১১. অর্থনীতি (ব্রাহ্মণ)

অর্থনীতি (ব্রাহ্মণ)

ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গক্রমে সমকালীন ব্যবসা, বাণিজ্য ও বহুবিধ প্রচলিত বৃত্তি সম্পর্কিত তথা আমাদের কাছে উপস্থাপিত করেছে। আমরা জানি যে, এই যুগে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়,–আৰ্যদের বিজয়লাভের পরে যা সাময়িকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছিল। এমন কি, দেশের মধ্যেও কুটীরশিল্প ও প্রধান শিল্প বহুগুণ বধিত হওয়ার ফলে সামাজিক শ্রেণী ও জাতিভেদ আরো পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বিনিময়ভিত্তিক অর্থনীতির স্থান ধীরে ধীরে মুদ্রা ও স্বর্ণভিত্তিক ক্রয়বিক্রয় রীতি দ্বারা অধিগৃহীত হ’ল। যজ্ঞের প্রয়োজনে সোম ক্ৰয়ের একটি প্রতীক আমাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে বাণিজ্যকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদানের প্রমাণ পাওয়া যায় [৩ : ৩ : ৩ : ১]।

তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে পুরুষমেধের বর্ণনায় তৎকালীন বৃত্তিগুলির সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মূল্যবান নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। প্রায় ৯৩ রকম পেশার উল্লেখ থেকে শ্রমের অসংখ্য উপবিভাগের বিস্ময়কর নিদর্শন এ-অংশে বিবৃত রয়েছে। এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র এখানে পরিস্ফুট, যা তৎকালে সংখ্যা, আকৃতি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে ক্রমবর্ধমান নগরগুলির প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ ছিল। সেই সঙ্গে সে যুগের বাস্তব জীবনের মান এবং ঐশ্বর্যশালী বণিকশ্রেণী ও সমাজের অন্যান্য সমৃদ্ধ অংশের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন সম্পর্কেও আমরা একটি ধারণা পাই।

সমগ্ৰ ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে আমরা ‘জ্ঞান’ অর্জনের পক্ষে সহায়ক একটি মানসিক পরিমণ্ডল দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে এই যুগেই জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্ৰ কৰ্ষিত ও উন্মোচিত হচ্ছিল। অন্তিম পর্যায়ের সামবেদীয় ব্রাহ্মণগুলিতে বহুবিধ রোগ উল্লিখিত; কিন্তু অথর্ববেদ পাঠ করে আমাদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, ঐন্দ্ৰজালিক আবেশসৃষ্টির পাশাপাশি রোগনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাও চলছিল। ওষধি, মণিরত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক নির্দেশ সম্ভবত স্বভাব বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণত ঐন্দ্ৰজালিক ছিল না। গোপথ ব্ৰাহ্মণ উত্তরভাগের একটি বাক্যে [ ১ : ১৯ ] রোগ পর্যবেক্ষণ চমৎকার প্রমাণ রয়েছে : ‘বিভিন্ন ঋতুর সন্ধিকালেই রোগ বর্ধিত হয়।’ বিজ্ঞানরূপে চিকিৎশান্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় শেষ পর্যায়ের সমাবেদীয় ব্ৰাহ্মণগুলিতে।

আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনেই জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছিল; মিশর ও ব্যাবিলনের প্রভাবে এদেশে জ্যোতিবিদ্যা চর্চার শুরু। তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণের একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়। তারকাপুঞ্জের বিবরণ দিয়েছে। অধ্যয়নের বিষয়বস্তুরূপে তালিকায় দেওয়া হয়েছে চার বেদ, ইতিহাস, লোকশ্রুতি, বীরদের এবং ঋষিদের সম্বন্ধে উপাখ্যান, ব্যাকরণ ও দর্শন। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ এই তালিকার সঙ্গে সাপবিদ্যা ও উপদেবতা বিষয়ক জ্ঞানকে যুক্ত করেছে। এছাড়া, আমরা দেখেছি যে, স্থাপত্য, ধাতুবিদ্যা ও জ্যামিতিরও তৎকালীন ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ

ভূমিক ছিল।

ব্ৰাহ্মণযুগের বস্তুগত সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হ’ল ধাতুবিদ্যায় লক্ষণীয় অগ্ৰগতি। সিন্ধু সভ্যতার ভগ্নাবশেষ থেকে বহু ধাতুর ব্যবহার প্রমাণিত হয়। আক্রমণকারী আর্যরা ধাতু গলানো ও ধাতুশিল্পের বিজ্ঞান পরাজিত জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে শিখেছিল, আর সম্ভবত প্ৰথম পর্যায়ে তাদের মধ্য থেকে কারুশিল্পীদের নিয়োগ করেছিল; এরাই ছিল শূদ্ৰ, দাস ও দস্যু যারা উত্তরাধিকারক্রমে আর্যদের জন্য শিল্প ও কারুশিল্পের একটি ধারা গড়ে তুলল। শতপথ ব্রাহ্মণে দেখছি [ ৫ : ৪ : ৪ : ২২ ] যে, রাজসূয় যজ্ঞের উদগাতা একটি সোনার হাতা পেতেন, হােতা পেতেন সোনার থালা আর দুজন অধ্বর্যু দুটি সোনার আয়না পেতেন। গোপনব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ১ : ২৪-২৬ ] থেকে সোনা, রূপা, লোহা, সীসা ও টিন-এর কাজ সম্পর্কে ইঙ্গিত এবং ধাতুগুলিতে রাসায়ণিক ও তাপ-প্রয়োগের উল্লেখ পাচ্ছি। জৈমিনীয় উপনিষদব্ৰাহ্মণ [ ৪ : ৩ : ৩ ] থেকে ধাতু গলানো ও খাদ মেশানোর পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হই। আবার তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণের একটি কাহিনীতে [৩ : ১১ : ৮ : ৪৮-৪৯] সোনা গলানোর অসুবিধাগুলির উল্লেখ আছে। কাঠ ও চামড়ার কাজ সম্পর্কেও বেশ কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় ( যেমন তৈত্তিরীয় ১ : ৪ : ১ : ৩, ৪ ]।

ব্রাহ্মণসাহিত্যে সেই সমাজের চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে যেটি মাংসাশী যাযাবর পশুপালক স্তর থেকে নব্য বিশ্ববীক্ষাসম্পন্ন, নিরামিষাশী কৃষিজীবী স্তরে বিবর্তিত হচ্ছিল–কেননা মেসোপোটামিয়ার মতোই নদীবিধৌত ব্ৰহ্মার্ষিদেশে ও উপত্যকাতেও কৃষিকাজ ছিল খুবই সহজ ও লাভজনক বৃত্তি। অপেক্ষাকৃত সংখ্যাগুরু জনতা স্বভাবত খাদ্যশস্য উৎপাদনে অধিক মনোযোগী ছিল কেননা এখানকার মধ্যম-শ্রেণীর জমিতেও ফসল ভাল হত। জনগোষ্ঠী এভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় পর্যায়ের পশুচারী অশ্বারোহী অবস্থা থেকে নব্য গোপালক শস্যভোজী পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সমগ্ৰ ব্ৰাহ্মণ – -সাহিত্যে গোষ্ঠীর সম্পত্তির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রূপে ধেনু স্বীকৃত হয়েছে; এছাড়া বাহন, কৃষির সহায় ও ভারবাহী পশু কিংবা খাদ্য ও যজ্ঞীয় বলি–বিশেষত দক্ষিণারূপে–ঘোড়া, ষাঁড়, বলদ, হাতি, গাধা, খচ্চর, গোরু, বাছুর, ভেড়া ও ছাগলের উল্লেখ লক্ষ্য করি। জনসাধারণ পর্যাপ্ত গোসম্পদ কামনা করত; এই লক্ষ্য মনে রেখেই তারা যজ্ঞের আয়োজন করত–আর, সমাজ বিপুল গোসম্পদের অধিকারীকেই ধন্যবান বলে গণ্য করত ।