০৯. দেবসঙ্ঘ

০৯. দেবসঙ্ঘ

ঋগ্বেদের দেবতারা যদিও অথর্ববেদেও উপস্থিত রয়েছেন, তথাপি ভাগ, অর্যামা, অংশ, দক্ষ, মার্তণ্ড, অদিতি এবং দেী-এর মতো যে সমস্ত গৌণ দেবতা। ঋগ্বেদের পর্যায়েই স্নান হয়ে গিয়েছিলেন, অথর্ববেদে তারা আরও ছায়াবৃত ও প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃতি। এইসব দেবতারা ঋগ্বেদ থেকে সরাসরি অথর্ববেদে এসে পৌঁছেছিলেন এবং প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই ঋগ্বেদের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে অথৰ্ববেদের সূক্তগুলির শিরোদেশে যান্ত্রিকভাবে তাদের আরোপ করা হয়েছিল। কেননা মৌলিক অথর্ববেদীয় সুক্তিগুলি স্বভাববৈশিষ্ট্যে ঐন্দ্ৰজালিক হওয়ার ফলে এগুলি প্রকৃত অর্থে দেবতার প্রভাবের বাইরে অবস্থিত। ঋগ্বেদের তুলনায় অথর্ববেদে অগ্নির অনেক বেশি কার্যকলাপ ও নাম রয়েছে। যেমন :–রক্ষোদ্ম, সপত্নহ, দস্যুনাশন, পাপমোচন ও শালাগ্নিদৈবতা। ঋগ্বেদের আপ্রীসূক্তেব, মতো অগ্নির আরও বহু ধরনের নাম ও বিশেষণ আমরা পাই। অগ্নির উপর অথর্ববেদে এই যে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা ইরাণীয় অগ্নিবাচক ‘অথর্‌’ ও অগ্নিচর্যর পুরোহিত অথর্বার অন্তর্লীন সম্পর্কের কথা বিবেচনা করতে পারি। পূর্বেই দেখেছি অথর্ববেদের তিনটি রচয়িতা বংশ–অথর্বা, ভৃগু ও অগ্নির–বুৎপত্তিগতভাবে অগ্নির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পূক্ত।

অথর্ববেদের বহু সূক্ত যেহেতু ঋগ্বেদ থেকে সরাসরি ঋণ হিসাবে গৃহীত, তাই এগুলির সঙ্গে সহগামী দেবতারাও অনিবাৰ্যভাবেই এখানে উপস্থিত। ব্রাত্যসূক্তের সঙ্গে আমরা মহাদেবকে (ঈশান বা শিব নামে) পাই, যার শারীরিক বর্ণন র মধ্যে পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিশ্লেষণ নীললোহিতের পূর্বভাস সূচিত হয়েছে। অথর্ববেদের মধ্যে বৈদিক সাহিত্যের মূলধারা ইতোমধ্যেই ইতিহাস, গীতিকা ও বিখ্যাত পুরুষদের সম্পর্কে লোকশ্রুতি দ্বারা সমৃদ্ধ হতে শুরু হয়েছে। বেদ এবং বেদমাতা সম্পর্কিত ধারণা যে অথর্ববেদে দেবতায় পরিণত হয়ে গেছে, তার মধ্যে সম্ভবত সংহিতা সাহিত্য রচনার সমাপ্তি ও পবিত্র লোকোত্তর শাস্ত্ররূপে তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার প্রমাণ স্পষ্ট। অথর্ববেদে রুদ্রদেবের সঙ্গে যে সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত, তা ঋগ্বেদে দেখা যায়নি; তাই, তিনি এখন বাণিজ্য-যাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং গৃহ, শস্য, ক্ষেত্র ও জলাধার থেকে সর্প, কুকুর, শৃগাল, বাজপাখি, অজগর, মশামাছি ইত্যাদি বিতাড়ন করেন। দেবতাদের পাশাপাশি বিচিত্র ধরনের অর্ধদেবতা, ভূতপ্ৰেত, সৰ্প, অন্সরা ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়। লোকায়াত ধর্মের লঘু ঐতিহ্যের অন্তৰ্গত অথর্ববেদ বোদরূপে স্বীকৃতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে লোকমানসের গহনে নিহিত জনপ্রিয় প্রত্নকথার একটি সমগ্ৰস্তর যৌথ অবচেতন থেকে উখিত হয়ে সচেতন সাহিত্য-রচনায় স্থানলাভ করে। ‘মধুকশা” নামক রহস্য-গৃঢ় ধর্মচৰ্যার সঙ্গে অস্বীদের সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। ভৃগুর সঙ্গে সম্পর্কিত ও অথর্ব-ধারার অন্তর্গত দধ্যঙ্‌ ঋষি এই গোপন মধুবিদ্যার তত্ত্ব অশ্বীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন।