২৭. মৌখিক সাহিত্যরূপে ঋগ্বেদ

মৌখিক সাহিত্যরূপে ঋগ্বেদ

প্ৰাচীনতম মৌখিক সাহিত্যের নিদর্শনগুলির মধ্যে যে সমস্ত রচনা পর্যাপ্ত পরিমাণে সংরক্ষিত হয়েছিল, ঋগ্বেদসংহিতা তাদের অন্যতম। হােমারের দুটি মহাকাব্য এবং রামায়ণ ও মহাভারতের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে গীতিকবিতা, গীতিকা ও সূক্তের সংকলনরূপে ঋগ্বেদ গড়ে উঠেছে এবং মহাকাব্যের পূর্ববর্তী মৌখিক কবিতার রূপ ও চরিত্র অনুশীলনের একটি বিরল সুযোগ আমাদের কাছে তুলে ধরেছে। মৌখিক কাব্যের স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী ঋগ্বেদের প্রথম পর্যায়ে প্রশস্তি ও স্তুতিগানের সরল পদ্ধতিরূপে ছন্দোরীতির উৎপত্তি হয়েছিল; কালের গতিতে ছন্দের জটিলতা ও দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাই ‘গায়ত্রী’ (গান করা অর্থে ‘গৈ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত ছন্দের নাম) নামের মধ্যে রয়েছে গানের অনুষঙ্গ, তেমনি ‘প্রগাথ’ কথাটির অর্থ প্রকৃষ্টরূপে গীত। স্তুভ্‌-ধাতু নিষ্পন্ন ‘ত্ৰিষ্টুভ্‌’ ও ‘অনুষ্টুভে’র মধ্যে রয়েছে প্রশস্তির দ্যোতনা কেননা এই দু’টি নামের তাৎপর্য যথাক্রমে ‘তিনবার স্তুতি’ ও ‘পরবর্তী স্তুতি’ । লক্ষণীয় যে, গায়ত্রী, ত্ৰিষ্টুভ্‌ ও অনুষ্টুভ্‌ প্রাচীনতম ছন্দরূপে পরিগণিত; যদিও গায়ত্রী, অনুষ্টুভ্‌ ও পঙক্তি ও মহাপঙক্তির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল-প্রত্যেকের আটটি করে অক্ষর যথাক্রমে তিন, চার, পাঁচ ও ছয়টি চরণ রয়েছে। আবার বিরাজ, ত্ৰিষ্টুভ্‌ ও জগতী ছন্দে প্ৰত্যেকটির রয়েছে চারটি চরণ এবং যথাক্রমে দশ, এগারো ও বারোটি অক্ষর। অন্যদিকে উষ্ণিহ্‌, বৃহতী, ককুভ, সতোবৃহতী ও অত্যষ্টি ছন্দে অক্ষয় ও চরণের সংখ্যা–দুটােই পরিবর্তিত হয়ে যায়।

পৃথিবীর প্রাচীনতম মৌখিক রচনারূপে ঋগ্বেদ আমাদের সামনে এমন কিছু লক্ষণ তুলে ধরেছে যা অক্ষর বা লেখা আবিষ্কারের পরবর্তী সাহিত্যের তুলনায় স্বরূপত ভিন্ন। যুগোস্লাভিয়ার মৌখিক মহাকাব্য সম্পর্কে অসামান্য গবেষণা করে বিদগ্ধ সমালোচক মিল্‌ম্যান প্যারি ও তাঁর সুযোগ্য ছাত্র-সহকমী এ. বি. লর্ড কাব্যের মৌখিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন এবং হােমার ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যিকদের রচনার আলোচনায় সেই সব সিদ্ধান্ত সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। সাহিত্যের লিখিতরূপে প্ৰত্যেকটি শব্দই মৌলিক এককরূপে প্ৰযুক্ত হয়। কিন্তু মৌখিকভাবে রচিত সাহিত্যে সাধারণত শব্দগুচ্ছই মূল ও ন্যূনতম উপাদান। কখনো কখনো মৌখিক সাহিত্যেও একক শব্দ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু রচনার প্রধান প্রবণতা সেদিকে থাকে না। সুদূর অতীতের প্রাচীন কবিরা যে সব শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে গেছেন, পরবর্তী কবিদের দ্বারা তা অক্ষয় উত্তরাধিকাররূপে সাদরে নিরন্তর গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়। লেখা আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বকালে বারংবার ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ স্মৃতিতে ধারণ করার পক্ষে যেমন সহজতর তেমনি নির্দিষ্ট ছন্দোগত কাঠামোয় সংস্থাপিত করার পক্ষেও সহজসাধ্য। মৌখিক সাহিত্যের চারণকবি যেহেতু বিচিত্র ধরনের ঐতিহ্যগত কাঠামোর সীমার মধ্যে কাব্যরচনা করতেন, তাই ভাষাগত অনুপুঙ্খের সাধারণ উৎস থেকে ঋণ গ্ৰহণ করে নিজস্ব রীতিতে কাব্যভাষাকে প্রয়োজনমতো নমনীয়তা-যুক্ত করতেও কোনো বাধা ছিল না। তাই মৌখিক ঐতিহ্যের কবি একই সঙ্গে স্বাধীন ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। ঋগ্বেদের পুনরাবৃত্ত অংশগুলিকে গভীরভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করলে মৌখিক কাব্যের নানা বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মন্ত্রের সূচনায় ও সমাপ্তিতে কখনো সম্পূর্ণ চরণ, কখনো বা বাক্যাংশ পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এছাড়াও পুনরাবৃত্তির সূক্ষ্মতব কিছু পদ্ধতিও রয়েছে—চরণের মাঝামাঝি পুনরাবৃত্তি, পরবর্তী স্তবকের সূচনায়ও পূর্ববতী স্তবকের শেষাংশের পুনরাবৃত্তি, কোনো স্তবকেব মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট শব্দের বাবাংবার আবৃত্তি, সুপরিচিত, প্ৰসিদ্ধ ও জনপ্রিয় চরণ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি। এই জাতীয় বাচনিক পদ্ধতির মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট কবি কখনো বা কবি-পবিবারের নিজস্ব ঘরানার ছাপও স্পষ্টভাবে রয়ে গেছে। অধিকাংশ সূক্তই যেহেতু যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় সমবেত জনতা কিংবা পুরোহিত ও তার সহকারীদের দ্বারা গীত হ’ত,–তাই কোন একটি চরণকে ধ্রুবপদ রূপে বারবার আবৃত্তি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কোনো চরণ পুনরাবৃত্ত হওয়ার পিছনে সম্ভবত এই বিশ্বাস সক্রিয় ছিল যে, এই সমস্ত চরণে ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি নিহিত রয়েছে।

পুনরাবৃত্ত চরণে আর্যদের প্রার্থনার গুরুত্ব প্রতিফলিত; আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক সঙ্কট থেকে রক্ষিত হওয়ার জন্য দেবতার প্রসন্ন অভিব্যক্তি যে তাদের প্রার্থিত, তা বোঝানোর জন্য এবং সেই সঙ্গে অন্তর্নিহিত জাদুকরী শক্তি উদ্বোধনের জন্য মন্ত্রের নির্দিষ্ট কোনো অংশ বারবার আবৃত্তি করা হত। কখনো কখনো একাধিক দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে একটি চরণ অনুরূপভাবে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এতে যে অতিজাগতিক শক্তির স্মরণ প্ৰত্যাশিত ছিল, বলা নিম্প্রয়োজন; খুব কম ক্ষেত্রেই তা শুধুমাত্র নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, খুব সম্ভবত ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি উদ্রেকের জন্যে এক প্রত্যয় কবি ও তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলীর অবচেতন মনে বিশেষ তাৎপর্য বহন করত। সমস্ত প্ৰাচীন সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম পর্বে বিশেষভাবেই শব্দের মধ্যে নিহিত এক অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্বন্ধে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল কবি মনীষীর ক্ষমতা আছে এই শক্তিকে মন্ত্রের দ্বারা সমষ্টি বা ব্যষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত করার। এ বিশ্বাস সব প্রাচীন সমাজেই ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান ছিল। আবার কোন স্তবকে একটিমাত্র শব্দ যখন বহুবার পুনরুক্ত হ’ত, তখন তা যেন তার নিজের প্রতি বিশেষ মনোযোগ আকৃষ্ট করে সেই স্তবকে বিধৃত ভাব-বিন্যাসের তীক্ষ্ম একটি কেন্দ্ৰবিন্দু হয়ে উঠত। ফলে সেই স্তবকের অন্য শব্দগুলি তুলনামূলকভাবে গৌণ হয়ে বাক্যের পশ্চাৎপটে অপসারিত হ’ত। তাছাড়া, পুনরুক্ত শব্দটি শ্রোতার মনে এমন মোহময় বা তন্দ্ৰাচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি করত যাতে সেই শব্দাশ্রিত ভাবনা মনে সুদৃঢ়ভাবে নিবিষ্ট হয়ে অন্য সমস্ত চিস্তাকে গৌণ ও নিম্প্রভ করে দেয়। সংক্ষেপে বলা যায়, এই রচনা-পদ্ধতি এমন সম্মোহনকারী শাব্দিক ইন্দ্ৰজাল সৃষ্টি করত যার প্ৰতি সমগ্ৰ সমাজের অনুমোদন অভিব্যক্ত হওয়াকে কবি তার কাব্যের ব্যবহারিক কার্যকারিতার প্রমাণ হিসাবে ধরে নিতেন।

আবার কোন সুক্তে যখন একটি বিশেষ চরণ পুনরাবৃত্ত হয়–মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী তা রচয়িতা ও স্তুত দেবতার সাময়িক ঐক্য বা একাত্মতা সূচিত করে। দ্বিতীয় মণ্ডলের দ্বাদশ সূক্তের প্রত্যেকটি ঋকই সমাপ্ত হয়েছে ‘স জনাস ইন্দ্ৰঃ” দিয়ে। এই পুনরুক্তি একটি সঙ্গে দুটি ভুমিকা পালন করছে : একদিকে এই শব্দগুচ্ছ অলৌকিক ঘটনার স্রষ্টারূপে ইন্দ্রের গৌরব দৃঢ়ভাবে প্রচার করছে এবং অন্যদিকে দেবতার অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়াচ্ছন্ন মন থেকে সমস্ত রকম সম্ভাব্য সন্দেহও দূর করছে। আর্যদের প্রথম বিজয়ী সেনাপতি ইন্দ্ৰ একদা নিশ্চিতই রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে জনসাধারণের স্মৃতিতে তিনি অমর দেবত্বে মণ্ডিত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক ইন্দ্ৰ হয়ত সামূহিক জীবনে চূড়ান্ত সাময়িক, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অধিকার করে গিয়েছিলেন; ফলে প্রথম ইন্দ্র সম্পর্কে যত দৈব ও অলৌকিক শক্তিসম্ভূত কীর্তিকলাপ প্রচারিত হয়েছিল–সেই সবই সংশয়েব বিষয় হয়ে উঠল, আলোচ্য পুনরুক্তি ইন্দ্রের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ও তার সাম্প্রতিক প্রত্নপৌরাণিক দৈবস্বভাবকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

পৃথিবীর বহু স্থানেই এই বিশ্বাস প্রচলিত যে, নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ঐন্দ্রজালিক শক্তিযুক্ত; এগুলি বহুবার পুনরুক্ত হলে শ্রোতার মনে একটি সম্মোহনী বাতাবরণ নির্মিত হয়, বিশেষভাবে দেবনামে রয়েছে পবিত্রভাবের দ্যোতনা ও অতীন্দ্ৰিয় ক্ষমতার আভাস। বহু ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ্য করি যে, আহুত দেবতাকে বিবিধ বিভক্তিযুক্ত শব্দরূপের মাধ্যমে উল্লেখ করা হচ্ছে; প্রশস্তির প্রতি দেবতার মনোযোগ আকর্ষণ করা কবির সাধারণ উদ্দেশ্য হলেও, দেবনামে অপ্তানীহিত ঐন্দ্ৰজালিক শক্তিকে উদ্বোধিত করাও নিঃসন্দেহে তার অভিপ্ৰেত! আবার কখনো কখনো পুনরুক্তির মধ্যে নান্দনিক আবেগও প্রচ্ছন্ন থাকে-ধ্রুবপদ জাতীয় চরণে উপমা ও অনুপ্রাসের প্রয়োগ ছাড়াও অনুকার ধ্বনির ব্যবহারে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সব ক্ষেত্রে কবি আত্মসচেতন শিল্পীর মতো সূক্ষ্ম প্রয়োগ নৈপুণ্যের অধিকারী; রচনারীতির প্রতি তাঁর এই বিশেষ মনোযোগের মধ্য দিয়ে তিনি একই সঙ্গে তার অভীষ্ট দেবতা ও সমসাময়িক জনসাধারণের তৃপ্তি বিধান করতে চান।

মৌখিক সাহিত্যের বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ–অর্থাৎ শব্দগুচ্ছ, পুনরুক্তি, অনুপ্রাস, সমধ্বনিযুক্ত অক্ষর এবং অন্যান্য স্মৃতিসহায়ক বাচনিক উপাদান-ইত্যাদির উপস্থিতি লিখিত সাহিত্যের সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্যকে স্পষ্ট করে তোলে। লেখন-পদ্ধতির বিস্তারের পরে লেখকরা বাচনিক এককরূপে একটি মাত্র শব্দকে ব্যবহার করতে সমর্থ হলেন; ফলে অন্যান্য উপাদানের আর কোনো প্রয়োজন রইল না। মৌখিক সাহিত্য সর্বতোভাবে স্মৃতিবাহিত ব’লেই বাচনিক উপাদানরূপে পুনরুক্তি এতে অপরিহার্য; এগুলির কিছু প্রার্থনাসূচক, কিছু বা আহ্বানমূলক আর কিছু অপেক্ষিত জাদুশক্তি-উদ্বোধিক-শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে আবেগ সঞ্চার করার প্রয়োজনে শব্দগুচ্ছগুলি সামগ্রিকভাবে ব্যবহৃত হয়। যে সমস্ত পুনরুক্তি সম্মোহনসঞ্চারী;–অন্তর্বস্তু, চিত্রকল্প, ছন্দ ও অনুপ্রাসের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে সেই সব এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করে যেখানে সামূহিক আনুষ্ঠানে নিস্ক্রিয়ভাবে যে জনতা যোগদান করে তাদের উপযোগী তন্দ্ৰাছন্ন মানসিক পরিণতি সৃষ্টির জন্য সমস্ত বিচারবুদ্ধির ক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়। প্ৰখ্যাত সমালোচক জি. এস. কার্ক নিয়মতান্ত্রিক সাহিত্যের পরিধিতে সন্নিবিষ্ট স্বাভাবিক রচনা এবং নিয়মতান্ত্রিক সাহিত্যশৈলীতে অভিব্যক্ত ইচ্ছাকৃত আত্মসচেতন রচনার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। যথার্থ মৌখিক সাহিত্যের পরিচয়জ্ঞাপক নিম্নোক্ত তিনটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন : (১) সংক্ষেপীকরণের আদর্শ অনুসরণ; (২) সূত্রবদ্ধ শব্দাবলীর পরিবর্ধন ও সোচ্চার গ্রন্থনীর স্বাভাবিকতা এবং (৩) ছন্দ, তাল বিষয়ে ঐতিহ্যগত অনুপুঙ্খা। তবে উক্ত সমালোচক যেহেতু হােমারের মহাকাব্যই বিশ্লেষণ করেছেন তাই তার নির্দেশিত সমস্ত লক্ষণ নিবিচারে বৈদিক কাব্য সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়, কেননা ঋগ্বেদ প্রাক-মহাকাব্য যুগের রচনা এবং চরিত্রগতভাবে বহুলাংশে আনুষ্ঠানিক। কার্ক-এর আলোচনা থেকে এইটুকু গ্ৰহণীয় যে, নিয়মতান্ত্রিক শৈলীতে রচিত যথার্থ মৌখিক সাহিত্যের চরিত্রবৈশিষ্ট্য লিখিত সাহিত্যের তুলনায় স্বরূপত ভিন্ন-সম্ভবত লেখনপদ্ধতি ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু সাহিত্য-রচনায় তা ব্যবহৃত হত না। এমন এক যুগে অনুকরণশীল মৌখিক রচনায় নিশ্চিতই পূর্বক বিদের রচনা থেকে প্রভূত পরিমাণ ঋণ-গ্ৰহণের চিহ্ন থাকাই স্বাভাবিক।

দশম-মণ্ডলের সূক্তগুলি পূর্ববতী মণ্ডলের অন্তত দুই শতাব্দী পরে সঙ্কলিত হয়েছিল, পূর্ববতী রচনা থেকে কাব্যিক উপাদান ঋণরূপে আত্মীকরণের চিহ্নও তাই এতে অধিকতর পরিমাণে ও স্পষ্টভাবে বিদ্যমান এবং সহজেই আবিষ্কারযোগ্য। বস্তুত ঋগ্বেদের গঠনগত উপাদানসমূহ বিভিন্ন কালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজন অনুসারে সংবর্ধিত হয়েছিল; সম্ভবত, সেই সঙ্গে, বিচিত্র সামাজিক ক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সমগ্ৰ মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য দীর্ঘকালব্যাপী ইতিহাসের ফলশ্রুতি, বেদ ও সুদীর্ঘকালীন শৈলীগত পরিমার্জনের ফসল, এর কাব্যভাষাও অনুরূপ কাব্যিক প্রক্রিয়ার ও পরিণতির চূড়ান্ত এক অভিব্যক্তি। বিশাল কাব্যভাণ্ডারের বহু প্ৰজন্মব্যাপী স্ৰষ্টাদের স্মৃতি যাতে অবাঞ্ছিতভাবে পীড়িত না হয়, কোনো অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় শব্দ যুক্ত না করার প্রতি কবিগণ তাই যত্নশীল থাকতেন। মৌখিক সাহিত্যের প্রধান চরিত্রলক্ষণ হল অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে কঠোর মিতভাষিতা। এই সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে অদৃশ্য দেবতার সন্তুষ্টি মূলত অনুমাননির্ভর হলেও সম্পৎশালী রাজন্যদের বদান্যতাটা কিন্তু সর্বদাই প্ৰত্যক্ষগোচর এবং কিছু কিছু নির্দিষ্ট কবিতা রাজকীয় দাতাদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত অধিক আনুকুল্য লাভ করত বলে এইসব গানের গৌরব সমাজে যেন তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে যেত। বিভিন্ন কবিদের মধ্যে দান-সামগ্ৰী লাভের জন্য তীব্ৰ প্ৰতিযোগিতা ছিল বলেই মন্ত্রে তার উপযোগী অংশের পুনরুক্তির প্রয়োজন অনিবাৰ্য হয়ে উঠেছিল। কেননা, নান্দনিকভাবে তৃপ্তিকর কোন চিত্রকল্প জনগোষ্ঠীর সাহিত্যভাণ্ডারে সতর্ক সংরক্ষণের যুগে নিশ্চয়ই একবার মাত্র ব্যবহৃত হয়ে বর্জিত হতে পারে না। বরং উপযুক্ত অবকাশে এই জাতীয় উপকরণ বারংবারই ব্যবহৃত হওয়া স্বাভাবিক। মৌখিক সাহিত্যের কবি উত্তরাধিকারসূত্রে, সামাজিক প্রত্নস্মৃতি থেকে বাচনিক আঙ্গিকসমূহ আহরণ করে, সামান্য পরিমার্জন করে নিজস্ব এক কাব্যরচনার শৈলী নির্মাণ করতেন। এই পদ্ধতি কেবলমাত্র অধিকতর নির্ভরযোগ্যই ছিল না একই সঙ্গে শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ছিল। উপসংহারে আমরা এই মন্তব্য করতে পারি যে, কবিদের প্রথম প্ৰজন্মকে অর্থাৎ যারা কাব্যের প্রাথমিক উপাদানরূপে মূল শব্দ বা শব্দগুচ্ছ নির্মাণ করেছিলেন তাদেরই প্ৰধান অনুপ্ৰাণিত কবি রূপে চিহ্নিত করা যায় কেননা প্ৰাথমিক পথ-প্ৰদৰ্শক রূপে তাদের সম্মুখে সূত্রবদ্ধ তেমন কোন বাক্যাংশের দৃষ্টান্ত ছিল না। যা থেকে তারা অনায়াসে ঋণগ্রহণ করতে পারতেন। পরবর্তী প্রজন্মের কবি, শিষ্যবৰ্গ বা উত্তরাধিকারীরা প্ৰাগুক্ত অনুপ্ৰাণিত কবিদের রচনা থেকে যথেচ্ছ মন্ত্রাংশ বা চরণ গ্ৰহণ করেছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে এলেন স্বল্পমেধা কবিরা, অপটু অনুকারক এবং নিছক আবৃত্তিকারেরা । এদের কোন রকম কাব্যপ্রতিভা বা নান্দনিক উপলব্ধি বা প্ৰকাশক্ষমতা ছিল না বলেই উত্তরাধিকাররূপে গৃহীত বাক্যাংশকে যথাযথ প্রসঙ্গ অনুযায়ী ব্যবহার করতে এঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন, ফলে এঁদের রচনা ক্ৰটিযুক্ত ও কাব্যমূল্যে দীন।