০১.১ জেনোয়া ও লুক্কা

ওয়ার অ্যান্ড পিস (যুদ্ধ এবং শান্তি) – অখণ্ড সংস্করণ – মূল রুশ থেকে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ
মূল : কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয়
সম্পাদনা : তপন রুদ্র

ভূমিকা

এক পৃথিবীতে এমন চারজন সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছেন যাদের সঙ্গে অন্য কারো তুলনা চলে না। তাঁরা দেশকালের অতীত। সর্বযুগের মানুষের আশা-আকাক্ষা সাফল্য নৈরাশ্য অসাধারণ ভাষায় তাঁরা প্রকাশ করেছেন। স্ব-স্ব দেশকালের গভীরে প্রবেশ করে জগৎ ও জীবনের এক সর্বকালীন সুমহান তাৎপর্য তারা আবিষ্কার করে গেছেন। তাই তারা শুধু নিজের দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক নন, তাঁরা বিশ্বশ্রেষ্ঠ। এই চারজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হলেন হলেন–ইংল্যান্ডের শেক্সপিয়র, জার্মানির গ্যেটে, রাশিয়ার তলস্তয় এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথ।

শেক্সপিয়র ইংল্যান্ডের বুর্জোয়াযুগের ঐশ্বর্যকালীন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, গ্যেটে বিপুল জনজাগরণের অন্যতম ভাষ্যকার এবং রবীন্দ্রনাথ আমাদের গভীর উপলব্ধির মহৎদ্রষ্টা ও স্রষ্টা।

উনিশ শতকের রাশিয়া মহা ভাগ্যবান। একের পর এক দিকপাল সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাশিয়াকে এক শতকের মধ্যেই দীপ্যমান করে তুলেছিলেন। সাহিত্যের সকল শাখায় সাফল্য দেখা দিলেও উপন্যাসে ও ছোটগল্পে যে অভূতপূর্ব সমারোহ দেখা গিয়েছিল তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। পুশকিন, গোগোল, তুর্গিনেভ, দস্তয়ভস্কি, গোর্কি এবং কম বেশি শক্তিসম্পন্ন আরো অনেক কথাসাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং এঁদের সকলের শীর্ষে আছেন তলস্তয়। তিনি সর্বোত্তম। রুশসাহিত্যের গ্র্যান্ড মাস্টার।

কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয় ১৮২৮ সালের ২৬ আগস্ট ইয়াসিনা পলিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে তিনি রাশিয়ার অভিজাতশ্রেণীর অন্যতম একজন। তখনকার রাশিয়া বর্তমানের মতো শিল্পসমৃদ্ধ ছিল না। অভিজাতদের ঐশ্বর্যের জোগান দিত জমি থেকে আয়। কিন্তু তলস্তয় জমিদার হয়েও নিজের শ্রেণী থেকে নিজেকে মুক্ত করার সগ্রামে আজীবন কাটিয়ে গেছেন। নিজের শ্ৰেণীকে পরিত্যাগ করা কখনো সহজ হয় না। তলস্তয়ের পক্ষেও বিষয়টি সহজ হয়নি। ফলে সারা জীবন স্ববিরোধীতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। অনেক লোকের বাধা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি, জীবনের একটি পর্বে স্ত্রীর বিরাগভাজনও হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের অন্বেষা থেকে কখনো বিরত হননি তিনি।

রাশিয়ার কৃষকশ্রেণী তখন জেগে উঠেছে। বহু শতাব্দীব্যাপী ভূমিদাস প্রথার বিলোপ হল ১৮৬১ সালে। তলস্তয়ের তখন পূর্ণ যৌবনকাল। তিনি দেখেছেন, আইনত ভূমিদাসপ্রথা লুপ্ত হলেও কৃষকদের দাসত্ব ও দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি সমাজের এই পুঞ্জীভূত অন্যায় ও বেদনাকে দূর করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ চেষ্টা শুধু তাঁর লেখনীকে আশ্রয় করে পরিস্ফুট হয়নি। তাঁর জীবনচর্যাও এই মহৎ প্রচেষ্টাকে ব্যক্ত করেছে। নিজের জমিদারি ত্যাগের বাসনা এই জীবনচর্যারই একটি দিক। বিলাসবহুল অভিজাতসুলভ জীবনযাত্রাকে তাই অস্বীকার করে তিনি দরিদ্র চাষী হতে চেয়েছিলেন। আমার জীবনই আমার বাণী–এ মহৎ বাক্য এ যুগে তাই তলস্তয়ের জীবনেই সর্বাধিক সার্থক হতে পেরেছিল।

তলস্তয় শৈশবেই তার মা-বাবাকে হারান। তাঁর দুবছর বয়সে মায়ের এবং নয় বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হয়। এক নিকট আত্মীয়ের কাছে তিনি লালিত পালিত হন। রাশিয়ার অভিজাতদের উপযুক্ত শিক্ষা তাঁকে দেওয়া হয়। অন্যান্য বিদ্যার সঙ্গে ফরাসি ও জার্মান ভাষাও শেখেন। মোল বছর বয়সে কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাদান পদ্ধতি তাকে খুশি করতে পারেনি। ফলে স্নাতক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে কলেজ ছাড়েন। তারপর থেকে জীবনের নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমনকি সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে জুয়ার আড্ডাতেও তাঁকে দেখা যেত। অবশেষে তখনকার রুশপ্রথা অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি ককেশাসে প্রেরিত হন। অতঃপর জুনিয়র অফিসার হিসেবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ-ফরাসি-তুর্কির মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এ সময়কার অভিজ্ঞতা থেকেই রচিত হয় সেবাস্তপোলের গল্পসমূহ। বিভিন্ন প্রণয় ব্যাপারেও তিনি কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলেন। ক্লিয়ার গ্লের্ডস অঞ্চলে চাষী ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য স্কুলও খুলেছিলেন। এখানেই তিনি তাঁর প্রগতিশীল শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। একসঙ্গে বহুমুখী কার্যধারা ও তাদের পরস্পরবিরোধী চরিত্র তলস্তয়ের মনে জটিল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেছিল। সারা জীবন তিনি এ দ্বন্দ্ব দিয়ে তাড়িত হয়েছিলেন।

তাঁর সাহিত্যজীবনের যথার্থ সূত্রপাত ঘটে ১৮৬২ থেকে। এই বছরেই তিনি সোফিয়া বেহস নামের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। বয়সে সোফিয়া তার প্রায় অর্ধেক ছিলেন। তখন থেকে তিনি ইয়াসিয়ানা পলিয়ানায় বসবাস করতে থাকেন। এরপর থেকেই তার শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। দি কসাকস প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে। এ বছরেই লেখা শুরু করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড পিস। ১৮৭৩ সালে আনা কারেনিনা লেখা শুরু হয়। এ উপন্যাসটি শেষ হবার আগেই গভীর আত্মিক সংকটের চেহারা কিছুটা ব্যক্ত হয়েছে ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত কনফেশনস নামের গ্রন্থে।

তলস্তয় তাঁর অতীতকে অস্বীকার করলেন। অভিজাত জীবনযাত্রা, তার সম্পত্তি, এমনকি তার এ যাবষ্কালের সমগ্র সাহিত্যকর্মকেও তিনি অস্বীকার করতে চাইলেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল আত্মিক উত্তরণ ও মানবতার সেবা। পরবর্তীতে যে-সকল লেখা লিখেছেন তার মূল কথা হল তার একান্ত নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি এবং যুক্তিতর্কের অতীত এক পরম বোধের প্রকাশ।

তলস্তয়ের মনের এ পরিবর্তন এসেছিল এক প্রবহমান নিরন্তর সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে। একদিকে ফরাসি চিন্তাবিদ রুশোর প্রভাব, অন্যদিকে রুশ কৃষকদের সরল জীবনযাত্রার প্রতি গভীর আগ্রহ তলস্তয়কে এ উপলব্ধির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছিল। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার যে ব্যাপক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, তলস্তয়ের সজাগ মন তার খবর রাখত। তাঁর বিশেষ ধরনের মানসিক গড়ন এ যান্ত্রিকতাকে মেনে নেয়ার অনুকূলে ছিল না। এ যান্ত্রিকতা ও কৃত্রিমতার উপর খড়গহস্ত তিনি, এমনকি, এ-বোধের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিলেন-সভ্যতা মানেই দাসত্বের শৃঙ্খল। সমাজ নিজের প্রয়োজনে এসব শৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নিয়েছে। কাজেই সভ্যসমাজ থেকেই যাবতীয় গরল উথিত হয়ে মনুষ্যত্বকে গ্রাস করছে। এ সমাজ বেশকিছু মিথ্যা মূল্যবোধ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে আছে। তার ফলে মানুষের ভেতরকার খাঁটি ভালো গুণগুলো স্কুরিত হতে পারছে না। তলস্তয় মনে প্রাণে চাইলেন এসব প্রাথমিক ভালোর কাছে গভীরভাবে ফিরে যেতে। তাঁর পীড়িত বিবেক বারবার সরল সত্যকে অবলম্বন করতে চাইল। তার সামাজিক মর্যাদা আর ঐশ্বর্য তাঁকে নিরন্তর যন্ত্রণাদগ্ধ করতে লাগল। তিনি মনে করলেন, গ্রামের গরিব চাষীদের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে তাদেরই মধ্যে অভিমানবিহীনভাবে বসবাস করতে পারলে জীবন যথার্থ সার্থক হয়ে উঠতে পারে। সরল গরিব চাষীদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা উপলব্ধি।

পারিবারিক জীবনের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রেখে তিনি একজন ভদ্র কৃষক হতে চাইলেন। এ সাধনা খুব সহজ ছিল না। পরিজন, বিশেষ করে স্ত্রী, এমন জীবনযাত্রা পদ্ধতিকে সহজে মেনে নিতে পারলেন না। সম্ভবও ছিল না। এর ফলে তাঁর মনে যে নিদারুণ মানসিকদ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল, তার পরিচয় সমকালীন সাহিত্যকীর্তিতে উজ্জ্বলভাবে ধরা আছে। মনের এই পর্যায় নিয়ে তলস্তয়ের প্রায় পনেরো বছর কেটেছিল। বলা যায় ১৮৮০ সালের পর থেকেই এই পর্যায়ের শুরু।

.

তলস্তয়ের জীবনে উভয়সংকট দেখা দিল। তার পক্ষে অসহ্য হল। তিনি বুঝলেন, এভাবে সময় করে সত্যকে পাওয়া সহজ নয়। তাই এবার, জীবনের শেষপর্বে চাইলেন সংসার সমাজ পরিজন সম্পদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মুক্ত সরল জীবনে আশ্রয় নিতে। তখন কিন্তু তাঁর পুত্রকন্যার সংখ্যা তেরা এবং অনেকেই তাদের মধ্যে সাবালক। এমনকি নিজস্ব সম্পত্তি সমস্ত বিলিয়ে দিয়ে একেবারে নিষ হতে চাইলেন তিনি। এই নিয়ে পরিবারের সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে স্ত্রীর সঙ্গে বাঁধল তার প্রচণ্ড বিরোধ। স্ত্রী যৌবনকালে স্বামীর লেখা বৃহত্তম উপন্যাস সগ্রাম ও শান্তির পাণ্ডুলিপি অসংখ্যবার অনুলিপি করে করে দিয়েছিলেন, তিনিই স্বামীর যাবতীয় ধ্যানধারণা ও সাহিত্যকীর্তির বিরোধী হয়ে উঠলেন। মতান্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছল যাতে সোফিয়া কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করলেন। নিজের সুকঠিন মানসিকসংকট এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব বিরাশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধ তলস্তয়কে বাধ্য করল ইয়াসিয়ানা ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি জমাতে। কখনো ঘোড়ার পিঠে, কখনো ট্রেনে শুরু হল তার দীর্ঘ পদযাত্রা। অবশেষে অস্তাপোডো স্টেশনে এসে আর চলতে পারলেন না। নিদারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ইয়াসিয়ানায় খবর পৌঁছল। কাউন্টেস সোফিয়া পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে অখ্যাত স্টেশনে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু তলস্তয় আর বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না। কাউন্টেস ও তার পরিজনেরা এসে পৌঁছবার তিনদিন পর ১৯১০ সালের ২৩ নভেম্বর ভোরে মৃত্যু হল সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয়ের।

যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হল ইয়াসিয়ানায়। কোনোরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই তাঁকে সমাহিত করা হল। ইয়াসিয়ানায় তলস্তয় স্মৃতিভবন গড়ে উঠল। ইয়াসিয়ানা পলিয়ানা আজ সোভিয়েত রাশিয়া তথা পৃথিবীর অন্যতম পবিত্রস্থান।

লিও তলস্তয়ের সমগ্র কথাসাহিত্যকে প্রবণতা অনুযায়ী মোট দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদিকে অভিজাত শ্ৰেণীর সমারোহপূর্ণ জীবনযাত্রার অন্তরালে তীব্র বাসনা ও নৈতিক সংকট, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সহজ সরল দৈনন্দিন জীবনে পরম উপলব্ধির বিকাশ। একদিকে আনা কারেনিনা বা রেজারেকসন জাতীয় উপন্যাস এবং আফটার দ্য বল বা কুয়েৎসার সোনাটা জাতীয় গল্প, অন্যদিকে ইয়ার্ডস্টিক বা হোয়ার লাভ ইজ শ্রেণীর রচনা। এবং সর্বোপরি রয়েছে তাঁর মহত্তম কীর্তি সংগ্রাম ও শান্তি।

উপন্যাসে বর্ণিত প্রধান পরিবারসমূহ এবং অন্যান্য কয়েকটি চরিত্র।

বেজুখভ-পরিবার

কাউন্ট সিরিল বেজুখভ
পিয়ের, ঐ পুত্র, পরবর্তীকালে কাউন্ট পিতর বেজুখভ
প্রিন্সেস কাতিচে, পিয়েরের সম্পর্কিত বোন

রস্তভ-পরিবার

কাউন্ট ইলিয়া রস্তভ
কাউন্টেস নাতালি রুস্তভা, ঐ স্ত্রী
কাউন্ট নিকলাস রস্তভ (নিকোলেংকা), ঐ বড় ছেলে
কাউন্ট পিতর রস্তভ (পেতয়া), ঐ ছোট ছেলে
কাউন্টেস ভেরা রস্তভ, ঐ বড় মেয়ে
কাউন্টেস নাতালি রস্তভা (নাতাশা), ঐ ছোট মেয়ে
সোনিয়া, রস্ত পরিবারের আশ্রিতা
বের্গ, আলফোঁস কালিচ, জার্মান বংশোদ্ভুত জনৈক অফিসার, পরে ভোর স্বামী

বলকনস্কি-পরিবার

প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কি অবসরপ্রাপ্ত সেনাপতি-প্রধান
প্রিন্স আলু বলকনস্কি, ঐ ছেলে
প্রিন্সেস মারি বলকনস্কায়া, ঐ মেয়ে
প্রিন্সেস এলিজাবেথ বলকনস্কায়া (লিজে), আন্দ্রুর স্ত্রী
তিখন, প্রিন্স এন, বলকনস্কির খানসামা
আলপাতি, ঐ নায়েব

কুরাগিন-পরিবার

প্রিন্স ভাসিলি কুরাগিন
প্রিন্স হিপোলিৎ কুরাগিন, ঐ বড় ছেলে
প্রিন্স আনাতোল কুরাগিন, ঐ ছোট ছেলে
প্রিন্সেস হেলেন কুরাগিনা (লেলিয়া),ঐ মেয়ে, পরে পিয়েরের স্ত্রী
প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভ দ্রুবেৎস্কায়া
প্রিন্স বরিস বেক্রয় (বরি), ঐ ছেলে
জুলি কুরাগিনা, বরিসের স্ত্রী
বিলিবিন, কূটনীতিবিদ
দেনিসভ, ভাসিলি দিমিত্রিচ, হুজার অফিসার
লাভ্রুশকা, ঐ সহিস
দলখভ (ফেদিয়া), জনৈক বেপরোয়া অফিসার
কাউন্ট রস্তপচিন, মস্কোর শাসনকর্তা
শিনশিন, কাউন্টেস রস্তভার আত্মীয়
তিমখিন, পদাতিক বাহিনীর অফিসার
তুশিন, গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার
প্লাতন কারাতে, জনৈক চাষী

.

প্রধান প্রধান ঘটনাবলির তারিখ

প্রথম খণ্ড :

১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ ১১ই অক্টোবর কুতুজভ ব্রাউনাউ-এর নিকটে সেনাদল পরিদর্শন করল
২৩শে অক্টোবর রুশবাহিনীর এনস নদী অতিক্রম
২৪শে অক্টোবর আমসতেতেন-এ যুদ্ধ
২৮শে অক্টোবর রুশ বাহিনীর দানিয়ুব নদী অতিক্রম
৩০শে অক্টোবর দুরেনস্তিন-এ মতিয়ের-এর পরাজয়
৪ঠা নভেম্বর নেপোলিয়ন শোন থেকে মুরাণকে চিঠি লিখল, শোন গ্ৰেবার্ন-এর যুদ্ধ
১৯শে নভেম্বর অস্ত্রালিজ-এ সমর-পরিষদের বৈঠক
২০শে নভেম্বর অস্তারলিজ-এর যুদ্ধ

১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ

২৭শে জানুয়ারি প্রুশিসঙ্ক-আইলাউ-এর যুদ্ধ
২রা জুন ফ্রিডল্যান্ড-এর যুদ্ধ
১৩ই জুন তিলসিট-এ দুই সম্রাটের সাক্ষাৎ

দ্বিতীয় খণ্ড

১৮১২ খ্রিস্টাব্দ

১৭ই মে নেপোলিয়নের ড্রেসডেন ত্যাগ
১২ই জুন নেপোলিয়নের নিয়েমেন অতিক্রম করে রাশিয়ায় প্রবেশ
১৪ই জুন আলেক্সান্দার বলাশেভকে নেপোলিয়নের কাছে পাঠাল
১৩ই জুলাই অস্ত্রভনাতে পাভলোগ্রাদ হুজারদের যুদ্ধ
৪ঠা আগস্ট আলপাতিচ স্নোলেন-এ কামানের গর্জন শুনতে পেল
৫ আগস্ট স্মোলেনঙ্কের উপর গোলাবর্ষণ
৭ আগস্ট প্রিন্স নিকলাস বলকনস্কির বন্ড হিলস ছেড়ে বোণ্ডচারভো যাত্রা
৮ই আগস্ট কুতুজভের প্রধান সেনাপতিপদে নিয়োগ
১০ই আগস্ট প্রিন্স আন্দ্রুর সেনাদলের বন্ড হিলসের অদূরে অবস্থান
১৭ই আগস্ট কুতুজভ কর্তৃক সেনাবাহিনীর ভার গ্রহণ, নিকলাস বোগুচারভো পৌঁছল
২৪শে আগস্ট শেভার্দিনো দুর্গের যুদ্ধ
২৬শে আগস্ট বরদিনোর যুদ্ধ

তপন রুদ্র

.

প্রথম পর্ব – অধ্যায় : ১

আচ্ছা প্রিন্স, তাহলে তো জেনোয়া ও লুক্কা এখন বোনাপার্তদের পারিবারিক সম্পত্তি বিশেষ। কিন্তু আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, একেও যদি আপনি যুদ্ধ না বলেন, এখনো যদি সেই খ্রিস্টবৈরীর–আমি সত্যি বিশ্বাস করি যে সে লোকটি খ্রিস্টবৈরী–জঘন্য আচরণ ও সন্ত্রাসকে সমর্থন করেন, তাহলে আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না, আপনি আমার বন্ধু থাকবেন না, বা আপনি যে নিজেকে আমার বিশ্বস্ত দাস বলে প্রচার করে থাকেন তাও আর থাকবেন না। কিন্তু আপনার হল কী? মনে হচ্ছে আপনাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছি–বসে পড়ুন, আর সব খবর আমাকে খুলে বলুন।

১৮০৫ সালে জুলাই মাস, বক্তা খ্যাতনামা আন্না পাভলভনা শেরার, ভদ্রমহিলা সম্রাজ্ঞী মারিয়া ফিয়দরভনার প্রধান ও প্রিয় সখী। কথাগুলো বলা হল প্রিন্স ভাসিলিকে, ভদ্রলোক উচ্চপদমর্যাদার অধিকারী, আজকের বৈঠকে সেই প্রথম সমাগত অতিথি। আন্না পাভলভনা কয়েকদিন যাবৎ কাশিতে ভুগছে। মহিলা নিজে অবশ্য বলেছে যে সে লা গ্রিপ্পেতে ভুগছে, গ্রিপ্পে কথাটা সেন্ট পিটার্সবুর্গে নতুন আমদানি হয়েছে, শুধু ভদ্রলোকরাই কথাটা ব্যবহার করে থাকে।

তার সব আমন্ত্রণপত্রই ফরাসি ভাষায় লেখা; সকালেই সেগুলো বিলি করে এসেছে লাল পোশাকপরা পরিচারক; তাতে লেখা ছিল :

কাউন্ট (অথবা প্রিন্স), আপনার হাতে যদি কাজ না থাকে আর একটি অসহায় পঙ্গু মানুষের সঙ্গে সন্ধ্যাটা কাটানো যদি ভয়ঙ্কর বলে মনে না করেন, তাহলে আজ রাতে ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে আপনার দর্শন পেলে খুবই আনন্দিত হব–আন্নেৎ শেরার।

মহিলাটির কথায় বিন্দুমাত্রও ক্ষুব্ধ না হয়ে প্রিন্স বলল, হা ঈশ্বর! কী তীব্র আক্রমণ! এই মাত্র সে ঘরে ঢুকেছে; পরনে নকশা-করা দরবারি পোশাক, ব্রিচেস আর জুতো, বুকে অনেকগুলো তারকা আঁটা; চ্যাপ্টা মুখে গাম্ভীর্যের প্রকাশ। সে কথা বলল সেই চোস্ত ফরাসিতে যে ভাষায় আমাদের পূর্বপুরুষরা শুধু কথাই বলত না, চিন্তাও করত, সমাজর উঁচু মহলে ও দরবারের পরিবেশে মানুষ হওয়া মর্যাদাসম্পন্ন লোকের মতো তার কথা বলার ভঙ্গি। আন্না পাভলাভনার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাতে চুমো খেয়ে প্রিন্স তার সুগন্ধী, চকচকে টাকটাকে এগিয়ে দিয়ে মৌজ করে একটা সোফায় বসল।

প্রিয় বান্ধবী, প্রথমেই বলুন আপনি কেমন আছেন। আপনার বন্ধুর মনকে শান্ত করুন, গলার স্বরের কোনোরকম পরিবর্তন না করেই প্রিন্স বলল; আপাত ভদ্রতা ও সহানুভূতির অন্তরালে তার কণ্ঠস্বরের নিস্পৃহতা, এমনকি বিদ্রূপটাও চাপা পড়ল না।

আন্না পাভলভনা বলল, মনের মধ্যে নৈতিক যন্ত্রণা দিয়ে কেউ কি ভালো থাকতে পারে? অনুভূতির বালাই থাকলে এখনকার মতো অবস্থায় কেউ কি শান্ত হতে পারে? আশা করি সারা সন্ধ্যাটাই এখানে কাটাবেন?

আর ইংরেজ রাজদূতের ওখানকার উৎসবের কী হবে? আজ বুধবার। একবার তো আমাকে সেখানে দেখা দিতেই হবে, প্রিন্স বলল। আমাকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য আমার মেয়ে আসবে।

আমি ভেবেছিলাম আজকের উৎসবটা বাতিল করা হয়েছে। সত্যি বলছি, এসব উৎসব আর আতসবাজি বড়ই ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে।

তারা যদি আপনার এই ইচ্ছাটা জানত তাহলে উৎসবটা অবশ্য বন্ধ করে দিত, প্রিন্স বলল। দম-দেয়া ঘড়ির মতো অভ্যাসবশত সে এমন সব কথা বলে যা লোকে বিশ্বাস করুক তাও সে চায় না।

ঠাট্টা করবেন না! আচ্ছা, নভসিলতসেভের কাগজপত্র সম্পর্কে কি স্থির হয়েছে? আপনি তো সবই জানেন।

তারা স্থির করেছে যে বোনাপার্ত তার নৌকাগুলি পুড়িয়ে দিয়েছে, আর আমার বিশ্বাস, আমাদের নৌকাগুলি পোড়াতেও আমরা রাজি।

প্রিন্স ভাসিলি সবসময়ই পুরনো পার্ট আওড়ানোর মতো করে টেনে টেনে কথা বলে। অপর দিকে, চল্লিশ বছর বয়স হলেও আন্না পাভলভনা শেরার উত্তেজনায় ও আবেগে টগবগ করে। সবসময় উৎসাহে ভরপুর থাকাটাই যেন তার সামাজিক কর্তব্য; আর তাই মনের অবস্থা কখনো সে রকম না থাকলেও পাছে পরিচিত জনকে হতাশ করতে হয় এই ভয়েই তাকে উৎসাহে ভরপুর থাকাটাই যেন তার সামাজিক কর্তব্য, আর তাই, মনের অবস্থা কখনো সে-রকম না থাকলেও পাছে পরিচিত জনকে হতাশ করতে হয় এই ভয়েই তাকে উৎসাহশীল হতে হয়। তার ম্লান মুখের সঙ্গে মানানসই না হলেও তার ঠোঁট দুখানিকে ঘিরে স্মিতহাসির রেখাঁটি সবসময়ই খেলা করে বেড়ায়; নিজের এই ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন হলেও এটাকে সংশোধন করতে সে চায় না, সংশোধন করতে পারে না। সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করে না।

রাজনীতিবিষয়ক আলোচনা প্রসঙ্গে আন্না পাভলভনা হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল :

আঃ, অস্ট্রিয়ার কথা আমার কাছে বলবেন না। আমি হয়তো এসব ব্যাপার বুঝি না, কিন্তু অস্ট্রিয়া কোনোদিন যুদ্ধ চায়নি, আজও চায় না। সে আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাশিয়া একাই ইউরোপকে বাঁচাবে। আমাদের মহামান্য সম্রাট এই মহৎ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, আর সে কর্তব্যে তিনি অবিচলই থাকবেন। এই একটি কথা আমি বিশ্বাস করি। আমাদের সৎ ও আশ্চর্য সম্রাট এই পৃথিবীতে একটি মহৎ ভূমিকা পালন করবেন; আর তিনি এতই ধার্মিক ও মহান যে ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করবেন না। তার কর্তব্য তিনি পালন করবেন, এই নরঘাতক শয়তানকে আশ্রয় করে যে সহস্ৰশীর্ষ সপ্নরূপী বিপ্লব আজ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তাকে তিনি ধ্বংস করবেন! ভালো মানুষের রক্তের প্রতিশোধ শুধু আমাদেরই নিতে হবে…। আর কার উপর আমরা নির্ভর করতে পারি শুনি? ব্যবসায়ীসুলভ মনোবৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড কখনো সম্রাট আলেক্সান্দারের মহত্ত্বকে বুঝবে না, বুঝতে পারে না। সে তো মাল্টা ছেড়ে আসতেও আপত্তি করেছে। আমাদের সব কাজের মধ্যেই তো সে একটা গোপন অভিসন্ধি খুঁজে বেড়াচ্ছে। নভসিলতসেভ কী জবাব পেয়েছে? কিচ্ছু না। আমাদের সম্রাটের আত্মত্যাগকে ইংরেজরা বুঝতে পারেনি, পারবেও না। নিজের জন্য তিনি কিছুই চান না, চান শুধু মানুষের কল্যাণ। আর তারা কী দিচ্ছে? কিছুই না! আর মুখে যেটুকু বা বলছে, কাজে তাও করছে না! প্রাশিয়া তো আগাগোড়াই বলছে, বোনাপার্ত অপরাজেয়; তার সামনে গোটা ইওরোপ অসহায়।…হার্ডেনবুর্গ বা হগউইজের কথার এক বর্ণও আমি বিশ্বাস করি না। প্রাশিয়ার এই বিখ্যাত নিরপেক্ষতা তো একটা ফাঁদমাত্র। আমার ভরসা শুধু ঈশ্বরকে, আর আমাদের পরমারাধ্য সম্রাটের মহৎ নিয়তিকে। ইওরোপকে তিনিই রক্ষা করবেন!

নিজের আবেগে হেসে উঠে মহিলাটি হঠাৎ থেমে গেল।

প্রিন্স হেসে বলল, আমার তো মনে হয়, আমাদের প্রিয় ইউজিনগেরোদের বদলে আপনাকে যদি পাঠানো হত, তাহলে আপনি হয়তো গায়ের জোরেই প্রাশিয়ার রাজার সম্মতি আদায় করে নিতে পারতেন। আপনার যা গলার জোর। এক কাপ চা কি মিলবে?

এখনই। শান্ত গলায় আবার বলল, ভালো কথা, আজ রাতে দুজন মজার লোককে আশা করছি। একজন ভাইকোঁত দ্য মর্তেমার্ত, সেরা ফরাসি পরিবার রোহাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে; একজন সত্যিকারের সৎ বিদেশী। অপরজন আবে মোরিও। সেই বিদগ্ধ চিন্তাশীল লোকটিকে আপনি চেনেন? সম্রাট তাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। শুনেছেন?

প্রিন্স বলল, তাদের সঙ্গে দেখা হলে খুশি হব। কিন্তু বলুন তো, এ কথা কি সত্যি যে বিধবা সম্রাজ্ঞী ব্যারন ফুংকে-কেই ভিয়েনাতে প্রথম সচিব নিযুক্ত করতে চাইছেন? ব্যারন লোকটি সবদিক থেকেই বড়ই বেচারি।

প্রিন্স ভাসিলির ইচ্ছা ছিল এই চাকরিটা তার ছেলে পাক, কিন্তু অন্য সকলে বিধবা ম্রাজ্ঞী মারিয়া ফিয়রভনার কাছে দরবার করছিল যাতে ব্যারনই চাকরিটা পায়।

আন্না পাভলভনা চোখ দুটো প্রায় বুজে ফেলল; যেন বোঝাতে চাইল সম্রাজ্ঞী যা ইচ্ছা করেছেন, বা যাতে খুশি হয়েছেন তা নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার তারও নেই, বা অন্য কারো নেই।

শুকনো করুণ গলায় সে শুধু বলল, বিধবা সম্রাজ্ঞীর বোনই ব্যারন ফুংকের নাম তার কাছে সুপারিশ করেছিলেন।

সম্রাজ্ঞীর নাম করতেই হঠাৎ আন্না পাভলভনার মুখে গভীর ও আন্তরিক অনুরাগ, শ্রদ্ধা ও বিষণ্ণতার একটা মিশ্র ভাব ফুটে উঠল। যতবার সে তার বিখ্যাত কত্রীর নাম উল্লেখ করে ততবারই তার মুখে এই একই ভাব ফুটে ওঠে।

প্রিন্স নীরবে বসে রইল, কেমন একটু উদাসীন ভাব। আন্না পাভলভনা তাকে সান্তনা দেবার জন্য বলল, এবার আপনার পরিবারের কথা বলুন। আপনি কি জানেন যে আপনার মেয়েকে দেখে সকলেই মুগ্ধ? সকলেই বলছে, সে তো অপূর্ব সুন্দরী।

শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য প্রিন্স মাথা নিচু করল। আমি অনেক সময়ই ভাবি, একটু চুপ করে থেকে প্রিন্সের আরো কাছে ঘেঁষে প্রসন্ন হাসি হেসে তার দিকে তাকিয়ে মহিলাটি বলতে লাগল, আমি অনেক সময়ই ভাবি, জীবনের সুখগুলিকে অনেক সময় কত। অন্যায়ভাবেই না বণ্টন করা হয়ে থাকে। ভাগ্য আপনাকেই এমন দুটি চমৎকার সন্তান উপহার দিয়েছে কেন? একেবারে হোট আনাতোলর কথা আমি বলছি না। তাকে আমি পছন্দ করি না। এমন চমৎকার দুটি সন্তান। অথচ আপনি তাদের মোটেই ভালো চোখে দেখেন না; তাই তো বলি, এমন সন্তান পাবার হক আপনার নেই।

একটি স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

প্রিন্স বলল, আমি কিন্তু নিরুপায়। লাভাতের হয়তো বলত, বাপ হবার মতো হিম্মৎই আমার নেই।

ঠাট্টার কথা নয়; আপনার সঙ্গে গুরুতর কথা আছে। আপনি কি জানেন, আপনার ছোট ছেলেকে নিয়ে আমি খুশি নই? নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি, সম্রাজ্ঞীর কাছে তার কথা তোলায় তিনি আপনার জন্য দুঃখ করলেন…

প্রিন্স কোনো কথা বলল না, কিন্তু জবাবের অপেক্ষায় মহিলাটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। প্রিন্স ভুরু কুঁচকাল।

অবশেষে বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলেন? আপনি তো জানেন তাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাবার পক্ষে যা করা দরকার সে সবই আমি করেছি, কিন্তু তারা দুজনেই মূর্খ। হিপোলিৎ তো তবু শান্ত মূর্খ, কিন্তু আনাতোল তো দুরন্ত মূর্খ। দুজনের মধ্যে ওইটুকুই যা পার্থক্য। অস্বাভাবিক হাসি হেসে সে কথাগুলি বলল; ফলে তার মুখের চারদিকে যে ভাঁজ পড়ল তাতে একটা অপ্রত্যাশিত কঠোরতা ও ক্ষোভই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল।

আপনার মতো মানুষের সন্তান হয় কেন? আপনি যদি বাবা না হতেন তাহলে তো আপনার বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার থাকত না, চোখ তুলে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্না পাভলভনা বলল।

আমি আপনার অনুগত দাস, আর তাই একমাত্র আপনার স্বীকার করছি যে আমার সন্তানরাই আমার জীবনের কলঙ্ক। এ দুঃখ আমাকে বয়ে বেড়াতেই হবে। এভাবেই আমি নিজেকে বোঝাই। এর হাত থেকে রেহাই নেই।

আর কোনো কথা বলল না। একটা বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করে নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের ভাব প্রকাশ করল শুধু। আন্না পাভলভনা ভাবতে লাগল।

একসময় বলল, আপনার অমিতব্যয়ী ছেলে আনাতোলের বিয়ের কথা কখনো ভেবেছেন? লোকে বলে, ঘটকালি করাটা বুড়িদের একটা নেশা, যদিও নিজের মধ্যে এখনো সে দুর্বলতা আমি বোধ করি না, তবু একটি ছোট মেয়ের কথা আমি জানি যে তার বাবাকে নিয়ে খুব কষ্টে আছে। সে আপনার আত্মীয়াও বটে–প্রিন্সের মারি বল্কনস্কায়া।

প্রিন্স ভাসিলি কোনো জবাব না দিলেও সাংসারিক লোকের পক্ষে উপযুক্ত ক্ষিপ্র স্মৃতিশক্তির বশে এমনভাবে মাথা নাড়ল যাতে মনে হল যে এ খবরটা সেও ভেবে দেখছে।

অবশেষে মনের বিষণ্ণ চিন্তাস্রোতকে সংযত করতে না পেরে বলে উঠল, আপনি কি জানেন যে আনাতোলের জন্য বছরে আমার চল্লিশ হাজার রুবল খরচ হয়? আর সে যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে পাঁচ বছরে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আর বাবাদের এ সবই সহ্য করতে হয়…। আপনার এই প্রিন্সেসটি কি ধনবতী?

তার বাবা খুব ধনী ও কঞ্জুস। গ্রামে থাকেন। তিনিই সুপরিচিত প্রিন্স বলকনস্কি; স্বৰ্গত সম্রাটের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন; সকলে তাকে প্রাশিয়ার রাজা বলেই ডাকে। লোকটি বুদ্ধিমান, কিন্তু ছিটগ্রস্ত ও বিরক্তিকর। মেয়েটি বড়ই কষ্টে আছে। তার একটি ভাই আছে। মনে হয় তাকে আপনি চেনেন, সম্প্রতি সে লিসা মিনেনকে বিয়ে করেছে। ছেলেটি কুতুজভের এড-ডি-কং; আজ এখানে আসবে।

হঠাৎ প্রিন্স আন্না পাভলভনার হাতটা চেপে ধরে যে কারণেই হোক হাতটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, শুনুন প্রিয় আন্নেৎ, এই ব্যবস্থাটা আপনি করে দিন, তাহলে চিরদিন আমি আপনার একান্ত বংশব্দ দাস হয়ে থাকব। মেয়েটি ধনী, বংশও ভালো, আর আমিও তাই চাই।

তারপর তার সুপরিচিত সহজ ভঙ্গিতে মহিলার হাতটি তার ঠোঁটের কাছে তুলে চুমো খেল এবং অন্য দিকে তাকিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতটাকে এদিক ওদিক দোলাতে লাগল।

একটু ভেবে আন্না পাভলভনা বলল, শুনুন। আজ সন্ধ্যায়ই আমি ছোট বলকুনস্কির স্ত্রী লিসার সঙ্গে কথা বলব, আশা করি ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। আপনার পরিবারের পক্ষ নিয়েই আমি ঘটকালির কাজে শিক্ষানবিশী শুরু করে দেব।

*

অধ্যায়

আন্না পাভলভনার ড্রয়িং রুম ক্রমেই লোকজনে ভরে উঠছে। পিটার্সবুর্গের একেবারে উঁচু মহলটাই সেখানে হাজির : সমবেত লোকজনের মধ্যে বয়স ও চরিত্রের ব্যবধান পিস্তর, কিন্তু সামাজিক মর্যাদায় সকলেই এক। প্রিন্স ভাসিলির মেয়ে সুন্দরী হেলেন এসেছে তার বাবাকে দূতাবাসের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে; তার পরনে বলনাচের পোশাক, তাতে প্রধান অতিথির তকমা আঁটা। পিটার্সবুর্গের সব চাইতে মনোরমা তরুণী প্রিন্সেস বলকনস্কায়াও এসেছে। গত শীতকালে তার বিয়ে হয়েছে; সন্তানসম্ভাবনা দেখা দেয়ায় সে আজকাল বড় জমায়েতে যায় না, শুধু ছোটখাটো অনুষ্ঠানেই যোগ দেয়। প্রিন্স ভাসিলির ছেলে হিপোলিৎ এসেছে মর্তোমাকে সঙ্গে নিয়ে; তাকে সে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মঠাধ্যক্ষ মোরিও এবং আরো অনেকেই এসেছে।

নতুন কেউ এলেই আন্না পাভলভনা তাকে বলছে, আমার খালার সঙ্গে তো আপনার এখনো দেখাই হয়নি, অথবা আমার খালাকে কি আপনি চেনেন না? আর খুব গম্ভীর হয়ে তাকে সেই বৃদ্ধ মহিলাটির কাছে নিয়ে হাজির করছে। টুপিতে মস্ত বড় একটা ফিতের বো পরে মহিলাটি ঘরের মধ্যে বসে আছে; ধীরে ধীরে প্রতিটি অতিথির নাম ঘোষণা করেই আন্না পাভলভনা সেখান থেকে চলে যাচ্ছে।

অতিথিরা কেউই এই বুড়ি খালাটিকে চেনে না, চিনতে চায় না, তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না; তবু প্রত্যেকেই তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে, আর আন্না পাভলভনা নীরবে, বিষণ্ণ আগ্রহের সঙ্গে সেটা লক্ষ্য করছে। খালাও প্রত্যেকের সঙ্গেই সেই একই কথা বলছে, সেই একই পারস্পরিক স্বাস্থ্যের কথা, আর মহামান্যা সম্রাজ্ঞীর স্বাস্থ্যের কথা, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আজ তিনি অনেকটা ভালো আছেন। ভদ্রতার খাতিরে বিরক্তি প্রকাশ থেকে বিরত থাকলেও সকলেই এই বিরক্তিকর কর্তব্যটি পালন করে সেখান থেকে সরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছে এবং সারা সন্ধ্যা আর সে জায়গা মারাচ্ছে না।

তরুণী প্রিন্সেস বলকনস্কায়া জরির কাজ-করা ভেলভেটের থলেতে কিছু কাজের নমুনা নিয়ে এসেছে। তার সুন্দর ছোট ঠোঁটের উপরে ঈষৎ গোঁফের রেখা চোখে পড়ছে; ঠোঁটটি দাঁতের তুলনায় কিছুটা ছোট হলেও তাতেই তাকে সুন্দর মানিয়েছে; বিশেষ করে দুটো ঠোঁট যখন মাঝে মাঝে মিলে যায় তখন তাকে বড়ই সুন্দর দেখায়। অন্য সব মনোরমা স্ত্রীর মতোই তার এই টি-উপরের ঠোঁট ছোট হওয়ার জন্য মুখটা অর্ধেক খুলে থাকা–এই ত্রুটিই যেন তার পক্ষে একটি বিশেষ সৌন্দর্যের লক্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সুন্দরী তরুণীটিকে দেখে সকলের মুখই জ্বলজ্বল করে উঠল–শীঘ্রই তো সে মা হবে, অথচ কেমন প্রাণ-শক্তি ও স্বাস্থ্যে ভরপুর, কেমন অনায়াসে এই ভার সে বহন করে চলেছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটালে, তার সঙ্গে কথাবার্তা বললে বৃদ্ধ ও মন-মরা যুবকরাও মনে করে তারাও বুঝি তার মতোই জীবন ও স্বাস্থ্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। যারাই তার সঙ্গে কথা বলে, প্রতিটি কথার পরে তার উচ্ছল হাসি ও সাদা দাঁতের ঝলকানি দেখতে পায়, তারাই মনে করে যে সে দিনটাতে তাদের মন-মেজাজও ভালো হয়ে উঠেছে।

ছোট্ট প্রিন্সেসটি হাল্কা অথচ দ্রুত পা ফেলে ফেলে কাজের থলেটা হাতে ঝুলিয়ে টেবিলের চারদিকে পাক খেয়ে সুন্দরভাবে পোশাকটা ছড়িয়ে রুপোর সামোভারটার পাশে একটা সোফায় এমনভাবে বসল যেন সে যা কিছু করছে তাতে যেমন সে নিজে, তেমনই অন্য সকলেই খুব খুশি। থলের জিনিসগুলি বের করে সকলকে ডেকে সে ফরাসিতে বলল, আমার কাজগুলি নিয়েই এসেছি। দেখুন আনেৎ, আশা করি আমার সঙ্গে আপনি ইয়ারর্কি করেন নি। চিঠিতে লিখেছিলেন, নেহাত্র ছোটখাট অনুষ্ঠান হবে, আর তাই দেখতেই পাচ্ছেন কী রকম বাজে পোশাক পরে আমি এসেছি।

আন্না পাভলভনা জবাব দিল, যাই পর না কেন তবু তুমি অন্য সকলের চাইতে সুন্দরী।

জনৈক জেনারেলের দিকে ফিরে সেই একই সুরে প্রিন্সেস ফরাসিতেই বলল, আপনি কি জানেন যে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে? সে তো যাচ্ছে নিজেকে খুন করতে। আপনিই বলুন, এই হতভাগা যুদ্ধে কি লাভ? প্রিন্স ভাসিলির দিকে ঘুরে সে জিজ্ঞাসা করল; তারপর জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই সে তার মেয়ে সুন্দরী হেলেনের দিকে মুখ ফেরাল।

প্রিন্স ভাসিলি আন্না পাভলভনাকে বলল, এই ছোট প্রিন্সেসটি কী মিষ্টি!

তার পরেই এসে হাজির হল মজবুত গড়নের একটি শক্ত-সমর্থ যুবক। চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখে চশমা, পরনে হাল্কা রঙের কেতাদুরস্ত ব্রিচেস ও বাদামি ড্রেস-কোট। এই যুবকটি ক্যাথারিনের সমকালীন বিখ্যাত জমিদার কাউন্ট বেজুকভের অবৈধ সন্তান। জমিদারবাবুটি এখন মুমূর্ষ অবস্থায় মস্কোতে দিন কাটাচ্ছে। যুবকটি এখনো সামরিক বা বেসামরিক কোনো চাকরিতেই যোগ দেয় নি, কারণ এই সবেমাত্র সে বিদেশ থেকে ফিরেছে; বিদেশেই সে লেখাপড়া শিখেছে; এখানকার সমাজে এই তার প্রথম আবির্ভাব। বৈঠকখানার নিম্নতর মর্যাদার অধিকারী লোকের মতোই মাত্র একটুখানি ঘাড় নেড়েই আন্না পাভলভনা তাকে অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু এই নিচু মানের অভ্যর্থনা সত্ত্বেও পিয়েরকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মহিলাটির মুখের উপর উদ্বেগ ও আতঙ্কের এমন একটা ছায়া নেমে এল যেন সেই মানুষটি এই ঘরের তুলনায় অনেক বড়, যেন এ ঘরে তাকে মানায় না। ঘরে সমবেত অন্য সকলের চাইতে এই যুবকটির চেহারা অবশ্যই বড় মাপের; কিন্তু মহিলাটির উদ্বেগের কারণ অন্য; যুবকটির মুখের ভাব লাজুক অথচ সপ্রতিভ, কিন্তু পর্যবেক্ষণশীল ও স্বাভাবিক ভাবটিই তাকে বৈঠকখানার অন্য সকলের চাইতে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

যুবকটিকে খালার কাছে নিয়ে যেতে যেতে তার সঙ্গে শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করে আন্না পাভলভনা বলল, মঁসিয় পিয়ের যে একটি অসহায় পঙ্গু মানুষকে দেখতে এখানে এসেছেন তাতে ভারী খুশি হয়েছি।

যেন কাউকে খুঁজছে এমনিভাবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে পিয়ের বিড় বিড় করে কি যে বলল কিছুই। বোঝা গেল না। খালার কাছে যেতে যেতেই সে স্মিত হাসি হেসে মাথা নিচু করে ছোট প্রিন্সেসকে অভিবাদন জানাল; যেন তার সঙ্গে পরিচয়টা বেশ ঘনিষ্ঠ।

আন্না পাভলভনার ভয়টা অকারণ হয়; মহামান্যা সম্রাজ্ঞীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খালা যে লম্বা বক্তৃতা দিল তার কোনো জবাব না দিয়েই পিয়ের তার দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। আন্না পাভলভনা তাকে আটকে দিয়ে সভয়ে বলে উঠল :

আপনি কি মঠাধ্যক্ষ মোরিওকে চেনেন? খুব আমুদে মানুষ।

হ্যাঁ, তার শাশ্বত শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা আমি শুনেছি; পরিকল্পনাটি আকর্ষণীয়, কিন্তু মোটেই। সম্ভবপর নয়।

গৃহকত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থেকেও আন্না পাভলভনা কোনো রকমে জবাব দিল, আপনি তাই মনে করেন বুঝি? পিয়ের কিন্তু এবার দ্ৰতাবিরুদ্ধ কাজ করে বসল। প্রথমে এক মহিলার কথা শেষ হবার আগেই তার কাছ থেকে চলে এসেছিল, আর এখন যে চলে যেতে চাইছে তাকে ধরে কথা শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাথা নুইয়ে দুই পা ছড়িয়ে সে বোঝাতে শুরু করে দিল কেন সে আবের পরিকল্পনাকে অলীক কল্পনাবিলাস বলে মনে করে।

আন্না পাভলভনা হেসে বলল, এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

যুবকটির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সে আবার গৃহকত্রীর কর্তব্য পালনে তৎপর হয়ে উঠল। সব দিকে তার চোখ, সর্বত্র তার কান; যেখানেই আলোচনায় ঢিল পড়ছে সেখানেই সে বাড়িয়ে দিচ্ছে তার সাহায্যের হাত। সুতো-কলের ফোরম্যান যেমন কারখানার কাজ চালু করে দিয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে-কোথায় একটা টেকো থেমে গেছে, বা কাঁচ-কাঁচ করছে, অথবা যতটা শব্দ হওয়া উচিত তার চাইতে বেশি শব্দ করছে, এবং সেখানেই ছুটে গিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখে বা ঠিক মতো চালিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই আন্না পাভলভনাও বৈঠকখানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো বা নীরব, আবার কখনো অতিমাত্রায় সরব কোনো দলের কাছে আলোচনার যন্ত্রটাকে আবার যথাযথভাবে চালু করে তুলছে। কিন্তু এসব কাজকর্মের মধ্যেও পিয়েরকে নিয়ে তার উদ্বেগটা বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠছে। পিয়ের যখনই মর্তেমায়ের দলের কাছে অথবা মধাধ্যক্ষের দলের কাছে যাচ্ছে তখনই মহিলাটি তার উপর কড়া নজর রাখছে।

পিয়ের লেখা-পড়া শিখেছে বিদেশে; রাশিয়াতে এসে আন্না পাভলভনার পার্টিতেই সে প্রথম যোগ দিল। সে জানত, পিটার্সবুর্গের সেরা সব গুণীজনরাই সেখানে হাজির থাকবে, তাই খেলনার দোকান কৌতূহলী শিশুর মতো কোনদিক রেখে কোনদিকে যে তাকাবে তাই ঠিক বুঝতে পারছে না, মনে ভয় পাচ্ছে কোনো কুশলী আলোচনা ও মন্তব্য না অশ্রুত থেকে যায়। সমবেত সকলের মুখে যে আত্মবিশ্বাস ও সুষ্ঠু অভিব্যক্তি তার চোখে পড়েছে তাতে সর্বক্ষণই একটা গম্ভীর কিছু শুনবার আশাই সে করছে। শেষপর্যন্ত সে মোরিওর কাছে গিয়ে হাজির হল। এখানকার আলোচনাটা তার বেশ মনোগ্রাহী বলে মনে হল; তাই অন্য সব যুবকদের মতোই সেও তার নিজের মত প্রকাশ করবার মতো একটা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

*

অধ্যায়-

আন্না পাভলভনার পার্টি পুরোদমে চলছে। চারদিকে (সুতো কলের) টেকোগুলো অবিশ্রান্তভাবে গুনগুন করে চলেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম খালাটি। তার চিন্তাক্লিষ্ট শুকনো মুখ এই ঝলমলে জমায়েতের মাঝখানে একান্তই বেমানান। শুধু আর একটি বয়স্কা মহিলা তার পাশে বসে আছে। তাছাড়া বাকি সব লোক তিনটে দলে ভাগ হয়ে জমে গেছে। একটি দল প্রধানত পুরুষরাই রয়েছে; তারা বসেছে মঠাধ্যক্ষকে ঘিরে। প্রধানত যুবকদের আর একটা দল প্রিন্স ভাসিলির মেয়ে সুন্দরী প্রিন্সেস হেলেন এবং বয়সের তুলনায় একটু মোটাসোটা খুবই সুন্দরী গোলাপবর্ণ ছোট্ট প্রিন্সেস বলকনস্কায়াকে ঘিরে বসেছে। তৃতীয় দলটা গড়ে উঠেছে মর্তোমাৎ ও আন্না আন্না পাভলভনাকে কেন্দ্র করে।

ভাইকোঁত সুদর্শন যুবক; নরম চোখ-মুখ, মার্জিত আচরণ; নিজেকে খ্যাতিমান মনে করলেও ভদ্রতার খাতিরে যে দলে বসেছে তার সঙ্গেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। আন্না পাভলভনারও সমবেত অতিথিদের সামনে দর্শনীয় বস্তু হিসেবেই তাকে উপস্থিত করেছে। হোটেলের কুশলী পরিবেশকারী যেভাবে একটি বিশেষ সুখাদ্য পরিবেশন করে, আন্না পাভলভনাও সেইভাবে প্রথমে ভাইকোঁতকে ও পরে মঠাধ্যক্ষকে বিশিষ্ট খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিবেশন করছে। মর্তোমার্তের দল সঙ্গে সঙ্গেই দুক দএনঝিনের হত্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিল। ভাইকোঁত বলল যে, দএনঝিন তার নিজের উদারতার জন্যই মারা গেছে; তার প্রতি বোনাপার্তের বিদ্বেষেরও তো বিশেষ কারণ ছিল।

আন্না পাভলভনা খুশি হয়ে বলল, তা তো বটেই। সে বিষয়ে সব কথা আমাদের বলুন ভাইকোঁত।

ভাইকোঁত যে অনুরোধটি রাখতে রাজি সেটা বোঝাবার জন্য সে সহৃদয় হাসি হেসে মাথাটা নোয়ালো। সে কাহিনী সকলকে শোনাবার জন্য আন্না পাভলভনা সকলকে ডেকে একত্র করল।

জনৈক অতিথির কানে ফিসফিস করে বলল, দুকের সঙ্গে ভাইকোঁতের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। আরেক জনকে বলল, কথক হিসেবেও ভাইকোঁত চমৎকার। আর তৃতীয়জনকে বলল, একেবারে সেরা মহলে যে তার চলাফেরা।

গল্প বলবার জন্য তৈরি হয়ে ভাইকোঁত ঈষৎ হাসল।

প্রিয় হেলেন, তুমি এখানে এসে বস, যে সুন্দর তরুণী প্রিন্সেসটি অন্য একটি দলের মধ্যমণি হয়ে কিছুটা দূরে বসেছিল, আন্না পাভলভনা তাকেও কাছে ডাকল।

প্রিন্সেস হাসল। অপরূপ সুন্দরী নারীর মুখের যে হাসিটি নিয়ে সে প্রথম এই ঘরে ঢুকেছিল সেই অপরিবর্তনীয় হাসিটি মুখে নিয়েই নিয়েই সে উঠে দাঁড়াল। পাটকরা সাদা পোশাকের ঈষৎ খসখস শব্দ তুলে, শুভ্র কাঁধ, চকচকে চুল, ঝলমলে হীরের দ্যুতি খেলিয়ে, প্রিন্সেস কারো দিকে না তাকিয়ে শুধু হাসিটি বিতরণ করে এগিয়ে চলল। সেকালের ফ্যাশান অনুসারে নিজের সুন্দর দেহ, সুঠাম কাঁধ, পিঠ ও বুককে সে এমনভাবে খুলে রেখেছে যাতে সকলেই সে-সবের প্রশংসা করার সুযোগ পায়। দেখে মনে হয়, আন্না পাভলভনার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে যেন একটা নাচঘরের ঝলকানি তার সঙ্গে নিয়ে চলেছে। হেলেনের রূপ এতই মোহময়ী যে তার চালচলনে কোনোরকম বাঁচালতার চিহ্ন তো ছিলই না, বরং দেখে মনে হল নিজের সন্দেহাতীত বিজয়িনী রূপ সম্পর্কে সে যেন কিছুটা সংকোচগ্রস্ত। যে চায় তার রূপের প্রভাবকে খাটো করতে, কিন্তু পারে না।

যে তাকে দেখে সেই বলে, কী চমৎকার! ভাইকেতের বিপরীত দিকের আসনে বসে সে যখন তার দিকে তাকিয়েও সেই অপরিবর্তনীয় হাসিটি হাসল তখন ভাইকোঁত এমনভাবে কাঁধ দুটি তুলে দুই চোখ আনত করল যেন একটা অসাধারণ কিছু দেখে সে চমকে উঠেছে।

সহাস্যে মাথাটা কাৎ করে সে বলল, মাদাম, এ হেন শ্রোতৃবৃন্দের সামন কিছু বলবার সামর্থ্য সম্পর্কে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে।

প্রিন্সেস তার উন্মুক্ত সুডৌল বাহুখানিকে একটি ছোট টেবিলের উপর রাখল; কোনো জবাব দেওয়াই প্রয়োজন মনে করল না। হেসে অপেক্ষা করতে লাগল। যতক্ষণ গল্প বলা চলল ততক্ষণই সে সোজা হয়ে বসে রইল, কখনো চোখ রাখল তার সুডৌল বাহুখানির উপর, আবার কখনো বা সুন্দর বুকের উপর দৃষ্টি রেখে হীরের নেকলেসটিকে ঠিকভাবে বসিয়ে দিল। মাঝে মাঝে পোশাকের ভাঁজগুলোকে ঠিক করে নিল; আর যখনই গল্প বেশ জমে উঠেছে তখনই আন্না পাভলভনার দিকে তাকাচ্ছে, আর তার মুখের ভাবকে নিজের মুখে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে; তারপর আবার ফিরে যাচ্ছে তার উজ্জ্বল হাসিতে।

ছোট প্রিন্সেসও হেলেনের দেখাদেখি চায়ের টেবিল ছেড়ে চলে এসেছিল।

একটু অপেক্ষা করুন, আমার সেলাইটা নিয়ে আসছি।…এবার বলুন, কি ভাবছেন? প্রিন্স হিপোলিৎতের দিতে ফিরে বলল। আমার সেলাইয়ের থলেটা নিয়ে এস।

প্রিন্সেস যখন হাসিমুখে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলতে এসে বহাল তবিয়তে আসনে বসল সেই সময়টুকুতে সকলেই একবার নড়েচড়ে বসল।

এখন আমি স্থির হয়ে বসেছি, এই কথা বলে সেলাইটা হাতে নিয়ে সে ভাইকোঁতকে গল্প শুরু করতে বলল।

প্রিন্স হিপোলিৎ সেলাইয়ের থলেটা এনে দিয়ে বলে ভিড়ে গেল এবং একটা চেয়ার টেনে এনে ছোট প্রিন্সেসের গা ঘেঁষে বসল।

কে দেখে অবাক হতে হয়। সুন্দরী বোনটির সঙ্গে তার অসাধারণ মিল, অথচ তা সত্ত্বেও সে অত্যন্ত কুৎসিত। বোনের মতোই তার চোখ-মুখ, কিন্তু বোনের বেলায় যে মুখ আনন্দে, আত্মতৃপ্তিতে, যৌবনে সতত প্রাণবন্ত, হাসিতেও আশ্চর্য এক ধ্রুপদী দেহ-সুষমায় উজ্জ্বল, ভাইয়ের বেলায় সেই মুখ, অপদার্থতা ও আরোপিত এক বিপ্ন আত্মবিশ্বাসে ক্লিষ্ট; তার দেহ শীর্ণ ও দুর্বল। তার চোখ, নাক, মুখ, সবই যেন এক অর্থহীন বিষণ্ণ বিকৃতিতে ভরা; হাত ও পায়ের অবস্থান যেন সর্বদাই কেমন অস্বাভাবিক।

একটা ভূতের গল্প বলবেন না তো? প্রিন্সেসের পাশে বসে সে বলে উঠল। তাড়াতাড়ি সে তার চশমাটা ঠিক করে নিল, যেন এটা যন্ত্রটা ছাড়া সে কিছুই শুনতে পায় না।

ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বক্তা বলল, না, না, তা বলব না। । কারণ ভূতের গল্পকে আমি ঘৃণা করি, প্রিন্স হিপোলিৎ এমন সুরে কথাটা বলল যাতে মনে হয়, নিজের মুখে উচ্চারণ করলে তবেই সে কোনো কথার অর্থ বুঝতে পারে। এত বেশি জোর দিয়ে সে কথাটা বলল যে তার বক্তব্যটা খুব বুদ্ধিদীপ্ত না অত্যন্ত বোকা-বোকা সেটাই শ্রোতারা ঠিক বুঝতে পারল না। তার পরিধানে গাঢ় সবুজ রঙের ড্রেস-কোট, হালকা রঙের ব্রিচেস, জুতো ও রেশমি মোজা।

ভাইকোঁত সুন্দরভাবে গল্পটি বলল। ঘটনাটি তখন চলতি। দুক দএনঝিন গোপনে প্যারিতে গিয়েছিল মাদময়জেল জর্জের সঙ্গে দেখা করতে; সেখানে বোনাপার্টের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়, বোনাপার্তও ছিল সেই বিখ্যাত অভিনেত্রীটির অনুকম্পার অংশীদার; দুকের উপস্থিতিতেই বোনাপার্ত তার পুরনো মূৰ্ছারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, এবং তার ফলে দুকের একেবারে হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। কিন্তু সে বোনাপার্তকে ছেড়ে দেয়, আর পরবর্তীকালে বোনাপার্ত মৃত্যু দিয়ে সে উদারতার প্রতিদান দেয়।

গল্পটি যেমন সুন্দর, তেমনি আকর্ষণীয়, বিশেষ করে সেই জায়গাটায় যেখানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে চিনতে পারে; সেখানটায় মহিলারা খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

ছোট প্রিন্সেসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্না পাভলভনা বলে উঠল, মনোরম!

