০১.৩ রস্তভদের নাচ-ঘরে

অধ্যায়-২১

রস্তভদের নাচ-ঘরে যখন দু-নম্বর নাচ চলছিল, ক্লান্ত বাজনাদাররা ভুল করছিল, আর শ্রান্ত পরিচারক ও রাঁধুনিরা রাতের খাবারের আযোজন করছিল, সেই সময় কাউন্ট বেজুখভের ষষ্ঠবার রোগের আক্রমণ হলো। ডাক্তাররা জানিয়ে দিল, নিরাময় অসম্ভব। নীরব দোষ-স্বীকৃতির পরে মুমূর্ষ লোকটির শেষ ভোজনানুষ্ঠান করা হলো, তৈল লেপন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়; এই সমস্ত অনুষ্ঠানের সময় সাধারণতই যা হয়ে থাকে, বাড়িতে একটা হট্টগোল ও উৎকণ্ঠা চলতে লাগল। বাড়ির বাইরে ফটকের ওপাশে একদল মুদাফরাস হাজির আছে; কোনো গাড়ি এলেই তারা লুকিয়ে পড়ছে; আসলে একটা ব্যয়বহুল অন্ত্যেষ্টির নির্দেশের আশায় তারা অপেক্ষা করে আছে। মস্কোর সামরিক শাসনকর্তা কাউন্টের স্বাস্থ্যের খবর নিতে এতদিন পর্যন্ত বরাবর এড-ডি-কংকেই পাঠিয়ে এসেছে; ক্যাথারিনের দরবারের বিখ্যাত প্রবীণ সদস্য কাউন্ট বেজুখভকে শেষ বিদায় জানাতে আজ সন্ধ্যায় সে নিজেই এসেছে।

জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা ঘরটিতে ভিড় জমে গেছে। মুমূর্ষ লোকটির পাশে নির্জনে প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়ে সামরিক শাসনকর্তা যখন বেরিয়ে এল তখন সকলেই সম্ভমে উঠে দাঁড়াল। কোনোরকমে তাদের অভিবাদকে স্বীকৃতি জানিয়ে এবং তা তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার, পুরোহিত ও পরিবারের আত্মীয়স্বজনের স্থির দৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টায় সামরিক শাসনকর্তা চলে গেল। গত কয়েকদিনেই প্রিন্স ভাসিলি কিছুটা শুকিয়ে গেছে। বিবর্ণ হয়ে গেছে; নিচু গলায় সামরিক শাসনকর্তার কানে কানে বারকয়েক কি যেন বলতে বলতে সে ফটক পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিল।

সামরিক শাসনকর্তা চলে গেলে প্রিন্স ভাসিলি এক পায়ের উপর অপর পাটা তুলে, হাঁটুর উপর কনুই রেখে হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে একাকি নাচ-ঘরের একটা চেয়ারে বসে পড়ল। সেইভাবে কিছুক্ষণ বসে থেকে সে উঠে দাঁড়াল, ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকাল, তারপর অস্বাভাবিক দ্রুত পা ফেলে লম্বা করিডরটা পেরিয়ে বাড়ির পিছন দিককার বড় প্রিন্সেসের ঘরের দিকে চলে গেল।

স্বল্পালোকিত অভ্যর্থনা-ঘরে যারা বসেছিল তারা ফিসফিস করে কথা বলছে। যখনই কেউ মুম্ষ লোকটির ঘরে ঢুকছে বা বেরিয়ে আসছে তখনই তারা দরজা খোলার সামান্য কাঁচ-কাঁচ শব্দ শুনেই চুপ হয়ে যাচ্ছে, আর কৌতূহল ও প্রত্যাশার দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকাচ্ছে।

মানব জীবনের সীমা তো…নির্দিষ্ট; তাকে পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে, বুড়ো পুরোহিত একজন মহিলাকে বলল; মহিলাটি তার পাশেই বসে সরলভাবে তার কথা শুনছিল।

তৈললেপন অনুষ্ঠানের কি বিলম্ব যাচ্ছে না? মহিলাটি শুধাল।

আহা মাদাম, সেটা তো খুব বড় অনুষ্ঠান, টাক মাথার যৎসামান্য জটাধা চুলে হাত বুলোতে বুলোতে পুরোহিত বলল।

ঘরের অপর দিকের কে একজন জিজ্ঞাসা করল, উনি কে? সামরিক শাসনকর্তা স্বয়ং কেমন যুবকের মতো দেখতে।

হ্যাঁ, তার বয়স ষাটের উপর। শুনলাম, কাউন্ট নাকি এখন কাউকে চিনতে পারছেন না? তারা তো তৈললেপন অনুষ্ঠানটা করে ফেলতে চাইছে।

আমি এমন লোকের কথাও শুনেছি যার সাতবার তৈললেপন অনুষ্ঠান হয়েছিল।

মেজ প্রিন্সেস এইমাত্র রোগীর ঘর থেকে এসেছে। কেঁদে কেঁদে তার চোখ লাল হয়ে গেছে। সে ডা. লোরেনের পাশে গিয়ে বসল। ক্যাথারিনের প্রতিকৃতির নিচে টেবিলের উপর কনুইতে ভর দিয়ে ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বসে ছিল।

আবহাওয়া সম্পর্কে একটা প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার বলল, সুন্দর। আবহাওয়া সুন্দর প্রিন্সেস, তাছাড়া, মস্কোতে থাকলে মনে হয় যেন গ্রামদেশেই আছি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে প্রিন্সেস বলল, সত্যি তাই। তাহলে ওঁকে কিছু পানীয় দেওয়া যেতে পারে কী?

লোরেন ভাবতে লাগল।

ওষুধ খেয়েছেন কি?

হ্যাঁ।

ডাক্তার ঘড়ি দেখল।

এক গ্লাস ফুটানো জলের মধ্যে এক চিমটে লবণ মিশিয়ে দেবেন,; এক চিমটে বলতে কি বোঝায় তাও সে দুটো আঙুলের ডগা দিয়ে বুঝিয়ে দিল।

জনৈক জার্মান ডাক্তার একজন এড-ডি-কংকে বলল, তৃতীয় আক্রমণের পর কোনো রোগী বেঁচে আছে এরকম দেখা যায় নি।

এড-ডি-কং বলল, অথচ কত হিসাবমতো তিনি চলতেন, আর তার শরীরটাও কত ভালো ছিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে হবে?

জার্মানটি, হেসে বলল, তার জন্য লোকের অভাব হবে না।

লোরেনের নির্দেশ মতো পানীয় তৈরি করে মেজ প্রিন্সেস ঘরে ঢুকল; দরজায় শব্দ হতেই সকলে আর একবার দরজার দিকে চোখ ফেরাল। জার্মান ডাক্তারটি লোরেনের কাছে উঠে গেল।

জার্মানটি খারাপ উচ্চারণে ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি মনে করেন উনি সকাল পর্যন্ত বাঁচবেন?

লোরেন ঠোঁট বেঁকিয়ে একটা আঙুলকে না-সূচকভাবে জোরে জোরে নাড়তে লাগল।

নিচু গলায় বলল, আজ রাতেই তার পরে নয়। সে যে রোগীর অবস্থা সঠিক বুঝতে পেরেছে এবং বলতে পেরেছে এই আত্মতৃপ্তিকে শিষ্টাচারসম্মত হাসি হেসে সে সরে গেল।

এদিকে প্রিন্স ভাসিলি দরজা কুলে প্রিন্সেসের ঘরে ঢুকল।

ঘরের ভিতরটা প্রায় অন্ধকার; দেবমূর্তির সামনে দুটো ছোট বাতি শুধু জ্বলছে; ঘরময় ফুল ও ধূপের গন্ধ। ছোট ঘোট আসবাব, হোয়াট-নট, ক্যাবার্ড ও ছোট টেবিল ছড়িয়ে আছে। পর্দার ওপাশে একটা উঁচু, সাদা পালকের বিছানা চোখে পড়ছে। একটা ছোট কুকুর ডাকতে শুরু করল।

কে দাদা?

প্রিন্সেস উঠে চুলটা ঠিক করল; অবশ্য তার চুল বেশ পরিপাটিই ছিল। কিছু কি ঘটেছে? সে জিজ্ঞাসা করল। আমার এত ভয় করছে।

ক্লান্তভাবে চেয়ারে বসে পড়ে প্রিন্স আস্তে বলল, না, কোনো পরিবর্তন নেই। আমি এসেছি তোমার সঙ্গে একটু কাজের কথা বলতে কাতিচে। ঘরটা কিন্তু বেশ গরম রেখেছ, সে কথা বলতেই হবে। আরে বস, একটু কথা বলা যাক।

মুখের কঠোর ভাবের কোনো পরিবর্তন না করেই প্রিন্সেস বলল, আমি ভাবলাম বুঝি কিছু একটা ঘটেছে। একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।

প্রিন্সেসের হাতটা ধরে অভ্যাসমতো সেটাকে নিচের দিকে বেঁকিয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলল, তাহলে বোন?

এই তাহলের অর্থ যে দুজনই ভালো বোঝে সেটা বেশ পরিষ্কার বোঝা গেল।

প্রিন্সেসের শরীর বেশ খাড়া ও শক্ত, পায়ের তুলনায় অস্বাভাবিক রকমের লম্বা। সে প্রিন্স ভাসিলির দিকে সোজাসুজি তাকাল; ভাসা-ভাসা ধূসর চোখে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। তারপর মাথাটা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবমূর্তির দিকে তাকাল। এটা দুঃখ ও ভক্তির লক্ষণ হতে পারে, আমার ক্লান্তি ও আসন্ন বিশ্রামের আশার লক্ষণও হতে পারে। প্রিন্স ভাসিলি এটাকে ক্লান্তির লক্ষণ বলেই মনে করল।

বলল, আর আমি? আমার পক্ষেই কি ব্যাপারটা সহজ বলে মনে কর? ডাক-গাড়ির ঘোড়ার মতো আমিও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছি। তবু তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতেই হবে কাতিচে, খুব গুরুতর কথা।

সরু হাড় বের-করা হাতে ছোট কুকুরটাকে কোলের উপর ধরে প্রিন্সেস সাগ্রহে প্রিন্স ভাসিলির মুখের দিকে তাকাল; সে স্থির করে ফেলেছে যে প্রথমে কথা বলবে না, তাতে যদি দরকার হয়তো সকাল পর্যন্ত ও অপেক্ষা করে থাকবে।

মনে মনে কিছুটা লড়াই করে প্রিন্স ভাসিলি এবার আসল কথায় এল, আমার প্রিয় প্রিন্সেস ও বোন ক্যাথারিন সেমেনভনা, কি জান এরকম একটা মুহূর্তে সবকিছুই অবশ্য ভাবতে হবে। ভবিষ্যতের কথা, তোমাদের সকলের কথা–সবই ভাবতে হবে।…তুমি তো জান, তোমাদের আমি নিজের ছেলেমেয়েদের মতোই ভালোবাসি!

প্রিন্সেস একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল; একটুও নড়াচড়া করল না।

তার দিকে না তাকিয়ে হোট টেবিলটাকে একটু সরিয়ে দিয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলতে লাগল, তারপর আমার নিজের পরিবারের কথাও অবশ্যই ভাবতে হবে। তুমি তো জান কাতিচে, আমরা-তোমরা তিন বোন, মামন্তভ ও আমার স্ত্রী-আমরাই কাউন্টের একমাত্র প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। আমি জানি, এ সব বিষয় নিয়ে এখন কথা বলা বা চিন্তা করা যে তোমার পক্ষে কত কঠিন তা আমি জানি। আমার পক্ষেও কাজটা সহজ নয়; কিন্তু বোন, আমার বয়স তো ষাট হতে চলল, আমাকে তো সবকিছুর জন্যই তৈরি থাকতে হবে। তুমি কি জান, আমি পিয়েরকেও ডেকে পাঠিয়েছি? কাউন্ট, তার ছবিটার দিকে তাকিয়ে, নিশ্চয় চাইবেন যে তাকেও ডাকা হোক।

প্রিন্স ভাসিলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রিন্সেসের দিকে তাকাল, কিন্তু সে তার কথাগুলি চিন্তা করছে না শুধুই তাকিয়ে আছে তা বুঝতে পারল না।– প্রিন্সেস জবাব দিল, দেখ দাদা, ঈশ্বরের কাছে আমি শুধু একটি প্রার্থনাই করছি, তিনি যেন ওঁকে করুণা করেন, ওঁর মহান আত্মা যেন শান্তিতে এই পৃথিবী ছেড়ে…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো নিশ্চয়ই, ধৈর্য হারিয়ে তার কথায় বাধা দিয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলে উঠল; টাক মাথাটা ঘষতে ঘষতে যে ছোট টেবিলটাকে সরিয়ে দিয়েছিল, বেশ রাগের সঙ্গে সেটাকেই আবার কাছে টেনে আনল। কিন্তু…অল্প কথায় ব্যাপারটা এই…তুমি নিজেও জান যে গত শীতের সময় কাউন্ট একটা উইল করে তার সম্পত্তির প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকার আমাদের না দিয়ে, দিয়ে গেছেন পিয়েরকে!

প্রিন্সেস শান্তভাবে জবাব দিল, উইল তিনি অনেক করেছেন। কিন্তু পিয়েরকে তিনি সম্পত্তি দিতে পারেন না। পিয়ের তার অবৈধ সন্তান।

ছোট টেবিলটাকে আঁকড়ে ধরে আরো উত্তেজিতভাবে প্রিন্স ভাসিলি হঠাৎ দ্রুতলয়ে বলতে লাগল, কিন্তু বোনটি, ম্রাটের কাছে যদি এমন একটা চিঠি লেখা হয়ে থাকে যাকে কাউন্ট পিয়েরকে বৈধ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন জানিয়েছেন? কাউন্টের রাজসেবার কথা বিবেচনা করে সে অনুরোধ যে মঞ্জুর হতে পারে তা কি বুঝতে পারছ?..।

প্রিন্সেস এমনভাবে হাসল যেন সে সবই জানে, এমন কি বক্তার চাইতে বেশিই জানে।

তার হাতটা ধরে প্রিন্স ভাসিলি বলতে লাগল, তোমাকে আরো বলতে পারি; চিঠিটা লেখা হয়েছিল কিন্তু পাঠানো হয় নি, কিন্তু সম্রাট সেটা জানেন। একমাত্র কথা হল, সেটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, অথবা হয় নি? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে যে মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যাবে এবং কাউন্টের কাগজপত্র ভোলা হবে তখনই উইল এবং চিঠিটা সম্রাটকে পাঠানো হবে, আর আবেদন অবশ্যই মঞ্জুর হবে। বৈধ সন্তান হিসেবে সবকিছু পাবে পিয়ের।

আর আমাদের অংশ? ব্যঙ্গের হাসি হেসে প্রিন্সেস এমনভাবে প্রশ্নটা করল যেন সেটা ছাড়াও আরো অনেক কিছু ঘটতে পারে।

হায় কাতিচে, এটা যে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার! সেই হবে সবকিছুর আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী, আর তোমরা কিছুই পাবে না। তোমাকে তাই জানতেই হবে, উইল ও চিঠি লেখা হয়েছিল কি না, এবং সেগুলি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে কি না। আর সেগুলোর কথা যদি কারো মনে না থেকে থাকে, তাহলে তোমাকে জানতে হবে সেগুলো কোথায় আছে, সেগুলোকে খুঁজে বার করতে হবে, কারণ…

তারপর? ব্যঙ্গের হাসির সঙ্গে প্রিন্সেস তার কথায় বাধা দিল; কিন্তু তার চোখের ভাব একটুও বদলাল না। আমি স্ত্রীলোক, আর তুমি মনে কর আমরা সব মূর্খ; কিন্তু আমি এইটুকু জানিঃ অবৈধ সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না।…জারজ! শেষের কথাটা যোগ করে সে যেন বোঝাতে চাইল যে এই অনূদিত শব্দটা প্রিন্স ভাসিলির বক্তব্যের অসারতাকে ভালোভাবেই প্রমাণ করে দেবে।

সত্যি নাকি কাতিচে! তুমি বুঝতেই পারছ! তোমার এত বুদ্ধি, অথচ এটা কেন বুঝতে পারছ না যে পিয়েরকে বৈধ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতির অনুরোধ জানিয়ে কাউন্ট যদি সম্রাটকে চিঠি লিখে থাকেন, তাহলে পিয়ের আর পিয়ের থাকবে না, সে হবে কাউন্ট বেজুখভ, আর উইল অনুসারে সেই তখন হবে সবকিছুর উত্তরাধিকারী। আর সেই উইল আর চিঠি যদি নষ্ট করে ফেলা না হয় তাহলে কর্তব্যপরায়ণা হবার সান্ত্বনা ও তার ফলাফল ছাড়া তোমাদের আর কিছুই থাকবে না! এটা একেবারে নিশ্চিত।

আমি জানি উইল করা হয়েছিল, কিন্তু আরো জানি যে সে উইল অসিদ্ধ; আর তুমি দাদা হয়েও আমাকে একটা বুদ্ধ বলে ভাব। প্রিন্সেস বেশ জোর দিয়ে বলল।

অধৈর্য হয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলতে শুরু করল, প্রিয় প্রিন্সেস ক্যাথারিন সেমেনভনা, আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসি নি, একজন আত্মীয়া, সত্যিকারের ভালো আত্মীয়ার সঙ্গে তার স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আর এই দশমবারের মতো তোমাকে বলছি, সম্রাটের কাছে লেখা চিঠি আর পিয়েরের অনুকূলে তৈরি সেই উইল যদি কাউন্টের কাগজপত্রের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তুমি ও তোমার বোনরা কেউই উত্তরাধিকারিণী নও। যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর, একজন বিশেষজ্ঞের কথায় বিশ্বাস কর। এইমাত্র আমি দিমিত্রি অনুফ্রি (পারিবারিক সলিসিটরের) সঙ্গে কথা বলে এসেছি; তিনিও ঐ একই কথা বলেছেন।

এই কথা শুনে প্রিন্সেসের মনের ভাব হঠাৎ বদলে গেল; পাতলা ঠোঁট দুটি সাদা হয়ে গেল, আর চোখের কোনো পরিবর্তন না হলেও কথা বলতে গিয়ে তার গলার স্বর এমন বদলে যেতে লাগল যে সে নিজেও তা আশা করে নি।

সে বলল, সে তো খুব ভালো হবে! আমি কখনো কিছু চাই নি। আর এখনো চাই না।

কোল থেকে কুকুরটাকে নামিয়ে দিয়ে সে পোশাক পাট করতে লাগল।

আর এই হল কৃতজ্ঞতা–যারা তার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, এই তাদের স্বীকৃতি! প্রিন্সেস চিৎকার করে বলল। এ তো চমৎকার। খুব ভালো! আমি কিছুই চাই না প্রিন্স।

ঠিক, কিন্তু তুমি তো একা নও। তোমার বোনরা আছে…, প্রিন্স ভাসিলি বলল।

কিন্তু প্রিন্সেস তার কথায় কান দিল না।

হ্যাঁ, অনেক আগেই আমি এ সব জানতাম, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম, নিচতা, প্রবঞ্চনা, ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র আর অকৃতজ্ঞতা–জঘন্যতম অকৃতজ্ঞতা ছাড়া এ বাড়িতে আর কিছুই আমি আশা করতে পারি না।…

উইলটা কোথায় আছে তা তুমি জান কি না? প্রিন্স ভাসিলি তবু জিজ্ঞাসা করল; তার গাল দুটো আগের চাইতে বেশি কুঁচকে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, সত্যি আমি বোকা ছিলাম! আমি মানুষকে বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসতাম, নিজেকে বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু যারা নিচ, যারা পাপী, তাদেরই জয় হয়! আমি জানি কে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

প্রিন্সেস উঠতে যাচ্ছিল, প্রিন্স তাকে হাত ধরে থামাল। প্রিন্সেসের তখন এমন অবস্থা যে গোটা মানব জাতির উপরেই সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। কুদ্ধ চোখে সে সঙ্গীর দিকে তাকাল।

এখনো সময় আছে বোন। তোমাকে মনে রাখতে হবে কাতিচে যে এ সবই করা হয়েছিল না ভেবেচিন্তে, একটা রাগের মুহূর্তে, রোগের মধ্যে, আর তার পরে আর কিছুই মনে ছিল না। এখন আমাদের কর্তব্য এই ভুলকে সংশোধন করা, এই অন্যায় কাজ থেকে বিরত করে তার শেষের মুহূর্তগুলিকে শান্তিতে ভরে তোলা; যাতে এই অনুভূতি নিয়ে তাঁকে মরতে না হয় যে তাদেরই তিনি অসুখী করে রেখে যাচ্ছেন যারা…

প্রিন্সেস সুর মিলিয়ে বলল, যারা তাঁর জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছে, যদিও তিনি সে ত্যাগের মূল্য দেন নি। না দাদা, আমি সর্বদা মনে রাখব যে এই জগতে কারো কোনো পুরস্কারের প্রত্যাশা রাখা উচিত নয়, এ জগতে মর্যাদা বা ন্যায় বলে কিছু নেই। এ জগতে মানুষকে শুধু ধূর্ত নিষ্ঠুর হতে হবে।

শোন, শোন, অবুঝ হয়ো না। তোমার মহৎ হৃদয়কে আমি চিনি।

না, তোমার পাপীর হৃদয়।

তোমার হৃদয়কে আমি চিনি, প্রিন্স আবার বলল। তোমার বন্ধুত্বকে আমি মূল্য দেই, আর আশা করি যে আমার সম্পর্কেও তুমি সেই অভিমতই পোষণ কর। এভাবে ভেঙে পড়ো না; একদিনই হোক, আর এক ঘণ্টাই হোক, এখনো সময় আছে, এস আমরা বুদ্ধির সঙ্গে আলোচনা করি। উইল সম্পর্কে সব কথা আমাকে বল। সব চাইতে বড় কথা সেটা কোথায় আছে। তুমি নিশ্চয় জান। এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে কাউন্টকে দেখাও। তিনি নির্ঘাৎ উইলের কথা ভুলেই গেছেন এবং সেটা নষ্ট করে ফেলতে চাইবেন। ঠিক জেনো, তার মনের বাসনাকে ঠিক ঠিক মতো পূর্ণ করাই আমার একমাত্র কামনা; শুধু সেই জন্যই আমি এখানে এসেছি। তা এবং তোমাকে সাহায্য করতেই আমি এসেছি।

এবার আমি সব বুঝতে পারছি। আমি জানি কে ষড়যন্ত্র করছে–আমি জানি! প্রিন্সেস চেঁচিয়ে বলে উঠল।

সেটা আসল কথা নয় বোন।

এ তোমাদের সেই আশ্রিতা, সেই মিষ্টি প্রিন্সেস বেস্কায়া, সেই আন্না মিখায়লভনা, যাকে আমি বাড়ির দাসী রাখতেও রাজি নই…কুখ্যাত, নিচ মেয়েমানুষ!

আমাদের এতটুকু সময় নষ্ট করা উচিত নয়…

আঃ, আমাকে কিছু বলল না! গত শীতের সময় মিষ্টি কথায় মন ভুলিয়ে সে এখানে এসেছিল, আমাদের সম্পর্কে, বিশেষ করে সোফিল সম্পর্কে এমন সব নিচ, লজ্জাজনক কথা বলেছিল-সে সব কথা আমি মুখেও আনতে পারি না-যার ফলে কাউন্ট অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আর এক পক্ষকাল তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেন নি। আমি জানি তখনই তিনি এই নিচ, ঘৃণ্য কাগজটা লিখেছিলেন; কিন্তু তখন আমি ভেবেছিলাম এটা অসিদ্ধ।

আমাদের শেষপর্যন্ত দেখতে হবে–আরো আগে কেন এ কথা আমাকে বল নি?

তার প্রশ্নে কান না দিয়ে প্রিন্সেস বলল, ওটা সেই কারুকার্যকরা পোর্টফোলিওতে আছে যেটা তিনি তার বালিশের তলায় রাখেন। এবার বুঝতে পারছি! হ্যাঁ; আমার মনে যদি কোনো পাপ থাকে, মহাপাপ, তো সেটা ওই নিচ মেয়েমানুষটা প্রতি তীব্র ঘৃণা! প্রিন্সেস প্রায় আর্তনাদ করে উঠল; এখন সে একেবারেই বদলে গেছে। কিসের জন্য সে মাকড়শার মতো এখানে এসেছিল? কিন্তু আমি তাকে দেকে নেব। সময় একদিন আসবেই!

*

অধ্যায়-২২

অভ্যর্থনা-ঘরে আর প্রিন্সেসের ঘরে যখন এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল সেই সময় একখানা গাড়ি পিয়ের (যাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল) এবং আন্না মিখায়লভনা (যে তার সঙ্গে যাওয়াটা দরকারী মনে করেছিল)-এই দুজনকে নিয়ে কাউন্ট বেজুখভের বাড়ির উঠোনে ঢুকল। চাকাগুলো যখন জানালার নিচেকার খড়ের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল তখন আন্না মিখায়লভনা সান্ত্বনার কথা বলে সঙ্গীর দিকে মুখ ঘোরাতেই দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে; মহিলাটি তাকে ডেকে তুলল। জেগে উঠে পিয়ের আন্না মিখায়লভনার পিছন পিছন গাড়ি থেকে নামল, আর তখনই তার মনে পড়ল যে এবার তাকে মুমূর্ষ বাবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। সে লক্ষ্য করল, সদর ফটকের পরিবর্তে তারা পিছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সে যখন গাড়ির পাদানি থেকে নামছে সেই সময় কারিগরের মতো দেখতে দুটি লোক ফটক থেকে ছুটে গিয়ে বাড়ির দুদিককার ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। একটুক্ষণ থেমে পিয়ের লক্ষ্য করল সেই ধরনের আরো কয়েকজন বাড়িটার দুদিকে ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের দেখেও আন্না মিখায়লভনা বা পরিচারক, বা কোচয়ান কেউই তাদের দিকে নজর দিল না। দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে, এই কথা ভেবে পিয়ের মহিলাটিকে অনুসরণ করল। স্বল্পালোকিত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মহিলাটি দ্রুত পায়ে উপরে উঠতে লাগল; পিয়ের একটু পিছিয়ে পড়ায় তাকে ডেকে নিল। কাউন্টের কাছে যাওয়ার তার পক্ষে প্রয়োজন কেন তা সে বুঝতে পারছে না; আরো বুঝতে পারছে না কেন সে পিছনের দরজা দিয়ে যাচ্ছে; তবু আন্না মিখায়লভনার নিশ্চিত ও দ্রুত পদক্ষেপ বিবেচনা করে সে ধরেই নিল যে যাওয়াটা একান্তই প্রয়োজনীয়। সিঁড়ির মাঝামাঝি পৌঁছে গামলাবাহী দুটো লোকের সঙ্গে তাদের প্রায় ধাক্কাধাক্কি হবার যোগাড়; বুট খটখটিয়ে তারা দুজনই দৌড়ে নেমে আসছিল। পিয়ের ও আন্না মিখায়লভনাকে পথ করে দেবার জন্য লোক দুটি দেয়াল ঘেঁষে সরে দাঁড়াল; তাদের দুজনকে সেখানে দেখে একটুও অবাক হলো না।

আন্না মিখায়লভনা তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কি প্রিন্সেসদের ঘরে যাবার পথ?

যেন এখন সবকিছুই চলতে পারে এমনি ভাব দেখিয়ে পরিচারকটি জোর গলায় বলল, হ্যাঁ, বাদিকের দরজা ম্যাম।

ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে পিয়ের বলল, কাউন্ট হয়তো আমাকে ডেকে পাঠান নি। আমি বরং আমার নিজের ঘরেই চলে যাই।

আন্না মিখায়লভনা তার উঠে আসার অপেক্ষায় একটু দাঁড়াল।

সেদিন বিকেলে ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় যেমনটি করেছিল সেই ভাবে পিয়েরের কাঁধে হাত রেখে মহিলা বলল, দেখ বাবা, বিশ্বাস কর যে তোমার চাইতে আমার দুঃখটা কিছু কম নয়। কিন্তু মানুষের মতো হও!

চশমার উপর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে পিয়ের বলল, কিন্তু সত্যি বলছি, আমার চলে যাওয়াই ভালো।

আহা, তোমার প্রতি যদি অন্যায় কিছু হয়েই থাকে সেটা ভুলে যাও। শুধু ভাব যে তিনি তোমার বাবা…হয়তো এখন তিনি মৃত্যু-যন্ত্রণায় ভুগছেন। মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রথম থেকেই তোমাকে আমি ছেলের মতো ভালোবেসেছি। আমার উপর ভরসা রেখো পিয়ের। তোমার স্বার্থ আমি ভুলব না।

পিয়ের একটা কথাও বুঝল না, কিন্তু এ সব যে ঘটতে বাধ্য সেই ধারণা তার মনে দৃঢ়তর হল। বাধ্য ছেলের মতো সে আন্না মিখায়লভনাকে অনুসরণ করল। মহিলা ততক্ষণে দরজাটা খুলে ফেলেছে।

দরজা দিয়ে একটা পিছনের ছোট ঘরে ঢোকা গেল। সেখানে এক কোণে বসে প্রিন্সের একটি বুড়ো চাকর মোজা বুনছিল। বাড়ির এ দিকটায় পিয়ের কখনো আসে নি, এ সব ঘরের অস্তিত্বের কথাও সে জানে না। ট্রের উপরে একটা ডিক্যান্টার নিয়ে একটি দাসী তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, তাকে আদর করে সোনা, মণি বলে ডেকে আন্না মিখায়লভনা প্রিন্সেসদের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিল; তারপর পিয়েরকে নিয়ে পাথরের দালান ধরে এগিয়ে চলল। বাঁদিকে প্রথম দরজাটা দিয়ে প্রিন্সেসদের মহলে যাবার পথ। ডিক্যান্টার হাতে দাসীটি তাড়াতাড়িতে দরজাটা বন্ধ করে যায় নি (সেই সময়ে বাড়িতে সবকিছুতেই একটা তাড়াহুড়া চলছে); পিয়ের ও আন্না মিখায়লভনা যেতে যেতে পাশের সেই ঘরটার দিকেই চোখ ফেলল যেখানে প্রিন্স ভাসিলি ও বড় প্রিন্সেস ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কথা বলছিল। তাদের যেতে দেখে প্রিন্স ভাসিলি আচমকা সরে বসল। আর প্রিন্সেস লাফ দিয়ে উঠে বেপরোয়াভাবে গায়ের সব জোর দিয়ে দরজাটাকে সশব্দে বন্ধ করে দিল।

কাজটা প্রিন্সেসের স্বভাবের পক্ষে এতই বেমানান এবং প্রিন্স ভাসিলির মুখে যে ভয়ের ভাব খেলে গেল সেটাও তার মর্যাদার পক্ষে এতই খাপছাড়া যে পিয়ের থেমে গিয়ে প্রশ্ন দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল। আন্না মিখায়লভনা কোনো রকম বিস্মিত হল না; ঈষৎ হেসে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল মাত্র; যেন বলতে চাইল যে এই রকম কিছুই সে আশা করেছিল।

পিয়েরের চাউনির উত্তরে সে বলল, মানুষ হতে শেখ বাবা। তোমার স্বার্থ আমি দেখব। সে আরো দ্রুত পা চালিয়ে দিল।

পিয়ের এ সবকিছুই বুঝতে পারছে না; তার স্বার্থ দেখার মানে কি তাও না; কিন্তু সে ধরে নিয়েছে যে যা হচ্ছে তাই হতে বাধ্য। দালান পার হয়ে কাউন্টের অভ্যর্থনা-ঘরের পাশের একটা বড় স্বল্পালোকিত ঘরে তারা ঢুকল। এ ঘরটা পিয়েরের কাছে পরিচিত; কিন্তু এখানেও দেখা গেল একটা শূন্য স্নানের টব; কার্পেটের উপর পানি ছড়িয়ে আছে। ধুনোচি হাতে একজন ডিয়েকন ও একটি চাকরের সঙ্গে তাদের দেখা হল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য না করেই দুজন পা টিপে টিপে চলে গেল। তারা অভ্যর্থনা-ঘরে ঢুকল। এ ঘরটা পিয়েরের পরিচিত। দুটো বড় ইতালিয় জানালা সবজি-ঘরের দিকে খোলা, বড় বড় আবক্ষ মূর্তি, আর ক্যাথারিন দি গ্রেটের একটা পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি। সেই একই সব লোক একই অবস্থায় বসে পরস্পর ফিসফিস করে কথা বলছে। সকলে চুপ করে চোখ তুলে তাকাল–তাদের সামনে বিবর্ণা অশ্রুমুখী আন্না মিখায়লভনা আর মাথা নিচু করে ভীরু অনুসরণকারী পিয়েরের শক্ত-সমর্থ দেহ।

আন্না মিখায়লভনার মুখ দেখেই বোঝা গেল, চরম মুহূর্ত যে সমাগত সে বিষয়ে সে খুবই সচেতন। সে বুঝতে পারছে, যেহেতু এমন একজনকে সঙ্গে নিয়ে সে এসেছে যার সঙ্গে মুমূর্ষ লোকটি দেখা করতে ইচ্ছুক, কাজেই নিজের প্রবেশ সম্পর্কে সে নিশ্চিত। ঘরের চারদিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে, কাউন্টের স্বীকৃতি গ্রহণকারীকে দেখতে পেয়ে সে সেই দিকে এগিয়ে গেল এবং প্রথমে তার ও পরে অপর একজন পুরোহিতের আশীর্বাদ গ্রহণ করল।– একজন পুরোহিতকে সে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন। আমরা আত্মীয়স্বজনরা

এত উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছি। আবোরা নরম গলায় বলল, এই যুবকটি কাউন্টের ছেলে। কী ভয়ংকর মুহূর্ত!

এই কথা বলেই সে ডাক্তারের কাছে গেল।

বলল, প্রিয় ডাক্তার, এই যুবকটি কাউন্টের ছেলে। কোনো আশা আছে কি?

ডাক্তার তাড়াতাড়ি উপরের দিকে চোখ তুলে নীরবে কাঁধে ঝাঁকুনি দিল। আন্না মিখায়লভনা কাঁধ ও চোখের সেই একই ভঙ্গি করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল; তারপর ডাক্তারের কাছ থেকে পিয়েরের কাছে সরে গেল। বিশেষ শ্রদ্ধায় ও মমতায় বিষণ্ণ গলায় তাকে বলল :

তাঁর করুণায় বিশ্বাস রেখো একটা ছোট সোফা দেখিয়ে তাকে বসতে বলে মহিলা নীরবে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। সকলেরই দৃষ্টি সেই দরজার দিকে। দরজায় কাঁচ করে একটু শব্দ হল; মহিলা দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পিয়ের মনে মনে স্থির করল, তার অভিভাবিকার সব কথাই মেনে চলবে। তাই তার নির্দেশিত সোফাটার : দিকে এগিয়ে গের। আন্না মিখায়লভনা চলে যাবার পরমুহূর্তেই সে লক্ষ্য করল, ঘরের সবগুলো চোখ তাকেই দেখছে; সে সব চোখে ফুটে উঠেছে কৌতূহল ও সহানুভূতির চাইতেও কিছু বেশি। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে সকলেই ফিসফিস করে কথা বলছে। সকলে তাকে এমন সম্মান দেখাচ্ছে যা সে এর আগে কখনো পায় নি। একটি বিচিত্র মহিলা আসন থেকে উঠে সেই আসনে তাকে বসতে বলল। পিয়েরের হাত থেকে একটা দস্তানা পড়ে যেতেই একজন এড-ডি-কং এসে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে তার হাতে দিল। ডাক্তার নীরব শ্রদ্ধায় তাকে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। পিয়েরও নিঃশব্দে এড-ডি-কংয়ের হাত থেকে দস্তানাটা নিল, এবং হাঁটুর উপর হাত দুটো রেখে মিশরীয় মূর্তির মতো মহিলার দেওয়া আসনেই বসল। মনে মনে স্থির করল, এ সবই ভবিতব্য, যা হবার তাই হচ্ছে; আর যাতে মাথাটা ঘুরে না যায় এবং বোকার মতো কাজ করে না বসে সেই জন্য আজ রাতে সে নিজের ধারণামতো কাজ করবে না, যারা তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ইচ্ছার উপরেই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেবে।

তারপর দুমিনিটও যায় নি এমন সময় প্রিন্স ভাসিলি রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে ঘরে ঢুকল। বুকে তিনটে তারকা লাগানো লং-কোট পরনে। সকালের তুলনায় অনেকটা শুকনো দেখাচ্ছে; চারদিকে তাকিয়ে সে যখন পিয়েরকে দেখতে পেল, তখন তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের চাইতে বড় দেখাল। সে পিয়েরের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা ধরল (এ কাজ সে কখনো করে না), এবং হাতটা শক্ত কি না বুঝবার জন্য হাতটাকে নিচের দিকে টেনে নিল।

সাহস, সাহস চাই বন্ধু! তিনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। খুব ভালো কথা! সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।

কিন্তু পিয়েরের মনে হল জিজ্ঞাসা করে :…কেমন আছেন, কিন্তু ইতস্তত করল; মুমূর্ষ লোকটিকে কাউন্ট বলা উচিত হবে কি না বুঝতে পারল না, আবার বাবা বলতেও লজ্জা করল।

আধ ঘন্টা আগে তাঁর আর একটা আক্রমণ হয়েছে। সাহস বন্ধু, সাহস,…

পিয়েরের মনটা এতই বিচলিত ছিল যে আক্রমণ কথাটা শুনে কিছুর আঘাতের কথাই তার মনে হল। বিব্রতভাবে সে প্রিন্স ভাসিলির দিকে তাকাল; তবে একটু পরেই সে বুঝতে পারল যে আক্রমণ মানে রোগের আক্রমণ। ভাসিলি যেতে যেতে লোরেনকে কি যেন বলে আঙুলে ভর দিয়ে পা টিপে টিপে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। পা টিপে সে ভালো হাঁটতে পারে না, তাই প্রতিটি পদক্ষেপেই তার গোটা শরীরটা কাঁপতে লাগল। বড় প্রিন্সেস তাকে অনুসরণ করল; পুরোহিতরা, ডিয়েকনরা ও কিছু চাকরও দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা দিয়ে ভিতরে কোনো কিছু সরাবার একটা শব্দ শোনা গেল। তার শেষপর্যন্ত আন্না মিখায়লভনা মুখে কর্তব্য-পালনের সেই একই দৃঢ় ভঙ্গি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল এবং পিয়েরের কাঁধে আস্তে হাত রেখে বলল :

ঈশ্বরের করুণা অপরিসীম। তৈললেপন অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। চল।

নরম কার্পেটের উপর পা ফেলে পিয়ের দরজার কাছে গেল। সেই বিচিত্র মহিলা, এড-কি-কং ও কয়েকটি চাকরও তার পিছন পিছন এল। পিয়েরের মনে হল, সে ঘরে ঢুকতে এখন যেন আর অনুমতির কোনো দরকারই নেই।

*

অধ্যায়-২৩

অনেকগুলি স্তম্ভ ও খিলানে বিভক্ত এবং দেয়ালে-দেয়ালে পারসিক কার্পেট ঝোলানো এই বড় ঘরটি পিয়েরের খুবই পরিচিত। স্তম্ভগুলির পিছনে ঘরের একটি অংশের একপাশে আছে সিল্কের মশারি-ঢাকা একখানি উঁচু মেহগনি খাট; অপর দিকে মস্ত বড় আলমারির উপর দেবমূর্তিগুলোর সামনে উজ্জ্বল মিখায় লাল আলো জ্বলছে, রুশ গির্জায় সান্ধ্য উপাসনার সময় যেমনটি জ্বলে। আলোকোজ্জ্বল দেবমূর্তিগুলোর নিচে একটা লম্বা ইনভ্যালিড-চেয়ার পাতা রয়েছে, তাতে সদ্য বদলানো কয়েকটি বরফ-সাদা বালিশ। পিয়ের দেখল, ঝকঝকে সবুজ লেপে কোমর পর্যন্ত ঢেকে সেই চেয়ারে বসে আছে তার বাবা কাউন্ট বেজুখভের পরিচিত সমুন্নত দেহ প্রশস্ত কপালের উপর পাকা চুলের রশি সিংহের কেশরের কথা মনে করিয়ে দেয়; সুদর্শন রক্তাভ মুখে অনেক বলীরেখার আল্পনা। মোটা হাত দুখানি লেপের বাইরে রেখে দেবমূর্তিগুলির ঠিক নিচে সে হেলান দিয়ে রয়েছে। তার ডান হাতের পাতায় তর্জনী ও বৃদ্ধার মাঝখানে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি রেখে একটি চাকর চেয়ারের পিছন থেকে ঝুঁকে মোমবাতিটিকে ঠিকমতোভাবে ধরে আছে। পুরোহিতরা চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে ধীর গম্ভীরভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে। ছোট প্রিন্সেস দুটি পিছনে দাঁড়িয়ে, রুমালে চোখ মুছছে, আর তাদের বড় বোন কাতিচে কুটিল, স্থির দৃষ্টিতে দেবমূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে একটি ভীরু, বিষণ্ণ, ক্ষমাসুন্দর ভাব ফুটিয়ে আন্না মিখায়লভনা দরজাটার কাছে সেই বিচিত্র মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্স ভাসিলি বাঁ হাতে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে দরজার সামনে ইনভ্যালিড-চেয়ারটার কাছে একটা ভেলভেট-মোড়া চেয়ারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর ডান হাতে যতবার কুশ-চিহ্ন আঁকছে ততবারই উপরের দিকে চোখ তুলে কপালটা স্পর্শ করছে। সারা মুখে ফুটে উঠেছে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের একটা বিনীত ভাব। যেন সে বলতে চাইছে, এ সব মনোভাব যদি তুমি বুঝতে পার তো তোমারই কপাল মন্দ!

তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এড-ডি-কং, ডাক্তার ও চাকররা; গির্জার মতোই এখানেও স্ত্রী ও পুরুষরা আলাদা-আলাদা দাঁড়িয়েছে। সকলেই নীরবে ক্রুশ-চিহ্ন আঁকছে; শুধু শোনা যাচ্ছে গির্জার অনুষ্ঠান, গম্ভীর অনুচ্চ প্রার্থনা, আর দীর্ঘশ্বাস ও পায়ের খসখস শব্দ। আন্না মিখায়লভনা মেঝেটা পেরিয়ে পিয়েরের কাছে গিয়ে তার হাতে একটা মোমবাতি দিল। সেটাকে জ্বালিয়ে সেও মোমবাতি ধরা হাতেই ক্রুশ-চিহ্ন আঁকতে লাগল।

গোলাপি গাল, হাসিখুশি ছোট প্রিন্সেস সোফি তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি হেসে রুমালে মুখ ঢাকল; কিছুক্ষণ ঢেকে রাখার পরে আবার মুখ তুলে পিয়েরকে দেখে হাসতে লাগল। সে যেন না হেসে তার দিকে তাকাতেই পারছে না, আবার না তাকিয়েও পারছে না; তাই লোভ সংবরণ করবার জন্য নিঃশব্দে একটা স্তম্ভের পাশে সরে গেল। অনুষ্ঠান চলার মাঝপথেই পুরোহিতদের গলা হঠাৎ থেমে গেল, নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করল, আর যে বুড়ো চাকরটি কাউন্টের হাত ধরে ছিল সে উঠে গিয়ে মহিলাদের কি যেন বলল। আন্না মিখায়লভনা এগিয়ে গিয়ে মুমূর্ষ লোকটির উপরে ঝুঁকে পড়ে মুখ ফিরিয়ে লোরেনকে ইশারায় ডাকল। ফরাসি ডাক্তারটির হাতে মোমবাতি নেই; একটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে সে সসম্ভম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; যেন বোঝাতে চাইছে, বিদেশী হলেও এ সব অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সে বোঝে এবং তার সমর্থনও করে। এবার সে নিঃশব্দে পা ফেলে রোগীর কাছে এগিয়ে গেল এবং সবুজ লেপের উপর থেকে খালি হাতটা তুলে ধরে তার নাড়িতে হাত রেখে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। রোগীকে কিছু পানীয় দেওয়া হলো; সকলের মধ্যে একটা উত্তেজনা দেখা গেল; তারপরই সকলে যে যার জায়গায় চলে গেল; আবার অনুষ্ঠান শুরু হল। এই বিরতির সময় পিয়ের লক্ষ্য করল, প্রিন্স ভাসিলি চেয়ারটা ছেড়ে দিয়েও মুমূর্ষ লোকটির কাছে না গিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে বড় প্রিন্সেসকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের সেইদিকটায় চলে গেল যেখানে সিল্কের মশারিতে ঢাকা উঁচু খাটটা রয়েছে। বিছানার কাছ থেকে প্রিন্স ভাসিলি ও বড় প্রিন্সেস দুজনেই পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল এবং অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই পর পর ঘরে ঢুকে নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়াল। পিয়ের এই ঘটনাটির প্রতি অন্য সব ঘটনার চাইতে বেশি মনোযোগ দিল না; সে ধরেই নিয়েছে যে এখানে এই সন্ধ্যায় যা কিছু ঘটছে সবই একান্ত প্রয়োজনীয়।

পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণ শেষ হলো; তারা মুমূর্ষ লোকটির শুভ কামনা করল। সে মানুষটি কিন্তু পূর্ববৎই নিজীব ও নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। চারপাশে সকলেই নড়াচড়া শুরু করল; পায়ের শব্দ ও ফিসফিস শব্দ শোনা গেল; সবচাইতে স্পষ্ট শোনা গেল আন্না মিখায়লভনার গলা।

পিয়ের তাকে বলতে শুনল : ওকে অবশ্যই বিছানায় নিয়ে যেতে হবে; এখানে তো অসম্ভব যে…

ডাক্তার বা প্রিন্সেসরা, আর চাকররা রোগীকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে পিয়ের এখন আর তার রক্তিমাভ হলুদ মুখ ও সাদা চুল দেখতে পাচ্ছে না, যদিও অন্য সব মুখের দিকে চোখ থাকলেও এতক্ষণ মুহূর্তের জন্য সে ঐ মুখটার উপর থেকে তার দৃষ্টিকে সরায় নি। সকলের সতর্ক চলাফেরা দেখেই সে বুঝে নিল যে তারা মুমূর্ষ লোকটিকে ইনভ্যালিড-চেয়ার থেকে তুলে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে।

সে শুনতে পেল একটি চাকর সভয়ে ফিসফিস কর বলে উঠল, আমার হাতটা ধর, নইলে তুমি ওঁকে ফেলে দেবে! নিচ থেকে ধর, এখানে! অনেকের গলা শোনা গেল। বাহকদের ঘন ঘন নিঃশ্বাস ও দ্রুততর পায়ের শব্দে বোঝা গেল, যাকে তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার ওজনটা তাদের পক্ষে বড় বেশি ভারী।

বাহকদের মধ্যে আন্না মিখায়লভনাও একজন; তাদের মাথা ও পিঠের ফাঁক দিয়ে মুহূর্তের জন্য মুমূর্ষ লোকটির উঁচু, মজবুত, খোলা বুক ও ঘাড় এবং কোকড়ানো সাদা চুলে ভরা সিংহসদৃশ মাথাটা পিয়েরের দৃষ্টিগোচর হল। সেই মাথাটি, তার চওড়া ভুরু ও চোয়ালের হাড়, তার সুন্দর, আকর্ষণীয় মুখ, তার নিরুত্তাপ, বিষণ্ণ অথচ মহান ভঙ্গিমা-কোনো কিছুর উপরেই আসন্ন মৃত্যুর ছায়া পড়ে নি। তিন মাস আগে কাউন্ট যখন তাকে পিটার্সবুর্গে ডেকে পাঠিয়েছিল তখন পিয়ের তাকে যেমনটি দেখেছিল সব তেমনই আছে। কিন্তু এখন বাহকদের অসমান পদক্ষেপের ফলে মাথাটি অসহায়ভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে; অর্থহীন দৃষ্টি যেন শূন্যে নিবদ্ধ হয়ে আছে।

উঁচু খাটটার পাশে কয়েক মিনিট হৈ-চৈ চলল; তারপরেই বাহকরা ঘর থেকে চলে গেল। পিয়েরের হাতটা ছুঁয়ে আন্না মিখায়লভনা বলল, এস। তার সঙ্গে পিয়ের বিছানার কাছে গেল। সদ্যসমাপ্ত অনুষ্ঠানের উপযোগী রাজকীয় ভঙ্গিতে রোগীকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। বালিশ দিয়ে মাথাটাকে উঁচু করে রাখা হয়েছে। হাত দুখানিকে সমানভাবে সিল্কের সবুজ লেপটার উপর রেখে দেওয়া হয়েছে। পিয়ের যখন সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন কাউন্ট সোজা তার দিকে তাকাল, কিন্তু সে দৃষ্টির ভাষা তো কোনো মরণশীল মানুষের পক্ষে বোধগম্য নয়। হয় সে দৃষ্টি একান্তই অর্থহীন, চোখ আছে বলেই কিছু না কিছু দেখা মাত্র, অথবা সে দৃষ্টি বড় বেশি অর্থবহ। কি করবে বুঝতে না পেরে সে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকাল। আন্না মিখায়লভনা তাড়াতাড়ি রোগীর হাতের দিকে তাকিয়ে এবং নিজের ঠোঁট নেড়ে ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিল যে চুমো খেতে হবে। পিয়ের সাবধানের এমনভাবে গলাটা বাড়াল যাতে লেপটাকে স্পর্শ করতে না হয়; তারপর মহিলার নির্দেশ মতো কাউন্টের চওড়া-হাড়, মাংসল হাতের উপর ঠোঁট চেপে ধরল। কি কাউন্টের হাত, কি তার মুখের একটি পেশী-কিছুই এতটুকু কাঁপল না। এবার কি করতে হবে জানবার জন্য পিয়ের আবার আন্না মিখায়লভনার দিকে তাকাল। মহিলা চোখের ইশারায় বিছানার পাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। পিয়ের অনুগতভাবে চেয়ারে বসে মহিলার দিকে তাকাল, যেন জানতে চাইল সে ঠিক কাজ করেছে কি না। আন্না মিখায়লভ সমর্থনসূচকভাবে ঘাড় নাড়ল। পিয়ের মিশরীয় প্রস্তর-মূর্তির মতো চুপচাপ বসে রইল; যেন তার অগোছালো শক্ত শরীরটা ঘরের অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকায় সে বড়ই বিব্রত বোধ করছে এবং নিজেকে যথাসম্ভব হোট করে রাখতে চেষ্টা করছে। আবার কাউন্টের দিকে তাকাল; বসবার আগে পিয়েরের মুখটা যেখানে ছুঁয়ে ছিল এখনো সেই জায়গাটাতেই কাউন্টের দৃষ্টি নিবদ্ধ। পিতা-পুত্রের মিলনের এই শেষ মুহূর্তগুলির সকরুণ গুরুত্ব সম্পর্কে সে যে সম্পূর্ণ সচেতন, আন্না মিখায়লভনা হাবেভাবেই তা বুঝিয়ে দিল। এইভাবে দুমিনিট কাটল; পিয়েরের মনে হল যেন একটি ঘণ্টা। সহসা মুখের চওড়া পেশী ও রেখাগুলি কাঁপতে লাগল। কাপনটা বাড়তেই লাগল; সুন্দর মুখখানি একদিকে বেঁকে গেল (এই প্রথম পিয়ের বুঝতে পারল তার বাবা মৃত্যুর কত কাছে এসে পড়েছে); আর সেই বিকৃত মুখের ভিতর থেকে একটা অস্পষ্ট, কর্কশ শব্দ বেরিয়ে এল। রুগ্ন লোকটি কি চাইছে বুঝবার জন্য আন্না মিখায়লভনা সাগ্রহে তার চোখের দিকে তাকাল; প্রথমে পিয়েরকে দেখাল, তারপরে কিছু পানীয় দেখাল, ফিসফিস করে প্রিন্স ভাসিলির নাম করল, লেপটা দেখাল। রোগীর চোখে-মুখে অধৈর্য ফুটে উঠল। খাটের মাথার দিকে যে চাকরটি সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, রোগী তার দিকে তাকাতে চেষ্টা করল।

পাশ ফিরে শুতে চাইছেন, বলে চাকরটি মনিবের ভারী দেহটাকে দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে গেল।

তাকে সাহায্য করতে পিয়েরও উঠে গেল।

কাউন্টকে পাশ ফিরিয়ে দেবার সময় তার একটা হাত এলিয়ে পড়ল; হাতটাকে টেনে তুলতে রোগী বৃথাই চেষ্টা করল। যে রকম আতংকিত দৃষ্টিতে পিয়ের সেই নির্জীব হাতটাকে দেখছিল সেটা লক্ষ্য করেই হোক, অথবা অন্য কোনো চিন্তার প্রেরণাতেই হোক, রোগী একবার তার অশক্ত শিথিল হাতটার দিকে, আর একবার পিয়েরের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকাল; আবার সে তাকাল নিজের হাতের দিকে। তখনই তার দুর্বল মুখে একটা দুর্বল, করুণ হাসি খেলে গেল। সে হাসি তার গম্ভীর মুখে বেমানান; মনে হল সে বুঝি নিজের অসহায় অবস্থাকেই ব্যঙ্গ করছে। সে হাসি দেখে পিয়েরের বুকের ভিতরটা অপ্রত্যাশিতভাবে কেঁপে উঠল, তার নাকটা সুড় সুড় করে উঠল, দুই চোখ জলে ঝাপসা হয়ে এল। রোগীকে দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। সে দীর্ঘনিঃশাস ফেলল।

একটি প্রিসেসকে ঘরে ঢুকতে দেখে আন্না মিখায়লভনা বলল, উনি ঝিমুচ্ছেন। এস আমরা চলে যাই।

পিয়ের বেরিয়ে গেল।

*

অধ্যায়-২৪

প্রিন্স ভাসিলি ও বড় প্রিন্সেস ছাড়া অভ্যর্থনা-ঘরে আর কেউ নেই। মহীয়সী ক্যাথারিনের প্রতিকৃতির নিচে বসে তারা সাগ্রহে কথা বলছে। পিয়ের ও তার সঙ্গিনীকে দেখামাত্রই তারা চুপ করে গেল। পিয়েরের মনে হল, বড় প্রিন্সেস কি যেন লুকিয়ে ফেলল; ফিসফিস করে বলল, ওই মেয়েটিকে আমি সহ্য করতে পারি না।

প্রিন্স ভাসিলি আন্না মিখায়লভনাকে বলল, কাভিচে ছোট বসার ঘরটাতে চায়ের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে গিয়ে কিছু খেয়ে নিন আন্না মিখায়লভনা, নইলে যে ধকল সইতে পারবেন না।

সে পিয়েরকে কিছু বলল না, শুধু কাঁধের নিচে তার হাতটাকে সহানুভূতির সঙ্গে একটু টিপে নিল। আন্না মিখায়লভনার সঙ্গে পিয়ের ছোট বসবার ঘরটাতে ঢুকল।

ছোট গোল ঘরটাতে একটা টেবিলে চা ও ঠাণ্ডা খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। সেখান থেকে একটা হাতলবিহীন সুদৃশ্য চীনা পেয়ালায় চা নিয়ে লোরেন সোৎসাহে বলে উঠল, একটা বিদ্রি রাতের পরে সুস্বাদু। রুশ চায়ের মতো স্ফুর্তিকর আর কিছু নেই। সেই রাতে যে সব অতিথি কাউন্ট বেজুখভের বাড়িতে এসেছিল। তারা সকলেই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সেই টেবিলে ভিড় করেছে। আয়না ও ছোট ছোট টেবিলে সাজানো এই ছোট গোল বসার ঘরটার কথা পিয়েরের খুব ভালোই মনে আছে। একটা ছোট টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম ও খাবারের ডিশ এলোমেলোভাবে সাজানো রয়েছে। এই মাঝরাতেই একদল লোক সেখানে বসে আছে; ফুর্তি করছে না; গম্ভীরভাবে ফিসফিস করে কথা বলছে; কিন্তু তাদের প্রতিটি কথায়, প্রতিটি ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে যে এখানে কি ঘটছে এবং শোবার ঘরে কি ঘটতে চলেছে সে কথা তারা মোটেই ভুলে যায় নি। খাবার যথেষ্ট ইচ্ছা থাকলেও পিয়ের কিছুই খেল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার অভিভাবিকার দিকে তাকাতে লাগল। সে দেখল, যে অভ্যর্থনা-ঘরে তারা প্রিন্স ভাসিলি ও বড় প্রিন্সেসকে রেখে চলে এসেছে, মহিলাটি পা টিপে টিপে সেই ঘরের দিকেই চলেছে। পিয়ের ধরে নিল যে এটাও অবশ্য প্রয়োজনীয়; একটু পরে সেও সেই দিকেই গেল। আন্না মিখায়লভনা বড় প্রিন্সেসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে; দুজনই ফিসফিস করে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে।

বড় প্রিন্সেস যে রকম উত্তেজিতভাবে দরজাটাকে সশব্দে বন্ধ করে দিয়েছিল ঠিক সেই রকম উত্তেজনার সঙ্গেই সে বলে উঠল, কোনটা দরকারী আর কোনটা দরকারী নয় সেটা আমিই ভালো বুঝি প্রিন্সেস।

শোবার ঘরে যাবার দরজাটা আটকে বড় প্রিন্সেসকে সেখানে যেতে না দিয়ে আন্না মিখায়লভনা সরাসরি জবাব দিল, কিন্তু প্রিয় প্রিন্সেস, এটা কি খুবই বাড়াবাড়ি হবে না? এই মুহূর্তে ওঁর যে বিশ্রামের বড়ই প্রয়োজন। তাঁর আত্মা যখন প্রস্তুত হয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এই সব পার্থিব আলোচনা…।

অভ্যস্ত ভঙ্গিতে এক পায়ের উপর আর এক পা তুলে প্রিন্স ভাসিলি একটা আরাম কেদারায় বসে ছিল। তার ভারী গাল দুটো ভীষণভাবে কুঁচকে যাচ্ছে; কিন্তু সে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে যেন এই দুটি মহিলার কথাবার্তার ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথাই নেই।

দেখুন আন্না মিখায়লভনা, কাতিচে যা করতে চায় তাই করতে দিন। কাউন্ট যে ওকে কত ভালোবাসেন তা তো আপনি জানেন।

হাতের কারুকার্যকরা পোর্টফোলিওটা প্রিন্স ভাসিলিকে দেখিয়ে বড় প্রিন্সেস বলল, এই কাগজে কি আছে তাও আমি জানি না। আমি শুধু এইটুকুই জানি যে তাঁর আসল উইলটা রয়েছে লেখার টেবিলে; এ কাগজের কথা তিনি ভুলেই গেছেন।…

সে আন্না মিখায়লভনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু মহিলাটি একলাফে এগিয়ে এসে তার পথ আটকে দিল।

সে যে সহজে ছেড়ে দেবে না এমনি ভাব দেখিয়ে পোর্টফোলিওটা শক্ত করে চেপে ধরে আন্না মিখায়লভনা বলল, আমি সব জানি গো দয়ালু প্রিন্সেস। তোমাকে মিনতি করছি, তার প্রতি একটু করুণা কর।

প্রিন্সেস জবাব দিল না। পোর্টফোলিও নিয়ে টানাটানি ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না, তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে বড় প্রিন্সেস যদি কথা বলে তাহলে সে কথাগুলি আন্না মিখায়লভনার পক্ষে শ্রুতিসুখকর হবে না। কিন্তু মহিলাটির কথায় মিষ্টতার ও দৃঢ়তা কোনোটারই অভাব নেই।

পিয়ের, এখানে এস বাবা। এই পারিবারিক পরামর্শের ব্যাপারে ওর যোগদান অবান্তর হবে না বলেই আমি মনে করি; তাই নয় কি প্রিন্স?

তুমি কথা বলছ না কেন দাদা? প্রিন্সেস হঠাৎ এত জোরে চিৎকার করে উঠল সে আশপাশের সকলেই চমকে উঠল। ঈশ্বর জানেন কে ওকে নাক গলাবার অনুমতি দিয়েছে। একটি মুমূর্ষ মানুষের একবারে দোরগোড়ায় এরকম গণ্ডগোল পাকাতে কে বলেছে? তুমি চুপ করে আছ কেন? সর্বশক্তি দিয়ে পোর্টফোলিওটাকে টেনে ধরে সে হিসহিস করে উঠল, ষড়যন্ত্রকারিণী!

কিন্তু আন্না মিখায়লভনা পোর্টফোলিওটাকে দখলে রাখতে একপা কি দুপা এগিয়ে হাতটা বদলে নিল।

প্রিন্স ভাসিলি উঠে দাঁড়াল। তিরস্কার ও বিস্ময়ের সুরে বলল, আঃ! এ তো অসহ্য। ছেড়ে দাও বলছি।

প্রিন্সেস ছেড়ে দিল।

আপনিও ছেড়ে দিন।

কিন্তু আন্না মিখায়লভনা তার কথা শুনল না।

ছেড়ে দিন বলছি! আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি নিজে গিয়ে তাঁকে বলব। আমি! তাহলে আপনি খুশি হবেন তো?

আন্না মিখায়লভনা বলল, কিন্তু প্রিন্স, এ রকম একটা পবিত্র অনুষ্ঠানের পরে তাঁকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন! এই যে পিয়ের, তোমার মতামতটা এদের জানিয়ে দাও। পিয়ের ততক্ষণে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রিন্স ভাসিলি কঠোর গলায় বলল, মনে রাখবেন যে এর ফলাফলের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। আপনি কি করছেন তা নিজেই জানেন না।

আচমকা একলাফে আন্না মিখায়লভনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পোর্টফোলিওটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বড় প্রিন্সেস চিৎকার করে বলল, নিচ মেয়েছেলে!

প্রিন্স ভাসিলি মাথা নিচু করে দুই হাত ছড়িয়ে দিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে সেই ভয়ংকর দরজাটা-যে দরজার উপর পিয়ের এতক্ষণ নজর রেখেছিল, যে দরজা এতক্ষণ নিঃশব্দে খুলছিল-এবার সেটা সশব্দে খুলে গিয়ে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ল, আর মেজ প্রিন্সেস হাত মোচড়াতে মোচড়াতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

তীব্রভাবে চিৎকার করে বলল, তোমরা করছ কি! তিনি মরতে বসেছেন, আর তোমরা আমাকে একা তার কাছে রেখে এসেছ!

