ব্রাত্য নয় প্রাজ্ঞ সঙ্গীত-সাধক দেবব্রত বিশ্বাস
|| জাগা দেশ হামারা/জাগা জাগা/দেশ হামারা || —গিরিকন্দর থেকে যেন সাম মন্ত্রের মন্দ্রধ্বনি উঠে আসছে ওপরে? প্রশ্ন জাগে, কে তুমি তাপস? এমন গিরি-গম্ভীর বৈদিক সঙ্গীত শোনাচ্ছ তোমার কণ্ঠ-ঐশ্বর্য দিয়ে? যেন দূর থেকে ভেসে আসছে সাগরের অতল থেকে বোধের সামগান৷ না, গানটি সামগানও নয়— পাহাড়ের গুহা থেকে উঠেও আসছে না,— হচ্ছে একটি মঞ্চে— কিন্তু অভিব্যক্তিতে তার পরিবেশনা আমায় এমনই একটা ভারত আত্মার অনুভবে নিয়ে গেল৷ শুনছি ‘জাগা দেশ হমারা’— কিন্তু মনে হচ্ছে শুনছি—
‘প্রথম প্রভাত উদয় তব গগনে
প্রথম সামরব তব তপোবনে
প্রথম প্রচারিত তব বন ভবনে
জ্ঞান ধর্ম কত কাব্য কাহিনী৷’
আমি অভিভূত, আমি বিস্মৃত আমার অস্তিত্ব৷ ভাবলাম এ কোন গন্ধর্ব, যার কম্বুধ্বনি আমায় এমনভাবে বিমোহিত করল৷ সারারাত আধো ঘুমে আধো জাগরণে শুনলাম৷ ‘জাগা দেশ হামারা/জাগা জাগা দেশ হামারা৷’ কার কণ্ঠস্বর পরে বলছি— তার আগে একটা ঘটনা বলি৷
সঙ্গীত-পরিচালক শ্রীপ্রবীর মজুমদার, যদিও বন্ধু আমার দাদার, কিন্তু সঙ্গীতজীবনের পথচলায় তিনি আমারই সাথী৷ আমার জীবনে এক কল্যাণময় অস্তিত্ব৷ আমার সঙ্গীতজীবনে তাঁর অবদান অনেকখানি৷ বিভিন্ন প্রবন্ধে সে কথা আমি লিখেছি৷ বয়স পরিবর্তনের সময় যে আমার কণ্ঠ নষ্ট হয়েছিল তাকে সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনতে তাঁর সাহায্য স্মরণযোগ্য৷ ভারতীয় গণনাট্যের দরজা তিনিই চিনিয়েছিলেন৷ সলিলদার কাছে আমায় পৌঁছেও দিয়েছিলেন তিনিই৷ এহেন প্রবীরদা আমায় বললেন, অভিজিৎ চলো তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাই৷ কোথায় প্রশ্ন করিনি৷ গেলাম একটি পাঁচিল-ঘেরা বড় বাড়ি— তার সমস্ত লন জুড়ে প্যান্ডেল— অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ কার অনুষ্ঠান? কীসের অনুষ্ঠান? জানলাম, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘শহীদের ডাক’, মঞ্চস্থ হবে৷ আমাদের পকেটে নেই পয়সা— টিকিট কাটা সম্ভব হল না৷ কী করা— পাঁচিলে উঠে বসলাম৷ সমস্ত দর্শকাসনে মানুষ বোঝাই— মঞ্চ ছাড়া আর কোথাও আলো নেই— সব অন্ধকার— মঞ্চের আলোও mood light— আধো আলো আধো ছায়ার মধ্যে সেই গিরিগুহার বৈদিক আওয়াজে সঙ্গীত, সামগানের মতো ভেসে আসছে— ‘জাগা দেশ হামারা/জাগা জাগা দেশ হামারা৷’ সেই, জ্ঞানী নয়, মর্ম দরদি কণ্ঠের ধ্রুপদী আওয়াজের মালিক যিনি ছিলেন— তাঁর পরিচয় নামই হচ্ছে শ্রীদেবব্রত বিশ্বাস৷ আমাদের প্রিয় ‘জর্জদা’৷ পরবর্তীকালে আমি একলব্যের মতো যার শিষ্যত্ব বরণ করেছি৷ আমার নিজের গাওয়া গানে এখনও যে-মানুষটি এসে ধরা দেন বারবার— যাঁর throwing আমার হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রেরণা হয়ে প্রবেশ করেছে, সেই মহান শিল্পীর নামই শ্রীদেবব্রত বিশ্বাস৷ ঐশী আওয়াজ, কিন্তু জ্ঞানীর উদ্ধত উচ্চারণ নয়— বৈষ্ণবের মাধুর্য রসে জারিত— বোধে স্ফুরিত— চৈতন্যে, প্রেমবিলাসী প্রকাশ৷ ভোলা যায় না তাঁর কণ্ঠের ‘মম দুঃখ বেদন/মম সফল স্বপন/ তুমি ভরিবে সৌরভে’-র প্রাণস্পর্শী, মর্মছোঁয়া rendering— সেখানে তিনি Romantic Voice-এর অধিকারীদেরও হারমানিয়ে বুঝিয়ে দেন, যে নারী মৃন্ময়ী, তারই শক্তি সত্তার মধ্যে ঘটে চিন্ময়ীর প্রকাশ৷
রাত ১০-৪৫-এর আকাশবাণীর অনুষ্ঠান— প্রথম গান, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’— স্বরক্ষেপণের উঠতি-পড়তি৷ কমবেশির ব্যঞ্জনায় যখন গাইলেন, ‘ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা’— তখন যেন কণ্ঠস্বরের ঢেউ from here to eternity-র মেজাজ নিয়ে সাগরের তরঙ্গের মতো কাছ থেকে দূরে মিলিয়ে গেল৷ তাঁর কণ্ঠ romantic নয়— কিন্তু স্বরের ঐশ্বর্য এতটাই aesthetical যে, প্রেম যে পূজাই তা উপলব্ধি করিয়ে দেয়৷ আমার গুরুদেব কবি-সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতীর উদ্ধৃত কবি Henry Bardson-এর একটি বাণী মনে পড়ে যায়—
‘God is Love and object of Love. Divine love is not a thing of God, it is God Himself.’
কোনটা প্রেমের গান? তাকে সহজে সঙ্গায়িত করা সহজ নয়, আবার সব গানই প্রেমসঙ্গীত এটাও ঠিক৷ সব সঙ্গীতই প্রেম সঙ্গীত কেন বললাম— তার ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমাদের মুক্তি মোক্ষ নয়৷ আমাদের মুক্তি প্রেম৷ চৈতন্যদেবই প্রথম এই উচ্চারণ করেন৷ প্রকৃতিকে ভালবেসে৷ দেশকে ভালবেসে৷ নারীকে ভালবেসে, ঈশ্বরকে ভালবেসেই মানুষ তাঁর নিজ নিজ সংস্কার ও পূজার তপস্যা ক’রে মুক্তি পায়৷ তাই আমরা যে সাধনাই করি— যে গানই গাই, সবই মুক্তির গান৷ সেই বিচারে সবই প্রেমের গান এমন কি নারী পুরুষের মিলন সঙ্গীতেও রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধন রূপে৷’ —আর এই মুক্তি আসে আত্মকেন্দ্রিকতায় না, প্রেমের বৈরাগ্য তন্ময়তায়, যাতে আনন্দ— যাতে পরিতৃপ্তি৷ বর্ষার প্রকৃতি দর্শন করেই রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন কাঁপন লাগে দ্বিগঙ্গনার ‘বুকের আঁচলে, সে আসিবে আমার মন বলে’— যেমন ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটি জর্জদার কণ্ঠে বোধহয় প্রেমের গানের সূক্ষ্মতম বোধের সুন্দরতম প্রকাশ৷ আবার প্রেমের অন্য একটি রূপ ‘তারে দেখাতে পারিনি কেন প্রাণ’— এ-ও তাঁর কণ্ঠে অন্য এক রূপ৷ জর্জদা অর্থাৎ দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে দুটি গানই শোনার আমার সৌভাগ্য হয়েছে,— আমি জোরগলায় বলতে পারি, ‘তুমি রবে নীরবে’— গানটির অন্তরার পঞ্চম স্পর্শ করে ফিরে আসার স্বরক্ষেপণে আজ পর্যন্ত যাঁরা যাঁরা এ গান গেয়েছেন, কেউই তাঁর অভিব্যক্তি অতিক্রম করে উৎকর্ষতা ও বোধকে তাঁর মতো বোধিদীপ্ত করতে পারেননি৷ বাকি যাঁরা গেয়েছেন তাঁরাও সব কিন্তু দারুণ romantic কণ্ঠস্বরের অধিকারী ও স্বনামধন্য৷ কিন্তু তাঁরাও নারীকে নারী হিসেবে, প্রেমিকা হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছেন, কিন্তু জর্জদা অসামান্য অভিব্যক্তিতে নারীকে শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর rendering-এ৷
‘তারে দেখাতে পারিনে কেন প্রাণ’— গানটি প্রেমের এক অন্য অভিব্যক্তি৷ এই গানটির শেষ অন্তরা—
‘এ প্রেম কুসুম যদি হত
প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম
তার চরণে করিতাম দান৷’
এই ‘প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম’ কথাটি জর্জদা যখন গানে গানে উচ্চারণ করতেন তা যদি কেউ শুনে থাকেন তবে বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথের বাণী— ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা’ আর ‘কীর্তন সংগীত আমি ভালোবাসি তার ভাব প্রকাশের নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে৷’ এ দুটি বাণী, জর্জদার গায়নের মধ্যে কী আশ্চর্য পূর্ণতায় জীবন্ত ও সত্যভাবে প্রকাশিত৷ প্রেমটা কুসুম হলে বুক থেকে ছিঁড়ে এনে প্রেমের চরণে দিতাম— প্রেমের এই যে পূজা— এ বৈষ্ণবীয় প্রেমের শরমাবরণ উন্মোচিত বিলাপের মতো তিনি প্রকাশ করেছেন৷ প্রেমের সাধনা না থাকলে এই বোধের স্ফুরণ হতে পারবে না৷ যাঁরা শুনবেন, তাঁদের এই বোধ নিয়ে শুনতে হবে৷ নাগরিক জীবনে প্রেমের একটা বিশেষ sophisticated, whispering স্বরক্ষেপণ আছে, কিন্তু ভাববিহ্বল বৈষ্ণবীয় প্রেম, নিঃসঙ্কোচ অনাবিল কুণ্ঠাহীন বৈকুণ্ঠের রসকলি প্রকাশ— তার সাবলীলতা ভদ্রতার শিকল পরা নয়, স্বতঃস্ফূর্ততার আকুতিতে আপ্লুত, আত্মদীপ্ত, আত্মতৃপ্ত অভিদ্যোতনা৷ সম্যক জীবনসাধনা ছাড়া এ অনুভব প্রকাশও করা যায় না৷ আর যে শুনবে, তারও সেই সাধনা না থাকলে বুঝবে না— কেন তিনি চরম নাট্যবোধের স্বরক্ষেপণে ‘প্রাণ হতে ছিঁড়ে লইতাম’— ওইভাবে বললেন৷ আবার প্রেম যখন ভক্ত ভগবানের লীলারসে আপ্লুত হয়ে বিহরকাতর, ঈশ্বরকে সর্বস্ব বোধে গ্রহণ করে যখন তিনি অনুভব করলেন আপন হৃদয়ে যে—
‘রৌদ্র মাখানো অলস বেলায়
তরু মর্মরে ছায়ায় খেলায়
কী মূরতি তব নীল আকাশে
নয়নে ওঠে গো আভাসি
হে সুদূর আমি উদাসী৷’
তখন সেই অন্তরে দৃশ্যমান দেবতার চরণে যে ক্রন্দনধ্বনি বাজিয়ে দিলেন তা মায়াযুক্ত নয়— তা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’-র মানসিক টানাপোড়েন৷ এই অভিব্যক্তি বেজে উঠল যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানের বাণীর মতো—
‘জানি হে তুমি মম
জীবনে শ্রেয়তম
এমন ধন আর
নাহি যে তোমা সম
তবু যা ভাঙা চোরা
ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে ||’
এই মায়াযুক্ত মনের বেদনা,— প্রেমের হাতছানি শুনছি অথচ মায়ার ঘরের ভাঙাচোরা চাওয়া-পাওয়ার সম্পত্তি ত্যাগ করতে পারছি না,— এই যে অন্তরসংগ্রাম— তার প্রাণ বিগলিত কান্নার ধ্বনি তিনি শুনিয়েছেন— ‘মোর ডানা নাই আছি এক ঠাঁই’— লাইনটি গাইবার সময়৷ অদ্ভুত বিষয়, ওই একই গান যখন তিনি যৌবনে প্রথম record করেন, তখন তিনি গেয়েছিলেন একজন সুদক্ষ সুগায়কের মতো৷ আবার জীবনের উপলব্ধির উত্তরণে যখন বুঝেছিলেন আগের গাওয়া ওই গান শুধু গানই হয়েছিল, জীবন পর্যন্ত পৌঁছোয়নি৷ তখন জীবন পরিক্রমার উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে তিনি যখন ফের গাইলেন, তখন তিনি আর গায়ক নয়— সঙ্গীত-সঙ্গীত কথাটা দেব না সাধক৷ তাই পুনরায় রেকর্ড করে তাঁর বোধের যথাযথ মর্মধ্বনিকে সম্মান জানালেন৷ প্রথমবার গায়নের মধ্যে যে শ্রুতিসুখকর ধ্বনি ছিল, দ্বিতীয়বারে তা বোধিদীপ্ত উজ্জ্বলতার আলোয় ভক্তের পরম পাওয়ার জন্যে যে চরম আকুতির টানাপোড়েন, তারই সম্পূর্ণতর প্রকাশ ঘটালেন, বৈষ্ণবের আকুল কীর্তনের রসবিন্যাসের মতো৷ যখন বলছেন, ‘ওগো সুদূর বিপুল সুদূর তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি’— তখন তিনি যেন প্রেমের বাঁশি শুনতে পাচ্ছেন৷ আর মায়ামুক্তি না হওয়া মনের শত বেদনার উচ্চারণ করছেন কেঁদে কেঁদে ‘মোর ডানা নাই আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি৷’ অর্থাৎ আমি ভুলে যাই মায়া আমার ওড়ার ডানা ভেঙে দিয়েছে, ওগো সুদূর প্রেম তোমার কাছে আমি যেতে পারছি না৷ দীর্ঘ জীবন-সাধনা ছাড়া যেমন এ গান গাওয়া যায় না, তেমনি দীর্ঘ স্বচ্ছ সুন্দর জীবন-সাধনা ছাড়া এ গান বিচার করাও যায় না৷ জর্জদা ব্রাত্য নয়, যাঁরা তাকে চিনতে পারেননি তাঁরাই ব্রাত্য৷ কারণ তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচিন্তার দ্বারা উদ্ভাবিত নন৷ তাঁরা মনোমুখী, স্বঘরানায় বিশ্বাসী— সোজা কথায় অ-রাবীন্দ্রিক৷
একদিন রেডিওতে শুনছি তিনি গাইছেন, ‘অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক’ — গানটি তালে গাইতে গাইতে হঠাৎ তাল থামিয়ে তাল ছাড়া adlib করে গাইলেন ‘হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত’ থেকে বাকি অংশ৷ ভাবলাম কেন এমন করলেন? নিশ্চয় কারণ আছে৷ সমগ্র গানটি পাঠ করে বুঝলাম— যতক্ষণ তালে গাইছিলেন ততক্ষণ অহং-এর আলোয় গায়ক চলছিলেন, আধো আলো আধো আঁধারের ধাঁধায় পড়ে, তাইতেই তাঁর পথের বিভ্রম— যেই মাথায় ঐশী আঘাত পেলেন নিভে গেল অহং-এর আলো৷ তুমির আলো প্রকাশিত হল তখনই, তখনই চঞ্চলতা স্তব্ধ৷ ঠিক যেন নীরব ধ্যানমগ্ন যোগী ব্রহ্মদর্শন করে স্থিতধী হলেন৷ এ অভিব্যক্তি তাদের বোঝা সম্ভব নয় যারা কেবল আগমার্কা লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের ফেরিওয়ালা৷ রবীন্দ্রনাথ চৈতন্যদেব সম্পর্কে যে উচ্চারণ করেছেন, তা বৈষ্ণবদেরও ভাবিয়ে তোলে৷ আর চৈতন্যের সেই চৈতন্যবোধ যে সুমহান গায়কের হৃদয় স্পর্শ করেছিল, সেই দেবব্রত বিশ্বাসই পারেন এমন ভাবনা ভাবতে এবং বোধহীন বোধের সঙ্গীতজ্ঞ যাঁরা, তাঁরা তা পারেন না৷ কথাটা অপ্রিয় হলেও সত্য৷
ধর্মজগতে একটা কথা চালু আছে — ‘যত গোপন তত স্ফুরণ, যত প্রকাশ তত নাশ৷’ জর্জদা বর্ণচোরা৷ সাধুরা ভাব গোপন করার জন্যে যেমন বহিঃপ্রকাশে নানারকম বিপরীত আচরণ করেন— জর্জদাও ছিলেন তাই৷ তাঁর অন্তরের পদ্মটিকে কেউ দেখুক, চিনুক— এটা তিনি চাইতেন না৷ গণনাট্যের ভূপতি নন্দীকে একদিন বলছেন, ‘তুমি তো আমার মত চরিত্রহীন হইতে পারবা না, তাই তোমার দ্বারা হবে না৷’ কথাটা মজা করে বললেন কে? তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের স্বতঃস্ফূর্ত ঋত্বিক দেবব্রত বিশ্বাস৷ একবার একটি ছোট্ট ঘটনায় হঠাৎ বোধহয় মুখ ফসকে একটা আত্মাভিমান প্রকাশিত হয়েছিল— শোনা কথা— তাঁর একটি রেকর্ডের বিজ্ঞাপনে কিংবা কভারে তাঁর একটি ছবি ছাপতে চাওয়াতে বলেছিলেন, ‘আমার ছবি কি ছাপাইবা’— বলেই Office-এর Desk-এ একটা গোলাপ ফুল রাখা ছিল, সেটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমার ছবির জায়গায় এই ফুলটার ছবি ছাপাইয়া দাও৷’ —কী করুণ এই অভিব্যক্তি! এতকাল পরেও লিখতে লিখতে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে৷
রবীন্দ্রনাথ সংগীত চিন্তা গ্রন্থে নিজে লিখছেন, ‘আমি নির্মমভাবে আধুনিক’৷ আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের গানকে যাঁরা জনমানসে প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই আধুনিক সঙ্গীতের মানুষ৷ যেমন— পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়৷ আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া সুদক্ষ গায়ক সুবিনয় রায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন প্রমুখ৷ সুচিত্রা মিত্রও কিন্তু তাঁর গায়নভঙ্গিতে ঐ রবীন্দ্র-অনুসারীদের মধ্যে, কারণ রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে গীত গানের যে নিষ্ঠ-বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি ও ভঙ্গিমা, তা সরাসরি সেই ভাবের স্বরক্ষেপণে সুচিত্রা মিত্রর গাওয়া গানে সুষমামণ্ডিত৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতের আশ্রমিক-কন্যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাজেশ্বরী দত্ত কিংবা মালতী ঘোষাল— তাঁরা সবাই মোটামুটি জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতন বা ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গনের শিল্পী৷ কিন্তু আমজনতার কাছে যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরা সবাই রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীর ঋত্বিক— ‘আমি নির্মমভাবে আধুনিক’৷ জর্জদা সব থেকে ব্যতিক্রমী, কারণ তিনিই সার্থকভাবে ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিক৷ তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বসঙ্গীতের মূল বোধের অঙ্গনে আসবার চেষ্টা করেছেন৷ সেটা ইউরোপীয় সঙ্গীতের যে সিম্ভনি concept, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ফুটিয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের বাদী সমবাদী অনুবাদী বিবাদীর সামন্তপ্রথা চুরমার করে, সঙ্গীতে পর্দার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, সপ্তককে সঙ্গীতের ভাবসাধনায় মুক্তি দিয়ে, মানুষের দ্বন্দ্বসমৃদ্ধ মনের মুখে সাঙ্গীতিক ভাষা ফুটিয়েছেন, তারই নিদর্শন স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন জর্জদা৷ কাজ করলে ত্রুটি আসে, কিন্তু সেখানে ত্রুটিকে অস্ত্র করে মূল উদ্দেশ্যকে অবমূল্যায়ন করা মানে সত্যবোধের ভাবধারাকে উপেক্ষা করা৷ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন—
‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে
নাহি ক্ষয় নাহি শেষ নাহি নাহি দৈন্য লেশ৷’
চিঠিপত্রের একটি পত্রে সোজাসুজি বলেছেন তাঁর জায়গা ছেড়ে দিয়ে নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার কথা৷ ‘শেষের কবিতা’য় নিজেই নিবারণ চক্রবর্তী হয়ে রবীন্দ্রোত্তর কাব্যের কথা উচ্চারণ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথের মতো প্রগতিশীলকে রক্ষণশীলতার হীনমন্য কারাগারে বন্দী করতে চেষ্টা করা আধ্যাত্মিক পাপ৷ আবার রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক বোধকে ব্যবসায়নের, বিশ্বায়নের বাজারে ব্যবসা করাও দেশদ্রোহিতা, সাংস্কৃতিক উচ্ছৃঙ্খলতা৷ ‘সঙ্গীতচিন্তা’র ছত্রে ছত্রে যে সব বাণী আছে, তার মর্মধ্বনি ‘বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে’৷ এই ‘বিশ্ব’ শব্দের সঙ্গে যে-কণ্ঠের মহামাধুর্য ধ্বনিত হতে পারে সেই কণ্ঠস্বরেরই অধিকারী হচ্ছেন চিরপ্রণম্য দেবব্রত বিশ্বাস৷ তিনি গণসঙ্গীত গাইতেন যথাযথ৷ আধুনিক সঙ্গীত গাইতেন বিস্ময়করভাবে সার্থকতা সৃষ্টি করে; আবার রবীন্দ্রনাথের গানে পরম বৈষ্ণবের মতো মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বরকে ভালবেসে৷ Versatile বলে একেই৷ যাঁরা জাগতিক প্রেমের কমনীয়তাকেই শুধু প্রকাশ করেন, তাঁরা Romantic৷ তাই তাঁরা গায়ক, তাঁরা শিল্পী আর দেবব্রত বিশ্বাস হচ্ছেন সঙ্গীতের জীবন-ঋত্বিক৷ তাঁর কণ্ঠ, ধ্রুপদী, কিন্তু প্রকাশে পদাবলি৷ রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতে যে আন্তর্জাতিকতার কথা বলেছেন এবং ঐতিহ্যনিষ্ঠ আধুনিকতার কথা বলেছেন, তার উদ্বোধনী প্রচেষ্টা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস৷ কিন্তু একটা জায়গায় বোধহয় তাঁর খামতি রয়ে গেল, যে-খামতির ভিত্তিতে তাঁর শুভ চেষ্টায় সাহায্য না দিয়ে, আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্তে না পৌঁছে, সঙ্গীত চিন্তার আলোয় বিচার না করে, ব্রাত্য করে দেওয়া হল তাঁকে৷ একটা প্রগতিশীল প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দেওয়া হল শুরুতেই৷ সেই চেষ্টা জর্জদার হাত ধরে সেদিন থেকে চলমান রাখলে আজ হয়ত রবীন্দ্রসঙ্গীতে সিম্ভনির প্রভাব অনুভূত হত এবং বাজারি বিশ্বায়নের Cacophony-র এত দাপট রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রয়োগ করার আগে উদ্যোক্তারা হাজারবার চিন্তা করত৷ এই অসভ্য দুঃসাহসিকতার স্পর্ধা তাদের থাকত না৷
কথাটা আরও একটু স্বচ্ছ করে বলি৷ রবীন্দ্রনাথ বারবার সঙ্গীতে মিশেলের কথা উচ্চারণ করেছেন— বলেছেন বর্বর বা বনমানুষ পারে না, কিন্তু মানুষ পারে শিল্পে-সঙ্গীতে মিশেল করতে৷ নিজে প্রয়োগে তার প্রমাণ রেখেছেন৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্দার চলন লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ভারতীয় সুরকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তাঁর চলন-পদ্ধতিকে নয়৷ বিশেষ করে রাগসঙ্গীতের ক্ষেত্রে৷ বেহাগকে ব্যবহার করেছেন, করে, অবলীলাক্রমে সবসময় কোমল ‘নি’ ব্যবহার করেছেন, অত্যন্ত dominent ভাবে৷ বাদী সমবাদীর প্রতি অহেতুক নিষ্ঠ সমীহ বজায় রেখে গানের ভাবের চেয়েও তার ব্যাকরণকে প্রাধান্য দেননি৷ ইমনে বিস্ময়করভাবে শুদ্ধ ‘ধা’ ব্যবহার করেছেন যাতে মনে হয় relative minor-কে তিনি খুব পছন্দ করেছেন৷ এরকম বহু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায় যে ভারতীয় সঙ্গীতের সুর নিয়ে তিনি পুরো সিম্ভনি পরিকাঠামোও ব্যবহার করে দেশজ সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক অর্থাৎ বিশ্বসঙ্গীত করেছেন৷ আমার নিশ্চিতভাবে মনে হয়েছে বহু ধরনের সঙ্গীত গাইবার কণ্ঠের অধিকারী হয়ে জর্জদা রবীন্দ্রনাথের গানের এই সিম্ভনিকে ধরতে পেরেছিলেন, আর তাঁর কণ্ঠের যে মহাকাশচারী স্বর ও স্বরক্ষেপণ, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ওই বিশ্বসঙ্গীতকে স্থাপন করার প্রয়াস নিয়েই, নানা যন্ত্রের ব্যবহারে, যেন তাকে প্রকৃতির উপলব্ধির মতো অনুষঙ্গ করে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন৷ তাঁর সদিচ্ছায় রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সঙ্গীতকে বিকৃত করার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যটা যে-কারণে সেভাবে গ্রহণ করা গেল না কেন, সেই সম্পর্কেই দু-চার কথা এখানে বলব— যা আজও রবীন্দ্রসঙ্গীতে সঙ্গীতায়োজনের সময় খেয়াল রাখা উচিত৷
প্রথমেই বলব ইউরোপীয় সঙ্গীত ও ভারতীয় সঙ্গীতের মিশেলের সপক্ষে তিনি যে সব মন্তব্য রেখেছেন, তার দু-একটা স্মরণ করা বোধহয় প্রয়োজন—
‘আমাদের শিল্পকলায় সম্প্রতি যে উদবোধন দেখা যাইতেছে তাহার মূলেও য়ুরোপীয় প্রাণশক্তির আঘাত রহিয়াছে৷ আমার বিশ্বাস সংগীতেও আমাদের সেই বাইরের সংস্রব প্রয়োজন হইয়াছে৷ তাহাকে প্রাচীন লোহার সিন্দুর হইতে মুক্ত করিয়া বিশ্বের হাটে ভাঙাইতে হইবে৷ য়ুরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সংগীতকে আমরা সত্য করিয়া, বড় করিয়া ব্যবহার করিতে শিখিব৷’
বাণীটির প্রথম অংশে যে ইউরোপীয় ও ভারতীয় সঙ্গীতের মিলন চেয়েছেন সেই প্রচেষ্টাই করতে চেয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, কিন্তু ত্রুটিটা অন্য জায়গায়৷ এই যে রবীন্দ্রনাথের বাণী, ‘য়ুরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সংগীতকে আমরা সত্য করিয়া, বড় করিয়া ব্যবহার করিতে শিখিব৷’ এইখানেই জর্জদার খামতি৷ তিনি যখন যন্ত্রানুষঙ্গে এই ইউরোপীয় সঙ্গীতের কর্ড, হার্মনিকে ব্যবহার করলেন, তখন সেটা তার স্বআয়ত্তাধীন দক্ষতা থেকে নয়— যন্ত্রশিল্পীদের ওপর নির্ভর করে৷ বিভ্রান্তির সৃষ্টি এখানেই৷ যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীর সাঙ্গীতিক জ্ঞান আছে, কিন্তু বোধের জায়গায় তার জর্জদার বোধের সঙ্গে মিলন ঘটেনি৷ ফলে এই বিভ্রাট৷ আরও একটু পরিষ্কার করে বলি৷ Bb Flat পর্দাটি Bb Major, minor-এও আছে, G minor-এও আছে, F# Shap-এও আছে, C7-এও আছে ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কয়েকটি কর্ড-এ আছে৷ এখন ওই Bbটির ওপর কোন কর্ডটি বসানো হবে তা বিষয় ও বোধের ওপর নির্ভরশীল৷ যেমন পারিবারিক সম্পর্কে এক ব্যক্তি কারও বাবা, কারও কাকা, কারও ছেলে, কারও ভাই এবং কারও স্বামী৷ ব্যবহারিক জীবনেও যেমন সম্পর্কের বিন্যাস, ব্যঞ্জনা, সংলাপের প্রকাশে তার তারতম্য থাকে, এই কর্ড, হার্মনি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাই৷ জীবন প্রয়োগে যেমন বোধের তারতম্যের ভিত্তিকে প্রকাশে প্রাধান্য দিতে হয়, কর্ড ও হার্মনির ক্ষেত্রেও তাই৷ সমস্যা সৃষ্টি করল জর্জদার বোধের উচ্চ চৈতন্য অথচ কর্ড-হার্মনির জানাশোনার অভাব আবার যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালকের সাঙ্গীতিক দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও না থাকা তার রবীন্দ্রবোধ— তাইতেই একটা জটিলতার সৃষ্টি হল৷ আমার প্রশ্ন, যাঁরা তাঁকে ব্রাত্য করলেন, তাঁরাও কি সঙ্গীত চিন্তার অনুসারী কাজের প্রচেষ্টাকে (তার ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও) বাধা দিয়ে ‘সঙ্গীত চিন্তা’ গ্রন্থের বিরোধিতা করে নিজেরা ব্রাত্য হলেন না? ভি বালসারা প্রথম দিকে, রবীন্দ্রভাবধারায় যখন তেমন ভাবে উদ্বুদ্ধ হননি, তখন কিছু কিছু কাজে অনভিপ্রেত কর্ড-হার্মনি ব্যবহার করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে৷ কিন্তু পরে, যখন ডুবে গেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতসাগরে, তিনি বলতেন— রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কিছু বাজাতে ইচ্ছে করে না৷ ইউরোপীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীত চিন্তার সমন্বয়ে কাজ করলে ঠিক ঠিক ভাবে জর্জদার কাজ সার্থক হত, কিন্তু তিনি একক যাত্রী হওয়াতে, অন্য শরিকদের সহযোগিতা তো নয়ই, বরঞ্চ বিরোধিতা, অসম্মান পেয়ে তিনি সরে গেলেন৷ তার একটা যথাযথ রবীন্দ্রভাবনাকে রূপ দেওয়ার প্রয়াস সঙ্ঘবদ্ধ অপরিণত আক্রমণে, সঙ্গীত মুক্তির পথ হারাল৷ রবীন্দ্রনাথের গানে যে ভারতীয় সঙ্গীত জীবনবোধে মুক্তিলাভ করেছে, তা আর দেবব্রত বিশ্বাস জনমানসে গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন না৷ দুরন্ত অভিমানে সরে দাঁড়ালেন৷ যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘সঙ্গীত চিন্তা’ গ্রন্থের প্রচেষ্টাকে বাতিল করে, চালের দোকানের বোমা দিয়ে বস্তা ফুটো করে চালের নমুনা দেখার মতো, রবীন্দ্রনাথের গানের পেট ফুটো করে রাগরাগিণীর খোঁজ করছেন— ইতিহাসই সময়মতো তাঁদের খবর নেবেন৷ রবীন্দ্রনাথের যে-উৎকর্ষ প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন জর্জদা, তা তাঁর নিত্যের সাধনা— তাই তার বিরোধীদের উদ্দেশে আমি গীতার বাণীই উচ্চারণ করব—
‘নাস তো বিদ্যতে ভাবো
না ভাবো বিদ্যতে সতঃ৷’
নিত্যের কোনও বিনাশ নেই অনিত্যের কোনও অস্তিত্ব নেই৷ কালের কাছে, ইতিহাসের কাছে দেবব্রত বিশ্বাস যে দাম পাবেন— রবীন্দ্র-বিরোধী রক্ষণশীলতা সে দাম তো পাবেই না বরঞ্চ অপরাধের মাশুল দিতে হবে৷
সব শেষে অন্য একটা কথা বলব— দেবব্রত বিশ্বাস একজন ব্যতিক্রমী আধুনিক Versalite Singer৷ সলিল চৌধুরি তাঁর প্রথম ছবির গানেই নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন করেন দেবব্রত বিশ্বাসকে৷ ঋত্বিকদা ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ গানটি ছবিতে জর্জদাকে দিয়ে গাইয়ে নিলেন৷ যাঁরা সামনে বসে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘অবাক পৃথিবী’, ‘বিদ্রোহ আজ’ শুনেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন সমাজ-সচেতন বৈতালিক কাকে বলে৷ এ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তাই আমি ধন্য৷ ‘কর বটে বদলতা’ বা ‘সারে জাঁহাসে অচ্ছা’ জর্জদার মুখে যাঁরা শোনেননি, তাঁরা জীবনের বিশ্বচেতনার অনেক গভীর কিছু শোনার মতো সঙ্গীত শুনতে পেলেন না৷ গান যে গলা দিয়ে গাইবার বিষয় নয়, চেতনা দিয়ে— তা জর্জদার গান শুনলে মনে হবেই৷ শ্যামল মিত্র এক অসাধারণ শিল্পী৷ কিন্তু তাঁর গাওয়া ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ গানটি বহু অনুষ্ঠানে গেয়েছেন জর্জদা৷ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বুঝেছেন আকাশের ব্যাপ্তি কতটা, আর আকাশের বৈষ্ণবদীনতাই বা কতটা! বুঝবেন আকাশ আমাদের ঔদার্য ও প্রেম-সাধনার যুগ্ম মূর্ত প্রতীক৷ রবীন্দ্রনাথ আমার অনুভবে শ্রেষ্ঠ আধুনিক সঙ্গীতনির্মাতা, আর জর্জদাও একজন পূর্ণাঙ্গ আধুনিক গায়ক৷ বড় দুঃখের কথা, জর্জদাকে কেবল শ্যামার ‘কোটাল’ ভাবা হল, জ্ঞানী প্রেমিক বজ্রসেন ভাবা হল না৷ নীরবতার আড়ালে, কৃচ্ছ্রসাধনার সন্ন্যাস জীবনযাপনে যে সঙ্গীত-ঋত্বিক দুরন্ত অভিমান নিয়ে চলে গেলেন, তা বড় বেদনার কথা৷ আমরা, শিল্পীরা, সঙ্গীতের পূজারিরা, একটু ভালবাসার আশ্রয়ও তাঁকে দিতে পারলাম না৷ তাঁর চওড়া বক্ষে সব বেদনা ধারণ করতে করতে যেন অন্তিম সঙ্গীতটি গেয়ে গেলেন—
‘তোমার ক্ষমা তোমার দয়া
হবে চির পাথেয় চির যাত্রার৷
হয় যেন মর্তে্যর বন্ধন ক্ষয়
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
জ্যোতি ধ্রুব তারকার৷
সমুখে শান্তি পারাবার৷’
উপসংহারে সংযোজন
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আধুনিক বাংলা গানের রূপকারদের মধ্যে আমি কেন জর্জ বিশ্বাসকে আধুনিক Singer ভাবছি৷ তার কারণ তিনিই সব থেকে বেশি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রেষ্ঠ আধুনিক সঙ্গীত এবং শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য সঙ্গীত৷ শাস্ত্রের চলমানতাকে অস্বীকার করে, অগ্রাহ্য করে রক্ষণশীলতার অচলায়তনে সঙ্গীতকে আবদ্ধ করেননি৷ আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় ও ইউরোপীয় সঙ্গীতের উভয়দিকটা তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন না হওয়ার কারণে তিনি ব্রাত্য হয়েছেন স্থবির রবীন্দ্র-ভাবধারার বিচারে, কিন্তু চির আধুনিক বা বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই, ‘আমি নির্মমভাবে আধুনিক’— এই উচ্চারণের প্রেক্ষিতে জর্জদাই প্রথম সন্ধান দেন যে সামগানের ঐকতান ও ইউরোপীয় ঐকতান (Symphony)-র মধ্যে আত্মিক সঙ্গতি আছে৷ শ্রদ্ধেয় জ্ঞানপ্রকাশ, যিনি ছিলেন একটি চলন্ত সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান, ‘ভজনে’ হার্মনি ব্যবহার করেছিলেন৷ এবং আমাকেই বলেছিলেন তিনি বৈদিক মন্ত্র থেকে অনুপ্রাণিত৷ জর্জদা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্রাত্য শিল্পী নন— তিনিই অচলায়নের মহাপঞ্চকদের বিরুদ্ধে পঞ্চক, তাসের দেশের রাজার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজপুত্র৷ রক্ষণশীলতার জীর্ণ প্রাচীর ভেঙে পড়বে, নতুনরূপে অঙ্কুরিত হবে মূল সৃষ্টিশীল বীজ৷ তাসের দেশের রাজপুত্র দেবব্রত বিশ্বাস আধুনিক সঙ্গীতকারের দিশারি হয়ে মহাকালের পূজা পাবেন৷