মনোরম! ফিস্ ফিস্ করে কথাটা বলে ছোট প্রিন্সেসও সেলাইতে একটা ছুঁচের ফোঁড় দিল; যেন গল্পের আকর্ষণে এতক্ষণ সে সেলাইটা করতে পারছিল না।

এই নীরব প্রশংসাকে সাদরে গ্রহণ করে ভাইকোঁত সকৃতজ্ঞ হাসি হেসে পুনরায় গল্প শুরু করতে প্রস্তুত হতেই আন্না পাভলভনা লক্ষ্য করল যে সেই যুবকটি মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে অত্যন্ত উদ্ধত ও সোচ্চারভাবে কথা বলে চলেছে; কাজেই সে তাড়াতাড়ি মঠাধ্যক্ষের উদ্ধারে এগিয়ে গেল। শক্তি-সাম্যের সমস্যা নিয়ে পিয়ের মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে একটা আলোচনার সূত্রপাত করেছে, আর মঠাধ্যক্ষও যুবকটির সরলতা ও আগ্রহ দেখে নিজের প্রিয় মতবাদটি তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। দুজনই সমান আগ্রহে ও সমান স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে ও শুনছে, আর তাতেই আন্না পাভলভনার যত আপত্তি।

মঠাধ্যক্ষ তখন বলে চলেছে, ইওরোপের শক্তি-সাম্য এবং জনগণের অধিকারই…পথ। এখন শুধু প্রয়োজন রাশিয়ার মতো কোনো শক্তিশালী জাতি-যদিও তাকে বর্বর বলা হয়ে থাকে–নিঃস্বার্থভাবে এসে একটি মিত্রশক্তির নেতৃত্ব গ্রহণ করুক, তার লক্ষ্য হোক ইওরোপে শক্তি-সাম্যকে অক্ষুণ্ণ রাখা; তাহলেই সে মিত্র-শক্তি পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে।

কিন্তু শক্তি-সাম্য কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখবেন? পিয়ের বলতে শুরু করল।

সেই মুহূর্তে আন্না পাভলভনা এসে হাজির হল; পিয়েরের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইতালিয় লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, রাশিয়ার আবহাওয়া তার কেমন লেগেছে। মুহূর্তের মধ্যে ইতালিয় লোকটির মুখের ভাব বদলে গিয়ে বেশি মিষ্টি-মিষ্টি হয়ে উঠল; মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক।

সে বলল, যে সমাজে অভ্যর্থনা লাভ করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে সেই সমাজের, বিশেষ করে এখানকার নারী সমাজের বুদ্ধি ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ আমাকে এতই মুগ্ধ করেছে যে আবহাওয়ার কথা ভাববার মতো সময় আমি এখনো পাই নি।

মঠাধ্যক্ষ ও পিয়েরকে পালাবার সুযোগ না দিয়ে আন্না পাভলভনা তাদের উপর নজর রাখবার সুবিধার জন্য দুজনকে বড় দলটার মধ্যে এনে হাজির করল।

*

অধ্যায়-

ঠিক সেই সময় আরো একজন অতিথি বসবার ঘরে ঢুকল : ছোট প্রিন্সেসের স্বামী প্রিন্স আদ্রু বলকনস্কি। সুদর্শন যুবক, উচ্চতা মাঝারি, চোখ-নাক-মুখ সুগঠিত। ক্লান্ত, একঘেয়ে মুখের ভাব থেকে শান্ত, পরিমিত পদক্ষেপ পর্যন্ত তার সবকিছুই তার প্রাণবন্ত ছোটখাটো স্ত্রীটির সম্পূর্ণ বিপরীত। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সে যে এই ঘরের সকলকেই চেনে তাই শুধু নয়, এরা সকলেই তার কাছে এতই বিরক্তিকর যে তাদের দিকে তাকাতে বা তাদের কথাবার্তা শুনতেও সে ক্লান্তি বোধ করে। আর এই যে সব মুখ তার কাছে এত একঘেয়ে লাগে তাদের মধ্যে সব চাইতে বিরক্তিকর মনে হয় তার সুন্দরী স্ত্রীর মুখখানি। এমন একটা মুখভঙ্গি করে প্রিন্স তার কাছ থেকে সরে গেল যে তার সুন্দর মুখটাও যেন বিকৃত হয়ে উঠল আন্না পাভলভনার হাতে চুমো খেয়ে সে চোখ কুঁচকে একে একে সমবেত সকলকেই দেখতে লাগল।

আপনি নাকি যুদ্ধে চলে যাচ্ছেন প্রিন্স? আন্না পাভলভনা শুধাল।

একজন ফরাসি ভদ্রলোকের মতো করে সেনাপতির নামের শেষ অংশের উপর জোর দিয়ে বলকনস্কি ফরাসি ভাষায় বলল, জেনারেল কুতুজভ আমাকে তার এড-ডি-কং হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আর লিসে, আপনার স্ত্রী।

সে দেশের বাড়িতে চলে যাবে।

আপনাকের মনোরমা স্ত্রীটির সঙ্গ থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে আপনার লজ্জা হচ্ছে না?

যে রকম গায়ে-পড়াভাবে সে অন্য সব পুরুষের সঙ্গেই কথা বলে থাকে তেমনিভাবেই স্বামীকে সম্বোধন করে তার স্ত্রী বলল, আন্দ্রে, মাদময়জেল জর্জ ও বোনাপার্তকে নিয়ে এমন একটা গল্প ভাইকৌত আমাদের বলছেন!

প্রিন্স আন্দ্রু চোখ দুটো কুঁচতে মুখ ফিরিয়ে নিল। প্রিন্স আন্দ্রু ঘরে ঢোকামাত্রই পিয়ের তাকে লক্ষ্য করছিল পরিতুষ্ট সস্নেহ দৃষ্টিতে; এবার সে এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরল। প্রিন্স আন্দ্রু এবারও ভুরু কোঁচকাল; যে কেউ তার হাত ধরলেই সে বিরক্তি বোধ করে; কিন্তু পিয়েরের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখে একটা অপ্রত্যাশিত সদয় স্মিত হাসি ফুটে উঠল।

এই যে!…এই বিরাট জমায়েতে আপনিও হাজিরও দেখছি? পিয়েরকে বলল।

পিয়ের জবাব দিল, আমি জানতাম আপনি এখানে আসবেন। নৈশভোজেও আমি আপনার সঙ্গে যোগ দেব। নিতে পারি তো? যাতে ভঁইকোঁতের গল্প বলায় ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য বেশ নিচু গলায় সে কথাটা বলল।

না, অসম্ভব! প্রিন্স আন্দ্রু হেসে বলে উঠল; এমনভাবে সে পিয়েরের হাতটা চেপে ধরল যাতে বোঝা যায় যে এ ধরনে প্রশ্ন করবার কোনো দরকারই ছিল না। আরো কিছু বলবার ইচ্ছা তার ছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে প্রিন্স ভাসিলি ও তার মেয়ে যাবার জন্য উঠে পড়ায় যুবক দুটিও তাদের পথ করে দেবার জন্য উঠে দাঁড়াল।

বন্ধুর মতো হাত ধরে ফরাসি ভদ্রলোকটিকে বসিয়ে দিয়ে প্রিন্স ভাসিলি বলল, প্রিয় ভাইকোঁত, আমাকে ক্ষমা করবেন। দুভার্গ্যবশত দূতাবাসের ভোজসভায় যোগ দিতে হবে বলে এই সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে, আর আপনাদের বিঘ্ন ঘটাতেও বাধ্য হচ্ছি। আপনার মনোরম সঙ্গ ত্যাগ করতে হচ্ছে বলে আমি খুবই দুঃখিত, আন্না পাভলভনার দিকে ফিরে সে শেষের কথাগুলি বলল।

তার মেয়ে প্রিন্সেস হেলেন পোশাকের ভাঁজগুলোকে আলতো করে তুলে ধরে চেয়ারের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেল; তার সুন্দর মুখের উপর একটা উজ্জ্বল হাসি ঝলমলিয়ে উঠল। তার দিকে চেয়ে পিয়েরের চোখে এমন একটা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ল যেন সে ভয় পেয়েছে।

খুব মনোরমা, প্রিন্স আন্দ্রু বলল।

খুব, পিয়ের বলল।

প্রিন্স ভাসিলি যেতে যেতে পিয়েরের হাতটা চেপে ধরে আন্না পাভলভনাকে বলল : আমার হয়ে এই ভালুকটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে একটু মানুষ করে তুলুন। একটা পুরো মাস সে আমার কাছে আছে, অথচ এই প্রথম তাকে আমি সমাজে মিশতে দেখলাম। একটি যুবকের পক্ষে চতুরা রমণীদের সাহচর্যের মতো দরকারি আর কিছু নেই।

আন্না পাভলভনা হেসে কথা দিল, পিয়েরকে সে হাতে নিল। সে জানে প্রিন্স ভাসিলির সঙ্গে তার বাবার যোগাযোগ আছে। যে বয়স্কা মহিলাটি বুড়ি খালার কাছে বসেছিল সে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে পাশের ঘরে প্রিন্স ভাসিলিকে ধরে ফেলল। তার মুখে উদ্বেগ আর ভয় ফুটে উঠেছে।

পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে সে বলল, আমার ছেলে বরিসের কী হল প্রিন্স? আমি তো আর পিটার্সবুর্গে থাকতে পারছি না। ফিরে গিয়ে বেচারি ছেলেটাকে কী খবর জানাব আমাকে বলে দিন।

প্রিন্স ভাসিলি অনিচ্ছার সঙ্গেই বয়স্কা মহিলাটির কথা শুনল; তার প্রতি খুব একটা ভদ্র ব্যবহারও করল, বরং তার আচরণে একটু অধৈর্যই প্রকাশ পেল; তবু মহিলাটি বিগলিত হাসি হেসে তার হাতটা চেপে ধরল, যাতে সে চলে যেতে না পারে।

সম্রাটকে শুধু একটি কথা যদি বলেন তাহলেই তো সঙ্গে সঙ্গে তাকে রক্ষী বাহিনীকে বদলি করে দেওয়া হবে, আর তাতে তো আপনার কোনই ক্ষতি হবে না, মহিলাটি বলল।

প্রিন্স ভাসিলি জবাব দিল, বিশ্বাস করুন প্রিন্সেস, আমার পক্ষে যা করা সম্ভব সবই করতে আমি প্রস্তুত; কিন্তু সম্রাটকে কোনো অনুরোধ করা আমার পক্ষে শক্ত। আমার কথা শুনুন, প্রিন্স গোলিসনকে দিয়ে রুমিয়ান্তসেভের কাছে আবেদন রাখুন। সেটাই সব চাইতে ভালো পথ।

বয়স্কা মহিলাটি ছিল প্রিন্সেস বেস্কায়া, রাশিয়ার একটি সেরা পরিবারের মেয়ে, কিন্তু এখন সে গরিব হয়ে পড়েছে, দীর্ঘদিন সমাজের বাইরে থাকায় আগেকার প্রভাব-প্রতিপত্তিও হারিয়ে ফেলেছে। একমাত্র ছেলের জন্য রক্ষীবাহিনীতে একটা চাকরি যোগাড় করবার জন্যই সে এখন পিটার্সবুর্গে এসেছে। আসলে শুধুমাত্র প্রিন্স ভাসিলির সঙ্গে দেখা করবার জন্যই সে আন্না পাভলভনার এই জমায়েতের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল এবং এতক্ষণ বসে ভাইকেতের গল্প শুনেছে। প্রিন্স ভাসিলির কথাগলি তাকে ভীত করে তুলল, তার একদা সুন্দর মুখের উপর তিক্ততার একটা ছায়া পড়ল; কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য; পরক্ষণেই আবার হেসে উঠে সে আরো জোরে প্রিন্স ভাসিলির হাতটা চেপে ধরল।

আমার কথা শুনুন প্রিন্স, সে বলতে লাগল। আজ পর্যন্ত আপনার কাছে আমি কিছুই চাই নি, আর কখনো চাইবও না; আবার বাবার সঙ্গে যে আপনার বন্ধুত্ব ছিল সে কথাও কোনোদিন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেই নি; ঈশ্বরের নামে শুধু এই একটিবার আপনাকে অনুরোধ করছি, আমার ছেলের জন্য এটুকু আপনি করুন–আর এ জন্য চিরদিন আপনাকে আমাদের উপকারী বন্ধু বলে মনে করব, সে তাড়াতাড়ি কথাগুলি যোগ করল। না, আপনি রাগ করবেন না; আমাকে কথা দিন! গোলিৎসিনকে বলেছিলাম, তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি তো চিরদিনই দয়ালুহৃদয়, আমাকে দয়া করুন চোখে জল ভরে এলেও হাসবার চেষ্টা করে সে কথাগুলি বলল।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুন্দর মাথাটা বেঁকিয়ে নিজের সুডৌল কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে প্রিন্সেস হেলেন বলল, বাপি, আমাদের দেরি হয়ে যাবে।

সমাজের উপর প্রভাব-প্রতিপত্তি হচ্ছে মূলধন; সেটাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ব্যয়বাহুল্য কে অবশ্যই ছাঁটাই করতে হবে। প্রিন্স ভাসিলি সে কথা জানে; সে বোঝে, যে যখন চাইবে তার কথা রাখতেই সে যদি সম্রাটকে অনুরোধ করে, তাহলে সে তো নিজের জন্য আর কিছুই চাইতে পারবে না; তাই নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটাবার ব্যাপারে সে কিছুটা কৃপণতা অবলম্বন করে থাকে। কিন্তু প্রিন্সেস বেস্কায়ার দ্বিতীয় আবেদনের পরে সে যেন কিছুটা বিবেকের দংশন অনুভব করল। একটি সত্য কথাই মহিলাটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে; জীবনে উন্নতির প্রথম ধাপের জন্য তার বাবার কাছে সে সত্যি ঋণী। তাছাড়া, তার ভাবভঙ্গি দেখেই সে বুঝতে পেরেছে যে এই মহিলাটি সেই সব নারীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মায়েদের-একজন যারা একবার মনস্থির করলে উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত থামে না, এবং দরকার হলে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে পারে, এমন কি একটা হই-চই পর্যন্ত বাধাতে পারে। এই শেষ বিবেচনাটিই তাকে বিচলিত করল।

বলল, প্রিয় আন্না পাভলভনা, আপনি যা চাইছেন সে কাজ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব; কিন্তু আপনার প্রতি আমার অনুরাগ এবং আপনার বাবার স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধাকে প্রমাণ করতে সেই অসম্ভব কাজই আমি করব–আপনার ছেলেকে রক্ষীবাহিনীতে বদলি করা হবে। এ কাজ আমি হাতে নিলাম। আপনি খুশি তো?

প্রিয় উপকারী বন্ধু! আপনার কাছে এইটাই আমি প্রত্যাশা করেছিলাম–আপনার দয়ার কথা আমি জানি!. প্রিন্স ভাসিলি যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

দাঁড়ান–মাত্র একটি কথা! সে যখন রক্ষীবাহিনীতে বদলি হবে… সে একটু থামল, মাইকেল ইলারিওনভিচ কুতুজভের সঙ্গে তো আপনার হৃদ্যতা আছেই…তাকে একটু বলবেন যেন বরিসকে তার অ্যাডজুটান্ট করে নেন। তাহলেই আমি নিশ্চিন্ত হই, আর তার পরে…

প্রিন্স ভাসিলি হাসল।

না, সে কথা আমি দিতে পারব না। আপনি জানেন না প্রধান সেনাপতিপদে নিযুক্ত হবার পর থেকে কুতুজভকে কতভাবে বিরক্ত হতে হচ্ছে। সে নিজে আমাকে বলেছে, মস্কোর সব মহিলারা তাদের সর ছেলেকে অ্যাডজুটান্ট বানিয়ে দেবার জন্য তার হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করেছে।

না, আপনাকে কথা দিতেই হবে! আমি আপনাকে ছাড়ব না…

সুন্দরী কন্যাটি আগের মতো সুরেই বলল, বাপি, আমাদের দেরি হয়ে যাবে।

আচ্ছা, তা হলে আসি! বিদায়! ওর কথা শুনলেন তো?

তাহলে কাল আপনি সম্রাটকে বলছেন তো?

নিশ্চয়; কিন্তু কুতুজভের ব্যাপারে আমি কথা দিচ্ছি না।

কথা দিন, কথা দিন ভাসিলি। আন্না মিখায়লভনা চিৎকার করে বলল; তার ঠোঁটে সেই বালিকাসুলভ কপট প্রেমের হাসি যা তার পরিণত বয়সের চিন্তাক্লিষ্ট মুখে একান্তই বেমানান।

পরিষ্কার বোঝা যায় সে তার বয়সের কথা ভুলে গেছে; তাই অভ্যাসবশতই নারীসুলভ পুরনো ছলাকলার আশ্রয় নিতে পারছে। কিন্তু প্রিন্স চলে যাওয়ামাত্রই তার মুখে আগেকার নিরুত্তাপ নকল ভাব ফুটে উঠল। আবার সে ভাইকেতের গল্প শুনতে দলের মধ্যে ফিরে গেল এবং বাড়ি যাবার সময় না হওয়া পর্যন্ত গল্প শোনার ভানই করে যাবে। তার উদ্দেশ্য তো সিদ্ধই হয়ে গেছে।

*

অধ্যায়-

আন্না পাভলভনা জিজ্ঞাসা করল, মিলানে রাজ্যাভিষেক-এই সাম্প্রতিক হাসির নাটক সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন? আবার এই যে জেনোয়া ও লুক্কার জনসাধারণ মঁসিয় বোনাপার্তের কাছে তাদের দরখাস্ত মঞ্জুর করল-এ হাসির নাটকটি সম্পর্কেই বা আপনি কি মনে করেন? প্রশংসনীয়! একটা মানুষের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে এই তো যথেষ্ট! দেখেশুনে মনে হয়, গোটা পৃথিবীই বুঝি পাগল হয়ে গেছে।

ব্যঙ্গের হাসি হেসে প্রিন্স আন্দ্রু সরাসরি আন্না পাভলভনার মুখের দিকে তাকাল! Dieu me la donne, gare a qui la touche! (ঈশ্বর আমাকে এটি দিয়েছেন, কে এটিকে স্পর্শ করবে সে বিষয়ে তিনিই সাবধান হবেন!)রাজ্যাভিষেকের সময় বোনাপাৰ্তই কথাগুলি বলেছিল। সকলেই বলছে কথাগুলি সে ভালোই বলেছে। এই মন্তব্য করে প্রিন্স ইতালীয় ভাষাতে কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করল, Dio mi la dona, gai a qui la tocca!

আশা করি গ্লাসটা ভরে উপচে পড়ার পক্ষে এটাই হবে শেষ জলের ফোঁটা, আন্না পাভলভনা বলতে লাগল। এই লোকটা সবকিছুর পক্ষে ক্ষতিকর কোনো রাষ্ট্র তাকে সহ্য করতে পারবে না।

রাষ্ট্র? আমি রাশিয়ার কথা বলছি না, বিনীত অথচ হতাশ গলায় ভাইকোঁত বলল, রাষ্ট্রের কথা মাদাম…চতুর্দশ লুইর জন্য, মাদাম এলিজাবেথের জন্য, তারা কি করেছে? কিছু না! ভাইকোঁত আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমার কথা বিশ্বাস করুন, বুরবনদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার উচিত পুরস্কার তারা পাচ্ছে। আরে, সেই পরস্পাপহারীকে পূজা করবার জন্য তারা তো রাষ্ট্রদূত পাঠাচ্ছে।

ঘৃণার সঙ্গে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সে নড়েচড়ে বসল।

প্রিন্স হিপোলিৎ কিছুক্ষণ যাবৎ চশমার ভিতর দিয়ে ভাইকোঁতকে দেখছিল; হঠাৎ সে সম্পূর্ণভাবে ছোট প্রিন্সেসের দিকে ঘুরে গেল এবং একটা উঁচ চেয়ে টেবিলের উপর একটা কুল-চিহ্ন আঁকতে শুরু করল। এমন গুরুত্বের সঙ্গে সে ছোট প্রিন্সেসকে ব্যাপারটা বোঝাতে লাগল যেন সেই তাকে ওটা আঁকতে বলেছে। আসলে সে কতকগুলি অর্থহীন উদ্ভট কথা আওড়াতে লাগল।

ভাইকোঁত বলল, বোনাপার্ত যদি আরো একটি বছর ফ্রান্সের সিংহাসনে থাকে তাহলে অবস্থা আরো অনেক দূর গড়াবে। ষড়যন্ত্র, হিংসা, নির্বাসন ও মৃত্যুদণ্ডের পথ ধরে ফরাসি সমাজ–আমি বলতে চাই সৎ ফরাসি সমাজ–চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তারপরে…।

ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে সে হাত দুটো বাড়িয়ে ধরল। কথাগুলি ভালো লাগায় পিয়ের কি যেন বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আন্না পাভলভনার নজর ছিল তার উপর; সে তাকে বাধা দিল।

রাজ-পরিবারের উল্লেখমাত্রেই তার গলায় যে বিষণ্ণতার সুর বেজে ওঠে সেই সুরে সে বলে উঠল, সম্রাট আলেক্সান্দার ঘোষণা করেছেন, ফরাসি জনগণ কোন ধরনের সরকার বেছে নেবে সেটা তিনি তাদের উপরেই ছেড়ে দেবেন; আর আমার বিশ্বাস, একবার সেই পরস্বাপহারীর হাত থেকে মুক্তি পেলে সমগ্র জাতি নিশ্চয় প্রকৃত রাজার কোলেই ফাঁপিয়ে পড়বে।

সেটা সন্দেহজনক, প্রিন্স আন্দ্রু বলল। মঁসিয় লা ভাইকোঁত যথার্থই ধরেছেন যে ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়েছে। আমি তো মনে করি, পুরনো শাসন-ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কঠিন হবে।

পিয়ের মুখ লাল করে আলোচনায় বাধা দিয়ে বলে উঠল, আমি যতদূর শুনেছি, প্রায় সব অভিজাত লোকরা ইতিমধ্যেই বোনাপার্তের দলে ভিড়ে পড়েছে।

পিয়েরের দিকে না তাকিয়েই ভাইকৌত বলল, বোনাপার্তের সমর্থকরাই একথা বলে। এই মুহূর্তে ফরাসি জনমতের প্রকৃত অবস্থা বোঝা শক্ত।

ব্যঙ্গের হাসি হেসে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, বোনাপার্তও তাই বলে।

ভাইকেতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলি না বললেও স্পষ্টই বোঝা যায় যে লোকটিকে সে পছন্দ করে না, আর তাকে লক্ষ্য করেই সে মন্তব্যটা করেছে।

কিছু সময় চুপ করে থেকে প্রিন্স আন্দ্রু নেপোলিয়নের কথারই উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে লাগল, আমি তাদের গৌরবের পথ দেখালাম, কিন্তু তারা সে পথে গেল না। আমি বৈঠকখানা খুলে দিলাম, তারা সেখানেই ভিড় করল। এ কথা বলবার হক তার ছিল কিনা আমি জানি না।

মোটেই ছিল না, ভাইকোঁত জবাব দিল। ডিউকের হত্যার পরে তার অতিবড় পক্ষপাতীও তাকে করে বীর বলে মনে করত না। যদি বা আগে সে কারো কারো কাছে বীর সেজেছিল, ডিউকের হত্যার পরে স্বর্গে বেড়ে গেছে একজন শহীদ, আর মর্তে কমে গেছে একজন বীর।

আন্না পাভলভনা ও অন্যরা একটু হেসে ভাইকেতের মন্তব্যকে প্রশংসা করবার আগেই পিয়ের আবার আলোচনায় বাধা দিল। আন্না পাভলভনা জানত যে সে কোনো অনুপযুক্ত কথাই বলবে, তবু তাকে থামাতে পারল না।

সঁসিয় পিয়ের জোর গলায় বলল, রাজনীতির বিচারে দুক দ এনঝিনের হত্যা ছিল একান্ত প্রয়োজন; আমার তো মনে হয়, সে কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিতে ভয় করে নেপোলিয়ন আত্মিক মহত্ত্বেরই পরিচয় দিয়েছে।

অনুচ্চ ভয়ার্ত স্বরে আন্না পাভলভনা বলে উঠল, ঈশ্বর! হে আমার ঈশ্বর!

হেসে সেলাইটাকে হাতের কাছে টেনে নিয়ে ছোট প্রিন্সেস বলল, সে সিয় পিয়ের…আপনি কি মনে করেন হত্যার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় আত্মিক মহত্ত্ব?

হায়! হায়! কয়েকজন সোচ্চারে বলল।

চমৎকার! প্রিন্স হিপোলিৎ ইংরেজিতে বলল; তারপর হাতের তালু দিয়ে হাঁটু বাজাতে লাগল।

ভাইকোঁত শুধুমাত্র ঘাড় ঝাঁকুনি দিল। পিয়ের চশমার উপর দিয়ে গম্ভীরভাবে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, আমি তাই বলছি, কারণ জনসাধারণকে অরাজকতার মধ্যে ফেলে রেখে বুরবনরা বিপ্লবের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল; একমাত্র নেপোলিয়নই বিপ্লবকে বুঝতে পেরেছিল, তাকে শান্ত করেছিল, আর তাই সকলের মঙ্গলের জন্য একটি মানুষের জীবন বাঁচাতে মাঝপথে থেমে যায় নি।

আপনি এবার অন্য টেবিলে চলুন না? আন্না পাভলভনা বলল।

তার কথায় কান না দিয়ে পিয়ের বক্তৃতা করেই চলল। অধিকতর আগ্রহের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, না। নেপোলিয়ন মহান, কারণ সে বিপ্লবের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল, তার দোষ-ত্রুটিগুলোকে বা দিতে পেরেছিল, বিপ্লবের যা কিছু ভালো-সকল নাগরিকের সাম্য, বাক্যের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা-সে সব রক্ষা করেছিল, আর শুধু সেই কারণেই ক্ষমতা তার হাতে এসেছিল।

হ্যাঁ, ক্ষমতা হাতে পেয়ে সেই সুযোগে হত্যা না করে সে যদি সেই ক্ষমতাকে প্রকৃত রাজার হাতে তুলে দিত, তাহলে তাকে আমি মহাপুরুষ বলতাম, ভাইকোঁত মন্তব্য করল।

তা সে করতে পারে না। সে যাতে জনসাধারণকে বুরবনদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে সেই জন্যই তারা তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল, কারণ তারা বুঝেছিল যে সে একজন মহান পুরুষ। বিপ্লব একটি মহান বস্তু!

কী? বিপ্লব আর রাজহত্যা মহৎ বস্তু?…আচ্ছা, তারপর…কিন্তু আপনি অন্য টেবিলে আসুন না? আন্না পাভলভনা আর একবার কথাটা বলল।

উপেক্ষার হাসি হেসে ভাইকোঁত বলল, রুশোর Contract Social.

রাজহত্যার কথা আমি বলছি না, বলছি ধারণার কথা।

হ্যা; ডাকাত, খুন, রাজহত্যার ধারণা, একটি ব্যঙ্গকঠিন কণ্ঠে কথাগুলি উচ্চারিত হল।

নিঃসন্দেহে সেগুলি চরম ব্যবস্থা, কিন্তু আসল কথা তো তা নয়। আসল কথা হল, মানুষের অধিকার, সংস্কার হতে মুক্তি, নাগরিক সাম্য, আর এসব ধারণাকেই নেপোলিয়ন পূর্ণ শক্তিতে রক্ষা করেছে।

ভাইকোঁত শেষপর্যন্ত স্থির করল, এই যুবকের কথাগুলি যে কত অর্থহীন সেটা তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে; তাই একান্ত উপেক্ষার সঙ্গে সে বলল, স্বাধীনতা ও সাম্য-এসব বড় বড় কথা অনেকদিন বাতিল হয়ে গেছে। স্বাধীনতা ও সাম্য কে না ভালোবাসে? আমাদের ত্রাণকর্তা পর্যন্ত স্বাধীনতা ও সাম্য প্রচার করে গেছেন। বিপ্লবের পরে মানুষ কি বেশি সুখী হয়েছে? ঠিক উল্টো আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীনতা, কিন্তু বোনাপার্ত তাকে ধ্বংস করেছে।

প্রিন্স আন্দ্রু স্মিত হাসির সঙ্গে পিয়ের থেকে ভাইকেতের দিকে এবং ভাইকোঁত থেকে গৃহকত্রীর দিকে তাকাতে লাগল। পিয়েরের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা শুনে প্রথমটা আন্না পাভলভনা ভয়ে আঁতকে উঠেছিল। কিন্তু যখন দেখল যে পিয়েরের অশালীন কথাবার্তা শুনে ভাইকোঁত মোটেই উত্তেজিত হয় নি এবং নিজেও ভালো করে বুঝতে পারল যে এ যুবকটিকে থামানো অসম্ভব, তখন সে সর্বশক্তি নিয়ে ভাইকেতের সঙ্গে যোগ দিয়ে। একসঙ্গে বক্তাটিকে কঠোরভাবে আক্রমণ করল।

বলল, কিন্তু প্রিয় সিয় পিয়ের, একজন মহাপুরুষ যে বিনা বিচারে একজন নিরপরাধ ডিউককে–কিংবা একজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করল, তার কি ব্যাখ্যা আপনি দেবেন?

ভাইকোঁত বলল, আমি কিন্তু জানতে চাই, ১৮তম মেয়ারের কি ব্যাখ্যা মঁসিয় দেবেন : সেটা কি প্রবঞ্চনা নয়? সে তো একটা জোচ্চুরি; মোটেই একজন মহাপুরুষের মতো আচরণ নয়!

আর আফ্রিকায় যে বন্দিদের সে খুন করেছে? সে তো ভয়াবহ! দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে ছোট প্রিন্সেস বলল। আপনি যাই বলুন, সে অতি হীন লোক, প্রিন্স হিপোলিৎ মন্তব্য করল।

কার কথার জবাব দেবে বুঝতে না পেরে পিয়ের সকলের দিকে তাকিয়েই হাসল। তার সে হাসি অন্য লোকের মতো আধখানা হাসি নয়। সে হাসলেই তার গম্ভীর মুখে সঙ্গে সঙ্গে ফুটে ওঠে এমন একটি শিশুর মতো বরং বলা যায় বোকা-বোকা-ভাব যে মনে হয় সে যেন ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে।

যুবকটির সঙ্গে ভাইকেতের এই প্রথম সাক্ষাৎ; সেও স্পষ্ট বুঝতে পারে যে এই তরুণ জ্যাকোবিনটি মুখে যত বড় বড় কথা বলে আসলে ততটা ভয়ের নয়। সকলেই চুপচাপ হয়ে গেল।

প্রিন্স আলু বলল, উনি একসঙ্গে আপনাদের সকলের কথার জবাব দেবেন, এটা আপনারা আশা করছেন। কেমন করে? তাছাড়া, একজন কূটনীতিকের কাজকর্ম প্রসঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে, সেনাপতি ও সম্রাট হিসেবে তার কাজের বিচার তো আলাদা আলাদা ভাবেই করতে হবে। আমার তো তাই মনে হয়।

নতুন করে একজনের সমর্থন পেয়ে খুশি হয়ে পিয়ের বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে যে আর্কোলার সেতুর উপরে এবং জাফার হাসপাতালে সে যখন প্লেগ-রোগীদের সেবায় হাত দিয়েছিল, তখন মানুষ হিসেবে নেপোলিয়ন অবশ্যই মহান; কিন্তু…আবার এমন সব কাজ আছে যাকে সমর্থন করা শক্ত।

পিয়েরের অপটু মন্তব্যের ধারটাকে একটু নরম করে দেওয়াই ছিল প্রিন্স আন্দ্রুর আসল উদ্দেশ্য। উঠে দাঁড়িয়ে সে স্ত্রীকে ইঙ্গিতে জানাল, যাবার সময় হয়ে গেছে।

হঠাৎ প্রিন্স হিপোলিৎ ইঙ্গিতে সকলের মনোযোগ আহ্বান করে সকলকে বসতে বলল; তারপর বলতে শুরু করল :

আজই একটি চমৎকার মস্কোর গল্প আমি শুনেছি, আর সেটা আপনাদের শোনাতে চাই। ক্ষমা করবেন ভাইকোঁত, গল্পটা আমি রুশ ভাষায় বলব, অন্যথায় তার মজাই নষ্ট হয়ে যাবে….। কোনো ফরাসি ভদ্রলোক বছরখানেক রাশিয়াতে বাস করবার পরে যে রকম রুশ ভাষা বলে ঠিক তেমনি ভাষায় প্রিন্স হিপোলিৎ গল্প বলতে শুরু করল। এমন আগ্রহে আর এত বেশি জোরের সঙ্গে সে সকলকে গল্পটা শুনতে বলল যে সকলেই গল্প শুনতে বসে রইল।

মস্কোতে এই মহিলা বাস করেন; তিনি খুব কৃপণ। তাঁর গাড়ির পিছনে দুজন সহিস থাকা চাই, বেশ বড় গোছের। সেটাই তার পছন্দ। তাঁর একটি পরিচারিকা ছিল, সেও বড়সড়। মহিলাটি বলল…

এখানে প্রিন্স হিপোলিৎ থামল; বেশ কষ্ট করে গল্পটাকে মনে মনে গুছিয়ে নিল।

মহিলাটি বলল…ও হ্যাঁ, বলল, দেখ মেয়ে, যখনই আমি কোথাও যাব তখনই ভালো করে তকমা এঁটে গাড়ির পিছনে চড়ে বসবে।

শ্রোতারা হাসবার আগেই এখানে প্রিন্স হিপোলিৎ নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল; তার ফলটা বক্তার পক্ষে মোটেই ভালো হল না। অবশ্য বয়স্কা মহিলা ও আন্না পাভলভনাসহ কয়েকজন হেসে উঠল।

মহিলাটি চলেছে। হঠাৎ জোর বাতাস উঠল। মেয়েটির টুপি উড়ে গেল, আর তার লম্বা চুল এলিয়ে পড়ল।…এখানে সে আর হাসি চাপতে পারল না। হাসির ফাঁকে ফাঁকেই কথা বলতে লাগল : আর সারা জগৎ জেনে ফেলল…।

এইভাবে গল্পটা শেষ হল। কেন যে সে গল্পটা বলল, আর কেনই বা রুশ ভাষাতে বলল, তা ঠিক বোঝা গেল না; তবু সে যে এইভাবে বুদ্ধি করে পিয়েরের অপ্রীতিকর ও অশোভন বক্তৃতাটাকে একটা সুন্দর পরিণতিতে টেনে আনতে পেরেছে সেজন্য আন্না পাভলভনা ও অন্য সকলে প্রিন্স হিপোলিৎতের প্রশংসাই করল। গল্পটার শেষে আলোচনা অন্য পথে মোড় নিল : আগেকার ও পরবর্তী বল-নাচ, থিয়েটার, কবে ও কোথায় কে কার সঙ্গে দেখা করবে–প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অতি সাধারণ ছোটখাট কথাবার্তা শুরু হল।

*

অধ্যায়-৬

মনোরম সান্ধ্য আসরের জন্য আন্না পাভলভনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিথিরা বিদায় নিতে শুরু করল।

পিয়ের কেমন যেন বেমানান। মজবুত গড়ন, উচ্চতা সাধারণ, চওড়া শরীর। বড় বড় লাল হাত। কিন্তু কেমন যেন; কথায় বলে, সে না জানে বৈঠকখানায় ঢুকতে, না জানে সেখান থেকে বের হতে; অর্থাৎ বিদায় নেবার আগে দুটো ভালো কথা কেমন করে বলতে হয় তাও জানে না। তার উপর, বে-খেয়াল। বিদায় নিতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের টুপির বদলে সে সেনাপতির তিন-কোণা টুপিটা তুলে নিল, এবং সেনাপতি চেয়ে না নেওয়া পর্যন্ত সেটা নিজের হাতেই রেখে দিল। অবশ্য তার এই খেয়ালের অভাব, ঘরে ঢুকবার বা কথা বলবার আদব-কায়দার অভাব–এ সবই ঢাকা পড়ে যায় তার সদয়, সরল ও বিনীত আচরণে। আন্না পাভলভনা তার দিকে এগিয়ে খৃস্টানসুলভ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বল : আশা করি আবার আপনার দেখা পাব; আরো আশা করি আপনার মতামতগুলো আপনি বদলাবেন প্রিয় মঁসিয় পিয়ের।

পিয়ের কোনো জবাব দিল না, শুধু মাথাটা নোয়াল; কিন্তু তার হাসিটি সকলেরই নজরে পড়ল; সে হাসিতে বুঝি এই কথাটিই শুধু প্রকাশ পেল, মতে কি আসে যায়, কিন্তু দেখুন তো আমি লোকটি কত সৎ স্বভাব। আর সকলেই, এমন কি আন্না পাভলভনাও সেটা অনুভব করল।

প্রিন্স আন্দ্রু তখন হল-ঘরে চলে গেছে; জোব্বাটা পরতে পরিচারক তাকে সাহায্য করছে; তার দিকে মুখ ফিরিয়ে সে নিরাসক্তভাবে প্রিন্স হিপোলিৎতের সঙ্গে তার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনতে লাগল। তারা দুজনেও হলঘরে চলে এসেছে। সুন্দরী, গর্ভিণী প্রিন্সেসের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রিন্স হিপোলিৎ চশমার ভিতর দিয়ে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আন্না পাভলভনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছোট প্রিন্সেস বলল, আপনি ভিতরে যান আনেৎ, আপনার  ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। তারপর বলল, তাহলে ঐ কথাই রইল।

আনাতোল ও ছোট প্রিন্সেসের ননদের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আন্না পাভলভনা ইতিমধ্যেই লিজার সঙ্গে কথা বলেছে।

নিচু গলায় আন্না পাভলভনা বলল, আপনার উপর আমার অনেক ভরসা। তাকে চিঠি লিখুন এবং এ ব্যাপারে তার বাবার মতামত আমাকে জানাবেন। বিদায়!–সে হল-ঘর থেকে চলে গেল।

প্রিন্স হিপোলিং ছোট প্রিন্সেসের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখটাকে তার খুব কাছে নিয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বলল।

উভয়ের পরিচারকই একটা শাল ও একটা জোব্বা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কতক্ষণে তাদের কথা শেষ হবে। ফরাসি ভাষার কথাগুলি তাদের কাছে অর্থহীন হলেও তারা এমনভাবে শুনতে লাগল যেন বুঝতে পারছে, অথচ সেটা তাদের জানতে দিতে চাইছে না। প্রিন্সেস যথারীতি কথা বলছে ঈষৎ হেসে আর কথা শুনে হাসছে হো হো করে।

প্রিন্স হিপোলিৎ বলল, রাষ্ট্রদূতের ওখানে না গিয়ে কী ভালোই যে করেছি, কী যে একঘেয়ে ব্যাপার। সন্ধ্যাটা বড়ই আনন্দে কাটল, তাই না? বড় ভালো!

ছোট ঠোঁটটি তুলে ধরে প্রিন্সেস বলল, সকলে বলছে বল-নাচটা খুব ভালো হবে। সমাজের সব সুন্দরীরা সেখানে হাজির হবে।

সকলে নয়। কারণ আপনি তো সেখানে থাকছেন না; সকলে নয়, সানন্দ হাসি হেসে প্রিন্স হিপোলিৎ বলল; তারপর পরিচালকের কাছ থেকে শালটা নিয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে শালটা প্রিন্সেসের গায়ে জড়িয়ে দিল। ইচ্ছা করেই কি না কে জানে, শালটা জড়িয়ে দেবার পরেও সে অনেকক্ষণ হাত দিয়ে ছোট প্রিন্সেসকে ঘিরে ধরে রাখল, যেন আলিঙ্গন করল।

প্রিন্সেস হাসতে হাসতে বেশ ভদ্রভাবে সেখানে থেকে সরে গেল, তার দৃষ্টি তখন স্বামীর উপর। প্রিন্স আর চোখ দুটি তখন বুজে এসেছে, তাকে ক্লান্ত ও ঘুমকাতর মনে হল।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তৈরি তো? প্রিন্স হিপোলিৎ তাড়াতাড়ি জোব্বাটা পরে নিল; আধুনিক ফ্যাশান অনুযায়ী সেটা তার গোড়ালি অবধি ঝুলে পড়ল; ফলে সেটাতে হোঁচট খেতে খেতে সে প্রিন্সেসের পিছন পিছন ফটক পর্যন্ত গেল। একটি পরিচারক তখন প্রিন্সেসকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছে।

প্রিন্সেস, বিদায়, তার পা এবং জিভ দুইই যেন হোঁচট খেল।

প্রিন্সেস পোশাক তুলে অন্ধকার গাড়িতে তার আসনে উঠে বসল। তার স্বামী তরবারিটা ঠিকমতো রাখতে ব্যস্ত। তাদের সাহায্য করতে গিয়ে প্রিন্স হিপোলিৎ দুজনেরই অসুবিধা ঘটাতে লাগল।

প্রিন্স হিপোলিৎ তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকায় প্রিন্স আন্দ্রু অসন্তুষ্ট গলায় রুক্ষ ভাষায় বলল, আমাকে করতে দিন স্যার পরে সেই একই লোক দ্র সাদর গলায় বলল, তোমাকে কিন্তু আশা করব পিয়ের।

ঘোড়া পা তুলল; গাড়ির চাকায় খটখট শব্দ উঠল। প্রিন্স হিপোলিৎ ফটকে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে, ভাইকেতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল; তাকে সে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে কথা দিয়েছে।

গাড়িতে হিপোলিৎতের পাশে বসে ভাইকোঁত বলল, দেখুন প্রিয় বন্ধু, আপনার এই ছোট প্রিন্সেসটি খুব ভালো, পুরোদস্তুর ফরাসি; সে তার আঙুলের ডগায় চুমো খেল। হিপোলিং হো-হো করে হেসে উঠল।

ভাইকোঁত বলল, আপনি কি জানেন, যতই ভালোমানুষেমি দেখান, আসলে আপনি সাংঘাতিক ছেলে। বেচারি স্বামী, সেই ছোট অফিসারটি এমন ভাব দেখায় যেন সে একজন রাজাগজা। তাকে দেখে আমার করুণা হয়।

হিপোলিৎ হাসতে হাসতে মুখে থুথু ছিটিয়ে বলল, আর আপনি বলছিলেন যে রুশ মহিলারা ফরাসিদের সমকক্ষ নয়? তাদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটা জানতে হয়!

