১৫. প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যুর পরে

পঞ্চদশ পর্ব অধ্যায়-১

একটি মুমূর্ষ জন্তুকে দেখলে মানুষের মনে আতংক জাগে : চোখের সামনে তারই অনুরূপ একটি জীব মরতে বসেছে। কিন্তু যখন কোনো প্রিয় ঘনিষ্ঠ মানুষের মৃত্যু ঘটে তখন জীবন অবসানের এই ত্রাস ছাড়াও দেখা দেয় একটা কাটা ঘা, একটা আত্মিক ক্ষত, দৈহিক ক্ষতের মতোই সে ক্ষত কখনো মারাত্মক হয়, কখনো শুকিয়ে যায়, কিন্তু বাইরে থেকে যে কোনোরকম খোঁচা লাগলেই ব্যথা লাগে, কুঁকড়ে ওঠে।

প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যুর পরে নাতাশা ও প্রিন্সেস মারিরও সেই অবস্থা হল। মৃত্যুর যে ভীতিপ্রদ মেঘ ছায়া ফেলেছে তাদের উপর তার মুখোমুখি হয়ে বিষণ্ণ মনে তারা চোখ বুজে রইল, জীবনের দিকে চোখ মেলে তাকাবার সাহস তাদের নেই। যে কোনোরকম বেদনাদায়ক স্পর্শ থেকে ক্ষতস্থানকে তারা সযত্নে রক্ষা করে চলল। রাস্তায় দ্রুত ধাবমান একটা গাড়ি, ডিনারে যোগ দেবার ডাক, কি পোশাক পরে বের হবে সে সম্পর্কে দাসীর প্রশ্ন, অথবা কোনোরকম আন্তরিকতাবিহীন বা দুর্বল সহানুভূতি : এ সবকিছুই তাদের কাছে অপমান বলে মনে হয়, ক্ষতস্থান বেদনায় নতুন করে টাটিয়ে ওঠে, যে কঠোর ভয়ংকর সঙ্গীত কল্পনায় এখনো তাদের কানে প্রতিধ্বনিত হয়, তাকে ভালো করে শুনবার জন্য যে প্রশান্তি প্রয়োজন হয় তাও বিঘ্নিত হয়, মুহূর্তের জন্য যে রহস্যময় সীমাহীন দৃশ্য তাদের সামনে খুলে গিয়েছিল সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আর হয়ে ওঠে না।

একমাত্র যখন তারা দুজন একত্র থাকে তখনই এই সব অপমান ও বেদনা থেকে তারা মুক্তি পায়। নিজেদের মধ্যেও তারা খুব কম কথা বলে, আর যখন বলে তাও অতি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই বলে।

ভবিষ্যতের আলোচনাকে দুজনই এড়িয়ে চলে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে স্বীকার করাটাই তাদের কাছে প্রিন্স আন্দ্রুর স্মৃতিকে অসম্মান দেখানোর সামিল। যে মারা গেছে তার সম্পর্কিত সবকিছুকেই তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে। তাদের মনে হয়, যে জীবনকে তারা পার হয়ে এসেছে তার অভিজ্ঞতাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, প্রিন্স আন্দ্রুর জীবনের যে কোনো ঘটনার উল্লেখ করলেই তাদের চোখের সামনে যে রহস্য রূপায়িত হত, তার মহত্ত্ব ও পবিত্রতা বিঘ্নিত হবে।

একাদিক্রমে কথা বলা থেকে বিরত থাকা এবং সে বিষয় সম্পর্কিত সবকিছুকে অনবরত এড়িয়ে চলার ফলে তাদের মনের অনুভূতির অধিকতর পবিত্রতা ও স্পষ্টতা নিয়ে তাদের মনের সামনে ভেসে ওঠে।

কিন্তু নির্ভেজাল পরিপূর্ণ সুখের মতোই নির্ভেজাল পরিপূর্ণ দুঃখও অসম্ভব। প্রিন্সেস মারি এখন তার নিজের ভাগ্যের একমাত্র স্বাধীন বিধাতা, সে তার ভাইপোটিরও অভিভাবিকা ও শিক্ষয়িত্রী, কাজেই প্রথম পক্ষকাল যে দুঃখের রাজ্যে সে বাস করেছে সর্বপ্রথম তাকেই সেখান থেকে বাস্তব জীবনে ফিরে আসতে হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে চিঠি এলে তার জবাব দেয়, যে ঘোট ঘরটায় ছোট নিকলাস থাকে সেটা স্যাঁতসেঁতে, আর তাই তার কাশি হয়েছে, আলপাতিচই তো স্লাভল থেকে সেখানকার অবস্থার কথা জানিয়ে প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছে যে মস্কোতে ভজদভিজেংকা স্ট্রীটের বাড়িতে ফিরে যাওয়াই তাদের উচিত, সে বাড়িটা অক্ষতই আছে, সামান্য মেরামত করে দিলেই চলবে। জীবন তো কোথাও থেমে থাকে না, কাজেই বাঁচতে তো হবেই। প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যুর পর থেকে প্রিন্সেস মারি যে নির্জন ধ্যানের রাজ্যে ডুবে ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে যত কষ্টই হোক, নাতাশাকে একলা ফেলে যেতে তার যত দুঃখ ও লজ্জাই হোক, তবু জীবনের নানা চিন্তার দাবিই বড় হয়ে দেখা দিল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে দাবির কাছে সে নতিস্বীকার করল। আলপাতিচের সঙ্গে বসে হিসাবপত্র দেখল, ভাইপোর ব্যাপারে দেসালেসের সঙ্গে আলোচনা করল, এবং মস্কো ফিরে যাবার হুকুম দিয়ে সেজন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল।

নাতাশা একা পড়ে গেল, প্রিন্সেস মারি যবে থেকে যাত্রার আয়োজন করতে লাগল তখন থেকে তার কাছ থেকেও সে সরে গেল।

প্রিন্সেস মারি কাউন্টেসকে বলল, নাতাশাকেও তাদের সঙ্গে মস্কো যেতে দেওয়া হোক, বাবা-মা সানন্দে সে প্রস্তাব গ্রহণ করল, কারণ তারা দেখছে তাদের মেয়েটি দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর স্থান পরিবর্তন ও মস্কোর ডাক্তারদের পরামর্শের ফল তার পক্ষে ভালোই হবে।

সে প্রস্তাব করা হলে নাতাশা বলল, আমি কোথাও যাচ্ছি না। দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও! অনেক কষ্টে দুঃখের চাইতে বিরক্তির চোখের জল চেপে সেখান থেকে ছুটে চলে গেল।

সে বুঝল, প্রিন্সেস মারি তাকে ছেড়ে যাচ্ছে, তার দুঃখ তাকে একাই সইতে হবে। বেশির ভাগ সময় সে নিজের ঘরে একাই কাটায়। এই নির্জনতা তাকে ক্লান্ত করে তোলে, যন্ত্রণা দেয়, তবু সেটা তার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। কেউ ঘরে ঢুকলেই সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, মুখের ভাব বদলে জায়গা বদল করে, একটা বই বা সেলাই হাতে নেয়, অনধিকার প্রবেশকারী কতক্ষণে চলে যাবে তার জন্য অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করে।

সারাক্ষণই তার মনে হয়, যার দিকে তার অন্তরের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে যে কোনো মুহূর্তেই তার ভিতরে সে প্রবেশ করতে পারবে।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে একদিন শীর্ণ, বিবর্ণ শরীর কালো পশমি গাউনে ঢেকে, চুলে কোনোরকমে একটা গিট বেঁধে, সোফার উপর গুঁড়িসুড়ি মেরে বসে, ওড়নার একটা কোণ পালিশ করতে করতে নাতাশা দরজাটার এক কোণের দিকে তাকিয়েছিল।

সে তাকিয়ে আছে সেই দিকে যেদিক দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু চলে গিয়েছে–জীবনের ওপারে। জীবনের সেই পরপারের কথা নাতাশা আগে কখনো ভাবেনি, সেটা তার কাছে মনে হত বহুদূরের এক দুর্গম স্থান, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেক কাছের, অনেক ঘনিষ্ঠ এবং অনেক বেশি বোধগম্য, বরং এখন জীবনের এপারটাই শূন্যতা ও নির্জনতায় ভরা, যন্ত্রণা ও অমর্যাদায় আকীর্ণ।

প্রিন্স আন্দ্রু এখন যেখানে আছে বলে সে জানে সেইদিকেই সে তাকিয়ে আছে, কিন্তু এখানে সে যে রূপে ছিল তা থেকে কোনো ভিন্নতর রূপে সে তাকে কল্পনাই করতে পারে না। এখনো সে তাকে সেইভাবেই দেখছে যেভাবে দেখেছিল মিতিশচিতে, এয়স্তায় এবং ইয়ারোস্লাভলে।

সে প্রিন্স আন্দ্রুর মুখ দেখতে পেল, তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, তার ও নিজের কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করল, আর মাঝে মাঝে এমন সব সংলাপ বানিয়ে বলল যা তারা বলতে পারত।

ওই তো শীর্ণ বিবর্ণ হাতের উপর মাথাটা রেখে ভেলভেটের জোব্বা পরে সে হাতল-চেয়ারটায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। বুকটা ভয়ংকরভাবে বসে গেছে, কাঁধ দুটো ঠেলে উঠেছে। দুটি ঠোঁট দৃঢ়বদ্ধ, দুচোখে আলোর ঝিলিক, বিবর্ণ কপালে কখনো ভাঁজ পড়ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা পা দ্রুতগতিতে ঈষৎ কাঁপছে। নাতাশা জানে সে ভয়ংকর ব্যথার সঙ্গে লড়ছে। সে ব্যথাটা কেমন ধারা? কেন এ ব্যথা তার হল? তার কেমন লাগছে? ব্যথাটা তাকে কীভাবে কষ্ট দিচ্ছে নাতাশা ভাবতে লাগল। সে যে তাকে দেখছে সেটা লক্ষ্য করে প্রিন্স আন্দ্রু চোখ তুলে বলতে লাগল : একটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে চিরদিনের মতো নিজেকে বেঁধে ফেলা–সে বড় ভয়ংকর। সে যে নিয়ত যন্ত্রণা। সেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাতাশার দিকে তাকাল। কি বলবে বুঝবার আগেই নাতাশা যথারীতি জবাব দিয়ে বসল : এরকম চলতে পারে না–চলবে না। তোমাকে সেরে উঠতেই হবে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে হবে।

সেই দৃশ্যের একেবারে গোড়া থেকেই সে তাকে দেখতে পেল, তখনকার পরিবেশটি যেন নতুন করে আবার ঘটল। কথাগুলির সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রুর চোখে যে দীর্ঘ, বিষণ্ণ, কঠিন দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল তাও তার মনে পড়ে গেল, সে দৃষ্টির তিরস্কার ও হতাশার অর্থও সে বুঝতে পারল।

নাতাশা নিজেকেই বলতে লাগল, স্বীকার করেছিলাম যে সে যদি কষ্ট পেয়েই চলতে থাকে তাহলে সেটা সত্যই ভয়ংকর ব্যাপার হবে। অবস্থাটা তার পক্ষে ভয়ংকর হবে জেনেই কথাটা বলেছিলাম, কিন্তু সে তার ভিন্ন অর্থ করল। ভাবল, ব্যাপারটা আমার দিক থেকে ভয়ংকর হবে। তখনো সে বাঁচতে চাইছে, মৃত্যুকে ভয় করছে। আর কি রকম বোকার মতো অদ্ভুতভাবে তাকে আমি কথাগুলি বললাম! যা আমার মনের কথা তা আমি বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম সম্পূর্ণ অন্য রকম। মনের কথা যদি বলতে পারতাম তাহলে আমার বলা উচিত ছিল : সে যদি মুমূর্ষ অবস্থায়ই চলতে থাকে, আমার চোখের সামনেই যদি একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, তাহলেও এখন আমি যে অবস্থায় আছি তার তুলনায় অধিকতর সুখীই হতাম। এখন তো কিছু নেই…কেউ নেই। সে কি তা জানত? না, সে জানত না, কোনো দিন জানবে না। আর সে ভুল শুধরে নেবার কোনো-কোনো সম্ভাবনাই এখন আর নেই। এখন আবার মনে হচ্ছে সেই একই কথাগুলি প্রিন্স আন্দ্রু আবার তাকে বলছে, আর নাতাশা কল্পনায় সম্পূর্ণ আলাদা উত্তর তাকে দিচ্ছে। তাকে থামিয়ে দিয়ে নাতাশা বলল : তোমার পক্ষে ভয়ংকর, কিন্তু আমার পক্ষে নয়। তুমি তো জান, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনের কোনো অর্থ নেই, আর তোমার সঙ্গে কষ্ট ভোগ করাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ। তার হাতটা ধরে নাতাশা তাতে চাপ দিল, প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যুর চার দিন আগেকার সেই ভয়ংকর সন্ধ্যায় ঠিক যেভাবে তার হাতটাকে সে চেপে ধরেছিল। কল্পনায় সে মমতা ও ভালোবাসা মাখানো সেই কথাগুলি বলতে লাগল যা সে তখনো বলতে পারত, কিন্তু বলছে শুধু এখন : আমি তোমাকে ভালোবাসি।…তোমাকেই! আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি… গভীর আবেগে নিজের হাত চেপে ধরে আপ্রাণ চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চেপে সে কথাগুলি বলল…

মধুর দুঃখ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, দুচোখ জলে ভরে এল : পরক্ষণেই সহসা নিজেকেই প্রশ্ন করল, কাকে সে বলছে এসব কথা? আবার সবকিছুই একটা শুষ্ক, কঠোর বিমূঢ়তায় ঢেকে গেল, ভ্রুকুটি কুটীল চোখে আবার সে ফিরে তাকাল বর্তমান জগতের দিকে। আর এখন, এখন তার মনে হল, রহস্যের যবনিকাকে সে ভেদ করতে পেরেছে।…কিন্তু যে মুহূর্তে তার মনে হল যে ধারণার অতীত সত্য তার কাছে প্রকাশিত হতে চলেছে ঠিক তখনই দরজার হাতলের একটা খটাখট আওয়াজ তার কানে এসে বিধল।

দাসী দুনিয়াশা দ্রুত পায়ে আচমকা ঘরে ঢুকল। তার মুখে ভয়ার্ত দৃষ্টি।

অদ্ভুত উত্তেজিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, দয়া করে এখনই আপনার বাবার কাছে চলুন। বড়ই দুর্ভাগ্য…পিতর ইলিনিচ…একটা চিঠি, ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে কথা শেষ করল।

.

অধ্যায়-২

সাধারণভাবে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ ছাড়াও নিজের পরিবার থেকে একটা বিশেষ বিচ্ছিন্নতার বোধ নাতাশাকে পেয়ে বসেছে। বাবা, মা ও সোনিয়া–সকলেই তার এত ঘনিষ্ঠ; এত পরিচিত, এত সাধারণ যে তাদের সব কথা, সব মনোভাবই তার সাম্প্রতিক জীবনের প্রতি একটা বিদ্রূপস্বরূপ, তাদের সম্পর্কে সে যে উদাসীন তাই শুধু নয়, তাদের প্রতি সে একান্তই বিরূপ। তাই দুনিয়াশার মুখে পিতর ইলিনিচ ও দুর্ভাগ্য কথা দুটি শুনেও তার অর্থটা যেন ঠিক ধরতে পারল না।

কিসের দুর্ভাগ্য? তাদের কি দুর্ভাগ্য ঘটতে পারে? তারা তো নিজেদের পুরোনো, শান্ত, সাধারণ জীবনযাত্রাকেই চালিয়ে যাচ্ছে, নাতাশা ভাবল।

সে যখন নাচ-ঘরে ঢুকল তখন তার বাবা দ্রুত পায়ে তার মার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার গালে ভাঁজ পড়েছে, চোখের জলে ভিজে গেছে। কান্নায় গলা আটকে আসছিল বলে বাবা সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। নাতাশাকে দেখে হতাশভাবে হাত নাড়তে নাড়তে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। গোল নরম মুখখানা কান্নায় বিকৃত হয়ে উঠল।

পে…পেতয়া…যাও, যাও, ও…ডাকছে… শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বাবা দুর্বল পা ফেলে কোনোরকমে চেয়ারের কাছে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ধপাস করে বসে পড়ল।

সহসা নাতাশার সারা শরীরের ভিতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ-প্রবাহ বয়ে গেল। তীব্র ব্যথার আঘাতে আর্ত হৃদয়ে সে একটা ভয়ংকর বেদনা অনুভব করল, মনে হল, তার ভিতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, সে যেন মরতে বসেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই বেদনার পরিবর্তে দেখা দিল একটা মুক্তির অনুভূতি–যে বেদনাদায়ক সংযম তাকে জীবন থেকে সরিয়ে রেখেছিল তার হাত থেকে মুক্তি। বাবার এই দৃশ্য, দরজার ফাঁক দিয়ে ভেসে-আসা মার ভয়ংকর উন্মাদ চিৎকার-মুহূর্তের মধ্যে ভুলিয়ে দিল নিজেকে, তার সব দুঃখকে।

সে বাবার কাছে ছুটে গেল, কিন্তু বাবা দুর্বলভাবে হাত নেড়ে মার ঘরটা দেখিয়ে দিল। প্রিন্সেস মারি বেরিয়ে এল সে ঘর থেকে। তার মুখ বিবর্ণ, থুতনি কাঁপছে, নাতাশার হাত ধরে কি যেন বলল। নাতাশা তাকে দেখতে পেল না, তার কথাও শুনতে পেল না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্য দরজায় একটু থামল, বুঝি বা নিজের সঙ্গে লড়াই করল, তারপর ছুটে গেল মার কাছে।

অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাউন্টেস হাতল-চেয়ারে শুয়ে আছে। শরীরটা টান-টান করে দেয়ালে মাথা ঠুকছে। সোনিয়া ও দাসী তার দুহাত ধরে আছে।

কাউন্টেস চিৎকার করছে, নাতাশা! নাতাশা! এ সত্য নয়…এ সত্য নয়…ও মিথ্যা কথা বলছে…নাতাশা! সকলকে ঠেলে দিয়ে সে আর্তনাদ করে উঠল, তোমরা চলে যাও। একথা সত্য নয়! মারা গেছে!…হা, হা, হা!…এ কথা সত্য নয়।

হাতল-চেয়ারে এক হাঁটু রেখে নাতাশা মার উপর ঝুঁকে দাঁড়াল, অপ্রত্যাশিত শক্তিতে তাসে তুলে ধরে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল, তারপর মাকে জড়িয়ে ধরল।

মামণি!…লক্ষ্মী সোনা!…এই তো আমি এসেছি সোনামণি!

 নাতাশা ফিসফিস করে অবিশ্রাম কথা বলতে লাগল।

কিছুতেই মাকে ছাড়ল না, গভীর মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরে রইল, একটা বালিশ ও গরম জল আনতে বলল, বোতাম খুলে মার পোশাকটা ছিঁড়ে খুলে ফেলল।  লক্ষ্মী সোনা মা…মামণি, মানিক আমার!…সারা মাথায়, হাতে, মুখে বার বার চুমো খেয়ে সে বলতে লাগল, আর তার নিজের অবারণ চোখের জল নাক ও গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কাউন্টেস মেয়ের হাত চেপে ধরে চোখ বুজল, মুহূর্তের জন্য শান্ত হল। সহসা অনভ্যস্ত দ্রুতগতিতে উঠে বসল, ফাঁকা চাউনিতে চারদিকে তাকাল, আর নাতাশাকে দেখতে পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তার মাথাটা চেপে ধরল, মেয়ের বেদনাদীর্ণ মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

অস্পষ্ট নিম্নস্বরে বলল, নাতাশা, তুমি তো আমাকে ভালোবাস? নাতাশা, তুমি তো আমাকে ঠকাবে না? সব সত্য আমাকে খুলে বলবে তো?

জল-ভরা চোখ মেলে নাতাশা মার দিকে তাকাল, সে চোখে ভালোবাসা ও ক্ষমার মিনতি ছাড়া আর কিছু নেই।

যে প্রচণ্ড দুঃখ তার মাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তার কিছুটা ভার নিজের উপর নেবার আপ্রাণ চেষ্টায় নাতাশা বারবার বলতে লাগল, লক্ষ্মী মামণি আমার!

কিন্তু জীবনে ফুটে ওঠার কালে তার বড় আদরের ছেলেটি নিহত হয়েছে আর সে নিজে এখনো বেঁচে আছে–এ-কথা মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই তো বাস্তব সত্যের সঙ্গে সংগ্রামে বিফল হয়ে আবার সে ফিরে গেল বিকারের জগতে।

সেদিনটা, সেরাতটা এবং তার পরের দিন ও রাত যে কীভাবে কাটল তা নাতাশার মনে পড়ে না। সে একটুও ঘুমল না, মাকে ছেড়ে কোথাও গেল না। ধৈর্যশীল ভালবাসা দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত মাকে ঘিরে রাখল। কোনো কথা নয়, সান্ত্বনা নয়, শুধু তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার অক্লান্ত প্রয়াস।

তৃতীয় রাতে কয়েক মিনিটের জন্য কাউন্টেস একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে নাতাশা চোখ বুজল, কিন্তু বিছানার ক্যাচ-কাঁচ শব্দে আবার চোখ মেলল। বিছানায় উঠে বসে কাউন্টেস মৃদুস্বরে কথা বলছে।

তুমি আসায় কত খুশি হয়েছি। তুমি ক্লান্ত। একটু চা খাবে না? নাতাশা তার কাছে এগিয়ে গেল। মেয়ের হাতখানি ধরে কাউন্টেস বলেই চলল, তুমি দেখতে কত ভালো হয়েছ, আরো মানুষের মতো হয়ে উঠেছ।

মামণি! কী বলছ তুমি?

নাতাশা, সে নেই, সে নেই!

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম কাউন্টেস কেঁদে উঠল।

.

 অধ্যায়-৩

প্রিন্সেস মারি তার যাত্রা স্থগিত রাখল। সোনিয়া ও কাউন্ট নাতাশার কাজগুলি করতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তারা বুঝল, একমাত্র নাতাশাই তার মার অকারণ হতাশাকে সংযত রাখতে পারে। তিনটি সপ্তাহ নাতাশা মার পাশে সর্বক্ষণ রইল, তার ঘরেই একটু লাউঞ্জ-চেয়ারে ঘুমোয়, তাকে খাওয়া-দাওয়ায়, অনবরত তার সঙ্গে কথা বলে, কারণ একমাত্র তার মুখের মমতামাখা কথাগুলি কানে গেলেই তার মা শান্ত থাকে।

কিন্তু মার আহত মন সুস্থ হল না। পেতয়ার মৃত্যু তার জীবনের অর্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। পেতয়ার মৃত্যু-সংবাদ যখন এল তখন সে ছিল পঞ্চাশ বছরের একটি তাজা উৎসাহে ভরা নারী, আর একমাস পরে সে যখন ঘর থেকে বের হল তখন সে জীবনে সম্পূর্ণ বীতশূহ একটি নিরাসক্ত বৃদ্ধা। কিন্তু যে আঘাত কাউন্টেসকে ঠেলে দিল প্রায় মৃত্যুর মুখে, সেই দ্বিতীয় আঘাত নাতাশাকে ফিরিয়ে আনল নবজীবনের মধ্যে।

নাতাশা ভেবেছিল তার জীবন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু মার প্রতি ভালোবাসা তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে বুঝিয়ে দিল, যে ভালোবাসা জীবনের মূল কথা তা এখনো তার মধ্যে সক্রিয়। ভালোবাসা জেগে উঠেছে, আর সেই সঙ্গে জীবনও জেগেছে।

প্রিন্স আন্দ্রুর শেষ দিনগুলি প্রিন্সেস মারি ও নাতাশার জীবনকে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে, এই নতুন দুঃখ তাদের দুজনকে আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলল। প্রিন্সেস মারি তার যাত্রা স্থগিত রাখল, তিনটি সপ্তাহ ধরে রুগ্ন শিশুর মতো নাতাশার পরিচর্যা করল। মার শয়নকক্ষে কাটানো শেষের সপ্তাহ কয়টি নাতাশার দৈহিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।

একদিন বিকেলে নাতাশাকে জ্বরে কাঁপতে দেখে প্রিন্সেস মারি তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। নাতাশা শুয়ে পড়ল, কিন্তু পর্দাগুলো নামিয়ে দিয়ে প্রিন্সেস মারি যখন চলে যাচ্ছিল তখন সে তাকে ডাকল।

আমার ঘুমতে ইচ্ছা করছে না মারি, আমার কাছে একটু বস।

তুমি ক্লান্ত-ঘুমতে চেষ্টা কর।

না, না। কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলে? মা আমার খোঁজ করবে।

 মা এখন ভালো আছে। আজ সে বেশ ভালোভাবে কথা বলেছে। প্রিন্সেস মারি বলল। নাতাশা বিছানায় শুয়ে ঘরের আধা-অন্ধকারে প্রিন্সেস মারির মুখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

সে ভাবতে লাগল, প্রিন্সেস মারি কি তার মতো দেখতে? হ্যাঁ, তার মতোই, তবু তার মতো নয়। কিন্তু এও তো আমার কাছে নতুন, বিচিত্র, অজ্ঞাত। এও আমাকে ভালোবাসে। কি আছে এর অন্তরে? যা কিছু ভালো সব। কিন্তু কেমন করে? এর মনটি কার মতো আমার সম্পর্কে এর ধারণা? সত্যি, প্রিন্সেস মারি চমৎকার মানুষ!

প্রিন্সেস মারির হাতটা টেনে নিয়ে নাতাশা ভীরু গলায় বলল, মারি তুমি আমাকে খারাপ ভেবো না। ভাববে না তো? প্রিয় মারি, তোমাকে আমি কত ভালোবাসি! এস আমরা বন্ধু হই, খুব বন্ধু।

তাকে জড়িয়ে ধরে নাতাশা তার মুখে ও হাতে চুমো খেল, তাতে প্রিন্সেস মারি লজ্জা পেল, আবার সুখীও হল।

সেদিন থেকেই প্রিন্সেস মারি ও নাতাশার মধ্যে দু-সখীর মতো একটা ভীরু উচ্ছ্বসিত বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তারা সবসময় পরস্পরকে চুমো খায়, ভালো ভালো কথা বলে, অধিকাংশ সময় একসঙ্গে কাটায়। যখন তারা একা থাকে তার তুলনায় তারা পরস্পরের মধ্যে গভীরতর মিল অনুভব করে যখন তারা একত্রে কাটায়। তাদের মধ্যে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের চাইতেও অধিকতর শক্তিশালী একটা অনুভূতি, একে অন্যের উপস্থিতিতে পায় যেন জীবনের এক নতুন অনুভূতি।

কখনো তারা ঘণ্টার পর ঘন্টা চুপ করে থাকে, কখনো বিছানায় শুয়ে কথা বলতে বলতে রাত ভোর করে দেয়। বেশির ভাগ সময় বলে দূর অতীতের কথা। প্রিন্সেস মারি বলে তার শৈশবের কথা, মার কথা, বাবার কথা, তার দিবাস্বপ্নের কথা। আর নাতাশাও প্রিন্সেস মারির প্রতি ভালোবাসায় তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের অতীতকেও ভালোবাসতে শিখেছে, জীবনের যেদিকটা তার কাছে দুরধিগম্য ছিল তাকেও বুঝতে শিখেছে। ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দুজনেই জীবনকে দেখতে শিখেছে নতুন দৃষ্টিতে, নতুন বিশ্বাসে–জীবনের প্রতি, তার আনন্দের প্রতি বিশ্বাসে।

আগের মতোই কখনো তারা প্রিন্স আন্দ্রুর কথা বলে না, কথা বলে নিজেদের মনের মহৎ ভাবনাকে তারা ছোট করতে চায় না, কিন্তু তার সম্পর্কে তাদের এই নীরবতার ফলে ক্রমেই তারা নিজেদের অজ্ঞাতেই তাকে ভুলে যেতে লাগল।

নাতাশা এতই শীর্ণ, বিবর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সকলেই তার স্বাস্থ্যের কথা বলে, আর তাতে সেও খুশি হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা ভয় তাকে চেপে ধরে-শুধু মৃত্যুর ভয় নয়, রোগ, দুর্বলতা ও খারাপ দেখাবার ভয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও খোলা হাতটাকে সে ভালো করে লক্ষ্য করে, তার শীর্ণতায় বিস্মিত হয়, আর সকালে উঠেই নিজের করুণ মুখখানি আয়নায় দেখে। সে বুঝতে পারে এইরকম হওয়াই স্বাভাবিক, তবু তার মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে যায়।

একদিন তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তার হাঁপ ধরে গেল। কিছু না বুঝেই তক্ষুনি নিচে নেমে গেল এবং নিজের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য আবার দৌড়ে উপরে উঠে গেল।

অন্য এক সময় দুনিয়াশাকে ডাকতে গিয়ে গলাটা কেঁপে ওঠায় আবার তাকে ডাকল–আর ডাকল সেই বুকের ভিতর থেকে আসা গলায় যে গলায় সে গান করত, তারপর কান পেতে নিজেই নিজের গলা শুনতে লাগল।

সে জানত না, একথা বিশ্বাসও করত না, কিন্তু যে চটচটে কাদায় ঢাকা পড়ার জন্য তার আত্মা দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছিল তার কাছে, সেই কাদার স্তরের নিচ থেকে নরম ঘাসের অংকুরগুলি এর মধ্যেই মাথা তুলতে শুরু করেছে, মাটিকে শিকড় গজিয়ে তাদের জীবন্ত সবুজের আভায় সেই অংকুরগুলি তার সব দুঃখকে এমনভাবে ঢেকে দেবে যে অচিরেই তাকে আর দেখা যাবে না। তার মনের ক্ষত ভিতর থেকে সেরে উঠতে শুরু করেছে।

জানুয়ারির শেষ দিকে প্রিন্সেস মারি মস্কো যাত্রা করল, নাতাশা যাতে তার সঙ্গে গিয়ে ডাক্তার দেখায় সেজন্য কাউন্ট পীড়াপীড়ি করতে লাগল।

.

অধ্যায়-৪

ভিয়াজমাতে শত্রুপক্ষকে পরাভূত করে তচনচ করে দিতে অতি-উৎসাহী সৈন্যদলকে কুতুজভ সংযত করে রাখতে পারেনি। সেই সংঘর্ষের পর থেকে পলায়মান ফরাসিদের এবং তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারী রুশদের অগ্রগতি ক্রাসনু পর্যন্ত বিনা যুদ্ধেই চলতে থাকল। পলায়ন ছিল এতই দ্রুতগতি যে পশ্চাদ্ধাবনকারী রুশ বাহিনী ফরাসিদের সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি। অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনীর ঘোড়াগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ল, আর ফরাসিদের গতিবিধির যেসব খবর পাওয়া গেল তাও কোনো ক্ষেত্রেই নির্ভরযোগ্য নয়।

দৈনিক সাতাশ মাইল হারে একটানা পথ চলার ফলে রুশ বাহিনীর সৈন্যরা এতই শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে আরো দ্রুত চলা তাদের পক্ষে সম্ভব হল না।

রুশ বাহিনী যে কতখানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেটা বুঝতে হলে শুধু এই সত্যটাই জানা প্রয়োজন যে তারুতিনোর পরে পাঁচ হাজারের মতো নিহত ও আহত করে এবং শতাধিক বন্দিকে হারিয়ে যে রুশ বাহিনী। এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে তারুতিনো ছেড়ে এসেছিল তারা ক্রাসনুতে পৌঁছল মাত্র পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে।

ফরাসিদের পলায়ন যেমন তাদের বাহিনীর ধ্বংস সাধন করেছিল, ঠিক তেমনই রুশদের পশ্চাদ্ধাবনের দ্রুতগতিও হয়েছিল আমাদের বাহিনীর পক্ষে ধ্বংসাত্মক। দুইয়ের মধ্যে একমাত্র তফাৎ হল-রুশ বাহিনীর গতি ছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত, ফরাসিদের মতো তাদের মাথার উপর ধ্বংসের খ ঝুলছিল না, আর যেখানে রুগ্ন ফরাসিদের ফেলে যেতে হল শত্রুর হাতে, রুগ্ন রুশদের ফেলে যাওয়া হল তাদের নিজেদেরই লোকের হাতে। নেপোলিয়নের বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতির প্রধান কারণ তাদের চলার দ্রুতগতি, আর রুশ বাহিনীর তুলনামূলক সৈন্য-সংখ্যার হ্রাসই তার চূড়ান্ত প্রমাণ।

পিটার্সবুর্গের কর্তৃপক্ষ এবং রুশ বাহিনীর জেনারেলরা সকলেই তখন চাইছিল ফরাসিদের পলায়ন। কুতুজভও ফরাসিদের পলায়নের পথে বিঘ্নসৃষ্টির চেষ্টা না করে তারুতিনো ও ভিয়াজমার মতোই এখানেও সেই একই লক্ষ্যে সাধ্যমতো সর্বশক্তি নিয়োগ করল এবং আমাদের বাহিনীর গতিকে যথাসম্ভব শ্লথ করে রাখল।

রুশ সৈন্যের মতো কুতুজভও মনে-প্রাণে বুঝল ও জানল-যুক্তি বা রণ-বিজ্ঞানের সাহায্যে নয়, সমগ্র রুশ সত্তা দিয়ে-যে ফরাসিরা পরাজিত হয়েছে, শত্রুরা পালাচ্ছে, তাদের তাড়িয়ে দিতেই হবে, কিন্তু সেইসঙ্গে বৎসরের এই সময়টাতে এরকম তুলনাবিহীন দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলার যে কত কষ্ট, কত দুঃখ সৈন্যদের মতোই সেটাও কুতুজভ ভালোই বুঝতে পারল।

কিন্তু যেসব জেনারেল–বিশেষ করে রুশ বাহিনীর বিদেশী জেনারেলরা–চাইল নিজেদের জন্য খ্যাতি অর্জন করতে, কাউকে তাক লাগিয়ে দিতে, এবং কোনো না কোনো কারণে রাজা ও ডিউককে গ্রেপ্তার করতে, তারা ভাবল যে যুদ্ধ করে বিজয়ী হবার এই তো সময়। তাই তারা যখন ছেঁড়া জুতো ও ছেঁড়া পোশাক পরা অর্ধভুক্ত সৈন্য নিয়েই একের পর এক যুদ্ধের প্রকল্প উপস্থিত করতে লাগল, কুতুজভ তখন শুধু বারবার দুকাঁধে ঝাঁকুনি দিতে লাগল।

রুশ বাহিনী যেখানেই ফরাসি বাহিনীর একেবারে ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়ল, এইভাবে নিজেদের বিশিষ্ট করে তুলবার, রণ-কৌশল প্রয়োগ করবার, শত্রুকে পরাজিত ও তচনচ করে দেবার বাসনা সেখানেই বিশেষ করে প্রকট হতে লাগল।

সেটাই ঘটল ক্রাসনুতে, তারা আশা করেছিল তিনটি ফরাসি সেনাদলের একটির সঙ্গে সেখানেই তাদের মোলাকাত হবে, কিন্তু তার বদলে সেখানে তারা হাজির হল ষোলো হাজার সৈন্যসহ স্বয়ং নেপোলিয়নের মুখোমুখি। সেখানে একটি বিধ্বংসী সংঘর্ষকে পরিহার করে নিজের সৈন্যদের অক্ষত রাখতে কুতুজভের সর্বপ্রকার চেষ্টা সত্ত্বেও পথশ্রমে ক্লান্ত রুশদের হাতে বিশৃখল ফরাসি সৈন্যদের নিধনযজ্ঞ তিনদিন ধরে চলল ক্রাসনুর পথে-প্রান্তরে।

তোল একটা নির্দেশনামা লিখেছিল : প্রথম সেনাদল অমুক অমুক দিকে এগিয়ে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু যথারীতি সে নির্দেশনামা মোতাবেক কিছুই ঘটল না। উতেমবের্গের প্রিন্স ইউজেন একটা পাহাড়ের উপর থেকে পলায়মান ফরাসিদের উপর গোলাবর্ষণ করতে লাগল। আরো সৈন্য সে চেয়ে পাঠাল, কিন্তু কেউ এল না। ফরাসিরা রুশদের দৃষ্টি এড়িয়ে পালাতে লাগল, রাতের আঁধারে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে যথাসাধ্য ছুটতে লাগল।

মিলরাদভিচ তো নিজেই নিজেকে ভয় ও নিন্দার অতীত এক নাইট।ফরাসিদের সঙ্গে আলোচনা চালানো ছিল তার প্রিয় কাজ। ফরাসিদের কাছে দূত পাঠিয়ে সে তাদের আত্মসমর্পণ দাবি করল, অনেক সময় নষ্ট করল, কিন্তু তাকে যা করতে বলা হয়েছিল তার কিছুই করল না।

ঘোড়ায় চেপে অশ্বারোহী বাহিনীর সামনে হাজির হয়ে ফরাসিদের দেখিয়ে সে বলল, দেখ বাছারা, ওই সেনাদলটা তোমাদের দিয়ে দিলাম।

অশ্বারোহী সৈন্যরা তখন ঘোড়র পেটে কাঁটা মেরে তরবারি উঁচিয়ে অনেক কষ্টে সেই সেনাদলের সামনে, অর্থাৎ ঠাণ্ডায় জমে-যাওয়া তুষারপাতে আহত ও অভুক্ত একদল ফরাসির সামনে গিয়ে হাজির হল, তারাও সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল, তারা তো অনেক আগে থেকে এইজন্যে অপেক্ষা করেই ছিল।

ক্রাসনুতে তারা ছাব্বিশ হাজার ফরাসিকে বন্দি করল, কয়েকশো কামান দখল করল, আর পেল মার্শালের দণ্ড নামক একটা লাঠি, কার কতখানি কৃতিত্ব তাই নিয়ে তর্ক করল, এবং নিজেদের সাফল্যে খুশিও হল, যদিও নেপোলিয়নকে, নিদেনপক্ষে কোনো মার্শাল বা নায়ককে পাকড়াও করতে না পারায় তারা দুঃখিত হল এবং সে অক্ষমতার জন্য পরস্পরকে, বিশেষ করে কুতুজভকে দায়ী করতে লাগল।

আবেগের তাড়নায় পরিচালিত এই লোকগুলি আসলে অনিবার্য নিয়মের হাতে অন্ধ যন্ত্রমাত্র হলেও তারা নিজেদের ভাবল এক একজন মহাবীর, মনে করল যে একটি মহান, সম্মানিত কাজ তারাই সম্পন্ন করেছে। সব দোষ তারা চাপাল কুতুজভের ঘাড়ে, বলল, অভিযানের গোড়া থেকেই সে নেপোলিয়নকে পরাজিত করার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে, নিজের বাসনা পূরণ করা ছাড়া আর কিছুই সে ভাবেনি, কাপড়ের কলগুলিতে বেশ আরামে ছিল বলে সেখান থেকে এক পাও নড়তে চায়নি, ক্রাসনুতে সে রুশ বাহিনীর অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে দিল কারণ সেখানে নেপোলিয়ন আছে শুনেই তার মুণ্ডু ঘুরে গিয়েছিল, এবং এটাও হতে পারে যে নেপোলিয়নের সঙ্গে তার একটা বোঝা-পড়া হয়ে গিয়েছিল, তাকে বেশ কিছু ঘুষ দেওয়া হয়েছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

শুধু যে সমসাময়িকরা আবেগের বশে এইসব কথা বলেছে তাই নয়, পরবর্তী যুগ এবং ইতিহাসও নেপোলিয়নকে মহান পুরুষ বলে প্রশংসা করেছে, তার কুতুজভকে বিদেশীরা বর্ণনা করেছে একজন ফন্দিবাজ, ইন্দ্রিয়পরায়ণ, দুর্বল বৃদ্ধ সভাসদরূপে, আর তার সম্পর্কে রুশদের বর্ণনা কিছুটা অস্পষ্ট–সে যেন এক ধরনের পুতুল, শুধু একটা রুশ নামের অধিকারী বলেই কিছুটা কাজের লোক।

.

অধ্যায়-৫

১৮১২ ও ১৮১৩ সালে কুতুজভের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভুল কাজের অভিযোগ আনা হল। সম্রাট তার উপর অসন্তুষ্ট হল। এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সম্প্রতি লিখিত একখানি ইতিহাসের পুঁথিতে বলা হয়েছে, কুতুজভ ছিল একজন ধূর্ত, মিথ্যাবাদী সভাসদ, নেপোলিয়নের নাম শুনেই ভয়ে জড়সড়, ক্রাসনুতে ও ও বেরিজিনাতে তার ভুলের জন্যই রুশ বাহিনী ফরাসিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয়লাভের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।

রুশ মানসিকতা যেসব মহাপুরুষদের (Grands Hommes) স্বীকার করে না তাদের নয়, কিন্তু যেসব বিরল ও একক ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করে তার কাছেই নিজের ইচ্ছাকে সঁপে দেয়, এই তাদের নিয়তি। উচ্চতর বিধানকে মেনে নেবার জন্য জনতার ঘৃণা ও বিদ্বেষ এইভাবেই তাদের দণ্ডিত করে।

বিচিত্র ও ভয়ংকর শোনালেও যে-নেপোলিয়ন ইতিহাসের হাতের একটি অতি নগন্য যন্ত্রমাত্র, যে কখনো কোথাও, এমনকি নির্বাসনকালেও, কোনোরকম মানিবক মর্যাদার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি, সেই নেপোলিয়নই রুশ ইতিহাসকারদের কাছে স্তুতিবচন ও উৎসাহের বস্তু, সেই এক মহাপুরুষ। কিন্তু কুতুজ-সে মানুষটি একেবারে শুরু থেকে ১৮১২ সালে তার কাজের শেষপর্যন্ত, বরদিনো থেকে ভিলনা পর্যন্ত, একটিবারও কি কথায় আর কি কাজে কখনো, দোলাচলচিত্ত হয়নি, আত্মত্যাগ ও ভবিষ্যৎ-সচেতনতার এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা ইতিহাসের ব্যতিক্রমস্বরূপ,-সেই কুতুজভ তাদের কাছে একটি অস্পষ্ট করুণার পাত্রবিশেষ, তার সম্পর্কে এবং ১৮১২ সাল সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই তারা কেমন যেন লজ্জা বোধ করে।

অথচ একটিমাত্র লক্ষ্যে স্থিরদৃষ্টি হয়ে কর্মের পথে এগিয়ে চলার এমন আর একটি ঐতিহাসিক চরিত্রের কল্পনা করাও তো শক্ত, আর সমগ্র জাতির ইচ্ছার অধিকতর উপযুক্ত বা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর একটি লক্ষ্যের কথা কল্পনা করাও তো সমান শক্ত। আবার, ১৮১২ সালে কুতুজভের সমগ্র কর্মপ্রচেষ্টা যে লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল, অন্য কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তির দ্বারা সেরূপ পরিপূর্ণভাবে লক্ষ্য পূর্ণ করবার আর একটি দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে বের করা তো ততোধিক শক্ত।

কুতুজভ কখনো, পিরামিডের উপর থেকে নিচে তাকিয়ে চল্লিশ শতাব্দীর কথা বলেনি, বলেনি পিতৃভূমির জন্য তার ত্যাগের কথা, সে কি করতে চেয়েছিল বা করতে পেরেছিল তার কথা : সাধারণভাবে বলা যায়, সে কখনো নিজের কথা বলেনি, কোনো মুখোশ আঁটেনি মুখে, অতি সাধারণ মানুষের মতো অত্যন্ত সরলভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছে, মুখেও বলেছে সরলতম সাধারণ কথা। চিঠি লিখেছে মেয়েদের কাছে আর মাদাম দ্য স্তাইলের কাছে, উপন্যাস পড়েছে, সুন্দরীদের সঙ্গ ভালোবেসেছে, জেনারেল, অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে হাসি-তামাশা করেছে, এবং কেউ কিছু প্রমাণ করতে চাইলে কখনো তার প্রতিবাদ করেনি। ইয়াউজা সেতুর কাছে কাউন্ট রস্তপচিন যখন ঘোড়া ছুটিয়ে কুতুজভের কাছে এসে ব্যক্তিগতভাবে তাকে তিরস্কার করে বলেছিল : আপনি যে কথা দিয়েছিলেন বিনা যুদ্ধে মস্কো ছেড়ে যাবেন না তার কি হল? কুতুজভ তখন উত্তরে বলেছিল : বিনা যুদ্ধে আমি মস্কো ছেড়ে যাব না, যদিও তখন মস্কো পরিত্যক্ত হয়েই গেছে। সম্রাটের কাছ থেকে এসে আরাকচিভ যখন বলল যে এর্মলভকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানের পদে নিযুক্ত করা উচিত তখন কুতুজভ জবাব দিল : ঠিক, এই কথাই আমি নিজেও ভাবছিলাম, যদিও একমুহূর্ত আগে এর উল্টো কথাই সে বলেছিল। একদল নির্বোধ জনতার মধ্যে যখন একমাত্র সেই বুঝেছে আসন্ন ঘটনাবলীর প্রচণ্ড তাৎপর্য, তখন মস্কোর সে মহাবিপদের জন্য রস্তপচিন তাকেই দায়ী করুক আর নিজেকেই দায়ী করুক তাতে কি আসে যায়? আর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে কে নিযুক্ত হল না হল, তাতেও তো বিশেষ কিছুই আসে-যায় না।

নিজে কখন কি বলছে না বলছে সে খেয়াল না থাকলেও এই মানুষটি কিন্তু পুরো কর্মকাণ্ডের মধ্যে একবারও এমন একটি কথা উচ্চারণ করেনি যা সমগ্র যুদ্ধকালে তার একমাত্র লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন। স্পষ্টই বোঝা যায়, সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সে বারবার নিজের মনের কথাকেও প্রকাশ করেছে, যদিও সে জানত যে তাকে কেউ ঠিক ঠিক বুঝবে না। যে বরোদিনের যুদ্ধে অন্য সকলের সঙ্গে তার মত-পার্থক্যের সূচনা সেখান থেকে আরম্ভ করে একমাত্র সেই বলেছে যে বরদিনোর যুদ্ধে তাদের জয় হয়েছে, আর মুখের কথায়, চিঠিপত্রে ও প্রতিবেদনে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সেই একই কথা সে বারবার বলেছে। একমাত্র সেই বলেছে, মস্কোকে হারানো মানেই রাশিয়াকে হারানো নয়। লরিস্তনের শান্তি-প্রস্তাবের উত্তরে সে বলেছে, কোনো রকম সন্ধি হতে পারে না, কারণ সেটাই জনগণের ইচ্ছা। ফরাসিদের পশ্চাদপসরণের সময় একমাত্র সেই বলেছে, আমাদের সব রণকৌশল বৃথা, আমাদের আশাতিরিক্ত ভালোভাবেই আপনা থেকেই সবকিছু ঘটে চলেছে, শত্রুকে একটা সোনালি সেতু অবশ্যই দিতে হবে, তারুতিনো, বা ভিয়াজমা, বা ক্রাসনুর যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই, সীমান্তে পৌঁছবার জন্য কিছু সৈন্য আমাদের সঙ্গে রাখতেই হবে, এবং দশজন ফরাসির বনিময়েও একজন রুশকে বলি দিতে সে রাজি নয়।

আর এই সভাসদটি–এইভাবেই তাকে বর্ণনা করা হয়েছে-সম্রাটকে খুশি করার জন্য আরাকচিভের কাছে মিথ্যা বললেও সেই সম্রাটের বিরূপতাকে মেনে নিয়ে ভিলনায় বলেছে, সীমান্তের ওপারে যুদ্ধকে চালিয়ে নেওয়া অর্থহীন ও ক্ষতিকর।

একমাত্র সেই যে ঘটনাবলির তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল তার প্রমাণ শুধু তার মুখের কথাই নয়। তিলমাত্র ব্যতিক্রমবিহীনভাবে তার সব কাজই পরিচালিত হয়েছিল একটিমাত্র ত্রিবিধ লক্ষ্যের দিকে–(১) ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। (২) তাদের পরাজিত করা, এবং (৩) আমাদের জনগণ ও আমাদের সৈন্যদের দুঃখ-কষ্টকে যথাসম্ভব কম রেখে শত্রুকে রাশিয়া থেকে বিতারিত করা।

এই সময়াপহরক কুতুজভ যার নীতি ছিল ধৈর্য ও সময়, চূড়ান্ত যুদ্ধের এই শত্রুই কিন্তু অতুলনীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে বরদিনোতে যুদ্ধ করেছিল। এই কুতুজভ অস্তারলিজের যুদ্ধ শুরু হবার আগেই বলেছিল যে সে যুদ্ধে আমাদের হার হবে, অন্য সকলের মতের বিরুদ্ধে সেই বৃদ্ধ পর্যন্ত বলেছে যে বরদিনোতে আমাদের জয় হয়েছে, অথচ যুদ্ধে জয়লাভ করে কোন সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ করেছে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। পশ্চাদপসরণের সময় একমাত্র সেই বারবার বলেছে যে তখন আর অকারণে কোন যুদ্ধ করা উচিত নয়, নতুন করে আর একটা যুদ্ধ শুরু করা অথবা রুশ সীমান্ত অতিক্রম করাও উচিত নয়।

কিন্তু সকলের অভিমতের বিরোধিতা করে সেই বৃদ্ধ মানুষটি একাকি কেমন করে তৎকালীন ঘটনাবলি সম্পর্কে জনমতের গুরুত্বটা এমনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল যাতে সারা কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটিবারের জন্যও তাকে তা থেকে সরে যেতে হয়নি?

তৎকালীন ঘটনাবলির তাৎপর্যকে প্রত্যক্ষ করবার এই অসাধারণ ক্ষমতার উৎস ছিল তার অন্তরের নিষ্কলুষ জাতীয়তাবোধ।

তার এই জাতীয়তাবোধের স্বীকৃতি হিসেবেই জনসাধারণ স্বয়ং জারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে-রাজানুগ্রহবঞ্চিত একটি বৃদ্ধকেই-এই জাতীয় যুদ্ধে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। আর এই জাতীয়তাবোধই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল মানবিকতার সেই সর্বোচ্চ মঞ্চে যেখান থেকে প্রধান সেনাপতিরূপে সে তার সর্বশক্তি নিয়োেগ করেছিল মানুষকে হত্যা ও ধ্বংস করতে নয়, তাদের রক্ষা করতে, তাদের করুণা করতে।

ইওরোপিয় নায়কের–মানুষের তথাকথিত শাসনকর্তার যে নকল ছাঁচ ইতিহাস আবিষ্কার করেছে, তার মধ্যে ফেলে এই সরল, বিনয়ী ও প্রকৃত মহৎ মূর্তিটিকে ঢালাই করা যায়নি।

অনাগত ভৃত্যের দৃষ্টিতে কোন মানুষই মহৎ হতে পারে না, কারণ মহত্ত্ব সম্পর্কে তারও একটা নিজস্ব ধারণা থাকে।

.

অধ্যায়-৬

তথাকথিত ক্রাসনু যুদ্ধের প্রথম দিনটি ছিল ৫ নভেম্বর। সন্ধ্যার দিকে–জেনারেলদের মধ্যে অনেক বির্তক ও ভুলভ্রান্তির পরে, এবং পরস্পরবিরোধী হুকুম দিয়ে অ্যাডজুটান্টদের দিকে দিকে পাঠিয়ে দেবার পরে যখন একটা কথা পরিষ্কার বোঝা গেল যে শত্রুপক্ষ সর্বত্র পালাতে শুরু করেছে এবং আর কোন যুদ্ধ হবে না, তখন কুতুজভ ক্রাস ছেড়ে দোতে চলে গেল, তার প্রধান ঘাঁটি সেইদিনই সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছে।

পরিষ্কার দিন। তুষার ঝরছে। ছোট, মোটা সাদা ঘোড়ার পিঠে চেপে কুতুজভ দোত্ৰু চলেছে, পিছনে চলেছে অসন্তুষ্ট জেনারেলদের একটা বড় দল, তারা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। পথের দুধারে আগাগোড়া সেদিনকার ফরাসি বন্দিরা (সংখ্যায় তারা সাত হাজার) দলে দলে শিবির-আগুনের পাশে ভিড় করে শরীর গরম করছে। দোক্রর কাছাকাছি এক জায়গায় ছিন্নবাস পরিহিত বন্দিদের একটা মস্ত বড় দল কলগুঞ্জনে ব্যস্ত, হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দিয়ে শরীরটা ঢেকেছে, ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধেছে, রাস্তার উপর এক সারি ফরাসি কামানের পাশে তারা দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান সেনাপতিকে দেখে তাদের কলগুঞ্জন থেমে গেল, সকলেরই চোখ পড়ল কুতুজভের উপর, তার মাথায় লাল পটি দেওয়া সাদা টুপি, আর একটা প্যাড-লাগানো ওভারকোট। সাদা ঘোড়ায় চেপে সে ধীরে ধীরে তাদের পার হয়ে গেল, কামানগুলো কোথায় দখল করা হয়েছে আর সৈনিকদের কোথায় বন্দি করা হয়েছে সেকথা বুঝিয়ে বলতে লাগল একজন জেনারেল।

কুতুজভ কি যেন ভাবছে, জেনারেলের কথাগুলি তার কানে গেল না। অসন্তোষভরা চোখ দুটি কুঁচকে সে একদৃষ্টিতে হতভাগা বন্দিদের দিকেই তাকিয়ে চলেছে। তুষারপাতের ফলে নাক ও গাল বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাদের প্রায় সকলকেই কিছুত দেখাচ্ছে, প্রায় সকলেরই চোখ লাল, ফোলাফোলা, পুঁজ জমেছে।

একদল ফরাসি রাস্তার খুব কাছে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজন একটুকরো কাঁচা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, একজনের মুখে ঘা দগদগ করছে। তাদের দ্রুত সঞ্চালিতে দৃষ্টির মধ্যে কেমন একটা ভয়ংকর পশুর মতো ভাব ফুটে উঠেছে।

কুতুজভ অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে এই সৈন্য দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে ভাঁজ পড়ল, চোখ কুঁচকে গেল, চিন্তিতভাবে মাথাটা দোলাতে লাগল। আর এক জায়গায় দেখল, একটি রুশ সৈনিক একজন ফরাসি কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতো কি যেন বলছে। সেই একইরকম মুখের ভাব করে কুতুজভ আর একবার মাথাট দোলাতে লাগল।

ফরাসিদের কাছ থেকে দখল-করা কতকগুলি পতাকার দিকে প্রধান সেনাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রিয়োব্রাঝেনস্ক রেজিমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে একজন জেনারেল সমানে কথা বলে যাচ্ছিল, তার দিকে ফিরে কুতুজভ শুধাল, আপনি কি বলছিলেন?…ওঃ, ঐ পতাকাগুলির কথা!

অন্যমনস্কভাবে কুতুজভ চারদিকে তাকাল। চারদিক থেকে হাজার হাজার চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখের একটা কথার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

প্রিয়োব্রাঝেনস্ক রেজিমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চোখ বুজল। পারিষদবর্গের একজন ইঙ্গিতে সৈন্যদের বলল, পতাকাগুলো হাতে দিয়ে তারা প্রধান সেনাপতিকে ঘিরে দাঁড়াক। কুতুজভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও কর্তব্যের খাতিরে মাথাটা তুলে কথা বলতে শুরু করল। একদল অফিসার তাকে ঘিরে দাঁড়াল। বেশ মনোযোগ দিয়ে অফিসারদের সেই বৃত্তের দিকে সে তাকাল, তাদের কয়েকজনকে চিনতে পারল।

প্রথমে সৈনিকদের এবং পরে অফিসারদের সম্বোধন করে বলল, তোমাদের সকলকে ধন্যবাদ। কঠোর ও বিশ্বস্ত কাজের জন্য তোমাদের সকলকেই ধন্যবাদ জানাই। জয় সম্পূর্ণ হয়েছে, রাশিয়া তোমাদের ভুলবে না! চিরদিন তোমরা সম্মানিত থাকবে!

কথা থামিয়ে সে আবার চারদিকে তাকাল।

একটি সৈনিক প্রিয়োব্রাঝেনস্ক পতাকার পাশে ফরাসি ঈগল-মার্কা একটা পতাকা ধরে ছিল। হঠাৎই তার হাতের ফরাসি ঈগলটাকে নিচু করে ফেলতেই কুতুজভ তাকে বলল, ওর মাথাটা নিচু কর, নিচু কর! নিচু, আরো নিচু, ঠিক আছে। হুররা বাছারা!

হুর-র-রা! হাজার কণ্ঠে উঠল গর্জন।

সৈন্যরা চিৎকার করতে লাগল। কুতুজভ ঘোড়ার পিঠে সামনে ঝুঁকে মাথাটা নিচু করল, তার চোখে একটা মৃদু, ব্যঙ্গের হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল।

চিৎকার থেমে গেলে আবার বলল, দেখ ভাইসব…সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ভাব ও গলার স্বর বদলে গেল। এ যেন প্রধান সেনাপতি কথা বলছে না, কথা বলছে একটি সাধারণ বুড়ো মানুষ যে তার সহকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা শোনাতে চায়।

অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা দিল, তার কথা ভালোভাবে শুনবার জন্য সকলেই এগিয়ে গেল।

দেখ ভাইসব, আমি জানি এটা সহ্য করা তোমাদের পক্ষে শক্ত, কিন্তু কোন উপায় নেই! সহ্য কর, আর বেশি দিন নয়। অতিথিদের বিদায় করতে পারলেই আমরা বিশ্রাম নেব। তোমাদের সেবার কথা জার ভুলবেন না। তোমরা কষ্ট পাচ্ছ। তবু তো তোমরা দেশেই রয়েছ, আর ওরা-দেখতেই তো পাচ্ছ ওদের কি হাল হয়েছে, বন্দিদের দেখিয়ে সে বলল। আমাদের চাইতেও ভিক্ষুকের চাইতেও ওদের অবস্থা শোচনীয়। ওরা যখন শক্তিশালী ছিল, তখন আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন আমরা ওদের প্রতি করুণা দেখাতে পারি। ওরাও তো মানুষ। তাই নয় কি বাছারা?

চারদিকে তাকাল, তার উপর নিবদ্ধ সশ্রদ্ধ বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টির মধ্যে সে সমবেত সকলের সহানুভূতিরই আভাস পেল। তার মুখ ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল, সেখানে ফুটে উঠল একটি বৃদ্ধ মানুষের মৃদু হাসি, তার ঠোঁটের কোণ দুটি সংকুচিত হল, চোখের উপর ভাজ পড়ল। কথা থামিয়ে বুঝি বা বিচলিত হয়েই সে মাথাটা নোয়াল।

হঠাৎ মাথা তুলে সে চিৎকার করে বলল, কিন্তু কে ওদের এখানে আসতে বলেছিল? ঠিক শাস্তি হয়েছে, য-যত…

চাবুক ঘুরিয়ে সে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল। সৈন্যরা আনন্দের সঙ্গে হুররা! বলে চেঁচিয়ে উঠল।

কুতুজভের কথাগুলি সৈনিকরা মোটেই বুঝতে পারেনি। ফিল্ড-মার্শালের কথাগুলি কেউ পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না! তার ভাষণটি শুরু হয়েছিল গম্ভীরভাবে। কিন্তু তারপরই হয়ে উঠল একটি বুড়ো মানুষের সরল মনের কথা, কিন্তু সেই ভাষণের হৃদ্য আন্তরিকতা, জয়-গৌরবের সঙ্গে শত্রুর প্রতি করুণার মিশ্র অনুভূতি, এবং আমাদের আদর্শের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে সচেতনতা–এ সবকিছু সৈনিকরা শুধু যে বুঝেছিল তাই নয়, প্রতিটি সৈনিকের অন্তরকে তা স্পর্শ করেছিল, তাদের দীর্ঘ সানন্দ উল্লাস-ধ্বনিতেই তা প্রকাশ পেল। পরে জনৈক জেনারেল যখন কুতুজভের কাছে জানতে চাইল যে তার কালিচে-গাড়িটা আনতে পাঠানো হবে কিনা তখন সে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কুতুজভ অপ্রত্যাশিতভাবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, গভীর আবেগে তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল।

.

অধ্যায়-৭

ক্রাসনু যুদ্ধের সর্বশেষ দিন ৮ নভেম্বর সৈন্যরা যখন রাতের বিশ্রামঘাঁটিতে হাজির হল তখন গোধূলির অন্ধকার নেমে আসছে। সারাদিন আবহাওয়া শান্ত ছিল, মাঝে মাঝে সামান্য বরফও পড়েছে, কিন্তু সন্ধ্যার দিকে আবহাওয়া পরিষ্কার হতে লাগল। পড়ন্ত বরফের ভিতর দিয়ে লাল-কালো তারকাখচিত আকাশ দেখা দিল, তুষারপাত তীক্ষ্ণতর হল।

যে পদাতিক রেজিমেন্টটি তারুতিনো ছেড়েছিল তিন হাজার সৈন্য নিয়ে, এখন তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র নয়শো। সেই রেজিমেন্টটাই বড় রাস্তার ধারে একটি গ্রামের রাতের ঘাঁটিতে এসে প্রথম পৌঁছল। কোয়ার্টার-মাস্টাররা জানাল, রুগ্ন ও মৃত ফরাসি, অশ্বারোহী সৈন্য ও কর্মচারীতে সব কুটিরই ভর্তি হয়ে গেছে। শুধু রেজিমেন্ট-কম্যান্ডারের জন্য একটা ঘর পাওয়া যেতে পারে।

কম্যান্ডার ঘোড়া নিয়ে সেই ঘরটাতে গেল। বাকি রেজিমেন্ট গ্রামের ভিতর দিয়ে এগিয়ে শেষ কুটিরটার সামনে তাদের অস্ত্রশস্ত্র স্তূপ করে রাখল। বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমন্বিত একটা প্রকাণ্ড জন্তুর মতো রেজিমেন্ট তাদের বিছানা ও খাবার তৈরির কাজে লেগে গেল। একদল এক-হাঁটু বরফ ভেঙে গ্রামের দক্ষিণ দিকের বার্চের বনে ঢুকে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে ভেসে আসতে লাগল কুড় ল ও তলোয়ারের শব্দ, ডাল ভাঙার শব্দ, নানারকম খুশির হল্লা। আর একদল হাঁড়ি-কড়াই ও যইয়ের বিস্কুট বের করল এবং ঘোড়াগুলোকে খাবার দিল। তৃতীয় দলটা, গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা করার কাজে লেগে গেল, ফরাসিদের মৃতদেহগুলি বয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিল, ঘরের বোর্ড, শুকনো কাঠ ও চালের খড় টেনে নিয়ে আগুন জ্বালাল, আর বাঁশের বেড়া দিয়ে নিজেদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে লাগল।

জন পনেরো লোক একটা চালাঘরের ছাদটা খুলে ফেলার পরে হৈ-হৈ করে তার উঁচু বাঁশের বেড়াটা ধরে টেনে নামাতে চেষ্টা করছিল।

সকলে সমস্বরে বলে উঠল, এবার, এক সাথে, সবাই মিলে, হেইয়ো জোয়ান, মারো টান! ধপাস করে দেয়ালটা পড়ে গেল, সেইসঙ্গে জোয়ানরাও ছিটকে পড়ল। শুরু হয়ে গেল উচ্চ হাসি ও হল্লা।

এবার এক সাথে হাত লাগাও। দুজন-দুজন করে। একটু সবুর কর বাছারা…একটা গান ধর!

সকলে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা মিষ্টি মোলায়েম গলায় গান শুরু হল। তৃতীয় কলিটা শেষ হতে শেষ সুরটা যখন মিলিয়ে গেল, অমনি বিশটা কণ্ঠস্বর একসঙ্গে গর্জন করে উঠল : উ-উ-উ-উ। এই তো চাই। এক সাথে। মারো টান, হেইয়ো জোয়ান। কিন্তু হাজার চেষ্টায়ও বেড়াটা নড়ল না। সকলেই চুপ। শুধু শোনা গেল বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ।

এই যে ষষ্ঠ কোম্পানির বাছারা! আচ্ছা বদমাশ তো তোমরা! একটু হাত লাগাও না বাবা…আবার একদিন আমাদেরও তো ডাকতে হতে পারে।

ষষ্ঠ কোম্পানির জন বিশেক সৈন্য গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। তারাও এসে হাত লাগাল। আর পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা ও সাত ফুট উঁচু বাঁশের বেড়াটা হেলেদুলে গ্রামের পথ দিয়ে চলতে চলতে শ্রান্ত লোকগুলোর কাঁধের উপর কেটে বসতে লাগল।

জোরসে ধরো…পড়ে যাচ্ছ নাকি? আরে, থামছ কেন? এই যে, ওদিকে… অর্থহীন খুশি-ভরা বকাবকি অবাধে চলতে লাগল।

হচ্ছে কি তোমাদের? সহসা জনৈক সার্জেন্ট-মেজরের কর্তৃত্বপূর্ণ গলা শোনা গেল। এখানে ভদ্রলোকরা রয়েছেন, স্বয়ং জেনারেল রয়েছেন কুটিরে, আর তোমরা যত সব মুখ-ফাজিল শয়তান আর জানোয়ারের দল! এটাই তোমাদের প্রাপ্য। চিৎকার করে কথাগুলি বলে প্রথম যাকে হাতের কাছে পেল তারই পিঠে লাগাল একটা মোক্ষম ঘুষি। চেঁচামেচিটা কম করতে পার না?

সকলে চুপ করল। বেড়ার উপর পড়ে গিয়ে আহত সৈনিকটির মুখে ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছে, সে আর্তনাদ করে মুখ মুছতে লাগল।

সার্জেন্ট-মেজর চলে যেতেই সভয়ে সে ফিসফিস করে বলে উঠল, দেখ না, শয়তানটা কী মার মেরেছে! মুখটাকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে।

কেমন লাগছে বল? কে যেন হাসতে হাসতে বলল। তারপর গলা নামিয়ে সকলে এগিয়ে চলল।

গ্রাম ছাড়িয়ে গিয়ে আবার তারা আগের মতোই জোর গলায় কথা বলতে লাগল, মাঝে মাঝেই তাতে চুটকি কথার ফোড়ন।

কুটিরের মধ্যে প্রধান অফিসাররা জড়ো হয়ে আজকের ঘটনাবলী ও আগামীকালের রণ-কৌশল নিয়ে আলোচনা করছে। প্রস্তাব করা হয়েছে, আগামীকাল বদিক ধরে এগিয়ে উপ-রাজাকে (মুরা) বিচ্ছিন্ন করে গ্রেপ্তার করা হবে।

সৈন্যরা যতক্ষণে বাঁশের বেড়াটাকে যথাস্থানে টেনে নিয়ে গেল ততক্ষণে চারদিকে শিবির-আগুনগুলো জ্বলে উঠে রান্নার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। কাঠ ফেটে শব্দ হচ্ছে, বরফ গলছে, সৈনিকদের কালো-কালো ছায়াগুলি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কুড়ল ও কাটারিগুলো চারদিকে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সবকিছুই করা হয়েছে বিনা হুকুমে। রাতের মতো কাঠ আনা হয়েছে, অফিসারদের মাথা গুজবার ঠাই করে দেওয়া হয়েছে, কড়াইতে খাবার সিদ্ধ হচ্ছে, বন্দুক ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

উত্তরের দিক থেকে আত্মরক্ষার জন্য বাঁশের বেড়াটাকে এনে সেইদিকে দাঁড় করানো হয়েছে। তার সামনেও একটা শিবির-আগুন জ্বালানো হয়েছে। সকলে ঢাক বাজাল, নাম ডাকা হল, রাতের খাবার খেল, রাতের মতো আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসল-কেউ মোজা মেরামত করতে লাগল, কেউ বা পাইপ ধরাল, আবার কেউ বা পোশাক খুলে আগুনের তাতে শার্টের উকুন তাড়াতে বসে গেল।

.

অধ্যায়-৮

একথা মনে হতে পারে যে রুশসৈন্যরা সেসময় যে অবিশ্বাস্য রকমের শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েছিল–গরম জুতো ছিল না, ভেড়ার চামড়ার কোট ছিল না, মাথার উপরে ছাদ ছিল না, পায়ের নিচে ছিল আঠারো ডিগ্রির বরফ (১৮ ডিগ্রি=শূন্য ফারেনহিটের আট ডিগ্রি নিচে), এমন কি পুরো রেশনও ছিল না (কমিসারিয়েট বিভাগ সবসময় সেনাদলের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারত না)-তাতে সে দৃশ্য খুবই করুণ ও কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু আসলে অত্যন্ত ভালো বাস্তব পরিবেশেও সেনাবাহিনী কখনো সেসময়কার চাইতে অধিক খুশি ও প্রাণচঞ্চল ছিল না। তার কারণ সৈন্যদের মধ্যে যারাই মন-মরা অথবা দুর্বল হয়ে পড়ল তাদেরই দিনের পর দিন সেনাদল থেকে ছাঁটাই করা হতে লাগল। দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে দুর্বল সৈন্যদের পিছনে ফেলে আসা হল, আর দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে যারা বাহিনীর প্রাণস্বরূপ তাদেরই শুধু রাখা হল।

অন্য সব জায়গার তুলনায় অষ্টম কোম্পানির বাঁশের বেড়াটার আড়ালেই সবচাইতে বেশি লোক জমায়েত হল। দুজন সার্জেন্ট-মেজরও তাদের দলে গিয়ে বসে পড়ল, তাদের শিবির-আগুনই সব চাইতে বেশি জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল। তাদের বেড়ার পাশে বসার অনুমতির জন্য চাঁদা হিসেবে তারা কাঠ দাবি করতে লাগল।

আরে মকিভ, তোমার হয়েছে কি কুকুরের বাচ্চা? তুমি কি শেষ হয়ে গেছ, না কি তোমাকে নেকড়েয় খেয়েছে। আরো কিছুটা কাঠ নিয়ে এস। লাল-চুল, লাল-মুখ একটি লোক চোখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বলল। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করলেও আগুনের কাছ থেকে না সরেই সে অপর একটি সৈনিককে বলল, আর তুমি ধোঁয়ায় চোখ জ্বল কিন্তু কাঠ নিয়ে এস। অনও নয়, কিন্তু গায়ে বেশ জোখ মানুষটি হুকুমমতো লোকগুলিতেই আগুনের খুব ভালো কাজ ফেলে দিয়ে আরো ঘন হতে লাগ

লাল-চুল লোকটি সার্জেন্টও নয়, কর্পোরালও নয়, কিন্তু গায়ে বেশ জোর আছে বলেই দুর্বলতর লোকগুলিকে দাপটের সঙ্গে হুকুম করছে। যাকে দাঁড়কাক বলা হল সেই শীর্ণ, ছোটখাট মানুষটি হুকুমমতো উঠে দাঁড়াতেই আগুনের আলোয় দেখা গেল একটি সুদর্শন তরুণ এক বোঝা কাঠ বয়ে এনেছে।

এখানে নিয়ে এস-খুব ভালো কাজ করেছ!

তারা কাঠ চিড়ল, সেগুলোকে আগুনে ফেলে দিয়ে ফুঁ দিতে লাগল, গ্রেটকোটের কোণ দিয়ে হাওয়া করতে লাগল, ফট ফট শব্দ করে হু-হুঁ করে জ্বলে উঠল। সকলে আরো ঘন হয়ে বসে পাইপ ধরাল। নবাগত সুদর্শন তরুণটি দুহাত বুকের উপর কোনাকুনি ভাজ করে দু-পা বরফের উপর ঠুকতে লাগল।

মাগো। শিশিরকণাগুলো ঠাণ্ডা কিন্তু পরিষ্কার। ভালোই হয়েছে যে আমি বন্দুকধারী… গান গাইতে গাইতে সে মাঝে মাঝেই হিক্কা তোলার ভান করে চলল।

তরুণটির বুটের তলা ঝুলে আছে দেখে লাল-চুল লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, দেখহে, তোমার জুতোর তলা যে উড়ে যাবে! এত নাচছই বা কেন?

নর্তক থামল, ঝুলে-পড়া চামড়াটা খুলে নিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল।

ঠিক বলেছেন বন্ধু, বলে তরুণটি বসে পড়ল। ঝোলার ভিতর থেকে একটুকরো নীল ফরাসি কাপড় বের করে পায়ের পাতাটা জড়িয়ে নিল। পা দুটো আগুনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, বাম্প ওগুলোর ক্ষতি করে।

শীঘ্রই আমাদের নতুন বুট দেওয়া হবে। ওঁরা বলছেন, এদের তুলোধোনা করাটা শেষ হলেই আমরা ডবল কিট পেয়ে যাব।

একজন সার্জেন্ট-মেজর বলল, মনে হচ্ছে কুকুরের বাচ্চা পেত্ৰভটা সকলের পিছনে পড়ে আছে।

অপরজন বলল, সারাক্ষণ আমি তার উপর নজর রেখেছি।

আচ্ছা, সৈনিক হিসেবে বেচারা বড়ই দুর্বল…।

কিন্তু সকলে বলছে, তৃতীয় কোম্পানির নয়জনকে কাল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 ঠিক, সবই ঠিক, কিন্তু কারো পা যদি জমে যায় তাহলে সে হাঁটবে কেমন করে?

একথা যে বলল তিরস্কারের ভঙ্গিতে তার দিকে ফিরে একটি বুড়ো সৈনিক বলল, তুমিও তাই করতে চাও না কি?

যে লোকটিকে দাঁড়কাক বলা হয়েছিল সে আগুনের ও-পাশে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দেখুন, আপনি তো জানেন, মোটা লোক সরু হয়ে যায়, কিন্তু সরু লোকের কপালে জোটে মৃত্যু। তারপর সার্জেন্ট মেজরের দিকে ঘুরে দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল, আমার কথাই ধরুন। ওদের বলুন, আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিক। আমার সারা শরীরে ব্যথা, আমি আর চলতে পারছি না।

সার্জেন্ট-মেজর শান্ত গলায় বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

সৈনিকটি আর কথা বলল না। গল্প-গুজব চলতে লাগল।

নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে একজন বলল, আজ ফরাসি বাবাজীদের অনেককে ধরা হয়েছে। তাদের কারো পায়েই সত্যিকারের বুট বলতে কিছু নেই। সব যেন সৈনিকের ভূত।

নর্তক তরুণটি বলল, কসাকরা তাদের বুটগুলি হাতিয়েছে। কর্নেলদের জন্য ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে তাদের বাইরে বের করে দিয়েছে। তাদের দেখলে সত্যি করুণা হয়। তাদের যখন ফেলে দিল তখনো একজনকে জীবন্ত বলে মনে হল, তোমরা কি বিশ্বাস করবে, ওদের ভাষায় সে যেন বিড়বিড় করে কি বলল।

প্রথম লোকটি বলতে লাগল, কিন্তু ওরা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মনে হয় বেশ বড় ঘরের মানুষ। আহা, আপনি কি মনে করেন? ওদের সেনাদলে সব শ্রেণীর মানুষই আছে।

নর্তক তরুণটি বিচলিত হাসি হেসে বলল, কিন্তু আমাদের কথা ওরা কিছুই বোঝে না। আমি শুধিয়েছিলাম, সে কার প্রজা, তাতে নিজের ভাষায়ই বিড় বিড় করে কি যেন বলল। দুর্ভাগ্য আর কি!

প্রথম লোকটি বলতে লাগল, কিন্তু বন্ধুগণ, আশ্চর্যের কথা কি জান, মোঝায়েস্কের চাষীরা বলছে তারা যখন মৃতদেহগুলিকে রণক্ষেত্রে কবর দিচ্ছিল তখনো যে সব মৃতদেহ প্রায় একমাসকাল সেখানে পড়েছিল সেগুলি তখনো ছিল কাগজের মতো সাদা, পরিষ্কার, বারুদের ধোয়ার মতো কোন গন্ধও তা থেকে পাওয়া যায়নি।

সেটা কি ঠাণ্ডার জন্য? একজন শুধাল।

তুমি খুব বুদ্ধিমান! ঠাণ্ডার জন্যই বটে! আরে, তখন তো বেশ গরম। যদি ঠাণ্ডার জন্যই হবে তাহলে তো আমাদের মৃতদেহগুলোও পচত না। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাদের মৃতদেহগুলি দেখে এস, সব পচে গেছে, পোক পড়েছে। তাদের টেনে নিয়ে যাবার সময় আমরা তো মুখে রুমাল বেঁধে মাথা ঘুরিয়ে নেই : কাজটা করা খুবই শক্ত। কিন্তু ওদের মৃতদেহগুলি কাগজের মতো সাদা, বারুদের ধোয়ায় যেটুকু গন্ধ থাকে তাও নেই।

সকলে চুপ।

সার্জেন্ট-মেজর বলল, তাহলে নিশ্চয় তাদের খাদ্যের ফল। তারা তো সকলেই ভদ্রলোকদের খাবার খেত।

কেউ তার কথার প্রতিবাদ করল না।

মোঝায়েঙ্কের যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটবর্তী চাষীরা বলছে, চারদিকের দশটা গাঁয়ের লোক ডেকে এনে বিশদিন ধরে গাড়ি বোঝাই করেও মৃতদেহগুলি সরিয়ে দেওয়া শেষ করা যায়নি, আর নেকড়ের কথা যদি বল…

জনৈক বুড়ো সৈনিক বলল, এটাই তো আসল যুদ্ধ। মনে করে রাখবার মতো একমাত্র যুদ্ধ। কিন্তু তারপর থেকে…লোকে শুধু যন্ত্রণাই ভোগ করছে।

আর তুমি কি জান বাবা, গত পরশু আমরা যেই তাদের দিকে ধেয়ে গেলাম, অমনি, বিশ্বাস কর, আমরা তাদের কাছে পৌঁছবার আগেই তারা বন্দুক ছুঁড়ে ফেলে নতজানু হয়ে বসে পড়ল। বলে উঠল, ক্ষমা কর! এটা তো মাত্র একটা ঘটনা। লোকে বলছে, প্লাতভ দু-দুবার স্বয়ং নেপোলিয়নকে ধরেছিল। কিন্তু তাকে ধরার সঠিক মন্ত্র তো তার জানা ছিল না। তাকে ধরছে, আবার ধরছে, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। সে হাতের মধ্যেই পাখি উড়ে যায়। তাকে মারবারও কোন পথ নেই।

তোমাকে দেখেই বুঝেছি তুমি একটি পাক্কা মিথ্যাবাদী!

 মিথ্যাবাদী, বটে! এটাই আসল সত্য।

সে যদি আমার হাতে পড়ত, তাহলে ধরামাত্রই একটা আস্পেন গাছের বর্শা দিয়ে তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলতাম। সে যে কত মানুষের সর্বনাশ করেছে!

বুড়ো সৈনিকটি হাই তুলে বলল, ওসব কথা এখন থামাও। সে আর এখানে আসছে না।

 আলোচনায় ভাটা পড়ল, সৈন্যরা ঘুমের আয়োজন করতে লাগল।

একজন সবিস্ময়ে আকাশের ছায়াপথের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তারাগুলোর দিকে তাকাও। কী রকম অদ্ভুত কিরণ দিচ্ছে। মনে হবে বুঝিবা নারীরা তাদের কাপড় বিছিয়ে দিয়েছে।

ওটা আসছে বছর ভালো ফসলের লক্ষণ।

 আরো কিছু কাঠ দরকার!

পিঠ গরম করি তো পেট ঠাণ্ডায় জমে যায়। আশ্চর্য ব্যাপার।

হা প্রভু!

ঠেলছ কেন? আগুনটা কি তোমার একার জন্য? দেখ, ও কেমন হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছে!

সব চুপ হয়ে গেল। যারা ঘুমিয়ে পড়েছে তাদের নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্যরা পাশ ফিরে শরীর গরম করতে করতে দু-একটা কথা বলছে। একশো পা দূরের একটা শিবির-আগুনের পাশ থেকে হাসির হররা ভেসে এল।

একজন বলে উঠল, পঞ্চম কোম্পানির গর্জনটা শোন! ওখানে অনেকে জমেছে!

একজন উঠে পঞ্চম কোম্পানিতে চলে গেল।

ফিরে এসে বলল, ওরা খুব ফুর্তি করছে। দুটি ফরাসি বাবাজী এসে হাজির হয়েছে। একজন একেবারে জমে গেছে, আর অপরজন রাজা-উজির মারছে। ব্যাটা গান গাইছে…

আরে, তাহলে আমিও গিয়ে দেখে আসি।

বেশ কয়েকজন পঞ্চম কোম্পানির কাছে চলে গেল।

.

অধ্যায়-৯

 পঞ্চম কোম্পানি বনের একেবারে প্রান্তে একটা গুপ্ত ডেরায় তখন বিশ্রাম করছে। বরফের মাঝখানে একটা বড় শিবির-আগুন উজ্জ্বল আভায় জ্বলছে, তার আলো, শুভ্র হিমানীকণায় ঢাকা গাছের ডালপালাগুলি আলোকিত হয়ে উঠেছে।

মাঝরাতে বনের ভিতর বরফের উপর তারা পায়ের শব্দ ও শুকনো ডালপালার মচমচ শব্দ শুনতে পেল।

একজন বলল, ভালুক আসছে হে।

সকলে কান খাড়া করল। আগুনের উজ্জ্বল আলোয় বন থেকে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে এল অদ্ভুত সাজে সজ্জিত দুটি মনুষ্যমূর্তি।

দুজন ফরাসি, তারা বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কর্কশ গলায় নিজেদের ভাষায় কি যেন বলতে বলতে তারা আগুনের কাছে এগিয়ে এল। আমাদের সৈন্যরা তাদের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। একজন অপরজনের চাইতে লম্বা, তার মাথায় অফিসারের টুপি, দেখে খুবই ক্লান্ত মনে হল। আগুনের কাছে এসে বসতে গিয়ে সে পড়ে গেল। অপরজন অনেক বেশি শক্ত-সমর্থ। মাথায় একটা শাল বাঁধা। সঙ্গীকে তুলে ধরে তার মুখটা দেখিয়ে কি যেন বলল। সৈন্যরা তাদের ঘিরে দাঁড়াল, রুগ্ন লোকটির জন্য একটা গ্রেটকোট পেতে দিল, আর দুজনের মতো পরিজ ও ভদকা এনে দিল।

ক্লান্ত লোকটি ফরাসি অফিসার রাম্বল, আর মাথায় শাল ঢাকা লোকটি তার আর্দালি মোরেল।

পরিজের পাত্রটা শেষ করে খানিকটা ভদকা পেটে ঢেলে মোরেলের মেজাজ হঠাৎ অস্বাভাবিক রকমের খুশি হয়ে উঠল, সৈন্যদের সঙ্গে অবিরাম বকবক করতে লাগল, অবশ্য সৈন্যরা তার কথা কিছুই বুঝতে পারল না। রাম্বল কিছু খেল না, কনুইয়ের উপর মাথাটা রেখে আগুনের পাশে চুপচাপ শুয়ে থেকে রক্তিম শূন্য দৃষ্টি মেলে রুশ সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে একটা টানা আর্তনাদ করে আবার চুপ করে থাকছে। তার কাঁধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোরেল সৈনিকদের বোঝাতে চেষ্টা করল যে সে একজন অফিসার, তাকে একটু গরমে রাখা দরকার। সেখানে উপস্থিত জনৈক রুশ অফিসার তার কর্নেলের কাছে লোক পাঠিয়ে জানতে চাইল, ফরাসি অফিসারটিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে একটু গরমে রাখা চলবে কি না। লোকটি এসে জানাল, কর্নেল লোকটিকে তার কাছেই পাঠিয়ে দিতে বলেছে, তখন রাম্বলকে যেতে বলা হল। সে উঠে হাঁটতে চেষ্টা করতেই তার পা টলতে লাগল। পাশের সৈনিকটি ধরে না ফেললে সে পড়েই যেত।

একটি সৈনিক চোখ টিপে রাম্বলকে ঠাট্টা করে বলল, একাজ আর কখনো করবেন না, কি বলেন?

আরে বোকা কোথাকার! কি বাজে বকছ, চাষা তো, একেবারে চাষা! চারদিকে থেকে সকলে তাকে বকতে লাগল, আহা, ভালো মানুষের দল, আমার দয়ালু, বড় দয়ালু বন্ধুরা! এরাই তো মানুষ! আমার সাহসী, দয়ালু বন্ধুরা! ছোট শিশুর মতো সে একজন সৈনিকের কাঁধে মাথাটা রাখল।

এদিকে মোরেল তখন সৈন্যপরিবৃত হয়ে আগুনের পাশে সবচাইতে ভালো জায়গাটাতে বসে পড়েছে।

মোরেল বেশ শক্ত-সমর্থ, ফোলা চোখ দুটো থেকে জল পড়ছে, তার পরনে একটা মেয়েদের জোব্বা, মাথায় টুপির উপরে মেয়েদের মতো করে একটা শাল জড়িয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে তার নেশা হয়েছে। পাশের সৈনিকটির গলাটা জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় একটা ফরাসি গান ধরেছে।

মোরেল যে সৈনিকটিকে জড়িয়ে ধরেছে সে একজন গায়ক ও রসিক লোক। সে বলে উঠল, এবার-এবার আমাদের শিখিয়ে দাও! আমি ঠিক তুলে নেব। বল-বল।

চোখ মিটমিট করে মোরেল ফরাসিতে গেয়ে উঠল, সাহসী রাজা চতুর্থ হেনরি দীর্ঘজীবি হোন! সে শয়তানের আছে চারটি…

সুরটা ঠিক মতো ধরে নিয়ে সৈনিকটি হাত নেড়ে নেড়ে গানটার পুনরাবৃত্তি করল।

 চারদিক থেকে হাসির হররা উঠল, সাবাস! হা, হা, হা!

 মোরেলও মুখ কুঁচকে হেসে উঠল।

বেশ, বেশ, চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও!

তিন গুণের অধিকারী ত্রিনাথ আমার,
পানে দক্ষ, যুদ্ধে দড়,
 সাহসেও বড় সড়…

বাঃ, বেশ তো চলছে। আচ্ছা, এবার তুমি গাও জালেতায়েভ।

জালেতায়েভ অনেক কষ্টে ঠোঁট চেটে চেটে কথাগুলি উচ্চারণ করল।

খাসা হয়েছে। ঠিক ফরাসি বাবাজীর মতোই! হো, হো, হো! তুমি আর কিছু খাবে কি?

 ওকে আরো খানিকটা পরিজ দাও। অনাহারের পরে পেটটা ভরাতে অনেক সময় লাগে।

আরো খানিকটা পরিজ দেওয়া হল। মোরেল হাসতে হাসতে তৃতীয় পাত্রে হাত দিল। তাকে দেখে অল্পবয়সী সৈনিকরা সকলেই খুশি। কিন্তু এই সব বাজে হৈ-চৈ মর্যাদাহানিকর বিবেচনা করে বুড়ো সৈনিকরা আগুনের অপর দিকটাতে চুপচাপ শুয়ে রইল। অবশ্য কেউ কেউ মাঝে মাঝে কনুইতে ভর দিয়ে মোরেলকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে কসুর করল না।

কোট দিয়ে শরীরটা ঢাকতে ঢাকতে একজন বলল, ওরাও তো মানুষ! তেতো সোমরাজ গাছও তো তার শিকড়েই জন্মায়।

হে প্রভু! হে প্রভু! আকাশে কত তারা! ভয়ংকর! তার মানে, প্রচণ্ড তুষারপাত…

সকলে চুপ করে গেল।

তাদের কেউ দেখছে না জানতে পেরে তারারাও যেন কালো আকাশের বুকে কেলি শুরু করে দিল : এই জ্বলছে, এই নিভছে, এই কাঁপছে, যেন পরস্পরের কানে কানে কোন রহস্যময় খুশির কথা বলছে।

.

অধ্যায়-১০

গাণিতিক হ্রাস-বৃদ্ধির একটা সমান হারে ফরাসি সৈন্যদের সংখ্যা হ্রাস পেতে লাগল। যে বেরিজিনা অতিক্রম সম্পর্কে এত কথা লেখা হয়েছে সেটা এই অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায় মোটেই নয়, ফরাসি বাহিনীর ধ্বংসের একটা মধ্যবর্তী পর্যায় মাত্র। বেরিজিনা সম্পর্কে যে এত কথা লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তার কারণ-ফরাসিদের দিক থেকে দেখতে গেলে, তাদের বাহিনী যেসব বিপদ-আপদ অনেকদিন ধরেই সয়ে আসছিল হঠাৎ ঐ নদীর উপরকার সেতুর মুখে সেটা একটি মুহূর্তে কেন্দ্রীভূত হয়ে এমন একটা শোচনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল যা প্রত্যেকের স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে আছে, আর রুশদের দিক থেকে দেখতে গেলে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে পিটার্সবুর্গে তখন একটা নতুন পরিকল্পনা (আবারও সেটা পফুয়েলেরই সৃষ্টি) রচনা করা হয়েছিল যাতে বেরিজিনা নদীতে একটা সমর-কৌশলের ফাঁদ পেতে নেপোলিয়নকে ধরা যায়। প্রত্যেকেই নিশ্চিত ছিল যে সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক ঘটবে, আর তাই তারা বারবার বলেছে যে বেরিজিনার মুখেই ফরাসি বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে। বস্তুত, সংখ্যাতত্ত্ব থেকে এটাই দেখা যায় যে বিনষ্ট কামান ও সৈন্যের বিচারে বেরিজিনার ফরাসিদের ক্ষয়-ক্ষতি ক্রাসনুর তুলনায় অনেক কমই হয়েছিল।

বেরিজিনা সেতু-মুখের একমাত্র গুরুত্ব হল, সেখানেই সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার প্রমাণ হয়ে গেল যে ফরাসিদের পশ্চাদপসরণের পথকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার সবগুলি পরিকল্পনাই ছিল ভ্রান্ত, আর কুতুজভ ও সাধারণ সৈনিকরা যে কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিল অর্থাৎ শত্রুপক্ষকে বাধা না দিয়ে কেবল অনুসরণ করে চলা–সেটাই ছিল একমাত্র সঠিক পথ। ফরাসিরা তখন দলে দলে পালাচ্ছিল ক্রমাগত গতিবেগ বাড়িয়ে, তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবার চেষ্টায়। তারা পালাচ্ছিল আহত জন্তুর মতো, তাই তাদের পথে বাধা দেওয়া ছিল অসম্ভব। সেতুটা যখন ভেঙে পড়ল তখন নিরস্ত্র সৈনিক, মস্কোর অধিবাসী, এবং নারী ও শিশু সকলেই নৌকোর দিকে ধেয়ে গেল, ছুটে গেল বরফ-ঢাকা জলের দিকে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করল না।

এই আবেগ খুবই যুক্তিপূর্ণ। পলাতক এবং পশ্চাদ্ধাবনকারী দুয়েরই অবস্থা তখন সমান খারাপ। যতক্ষণ তারা নিজেদের লোকের মধ্যে ছিল ততক্ষণ প্রত্যেক পক্ষই নিজের লোকদের কাছ থেকে সাহায্য পাবার আশায় ছিল। কিন্তু যারা আত্মসমর্পণ করল তারা অপর পক্ষের মতো একই শোচনীয় অবস্থায় পড়লেও জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সমান অংশীদার হতে পারে না। বিজয়ী পক্ষের শুভবুদ্ধি সত্ত্বেও অর্ধেক ফরাসি বন্দি যে শীতে ও ক্ষুধায় মারা গিয়েছিল একথা ফরাসিদের জানাবার কোন প্রয়োজন ছিল না, কারণ তারা জানত যে এর অন্যথা হতে পারে না। যেসব দয়ালু রুশ কম্যান্ডার ফরাসিদের প্রতি সদয় ছিল–এমন কি রুশ সেনাদলভুক্ত ফরাসিরাও-বন্দিদের জন্য কিছুই করতে পারেনি। যে পরিস্থিতিতে রুশ বাহিনী পড়েছিল সেই একই পরিস্থিতিতে ফরাসি বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল। আমাদের ক্ষুর্ধাত সৈনিকদের কাছ থেকে রুটি ও কাপড় ছিনিয়ে নিয়ে তা ফরাসিদের দেওয়া একান্তই অসম্ভব ছিল। ফরাসিরা ক্ষতির কারণ না হতে পারে, ঘৃণার বস্তু না হতে পারে, অপরাধীও না হতে পারে, কিন্তু তাদের কোন প্রয়োজন তো ছিল না। কিছু রুশ হয় তো তাও করেছিল, কিন্তু তারা বিরল ব্যতিক্রম।

ফরাসিদের পশ্চাতে নিশ্চিত ধ্বংস, কিন্তু সম্মুখে আশা। তাদের জাহাজগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সমবেত পলায়ন ছাড়া মুক্তির অন্য কোনো পথ ছিল না, আর ফরাসিদের সব শক্তি সেইপথেই কেন্দ্রীভূত হল।

তারা যত পালাতে লাগল ততই তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠল, বিশেষ করে বেরিজিনার পরে, কারণ পিটার্সবুর্গ পরিকল্পনার ফলে সেখানে রুশদের মনে নতুন আশা জেগেছিল। পিটার্সবুর্গ-বেরিজিনা পরিকল্পনা যদি বিফল হয় তো কুতুজভের জন্যই হবে, এই আশংকায় রুশ কম্যান্ডারদের অসন্তোষ, ঘৃণা ও পরিহাসের ভাষা ক্রমেই কঠোরতর হতে লাগল। পরিহাস ও ঘৃণাকে অবশ্য প্রকাশ করা হত সশ্রদ্ধ ভাষায়, কাজেই তার দোষটা যে কোথায় সে প্রশ্নও কুতুজভের পক্ষে ভোলা সম্ভব ছিল না। সামনাসামনি সকলেই সৌজন্যের মুখোশ পরে থাকত, কিন্তু পিছন থেকে তাকে দেখে চোখ টিপত, আর পদে পদে তাকে ভুল পথে নিতে চেষ্টা করত।

তাকে বুঝতে পারত না বলেই এই লোকগুলো ধরেই নিয়েছিল যে বুড়োটার সঙ্গে কথা বলা বৃথা, তাদের পরিকল্পনার গভীরতা সে কখনো পরিমাপ করতে পারবে না, সবসময় সেই একই পুরনো কথা বলবে-বলবে সোনালি সেতুর কথা, বলবে যে এইসব ছিন্নবাস বিপর্যস্ত সৈন্যদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা অসম্ভব, ইত্যাদি। এসব কথা তারা অনেক শুনেছে। তাছাড়া, তার সব কথাই এত সহজ ও সরল, আর তাদের প্রস্তাবগুলি এতই জটিল ও কুশলী যে এটা একান্ত স্পষ্ট যে সে লোকটি বুড়ো ও নির্বোধ, আর তারা ক্ষমতাসীন হলেও প্রতিভাবান।

খ্যাতিমান নৌ-সেনাধ্যক্ষ ও পিটার্সবুর্গের মহানায়ক উইগেনস্তিন যখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিল তখনই জেনারেলদের এই মনোভাব ও কথাবার্তা একেবারে তুঙ্গে উঠল। কুতুজভ সবই জানল, বুঝল, কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধে ঝাঁকুনি দিল। শুধু একবার, বেরিজিনার ব্যাপারে পরে, সে রাগে ফেটে পড়ল এবং বেনিংসেনকে (সে আলাদাভাবে ম্রাটের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল) নিম্নবর্ণিত চিঠি লিখল : আপনার নষ্ট স্বাস্থ্যের কারণে ইয়োর এক্সেলেন্সি যেন এই চিঠি পেয়েই দয়া করে কালুগা যাত্রা করেন এবং ইম্পিরিয়াল ম্যাজেস্ট্রির কাছ থেকে আরো নির্দেশ ও কর্ম-নিযুক্তির জন্য সেখানেই অপেক্ষা করে থাকেন।

কিন্তু বেনিংসেনের যাত্রার পরে গ্র্যান্ড ডিউক জারেভিচ কনস্তান্তিন পাভলভিচ সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিল। এই অভিযানের গোড়ায় সে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু পরে কুতুজভ তাকে সরিয়ে দিয়েছিল। এবার সেনাদলে এসেই কুতুজভকে জানিয়ে দিল, আমাদের বাহিনীর যৎসামান্য সাফল্য ও অগ্রগতির মন্থরতার দরুন সম্রাট তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্রাট নিজে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবে।

কি রাজদরবারে কি সমরক্ষেত্রে সমান অভিজ্ঞ এই বৃদ্ধ মানুষটি-সেই কুতুজভ যে গত অগস্ট মাসে সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিল এবং গ্র্যান্ড ডিউক ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে সরিয়ে দিয়েছিল-যে নিজের ক্ষমতায় এবং সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মস্কো পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, এবার সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল যে তার দিন শেষ হয়ে এসেছে, তার যা করার তা করা হয়েছে। আর যে ক্ষমতায় সে এখন অধিষ্ঠিত আছে বলে মনে করে সেটা আর তার নেই। আর শুধু যে রাজদরবারের মনোভাব থেকেই সে এটা বুঝতে পারল তাও নয়। সে বুঝল, যে সামরিক কর্মক্ষেত্রে তার ভূমিকা সে পালন করেছে সেখানকার কাজ শেষ, হয়েছে, আর তার উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হয়েছে। আর সেইসঙ্গে বার্ধক্যজীর্ণ শরীরের ক্লান্তি এবং দৈহিক বিশ্রামের প্রয়োজন সম্পর্কেও সে সচেতন হয়ে উঠল।

২৯শে নভেম্বর কুতুজভ ভিলনা প্রবেশ করল–যাকে সে বলত আদরের ভিলনা। দুবার সে ভিলনার শাসনকর্তা হয়েছে। সমৃদ্ধ শহরটার কোনো ক্ষতি হয়নি, সেখানে সে পেল পুরনো বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত জনের সান্নিধ্য, পেল জীবনের সেই আরাম যা থেকে দীর্ঘকাল সে বঞ্চিত ছিল। আর হঠাৎই সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে গিয়ে সেই শান্ত জীবনের মধ্যে সে ডুব দিল যাতে সে চিরদিন অভ্যস্ত, মনে হল, ইতিহাসের ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটছে এবং এখনো করণীয় আছে, তাকে নিয়ে তার কোনোরকম চিন্তা-ভাবনাই নেই।

যে দুর্গ-প্রাসাদে কুতুজভ এসে উঠেছে সেখানে সর্বপ্রথম তার সঙ্গে এসে দেখা করল চিচাগভ। নৌ বিভাগের সাধারণ ইউনিফর্মের সঙ্গে একটা ছোরা ঝুলিয়ে এবং টুপিটাকে বগলদাবা করে সে দুর্গের বিবরণ ও শহরের চাবিগুলো কুতুজভের হাতে তুলে দিল। কুতুজভের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তার খবর চিচাগভ জানত। তাই তার ব্যবহারে একটি বাহাত্তরে বুড়োর প্রতি এক অল্পবয়সীর তাচ্ছিল্যপূর্ণ অথচ শ্রদ্ধাশীল ব্যবহারই অতিমাত্রায় প্রকাশ পেল।

কথাপ্রসঙ্গে কুতুজভ বলল, চীনামাটির বাসনপত্রে বোঝাই যে গাড়িগুলি বরিসভে তার কাছ থেকে আটক করা হয়েছিল সেগুলি উদ্ধার করা হয়েছে এবং তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তাতে চিচাগভ জবাব দিল, আপনি কি বলতে চান যে আমার খাবার থালাটাও নেই…বরং আপনি যদি কোনো ডিনার-পার্টি দিতে চান তো আমি প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে পারি।

কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে কুতুজভ তার সূক্ষ্ম, অন্তর্ভেদী হাসির সঙ্গে বলল, আমি যা বলেছি শুধু সেইটুকুই বলতে চেয়েছিলাম।

সম্রাটের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুতুজভ সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশকে ভিলনাতেই আটকে রাখল। আশপাশের লোকরা বলেছে, সেই শহরে অবস্থানকালে সে অস্বাভাবিক রকমের শ্লথগতি এবং শারীরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সামরিক ব্যাপারে সে উপস্থিত হত অনিচ্ছাসত্ত্বে, সবকিছু জেনারেলদের উপর ছেড়ে দিল, এবং সম্রাটের আগমনের অপেক্ষায় অযথা আমোদ-প্রমোদে কাল কাটাতে লাগল।

৭ই ডিসেম্বর পিটার্সবুর্গ ছেড়ে সম্রাট তার দলবল-কাউন্ট তলস্তয়, প্রিন্স বলকনস্কি, আরাকচিভ ও অন্যান্যদের নিয়ে ১১ তারিখে ভিলনা পৌঁছে স্লেজ নিয়ে সোজা গিয়ে উঠল দুর্গ-প্রাসাদে। প্রচণ্ড তুষারপাত সত্ত্বেও শত শত জেনারেল ও রাজকীয় কর্মচারী পূর্ণ প্যারেড-ইউনিফর্মে সজ্জিত হয়ে দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর সেমেনভ রেজিমেন্টের একটা গার্ড-অব-অনারের ব্যবস্থা করা হল।

একজন বার্তাবাহক ঘর্মাক্ত কলেবরে তিন-ঘোড়ায় টানা এয়কা গাড়িতে চেপে সকলের আগে দুর্গদ্বারে পৌঁছে চিৎকার করে ঘোষণা করল, আসছেন! আর কনভনিৎসিন ছুটে গিয়ে কুতুজভকে খবরটা দিল, সে তখন দ্বাররক্ষকের ঘোট বাসায় অপেক্ষা করছিল।

এক মিনিট পরেই সেই বুড়ো মানুষটির মস্তবড় দশাসই মূর্তিটা হেলেদুলে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। পরনে পূর্ণ ইউনিফর্ম, বুকের উপর সম্মান-স্মারকগুলি ঝোলানো, পেটের উপর একটি চাদর জড়ানো। টুপিটাকে কাৎ করে মাথায় পরে নিল, দস্তানা দুটো হাতে নিল, তারপর বেশ কষ্ট করে একপাশ হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তার সমতলে পৌঁছে সম্রাটের জন্য তৈরি প্রতিবেদনটি হাতে নিল।

চারদিকে ফিসফিস ও ছুটাছুটি শুরু হল। আর একটা এয়কা গাড়ি তীর বেগে ছুটে এল, সকলের দৃষ্টি ঘুরে গেল অগ্রসরমান স্লেজটার দিকে। তাতে সম্রাট ও বলকনস্কির মূর্তি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

পঞ্চাশ বছরের অভ্যাসবশত এ সবকিছুই বৃদ্ধ জেনারেলকে উত্তেজিত করে তুলল। অতি সযত্নে সাজ পোশাকটা ঠিক করে নিল, টুপিটা ঠিক মতো বসাল, মনে সাহস আনল, আর ঠিক যেমুহূর্তে মেজ থেকে নেমে সম্রাট তার দিকে চোখ তুলে তাকাল অমনি প্রতিবেদনটা তার হাতে দিয়ে কোমল কৃতজ্ঞ গলায় কথা বলতে শুরু করল।

সম্রাট দ্রুত সঞ্চালিত দৃষ্টিতে কুতুজভের মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখল, মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি দ্রুকুটিকুটিল হয়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে ভাব দমন করে বুড়ো মানুষটির দিকে এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করল। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত সেই আলিঙ্গনের ফলেও কুতুজভের বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

সম্রাট অফিসার ও সেমেনভ রেজিমেন্টকে অভিনন্দন জানাল, তারপর পুনরায় বুড়ো মানুষটির হাতটা চেপে ধরে তার সঙ্গেই দুর্গে প্রবেশ করল।

ফিল্ড-মার্শালকে একাকি পেয়ে সম্রাট শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনে শ্লথ গতি এবং ক্রাসনু ও বেরিজিনাতে ভুলের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করল, এবং বিদেশে আর একটি অভিযানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। কুতুজভ কোনো উত্তর দিল না, কিছু মন্তব্যও করল না। সাত বছর আগে অস্তারলিজ রণক্ষেত্রে যে বিনীত, ভাবলেশহীন দৃষ্টি নিয়ে সম্রাটের নির্দেশ শুনেছিল, আজও সেই একই দৃষ্টি ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।

পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে ভারী শরীরটা দুলিয়ে কুতুজভ যখন নতশিরে নাচঘরটা পার হয়ে যাচ্ছিল, তখন কার যেন কণ্ঠস্বরে তার গতিরোধ হল, প্রশান্ত মহামহিম!

কুতুজভ মাথা তুলল। অনেকক্ষণ কাউন্ট তলস্তয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা রুপোর পাত্র হাতে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। পাত্রের উপর একটা ছোট কি যেন রয়েছে। কুতুজভ কিছুই বুঝতে পারল না।

সহসা তার মনে পড়ে গেল, তার গোল মুখে একটা প্রায় অলক্ষ্য হাসি খেলে গেল, মাথা নীচু করে শ্রদ্ধাভরে সে পাত্র থেকে জিনিসটি তুলে নিল। জিনিসটি প্রথম শ্রেণীর অর্ডার অব সেন্ট জর্জ।

.

 অধ্যায়-১১

পরদিন ফিল্ড-মার্শাল একটি নৈশভোজ ও বলনাচের আয়োজন করল। সম্রাট উপস্থিত থেকে তাকে কৃতার্থ করল। কুতুজভ প্রথম শ্রেণীর অর্ডার অব সেন্ট জর্জ লাভ করল, সম্রাট তাকে সুউচ্চ সম্মান দেখাল, কিন্তু সম্রাটের অসন্তোষের কথাও প্রত্যেকেই জানল। যথাবিহিত সৌজন্য দেখানো হল, সে ব্যাপারে সম্রাটই প্রথম। দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, কিন্তু সকলেই জানল যে বুড়ো মানুষটিই দোষী, সে কোনো কাজের নয়। ক্যাথারিনের সময়কার একটা রীতি অনুযায়ী কুতুজভ যখন হুকুম দিল, যেসব পতাকা দখল করা হয়েছে সম্রাট নাচঘরে ঢুকলেই সেগুলি তার পায়ের কাছে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়, তখন সম্রাটের মুখটা ঈষৎ বিকৃত হয়ে গেল, বিড়বিড় করে সম্রাট যা বলল তার মধ্যে কেউ কেউ শুনতে পেল, পুরোনো বিদূষক কথা দুটি।

কুতুজভের প্রতি সম্রাটের অসন্তোষ বিশেষভাবে বেড়ে গেল ভিলনাতে, কারণ আসন্ন অভিযানের গুরুত্বটা সে বুঝতে পারল না, বুঝিবা বুঝতে চাইলও না।

পরদিন সকালে সম্রাট যখন সমবেত রাজকর্মচারীদের বলল : আপনারা শুধু রাশিয়াকে রক্ষা করেননি, রক্ষা করেছেন সারা ইওরোপকে, তখনই সকলে বুঝল যে যুদ্ধ শেষ হয়নি।

শুধু কুতুজভই সেটা বুঝতে পারল না, সে প্রকাশ্যেই এই বলে নিজের মতো ব্যক্ত করল যে নতুন কোনো যুদ্ধ অবস্থার উন্নতি করতে পারবে না, রাশিয়ার গৌরবকেও বৃদ্ধি করতে পারবে না, শুধু যে গৌরব রাশিয়া অর্জন করেছে তাকে নষ্ট করবে। নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করা অসম্ভব, জনসাধারণ যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করেছে, পরাজয়ের সম্ভাবনাও তো রয়েছে-এইসব কথাই সে সম্রাটকে বোঝাতে চেষ্টা করল।

এই যখন ফিল্ড-মার্শালের মনোভাব তখন স্বভাবতই তাকে আসন্ন যুদ্ধের পথে একটা বিঘ্ন বলেই মনে করা হতে লাগল।

এই বুড়ো মানুষটির সঙ্গে অপ্রীতিকর সংঘর্ষ এড়াতে অস্তারলিজে তাকে নিয়ে যা করা হয়েছিল এবং রুশ অভিযানের একেবারে শুরুতে বার্কলেকে নিয়ে যা করা হয়েছিল সেই স্বাভাবিক পথটাই বেছে নেওয়া হল–ক্ষমতা সরিয়ে দেওয়া হল স্বয়ং সম্রাটের হাতে, আর এইভাবেই বুড়ো লোকটিকে কিছু না জানিয়ে প্রধান সেনাপতির পায়ের নীচ থেকে মাটি কেটে সরিয়ে দেওয়া হল।

এই উদ্দেশ্য নিয়েই ধীরে ধীরে তার দলবলকে নতুন করে গড়া হল, আর আসল ক্ষমতা চলে গেল ম্রাটের হাতে। তোল, কনভনিৎসিন ও এর্মলভ নতুন নতুন পদ পেল। সকলেই ফিল্ড-মার্শালের চরম দুর্বলতা ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কথা জোর গলায় বলে বেড়াতে লাগল।

তাকে মর্যাদার আসন থেকে সরিয়ে সে আসন অন্যকে দিতে হলে তার স্বাস্থ্য তো খারাপ হতেই হবে। আর আসলেও তার স্বাস্থ্য তো খারাপই ছিল।

সুতরাং তার ভূমিকা যখন শেষ হয়ে গেল তখন স্বাভাবিক ও সরল পথেই নতুন ও প্রয়োজনীয় অভিনেতার দ্বারা একে একে তার স্থান পূরণ করা হতে লাগল।

১৮১২ সালের যুদ্ধের যে জাতীয় তাৎপর্য প্রতিটি রুশের অন্তরের নিধি, তাছাড়াও সে যুদ্ধকে এবার লাভ করতে হবে একটা ইওরোপীয় তাৎপর্য।

জনসাধারণের পশ্চিম থেকে পুবে অভিযানের পরেই শুরু করতে হবে তাদের পুব থেকে পশ্চিমে অভিযান, আর সেই নতুন যুদ্ধের জন্য চাই এমন একজন নেতা যার গুণ-গরিমা, মনোভাব কুতুজভ থেকে ভিন্ন, যে পরিচালিত হবে ভিন্ন অভিপ্রায়ের দ্বারা।

রাশিয়ার মুক্তি ও গৌরবের জন্য যেমন প্রয়োজন হয়েছিল কুতুজভকে, তেমনই জনগণকে পুব থেকে পশ্চিমে পরিচালিত করতে, জাতীয় সীমান্তকে নতুন করে নির্ধারণ করতে প্রয়োজন হল প্রথম আলেক্সান্দারকে। ইওরোপ, শক্তি-কাম্য, বা নেপোলিয়ন বলতে কি বোঝায় কুতুজভ তা বুঝতে পারল না। সত্যি সে বুঝতে পারেনি। শত্রুকে ধ্বংস করে রাশিয়াকে মুক্ত করে গৌরবের শিখরে প্রতিষ্ঠিত করার পরে, একজন রুশ হিসেবে রুশ জনগণের প্রতিনিধির আর কিছু করার ছিল না। জাতীয় যুদ্ধের প্রতিনিধির সম্মুখে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই রইল না। কুতুজভের মৃত্যু হল।

.

অধ্যায়-১

সাধারণত যা ঘটে থাকে, বন্দি থাকা অবস্থায় যেসব দৈহিক দুঃখকষ্ট ও মানসিক চাপ পিয়েরকে সহ্য করতে হয়েছিল তার ফল ফলতে লাগল সে অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পরে। মুক্তি পেয়ে সে প্রথম গেল ওরিল, সেখানে তিন দিন কাটিয়ে কিয়েভ যাত্রার মুখে অসুস্থ হয়ে তিন মাস শয্যাশায়ী হয়ে কাটাল। ডাক্তাররা বলল তার পিত্ত জ্বর হয়েছে। চিকিৎসা চলল, রক্তমোক্ষণ করা হল, খাবার ওষুধ দেওয়া হল-সে ভালো হয়ে উঠল।

উদ্ধারলাভের সময় থেকে অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত সময়ে যা কিছু ঘটেছিল তার প্রায় কোনো কথাই পিয়েরের মনে নেই। শুধু মনে পড়ে একঘেয়ে ধূসর আবহাওয়া, কখনো বৃষ্টি পড়ছে, কখনো বরফ, শরীরের ভিতরে যন্ত্রণা, পায়ে ও এক পাশে ব্যথা। সাধারণভাবে আরো মনে পড়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভাগ্যের কথা, অফিসার ও জেনারেলদের কৌতূহল ও জেরার যন্ত্রণা, যানবাহন ও ঘোড়া সংগ্রহ করার অসুবিধা, এবং নিজের দিক থেকে সর্বক্ষণ চিন্তা ও অনুভূতির অক্ষমতা। মুক্তির দিনটিতেই সে দেখেছিল পেতয়া রশুভের মৃতদেহ। সেই একই দিনে জানতে পেরেছিল, বরদিনো যুদ্ধের পরে এক মাসেরও বেশি সময় বেঁচে থাকার পরে প্রিন্স আন্দ্রু সম্প্রতি মারা গেছে রস্তভদের ইয়ারোস্লাভলের বাড়িতে, সেই সঙ্গে দেনিসভ আরো জানিয়েছিল যে হেলেনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও সে ধরেই নিয়েছিল যে এ খবরটা পিয়ের অনেক আগেই জেনেছে। সেসময় পিয়েরের কাছে সবকিছুই আশ্চর্য লেগেছিল : মনে হয়েছিল এসব কথার কোনো তাৎপর্যই সে ধরতে পারছে না। তখন তার একমাত্র লক্ষ্য যেসব জায়গায় মানুষ মানুষকে খুন করছে সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে এমন কোনো শান্তিপূর্ণ আশ্রয়ে চলে যাওয়া যেখানে গেলে সে সেরে উঠবে, বিশ্রাম নিতে পারবে, এবং যেসব বিচিত্র নতুন ঘটনার কথা শুনেছে তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে পারবে। কিন্তু ওরিলে পৌঁছেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। রোগ থেকে সেরে উঠে দেখল, তার দেখাশুনা করার জন্য মস্কো থেকে এসেছে তার দু চাকার তেরেন্তি ও ভাস্কা, আর এসেছে তার জ্ঞাতি-বোন বড় প্রিন্সেস যে নিজের এলেৎসের জমিদারিতে থাকে এবং তার উদ্ধার ও অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তাকে দেখতে এসেছে।

একটু একটু করে রোগ থেকে সেরে উঠলেও অনেকদিন পর্যন্ত সে স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেত, সে যেন এখন সেই বন্দি জীবনই কাটাচ্ছে। সেই অবস্থায়ই একটু একটু করে সে জেনেছে প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যু, তার স্ত্রীর মৃত্যু এবং ফরাসিদের ধ্বংসের খবর।

রোগ থেকে সেরে উঠতে উঠতে মুক্তির একটা সানন্দ অনুভূতি পিয়েরের অন্তরকে ভরে তুলল। অবাক হয়ে দেখল, অন্তরের এই মুক্তির অনুভূতি যেন একটা বাহ্যিক মুক্তির পরিবেশও রচনা করেছে। এখানে এই অপরিচিত শহরে সে একেবারে একা-কোনো পরিচিত মানুষ নেই। কেউ তার কাছে কিছু চাইল না, তাকে কোথাও পাঠাল না। যা কিছু চেয়েছিল সবই সে পেয়েছে : যে স্ত্রীর চিন্তা ছিল তার নিরন্তর যন্ত্রণার কারণ সেও আর এখানে নেই, কারণ সে তো ইহলোকেই নেই।

আঃ, কী সুন্দর! কী চমৎকার! সুস্বাদু গোমাংস-চা সাজানো পরিষ্কার টেবিলটা যখন তার দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়, রাত হলে যখন সে একটা পরিষ্কার নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, অথবা যখন তার মনে পড়ে যে ফরাসিরা চলে গেছে আর তার স্ত্রী ইহজগতে নেই, তখনই সে নিজের মনে বলে ওঠে, আঃ, কী সুন্দর! কী চমৎকার!

 তারপর পুরনো অভ্যাসবশত নিজেকেই প্রশ্ন করে : আচ্ছা, তারপর কি? এখন আমি কি করব? সঙ্গে সঙ্গে নিজেই জবাব দেয়, ঠিক আছে, আমি বাঁচব। আঃ, কী চমৎকার!

যে প্রশ্নটি আগে তাকে যন্ত্রণা দিত, জীবনের যে লক্ষ্যকে সে অবিরাম খুঁজে বেড়াত, এখন আর সে প্রশ্ন তার সামনে নেই। জীবনের লক্ষ্যকে অনুসন্ধান করে ফেরা যে সাময়িকভাবে দূর হয়েছে তাই নয়, তার জীবনে।  তার কোনো অস্তিত্বই আর নেই, কোনোদিন থাকবে না। আর জীবনের এই লক্ষ্যহীনতাই তাকে এনে দিয়েছে। পরিপূর্ণ মুক্তির আনন্দ, সুখের অনুভূতি।

সামনে কোনো লক্ষ্য নেই, কারণ এখন পেয়েছে বিশ্বাসকোনো বিধান বা বাণী, বা ধারণায় বিশ্বাস নয়, সে বিশ্বাস চিরজাগ্রত, চিরপ্রকাশ ঈশ্বরের প্রতি। আগে নিজের গড়া লক্ষ্যের মধ্যেও সে ঈশ্বরকেই খুঁজেছে। সেই লক্ষ্যের সন্ধান আসলে ঈশ্বরেরই সন্ধান, বন্দি অবস্থায় সহসা সে জেনেছে, কোনো বাণী বা যুক্তি দিয়ে নয়, জেনেছে প্রত্যক্ষ অনুভূতি দিয়ে, সেই সত্য যা অনেককাল আগে তার ধাত্রী তাকে শুনিয়েছিল : ঈশ্বর এখানে এবং সর্বত্র বিরাজিত। বন্দি অবস্থায় সে জেনেছে, ভ্রাতৃসংঘ কর্তৃত্ব স্বীকৃত বিশ্বস্রষ্টার ধারণার চাইতে কারায়েভের ঈশ্বর অনেক বড়, অনন্ত ও অপরিমেয়। তার মনের অবস্থা এখন সেই মানুষের মতো যে বহুদূরে দৃষ্টি মেলে কাউকে খুঁজতে গিয়ে নিজের পায়ের কাছেই তাকে দেখতে পায়। সারা জীবন চারদিকে মানুষদের মাথার উপর দিয়েই সে তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে, অথচ তার বদলে তার উচিত ছিল শুধু নিজের সামনে দৃষ্টিকে মেলে ধরা।

অতীতে সেই দূরধিগম্য অসীমকে সে কখনো খুঁজে পায়নি। শুধু অনুভব করেছে কোথাও না কোথাও সে আছে, তাই তাঁকে খুঁজে ফিরেছে। যা কিছু কাছের, যা কিছু বোধগম্য তার মধ্যে সে দেখেছে শুধু সসীমকে, ক্ষুদ্রকে, সাধারণকে, অর্থহীনকে। চোখে একটা মানস দূরবীণ লাগিয়ে অনেক দূরে দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দূরত্বের কুয়াশা ঢাকা যে তুচ্ছ জাগতিক বস্তুকে দেখেছে, স্পষ্ট করে দেখতে না পারার দরুন তাকেই মনে হয়েছে মহৎ ও অন্তত ইওরোপীয় জীবনযাত্রা, রাজনীতি, ভ্রাতৃসংঘ, দর্শন, বিশ্বমানবতা–সবকিছুকেই সেই একইভাবে সে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু আজ সবকিছুর মধ্যে সেই মহান, শাশ্বত ও অনন্তকে সে দেখতে শিখেছে, আর তাই স্বাভাবিকভাবেই দূরবীণটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চারদিকেই খুঁজে পেয়েছে সেই চিরপরিবর্তনশীল, শাশ্বত, অপরিমেয়, অনন্ত জীবনকে। দৃষ্টিতে যত কাছে নিয়ে আসছে ততই শান্তি-সুখে ভরে উঠছে হৃদয়। কিসের জন্য? এই ভয়ংকর প্রশ্ন এতদিন তার মনের মন্দিরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আজ সে প্রশ্নের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিসের জন্য? এই প্রশ্নের একটা সরল উত্তর এখন সর্বদাই তার মনের মধ্যে উপস্থিত : কারণ ঈশ্বর আছেন, আর সে ঈশ্বরের ইচ্ছা না হলে মানুষের মাথার একগাছি চুলও পড়ে না।

.

অধ্যায়-১৩

 বাইরে থেকে দেখলে পিয়েরের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। চেহারা যেমন ছিল ঠিক সেই রকমই আছে। এখনো সে আগের মতোই অন্যমনস্ক, চোখের সামনে যা থাকে তার বদলে নিজের বিশেষ কোনো জিনিস নিয়েই সে ব্যস্ত থাকে। সে আগে যা ছিল এবং এখন যা হয়েছে তার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। আগে তাকে মনে হত দয়ালু কিন্তু দুঃখী মানুষ, তাই লোকে তাকে এড়িয়ে চলত, এখন জীবনের আনন্দের একটা হাসি সর্বদাই তার ঠোঁটে লেগে থাকে, অপরের প্রতি সহানুভূতি জ্বল জ্বল করে তার চোখে, তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একটাই প্রশ্ন-তারা ও কি তার মতোই পরিতুষ্ট, তাই তার উপস্থিতিতে মানুষ এখনো আনন্দিত বোধ করে।

আগে সে কথা বলত বেশি, কথা বললেই উত্তেজিত হয়ে উঠত, কদাচিৎ অন্যের কথা শুনত, এখন সে কদাচিৎ কথার মধ্যে ডুবে যায়, এমনভাবে মন দিয়ে অন্যের কথা শোনে যে সকলেই সাগ্রহে নিজেদের গোপন কথা তাকে বলে।

যে প্রিন্সেস কোনোদিনই পিয়েরকে পছন্দ করত না, কারণ বুড়ো কাউন্টের মৃত্যুর পর সে নিজেকে পিয়েরের উপর একটি বোঝা বলে মনে করত, কিন্তু এখন ওরিলে এসে অল্প কিছুদিন থেকেই পিয়েরকে তার ভালো লেগে গেছে। এদিকে পিয়েরও ধীরে ধীরে যেভাবে তার বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছে, একজন অতি চতুর লোকও তা করতে পারত না। সে সর্বদাই প্রিন্সেসের যৌবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির স্মৃতিচারণ করত, আর তার প্রতি সহানুভূতি দেখাত। এই তিক্তহৃদয়, কঠোর, গর্বিত প্রিন্সেসটির মানবিক গুণগুলিকে বাইরে টেনে বের করাই এ ব্যাপারে পিয়েরের একমাত্র কৌশল।

প্রিন্সেস মনে মনে বলল, খারাপ লোকের প্রভাবে না পড়ে সে যখন আমার মতো লোকের সাথে মেশে, তখন তো সে খুব, খুবই সদয়।

তার দু চাকর তেরেন্তি ও ভাস্কাও পিয়েরের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। তাদের ধারণা, মনিব এখন অনেক সরল ও স্বাভাবিক হয়েছে। তেরেন্তি তো অনেক সময়ই তার পোশাক ছাড়িয়ে শুভরাত্রি জানাবার পরেও মনিবের বুট ও পোশাক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে থাকে, সে নতুন করে কথা বলতে শুরু করে কিনা দেখতে। আর পিয়ের ও তেরেন্তি গল্প করতে চাইছে বুঝতে পেরে সাধারণতই তাকে আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখে।

হয়তো জিজ্ঞাসা করত, আচ্ছা, বল তো… তোমরা খাবার পেতে কী ভাবে?

আর তেরেন্তিও বলতে শুরু করত মস্কো ধ্বংসের কথা, বুড়ো কাউন্টের কথা, আর দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করত, অথবা পিয়েরের গল্প শুনত, আর তারপরে মনিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারার সুখে ও তার প্রতি স্নেহে গদগদ হয়ে হল ঘরের দিকে চলে যেত।

যে ডাক্তার পিয়েরের চিকিৎসা করত এবং প্রতিদিন তাকে দেখতে আসত, যদিও সে মনে করত যে রোগজৰ্জর মানবতার স্বার্থে তার প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান, তবু সেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে পিয়েরের সঙ্গে গল্পগুজব করত।

ভাবত, এ ধরনের লোকের সঙ্গে কথা বলে সুখ আছে, সে তো অন্য সব প্রাদেশিক লোকদের মতো নয়।

ফরাসি বাহিনীর কয়েকজন বন্দি ওরিলে থাকত। তাদের মধ্যে একজন তরুণ ইতালিয়কে ডাক্তারটি একদিন পিয়েরের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে এল।

অফিসারটি প্রায়ই পিয়েরের সঙ্গে দেখা করতে আসতে লাগল, আর পিয়েরের প্রতি ইতালিয় যুবকটির অনুরাগ নিয়ে প্রিন্সেস প্রায়ই হাসি-ঠাট্টা করত।

পিয়েরের সঙ্গে দেখা করতে, তার সঙ্গে কথা বলতে, তার নিজের অতীত জীবনের কথা, বাড়ির কথা, ভালোবাসার কথা বলতে পারলেই ইতালিয় যুবকটি খুব আনন্দ পেত। ফরাসিদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে মনের ক্ষোভ ঢালতে পারলে সে খুব খুশি হত।

একদিন সে পিয়েরকে বলল, সব রুশ যদি তিলমাত্রও আপনার মতোই হয়, তাহলে তো এরকম একটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মহাপাপ। ফরাসিদের হাতে আপনি এত কষ্ট সয়েছেন, অথচ তাদের প্রতি কোনো শত্রুতা আপনি মনের মধ্যে পোষণ করেন না।

শুধু ইতালিয় যুবকটির অন্তরের সৎগুণগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সে কাজে আনন্দ অনুভব করেই পিয়ের যুবকটির উচ্ছ্বসিত অনুরাগ অর্জন করতে পেরেছে।

ওরিলে অবস্থানের শেষের দিকে ভ্রাতৃসংঘের একজন পূর্বপরিচিত ভাই কাউন্ট উইলার্স্কি পিয়েরের সঙ্গে দেখা করতে এল। ওরিল প্রদেশের একটা বড় জমিদারির এক উত্তরাধিকারিণীকে সে বিয়ে করেছে এবং সেই শহরে কমিসারিয়েট বিভাগে একটি অস্থায়ী চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছে।

আগেকার দিনে টাকাপয়সার ব্যাপার নিয়ে, বিশেষ করে কেউ টাকাপয়সা চাইতে এলে পিয়ের বড়ই বিপদে পড়ে যেত। নিজেকে প্রশ্ন করত, দেব কি দেব না? আমার টাকাটা আছে, আর তার ওটা দরকার। কিন্তু অন্য কারো দরকার তো আরো বেশি। কার দরকার সব চাইতে বেশি? আর হয় তো দুজনই জোচ্চোর। পুরোনো দিনগুলোতে এইসব প্রশ্নের সামনে সে বড়ই অসহায় বোধ করত, আর যতক্ষণ দেবার মতো কিছু থাকত ততক্ষণ যে এসে চাইত তাকেই দিয়ে দিত। সে সময় সম্পত্তির ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন দেখা দিলেই এক একজন এক একরকম পরামর্শ দিত, আর সে বড়ই বিপাকে পড়ে যেত।

কিন্তু এখন সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করছে যে এসব প্রশ্ন নিয়ে তার মনে এখন আর কোনো সন্দেহ বা বিহ্বলতা নেই। তার মধ্যে এখন এমন একজন বিচারক আসন পেতে বসেছে যে তার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক বিধানের বলে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় সেটা মুহূর্তেই স্থির করে দেয়।

এই নতুন বিচারকের আশ্রয় সে প্রথম লাভ করল যখন জনৈক ফরাসি বন্দি, একজন কর্নেল, তার কাছে এল, অনেক বড় বড় কথা বলল, এবং এই বলে শেষ করল যে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে পাঠাবার জন্য তাকে চার হাজার ফ্রাঁ পিয়েরকে দিতেই হবে। তিলমাত্র অসুবিধা বোধ বা প্রচেষ্টা ছাড়াই পিয়ের টাকাটা দিতে অস্বীকার করল, আর পরে এই ভেবে বিস্মিত হল যে আগে যে-কাজটা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য এখন সেটা কত সহজ ও সরলভাবে হয়ে গেল। জাগতিক ব্যাপারে তার এই স্থির সিদ্ধান্তের মনোভাবের আর একটা প্রমাণ পিয়ের পেল তার স্ত্রীর ঋণশোধ এবং মস্কোতে ও শহরতলীতে তার বাড়িঘরগুলি নতুন করে তৈরি করা সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তকে লক্ষ্য করে।

তার বড় নায়েব ওরিলে এসে পিয়েরের সঙ্গে দেখা করল। তার সঙ্গে বসে পিয়ের নিজের স্বল্প আয়ের হিসাব করল। বড় নায়েবের হিসাব মতে মস্কোর অগ্নিকাণ্ডের ফলে তার ক্ষতি হয়েছে প্রায় বিশ লক্ষ রুবল।

এই ক্ষতির জন্য সান্ত্বনা জানাতে প্রধান নায়েব তাকে হিসাব কষে দেখিয়ে দিল যে এইসব ক্ষতি সত্ত্বেও তার আয় হ্রাস না পেয়ে বরং আরো বৃদ্ধি পেতে পারে যদি সে তার স্ত্রীর ঋণ শোধ করতে অস্বীকার করে, সে ঋণ শোধ করার কোনো বাধ্যবাধকতা তার নেই-এবং তার মস্কোর বাড়ি এবং মস্কোর জমিদারিতে অবস্থিত পল্লীভবনটি নতুন করে তৈরি না করে, সেইসব বাড়ির জন্য তার বছরে ব্যয় হয় আশি হাজার রুবল, অথচ উপার্জন হয়না কিছুই।

স্মিত হাসির সঙ্গে পিয়ের বলল, হ্যাঁ, সেকথা সত্যি। সেসবের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। সর্বস্বান্ত হয়ে আমি অধিকতর ধনী হয়েছি।

কিন্তু জানুয়ারি মাসে সা ভেলিচ মস্কো থেকে এসে সেখানকার পরিস্থিতির একটা বিবরণ দিল এবং মস্কোর বাড়ি ও পল্লীভবন পুনরায় নির্মাণের দরুন জনৈক স্থপতির একটা হিসাব দিয়ে বলল যে সে কাজ করার ব্যবস্থাটা পাকা হয়ে গেছে।সেইসময়ই প্রিন্স ভাসিলি এবং পিটার্সবুর্গের অন্য পরিচিতজনরা চিঠি লিখে তার স্ত্রীর ঋণের কথাটা জানিয়ে দিল। আর পিয়েরও স্থির করে ফেলল যে, নায়েবের যে প্রস্তাব তাকে এত খুশি করেছিল সেটা ছিল ভুল। কাজেই সে অবিলম্বে পিটার্সবুর্গ যাবে এবং স্ত্রীর ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলবে, আর মস্কোতে বাড়িঘরও নতুন করে তৈরি করবে। সেটা যে কোন প্রয়োজন তা জানে না, কিন্তু এটা সে নিশ্চিত জানে যে কাজটা প্রয়োজনীয়। এতে তার আয় তিন-চতুর্থাংশ হ্রাস পাবে, কিন্তু এটা অবশ্য করতে হবে।

উইলার্স্কিও মস্কো যাচ্ছিল, স্থির হল দুজন একসঙ্গেই যাবে।

ওরিলে স্বাস্থ্যোদ্ধারের সময় আনন্দ, মুক্তি ও জীবনের একটা অনুভূতি পিয়েরের হয়েছিল, কিন্তু এবার যাত্রাপথে খোলা পৃথিবীতে এসে, শত শত নতুন মুখ দেখে, সেই অনুভূতি তীব্রতর হল। সারা পথ তার নিজেকে ছুটিপাওয়া স্কুলের ছাত্রের মতো মনে হতে লাগল। সরকারি গাড়ির কোচয়ান, ডাক-ঘাঁটির ওভারসিয়ার, রাস্তার ও গ্রামের চাষীর দল, সবকিছুই তার কাছে নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠল। উইলার্স্কি অনবরত ইউরোপের তুলনায় রাশিয়ার অজ্ঞানতা, দারিদ্র্য ও অনগ্রসরতার নিন্দা করতে লাগল, তবু তার উপস্থিতি ও মন্তব্য পিয়েরের আনন্দকে শুধু বাড়িয়েই তুলল। উইলাঙ্কি যেখানে দেখে মৃত্যু, পিয়ের সেখানেই দেখে অসাধারণ জীবনীশক্তি-যে শক্তি এই বরফাবৃত বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বুকে এই মৌলিক, বিচিত্র, অসাধারণ মানুষগুলির জীবনকে রক্ষা করছে। উইলার্স্কির কথার কোনো প্রতিবাদ সে করল না, বরং তার সঙ্গে একমতই হল-যে আলোচনা শেষপর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে না তাকে এড়িয়ে চলবার সহজতম পথই হল আপাতত একমত হওয়া-আর তার কথা শুনতে শুনতে পিয়ের আনন্দের হাসি হাসতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৪

পিঁপড়ের ঢিপি ভেঙে দিলে পিঁপড়েরা ছুটোছুটি করে কোথায় যায়, কেন যায়, সেকথা বোঝ শক্ত: কেউ টিপি থেকে বেরিয়ে আসে আজেবাজে জিনিস, ডিম ও মরা পিঁপড়ে পিঠে নিয়ে, কেউ বা আবার ফিরে যায় টিপিতে, কেনই বা তারা ঠেলাঠেলি করে, একে অন্যকে ছাড়িয়ে যায়, লড়াই করে। ঠিক সেইরকমই ফরাসিরা চলে যাবার পরে কেন যে রুশরা পুরনো মস্কোতে গিয়ে ভিড় করল তাও বোঝা খুব শক্ত। কিন্তু যখনই আমরা ভেঙে-যাওয়া টিপির চারপাশে পিঁপড়েরদের ভিড় করতে দেখি, লক্ষ্য করি তাদের অধ্যবসায়, শক্তি ও সংখ্যার আধিক্য তখনই বুঝতে পারি, টিপি ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও অবিনশ্বর ও স্পর্শাতীত এমন কিছু তখনো থেকে যায় যা পিঁপড়ে-উপনিবেশকে শক্তি যোগায়, আর ঠিক সেইভাবেই যদিও অক্টোবর মাসে মস্কোতে কোনো রকম শাসন-ব্যবস্থা ছিল না, গির্জা ছিল না, তীর্থস্থান ছিল না, ধনসম্পদ বা বাড়িঘরও ছিল না, তবুও সেটা ছিল আগস্ট মাসের সেই একই মস্কো। তখন সবই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু এমন কিছু ধ্বংস হয়নি যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে হয়েও অত্যন্ত শক্তিশালী ও অবিনশ্বর।

শত্রুমুক্ত হবার পরে যে প্রেরণায় সকলে চারদিক থেকে এসে মস্কোতে ভিড় করল তা ছিল যেমন ভিন্ন ভিন্ন তেমনই ব্যক্তিগত, আর গোড়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্বর ও পাশবিক। তবে একটা প্রেরণা সকলের মধ্যেই সমানভাবে কাজ করছিল, যে স্থানটিকে একদা মস্কো বলা হত সেখানে পৌঁছে নিজেদের সাধ্যমতো সেখানে কাজ করার বাসনা।

এক সপ্তাহের মধ্যে পনেরো হাজার অধিবাসী মস্কোতে হাজির হল, পক্ষকালের মধ্যে এল পঁচিশ হাজার, এইভাবেই চলতে লাগল। ১৮১৩ সালের হেমন্তকালে সেই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ১৮১২ সালের লোকসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেল।

প্রথম দফায় মস্কোতে ঢুকল উইন্ত জিনগেররাদের সেনাদলের কসাকরা, নিকটবর্তী গ্রামের চাষীরা, আর মস্কোর যেসব অধিবাসী পালিয়ে গিয়ে কাছাকাছি কোথাও লুকিয়েছিল। মস্কোতে ঢুকে রুশরা যখন দেখল যে সব লুট হয়ে গেছে, তখন তারাও লুটপাট শুরু করে দিল। ফরাসিরা যেকাজ শুরু করেছিল সেটাই তারা চালিয়ে যেতে লাগল। বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ও রাজপথে যা কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল সেগুলি গ্রামে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য দলে দলে মালগাড়ি মস্কোকে আসতে লাগল। কসাকরা যা পারল তাদের শিবিরে নিয়ে গেল, অধিবাসীরা অন্য বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে নিজেদের বোঝাই করতে লাগল, যেন সেগুলো তাদেরই সম্পত্তি।

প্রথম লুটেরাদের পরে এল দ্বিতীয় লুটেরা দল, তারপর তৃতীয় দল, এমনি করে দল বাড়তে বাড়তে লুট করাটা ক্রমেই শক্ত হয়ে পড়ল, আর তাই সেকাজটা আরো সরাসরিভাবে শুরু হয়ে গেল।

ফরাসিরা মস্কোকে পেয়েছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়, কিন্তু তখনো তারা পেয়েছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানাবিধ শিল্পকর্ম সমন্বিত নিয়মিত জীবনযাত্রার সব রকম ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান, পেয়েছিল বিলাসের উপকরণ এবং সরকারি ও ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠান। সেসব ব্যবস্থাই তখন নিষ্প্রাণ, তবু তো তাদের অস্তিত্ব ছিল। বাজার ছিল, দোকান ছিল, মালগুদাম ছিল, শস্যভাণ্ডার ছিল–অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি মালপত্র বোঝাই ছিল-ছিল ছোট বড় কারখানা, বিলাদ্রব্যে ভর্তি বড় বড় প্রাসাদ ও সম্পন্ন বাড়িঘর, হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি আপিস, গির্জা ও ভজনালয়। ফরাসিরা যত বেশি দিন থাকল ততই শহর-জীবনের এইসব সুখ-সুবিধা লোপ পেতে লাগল, আর শেষপর্যন্ত সবকিছু তালগোল পাকিয়ে লুটতরাজের একটা নিষ্প্রাণ দৃশ্যে পরিণত হল।

ফরাসিদের লুটতরাজ যত চলতে থাকল ততই মস্কোর ধন-সম্পত্তি এবং লুটেরাদের শক্তি ক্ষয় হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু শহর পুনর্দখলের পরে রুশদের হাতে যে লুটতরাজ শুরু হল তার ফল হল বিপরীতঃ সে লুটতরাজ যত বেশি দিন ধরে চলতে থাকল আর লুটেরাদের সংখ্যা যতই বাড়তে লাগল ততই শহরের ধনসম্পত্তি ও নিয়মিত জীবনযাত্রা দ্রুততর গতিতে পুনর্গঠিত হতে লাগল।

লুটেরা ছাড়াও নানা ধরনের মানুষ মস্কোতে ফিরে এল, কেউ এল কৌতূহলবশে, কেউ এল সরকারি কর্তব্যের তাগিদে, কেউ এল নিজের স্বার্থের টানে, বাড়ির মালিক, পাদরি, নানা রকমের সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, মিস্ত্রি, চাষীরা–সকলেই সারা শরীরের রক্ত যেভাবে হৃৎপিণ্ডে ছুটে যায় সে বাবে জলস্রোতের মতো মস্কোর দিকে ধেয়ে আসতে লাগল।

যেসব চাষীরা লুটের মাল বয়ে নিয়ে যাবার জন্য খালি গাড়ি নিয়ে এসেছিল, এক সপ্তাহের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ তাদের থামিয়ে সেই সব গাড়িতে করে মৃতদেহগুলি শহরের বাইরে পাঠাতে লাগল। অন্য চাষীরা বন্ধুদের এই মুশকিলের খবর পেয়ে যই, যব ও খড় নিয়ে শহরে এল এবং রেষারেষি করে সে সব জিনিসের দাম আগের চাইতেও কমিয়ে দিল। ছুতোর মিস্ত্রিরা বেশি মজুরির আশায় প্রতিদিন দলে দলে মস্কোতে আসতে লাগল, চারদিকেই শুরু হল কাঠ চেরাই, নতুন বাড়ি তৈরি, আর পুরনো পোড়া বাড়ির মেরামতের কাজ। ব্যবসায়ীরা বাজার চালু করল। আধপোড়া বাড়িগুলোতে হোটেল ও মদের দোকান খোলা হল। যেসব গির্জা পুড়ে যায়নি সেখানে পাদরিরা ভজন-পূজন শুরু করে দিল। গির্জার যেসব সম্পত্তি চুরি হয়ে গিয়েছিল দাতারা সেগুলি নতুন করে দান করল। সরকারি কর্মচারীরা তাদের কাজের টেবিল সাজিয়ে বসল। ফরাসিরা যেসব মালপত্র ফেলে গিয়েছিল ঊর্ধ্বতন কর্মচারী ও পুলিশ মিলে সেগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করে দিল। যেসব বাড়িতে অন্য সব বাড়ি থেকে এনে মালপত্র বোঝাই করা হয়েছিল তার মালিকরা বলতে লাগল, সব জিনিস নিয়ে ক্রেমলিনের প্রাসাদে মজুত করাটা অন্যায়। আবার অন্য একদল বলতে লাগল, ফরাসিরা নানা বাড়ি থেকে মালপত্র এনে যেসব বাড়িতে মজুত করেছিল তার মালিকদের সে সব মালপত্রের মালিকানা দেওয়াটা অন্যায়। তারা পুলিশকে গালাগালি করল, তাদের ঘুষ দিল, আগুনে যেসব সরকারি গুদাম পুড়ে গিয়েছিল তার দামের পরিমাণ দশগুণ বাড়িয়ে নিয়ে সরকারি সাহায্যের দাবি জানাল। আর কাউন্ট রস্তপচিন ঘোষণাপত্র লিখে চলল।

.

অধ্যায়-১৫

জানুয়ারির শেষে পিয়ের মস্কোতে গেল। তার বাড়ির সংলগ্ন যে অংশটা পোড়েনি সেখানেই উঠল। কাউন্ট রস্তপচিন ও অন্য কয়েকজন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করল। মনের ইচ্ছা, দিন দু পরে পিটার্সবুর্গ যাত্রা করবে। বিধ্বস্ত কিন্তু নতুন করে গড়ে ওঠা শহরের সকলেই বিজয়-উৎসবে ব্যস্ত, সবকিছুই যেন নব জীবনের উত্তাপে টগবগ করছে। পিয়েরকে দেখে সকলেই খুশি, সকলেই তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক, সকলেই জানতে চায় তার অভিজ্ঞতার কথা। পিয়েরও সকলের প্রতিই প্রসন্ন, আবার পাছে কোথাও বাঁধা পড়ে যায় সেই আশংকায়ও সদাসতর্ক। গুরুত্বপূর্ণ বা তুচ্ছ যে প্রশ্নই তাকে করা হয়, যেমন–সে এখন কোথায় থাকবে? নতুন করে বাড়িঘর তুলবে কি না? পিটার্সবুর্গে কবে যাবে, আর কারো জন্যে একটা পুলিন্দা নিয়ে যেতে পারবে কি?-সব প্রশ্নেরই তার একই জবাব হ্যাঁ, হয় তো, অথবা তাই তো মনে হয়, ইত্যাদি।

সে শুনেছে, রস্তভরা এখন কমাতে আছে, কিন্তু নাতাশার কথা কদাচিৎ তার মনে পড়ে। মনে পড়লেও সেটা দূর অতীতের একটা মধুর স্মৃতিমাত্র।

আসার তিনদিন পরে দ্রবেস্কয়দের কাছে শুনল, প্রিন্সেস মারি মস্কোতেই আছে। প্রিন্স আন্দ্রুর মৃত্যু, যন্ত্রণা ও শেষের দিনগুলির কথা প্রায়ই তার মনে পড়ে, এখন যেন সে স্মৃতি স্পষ্টতর হয়ে দেখা দিল। প্রিন্সেস মারি মস্কোতে ভজদভিজেংকা স্ট্রিটের বাড়িতেই বাড়িটা পোড়েনি-আছে শুনে সেই সন্ধ্যায়ই তার সঙ্গে দেখা করতে গেল।

যেতে যেতে পিয়ের ভাবতে লাগল প্রিন্স আন্দ্রুর কথা, তাদের বন্ধুত্ব, বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাৎ, বিশেষ করে বরদিনোতে তাদের শেষ সাক্ষাতের কথা। সে ভাবতে লাগল, এও কি সম্ভব যে মনের সেই তিক্ততা নিয়েই সে মারা গেছে? এও কি সম্ভব যে মৃত্যুর আগেও জীবনের অর্থ তার কাছে প্রকাশিত হয়নি। তার মনে পড়ল কারাতায়েভ ও তার মৃত্যুর কথা। আপনা থেকেই এই দুটি মানুষের একটা তুলনা তার মনে এল, এরা দুজন কত আলাদা, অথচ তাদের মধ্যে মিলও কতঃ দুজনই বেঁচে ছিল, দুজনই মারা গেছে, আর তাদের দুজনকেই সে ভালোবেসেছে।

 বেশ বিষণ্ণ মনেই পিয়ের বুড়ো প্রিন্সের বাড়িতে পৌঁছে গেল। বাড়িটার অনেক ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু চেহারাটা পাল্টায়নি। পুরনো পরিচারকটি জানাল, প্রিন্সেস তার ঘরে চলে গেছে, আর রবিবারেই সে লোকজনদের সঙ্গে দেখা করে থাকে।

পিয়ের বলল, আমার নাম করে বল। হয় তো তিনি দেখা করবেন।

লোকটি বলল, ঠিক আছে স্যার। দয়া করে ছবির ঘরটায় আসুন।

কয়েক মিনিট পরে পরিচারক দেসালেসকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। দেসালেস জানাল, পিয়ের যদি আনুষ্ঠানিক রীতির অভাব ক্ষমা করে দোতলায় তার ঘরে যায় তাহলে প্রিন্সেস সানন্দে তার সঙ্গে দেখা করবে।

একটা নিচু ঘরে একটিমাত্র মোমবাতির আলোয় প্রিন্সেস বসে আছে, তার সঙ্গে আছে কালো পোশাক পরা আরো একজন। পিয়েরের মনে পড়ল, প্রিন্সেস সব সময়ই সঙ্গিনী নিয়ে থাকে, তবে তারা কারা আর কি রকম প্রকৃতির তা সে জানে না, মনেও নেই। কালো পোশাক পরা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, নিশ্চয়ই প্রিন্সেসের কোনো সঙ্গিনী।

প্রিন্সেস তাড়াতাড়ি উঠে হাতটা বাড়িয়ে দিল।

পিয়ের তার হাতে চুমো খাবার পরে তার পরিবর্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস বলল, আচ্ছা, তাহলে এইভাবেই আবার আমাদের দেখা হল। শেষপর্যন্তও সে আপনার কথাই বলত।

আপনার নিরাপদে থাকার খবর পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। অনেকদিন পরে সেই প্রথম একটা সুখবর পেয়েছিলাম।

কেমন যেন একটা অস্বস্তির সঙ্গে প্রিন্সেস সঙ্গিনীর দিকে তাকাল। তারপর আরো কিছু বলতে যাবার মুখেই পিয়ের তাকে বাধা দিল।

ভাবুন তো তার কথা আমি কিছুই জানতাম না! ভেবেছিলাম সে যুদ্ধে মারা গেছে। যা কিছু জেনেছি অন্যের মুখ থেকে শুনে জেনেছি। শুধু জানি যে রস্তভদের সঙ্গে তার একটা মনোমালিন্য ঘটেছিল…কী আশ্চর্য যোগাযোগ!

পিয়ের উৎসাহের সঙ্গে দ্রুত কথা বলতে লাগল। একবার সঙ্গিনীটির মুখের দিকে তাকাল, দেখল তার সদয় ও সমনোযোগ দৃষ্টি তার উপরেই নিবদ্ধ, কেন যেন পিয়েরের মনে হল, কালো পোশাকের এই মানুষটি খুবই সদয় ও ভালো, তার সামনে প্রিন্সেস মারির সঙ্গে খোলাখুলিভাবে সব কথা বলা চলে।

কিন্তু সে যখন রস্তভদের কথা বলল তখন প্রিন্সেস মারির মুখে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি পিয়েরের মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে কালো পোশাকের মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি সত্যি ওকে চিনতে পারেননি।

পিয়ের আর একবার সঙ্গিনীটির বিবর্ণ নরম মুখের দিকে তাকাল, তার কালো চোখের সাগ্রহ দৃষ্টির ভিতর দিয়ে দীর্ঘবিস্তৃত, মধুরতর, বড়ই প্রিয় কে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ভাবল, কিন্তু না, তা হতে পারে না। এই কঠোর, শীর্ণ, বিবর্ণ মুখে যে অনেক বেশি বয়সের ছায়া! এ তো সে হতে পারে না। শুধু একে দেখে তার কথা আমার মনে পড়ছে। কিন্তু সেইমুহূর্তে প্রিন্সেস মারি ডাকল নাতাশা! আর অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায়, অনেক যত্নে মরচে-ধরা কজাওয়ালা দরজা খুলে যাওয়ার মতো সে মুখে একটু হাসি খেলে গেল, আর সেই ভোলা দরজা দিয়ে একঝলক সুগন্ধ এসে এমন সুখে পিয়েরের মনকে ভরে দিল যা সে অনেকদিন হল ভুলে গেছে, আর-অন্তত এইমুহূর্তে-যার কথা সে চিন্তাও করেনি। সে সুখ তার মনকে ভরে দিল, তাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে দিল। সে ঈষৎ হাসল, আর কোনো সন্দেহ রইল না, এই তো নাতাশা, তাকে সে ভালোবাসে।

সেই মুহূর্তে নাতাশার কাছে, প্রিন্সেস মারির কাছে, সর্বোপরি নিজের কাছে আপনা থেকেই পিয়ের এমন একটা গোপন কথাকে প্রকাশ করে বসল যার খবর সে নিজেই জানত না। আনন্দে ও যন্ত্রণায় তার মুখটা লাল হয়ে উঠল। মনের উত্তেজনাকে চেপে রাখতে চেষ্টা করল। কিন্তু লুকিয়ে রাখার যত চেষ্টা করতে লাগল ততই স্পষ্টতর ভাবে-ভাষার অতীত স্পষ্টতায়-এই সত্যকেই সে নিজের কাছে, নাতাশার কাছে, ও প্রিন্সেস মারির কাছে প্রকাশ করে দিল যে সে নাতাশাকে ভালোবাসে।

পিয়ের ভাবল, এ যে বড়ই অপ্রত্যাশিত। পুনরায় প্রিন্সেস মারির সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আবারও সে নাতাশার দিকেই দৃষ্টি ফেরাল, আর গাঢ়তর রঙে রাঙ হয়ে উঠল তার মুখ, আনন্দ ও শংকা মিশ্রিত অধিকতর শক্তিশালী একটা উন্মাদনা তার অন্তরকে চেপে ধরল। তার কথাবার্তা কেমন গোল মেলে হয়ে গেল, কথার মাঝখানেই সে থেমে গেল। পিয়ের প্রথমে নাতাশাকে খেয়াল করেনি, কারণ এখানে তাকে দেখতে পাবে এটা সে আশাই করেনি, তাকে যে চিনতে পারেনি তার কারণ তার সঙ্গে শেষ দেখার পরে নাতাশার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে অনেক শীর্ণ, বিবর্ণ হয়ে গেছে, কিন্তু তাকে চিনতে না পারার কারণ সেটা নয়, তাকে যে চিনতে পারা যায়নি তার কারণ সে মুখের দুটি চোখে সব সময়ই ঝিলিক দিত জীবনানন্দের একটা চাপা হাসি, এখন প্রথম দর্শনের মুহূর্তে সে মুখে সেই হাসির ছায়ামাত্র ছিল নাঃ ছিল শুধু সাগ্রহ মনোযোগ আর বিষণ্ণ জিজ্ঞাসা।

পিয়েরের বিব্রত ভাবটা কিন্তু নাতাশার মুখে প্রতিফলিত হল না, একটা আনন্দের আভায় তার সারা মুখটা ঈষৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

.

অধ্যায়-১৬

প্রিন্সেস মারি বলল, ও আমার কাছে থাকতে এসেছে। কাউন্ট ও কাউন্টেসও কয়েকদিনের মধ্যেই এখানে এসে পড়বেন। কাউন্টেসের অবস্থা শংকাজনক। কিন্তু নাতাশার নিজেরও ডাক্তারকে দেখানো দরকার ছিল। তাই তাঁরা ওকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

নাতাশাকে সম্বোধন করে পিয়ের বলল, ঠিক, আজকাল দুঃখ ছাড়া একটিও পরিবার আছে কি? জানেন তো, যেদিন আমরা উদ্ধার পেলাম সেইদিনই ঘটনাটি ঘটল। তাকে আমি দেখেছি। কী যে আনন্দঘন মূর্তি ছেলেটির!

নাতাশা চোখ তুলে তাকাল, চোখ দুটি বিস্ফারিত ও উজ্জ্বল হয়েই যেন তার কথার জবাব দিল।

পিয়ের বলল, সান্ত্বনার বাণী কিই বা শোনাব? কিছু বলার নেই। এরকম একটি প্রাণোচ্ছল চমৎকার ছেলেকে কেনই বা মরতে হল?

ঠিক, এখনকার দিনে বিশ্বাস ছাড়া বাঁচা বড় শক্ত, প্রিন্সেস মারি বলল।

তাকে বাধা দিয়ে পিয়ের তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ঠিক, ঠিক, খুব ঠিক কথা।

পিয়েরের চোখে সাগ্রহ দৃষ্টি রেখে নাতাশা শুধাল, কেন ঠিক?

প্রিন্সেস মারি বলল, কেন তাও জিজ্ঞাসা করছ? ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই… ।

 প্রিন্সেস মারির কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করেই নাতাশা আবার সাগ্রহে পিয়েরের দিকে তাকাল।

পিয়ের বলতে লাগল, কারণ আমাদের সকলের উপরে একজন ঈশ্বর আছেন এ বিশ্বাস যার আছে একমাত্র সেই ওর… এবং আপনার এতবড় ক্ষতিকে সহ্য করতে পারে।

কি যেন বলতে মুখ খুলেও নাতাশা হঠাৎ থেমে গেল। পিয়ের তাড়াতাড়ি মুখটা ঘুরিয়ে প্রিন্সেস মারির কাছে জানতে চাইল বন্ধুর শেষের দিনগুলির কথা।

পিয়েরের বিব্রত ভাবটা এখন সম্পূর্ণ কেটে গেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে সে এটাও বুঝতে পারছে যে তার স্বাধীনতাও সম্পূর্ণ চলে গেছে। সে বুঝতে পারছে, তার প্রতিটি কথা ও কাজের এমন একজন বিচারক এখন এসেছে যার বিচার তার কাছে পৃথিবীর অন্য সকলের বিচারের চাইতে অধিক মুল্যবান। এখন কথা বলতে গেলেই সে ভাবছে তার কথা নাতাশার মনে কোন ভাবের সৃষ্টি করবে। সে যে ইচ্ছা করে নাতাশাকে খুশি করতে কথা বলছে তা নয়, কিন্তু সে যা কিছু বলছে নাতাশার দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছে।

প্রিন্স আন্দ্রুকে যে অবস্থায় দেখতে পেয়েছিল সেই কথাই প্রিন্সেস মারি বলতে শুরু করল। কিন্তু পিয়েরের আধো-কম্পিত মুখ, তার প্রশ্ন, তার উৎকণ্ঠ চঞ্চল ভাব ধীরে ধীরে প্রিন্সেস মারিকে বাধ্য করল বিস্তারিত বিবরণ দিতে, যদিও সে বিবরণকে স্মরণে আনতে তার নিজেরই ভয় করে।

সমস্ত শরীরটাকে তার দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে তার কাহিনীকে সাগ্রহে শুনতে শুনতে পিয়ের বারবার বলতে লাগল, ঠিক, ঠিক, আর তাই…? ঠিক, ঠিক, সে ক্রমেই শান্ত ও নরম হয়ে উঠল? সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সর্বদা একটা জিনিসই তো সে চেয়েছে-পরিপূর্ণ ভালো হতে-সুতরাং মৃত্যুকে সে ভয় করতে পারে না। যেটুকু দোষ তার ছিল-যদি কোনো দোষ আদপেই থেকে থাকে-তাও তার নিজের তৈরি নয়। তাহলে সে নরম হয়েছিল?… সহসা নাতাশার দিকে ফিরে অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, …কী সুখের কথা যে সে আপনাকে আবার দেখতে পেয়েছিল।

নাতাশার মুখটা কুঁচকে গেল। চোখে ভ্রুকুটি দেখা দিল। একমুহূর্তের জন্য চোখ নামিয়ে নিল। কথা বলবে কি বলবে না ভেবে ইতস্তত করতে লাগল।

তারপর শান্ত চাপা স্বরে বলল, হ্যাঁ, সত্যি বড় সুখের। আমার কাছে সত্যি সুখের। একটু থেমে বলল, আর সে…সে…সে বলেছিল আমার ঘরে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই সে এটা চাইছিল…

নাতাশার গলা থেমে গেল। মুখ লাল হয়ে উঠল, দু-হাত এক করে হাঁটুটাকে চেপে ধরল, তারপর বেশ চেষ্টা করে নিজেকে সংযত করে মাথাটা তুলে দ্রুত কথা বলতে লাগল।

মস্কো থেকে যখন যাত্রা করি তখন এর কিছুই আমরা জানতাম না। তার কথা জিজ্ঞাসা করার সাহসও হয়নি। তারপর হঠাৎ সোনিয়াই বলল যে সে আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছে। তার তখনকার অবস্থা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, সে অবস্থা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম তাকে দেখতে, তার সঙ্গে থাকতে। ঘন ঘন শ্বাস টেনে অতি দ্রুত সে কথাগুলি বলল।

তারপর সে একটানা বলে গেল সেই সব কথা যে সে আজ পর্যন্ত আর কাউকে বলেনি তাদের তিন সপ্তাহব্যাপী পথযাত্রা এবং ইয়াবোশ্লাভলের জীবনযাত্রার সব অভিজ্ঞতার কথা।

অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি নাতাশার উপর স্থির রেখে পিয়ের হাঁ করে সব কথা শুনল। শুনতে শুনতে প্রিন্স আন্দ্রু, বা মৃত্যু, বা তার কথা-কোনো কিছু নিয়েই সে কিছু ভাবল না। শুধুই তার কথাগুলি শুনল, আর কথা বলতে বলতে যে যন্ত্রণা সে ভোগ করছে সেজন্য তার প্রতি করুণা বোধ করতে লাগল।

নাতাশার পাশে বসে প্রিন্সেস মারিও এই প্রথম শুনল তার দাদার শেষের দিনগুলি ও নাতাশার ভালোবাসার কথা।

স্পষ্টতই সেই বেদনাদীর্ণ অথচ আনন্দময় কাহিনী বলা নাতাশার পক্ষে খুবই প্রয়োজন ছিল।

অন্তরের গোপনতম কথার সঙ্গে অতি তুচ্ছ বিবরণকে মিশিয়ে সে কথাগুলি বলতে লাগল, মনে হল, তার কথা বুঝি কোনোদিন শেষ হবে না। অনেক সময়ই একই কথা দুবার করে বলতে লাগল।

দরজার বাইরে দেসালেসের গলা শোনা গেল, সে জানতে চাইছে, ছোট্ট নিকলাস ঘরে ঢুকে শুভরাত্রি জানাতে পারে কি না।

আচ্ছা, এই সব-সব কথা, নাতাশা বলল।

নিকলাস ঢুকতেই তাড়াতাড়ি উঠে সে প্রায় দৌড়ে পর্দার আড়ালে ঢাকা দরজাটার দিকে গেল, দরজাটায় মাথাটা ঠুকে গেল ব্যথায় বা দুঃখে আর্তনাদ করে সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পিয়ের একদৃষ্টিতে দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল, এই পৃথিবীতে সহসা কেন যে তার নিজেকে একেবারে একা মনে হল তা সে বুঝতে পারল না।

 প্রিন্সেস মারিই তার অন্যমনস্কতা ভেঙে দিয়ে ভাইপোটির প্রতি তার মনোযোগ আকর্ষণ করল।

সেই আবেগের মুহূর্তে ছোট্ট নিকলাসের মুখের সঙ্গে তার বাবার মুখের বড় বেশি মিল দেখে পিয়ের এতদূর অভিভূত হয়ে পড়ল যে ছেলেটিকে চুমো খাবার পরেই সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, পকেট থেকে রুমালটা বের করে জানালার কাছে চলে গেল। তখনই প্রিন্সেস মারির কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইল, কিন্তু সে তাকে ছাড়ল না।

না, অনেক সময়ই নাতাশা ও আমি দুটোর আগে ঘুমতে যাই না, কাজেই আপনি দয়া করে যাবেন না। খাবার দিতে বলছি। আপনি নিচে যান, আমরা এখনি আসছি।

পিয়ের ঘর থেকে যাবার আগে প্রিন্সেস মারি তাকে বলল, এই প্রথম নাতাশা তার সম্পর্কে এত কথা বলল।

.

অধ্যায়-১৭

উজ্জ্বল আলোকশোভিত বড় খাবার ঘরে পিয়েরকে নিয়ে যাওয়া হল। কয়েক মিনিট পরে দরজায় পায়ের শব্দ শোনা গেল, নাতাশাকে নিয়ে প্রিন্সেস মারি ঘরে ঢুকল। একটা কঠিন গম্ভীর ভাব মুখের উপর নেমে এলেও নাতাশা এখন বেশ শান্ত। একটা গুরুতর আন্তরিক আলোচনার পরে সাধারণত যা হয়ে থাকে এক্ষেত্রেও তারা তিনজনই এখন কিছু বিব্রত বোধ করল। আগেকার আলোচনায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আলোচনা খারাপ দেখায়, অথচ কথা বলার ইচ্ছাটা পুরোপুরিই থাকে। তারা চুপচাপ টেবিলে গিয়ে বসল। পরিচারকরা চেয়ারগুলো পিছনে টেনে নিয়ে আবার সামনে ঠেলে দিল। পিয়ের টেবিল-তোয়ালের ভাজ খুলল, এবং নিস্তব্ধতা ভাঙবার জন্য প্রথমে নাতাশার দিকে ও পরে প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাল। তাদের মনেও ঐ একই সংকল্প। দুজনের চোখেই জ্বলছে খুশির আলো, যেন বলছে দুঃখের পরেও জীবনে আছে আনন্দ।

প্রিন্সেস মারি শুধাল, আপনি কি ভদকা খান কাউন্ট? আর এই কথাগুলি যেন অতীতের ছায়াকে ঠেলে দিল দূরে। এবার আপনার কথা বলুন। আপনার সম্পর্কে এমন সব অদ্ভুত আশ্চর্য কথা শুনেছি।

এবার তার পক্ষে স্বাভাবিক মৃদু বিদ্রুপের হাসি হেসে পিয়ের বলল, তা ঠিক। লোকে আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে যা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। মারি এব্রামভনা আমাকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আমার কপালে কি ঘটেছে বা ঘটা উচিত ছিল তাই একটানা বলে গেলেন। আমার অভিজ্ঞতার কথা কেমন করে বলা উচিত সে পরামর্শ দিলেন স্তেপান স্তেপানিচ। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, নাম-করা লোক হওয়াটা খুব সোজা (আমিই তো এখন একজন নামী লোক), লোকে আমাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে আমার কথাই শুনিয়ে দেয়।

নাতাশা হেসে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে প্রিন্সেস মারি বলল, আমরা শুনেছি মস্কোতে আপনার দশ লাখ ক্ষতি হয়েছে। কথাটা কি সত্যি?

কিন্তু আমি তো আগের চাইতে তিনগুণ ধনী হয়েছি, পিয়ের জবাবে বলল। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, আমি যে মুক্তি পেয়েছি সেটাই আমার সত্যিকারের লাভ। কিন্তু প্রসঙ্গটা খুবই ব্যক্তিগত হয়ে পড়ছে দেখে সে আর কথা বাড়াল ।

আপনি কি নতুন করে বাড়িঘর তৈরি করছেন?

হ্যাঁ। সাভেলিচ বলছে করতেই হবে।

প্রিন্সেস মারি শুধাল, আচ্ছা বলুন তো, যখন মস্কোতে থাকা স্থির করলেন তখন কি আপনি কাউন্টেসের মৃত্যুর সংবাদ জানতেন না?

পিয়ের জবাব দিল, না। আমি খবরটা শুনি ওরিলে। শুনে কত যে আঘাত পেয়েছিলাম তা কল্পনাও করতে পারবেন না। আমরা আদর্শ দম্পতি ছিলাম না, কিন্তু তার মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছিল। দুটি মানুষের মধ্যে যখন ঝগড়া হয় তখন দুজনেরই দোষ থাকে, কিন্তু তাদের এক একজন যখন আর জীবিত থাকে না তখন অপর জনের দোষটা হঠাৎ বড় বেশি ভারি হয়ে দেখা দেয়। তার উপর এমন মৃত্যু…বন্ধু নেই, সান্ত্বনা নেই! তার জন্য আমি খুব, খুব দুঃখিত। কথা শেষ করে নাতাশার মুখে সানন্দ সমর্থনের ভাব লক্ষ্য করে সে খুশি হয়ে উঠল।

প্রিন্সেস মারি বলল, ঠিক, তাহলে তো আপনি আর একবার একটি বিবাহযোগ্য কুমার হলেন।

পিয়েরের মুখটা হঠাৎ রাঙা হয়ে উঠল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে নাতাশার দিকে চাইতেই পারল না। আবার তার দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল, নাতাশার মুখটা কঠোর, কঠিন, এমন কি সম্ভবত অবজ্ঞাসূচক হয়ে উঠেছে।

প্রিন্সেস মারি শুধাল, আমরা শুনেছি আপনি নেপোলিয়নের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন, সেটা কি সত্যি?

পিয়ের হাসল।

না, মোটেই না। সকলেই কল্পনায় দেখে, বন্দি হওয়া মানেই নেপোলিয়নের অতিথি হওয়া। তাকে তো কখনো দেখিই নি, তার সম্পর্কে কিছু শুনিনি পর্যন্ত-আমি ছিলাম অনেক নিচু স্তরের লোকদের সঙ্গে।

খাওয়া শেষ হয়ে গেল। বন্দি-জীবন সম্পর্কে কোনো কথা বলার ইচ্ছা প্রথম দিকে পিয়েরের ছিল না, কিন্তু ক্রমে তাকে সেইদিকে নিয়ে যাওয়া হল।

ঈষৎ হেসে নাতাশা বলল, কিন্তু আপনি যে নেপোলিয়নকে হত্যা করতেই মস্কোতে ছিলেন সেটা তো সত্যি? যখন সুখারেভ মিনারে আমাদের দেখা হয়েছিল তখনই আমি ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলাম। সেকথা আপনার মনে পড়ে?

পিয়ের স্বীকার করল যে কথাটা সত্যি, তারপর প্রিন্সেস মারি ও নাতাশার প্রশ্নের টানে নিজের অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ দিতে লাগল।

মৃদু হাসি হেসে প্রিন্সেস মারি একবার পিয়েরের দিকে, একবার নাতাশার দিকে তাকাতে লাগল। গোটা বিবরণের মধ্যে সে শুধু পিয়েরের ভালোমানুষিরই পরিচয় পেল। কনুইতে ভর দিয়ে নাতাশা অবিচল মনোযোগের সঙ্গে পিয়েরকে দেখতে লাগল, বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ভাব বদলাতে লাগল, মনে হল, পিয়েরের বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে সেও যেন তার অভিজ্ঞতার অংশীদার হয়ে উঠেছে। শুধু নাতাশার চাউনি নয়, তার উচ্ছ্বাস ও ছোট ঘোট প্রশ্ন থেকেই পিয়ের বুঝতে পারল, সে যা বোঝাতে চাইছে ঠিক সেই কথাটিই নাতাশা বুঝতে পারছে। শুধু সে যা মুখে বলছে তাই নয়, যা সে বলতে চাইছে অথচ ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না সে সবকিছুই নাতাশা বুঝতে পারছে। যে শিশু ও নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে পিয়েরকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল তার বিবরণটা এইরকম: সে বড় ভয়ানক দৃশ্য-শিশুরা পরিত্যক্ত, কেউ কেউ আগুনের মধ্যে…আমার চোখের সামনে একজনকে কেড়ে নিয়ে গেল…অনেক মেয়েমানুষের মালপত্র কেড়ে নিল, কানের দুল ছিঁড়ে নিল…বলতে বলতে তার মুখ লাল হয়ে উঠল, সব কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল। তারপর একটা পাহারাদার বাহিনী এল, আর সব পুরুষদের মানে যারা লুটতরাজ করছিল না তাদের-গ্রেপ্তার করল। আমিও তাদের মধ্যে ছিলাম।

আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আপনি সব কথা বলছেন না, আপনি নিশ্চয় কিছু করেছিলেন… নাতাশা বলতে বলতে একটু থেমে যোগ করল, কোনো ভালো কাজ?

পিয়ের বলতে লাগল। মৃত্যুদণ্ডের কথা বলতে গিয়ে ভয়াবহ অংশগুলো সে বাদ দিতে চাইল, কিন্তু নাতাশা জেদ ধরল যে কিছুই বাদ দেওয়া চলবে না।

কারায়েভের কথা বলতে শুরু করে পিয়ের থেমে গেল। ততক্ষণে সে টেবিল থেকে উঠে ঘরময় পায়চারি করছে, আর নাতাশার চোখ দুটি তাকে অনুসরণ করছে। সে বলতে লাগল :

না, সেই অশিক্ষিত লোকটির কাছ থেকে-সেই সরল লোকটির কাছ থেকে আমি যা শিখেছি তা আপনারা বুঝতে পারবেন না।

নাতাশা বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলে যান! লোকটি এখন কোথায়?

 প্রায় আমার চোখের সামনেই তারা তাকে মেরে ফেলেছে।

কম্পিত গলায় পিয়ের তাদের পশ্চাদপসরণের শেষের দিনগুলি, কারায়েভের অসুস্থতা ও তার মৃত্যুর কথাগুলি বলতে লাগল।

অভিযানের যেসব কথা এতদিন মনেও আনেনি সেইসব কথাই পিয়ের তাদের শোনাল। সেই সব অভিজ্ঞতার একটু নতুন অর্থ যেন সে এখন খুঁজে পেয়েছে।

তার কথাগুলি বুঝতে পেরে প্রিন্সেস মারি তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে, কিন্তু এখন সে এমন কিছু পেয়েছে যাতে তার মনোযোগ আবিষ্ট হয়ে উঠেছে। নাতাশা ও পিয়েরের মধ্যে ভালোবাসা ও সুখের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তার অন্তর খুশিতে ভরে উঠেছে।

 সকাল তিনটে বাজল। পরিচারকরা বিষণ্ণ কঠিন মুখে এসে মোমবাতি বদলে দিয়ে গেল, কিন্তু কেউ তাদের খেয়াল করল না।

পিয়েরের গল্প শেষ হল। উজ্জ্বল চোখ মেলে উচ্ছ্বসিত মনোযোগের সঙ্গে নাতাশা তার দিকে চেয়েই রইল। মনে হল, হয় তো পিয়ের মুখে যা বলেনি এমন কোনো কথাকে সে ধরতে চেষ্টা করছে। বিব্রত লাজুক চোখে তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের ভাবতে চেষ্টা করল, কোন কথা দিয়ে আর একটা নতুন বিষয়ের অবতারণা করা যায়। প্রিন্সেস মারি নীরব। কারোরই মনে হল না যে এখন তিনটে বাজে, শুতে যাবার সময় হয়েছে।

পিয়ের বলতে শুরু করল, লোকে দুর্ভাগ্য ও কষ্টের কথা বলে, কিন্তু এইমুহূর্তে আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ তুমি কি বন্দি হবার আগে যা ছিলে তাই থাকতে চাও, না আবার এইসব কষ্টের ভিতর দিয়ে চলতে চাও? তাহলে ঈশ্বর করুন আমি যেন আবার সেই বন্দিত্ব ও ঘোড়ার মাংসই ফিরে পাই! আমরা মনে করি বাঁধা পথের বাইরে ছিটকে পড়লেই বুঝি সব গেল, কিন্তু একমাত্র তখনই তো শুরু হয় যা কিছু নতুন আর ভালো। যতক্ষণ জীবন ততক্ষণই তো সুখ। আমাদের সামনে অনেক কিছু আছে। নাতাশার দিকে ফিরে বলল, একথাটা আপনাকে বলছি।

সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর জবাবে নাতাশা বলল, ঠিক, ঠিক, গোড়া থেকে এই জীবনের মধ্যেই নতুন করে বাঁচতে চাওয়া ছাড়া আমারও আর কিছু চাওয়া উচিত নয়।

পিয়ের একাগ্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

নাতাশা বলল, হ্যাঁ, তার বেশি কিছু না।

একথা সত্যি নয়, সত্যি নয়! পিয়ের চিৎকার করে বলল। আমি যে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকতে চাই সেটা তো আমার দোষ নয়-আপনারও নয়।

হঠাৎ নাতাশা মাথা নিচু করে দু-হাতে মুখটা ঢেকে কাঁদতে লাগল।

কি হল নাতাশা? প্রিন্সেস মারি বলল।

কিছু না, কিছু না। চোখের জলের ভিতর দিয়ে নাতাশা পিয়েরের দিকে তাকিয়ে হাসল। শুভরাত্রি শুতে যাবার সময় হয়েছে।

পিয়ের উঠে বিদায় নিল।

প্রিন্সেস মারি ও নাতাশার সঙ্গে যথারীতি শোবার ঘরেই দেখা হল। পিয়েরের কথা নিয়েই তারা আলোচনা করল। পিয়ের সম্পর্কে প্রিন্সেস মারি কোনো মতামত ব্যক্ত করল না, নাতাশাও তার সম্পর্কে কিছু বলল না।

নাতাশা বলল, আচ্ছা, শুভরাত্রি মারি। তুমি কি জান, আমার প্রায়ই ভয় হয়, তার সম্পর্কে (অর্থাৎ পিয়েরের কথা) এভাবে কোনো কথা না বললে আমরা তাকে ভুলেই যাব!

যেন নাতাশার কথার সমর্থনেই প্রিন্সেস মারি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল,কিন্তু মুখে সেকথা জানাল না। বলল, ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? আজ সব কথা বলতে পেরে আমার এত ভালো লাগছে। কথাগুলি বলা শক্ত, বলতে কষ্টও হয়, তবু বলা ভালো। খুব ভালো! নাতাশা বলল। আমি নিশ্চিত জানি সে আমাকে ভালোবাসত। তাই তো সব তাকে বললাম।…ঠিক করিনি? সহসা সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

পিয়েরকে সব কথা বলা? নিশ্চয়। কী চমৎকার লোক। প্রিন্সেস মারি বলল।

নাতাশার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল। অনেকদিন তার মুখে এমন হাসি প্রিন্সেস মারি দেখেনি। হঠাৎনাতাশা বলে উঠল, তুমি কি জান মারি, যে করেই হোক সে যেন পরিচ্ছন্ন, মসৃণ ও তাজা হয়ে উঠেছে–যেন এইমাত্র একটা রুশ বাথ নিয়ে এসেছেঃ বুঝতে পারলে তো? একটা নৈতিক মানের কথাই আমি বলছি। ঠিক কি না?

প্রিন্সেস মারি জবাব দিল, ঠিক। তার অনেক উন্নতি হয়েছে।

পরনে একটা খাটো কোট, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, ঠিক যেন এইমাত্র স্নান-ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন…বাপি বলত….

কেন যে সে (প্রিন্স আন্দ্রু) তাকে অন্য সকলের চাইতে বেশি পছন্দ করত তা আমি জানি, প্রিন্সেস মারি বলল।

ঠিক, আর সে তো সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের মানুষ। লোকে বলে, ভিন্ন চরিত্রের লোকরাই বন্ধু হয়। সেকথাটা নিশ্চয় ঠিক। সত্যি, সে তো সম্পূর্ণ অন্য রকম–সবদিক থেকেই।

ঠিক, কিন্তু সে এক আশ্চর্য মানুষ।

আচ্ছা, শুভরাত্রি, নাতাশা বলল।

সেই একই দুষ্টুমির হাসি অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখের উপর লেগে রইল।

.

অধ্যায়-১৮

সে রাতে পিয়েরের ঘুম আসতে অনেক দেরি হল। ঘরময় পায়চারি করল, কখনো কোনো কঠিন সমস্যার চিন্তায় ভুরু কোঁচকাল, কখনো মুখ বেঁকিয়ে দু কাঁধে ঝাঁকুনি দিল, কখনো বা খুশিতে হেসে উঠল।

ভাবতে লাগল প্রিন্স আন্দ্রুর কথা, নাতাশার কথা, তাদের ভালোবাসার কথা,কখনো অতীতের জন্য মনে ঈর্ষা দেখা দিল, আবার সে মনোভাবের জন্য পরমুহূর্তে নিজেকেই ভর্ৎসনা করল। ছয়টা বেজে গেল। তখনো সে ঘরময় পায়চারিই করছে।

 আচ্ছা, এটা যদি অনিবার্যই হয় তাহলে আর কি করা যাবে? কি আর করা যাবে? নিশ্চয়ই এটাই ঘটবে। কথাগুলি নিজেকেই বলে সে তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে শুতে গেল, মনটা খুশি ও উত্তেজিত, কিন্তু সব রকম ইতস্তত ভাব থেকে মুক্ত।

কয়েকদিন আগে পিয়ের স্থির করেছিল শুক্রবার পিটার্সবুর্গে যাবে। বৃহস্পতিবারে সে যখন ঘুম থেকে উঠল তখন সাভেলিচ এসে জানতে চাইল যাত্রার জন্য বাঁধাছাদা করবে কি না।

কি, পিটার্সবুর্গে? পিটার্সবুর্গে কেন? পিটার্সবুর্গে কে আছে? যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল। ভাবল, ও হ্যাঁ, এই ঘটনার অনেক আগে কোনো কারণে পিটার্সবুর্গে যেতে চেয়েছিলাম বটে। কেন? কিন্তু হয় তো আমাকে যেতেই হবে। বুড়ো সাভেলিচের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, লোকটি কত ভালো, সব দিকে নজর, সব কথা মনে রাখে। আর হাসিটিও কত সুন্দর!

পিয়ের তাকে শুধাল, আচ্ছা সাভেলিচ, তুমি কি মুক্তি পেতে চাও না?

আমার কাছে মুক্তির কি দাম ইয়োর এক্সেলেন্সি? আমরা স্বৰ্গত কাউন্টের–তাঁর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটুক–অধীনে কাজ করেছি, আবার আপনার অধীনেও কাজ করছি, কিন্তু কোনোদিন তো আমাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হয়নি।

আর তোমার ছেলেমেয়েরা?

ছেলেমেয়েরাও এইভাবেই কাটিয়ে দেবে। এমন মনিবের অধীনে বেঁচে থাকা চলে।

পিয়ের বলল, কিন্তু আমার বংশধরদের বেলায়? ধর আমি হঠাৎ বিয়ে করলাম…তাও তত হতে পারে। তার মুখে ঈষৎ হাসি।

ইয়োর এক্সেলেন্সি যদি অনুমতি দেন তো বলি, তাহলে তো খুব ভালো হয়।

পিয়ের ভাবল, ব্যাপারটাকে সে কত সহজ মনে করছে। সে জানে না কাজটা কত সাংঘাতিক, কত বিপজ্জনক। আজ হোক, কাল হোক…কাজটা সাংঘাতিক।

তাহলে কি হুকুম হয়? কাল রওনা দিচ্ছেন তো? সাভেলিচ শুধাল।

না, আপাতত স্থগিত রাখছি। তোমাকে পরে বলব। তোমার অসুবিধা ঘটালাম বলে ক্ষমা কর, পিয়ের বলল, সাভেলিচকে হাসতে দেখে ভাবল : কী আশ্চর্য যে লোকটা বুঝতে পারছে না আমার কাছে এখন পিটার্সবুর্গ বলে কিছু নেই, সকলের আগে সেই ব্যবস্থাটা পাকা করতে হবে। কিম্বা হয় তো ও সবই জানে, শুধু না জানার ভান করছে। একটু কথা বলে দেখব নাকি ও কি ভাবছে? না, অন্য সময় হবে।

প্রাতরাশের সময় পিয়ের তার দিদি প্রিন্সেসকে বলল যে আগের দিন সে প্রিন্সেস মারির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, আর সেখানেই দেখা হয়েছিল- কার সঙ্গে বল তো? নাতাশা রস্তভার সঙ্গে?

তার সঙ্গে যদি আন্না সেমেনভনার দেখা হত তার চাইতে এটা অসাধারণ কি যে হল সেকথা প্রিন্সেস বুঝতেই পারল না।

তুমি তাকে চেন? পিয়ের শুধাল।

সেসময় তার সেই ব্যাপারটার কথা শুনেছিলাম। খুবই দুঃখের কথা।

পিয়ের ভাবল, না, এ হয় কিছু জানে না, আর নয়তো না জানার ভান করছে। একে কোনো কথা না বলাই ভালো।

প্রিন্সেসও পিয়েরের যাত্রার জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিল।

পিয়ের ভাবল, এরা সকলেই কত সদয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে সব বিষয়ের প্রতি এখন আর তাদের কোনো আগ্রহ থাকতে পারে না তা নিয়ে এরা মাথা ঘামাচ্ছে কেমন করে।

সেইদিনই পুলিশের বড় কর্তা এসে পিয়েরকে জানিয়ে গেল, যেসব মাল উদ্ধার করা হয়েছে সেইদিনই ক্রেমলিন প্রাসাদ থেকে সেগুলি মালিকদের ফেরৎ দেওয়া হবে, কাজেই সে যেন মাল আনতে একজন প্রতিনিধিকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশের বড় কর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে পিয়ের ভাবল, আর এই লোকটিও। অফিসারটি কত ভালো, কী সুন্দর দেখতে, আর কত সদয়! লোকটি যে এই তুচ্ছ জিনিস নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে সেকথা ভাবা যায়! অথচ লোকে বলে লোকটি সৎ নয়, ঘুষ খায়। যত সব বাজে কথা। তাছাড়া ঘুষ খাবে না কেন? এইভাবেই তো সে মানুষ হয়েছে, আর একাজ তো সকলেই করে। কিন্তু কি সদয় ও খুশি মাখানো মুখ, আর আমার দিকে তাকিয়ে কেমন হাসছে।

পিয়ের প্রিন্সেস মারির বাড়ি গেল ডিনার খেতে।

পোড়া বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেই ধ্বংসস্তূপের সৌন্দর্য দেখে সে বিস্মিত হল। শহরের পোড়া বাড়িগুলোর চিমনির তূপ আর ভেঙেপড়া দেয়ালের বহুদূর প্রসারিত মনোরম সৌন্দর্য দেখে তার মনে পড়ে গেল রাইনের কথা, রোমের কলসিয়ামের কথা। পথে যেসব কোচয়ান ও তার সওয়ারিদের সঙ্গে দেখা হল, যে ছুতোর মিস্ত্রিরা নতুন বাড়ি তৈরি করার জন্য কুড ল দিয়ে কাঠ কাটছে, ফেরিওয়ালী ও দোকানিরা–সকলেই যেন সানন্দ উজ্জ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলছে, আহা! এই তো তিনি এসেছেন! দেখা যাক এবার কি হয়!

প্রিন্সেস মারির বাড়ির ফটকে পৌঁছে পিয়েরের মনে সন্দেহ জাগল, সত্যি কি সে কাল রাতে এখানে এসেছিল, সত্যি কি নাতাশার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, তার সঙ্গে কথা বলেছিল। হয় তো সবই আমার কল্পনা, হয়তো ভিতরে ঢুকে দেখব তারা কেউ নেই। কিন্তু ঘরে ঢোকা মাত্রই সমগ্র সত্তা দিয়ে সে নাতাশার উপস্থিতিকে অনুভব করল, নিজের সব স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলল। আগের দিনের মতোই সেই কালো পোশাক তার পরনে, সেই একইভাবে চুল বাঁধা, তবু সে আজ কত আলাদা। আগের দিন ঘরে ঢুকেও তাকে যদি এইরূপেই দেখত তাহলেও পিয়ের মুহূর্তের জন্য তাকে চিনতে ভুল করত না।

শৈশবে এবং পরে প্রিন্স আন্দ্রুর বাগদত্তা হিসেবে সে তাকে যেরূপে চিনত নাতাশা এখন সেইরূপেই উপস্থিত। তার দু চোখে একটা জিজ্ঞাসু আলোর ঝিলিক,তার মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিচিত্র দুষ্টুমি ভরা ভাব।

পিয়ের তাদের সঙ্গে ডিনার খেল, হয়তো সারাটা সন্ধ্যা তাদের সঙ্গেই কাটাত, কিন্তু প্রিন্সেস মারি সান্ধ্য উপাসনায় যোগ দিতে যাবে বলে তার সঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

পরদিন সে সকাল-সকাল এল, ডিনার খেল, সারা সন্ধ্যা সেখানে কাটাল। যদিও অতিথিকে পেয়ে প্রিন্সেস মারি ও নাতাশা দুজনই খুশি, যদিও পিয়েরের সব আগ্রহ এখন এই বাড়িটাতে কেন্দ্রীভূত, সন্ধ্যা নাগাদ তাদের সব কথাই বলা হয়ে গেল, আলোচনা ক্রমেই একটা তুচ্ছ বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে লাগল এবং বার বার ভেঙে যেতে লাগল। পিয়ের এত বেশি সময় সেখানে থাকল যে প্রিন্সেস মারি ও নাতাশার মধ্যে দৃষ্টি-বিনিময় শুরু হয়ে গেল, যেন তারা ভাবছে লোকটি কখন উঠবে। পিয়ের সেটা লক্ষ্য করেও চলে যেতে পারল না। সেও অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হল, কিন্তু তবু বসেই রইল, কারণ উঠে বিদায় নেবার শক্তি তার নেই।

প্রিন্সেস মারি যখন বুঝল যে এ বসে থাকার কোনো শেষ নেই তখন সেই প্রথমে উঠে দাঁড়াল, এবং মাথা ধরার কথা বলে শুভরাত্রি জানাল।

শুধাল, তাহলে আপনি তো কালই পিটার্সবুর্গ যাচ্ছেন?

যেন কিছুটা আহত হয়েছে এমনি বিস্মিত গলায় পিয়ের তাড়াতাড়ি জবাব দিল, না, আমি যাচ্ছি না। হ্যাঁ…না…. পিটার্সবুর্গ তো? কাল–কিন্তু এখনই শুভরাত্রি জানাচ্ছি না। আপনাদের যদি কোনো দরকার থাকে তো আবার একবার আসব। প্রিন্সেস মারির সামনে দাঁড়িয়ে মুখ লাল করে সে কথাগুলি বলল, কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না।

নাতাশা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রিন্সেস মারি কিন্তু বেরিয়ে গেল না, একটা হাতল-চেয়ারে বসে গভীর উজ্জ্বল চোখে কঠোর একাগ্রদৃষ্টিতে পিয়েরের দিকে তাকাল। যে ক্লান্তি দেখা দিয়েছিল তার মুখে সেটা এখন সম্পূর্ণ চলে গেছে। একটা গভীর টানা নিঃশ্বাস ছেড়ে সে যেন দীর্ঘ আলোচনার জন্য প্রস্তুত হল।

নাতাশা ঘর থেকে চলে যেতেই পিয়েরের বিব্রত ভাবটা চলে গেল, সেখানে দেখা দিল অধীর উত্তেজনা। তাড়াতাড়ি একটা হাতল-চেয়ার প্রিন্সেস মারির কাছে টেনে নিল।

তার দৃষ্টির জবাবেই যেন বলতে লাগল, হ্যাঁ, আপনাকে বলতেই চাইছিলাম। প্রিন্সেস, আপনি আমাকে সাহায্য করুন! আমি কি করব? আমি কি আশা করতে পারি? প্রিন্সেস, প্রিয় বান্ধবী আমার, শুনুন! আমি সব কথা জানি। আমি জানি আমি তার যোগ্য নই, জানি এখন এসব কথা বলা অসম্ভব। কিন্তু আমি তার দাদা হতে চাই। না, তা নয়, আমি চাই না, আমি পারি না…..

কথা থামিয়ে সে দুহাতে মুখ ও চোখ ঘষতে লাগল।

চেষ্টা করে নিজেকে সংযত করে সে আবার বলল, দেখুন, কখন যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি তা আমি জানি না, কিন্তু সারাজীবন আমি ওকেই ভালোবেসেছি, একমাত্র ওকে ওকে এত ভালোবেসেছি যে ওকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। বর্তমানে তার কাছে আমি বিয়ের প্রস্তাব করতে পারি না, কিন্তু হয় তো একদিন সে আমার স্ত্রী হতে পারে এবং আমি হয় তো সে সম্ভাবনাকে….সে সম্ভাবনাকে….হারিয়ে ফেলতে পারি, এই চিন্তাই আমার কাছে মর্মান্তিক। বলুন, আমি কি আশা করতে পারি? প্রিয় প্রিন্সেস, বলুন আমি কি করব! কোনো জবাব না পেয়ে পিয়ের তার হাতটা স্পর্শ করল।

প্রিন্সেস মারি জবাব দিল, আপনি যা বললেন সেই কথাটাই আমি ভাবছি। আমার বক্তব্য শুনুন। আপনি ঠিকই বলেছেন যে এসময় তার কাছে ভালোবাসার কথা বলা….

প্রিন্সেস মারি থামল। সে বলতে যাচ্ছিল যে তার কাছে ভালোবাসার কথা বলা অসম্ভব, কিন্তু সে থেমে গেল কারণ দুদিন আগে নাতাশার আকস্মিক পরিবর্তন দেখে সে বুঝেছে যে পিয়ের যদি তাকে ভালোবাসার কথা বলে তাহলে সে আঘাত তো পাবেই না, বরং সেই জিনিসটিই সে এখন চাইছে।

তবু প্রিন্সেস বলল, এখন সেকথা বললে কিছু হবে না।

কিন্তু আমি কি করব?

সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন, প্রিন্সেস মারি বলল। আমি জানি…

পিয়ের প্রিন্সেস মারির চোখের দিকেই তাকিয়েছিল।

 বলল, তারপর?….তারপর?

কথাগুলি প্রিন্সেস মারির মুখ থেকে বের হবার আগেই পিয়ের লাফিয়ে উঠল, ভয়ার্ত মুখে তার হাতটা চেপে ধরল।

কিসের থেকে আপনি একথা ভাবছেন? আপনি মনে করেন যে আমি আশা করতে পারি? আপনি…মানে,

প্রিন্সেস মারি হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। ওর বাবা-মার কাছে চিঠি লিখুন, আর ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন। সুবিধামতো আমি ওকে বলব। আমিও চাই এটা ঘটুক। আমার মন বলছে এটা ঘটবে।

না, এ হতে পারে না আমি কত সুখী! কিন্তু এ হতে পারে না…আমি কত সুখী! এ হতে পারে না! প্রিন্সেস মারির হাতে চুমো খেয়ে পিয়ের বারবার বলতে লাগল।

প্রিন্সেস মারি বলল, আপনি পিটার্সবুর্গ চলে যান। সেটাই সবচাইতে ভালো হবে। আমি আপনাকে লিখব।

পিটার্সবুর্গে? চলে যাব? বেশ, তাই যাব। কিন্তু কাল আবার আসতে পারি তো?

পরদিন পিয়ের বিদায় নিতে এল। আজ নাতাশা আগের দিনের মতো ততটা প্রাণ-চঞ্চল নয়, কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে পিয়রের মনে হল সে বুঝি নিজেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন তাদের কারো কোনো অস্তিত্ব নেই, একমাত্র সুখ ছাড়া আর কিছু নেই। প্রতিটি চাউনি,প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি কথা তার অন্তরকে আনন্দে ভরে তুলল, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল, এও কি সম্ভব? না, এ হতে পারে না।

বিদায় নেবার সময় নাতাশার শীর্ণ নরম হাতখানি ধরে বেশ কিছু সময় নিজের হাতের মধ্যে না রেখে সে পারল না।

এও কি সম্ভব যে এই হাত, ওই দুটি চোখ, নারীর সৌন্দর্যের এই রত্নভাণ্ডার যা আজ আমার কাছে এত অপরিচিত তাই একদিন চিরদিনের মতো আমার হবে, আমার নিজের মতোই একান্ত পরিচিত হবে?… না, সে অসম্ভব.?

বিদায় কাউন্ট, কথাটা উঁচু গলায় বলে তারপর ফিসফিস করে নাতাশা বলল, আপনার ফিরে আসার জন্য আমি উৎকণ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করে থাকব।

আর এই কয়েকটি সহজ কথা, তার চাউনি, তার মুখের ভাব–সবই দুটি মাস ধরে পিয়েরের কাছে হয়ে রইল অক্ষয় স্মৃতি, ব্যাখ্যা ও সুখ-চিন্তার বিষয়। আপনার ফিরে আসার জন্য আমি উত্তষ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করে থাকব…হাঁ, হ্যাঁ, কেমন করেই না সে কথাগুলি বলল? হ্যাঁ, আপনার ফিরে আসার জন্য আমি উত্তপ্ত হয়ে অপেক্ষা করে থাকব। আহা, আমি আজ কত সুখী! আমার ভাগ্যে কি ঘটছে? আমি কত সুখী! পিয়ের আপন মনেই বলতে লাগল।

.

অধ্যায়-১৯

হেলেনের সঙ্গে পূর্বরাগের সময় যা কিছু পিয়েরকে বিপন্ন করে তুলেছিল তার কিছুই এখন পিয়েরের অন্তরে নেই। একটা লজ্জাবোধ থেকে তাকে কখনো একবার বলা কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে হয়নি, অথবা বলতে হয়নি, আহা, ও কথাটা কেন বললাম না? অথবা কেনই বা আমাকে বলতে হল fe vous aime? উল্টে সে বা নাতাশা যা বলেছে তার প্রতিটি কথা সে এখন কল্পনায় পুনরাবৃত্তি করে, নাতাশার মুখ ও তার হাসির প্রতিটি ছবি মনে মনে নতুন করে আঁকে, কিছুই বাদ দিতে বা যোগ করতে চায় না, শুধুই বারবার তার পুনরাবৃত্তি করে। যেপথে থেকেছে সেটা ঠিক কি ভুল সে বিষয়ে সন্দেহের ছায়ামাত্র এখন তার মনে নেই। শুধু মাঝে মাঝে একটা ভয়ংকর সন্দেহ তার মনের মধ্যে উঁকি দেয় : এইসব স্বপ্ন নয় তো? প্রিন্সেস মারি ভুল করেনি তো? আমি নিজেই বড় বেশি অহংকারী বা আত্মবিশ্বাসী নই তো? আমি এসবই বিশ্বাস করছি, আর হঠাৎ একদিন প্রিন্সেস মারি তাকে কথাটা বলবে আর সে হেসে বলবে : কি আশ্চর্য! তিনি নিশ্চয় নিজেকে ভুল বুঝিয়েছেন। তিনি কি জানেন না যে তিনি একজন পুরুষ মানুষ, শুধুই মানুষ, আর আমি…? আমি তো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও মহত্তর কিছু।

এই একটি মাত্র সন্দেহ প্রায়ই পিয়েরকে বিপন্ন করে তোলে। সে এখন কোনো পরিকল্পনা করে না। আসন্ন সুখটা তার কাছে এতই ধারণার অতীত বলে মনে হয় যেন সেটা পেলেই সবকিছুর অবসান ঘটবে। তার সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছুর অবসান। একটা অপ্রত্যাশিত আনন্দের বিকার তাকে পেয়ে বসেছে। তার মনে হচ্ছে, তার ভালোবাসা এবং নাতাশার ভালোবাসা পাবার সম্ভাবনা–এই দুইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে জীবনের অর্থ–শুধু তার নয়, সমগ্র জগতের। কখনো কখনো তার মনে হয়, সকলেই যেন তার ভবিষ্যৎ সুখ নিয়েই মত্ত হয়ে আছে। আবার কখনো মনে হয়, অন্য সকলেই তার মতো সুখী, শুধু অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার ভান করে সে সুখকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে। প্রতিটি কথায় ও ভঙ্গিতে তার নিজের সুখের উল্লেখই সে দেখতে পায়।

যখন তাকে বলা হত যে তার সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়া উচিত, অথবা যখন যুদ্ধ বা অন্য কোনো রাজনীতির বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হত যে এইসব ঘটনার ফলাফলের উপরেই সকলের কল্যাণ নির্ভর করছে, তখন সে করুণার হাসি হেসে সেসব কথা শুনত, আর বিচিত্র সব মন্তব্য করে সকলকে অবাক করে দিত। কিন্তু এখন যারা জীবনের অর্থ বোঝে বলে সে মনে করে এবং সে দুর্ভাগারা তা বোঝে না তাদের প্রত্যেককেই সে দেখে নিজ অন্তরের আবেগের উজ্জ্বল আলোয়, আর সঙ্গে সঙ্গে অতি সহজে প্রত্যেকের মধ্যেই সে দেখতে পায় যা কিছু ভালো, যা কিছু ভালোবাসার যোগ্য।

মৃতা স্ত্রীর ব্যাপার ও কাগজপত্র নিয়ে আলোচনার সময় তা তার স্মৃতি পিয়েরের মনে একমাত্র করুণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি জাগায় না–আজ সে যে আনন্দের স্বাদ পেয়েছে তার সন্ধান সে বেচারি জানত না বলেই তার জন্য পিয়েরের করুণা হয়। প্রিন্স ভাসিলি ইতিমধ্যে নতুন পদমর্যাদা পেয়েছে, কয়েকটা নতুন সম্মান-পদকও লাভ করেছে, তাই এখন সে বেশ গর্বিত, অথচ পিয়েরের চোখে সেই শোচনীয় সদয় বৃদ্ধটি একান্ত করুণার পাত্র।

পরবর্তী জীবনে এই সময়কার সুখময় উন্মত্ততার কথা প্রায়ই পিয়েরের মনে পড়ত। এইসময় নানা মানুষ ও ঘটনার যে অর্থ তার মনে গড়ে উঠেছিল তা চিরদিন তার কাছে সত্য হয়েই ছিল। পরবর্তীকালে সে সব ধারণাকে সে পরিত্যাগ তো করেইনি, বরং যখনই মনে কোনো সন্দেহ বা বিরোধ দেখা দিত তখনই সে এই উন্মাদনার সময়কার মতামত দিয়ে তার বিচার করত, আর সব সময় পূর্বেকার সিদ্ধান্তগুলিই সঠিক প্রমাণিত হত।

যে ভাবত, তখন আমাকে হয়ত বিচিত্র ও অদ্ভুত মনে হত, কিন্তু আমাকে যতটা পাগল বলে মনে হত আমি ততটা পাগল ছিলাম না। বরং অন্য যে-কোনো সময়ের তুলনায় তখনই আমি ছিলাম বিজ্ঞতর, আমার অন্তর্দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণতর, এবং জীবনে যা কিছু জানার যোগ্য সবই জেনেছিলাম, কারণ…কারণ তখন আমি সুখী ছিলাম।

 মানুষকে ভালোবাসার আগেই তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে–যাকে সে বলত সৎ গুণাবলি–আবিষ্কার করার ব্যাপারে সে যে অপেক্ষা করে থাকত না এটাই ছিল পিয়েরের পাগলামি, এখন তার অন্তর ভালোবাসায় দু-কূল ছাপিয়ে গেছে, আর অকারণে মানুষকে ভালোবেসে তাদের ভালোবাসার সন্দেহাতীত কারণগুলি সে খুঁজে পেয়েছে।

.

অধ্যায়-২০

সেই প্রথম সন্ধ্যায় নাতাশা যখন সানন্দ তামাশার সুরে প্রিন্সেস মারিকে পিয়ের সম্পর্কে বলেছিল, ওকে দেখে মনে হচ্ছে বুঝি এই মাত্র রুশ বাথ থেকে বেরিয়ে এসেছেন-পরনে একটা খাটো কোট, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, তখন পিয়ের চলে যাবার পরে নাতাশার অন্তরের মধ্যে জেগে উঠেছিল অজ্ঞাতপূর্ব ও লুকনো এমন কিছু যাকে কিছুতেই চেপে রাখা যায় না।

তার মুখ, হাঁটা-চলা, চাউনি, কণ্ঠস্বর, সবকিছু সহসা বদলে গেল। সবিস্ময়ে সে অনুভব করল, একটা জীবনী-শক্তি ও সুখের আশা জেগে উঠে প্রকাশের পথ খুঁজছে। সেই সন্ধ্যা থেকেই অতীত জীবনের সবকিছু যেন সে ভুলে গেল। জীবনের অবস্থা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, অতীত সম্পর্কে একটি কথাও বলে না, ভবিষ্যতের কোনো সুখের পরিকল্পনা করতেও আর ভয় পায় না। পিয়ের সম্পর্কে অতি সামান্য কথাই বলে, কিন্তু প্রিন্সেস মারি যখন তার কথা উল্লেখ করে তখনই একটা দীর্ঘ-নির্বাপিত আলো জ্বলে ওঠে তার চোখে, ঠোঁট দুটি বেঁকে যায় একটি বিচিত্র হাসিতে।

নাতাশার এই পরিবর্তন দেখে প্রথম প্রথম প্রিন্সেস মারি বিস্মিত হত: কিন্তু পরে তার অর্থ বুঝতে পেরে সে দুঃখ পায়। এই পরিবর্তনের কথা মনে এলেই সে ভাবে : তাহলে কি আমার দাদার প্রতি তার ভালোবাসা এতই সামান্য ছিল যে এত শীঘ্রই তাকে ভুলে গেল? কিন্তু নাতাশা কাছে এলে সে মোটেই বিরক্ত হয় না, কোনোরকম অনুযোগও করে না। জীবনের যে নবজাগ্রত শক্তি নাতাশাকে গ্রাস করেছে সেটা তার কাছে এতই অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রত্যাশিত যে তার উপস্থিতিতে প্রিন্সেস মারিও অনুভব করে যে অন্তর থেকে নাতাশাকে তিরস্কার করার কোনো অধিকারই তার নেই।

এত পরিপূর্ণ ও খোলাখুলিভাবে এই নতুন অনুভূতির কাছে নাতাশা নিজেকে সঁপে দিয়েছে যে তার যে আর কোনো দুঃখ নেই, তার অন্তর যে এখন আনন্দে উজ্জ্বল এ সত্যকে লুকোবার কোনো চেষ্টাই সে করে না।

পিয়েরের সঙ্গে নৈশ আলোচনা শেষ করে প্রিন্সেস মারি যখন নিজের ঘরে ফিরে গেল তখন দরজার মুখেরই তার সঙ্গে নাতাশার দেখা হয়ে গেল।

সে কথা বলেছে? সত্যি কথা বলেছে? সে বারবার প্রশ্ন করল।

একটা আনন্দের অথচ দুঃখের প্রকাশ নাতাশার মুখে স্থির হয়ে রইল, এই আনন্দ টুকুর জন্যও যেন সে ক্ষমা প্রার্থনা করছে।

দরজায় কান পেতে শুনতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু আমি জানতাম তুমি আমাকে বলবে।

নাতাশার এই একাগ্র দৃষ্টির অর্থ প্রিন্সেস মারি বুঝল, তাতে অভিভূতও হল, তবু নাতাশার এই উত্তেজনা তাকে দুঃখ দিল, তার কথাগুলি তাকে ব্যথা দিল। প্রিন্সেস মারির মনে পড়ল দাদার কথা, তার ভালোবাসার কথা।

ভাবল, কিন্তু কি আর করা যাবে? ও তো নিরুপায়।

তারপর বিষণ্ণ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিয়েরের সব কথা সে নাতাশাকে বলল। পিয়ের পিটার্সবুর্গ চলে যাচ্ছে শুনে নাতাশা স্তম্ভিত হয়ে গেল।

যেন বুঝতে পারেনি এমনিভাবে বলে উঠল, পিটার্সবুর্গে!

কিন্তু প্রিন্সেস মারির মুখে বেদনার ছায়া লক্ষ্য করে তার এই দুঃখের কারণটি অনুমান করে নাতাশা সহসা কাঁদতে লাগল।

বলল, মারি, তুমিই বলে দাও আমি কি করব! ভয় হচ্ছে আমি বুঝি খারাপ হয়ে যাব। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। আমাকে বলে দাও…

তুমি তাকে ভালোবাস?

 হ্যাঁ, নাতাশা ফিসফিসিয়ে বলল।

তাহলে কাঁদছ কেন? তোমাকে নিয়ে তো আমিও সুখী, প্রিন্সেস মারি বলল, নাতাশার চোখে জল দেখে তার আনন্দকে সে ক্ষমা করেছে।

এখনই কিছু হচ্ছে না-একদিন হবে। ভাব তো, যখন আমি তার স্ত্রী হব আর তুমি নিকলাসকে বিয়ে করবে তখন কী মজাই না হবে!

নাতাশা, তোমাকে তো বলেছি ওকথা তুলবে না। এস, তোমার কথাই হোক। দুজনই চুপ করে গেল।

কিন্তু পিটার্সবুর্গে যাবে কেন? হঠাৎ প্রশ্ন করে নাতাশা তাড়াতাড়ি নিজেই তার জবাব দিল। কিন্তু না, না, তাকে যেতেই হবে…হ্যাঁ মারি। সে অবশ্যই যাবে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *