০৭. সূক্তসমূহের শ্রেণী বিন্যাস

সূক্তসমূহের শ্রেণী বিন্যাস

আমরা ইতোমধ্যে সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে রচিত সূক্তগুলিকে নিম্নোক্তভাবে বর্গীকরণ করেছি : (১) শারীরিক কল্যাণ, (২) দৈনন্দিন জীবনে কল্যাণ, (৩) পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ, (৪) রাজকীয় ও সৈন্যবাহিনী সংক্রান্ত, (৫) ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সম্পর্কিত, (৬) সৃষ্টিতত্ত্ব, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক এবং (৭) ঐন্দ্ৰজালিক মায়া।

শারীরিক কল্যাণ বিষয়ক সুক্তিগুলিতে তৎকালীন জনসাধারণের মধ্যে যেসব ব্যাধির প্রকোপ দেখা যেত তার উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে আছে ক্ষয়রোগ, হৃদরোগ, ম্যালেরিয়া, সর্দি-কাশি, রক্তাল্পতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব, জ্বর, পাণ্ডুরোগ, কৃমি, কেশনাশ, বিভিন্ন রকমের ব্যথা এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের পক্ষাঘাত। এইসব ব্যাধির অধিকাংশেরই মূলে রাক্ষস বা ভূতপ্ৰেত–এই বিশ্বাস তখন প্রচলিত ছিল।

এইজন্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান এদের বিরুদ্ধেই প্ৰযুক্ত হত এবং মন্ত্রগুলি প্ৰেতবিতাড়নের জাদুকৌশল ছিল বলে মনে হয়। রক্তপাত, অতিরিক্ত সোমপানজনিত ব্যাধি, শারীরিক যন্ত্রণা, উন্মত্ততা, আকস্মিক দুর্ঘটনা, বিষক্রিয়া, সৰ্পদংশন, শিশুর দান্তোদগম প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের জন্য ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়া কিংবা প্রার্থনা প্ৰচলিত ছিল। বহু ঔষধি, ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থ, গ্ৰহরত্ন, রক্ষাকবচ ইত্যাদির প্রস্তুতি ও প্রয়োগের জন্য নানাবিধ ইন্দ্ৰজাল প্রয়োগ করা হত। এ সমস্ত বিষয়ের অধিকাংশই অথর্ববেদের নিজস্ব বিষয় নয়। কিন্তু শাস্ত্রে এদের অন্তর্ভুক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শাস্ত্র রচনার মূলপর্ব যখন সমাপ্ত হতে চলেছিল, বৈদিক যুগের সেই অস্তিম পর্বেই এইগুলি সংকলিত।

বাস্তবজীবনের কল্যাণকামনায় প্রযুক্ত সূক্তগুলিই সংখ্যায় সর্বাধিক; এদের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘজীবন ও সম্পত্তির জন্য প্রার্থনা (আয়ুষ্য ও পৌষ্টিক), স্থাপত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, বৃক্ষলতা ও প্রাণীসমূহের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা, নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা, আকস্মিক আঘাত, সৰ্প ও বিষাক্ত কীটের দংশন থেকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা ইত্যাদি। সাধারণভাবে এইসব প্রার্থনা নবপ্রতিষ্ঠিত কৃষিজীবীদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যারা সুনির্মিত গৃহে বাস করত, কৃষির প্রয়ােগিক দিকসম্পর্কে অবহিত ছিল, বৃক্ষলতা ইত্যাদির প্রয়োজন অনুভব করে তাদের প্রতি যত্নবান ছিল এবং যারা পশুপালন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করত।-সম্ভবত, সেই প্রয়োজনেই গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে তাদের মধ্যে নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছিল।

সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের কাছ থেকে আর্যরা পোড়া ইটের সাহায্যে গৃহনির্মাণপদ্ধতি শিখে নিয়েছিলেন। অথর্ববেদে গৃহনির্মাণের বিভিন্ন উল্লেখ থেকে স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে আর্যদের আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণভাবে যে অর্থনৈতিক চিত্র এখানে পরিস্ফুট, তা থেকে বোঝা যায় যে, নিতান্ত প্ৰাথমিক স্তরে থাকলেও বিত্তবান শ্রেণীর দ্বারা নির্বিত্তের শ্রমশক্তির শোষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে; ফলে, প্ৰাথমিক উৎপাদক আর ধন ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে পারছে না, এবং তাদের শ্রমের ফল থেকে বঞ্চিত করার জন্যে একটি উপস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে। অথর্ববেদে ব্যবহৃত ‘বন’ শব্দটির অর্থ বিক্রয়মূল্যের অংশ; এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুনাফা সম্পর্কিত ধারণা ও তার বাস্তব অভিব্যক্তি তখনকার সমাজে পরিচিত ছিল।

পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণবিষয়ক সূক্তগুলিতে আমরা পারিবারিক শান্তির জন্যে প্রার্থনা (সাংমনস্য), দাম্পত্য সম্পর্কে এবং মহিলাদের নিজস্ব প্রয়োজন নিবৃত্তির জন্যে প্রার্থনা (স্ত্রীকর্ম) এবং গর্ভধারণ ও প্রসবসময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাধিগুলির উপশমের জন্যে প্রার্থনা লক্ষ্য করি। গর্ভবতী রমনী ও নবজাত শিশুর জন্যে তখনকার সমাজের বিবিধ ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল,–দানব ও অপদেবতাদের বিতাড়িত করাই ছিল এগুলির লক্ষ্য। অথর্ববেদের সমকালীন ঋগ্বেদের একটি সুক্তে (১০ : ১৬২) অথর্ববেদের মতই গাৰ্হস্থ্য বিষয় বর্ণিত; সেখানে আসন্নপ্রসবা নারীর নিরাপত্তার জন্যে অপদেবতাদের বিতাড়নের কথা বলা হয়েছে। তখনকার সমাজে যেহেতু জনসংখ্যার বৃদ্ধি অভিপ্রেত ও প্রয়োজনীয় ছিল, তাই বন্ধ্যাত্বকে সমাজ অভিশাপ বলেই জ্ঞান করত। উপযুক্ত মন্ত্র ও ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে বন্ধ্যাত্বি দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুমান করা যেতে পারে, সমগ্র অথর্ববেদ বৈদিক ধৰ্মচর্যার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বহু স্ত্রী-আচার মূলত নারীসমাজের দ্বারাই আচরিত ও পরিচালিত হত।

অন্যদিকে বহুপত্নীক স্বামীর অবিভক্ত প্রেম ও মনোযোগ লাভ করার জন্যে প্রার্থনা এবং প্ৰণয়িনীর প্ৰেম-অধিকারের জন্যে স্বামী বা প্রণয়ীর প্রার্থনাও চােখে পড়ে। শ্ৰীকর্ম বিষয়ের সূক্তগুলির মধ্যে রয়েছে স্পষ্টত প্ৰণয় আকর্ষণের উদ্দেশ্যে জাদুক্ৰিয়া-ঈপ্সিত প্রণয়ীর চিত্ত জয় করার জন্যে বা শীতলহাদয় প্রণয়ীর হৃদয়ে প্ৰেম উদ্রেক করার জন্যে সম্ভবত প্ৰণয়বর্ধক পানীয়, প্রলেপ ও রক্ষাকবচ ব্যবহার করা হােত। পিতৃগৃহ-নিবাসিনী পরিণতবয়স্কা অনূঢ়া কন্যারও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে কিছু কিছু প্রার্থনা আছে। স্পষ্টতই সেই সময় বিবাহ সকল নারীর পক্ষেই আবশ্যিক বলে সমাজে বিবেচিত হত এবং অনূঢ়া যুবতী সমাজের দৃষ্টিতে কণ্টক-স্বরূপ হয়ে উঠত; কুলপা কন্যারাপে তার উপস্থিতি তাই তাৎপৰ্যপূর্ণ। অধিকতর সমৃদ্ধি ও সম্পত্তির বৃদ্ধির ফলে সামাজিক ক্ষমতা সম্পূর্ণতই পুরুষের অধিগত হয়ে পড়েছিল; অনূঢ়া নারীর সম্পত্তির অধিকার বিতর্কের বিষয়বস্তু হওয়ার ফলে সেই নারী অনিবাৰ্যভাবেই সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছিল।

স্ত্রী-আচারগুলিতেও প্রণয়সম্পর্কিত জাদুতে সাধারণত অগ্নি যে আহুত হতেন, সম্ভবত তার কারণ এই যে, আবেগের প্রতীকী প্ৰকাশ হওয়া ছাড়াও তিনি প্রতিকূল দানবশক্তির বিরুদ্ধেও কার্যকরী ছিলেন।