০৬. রচনা প্রকরণ

রচনা প্রকরণ

সৌন্দর্য ও লাবণ্য সম্পর্কে ঋগ্বেদে অনেক শব্দ রয়েছে। যেমন : পেশ, প্সর, শ্ৰী, বন্ধু, ভদ্র, ভদ্দ, চারু, প্রিয়, বপুস্‌, রূপ, কল্যাণ, শুভ, চিত্র, স্বাদু, রণ্ব (বা রণ্য) ; বাম, যক্ষ ও অদ্ভুত। এই সমস্ত শব্দের মধ্যে অনেকগুলি প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন শিল্পকলার দিকে ইঙ্গিত করছে। কয়েকটি শুভবাচক এবং অন্যগুলি মুগ্ধতা ও মিষ্টস্বাদের অর্থবহ। কবিরা অবশ্য আসবাব বা রথ নির্মাণ এবং বস্ত্ৰ বয়নের চিত্রকল্প নিয়েই প্ৰধানত বেশি যত্নবান, কেননা কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে তাদের যৌথ অবচেতনে এই দুটি মৌলিক ভাবনাই সমধিক সক্রিয়স্থিল। এইসব চিত্ৰকল্প বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি–(ক) শেষতম বা চূড়ান্ত কারুশিল্পী কর্তৃক ব্যবহৃত হওয়ার পূর্বেই কাঠামোর অংশগুলি পৃথকভাবে নির্মাণ করা যেতে পারে ; (খ) সম্পূর্ণ পৃথক ব্যক্তিগণ এইসব অংশ করতে পারেন। কিংবা পূর্বসূরিদের দ্বারা নির্মিত সামগ্রিক কাঠামো থেকে পূর্বপ্রস্তুত সমরূপ অংশগুলি উত্তরাধিকার হিসাবে গৃহীত হতে পারে ; (গ) বা শেষতম চুড়ান্ত শিল্পীটি পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাঠামোর পূর্বপ্রস্তুত অংশগুলিকে ব্যবহার করেন ; (ঘ) যেহেতু প্রত্যেক শিল্পীর চূড়ান্ত সৃষ্টিই অন্য যে কোন শিল্পীর তুলনায় ভিন্ন, সেহেতু শিল্পনিমিতির অস্ত্য অভিব্যক্তিতেও পৃথক ব্যক্তিত্বের অনিবাৰ্য স্বাক্ষর থাকে ; সেই অন্ত্য অভিব্যক্তিকে হয়তো বা অনুকরণ করা যায়, কিন্তু কখনোই অন্য কেউ তাকে সৃষ্টি করতে পারেন না ; (ঙ) অতএব, অন্তর্দৃষ্টি যেহেতু শিল্পীকে পরিচালিত করে, তাই তিনি (বিশেষত যদি কবি হয়ে থাকেন) সমকালীন অন্যান্য মানুষের থেকে আপনি স্বভাবধর্মে পৃথক ; অসামান্য প্ৰতিভান্বিত হওয়াতেই তার সৃষ্টি ‘ঐশী প্রেরণাসঞ্জাত’ বা ‘অপৌরুষের’ রচনারূপে পরিগণিত হয়।

রূথ ফিনেগান বলেছেন, শ্রুতি-ঐতিহ্যের কবি তার রচনায় একই সঙ্গে বদ্ধ ও স্বাধীন ; একাধারে পুরাতন ও নূতন, ঐতিহ্য ও মৌলিকতার প্রতিনিধি–তিনি যেমন স্বাধীন ও তাৎক্ষণিকভাবে নুতন ধরনের সংযোজন করেন তেমনি একই সঙ্গে একটি-সর্বসম্মত পরিপ্রেক্ষার মধ্যেই তিনি তাঁর শিল্প-কাজ করেন। তন্তুবায় বা রথনির্মাতার উপমায় এ দুই কারুশিল্পীর ব্যবহারের জন্য কোন সামগ্রিক বস্তুর খণ্ড খণ্ড উপাদানের অস্তিত্বের উপমান শ্রুতি-সাহিত্যের প্রকৃতিকেই প্ৰকাশ করে ; কেননা তাতেও কোন একক শব্দের পরিবর্তে মুখ্যত সেইসব পদগুচ্ছ ব্যবহৃত হয় যা সুদূর অতীতের পূর্বসূরি কবিদের দ্বারা নিরস্তর পরিমার্জিত হয়ে অবশেষে যথাযথ ও সুসম্পূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই দিক দিয়ে ভাবলে বহুস্তরে-বিন্যস্ত ঋগ্বেদ কোন সর্বতোভাবে নতুন সাহিত্য-ধারাব জন্ম দেয় নি। বহু রচয়িতার সন্তান সন্ততি ও শিষ্যদের পরম্পরায় আমাদের কাছে যে সমস্ত সূক্ত দীর্ঘ শ্রুতি ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এসে পৌঁছেছে, সেইসব বিভিন্ন যুগের কাব্য রুচি ও কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। শব্দই কবির মৌল উপাদান ; আবার শব্দের অন্তরালে নিহিত রয়েছে কাব্যিক অভিজ্ঞতা– একই সঙ্গে যা আবেগ-নির্ভর ও বোধিদীপ্ত ; অনুভবগম্য চিরাচঞ্চল।