১৫. কাব্য (উপনিষদ)

কাব্য (উপনিষদ)

সমস্ত উপনিষদ সাহিত্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু জ্ঞানগর্ভ ও উপলব্ধি-ঋদ্ধ শ্লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এগুলি সম্ভবত বহু প্ৰাচীন লোকসাহিত্যের সিন্ধুতরঙ্গে আবর্তিত একটি অমূল্য কাব্যসঞ্চয়। সাধারণ গদ্যধর্ম সাহিত্যে সন্নিহিত এই গাথাগুলিই সহসা অসামান্য সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়। এ ধরনের রচনার প্রথম সাক্ষাৎ আমরা ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যে পেয়েছি, যা সাধারণভাবে গদ্যময় ও নিষ্কপ্রাণ রচনাকে আকস্মিকভাবে প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু অন্তলীন উপলব্ধি-জনিত দীপ্তি ও সৌন্দর্যে উন্নততর অভিব্যক্তিতে রাপান্তরিত করেছে। এ ধরনের গাথা বৈদিক ও ব্ৰাহ্মণ্য সাহিত্যের মতো বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য যতি-সাহিত্যকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। এই যুগের শেষ পর্যায়ে রচিত মহাভারতে এধরনের অসংখ্য নৈতিক ও উপলব্ধি-সমৃদ্ধ শ্লোকে প্রভূত সৌন্দর্য ও শক্তির পরিচয় নিহিত রয়েছে।

উপনিষদের মর্মবাণী যে এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, তার কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নততম চিন্তা ও উপলব্ধি কাব্যের মাধ্যমে উপস্থাপিত। উপমার বহুল ব্যবহারের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি যে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে চিত্র-কল্পগুলি আহত হওয়ায় অত্যন্ত সার্থকভাবে তা জিজ্ঞাসুর মনকে আন্দোলিত করে। প্রকৃতপক্ষে চিত্রকল্পের এ-জাতীয় প্রয়োগ নব্য মতপ্রচারে অপরিহার্য। উপনিষদের ঋষিরা যে বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তা এত অভিনব এবং চিরাগত অভিজ্ঞতার তুলনায় এত স্বতন্ত্র ও দুর্জেয় আধ্যাত্মিক উপলব্ধিমণ্ডিত যে কেবলমাত্র পরিচিত পৃথিবীর বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে তুলনা করেই অন্তনিহিত ভাবকে পরিস্ফুট করা সম্ভব ছিল (যেমন কঠ ২ : ১ : ১৪; মুণ্ডক ৩ : ২ : ৮; ছান্দোগ্য ৪ : ১৪ : ৩, বৃহদারণ্যক ১ : ৪ : ৭; শ্বেতাশ্বেতর ১ : ১৩ ইত্যাদি)।

বিশেষভাবে ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত উপমাগুলি গভীর সত্যের বাহন (ছান্দোগ্য ৬ : ৮ : ২, বৃহদারণ্যক ২ : ৫ : ১৫; ৪ : ৩ : ২১; 8 : 8 : ৩ : 8 : ৭)। এই উপমাগুলির সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এই যে, আপাত-তুচ্ছ সর্বজন পরিচিত দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার উপকরণে সাহায্যে ঋষি কবি সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত আধ্যাত্মিক ভাবনাকে পরিস্ফুট করে তুলেছেন। এদিক দিয়ে উপনিষদের চিত্রকল্প সংহিতা যুগের অলঙ্করণের তুলনায় স্বরািপত ভিন্ন। আবার, রূপক প্রয়োগের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার গভীরতর বিস্তার ঘটানো হয়েছে; উপনিষদের কবি চৈতন্যের গভীরতর স্তরে অবগাহন করে দুটি পরস্পন্ন ভিন্ন বস্তুর মধ্যবর্তী ব্যবধানকে যেন বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এধরনের অভিব্যক্তি চরিত্রগতভাবে অতীন্দ্ৰিয় প্রবণতাযুক্ত (যেমন মুণ্ডক ৩ : ২ : ১; তৈত্তিরীয় ২ : ৭ : ৮ : ১; ছান্দোগ্য ৩ : ১৫ : ১; বৃহদারণ্যক ২ : ৪ : ১০; প্রশ্ন ২ : ৯ ইত্যাদি)। তবে, উপনিষদের সর্বোত্তম কাব্যিক অভিব্যক্তি কোনও অলঙ্কার প্রয়োগের মাধ্যমে ঘটেনি, অভিজ্ঞতার অব্যবহিত প্রত্যক্ষ উপস্থাপনার দ্বারাই ঘটেছে। (যেমন-বৃহদারণ্যক ২ : ৫ : ১; ছান্দোগ্য ৩ : ১ : ১; ঈশ্য ১৬; তৈত্তিরীয় ২ : ৪, ৯; শ্বেতাশ্বেতর ৩ : ৯ ইত্যাদি)। বস্তুত, বিমূর্ত আধ্যাত্মিক ও নীরস বর্ণনাও অনুভূতির স্পর্শে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে বিশ্বাত্মা রূপী পুরুষকে কখনো অনন্ত অশ্বত্থবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে (২ : ৩ : ১) কখনো বা সীমাহীন আকাশের সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। তেমনি উপনিষদের কবির কালচেতনা (শ্বেতাশ্বেতর ৬ : ১) কিংবা অপরিমেয় ব্রহ্মের বর্ণনা (বৃহদারণ্যক ৩ : ৭ : ৩) আমাদের মুগ্ধ ও চমৎকৃত করে। অনুরূপভাবে আত্মা ও ব্ৰহ্মের ঐক্যবোধ যেভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে, তা অসামান্য কাব্যিক গভীরতায় মণ্ডিত (তৈত্তিরীয় ১ : ১০)। এই উপনিষদেই কাব্যিক প্রকাশ ও অন্তর্গূঢ় সৌন্দর্যবোধ লালিত ‘রসে’র। এর কবিত্বপূর্ণ উল্লেখ রয়েছে (২ : ৭)।

এটা সত্য যে, ঋগ্বেদ-সংহিতাতেও উন্নত কাব্যের বিদ্যুৎ-চমক ছিল; অনুরূপ উন্নত কাব্যিক অভিব্যক্তি বেশকিছু অথর্ববেদীয় মন্ত্রেও রয়েছে। কিন্তু প্ৰত্যক্ষ ও শক্তিশালী কাব্যিক অন্তদৃষ্টি এবং সজীব সরল ও দৃপ্ত অলঙ্করণের সাহায্যে উপনিষদের কাব্যগুণ পূর্ববর্তী যুগের সমস্ত সাহিত্যকে অতিক্রম করেছে। গভীরতা, ব্যাপ্তি ও অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল প্ৰকাশের দ্বারা এবং সামান্যমাত্র কলাকৃতির সাহায্যে উপনিষদ পাঠকচিত্তকে অভিভূত করে। যে অসামান্য প্রত্যক্ষভাষা ও রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে উপনিষদে উপলব্ধির চমৎকৃতি অভিব্যক্ত হয়েছে, তা সংস্কৃত-ভাষা পূর্বে বা পরে আর কখনো পায়নি।

ঋগ্বেদের শেষ অংশ এবং অথর্ববেদ–এই উভয়েই রচনা কালের দিক দিয়ে প্রাচীনতর উপনিষদগুলির সমকালীন, ফলে কাব্যাংশে তাদের মধ্যেও একধরনের প্রত্যক্ষতা, শক্তি, ঋজুতা ও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের শ্ৰেষ্ঠ কাব্যাংশ বাদ দিলে এরা নিত্যগুণে ভাস্কর এবং সর্বপ্রথম ভারতীয় সাহিত্যে রচনাশৈলীর ঋজু ও বিদ্যুৎতুল্য উজ্জ্বলতার প্রবর্তক। বস্তুত, এই রচনাশৈলী নূতন এক অভিজ্ঞতার ফল, কারণ উপনিষদের ঋষিরা জীবনের মৌলিক তাৎপর্য সন্ধানের জন্য সমকালীন জীবনের গভীরে অবগাহন করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যথেষ্ট উদ্বেগ জড়িত ছিল, কেননা লোকপ্রিয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে এ জন্য তাদের প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। কবিরা আত্মানুসন্ধানের আত্যন্তিক প্রয়োজনে এবং নুতন আলো ও উপলব্ধির অব্যবহিত প্রকাশের জন্য নূতন বাগভঙ্গী নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যেহেতু প্ৰাচীনতর ভাষা তাদের অভিনব আত্মিক উপলব্ধি প্রকাশের পক্ষে সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। অভিজ্ঞতার তীব্রতার ফলে তারা নূতন বাককৌশল ও সজীব চিত্রকল্প প্রণয়নে মনোনিবেশ করে সম্পূর্ণ নূতন ধরনের এক কাব্য সৃষ্টি করলেন। উপনিষদের কাব্যকলায় নিহিত শক্তি ও সজীবতা যে আমাদের আন্দোলিত করে, তার উৎস হ’ল বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ে উদ্ভূত যুগন্ধর নব্য চিন্তাধারার অপরিমেয় গভীরতা, আন্তরিকতা ও জীবনের তাৎপর্য অন্বেষণের তীব্র যন্ত্রণা।