বড় বোন পোর্টফোলিওটা ফেলে দিল। আন্না মিখায়লভনা নিচু হয়ে তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিয়ে ছুটে গিয়ে শোবার ঘরে ঢুকল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বড় প্রিন্সেস ও প্রিন্স ভাসিলিও তার পিছনে ছুটল। কয়েক মিনিট পরে বিবর্ণ, কঠিন মুখে নিচের ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে বড় প্রিন্সেস বেরিয়ে এল। পিয়েরকে দেখতে পেয়ে তার মুখে ফুটে উঠল অদম্য ঘৃণা।

বলল, হ্যাঁ, এবার তুমি খুশি হবে! এর জন্যই তো তুমি অপেক্ষা করে ছিলে! হঠাৎ কেঁদে উঠে রুমালে মুখ ঢেকে সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তারপরেই ঢুকল প্রিন্স ভাসিলি। যে সোফায় পিয়ের বসেছিল টলতে টলতে সেখানে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে সেখানে ধপ করে বসে পড়ল। পিয়ের দেখল, তার মুখটা কালো হয়ে গেছে; তীব্র যন্ত্রণায় তার চোয়াল থরথর করে কাঁপছে।

পিয়েরের কনুইটা ধরে সে বলল, হায় বন্ধু আমার! এখন তার গলায় এমন একটা আন্তরিকতা ও দুর্বলতার সুর ফুটে উঠেছে যা এর আগে পিয়ের কখনো শোনে নি। প্রিন্স ভাসিলি বলতে লাগল, আমরা কত পাপ করি, কত লোককে ঠকাই, কিন্তু কিসের জন্য? আমার বয়স প্রায় ষাট হল বন্ধু…আমিও…মৃত্যুতে সবই তো শেষ হয়ে যাবে, সব! মৃত্যু ভয়াবহ… বলেই সে কেঁদে উঠল।

সব শেষে বেরিয়ে এল আন্না মিখায়লভনা। ধীর, শান্ত পা ফেলে সে পিয়েরের কাছে এগিয়ে গেল।

ডাকল, পিয়ের!

পিয়ের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। মহিলাটি তার কপালে চুমো খেল; তাকে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল। একটু চুপ করে থেকে বলল, তিনি ইহজগতে নেই…

চশমার উপর দিয়ে পিয়ের তার দিকে তাকাল।

চল। আমি তোমার সঙ্গে যাব। কাঁদতে চেষ্টা কর। চোখের জলের মতো সান্ত্বনা আর কিছুই দিতে পারে না।

মহিলাটি তাকে অন্ধকার বসবার ঘরে নিয়ে গেল। কেউ তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ভেবে পিয়ের খুশি হল। তাকে রেখে আন্না মিখায়লভনা চলে গেল। ফিরে এসে দেখল হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সকালে আন্না মিখায়লভনা পিয়েরকে বলল :

হ্যাঁ বাবা, এটা আমাদের সকলেরই এক বিরাট ক্ষতি; তোমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু ঈশ্বর তোমার সহায় হবেন : তুমি যুবক, আর আমি আশা করি তুমি এখন প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী। উইলটা এখনো ভোলা হয় নি। তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি, তাই নিশ্চিত আশা রাখি যে সম্পত্তি তোমার মাথা ঘুরিয়ে দেবে না; কিন্তু এই সম্পত্তি তোমার উপর অনেক কর্তব্যের ভার চাপিয়েছে; তোমাকে মানুষ হতে হবে।

পিয়ের নীরব।

হয়তো পরে তোমাকে বলব বাবা যে আমি সেখানে না থাকলে কি যে ঘটত তা শুধু ঈশ্বরই জানেন! তুমি জান, গতকালের আগের দিনই তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, বরিসকে ভুলবেন না। কিন্তু তিনি তো সময় পেলেন না। আশা করি, তোমার বাবার ইচ্ছা তুমি পূরণ করবে।

পিয়ের এ সবকিছুই বুঝল না; লজ্জায় লাল হয়ে সে নিঃশব্দে প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভনার দিকে তাকাল। পিয়েরের সঙ্গে কথা বলে আন্না মিখায়লভনা রশুভদের বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঘুমতে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে রস্ত পরিবারকে এবং অন্য পরিচিত লোকদের কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যুর বিবরণ বিস্তারিতভাবে শোনাল। বলল, কাউন্ট যে ভাবে মারা গেছে সে-মৃত্যু তার নিজেরও কাম্য; তার পরিণতি শুধু মর্মস্পর্শী নয়, মহান। আর পিতা-পুত্রের শেষ সাক্ষাৎ, সেটি এতই মর্মস্পর্শী যে সে কথা ভাবলেই তার চোখে পানি আসে; সেই ভয়ংকর মুহূর্তগুলিতে কার ব্যবহার যে বেশি ভালো হয়েছিল তা সে জানে না যে পিতা শেষ মুহূর্তেও সব জিনিস ও সব মানুষকে স্মরণে রেখেছিল এবং ছেলেকে এত সব করুণ কথা বলেছিল, সে-না কি পিয়ের যে দুঃখে এতদূর ভেঙে পড়েছিল যে তাকে দেখেও কষ্ট হচ্ছিল, অথচ মুমূর্ষ বাবাকে কষ্ট না দেবার জন্য সে দুঃখকে সে প্রাণপণে চেপে রেখেছিল। মৃত্যু বেদনাদায়ক, তবু সে মানুষের কল্যাণ করে। বৃদ্ধ কাউন্ট ও তাঁর উপযুক্ত ছেলের মতো মানুষকে দেখিয়ে মৃত্যু আমাদের মনকে উন্নত করে, মহিলাটি বলল। বড় প্রিন্সেস ও প্রিন্স ভাসিলির ব্যবহারকে সে সমর্থন করল না, কিন্তু তাদের কথা সে বলল ফিসফিস করে অত্যন্ত গোপন । কথার মতো।

*

অধ্যায়-২৫

প্রিন্স নিকলাস আন্দ্রিভিচ বলকনস্কির জমিদারী বন্ড হিলসে তরুণ প্রিন্স আন্দ্রু ও স্ত্রীর আগমন প্রতিদিনই আশা করা হচ্ছিল, কিন্তু সেই আশার ফলে বৃদ্ধ প্রিন্সের গৃহস্থালির নিয়মিত কাৰ্যসূচীর কোনোরকম পরিবর্তন ঘটে নি। সম্রাট পল যেদিন তাকে তার গ্রামের জমিদারীতে নির্বাসিত করেছিল সেদিন থেকেই প্রধান সেনাপতি প্রিন্স নিকলাস আন্দ্রিভিচ (সমাজে তার ডাক নাম প্রাশিয়ার রাজা) মেয়ে প্রিন্সেস মারি ও তার সখী মাদময়জেল বুরিয়েকে নিয়ে সেখানেই একটানা বাস করে চলেছে। যদিও নতুন শাসন-ব্যবস্থায় সে ইচ্ছা করলেই রাজধানীতে ফিরে যেতে পারে, তবু সে এখনো গ্রামেই বাস করছে। তার বক্তব্য : কেউ যদি তার সঙ্গে দেখা করতে চায় তা হলে সে তো একশ মাইল পেরিয়ে মস্কো থেকে বন্ড হিলস-এই আসতে পারে; তার নিজের কাউকেই দরকার নেই, কোনো জিনিসেরও দরকার নেই। সে বলে, মানুষের পাপের উৎস দুটি–আলস্য আর কুসংস্কার, আবার সৎগুণও দুটি-কর্ম ও বুদ্ধি। মেয়ের শিক্ষার ভার সে নিজেই নিয়েছে; তার অন্তরে এই দুটি প্রধান গুণকে গড়ে তোলার জন্য তার বিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রিন্স তাকে বীজগণিত ও জ্যামিতি শিক্ষা দিয়েছে এবং এমনভাবে মেয়ের জীবনকে গড়ে তুলেছে যাতে সে সব সময়ই কর্মব্যস্ত থাকতে পারে। প্রিন্স নিজেও সব সময়ই কর্মব্যস্ত : স্মৃতি-কথা লেখা, উচ্চতর গণিতের সমস্যাসমূহের মীমাংসা, যন্ত্রের সাহায্যে নস্যি-দান প্রস্তুত, বাগানে কাজ, আর জমিদারীতে সর্বদাই যে সব বাড়ি তৈরি করা হয় তার তদারকি। যেহেতু নিয়মানুবর্তিতাই কর্ম-সাধনের প্রধান শর্ত, তাই তার গৃহস্থালিতে নিয়মানুবর্তিতাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে। ঠিক একই অবস্থায় সে সব সময় টেবিলে এসে বসে; শুধু একই ঘণ্টায় নয়, একই মিনিট গুণে। মেয়ে থেকে আরম্ভ করে ভূমিদাস পর্যন্ত যারা তাকে ঘিরে থাকে তাদের প্রতি সে বড়ই কঠোর ও অনমনীয়। তাদের প্রতি কঠোর-হৃদয় না হয়েও সে তাদের মনে যুগপৎ ভয় ও শ্রদ্ধা জাগাতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এখন সে অবসর জীবন যাপন করছে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে তার কোনো প্রভাব কর্মচারীই তার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করাটাকে তাদের কর্তব্য বলে মনে করে, এবং পূর্বনির্ধারিত যথাসময়ে প্রিন্স স্বয়ং উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত স্থপতি, মালী, অথবা প্রিন্সেস মারির মতোই মস্ত বড় দরবার-কক্ষে অপেক্ষা করে থাকে। পড়ার ঘরের অত্যন্ত উঁচু দরজাটা খুলে একটি বৃদ্ধ মানুষের ছোটখাট মূর্তি যখন পাউডার-মাখা পরচুলা, ছোট দুখানি শীর্ণ হাত ও ঘন পাকা ভুরু নিয়ে হাজির হয়, এবং সেই ভুরু দুটি কুঞ্চিত হয়ে তার তীক্ষ্ণ, যুবকোচিত উজ্জ্বল চোখের জলকানিকে কখনো কখনো ঢেকে দেয়, তখন সেই দরবার-কক্ষে সমাসীন প্রতিটি মানুষের মনেই সেই একই শ্রদ্ধা, এমন ভীতির সঞ্চার হয়।

নবদম্পতির যেদিন আসার কথা সেদিন সকালে প্রিন্সেস মারি দুরু দুরু বুকে ক্রুশ-চিহ্ন এঁকে নীরবে প্রার্থনা করতে করতে যথারীতি নির্ধারিত সময়ে প্রাতঃকালীন সাক্ষাৎকারের জন্য দরবার-ঘরে ঢুকল। প্রতিদিন সকালেই সে এইভাবে আসে এবং প্রতিদিন সকালেই প্রার্থনা জানায় যাতে সাক্ষাৎকার-পর্বটি ভালোভাবে সমাধা হয়।

যে বুড়ো চাকরটি সেখানে বসেছিল সে উঠে ফিসফিস করে বলল, দয়া করে ভিতরে আসুন।

একটা লেদ-যন্ত্রের গুনগুন শব্দ দরজা দিয়ে ভেসে আসছে। প্রিন্সেস ভয়ে ভয়ে দরজাটা খুলল। একটু থামল। প্রিন্স লেদে বসে কাজ করছিল; একবার চারদিক দেখে নিয়ে আবার কাজ করতে লাগল।

ঘরটা নানা জিনিসপত্রে ঠাসা। সবগুলিই সব সময় ব্যবহার করা হয়। বড় টেবিলটায় বই ও নক্সা ছড়ানো, চাবিসুদ্ধ কাঁচ-লাগানো উঁচু বুক-কেস, দাঁড়িয়ে লেখার জন্য উঁচু ডেঙ্কটায় একখানা খাতা খোলা পড়ে আছে, যন্ত্রপাতিসহ একটা লেদ-যন্ত্র, দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম–সবকিছুতেই নানাবিধ অবিশ্রাম ও সুশৃঙ্খল কাজকর্মের চিহ্ন পরিস্ফুট। রুপোর কাজ-করা তাতার বুট-পরা ছোট পায়ের কর্মচাঞ্চল্য এবং পেশীবহুল সরু হাতের দৃঢ় চাপ দেখলেই বোঝা যায় এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রিন্স তার কাজের ধৈর্য ও উৎসাহ অক্ষুণ্ণ রেখেছে। লেদটাকে আরো কয়েক পাক ঘুরিয়ে সে লেদের পা-দান থেকে পাটা তুলে নিল, বাটালিটাকে মুছে চামড়ার থলেটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, তারপর টেবিলের দিকে পা বাড়িয়ে মেয়েকে ডাকল। সে কখনো ছেলে-মেয়েদের আশীর্বাদ করে না; শুধু দাড়িসমেত গালটা (এখনো দাড়ি কামানো হয় নি) এগিয়ে দিয়ে সস্নেহে তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল :

ভালো আছ তো? ঠিক আছে, তাহলে বস। নিজের লেখা জ্যামিতির পাঠের অনুশীলন খাতাটা হাতে নিয়ে প্রিন্স পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিল।

তাড়াতাড়ি পৃষ্ঠাটা বের করে শক্ত নখ দিয়ে এক প্যারাগ্রাফ থেকে অন্য প্যারাগ্রাফ পর্যন্ত দাগ টেনে বলল, কালকের জন্য!

প্রিন্সেস টেবিলের উপরে অনুশীলন-খাতার উপর ঝুঁকে বসল।

একটু দাঁড়াও, তোমার একটা চিঠি আছে, হঠাৎ টেবিলের উপর দিকে ঝোলানো থলে থেকে মেয়েলি হাতে ঠিকানা লেখা একটি চিঠি বের করে প্রিন্স বলল।

চিঠিটা দেখেই প্রিন্সেসের গালে লালের ছোপ লাগল। তাড়াতাড়ি চিঠিটা নিয়ে তাতে মুখ গুঁজল।

হেলোসের চিঠি? প্রিন্স হেসে জিজ্ঞাসা করল; তার শক্ত, হলদে দাঁতগুলো দেখা গেল।

ভীরু চোখে তাকিয়ে ভীরু হাসি হেসে প্রিন্সেস বলল, হ্যাঁ, জুলির চিঠি।

প্রিন্স কড়া গলায় বলল, আরো দুটো চিঠি আমি ছেড়ে দেব, কিন্তু তৃতীয়টা আমি পড়ব। আমার ভয় হচ্ছে যে তোমরা অনেক বাজে কথা লেখ। তৃতীয় চিঠিটা আমি পড়বই।

ইচ্ছা করলে এটাও পড়তে পার বাবা, আরো লাল হয়ে প্রিন্সেস চিঠিটা বাড়িয়ে ধরল।

চিঠিটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রিন্স হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, তৃতীয়টা, বললাম না যে তৃতীয়টা পড়ব! তারপর টেবিলের উপর কনুই রেখে জ্যামিতির নক্সা-আঁকা অনুশীলন-খাতাটা সামনে টেনে নিল।

মেয়ের খুব কাছাকাছি খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে তার চেয়ারের পিছনে হাত রেখে প্রিন্স বলল, তাহলে মাদাম; অনেক দিনের পরিচিত বার্ধক্যের ও তামাকের কটুগন্ধ যেন মেয়েকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। দেখ মাদাম, এই ত্রিভুজগুলো সমান; খেয়াল রাখ যে ত্রিভুজ ক খ গ…

প্রিন্সেস ভয়ে ভয়ে বাবার চকচকে চোখের দিকে তাকাল; তার মুখের লাল আভা একবার ফুটে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়; স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে কিছুই বুঝতে পারছে না; সে এতই ভয় পেয়েছে যে তার বাবা যত ভালো করেই বোঝাক না কেন এই ভয়ের জন্যই সে কিছুই বুঝতে পারবে না। দোষটা শিক্ষকের কি ছাত্রীর কে জানে, আসলে প্রতিদিন এই একই ব্যাপার চলে; প্রিন্সেসের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, সে কিছুই দেখতে পায় না, শুনতে পায় না; শুধু বোঝে যে বাবার কঠিন শুকনো মুখটা তার পাশেই আছে, তার নিঃশ্বাস ও গন্ধ সে পাচ্ছে; আর শুধু ভাবে কতক্ষণে নিজের ঘরে গিয়ে শান্তিতে পড়াটা করতে পারবে। বুড়ো মানুষটি চটে যায়, চেয়ারটাকে একবার সামনে, একবার পিছনে ঠেলে, যাতে চটে না যায় সে জন্য নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু সব সময়ই চটে যায়, বকাঝকা করে, কখনো কখনো খাতাপত্রও ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

প্রিন্সেস একটা ভুল জবাব দিল।

এই দেখ, কী বোকা মেয়ে রে! প্রিন্সে চেঁচিয়ে উঠল; খাতাটাকে ঠেলে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল, চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু পায়চারি করল; তার পরেই আলতো করে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে আবার বসে পড়ল।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে আবার বোঝাতে বসল।

প্রিন্সেস মারি যখন খাতাটা নিয়ে সেটাকে বন্ধ করে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল তখন প্রিন্স বলে উঠল, তা চলবে না প্রিন্সেস, তা চলবে না। গণিতটাই হচ্ছে আসল মাদাম! আমি চাই না যে তুমিও ঐ সব বোকা মহিলাদের মতো হয়ে থাক। অভ্যাস কর, দেখবে তাহলেই সব বুঝতে পারবে। মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, গণিত তোমার মাথার ভিতর থেকে সব জঞ্জাল ঝেটিয়ে বার করে দেবে।– মেয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই প্রিন্স ইশারায় তাকে থামতে বলে উঁচু ডেস্ক থেকে একটা আনকোরা নতুন বই নামাল।

এই রহস্যের চাবিকাঠি বইখানা তোমার হেলোস তোমার জন্য পাঠিয়েছে। ধর্মপুস্তক! কারো ধর্মবিশ্বাসে আমি হাত দেই না।…বইটা আমি দেখেছি। এটা নাও। আচ্ছা, এবার যাও। যাও।

মেয়ের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে প্রিন্স নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিল।

ভীত, বিষণ্ণ মুখে প্রিন্সেস মারি তার ঘরে ফিরে গেল। এ অবস্থা তার প্রায় সব সময়ই হয়। তার সাদা রোগাটে মুখটা আরো সাদা হয়ে গেছে। লেখার টেবিলে বসল। টেবিলে অনেক হোট প্রতিকৃতি। বই ও কাগজপত্র ছড়ানো। বাবা যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মেয়ে তেমনি অগোছালো। জ্যামিতির খাতা রেখে সাগ্রহে সে চিঠির সিল ভেঙে ফেলল। তার ছেলেবেলা থেকে সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জুলির চিঠি। রস্তভ-পরিবারের নামকরণ অনুষ্ঠানে যে জুলি কারাগিন উপস্থিত ছিল এ সেই।

জুলি ফরাসিতে লিখেছে :

প্রিয় সোনা বন্ধু, বিরহ কি ভয়ংকর, ভয়াবহ! যদিও, নিজেকে বলি, আমার অর্ধেক জীবন ও অর্ধেক সুখ তোমাকেই জড়িয়ে আছে, আমাদের মাঝখানে যত দূরত্বই থাকুক, আমাদের দুটি হৃদয় অচ্ছেদ্য বন্ধনে এক সাথে বাধা, তবু আমার মন ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, চারদিকের এত সুখ ও আমাদের মধ্যেও আমাদের ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে যে গোপন দুঃখ আমার মনে বাসা বেঁধেছে তাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। গত গ্রীষ্মকালে তোমার বড় পড়ার ঘরটিতে, নীল সোফার উপরে, সেই গোপন সোফার উপরে, আমরা যে ভাবে মিলিত হয়েছিলাম, সেই ভাবে আবার কেন মিলিত হতে পারছি না? তোমার যে শান্ত, স্নিগ্ধ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে আমি এত ভালোবাসি, লিখতে বসে এখনো সে দৃষ্টি আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, তিন মাস আগের মতো এখনো কেন আমি সেই দৃষ্টি থেকে নতুন করে নৈতিক শক্তি সংগ্রহ করতে পারছি না?

এই পর্যন্ত পড়ে প্রিন্সেস মারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডান দিককার আয়নাটার দিকে তাকাল। একটি দুর্বল, সাধারণ দেহ ও পাতলা মুখের ছায়া পড়েছে সেখানে। তার বিষণ্ণ চোখ দুটি যেন একান্ত হতাশভাবে আয়নার সেই প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। ও আমাকে স্তোকবাক্য শোনাচ্ছে, এই কথা ভেবে মুখ ফিরিয়ে সে আবার পড়তে শুরু করল। জুলি কিন্তু বন্ধুকে স্তোকবাক্য বলে নিঃ প্রিন্সেসের বড় বড়, গভীর, উজ্জ্বল চোখ দুটি এতই সুন্দর যে তার ফলে তার সাদামাঠা মুখখানিও অন্য যে কোনো সুন্দরীর মুখের চাইতে অধিক আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতে তার চোখে যে সুন্দর ভাবটি ফুটে ওঠে প্রিন্সেস নিজে তো কখনো তা দেখতে পায় না। অন্য সকলের মতোই আয়নার দিকে তাকাতে গেলেই তার মুখে জোর করে টেনে আনা একটা অস্বাভাবিক ভঙ্গি ফুটে ওঠে। সে পড়তে লাগল :

সারা মস্কো জুড়ে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো কথা নেই। আমার দুই ভাইয়ের একজন ইতিমধ্যেই চলে গেছে, আর একজন রক্ষীবাহিনীতে আছে, শীঘ্রই তারাও সীমান্তের পথে পা বাড়াবে। আমাদের প্রিয় সম্রাট পিটার্সবুর্গ ছেড়ে চলে গেছেন; সকলেরই ধারণা, বহুমূল্য জীবন নিয়ে তিনিও রণক্ষেত্রে দর্শন দেবেন। ঈশ্বর করুন, সর্বশক্তিমান কৃপা করে যে দেবদূতকে আমাদের সম্রাট করে পাঠিয়েছেন, তার হাতে যেন ইওরোপের শান্তি ধ্বংসকারী কর্সিকার রাক্ষসটি পর্যদস্ত হয়! ভাইদের কথা তো বলাই বাহুল্য, এই যুদ্ধ আমার অন্তরের একজন নিকটতম সাথীর সঙ্গ থেকেও আমাকে বঞ্চিত করেছে। আমি তরুণ নিকলাস রস্তভের কথা বলছি। অন্তরের উৎসাহ তাকে কর্মহীন থাকতে দেয় নি; বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি। গত গ্রীষ্মকালে এই যুবকটির কথা তোমাকে আমি বলেছি; সে এতই মহৎ-হৃদয়, সত্যিকারের যৌবনদীপ্তিতে তার মন এতই ভরপুর যে আজকালকার বিশ বছরের বুড়োদের মধ্যে তা কদাচিৎ দেখা যায়। তাছাড়া, সে এত দিলখোলা, এত হৃদয়বান যে কি বলব। সে এত পবিত্র ও কাব্যময় যে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব অল্প দিনের হলেও সেই সম্পর্কের স্মৃতি আমার দীন অন্তরের এক মধুরতম সান্ত্বনার স্থল। আমাদের বিদায়ের কথা, অন্য যে সব কথা তখন হয়েছিল, সব একদিন তোমাকে বলব। সে স্মৃতি এখনো এত তাজা যে বলবার মতো নয়। আহা প্রিয় বন্ধু, তুমি কী সুখী যে এই তীব্র আনন্দ ও দুঃখের কথা তোমাকে জানতে হয় নি। তুমি ভাগ্যবতী, কারণ এ সবক্ষেত্রে দুঃখের মাত্রাটাই বড় বেশি হয়ে থাকে! আমি ভালো করেই জানি যে কাউন্ট নিকলাস বয়সে এতই তরুণ যে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের অধিক কোনো সম্পর্ক আমার হয় নি; কিন্তু এই মধুর বন্ধুত্ব, এই কাব্যময় পবিত্র ঘনিষ্ঠতা-এর যে আমার বড়ই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এ কথা আর নয়! যে প্রধান সংবাদটি এখন সারা মস্কোর মুখে মুখে ফিরছে সেটি হল বুড়ো কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যু ও তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ভাবতে পার! তিন প্রিন্সেস পেয়েছে যৎসামান্য, প্রিন্স ভাসিলি কিছুই পায় নি, আর মঁসিয় পিয়ের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তো হয়েছেই, তার উপরে সে বৈধ সন্তান হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে; ফলে সেই এখন কাউন্ট বেজুখভ এবং রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পত্তির মালিক। গুজব যে এ ব্যাপারে প্রিন্স ভাসিলি একটি ঘৃণ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, আর হতাশ হয়ে পিটার্সবুর্গে ফিরে গেছেন।

স্বীকার করছি, এই সব উইল ও উত্তরাধিকারের ব্যাপার-স্যাপার আমি সামান্যই বুঝি; কিন্তু এটা ভালোই জানি, যে যুবকটিকে আমরা এতদিন সাদামাঠা মঁসিয় পিয়ের বলেই জানতাম সে আজ কাউন্ট বেজুখভ হওয়ায় এবং রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সম্পত্তির মালিক হওয়ায় তার প্রতি বিবাহযোগ্য কন্যাদের মামণিদের ও সেই সব কন্যাদের আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তায় যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে আমার ভারী মজা লাগছে; অথচ তোমার-আমার মধ্যে বলছি, আমার কিন্তু আগাগোড়াই তাকে একটি বেচারা গোছর লোক বলেই মনে হয়েছে। গত দুবছর ধরে এখানকার লোকজনরা যেমন আমার জন্য স্বামী খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে (যাদের অনেককেই আমি চিনি না পর্যন্ত), তেমনি এখনো আবার মস্কোর ঘটক মহলে জোর গুজব যে আমিই নাকি ভাবী কাউন্টেস বেজুখভা। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে সে পদটির জন্য আমার কোনো বাসনা নেই। হ্যাঁ, বিয়ের প্রসঙ্গে বলি : তুমি কি জান যে এই কিছুক্ষণ আগে সেই সর্বজনীন খালা আন্না মিখায়লভনা আমার কাছে এসে একান্ত গোপনীয় রাখবার শর্তে তোমার বিয়ের একটা প্রস্তাবের কথা বলে গেছেন। সেই ভাবীটি প্রিন্স ভাসিলির ছেলে আনাতোল ছাড়া আর কেউ নয়। কোনো ধনবতী বিশিষ্ট কন্যার সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে তারা ছেলেদের চরিত্রকে সংশোধন করতে ইচ্ছুক, আর সেজন্য তার আত্মীয়স্বজনরা তোমাকেই পছন্দ করেছে। এ বিষয়ে তুমি কি ভাববে আমি জানি না, কিন্তু কথাটা তোমাকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে করি। শুনেছি সে নাকি খুব সুদর্শন ও ভয়ংকর লম্পট। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকুই জানতে পেরেছি।

কিন্তু এ সব গালগল্প তো অনেক হল। চিঠির দুনম্বর পাতা প্রায় শেষ করে এনেছি; আপ্রাক্সিনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাবার জন্য মামণির ডাক এসেছে। মরমিয়াবাদের উপর যে বইখানা পাঠালাম পড়ে দেখো; এখানে বইটার প্রচুর সুখ্যাতি। দুর্বল মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই বোঝা শক্ত, তবু এই আশ্চর্য বইটি মনকে। শান্ত করে, উন্নত করে। বিদায়! তোমার বাবা মঁসিয়কে আমার শ্রদ্ধা জানিও, আর মাদময়জেল বুরিয়েকে জানিও আমার প্রীতি। তোমাকে জানাই ভালোবাসাভরা আলিঙ্গন।জুলি

পুনশ্চ। তোমার ভাই ও তার মনোরমা ছোট্ট স্ত্রীটির সংবাদ জানিও।

ঈষৎ হেসে প্রিন্সেস কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ; সে হাসিতে তার উজ্জ্বল চোখ দুটি এমনভাবে জলমল করে উঠল যে তার মুখের চেহারাটাই সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তারপর হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল, ভারি পা ফেলে টেবিলের কাছে গেল। এক তা কাগজ নিয়ে তার উপর দ্রুত হাত চালাতে লাগল। চিঠির জবাব লিখে ফেলল ফরাসিতে :

প্রিয় সোনা বন্ধু,-তোমার ১৩ তারিখের চিঠি আমাকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছে। রোমান্টিক জুলি আমার, তাহলে এখন তুমিও আমাকে ভালোবাসা যে বিরহকে তুমি এত খারাপ বলে উল্লেখ করেছ তার স্বাভাবিক প্রভাব তো তোমার উপর পড়েছে বলে মনে হয় না। তুমি আমাদের বিরহের নালিশ জানিয়েছ। আমি যদি নালিশ জানাতে পারতাম, তাহলে কি বলতাম? আমি যে সব প্রিয়জনের সঙ্গসুখ হতে বঞ্চিত হয়ে আছি। আঃ, ধর্মের কাছ থেকে যদি সান্ত্বনা না পেতাম, তাহলে যে জীবন বড়ই দুঃখময় হত। সেই যুবকটির প্রতি তোমার অনুরাগকে আমি বিরূপ চোখে দেখব এ-কথা তুমি ভাবলে কেমন করে? এ সব ব্যাপারে আমি শুধু নিজের উপরেই বিরূপ হই। অপরের বেলায় এ ধরনের মনোভাব আমি বুঝতে পারি; নিজের সে অভিজ্ঞতা না থাকায় আমি তাকে সমর্থন করতে পারি না, কিন্তু তাই বলে নিন্দাও তো করতে পারি না। আমার শুধু মনে হয়, একটি যুবকের সুন্দর দুটি চোখ তোমার মতো একটি রোমান্টিক প্রেমময়ী যুবতীর অন্তরে যে অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে তার তুলনায় খৃস্টিয় ভালোবাসা, প্রতিবেশীকে ভালোবাসা, শত্রুকে ভালোবাসা অনেক মহত্তর, মধুরতর, শ্রেয়তর।

তোমার চিঠি আসার আগেই কাউন্ট বেজুখভের মৃত্যু-সংবাদ আমরা পেয়েছি; বাবা তাতে খুবই বিচলিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, কাউন্ট ছিলেন একট মহান শতাব্দীর একজন ব্যথীত শেষ প্রতিনিধি; এবার তার পালা, কিন্তু সে পালা যাতে যথাসম্ভব দেরিতে আসে সে জন্য তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। সেই ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের হাত থেকে ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন!

পিয়ের সম্পর্কে তোমার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না; শিশুকাল থেকে তাকে আমি চিনি। চিরকালই আমার মনে হয়েছে যে সে একটি মহৎ হৃদয়ের অধিকারী, আর মানুষের এই গুণটিকেই আমি সবচাইতে বেশি মূল্য দিয়ে থাকি। তার উত্তরাধিকার এবং প্রিন্স ভাসিলির ভূমিকা সম্পর্কে বলি, দুজনের পক্ষেই ব্যাপারটা দুঃখের। হায় প্রিয় বন্ধু, আমাদের স্বর্গীয় উদ্ধারকর্তার সেই বাণী–একটি উট যদি বা ছুঁচের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে যেতে পারে, কোনো ধনী কদাপি ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না–যা ভয়ংকরভাবে সত্য। প্রিন্স ভাসিলির জন্য আমার দুঃখ হয়, কিন্তু ততোধিক দুঃখ হয় পিয়েরের জন্য। এত অল্প বয়স আর এত সম্পদের ভার-কত না প্রলোভন তার সামনে হারি হবে! আমাকে যদি কেউ শুধায়, পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি করে আমি কি চাই তো আমি চাইব-দরিদ্রতম ভিক্ষুকের চাইতেও দরিদ্রতর হতে। প্রিয় বন্ধু, মস্কোতে এত সাফলমণ্ডিত যে বইখানি তুমি আমাকে পাঠিয়েছ তার জন্য হাজার ধন্যবাদ। তথাপি যেহেতু তুমি লিখেছ যে অনেক ভালো কথার মধ্যে বইটিতে এমন সব কথা আছে, আমাদের দুর্বল মানবিক বুদ্ধি যার নাগাল পায় না, সেইহেতু আমার মনে হয়, যা দুর্বোধ্য এবং সে কারণে ফলপ্রসূ হতে পারে না তা পড়ে সময় নষ্ট করা বৃথা। মরমীয়াবাদ সংক্রান্ত বইগুলি মানুষের মনকে শুধু সন্দেহগ্রস্ত করে তোলে, তাদের কল্পনাকে উত্তেজিত করে; ফলে খৃস্টিয় সরলতার পরিবর্তে তাদের মনে সবকিছুকে বাড়িয়ে দেখবার একটা প্রবণতা জন্মে। এইভাবে কিছু লোক কেন যে তাদের চিন্তাশক্তিকে গুলিয়ে ফেলতে ভালোবাসে আমি তা বুঝতে পারি না। তার চাইতে আমরা কেন পত্রাবলি ও সুভাষিতাবলি পড়ি না। তাদের মধ্যে রহস্যময় যা কিছু আছে তার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা যেন আমরা না করি; আমরা তো শোচনীয় পাপীর দল; যে রক্ত-মাংসের দেহ আমাদের ও চিরশাশ্বতের মধ্যে একটা দুর্ভেদ্য যবনিকা রচনা করে আছে যতদিন আমরা তার মধ্যে বাস করছি ততদিন ঈশ্বরের সব ভয়ংকর ও পবিত্র গোপন কথাকে আমরা কেমন করে জানব? তার চাইতে এই মরজগতে আমাদের পথ দেখাবার জন্য স্বর্গীয় পরিত্রাতা যে সব মহৎ বিধান আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার পঠন-পাঠনের মধ্যে নিজেদের সীমিত রাখাই তো আমাদের পক্ষে বাঞ্ছনীয়। আমাদের চেষ্টা করতে হবে সেই সব বিধান মেনে তাকে অনুসরণ করে চলতে; আমাদের বুঝতে হবে যে মানুষের দুর্বল মনের সুতোকে আমরা যত অল্প ছাড়ব ততই আমরা ঈশ্বরকে খুশি করতে পারব। যে জ্ঞান ঈশ্বর থেকে আগত নয় তাকে তিনি সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। আর যে রহস্যকে তিনি কৃপা করে আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন তাকে পরিমাণ করতে আমরা যত অল্প চেষ্টা করব ততই তিনি তাঁর ঐশ্বরীয় আবির্ভাবের ভিতর দিয়ে সেই রহস্যকে উন্মোচন করবেন।

আমার বাবা কোনো বরের কথা আমাকে বলেন নি, তবে এ কথা বলেছেন যে প্রিন্স ভালিসির চিঠি তিনি পেয়েছেন এবং আশা করছেন যে প্রিন্স এখানে আসবেন। আমার বিয়ের এই প্রস্তাব সম্পর্কে তোমাকে বলতে চাই যে বিয়েকে আমি এমন একটি ঐশ্বরিক অনুষ্ঠান বলে মনে করি যাকে মেনে চলা কর্তব্য। সর্বশক্তিমান যদি স্ত্রী ও মা হবার কর্তব্য আমার উপর চাপিয়ে দেন তাহলে আমার পক্ষে যত দুঃখদায়কই হোক না কেন সে কর্তব্যকে যথাযথভাবে পালন করতেই আমি চেষ্টা করব; স্বামী হিসেবে তিনি যাকেই আমার কাছে পাঠাবেন তার প্রতি আমার মনোভাবের কথা বিচার করে নিজেকে বিচলিত করে তুলব না।

ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি; লিখেছে, শিগগিরই বৌকে নিয়ে বন্ড হিলসে আসবে। অবশ্য এ আনন্দ খুবই অল্প দিনের, কারণ এই দুঃখের যুদ্ধে অংশ নিতে সে আবার চলে যাবে। এ যুদ্ধে যে কীভাবে । আর কি কারণে আমরা জড়িয়ে পড়েছি তা ঈশ্বরই জানেন। যে কর্মব্যস্ত জগতের একেবারে মাঝখানে তোমরা রয়েছ শুধু যে সেখানেই যুদ্ধের কথা চলছে তাই নয়, এখানে, এই ক্ষেত-খামারের কাজ ও শান্ত প্রকৃতির মধ্যে-শহরের লোকরা যাকে দেশের মূল বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে সেখানেও যুদ্ধের গুজব ছড়াচ্ছে আর আমরা তা মর্মে মর্মে বুঝছি। বাবা তো শুধু অভিযান আর পাল্টা অভিযানের কথাই বলেন; আমি তার কিছুই বুঝি না। গতকালের আগের দিন গ্রামের পথে দৈনন্দিন ভ্রমণের সময় একটা মর্মভেদী দৃশ্য দেখেছি…আমাদের অঞ্চল থেকে বলপূর্বক সংগৃহীত একদল সৈনিক চলেছে যুদ্ধে যোগ দিতে। যারা যাচ্ছে তাদের মা, বৌ ও ছেলেমেয়েদের অবস্থা যদি দেখতে, তাদের ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না যদি শুনতে! মনে হল, যে স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা প্রেম ও ক্ষমার বাণী প্রচার করেছেন তাঁর বিধান বুঝি মানুষ ভুলে গেছে পরস্পরের হানাহানির কৌশলকে দিচ্ছে সর্বাধিক মূল্য।

বিদায়, প্রিয় বন্ধু; আমাদের স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা ও তাঁর পরম পবিত্র জননী তাঁদের পবিত্র ও সর্বক্ষম যন্ত্র দিয়ে তোমাকে ঘিরে রাখুন!-মারি।

আরে, প্রিয় বন্ধু; আমাদের স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা ও তাঁর পরম পবিত্র জননী তাঁদের পবিত্র ও সর্বক্ষম যন্ত্র দিয়ে তোমাকে ঘিয়ে রাখুন!-মারি।

আরে, তুমি একটা চিঠি পাঠাচ্ছ প্রিন্সেস? আমার চিঠি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। চিঠিটা মাকে লিখেছি, হাস্যময়ী মাদময়জেল বুরিয়ে দ্রুতলয়ে কথাগুলি বলে গেল। প্রিন্সেস মারির প্রচণ্ড শোক ও বিষণ্ণতা ভরা জগতে সে যেন নিয়ে এল একটা সম্পূর্ণ নতুন হাওয়া নিশ্চিন্ত, হাল্কা ও আত্মতুষ্ট।

গলা নামিয়ে সে আবার বলল, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি প্রিন্সেস, প্রিন্স কিন্তু মাইকেল আইভানভিচকে বকছেন। তার মেজাজ কিন্তু খুব খারাপ। তৈরি থেকো।

প্রিন্সেস মারি বলল, দেখ বন্ধু, তোমাকে তো বলেছি আমার বাবার মেজাজ নিয়ে তুমি কখনো আমাকে সাবধান করে দেবে না। আমি নিজে কখনো তার বিচার করি না, আর অন্য কেউ করুক তাও চাই না।

প্রিন্সেস ঘড়ি দেখল; ক্ল্যাভিকর্ড নিয়ে অনুশীলন শুরু করতে পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে দেখে ভয়ে ভয়ে সে বসবার ঘরে ঢুকল। বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত প্রিন্স বিশ্রাম নেয়, আর প্রিন্সেস ক্ল্যাভিকর্ড বাজায়।

*

অধ্যায়-২৬

বড় পড়ার ঘরটাতে প্রিন্স নাক ডাকাচ্ছিল। পাকা-চুল খানসামাটি বসে ঝিমুতে ঝিমুতে সেই নাসিকা-ধ্বনি শুনছিল। বাড়ির একেবারে অন্য প্রান্ত থেকে বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে ভেসে আসছে দুসেকের একটা গতের কতকগুলি শক্ত অংশের বার বার আবৃত্তির শব্দ।

ঠিক সেই সময় একখানা ঢাকা গাড়ি ও একখানা খোলা গাড়ি এসে উঠোনে ঢুকল। প্রিন্সে আন্দ্রু গাড়ি থেকে নেমে তার স্ত্রীকে নামতে সাহায্য করল এবং নিজের আগেই তাকে বাড়ির ভিতরে যাবার ব্যবস্থা করে দিল। বুড়ো তিখন মাথায় পরচুলা এঁটে দরজার ফাঁক দিয়ে মাথাটা বের করে ফিসফিস করে জানিয়ে দিল যে প্রিন্স তখনো ঘুমুচ্ছে; তারপরই তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল। তিখন জানে, ছেলেই আসুক আর কোনো অসাধারণ ঘটনাই ঘটুক, কিছুতেই নির্দিষ্ট দৈনন্দিন কর্মসূচীর কোনো বিঘ্ন ঘটানো চলবে না। তিখনের মতোই প্রিন্স আন্দ্রুও সে কথা জানে। তাই সে এখান থেকে চলে যাবার পরে তার বাবার অভ্যাসগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেটা বুঝবার জন্য ঘড়িটা একবার দেখল; যখন বুঝল যে পরিবর্তন কিছু ঘটে নি তখন সে স্ত্রীর দিকে মুখ ফেরাল।

বলল, বাবা কুড়ি মিনিটের মধ্যেই উঠে পড়বেন। আমরা বরং মারির ঘরেই যাই।

ছোট প্রিন্সেস এতদিনে একটু শক্ত-পোক্ত হয়েছে; কিন্তু সে যখন আগেকার মতোই খুশি-খুশিভাবে কথা বলতে শুরু করল তখন তার চোখ দুটো আর হাসি-হাসি ঠোঁটটা উল্টো গেল।

চারদিক তাকিয়ে স্বামীকে বলল, আরে, এ যে রাজপ্রাসাদ গো! চল, তাড়াতাড়ি চল! চারদিকে দেখে নিয়ে সে একবার তিখনের দিকে, একবার স্বামীর দিকে, ও পরে পরিচারকের দিকে তাকিয়ে হাসল।

ঐ তো মারি বাজনা বাজাচ্ছে না? চল, চুপি চুপি গিয়ে ওকে অবাক করে দেই।

মুখে একটা ভদ্র অথচ বিষণ্ণ ভাব ফুটিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু তাকে অনুসরণ করল।

তিখন এগিয়ে এসে তার হাতে চুমো খেল। প্রিন্স বলল, তুমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছ তিখন।

যে ঘর থেকে ক্ল্যাভিকর্ডের শব্দ আসছিল তারা সে ঘরে পৌঁছবার আগেই ফরাসি সুন্দরী মাদময়জেল বুরিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে এল।

চেঁচিয়ে বলল, প্রিন্সেসের কি আনন্দের দিন! শেষপর্যন্ত! ওকে এখনই খবর দিচ্ছি।

তাকে চুমো খেয়ে ঘোট প্রিন্সেস বলল, না, না, দয়া করে বলো না।…তুমি তো মাদময়জেল বুরিয়ে। তোমার সঙ্গে আমার ননদের বন্ধুত্বের সূত্রে তোমাকে আমি আগেই চিনেছি। আমরা আসব সে কি জানে না?

