দরখাস্ত
এইমাত্র কয়েকদিন পূর্বে ঘটনাটি ঘটেছে। আমার এক বন্ধুপুত্র ঝাড়া তেরোটি বচ্ছর কাজ করার পর মিন্ নোটিশে চাকরি হারাল। টাইপ-করা একখানা কাগজ হাতে তুলে দিল, তার সারমর্ম–তোমাকে দিয়ে আমাদের আর কোনও প্রয়োজন নেই, কেটে পড়।
চৌদ্দ বছর পর চাকরি গেলে খুব আশ্চর্য হতুম না। কারণ আজকাল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর অর্থ চোদ্দ বছর। তার পর মুক্তি। ঠিক সেইরকম আমার এক ফরাসি-বন্ধু তার সিলভার ওয়েডিঙের প্রবে আমায় শুধোলেন, আমাদের দেশে, জেলে ম্যাক্সিমাম ক বছর পুরে রাখে? আমি ওই উত্তর দিলে তিনি বললেন, তবে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন?
আমি শুধালুম, কিসের থেকে?
কড়ে আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে বউকে দেখিয়ে বললেন, ওই যে, ওর সঙ্গে পঁচিশটি বৎসর বন্দি হয়ে কাটালুম। এখনও কি মুক্তি পাব না?
উল্টোটাও শুনেছি। এক ইংরেজকে শুধিয়েছিলুম নিজে বিয়ে করতে যাবার ঠিক আগের দিন ওদের বিবাহিত জীবনের কাহিনী শোনাতে। বললেন, বিয়ের চোদ্দ বছর পর একদিন বউকে একটুখানি সামান্য কড়া কথা বলতেই সে ডান রুটি একটু উপরের দিকে তুলে শুধোল, ডার্লিং! তবে কি আমাদের হানিমুন শেষ হয়ে গেল? ইংরেজ একটু থেমে বললেন, ওই আমার আক্কেল হয়ে গেল। এর পর আর কখনও রা-টি পর্যন্ত কাড়িনি। তারই কিছুদিন পর তার যমজ সন্তান হলে পর আমি তাকে বলেছিলুম, চীনা ভাষায় প্রবাদ আছে যে লোক মোমবাতির খর্চা বাঁচাবার জন্য সন্ধ্যার সময়েই শুয়ে পড়ে তার যমজ সন্তান হয়। ইংরেজ সেয়ানা; সঙ্গে সঙ্গে সক্কলকে একটা রাউন্ড খাইয়ে দিলে।
এ বাবদে আমাকে লাখ কথার সেরা কথা শুনিয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রপতি-তখন অবশ্য তিনি কাশীতে সাদামাটা অধ্যাপক জুলুদের অভিধানে নাকি স্বামীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এক প্রকার জংলি পশু যাকে স্ত্রী পোষ মানায়।
এবং দুই এক্সট্রিম সদাই মিলে যায় বলে অভিজাত চীনাদের অভিধানে লেখকের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, একপ্রকারের বন্যজন্তু যাকে সম্পাদক পোষ মানায়।
গেল চৌদ্দটি বছর ধরে বঙ্গদেশের সম্পাদক তথা প্রকাশককুল আমাকে পোষ মানাবার চেষ্টা করেছেন। আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন তারা আর আমাকে ছাড়তে চান না। উত্তম শায়েস্তাপ্রাপ্ত কয়েদিকে জেলার ছাড়তে চায় না। বাড়ির এড়া-সেডা করে দেয় অথচ তাকে মাইনে দিতে হয় না।
আমি কিন্তু মহারানির কাছে আপিল করেছি– চোদ্দ বছর পূর্বে ঠিক ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আমার প্রথম বই বেরোয়। আজ ১৯৬৪, আমার ছুটি মঞ্জুর হোক।
কুকর্ম করে মানুষ জেলে যায়। আমিও কুমতলব নিয়ে লেখক হয়েছিলুম।
সাধারণের বিশ্বাস, লেখকের কর্তব্য পাঠককে পরিচিত করে দেবে বৃহত্তর চিন্তাজগতের সঙ্গে, তাকে উদ্বুদ্ধ করবে মহান আদর্শের পানে, প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক জেরোম কে জেরোমের ভাষায়, তাকে এলিভেট করবে। এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন, মাই বুক উইল নট এলিভেট ইভন এ কাউ!
লেখকের কর্তব্য যদি পাঠককে মহত্তর করে ভোলাই হয়, তবে নিঃসন্দেহে কুমতলব নিয়েই আমি সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলুম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ লাভ।
মহাকবি হাইনে একাধিকবার বলেছেন– তাই তাকে একাধিকবার উদ্ধৃত করতে আপত্তি নেই– কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই বুঝেছি। আমার বেলা তারচেয়েও সরেস। আমার হাতে অর্থ কখনওই আসেনি। কাজেই মূল্য বোঝা-না-বোঝার কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। আমি চিরটাকাল খেয়েছি লঙ্গরখানায়, ঘুমিয়েছি মসজিদে; কাজেই বছরটা আঠারো মাসে যাচ্ছিল।
এমন সময় লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে যিনি পুষতেন তিনি আল্লার ডাক শুনে ওপারে চলে গেলেন। বেহেশতে গিয়েছেন নিশ্চয়ই; কারণ আমাকে নাহক পোষা ছাড়া অন্য কোনও অপকর্ম (গুনাহ্) তিনি করেননি।
মাত্র কিছুদিন পূর্বে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে বেরিয়েছে ফ্লেমিঙের মত্যর পর তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে যাতে আছে আনঅ্যাশেমডলি আই অ্যাডমিট আই রাইট ফর মানি।
এর পর যেসব পূর্বসূরিগণ নিছক অর্থের জন্যই লিখনবৃত্তি গ্রহণ করেন, তাঁদের নাম করতে গিয়ে বাজা, ডিকেন্স, টু, ট্রলোপের নাম করেছেন।
এই প্রবন্ধটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন মি. কাউলি। তিনি তার পর আপন মন্তব্য জুড়েছেন, কিন্তু এখানে, থেমে যাওয়া কেন?বওয়েলের লেখা যারা স্মরণে রাখেন তারাই মনে করতে পারবেন, ড, জনসনও এ-বাবদে কুহকাচ্ছন্ন ছিলেন না, নিতান্ত গাড়োল (blockhead) ভিন্ন অন্য কেউ অর্থ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লেখে না–এই ছিল সেই মহাপুরুষের সুচিন্তিত অভিমত।
অবশ্য তারচেয়েও বড় গাড়োল, যে টাকার জন্য লিখেও টাকা কামাতে পারল না।
আমি ড. জনসনের পদধূলি হওয়ার মতোও স্পর্ধা ধরিনে; অতএব তাঁর মতো কটুভাষা ব্যবহার না করে, অর্থাৎ কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখে, সেই অনুযায়ী কে পাঠা, কে গোলাপফুল সে আলোচনা না করে শুধু বলব আমি স্বয়ং লিখেছি, নিছক টাকার জন্য।
আমার বয়স যখন উনিশটাক তখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আমাকে একদিন বললেন, এবার থেকে তুই লেখা ছাপাতে আরম্ভ কর। আর দেখ, লেখাগুলো আমাকে দিয়ে যাস। আমি ব্যবস্থা করব।
আমার অর্থাভাব তিনি জানতেন; তদুপরি আমার হাত দিয়ে কেউ যেন তামাক না খায়, অর্থাৎ আমাকে exploit না করে। তিনি একদা উত্তমরূপেই জমিদারি চালিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যাচ্ছিল তাই বান্দেবীকে বানরীর মতো ঘাগরা পরিয়ে ঘরে ঘরে নাচতে হল না (এটি বিদ্যাসাগর মশাই দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, অস্য দগ্ধ উদরস্যার্থে কিং কিং ন ক্রিয়তে ময়া। বানরীমিব বান্দেবীং নয়ামি গৃহে গৃহে ॥)।
আমি শান্তিনিকেতন ছাড়ি ১৯২৬-এ। ১৯৩৮-এ গুরুদেবকে প্রণাম করতে এলে তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোনও লেখা ছাপাচ্ছি না কেন? উত্তরে কী বলেছিলুম সেটা আর এখানে বলে কাজ নেই।
কায়ক্লেশে চলে গেল ১৯৪৯ পর্যন্ত। লঙ্গরখানা (অর্থাৎ ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্ট-মসৃজিদে) বন্ধ হয়ে গেল তখন; যেটা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও পৃথিবীতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অপরা কম্পজিস্ট রসসিনি বলতেন, আমি ছেলেবেলা থেকেই জানতুম, অর্থের প্রয়োজন আছে। কিন্তু দেখলুম, এক অরা কম্পোজ করা ভিন্ন অন্য কোনও এলেম আমার পেটে নেই। সেই করে টাকা হয়েছে যথেষ্ট। এখন আর কম্পোজ করব কোন দুঃখে! খ্যাতির মধ্যগগনে, যৌবনে, তিনি এই আপ্তবাক্যটি ছাড়েন। তার পর তিনি বোধহয় আরও দুটি অপূরা তৈরি করেন একবার নিতান্ত বাধ্য হয়ে, প্রায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য, ও আরেকবার একজনকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য।
রসসিনির তুলনায় আমি কীটস্য কীট। কিন্তু আমি দেখলুম, ওই এক বই লেখা ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে পয়সা কামাবার মতো বিদ্যে আমার ব্রেন-বাক্সে নেই। আশ্চর্য, তার পর একটা চাকরি পেয়ে গেলুম। কাজেই লেখা বন্ধ করে দিলুম। চাকরি ইস্তফা দিলুম। ফের কলম ধরতে হল। ফের চাকরি। ফের কলম। ফের চাকরি, ফের- ইত্যাদি।
আমার লেখা অল্প লোকেই পড়েন, আমার জীবন এমন কিছু একটা নয় যা নিয়ে লোকের কৌতূহল থাকতে পারে। তবু যারা নিতান্তই নোজি (পিপিং টম–নোজি পার্কার) তারা লক্ষ করে থাকবেন, যখন আমার চাকরি থাকে, তখন আমি লিখি না।
একবার ফ্রান্সে ঢোকবার ফর্মে প্রশ্ন ছিল–তোমার জীবিকা নির্বাহের উপায় কী?
উত্তরে লিখেছিলুম, কিছুদিন অন্তর অন্তর চাকরি রিজাইন দেওয়া (রিজাইনিং জ ফ্রম টাইম টু টাইম্)।
ফরাসি শুধোল, তা হলে চলে কী করে?
বললুম, তুমি রেজিগনেশনগুলো দেখছ; আমি জবগুলো দেখছি।
পেটের দায়ে লিখেছি মশাই, পেটের দায়ে। বাংলা কথা স্বেচ্ছায় না লেখার কারণ—
(১) আমার লিখতে ভালো লাগে না। আমি লিখে আনন্দ পাইনে।
(২) এমন কোনও গভীর, গূঢ় সত্য জানি নে যা না বললে বঙ্গভূমি কোনও এক মহাবৈভব থেকে বঞ্চিত হবেন।
(৩) আমি সোশ্যাল রিফর্মার বা প্রফেট নই যে দেশের উন্নতির জন্য বই লিখব।
(৪) খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কি না, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোন্ড ব্লাডেড, যেরকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয় অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কি না?–শবুনমের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল কি না, চাচাটি কে, আমি আমার বউকে ডরাই কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মতো খাটাশটাকেও একনজর দেখে নিতে চান। কারণ কলকাতায় ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতোমধ্যে আর কী করা যায়। এবং এসে রীতিমতো হতাশ হন। ভেবেছিলেন দেখবেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো সুপুরুষ সৌম্যদর্শন নাতিবৃদ্ধ এক ভদ্রজন লীলাকমল হাতে নিয়ে সুদূর মেঘের পানে তাকিয়ে আছেন; দেখেন বাধিপোতার গামছা পরা, উত্তমার্ধ অনাবৃত, বক্ষে ভালুকের মতো লোম, মাথা-জোড়া-টাক ঘনকৃষ্ণ ছাড়া ছ্যাবড়া রঙ, সাত দিন খেউরি হয়নি বলে মুখটি কদমফুল হাতলভাঙা পেয়ালায় করে চা খাচ্ছে আর বিড়ি ফুকছে!
আমি রীতিমতো নোটিশ দিয়ে লেখা বন্ধ করেছি। গত বৎসর মে মাসে আমি দেশ পত্রিকা মারফৎ সেটা জানিয়ে দিয়েছিলুম। কেউ কেউ আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন– তাদের স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। তার পরও দু-একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দাদন শোধের জন্য।
আর কখনও লিখব না, একথা বলছি না। চাকরি গেলেই লিখব। খেতে পরতে তো হবে।