি করিতে চায়, কেননা রাজত্ব করা তার প্রকৃতিগত নয়৷ তাই ওস্তাদের হাতে সংগীত সুরতালের কৌশল হইয়া ওঠে৷ কৌশলই কলার শত্রু৷ কেননা কলার বিকাশ সামঞ্জস্যে, কৌশলের বিকাশ দ্বন্দ্বে৷’ একটি দৃষ্টান্ত ‘আমার মনের কোণের বাইরে’—গানটি স্বরলিপিতে 6/8 ছন্দে লিপিবদ্ধ কিন্তু ওই ছন্দে তাল বাদ্য বাজলে বাঈজী বাড়ির গান মনে হবে৷ বাণীর উদাসীনতা সুবিচার পাবে না৷ গানটি 4/4 ছন্দে বাজলে তার ভাব প্রস্ফুটিত হবে—বাণীর সঠিক উচ্চারণ করা যাবে৷ ক্রিয়াত্বক প্রকাশ বতিরেখে সঠিক ভাবে বোঝানো সম্ভব না৷
কী জীবনে, কী ধর্মে, কী কাব্য সাহিত্যে, কী সংগীতে ঐতিহ্য ও প্রগতির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলাই সব থেকে বড় art and religion— রবীন্দ্রনাথ যেন সারা জীবন ধরে এইটাই বোঝাতে চেয়েছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে পূজার থালা হাতে লাল পাড় গরদ পরে, হাতে পূজার থালা নিয়ে এক লক্ষ্মী প্রতিমা গৃহবধূ মন্দিরে যাবে— তার পায়ে থাকবে আলতা— কপালে বড় লাল সিঁদুরের টিপ— মাথায় ঘোমটা— চাবি ঝোলানো আঁচলটা ঘাড়ের বাঁদিক থেকে ডান দিকে এসে ঝুলবে৷ এটাই সামঞ্জস্য৷ আজ মেয়েরা dress-এ Matchingটাকে প্রাধান্য দেয়৷ কিন্তু সে আধুনিকতা যদি মতিচ্ছন্ন ছিন্নমূল হয় তবে তা স্বাধীন শিল্প নয়— উচ্ছৃঙ্খল ও অসম্মানের নিদর্শন৷ তেমনি বাউল, কীর্তন, শাস্ত্রীয় সংগীতে বিদেশী বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার হবে এমনভাবে যাতে দেশজবোধ, আত্মিকবোধ, প্রেম অসম্মানিত হয় না৷ মিলিত উপলব্ধির রস হবে সৃষ্টি৷ রবীন্দ্রনাথ রিহার্সাল করছেন৷ একজন এসে জানাল— অনশনরত যতীন দাস প্রয়াত— রবীন্দ্রনাথ কান্নার গান রচনা করলেন না— উদ্দীপনার গান রচনা করলেন৷ ‘সর্ব খর্বতারে দহে হে তব ক্রোধ দাহ’ এতে যে ছন্দ ছিল তা সংগ্রামের বোধকে উদ্বুদ্ধ করে৷ কিন্তু সেই ছন্দকে নিয়ে যদি জনমানসকে Sex & Crime-কে উত্তেজিত করা হয়— সেটাই অসামঞ্জস্য৷ যা বিশ্বায়নের সংস্কৃতি করছে৷
একজন নিজে সংগীত নির্মাণকারী হিসাবে এই কথাই বলব আমাদের আধুনিক সৃষ্টিতে অনেক কিছু নতুন গড়ে ওঠা সত্ত্বেও এমন কিছু পথ নতুন পাইনি যা রবীন্দ্রভাবনায় আগে ধরা পড়েনি৷ প্রশ্ন উঠতে পারে যন্ত্রসংগীত সংযোজনের কথা, তাতে আমার এইটাই উত্তর, যন্ত্রসংগীতের প্রাধান্য সে যুগে না থাকায় যন্ত্রের প্রয়োগটা হয়ত তিনি সরাসরি দেখাননি, কিন্তু আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যন্ত্রানুষঙ্গর চলন পদ্ধতি, এমনকি স্বররূপও তিনি তার গানের মধ্যের চলনেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন৷ সাংগীতিক দৃষ্টান্ত দেওয়ার সুযোগ থাকলে সেটা দেখিয়ে দিতাম৷ যেখানে বোঝা যেত চার/দুই/তিন/সাত সবের মধ্যেই তিনি সিম্ভনির প্যাটার্নকে প্রয়োগ করেছেন৷ কর্ড পরিবর্তন তো বিস্ময়কর৷ আধুনিক সংগীতকারদের রবীন্দ্রনাথকে চেনাজানার প্রয়োজন আছে৷ তাতে সমৃদ্ধ হবে, আঁধারে পথ পাবে আধুনিক বাংলা গান৷
গানে যন্ত্রসংগীতের Composition ঘেঁষা পর্দা লাগাবার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি৷ ‘আজি সাঁঝের যমুনায়’ গানটিতে যদি নিম্নলিখিতভাবে কেউ যন্ত্র ব্যবহার করেন, আমার বক্তব্য মানতে বাধ্য হবেন যে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় পদ্ধতিতে পর্দা ব্যবহার করেননি৷ বাদী সমবাদী বাদ দিয়ে যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে মুক্তি দিয়ে জীবনকথাকে সুরে স্বাভাবিকভাবে বলা যায় তারই সক্রিয় দৃষ্টান্ত৷ এইভাবে যন্ত্র ভাগ করছি—
‘আজি সাঁঝের যমুনায় গো’ একটি মোটা বাঁশের বাঁশি
‘তরুণ চাঁদের কিরণ তরী’— Saxophone
‘কোথায় ভেসে যায় গো’— Body orchestra with low high combined obligato
মনে হবে একটা সিম্ভনির piece.
বর্তমানে মানুষ গুলিয়ে ফেলছেন৷ Western music বলে সমস্ত বিদেশি সুরকে আখ্যায়িত করছেন— নব বিশ্বায়ণ সংস্কৃতির তকমা গায়ে দুর্গন্ধময় জীবন গড়ে তুলতে এক বিষ মাখানো সংগীতকে বাজার তৈরির কারখানা মারফত ভারতীয় মনকে বিভ্রান্ত করার জন্য হাতিয়ার করা হচ্ছে— তাকে সংগীত বলে চালাতে চেষ্টা করা হচ্ছে৷ কিন্তু তা পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির জঞ্জাল এনে প্রাচ্যের মন্দিরে ঢালার চেষ্টা হচ্ছে— এ রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে’র বিশ্বসংগীতের মতো সংগীত না— উল্টে ভারতীয় মানস ও মননকে দূষিত করারই অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া৷ রবীন্দ্রনাথ যে অবধ্য, তাঁর গান যে সনাতন-শাস্ত্র, তাকে বধ করবে কে? আকাশকে কে কি বধ করা যায়? আজ তিনিই তো সব থেকে জনপ্রিয় সংগীতস্রষ্টা বাংলা আধুনিক গানের৷
বর্তমান সংস্কৃতির জগতে নানা পরীক্ষার হুজুক এসেছে৷ সমস্ত শিল্পকলায় ঐতিহ্যকে বুড়ো আঙুল দেখাবার এক লাগাতর চেষ্টা চলেছে৷ কিন্তু সংগীতের উপাদান comodity নয় যে তাকে Re বাদ দিয়ে Production বলা যাবে৷ মানুষ যেমন Re-production— তার সংস্কৃতিও Re-production৷ আর এই Re-টাই heritage. আর রবীন্দ্রনাথ সেই ঐতিহ্যনিষ্ট আধুনিকতার প্রয়োগ মাপনের একক৷ তাই এই নব প্রচেষ্টার নব নায়ক, সেনাপতি, সৈনিকদের কাছে অর্থাৎ সংগীতের নব নির্মাতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের বাণী উদ্ধৃতি দিয়েই আমার দায় শেষ করলাম৷ লিখেছেন—
‘আমাদের ভাব, আমাদের ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙালি যেখানে হৃদয়ের কথা বলিয়াছে সেইখানে সন্ধান করিতে হয়৷
যাঁহাদের প্রাণ বিদেশী হইয়া গিয়াছে তাঁহারা কথায় কথায় বলেন—ভাব সর্বত্রই সমান, জাতিবিশেষের বিশেষ সম্পত্তি কিছুই নাই৷ কথাটা শুনিতে বেশ উদার, প্রশস্ত৷ কিন্তু আমাদের মনে একটি সন্দেহ আছে৷ আমাদের মনে হয়, যাহার নিজের কিছু নাই সে পরের স্বত্ব লোপ করিতে চায়৷ উপরে যে মতটি প্রকাশিত হইল তাহা চৌর্যবৃত্তির একটি সুশ্রাব্য ছুতা বলিয়া বোধ হয়৷ যাঁহারা ইংরাজি হইতে দুই হাতে লুট করিতে থাকেন, বাংলাটাকে এমন করিয়া তোলেন যাহাতে তাহাকে আর ঘরের লোক বলিয়া মনে হয় না, তাঁহারাই বলেন ভাষাবিশেষের নিজস্ব কিছুই নাই, তাঁহারাই অম্লানবদনে পরের সোনা কানে দিয়া বেড়ান৷ আমারই যে নিজের সোনা আছে এমন নয়, কিন্তু তাই বলিয়া একটা মতের দোহাই দিয়া সোনাটাকে নিজের বলিয়া জাঁক করিয়া বেড়াই না৷ ভিক্ষা করিয়া থাকি, তাহাতেই মনে মনে ধিক্কার জন্মে, কিন্তু অমন করিলে যে স্পষ্ট চুরি করা হয়৷
সাম্য এবং বৈষম্য, দুটোকেই হিসাবের মধ্যে আনা চাই৷ বৈষম্য না থাকিলে জগৎ টিঁকিতেই পারে না৷ সব মানুষ সমান বটে, অথচ সব মানুষ আলাদা৷ দুটো মানুষ ঠিক এক ছাঁচের এক ভাবের পাওয়া অসম্ভব ইহা কেহ অস্বীকার করিতে পারেন না৷ তেমনি দুইটি স্বতন্ত্র জাতির মধ্যে মনুষ্যস্বভাবের সাম্যও আছে, বৈষম্যও আছে৷ আছে বলিয়াই রক্ষা, তাই সাহিত্যে আদান প্রদান বাণিজ্য-ব্যবসায় চলে৷ উত্তাপ যদি সর্বত্র একাকার হইয়া যায়, তাহা হইলে হাওয়া খেলায় না, নদী বহে না, প্রাণ টেকে না৷ একাকার হইয়া যাওয়ার অর্থই পঞ্চত্ব পাওয়া৷ অতএব আমাদের সাহিত্য যদি আমরা বলি সংগীত বাঁচিতে চায় তবে ভালো করিয়া বাংলা হইতে শিখুক৷’
আমারও প্রার্থনা, মিশ্রণ চাই, বিনিময় চাই, কিন্তু বিদেশী হতে চাই না৷ বাংলার বৈতালিক হওয়াই শ্রেয় ও প্রেয়৷ সব আভরণ নিয়েই সামজস্য রক্ষা করে বাংলাগান বাংলা গানই ‘থাকুক’৷ আধুনিক সংগীতের গলায় চুরি করা সোনার হার দেখতে চাই না৷ আমাদের বিনি সুতোর মালার সংস্কার৷ world music concept সব music-কে এক ছাঁচে ফেলা নয়৷
প্রয়োগ শিল্পকে বোঝানো যায় না৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি সংগীতের চেয়ে সংগীতের কৌশল যেন বড় না হয়ে ওঠে৷ তিনি ঐতিহ্য সুরকে শ্রদ্ধাযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন — কেবল শাস্ত্রীয় সংগীতকে না — কীর্তন, বাউল, লোকগীতির বিভিন্ন শাখার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালবাসা, আন্তরিকতা৷ ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থটি আদ্যোপান্ত পাঠ করলে তা বোঝা যাবে৷ চৈতন্যদেবের কীর্তনকে তিনি অপরিসীম মর্যাদা দিয়েছেন— কিন্তু যে কোনও ধারার সুরকে — এমনকি য়ুরোপীয় সংগীতকেও কৌলীন্য ছেড়ে গানকে তাঁর ভাব, বোধ, ও প্রকাশের সামঞ্জস্য সংগীত হিসাবে ধরা দিতে হয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের সংগীত নির্মাণে বাণী ব্যবহারেও তিনি বলেছেন, পড়ার কবিতাকে যেন গীতি কবিতার সঙ্গে এক না করা হয়৷ এ বিষয়ে সংগীত চিন্তা গ্রন্থে তিনি বলেছেন অনেক কথা৷ ইদানীং কবিতায় সুর করাটা বিশেষ বাহাদুরির মধ্যে গণ্য হচ্ছে কিন্তু সেটা কালের কাছে টিকবে না৷ কারণ কবিতার রসাস্বাদনের ইন্দ্রিয়বোধ আর গানের শ্রবণসুখ, আনন্দ ব্যথা এক নয়৷ গীতি কবিতার বোধের যে সহজ সাবলীল উপাদান তা না থাকলে একটি কবিতা গান হয়ে উঠতে পারে না৷ রবীন্দ্রনাথের এমনই অভিমত৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমাদের গান একার গান, একলার গান, কিন্তু তা কোণের এক নয় বিশ্বব্যাপী এক৷’ এই একলার গানে— একার গানের সুরের পরিকাঠামোয় সমর্পণের বোধকে বোধিত করতে পারে কিন্তু অন্তরের দ্বন্দ্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সেই দেশীয় সুর, যা Melody of perpetual life তাকে sympthonise করতেই হবে— যা রবীন্দ্রনাথ নিজের গানে সৃষ্টি করে বিশ্বসংগীতে পরিণত করেছেন বাংলা গানকে৷ ‘গীতবিতানে’ ছাপানো প্রথম যে দুটি গান তার দুটি লাইন উদ্ধৃত দিয়ে আমি বোঝাতে চাই যে, গানে তিনি দ্বন্দ্ববাদকে প্রকাশ করে তাঁর সুর রচনা করেছেন— ভারতীয় melody তে ফেলে সেই দ্বন্দ্বকে স্থিতধী করে জীবন সাধনার বাহন করেছেন৷ মানুষের হাতে আত্মসংগ্রামের হাতিয়ার তুলে দিয়েছেন৷ dialectical music তিনি accept করেছেন৷
প্রথম গান — (১) কান্না হাসির দোল দোলানো — তার দ্বিতীয় অন্তরা—
‘শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন মাঝে
অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে৷’—এ দ্বন্দ্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্য৷
(২) সুরের শুরু দাও গো সুরের ভিক্ষা
দ্বিতীয় অন্তরা ‘কোলাহলের বেগে ঘূর্ণি ওঠে জেগে
সেইখানেতেই নিয়ো তুমি আমার বীণার পরীক্ষা৷’ এও দ্বন্দ্বের সংগ্রাম থেকে বেঁচে ওঠা সংগীত ঐক্যের প্রকাশ৷
সোজাসুজি সাংগীতিকভাবে দ্বন্দ্ববাদকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন৷ ভারতীয় সংগীতের melody পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিন্তু তার পরিকাঠামোয় কেবল সামন্ততান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক মনোভাবের সমর্পণ — কিন্তু শিল্পীর অন্তর্নিহিত সংগ্রামের কাঠামো নেই৷ বাদী সমবাদী বা এক সুরের প্রবণতায় জীবনের জিজ্ঞাসার সংগ্রামের আঙ্গিক নেই — যা আছে Symphony-র মধ্যে৷ ভারতীয় সুর ও য়ুরোপীয় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে তিনি জনমানসে চরমতম, পরমতম সাধনার শুচিশুদ্ধ পুজোপচার তুলে দিয়েছেন — তাই তাঁর সংগীত বিশ্বসংগীত৷
আমি ছাপমারা আধুনিক গানের নির্মাতা হিসাবে বলতে পারি, ভারতীয় আধুনিক বিশেষ করে বাংলা গানের জনক রবীন্দ্রনাথ — এমন কোনও আধুনিক আঙ্গিক— এমনকি যন্ত্রানুষঙ্গের আয়োজন পর্যন্ত নেই যার format রবীন্দ্রনাথ করে দিয়ে যাননি৷ গদ্য কবিতায় সুর পর্যন্ত৷ তাই আমার বিচারে আধুনিক সংগীতের গবেষণায় ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থ উপক্রমণিকা আর রবীন্দ্রনাথের গান শাস্ত্রীয় সংগীত হিসাবে গণ্য করা উচিত নবনির্মাতাদের৷
রবীন্দ্রনাথের সংগীত সৃষ্টির আর একটি অভিনব অবদান তাঁর গীতিনাট্য তথা নৃত্যনাট্য৷ এক একটি নির্মাণ বিষয়ে ও সাংগীতিক বৈচিত্র্যে বিস্ময়কর৷ তার আঙ্গিকটা পুরো opera style৷ আমাদের দেশে যাত্রায়, গানে আংশিকভাবে opera form আছে, যার অনেকটা বিবেকের গানে opera ধর্মচ্যুত, কিন্তু যেখানে নাটকের চরিত্র নিজের নিজের সংলাপকে গানে গানে বলে যাচ্ছে সেখানে যে format সেটা প্রায় বিদেশি অপেরারই স্বদেশি রূপ৷ তরজা গানে, কবিগানে অনেক সময়েই নেচে নেচে যে ভাবে গাওয়া হয় তা কতটা opera-র ধরনের৷
রবীন্দ্রনাথ যে গীতিনাট্য নৃত্যনাট্যের সৃষ্টি করেছেন তার প্রয়োগে প্রকাশে ও চিন্তাভাবনা জীবন দর্শনের উজ্জ্বল্যে ও উৎকর্ষে opera-র প্রায় সমগোত্রীয়৷
‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যের বিষয়বস্তু আজও প্রাসঙ্গিক৷ এখনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাতপাতের অস্ত্রে মানুষে মানুষে বিভেদের বীজ বপন করে চলেছে৷ ধর্মান্ধতা ধর্মের আঙিনায়, নীতি ভাবনায় আধ্যাত্মিকতাতে আদর্শ আলো মেলে ধরছে না৷ সমানো মন্ত্র সমিতির শাস্ত্র মন্ত্র আজও বিভেদপন্থীদের চক্রান্তে মানুষকে, মানবতাকে অসম্মান করছে৷ রবীন্দ্রনাথ মানুষের, মনুষ্যত্বের অবমাননা সহ্য করতে পারতেন না৷ তাঁর জীবনের মূল বীজ মন্ত্র তাঁকে বলতে শিখিয়েছে ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর৷’ পিপাসার জল সামাজিক জাতপাতের বিভেদনীতির দ্বারা দূষিত হয়, এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের নয়— তাই মনুষত্বকে অসম্মানিত করা সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রচনা করলেন এই নৃত্যনাট্য৷ এই সৃষ্টির সংলাপের জীবন বোধ বিস্ময়কর, সুর সংযোজনায় দেশজ সুরের ওপর symphonic প্রয়োগ শিক্ষণীয়, গবেষণার বিষয়৷ গদ্য ছন্দকেও অসাধারণ দক্ষ সাবলীলতায় সুর সংযোজন করেছেন এই নৃত্য নাট্যে, যা রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা গানের অনেক চলনকে পথ দেখিয়েছে৷ ‘আমি চাই তারে/আমারে দিলেন যিনি সেবিকার সম্মান’— কেবল এইটুকুই ঠিক মতো গবেষণা করলে এই সত্য যাচাই হবে৷ পুরো নির্মাণ গবেষণাযোগ্য৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই opera form-কে ‘মন নিয়ে’ ছবিতে ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী— গানে ব্যবহার করেছেন৷
‘চিত্রাঙ্গদা’র বিষয়বস্তুকেও আমি বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক মনে করি৷ কারণ বিদেশি শিক্ষায় ও বিশ্বায়নের কবলে পড়ে নারী স্বাধীনতার নামে নারীর নারীত্ব বিসর্জন দেওয়ার যে নীতি আদর্শ সমস্ত সমাজটাকে একটা নগ্ন চেহারায় কুৎসিত করে তুলেছে তার প্রেক্ষিতে ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা আদর্শ ও প্রেরণামূলক গীতিনাট্য৷ যা স্বাক্ষর রেখেছে, নারীর নারীত্ব ব্যতীত কেবল পুরুষালি, নারীর শাশ্বত বোধের বিকাশকে স্তব্ধ করে দেয়৷’ রবীন্দ্ররচনার বিখ্যাত লাইন—
‘শ্যামকান্তিময়ী কোন স্বপ্ন মায়া ফিরে বৃষ্টি জলে৷
ফিরে রক্ত অলক্তক ধৌত পায়ে ধারা সিক্ত বায়ে
মেঘ মুক্ত সহাস্য শশাঙ্ক কলা সিঁথি প্রান্তে জ্বলে৷’
এই বাণীর মধ্যে যে নারীর শাশ্বতিক রূপ তা ধ্বংস করতে উদ্যত বিশ্বায়নের সংস্কৃতি৷ বর্তমান প্রজন্ম বারবার শুনুক আর বিশ্বাস করুক রবীন্দ্রনাথকে — এই ভেবে যে রবীন্দ্রনাথ সত্যদ্রষ্টা ঋষি৷ বিশ্বায়নের সংগীত ‘ভারতীয় সংগীতের বিচিত্রগামীতাকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ধারায় যেমন বিভিন্ন জীবন রস আস্বাদন করা থেকে বঞ্চিত করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার পোশাক আসাক ও সমগ্র প্রকাশকেও কুরুচিপূর্ণ করে তুলছে৷ পুরুষ ও নারীর মধ্যে ব্যবধান কমাতে যদি নারী প্যান্ট ও গেঞ্জি পরিধান করে তবে তাতে ব্যবধান বাড়বে কারণ like pole repels un like pole attracts.
সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ সব প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য কারণ জীবনের ওঠাপড়া, তার মধ্যে যে নাট্যের উপাদান তার যথাযথ সাঙ্গীতিক রূপ দিতে গেলে জীবনে জীবনের মধ্যে যে নব নব আবিষ্কার তা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং সেই ঐশী জাদুকরিতে রবীন্দ্রনাথ তার বিচিত্র প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই সব নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যে৷ যেমন ‘বাল্মীকি প্রতিভাতে’ রত্নাকর যতক্ষণ দস্যু ততক্ষণ তারা বিদেশি সুরের উদ্দীপনায় নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে৷ এমনকি কালী নামেও দস্যুবৃত্তির ছন্দ ও সুর দাপটকে প্রয়োগ করা — আর সেই বাল্মীকি যখন উচ্চারণ করলেন, ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সুরের মধ্যে ফিরে এল ভারতীয় বোধের সংস্কারের সুর৷ কেবল তাই নয়, কালীপুজা করে যে দস্যুবৃত্তির জীবন তা যখন সরস্বতীর আশ্রয় পেল, যা রত্নাকরের স্বধর্মের বিকাশ বিগ্রহ — তখন ‘মা লক্ষ্মী’ও তাঁর গ্রহণযোগ্যতাতে স্থান পেলেন না৷ বর্তমান সময়ে শিল্প আর art নেই, হয়েছে industry– এই দুঃসময়ে বাল্মীকির শেষ অংশ শুনতে শুনতে যে কোনও শিল্প দায়বদ্ধ সৎরুচির নয়ন সিক্ত হবে৷ আর বিস্ময়কর এই নাটকের সুর, ছন্দ, তাল, Scan ভাগ৷ দস্যু অবস্থায় অনেক গানে ভারতীয় সুর বা তার চলনকে বাঁধা যেত কিন্তু সংগীতে সুরের আবেগ এবং Vocal modulation tone-কে ব্যবহার করার জন্যে তিনি এতটাই আধুনিক আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন, যা ২০১০ সালেও গবেষণার বিষয়৷ কাজটি সামনে রেখে এই সব সৃষ্টির উৎকর্ষ, নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তরিক চর্চা করলে বোঝা যাবে রবীন্দ্র সৃষ্ট শিল্প, সংস্কৃতি জীবনের সঙ্গে কতটা যুগপৎ অধ্যাত্মচেতনায় ও আধুনিক ভাবনায় সম্পৃক্ত৷
‘শ্যামা’ নিয়ে গভীর আলোচনা করা উচিত৷ উত্তীয় চরিত্রের মহানুভবতা নিয়ে উত্তীয়কে বড় করে দেখা হয়— কিন্তু বজ্রসেনকে নিয়ে ভাববার অবকাশ আরো বেশি৷ কারণ উত্তীয়র প্রেম অন্ধ — তার আত্মাহুতি শ্যামাকে পাপের পথে ঠেলে দিয়েছে৷ কিন্তু বজ্রসেন?— শ্যামার পাপের ভাগ নিজের জীবনে তুলে দিয়ে তার বিদগ্ধ প্রেমকে বিচ্ছেদের হাতে তুলে দিয়েও তার প্রেমিকাকে সে নিষ্কলুষ করতে চেয়েছে৷ তুল্যমূল্য বিচারের প্রয়োজন আছে —
উত্তীয় গাইল— ‘প্রিয় যে তোমার বাঁচাবে যারে নেবে মোর প্রাণলীন
তাহারি সঙ্গে তোমারই বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন
মরণ ডোরে
কেমনে ছাড়িবে মোরে?’
আপাত ত্যাগ কিন্তু প্রেম সব দিক থেকে মায়া, বিকারকে প্রশ্রয় দিল৷ প্রেমের শাশ্বত দীপ্তি ম্লান হল৷ কিন্তু বজ্রসেন?
বজ্রসেন গাইল — ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষম হে মম দীনতা
পাপী জন শরণ প্রভু —
মরিছে তাপে মরিছে লাজে প্রেমের বলহীনতা৷
প্রিয়ারে নিতে পারিনি বুকে, প্রেমেরে আমি হেনেছি
পাপীরে দিতে শান্তি শুধু পাপেরে ডেকে এনেছি৷
এই উচ্চারণে বোঝা যায় শ্যামাকে ছাড়তে তার কত কষ্ট — তবু বুকে সেই কষ্টকে বয়ে সে শ্যামাকে উত্তীয় বধের পাপ থেকে রক্ষা করার জন্যে গাইল—
‘জানি গো তুমি ক্ষমিবে তারে
যে অভাগিনী পাপের ভারে
চরণে তব বিনতা
ক্ষমিবে না ক্ষমিবে না
আমার ক্ষমাহীনতা৷
পাপী জন শরণ প্রভু৷’
উত্তীয় শ্যামাকে পাপকর্মে সহযোগিতা করেছে— আর বজ্রসেন তাকে সেই পাপ থেকে উদ্ধার করার জন্যে ‘পাপী জন শরণ প্রভু’ — স্বয়ং ঈশ্বরের পদতলে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছেন৷ মানবতার কোন উচ্চ শিখরে উঠলে এই গান, এই নাটক রচনা করা যায়? জন্মে জমে তপস্যা করে এই সন্ন্যাসী অন্তরকে একজন তৈরি করতে পারবে না৷ আর এর সুর, সাংগীতিক অভিব্যক্তি কেমন আমি আমার ধারণা দিয়ে প্রকাশ না করে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি৷
বোম্বে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক প্রযোজক, ভি শান্তারাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ‘শিবশক্তি’ বলে একটা ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি পারবে তো?’ হেমন্তদা তাঁকে পুরো শ্যামা শুনিয়ে দিয়ে বলেছিলেন — আমি পারবো আমার কাছে সোনার খনি আছে৷
নব বিশ্বায়নের শিল্প সংস্কৃতি যখন পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতির জঞ্জাল এনে প্রাচ্যের মন্দিরে ঢেলে দিচ্ছে তখন পৃথিবীর সমস্ত শুভ শক্তির পক্ষে কাজ করার যে বিশ্বমানব সভ্যতার সংহতির যে গান, রবীন্দ্রনাথের গান সেই বিশ্বসংগীত — যা ঐতিহ্য ও রুচিশীল মানব জীবনের পক্ষে, সুস্থ পৃথিবী গড়ার পথে এক সত্যিকার সংগীত — যা বিশ্বায়নের দাস নয়, আন্তর্জাতিকতার সার্থক রসায়ন৷ আসুন আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি ‘রবীন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রসংগীতকে — গেয়ে উঠি ‘সমানো মন্ত্র সমিতি সমানি’৷