যে ঘর থেকে সোনাতার একই অংশ বারবার বাজাবার শব্দ আসছিল, সকলে সেই ঘরের দরজায় উপস্থিত হল। যেন অপ্রীতিকর কিছুর আশংকায় প্রিন্স আন্দ্রু মুখটা বেঁকিয়ে থেমে গেল।

ছোট প্রিন্সেস ঘরে ঢুকল। মাঝপথে বাজনা থেমে গেল, একটা আনন্দের চিৎকার শোনা গেল। তারপরই প্রিন্সেস মারির ভারী পায়ের শব্দ ও চুমো খাবার আওয়াজ। প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢুকল। তার বিয়ের সময় মাত্র অল্প দিনের জন্য এই দুই প্রিন্সেসের দেখা হয়েছিল! তবু এখন তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে যে যেখানে পারছে অনবরত চুমো খাচ্ছে। মাদময়জেল বুরিয়ে বুকের উপর হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে; মুখে অপার্থিব হাসি; দেখে মনে হয় যে কোনো সময়ে সে কেঁদে ফেলবে বা হেসে উঠবে। ভুল বাজনা শুনলে সঙ্গীত রসিকতা যেমন করে থাকে, প্রিন্স আন্দ্রুও সেই ভাবে ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে ভুরু কুঁচকাল। প্রিন্সেসরা পরস্পরকে ছেড়ে দিল। তারপর বুঝি বা দেরি হয়ে গেছে এই আশংকায় দুজনই দুজনের হাত চেপে ধরে চুমো খেয়ে হাত ছেড়ে দিল; আবার পরক্ষণেই পরস্পরের মুখে চুমো খেয়ে প্রিন্স আন্দ্রুকে অবাক করে দিয়ে দুজনই কাঁদতে লাগল ও চুমো খেতে লাগল। মাদময়জেল বুরিয়েও কাঁদতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু খুবই অস্বস্তি বোধ করল। কিন্তু প্রিন্সেস দুজনের কাছে এই কান্নাটাই একান্ত স্বাভাবিক বলে মনে হল; তাদের এই সাক্ষাতের সময় তাদের ব্যবহার যে অন্যরকম হতে পারে এটা তাদের মাথায়ই এল না।

আঃ! সোনা আমার! আঃ! মারি!… কথাগুলি বলতে বলতে তারা হো-হো করে হেসে উঠল। কাল রাতেই আমি স্বপ্ন দেখেছি…–তুমি কি আমাদের আশা কর নি?…–আঃ! মারি! তুমি শুকিয়ে গেছ!…–আর তুমি খুব মুটিয়েছ!…।

আমি কিন্তু দেখেই প্রিন্সেসকে চিনতে পেরেছি, মাদময়জেল বুরিয়ে বলল।

আর আমি তো ভাবতেই পারি নি!.. প্রিন্সেস মারি চেঁচিয়ে বলল। আরে আ, তোমাকে তো আমি দেখতেই পাই নি।

প্রিন্স আন্দ্রু ও তার বোন হাত ধরাধরি করে পরস্পরকে চুমো খেল; প্রিন্স আন্দ্রু বোনকে বলল যে সে এখন সেই ছিচকাঁদুনে মেয়েটিই আছে। প্রিন্সেস মারি মুখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল; অশ্রুসজল দুটি উজ্জ্বল চোখ রাখল প্রিন্স আর মুখের উপর।

ছোট প্রিন্সেস অনবরত বকবক করতে লাগল; তার লোমশ ছোট উপরের ঠোঁটটা বার বার নিচের ঠোঁটটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, আর তখনি ঈষৎ হাসির সঙ্গে তার চকচকে দাঁতগুলি দেখা যাচ্ছে; চোখ দুটি ঝিলমিলিয়ে উঠছে। সে বলতে লাগল : পাকি পাহাড়ে তারা একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল; তার এই অবস্থায় একটা গুরুতর কিছু ঘটতে পারত; সব জামা-কাপড় সে পিটার্সবুর্গে রেখে এসেছে, তাই এখানে কি যে পরবে তাই সে জানে না; আন্দ্রু খুব বদলে গেছে; কিটি অদিন্তসভা একটি বুড়োকে বিয়ে করেছে; মারির জন্য একটি সত্যিকারের বর জুটেছে, তবে সে বিষয়ে পরে কথা হবে। প্রিন্সেস মারি তখনো তার ভাইয়ের দিকেই নীরবে তাকিয়ে আছে; তার সুন্দর চোখ দুটি ভালোবাসা। ও বিষণ্ণতায় ভরা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তার বৌদি যাই বলুক না কেন, তার মনের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র চিন্তার ধারা বয়ে চলেছে। পিটার্সবুর্গের গত উৎসবের বর্ণনার মাঝখানেই সে ভাইকে বলল :

তাহলে সত্যি সত্যি তুমি যুদ্ধে যাচ্ছ আন্দু? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লিজাও দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

হ্যাঁ, আর কালই যাচ্ছি, ভাই জবাব দিল।

ও আমাকে এখানে রেখে যাচ্ছে; ও তো প্রমোশন পেতে পারত, তবু কেন যে আমাকে রেখে যাচ্ছে তা ঈশ্বরই জানেন…

শেষপর্যন্ত না শুনে নিজের চিন্তার জের টেনেই প্রিন্সেস মারি ভ্রাতৃবধূর দিকে মুখ ফিরিয়ে শুধাল, এটা কি ঠিক?

ছোট প্রিন্সেসের মুখের ভাব বদলে গেল। আবার নিঃশ্বাস ফেলে বলল, …হ্যাঁ, খুব ঠিক। আঃ! কী ভয়াবহ…

তার ঠোঁট নেমে এল। ভ্রাতৃবধূর মুখের কাছে মুখ নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আবার সে কাঁদতে শুরু করল।

প্রিন্স আন্দ্রু ভুরু কুঁচকে বলল, ওর বিশ্রামের দরকার। তাই না লিজা? ওকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আমি বাবার কাছে যাচ্ছি। বাবা কেমন আছেন? সেই রকমই?

হ্যাঁ ঠিক সেই রকম। যদিও তুমি কি মনে করবে আমি জানি না, প্রিন্সেস খুশি হয়ে বলল।

আর সেই রকম ঘণ্টা ধরে চলা? পথ দিয়ে বেড়ানো? আর সেই লেদ? প্রশ্নগুলি করবার সময় প্রিন্স আন্দ্রুর মুখে ঈষৎ হাসি খেলে গেল; বোঝা গেল, বাবার প্রতি যথেষ্ট ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তার দুর্বলতা সম্পর্কেও সে সচেতন।

ঘণ্টার হিসেব ঠিকই আছে; লেদও; আমার গণিত ও জ্যামিতির পাঠও একভাবেই চলছে, এমন খুশির সুরে প্রিন্সেস মারি কথাটা বলল যেন জ্যামিতিই তার জীবনের সবচাইতে খুশির ব্যাপার।

বিশ মিনিট পরে যখন বুড়ো প্রিন্সের উঠবার সময় হল তখন তিখন এল ছোট প্রিন্সকে তার বাবার কাছে নিয়ে যেতে। ছেলের আগমনের সম্মানে বুড়ো লোকটি দৈনন্দিন কর্মসূচীর একটু পরিবর্তন ঘটাল : ডিনারের পোশাক পরার সময়ই সে ছেলেকে তার ঘরে নিয়ে আসবার অনুমতি দিল। বুড়ো প্রিন্স সবসময়ই পুরোনো ধরনের পোশাক পরে–একটা সেকেলে কোট ও পাউডার-মাখা চুল। প্রিন্স আন্দ্রু যখন বাবার সাজ-ঘরে ঢুকল তখন বুড়ো লোকটি একটা বড় চামড়া-ঢাকা চেয়ারে বসেছিল। তিখন তার মাথায় পাউডার লাগাচ্ছে।

পাউডার মাখা মাথাটা সজোরে নাড়তে নাড়তে বুড়োলোকটি বলে উঠল, আঃ! এই যে মহাবীর! বোনাপার্তকে পরাজিত করতে চাও কি? তার সঙ্গে অন্তত একটু ভালোভাবে বোঝাঁপড়া কর; নইলে সে যদি এইভাবে চলতে থাকে তো অচিরেই আমাদের সবাইকে তার প্রজা বানিয়ে ছাড়বে। কেমন আছ? বলে সে গালটা বাড়িয়ে দিল।

খাবার আগে একটু ঘুমের ফলে বুড়ো লোকটির মেজাজ বেশ ভালো আছে। (বুড়ো প্রিন্স প্রায়ই বলে, খাবারের পরে ঘুম রুপো,-খাবার আগে ঘুম সোনা।) ঘন ভুরুর নিচ দিয়ে সে বাঁকা চোখে ছেলের দিকে তাকাল। প্রিন্স আন্দ্রু এগিয়ে গিয়ে বাবা যেখানটায় দেখিয়ে দিল সেখানে চুমো খেল। সামরিক বিভাগের লোকদের নিয়ে, বিশেষ করে বোনাপার্তকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা তার বাবার এই প্রিয় বিষয়। তাই প্রিন্স আন্দ্রু বাবার কথার কোনো জবাব দিল না।

সাগ্রহে সশ্রদ্ধভাবে বাবার মুখের প্রতিটি ভঙ্গির দিকে নজর রেখে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, হ্যাঁ বাবা, আমি আপনার কাছে এসেছি; আমার গর্ভবতী স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আপনার স্বাস্থ্য কেমন আছে?

দেখ বাবা, শুধু বোকা আর লম্পটরাই অসুখে ভোগে। তুমি তো আমাকে জান; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি কাজ নিয়ে থাকি। আমি মিতাচারীও; কাজেই আমি ভালোই আছি।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ছেলে হেসে বলল।

এ ব্যাপারে ঈশ্বরের কিছু করবার নেই! বলেই সে তার প্রিয় বিষয়বস্তুতে ফিরে গেল; যে নতুন বিজ্ঞানকে তোমরা রণকৌশল বল তার সাহায্যে বোনাপার্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা জার্মানরা তোমাদের কীভাবে শিখিয়েছে বল তো?

প্রিন্স আন্দ্রু হাসতে লাগল।

সব ব্যাপারটা বুঝে নিতে আমাকে সময় দিন বাবা, ছেলে হেসে বলল। বোঝা গেল, বাবার চরিত্রের দুর্বলতা সত্ত্বেও ছেলে তাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। আহ আমি তো এখনো গুছিয়ে বসতেই পারি নি!

বুড়ো লোকটি ছেলের হাত চেপে ধরে সজোরে মাথা নেড়ে বলে উঠল, বাজে কথা, বাজে কথা! তোমার স্ত্রীর বাড়ি ঠিক করাই আছে। প্রিন্সেস মারি তাকে সেখানে নিয়ে সব বুঝিয়ে দেবে। তারা তো এক কথার জায়গায় দশ কথা বলবে। মেয়েদের স্বভাবই তাই। সে আসায় আমি খুশি হয়েছি। বসে কথা বল। মাইকেলসেনের বাহিনীকে আমি বুঝতে পারি, তলস্তয়কেও বুঝি…যুগপৎ অভিযান…কিন্তু দক্ষিণী বাহিনী কি করবে? প্রাশিয়া নিরপেক্ষ…সেটা আমি জানি। অস্ট্রিয়ার ব্যাপারটা কী? চেয়ার থেকে উঠে বুড়ো ঘরময় পায়চারি করতে লাগল, আর তিখন যখন সে পোশাকটা তার দরকার সেটা হাতে তুলে দিতে তার পিছন পিছন দৌড়তে লাগল। সুইডেনেরই বা খবর কী? তারা পোমেরানিয়া পার হবে কেমন করে? …. বাবা শুনতেই চাইছে দেখে প্রিন্স আন্দ্রু প্রথমে অনিচ্ছাসত্ত্বেই আসন্ন অভিযানের কার্যক্রম বোঝাতে শুরু করল; কিন্তু ক্রমেই তার আগ্রহ বাড়তে লাগল এবং অভ্যাসবশতই নিজের অজ্ঞাতসারেই রাশিয়া থেকে ফ্রান্সের কথায় চলে গেল। সে বোঝাতে লাগল, নব্বই হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রাশিয়াকে এমন ভয় দেখাবে যে, সে নিরপেক্ষতা ভেঙে বেরিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হবে; সেই বিরাট বাহিনীর একটা অংশ স্ট্রালসুন্ডে সুইডিশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে; এক লক্ষ রুশ সৈন্যসহ দুলক্ষ বিশ হাজার অস্ট্রিয় সৈন্য ইতালিতে ও রাইন নদীর তীরে সমবেত হবে; পঞ্চাশ হাজার রুশ ও সমসংখ্যক ইংরেজ সৈন্য নেপলসে নামবে; এবং মোট পাঁচ লক্ষ সৈন্য বিভিন্ন দিক থেকে ফরাসি বাহিনীকে আক্রমণ করবে। বুড়ো প্রিন্স কিন্তু এই সব বিবরণে তিলমাত্রও উৎসাহ দেখাল না; বরং যেন কিছুই শুনছে না এমনিভাবে হাঁটতে হাঁটতেই পোশাক পরতে লাগল এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তিন তিনবার কথার মাঝখানে বাধার সৃষ্টি করল। একবার চেঁচিয়ে বলল : সাদা পোশাকটা, সাদা পোশাকটা!

তার মানে যে ওয়েস্টকোটটা সে চাইছিল তিখন সেটা তার হাতে দেয় নি। আর একবার ছেলের কথায় বাদা দিয়ে সে বলল : শীঘ্রই তাকে সূতিকাঘরে যেতে হবে। তিরস্কারের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল : এটা খারাপ! বলে যাও, বলে যাও।

প্রিন্স আন্দ্রু তার বক্তব্য প্রায় শেষ করে এনেছে এমন সময় এল তৃতীয় বাধা। বুড়ো বয়সের ভাঙা গলায় বুড়ো গেয়ে উঠল : মার্লবরো যুদ্ধে চলিলেন; ঈশ্বরই জানেন তিনি কবে ফিরিবেন। (একটি পরিচিত ফরাসি গান।)

ছেলে শুধু হাসল।

বলল, এ রণকৌশল যে আমি সমর্থন করি তা বলছি না। আমি শুধু সত্য কথাটা বলছি। এতদিনে নেপোলিয়নও নিশ্চয় একটা রণকৌশল তৈরি করেছে, আর সেটা এর চাইতে খারাপও হবে না।

দেখ, তুমি নতুন কথা কিছু বল নি, এই কথা বলেই বুড়ো গরগর করে আওড়াতে লাগল : Deiu sait Quand rivicndra. এবার খাবার ঘরে চলে যাও।

*

অধ্যায়-২৭

দাড়ি কামিয়ে পাউডার মেখে প্রিন্স নির্দিষ্ট সময়ে খাবার ঘরে ঢুকল। তার পুত্রবধূ প্রিন্সেস মারি ও মাদময়জেল বুরিয়ে তার জন্যই সেখানে অপেক্ষা করছিল; বুড়োর স্থপতিও তাদের সঙ্গেই ছিল; এই নগণ্য লোকটির পক্ষে এ সম্মান আশা করারই কথা নয়, তবু মালিকের একটা অদ্ভুত খেয়ালের ফলে এই টেবিলে তার স্থান হয়েছে। প্রিন্স সাধারণতই সামাজিক মর্যাদাকে কঠোরভাবে মেনে চলে এবং বড় বড় সরকারি কর্মচারীকে পর্যন্ত তার টেবিলে আমন্ত্রণ করে না; অথচ একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে সে মাইকেল আইভানভিচকে (চৌখুপি-কাটা রুমালটায় নাক ঝাড়বার জন্য লোকটি প্রতিবারই ঘরের একেবারে এক কোণে চলে যাচ্ছে) এই টেবিলে ডেকেছে। সে এই কথাই বোঝাতে চায় যে সব মানুষই সমান, আর অনেকবারই মেয়েকে বোঝাতে চেয়েছে যে মাইকেল আইভানভিচ তোমার বা আমার চাইতে একতিলও ছোট নয়। খেতে বসে প্রিন্স সাধারণত অন্য অনেক লোক অপেক্ষা স্বল্পভাষী মাইকেল আইনভানভিচের সঙ্গেই বেশি কথা বলে থাকে।

এ-বাড়ির অন্য সব ঘরের মতোই খাবার ঘরটাও খুব উঁচু। বাড়ির লোকজন এবং পরিচারকরা প্রত্যেকে এক একটি চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে প্রিন্সের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তোয়ালে-কাঁধে খানসামা টেবিল সাজানোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, পরিচারকদের ইশারা করছে, এবং যে দরজা দিয়ে প্রিন্স ঢুকবে একবার সেদিকে আর একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বলকনস্কি জমিদার-পরিবারের বংশলতিকাসম্বলিত মস্তবড় একটা গিল্টি-করা ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিন্স আন্দ্রু; এ জিনিসটি তার কাছে নতুন। তার বিপরীত দিকে আর একটি অনুরূপ ফ্রেম ঝুলছে; তাতে আঁকা রয়েছে মুকুটধারী কোনো প্রিন্সের একটি অত্যন্ত বাজেভাবে আঁকা প্রতিকৃতি (সম্ভবত জমিদারিরই পোষ্য কোনো চিত্রকরের হাতে আঁকা); জানা যায়, এই প্রিন্সটি রুরিক বংশাবতংশ এবং বলকনস্কি পরিবারের পূর্বপুরুষ। বংশলতিকার দিকে আর একবার তাকিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু মাথা নেড়ে হাসতে লাগল; মূল মানুষটির সঙ্গে প্রতিকৃতির সাদৃশ্যটা হাস্যকর মনে হলে যে ভাবে কোনো মানুষ হাসে ঠিক সেই ভাবে।

প্রিন্সেস মারিকে পাশে দেখে তাকে বলল, ছবিটা পুরোপুরি ঠিক তার মতো!

প্রিন্সেস মারি অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। তার হাসির কারণ সে কিছুই বুঝতে পারল না। বাবার সব কাজকেই সে শ্রদ্ধার চোখে দেখে; মনে কোনো প্রশ্ন রাখে না।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, প্রত্যেক লোকেরই দুর্যোধনের উরু (Achilles heel) থাকে। ভাব তো, এত বড় মন নিয়ে তিনি এই বাজে ছবিটা আঁকিয়েছেন।

ভাইয়ের সমালোচনার এই নির্ভীকতা প্রিন্সেস মারি বুঝতে পারল না; একটা জবাব দিতে যাবে এমন সময় পড়ার ঘর থেকে প্রত্যাশিত পদশব্দ ভেসে এল। যেন এ বাড়ির কঠোর নিয়মের সঙ্গে তুলনায় নিজের আচরণের ক্ষিপ্রতাকে স্পষ্ট করে তুলবার জন্য ইচ্ছা করেই প্রিন্স তার স্বভাবমতো বেশ ফুর্তির সঙ্গে দ্রুত পা ফেলে ঘরে ঢুকল। ঠিক সেই মুহূর্তে বড় ঘড়িটাকে দুটোর ঘণ্টা বাজল, আর বসার ঘর থেকে আর একটি ঘড়ির কর্কশ শব্দ তার সঙ্গে যুক্ত হলো। প্রিন্স স্থির হয়ে দাঁড়াল; ঘন ভুরুর নিচ থেকে দুটি জীবন্ত ঝকঝকে চোখ কঠোর দৃষ্টিতে উপস্থিত সকলকে ভালোভাবে দেখে নিয়ে ছোট প্রিন্সেসের উপর গিয়ে স্থির হল। যার ঘরে ঢুকলে সভাসদগণের যেমন হয়, বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে ছোট প্রিন্সেসের মনেও সেই রকম ভয় ও শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগল। প্রিন্স তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে অদ্ভুতভাবে তার গলার পিছনে আস্তে আস্তে চাপড় মারতে লাগল।

একাগ্র দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স বলল, তোমাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি, খুব খুশি, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। বস, বস! মাইকেল আইভানভিচ, তুমিও বস!

সে পুত্রবধূকে নিজের পাশেই একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। পরিচারক তার জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।

তার গোলগাল চেহারার উপর চোখ বুলিয়ে বুড়ো লোকটি বলল, হো-হে! তুমি বড় বেশি তাড়াহুড়ো করছ। এটা ভালো নয়!

শুধু ঠোঁট নেড়ে প্রিন্স তার স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষ কাষ্ঠ হাসিটি হাসল; চোখে সে হাসি প্রতিফলিত হল না।

শুধু বলল, তুমি হাঁটবে, যতটা পার হাঁটবে, যতটা পার।

ছোট প্রিন্সেসের কানে কথাটা গেল না; ইচ্ছা করেই কানে নিল না। চুপ করে রইল; তাকে একটু বিচলিত মনে হল। প্রিন্স তার বাবার কথা জানতে চাইলে ছোট প্রিন্সেসের মুখে হাসি ফুটল; সে কথা বলতে শুরু করল। প্রিন্স পরিচিত লোকজনদের কথা জানতে চাইলে ছোট প্রিন্সেস আরো চাঙ্গা হয়ে উঠল, নানা লোকের অভিনন্দন-বাণী তাকে শোনাতে লাগল, শহরের গল্পগুজবের বিস্তারিত বর্ণনা দিল।

বেচারি কাউন্টেস আপ্রাকসিনা তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন; কেঁদে কেঁদে তার চোখ দুটি গেছে। পুত্রবধূটির গলা ক্রমেই ঝরঝরে হয়ে উঠল।

প্রিন্সের দৃষ্টিও ক্রমেই কঠোরতর হতে লাগল; তারপরই যেন পুত্রবধূটিকে যথেষ্ট দেখা হয়েছে, তার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণাও হয়ে গেছে, এমনিভাবে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে সে মাইকেল আইভানভিচের দিকে মুখ ঘোরাল।

দেখ মাইকেল আইভানভিচ, আমাদের বোনাপার্তের অবস্থা কিন্তু কাহিল। তার বিরুদ্ধে কতভাবে যে সৈন্যসমাবেশ করা হচ্ছে সে কথা প্রিন্স আই (ছেলেকে সে এইভাবে ডাকে) আমাকে বলছিল! অথচ তুমি আর আমি তাকে মোটেই পাত্তা দেই নি।

তুমি আর আমি-কখন যে বোনাপার্ত সম্পর্কে এ সব কথা বলেছে সে কথা কিন্তু মাইকেল আইভানভিচ । মোটেই জানে না। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারল যে তাকে সাক্ষীগোপাল খাড়া করে প্রিন্স তার মনের মতো বিষয়বস্তুটির আলোচনা শুরু করতে চাইছে, তখন সে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যুবক প্রিন্সের দিকে তাকাল। এরপর কি হবে তা কে জানে।

স্থপতিকে দেখিয়ে প্রিন্স ছেলেকে বলল, ইনি একজন খুব বড় দরের রণনীতিবিদ!

আবার শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ, বোনাপার্ত, সেনাপতি ও কুটনীতিকদের নিয়ে আলোচনা। বুড়ো প্রিন্সের তো বদ্ধমূল ধারণা যে আজকালকার লোকজনরা সব কচি খোকা, যুদ্ধ বা রাজনীতির অ-আ-ক-খ-ও তারা জানে না, আর ঐ বোনাপার্ত তো একটা বখাটে ফরাসি ছোকরা মাত্র, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো কোনো পটেমকিন অথবা সুভরভ নেই বলেই তার এত জয়-জয়কার। তাছাড়া, তার আরো ধারণা ইওরোপে কোনো সত্যিকারের রাজনৈতিক সংকট নেই, কোনো সত্যিকারের যুদ্ধ নেই, যা আছে সেটা একধরনের পুতুল খেলা, সেই খেলা খেলতে বসেই আজকের লোকরা এমন ভান করছে যেন সত্যিকারের যুদ্ধই করছে। নতুন যুগের মানুষদের নিয়ে বাবার এই বিদ্রূপকে প্রিন্স আন্দ্রু খুশি মনেই সহ্য করে গেল, মন দিয়ে শুনল।

বলল, অতীত চিরদিনই মধুর, কিন্তু স্বয়ং সুলভও কি মরো-র পাতা ফাঁদে পড়েননি? এবং সে ফাঁদ থেকে বের হবার পথটা পর্যন্ত খুঁজে পাননি?

প্রিন্স চেঁচিয়ে বলে উঠল, এ কথা তোমাকে কে বলেছে? কে? সুভরভ! বলেই সে খাবার প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, আর তিখন সঙ্গে সঙ্গে সেটা ধরে ফেলল। সুভরভ!…ভেবে দেখ প্রিন্স আন্দ্রু! দুই…ফ্রেডেরিক ও সুভরভ; মরো! সুভরভ যদি নিজের ইচ্ছামতো চলতে পারত তাহলে মরোকেই বন্দি হতে হত; কিন্তু তার হাত বাধা ছিল অস্ট্রিয় যুদ্ধ পরিষদের কাছে যাদের মাথায় ছিল শুধু তরকারির ঝোল। তাদের পাল্লায় পড়লে শয়তানেরও ধাঁধা লাগে। সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে অস্ট্রিয় যুদ্ধ পরিষদটি কী চিজ! সুভরভই তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না, তো মাইকেল কুতুজভ কোন ছাড়! না হে বাপু, তুমি ও তোমার সেনাপতিরা বোনাপার্তের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না; তোমাদের ডেকে আনতে হবে ফরাসিদের, যাতে চোরে চোরে লড়াই লেগে যায়। ফরাসি মরোকে ডেকে আনবার জন্য জার্মান পাহলেন (পিটার্সবুর্গের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল পি. এ. পাহলেন)-কে পাঠানো হয়েছে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। সে বছর রাশিয়ায় চাকরি নেবার জন্য যে মরোকে ডাকা হয়েছিল প্রিন্স সেই ঘটনাকেই উল্লেক করল।…চমৎকার! পোটেমকিন, সুভরভ ও অরলভরা কি জার্মান ছিল? না হে বাপু, হয় তোমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আর না হয়তো আমাকেই বাহাত্তরে ধরেছে। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন, কিন্তু আমরা সবকিছুই দেখে যাব। বোনাপার্ত তো মস্ত বড় সেনাপতি সেজেছে! হুম!…

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমি বলছি না যে আমাদের সব পরিকল্পনাই ভালো, তবে বোনাপার্ট সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে অবাক করেছে। আপনি যত খুশি হাসতে পারেন, কিন্তু তা হলেও বোনাপার্ত একজন জাদরেল সেনাপতি!

স্থপতি লোকটি এতক্ষণ মাংসের রোস্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিল; আশা করেছিল যে তার কথা সকলে ভুলেই গেছে। কিন্তু বুড়ো প্রিন্স এবার হাঁক দিল, মাইকেল আইভানভিচ! আমি তোমাকে বলি নি যে বোনাপার্ত একজন মস্ত বড় রণকুশলী? দেখ, ইনিও সেই একই কথা বলছেন।

সে তো ঠিকই ইয়োর এক্সেলেন্সি স্থপতি জবাব দিল।

প্রিন্স আর একবার হো-হো করে হেসে উঠল।

মুখে রুপোর চামচে নিয়েই বোনাপার্ত জন্মেছিল। চমঙ্কার সব সৈন্য সে হাতে পেয়েছে। তাছাড়া, জার্মানদের দিয়েই তার আক্রমণে হাতেখড়ি। আর একমাত্র আলসেরাই জার্মানদের হারাতে পারে না। জগতের শুরু থেকে সকলেই তো জার্মানদের পিটিয়েছে। তারা কিন্তু নিজেদের ছাড়া আর কাউকে পেটাতে পারে না। তাদের সঙ্গে লড়াই করেই তো বোনাপার্তের যত নাম।

তারপরেই তার মতে বোনাপার্ত নানা অভিযানে, এমন কি রাজনীতিতেও যে সব মস্ত ভুল করেছে প্রিন্স সেগুলি সব ব্যাখ্যা করতে শুরু করল। ছেলে কোনো প্রত্যুত্তর করল না, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল যে যত যুক্তিই দেখানো হোক বাবার মতোই সেও নিজের মতো সহজ বদলাতে পারে না। কোনো রকম জবাব না দিয়ে সে চুপচাপ শুনতে লাগল, এত বছর ধরে একাকি গ্রামে বাস করেও এই মানুষটি কেমন করে যে সাম্প্রতিক ইওরোপের সব সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনার খবর রাখে এবং তা নিয়ে এত সূক্ষ্ম ও তীব্র সমালোচনা করতে পারে সে কথা ভেবে তার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

 তোমরা ভাব যে আমি বুড়ো মানুষ, বর্তমানের কোনো খোঁজ-খবরই রাখি না, এই বলে বাবা কথা শেষ করল। কিন্তু এ সবকিছুই আমাকে বিব্রত করে। রাতে আমি ঘুমতে পারি না। এখন বল, তোমাদের এই আঁদরেল সেনাপতির আসল কেরামতিটা কোথায়? সে কথা শেষ করল।

সে কথা বলতে অনেক সময় লাগবে, ছেলে জবাব দিল।

ঠিক আছে, তোমার বোনাপার্তকে নিয়েই থাকগে। মাদময়জেল বুরিয়ে, তোমাদের পাউডার-মাখা বাদর ম্রাটের এই আর একজন স্তাবক! চমৎকার ফরাসিতে প্রিন্স জোর গলায় বলল।

আপনি তো জানেন প্রিন্স, আমি বোনাপার্তের সমর্থক নই।

প্রিন্স গুনগুন করে একটা বেসুরো গান গেয়ে ততোধিক বেতালা হাসি হেসে টেবল ছেড়ে উঠে গেল।

আলোচনার সময়ে এবং ডিনারের বাকি সময়টাকেও ছোট প্রিন্সেস চুপচাপ বসে থেকে ভীত দৃষ্টিতে একবার শ্বশুরের দিকে ও একবার প্রিন্সেস মারির দিকে তাকাতে লাগল। সকলে টেবিল থেকে উঠে গেলে সে ননদের হাতটা ধরে তাকে টেনে নিয়ে আর একটা ঘরে চলে গেল।

বলল, তোমার বাবার কত বুদ্ধি; হয়তো সেই জন্যই তাকে আমার এত ভয়।

আঃ, বাবা খুব ভালো মানুষ! প্রিন্সেস মারি জবাব দিল।

*

অধ্যায়-২৮

পরদিন সন্ধ্যায় প্রিন্স আন্দ্রুর চলে যাবার কথা। দৈনন্দিন কর্মসূচীর কোনো রকম পরিবর্তন না করে বুড়ো প্রিন্স ডিনারের পরে যথারীতি শুতে চলে গেল। ছোট প্রিন্সেস ননদের ঘরে। স্কন্ধত্ৰাণবিহীন ট্রাভেলিং-কোট গায়ে প্রিন্স আন্দ্রু খানসামাকে নিয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে জিনিসপত্র প্যাক করছে। নিজে গাড়িটা পরীক্ষা করে তাকে ট্রাংকগুলি তুলি দিয়ে ঘোড়াগুলো জুততে বলল। শুধু নিজের সঙ্গে রাখার জিনিসগুলোই ঘরের মধ্যে পড়ে আছে : একটা ছোট বাক্স, রুপোর প্লেটসহ একটা বড় খাবারের বাক্স, দুটো তুর্কি পিস্তল ও একখানি তরোয়াল-ওচাকভ অবরোধের সময় তার বাবা এটা এনেছিল; পরে ছেলেকে উপহার দিয়েছে। প্রিন্স আন্দ্রুর এইসব ভ্রমণ-সঙ্গী জিনিসপত্রই বেশ সাজানো গোছানো; নতুন, পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে ফিতে দিয়ে বাঁধা।

কোথাও যাত্রা করবার আগে অথবা জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ঘটাবার সময় চিন্তাশীল লোকরা সাধারণত বেশ গম্ভীর হয়ে যায়। সেই সময় তারা অতীতের পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে। প্রিন্স আন্দ্রুর মুখটাও খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। হাত দুটি পিছনে রেখে সে ঘরের এক কোণ থেকে আর এক কোণ দ্রুত হাঁটছে, আর সোজা সামনের দিকে তাড়িয়ে চিন্তিতভাবে মাথাটা নাড়ছে। তার কি যুদ্ধে যেতে ভয় করছে? নাকি স্ত্রীকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো দুটোই, কিন্তু সে চায় না যে এক অবস্থায় কেউ তাকে দেখে ফেলে; তাই বাইরে পায়ের শব্দ শুনেই সে তাড়াতাড়ি পিছনের হাত খুলে সামনে এনে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, যেন হোট বাক্সের ঢাকনিটা বাঁধছে। তারপরই তার স্বাভাবিক ও দুর্ভেদ্য মুখের ভাব ফিরিয়ে আনল। প্রিন্সেস মারির ভারি পায়ের শব্দই সে শুনতে পেয়েছিল।

প্রিন্সেস মারি হাঁপাতে হাঁপাতে (সে নিশ্চয় গৌড়ে এসেছে) চেঁচিয়ে বলল, তুমি নাকি ঘোড়াকে সাজ পরাতে বলেছ? অথচ আমি যে তোমার সঙ্গে একান্তে কত কথা বলতে চেয়েছিলাম! ঈশ্বর জানেন আবার কতদিন আমরা দূরে দূরে থাকব। আমি এসেছি বলে তুমি রাগ কর নি তো? তুমি কত বদলে গেছ আশা,

যেন প্রশ্নটার ব্যাখ্যা হিসেবেই সে কথাটা যোগ করল।

প্রিন্সের প্রিয় নাম আশা বলে ডেকেই মারি হেসে ফেলল। এই রুক্ষ সুদর্শন মানুষটি যে তার ছোটবেলার খেলার সাথী সেই ছোট্ট দুষ্ট ছেলে আশা হতে পারে সে কথা ভাবতেই সে অবাক হয়ে গেল।

শুধু একটু হেসে বোনের কথার জবাব দিয়ে প্রিন্স আল্লু জিজ্ঞাসা করল, আর লিজা কোথায়?

সে এতই ক্লান্ত যে আমার ঘরে সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওঃ আন্দ্রু! কী সোনা বউই তুমি পেয়েছ, একটা সোফায় বসে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল। ও তো একেবারে ছেলেমানুষ; কী মিষ্টি, হাসি-খুশি মেয়ে। ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু চুপ করে রইল; কিন্তু ব্যঙ্গ ও ঘৃণার যে চিহ্ন তার মুখে ফুটে উঠল সেটা প্রিন্সেসের নজর এড়াল না।

ছোটখাট দোষ-ক্রটিকে মেনে নিতেই হবে; সেটুকু ত্রুটি কার নেই আন্দ্রু? ভুলে যেয়ো না যে সে একটা উঁচু সমাজে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে; এখানে তার অবস্থা তো খুব সুখকর না হবারই কথা। প্রত্যেকের অবস্থাই তো আমাদের বোঝা দরকার। Tout compendre, cest tout pardonner, (সকলের অবস্থাটা বুঝতে পারলে সকলকেই ক্ষমা করা যায়।) বেচারির কথাটা একবার ভাব! এতদিনের অভ্যস্ত জীবনকে ছেড়ে, স্বামীকে ছেড়ে, এই অবস্থায় তাকে একাকি একটা গ্রামে থাকতে হবে! এটা খুবই শক্ত।

যারা নিজেদের সবজান্তা ভাবে তাদের দেখে আমরা যে ভাবে হাসি, বোনের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আও সেইভাবে হাসল।

বলল, তুমিও তো গ্রামে থাক; তোমরা তো জীবনকে ভয়ংকর ভাব না।

আমি…আমার কথা আলাদা। আমরা কথা কেন বলছ? আর কোনো জীবন আমি চাই না, চাইতে পারি না, কারণ আর কোনো জীবন আমি জানি না। কিন্তু আন্দ্রু, ভেবে দেখ তো, অভিজাত সমাজের একটি তরুণী তার জীবনের সেরা দিনগুলি একাকি কাটাবে এই গ্রামের মাটিতে মাথা গুঁজে-বাপি তো সব সময়ই ব্যস্ত, আর আমি…তুমি তো জান, অভিজাত সমাজে চলতে অভ্যস্ত একটি মেয়ের মনোরঞ্জন করবার মতো কোনো বিদ্যাই আমার নেই। আর আছে শুধু মাদময়জেল বুরিয়ে… ।

তোমাদের ওই মাদময়জেল বুরিয়েঁকে আমি মোটেই পছন্দ করি না, প্রিন্স আ বলল।

কর না? সে তো খুব ভালো, দয়ালু; তাছাড়া সেও তো করুণার পাত্র। তার তো কেউ কোথাও নেই–কেউ না। সত্যি কথা বলতে কি তাকে আমার কোনো দরকারই নেই; বরং সে আমার পথের বাধা। তুমি তো জান, চিরকালই আমি একটু বুনোম এখন তো আরো বুনো হয়ে গেছি। একলা থাকতেই আমি ভালোবাসি।…বাবা ওকে খুব ভালোবাসেন। সে আর মাইকেল আইভানভিচ–এই দুজনের প্রতিই বাবা খুব সদয় ও সন্তুষ্ট, কারণ তিনি দুজনেরই আশ্রয়দাতা। স্টার্ন বলেছেন : মানুষ আমাদের কি উপকার করেছে তার জন্য আমরা তাকে তত ভালোবাসি না যত ভালোবাসি আমরা তাদের কি উপকার করেছি সেই জন্য। বাবাকে হারিয়ে ও যখন গৃহহারা হয়ে পড়েছিল তখনই বাবা ওকে নিয়ে আসেন। ওর স্বভাবটা খুব ভালো; ওর বই পড়ার ধরন বাবার খুব পছন্দ। সন্ধ্যাবেলা ও বাবাকে পড়ে শোনায়; খুব সুন্দর পড়ে।

খোলাখুলি বলতে কি মারি, বাবার চরিত্র অনেক সময় তোমাকে খুব বিপদে ফেলে দেয়, তাই না? প্রিন্স আন্দ্রু হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল।

এ প্রশ্ন প্রিন্সেস মারি প্রথমে অবাক হয়ে গেল; পরে ভীষণ ভয় পেল।

আমাকে? আমাকে?…আমাকে বিপদে ফেলেন?… সে বলল।

তিনি চিরকালই কিছুটা কঠোর; কিন্তু আমার তো ধারণা এখন তিনি খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছেন, প্রিন্স আন্দু বলল। বোনকে বোকা বানাতে, বা তাকে পরখ করে দেখতেই সে বাবার সম্পর্কে এ ধরনের লঘু উক্তি করল।

আলোচনার প্রসঙ্গে না গিয়ে নিজের চিন্তাকে অনুসরণ করেই প্রিন্সেস বলল, তুমি সব দিক থেকেই ভালো আন্দ্রু, কিন্তু তোমার মনে একটা বুদ্ধির অহংকার আছে, আর সেটা একটা বড় পাপ। কেউ কি বাবাকে বিচার করতে পারে? আর যদি পারেও, তবু তো আমার বাবার মতো লোকের প্রতি শ্রদ্ধা ভিন্ন অন্য কোনো অনুভূতি জাগতে পারে কী? তাকে নিয়ে আমি কত সন্তুষ্ট, কত সুখী। তুমিও আমার মতোই সুখী হও, এটাই তো আমার একমাত্র কামনা।

তার ভাই অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

একটি মাত্র কাজ আমার পক্ষে শক্ত।…তোমাকে সত্যি কথাই বলব আন্দ্রু,সেটা হলো ধর্মবিষয়ে বাবার আচরণ। যে জিনিস দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তা কেমন করে বাবার মতো প্রচণ্ড বুদ্ধির অধিকারী মানুষের চোখে পড়ে না, কেমন করে তিনি বিপথে চলে যান আমি তো বুঝতেই পারি না। ঐ একটি মাত্র ব্যাপারে আমি অসুখী। কিন্তু এ ব্যাপারেও আমি আজকাল কিছুটা উন্নতি দেখতে পাচ্ছি। ইদানীং তার ব্যঙ্গ বিদ্রুপের তীক্ষ্ণতা অনেক কমে গেছে। একজন সন্ন্যাসীকে তিনি বাড়িতে ডেকে এনেছিলেন; তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।

হায়! সোনা, আমার ভয় হচ্ছে তুমি আর তোমার ঐ সন্ন্যাসীর সব চেষ্টাই মাঠে মারা যাচ্ছে, মমতামাখা ঠাট্টার সুরে প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্রিন্সেস মারি বলল, ওঃ! আমাদের ভাইটি, আমার শুধু একটিই প্রার্থনা, একটিই আশা যে ঈশ্বর আমার কথা শুনবেন। আন্দ্রু, তোমার কাছে আমি একটা জিনিস চাই।

সেটা কি?

না–কথা দাও তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না! তাতে তোমার কোনো কষ্ট হবে না, সেটা তোমার অযোগ্যও নয়, কিন্তু আমার পক্ষে অনেক সান্ত্বনার। কথা দাও আশা!… থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়েও তার মধ্যে কি আছে সেটা বের না করে প্রিন্সেস মারি বলল; বোঝা গেল, থলির ভিতরকার জিনিসটিই তার অনুরোধের বস্তু, কিন্তু অনুরোধ মঞ্জুর হবার আগে সেটা সে বের করবে না।

ভীরু চোখ তুলে সে ভাইয়ের দিকে তাকাল।

যেন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই প্রিন্স আন্দ্রু বলল, যদি কষ্টকর ব্যাপারও হত…

তুমি যা খুশি ভাবতে পার!…আমি জানি, তুমিও ঠিক বাবার মতো। যা খুশি ভাব, তবু আমার জন্য অন্তত এই কাজটি কর। দয়া করে কর! বাবার বাবা, আমাদের ঠাকুর্দা, সব যুদ্ধে এটা পরতেন। (থলের ভিতরকার জিনিসটি সে এখনো বের করল না।) তাহলে কথা দিলে?

নিশ্চয়। এটা কি?

আন্দ্রু, এই দেবমূর্তি দিয়ে আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, কিন্তু আমার কাছে তোমাকে কথা দিতে হবে যে কখনো এটা খুলে রাখবে না। কথা দিলে?

ওটার ওজন যদি এক হর না হয়, ওটার ভারে যদি আমার ঘাড় না ভাঙে…তো তোমাকে খুশি করতে… প্রিন্স আন্দ্রু বলল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ঠাট্টা ফলে বোনের মুখে বেদনার যে ছায়া ফুটে উঠেছে সেটা দেখতে পেয়ে তার অনুশোচনা হল; সে বলে উঠল, আমি খুব খুশি হয়েছি; সত্যি সোনা, খুব খুশি হয়েছি।

তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন, তোমাকে করুণা করবেন, নিজের কাছে টেনে নেবে, কারণ সত্য ও শান্তি একমাত্র তাঁর মধ্যেই অবস্থান করে, আবেগ-কম্পিত স্বরে প্রিন্সেস মারি কথাগুলি বলল; সুন্দর একটি রুপোর হারের উপর সোনার কাজ-করা ছোট, ডিম্বাকৃতি, অত্যন্ত প্রাচীন একটি ত্রাণকর্তার কালো দেবমূর্তি গম্ভীরভাবে দুই হাতে তুলে ধরল ভাইয়ের সামনে।

কুশ-চিহ্ন এঁকে, দেবমূর্তিটিকে চুমো খেয়ে সে ভাইয়ের হাতে সেটাকে তুলে দিল।

দোহাই আন্দু, আমার জন্যে!…

তার দুটি বড় বড় ভীরু চোখ থেকে শান্ত আলোর রশ্মি বিচ্ছুরিত হতে লাগল। সে আলোয় তার রুগ্ন। পাতলা মুখখানি উদ্ভাসিত হয়ে সুন্দর হয়ে উঠল। ভাই দেবমূর্তিটা পরতে গেল, কিন্তু বোন তাকে থামিয়ে দিল। আন্দ্রু বুঝতে পারল, ক্রুশ-চিহ্ন আঁকল, দেবমূর্তিকে চুমো খেল। সেও তখন অভিভূত হয়েছে; তার চোখে মমতার আভা, কিন্তু সেই সঙ্গে তার মুখে দেখা দিল ব্যঙ্গের ঝলকানি।

ধন্যবাদ, লক্ষ্মী ভাই। ভাইয়ের কপালে চুমো খেয়ে প্রিন্সেস মারি আবার গিয়ে সোফায় বসল। কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ।

আগেই বলেছি আন্দ্রু, তুমি যেমন দয়ালু ও উদার ছিলে তেমনি থেকো। লিজার প্রতি কঠোর হয়ো না, প্রিন্সেস মারি বলতে শুরু করল। সে খুব ভালো, আর এখানে তার অবস্থা বড় সঙ্গীন।

আমার স্ত্রী সম্পর্কে তোমার কাছে কোনো নালিশ করেছি, বা তাকে দোষ দিয়েছি বলে মনে পড়ে না মাশা (মারির সংক্ষিপ্ত রূপ)। তাহলে এ সব কথা আমাকে বলছ কেন?

প্রিন্সেস মারির গালে লালের ছোপ লাগল; অপরাধীর মতো সে চুপ করে রইল।

আমি তোমাকে কিছুই বলি নি, কিন্তু তুমি অনেক কথাই শুনেছ। সে জন্য আমি দুঃখিত।

প্রিন্সেস মারির কপালে, ঘাড়ে ও গালে লালের ছোপ গাঢ়তর হল। সে কি যেন বলতে চাইল, কিন্তু বলতে পারল না। তার ভাই ঠিকই অনুমান করেছে; ছোট প্রিন্সেস ডিনারের পরে কেঁদেছে, আসন্ন প্রসবের ব্যাপারে তার মনে যে ভয় ঢুকেছে তা বলেছে, নিজের ভাগ্য, শ্বশুর ও স্বামীর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বোনের জন্য প্রিন্স আন্দ্রু দুঃখ বোধ করল।

একটা কথা জেনে রাখ মাশা : কোনো ব্যাপারেই আমার স্ত্রীকে আমি বকতে পারি না, কখনো বকি নি, ভবিষ্যতেও বকব না; তার সম্পর্কিত কোনো ব্যাপার নিয়ে নিজেকেও আমি দোষ করতে পারি না; যে অবস্থায়ই আমি থাকি না কেন, এই রকমই চলতে থাকবে। কিন্তু তুমি যদি আসল সত্য জানতে চাও…যদি জানতে চাও আমি কি সুখী? না! সে কী সুখী? না! কিন্তু কেন নয় তা আমি জানি না…।

বলতে বলতে ভাই উঠে বোনের কাছে গেল, নিচু হয়ে তার কপালে চুমো খেল। একটা চিন্তাক্লিষ্ট অনভ্যস্ত উজ্জ্বলতায় তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করতে লাগল; কিন্তু তখন তার দৃষ্টি বোনের দিকে ছিল না, ছিল খোলা দরজার পথে বাইরের অন্ধকারের দিকে।

চল, ওর কাছে যাই। আমাকে তো বিদায় নিতেই হবে। অথবা–তুমি গিয়ে ওর ঘুম ভাঙাও, আমি একটু পরেই যাচ্ছি। পেশকা! সে খানসামাকে ডাকল : এদিকে এস। এগুলি নিয়ে যাও। এগুলিকে আসনের উপর রাখ, আর এগুলি ডানদিকে।

প্রিন্সেস মারি উঠে দরজার দিকে পা বাড়াল; তারপর থেমে বলল :

আন্দ্রু, তোমার যদি বিশ্বাস থাকত তাহলে সেই ভালোবাসা তুমি ঈশ্বরের কাছে চাইতে পারতে যা তোমার নেই, আর তোমার সে প্রার্থনা পূর্ণ হত।

কি জানি, হতে পারে! প্রিন্স আন্দ্রু বলল। তুমি যাও মাশা; আমি এখনি আসছি।

বোনের ঘরের দিকে যাবার পথেই মাদময়জেল বুরিয়ের সঙ্গে প্রিন্স আর দেখা হলে গেল। তার মুখে মিষ্টি হাসি। একই দিনে এই তৃতীয়বার নির্জন বারান্দায় মুখে সরল বিমুগ্ধ হাসি নিয়ে সে প্রিন্স আর সম্মুখীন হল।

যে কারণেই হোক মুখ লাল করে চোখ নামিয়ে সে বলল, ওহো, আমি ভেবেছিলাম আপনি আপনার ঘরেই আছেন।

প্রিন্স আন্দ্রু কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। মুখে ফুটে উঠল ক্রোধের আভাস। কোনো কথা না বলে মেয়েটির চোখের বদলে সে তার কপাল ও চুলের দিকে এমন ঘৃণাভরে তাকাল যে ফরাসিনী মুখ লাল করে কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে চলে গেল। প্রিন্স আন্দ্রু বোনের ঘরে পৌঁছে খোলা দরজা দিয়ে শুনতে পেল, তার স্ত্রী ইতিমধ্যেই উঠে খুশি মনে অনর্গল কথা বলে চলেছে। যথারীতি ফরাসিতেই সে কথা বলছে; মনে হল, দীর্ঘ সংযমের পরে সে বোধহয় হারানো সময়টুকুর ক্ষতিপূরণ করতে চাইছে।

আরে না, কিন্তু ভাব তো, বুড়ি কাউন্টেস জুবোভার মাথায় নকল চুল, আর মুখভরা নকল দাঁত, যেন বুড়ো বয়সকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা…হা, হা, হা, মারি!

অন্য অনেকের সামনে স্ত্রীর মুখে কাউন্টেস জুবোভা সম্পর্কে এই একই কথা এবং এই একই হাসি প্রিন্স আন্দ্রু অন্তত পাঁচবার শুনেছে। ধীর পায়ে সে ঘরে ঢুকল। গোলগাল, গোলাপি ছোট প্রিন্সেস সেলাইটা হাতে নিয়ে একটা আরাম কেদারায় বসে অনর্গল বলে যাচ্ছে বহুবার বলা পিটার্সবুর্গের স্মৃতি-কথা। প্রিন্স আন্দ্রু কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে পথের ক্লান্তি কেটে গেছে কিনা জানতে চাইল। কথার জবাব দিয়ে ছোট প্রিন্সেস আবার কিচির-মিচির শুরু করে দিল।

ছয়-ঘোড়ার গাড়িটা ফটকে দাঁড়িয়ে আছে। হেমন্তের রাত এত অন্ধকার যে কোচয়ান গাড়ির দণ্ডটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। লণ্ঠন হাতে চাকররা ছুটাছুটি করছে। মস্ত বড় বাড়িটার উঁচু জানালা দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। বাড়ির ভূমিদাসরা হল-ঘরে ভিড় করেছে। তরুণ প্রিন্সকে বিদায়সম্ভাষণ জানাতে অপেক্ষা করে আছে। বাড়ির লোকজনরা সব জমায়েত হয়েছে অভ্যর্থনা-ঘরে; মাইকেল আইভানভিচ, মাদময়জেল বুড়িয়ে, প্রিন্সেস। মারি ও ছোট প্রিন্সেস। প্রিন্স আন্দ্রুর ডাক পড়েছে তার বাবার পড়ার ঘরে, কারণ বাবা তাকে আলাদা করে বিদায় দিতে ইচ্ছুক। সকলেই তাদের দুজনের জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রিন্স আন্দ্রু যখন পড়ার ঘরে ঢুকল বুড়ো মানুষটি তখন তার বুড়ো বয়সের চশমাজোড়া ও সাদা ড্রেসিং গাউন পরে লেখার টেবিলেও বসে ছিল। এ পোশাকে একমাত্র ছেলে ছাড়া আর কারো সঙ্গেই সে দেখা করে না। চারদিক তাকিয়ে শুধাল, যাচ্ছ? আবার লিখতে শুরু করল।

আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।

এইখানে চুমো খাও, সে নিজের গালটা দেখাল : ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!

ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন?

গয়ংগচ্ছ না করার জন্য, আর নারীর আঁচল ধরে ঝুলে না থাকার জন্য। সকলের আগে কর্তব্য। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ! আবার লিখতে শুরু করল; তার পাখের কলম খসখস করে চলতে লাগল। তোমার যদি কিছু বলার থাকে তো বলে ফেল। এ দুটো জিনিস এক সঙ্গে চলতে পারে, সে আরো বলল।

আমার স্ত্রীর ব্যাপারে…এভাবে তাকে আপনার হাতে রেখে যাচ্ছি বলে আমি লজ্জিত…

কেন বাজে বকছঃ কি চাও তাই বল।

তার প্রসবের সময় হলে তাকে মস্কোতে কোনো ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।…ততদিন সে এখানেই থাকবে…

বুড়ো প্রিন্স লেখা থামিয়ে কড়া চোখে এমনভাবে ছেলের দিকে তাকাল যেন তার কথাগুলি বুঝতে পারে নি।

কিছুটা বিচলিত হয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, প্রকৃতি তার কাজ না করলে কেউ কিছু করতে পারে না তা আমি জানি। আমি জানি যে লক্ষজনের মধ্যে মাত্র একজনের বেলায় গোলমাল হতে পারে, কিন্তু একটা ওরও ইচ্ছা, আমারও ইচ্ছা। সকলেই ওকে নানা কথা বলছে। ওরও একটা স্বপ্ন আছে, আর ভয়ও পাচ্ছে।

লেখা শেষ করে প্রিন্স বলল, হুম…হুম…। তাই করব।

সশব্দে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল; তারপর হঠাৎ ছেলের দিকে ঘুরে হাসতে লাগল।

খুব বাজে ব্যাপার, তাই না?

কি বাজে বাবা?

এই বৌ! সংক্ষেপে অর্থপূর্ণভাবে বুড়ো প্রিন্স বলল।

বুঝতে পারছি না! প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

তা বটে, কিছু করার নেই বাপু, প্রিন্স বলল। ওরা সবাই এক; বিয়ে তো আর ফেরৎ দেওয়া যায় না। ভয় পেয়ো না; কাউকে বলব না, কিন্তু তুমি নিজে তো বোঝ।

ছোট ঘোট গাড়-কঠিন আঙুল দিয়ে ছেলের হাতটা চেপে ধরে নাড়া দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে সোজা তার চোখের দিকে তাকাল, তারপর আবার সেই আড়ষ্ট হাসি হাসতে লাগল।

ছেলে নিঃশ্বাস ফেলল, যেন স্বীকার করল যে বাবা তাকে ঠিকই বুঝেছে। বুড়ো চিঠিটা ভাঁজ করে সিল করতে লাগল; অভ্যস্ত দ্রুততার সঙ্গে মোম, সিল ও কাগজকে একবার তুলতে লাগল, একবার নামাতে লাগল।

চিঠিটা সিল করতে করতেই কাটা-কাটা ভাবে বলল, কি করতে হবে? সে তো ছেলেমানুষ! সবকিছু আমিই করব। কোনো চিন্তা করো না।

আন্দ্রু কোনো কথা বলল না, বাবা যে তার কথা বুঝতে পেরেছে তাতে সে খুশি হয়েছে, আবার অখুশিও বটে। বুড়ো মানুষটি উঠে দাঁড়িয়ে চিঠিটা ছেলের হাতে দিল।

বলল, শোনো! তোমার স্ত্রীর জন্য চিন্তা করো না; সাধ্যমতো সবই করা হবে। এখন শোন! এই চিঠিটা মাইকেল ইলারিয়নভিচকে (কুতুজভ) দিও। তাকে লিখে দিলাম, সে যেন তোমাকে যথাযথ স্থানে বসিয়ে কাজে লাগায়, দীর্ঘকাল অ্যাডজুটান্ট করে না রাখে : সেটা খুব বাজে চাকরি! তাকে বলল, তার কথা আমার মনে আছে; তাকে আমি পছন্দ করি। সে তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করে সেটা আমাকে লিখে জানিও। যদি ভালো ব্যবহার করে কাজ করো।

নিকলাস বলকনস্তির ছেলেকে কারো অপ্রীতিভাজন হয়ে তার কাছে চাকরি করতে হবে না। এবার এদিকে এসো।

সে এত তাড়াতাড়ি কথা বলছিল যে অর্ধেক কথাই শেষ হচ্ছিল না, কিন্তু ছেলে তার মুখে এ ধরনের কথা শুনে তা বুঝতে অভ্যস্ত। বুড়ো ছেলেকে ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল, ডালাটা তুলল, একটা দেরাজ টেনে বের করল, এবং মোটা মোটা, বড় বড় ঘন হাতের লেখায় ভরা একখানা খাতা তুলে নিল।

আমি হয়তো তোমার আগেই মারা যাব। কাজেই মনে রেখো যে এগুলি আমার স্মৃতিকথা, আমার মৃত্যুর পরে এগুলি সম্রাটের হাতে দিও। আর এই একখানা লোম্বার্ড-বন্ড কোম্পানির কাগজ) ও একটা চিঠি, সুভরভদের যুদ্ধের ইতিহাস যে লিখবে এই সম্মানদক্ষিণাটা তারই প্রাপ্য হবে। এটাকে অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়ে দিও। আর এতে কিছু টুকরো-টুকরো লেখা রইল, আমি মরে যাবার পরে তুমি পড়ো। সেগুলো তোমার কাজে লাগবে।

বাবা যে আরো দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবে এ কথাটা আন্দ্রু বলল না। তার মনে হলো, কথাটা বলা ঠিক হবে না।

এ সবই আমি করব বাবা, সে বলল।

বাস, এবার তাহলে বিদায়! চুমো খাবার জন্য ছেলের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে প্রিন্স তাকে আলিঙ্গন করল। একটা কথা মনে রেখো প্রিন্স আন্দ্রু, ওরা যদি তোমাকে মেরে ফেলে তাহলে তোমার এই বুড়ো বাবা মনে আঘাত পাবে।…অপ্রত্যাশিতভাবে একটু থেমে তারপরই খুঁতখুঁতে মেজাজে চিৎকার করে বলে উঠল : কিন্তু যদি শুনি যে নিকলাস বলকনস্কির ছেলের উপযুক্ত আচরণ তুমি করনি, তাহলে আজি লজ্জা বোধ করব!

ছেলে হেসে বলল, এ কথাটা আমাকে না বললেও পারতেন বাবা।

বৃদ্ধ চুপ করে রইল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, আরো একটা কথা আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম, আমি যদি মারা যাই, আর আমার যদি ছেলে হয়, তাহলে তাকে আপনার কাছ থেকে নিয়ে যেতে দেবেন না–সে কথা কালও বলেছি, সে যেন আপনার কাছেই বড় হয় দেখবেন।

তোমার স্ত্রীও যাতে তাকে নিয়ে যেতে না পারে? বলেই বুড়ো লোকটি হেসে উঠল।

পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ো মানুষটির চোখ দুটি সরাসরি ছেলের চোখের উপর স্থিরনিবদ্ধ। বুড়ো প্রিন্সের মুখের নিচের দিকটা কুঁচকে উঠল।

তারপর দরজাটা খুলে হঠাৎ ক্রুদ্ধ জোর গলায় সে চেঁচিয়ে বলল, বিদায় নেয়া তো হলো। চলে যাও!

দরজার কাছে প্রিন্স আন্দ্রুকে এবং সাদা ড্রেসিং-গাউনপরা, চশমা-চোখে, পরচুলাবিহীন মাথায় বুড়ো লোকটিকে ক্রুদ্ধ গলায় চিৎকার করতে দেখে মুহূর্তের জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে দুই প্রিন্সেসই বলে উঠল, কী হলো? কী হলো?

প্রিন্স আন্দ্রু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, জবাব দিল না। স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, আচ্ছা।

এই আচ্ছা শব্দটা বড়ই নিরুত্তাপ ও ব্যাঙ্গাত্মক শোনাল; যেন সে বলত চাইছে, এবার তোমার নাটক শুরু করে দাও।

আন্দ্রু, এখনই! মুখ কালো করে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হোট প্রিন্সেস বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু তাকে জড়িয়ে ধরতেই সে আর্তনাদ করে তার কাঁধের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ল।

খুব সাবধানে কাঁধটাকে সরিয়ে নিয়ে সে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর সযত্নে তাকে আরাম কেদারায় শুইয়ে দিল।

বিদায় মারি, প্রিন্স আন্দ্রু নরম গলায় বোনকে কথাটা বলে তার হাতটা ধরে চুমো খেল, তারপর দ্রুত পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হোট প্রিন্সেস আরামকেদারায় শুয়ে রইল, মাদময়জেল বুরিয়ে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যে দরজা দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রু বেরিয়ে গেল, অপূর্ণ চোখে সে দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রিন্সেস মারি ক্রুশচিহ্ন আঁকল। পড়ার ঘর থেকে বুড়ো মানুষটির রেগে নাক ঝাড়ার শব্দ আসতে লাগল পিস্তলের গুলির শব্দের মতো। প্রিন্স আন্দ্রু চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ার ঘরের দরজাটা খুলে গেল, বুড়ো লোকটির সাদা ড্রেসিং গাউন পরা শক্ত দেহটা দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল।

বলল, চলে গেছে? খুব ভালো হয়েছে! অচৈতন্য ছোট প্রিন্সেসের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, তারপরই সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *