০৪. শিক্ষা (বেদাঙ্গসূত্র)

শিক্ষা  (বেদাঙ্গসূত্র)

আমরা বেদাঙ্গের অধিকতর বিধিবদ্ধ দিকগুলি প্ৰথমে আলোচনা করছি। এই পর্যায়ে রয়েছে শিক্ষা (ধ্বনিতত্ত্ব), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (ব্যুৎপত্তি শাস্ত্র) এবং ছন্দ। এদের মধ্যে শিক্ষা আমাদের প্রথম আলোচ্য বিষয়, কারণ সর্বাধিক সংখ্যক রচনা শিক্ষা সম্পর্কে প্ৰণীত হয়েছে।

শিক্ষাবিষয়ক রচনাগুলিতে আমরা প্রাচীন ভারতবর্ষে ধ্বনিতত্ত্ব অনুশীলন সম্পর্কে পরিচয় পাই। ধ্বনি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত উচ্চারণপদ্ধতি, বাকযন্ত্র ও আস্য-প্ৰয়াস সম্পর্কে শিক্ষা-গ্রন্থগুলি আমাদের অবহিত করে : সংক্ষেপে বলা যায়, বেদমন্ত্র উচ্চারণ প্ৰশিক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কিছুই এই গ্রন্থের পরিধিভুক্ত। শিক্ষা প্ৰায় অবিচ্ছেদ্যভাবে প্ৰতিশাখ্য শ্রেণীর গ্রন্থসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর নামকরণেই এই ইঙ্গিত নিহিত যে প্রতিবৈদিক শাখায় পরিশীলিত শিক্ষাগ্ৰন্থই হল প্রাতিশাখ্য। অবশ্য বিধিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষা বেদাঙ্গের অন্যতম হলেও প্রাতিশাখ্যগুলি এই বৃত্ত-বহির্ভূত; তবে এদের একটিকে অপরটির সাহায্যে ছাড়া আলোচনা করা অসম্ভব।

বহু শিক্ষাগ্রন্থের নাম আমাদের কাছে পৌঁছালেও এসমস্ত রচনাগুলি এখন আর পাওয়া যায় না। সমস্ত শাখার চালিত সাধারণ শিক্ষাগ্রন্থগুলি হল ‘পাণিনীয়’, ‘সর্বসম্মত’ ও ‘সিদ্ধান্ত’। মন্ত্রের বিভিন্ন অংশ গানের প্রণালী, সংহিতা পাঠকে পরিশীলিত করে সুর-সমন্বিত করার পদ্ধতি, উচ্চারণ পদ্ধতি এবং গান ও বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের সহযোগী অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি এইসব গ্রন্থের প্রধান বিষয়বস্তু। শিক্ষা সংগ্ৰহ গ্রন্থটি তুলনামূলকভাবে নবীনতর ও বহু বিষয়-সমৃদ্ধ রচনা। এধরনের গ্রন্থগুলি মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ‘পাণিনীয় শিক্ষা’ যথার্থ উচ্চারণ, সন্ধিবিচ্ছেদ ও সংহিতা পাঠে পরিবর্তন সংক্রান্ত প্ৰধান বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করেছে। এই গ্রন্থে ব্যাস, নারদ, শৌনক প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা উল্লিখিত হয়েছেন। পাণিনির উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রচলিত গ্রন্থটি স্বয়ং পাণিনির দ্বারা রচিত নয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে শিক্ষাকে অক্ষর, স্বর, সম্বোধনের স্বর-দৈর্ঘ্য, শ্বাসাঘাত, মন্ত্রোচ্চারণ, ও সন্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সবগুলি শিক্ষাগ্রন্থেই এই বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। তাছাড়া পাণিনীয়-শিক্ষার মত প্ৰধান শিক্ষাগুলি বিষয়বস্তুর গভীরে অবগাহন করে পদের উৎস এবং উচ্চারণের মৌখিক কলাকৌশল আলোচনা করেছে কেননা প্রাতিশাখ্যগুলি যেখানে ধ্বনির শ্রবণগত দিক সম্পর্কে উৎসাহী, শিক্ষা যেখানে ধ্বনি উচ্চারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আৰ্য-প্ৰযত্ন সম্পর্কে আলোচনা করেছে। প্ৰাচীনতর বৈদিক সাহিত্যে স্বরন্যাস উচ্চারণের তীব্রতা অনুযায়ী নির্ধারিত হত। কিন্তু কালক্রমে অবৈদিক উচ্চারণ রীতির সঙ্গে নিরন্তর পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে তা ধীরে ধীরে ও নিশ্চিতভাবে শ্বাসাঘাতমূলক স্বরন্যাসে বিবর্তিত হয়। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের সময় থেকে এটা বিধিতে পরিণত হয়ে উপনিষদের কাল পর্যন্ত প্ৰচলিত থাকে।

এছাড়া আমরা অন্য যেসব শিক্ষাগ্রন্থের কথা শুনি, তাদের মধ্যে কেশব, মাধ্যন্দিনীয়, লোমশ ও অমোঘনন্দিনী শুক্লা-যজুর্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের মধ্যে অমোঘনন্দিনী প্ৰধানত উচ্চারণবিধি সম্পর্কিত সাতান্নটি শ্লোকে গ্রথিত সংক্ষিপ্ত একটি রচনা; মাধ্যদিনীয়তে রয়েছে সাতাশটি এবং কেশবে মাত্র নয়টি শ্লোক। গার্গ্যাচার্য রচিত লোমশী গ্রন্থটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর রচনা; এতে চারটি খণ্ড ও চল্লিশটি শ্লোক রয়েছে।

ভারদ্বাজ, চারায়ণীয়, আরণ্য ও ব্যাসশিক্ষা তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একশ তেত্রিশটি শ্লোকে রচিত ভারদ্বাজ গ্রন্থটি একটি ব্যবহারিক নির্দেশিকা যা প্ৰতিশব্দগুলির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে ও যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে শেখায়। তৈত্তিরীয় সংহিতা পাঠের বিশুদ্ধতা রক্ষাই এর লক্ষ্য। দশটি অধ্যায় ও তিনশ পঁয়ত্রিশটি শ্লোক-সংবলিত চারায়ণীয় একটি দীর্ঘতর রচনা; এর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে। সন্ধি, সমাস, আবৃত্তির নিয়ম, স্বরন্যাস, যতি, বিভিন্ন পদের দৈর্ঘ্য, ছন্দ ইত্যাদি। বিষয় পরিধির ক্ষেত্রে ‘আরণ্য’ ক্ষুদ্রতম, কেননা এই গ্ৰন্থ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের স্বরন্যাসেই সীমাবদ্ধ। এর দাবি হল যে অন্য নীটি শিক্ষাগ্ৰন্থ থেকে এ-গ্ৰন্থ তার বিষয়বস্তু আহরণ করেছে। ব্যাসশিক্ষা সম্ভবত প্ৰাচীনতম এবং তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য নামক গ্রন্থের উপর নির্ভরশীল। এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি অন্য বহু শিক্ষার তুলনায় বিষয়বস্তুর দিক থেকে ব্যাপকতর।

অথর্ববেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাণ্ডুকী শিক্ষা ষোলটি অধ্যায় ও একশ চুরাশিটি শ্লোকে গ্রথিত দীর্ঘ রচনা; বশিষ্ট-শিক্ষা নামক অতি ক্ষুদ্র রচনাটিতে শুধুমাত্র অক্ষরের দ্বিত্ব বা ‘আবৃত্তি’ আলোচিত হয়েছে। গদ্যে রচিত আপিশলী শিক্ষায় বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষরের শ্রেণীবিভাগ ও যথার্থ উচ্চারণ ও ধ্বনির উৎপত্তি আলোচিত হয়েছে।

সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নারদীয় শিক্ষার দুটি প্ৰপাঠকের প্রতিটিই আটটি অধ্যায় বিভক্ত। এতে মোট দুশ চল্লিশটি শ্লোক ও কিছু গদ্য-স্তবক রয়েছে; সামবেদের পাঠকে সুরের নিয়ম অনুযায়ী বিন্যস্ত করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। সামবেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাসশিক্ষা দীর্ঘতম শিক্ষাগ্ৰন্থ, এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলির অন্যতম। সামবেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এটি তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্যকে এত বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছে যে প্রকৃতপক্ষে শেষোক্ত গ্রন্থের একটি ভিন্ন ধরনের পদ্য-সংস্করণ হয়ে পড়েছে। এই গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে প্ৰায়োগিক পরিভাষা, স্বরন্যাসের বিধি, দ্বিত্ব-বিধি ইত্যাদি।

অন্যান্য রচনার উল্লেখ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে শিক্ষাশ্রেণীভুক্ত সমস্ত গ্ৰন্থ শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে পৌছায়নি। এমন প্ৰায় চৌদ্দটি নাম পাওয়া যায় যা এখন আমাদের নিকট লুপ্ত। পাণিনি তার রচনাকে সংহিতা, ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ এবং কয়েকটি প্রাচীনতর শ্রৌতসূত্রের প্রয়োগিক দিকের সাহায্যে প্রণয়ন করেছিলেন। সোমশৰ্মা রচিত ‘যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা’র বিষয়-পরিধি পাণিনীয়ের অনুরূপ; তবে এটা বহু পরবর্তীকালের রচনা-অন্তত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী তো নয়-ই অর্থাৎ যখন গুপ্ত সাম্রাজ্যের যুগে নুতনভাবে যজ্ঞধর্মের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হয়েছিল তখনকার। এর চেয়েও পরবর্তী রচনা হল ‘কাত্যায়ন-শিক্ষা’ যদিও কোনো কোনো বিখ্যাত গবেষকের মতে এটি যাজ্ঞবল্ক্য শ্রৌতসূত্র অপেক্ষা প্রাচীনতর। যেহেতু প্রথমোক্ত রচনা থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি শেষোক্ত গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে আমাদের মনে হয়, উভয় গ্ৰন্থই সম্ভবত কোনো বিলুপ্ত প্ৰাচীনতর রচনা থেকে বিষয়বস্তু আহরণ করে থাকবে। অনুমান করা যায়, কাত্যায়ন-শিক্ষা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচি৩ হয়েছিল। এর শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্যা—উভয়ক্ষেত্রে বিষয়সূচী প্ৰায় এক; তবে প্রথমোক্ত রচনা উচ্চারণ-প্ৰয়াসের প্রকৃতি সম্পর্কে অধিক মনোযোগী এবং দ্বিতীয়োক্ত রচনায় উচ্চারিত ধ্বনির শাব্দিক চরিত্র আলোচিত। এই দুই শ্রেণীর রচনার প্রকৃত পার্থক্য একটি বিধিতে আভাসিত হয়েছে : যখন শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য পরস্পরবিরোধী অভিমতদেয়। তখন প্ৰতিশাখাই প্রামাণ্য বলে গণ্য হবে; কেননা বৈদিক ধর্ম ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হওয়ায় ফলে বাচনভঙ্গীতে যে বৈচিত্র্য ও উচ্চারণ-বিধিতে যে পরস্পর-বিরোধিতা দেখা দেয়, তার ফলে বহু ভাষাভাষী জনসাধারণের কাছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্দিষ্ট বিধি প্ৰণয়ন করা কাৰ্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্ৰত্যেক অঞ্চল কোনো নির্দিষ্ট শাখার প্রচলিত প্রয়োগ বিধির দ্বারা পরিচালিত হত। কীল্‌হর্ন মনে করেন যে অপেক্ষাকৃত নবীনতর শিক্ষাগুলি বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে প্রাতিশাখ্যের তুলনায় পূর্ণতর ও রচনা-বিন্যাসের ক্ষেত্রে উন্নততর। তবে প্রথম সম্ভবত একটিমাত্র শিক্ষা প্রচলিত ছিল এবং পাণিনির বৈদিক ধ্বনিতত্ত্ব-বিষয়ক প্রাচীন৷৩ম রচনাটি ছিল এই শিক্ষা, যা দীর্ঘকাল ধরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়। লক্ষণীয় যে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ‘শিক্ষা’ শব্দটি একবচনে প্ৰযুক্ত হয়েছে; (৭ : ২ : ১); এতে মনে হয় যে এটা শ্রেণীনাম ও সম্ভবত বিভিন্ন শাখায় প্রচলিত বেশ কিছু রচনার সাধারণ নাম। আমাদের কাছে যেসব শিক্ষাগ্রন্থ পৌঁছতে পেরেছে, সেগুলিকে বেদাঙ্গসূত্রের প্রাচীনতম পর্যায়ের কাছাকাছি স্থাপন করতে হবে; কিন্তু ‘প্ৰতিশাখ্যগুলি অন্ততপক্ষে চার বা তিন শতাব্দী পরে রচিত–নবীনতম প্রাতিশাখ্যগুলি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।

প্রচলিত প্ৰতিশাখ্যগুলি মূল শৌনকের ঋক-প্রাতিশাখ্য, যদুর্বেদের অন্তৰ্গত তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য, শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত কাত্যায়ন-রচিত ‘বাজসনেয়’ প্ৰতিশ্যাখ্য, অথর্ববেদের অন্তর্গত শৌনক রচিত অথর্ব-প্ৰতিশাখ্য’ বা চতুরধ্যায়িকা, এবং সামলেদের অন্তর্গত সাম-প্রাতিশাখ্য’ (পুষ্প বা পঞ্চবিধ সূত্রের মত সংক্ষিপ্ত রচনাগুলিও এর সঙ্গে সংযোজিত)। বহু প্ৰতিশাখ্য প্রাচীনতর। এবং অঞ্চল ও শাখাভেদে ভিন্ন ভিন্ন; এদের মধ্যে থেকেই বিমূর্তায়ন ও সাধারণীকরণের প্রবণতার ফলস্বরূপ শিক্ষাগ্রন্থগুলি উদ্ভূত হয়। উবট ভাষ্যে আমরা এর প্রমাণ পাই যেখানে তিনি বলেছেন যে এই বিশেষ বেদাঙ্গটি (অর্থাৎ প্রাতিশাখ্য) সমস্ত বেদের শিক্ষা ছন্দ ও ব্যাকরণগুলিতে সাধারণভাবে প্রাপ্ত সূত্রগুলির সংকলন; তাছাড়া কোনও নির্দিষ্ট শাখার প্রয়োগরীতি অনুযায়ী সাধারণ নিয়মগুলি এতে পরিশীলিত হয়েছে বলেই এধরনের রচনাকে প্রাতিশাখ্য’ বলা হয়। খুব তাৎপৰ্যপূর্ণভাবে ঋক প্রাতিশাখ্য নিজেকে বেদাঙ্গরূপে বর্ণনা করেছে (১৬ : ৬৯); যদিও পরিচিত তালিকাগুলি শিক্ষাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে। কারণ সম্ভবত প্ৰতিশাখা থেকে শিক্ষা গঠিত হওয়ার পরই সেই তালিকা সংকলিত হয়েছিল। উবট প্রাতিশাখ্য তালিকায় শিক্ষাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং শেষোক্ত রচনাগুলিকে তিনি ‘পার্ষদ’ বা বিদ্বজনমণ্ডলীরূপে অভিহিত করেছেন। শৌনকের ঋক-প্রতিশ্যাখ্য শাকিল শাখার অন্তর্গত, এর আঠারটি ‘পটল’ দুটি প্রধান ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমভাগে রয়েছে। বর্ণমালাসম্পর্কিত একটি অধ্যায় যাকে ধ্বনিগত উৎস অনুযায়ী কয়েকটি সমরূপযুক্ত ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে (১ম পটল); এছাড়া রয়েছে চোদ্দ রকম সন্ধি ও সন্ধি-প্ৰতিষেধ (২য়) এবং বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সংবলিত আরো চারটি অধ্যায়। দ্বিতীয় ভাগে যে বারোটি পটল (অধ্যায়) রয়েছে, তার মধ্যে দীর্ঘায়িত স্বরবর্ণ (৭ম), পুতস্বরের বৈচিত্ৰ্য (৮ম ও ৯ম), স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য ক্ৰম-পদ্ধতি (১০ম ও ১১শ), ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণ (১৪শ), ছাত্রদের শিক্ষাদান করার উপায় (১৫শ) ও ছন্দ (১৬শ) ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য গ্রন্থে প্রকৃতপক্ষে একই বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে; এছাড়া বিভিন্ন প্ৰায়োগিক পরিভাষাও আলোচিত হয়েছে।

কাত্যায়নের শুক্ল-যজুর্বেদ-প্ৰতিশাখ্য গ্রন্থে আটটি অধ্যায় ও সাতশ’ সাতাশটি সূত্র রয়েছে। এতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে : সামবেদীয় ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ, শিক্ষকদের দ্বারা নির্দেশিত আবৃত্তির বিচিত্র প্রাচ্যরীতি, শুক্ল যজুর্বেদের পদ ও ক্রমপাঠ, সন্ধিবিধি, স্বরন্যাস, আবৃত্তির জন্য কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, বিভিন্ন জটিল পাঠে প্রতিটি শব্দ পুনরাবৃত্তির পদ্ধতি ইত্যাদি।

আমরা শুক্ল যদুর্বেদের পনেরোটি ভিন্ন শাখার কথা শুনি, এদের সবগুলি একটিমাত্ৰ সাধারণ প্ৰতিশ্যাখ্য ছিল। ঋকপ্রাতিশাখ্যে ছন্দ আলোচিত হলেও শুক্ল যজুর্বেদ-প্ৰতিশাখ্যে তা হয় নি-সম্ভবত এর কারণ এই যে, প্রাতিশাখ্যরচয়িতা কাত্যায়ন তার সর্বানুক্ৰমণী গ্রন্থে বিষয়টি আলোচনা করেছেন। বিশেষভাবে শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ধ্বনিতত্ত্ব এই গ্রন্থে আলোচিত হলেও বহু আপাত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় এতে সন্নিবেশিত হয়েছে; যেমন-স্মৃতি-নিবদ্ধ করার প্রয়োজন বা বেদাধ্যয়নের নির্দেশ বা সাঙ্গীতিক প্ৰণালী বা কিছু কিছু প্ৰাচীন আচার্য ও তাদের অনুসরণকারীদের বিচিত্র আবৃত্তিরীতি। শুক্লযজুর্বেদ প্রাতিশাখ্য অনুযায়ী বর্ণমালায় ৬৫টি বর্ণ রয়েছে–কেননা উচ্চারণের বিভিন্ন সূক্ষ্ম তারতম্যও এতে স্বীকৃত; এছাড়া আছে। ফলশ্রুতি অংশ, যেখানে আলোচ্য গ্ৰন্থপাঠ-লব্ধ পুণ্যসমূহ বিবৃত হয়েছে।

সর্বাধিক-সংখ্যক প্ৰতিশাখ্য সামবেদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট; এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরিচিত হল সাম-প্রতিশ্যাখ্য, ‘পঞ্চবিধ” বা ‘পুষ্পসূত্র’ ও ঋকতন্ত্র। ঋকতন্ত্র গ্রন্থটি মূলত ব্যাকরণের প্রকৃতি যুক্ত; অন্যান্য রচনাগুলিতে সামবেদের আবৃত্তি ও গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চারণের বিশেষ পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন শাখা ও অঞ্চলভেদে গায়নরীতি প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তিত হতে পারে; এই রচনাসমূহে পরিবর্তন-সম্পর্কিত নিয়মাবলী দেওয়া হয়েছে। তাই সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাতিশাখ্যের এত সংখ্যাধিক্য।

সামবেদের প্রাতিশাখ্যগুলি সম্ভবত অথর্ববেদীয় প্রতিশ্যাখ্য অপেক্ষাও প্রাচীনতর।; শেষোক্ত রচনাগুলিতে প্রকৃতপক্ষে সূত্রসাহিত্যের উন্মেষপর্বের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে অথর্ববেদের তিনটি প্রাতিশাখের মধ্যে মাত্র একটি, অথর্ব। প্ৰতিশ্যাখ্য নামে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অন্য একটি, কৌণক ও সায়ণ শাখার রচনা ‘চতুরধ্যায়’ নামে পরিচিত; পৈপ্পলাদ শাখার তৃতীয় প্রাতিশাখ্যটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চতুরধ্যায় ও অথর্ব প্রাতিশাখ্যের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। এর বিষয়বস্তু অন্যান্য প্রাতিশাখ্যগুলির প্রায় অনুরূপ। কিন্তু যেহেতু অন্যান্য পরিচিত সংহিতাগুলির

প্রাতিশাখ্যের অতিরিক্ত গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে। কারণ তা এমন একটি দুর্জেয় ভাষার উপর আলোকসম্পাত করেছে যার মধ্যে একই সঙ্গে ঋকবেদ ও যজুর্বেদ সংহিতা প্রাচীনতর ও নবীনতর—এই উভয়বিধ নিদর্শনই সংরক্ষিত আছে। এর অন্য বৈশিষ্ট্য হল লেখনপ্রণালীর প্রতি গুরুত্ব আরোপের প্রবণতা; এই অসামান্য বৈশিষ্ট্যের জন্য একে স্পষ্টত সেই সময়ের রচনা বলে চিহ্নিত করা চলে যখন বৈদিক সাহিত্য লিখিত রূপ পরিগ্রহ করছিল। পাণিনি ও পতঞ্জলির আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়ে-সম্ভবত শেষোক্ত জনেরই বেশি কাছাকাছি-এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল। ‘চতুরধ্যায়’–প্ৰচলিত অথর্ববেদ পাঠকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছে। যদিও কখনো কখনো স্পষ্টতই তা ত্রুটিপূর্ণ। লক্ষণীয় যে, প্ৰতিশাখ্যের বিষয়বস্তুর মতে, এমন কিছু রয়েছে সাধারণত যাকে ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়; এদের বিষয়বস্তু প্ৰায়ই পরস্পরের বৃত্তে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু প্রাতিশাখাগুলি কখনো ব্যাকরণ বলে’ অভিহিত হয় না, কারণ ভাষার ব্যাকরণ শিক্ষাদান এগুলির প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়, বিভিন্ন বৈদিক শাখার নির্ভুল প্রকরণ বিবৃত করাই এদের লক্ষ্য। অবশ্য এদের মধ্যে স্পষ্টভাবে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যাকরণের অস্তিত্ব ও পরিশীলন সূচিত হয়; এই সঙ্গে দুটি স্পষ্টত ভিন্ন ধারায় এদের বর্গীকরণের পূর্বাভাসও পাওয়া যায়। প্রাতিশাখাগুলিতে ভাষা অধিক তরল্যায়িত; উচ্চারণ, স্বরভঙ্গি, সন্ধি ও স্বরন্যাসের অসংখ্য আঞ্চলিক বিকল্প কােপ প্রকাশিত হয়েছে। পৃথক বিষয়-রূপে ব্যাকরণের উদ্ভবের ফলে এগুলি আরো কঠোরভাবে বিধিবদ্ধ হয়েছিল।

পদপাঠের প্রণেতা শাকল্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাস্ক বা শৌনক অপেক্ষা প্রাচীনতর। পদপাঠ ছাড়াও সংহিতাকে স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য অন্যান্য পদ্ধতিও প্ৰচলিত ছিল; যেমন–জটা, মালা, রথ, ধ্বজ, ঘন, রেখা, শিখা ও দণ্ড। সংহিতাপাঠের যথাযথ পৌর্বাপর্য অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিভিন্ন পারস্পর্যে সংহিতার শব্দসমূহ প্ৰাণ্ডাক্ত স্মৃতিসহায়ক পদ্ধতি অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হত।