• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৪. জাতিভেদ (ব্রাহ্মণ)

লাইব্রেরি » সুকুমারী ভট্টাচার্য » ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য » ৫. ব্রাহ্মণ - পঞ্চম অধ্যায় » ১৪. জাতিভেদ (ব্রাহ্মণ)

জাতিভেদ (ব্রাহ্মণ)

যদিও সমগ্র ঋগ্বেদের মধ্যে একটিমাত্ৰ মন্ত্রে চতুর্বর্ণ ও তাদের উৎপত্তি স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে, পরবর্তী যুগের ব্ৰাহ্মণ গ্রন্থগুলি কিন্তু জাতিভেদের উল্লেখে পূর্ণ। ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের যজ্ঞানুষ্ঠানের অধিকার ছিল। পাণ্ডিত্য ও অতিপ্ৰাকৃত ক্ষমতার জন্য সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল সর্বোচ্চ। পুরোহিতরা প্রকৃতই সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী ছিলেন; অগ্নির সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য কল্পিত হত। তাৎপৰ্যপূৰ্ণ দ্বৈতবোধের ফলে ক্ষত্রিয়কে দুজন দেবতার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে; শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি স্তবকে (২ : ৪ : ৩ : ৬) ক্ষত্ৰিয় ইন্দ্র ও অগ্নিরূপে বৰ্ণিত। ক্ষত্রিয়কে যেমন ইন্দ্রের, তেমনি ব্ৰাহ্মণকে সোমের সমতুল্য করা হয়েছে। আবার তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে (৩ : ১২ : ৮ : ৪৯-৫০) বলা হয়েছে যে, সামবেদের সঙ্গে ব্ৰাহ্মণের, যজুর্বেদের সঙ্গে ক্ষত্ৰিয়ের এবং ঋগ্বেদের সঙ্গে বৈশ্যের সম্পর্ক্য। অন্যদিকে বসন্ত হল ব্ৰাহ্মণের, গ্ৰীষ্ম রাজন্যের এবং শরৎ বৈশ্যের ঋতু। গোপথ ব্ৰাহ্মণ উত্তরভাগে (২ : ২) মতে জন্মমাত্রই ব্ৰাহ্মণ পবিত্র গুণাবলীর অধিকারী; ব্ৰাহ্মণ্য গৌরব, খ্যাতি, নিদ্ৰা, ক্ৰোধ, শম ও দৈব সৌরভ। অন্য কোনো বর্ণের নরহত্যা তেমন পাপ নয়, কিন্তু ব্ৰাহ্মণকে হত্যা করার শান্তি মৃত্যুদণ্ড (শতপথ ব্রাহ্মণ : ১৩ : ৩.৫ : ৩); ব্রাহ্মণকে দক্ষিণাদ্বারা তৃপ্ত করা হলে যজ্ঞই তৃপ্ত হয়ে থাকে (তদেব, ৭ : ২ : ২৮)। বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণরা ‘নরদেব’ ব’লে গণ্য।

বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ দুমেজিল-এর মতে ত্রিস্তর বৈদিক সমাজ পুরোহিত, যোদ্ধা ও গো-প্ৰতিপালকদের মধ্যে বিভক্ত ছিল এবং ইতোমধ্যে তা যাজকতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। প্রাচীনতর সাহিত্যে আমরা ব্ৰাহ্মণ বা পুরোহিত, যোদ্ধা বা রাজন্য (বা ক্ষত্ৰিয়) এবং শূদ্রের উল্লেখ লক্ষ্য করি, তবে বৈশ্যের উল্লেখ পাই আরো দেরিতে; সম্ভবত এর কারণ এই যে, আর্যরা প্ৰাথমিক স্তরে যাযাবর ছিল এবং প্রাগাৰ্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই তারা কৃষিকার্যে নিরত হয়।

ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে পুরোহিতশ্রেণী ছিল সর্বাধিক সুবিধাভোগী। ক্ষমতা ও অবস্থানের সুদৃঢ় হওয়ার পরে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা কয়েক শতাব্দী ধরে নিজেদের প্ৰভুত্ব অব্যাহত রেখেছিল। সুবিধাভোগী অবস্থানে তাদের উত্থানের সূচনা দেখি ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে। পুরোহিতের ব্যক্তিত্ব ও সম্পত্তি ঔ অতিপবিত্র বলে বিবেচিত হ’ত; এর সম্ভাব্য কারণ এই যে, প্ৰাথমিক স্তরে এই গোষ্ঠী জ্ঞানী ব্যক্তির দ্বারা গঠিত হ’ত; যাদের কার্যাবলী সমাজের সর্বাধিক কল্যাণ বিধানে সমর্থ। তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধী ব্ৰাহ্মণের শান্তি বিধানের ব্যবস্থাও রয়েছে। সাধারণভাবে কোনো পুরোহিতকে অপরাধের জন্য গুরুদণ্ড দেওয়া হত না কিংবা তার সম্পত্তিও কোনোভাবেই স্পর্শ করা যেত না। পরবর্তী যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সঞ্চরণশীলতা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেলেও ব্রাহ্মণের যুগে তা কতকটা বর্তমান ছিল। এরজন্য শতপথ ব্ৰাহ্মণে [ ১০ : ৪ : ১; ১০ ] দেখা যায় যে, শ্যাপর্ণ সত্যকমের পুত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ব্ৰাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয় এবং কেউ বা বৈশ্য হয়েছিল।

সমাজে প্ৰতিপত্তির দিক দিয়ে ব্ৰাহ্মণদের পরেই ছিল ক্ষত্ৰিয়। রাজসভার সঙ্গে ঘনিষ্ট, ঐশ্বর্যশালী ও মর্যাদাবান ক্ষত্ৰিয় পরিবারের সদস্যরা উচ্চপদে নিযুক্ত হতেন, এবং এরাই ‘রাজন্য’ পদবীতে ভূষিত হতেন। যোদ্ধা, এবং রাষ্ট্র ও সম্পদের রক্ষকরূপে সমাজে ক্ষত্রিয়দের বিশেষ সম্মানিত আসন নির্দিষ্ট ছিল। ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি যতই সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে লাগল এবং ক্রমশ অধিক সংখ্যক বিষয়ে রাজারা ক্ষমতা অর্জন করতে লাগলেন, ততই একটি নূতন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হয়ে উঠল, মধ্যযুগীয় ইউরোপে গির্জার সঙ্গে রাষ্ট্রের যেমন সংঘাত দেখা দিয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনীয়ভাবে পুরোহিত্য-জাতি ও যোদ্ধাজাতির মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের বাতাবরণ এদেশেও সৃষ্টি হ’ল। এই দুটি জাতি দুটি ভিন্ন ধরনের শ্রেষ্ঠত্ব ভোগ করত : আধ্যাত্মিক ও পার্থিব। যজ্ঞই যেহেতু সে সময় ধর্মের প্রচলিত ও পরিচিত রূপ ছিল এবং যজ্ঞে অপরিহার্য ভূমিকা ছিল পুরোহিতের ও পৃষ্ঠপোষক যজমানের, তাই এই দুজনেই সমাজে সর্বাধিক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ দুজনের প্রত্যেকেই নিজেকে সমাজের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অঙ্গ ব’লে ভাবতে শুরু করেছিলেন বলে সমাজে। এ উভয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণভাবে ক্ষত্ৰিয়রা যে সর্বদাই ব্ৰাহ্মণদের তুলনায় বেশি ঐশ্বৰ্যবান ছিলেন, তার সমর্থন পাওয়া যায় তৈত্রিরীয় ব্ৰাহ্মণে (৩ : ৯ : ১৪ : ৫৪)। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে (৮ : ২৩) ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের দ্বন্দ্ব যে তীব্র হয়ে উঠেছে, তার আভাস পাওয়া পাওয়া যায়। পৃষ্ঠপোষকরূপে যজ্ঞের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে রাজারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলেন, কীভাবে তাঁদের রাজকোষ প্রত্যক্ষভাবে পুরোহিতদেরই ধনবৃদ্ধি ঘটাচ্ছিল এবং কীভাবে কোনো কোনো পুরোহিত জনসাধারণকে নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানসম্পর্কিত নতুন নির্দেশাবলীর ফলে পুরোহিতদের প্রাপ্য ও দাবি এমনভাবে বর্ধিত হ’ল যে, রাজ পুরোহিতদের প্রকৃত সম্পদই প্ৰভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেল। সম্ভবত এ-সময়েই রাজপুরোহিতদের ভূমিদান করার প্রথা প্রবর্তিত হয়েছিল; সুতরাং, ঐশ্বর্যবান পুরোহিতশ্রেণীর উত্থানকে ক্ষত্রিয় রাজা নিজ ক্ষমতার পক্ষে বিপদসূচক বলে মনে করতেন।

ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের যদিও প্রায়ই পরস্পরের উপর নির্ভরশীলরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তবু ক্ষমতা ও পাদপ্রদীপের আলোক অধিকারের জন্য প্রপ্তিদদ্বন্দ্বিতার ফলে কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো বা প্ৰকাশ্য বৈরিতার সূচনা হয়। বাস্তব জীবনে ব্রাহ্মণ যে অভাব বোধ করতেন, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তার বহুগুণ বেশি ক্ষতিপূরণ ঘটত— এই ছিল প্রচলিত ধারণা। অন্তর্দেশীয় সমৃদ্ধি ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রসারেরর সঙ্গে সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা এবং বৈভব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল—বিশেষত রাজা ও অভিজাতবর্গের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত বিপুল আড়ম্বর এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রজাসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি পর্যবেক্ষণ করে ব্ৰাহ্মণরা নিশ্চিতই প্ররোচিত বোধ করেছিলেন। আবার, তাদের সমস্ত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা সত্ত্বেও রাজা ও তার অভিজাত পারিষদবর্গ ব্ৰাহ্মণের আধ্যাত্মিক শক্তি ও তাজনিত দম্ভের সম্মুখীন হয়ে নিশ্চিত ক্ষুব্ধ বোধ করতেন। শতপথ ব্ৰাহ্মণে [ ১১ : ৬ : ২ : ৫ ] জনকের বিতর্কসভা (ব্ৰহ্মোদ্য) সম্পর্কে ব্ৰাহ্মণদের প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তিতে এর আভাস রয়েছে।

নৌ-বাণিজ্যের শ্ৰীবৃদ্ধির ফলে প্রাথমিক পুঁজি বৈশ্যদের হাতে কেন্দ্রীভূত হ’ল; তা সত্ত্বেও তিনটি আর্য বর্ণের মধ্যে এরাই ছিল নিম্নতম। এদের বিপুল ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য সমাজে যে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রমাণ রয়েছে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের একটি নির্দেশে [ ৩ : ৯ : ৭ : ৩২ ] : ‘বৈশ্যের পুত্রকে (রাজপদে) অভিষিক্ত করবে না।’ আদিত্য, রুদ্র ও বসু-এই গণদেবতাদের মধ্যে বিভিন্ন কৌমের প্রতিফলন দেখা যায়; তাদেরও আবার যথাক্রমে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে কৌমগুলি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছিল, যদিও তাঁদের মধ্যে চিরাগত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল অব্যাহত; তার ইঙ্গিত ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বেশ কিছু স্থানে পাওয়া যায়। আবার, কিছু কিছু অস্পষ্ট আভাস থেকে মনে হয়, অন্তত বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বর্ণগত সঞ্চরণশীলতা অক্ষুন্ন ছিল। ঋষি মেধাতিথি বৎসকে অব্রাহ্মণ, শূদ্র নারীর পুত্র বলে অভিহিত করেছিলেন। বিতর্ক মীমাংসার জন্য তারা নিজেদের মন্ত্রসহ অগ্নিপ্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই অগ্নিপরীক্ষায় বৎস শ্রেষ্ঠতর ব্রাহ্মণরূপে প্রমাণিত হয়েছিলেন [তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণ ১৪ : ৬ : ৬ ]। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, শূদ্রার পুত্ৰও জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ ঋষি মেধাতিথির তুলনায় প্রশংস্যতার ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হয়েছিলেন; যদিও এই মেধাতিথি বৈদিক সুক্তেরও রচয়িতা।

শূদ্র উচ্চতর তিনটি বর্ণের ভৃত্য, অস্থাবর সম্পত্তি, এমনকি মাঝে মাঝেই ক্রীতদাসররূপে বৰ্ণিত হয়েছে। মহাব্ৰত অনুষ্ঠানের অন্তৰ্গত ছদ্ম যুদ্ধে একটি গোলাকৃতি চর্মখণ্ডের জন্য ব্রাহ্মণ ও শূদ্র পরস্পরের সঙ্গে বিসংবাদে প্ৰবৃত্ত হত; তখন অনুষ্ঠানের খাতিরে তারা পর্যায়ক্রমে পরস্পরকে দোষারোপ ও প্রশংসা করত [তৈত্তিরীয় ১ : ২ : ৬ : ৫০ ]। কিন্তু এটা এমন বেশি মাত্রায় প্রথা সিদ্ধ আনুষ্ঠানিক কর্ম যে, এর মধ্য থেকে সম্ভাব্য কোনো প্রকৃত ঐতিহাসিক সূত্র আবিষ্কার করা খুব দুরূহ। এই বিবৃতির শেষে শূদ্রের উৎপত্তি স্পষ্টভাবে প্রদত্ত হয়েছে : ‘শূদ্ৰ অসুর উৎসজাত।’ অর্থাৎ পরাজিত আদিম অধিবাসীদের মধ্য থেকেই শূদ্রের উৎপত্তি। কৌষীতকি ব্রাহ্মণে [ ২৭ : ১ ] বারাঙ্গনা অপেক্ষাও হীন ও অস্পৃশ্য বলে শূদ্র নারীকে বর্ণনা করা হয়েছে। শূদ্র বর্ণের কাছ থেকে অগ্নিকে অপসারিত করার কথা বলেছে শতপথ ব্ৰাহ্মণ [ ৬ : ৪ : ৪ : ৯ ]। সোম যাগের জন্য দূরবতী পার্বত্য অঞ্চল থেকে সোম সংগ্ৰহ করত শূদ্রেরা; বিনিময়ে যে গোবৎসটি তারা মূল্য হিসাবে লাভ করত, তাও মধ্যপথে প্ৰহার করে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হ’ত [ কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণ ১৭ : ১ ]। তৎকালীন সমাজে শূদ্ৰদের বিড়ম্বিত জীবনের সুস্পষ্ট চিত্র এখানে পাওয়া যাচ্ছে। অস্থাবর সম্পত্তিরূপে পরিগণিত শূদ্ৰদের শ্রম ও তাদের দ্বারা উৎপাদিত সমস্ত কিছুই আৰ্যসমাজের অপর তিন জাতির দ্বারা শোষিত হত,–কেননা তাদের পিতৃপুরুষেরা আর্য আক্রমণের বিরোধিতা করেছিল ও যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিল। আৰ্য সংস্কৃতির বৃত্তবহির্ভূত হওয়ার ফলে যজ্ঞে যেহেতু শূদ্ৰদের কোনো স্থানই ছিল না, তাই তাদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য নানা তিৰ্যক উল্লেখের মধ্যে থেকে প্রসঙ্গক্রমে পাওয়া যায়। তবে, ‘ধর্মসূত্র’ রচিত হওয়ার পূর্বে শূদ্ৰদের পৃথক বর্ণরূপে স্বীকার করা হয় নি; রচনাগুলিতে তাদের সামাজিক অবস্থানের হীনতা সমর্থিত হয়েছে।

শূদ্ৰদের প্রতি সমাজের সর্বাধিক ঘূণাসূচক মন্তব্য সম্ভবত তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণে [ ৫ : ৮ : ১১ ] পাওয়া যায় : ‘শূদ্র যজ্ঞের উপযুক্ত নয়, তার কোনো দেবতা নেই, কোনো দেবতা কখনো তাকে সৃষ্টি করেন নি; সুতরাং শুধুমাত্র অন্য সকলের পদপ্রক্ষালন করেই তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।’ সমস্ত গ্ৰন্থই অন্তত এই ব্যাপারে একমত যে, শূদ্রের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক তৈরি করে কোনো দেবতাকে দূষিত করা উচিত নয়। শূদ্রের অনার্য উৎস ও ফলত আৰ্য দেবতার সঙ্গে তার সম্পর্কহীনতা, ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত; ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের বহু অংশে দেবতাদের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত করে শূদ্রকে সমাজে অপাঙক্তেয় প্রতিপন্ন করার সচেতন প্ৰয়াস স্পষ্ট; কেননা, সে যুগে দৈবসম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতির প্রকৃত সমর্থনরূপে বিবেচিত হত। শতপথ ব্ৰাহ্মণে ।[ ১৪ : ১০১ : ৩১ ] বলা হয়েছে : ‘নারী, শূদ্ৰ, কুকুর ও কালো পাখি হ’ল অসত্য, পাপ ও অন্ধকার—তাই তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিত নয়।’ রচয়িতা নারীবিদ্বেষী ছিলেন কিনা এবং নারীর প্রতি সত্যই দৃষ্টিপাত করা হত না কিনা, এই নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু শূদ্রের প্রতি অমানবিক ঘূণা যে সমাজের প্রচলিত রীতি ছিল, তাতে কোনো সংশয় নেই।

মহব্ৰত যজ্ঞে ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্ৰদের পারস্পরিক নিন্দাবাদের সময় শূদ্রেরা ব্ৰাহ্মণদের ‘ধনী অদাতা’ রূপে সম্বোধন করে থাকে। সমাজে জাতিভেদের মতোই ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিভাজনও সমান তীব্র ছিল; স্পষ্টতই শূদ্রেরা উভয় দিক দিয়েই সর্বাধিক নিপীড়িত হত। তাই, আমরা ধনী ব্ৰাহ্মণ, ধনী ক্ষত্রিয় ও ধনী বৈশ্যের কথা শুনি, কিন্তু প্ৰায় কখনোই ধনী শূদ্রের কথা শুনি না। ধন যে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের নিয়ামক হয়ে উঠছে, তার প্রমাণ পাই তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে (১ : ৪ : ৮ : ৪৫)। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার সমাজে ধন ও স্বর্ণের আকাঙক্ষা প্ৰবল হয়ে উঠেছিল। এবং যজ্ঞ আয়োজনের পক্ষে তা বাস্তব প্রেরণাররূপে সক্রিয় থাকত। গৃহ, আত্মীয়, শস্য, গোধন, অশ্ব, রথ ইত্যাদির প্রাপ্তিও যজ্ঞের ফলরূপে বিবেচিত হত। সমাজের অল্পসংখ্যক লোকই যেহেতু ঐশ্বৰ্যবান হতে পারত, তাই অন্যদের মধ্যে ধনলাভের প্ৰবল আকাঙক্ষা এবং ক্ষতি বা হানির বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন প্রকার শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচুর প্রার্থনা রচিত হয়েছে। অসুর ও রাক্ষসদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত তীব্র নিন্দাসূচক উক্তিতে ‘ব্রাহ্মণগুলি পরিপূর্ণ; তাদের সঙ্গে শূদ্ৰদের একমাত্র পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্তরা তখনও আর্যদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু শূদ্ররা, বিশেষত ক্রীতদাসেরা, পরাজিত শত্রুরূপে এমন এক সন্ধিপত্রে অলিখিতভাবে স্বাক্ষর করেছিল, যার প্রত্যেকটি শর্ত তাদের পক্ষে হীনতাপূর্ণ অপমানকে চিরস্থায়ী করেছিল। সাধারণত তারা নিতান্ত সামান্য অর্থের বিনিময়েই পরিশ্রম করত, মাঝে মাঝে নামমাত্র বেতনই পেত। কিন্তু ক্রীতদাসদের জন্য কোনরকম বেতনের ব্যবস্থাই ছিল না। তীব্র দারিদ্র্য, অবিরাম দাসত্ব এবং ব্যক্তি বা সম্পত্তিতে অনধিকারের ফলে শোষক প্ৰভুদের বিরুদ্ধে ফলপ্ৰসূ বিদ্রোহ ঘোষণা করা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হ’ত না।

তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণের অষ্টাদশ অধ্যায়ে ব্রাত্যদের সম্পর্কে একটি দীর্ঘ পরিচ্ছেদ রয়েছে। অথর্ববেদের পঞ্চদশ অধ্যায়েও ব্রাত্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্ৰাহ্মণে ব্রাত্যদের বর্ণনায় প্রত্যেকটি অনুপুঙ্খ স্পষ্টভাবে নির্দেশিত। যদিও ব্রাত্যদের সকলেই রাজপদবীর অধিকারী ছিলেন না, তবুও তাদের সম্বন্ধে বিবরণে সমৃদ্ধিশালী কৌম রাজার আড়ম্বরপূর্ণ বর্ণনা আমরা লক্ষ্য করি। গৃহস্থরা ব্রাত্যদের যে দানসামগ্ৰী অৰ্পণ করতেন, তাতে প্ৰত্যেকটি দ্রব্য ছিল বিলাসিতার প্রয়োজনে ব্যবহৃত। অতিথিরূপে ব্রাত্যদের অবস্থান থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, এরা প্রকৃতপক্ষে কোনো অবৈদিক আৰ্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অথর্ববেদেও ব্রাত্যরা সম্মানিত, বিশেষত জ্ঞানী ব্রাত্যের সাহচৰ্য আর্য রাজার পক্ষেও কাম্য ছিল। এই ব্রাত্যদের পরিচয় যাই হােক না কেন, অথর্ববেদে দেখি তারা রক্ষণশীল বৈদিক ধর্মের অনুসরণ করতেন না। কিন্তু তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণে ব্রাত্যদের অবস্থান ভিন্নতর। সামগীতিপূর্ণ সোমযাগের মর্যাদা যখন খুবই প্ৰবল, সেই সময়কার একটি সামবেদীয় ব্রাহ্মণের ব্রাত্যদের অবস্থান সমাজের নিম্নতম সোপানের কাছাকাছি বলে নির্দেশিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এরা ব্ৰাহ্মণদের খাদ্য ও সম্পদ লুণ্ঠন করে, এদের ব্রাহ্মণ বা বৈশ্য শ্রেণীর অন্তৰ্গত করা যায় না। ব্রাত্যরা অদীক্ষিত হয়েও পবিত্র বৈদিক ভাষায় কথা বলে। কৃষিকাৰ্য বা বাণিজ্য তাদের জীবিকা নয় এবং তাদের পোষাকও খুব উদ্ভট। এই ও ঘূণার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করতে পারা যায়, যদি ব্রাত্যদের আর্য জনগোষ্ঠীর প্রাচীনতর অর্থাৎ অবৈদিক অংশরূপে গ্ৰহণ করি, যারা বৈদিক আৰ্যদের পূর্বে কোনো প্রাচীনকালে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সংখ্যায়। এদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং প্ৰাগাৰ্যদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিবর্তে তাদের সহাদয় আতিথ্যলাভ করেছিলেন। বিখ্যাত গবেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই অভিমতই পোষণ করতেন। আদিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এই ব্রাত্যদের অধিকমাত্রায় সংমিশ্রণ ঘটেছিল বলে তারা বৈদিক আৰ্যদের শত্রুপক্ষে পরিণত হয়েছিলেন, আবার তাদের আর্য পরিচয়ও যেহেতু অক্ষুন্ন ছিল, তাই নবাগতদের পক্ষে তা অস্বন্তি ও বিরক্তির কারণ হওয়ায় দ্বিধান্বিত প্ৰতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।

Category: ৫. ব্রাহ্মণ - পঞ্চম অধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ১৩. নারী (ব্রাহ্মণ)
পরবর্তী:
১৫. সামাজিক আচার (ব্রাহ্মণ) »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