তপঃশান্ত

তপঃশান্ত

শাস্ত্র তো মানি না আজ। হে তরুণ, তব পদাঘাত
দেশের তারে দিল কী রূঢ় চেতনা! ঝঞ্ঝাবাত
ঘূর্ণিবায়ু দিগ্বিদিক আন্দোলিয়া কী মহাপ্রলয়
নটেশ তাব্ব-নৃত্য। হে তরুণ! জয়, জয়, জয়
জয় তব; অর্থহীন মূল্যহীন কে বৃথা শুধায়
কোথায় তোমার লক্ষ্য! বন্যা যবে বাঁধ ভেঙে যায়
 মিথ্যা প্রশ্ন কোথা তার গতি। হে তরুণ, হে প্লাবন
 নহ তো তটিনী। দুকূলের শাস্ত্র মিথ্যা। চিরন্তন,
 মৃত্যুঞ্জয়, হে নবীন, তোমার ধমনী রক্তবীণ,
অন্তহীন, পঞ্চনদে তার শাখা- সে তো নহে ক্ষীণ
সে তো নহে ধর্মে বর্ণে অবরুদ্ধ।

পঞ্চনদবাসী
কিবা হিন্দু কি মুসলিম্ শিখ আর যত শ্বেতত্রাসী
লালকেল্লা অধিবাসী– পাইল তোমার বক্ষে স্থান,
কে বলে বাঙালি তুমি? তব রক্তপাতে অভিযান
দেশের বিশ্বের অনন্ত মঙ্গল লাগি। হে অভয়,
জয় তব জয়।

প্রদোষের অন্ধকারে
নির্জীব নিদ্রায় ছিনু রুদ্ধ; নৈরাশ্যের কারাগারে
অবিশ্বাসে নিমজ্জিত। হেনকালে শুনি বজ্রশঙ্খ
 হে পার্থসারথি লক্ষ। লৌহের কীলক পেতে অঙ্ক,
 বক্ষ, ভাল, কী আদরে নিলে বরি মৃত্যু তুচ্ছ করি।
জীর্ণ এ জীবন মম পুণ্য হল বারে বারে স্মরি।

ক্ষান্ত রণ?
 নহে নহে। শিবের তার অন্তহীন অনুক্ষণ,
 কখনও বাহিরে কভু অন্তর্মুখী। এবে শান্ত শিব
লহ সংহরিয়া নিগূঢ় ধ্যানেতে, জ্বালো অস্তদীপ
জ্যোতির্ময়, গহন সাধন মাঝে হও নিমজ্জিত
যে-শক্তি সঞ্চয় হল চক্রাকারে করুক প্লাবিত
বৃদ্ধি পেয়ে, গতিবেগে, পর্বত করে নদী যথা
অবরুদ্ধ, কিন্তু বহির্মুখী।

তার পর এক দিন বাহিরিবে তপঃ সাঙ্গ হলে
 শৃঙ্খল হবে মুক্ত– এ প্রলয় অভিজ্ঞতা বলে
 হবে না তো উচ্ছল; অচঞ্চল দৃঢ় পদক্ষেপে
সমাহিত, রিপু শান্ত, স্বর্গ মর্ত্য ত্রিভুবন ব্যেপে
 চলিবে হে ত্রিবিক্রম। পরিবে দুর্জয় বরমালা
পূত শান্তি মিষ্ণু পূণ্য সর্ব-বিশ্ব-প্রেম গন্ধ ঢালা ॥*

২৫/১১/১৯৪৫

———-

* দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ সরকার যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনানীদের লালকেল্লায় বিচার শুরু করে, তখন তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। শাহনওয়াজ-ধীলন-ভোঁসলে দিবসে বাংলার তরুণসমাজ কলকাতায় সেদিন যে সম্পূর্ণ অহিংস প্রতিবাদ আন্দোলনের পরাকাষ্ঠা দেখান তার তুলনা বিরল। অথচ সেই অহিংস আন্দোলনকারীদের ওপর ইংরেজ পুলিশ গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি। এই গুলিবর্ষণের ফলে রামেশ্বর নামে একটি তরুণ ছাত্র নিহত হন। সেদিনের ঘটনার পটভূমিকায় এই কবিতা লিখিত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *