সম্ভ্রান্ত শিক্ষার আভিজাত্যে উজ্জ্বল শ্রী হিমাংশু দত্ত (সুরসাগর)
রবীন্দ্রোত্তর যুগের অথচ প্রাক-স্বর্ণযুগের অসাধারণ মৌলিক সুরস্রষ্টা সুরসাগর হিমাংশু দত্ত৷ বাংলা গানের নির্মাণের ইতিহাসে তিনি কেবল এক অত্যুজ্জ্বল রূপকারই ছিলেন না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একজন পূর্ণাঙ্গ সংগীত নির্মাণ অভিধান৷ সংস্কৃতির ময়লা জলে স্নান করতে করতে যখন সমাজের শরীরে দুর্গন্ধ ছেয়ে গেছে তখন বিস্মৃত সময়ের শুদ্ধ সংগীত নির্মাতার কথা যেমন বিস্মরণ হওয়া স্বাভাবিক তেমনি চারু সচেতন ব্যক্তির পক্ষে তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত— অবশ্যকর্তব্য— অবশ্য দায়বদ্ধতা৷ এমনই ভাবনা নিয়ে তাঁর সম্পর্কে আমার দু-চার কথা নিবেদন করছি৷
সুরসৃষ্টির অনুভবে যাঁদের গুরু হিসেবে গণ্য করি তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আমার প্রিয় সুর রচয়িতা পরমশ্রদ্ধেয় হিমাংশু দত্ত সুরসাগর৷ বাংলা গানের মহাকাশে তিনি অন্যতম এক সমুজ্জ্বল নক্ষত্র৷ কাব্যসংগীত রচনায় এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব৷ বিভিন্ন সুরকারের সুর রচনাকে আমি ইদানীং খুব বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি— এতে প্রত্যক্ষভাবে দুটো লাভ হয় দেখেছি৷ একটি, সেই মহান স্রষ্টার সৃষ্টির উৎকর্ষকে আবিষ্কার করা যায়৷ অপরটি, সেই গবেষণার মধ্যে দিয়ে নিজেকেও শিক্ষিত করতে পারি৷ দুটি বিষয়ই আমার কাছে মূল্যবান৷ সুরের পথিক হিসেবে আমার ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করেও আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই, কারণ, মনে হয় আমার চিন্তা, ভবিষ্যৎ বাংলা গানের ইতিহাসের যদি কোনও কাজে আসে, তবে আমি সামান্য হলেও অসামান্যের দরবারে আমার একটা ছোট্ট আসন থাকবে— এই প্রত্যাশাও তো উপেক্ষার নয়৷
যদিও সলিলদা, নচিদা, হেমন্তদা, শ্যামলদাদের যেভাবে দেখেছি, জেনেছি, বুঝেছি সেভাবে হিমাংশু দত্ত মহাশয়কে দেখিনি, জানিনি, বুঝিনি৷ কারণ, সলিলদাদের যেভাবে অনেক কাছ থেকে পেয়েছি, সেভাবে তো শ্রীহিমাংশু দত্তকে পাইনি৷ তাতে বিচার-বিশ্লেষণের একটা ফাঁক থেকে যায়ই৷ কারণ, স্রষ্টা-মানুষ ও তাঁর সৃষ্টিকে জানলে যে পূর্ণতা ও আন্তরিকভাবে জানা হয় তাতে অনেকটাই নির্ভুলভাবে তাকে প্রকাশ করা যায়৷ কিন্তু কেবল সৃষ্টিকে ধরে এগোলে সেই বিচার কিছুটা অপূর্ণতার মূল্যায়নে দুষ্ট হয়৷ রবীন্দ্রনাথকেও কাছ থেকে দেখিনি, তবু তাঁর জীবনের অনেকটাই নানা গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে জানতে অনেকটাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির বোধকে মিলিয়ে নিতে পেরেছি৷ তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বকীয় দক্ষতায় তাঁকে অবলম্বন করতে বাধ্য করিয়েছেন তাই রবীন্দ্রনাথকে প্রাণের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে পেরেছি৷ কিন্তু শ্রীহিমাংশু দত্তের ক্ষেত্রে সে সুযোগ অন্তত আমি পাইনি৷ কারণ সুরকার হিসেবে আমার আত্মপ্রকাশের বহু পূর্বেই তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন৷ আর তাঁর জীবন ইতিহাস আজও তেমনভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি৷ তাই তাঁর সৃষ্টি ধরেই আমি তাঁকে চিনেছি৷ অনুভব করেছি, কত বড় সংবেদনশীল, কাব্যিক মনোভাবের সুরস্রষ্টা তিনি৷ ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংগীত-উৎকর্ষে তাঁর মান কতটা সুউচ্চ তা জেনেছি, বুঝেছি৷ যেসব বাণীতে তিনি সুর সংযোজনা করেছেন প্রতিটি বাণীর অসাধারণ কাব্যিক মূল্য অনস্বীকার্য৷ আর মূলত সে সব গানের রচয়িতা ছিলেন এক একজন দিকপাল, জাতকবি৷ বিশেষ করে অতুলনীয় ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য ও শৈলেন রায় দুজনেই মেজাজে ও সৃষ্টি-যোগ্যতায় বিশিষ্ট কবি৷ এঁদের রচনার মর্মবোধের গভীরতাকে সুরে যে সুরকার প্রকাশ করতে পারেন তাঁর উৎকর্ষ ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত৷
অজয় ভট্টাচার্য রচিত ও হিমাংশু দত্ত সুরসাগর সুরারোপিত ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’, কেবলমাত্র এই একটি গানের রচনা নিয়েই যদি আলোচনা করা যায়, এবং সেই রচনার আন্তরিক রসবিন্যাস করে যদি গানটি শোনা যায়— তবে বোঝা যাবে কত বড় মাপের মর্মস্পর্শী সুরকার হলে তবে এই বাণীতে যথাযথ সুর সংযোজনা করা সম্ভব৷ এই গানের বাণীতে বৈষ্ণবের অভিসারের মতো প্রেমের সমর্পণের অনুভব বিধৃত৷
‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে
বিরহীর ব্যথা ল’য়ে
বাঁশরীর সুর হ’য়ে
কে গো আজ ডাকিল তারে৷’
সহজ স্বাভাবিক মানবিক বোধেই দয়িত-দয়িতার দূরত্বের প্রেমের বেদনা মিশ্রিত প্রেমসংগীত ভালবাসার আর এক চরম প্রকাশ— ‘বিরহ মধুর হল আজই মধু রাতে’ [রবীন্দ্রনাথ)৷ ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’ গানেও সুদূর আকাশে চাঁদ মাটির ফুলের বিরহ নিয়ে অবস্থান করছে— আর নিচে থেকে তাকে ডাকছে কে? এক চামেলী ফুল৷
‘ধরণীর ধুলি থেকে
চামেলী কহে ডেকে
এসো প্রিয়, প্রিয়, ডাকিল তারে৷’ সে ডাকে সাড়া দিলেও
সুদূর থেকে চাঁদ নিজে নেমে আসতে পারবে না— কিন্তু প্রেম অনির্বচনীয় অনুভূতির স্পন্দনের বাহনে চেপে পৌঁছে যেতে পারে অনু থেকে অনন্তে সেইরকমভাবেই চাঁদ বলল—
‘চাঁদ কহে সুদূরে আমি
মোর প্রেম জোছনা যে
কেঁদে মরে তব পাশে
ওগো ফুল কেমনে নামি?’
