কুট্টি
পুব-বাঙলার বিস্তর নরনারী চিরকালই কলকাতায় ছিলেন; কিন্তু এবারে কলকাতায় এসে দেখি তাদের সংখ্যা একলপতে শুয়াগাছের ডগায় উঠে গেছে। কিছুদিন পূর্বেও পুব-বাঙলার উপভাষা শুধু দক্ষিণ কলকাতাতেই শোনা যেত, এখন দেখি তামাম কলকাতায় বাঙাল ভাষার (আমি কোনও কটু অর্থে শব্দটি ব্যবহার করছিনে–শব্দটি সংক্ষিপ্ত এবং মধুর) ছয়লাপ।
বাঙাল ভাষা মিষ্ট এবং তার এমন সব গুণ আছে যার পুরো ফায়দা এখনও কোনও লেখক ওঠাননি। পুব-বাঙলার লেখকেরা ভাবেন করে শব্দ কইরা এবং অন্যান্য ক্রিয়া সম্প্রসারিত করলেই বুঝি বাঙাল ভাষার প্রতি সুবিচার হয়ে গেল। বাঙাল ভাষার আসল জোর তার নিজস্ব বাক্যভঙ্গিতে বা ইডিয়মে–অবশ্য সেগুলো ভেবে-চিন্তে ব্যবহার করতে হয়, যাতে করে সে ইডিয়ম পশ্চিমবঙ্গ তথা পুব-বাঙলার সাধারণ পাঠক পড়ে বুঝতে পারে। যেমন মনে করুন, বড়লোকের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে যদি গরিব মার খায় তবে সিলেট অঞ্চলে বলে, হাতির লগে পাতি খেলতায় গেছলায় কেনে? অর্থাৎ হাতির সঙ্গে পাতি খেলতে গিয়েছিলে কেন? কিন্তু পাতি খেলা যে polo খেলা সেকথা বাঙলা দেশের কম লোকই জানেন; (চলন্তিকা এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটি নেই। কাজেই এ ইডিয়ম ব্যবহার করলে রস ওত্রাবে না। আবার
দুষ্টু লোকের মিষ্টকথা
দিঘল ঘোমটা নারী
পানার তলার শীতল জল
তিন-ই মন্দকারী।
কামুফ্লাজ বোঝাবার উত্তম ইডিয়ম। পুব, পশ্চিম কোনও বাঙলার লোকের বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধে হবে না।
ইডিয়ম, প্রবাদ, নিজস্ব শব্দ ছাড়া বাঙাল সভ্যতায় আরেকটি মহগুণ আছে এবং গুণটি ঢাকা শহরের কুট্টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ– যদিও তার রস তাবৎ পুব-বাঙলা এবং পশ্চিম বাঙলারও কেউ কেউ চেখেছেন। কুট্টির রসপটুতা বা wit সম্পূর্ণ শহুরে বা নাগরিক–এস্থলে আমি নাগরিক শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত অর্থে ব্যবহার করলুম অর্থাৎ চটুল, শৌখিন, হয়তো-বা কিঞ্চিৎ ডেকাডেন্ট।
কলকাতা, লখনউ, দিল্লি, আগ্রা বহু শহরে আমি বহু বত্সর কাটিয়েছি এবং স্বীকার করি লখনউ, দিল্লিতে (ভারত বিভাগের পূর্বে) গাড়োয়ান সম্প্রদায় বেশ সুরসিক কিন্তু এদের সব্বাইকে হার মানতে হয় ঢাকার কুষ্টির কাছে। তার উইট, তার রিপার্টি (মুখে মুখে উত্তর দিয়ে বিপক্ষকে বাকশূন্য করা, ফারসি এবং উর্দুতে যাকে বলে হাজির-জবাব) এমনই তীক্ষ্ণ এবং ক্ষুরস্য ধারার ন্যায় নির্মম যে আমার সলা যদি নেন তবে বলব, কুট্টির সঙ্গে ফস করে মশকরা না-করতে যাওয়াটাই বিবেচকের কর্ম। খুলে কই।
প্রথম তা হলে একটি সর্বজনপরিচিত রসিকতা দিয়েই আরম্ভ করি। শাস্ত্রও বলেন, অরুন্ধতী-ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়, অর্থাৎ পাঠকের চেনা জিনিস থেকে ধীরে ধীরে অচেনা জিনিসে গেলেই পাঠক অনায়াসে নতুন বস্তুটি চিনতে পারে–ইংরেজিতে এই পন্থাকেই ফ্রম সুল রুম টু দি ওয়ার্লড ওয়াইড বলে।
আমি কুট্টি ভাষা বুঝি কিন্তু বলতে পারিনে। তাই পশ্চিম-বাংলার ভাষাতেই নিবেদন করি
যাত্রী : রমনা যেতে কত নেবে?
কুট্টি গাড়োয়ান : এমনিতে তো দেড় টাকা; কিন্তু কর্তার জন্য এক টাকাতেই হবে।
যাত্রী : বল কী হে? ছ আনায় হবে না?
কুট্টি : আস্তে কন কর্তা, ঘোড়ায় শুনলে হাসবে।
এর যুতসই উত্তর আমি এখনও খুঁজে পাইনি।
মোটেই ভাববেন না যে, এ-জাতীয় রসিকতা মান্ধাতার আমলে একসঙ্গে নির্মিত হয়েছিল এবং আজও কুট্টিরা সেগুলো ভাঙিয়ে খাচ্ছে।
ঘোড়ার হাসির মতো কতকগুলি গল্প অবশ্যই কালাতীত, অজরামর, কিন্তু কুট্টি হামেশাই চেষ্টা করে নতুন নতুন পরিবেশে নতুন নতুন রসিকতা তৈরি করার।
প্রথম যখন ঢাকাতে ঘোড়দৌড় চালু হল তখন এক কুটি গিয়ে যে-ঘোড়াটাকে ব্যাক করল সেটা এল সর্বশেষে। বাবু বললেন, এ কী ঘোড়াকে ব্যাক করলে হে সক্কলের শেষে এল?
কুট্টি হেসে বলল, কন্ কী কর্তা, দেখলেন না, ঘোড়া তো নয়, বাঘের বাচ্চা; বেবাকগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে গেল।
আমি যদি নীতি-কবি ঈসপ কিংবা সাদি হতুম, তবে নিশ্চয়ই এর থেকে মরাল ড্র করে বলতুম, একেই বলে রিয়েল, হেলথি, অপটিমিজম।
কিংবা, আরেকটি গল্প নিন, এটা একেবারে নিতান্ত এ-যুগের।
পাকিস্তান হওয়ার পর বিদেশিদের পাল্লায় পড়ে ঢাকার লোকও মর্নিং সুট, ডিনার জ্যাকেট পরতে শিখেছেন। হাঙ্গামা বাঁচাবার জন্য এক ভদ্রলোক গেছেন একটি কালো রঙ কোট বা প্রিন্সকোট বানাতে। ভদ্রলোকের রঙ মিশকালো, তদুপরি তিনি হাড়কিপটে। কালো বনাত দেখলেন, সার্জ দেখলেন, আশপাশ দেখলেন, কোনও কাপড়ই তার পছন্দ হয় না, অর্থাৎ দাম পছন্দ হয় না। যে-কুটি কোচম্যান সঙ্গে ছিল সে শেষটায় বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোককে সদুপদেশ দিল, কর্তা, আপনি কালো কোটের জন্য খামকা পয়সা খরচা করতে যাবেন কেন? খোলা গায়ে বুকের উপর ছটা বোম, আর দু হাতে কব্জির কাছে তিনটে তিনটে করে ছটা বোতাম লাগিয়ে নিন! খাসা প্রিন্সকোট হয়ে যাবে।
তিন বৎসর পূর্বেও কলকাতায় মেলা অনুসন্ধান না করে বাখরখানি (বাকিরখানি) রুটি পাওয়া যেত না; আজ এই আমির আলি এভিতেই অন্তত আধাডজন দোকানে সাইনবোর্ডে বাখরখানি লেখা রয়েছে। তাই বিবেচনা করি, কুট্টির সব গল্পই ক্রমে ক্রমে বাখরখানির মতোই পশ্চিম-বাংলায় ছড়িয়ে পড়বে এবং তার নতুনত্বে মুগ্ধ হয়ে কোনও কৃতী লেখক সেগুলোকে আপন লেখাতে মিশিয়ে নিয়ে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে দেবেন– পরশুরাম যেরকম পশ্চিমবাংলার নানা হাল্কা রসিকতা ব্যবহার করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, হুতোম একদা কলকাতার নিতান্ত কনিকে সাহিত্যের সিংহাসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিলেন।
এটা হল জমার দিকে কিন্তু খরচের দিকে একটা বড় লোকসান আমার কাছে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছে, নিবেদন করি।
ভদ্র এবং শিক্ষিত লোকেরই স্বভাব অপরিচিত, অর্ধপরিচিত কিংবা বিদেশির সামনে এমন ভাষা ব্যবহার না করা, যে-ভাষা বিদেশি অনায়াসে বুঝতে না পারে। তাই খাস কলকাতার শিক্ষিত লোক পুব-বাঙালির সঙ্গে কথা বলবার সময় বাস কলকাত্তাই শব্দ, মোটামুটিভাবে যেগুলোকে ঘরোয়া অথবা স্ল্যাঙ বলা যেতে পারে, ব্যবহার করেন না। তাই এন্তার, ইলাহি, বেলেল্লাবেহেড়, দোগেড়ের চ্যাং– এসব শব্দ এবং বাক্য কলকাতার ভুদ্রলোক পুব-বাঙালির সামনে সচরাচর ব্যবহার করেন না। অবশ্য যদি বক্তা সুরসিক হন এবং আসরে মাত্র একটি কিংবা দুটি ভিন্ন প্রদেশের লোক থাকেন তবে তিনি অনেক সময় আপন অজান্তেই অনেক ঝঝওলা ঘরোয়া শব্দ ব্যবহার করে ফেলেন।
ত্রিশ বৎসর পূর্বে শ্যামবাজারের ভদ্র আড়তে পুব-বাঙালির সংখ্যা থাকত অতিশয় নগণ্য। তাই শ্যামবাজারি গল্প ছোটালে এমন সব ঘরোয়া শব্দ, বাক্য, প্রবাদ ব্যবহার করতেন। এবং নয়া বাক্যভঙ্গি বানাতেন যে রসিকজনমাত্র বাহবা শাবাস না বলে থাকতে পারত না।
আজ পুব-বাংলার বহু লোক কলকাতার আসর সরগরম করে বসেছেন বলে খাঁটি কলকাত্তাই আপন ভাষা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন হয়ে গিয়েছেন এবং ঘরোয়া শব্দ-বিন্যাস ব্যবহার ক্রমেই কমিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো এঁরা বাড়িতে এসব শব্দ এখনও ব্যবহার করেন; কিন্তু আড্ডা তো বাড়ির লোকের সঙ্গে জমজমাট হয় না– আড্ডা জমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এবং সেই আড্ডাতে পুব-বাংলার সদস্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে বলে খাস কলকাত্তাই আপন ঘরোয়া শব্দগুলো ব্যবহার না করে করে ক্রমেই এগুলো ভুলে যাচ্ছেন। কোথায় না এসব শব্দ আস্তে আস্তে ভদ্রভাষায় স্থান পেয়ে শেষটায় অভিধানে উঠবে, উল্টো এগুলো কলকাতা থেকে অন্তর্ধান করে যাবে।
আরেক শ্রেণির খানদানি কলকাত্তাই চমৎকার বাংলা বলতেন। এঁরা ছেলেবেলায় সায়েবি ইস্কুলে পড়েছিলেন বলে বাংলা জানতেন অত্যন্ত কম এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল ভাশুর-ভাদ্রবধূর। তাই এঁরা বলতেন ঠাকুরমা-দিদিমার কাছে শেখা বাঙলা এবং সে বাঙলা যে কত মধুর এবং ঝলমলে ছিল তা শুধু তারাই বলতে পারবেন যারা সে-বাংলা শুনেছেন। ক্রিক রোর মন্মথ দত্ত ছিলেন সোনার বেনে, আমার অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু, কলকাতার অতি খানদানি ঘরে জন্ম। মন্মথদা যে-বাংলা বলতেন তার ওপর বাংলা সাহিত্যের বা পুব-বাংলার কথ্যভাষার কোনও ছাপ কখনও পড়েনি। তিনি যখনই কথা বলতে আরম্ভ করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর মন্মথদা উৎসাহ পেয়ে রেকাবের পর রেকাব চড়ে চড়ে একদম আসমানে উঠে যেতেন। কেউ অন্যমনস্ক হলে বলতেন, ও পরান, ঘুমুলে? মন্মথদার। কাছ থেকে এ-অধম এন্তার বাংলা শব্দ শিখেছে।
আরেকজনকে অনেক বাঙালিই চেনেন। এঁর নাম গাঙ্গুলিমশাই- ইনি ছিলেন শান্তিনিকেতনে অতিথিশালার ম্যানেজার। ইনি পিরিলি ঘরের ছেলে এবং গল্পবলার অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা এর ছিল। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত হরিনাথ দে, সুসাহিত্যিক সুরেশ সমাজপতি ছিলেন এঁর বাল্যবন্ধু এবং শুনেছি এরা এর গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতেন।
কলের একদিক দিয়ে গরু ঢোকানো হচ্ছে, অন্যদিক দিয়ে জলতরঙ্গের মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিটারি বুট বেরিয়ে আসছে, টারালাপু টারালাপ করে, গাঙ্গুলিমশাই আর অন্যান্য ক্যাডেটরা বসে আছেন পা লম্বা করে, আর জুতোগুলো ফটাফট করে ফিট হয়ে যাচ্ছে– এ গল্প শুনে শান্তিনিকেতনের কোন ছেলে হেসে কুটিপাটি হয়নি?
হায়, এ শ্রেণির লোক এখন আর দেখতে পাইনে। তবুও এখনও আমার শেষ ভরসা শ্যামবাজারের ওপর।
শ্রদ্ধেয় বসু মহাশয়ের উপাদেয় স্মৃতিমন্থন আমারও স্মৃতির ভিজে গামছাটি নিংড়ে বেশ কয়েক ফোঁটা চোখের জল বের করল।
আমিও এ বাবদ একদা একটি প্রবন্ধ লিখি। আশ্চর্য! ছাপাও হয়েছিল। এবং চাটগাঁয়ে প্রকাশিত একটি মাসিকে সেটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। আবার কোনও পুস্তকে সেটি স্থান পেয়েছে কি না, মনে পড়ছে না।
আমার মনে হয়, কুটি সম্প্রদায় (ঢাকার গাড়োয়ান শ্রেণি) একদা মোগল সৈন্যবাহিনীর ঘোড়সওয়ার সেপাই ছিল। যার ফলে তারা কুঠিবাড়ির ব্যারাকে থাকত। এবং তাই পরে এদের নাম কুট্টি হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজবাহিনীতে এদের স্থান হয়নি বলে, কিংবা মোগলের নেমকহারামি করতে চায়নি বলে এরা ঘোড়ার গাড়ি চালাতে রু করে। কারণ ঘোড়া তাদের নিজেরই ছিল, এবং ঘোড়ার খবরদারি করতে তারা জানত। বরোদা রাজ্যেও আমি শুনতে পাই, সেখানকার কোচম্যানরাও নাকি পূর্বে মারাঠা সৈন্যবাহিনীতে ক্যালরি অঙ্গে কাজ করত। ঢাকার কুট্টিরা এককালে উর্দু বলত, পরে ঢাকা শহরের চলতি বাঙলার সঙ্গে মিশে কুট্টি ভাষার সৃষ্টি হয়। তাই তারা এখনও লেকিন, মগর এ-ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে। তবে পুব-বাঙলার মৌলবি সায়েবরাও লেকিন, মগর ছাড়া আরও বহু বহু আরবি ফারসি শব্দ বাঙাল কথা বলার সময় ব্যবহার করে থাকেন এই অঞ্চলে হিন্দু পণ্ডিতরাও যেরকম গলায় ঘা হলে বলেন, কণ্ঠদেশে ক্ষত অইছে। তাই শুনে মেডিকেল কলেজের গোরা ডাক্তার নাকি বিরক্ত হয়ে বলেছিল, চীন দেশ হ্যায়, জাপান ভি দেশ হ্যায়, ফির কণ্ঠদেশ কোন দেশ হ্যায়?
বছর-পঞ্চাশেক পূর্বে ঢাকার এই কুট্টি ভাষা সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ বেরোয়। তাতে এই আমলের কুট্টিভাষার উদাহরণস্বরূপ বলা হয়।
করিম বক্সকা মা নে আর রহিম বকা জরুনে এয়সা লাগিস লাগিস্তা কে এ ভি উসকা বালমে ধরি টানিস্তা, উ ভী ইসকা বামে ধরি টানিস্তা।
অর্থাৎ করিম বশের মা আর রহিম বখশের স্ত্রীতে এমন লাগাই লাগল (কোদল) যে, এ ওর চুল ধরে টানে, ও এর চুল ধরে টানে।
(কুট্টি ভাষার উদ্ধৃতিতে কোনও ভুল থাকলে যেন কুট্রিভাষাভাষী আমার ওপর বিরক্ত না হন– কারণ কুটি গাড়োয়ান ছাড়া অন্য অনেক লোক এ-ভাষা বলে থাকেন এবং বাঙলা সাহিত্যের চর্চাতে আনন্দ পান। পূর্বে এরা সকলেই উঁচু সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। শুনতে পাই এদের কেউ কেউ নাকি ভাষা-আন্দোলনে বাঙলা ভাষার পক্ষ নেন।)
***
হাওয়া গাড়ি চইলা গেল গো।
(আমার) বন্ধু আইল না।
গানটি পুব-বাঙলায় রূপকার্থেও নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ যে হাসন রাজার—
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন।
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানি দীন (ধর্ম)–
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় বদ্বয় (সুগন্ধ, দুর্গন্ধ)
আমা হইতে সব উৎপত্তি হাসন রাজায় কয়।
এ ছত্রগুলো ব্যবহার করেন, সেই হাসন রাজারই একটি গান আছে, হাওয়ার গাড়ি ধু ধা করে চলেছে। (নিশ্বাস প্রশ্বাসের হাওয়ায় যে গাড়ি চলে অর্থাৎ শরীর) তার ভিতর সায়েব সোয়ারি (পরমাত্মা, আল্লা) বসে আছেন। হাসন রাজা (অর্থাৎ ব্যষ্টি পুরুষ) সেই সায়েবকে সেলাম করাতে (মর্মে মর্মে তাকে ভক্তিতরে অনুভব করাতে) তিনি হাসনকে আদর করে পাশে বসালেন।
পুরো গানটি আমার স্মরণে নেই; তবে শেষের দু ছত্র আছে–
হাসন রাজা, নচিতে আছে, আল্লা আল্লা ধরি।
পবনের গাড়ি চলতে আছে ধু ধু ধা ধা করি।
এখানে পবনের গাড়ি, হাওয়া গাড়ি, শ্রদ্ধেয় বসু মশায়েরও হাওয়া গাড়ি মোটামুটি একই। তাই অর্থ দাঁড়ায়, পবনের গাড়ি অর্থাৎ আমার প্রাণবায়ু চলে গেল, তবু আমার বন্ধু এল না। বলাবাহুল্য পুব-বাঙলার ভাটিয়ালি গীত রচয়িতা এবং পশ্চিম বাঙলার বাউল উভয়ই কিছুদিন আগে পর্যন্তও অত্যন্ত সজীব, প্রাণবন্ত স্রষ্টা ছিলেন বলে নতুন নতুন জিনিস আমদানি হলেও তাকে সিমবল, রূপক রূপে, এলেগরি করে মরমিয়া মিস্টিক) গান রচনা করতেন। যেমন রেলগাড়ির ঘণ্টা বেজেছে (আসন্ন মৃত্যুর ধ্বনি বেজেছে), আমি যাত্রী ঘুমে অচৈতন্য (তমোঋণে আচ্ছন্ন) ইত্যাদি। বিজলিবাতি নিয়ে একটি গান আমার আবছা আবছা মনে পড়ছে। হাওয়া গাড়ি প্রবর্তিত হলে এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ওই মোতিফ নিয়ে একাধিক গীত রচিত হয়।
***
প্রধানত রিকশার চাপে কুট্টি গাড়োয়ান সম্প্রদায় ঢাকার রাস্তা থেকে প্রায় অন্তর্ধান করেছে। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত এরা নতুন নতুন অবস্থায় নতুন নতুন রসিকতা তৈরি করে গিয়েছে– অনেকেরই ভুল বিশ্বাস, এদের রসিকতার একটি প্রাচীন ভাণ্ডার ছিল এবং তারা শুধু সেগুলো ভাঙিয়েই খায়, আমি যে শেষ রসিকতাটি শুনেছি, সেটি ১৯৪৭-৪৮ সালে নির্মিত।
আমি ১৯৪৮ সালে ঢাকার এক আত্মীয়কে শুধোই, মুসলিম লীগ কীরকম রাজত্ব চালাচ্ছেন?
তিনি বললেন, সে সম্বন্ধে একটি কুঠি রসিকতা বাজারে চালু হয়েছে। অত্যন্ত ক্যারাটিরিসটি–অর্থাৎ লীগের ক্যারাটার প্রকাশ করে। যদিও গল্পটি একটু রিসূকে– অর্থাৎ গলা খাকরি দিয়ে বলতে হয়।
মুসলিম লীগ শাসনভার হাতে নিয়ে এক কুটি গাড়োয়ানকে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা দিলেন, সে যেন তার জাতভাইদের মধ্যে তাদের জন্য প্রচারকার্য বা প্রোপাগান্ডা করে। সে তাদের ডেকে বক্তৃতা আরম্ভ করলে, ভাই সকল, শোনো (আমি এস্থলে কুট্টি ভাষার পরিবর্তে সাধুই ব্যবহার করছি–লেখক)। আমাদের রাষ্ট্র আমাদের মায়ের মতো! মাকে যদি খাওয়া-পরাও তবে মায়ের দুধ তুমি-ই পাবে। খাজনাটা ট্যাক্সোটা ঠিকমতো দাও; মায়ের দুধ তুমিই পাবে। তখন এক ব্যাকবেঞ্চার (হেকলার) বলে উঠল, কইছ ঠিকই, লেকিন বাবা হালায় যে খাইয়া ফুরাইয়া দিল। অর্থাৎ মিনিস্টার, পলিটিশিয়ানের দলই সব লুটে নিচ্ছে।… মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ কারও প্রতিই আমাদের কোনও বৈরী ভাব নেই, তবে মনে হয়, গল্পটি বহু দেশ-প্রদেশের শাসনকর্তাদের সম্বন্ধে খাটে।
***
এই কুট্টি গাড়োয়ানদের সম্বন্ধে শেষ একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি।
পার্টিশনের, পূর্বে ও পরে, কি হিন্দু, কি মুসলমান সর্ব পিতামাতা নির্ভয়ে তাদের কন্যাদের কুটির গাড়িতে তুলে দিতেন। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, ভূমিকম্প হোক এরা ঠিক সময়ে মেয়েদের ফের স্কুল-কলেজ থেকে ফিরিয়ে আনত। হঠাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে গেলেও এবং শুনেছি, কোনও কোনও স্থানে দাঙ্গার ফলে বাপ-মা উধাও জানতে পেরে ভালো জায়গায় তাদের পৌঁছে দিয়েছে। কুষ্টিরা এ জিম্মাদারিতে কখনও গাফিলি করেছে বলে শোনা যায়নি। এরা সত্যই শিভারাস।
আর ওই শিভালুস কথাটা এসেছে ফরাসি শেভালিয়ের থেকে। শেভাল মানে ঘোড়া!
শেভালিয়ের অর্থাৎ ঘোড়সওয়ার। একদা খানদানি ফরাসিদের ছেলেরা এই ক্যাভালরি বা অশ্ববাহিনীর সদস্য ছিল। তাই বলছিলুম, কুট্টিরা আসলে মোগল বাহিনীর ঘোড়সওয়ার ছিল।