সরলাবালা
সরলাবালার অমরাত্মার উদ্দেশে বার বার প্রণাম জানাই।
বাঙলার সংস্কৃতি জগতে তিনি এতই সুপরিচিতা যে, বহু কীর্তিমান লেখক তার জীবনী নিয়ে আলোচনা করবেন, তার বহুমুখী প্রতিভার অকুণ্ঠ প্রশংসা করবেন, তার সরল জীবনাদর্শ তিনি দেশের-দশের চিন্ময় জগতে যে কতখানি সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন, তা দেখে বারবার বিষয় মানবেন।
কিন্তু আমরা যারা তার স্নেহ, তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি আমাদের শোকের অন্ত নেই যে, আজ আমরা যাকে হারালুম, তার আসন নেবার মতো আর কেউ রইলেন না। সাহিত্য জগতে তিনি ছিলেন আমাদের স্নেহময়ী মাতার মতো। আমরা জানতুম, যে সাপ্তাহিক-দৈনিক পত্রিকার জগতে আমরা বিচরণ করি, সেখানে নানা বাধাবিঘ্ন আছে, কিন্তু একথা আরও সত্যরূপে জানতুম যে, শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের ফরিয়াদ-আর্তনাদ এমন একটি মাতার কাছে নিয়ে যেতে পারব, যেখানে সুবিচার পাবই পাব।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, তার সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় ছিল না।
১৯৪৪ ইংরেজিতে আমি সত্যপীর নাম নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পরবর্তী স্তম্ভে প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করি। দুটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরই সরলাবালার এক আত্মীয়, আমার বন্ধু এসে আমাকে জানালেন, আমার লেখা তার মনঃপূত হয়েছে।
নিজেকে ধন্য মনে করেছিলুম। ওইদিনই আমার আত্মবিশ্বাসের সূত্রপাত।
তাই আজ স্বৰ্গত সুরেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের কথাও বার বার মনে পড়ছে। তার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরলাবালার অনুমোদন না পেলে বাঙালিকে আমার সামান্য যেটুকু বলার ছিল, সেটুকু বলা হত না।
একটুখানি ব্যক্তিগত কথা বলা হয়ে যাচ্ছে, সেটা হয়তো দৃষ্টিকটু ঠেকবে, কিন্তু আজ যদি আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা সর্বজনসমক্ষে উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ না করি, তবে অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ-নেমকহারামের আচরণ হবে। বরঞ্চ সে-আচরণ দৃষ্টিকটুকর হোক।
একথা সত্য, আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান, দেশ পত্রিকায় আমার একাধিক বন্ধু ও স্নেহভাজন ব্যক্তি ছিলেন এবং তাদের একজনের– এর কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি–মাধ্যমে সুরেশচন্দ্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কিন্তু একথা আরও সত্য যে, এরা সকলেই সহৃদয় বলে আমার মতো আরও বহু বহু অচেনা-অজানা লেখককে তার কাছে নিয়ে গিয়েছেন। সুরেশচন্দ্র যেমন একদিকে পাকা জহুরির মতো কড়া সমালোচক ছিলেন, অন্যদিকে ঠিক তেমনি অতিশয় সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। এই দ্বন্দ্বের সমাধান না করতে পেরে তিনি অনেক সময় অভাজন জনকেও গ্রহণ করতেন– আমি তাদেরই একজন।
সুরেশচন্দ্রকে আমি বাঘের মতো ডরাতুম, যদিও খুব ভালো করেই জানতাম যে, তাকে ভরাবার কণামাত্র কারণ নেই। কঠিন কথা দূরে থাক–যে ক বৎসর আমি তাঁর স্নেহ-রাজত্বে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলুম, তার মধ্যে একদিন একবারও তিনি আমার লেখার সমালোচনা করেননি, কোনও আদেশ বা উপদেশও দেননি।
মনে পড়ছে, ১৯৪৪-৪৫ সালে কলকাতায় একবার একটা অশান্তির সৃষ্টি হয়। আফটার-এডিট না লিখে লিখলুম একটি কবিতা। মনে ভয় হল, আফটার-এডিটের এরজাস তো কবিতায় হয় না! তাই এ নিয়ে গেলুম সুরেশবাবুর কাছে স্বহস্তে। তিনি মাত্র দুটি ছত্র পড়েই প্রেমে পাঠিয়ে দিলেন। ওরে- একে চা দে, আর কী দিবি দে, আর– বাক্য অসমাপ্ত রেখে তিনি ফের কাজে মন দিলেন।
তবু তাকে আমি উরাতুম। কিন্তু যেদিন শুনলুম, সুরেশচন্দ্র অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন সরলাবালাকে এবং তিনি আমার রচনার ওপর আশীর্বাদ রেখেছেন, সেদিন আমার মনে এক অদ্ভুত সাহস সঞ্চার হল। আমার মনে হল, পত্রিকা জগতের সুপ্রিমকোর্টের (তখন বোধহয় প্রিতি কৌন্সিল ছিল) চিফ জসটিসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেল, সে জগতে যদি আমার মনোবেদনার কারণ ঘটে, তবে আপিল করব খুদ সুপ্রিমকোর্টে! অবশ্য আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমাকে কখনও স্মল-কজ কোর্টে যেতে হয়নি। হবে না, সে বিশ্বাসও ধরি।
এটা আমার ব্যক্তিগত কথা নয়। বহু কর্মী, প্রচুর সাহিত্যিক আমার কথায় সায় দেবেন।
সরলাবালা ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্লের (এন্ড অব দি সেরির) লোক। গত শতাব্দীর শেষ এবং এ শতাব্দীর অর্ধাধিক তিনি দেখেছেন। ফরাসিতে যেমন এঁদের ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্লের প্রতিভূ বলে, আরবিতে ঠিক তেমনি বলে জু অল-করনেন দুই শতাব্দীর মালিক। এদের সম্বন্ধে লেখা কঠিন। বঙ্কিম-রমেশের মধ্যাহ্ন গগন, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের উদয় সরলাবালা চোখের সামনে দেখেছেন–এবং আর পাঁচজনের তুলনায় অনেক বেশি ভালো করে দেখেছেন, কারণ সাহিত্যে তাঁর রসবোধ ছিল তো বটেই, তদুপরি তার আসন ছিল ঘোষ-সরকার উভয় পরিবারের পত্রিকা-জগতের মাঝখানে। এদিকে বৈষ্ণবধর্মের রসকুণ্ডে তিনি আবাল্য নিমজ্জিতা, অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণের আন্দোলন, বিবেকানন্দের সকর্মযোগ এবং সর্বশেষ শ্রীঅরবিন্দের সাধনায় তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। অত্যন্ত উদারচিত্ত না হলে মানুষ এ তিনটেকে একসঙ্গে গ্রহণ করতে পারে না। আমার কাছে আরও আশ্চর্য বোধ হয়, যে রমণী কোনও বিদ্যালয়েও কখনও যাননি, চিরকাল অন্তঃপুরের অন্তরালেই রইলেন, তাঁর পক্ষে এতখানি উদার, এতখানি ক্যাথলিক হওয়া সম্ভব হল কী প্রকারে।
ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্ল সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু পড়েছি, কিন্তু তার অধিকাংশ অধিকাংশ কেন, প্রায় সমস্তটাই পুরুষের লেখা। তার মাঝখানে সরলাবালার কোমল নারীহৃদয় সবকিছু অনুভব করেছে হৃদয় দিয়ে, মাতুরসে সিক্ত করে। ইংরেজিতে বলতে গেলে বলব, তার বর্ণনা রিছ উইদ নলেজ না হতে পারে সর্বক্ষেত্রে, কিন্তু নিশ্চয় নিশ্চয় অতিনিশ্চয় রেডিয়েন্ট উইদ লা।
অথচ তার লেখাতে ভাবালুতা উসপ্রবণতা নেই। অত্যন্ত মধুর, আন্তরিক লেখার মধ্যেও সর্বক্ষণ পাই, কেমন যেন একটা বৈরাগ্যের ডিটাচমেন্টের ভাব। আমার মনে হয়, তিনি বাল্যকাল থেকে অনেক শোক পেয়েছিলেন বলেই বৈরাগ্যযোগে আপন চেষ্টায় সেসব শোক সংহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রচনাতে পদে পদে তারই পরিচয় পাই।
ছেলের হৃদয়ের আঁকুবাঁকু মা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারেন, এবং তিনি যখন সেটা সরল ভাষায় প্রকাশ করেন, তখন ছেলে বিস্ময় মানে, যে জিনিস সেই ভালো করে বুঝতে পারেনি, মা বুঝল কী করে এবং এত সরল ভাষায় প্রকাশ করল কী করে?
বাঙলার চিন্ময় জগতে সরলা ছিলেন মাতৃরূপা। অতি অল্প বয়সেই তিনি মাতৃক্রোড় পেতে দিয়েছিলেন বাঙলার তরুণকে। তাই শুনতে পাই, বাঙালির ওপর যখনই অত্যাচার এসেছে, তিনি ক্ষুব্ধ মাতার মতো অনশন করেছেন। এবং তাই তিনি শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালির মনোবেদনা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে অতি মহৎ ভাষায় সেটি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
সে ভাষায় আছে দার্ঢ্য অথচ মাধুর্য।
এবং সর্বোপরি সে ভাষা অতিশয় সরলা।
সার্থক নাম সরলাবালা ॥