মস্কো-যুদ্ধ ও হিটলারের পরাজয়
০১.
লজ্জায় জর্মন জাঁদরেলরা হিটলারকে মুখ দেখাতে পারতেন না। রুশ-যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বার বার সপ্রমাণ করে ছেড়েছিলেন যে, জাঁদরেলরা ভুল করছেন– সত্যপন্থা জানেন হিটলার।
ভের্সাইয়ের চুক্তিতে পরিষ্কার শর্ত ছিল জর্মনি রাইনল্যান্ডে সৈন্য সমাবেশ করতে পারবে না। হিটলার যখন করতে চাইলেন তখন জেনারেলরা তারস্বরে প্রতিবাদ করে বললেন, যদি তখন ফ্রান্স আমাদের আক্রমণ করে তবে…? হিটলার দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, করবে না। হিটলারের কথাই ফলল। অবশ্য হিটলার পরে একাধিকবার স্বীকার করেছেন, তখন ফ্রান্স আক্রমণ করলে জর্মনি নির্ঘাত হেরে যেত। তার পর হিটলার পরপর অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করলেন– জেনারেলদের আপত্তি সত্ত্বেও ফরাসি-ইংরেজ রা-টি পর্যন্ত কাড়লে না। বার বার তিনবার লজ্জা পাওয়ার পরও পোল্যান্ড আক্রমণের পূর্বে জেনারেলরা ফের গড়িমসি করেছিলেন, এমনকি ফ্রান্স আক্রমণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও তারা ওই জুয়ো খেলতে চাননি। কিন্তু বার বার হিটলার প্রমাণ করলেন, জেনারেলদের আর যা থাকে থাক্ সমরনৈতিক দূরদৃষ্টি তাদের নেই ভবিষ্যদ্বাণী করা তো দূরের কথা।
এতবার লজ্জা পাওয়ার পর তারা আর কোন মুখ নিয়ে আপত্তি করতেন- হিটলার যখন রুশ আক্রমণ করবার প্রস্তাব তাদের সামনে পড়লেন এবং বহু বিদ্রি যামিনী যাপন করার পর যে হিটলার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন সেকথা তারা ভালো করেই জানতেন। বক্ষ্যমাণ টেস্টামেন্টেই আছে,
এ যুদ্ধে আমাকে যত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে তার মধ্যে কঠিনতম সিদ্ধান্ত রুশ আক্রমণ। আমি বরাবর বলৈ এসেছি, সর্বস্ব পণ করেও যেন আমরা দুই ফ্রন্টে লড়াই করাটা ঠেকিয়ে রাখি, এবং আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, আমি নেপোলিয়ন এবং তার রুশ-অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আপন মনে বহুদিন ধরে বিস্তর তোলাপাড়া করেছি।
এসব তত্ত্ব জানা থাকা সত্ত্বেও জেনারেলরা তো মানুষই বটেন। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের আকছারই যে আচরণ হয় তাদেরও তাই হয়েছিল। অর্থাৎ জর্মনি যখন পোল্যান্ড, গ্রিস, ফ্রান্স একটার পর একটা লড়াই জিতে চলল তখন জাদরেলরা নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়ে বললেন, আমরা জিতেছি, আমরা লড়াই জিতেছি। হিটলারকে স্মরণে আনবার প্রয়োজন তারা অনুভব করলেন না।(১) কিন্তু হিটলার রুশযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করলে পর এই আঁদরেলরাই মোটা মোটা কেতাব লিখলেন, হিটলার অগা, হিটলার বুদ্ধ– তারই দুর্বুদ্ধিতে আমরা লড়াই হারলুম। বাংলা প্রবাদে বলে, খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলা গোবন। ফ্রান্স জয়ের দই খেলেন জাদরেলরা, রুশ পরাজয়ের বিকার হল হিটলারের। অবশ্য তাঁর পক্ষে এই সান্তনা যে, তিনি এসব বই দেখে যাননি।
অবশ্য তিনিও কম না। জাদরেলরা যা করেছেন তিনিও তাই করে গেছেন। পোল্যান্ড ফ্রান্স জয়ের গর্ব তিনি করেছেন পুরো ১০০ নঃ পঃ, কিন্তু রুশ-অভিযান-নিষ্ফলতার জন্য দায়ী করেছেন তার জাদরেলদের ন-সিকে। তিনি আত্মহত্যা করবার কয়েক ঘন্টা পূর্বে যে উইল লিখে যান তাতে লিখেছেন, বিমানবাহিনী লড়েছে ভালো, নৌবহরও কিছু কম নয়, স্কুল-সৈনিকরাও লড়েছে উত্তম, কিন্তু সর্বনাশ করেছে ওই জাঁদরেলরা। অন্যত্র তিনি বলেছেন, তারা মূর্খ, তারা প্রগতিশীল নয়, যুদ্ধের সময় তাদের চিন্তা, তাদের কর্মধারা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ১৯৪১-৪৫ সালে তারা যে কায়দায় পড়েছে সেটা যেন ১৯১৪-১৮-এর যুদ্ধ। ব্লিস ক্রিগ বিদ্যুৎ-গতি যুদ্ধ- এ যে কী জিনিস তারা আদপেই বুঝতে না পেরে পদে পদে আমার আদেশ অমান্য করেছে।(২)
অর্থাৎ এবার দই খাচ্ছেন হিটলার, বিকারের বেলা জাঁদরেলরা। ফ্রান্স, পোল্যান্ড জয় করেছিলেন তিনি, রুশ-যুদ্ধে হারল জর্মন জাঁদরেলরা!
কিন্তু এহ বাহ্য! কুশ-যুদ্ধে জনির হার হয়েছিল অন্য কারণে।
বহু রণপণ্ডিত একথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, সে প্রাজয়ের জন্য প্রধানত দায়ী শ্রীমান মুসোলিনি! হিটলার ২লেছেন (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫),
ইটালি যুদ্ধে প্রবেশ করামাত্র আমাদের শত্রুদের এই প্রথম কয়েকটি সগ্রাম জয় সম্ভব হল (এস্থলে হিটলার ইংরেজ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা জয়ের কথা বলেছেন) এবং তারই ফলে চার্চিলের পক্ষে সম্ভব হল তার দেশবাসী তথা পৃথিবীর ইংরেজ-প্রেমীদের মনে সাহস এবং ভরসা সঞ্চার করা। এদিকে মুসোলিনি আবিসিনিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় হেরে যাওয়ার পরও গোঁয়ারের মতো হঠাৎ খামোখা আক্রমণ করে বসল গ্রিসকে আমাদের কাছে থেকে কোনও পরামর্শ না চেয়ে, এমনকি আমাদের সে সম্বন্ধে কোনও খবর না দিয়ে।(৩) খেল বেধড়ক মার; ফলে বক্কানের রাজ্যগুলো আমাদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করল। বাধ্য হয়ে, আমাদের তাবৎ প্ল্যান ভণ্ডুল করে নামতে হল বন্ধানে (এবং গ্রিসে) এবং তাতে করে আমাদের রুশ অভিযানের তারিখ মারাত্মকরকম পিছিয়ে (কাটাট্রফিক ডিলে) দিতে হল। এবং তারই ফলে আবার বাধ্য হয়ে আমাদের সৈন্যবাহিনীর কতকগুলি অত্যুত্তম ডিভিশন পাঠাতে হল সেখানে। এবং সর্বশেষে নেট ফল হল, বাধ্য হয়ে আমাদের বহুসংখ্যক সৈন্যকে খোদার-খামোখা বন্ধানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মোতায়েন করে রাখতে হল। (হিটলার বলতে চান, তা না হলে এ সৈন্যদের রুশ অভিযানে পাঠানো যেত। পক্ষান্তরে তখন তাদের সরালে ইংরেজ ফের গ্রিসে আপন সৈন্য নামাত এবং মুসোলিনি একা যে তাদের ঠেকাতে পারতেন না, সে তো জানা কথা)!
হায়, ইটালি যদি এ যুদ্ধে না নামত। তারা কোনও পক্ষে যদি যোগ না-দিত!
এ যুদ্ধ একা যদি জর্মনিই লড়ত– এ যদি অ্যাকসিসের যুদ্ধ না হত তবে আমি ১৫ মে, ১৯৪১-এ-ই রাশা আক্রমণ করতে পারতুম। জর্মন সৈন্য ইতোপূর্বে কোথাও পরাজিত হয়নি বলে আমরা শীত আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই (১৯৪১-৪২-এর শীত) যুদ্ধ খতম করে দিতে পারতুম। (ইটালির গ্রিস আক্রমণের ফলে ও তাকে সাহায্য করতে গিয়ে সময় নষ্ট হওয়াতে, হিটলার রাশা আক্রমণ করতে সমর্থ হলেন প্রায় এক মাস পরে। তিনি যখন মস্কোর কাছে এসে পৌঁছলেন তখন হঠাৎ প্রচণ্ড শীত আর বরফপাত আরম্ভ হল– এরকম ধারা শীত আর বরফ রাশাতেও বহুকাল ধরে পড়েনি যুদ্ধের তাবং যন্ত্রপাতির তেল-চর্বি জমে গেল, শীতের পূর্বেই জর্মন সৈন্য মস্কো দখল করে সেখানে শীতবস্ত্র লুট করতে পারবে বলে তারও কোনও ব্যবস্থা হিটলার করেননি, বহু হাজার সৈন্য শুধু শীতের অত্যাচারেই জমে গিয়ে মারা গেল। বলা যেতে পারে এই শীতেই হিটলারের পরাজয় আরম্ভ হল– যদিও সেটা দৃশ্যমান হল তার পরের শীতে স্টালিনগ্রাডে।}
হিটলার হা-হুতাশ করে বলেছেন, হায়, তাই সব-কিছু সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিল!
কিন্তু প্রশ্ন, মস্কো দখল করতে পারলেই কি হিটলার শেষ পর্যন্ত জয়ী হতেন? নেপোলিয়ন তো মস্কো জয় করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তিনি রুশ জয় করতে পারেননি।
.
০২.
গত প্রবন্ধে মস্কো যুদ্ধের বর্ণনা লেখার কালি শুকোতে না শুকোতে খাস মস্কো থেকে একটি চমকপ্রদ খবর এসেছে। মস্কো যুদ্ধের বিংশ বাৎসরিক স্মরণ দিবসে গত ৫ ডিসেম্বর (১৯৬১ খ্রি.) মস্কো শহরে মার্শাল রকসস্কি তাস্ এজেন্সিকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জর্মনরা স্থির করেছিল, মস্কোকে জলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে সেটাকে সমুদ্রের মতো করে ফেলবে। পরে যখন দেখা গেল টেকনিকাল কারণে সেটা সম্ভবপর নয়, তখন তারা বোমা ফেলে সেটা ধ্বংস করার চেষ্টা নিল।
আমার মনে হয়, টেকনিকাল কারণে সম্ভবপর হলেও কৃত্রিম বন্যায় মস্কো ভাসিয়ে দেবার প্রস্তাবে হিটলার স্বয়ং রাজি হতেন না। তার প্ল্যান ছিল, জর্মন সৈন্য মস্কো লুট করে গরম জামা-কাপড় এবং কিছু কিছু খোরাক পাবে কিন্তু প্রধানত গরম জামা-কাপড় ও শীতের আশ্রয়ই ছিল তার আসল লক্ষ্য, কারণ যুদ্ধ শীতের পূর্বেই শেষ হয়ে যাবে মনে করে হিটলার তার সৈন্যবাহিনীর জন্য সে ব্যবস্থা করেননি। (এস্থলে স্মরণ রাখা উচিত, জর্মনিতে কোনওকালেই উলের প্রাচুর্য ছিল না– জর্মনি চিরকালই তার জন্য নির্ভর করেছে। প্রধানত স্কটল্যান্ডের ওপর এবং মস্কোর দোরে যখন জর্মনরা আটকা পড়ে গেল তখন হিটলারকে বাধ্য হয়ে জর্মনির জনসাধারণের কাছে শীতবস্ত্রের জন্য ঢালাও আবেদন জানাতে হল)। কাজেই মস্কো শহরকে সমুদ্রে পরিণত করলে তার কোনও লাভই হত না। এবং মনে পড়ছে, নেপোলিয়নের বেলাতে রুশরা নিজেই কাঠের তৈরি মস্কো শহর পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার ফলে তিনি মস্কোর শ্মশানভূমিতে তাঁর সৈন্যের জন্য এককণা ক্ষুদ, ঘোড়ার জন্য একরত্তি দানা পাননি। এবারে রুশরা সেটা চাইলেও করতে পারত না, কারণ ইতোমধ্যে তারা মস্কো শহর কনক্রিট আর লোহাতে তার বাড়িঘর বানিয়ে বসে আছে। সেটাকে পোড়ানো অসম্ভব।
কাজেই মস্কো জয় করে নেপোলিয়ন লাভবান হননি, কিন্তু হিটলার হতেন।
মার্শাল রকসস্কি আরও বলেছেন, মস্কোবাসী এবং সেখানে রুশ সৈন্যদল জর্মনদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করা সত্ত্বেও তারা সেটা গ্রহণ করেননি। এটা সত্যই অত্যন্ত চমকপ্রদ খবর। এর একমাত্র কারণ এই হতে পারে যে, কোনও নগর আত্মসমর্পণ করলে সেটাকে বে-এক্তেয়ার লুটতরাজ করা যায় না।(৪)
অবশ্য যেসব ভুলের ফলে হিটলার মস্কো দখল করতে পারলেন না, সেগুলো না করে মস্কো দখল করতে পারলে তিনি যে তার পর অন্য ভুল করে যুদ্ধ হারতেন না, সেকথা বুক ঠুকে বলবে কে?
***
সমস্ত জৰ্মনি যখন রুশ, ইংরেজ, মার্কিন, ফরাসি সৈন্য দ্বারা অধিকৃত হয়ে গিয়েছে, রুশবাহিনী প্রায় তাবৎ বার্লিন দখল করে হিটলারের বুঙ্কারের থেকে দু-পাঁচ শগজ দূরে, বুঙ্কার সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, বার্লিনের বাইরে তার সৈন্যদল ও সেনাপতিরা আত্মসমর্পণে ব্যস্ত তখনও হিটলার কিসের আশায় পরাজয় স্বীকার করছিলেন না? আত্মহত্যার ঠিক তিন মাস পূর্বে হিটলার তার আদর্শ মানব ফ্রেডরিককে স্মরণ করে বলেছেন,
না। একেবারে আর কোনও আশা নেই, এরকম পরিস্থিতি কখনও আসে না। জর্মনির ইতিহাসে আকস্মিক কতবার তার সৌভাগ্যের সূচনা হয়েছে সেইটে শুধু একবার স্মরণ কর। সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধে ফ্রেডরিক তার নৈরাশ্য ও দুরবস্থার এমনই চরমে পৌঁছেছিলেন যে, ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে তিনি মনস্থির করেন যে, বিশেষ একটি দিনের ভেতর তার সৌভাগ্যের সূত্রপাত না হলে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন। ওই স্থির করা বিশেষ দিনের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে জারিনা হঠাৎ মারা গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন দৈবযোগে সমস্ত পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। মহান পুরুষ ফ্রেড়রিকের মতো আমরাও কয়েকটি সমবেত শক্তির (কোয়ালিশনের) বিরুদ্ধে লড়ছি, এবং মনে রেখ, কোনও কোয়ালিশনই চিরন্তনী সত্তা ধরে না। এর অস্তিত্ব শুধু গুটিকয়েক লোকের ইচ্ছার ওপর। আজ যদি হঠাৎ চার্চিল অবলুপ্ত হয়ে যায়, তা হলে তড়িৎশিখার ন্যায় এক মুহূর্তেই সমস্ত অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। ব্রিটেনের খানদানি মুরুব্বিরা সেই মুহূর্তেই দেখতে পাবে তারা কোন অতল গহ্বরের সামনে এসে পড়েছে এবং চৈতন্যোদয় হবে তখন।
হিটলার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করেছিলেন মার্কিন এবং ইংরেজ একদিন না একদিন অতি অবশ্য বুঝতে পারবে, ওদের শত্রু জৰ্মনি নয়, ওদের আসল শত্রু রুশ। এবং সেইটে হৃদয়ঙ্গম করামাত্রই তারা জর্মনির সঙ্গে আলাদা সন্ধি করে সবাই একজোট হয়ে লড়াই দেবে রুশের বিরুদ্ধে। হিটলার আশা করেছিলেন, যেদিন মার্কিনিংরেজ জর্মনির কিয়দংশ দখল করার পর রুশের মুখোমুখি হবে সেইদিনই লেগে যাবে ঝগড়া, মার্কিনিংরেজ স্পষ্ট বুঝতে পারবে, রুশ কী চিজ এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু ঠিক সেইটেই হল না। বার্লিনকে বাইপাস করে রুশ এবং মার্কিনিংরেজ যখন মুখোমুখি হল তখন তারা সুবোধ বালকের ন্যায় আপন আপন গোঠে জমিয়ে বসে গেল।
এবং অদৃষ্ট হিটলারের দিকে শেষ মুহূর্তে কী নিদারুণ মুখ-ভেংচিই-না কেটে গেলেন।
হিটলারের দুর্দশা যখন চরমে, তিনি যখন দিবারাত্রি আকস্মিক ভাগ্য-পরিবর্তনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছেন, গ্যোবেলস্ প্রজ্ঞ হৃদয়ে সাহস সঞ্চারের এবং কালাইলের লিখিত ফ্রেরিক দি গ্রেটের ইতিহাস মাঝে মাঝে পড়ে শুনিয়ে যান, এমন সময় উত্তেজনায় বিবশ গ্যোবেলস্ প্রভুকে ফোন করলেন, মাইন ফুরার, আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। নিয়তি আপনার পরম শত্রুকে বিনাশ করেছেন। জারিনা মারা গেছেন।
এস্থলে জারিনা অবশ্য রোজোভেল্ট, তিনি মারা যান ১২ এপ্রিল ১৯৪৫।
কিন্তু হায়, চার্চিল নয়, অদৃশ্য হলেন রোজোভেল্ট! তবু মন্দের ভালো। কিন্তু তার চেয়েও নিদারুণ— হায়, হায় রোজোভেল্টের মৃত্যু সত্ত্বেও মার্কিন তার সমরনীতি বদলাল না। হিটলার প্রতিটি মুহূর্ত গুনলেন অধীর প্রত্যাশায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে। আত্মহত্যা করলেন তার আঠারো দিন পরে। ফ্রেডরিককে করতে হয়নি।
***
এইবারে তাঁর শেষ ভবিষ্যদ্বাণী :
জর্মনি হেরে গেলে, যতদিন না এশিয়া, আফ্রিকা এবং সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার ন্যাশনালিজমগুলো জাগ্রত হয়, ততদিন পৃথিবীতে থাকবে মাত্র দুটি শক্তি যারা একে অন্যকে মোকাবেলা করতে পারে মার্কিন এবং রুশ। ভূগোল এবং ইতিহাসের আইন এদের বাধ্য করবে একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সশস্ত্র সংগ্রাম কিংবা অর্থনীতি এবং আদর্শবাদের (ইডিয়লজিকাল) সংগ্রাম। এবং সেই ইতিহাস ভূগোলের আইনেই উভয়পক্ষই হবে ইউরোপের শত্রু। এবং এ বিষয়েও কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, শীঘ্রই হোক আর দেরিতেই হোক, উভয়পক্ষকেই ইয়োরোপের একমাত্র বিদ্যমান শক্তিশালী জর্মন জাতির বন্ধুত্বের জন্য হাত পাততে হবে।
এর টীকা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড় যে জর্মনিতেই হচ্ছে সেকথা কে-না জানে? আর আডেনাওয়ারের কণ্ঠস্বর যে ক্রমেই উঁচু পর্দায় উঠছে সে-ও তো শুনতে পারছি! এবং রুশ যে পূর্ব জর্মনির মারফতে পশ্চিম জর্মনির সঙ্গে আলাদা সন্ধি করতে উদগ্রীব, সে-ও তো জানা কথা।
————
১. একমাত্র জঙ্গিলাট কাইটেল করেছিলেন। ফ্রান্স পরাজয়ের খবর পৌঁছলে তিনি উল্লাসে বে-এক্তেয়ার হয়ে হিটলারকে উদ্দেশ করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলেছিলেন, আপনি সর্বকালের সর্ব সেনাপতির প্রধানতম! Groesste Feldherr alle Zeiten/ ঈষৎ অবান্তর হলেও এস্থলে বলি, হিটলার যখন রুশে পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছেন তখন জর্মন কাষ্ঠরসিকরা Groesste-এর Gro, Feldher-এর E, aller-এর A এবং Zeiten-এর 2 নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে Grofatz নির্মাণ করেন। এখানে Gro মানে বিরাট এবং Fatz শব্দের অর্থ– গ্রাম্য ভাষায় বাতকর্ম। আমি বাংলায় ভদ্ৰশব্দটি প্রয়োগ করলুম। বাংলা আটপৌরে শব্দটির সঙ্গে জর্মন শব্দটির উচ্চারণের মিল এস্থলে লক্ষণীয়।
২. যেমন মনে করুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কানুন ছিল, শত্ৰু পরাজিত হলেও এক দিনের ভেতর কুড়ি মাইলের বেশি এগোবে না, পাছে তোমার লাইন অব কম্যুনিকেশন ছিন্ন হয়ে যায়। ব্লিস ক্ৰিগে পঞ্চাশ মাইলও নস্যি।
৩. মুসোলিনি বলেছেন, হিটলার প্রতিটি লড়াই লড়েছে আমাকে নোটিশ না দিয়ে আমিই-বা কেন আগেভাগে দিতে যাব?
৪. এরসঙ্গে তুলনীয় মার্কিন কর্তৃক হিরোশিমায় অ্যাটম বম প্রয়োগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জর্মনির পরাজয়ের পর জাপান নিরপেক্ষ সুইডেনের মারফতে আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। মার্কিন সেটা গ্রহণ করলে হিরোশিমায় অ্যাটম বম ফাটিয়ে তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। তাই করেনি। করল এক্সপেরিমেন্টটা দেখে নিয়ে।