অন্য সকলের আগে পৌঁছে পিয়ের স্বচ্ছন্দে প্রিন্স আর পড়ার ঘরে ঢুকে পড়ল এবং অভ্যাসমতো সঙ্গে সঙ্গে একটা সোফায় শুয়ে পড়ে প্রথম যে বইটা হাতে পড়ল (সিজারের কমেন্টারিস) সেটাই তুলে নিয়ে কনুইতে ভর দিয়ে মাঝখান থেকে পড়তে শুরু করল।

ছোট ছোট সাদা হাত দুখানি ঘষতে ঘষতে পড়ার ঘরে ঢুকে প্রিন্স আন্দ্রু বলল, মাদময়জেল শেরেরের সঙ্গে তুমি কি করেছ? তিনি তো এখনই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

পিয়ের গোটা শরীরটাকে মোড় ফেরাল; সোফাটা মচ মচ করে উঠল। আগ্রহে প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকিয়ে হেসে হাতটা নাড়ল।

মঠাধ্যক্ষটি লোক ভালো, কিন্তু বিষয়টিতে তিনি সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে জানেন না।…আমার মতে, শাশ্বত শান্তি সম্ভব, কিন্তু কীভাবে যে কথাটা বলব বুঝতে পারছি না…রাজনৈতিক শক্তি-সাম্যের দ্বারা নয়…

স্পষ্টতই এ ধরনের বিমূর্ত আলোচনায় প্রিন্স আন্দ্রু আগ্রহী নয়।

একটু চুপ করে থেকে সে প্রশ্ন করল, প্রিয় বন্ধু, মনের সব কথা কেউ সর্বত্র বলতে পারে না। আচ্ছা, শেষপর্যন্ত তুমি কি কোনো সিদ্ধান্তে এসেছ? তুমি কি হতে চাও, সৈনিক না কূটনীতিক?

পিয়ের উঠে পা ভেঙে সোফার উপর বসল।

আসলে আমি নিজেই এখনো জানি না। দুটোর কোনোটাই আমি পছন্দ করি না।

কিন্তু তোমাকে তো একটা সিন্ধান্ত নিতেই হবে! তোমার বাবা সেটাই আশা করেন।

পিয়েরের যখন দশ বছর বয়স তখন একজন মঠাধ্যক্ষকে গৃহশিক্ষক রূপে সঙ্গে নিয়ে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সে বিদেশেই ছিল। সে যখন মস্কো ফিরে এল তখন তার বাবা মঠাধ্যক্ষকে বিদায় দিয়ে ছেলেকে বলল, এবার পিটার্সবুর্গে চলে যাও, চারদিক দেখ, নিজের জীবিকা বেছে নাও। তুমি যা করবে তাতেই আমি রাজি। এই নাও প্রিন্স ভাসিলিকে লেখা চিঠি, আর এই নাও টাকা। তিন মাস ধরে পিয়ের জীবিকা খুঁজেই বেড়াচ্ছে, এখনো কিছুই স্থির করতে পারে নি। জীবিকা খুঁজে নেবার কথাই প্রিন্স আন্দ্রু বলছিল। পিয়ের কপাল ঘষতে লাগল।

যে মঠাধ্যক্ষটির সঙ্গে সন্ধ্যায় পরিচয় হয়েছিল তার কথা উল্লেখ করে সে বলল, কিন্তু তিনি তো অবশ্যই ভ্রাতৃসংঘের একজন পরোপকারী লোক।

প্রিন্স আন্দ্রু পুনরায় তাকে বাধা দিয়ে বলল, ওসব বাজে কথা রাখ। অশ্বারোহী রক্ষী বিভাগে গিয়েছিলে কি?

না, যাই নি; কিন্তু সেই কথাই আমি ভাবছি, আর তোমাকেও বলতে চাই। এখন যুদ্ধ হচ্ছে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে। এটা যদি মুক্তির যুদ্ধ হত তাহলে আমি সেটা বুঝতে পারতাম এবং সকলের আগে সেনাবাহিনীতে ঢুকতাম; কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াকে সাহায্য করা ঠিক কাজ নয়।

পিয়েরের ছেলেমানুষের মতো কথা শুনে প্রিন্স আন্দ্রু শুধু কাঁধ ঝাঁকুনি দিল। সে এমন ভাব দেখাল যেন এরকম অর্থহীন কথার কোনো জবাব দেওয়াই অসম্ভব। কিন্তু এই অতিসরল প্রশ্নের যে জবাব সে দিল তাছাড়া অন্য কোনো জবাব দেওয়া সত্যি খুব কঠিন।

সে বলল, নিজের বিশ্বাসের তাগিদ ছাড়া কেউ যদি যুদ্ধ না করত, তাহলে তো কোনো যুদ্ধই হত না।

আর সেটাই তো হত চমৎকার, পিয়ের বলল।

প্রিন্স আন্দ্রু ব্যঙ্গের হাসি হাসল।

হয়তো চমৎকারই হত, কিন্তু সেটা কোনোদিনই হবে না…।

আচ্ছা, তুমি যুদ্ধে যাচ্ছ কেন? পিয়ের প্রশ্ন করল।

কিসের জন্য? জানি না। আমাকে যেতে হবেই। তাছাড়া আমি যাবি… সে থামল। আমি যাচ্ছি কারণ এখানে আমি যে জীবন যাপন করছি সেটা আমার ভালো লাগছে না!

*

অধ্যায়-

পাশের ঘরে মেয়েদের পোশাকের খসখস শব্দ শোনা গেল। প্রিন্স আন্দ্রু ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো নড়েচড়ে উঠল। আন্না পাভলভনার বসবার ঘরে তার মুখে যে ভাব ছিল সেই ভাবটাই ফিরে এল । পিয়ের সোফার উপর থেকে পা নামাল। প্রিন্সেস ঘরে ঢুকল। সে গাউন ছেড়ে একটা নতুন সুন্দর আটপৌরে পোশাক পরেছে। প্রিন্স আন্দ্রু উঠে বিনীতভাবে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।

আরাম কেদারায় ভালোভাবে বসে সে যথারীতি ফরাসি ভাষায় বলল, আন্নেতের বিয়ে হয় নি কেন? তোমরা পুরুষরা এতই অপদার্থ যে তার বিয়েটাও দিতে পার নি! এ কথা বলার জন্য আমাকে ক্ষমা কর, কিন্তু সত্যি মেয়েদের সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণাই নেই। আপনি তো আচ্ছা তর্কপ্রিয় মানুষ মঁসিয় পিয়ের!

এখনো আপনার স্বামীর সঙ্গে আমি তর্ক করছিলাম। কেন যে সে যুদ্ধে যেতে চাইছে তা তো আমি বুঝতে পারি না। যুবতীদের সঙ্গে কথা বলার সময় সাধারণত যুবকরা যে রকম বিব্রত বোধ করে থাকে তার কোনোরকম ধার না ধেরে পিয়ের প্রিন্সেসকে কথাগুলি বলল।

এবার প্রিন্সেস শুরু করল। পিয়েরের কথাগুলি তার মনে খুব লেগেছে।

সে বলল, আঃ, ঠিক ওই কথাই তো আমিও তাকে বলি! আমিও বুঝতে পারি না। পুরুষ মানুষরা কেন যুদ্ধ ছাড়া থাকতে পারে না সেটা আমি মোটেই বুঝতে পারি না। আমাদের মেয়েদের তো ওসব দরকার হয় না। আপনিই আমাদের কথাগুলি বিচার করুন। আমি সব সময় ওকে বলি : এখানে সে তো খুড়ো এড-ডি কং, চমৎকার চাকরি। সকলে তাকে চেনে, সকলে কত প্রশংসা করে। এই তো সেদিন অপ্রাকসিনদের বাড়িতে একটি মহিলাকে বলতে শুনলাম : ইনিই কি বিখ্যাত প্রিন্স আন্দ্রু? সত্যি শুনেছি। সর্বত্রই তার কত সমাদার। সে তো অনায়াসেই সম্রাটের এড-ডি-কং হতে পারে। আপনারা তো জানেন, সম্রাট কত আদর করে তার সঙ্গে কথা বলেন। কেমন করে সে ব্যবস্থাটা করা যায় তা নিয়ে আনেৎ ও আমি কথাও বলেছি। আপনি কি মনে করেন?

পিয়ের বন্ধুর দিকে তাকাল। সে আলোচনাটা পছন্দ করছে না দেখে কোনো জবাব দিল না।

জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কবে রওনা হবেন?

ওঃ, তার যাবার কথা আর তুলবেন না, মোটেই তুলবেন না। সে কথা শুনতে আমি চাই না। আজ যখনই মনে পড়ছে যে এইসব মধুর মিলন ভেঙে দিতে হবে…আর তারপরে আপনারা তো জানেন আন্দ্রে…(অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সে স্বামীর দিকে তাকাল) আমার ভয় করছে, আমার ভয় করছে। ফিসফিস করে সে কথাগুলি বলল; দৃষ্টিতে সে স্বামীর দিকটা কাঁপুনি নেমে গেল আছে দেখে বিস্মিত

পিয়ের ও নিজে ছাড়া আরো একজন ঘরে আছে দেখে বিস্মিত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কঠিন অথচ বিনীত গলায় প্রিন্স তাকে বলল :

কিসে তোমার ভয় করছে লিজে? আমি তো বুঝতে পারছি না।

এই তো, পুরুষ মাত্রই কী স্বার্থপর : সব, সব্বাই স্বার্থপর! শুধুমাত্র খেয়ালের বশে সে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে, আমাকে একলা আটকে রেখে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে।

মনে রেখো, আমার বাবা ও বোনের কাছে, প্রিন্স আন্দ্রু শান্ত স্বরে বলল।

তবু তো একাই…বন্ধুবান্ধব ছাড়া…আর সে আশা করে যে আমি ভীত হব না।

তার গলার স্বর খুঁতখুঁতে; ঠোঁট ওল্টানো; কেমন কাঠবিড়ালীর মতো মুখের ভাব। সে থামল; বুঝতে পারল যে পিয়েরের সামনে নিজের গর্ভাবস্থার কথা বলাটা অশোভন হবে, যদিও সেটাই আসল কথা।

স্ত্রীর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই প্রিন্স আন্দু বলল, আমি এখনো বুঝতে পারছি না কিসে তোমার এত ভয়।

প্রিন্সেসের মুখ লাল হয়ে উঠল; হতাশার ভঙ্গিতে সে হাত দুটি তুলল।

না আন্দু, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে তুমি বদলে গেছে। ওঃ, তুমি কত…

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, ডাক্তার তোমাকে সকাল-সকাল শুতে বলেছে। তুমি বরং শুতে চলে যাও।

প্রিন্সেস কোনো কথা বলল না; হঠাৎ তার পাতলা লোমশ ঠোঁট দুটি কাঁপতে লাগল। প্রিন্স আন্দ্রু উঠে দাঁড়াল; কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

পিয়ের অবাক বিস্ময়ে কখনো এর দিকে কখনো ওর দিকে তাকাতে লাগল চশমার উপর দিয়ে। উঠতে গিয়েও মনের ইচ্ছাটা পাল্টে নিল।

মঁসিয় পিয়ের এখানে আছেন তো কি হয়েছে? ছোট প্রিন্সেস হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল; উচ্ছ্বসিত কান্নায় তার সুন্দর মুখখানি বিকৃত হয়ে গেল। অনেক দিন থেকেই তোমাকে বলতে চেয়েছি, আন্দ্রু কেন তুমি আমার প্রতি এতটা বদলে গেছ? আমি তোমার কি করেছি? তুমি যুদ্ধে চলে যাচ্ছ, আমার জন্য তোমার এতটুকু করুণা নেই। কেন? কেন?

লিজে! প্রিন্স আন্দ্রু শুধু এইটুকুই বলল। কিন্তু এই একটি শব্দেই প্রকাশ পেল অনুনয়, শাসানি, এবং এই দৃঢ় প্রত্যয় যে ছোট প্রিন্সেস যা বলেছে তার জন্য তার নিজেরই দুঃখিত হওয়া উচিত। সে কিন্তু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কর যেন আমি একজন পঙ্গু, একটা ছোেট শিশু। আমি সব বুঝতে পারি! ছমাস আগে কি তুমি এ রকম ব্যবহার করতে?

প্রিন্স আন্দ্রু এবার আরো জোরের সঙ্গে বলল, লিজে, আমার মিনতি, তুমি থাম।

এইসব কথাবার্তা শুনে পিয়ের ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। এবার সে প্রিন্সেসের কাছে এগিয়ে গেল। চোখের জল সে সইতে পারে না; মনে হল বুঝি সে নিজেই কেঁদে ফেলবে।

শান্ত হোন প্রিন্সেস! আপনার এ-কথা মনে হচ্ছে কারণ…আমি বলছি, এ অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও হয়েছে…আর তাই…কারণ…না, না, আমাকে ক্ষমা করুন। বাইরের কোনো লোক এখানে বেমানান…না, আপনি দুঃখ করবেন না।…বিদায়।

প্রিন্স আন্দ্রু তার হাতটা ধরে ফেলল।

দাঁড়াও পিয়ের! এটুকু দয়া প্রিন্সেসের মনে আছে যে আজকের সন্ধ্যাটা তোমার সঙ্গে কাটাবার সুখ থেকে সে আমাকে বঞ্চিত করবে না।

না, সে শুধু নিজের কথাটাই ভাবে, বলতে বলতে তীব্র ক্ষোভে প্রিন্সেসের চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।

লিজে! প্রিন্স আন্ডু শুকনো গলায় বলল, তার গলা এতদূর চড়েছে যাতে বোঝা যায় যে তার ধৈর্য ফুরিয়ে গেছে।

সহসা প্রিন্সেসের সুন্দর মুখের সেই ক্রুদ্ধ, কাঠবিড়ালী ধরনের ভাব পাল্টে গিয়ে সেকানে ফুটে উঠল একটা করুণ ভয়ের ভাব। সুন্দর চোখের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে স্বামীর দিকে তাকাল; কুকুর যখন লেজ গুটিয়ে অতি দ্রুত লেজটা নাড়তে থাকে তখন তার মুখে যে ভাব ফুটে ওঠে ঠিক সেই ভাব ফুটে উঠল প্রিন্সেসের মুখে।

আমার ঈশ্বর। আমার ঈশ্বর! বলতে বলতে এক হাতে পোশাকটা তুলে ধরে স্বামীর কাছে এগিয়ে গিয়ে সে তার কপালে চুমো খেল।

শুভ রাত্রি লিজে, বলে সে এমন ভদ্রভাবে স্ত্রীর হাতে চুমো খেল যেন কোনো অপরিচিতাকে চুমো খাচ্ছে।

*

অধ্যায়

দুই বন্ধু চুপচাপ। কেউ আগে কথা বলতে চাইছে না। পিয়ের বার বার প্রিন্স আন্দ্রুর দিকে তাকাচ্ছে; প্রিন্স আন্দ্রু ছোট হাতখানি দিয়ে কপাল ঘষছে।

দরজার দিকে যেতে যেতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, চলো, রাতের খাবারটা খেয়ে নিই।

নতুন করে সাজানো, রুচিসম্মত, বিলাসবহুল খাবার ঘরে তারা ঢুকল। টেবিল ভোয়ালে থেকে শুরু করে রুপোর, চিনেমাটির ও কাঁচের বাসনপত্র পর্যন্ত সবকিছুতেই নববিবাহিত দম্পতির গৃহস্থালির নতুনত্বের ছাপ। খাবার মাঝপথে প্রিন্স আন্দ্রু টেবিলের উপর কনুই রেখে তার উপর ঝুঁকে এমন একটা স্নায়বিক উত্তেজনাভরা দৃষ্টিতে তাকাল, যেটা পিয়ের আগে কখনো দেখেনি; তারপর সে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন কোনো একটা কথাকে অনেক দিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রেখে হঠাৎ বলবে বলে স্থির করে ফেলেছে।

কখনো বিয়ে করো না হে ভাই! এই আমার পরামর্শ : যতদিন পর্যন্ত না নিজেকে বলতে পারবে যে তোমার যা কিছু করবার সাধ্য আছে তা শেষ করেছ, যতদিন পর্যন্ত না তোমার মনের মতো নারীর প্রতি তোমার ভালোবাসার অবসান ঘটেছে এবং তাকে তার স্বরূপে দেখতে পেয়েছ, ততদিন পর্যন্ত কদাপি বিয়ে। করো না; করলে এমন ভুল করবে যা যেমন নির্মম তেমনই অসংশোধনীয়। যখন বুড়ো হবে, অকর্মণ্য হয়ে যাবে, তখন বিয়ে করো–অন্যথায় তোমার মধ্যে যা কিছু ভালো, যা কিছু মহৎ আছে সব নষ্ট হয়ে যাবে। অতি তুচ্ছ জিনিসের জন্য সবকিছু বৃথা হয়ে যাবে। হ্যাঁ, হা, হ্যাঁ। অমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিও না। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো প্রত্যাশা নিয়ে যদি বিয়ে কর তাহলে প্রতি পদক্ষেপে বুঝতে পারবে যে তোমার সব শেষ হয়ে গেছে, একমাত্র নির্বোধ চাটুকারপরিবেষ্টিত বসার ঘরে ছাড়া আর সব দরজা তোমার সামনে বন্ধ।…কিন্তু তাতে কী লাভ?… এই বলে সে হাতটা ঘোরাতে লাগল।

পিয়ের চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলল, তাতে তার মুখটা যেন অন্যরকম দেখতে হল, ভালোমানুষি ভাবটা যেন স্পষ্টতর হল। অবাক হয়ে সে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রিন্স আন্দ্রু বলতে লাগল, আমার স্ত্রী চমৎকার মহিলা, যে বিরল মহিলাদের হাতে পুরুষের মর্যাদা নিরাপদ থাকে সে তাদেরই অন্যতমা, কিন্তু তা ঈশ্বর, অবিবাহিত থাকবার জন্য আজ আমি কী না দিতে পারি! তুমিই প্রথম ও একমাত্র লোক যার কাছে এসব কথা বললাম, কারণ তোমাকে আমি পছন্দ করি।

যে বলকনস্কি আন্না পাভলভনার আরাম কেদারায় শুয়ে আধ-বোজা চোখে দাঁতের ফাঁক দিয়ে ফরাসি বকুনি আওড়াচ্ছিল, এই কথাগুলি বলার সময় প্রিন্স আন্দ্রু যেন আর সে লোক নেই। তার মুখের প্রতিটি পেশী এখন স্নায়বিক উত্তেজনায় কাঁপছে; যে চোখ থেকে জীবনের অগ্নিশিখা নিভে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল, সে চোখ এখন উজ্জ্বল আলোয় ঝলসে উঠেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সাধারণ অবস্থায় তাকে যত নিষ্প্রাণ মনে হয়, এই এসব অসুস্থ বিরক্তির মুহূর্তে সে তত বেশি আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

সে বলতে লাগল, কেন আমি এ কথা বলছি তা তুমি বুঝতে পারছ না, কিন্তু এটাই জীবনের সমগ্র কাহিনী। তুমি বোনাপার্ত ও তার জীবনের কথা বলেছ (যদিও পিয়ের বোনাপার্তের নাম উল্লেখ করেনি), কিন্তু বোনাপার্ত কার্যক্ষেত্রে ধাপে ধাপে তার লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হয়েছে। সে ছিল মুক্ত, স্বীয় লক্ষ্য ছাড়া আর কিছু তার ভাবার ছিল না; তাই সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিল। কিন্তু নিজেকে কোনো নারীর সঙ্গে বেঁধে ফেললেই শৃঙ্খলিত কয়েদির মতো তুমি সব স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলবে! আশা করবার, বল পাবার মতো যা কিছু তোমার আছে সবই তোমাকে টেনে নামাবে, অনুতাপে দগ্ধ করবে। বৈঠকখানা, গল্পগুজব, বলনাচ, অহংকার, তুচ্ছতা-এ সবকিছুর মায়াবী চক্রের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। আমি এখন যুদ্ধে যাচ্ছি, এক বিরাট যুদ্ধ, অথচ আমি কিছুই জানি না, কোনো কিছুরই যোগ্য নই। আমি খুব অমায়িক লোক, আমার বুদ্ধি শানিত, আন্না পাভলভনার বাড়িতে সকলে আমার কথা শোনে। আর সেই সব বোকা মানুষের দল যাদের ছাড়া আমার স্ত্রী বাঁচতে পারে না। আর সেই সব নারী…। ওইসব উঁচু মহলের স্ত্রীলোকরা যে কী, সব নারী সমাজই যে কী তা যদি জানতে। আমার বাবাই ঠিক জানেন। স্বার্থপর, অহংকারী, নির্বোধ, সব বিষয়ে অকিঞ্চিৎকর–সত্যস্বরূপে এই হল স্ত্রীজাতির পরিচয়! সমাজে যখন তাদের দেখ তখন মনে হয় তাদের মধ্যে কিছু পদার্থ আছে, কিন্তু কিছু নেই, কিছু নেই, কিছু নেই! না, প্রিয় বন্ধু, বিয়ে করো না; বিয়ে করো না! প্রিন্স আন্দ্রু কথা শেষ করল।

পিয়ের বলল, তুমি, তুমি নিজেকে অক্ষম ভাববে, তোমার জীবনকে ব্যর্থ মনে করবে-এটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। তোমার সামনে তো সব আছে, সবকিছু। আর তুমি…।

সে কথা শেষ করল না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা গেল বন্ধুর সম্পর্কে তার ধারণা কত উঁচু, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কত আশা সে পোষণ করে।

এ রকম কথা সে বলে কেমন করে? পিয়ের ভাবল। বন্ধুকে সে পূর্ণতার প্রতিমূর্তি বলে মনে করে, কারণ যে সব গুণ তার নিজের মধ্যে নেই, প্রিন্স আন্দ্রু পূর্ণমাত্রায় তার অধিকার; এই কথায় সে গুণাবলিকে বলা যায় ইচ্ছার দৃঢ়তা। সবকিছুকে শান্তভাবে বিচার করবার ক্ষমতা, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি; পড়াশুনার ব্যাপকতা (সে পড়েছে সবকিছু জেনেছে সবকিছু, ভেবেছে সবকিছু), আর সর্বোপরি কাজ করবার ও পড়ামুনা করবার ক্ষমতা–প্রিন্স আর এইসব ক্ষমতা দেখে পিয়ের সর্বদাই বিস্মিত হয়েছে। আন্দ্রু যে দার্শনিক তত্ত্বালোচনা ক্ষমতা রাখে না এটা দেখে বেশ অবাক হলেও পিয়ের সেটাকেও আন্দ্রুর ত্রুটি মনে না করে বরং তার ক্ষমতার লক্ষণ বলেই মনে করে।

জীবনের সব চাইতে ঘনিষ্ঠ, বন্ধুত্বপূর্ণ ও সরল সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রশংসা ও গুণকীর্তন অপরিহার্য, ঠিক যেমন গাড়ির চাকা ঠিকভাবে চলবার জন্য তৈলাক্ত জিনিস দরকার।

প্রিন্স আন্দ্রু বলল, আমার খেলা সাঙ্গ হয়েছে। আমার কথা বলে আর লাভ কী? এস, তোমার কথা বলা যাক, একটু চুপ করে থেকে সে হেসে বলল।

সঙ্গে সঙ্গে সে হাসি পিয়েরের মুখে প্রতিফলিত হল।

স্মিত হাসি হেসে পিয়ের বলল, আমার সম্পর্কেই বা বলবার কি আছে? আমি কে? এক অবৈধ সন্তান! হঠাৎ তার মুখখানা লাল হয়ে উঠল; পরিষ্কার বোঝা গেল অনেক চেষ্টা করে তবে সে এ কথাটা বলেছে। আমি তো নামহীন, উপায়হীন…আর সত্যি সত্যি… কিন্তু সত্যি সত্যি যে কি তা সে বলল । আপাতত আমি মুক্ত, আমি চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে।

প্রিন্স আন্দ্রু সদয় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল; সে দৃষ্টি বন্ধুত্বপূর্ণ, স্নেহসিক্ত, তবু তার ভিতর দিয়ে ফুটে উঠল তার শ্রেষ্ঠত্বের আভাস।

তোমাকে আমার ভালো লাগে, তার বিশেষ কারণ আমাদের সকলের মধ্যে একমাত্র তুমিই জীবন্ত মানুষ। হ্যাঁ, তুমিই সঠিক পথের মানুষ! তুমি যা ইচ্ছা বেছে নাও; সবই সমান। যে কোনো জায়গায় তুমি ঠিক খাপ খেয়ে যাবে। কিন্তু একটা কথা : এইসব কুরাগিনদের কাছে এস না, তাদের মতো জীবন যাপন করো না। এই ব্যভিচার, লাম্পট্য, এদের যা কিছু–এ সব তোমাকে মানায় না!

কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে পিয়ের বলল, তুমি কি চাও ভাই? নারী, বুঝেছ, নারী!

প্রিন্স আন্দ্রু জবাব দিল, আমি এ সব বুঝি না। যে সব নারীরা ঠিক পথে আছে, তাদের কথা আলাদা, কিন্তু এই কুরাগিনদের মতো নারী, সাকি ও সুরা, এদের আমি বুঝি না।

প্রিন্স ভাসিলি কুরাগিনদের সঙ্গেই পিয়ের বাস করে, তার ছেলে আনাতেলের ব্যভিচারী জীবনের সেও অংশীদার; প্রিন্স আন্দ্রুর বোনের সঙ্গে সেই ছেলের বিয়ে দিয়ে তার চরিত্র শোধরাবার মতলবই করা হয়েছে।

যেন হঠাৎ একটা সুখের কথা মনে পড়েছে এমনিভাবে পিয়ের বলে উঠল, তুমি কি জান? সত্যি বলছি, অনেক দিন ধরে আমি এই কথাটাই ভাবছিলাম।…এ ধরনের জীবন যাপন করি বলে আমি কোনোকিছু স্থির করতে পারি না, বা সঠিকভাবে ভাবতেও পারি না। মাথার যন্ত্রণা হয়, সব টাকা খরচ হয়ে যায়। আজ রাতে সে আমাকে যেতে বলেছিল, কিন্তু আমি যাব না।

আমাকে কথা দিলে যে যাব না?

কথা দিলাম!

*

অধ্যায়-৯

পিয়ের যখন বন্ধুর কাছ থেকে চলে গেল তখন একটা বেজে গেছে। উত্তরাঞ্চলের গ্রীষ্মকালের নির্মেঘ রাত। সোজা বাড়ি যাবার জন্য পিয়ের একটা ভোলা গাড়ি নিল। কিন্তু যত বাড়ির কাছে এগোতে লাগল ততই তার মনে হল যে এ রকম একটা রাত ঘুমিয়ে কাটানো অসম্ভব। যেটুকু আলো আছে তাতে জনহীন রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়; মনে হয় এ যেন রাত নয়, সকাল বা সন্ধ্যা। যেতে যেতে পিয়েরের মনে পড়ল, আজ । রাতেও আনাতোল কুরাগিন যথারীতি তাস নিয়ে অপেক্ষা করে আছে; তারপর বসবে সুরাপানের আসর; আর সব শেষে এমন জায়গায় যাওয়া হবে যেটা পিয়েরের খুব পছন্দ।

আমার তো কুরাগিনদের বাড়িই যাওয়া উচিত, সে ভাবল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, সেখানে যাবে না বলে প্রিন্স আন্দ্রুকে কথা দিয়েছে। তারপরই, দুর্বল চরিত্র লোকদের বেলায় যেমন ঘটে থাকে, যে ভ্রষ্টাচারী জীবনে সে অভ্যস্ত তার প্রতি আকর্ষণ এতই প্রবল হয়ে দেখা দিল যে সে সেখানে যাওয়াই স্থির করল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল যে প্রিন্স আন্দ্রুর কাছে কথা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না, কারণ প্রিন্স আনাতোলের জমায়েতে যাবে বলে সে আগেই তাকে কথা দিয়ে রেখেছে; তাছাড়া, এইসব কথা দেওয়া তো একটা মামুলি ব্যাপার, তার কোনো সঠিক অর্থ নেই; বিশেষ করে যখন ভাবা যায় যে কাল তো যে কোনো লোক মরেও যেতে পারে, অথবা এমন কিছু অঘটন ঘটতে পারে যাতে সম্মান-অসম্মান সবই সমান হয়ে দেখা দেবে। নিজের কোনো সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায়কে বাতিল করে দেবার সপক্ষে এই ধরনের যুক্তির আশ্রয় পিয়ের প্রায়ই নিয়ে থাকে। সে কুরাগিনদের বাড়ির পথে পা বাড়াল।

অশ্বারোহী রক্ষীবাহিনীর ব্যারাকের নিকটবর্তী মস্ত বড় যে বাড়িটায় আনাতোল থাকে সেখানে পৌঁছে পিয়ের আলোকিত ফটক দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি পেরিয়ে একটা খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল। সামনের ঘরে কেউ ছিল না; খালি বোতল, জোব্বা ও ওভার-৩ চারদিকে ছড়ালো; মদের গন্দ; দূরে নানা কণ্ঠস্বর ও চেঁচামেচি।

তাসের আড্ডা ও নৈশভোজন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু অতিথিরা তখনো বিদায় হয় নি। গায়ের জোব্বাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পিয়ের প্রথম ঘরটায় ঢুকল; সেখানে নৈশভোেজনের উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে। কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না ভেবে জনৈক পরিচারক গ্লাসে গ্লাসে যে তলানি পড়ে ছিল তাই গলায় ঢালছিল। তৃতীয় ঘর থেকে ভেসে আসছে হাসির অট্টরোল, পরিচিত গলার চিৎকার। একটা ভালুকের গর্জন, আর সাধারণ হৈ-চৈ। আট-নয়টি যুবক একটা খোলা জানালার কাছে ভিড় জমিয়েছে। অপর তিনজন একটা বাচ্চা ভালুককে শিকল ধরে টেনে অপর সকলের দিকে লেলিয়ে দিচ্ছে।

আমি একশ বাজি ধরছি স্টিভেন্সের উপর, একজন চেঁচিয়ে বলল।

মনে রেখ, কোনোকিছু ধরা চলবে না, আর একজন চেঁচিয়ে উঠল।

তৃতীয় জন বলল, আমি বাজি ধরছি দলোখভের উপর! কুরাগিন, তুমি আমাদের হাত ছাড়িয়ে দাও। রাশিয়ার নিয়ম-বাজি ধরলে দুজন করমর্দন করে, আর অপর একজন তাদের হাত ছাড়িয়ে দেয়।

এই যে, ব্রুইনকে ছেড়ে দাও, এদিকে বাজি চলছে।

এক চুমুকে শেষ করা চাই, নইলে তার হার, চতুর্থ জন হই-চই করে বলল।

জ্যাকব, একটা বোতল নিয়ে আয়, গৃহকর্তার গলা শোনা গেল; লোকটি লম্বা, সুদর্শন, দাঁড়িয়ে আছে দলের মাঝখানে; পরনে কোট নেই, পাতলা সুতির শার্টের বুক খোলা। একটু সবুর কর বাবা সকল।…পেতয়া এসেছে। এই যে ভালোমানুষ! পিয়েরকে দেখে সে চেঁচিয়ে বলল।

জানালার কাছ থেকে কথা বলল আর একজন। তার উচ্চতা মাঝারি, পরিষ্কার দুটি নীল চোখ; এইসব মাতাল কণ্ঠস্বরের মধ্যে তার গলার স্বরেই কিছুটা সুস্থতার আমেজ; সে বলল, এখানে এস; বাজির হাত খুলে দাও! এই হল দলোখভ; সেমেনভ রেজিমেন্টের অফিসার, বিখ্যাত জুয়াড়ি ও দ্বৈতযোদ্ধা, আনাতেলের সঙ্গেই থাকে। খুশির চোখে চারদিকে তাকিয়ে পিয়ের হাসল।

আমি তো বুঝতে পারছি না। এ সব কি হচ্ছে?

একটু সবুর কর, তোমার পেটে এখনো মাল পড়েনি। এখানে একটা বোতল চাই, বলে আনাতোল টেবিল থেকে একটা বোতল নিয়ে পিয়েরের কাছে গেল।

প্রথমেই তোমাকে এটা খেতে হবে!

যে সব মাতাল অতিথিরা জানালায় ভিড় করে আছে তাদের দিকে তাকিয়ে আর তাদের গল্প-গুজব শুনতে শুনতে পিয়ের গ্লাসের পর গ্লাস টানতে লাগল। আনাতোল পিয়েরের গ্লাস ভরে দিতে দিতে তাকে বুঝিয়ে বলল যে, নৌ-বিভাগের ইংরেজ অফিসার স্টিভেন্সের সঙ্গে বাজি ধরেছে দলোখভ : তিনতলার জানালার বাইরের টাকে বসে দুই পা ঝুলিয়ে দিয়ে সে এক বোতল রাম খাবে।

শেষবারের মতো গ্লাসে মদ ঢেলে দিয়ে আনাতোল পিয়েরকে বলল, চালিয়ে যাও; এর সবটা খেতে হবে, নইলে তোমাকে ছাড়ছি না!

না, আর খাব না, বলে আনাতোলকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পিয়ের জানালাটার কাছে গেল।

ইংরেজ ভদ্রলোকের হাত চেপে ধরে দলোখভ স্পষ্ট গলায় বাজির শর্তগুলো আওড়াচ্ছে; তার বিশেষ লক্ষ্য আনাতোল ও পিয়ের।

দলোখভের উচ্চতা মাঝারি, কোঁকড়া চুল, হাল্কা নীল চোখ। বয়স এককুড়ি পাঁচ। পদাতিক বাহিনীর অফিসারদের মতোই তারও গোঁফ নেই; ফলে তার সুন্দর মুখমণ্ডলের সবটাই চোখে পড়ছে। মুখের সুগঠিত রেখাগুলি স্পষ্টভাবে আঁকা; উপরের ঠোঁটটা নিচের ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে; ঠোঁটের কোণে একটা হাসি সবসময়ই খেলে বেড়াচ্ছে; তার সঙ্গে মিলেছে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ; ফলে তার উপর কারো নজর না পড়েই পারে না। দলোখভের আর্থিক সামর্থ্য সামান্য, বড় বড় আত্মীয়স্বজনও নেই। তবু আনাতোল হাজার হাজার রুবল খরচ করলেও দলোখভ তার সঙ্গেই থাকে, আর এমনভাবে চলে যে তার পরিচিত সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে; আনাতোলের চাইতেও বেশি শ্রদ্ধা করে। দলোখভ সব রকম খেলা জানে, এবং প্রায় সব সময়ই খেলায় জেতে। যতই মদ খাক, তার মাথা কখনো ঘুরে যায় না। পিটার্সবুর্গের তৎকালীন লম্পট ও দুশ্চরিত্র লোকদের মধ্যে কুরাগিন ও দলোখভ দুজনই নামকরা।

রামের বোতলটা আনা হল। জানালার ফ্রেমটার জন্য বাইরের গোবরাটে বসা যায় না বলে দুজন পরিচারক ফ্রেমটা খুলে ফেলছে। ভদ্রলোকরা হৈ চৈ করে তাদের নানা রকম নির্দেশাদি দিচ্ছে।

আনাতোল হেলতে দুলতে জানালার কাছে গেল। পরিচারক দুজনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফ্রেমটাকে ধরে টানতে লাগল, কিন্তু নড়াতে পারল না। কাঁচটা ভেঙে গেল।

পিয়েরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ তো হার্কিউলিস।

পিয়ের এড়োর কাঠটা ধরে টান দিল, আর ওক কাঠের ফ্রেমটা সশব্দে খুলে বেরিয়ে এল।

ওটাকে একেবারে সরিয়ে দাও, নইলে সকলে ভাববে আমি ওটা ধরে আছি, দলোখভ বলল।

ইংরেজ ভদ্রলোকের খুব দর্প… না? ঠিক আছে তো? আনাতোল বলল।

রামের বোতলটা হাতে নিয়ে দলোখভ জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে আকাশের আলো চোখে পড়ছে; সে আলোয় উষার সঙ্গে সূর্যাস্তের আভা মিশে গেছে।

রামের বোতলটা হাতে দিয়ে দলোখভ একলাফে জানালার গোবরাটে চলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরকার লোকদের ডেকে বলল, আপনারা শুনুন! সকলে চুপচাপ শুনতে লাগল।

আমি পঞ্চাশ ইম্পিরিয়াল (১ ইম্পিরিয়াল=১০ রুবল) বাজি রাখছি-ইংরেজ ভদ্রলোক যাদে বুঝতে পারে সেজন্য সে ফরাসিতেই কথাগুলি বলল, যদিও ফরাসি সে ভালো বলতে পারে না। ইংরেজ ভদ্রলোককে সম্বোধন করে আরো বলল, আমি পঞ্চাশ ইম্পিরিয়াল বাজি রাখছি…আপনি কি চান সেটা একশ রাখা হোক?

না, পঞ্চাশ, সে জবাব দিল।

ঠিক আছে। পঞ্চাশ ইম্পিরিয়াল… জানালার বাইরে এই জায়গায় বসে মুখ থেকে না সরিয়ে পুরো এক বোতল রাম আমি খেয়ে শেষ করব (নিচু হয়ে সে জানালার বাইরের ঢালু গোবরাটটা দেখাল) আর সে-সময় কোনো কিছু ধরে থাকব না। ঠিক আছে?

ঠিক আছে, ইংরেজটি বলল।

আনাতোল ইংরেজটির দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তার কোটের একটা বোতাম ধরে ঝুঁকে পড়ে-ইংরেজটি খর্বকায় মানুষ-ইংরেজিতে বাজির শর্তগুলি আর একবার বলতে লাগল।

একটু সবুর কর! সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য বোতলটা দিয়ে গোবরাটের উপর আঘাত করে দলোখভ বলল। একটু সবুর কর কুরাগিন। আপনারা শুনুন! আর কেউ যদি এ কাজটা করতে পারে তাকে আমি একশ ইম্পিরিয়াল দেব। বুঝলেন?

ইংরেজটি ঘাড় নাড়ল, কিন্তু সে এই বাজি গ্রহণ করতে রাজি কি না তা বোঝা গেল না। আনাতোল তাকে ছাড়ল না; যদিও সে যে কথাগুলি বুঝতে পেরেছে সেটা বোঝাবার জন্য সে ঘাড় নাড়তে লাগল, তবু আনাতোল দলোখভের কথাগুলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাতে লাগল। রক্ষীবাহিনীর হুজার একটি সরুমতো ছোকরা জানালার গোবরাটে উঠে ঝুঁকে পড়ে নিচের দিকে তাকাল।

জানালা থেকে রাস্তার পাথরগুলো দেখতে পেয়ে সে বলে উঠল, ওঃ! ওঃ! ওঃ!

তাকে জানালা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দলোখভ চেঁচিয়ে বলল, চুপ কর! ছোকরা থতমতো খেয়ে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে নেমে পড়ল।

সহজেই হাতে পাওয়া যায় গোবরাটের উপর এমন জায়গায় বোতলটা রেখে দলোখভ সাবধানে ধীরে ধীরে জানালা বেয়ে উঠে পা ঝুলিয়ে বসল। জানালার দুই দিকে চাপ রেখে সে নিজের আসনে ঠিক হয়ে বসল, হাত দুটি নামিয়ে নিয়ে একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে একটু সরে বসে বোতলটা হাতে নিল। তখন বেশ আলো ফুটেছে, তবু আনাতোল দুটো মোমবাতি এনে গোবরাটের উপরে রাখল। দলোখভের সাদা শার্টপরা পিঠ ও কোঁকড়া চুলে ভর্তি মাথাটার দুদিকে আলো পড়ল। সকলেই জানালার কাছে গিয়ে ভিড় করল; ইংরেজটি সকলের আগে। পিয়ের চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল। উপস্থিত সকলের চাইতে একটু বয়স্ক একটি লোক হঠাৎ ভীত ও ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে গেল এবং দলোখভের শার্টটা চেপে ধরতে চেষ্টা করল।

আমি বলছি, এটা বোকামি! ও তো মরে যাবে, অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান লোকটি বলল।

আনাতোল তাকে থামিয়ে দিল।

ওকে ছোঁবেন না! আপনি ওকে হকচকিয়ে দেবেন, আর তাহলেই ও মারা পড়বে। অ্যাঁ?… তারপর?… অ্যাঁ?

দলোখভ মুখটা ফেরাল, দুই হাতে ধরে নিজের জায়গায় ঠিকমতো বসল।

চাপা পাতলা ঠোঁট দুটির ভিতর দিয়ে কেটে-কেটে বলল, আবার যদি কেউ এসে গোলমাল করে তো তাকে আমি নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেব এবার তাহলে!

এই কথা বলে সে আবার মুখটা ঘোরাল, দুই হাত নামিয়ে বোতলটা তুলে ঠোঁটে লাগাল, মাথাটা পিছনে ঠেলে দিল এবং হাত দুটো তুলে তাল সামলাতে লাগল। একজন পরিচারক ভাঙা কাঁচ কুড়োচ্ছিল; সে আর জানালা থেকে এবং দলোখভের পিঠের দিক থেকে চোখ সরাতে পারল না; সেই অবস্থায়ই তাকিয়ে রইল। আনাতোল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে রইল। ইংরেজটি বাঁকা চোখে তাকিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। যে লোকটি একাজে বাধা দিতে চেয়েছিল সে ঘরের এক কোণে ছুটে গিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে একটা সোফায় বলে পড়ল। পিয়ের দুই হাতে মুখ ঢাকল; এতক্ষণ তার মুখে একটা ক্ষীণ হাসি লেগেছিল; এবার সেখানে ফুটে উঠল ভয় ও আতংক। সকলেই স্তব্ধ। পিয়ের চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল; দলোখভ তখনো একই অবস্থায় বসে আছে; শুধু তার মাথাটা আরো পিছনে সরে আসায় কোঁকড়া চুলগুলি শার্টের কলার ছুঁয়েছে; যে হাতে বোতলটা ধরেছে সেটা ক্রমেই আরো উঁচুতে উঠেছে আর থথর করে কাঁপছে। বোতলটা ক্রমেই খালি হয়ে আসছে, ক্রমেই আরো উঁচুতে উঠছে, আর মাথাটা ক্রমেই পিছনে হেলে পড়ছে। এতক্ষণ লাগছে কেন? পিয়ের ভাবল। তার মনে হল যেন আধ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। হঠাৎ দলোখভের শিরদাঁড়াটা পিছনদিকে সরে এল, তার হাতটা থথ করে কাঁপতে লাগল; তার ফলে জানালার ঢালু গোবরাট থেকে তার পুরো শরীরটা বসা অবস্থায়ই পিছলে গেল। যত সে পিছলে নেমে যেতে লাগল ততই তার মাথা ও হাত দুলতে লাগল। একটা হাত যেন দুলে উঠে গোবরাটটাকে চেপে ধরতে গেল, কিন্তু সেটাকে ছুঁল না। পিয়ের আবার চোখ ঢাকল; মনে হল, সে চোখ আর কখনো সে খুলবে না। হঠাৎ তার মনে হল, চারদিকে একটা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ছে। চোখ মেলে তাকাল : জানালার গোবরাটে দলোখ দাঁড়িয়ে আছে; তার ম্লানমুখে হাসির ছটা।

বোতল খালি!

ইংরেজটিকে লক্ষ্য করে সে বোতলটা ছুঁড়ে দিল; সেও ভালোভাবে সেটাকে ধরে নিল। দলোখভ লাফ দিয়ে নিচে নামল। গায়ে রামের তীব্র গন্ধ।

বেড়ে করেছ! আচ্ছা ছেলে!… বাজিমাৎ করে দিয়েছ!… তোমার উপর শয়তান ভর করুক! চারদিক থেকে নানা মন্তব্য ভেসে এল।

ইংরেজটি থলে বের করে টাকা গুনতে লাগল। দলোখভ ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না। পিয়ের লাফ দিয়ে জানালার গোবরাটে উঠল।

ভদ্রজনরা, আমার সঙ্গে কে বাজি ধরবেন? এ কাজ আমিও করব! হঠাৎ সে চেঁচিয়ে বলে উঠল। কেউ বাজি না ধরলেও করব! দেখুন! একটা বোতল আনতে বলুন। আমিও খেলা দেখাব। একটা বোতল এনে দিন!

ওকে খেলা দেখাতে দিন, ওকে খেলা দেখাতে দিন, ওকে খেলা দেখাতে দিন, দলোখভ হেসে বলল।

আর তারপরে? আপনি কি পাগল হয়েছেন?…কেউ আপনার সঙ্গে বাজি ধরবে না!…আরে, আপনার তো সিঁড়িতে চলতেই মাতা ঘোড়ে, বেশ কিছু লোক চেঁচিয়ে বলতে লাগল।

স্থিরসংকল্পে মাতালের মতো টেবিলে একটা থাপ্পড় মেরে পিয়েরও চেঁচিয়ে বলল, আমিও খাব! এক বোতল রাম চাই! সে জানালা বেয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুত হল।

সকলে তার হাত চেপে ধরল, কিন্তু তার এতই শক্তি যে তার গায়ে যে হাত দিল তাকেই সে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

আনাতোল বলল, না, এভাবে ওর সঙ্গে পারবেন না। একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।… শোন! কাল আমি তোমার সঙ্গে বাজি ধরব, কিন্তু এখন আমরা সকলে যাব-এর বাড়ি।

বেশ, তাই চল, পিয়ের চেঁচিয়ে বলল। তাই চল!…আর ব্রুইন-কে সঙ্গে নিয়ে চল।

ভালুকটাকে ধরে দুই হাতে তুলে সে সারা ঘরে নাচতে শুরু করল।

*

অধ্যায় ১০

আন্না পাভলভনার নৈশভোজের দিন প্রিন্সেস দ্রবেস্কায়া তার একমাত্র ছেলে বরিসের জন্য অনুরোধ জানালে প্রিন্স ভাসিলি তাকে যে কথা দিয়েছিল সে-কথা সে রেখেছে। ব্যতিক্রম হিসেবেই ব্যাপারটা সম্রাটের গোচরে আনা হয়েছিল। এবং কর্নেলের পদমর্যাদাসহ বরিসকে সেমেনভ রক্ষীবাহিনীতে বদলি করা হয়েছে। তবে আন্না মিখায়লভনার সব চেষ্টা ও অনুরোধ সত্ত্বেও সে কুতুজভের অধীনে চাকরি পায়নি। আন্না পাভলভনার বাড়ির আসরের কিছু পরেই আন্না মিখায়লভনা মস্কোতে ফিরে সোজা চলে এসেছে তার ধনী আত্মীয় রস্তভদের বাড়ি। শহরে এলে সে এই বাড়িতেই থাকে এবং তার আদরের বরিসও ছেলেবেলা থেকে এখানেই লেখাপড়া শিখেছে এবং বছরের পর বছর থেকেছে। রক্ষীবাহিনী ১০ আগস্ট তারিখে পিটার্সবুর্গ ছেড়ে চলে গেছে; তার ছেলেটি সাজপোশাকের জন্য এখনো মস্কোতেই আছে; সীমান্ত শহর বাদজিভিলভে সে তার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে।

সে দিনটি সেন্ট নাতালিয়া দিবস। আবার রস্ত পরিবারের মা ও কনিষ্ঠা কন্যা দুজনেরই নামকরণ দিবসও বটে; দুজনেরই নাম নাতালি। সকাল থেকেই ছয়-ঘোড়ার গাড়ির অবিরাম আসা-যাওয়া চলেছে। পোভাস্কায়াতে অবস্থিত ও মস্কোতে সুপরিচিত কাউন্টেস রস্তভের বড় বাড়িটাতে অতিথির ভিড় জমে চলেছে। যে-সব অতিথি একের পর এক পালা করে এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে তাদের অভ্যর্থনা করবার জন্য কাউন্টেস স্বয়ং ও তার সুন্দরী বড় মেয়ে বসার ঘরেই অপেক্ষা করছে।

কাউন্টেসের বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, পাতলা প্রাচ্যদেশীয় মুখ, সন্তানধারণের জন্য ভগ্নস্বাস্থ্য–তার সন্তানসংখ্যা বারো। দুর্বলতার দরুন তার চলনে ও কথা বলার ধরনে এমন একটা অবসাদ ফুটে উঠে যার ফলে তার প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব স্বভাবতই সকলের মধ্যে জেগে ওঠে। এই পরিবারেরই একজন হিসেবে প্রিন্সেস আন্না মিখায়লভনা বেঙ্কায়াও বসার ঘরে হাজির থেকে অতিথিদের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নের কাজে সাহায্য করছে। ছোট ছেলেমেয়েরা রয়েছে ভিতরের ঘরে; অতিথি-আপ্যায়নের কাজে তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। কাউন্ট নিজে অতিথিদের সঙ্গে দেখা করে সকলকেই ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় করছে।

প্রিয় বন্ধু বা প্রিয় বান্ধবী, আপনার কাছে আমি খুব, খুব কৃতজ্ঞ-অতিথিরা পদমর্যাদায় তার ছোট হোক কি বড় হোক, কোনোরকম ব্যতিক্রম না করে সকলকেই সে প্রিয় বলে সম্বোধন করছে-আমার নিজের পক্ষ থেকে এবং আমার যে দুটি প্রিয়জনের নামকরণ-দিবস আমরা পালন করছি তাদের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন, ডিনারে আসা চাই, নইলে আমি অসন্তুষ্ট হব, প্রিয় বান্ধবী! গোটা পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে আসতে বলছি, প্রিয় বন্ধু! এই একই কথা সে প্রত্যেককে বলছে, কারো বেলায় কোনো রকম হেরফের হচ্ছে না; তার পরিষ্কার কামানো হাসিমাখা মুখে একই ভাব, হাতের একই সুদৃঢ় চাপ, আর একই ভাবে বার বার মাথা নোয়ানো। কোনো অতিথিকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসেই বসবার ঘরে অপেক্ষমান অতিথিদের একজনের কাছে এসে তার দিকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসছে, পা দুটোকে ছড়িয়ে হাঁটুর উপর এমনভাবে হাত রাখছে যাতে বোঝানো যায় যে জীবনকে সে ভোগ করছে এবং কেমন করে বাঁচতে হয় তা সে জানে; তারপর মর্যাদার সঙ্গে শরীরটাকে সামনে-পিছনে একটু দোলাচ্ছে, আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করছে, অথবা স্বাস্থ্য সম্পর্কে দু-একটা কথা বলছে, কখনো রুশ ভাষায়, আবার কখনো বা অত্যন্ত খারাপ অথচ আত্মবিশ্বাসে ভরা ফরাসি ভাষায়, তারপর আবার ক্লান্ত অথচ কর্তব্যপালনে। দৃঢ়চিত্ত মানুষের মতো আর একজন অতিথিকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়াচ্ছে এবং টাক মাথার উপর যৎসামান্য পাকা চুল চাপড়ে বসাতে বসাতে তাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কখনো বা সামনের ঘর থেকে ফিরবার পথে ভঁড়ার ঘর ও রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে শ্বেত পাথরের মস্ত বড় খাবার ঘরে ঢুকছে; সেখানে আমি জন অতিথির জন্য টেবিল পাতা হচ্ছে; পরিচারকরা রুপোর ও চীনেমাটির বাসনপত্র আনছে, টেবিল সরাচ্ছে, দামাস্কাসের টেবিল-ঢাকনা বিছিয়ে দিচ্ছে। সেইসব দেখতে দেখতে সে দিমিত্রি ভাসিলোভিচকে ডেকে পাঠাচ্ছে; লোকটি সদ্বংশজাত এবং তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তির ম্যানেজার। খুশিমনে প্রকাণ্ড টেবিলটার দিকে তাকিয়ে বলছে : দেখ দিমিত্রি, যেমন-যেমন হওয়া উচিত সবকিছু যেন ঠিক তেমনটি হয়। ঠিক আছে! আসল কথাই তো পরিবেশন, তাই বটে। তারপর খুশির নিঃশ্বাস ফেলে সে বসবার ঘরে ফিরে আসছে।

কাউন্টেসের বিশালবপু পরিচারক বসবার ঘরে ঢুকে গম্ভীর গলায় হাঁক দিল, মরিয়া লভভনা কারাপিনা ও তাঁর কন্যা! কাউন্টেস এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর স্বামীর প্রতিকৃতি আঁকা সোনার নস্যদানি থেকে এক টিপ নস্য নিল।

অতিথির জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলাম। যাই হোক, শুধু এই মহিলার সঙ্গেই দেখা করব, আর নয়। মহিলাটি এত ভণিতা জানেন। তাঁকে ভিতরে আসতে বল, এমন বিষণ্ণ সুরে পরিচারককে হুকুম করল যেন বলতে চাইল : খুব ভালো কথা, আমাকে শেষ করে ফেল।

একটি লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ, গর্বিত-মুখ স্ত্রীলোক একটি গোলমুখ হাস্যময়ী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পোশাকের খসখস শব্দ তুলে বসবার ঘরে প্রবেশ করল।

প্রিয় কাউন্টেস, কী যুগ পড়েছে…বেচারি মেয়েটা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে…রাজুমভস্কিদের বল নাচে…আর কাউন্টেস এপ্রাক্সিনা…আমি তো খুব খুশি…, পোশাকের খসখস আর চেয়ার টানার ঘসঘস শব্দের সঙ্গে গলা মিশিয়ে এবং পরস্পরের গলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা নারীকণ্ঠের উচ্ছ্বসিত শব্দ ভেসে আসতে লাগল। তারপর শুরু হয় সেইসব আলোচনা যা ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ না অতিথিরা। পোশাক খসখসিয়ে উঠে বলতে থাকে, আমি খুব খুশি হয়েছি…মামণির স্বাস্থ্য…আর কাউন্টেস এপ্রাক্সিনা…; তারপর আবার সেই খসখসানি, সামনের ঘরে গমন, জোব্বা অথবা আলখাল্লা পরিধান এবং প্রস্থান। আলোচনার বিষয়বস্তু সেদিনকার প্রধান ঘটনা : ক্যাথারিনের ধনবান ও খ্যাতিমান প্রেমিক কাউন্ট বেজুকভের অসুস্থতা এবং তার অবৈধ সন্তান পিয়ের যে নাকি আন্না পাভলভনার ভোজের আসরে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছে।

অতিথি বলল, বেচারি কাউন্টের জন্য আমার দুঃখ হয়। একে তার স্বাস্থ্য খারাপ, তার উপর ছেলেকে নিয়ে এই বিরক্তিই তাকে মেরে ফেলবে!

কাউন্টেস যদিও এর আগেই পনেরো বারের মতো কাউন্ট বেজুকভের দুঃখের কথা শুনেছে তবু সে যেন কিছুই জানে না এমনি বাব দেখিয়ে বলে উঠল, সে আবার কি?

অতিথি সোচ্চারে বলল, আধুনিক শিক্ষার এই তো ফল। মনে হয়, কাউন্ট যখন বিদেশে ছিলেন তখন এই ছেলেটি যেমন খুশি চলাফেরা করত, এখন তো পিটার্সবুর্গে শুনলাম সে এমন সব ভয়ংকর কাণ্ডকারখানা করে চলেছে যে পুলিশ তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

এমন কথা বলবেন না! কাউন্টেস বলল।

আন্না মিখায়লভনা গলা মেলাল, যত সব কুসঙ্গী জুটিয়েছে। প্রিন্স ভাসিলির ছেলে, সে আর কে এক দলোখভ মিলে কী যে কাণ্ডকারখানা করে বেড়াচ্ছে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আর সেজন্য তাদের কষ্টও ভোগ করতে হয়েছে। দলোখভের পদাবনতি ঘটেছে, আর বেজুকভের ছেলেকে মস্কোতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে। আনাতোল কুরাগিনের বাবা কোনোরকমে ছেলের ব্যাপার-স্যাপার চাপা দিলেও তাকেও পিটার্সবুর্গ ছেড়ে যাবার হুকুম দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তারা করেছেটা কি? কাউন্টেস শুধাল।

অতিথি জবাব দিল, তারা তো সব রীতিমতো গুণ্ডা, বিশেষ করে দলোখভ। সে তো মারিয়া আইভানভনা দলোখভার ছেলে। মহিলা ভালোমানুষ, আর তার কপালে এই। তাই ভাবুন। ঐ তিনজন মিলে কোথা থেকে একটা ভালুক যোগাড় করেছে, আর সেটাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে! পুলিশ বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিন ছোকরা কি করল? পুলিশ ও ভালুকটাকে পিঠে-পিঠ দিয়ে বেঁধে ফেলে দিল ময়লা খালের জলে। আর ভালুকটা সেই পুলিশকে পিঠে নিয়ে সাঁতরাতে লাগল!

হাসতে হাসতে খুন হয়ে কাউন্ট বলে উঠল, আহা, পুলিশটার অবস্থা না জানি কী মধুরই হয়েছিল!

ওঃ, কী ভয়ংকর! একথা শুনে আপনি হাসতে পারছেন কাউন্ট?

অথচ মহিলারা নিজেরাও হাসি সংবরণ করতে পারল না।

অতিথি বলতে লাগল, শেষপর্যন্ত অবশ্য তারা সে বেচারিকে উদ্ধার করেছিল। আর ভেবে দেখুন, সিরিল ব্লাদিমিরভিচ বেজুকভের ছেলে হয়ে সে এমনভাবে মজা করতে পারে! অথচ সকলে বলে সে সুশিক্ষিত ও চতুর। বিদেশী শিক্ষা তো তাকে এই তৈরি করেছে! আশা করি, যতই টাকাপয়সা থাকুক মস্কোতে কেউ তাকে অভ্যর্থনা জানাবে না। আমার সঙ্গে তার পরিচয় করাতে তারা চেয়েছিল, কিন্তু আমি সোজা ফিরিয়ে দিয়েছি; নিজের মেয়ের কথা তো আমাকে ভাবতে হবে।

এ কথার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা অমনোযোগের ভান করল। তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কাউন্টেস বলল, এই যুবককে আপনি এত ধনী বলছেন কেন? তার ছেলেরা তো সকলেই অবৈধ। আমার তো মনে হয় পিয়েরও অবৈধ সন্তান।

অতিথি হাত নেড়ে একটা ভঙ্গি করে দেখাল।

আমার তো ধারণা এ রকম সন্তান তার এককুড়ি আছে।

প্রিন্সেস মিখায়লভনা এবার আলোচনায় যোগ দিল; সে যে উঁচু মহেলের মানুষ, আর সমাজে কি চলছে তা যে তার ভালোই জানা আছে সেটাই সে বোঝাতে চায়।

অর্থপূর্ণভাবে ফিসফিস করে সে বলল, আসল ব্যাপার হল কাউন্ট সিরিলের সুখ্যাতি সকলেরই জানা।…ছেলেমেয়েদের অনেককে তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু এই পিয়ের তার খুব প্রিয় ছিল।

কাউন্টেস বলল, মাত্র এক বছর আগেও এই বুড়ো মানুষটি কী সুন্দরই না ছিলেন! তার চাইতে সুন্দর পুরুষ মানুষ আমি আর দেখি নি।

আন্না মিখায়লভনা বলল, এখন তিনি অনেক বদলে গেছেন। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, তাঁর স্ত্রীর দিক থেকে প্রিন্স ভাসিলিই তার উত্তরাধিকারী; কিন্তু কাউন্ট পিয়েরকে খুব ভালোবাসেন, তার লেখাপড়ার উপর নজর রাখেন, এমন কি সম্রাটকেও তার কথা লিখেছেন; যাতে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি যে রকম অসুস্থ তাতে যে কোনো সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে; ডা. লোরাইনও পিটার্সবুর্গ থেকে এসে হাজির হয়েছে তার প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী কে হবে, পিয়ের না প্রিন্স ভাসিলি, তা কেউ জানে না। চল্লিশ হাজার ভূমিদাস আর লক্ষ লক্ষ রুবল! সবকিছু আমি ভালোই জানি, কারণ প্রিন্স ভাসিলি নিজে আমাকে বলেছেন। তাছাড়া, সিরিল ম্লাদিমিরভিচ আমার মায়ের সম্পর্কে ভাই হন। তিনি আমার বরি-র ধর্মবাপও বটে।

প্রিন্স ভাসিলি গতকাল এখানে এসেছে। শুনেছি, কোনো তদন্তের কাজে সে এসেছে অতিথিটি বলল।

প্রিন্সেস বলল, তা বটে, তবে নিজেদের মধ্যে বলেই বলছি, ওটা একটা অজুহাত। আসল কথা, কাউন্ট সিরিল ব্লাদিমিরভিচের অসুখের সংবাদ শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই সে এসেছে।

কাউন্ট বলে উঠল, কিন্তু তুমি কি জান গো, সেটা জব্বর রসিকতা হয়েছিল। কিন্তু বয়স্কা অতিথিটি তার কথা শুনছে না দেখে সে তরুণীদের দিকে ফিরে বলল, পুলিশটির যে কী হাস্যকর অবস্থা হয়েছে সেটা আমি যেন কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি!

নিজেকে পুলিশের ভূমিকায় কল্পনা করে কাউন্ট তার হাত দুটো দোলাতে লাগল। যে সব মানুষ ভালো খায়, বিশেষ করে ভালো টানে, তাদের মতো উচ্ছ্বসিত হাসিতে কাউন্টের মোটাসোটা দেহটা দুলে দুলে কাঁপতে লাগল। অতএব, সকলে আসবেন এবং আমাদের সঙ্গে খাবেন! সে বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *