০২. রচনাকাল

০২. রচনাকাল

মৌখিক কাব্যের ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সমসাময়িক প্রতিশব্দ ও বাগবিধিকে আত্মস্থ করে অব্যবহাৰ্য্য ও প্রাচীনতর প্রকাশরীতিকে পরিত্যাগ করা হয। তাই আদি বাসভূমি থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দিকে যাত্রার পূর্বে যে ইন্দো-ইয়োরীপীয় মূল ভাষাটির প্রচলন ছিল, তা আর্যদের ভারতে আগমণের পূর্বেই পথিমধ্যে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের ফলে এবং স্বাভাবিক সময়-বাহিত ধ্বনিগত ও শব্দার্থগত বিবর্তনের ফলে বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়ে ঋগ্বেদের প্রাথমিক সূক্তগুলি যখন তারা রচনা করলেন, তারপরেও কথ্যভাষা স্থিতিশীল রইল না। লিখিতরূপের অভাবে আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অর্থাৎ ভারতভূমিতে আর্যরা পদার্পণ করবার আগেকার রচনার ভাষাকে নিরস্তর সমসাময়িক লক্ষণযুক্ত করে তোলা হচ্ছিল। সম্ভবত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রচিত সমস্ত সূক্তে এই ভাষা সংস্কারের প্রবণতা অক্ষুন্ন ছিল। শেষোক্ত সময়সীমাতে সংহিতা-রচনার ধারা তুলনামূলকভাবে ক্ষীণ হয়ে উৎপাদনাকর্ম বেড়ে ওঠায় ভাষা কতটা স্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে সেই যুগের ভাষার সূক্তগুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা একটি পবিত্র দায়িত্বরূপে গণ্য হয়েছিল। ভাষাগত পরিবর্তন থেমে যাওয়ার আরও একটি কারণ হল সেই সময়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সাহিত্যরীতি অর্থাৎ গদ্যে ব্রাহ্মণসাহিত্যের সূত্রপাত। সংহিতা রচনার প্রেরণাময় ও সৃষ্টিশীল পর্যায়টি ততদিনে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছিল এবং ক্রমশই অনুষ্ঠান-সর্বস্ব ভাষ্যমূলক গদ্য রচনার দিকে বিবর্তিত হচ্ছিল। ইদানীং ঋগ্বেদ রচনার কাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ (মতান্তরে ত্রয়োদশ) শতক থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে ধার্য করা হয়ে থাকে, যদিও সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন কালসী , সম্পর্কে গবেষকদের ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে পণ্ডিতরা সাধারণভাবে অনেক বেশি। প্রাচীনতার পক্ষপাতী ছিলেন। সমসাময়িক গবেষকদের মধ্যে কোন কোন ভারতীয় পণ্ডিত এখনও প্রাচীনতার পক্ষপাতী, কিন্তু সাধারণভাবে ভারতীয় ও বিদেশী বিদ্বৎসমাজের অভিমত এই যে ঋগ্বেদ-রচনা আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ বা ৯০০ খিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল। পণ্ডিত টি বারো-র মতে প্রাচীনতর বৈদিক বা পূর্ব-বৈদিক সাহিত্য (অর্থাৎ ঋগ্বেদের প্রথম থেকে নবম মণ্ডলের সূক্তগুলি) ১২০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়ে গিয়েছিল, আর উত্তর-বৈদিক সাহিত্য (অর্থাৎ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল থেকে উপনিষদ পর্যন্ত) ১০০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন কতকটা পরবর্তীকালে রচনার সীমানিরূপণের পক্ষপাতী (অর্থাৎ সূচনা আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ; ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায় বৈদিক ভাষার তুলনায় অবেস্তা কিছু পরবতী অর্থাৎ ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-অতএব এই দুটি ভাষার সাধারণ উৎসটি অর্থাৎ ইন্দোইরাণীয় সাহিত্যের আদিপর্ব ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিছিয়ে যাবে। তার মতে ঋগ্বেদ খ্রিস্টপূর্ব একাদশ থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়ে গিয়েছিল। আবার কিছু কিছু গবেষক সমগ্র বৈদিক সাহিত্যের রচনাকালের নিম্নতম সীমা ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছেন, অবশ্য পণ্ডিতমহলে এ মত গৃহীত হয়নি।

ঋগ্বেদ-রচনায় সর্বাধিক কালগত ব্যবধান রয়েছে প্ৰথম নয়টি মণ্ডল থেকে দশম মণ্ডলের মধ্যে। যেহেতু একমাত্র দশম মণ্ডল থেকেই সামবেদ কোন উদ্ধৃতি দেয় নি, এতেই প্রমাণিত হয় যে দশম মণ্ডল সামবেদের পরবর্তী। ভাষাগত দিক দিয়েও এই মণ্ডলের অর্বাচীনত্ব প্রমাণিত : শব্দ-ভাণ্ডার, ব্যঞ্জনবর্ণের রূপ, বাক্যগঠন রীতি, ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য-সমস্তই এখানে ভিন্ন। অনেক প্রাচীনতর বাকরীতি অপ্রচলিত হয়ে গেছে এবং বহু নূতন বাকপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে-বাগভঙ্গি, ক্রিয়াপদের গঠন, শব্দরূপ ও ধাতুরূপের সীমাবদ্ধ বৈচিত্ৰ্য সঙ্কুচিত ও বহুপূর্বপ্রয়োগ আচলিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। প্ৰত্নকথা, দেবকল্পনা, ভৌগোলিক সংস্থান ও দার্শনিক প্ৰতীতির দিক দিয়েও দশম মণ্ডলকে বহু পরবতী রচনারূপে চিহ্নিত করা যায়। যদিও এতে কিছু কিছু প্ৰাচীনতর সূক্ত সন্নিবেশিত হয়েছে, আমাদের মনে হয় যে সামূহিক স্মৃতি সম্পূর্ণ ক্ষয় হওয়ার পূর্বে কয়েকটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প তাৎপৰ্যপূর্ণ সূক্তকে সংরক্ষণ করার একটা চেষ্টা হয়েছিল। স্বভাবতই এই প্রবণতা সেই সময়ের দিকেই সংকেত করছে, যখন মন্ত্ররচনার সৃষ্টিশীল পর্যায় অবসিত হয়ে সংরক্ষণ, পুনরাবৃত্তি ও সংশ্লেষনের পর্যায় আরম্ভের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই দশম মণ্ডলকে পরবতী বৈদিক-সাহিত্য সূচনার প্রথম সৃষ্টিরূপে সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়।

ভের্নন আর্নল্ড বলেছেন যে, ঋগ্বেদের সূক্তগুলি তিনটি প্রধান ভাবে বিন্যস্ত হয়েছিল। প্ৰথম ভাগে রয়েছে প্ৰথম মণ্ডলের ৫১তম সূক্ত থেকে মণ্ডল পর্যন্ত ; এতে প্রকৃতপক্ষে আরোহী সূক্ত-সংখ্যার ভিত্তিতে সংগৃহীত চৌদ্দটি মন্ত্ৰ-সংগ্রহ রয়েছে। এইগুলি হচ্ছে তথাকথিত পারিবারিক মণ্ডল যেখানে প্ৰথম সূক্তগুচ্ছ অগ্নির উদ্দেশে নিবেদিত, আর তার পরই রয়েছে ইন্দ্ৰসূক্তগুলি। দ্বিতীয় বিভাগে রয়েছে প্ৰথম মণ্ডলের ১-৫০ সূক্ত এবং অষ্টম মণ্ডল-এটাও আসলে পারিবারিক সংগ্রহেরই আরেকটি পর্যায়, যেখানে সূক্তবিন্যাস প্রথম বিভাগের মত নিয়মিত নয় এবং অগ্নিসূক্তগুলি মণ্ডলের প্রারম্ভিক অংশ নয়। এই বিভাগটি প্রথম বিভাগের তুলনায় ক্ষুদ্রতর। তৃতীয় বিভাগে রয়েছে। নবম মণ্ডল। আর্নল্ড মনে করেন এই মণ্ডলেই ঋগ্বেদের নূতন ধরনের পাঠ প্ৰস্তুত করার প্রয়াস আরম্ভ হয়ে গেছে, যেখানে সূক্তবিন্যাস কবি ও তার পরিবারের পরিচয় দিয়ে নির্ধারিত না হয়ে উদ্দিষ্ট দেবতা অনুযায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু এ ধরনের কোন চেষ্টা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তা নবম মণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। চতুর্থ বিভাগে রয়েছে। দশম মণ্ডল, যেখানে রচনার দুটি অংশে সূক্তসমূহ মন্ত্রসংখ্যার আরোহী ও অবরোহী ক্রমে বিন্যস্ত হয়েছে।