• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

বড়বাবু – সৈয়দ মুজতবা আলী

লাইব্রেরি » সৈয়দ মুজতবা আলী » বড়বাবু – সৈয়দ মুজতবা আলী

বড়বাবু – সৈয়দ মুজতবা আলী

অবতরণিকা (বড়বাবু)

প্রিন্স্ দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে; পিতার চেয়ে তেইশ বছরের ছোট এবং তার জনের সময় তাঁর মাতার বয়স চৌদ্দ। কনিষ্ঠতম ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ তার চেয়ে একুশ, বাইশ বহুরের ছোট।

আমি এ জীবনে দুটি মুক্ত পুরুষ দেখেছি; তার একজন দ্বিজেন্দ্রনাথ।

এঁর জীবন সম্বন্ধে কোনওকিছু জানবার উপায় নেই। তার সরল কারণ, তার জীবনে কিছুই ঘটেনি। যৌবনারম্ভে বিয়ে করেন, তার পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা। যৌবনেই তিনি বিগতদার হন। পুনর্বার দারুগ্রহণ করেননি।(১) চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ শ্ৰীযুত সৌম্যেন্দ্রনাথ এদেশে সুপরিচিত। দুঃখের বিষয় সুধীন্দ্রনাথের স্থায়ী কীর্তিও বাঙালি পাঠক ভুলে গিয়েছে।

দ্বারকানাথ যে যুগে বিলেত যান সে-সময় অল্প লোকই আপন প্রদেশ থেকে বেরুত। তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ তো প্রায়শ বাড়ির বাইরে বাইরে কাটাতেন। ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথের তো কথাই নেই। তাই স্বতই প্রশ্ন জাগবে, ইনি কতখানি ভ্রমণ করেছিলেন।

একদা কে যেন বলেছিলেন, বাংলায় মন্দাক্রান্ত ছন্দে লেখা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে তিনিই লিখে দিলেন :

ইচ্ছা সম্যক জগদরশনে(২) কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিক্লি মন উড়ু উড়ু এ কি দৈবের শাস্তি!
 টঙ্কা দেবী করে যদি কৃপা না বহে কোনও জ্বালা।
বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না শুধু ভস্মে ঘি ঢালা। (৩)

 চারটি ছত্রের চারটি তথ্যই ঠাট্টা করে লেখা। কারণ আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনিনি, বড়বাবুর (দ্বিজেন্দ্রনাথের) বেড়াবার শখ ছিল। বরঞ্চ শুনেছি, তার প্রথম যৌবনে তাঁর পিতা মহর্ষিদেব তার বিদেশ যাবার ইচ্ছা আছে কি না, শুধিয়ে পাঠান এবং তিনি অনিচ্ছা জানান। পাথেয় নাস্তি কথাটারও কোনও অর্থ হয় না; দেবেন্দ্রনাথের বড় ছেলের টাকা ছিল না, কিংবা কর্তা গত হওয়ার পরও হাতে টাকা আসেনি, এটা অবিশ্বাস্য।

আমার সামনে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি তা হলে নিবেদন করি। ১৩৩১-এর ১লা বৈশাখের সকালে রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে উপাসনা সমাপন করে যথারীতি সর্বজ্যেষ্ঠের পদধূলি নিতে যান। সেবারে ওই ১লা বৈশাখেই বোঝা গিয়েছিল, বাকি বৈশাখ এবং বৃষ্টি না নামা পর্যন্ত কীরকম উৎকট গরম পড়বে। প্রেসের পাশের তখনকার দিনের সবচেয়ে বড় কুয়োর জল শুকিয়ে গিয়ে প্রায় শেষ হতে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ তার সর্বাগ্ৰজকে বললেন যে, এবারে গরম বেশি পড়বে বলে তিনি হিমালয়ের ঘুমে বাড়ি ভাড়া করেছেন, বড়দাদা গেলে ভালো হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বড়বাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, আমি আমি আমার এই ঘর-সংসার নিয়ে যাব কোথায়? যে সব গুরুজন আর ছেলেরা গুরুদেবের সঙ্গে গিয়েছিলেন তারা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলেন। হয়তো-বা মুখ টিপে হেসেও ছিলেন। তার ঘর-সংসার! ছিল তো সবে মাত্র দু-একটি কলম, বাক্স বানাবার জন্য কিছু পুরু কাগজ, দু-একখানা খাতা, কিছু পুরনো আসবাব! একে বলে ঘর-সংসার! এবং তার প্রতি তার মায়া! জীবনস্মৃতির পাঠক স্মরণে আনতে পারবেন, নিজের রচনা, কবিতার প্রতি তার কী চরম ঔদাসীন্য ছিল!(৪) লোকমুখে শুনেছি সকলের অজান্তে এক ভিখিরি এসে তার কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন, আমার কাছে তো এখন কিছু নেই। তুমি এই শালখানা নিয়ে যাও। প্রাচীন যুগের দামি কাশ্মিরি শাল। হয়তো-বা দ্বারকানাথের আমলের। কারণ তার শালে শখ ছিল। ভিখিরি প্রথমটায় নাকি নিতে চায়নি! শেষটায় যখন বড়বাবুর চাকর দেখে বাবুর উরুর উপর শালখানা নেই, সে নাতি দিনেন্দ্রনাথকে (রবীন্দ্রনাথের গানের ভারী) খবর দেয়। তিনি বোলপুরে লোক পাঠিয়ে শালখানা কিনিয়ে ফেরত আনান। ভিখিরি নাকি খুশি হয়েই বিক্রি করে; কারণ এরকম দামি শাল সবাই চোরাই বলেই সন্দেহ করত। কথিত আছে, পরের দিন যখন সেই শালই তার উরুর উপর রাখা হয় তখন তিনি সেটি লক্ষ করলেন না যে এটা আবার এল কী করে!

আবার কবিতাটিতে ফিরে যাই। পায়ে শিকলি, মন উড়ু উড়ু আর যার সম্বন্ধে খাটে খাটুক, দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে খাটে না! এরকম সদানন্দ, শান্ত-প্রশান্ত, কণামাত্র অজুহাত পেলে অট্টহাস্যে উচ্ছ্বসিত মানুষ আমি ভূ-ভারতে কোথাও দেখিনি। আমার কথা বাদ দিন। তাঁর সম্বন্ধে বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, হরিচরণ যা লিখে গেছেন সে-ই যথেষ্ট। কিংবা শ্ৰীযুত নন্দলালকে জিগ্যেস করতে পারেন।

টঙ্কা দেবী করে যদি কৃপা– ও বিষয়ে তিনি জীবন্মুক্ত ছিলেন।

আর সবচেয়ে মারাত্মক শেষ ছত্রটি! তার বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না বললে কার যে ছিল, কার যে আছে সেটা জানবার আমার বাসনা আছে। অবশ্য সাংসারিক বুদ্ধি তার একটি কানাকড়িমাত্রও ছিল না। কিন্তু সে অর্থে আমি নেব কেন? বুদ্ধি বলতে সাংখ্যদর্শনে যে অর্থে আছে সে অর্থেই নিচ্ছি যে গুণ প্রকৃতির রজঃ তম গুণের জড়পাশ ছিন্ন করে জীবকে পুরুষের উপলব্ধি লাভ করতে নিয়ে যায়।(৫) তার বিদ্যা সম্বন্ধে পুনরাবৃত্তি করে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথ একদিন আমাদের বলেন, তিনি জীবনে দুটি পণ্ডিত দেখেছেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং তাঁর বড়দাদা; কিন্তু রাজেন্দ্রলাল পণ্ডিত ইয়োরোপীয় অর্থে। তাঁর বড়দাদা কোন অর্থে, কবি সেটি বলেননি। এবং খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা যেন না ভাবি তার বড়দাদা বলে তিনি একথা বললেন।

বর্তমান লেখকের বিদ্যাবুদ্ধি উভয়ই অতিশয় সীমাবদ্ধ। তবে আমারই মতো অজ্ঞ একাধিকজনের জানবার বাসনা জাগতে পারে আমি কাদের পণ্ডিত বলে মনে করি। আমি দেখেছি দুজন পণ্ডিতকে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ইয়োরোপবাসের পরও।

অনেকের সম্বন্ধেই বেখেয়ালে বলা হয়, অমুকের বহুমুখী প্রতিভা ছিল। আমি বলি সত্যকার বহুমুখী প্রতিভা ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের। বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়েরই চর্চা করেছেন তিনি সমস্ত জীবন ধরে। রবীন্দ্রনাথ তার গণিতচর্চা বিদেশে প্রকাশিত করার জন্যে উত্সাহী ছিলেন, কিন্তু বড়দাদা বিশেষ গা-করেননি।(৬) এদেশের অত্যল্প লোকই এযাবৎ গ্রিকলাতিনের প্রতি মনোযোগ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ গ্রিকলাতিনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে শব্দতত্ত্বে সংস্কৃত উপসর্গ, তথা মুখুয্যে, বড়য্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে তার সুদীর্ঘ রচনা অতুলনীয়। কঠিন, অতিশয় কঠিন পাঠককে সাবধান করে দিচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটারও উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করি যে, এরকম কঠিন জিনিস এর চেয়ে সরল করে স্বয়ং সরস্বতীও লিখতে পারতেন না।

আমার যতদূর জানা, খাঁটি ভারতীয় পণ্ডিতের ন্যায় ইতিহাসকে তিনি অত্যধিক মূল্য দিতেন না–ইতিহাস পের সে, বাই ইটসেল। অথচ পরিপূর্ণ অনুরাগ ছিল ইতিহাসের দর্শন-এর (ফিলসফি অব হিস্ট্রির প্রতি।

সাহিত্য ও কাব্যে তার অধিকার কতখানি ছিল সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অভিমত পূর্বেই উদ্ধৃত করেছি। বিশেষ বয়সে তিনি খাঁটি কাব্য রচনা বন্ধ করে দেন। কিন্তু দর্শন ছাড়া যে কোনও বিষয় রচনা করতে হলে (যেমন শব্দতত্ত্ব বা রেখাক্ষর বর্ণমালা অর্থাৎ বাংলায় শর্টহ্যান্ড) মিল, ছন্দ ব্যবহার করে কবিতারূপেই প্রকাশ করতেন। বস্তৃত কঠিন দর্শনের বাদানুবাদ ভিন্ন অন্য যে কোনও ভাবানুভূতি তার হৃদয়মনে সঞ্চারিত হলেই তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হত সেটি কবিতাতে প্রকাশ করার। এবং তাতে যদি হাস্যরসের কণামাত্র উপস্থিতি থাকত, তা হলে তো আর কথাই নেই।

নিচের একটি সামান্য উদাহরণ নিন :

তারই নামে নাম, অধুনা অর্ধবিস্মৃত, কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (বরঞ্চ ডি, এল. রায় বললে আজকের দিনের লোক হয়তো তাকে চিনলে চিনতেও পারে) একদা তদীয় গণ্যমান্য বিখ্যাত ও অব্যাত বই বন্ধু-বান্ধবকে একটা বিরাট ভেজে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে তাহার যে আহ্বান-লিপি জারি হইয়াছিল তাহা এস্থলে অবিকল মুদ্রিত করিয়া দিতেছি।

যাহার কুবেরের ন্যায় সম্পত্তি, বৃহস্পতির ন্যায় বুদ্ধি, যমের ন্যায় প্রতাপ এ হেন যে আপনি, আপনার বনের নন্দনকানন ছাড়িয়া, আপনার পদ্মপলাশবনা ভামিনী-সমভিব্যাহারে (sic), আপনার স্বর্ণশকটে অধিরূঢ় হইয়া, এই দীন অকিঞ্চিৎকর, অধমদের গৃহে, শনিবার মেঘাচ্ছন্ন অপরাহ্নে আসিয়া যদি শ্রীচরণের পবিত্র ধূলি ঝাড়েন–তবে আমাদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়। ইতি,

শ্রীসুরবালা দেবী
 শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
 শ্রীজিতেন্দ্রনাথ মজুমদার।(৭)

এর উত্তরে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখলেন,

ন চ সম্পত্তি ন বুদ্ধি বৃহস্পতি,
যমঃ প্রতাপ নাহিক মে।
 ন চ নন্দনকানন স্বর্ণসুবাহন
পদ্মবিনিন্দিত পদযুগ মে।
আছে সত্যি পদরজরত্তি।
তাও পবিত্র কে জানিত মে
চৌদ্দপুরুষ তব ত্রাণ পায় যদি,
অবশ্য ঝাড়িব তব ভবনে।
 কিন্তু মেঘাচ্ছনে শনি অপরাহ্নে
যদি গুরু বাধা না ঘটে মে।
কিম্বা (sic) যদ্যপি সহসা চুপিচুপি
প্রেরিত না হই পরধামে।(৮)

 গুরুজনদের মুখে এখানে গুনেছি যে সময় তিনি এই মিশ্র সংস্কৃতে নিমন্ত্রণপত্রের উত্তর দেন তখন তিনি গীতগোবিন্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন বলে ওই ভাষাই ব্যবহার করেন। কেউ কেউ বলেন, জয়দেবই প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষার কাঠামো তৈরি করে দিয়ে যান। তাই দ্বিজেন্দ্রনাথের উত্তরও শেষের দিকটি বাঙলায়। আবার কোনও কোনও গুরুজন দ্বিতীয় ছত্রটি পড়েন, ন চ নন্দনকানন স্বর্ণসুবাহন পদ্মপলাশলোচনভামিনী মে।

কবিতাতে সবকিছু প্রকাশ করার আরও দুটি মধুর দৃষ্টান্ত দিই।

শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষেধ ছিল। একদিন দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাতভ্রমণের সময় দূর হতে দেখতে পান, হেডমাস্টার জগদানন্দ রায় একটি ছেলের কান আচ্ছা করে কষে দিচ্ছেন। কুটিরে ফিরে এসেই তাঁকে লিখে পাঠালেন।

শোনো হে, জগদানন্দ দাদা,
গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব
অশ্বে পিটিলে হয় যে গাধা—

 গাধা পিটলে ঘোড়া হয় না–এটা আমাদের জানা ছিল, কিন্তু ঘোড়াকে পিটলে সেটা গাধা হয়ে যায় এটি দ্বিজেন্দ্রনাথের অবদান। এরসঙ্গে আবার কেউ কেউ যোগ দিতেন,

শোন হে জগদানন্দ,
তুমি কি অন্ধ!

 এটির লিখিত পাঠ নেই। তাই নির্ভয়ে উদ্ধৃত করলুম। এর পরেরটি কিন্তু ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে বেরিয়েছে। এরমধ্যে ভুল থাকলে গবেষক সেটি অনায়াসে মেরামত করে নিতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথের ৬৫ বৎসর বয়স হলে তিনি ভোরবেলা চিরকুটে লিখে পাঠালেন :

চমৎকার না চমৎকার।
সেই সেদিনের বালক দেখো,
পঞ্চষট্টি হল পার।
কাণ্ডখানা চমৎকার,
চমৎকার না চমৎকার!

পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ততদিন কলকাতাতেই ছিলেন। মোটামুটি বলা যেতে পারে, ১৮৭০ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় বিদ্বজ্জনসমাজের চক্রবর্তী ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম তিনি ধর্মের স্মৃতিশাস্ত্রটুকু ব্যবহার করেছেন মাত্র; মোক্ষপথ-নির্দেশক ধর্ম ও দর্শনে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল না) ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করতেন না বলে সে যুগের অন্যতম চক্রবর্তী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের নিত্যালাপী প্রায়ই ঠাকুরবাড়িতে এসে তার সঙ্গে তত্ত্বালোচনা করে যেতেন।(৯)

ওই সময় বঙ্কিমের বিরুদ্ধ-আলোচনা হলে তার কিঞ্চিৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং ফলে, এর মধ্যে একজন ঠাকুরবাড়িতে কাজ করতেন বলে বঙ্কিম লেখেন, শুনিয়াছি ইনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর মহাশয়দিগের একজন ভূত– নাএব কি কি আমি ঠিক জানি না। অথচ দ্বিজেন্দ্রনাথ যখন আমার মনে হয় অনিচ্ছায়–বঙ্কিম সম্বন্ধে আলোচনা করেন তখন বঙ্কিম গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, তত্ত্ববোধিনীতে নব্য হিন্দু সম্প্রদায় এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধে আমার লিখিত ধর্ম-জিজ্ঞাসা সমালোচিত হয়। সমালোচনা আক্রমণ নহে। এই লেখক বিজ্ঞ, গম্ভীর এবং ভাবুক। আমার যাহা বলিবার আছে, তাহা সব শুনিয়া যদি প্রথম সংখ্যার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করিয়া (বঙ্কিমের রচনাটি ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হচ্ছিল–লেখক) তিনি সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইতেন, তবে তাহার কোনও দোষই দিতে পারিতাম না। তিনি যদি অকারণে আমার উপর নিরীশ্বরবাদ প্রভৃতি দোষ আরোপিত না করিতেন,(১০) তবে আজ তাঁহার প্রবন্ধ এই গণনার ভিতর (অর্থাৎ যারা বঙ্কিমের প্রতিবাদ করেন, নগণ্য অর্থে নয় –লেখক) ধরিতে পারিতাম না। তিনি যে দয়ার সহিত সমালোচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি আমার ধন্যবাদের পাত্র। বোধহয় বলায় দোষ নাই যে, এই লেখক স্বয়ং তত্ত্ববোধিনী সম্পাদক বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আমি জানি আমার কথায় কেউ বিশ্বাস করবেন না, তাই আমি এঁর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণার উল্লেখ করলুম। বস্তৃত বাঙলা দেশের এই উনবিংশ শতকের শেষের দিক (ফঁ্যা দ্য সিএল) যে কী অদ্ভুত রত্নগর্ভা তা আজকের দিনের অবস্থা দেখে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।

আমি সে আলোচনা এস্থলে করতে চাই নে। আমি শুধু নব্যসম্প্রদায়ের মধ্যে যারা তত্ত্বানেষী তাদের দৃষ্টি দ্বিজেন্দ্রনাথের দিকে আকৃষ্ট করতে চাই।

পিতার মৃত্যুর পর তিনি প্রায় এক বত্সর তার সখা সিংহ পরিবারের সঙ্গে রাইপুরে কাটান। তার পর ১৯০৭-এর কাছাকাছি শান্তিনিকেতন আশ্রমের বাইরে (এখন রীতিমতো ভিতরে এসে আমৃত্যু (১৯২৬) বসবাস করেন। কলকাতার সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে তিনজন লোক তার নিত্যালাপী ছিলেন, স্বৰ্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন ও রেভরেন্ড এন্ড্রুজ। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়ই ভুলে যেতেন যে রবীন্দ্রনাথের বয়সও ষাট পেরিয়ে গেছে (আমি শেষের পাঁচ বত্সরের কথা বলছি। স্বচক্ষে যা দেখেছি) এবং শাস্ত্রীমশাই যদি দ্বিজেন্দ্রনাথের কোনও নতুন লেখা শুনে মুগ্ধ হয়ে বলতেন, এটি গুরুদেবকে দেখাতেই হবে, তখন তিনি প্রথমটায় বুঝতেনই না, গুরুদেব কে, এবং অবশেষে বুঝতে পেরে অট্টহাস্য করে বলতেন, রবি রবি তো ছেলেমানুষ! সে এসব বুঝবে কি তুলে যেতেন, বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। আবার পরদিনই হয়তো বাঙলা ডিফথং সম্বন্ধে কবিতায় একটি প্রবন্ধ (!) লিখে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথকে। চিরকুটে প্রশ্ন, কীরকম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কী উত্তর দিতেন সেটি পাঠক খুঁজে দেখে নেবেন।

শিশুর মতো সরল এই মহাপুরুষ সম্বন্ধে সে যুগে কত লেজেন্ড প্রচলিত ছিল তার অনেকখানি এখনও বলতে পারবেন শ্ৰীযুত গোস্বামী নিত্যানন্দবিনোদ, আচার্য নন্দলাল, আচার্য সুরেন কর, বন্ধুবর বিনোদবিহারী, অনুজপ্রতিম শান্তিদেব, উপাচার্য সুধীরঞ্জন। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দীপেন্দ্রনাথ তারই জীবদ্দশায় গত হলে পর তিনি নাকি চিন্তাতুর হয়ে পুত্রের এক সখাকে জিগ্যেস করেন, তা দীপু উইল-টুইল ঠিকমতো করে গেছেন তো? এ গল্পটি বলেন শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত ও উপাচার্য শ্ৰীযুত সুধীরঞ্জন। সুধীরঞ্জন চিফ-জাস্টিস ছিলেন বলে আইনের ব্যাপারে দ্বিজেন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা স্বতই তার মনে কৌতুকের সৃষ্টি করে এবং গল্পটি বলার পর তিনি বিজ্ঞভাবে গম্ভীর হয়ে চোখের ঠার মানেন।

তার অকপট সরলতা নিয়ে যেসব লেজেন্ড (পুরাণ) প্রচলিত আছে সে সম্বন্ধে একাধিক আশ্রমবাসী একাধিক রসরচনা প্রকাশ করেছেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সামান্য। একবার আমার হাতে একটি সুন্দর মলাটের পাতা দেখে শুধোলেন, এটা কোথায় কিনলে? আমি বললুম, কোপে। সে আবার কী? আমি বললুম, কো-অপারেটিভ স্টোর্সে। তিনি উচ্চহাস্য(১১) (এ উহাস্য কারণে অকারণে উসিত হত এবং প্রবাদ আছে দেহলীতে বসে গুরুদেব তাই শুনে মৃদুহাস্য করতেন) করে বললেন, ও! তাই নাকি! তা কত দাম নিলে? আমি বললুম, সাড়ে পাঁচ আনা। আমি চলে আসবার সময় একখানা চিরকুট আমার হাতে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, বউমা (কিংবা ওই ধরনের সম্বোধন, আমাকে তুমি (কিংবা আপনি, তিনি কখন কাকে আপনি কখন তুমি বলতেন তার ঠিক থাকত না–তুই বলতে বড় একটা শুনিনি) সাড়ে পাঁচ আনা পয়সা দিলে আমি একখানা খাতা কিনি। তার পুত্রবধূ তখন বোধহয় দু-একদিনের জন্য উত্তরায়ণ গিয়েছিলেন।

তার এক আত্মীয়ের মুখে শুনেছি, একবার বাম্পা-ক্রপ হলে পর সুযোগ বুঝে পিতা মহর্ষিদেব তাঁকে খাজনা তুলতে গ্রামাঞ্চলে পাঠান। গ্রামের দুরবস্থা দেখে তিনি নাকি তার করলেন, সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড। (তার গ্রামোন্নয়ন করার বোধহয় বাসনা হয়েছিল। উত্তর গেল, কাম ব্যাক!

***

তাঁর সাহিত্যচর্চা, বিশেষত স্বপ্নপ্রয়াণ, মেঘদূতের বঙ্গানুবাদ ও অন্যান্য কাব্য শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন তার ইতিহাস গ্রন্থে অত্যুত্তম আলোচনা করেছেন। বস্তুত তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথকে উপেক্ষা করেননি বলে বঙ্গজন তার কাছে কৃতজ্ঞ। এ নিয়ে আরও আলোচনা হলে ভালো হয়।

আশ্চর্য বোধ হয়, এই সাতিশয় অন-প্রাকটিক্যাল, অধ্যবসায়ী লোকটি কেন যে বাঙলায় শর্টহ্যান্ড প্রচলন করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলেন! এ কাজে তার মূল্যবান সময় তো একাধিকবার গেলই, তদুপরি আগাগোড়া বইখানা–দু দুবার-ব্লকে ছাপতে হয়েছে, কারণ তিনি যেসব সাংকেতিক চিহ্ন (সিম্বল) আবিষ্কার করে ব্যবহার করেছেন সেগুলো প্রেসে থাকার কথা নয়। তদুপরি মাঝে মাঝে পাখি, মানুষের মুখ, এসবের ছবিও তিনি আপন হাতে একে দিয়েছেন।

প্রথমবারের প্রচেষ্টা পুস্তকাকারে প্রকাশের(১২) বহু পরে তিনি দ্বিতীয় প্রচেষ্টা দেন। তার প্রাক্কালে তিনি বিধুশেখরকে যে পত্র দেন সেটি প্রথম (কিংবা দ্বিতীয় প্রচেষ্টার পুস্তকের ভিতর একখানি চিরকুটে আমি পেয়েছি। তাতে লেখা,

শাস্ত্রী মহাশয়,
আমি বহু পূর্বে হোলদে কাগজে রেখাক্ষর স্বহস্তে ছাপাইয়াছিলাম১৩-লাইব্রেরিতে তাহার গোটা চার-পাঁচ কপি আছে। তাহার একখানি পাঠাইয়া দিন। নিচে স্বাক্ষর নেই। শুনেছি, স্বৰ্গত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি দ্বিতীয়বার একখানি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক রচনা করেন। প্রথমখানির সঙ্গে দ্বিতীয়খানি মিলালেই ধরা পড়ে যে, তিনি এবারে প্রায় সম্পূর্ণ নতুন করে বইখানা লিখলেন। এটির প্রকাশ ১৩১৯ সনে।

এবং বই দুইখানি না দেখা পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করবেন না যে, শর্টহ্যান্ডের মতো রসকষহীন বিষয়বস্তু তিনি আগাগোড়া লিখেছেন পদ্যে–নানাবিধ ছন্দ ব্যবহার করে।

প্রথমেই তিনি লেগেছেন বাঙলার অক্ষর কমাতে; লিখেছেন–

রেখাক্ষর বর্ণমালা

॥ প্রথম ভাগ ॥

বত্রিশ সিংহাসন।

বাঙলা বর্ণমালায় উপসর্গ নানা।
অদৃভুত নূতন সব কাণ্ডকারখানা।
য-যে শূন্য, ড-য়ে শূন্য, শূন্য পালে পাল!
দেবনাগরিতে নাই এসব জঞ্জাল।
য যবে জমকি বসে শবদের মুড়া।
জ বলে সবাই তারে কি ছেলে কি বুড়া ॥
 মাজায় কিম্বা ল্যাজায় নিবসে যখন।
ইয় উচ্চারণ তার কে করে বারণ।
 ময়ূর ময়ূর বই মজুর তো নয়।
উদয় উদজ নহে, উদ্য উদয়।

এরপর তাঁর বক্তব্য ছবি দিয়ে দৃষ্টি আকৃষ্ট করে তিনি ড ঢ ও ড় ঢ় নিয়ে পড়লেন :

কেন এ ঘোড়ার ডিম ড-য়ের তলায়।
 বুঢ়াটাও ডিম পাড়ে! বাঁচিনে জ্বালায়?
একি দেখি! বাঙ্গালার বর্ণমালী যত
সকলেই আমা সনে লঢ়িতে উদ্যত।
 ব্যাকরণ না জানিয়া অকারণ লঢ়।
শবদের অন্তে মাঝে ড ঢ-ই তো ড় ঢ়।

দ্বিতীয় সংস্করণে ব্যাপারটি তিনি আরও সংক্ষেপে সারছেন :

শূন্যের শূন্যত্ব
শবদের অন্তে মাঝে বসে যবে সুখে।
বেরোয় য়-ড়-ঢ় বুলি য-ড-ঢ’র মুখে।
জানো যদি, কেন তবে শূন্য দেও নীচে?
চেনা বামুনের গলে পৈতে কেন মিছে!
নীচের ছত্তর চারি চেঁচাইয়া পড়–
 যাবৎ না হয় তাহা কষ্ট্রে সড়গড়।

পাঠ
আষাঢ়ে ঢাকিল নভ পয়োধর-জালে।
 বায়স উড়িয়া বসে ডালের আড়ালে।
 ঘনরবে ময়ূরের আনন্দ না ধরে।
খুলিয়া খড়ম জোড়া ঢুকিলাম ঘরে।

 একেই বোধহয় গ্রিক অলঙ্কারের অনুকরণে ইংরেজিতে বেথস বলা হয়। প্রথম তিন লাইনে নৈসর্গিক বর্ণনার মায়াজাল নির্মাণ করে হঠাৎ খড়ম-জোড়ার মুদার দিয়ে আলঙ্কারিক মোহ-মুদার নির্মাণ।

ছন্দ মিল ব্যঞ্জনা অনুপ্রাসকবিতা রচনার যে কটি টেকনিক্যাল স্কিল প্রয়োজন তার সবটাই কবির করায়ত্ত। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই! এর পরেই দেখুন সাদামাটা পয়ার ভেঙে ১১ অক্ষরের (!) ছন্দ :

চারি কর্মপতি
ক চ-বগের ক মহারথী :
 ত প-বরগের ত কুলপতি,
ন ট-বরগের ন নটবর;
 র স-বরগের গুণধর;–
চারি বরগের চারি অধিপ
বরণমালার প্রদীপ ॥

শুধু তাই নয়, পাঠক লক্ষ করবেন, প্রথম চার ছত্রের প্রথম অংশে ছ অক্ষর, শেষের অংশে চার অক্ষর; ফলে জোর পড়বে সপ্তম অক্ষর ক, ত, ন, র-এর ওপর। এবং সেইটেই লেখকের উদ্দেশ্য, জোর দিয়ে শেখানো।

এই যুগে অনেকেই বৈষ্ণবদের ঢলাঢলি পছন্দ করতেন না। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁদের বহু ঊর্ধ্বে। তাই :

এই এউ আউ ইত্যাদি ডিফথং-এর অনুশীলন করাতে এগুলো নিয়ে কীরকম কবিতা ফেঁদেছেন, দেখুন :

আউলে গোঁসাই গউর চাঁদ
 ভাসাইল দেশ টুটিয়া বাঁধ
 দুই ভাই মিলি আসিছে অই(১৪)
কী(১৫) মাধুরী আহা কেমনে কই।
পাষাণ হৃদয় করিয়া জয়
আধাআধি করি বাঁটিয়া লয়
শওশ হাজার দোধারি লোক।
 দোঁহারে নেহারে ফেরে না চোক।
 কূল ধসানিয়া প্রেমের ঢেউ
 দেখেনি এমন কোথাও কেউ
এই নাচে গায় দুহাত তুলি।
এই কাঁদে এই লুটায় ধূলি।

 কে বলবে এটা নিছক রসসৃষ্টি নয়, অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা? নিতান্ত গদ্যময় শর্ট্যান্ড-পদ্যে!

এর পর তিনি যেটা প্রস্তাব করেছেন সেটি বহু বৎসর পরে মেনে নেওয়া হল :

শুনিবে গুরুজি মোর কি বলেন? শোনো!
চেলা শিরে তেল দিয়া ফল নাই কোনও
আর-ত দিলে আর্ত-এ ছাড়িবে আর্তরব।
আর-দ চাপাইলে পিঠে রবে না গর্দভ।
ইট করিও না নষ্ট বোঝা করি পুষ্ট।
 অর্ধে(১৬) দিয়া জলে ফেলি অর্ধে থাক তুষ্ট।
কর্মের ম এ ম ফলা অকর্ম বিশেষ।
কার্য্যের যয়ে য ফলা অকার্যের শেষ।

প্রথম পাঠ সাঙ্গ হলে কবি-মাস্টার ভরসা দিচ্ছেন পুরো লেখা সাঙ্গ হবে অর্ধেক পাতায়। এবং তদুপরি

কাগজ বাঁচিবে ঢের নাহি তায় ভুল।
বাঁচিতেও পারে কিছু ডাকের মাশুল।

এ না হয় হল। কিন্তু গড়ের মাঠে যখন কংগ্রেসিরা (তখনও কনিষ্টি আসেননি), বাক্যের ঝড় বওয়াবেন তখন? তখন কি সেটা শব্দে শব্দে ভোলা যাবে না।

ওবিদ্যার কর্ম নহে- যখন বক্তার
 মুখে ঝড় বহি চলে ছাড়ি হুহুকার
তার সঙ্গে লেখনীর টক লাগানো
এ বিদ্যা দ্বিতীয় খণ্ডে হয়েছে বাগানো।
তখন
 মস্তকে মথিয়া লয়ে পুস্তকের সার,
হস্তকে করিবে তার তুরুক-সোআর।
হইবে লেখনী ঘোড় দোউড়ের ঘোড়া
আগে কিন্তু পাকা করি বাঁধা চাই গোড়া।

 এবং দ্বিতীয় খরে পুস্তক সমাপ্তিতে বলছেন;

তখন তাহাকে হবে থামানো কঠিন।
ছুটিবে– পরাণ ভয়ে যেমতি হরিণ।

এই বইয়ে প্রতিটি ছত্র তুলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্থানাভাব। তবে সর্বশেষে কয়েকটি ছত্র না তুলে দিলে সে আমলের কয়েকটি তরুণ আজ তারা বৃদ্ধ– মর্মাহত হবেন। কারণ রেখাক্ষর তারা না শিখলেও এ কবিতাটি মুখে মুখে এতই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আজও সেটি কিয়নের কণ্ঠস্থ :

আনন্দের বৃন্দাবন আজি অন্ধকার।
 গুঞ্জরে না ভৃঙ্গকুল কুঞ্জবনে আর(১৭)
 কদম্বের তলে যায় বংশী গড়াগড়ি
 উপুড় হইয়া ডিঙ্গা পঙ্কে আছে পড়ি।
 কালিন্দীর কূলে বসি কান্দে গোপনারী,
তরঙ্গিণী তরাইবে কে আর কাণ্ডারী(১৮)
আর কি সে মনোচোর দেখা দিবে চক্ষে
সিন্ধিকাঠি থুয়ে গেছে বিন্ধাইয়া বক্ষে ॥
 কৃষ্ণ গেছে গোষ্ঠ ছাড়ি রাষ্ট(১৯) পথে হাটে।
শুষ্ক মুখ রাধিকার দুখে বুক ফাটে।
কৃষ্ণ বলি ভ্রষ্ট বেণী বক্ষে ধরি চাপি।
 ভূপৃষ্ঠে লুটায় পড়ে মর্মদাহে ভাপি।
 কষ্ট বলে অষ্ট সখী মমদাহে কোলে
 চিন্তা করিও না রাই কৃষ্ণ এল বলে।
এত বলি হাহু করে বাষ্প আর মোছে।
 সবারই সমান দশা কেবা কারে পোছে।
 দুষ্ট বধে পূরে নাই কৃষ্ণের অভীষ্ট।
অদৃষ্টে অবলাবধ আছে অবশিষ্ট। (২০)

 কে বলবে প্রথমাংশ লেখা হয়েছে ন, ঙ, ম-প্রধান যুক্তাক্ষর ও দ্বিতীয়টি স্ব-প্রধান যুক্তাক্ষরের অনুশীলনের জন্য! আরেকটি কথা এই সুবাদে নিবেদন করি আমার এক আত্মজনের মুখে শোনা : বঙ্কিমচন্দ্র যখন তার কৃষ্ণচরিত্রে প্রমাণ করতে চাইলেন, গীতার শ্রীকৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ এক ব্যক্তি নন, তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ নাকি রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে বলেন, বঙ্কিমবাবু, এসব কী আরম্ভ করলেন, রবি? বৃন্দাবনের রসরাজকে মেরে ফেলছেন যে! বাঙলা সাহিত্য বৈষ্ণব পদাবলীর ওপর কতখানি খাড়া, আজ সেটা স্বীকার করতে আমাদের আর বাধে না। কিন্তু সেই মারাত্মক পিউরিটান যুগে, যখন কেউ কেউ নাকি কদম্ববৃক্ষকে অশ্লীলবৃক্ষ (এটা অবশ্য বিরুদ্ধপক্ষের ব্যঙ্গ- রিডাকসিও অ্যাড আবসার্ডাম পদ্ধতিতে) বলতেন তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ জানতেন, বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে গীতার শ্রীকৃষ্ণ থেকে ভিন্ন করে ফেললে বৃন্দাবন-লীলা নিতান্তই মানবিক প্রেমে পর্যবসিত হয়; ভক্তজন তাঁদের আধ্যাত্মিক অমৃত থেকে বঞ্চিত হবেন।

প্রথম যৌবন থেকেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ধর্ম-সঙ্গীত রচনা আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন তাঁর এগারো বছর বয়সে আমি বেহাগে গান গাহিতেছি–

তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে
সে সহায় ভব-অন্ধকারে

 তিনি (পিতা) নিস্তব্ধ হইয়া নতশিরে কোলের উপর দুই হাত জোড় করিয়া শুনিতেছেন– সেই সন্ধ্যাবেলাটির ছবি আজও মনে পড়িতেছে।

এই গানটি দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা; এবং রেখাক্ষর বর্ণমালাতেও তিনি অনুশীলন হিসেবে এটি উদ্ধৃত করেছেন। যদিও ব্রহ্মসঙ্গীতে তার মাত্র ত্রিশাট গান পাওয়া যায়, তবু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তিনি বিস্তর গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের রচনা সম্বন্ধে এমনই উদাসীন ছিলেন একথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে সেগুলো বাঁচিয়ে রাখবার কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি।

ধীরে ধীরে তিনি সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত, শব্দতত্ত্ব, ইতিহাসের দর্শন সব জিনিস থেকে বিদায় নিয়ে ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান ও তার অনুশীলনে নিযুক্ত হলেন। এ যে কী অভ্রভেদী দুর্জয় সাধনা তার বর্ণনা দেবার শাস্ত্রাধিকার আমার নেই। একদিকে ইয়োরোপীয় দর্শন তাঁর নখদর্পণে ছিল। অন্যদিকে বেদান্ত, সাংখ্য এবং মোগ– উপনিষদ, গীতা এবং মহাভারতের তত্ত্বাংশ। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান শুধু স্পেকুলেট তথা তর্কবিতর্ক করতে শেখায় না। গোড়ার থেকেই ধ্যানধারণা, সাধনা করতে হয়। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান মেন্টাল জিমনাস্টিক নয়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণায় মগ্ন হলেন।

এখনও বাঙলা দেশে বিস্তর না হোক, বেশকিছু লোক বেঁচে আছেন যারা তার সে ধ্যানমূর্তি দিনের পর দিন দেখেছেন। সুর্যোদয়ের বহু পূর্বেই তিনি আগের দিনের বাসি জলে স্নান করে ধ্যানে বসতেন। সেসময় ছোট ছোট পাখি, কাঠবেড়ালি তাঁর গায়ের উপর বসত, ওঠা-নামা করত। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। পাখিরা অপেক্ষা করত, ধ্যান ভঙ্গের পর তিনি তাদের খাওয়াবেন। ময়দার গুলি বানিয়ে মুনীশ্বর তার ব্যবস্থা করে রাখত।

বহু বৎসর একাগ্রচিত্তে ধ্যানধারণা ও শাস্ত্র-চর্চার ফলস্বরূপ তার গ্রন্থ, বাঙলা তত্ত্বকথার অতুলনীয় সম্পদ, গীতাপাঠ।

এখানে এসে আমার ব্যক্তিগত মত অসঙ্কোচে বলছি–বিড়ম্বিত হতে আপত্তি নেই, যদি শাস্ত্রজ্ঞরা বলেন, আমার মতের কীই-বা মূল্য- বাঙলা ভাষায় এরকম গ্রন্থ তো নেই-ই, ভারতীয় তথা ইংরেজি, ফরাসি, জর্মনেও ভারতীয় তত্ত্বালোচনার এমন গ্রন্থ আর নেই।

যাদের সামনে (এবং খুব সম্ভব তাদের অনুরোধেই তিনি এ গ্রন্থখানি লেখেন) তিনি এই গ্রন্থখানি পাঠ করে শোনান (পুস্তকের ভূমিকায় আছে এই গীতাপাঠ তত্ত্ববোধিনী এবং প্রবাসীতে ছাপাইতে দিবার পূর্বে সময়ে সময়ে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আচার্যগণের সভা আহ্বান করিয়া তাহাদিগকে উত্তরোত্তর-ক্রমে নানো হইয়াছিল) তাদের অনেকেই ইয়োরোপীয় দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাই তাদের বোঝার সুবিধার জন্য (আজও তাই ইয়োরোপীয় দর্শনের পণ্ডিতদের কাছে এ বইটি অমূল্য) তিনি প্রয়োজনমতো ইয়োরোপীয় দার্শনিকদের অভিমতও প্রকাশ করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ উদ্ধৃত করি : উপনিষদে আছে অবিদ্যা শব্দটি; সেটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বেদান্ত এবং সাংখ্য ছাড়া আরেক শাস্ত্র আছে; সে শাস্ত্রে বলে এই যে, ১. সাংখ্যের অচেতন প্রকৃতি, ২. কান্টের Thing-in-itself, ৩. Schopnhauer-এর অন্ধ Wil, ৪. Mil]-এর ইন্দ্রিয়-চেতনার অধিষ্ঠাত্রী নিত্যা শক্তি, ইংরাজি ভাষায়– Permanent Possibility of Sensation, ৫. বেদান্তের সদসদৃভ্যামনির্বাচনীয়া অবিদ্যা; পাঁচ শাস্ত্রের এই পাঁচ রকমের বস্তু একই বস্তু। পূর্বেই বলেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথের মূল উপনিষদ, গীতা, মহাভারত, বেদান্ত (দর্শন) সাংখ্য ও যোগ। পাঠক আরও পাবেন, বেন্থাম, চার্বাক, সফি, স্টয়ি, ডারুইন, ভোজরাজ, যাজ্ঞবল্ক্য, জনক, ভাস্করাচার্য, সেন্ট আইস্টিন, নীলকণ্ঠ, স্পেন্সার প্রভৃতি।

সম্পূর্ণ পুস্তিকায় পাঠক পাবেন কী? এর নাম নাকি গোড়াতে ছিল গীতাপাঠের ভূমিকা পরে গীতাপাঠ-এ পরিবর্তিত হয়। সাংখ্য বেদান্ত তথা তাবৎ ইয়োরোপীয় জ্ঞান (এবং বিজ্ঞান) ও দর্শনের ভিতর দিয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ তরল সাধককে গীতাপাঠ এবং তার অনুশীলনে নিয়ে যেতে চান।

তাই তিনি আরম্ভ করেছেন সাংখ্য নিয়ে।

দুঃখত্রয়াভিঘাত জিজ্ঞাসা।

অর্থাৎ ত্রিবিধ দুঃখের (বাইরে থেকে, নিজের থেকে এবং দৈবদুর্বিপাকে ঘটিত দুঃখ) কীরূপে বিনাশ হইতে পারে, তাহাই জিজ্ঞাসার বিষয়। এবং সেটা যেন একান্তাভ্যন্ততোভবাৎ ক্ষণিক বা আংশিক বিনাশ না হয়; হয় যেন, ঐকান্তিক এবং আত্যন্তিক বিনাশ। কারণ, দুঃখ লোপ পেলেই সুখ দেখা দেবে। যেরকম শরীর থেকে সর্বরোগ দূর হলে স্বাস্থ্যের উদয় হয়। তা ভিন্ন স্বাস্থ্য বলে অন্য কোনও জিনিস নেই। এবং এ সুখ যা-তা সুখ নয়। উপনিষদের ভাষায় অমৃত, আনন্দ।

গ্রন্থের মাঝামাঝি এসে তিনি এই তত্ত্বটি গীতা থেকে উদ্ধৃত করে আরও পরিষ্কার করে বলেছেন :

আপূৰ্যমানমচলপ্রতিষ্ঠং সমাপঃ
প্রবিশন্তি যদবৎ।
তদবৎকামা যং প্রবিশন্তি সর্বে স
শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।

অর্থাৎ স্বস্থানে অবিচলিতভাবে স্থিতি করিতেছেন যে আপূৰ্যমান সমুদ্র, তাহাতে যেমন নদনদী সকল প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, তেমনি, যিনি আপনাতে স্থির থাকেন, আর, চতুর্দিক হইতে কামনা সকল যাহাতে প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, তিনিই শান্তি লাভ করেন; যিনি কামনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হন– তিনি না।

এরই টীকা করতে গিয়ে তিনি তার জীবনের উদ্দেশ্য, মানবমাত্রেরই জীবনের উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন :

আত্মসত্তার রসাস্বাদ-জনিত একপ্রকার নিষ্কাম প্রেমানন্দ যাহা মনুষ্যের অন্তঃকরণের অন্তরতম কোষে নিয়তকাল বর্তমান রহিয়াছে, তাহা জীবাত্মার অনন্তকালের পাথেয় সম্বল, এবং সেইজন্য তাহারই পরিস্ফুটন মনুষ্যজীবনের চরম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। (গীতাপাঠ পৃ. ১৬২)।

এই চরম মোক্ষকেই মুসলমান সাধকেরা বলে থাকেন, ফানা ও বাকা। খ্রিষ্টীয় সাধকরা 98 atat inco FC 1691699, As the bridegroom rejoiceth over the bride, so shall the Lord rejoice over thee i

এদেশে একাধিক সাধকও ওই একই বর্ণনা দিয়েছেন।

 দ্বিজেন্দ্রনাথ খুব ভালো করেই জানতেন এ যুগে কেন, সর্বযুগেই মানুষ সাধনার এই কঠিন পথ বরণ করতে চায় না। তাই তিনি গীতা পাঠের তৃতীয় অধিবেশনের অন্তে বলেছেন :

আনন্দ সম্বন্ধে এ যাহা আমি কথা প্রসঙ্গে বলিলাম– এটা সাধন পদ্মানদীর ওপারের কথা; আমরা কিন্তু রহিয়াছি এপারে কারাবদ্ধ, কাজেই আমাদের পক্ষে ওরূপ উচ্চ আনন্দের কথাবার্তার আন্দোলন এক প্রকার গাছে কাটাল– গোঁফে তেল। এরকম বাক্যবাণ আমার সহা আছে ঢের; সুতরাং উহা গ্রাহ্যের মধ্যে না আনিয়া আমার যাহা কর্তব্য মনে হইল তাহাই আমি করিলাম– যাত্রীরা পাছে নৌকাযোগে পদ্মানদী পার হইতে অনিচ্ছুক হন– এই জন্য পদ্মানদীর ওপার যে কীরূপ রমণীয় স্থান তাহা দুরবীনযোগে (অর্থাৎ প্রথম তিন অধিবেশনে তিনি যে অবতরণিকা নির্মাণ করেছেন তা দিয়ে লেখক) তাহাদিগকে দেখাইলাম। এখন নৌকা আরোহণ করিবার সময় উপস্থিত; অতএব যাত্রী ভায়ারা পেট্রলাপুঁটুলি বাঁধিয়া প্রস্তুত হউন।(২১)

এই অমূল্য পুস্তকের গুণাগুণ বিচার করা আমার জ্ঞানবুদ্ধি ত্রিসীমানার বাইরে। তবে বর্ণনা দিতে গিয়ে এইটুকু নিবেদন করতে পারি, জড়-প্রকৃতি, জীব-প্রকৃতি, তথা জীবের সুখ-দুঃখ বিশ্লেষণ করার সময় তিনি প্রধানত শরণ নিয়েছেন সাংখ্যের, সাধনার যে পন্থা অবলম্বন করেছেন সেটি যোগের এবং আস্থা ও আশা রেখেছেন বেদান্তের ওপর।

তবে এ পুস্তিকায় মৌলিকতা কোথায়? ছত্রে ছত্রে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। তিন দর্শন এক করে (প্রয়োজনমতো ইউরোপীয় দর্শন দিয়ে সেটা আমাদের আরও কাছে টেনে এনে তার সঙ্গে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমজনিত দীর্ঘকালব্যাপী সশ্রদ্ধ সাধনালব্ধ অমূল্য নিধি যোগ করে, কবিজনোচিত অতুলনীয় তুলনা, ব্যঞ্জনা, বর্ণনা দিয়ে অতিশয় কালোপযোগী করে তিনি এই পুস্তকখানি নির্মাণ করেছেন।

সকলেই বলে, এ পুস্তক বড় কঠিন। আমিও স্বীকার করি। তার প্রধান কারণ, দ্বিজেন্দ্রনাথ একই সময়ে একাধিক ডাইমেনশনে বিচরণ করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও পুনরায় সবিনয় নিবেদন করি, এরকম কঠিন জিনিস এতখানি সরল করে ইতোপূর্বে আর কেউ লেখেননি।

———–

১. এ তথ্যগুলো প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী থেকে নেওয়া।

২. আমি ভ্রমণগমনে পাঠও শুনেছি। কিন্তু স্পষ্টত জ অক্ষর– চেয়ে ভালো।

এই কবিতাটির আর একটি পাঠ আমি পেয়েছি। কোনটা আগের কোনটা পরের বলা কঠিন। মনে হয় নিম্নলিখিতটাই আগের। এটি রাজনারায়ণ বসুকে লিখিত :

দীন দ্বিজের রাজ-দর্শন না ঘটিবার কারণ।

টঙ্কা দেবী কর যদি কৃপা
না রহে কোন জ্বালা।
বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই কিছু না
খালি ভন্মে ঘি ঢালা ॥
ইচ্ছা সম্যক্ তব দরশনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিক্লি মন উড়ু উড়
এ কি দৈবের শাস্তি ॥

৩. এর থেকে কিছুটা উৎসাহ পেয়েই বোধহয় সত্যেন্দ্রনাথ রচেন পিঙ্গল বিল, ব্যথিত নভতল,-! চতুষ্পদীটি আমি স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে উদ্ধৃত করছি বলে ছন্দপতন বিচিত্র নয়। সংস্কৃত কাব্যের আদি ও মধ্যযুগে মিল থাকত না (মিল জিনিসটাই আর্য ভাষা গোষ্ঠীর কাছে অর্ধপরিচিত। পক্ষান্তরে সেমিতি আরবি ভাষাতে মিলের ছড়াছড়ি। মিলের সংস্কৃত ‘অন্ত্যানুপ্রাস শব্দটিই কেমন যেন গায়ের জোরে তৈরি বলে মনে হয়। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।)

৪. বসন্তে আমের বোল যেমন অকালে অজস্র ঝরিয়া পড়িয়া গাছের তলা ছাইয়া ফেলে, তেমনি স্বপ্নপ্রয়াণের কত পরিত্যক্ত পত্র বাড়িময় ছড়াছড়ি যাইত তাহার ঠিকানা নাই। বড়দাদার কবিকল্পনার এত প্রচুর প্রাণশক্তি ছিল যে, তাহার যতটা আবশাক তাহার চেয়ে তিনি ফলাইতেন অনেক বেশি। এই জন্য তিনি বিস্তর লেখা ফেলিয়া দিতেন। সেইগুলো কুড়াইয়া রাখিলে বঙ্গসাহিত্যের একটি সাজি ভরিয়া তোলা যাইত।- জীবনস্মৃতি।

৫. অবশ্য শেষ পর্যন্ত কৈবল্য লাভের পর এটিও থাকে না। গীতাতে আছে, ভূমিরাপোঞ্জলো বায়ুঃখং মনোবৃদ্ধিরেবচ অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টকা ॥ ভূমি জল অগ্নি বায়ু আকাশ মন বুদ্ধি অহঙ্কার (আমিত্ববোধ) এ প্রকৃতি অপরাপ্রকৃতি। প্রবন্ধের কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে কৈবল্য লাভে বুদ্ধির কতখানি প্রয়োজন সেটি এস্থলে না বলে পাঠককে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথামৃত, পঞ্চম ধরে ৪৭ পৃষ্ঠায় বরাত দিচ্ছি।

৬. দ্বিজেন্দ্রনাথের এক আত্মীয়ের (ইনি রবীন্দ্র সদনে কাজ করেন) মুখে শুননছি, রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ আরম্ভ করেন তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ তাকে একদিন বলেন, এসব কাজ তুই করছিস কেন? যার দরকার সে অনুবাদ করিয়ে নেবে। তুই তোর আপন কাজ করে যা না।

৭. দেবকুমার রায়চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রলাল, পৃ. ৩২০

৮. যদিও দেবকুমার হতাশায় লিখেছেন তিনি এগুলো অবিকল মুদ্রিত করে দিয়েছেন, তবু আমার মনে ধোঁকা আছে যে তাঁর নকলনবিশ কোনও কোনও স্থলে ভুল করেছেন। এমনকি শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে যে দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনী রয়েছে সেটিতে চৌদ্দপুরুষ তব ত্রাণ পায় যদি স্থলে চৌদ্দপুরুষাবধি ত্রাণ পায় যদি কে যেন মার্জিনে পাঠান্তর প্রস্তাব করছেন, হস্তাক্ষরে। তাই বোধ করি হবে। কারণ প্রতি ছত্রে ভিতরের মিল, যথা সম্পত্তির সঙ্গে বৃহস্পতি, কানন-এর সঙ্গে বাহন, সত্যি-র সঙ্গে রত্তি রয়েছে। বস্তৃত দ্বিজেন্দ্রনাথের এসব রচনা কখনও পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি বলে শুদ্ধপাঠ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব।

৯. ব্রাহ্মসমাজ ও বঙ্কিমে তখন যে বাদ-বিবাদ হয় সেসময় প্রসঙ্গক্রমে বঙ্কিম লেখেন, ’১৫ শ্ৰবণ আমার ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপর অনেক রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছে। প্রতিবারে অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাবার্তা হইয়াছে। কথাবার্তা প্রায় সাহিত্য বিষয়েই হইয়াছে। (বঙ্কিম রচনাবলী, সাহিত্যসংসদ, ২ খণ্ড, পৃ. ৯১৬।১৭। বলাবাহুল্য বঙ্কিম যেতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে।

১০. বস্তুত তখন বাঙলা দেশে প্রচলিত ধারণা ছিল, বিদ্যাসাগর ও কং-এর শিষ্য বঙ্কিমের। ঈশ্বরবিশ্বাস দৃঢ় নয়।

১১. তিনি একাধিকবার গীতা থেকে, প্রসন্নচেতসো ন্যস্ত বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে প্রচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি লক্ষ্যবস্তুতে স্থিরভাবে নিবিষ্ট হয়, ছত্রটি উদ্ধৃত করেছেন।

১২. ১৩. এ পুস্তক বোধহয় কখনও সাধারণে প্রকাশ হয়নি। প্রাইভেট সার্কুলেশনের জন্য ছিল। তার অন্যতম কারণ তাতে প্রকাশক বা প্রকাশস্থানের নাম নেই। এবং লেখক বলছেন, তিনি স্বহস্তে ছাপিয়েছিলেন।

১৪. এটি বহু বৎসর পরে বানান-সংস্কার-সমিতি গ্রহণ করেন।

 ১৫, পরবর্তী যুগে তিনি প্রধানত বিষয় হলে (যেমন এখানে) কী লিখতেন। অবশ্য বানান-সংস্কার-সমিতির বহু পূর্বে।

 ১৬. এখানে দ্ধ আছে। আজকাল প্রেসে তার উপর রেফ দেবার ব্যবস্থা আছে কিনা, অর্থাৎ দ + ধ + রেফ, জানি না।

১৭. প্রথম সংস্করণে এর পাঠ : বন্ধ হলো বৃন্দাবনে যাহার যা কাজ। ভঙ্গ হল তৃগীত কুঞ্জবন মাঝ।

১৮. ডোঙ্গাখানি ভাসিতেছে নবেন্দুসুঠামপারাপার হইবার নাহি আর নাম। কালিন্দী বহিয়া যায় কান্দ কান্দ স্বরেকুঞ্চিত কুন্তল প্রায় মন্দানিল ভরে।

১৯. দ্বিজেন্দ্রনাথ বরাবর রাষ্ট লিখতেন; রাষ্ট্র লেখেননি।

২০. বলা বাহুল্য কৃষ্ণ শব্দ কষ্ট বা কেষ্ট পড়তে হবে।

২১. দ্বিজেন্দ্রনাথ বলতেন, বাংলা ভাষা এখনও এমন দুর্বল যে সূক্ষ্ম চিন্তা প্রকাশ করা কঠিন; তাই আমাদের প্রধান কাজ হবে টু বি কনসাইজ, টু বি প্রিসাইজ, টু বি ক্লিয়ার। সেটা করতে গিয়ে যদি একটি কঠিন সংস্কৃত শব্দের পরেই একটি জুতসই–not juste– সহজ বাংলা শব্দ আসে, তবে নির্ভয়ে সেখানে লাগানো উচিত। অর্থাৎ তিনি গুরুচণ্ডালী অনুশাসন মানতেন না।

Book Content

রবীন্দ্রনাথের আত্মত্যাগ
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
সরলাবালা
হাসনোহনা
বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি
পরিচিতি
হতভাগ্য কাছাড়
নেতাজি
মস্কো-যুদ্ধ ও হিটলারের পরাজয়
কুট্টি
দরখাস্ত
সর্বাপেক্ষা সঙ্কটময় শিকার
অপর্ণার পারণা বা স্যালাড
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহকর্মিদ্বয়
রাষ্ট্রভাষা
বন্ধ-বাতায়নে
অ্যারোপ্লেন
চরিত্র-বিচার
গান্ধীজির দেশে ফেরা
তপঃশান্ত
মৃত্যু
লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলীবইয়ের ধরন: প্রবন্ধ ও গবেষণা

রায় পিথৌরার কলমে – সৈয়দ মুজতবা আলী

উভয় বাঙলা – সৈয়দ মুজতবা আলী

সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলি ১০

সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলি ৯

Reader Interactions

Comments

  1. SUKAMAL MANDAL

    July 30, 2024 at 2:45 am

    I want to purchase one copy of barobabu written by sd mujatsba ali

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.