০৫. দেবসঙ্ঘ (আরণ্যক)

দেবসঙ্ঘ (আরণ্যক)

মহিমার কিয়দংশ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ব্রাহ্মণ যুগে এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হয়ে, সেই যুগেই তা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হলেও, আরণ্যকে তার ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া অব্যাহত। ঐতরেয় আরণ্যকে (২ : ১ : ৮) বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রদত্ত খাদ্যসামগ্ৰীীর উপরই দেবতারা নির্ভরশীল। এই পর্যায়ে দুটি স্পষ্ট প্রবণতা লক্ষণীয়; প্রথমত, লোকায়ত অনৈষ্ঠিক দেবতাদের প্রবর্তন এবং দ্বিতীয়ত, সমস্ত দেবতার এমন এক সর্বোত্তম দেবতার মধ্যে আশ্রয়লাভ, যিনি সমস্ত প্ৰাচীন দেবসঙ্ঘের সম্পূরক হয়ে উঠেছেন। কুবের বৈশ্রবণ এখন হােমের পরিবর্তে বলিভুক। এই নির্দেশের পরবর্তী স্তোত্রে ধর্ম সম্পর্কে পুরাণ-কথিত উপাসনাপদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আভাসিত হয়েছে। রতি বিশ্বাবসু, দন্তী, গরুঢ়, দুগী, তৎপুরুষ, কন্যাকুমারী, নারায়ণ ও বাসুদেবের উদ্ভব ঘটেছে। একই স্তবকে অগ্নিতুল্য উজ্জ্বল ও দুৰ্গতিতারিণী দুৰ্গাদেবীকে আহ্বান করা হয়েছে। নারায়ণের উদ্দেশে নিবেদিত সূক্তটিতেও দেখি নুতন বৈশিষ্ট্য; সমুদ্রনিবাসীরূপে তিনি এখানে বর্ণিত। বস্তুত, এখানেই মহাকাব্য ও পৌরাণিক ঐতিহ্যের অন্যতম কেন্দ্রীয় দেবতা নারায়ণের প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া গেল।

অম্বিকার পতিরূপ রুদ্র আহূত হয়েছে–শুক্ল যজুর্বেদে (১৬শ) তিনি অম্বিকার ভ্ৰাতা ও উমার স্বামী; স্বয়ং উমাকে পাওয়া গেছে কেনোপণিষদে। অদিতির উদেশে নিবেদিত একটি আগ্রহহােদীপক সূক্ত অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ-সেখানে তাকে সকল প্ৰাণী, পৃথিবী এবং পরমপুরুষের মাতাররূপে সম্বোধন করা হয়েছে, আমাদের কাছে সেই পরমা মাতৃকাদেবীর উত্থান। এখানে আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, পৃথিবী যাঁর ভিত্তিভূমি; কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর পক্ষে তা-ই স্বাভাবিক–অথচ ইনি অন্যান্য মাতৃকাদেবীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও আত্মস্থ করে নিয়েছেন। এই সঙ্গে আমরা যখন মনে রাখি যে, সংহিতা-ব্ৰাহ্মণ যুগের দেবসঙেঘ্য পুরুষদেবতাদের প্রাধান্য ছিল তর্কাতীত, তখন প্রাগুক্ত পরম মাতৃকার উত্থান অধিকতর তাৎপর্যাবহ হয়ে ওঠে; কারণ এই দেবী এখন আর অন্য কোনো পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী নন, আপন অধিকারেই তিনি বিশিষ্টা মাতৃকা।

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্ৰজাপতির উত্থানের মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদী প্রবণতার সূত্রপাত হয়েছিল, কিন্তু আরণ্যক পর্যায়ে আরো বহু নূতন উপাদান যুক্ত হওয়ায় এই প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠল, যে সমস্ত প্ৰাচীনতর রচনায় পুরুষ, অক্ষর, ওম, ব্ৰহ্মা ইত্যাদি মহিমান্বিত হয়েছিলেন সেসব ক্ষেত্রে এদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় অস্তিত্ব ছিল স্বীকৃত; কিন্তু এই পর্যায়ে তাদের একীভূত করে তোলার সচেতন প্ৰয়াস দেখা গেল। পরম দেবতার নাম যদিও তখনো পর্যন্ত অনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনশীল, ‘সমস্ত দেবতাই পুরুষে প্রতিষ্ঠিত’ (শাঙ্খায়ন ১০ : ১) তবুও এমন বিবৃতি সাধারণভাবে লভ্য এবং তাতে ক্রমবর্ধমান একেশ্বরবাদী প্রবণতারই পরিচয় স্পষ্ট।