চাঁদ সশরীরে আসতে পারল না,— জোছনা করে পাঠাল তার প্রেমকে৷ তখন অনন্ত মিলনের আকুতির আকাঙ্খায় শরীর বিসর্জন দিয়ে আত্মার মহামিলনে আপন অন্তর অভিষিক্ত করে চামেলি গেয়ে উঠল পরম বৈষ্ণবের সমর্পণের মতো—
‘চামেলি কহিল তবে
আমি যাই দূর নভে
ঝরিল সে পথের ধারে৷’
এই গানটি যেন রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি গানের একটি লাইনের ব্যাখ্যা— ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান৷’ পাঠকবর্গ বলতেই পারেন, এ তো হিমাংশু দত্তর রচনা নয়৷ গীতিকার তো অজয় ভট্টাচার্য৷ তার উত্তর হচ্ছে এই যে, এই মহৎ জীবন-ব্যঞ্জনাকে যে মহান সুরকার সুরারোপিত করতে পেরেছেন তিনি সাঙ্গীতিক শিক্ষা, কাব্যসাহিত্যের মর্মিতা ও প্রেমদর্শন, রসবিদগ্ধতা ও সামগ্রিক জীবনবোধের সুউচ্চ অভিদ্যোতনায় নিশ্চয় অধিষ্ঠিত, যা নিশ্চয়ভাবে পূর্ণমাত্রায় শ্রীহিমাংশু দত্তের মধ্যে ছিল৷ রবীন্দ্রোত্তর সময়ে কাজ করতে গিয়ে কাব্যসংগীতে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তভাবে কেবল ভারতীয় ঐতিহ্যসংগীতে বিচরণ করেও এমন একটি অনবদ্য সুর সৃষ্টি করা যায়, তা বোধহয় শ্রীহিমাংশু দত্তই স্বকীয়ভাবে প্রমাণ রেখেছেন৷ পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল— তাঁরা বারবার রবীন্দ্রপ্রভাবের জালে ধরা পড়েছেন, কিন্তু হিমাংশু দত্ত সুরসাগর সবসময় নিজেকে মৌলিকভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন, He himself was a style৷ ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’ গানটিতে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতের একটি বিশেষ রাগকে অবলম্বন করেও সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে একটি বিশেষ রূপ দিয়ে, একটি বিশেষ রাগের নামকরণ করে, সেটি জনসমাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন৷ কিন্তু সেই রাগ বা মিশ্রণ কখনওই গানটিকে রাগপ্রধান গানের সমগোত্রীয় করেনি৷ গানটির একটি স্বতন্ত্র রূপের ছবি এঁকে একটি সার্থক কাব্যসংগীত সৃষ্টি করেছেন৷ যদিও রাগ নিয়ে যাঁরা রাগারাগি করেন তাঁরা ওই রাগেরই চচ্চড়ি, ঘণ্ট বানান-বৈষ্ণবীয় প্রেমকে কবর দিয়ে৷ নিজেকে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত রেখেও রবীন্দ্রনাথের বাংলা গান সম্পর্কে যে দর্শন নিজ সৃষ্টির মধ্যে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হিমাংশু দত্ত তাঁর এই গানে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘বাংলায় [অর্থাৎ বাংলা সংগীতে] সুর কথাকে খোঁজে৷ চিরকুমার ব্রত তার নয়, সে যুগল মিলনের পক্ষপাতী৷ বাংলার ক্ষেত্রে রসের স্বাভাবিক টানে সুর ও বাণী আপস করে নেয়৷ যেহেতু সেখানে একের যোগেই অন্যটি সার্থক৷ দম্পতির মধ্যে পুরুষের জোর, কর্তৃত্ব যদিও সাধারণভাবে প্রবল, তবুও উভয়ের মিলনে যে সংসারটির সৃষ্টি হয় সেখানে কে বড়, কে ছোট তার মীমাংসা হওয়া কঠিন৷ বাংলা সংগীতের সুর ও কথার সেইরূপ সম্পর্ক৷’ রবীন্দ্রনাথের এই সংগীত-দর্শনের সার্থক রূপ— ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে৷’ সুরস্রষ্টা যদি ওই অসাধারণ বাণীর মর্মস্থলে প্রবেশ করতে না পারতেন, তবে এই হর-পার্বতী মিলন কখনই সম্ভব হত না৷ যে চিত্রকর, তার হাতে অনেক তুলি অনেক রঙ৷ সে তার আবেগ ও শিল্পবোধ বিভাব বিবেক দিয়ে তার চিত্রাঙ্কন করে৷ কিন্তু সুরকার কেবল সুরের রঙ খেলিয়েই তার লীলাচিত্র আঁকেন৷ যিনি বা যে সুরস্রষ্টা সেটা পারেন, তিনিই সার্থক স্রষ্টা৷ অনেক সময় অনেক গান সৃষ্টি হয় কেবল আঙ্গিকসর্বস্ব মূলধনে, তাকে অনেক সময় বৃষ্টির গানে ‘কেটি’কে পাওয়া যায়, কিন্তু ‘কেতকী’র অনুভবে হৃদয়কে স্পর্শ করে না৷ তাই ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’ এই একটি গান দিয়েই শ্রীহিমাংশু দত্ত সুরসাগরের সংগীতস্রষ্টা স্বরূপের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি আঁকা যায়৷ আরও বলব, অনেক সময় গানের বাণীতে একটি বা প্রথম লাইনেই সম্পূর্ণ গানটির বোধকে ধরা যায়, যেমন ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করে প্রভু’ বা ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’৷ কিন্তু ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে’ গানটি আবেগে, উৎকণ্ঠায় নির্মিত কাহিনী-গানের মতো শেষ লাইন পর্যন্ত বোধকে বিধৃত করে সৃষ্টি৷ এখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনুভূতিকে টেনে ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন৷ ছড়াগানে বা ছড়ার ছন্দে রচিত গল্পগানে সুরপ্রাধান্য কমিয়ে হয়ত সেটা করা সহজ৷ কিন্তু পূর্ণমাত্রায় শাস্ত্রীয় সুর ধরে, ওই গভীর কাব্যবোধের সুর রূপায়ণ— এ অসাধারণ সুদক্ষ, ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতাসম্পন্ন সুরসাধকের পক্ষেই সম্ভব৷ দুঃখ হয় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, এই দিকপাল সুরস্রষ্টাদের নির্মাণ নিয়ে আমাদের দেশে কোনও গবেষণা হয় না৷ সংরক্ষণেরও তেমন কোনও প্রামাণিক সুব্যবস্থাও নেই৷ বলতেও দ্বিধা নেই সংগীত নির্মাণের ইতিহাস ধরে, সাংগীতিক, ঐতিহাসিক, কাব্যিক, জীবনদর্শন মিলিয়ে কোনও সুরনির্মাতার সুর বিশ্লেষণ করবেন এমন সুদক্ষ গবেষকেরও যথেষ্ট অভাব আছে৷ এবং যুগক্ষয়ের পচনের মধ্যে ও বিশ্বায়নের ব্যবসা-দর্শনের চাপে গড়ে ওঠা এক অদ্ভুত Cacophonic Culture-এর মধ্যে ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আজ যেভাবে কোণঠাসা, সেখানে যুগের যন্ত্রণার বুকে সেই দুঃসময়কে কাটিয়ে উঠবার পরিকল্পিত পরিকল্পনাও নেই৷ স্বর্ণযুগের সুরকারদের সৃষ্টি নিয়েও ভাবনাচিন্তা হচ্ছে, আধুনিক অনেকের গানের নির্মাণ নিয়েও বিশ্লেষণ হচ্ছে— কিন্তু প্রাক স্বর্ণযুগের দিকপাল সুরস্রষ্টা— যাঁরা আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাসের ধারক— তাঁদের নিয়ে কারও তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই৷ এটা যেমন দুঃখজনক, ততটাই হতাশাব্যঞ্জক৷
শ্রদ্ধেয় শ্রীহিমাংশু দত্ত এমন বিরল বোধে শাস্ত্রীয়সংগীত নিয়ে কাব্য জগতে বিচরণ করেছিলেন যে, তাঁর সময়ের সমসাময়িক সুরকাররাও তাঁর চলার পথের সমগোত্রীয় হয়ে সেই প্রয়োগের দ্বারা অনেকেই প্রভাবান্বিত হন৷ বিশেষ করে সেই অর্থে কুমার শচীন দেববর্মনের কথা এ প্রসঙ্গে উঠবেই৷
সেই সময়ে একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়— যার এক পিঠে ছিল শচীন দেববর্মনের বিখ্যাত গান ‘প্রেমের সমাধি তীরে’৷ গানটার বাণী-রচয়িতা কবি শৈলেন রায় আর সুর সংযোজনা করেছিলেন স্বয়ং হিমাংশু দত্ত সুরসাগর৷ আর অপর পিঠের গানটি ‘আমি ছিনু একা’র রচয়িতা কবি অজয় ভট্টাচার্য এবং সুর দিয়েছিলেন শিল্পী স্বয়ং অর্থাৎ শচীন দেববর্মন নিজেই৷ পাঠকবর্গ যদি দুটি গান পরপর বাজিয়ে শোনেন বুঝতে পারবেন নির্মাণের আঙ্গিকগত সাদৃশ্য৷ রবীন্দ্রনাথের ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’ বা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার রচিত ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’— এই লাইনগুলো সব স্বয়ংসম্পূর্ণভাব বহন করছে অর্থাৎ ওই একটি লাইনেই Istant Coffee-র মেজাজের উত্তাপ অনুভবের মতো৷ বলতে চাইছি এক লাইনেই ক্লান্তিবোধের অনুভব বা স্মৃতির বেদনার বোধ শ্রোতার মনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়৷ কিন্তু ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ গানটি যতক্ষণ না স্থায়ীর পূর্ণ বাণীটি প্রকাশিত হচ্ছে, ততক্ষণ স্থায়ী বা সমগ্র সংগীতটির অর্থ ও অভিপ্রায়ের স্ফূরণ হচ্ছে না৷ স্থায়ীর বাণী ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ অর্থ ও অভিপ্রায় পূর্ণাঙ্গ নয়৷ ক্রমশ প্রকাশিত৷ ‘নেমে এল শুভ্র মেঘের দল এখনও অর্থ ও অভিপ্রায় পূর্ণ প্রকাশিত নয়, সম্পূর্ণ মানেটা প্রকাশিত হল যখন পরের বাণী এল ‘তাজমহলের মর্মরে গাঁথা কবির অশ্রুজল৷’ ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’র— ক্লান্তিবোধ বোঝাতে একটি লাইনই independent এবং ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’— বলার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিমেদুর বেদনার অনুভূতির মধ্যে আমরা প্রবেশ করি৷ এখানেও গৌরীদার গানের প্রথম লাইন independent. কিন্তু ‘প্রেমের সমাধি তীরে’তে যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘কবির অশ্রুজল’ বাণী প্রকাশিত না হচ্ছে, ততক্ষণ প্রতিটি লাইনই dependent, শেষ বাণীটি পর্যন্ত৷ এখানে সুরকার হিসেবে আমাকে ভাবায় তাঁর অসাধারণ সুর নির্মাণ দক্ষতার কথা৷ লোকগাথা গল্পগাথা যেমন ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘রানার’, ‘ছিপখান তিন দাঁড়’, ‘পাল্কি চলে’— এসব গানে সাধারণত আমরা পল্লীসংগীতের নানা আঙ্গিক ব্যবহার করেছি যার story telling style, যা আমাদের কবিগান, তরজা ইত্যাদি থেকে পাওয়া৷ সেখানে সুরের চলনের ক্রম কাহিনীর হাত ধরে চলে৷ কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীতের বিচরণ তো বাণীকেন্দ্রিক নয়— যদিও আলাপ, বিস্তার কোনও না কোনও বাণীকে অবলম্বন করেই— তথাপি তা সুরেরই ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল৷ বাণীর উৎকর্ষ সেখানে প্রধান নয়৷ অথচ সুরসাগর হিমাংশু দত্ত বারবার এই শাস্ত্রীয় সুরকে বাণীময় কাব্যগীতির ভাববিন্যাসে সুনিপুণ দক্ষতায় ব্যবহার করে, বাণীর ও ভাবের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে, সার্থক কাব্য সংগীতের রূপ দিয়েছেন৷ বাণীর বিস্তৃত বিচরণ থাকা সত্ত্বেও তার ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে সৃষ্টি করেছেন৷ কিন্তু রাগ-রাগিণীর দাসত্ব করে রাগপ্রধান বা রাগ অঙ্গের গানের শিরোনামে ভূষিত হতে দেননি৷ হৃদয়ের ভাষা হৃদয় দিয়েই পাঠ করতে হয়— সে ভাষা কেমন হবে তা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’য় বলা আছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথের অমিত রায় লাবণ্যকে বলছে, ‘দেখুন আর্যা, আমাদের দেশে দুটো ভাষা, একটা সাধু, একটা চলতি৷ কিন্তু এ ছাড়া আরও একটা ভাষা থাকা উচিত ছিল— সমাজের ভাষা নয়, ব্যবসায়ের ভাষা নয়, আড়ালের ভাষা৷ এইরকম জায়গা (শিলং পাহাড়)-র জন্যে৷ পাখির গানের মতো, কবির কাব্যের মতো— সেই ভাষা অনায়াসেই কণ্ঠ দিয়ে বেরনো উচিত ছিল৷ যেমন করে কান্না বেরোয়৷’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের কথা বলছেন৷ গীতিকার হিসেবে কবি অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায় যখন সেই ভাষার আবেগকে তুলে ধরেছেন, সেই আবেগের কাব্যকে ঐতিহ্যসংগীতের ধারাকে অবলম্বন করে যে সংগীত-রূপকার সেই ভাষার আবেগকে সুরের আবেগে মিশিয়ে দিতে পারেন এবং dependent লাইনগুলো সুরারোপিত করার সময় কাব্যময়তার continuty বজায় রেখে independent ভাবনাকে সঙ্গে বহন করে নিয়ে যেতে পারেন, তখন একজন উত্তরকালীন সুরকার হিসাবে তাঁকে প্রণাম না জানিয়ে, শ্রদ্ধা না জানিয়ে কী করে নির্লিপ্ত থাকতে পারি? এক্ষেত্রে আমায় মুগ্ধ করে আরও একটা বিশেষ তাৎপর্য, যেটা আমরা রবীন্দ্র অনুসারী সুরকার হয়েও আজও ভাবতে পারি না৷ যখন রবীন্দ্রসূর্য মধ্যাহ্নগগনে পরিপূর্ণতায় আকাশে জ্বলজ্বল করছেন তখন রবীন্দ্র অনুসারী সুরস্রষ্টা না হয়েও তিনি রবীন্দ্রচিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন আপন স্বকীয়তায়৷ কাব্যসংগীত রচনায় সুরকারকে যে-সব রবীন্দ্রভাবনা উদ্বুদ্ধ করতে পারে তা হচ্ছে— ১. ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা’৷ ২. সংগীত সুরের রাগ-রাগিণী নয়— সংগীত ভাবের রাগ-রাগিণী৷ ৩. ‘বাংলা গানে হিন্দুস্থানী সুরই তো পনেরো আনা৷… বাংলা গানে হিন্দুস্থানি সুরের শাশ্বত দীপ্তিই যে নবজন্ম পেয়েছে৷ …হিন্দুস্থানি সংগীতকে আমরা চেয়েছি, কিন্তু আপনার করে পেলে তবেই না পাওয়া হয়৷’
রবীন্দ্র অনুসারী না হয়েও এক পূর্ণাঙ্গ মৌলিক পদ্ধতিতে রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সংগীত সম্পর্কে যে চিন্তা রূপ দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় হিমাংশু দত্ত সুরসাগর তাঁর সৃষ্টি সংগীতে তা অবশ্যই স্বমহিমায়৷ হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের সুর রবীন্দ্রচিন্তার নির্যাস,— বাণী ও সুরের সার্থক দাম্পত্য সম্পর্ক— এরই যথাযথ প্রতিধ্বনি— কিন্তু তা রবীন্দ্রসুরের অনুসারী নয়৷ তাঁর কাব্যময়, মনন-বিচরণে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যবহারে এই যে স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীলতা তা সমকালীন ব্যক্তিত্বের কী রকম প্রভাবিত করেছিল তার একটি উদাহরণ দেব৷ ওই ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ গানটির অপর পিঠে ‘আমি ছিনু একা’— গানটির সুর আরোপ করতে গিয়ে কুমার শচীন দেববর্মনও এই ভাবধারায় কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা ‘আমি ছিনু একা’ গানটির সঞ্চারী তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে৷
‘প্রদীপে শুধানু’ [কী শুধানু?] ‘কিছু জান কি গো’ [কী জান কি গো?] ‘শুধু সে কহিল’, ‘সে যে মায়ামৃগ’— তাতেও অর্থ, অভিপ্রায় পূর্ণ প্রকাশিত নয়— তার পরের লাইনেও ভাব dependent– ‘ কিছু তার আলো কিছু ঢাকা ছায়ে’, এতক্ষণ পরে পুরো অন্তরাটির ভাব শ্রোতার অন্তরে সঞ্চারিত হল৷ কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীত অবলম্বন করে সুর স্বরবিস্তারের আঙ্গিকে এতগুলো dependent লাইনকে ধরে independent ভাবকে অন্য মনে পৌঁছে দিতে পেরেছে৷ আমার বিচারে হিমাংশু দত্তর সৃষ্ট সুর বাতাবরণের প্রভাবেই শচীন দেববর্মন, হয়ত তাঁর অজান্তেই সেই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন৷
‘প্রেমের সমাধি তীরে’ সুরটিতে হিমাংশু দত্ত দরবারি সুর ব্যবহার করেছেন৷ এই রাগ ব্যবহার অনুভব করে আমার একদিন মনে হল, সত্যিই তো সম্রাটের কৃতিত্ব সৌন্দর্যবোধের উৎকর্ষ ‘দরবারি’-তেই তো অধিক প্রমাণিত৷ মমতাজের বিয়োগব্যথায় তো পর্যটকরা ব্যথিত হন না৷ বহুবার তাজমহল দর্শনকারীর সঙ্গে কথা বলেও বুঝেছি, শিল্পের জৌলুস, দরবারি বিলাসের যে ঐতিহাসিক উপভোগ, তাকে ছাপিয়ে প্রেয়সীর বিয়োগব্যথা, দর্শনকে প্রভাবিত করতে পারেনি৷ ‘ছিল চাঁদ’ গানে বৈষ্ণবের যে সমপর্ণের আত্মীয়তা, মমতাজের বিদায়গাথায় তা নেই৷ আমার এই বোধ সমর্থন পেল শ্রদ্ধেয় হিমাংশু দত্তর দরবারি ব্যবহারের নিরিখে৷ অর্থাৎ দরবারের নবাবি প্রভাব থেকে তাজমহল প্রেমের বৃন্দাবনে মুক্তি পায়নি৷ আমার এই বোধ পরবর্তীকালে যাত্রায় সুর দিতে গিয়ে প্রভূত কাজে লেগেছে৷ যাত্রায় রাজদরবারের দৃশ্য হামেশাই পাওয়া যায়— আমি যখনই এইসব দৃশ্যের সংগীত দিয়েছি, ওই দরবারিকে অবলম্বন করেছি৷ আর মনে হয়েছে, বাঁশির সুরে তাজমহলকে বোঝানো যায় না৷ সরোদেই বোঝাতে হয়৷ এ শিক্ষা পেয়েছি শ্রদ্ধেয় হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের সৃষ্টি থেকেই৷ পাঠকবর্গের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, পাঠক-শ্রোতারা যদি সত্যি সত্যি এই বিস্মৃত মহান সুরকারের সৃষ্টিশৈলীর বিষয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে অবগত হওয়ার ইচ্ছা করেন, তবে কিছু তাঁর সুর রচনার সংগীতকে সংগ্রহ করে আমার বক্তব্যের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করুন৷ তাহলে মনে হয় তাঁকে আরও একটু ভালভাবে জানবেন, বুঝবেন— যা কেবল আমার রচনা পাঠ করে বোঝা যাবে না৷ কিছু গানের কথা বলছি— যার মধ্যেই অসাধারণ কাব্যময়তা থাকা সত্ত্বেও যা অসাধারণ ঐতিহ্যপূর্ণ সুর উৎকর্ষে বিধৃত৷ যেমন: ১. রাতের ময়ূর ছড়ালো পাখা, ২. তুমি যে আঁধার, ৩. চাঁদ কহে চামেলি, ৪. আলো ছায়া দোলা, ৫. বরষার মেঘ নামে ইত্যাদি৷
এইসব গানে যেমন শাস্ত্রীয় সংগীতের বিচরণ, তেমনই কাব্যধর্মিতায় সমৃদ্ধ৷ রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সিম্ভনিকে অবলম্বন করে যে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সংগীতের মিশেল ঘটিয়েছিলেন, যাতে বাদী সমবাদীদের সামন্তপ্রতাপ খর্ব হয়েছিল৷ তার প্রয়োগ প্রণালী নিয়েই হিমাংশু দত্তের গান তৈরি, কিন্তু তবু তা মৌলিক৷ আবার সোজাসুজি বিদেশি পর্দা ব্যবহারের পদ্ধতিও তাঁর গানে পাওয়া যায়— যেমন ‘তোমারই পথ পানে চাহি’৷ হিমাংশু দত্তর মতো বৈচিত্র্য-পিয়াসী মন সেখানেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে৷ হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের গানে একটা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত আভিজাত্যের ছাপ আছে, এক পরিশীলিত শিক্ষাযুক্ত রুচির শুচির বিচরণ আছে৷ মূল্যবোধহীন সমাজে তাই এইসব স্রষ্টার সৃষ্টিশৈলী নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা অত্যন্ত জরুরি৷ সুরের ভুবনে তা হবে সুস্থতার চিকিৎসা৷