০৫. শ্রোতাদের সঙ্গে বক্তব্য আদান প্রদান করুন

০৫. শ্রোতাদের সঙ্গে বক্তব্য আদান প্রদান করুন

রাসেল কনওয়েলের বিখ্যাত বক্তৃতা ‘একরেস অব ডায়মন্ডস্’ প্রায় হাজার বার দেওয়া হয়। আপনি হয়তো ভাবছেন এতবার দেওয়ার ফলে বক্তৃতার প্রতিশব্দ প্রতিটা কথাই বক্তার মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা অবশ্য তা হয়নি। ড. কনওয়েল জানতেন শ্রোতারা সাধারণত নানা ধরনের হয়। তাই ডঃ কনওয়েল সিদ্ধান্তে আসেন শ্রোতাদের বোঝাতে হবে এ বক্তৃতা কেবল তাদের জন্যই করা হচ্ছে। তাহলে তিনি কিভাবে পরের বার বক্তা, বক্তৃতা আর শ্রোতাদের মধ্যে পারস্পরির সম্পর্ক বজায় রাখেন? ডঃ কনওয়েল এ সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘কোন শহরে যখন কথা বলার আমন্ত্রণ পাই, সেখানে বেশ আগেই হাজির হই। তারপর প্রথমে যাই সেখানকার পোষ্টামাষ্টার, ক্ষৌরকার, হোটেল ম্যানেজার, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কোন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। এরপর যাই কোন দোকানে আর লোকজনের সঙ্গে কথাও বলি। আমি জানতে চেষ্টা করি ওখানকার ইতিহাস, কি কি সুযোগ তাদের শহরে আছে, এই সব। তারপর ওখানকার শ্রোতাদের সামনে তাদের পছন্দসই স্থানীয় বিষয়ে বক্তৃতা দিই।’

ডঃ কনওয়েল ভালই জানতেন সফল আদান-প্রদান নির্ভর করে বক্তা কিভাবে শ্রোতাদের কাছে বক্তব্য পৌঁছে দিলে তারাও তাতে অংশ গ্রহণ করবে। আর এই কারণেই আমাদের কাছে একরেস অব ডায়মণ্ডের’ আসল কোন কপি নেই। ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝতে পারছেন। মানব চরিত্র সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ হওয়ায় ডঃ কনওয়েল কখনই এক বক্তৃতা দুবার দেননি–অথচ তিনি একই বিষয় নিয়ে অন্তত ছ’ হাজার বার আলাদা শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা দেন। বিশেষ ধরনের শ্রোতাদের কথা মনে রেখে আপনার বক্তব্য তৈরী করে শোনাতে এই অভিজ্ঞতাকে আপনিও কাজে লাগাতে পারেন। নিচে আপনার সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোরার কতকগুলো সহজ নিয়ম উল্লেখ করছি।

১. শ্রোতাদের পছন্দ বিষয়ে বক্তব্য রাখুন

ডঃ কনওয়েলও ঠিক তাই করতেন। তিনি তার বক্তব্যে মিশিয়ে দিতেন স্থানীয় বহু আগ্রহের বিষয়। তাঁর শ্রোতারা খুব আগ্রহ বোধ করতেন কারণ তাঁর বক্তৃতা শ্রোতাদের পছন্দসই বিষয়ে ভরপুর থাকতো। শ্রোতাদের সঙ্গে বক্তার এই যে একাত্মতা এটাই বক্তার জনপ্রিয়তা আনতে পারে। আমেরিকার চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আর পরবর্তীকালে মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এরিক জনস্টন যত বক্তৃতা দেন তার সব কটিতেই এই কৌশল প্রয়োগ করেন। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি কিভাবে স্থানীয় জনগণের আগ্রহের বিষয় কাজে লাগিয়েছিলেন দেখুন:

……ওকলাহোমা একদিন হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, তাকে প্রায় বাতিলের পর্যায়েই ফেলতে চাওয়া হয়েছিল।

১৯৩০ সালে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে উড়ন্ত দাঁড়কাকের দলও ওকলাহোমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়। ওকলাহোমাকে আমেরিকার দিগন্ত প্রসারী মরুভূমির অংশ বলেই প্রচার হতে থাকে…। সবাই বলতে থাকে এখানে আর কোনদিনই সবুজের ছোঁয়া লাগবে না।

কিন্তু ১৯৪০ সালে ওকলাহোমাই হয়ে ওঠে এক সুন্দর বাগান–আবার ক্ষেতের বুকে বাতাসে দোলে গমের শিষ, বাতাস বয়ে আনে আগামী বর্ষণের ইশারা।

…এখানে খুঁজে পেয়েছি আশার আলো। ওকলাহোমার ভবিষ্যৎ। এখানে শুধুই ভবিষ্যৎ আশাভরা জীবনের প্রতিশ্রুতি।

শ্রোতাদের মনের মত বক্তৃতার এমন চমৎকার নিদর্শন আর নেই। এরিক জনস্টন শ্রোতাদের জীবনের অতীত ঘটনাবলি থেকেই তার বক্তৃতার রসদ জোগাড় করেছিলেন। তিনি শ্রোতাদের বুঝতে দিয়েছিলেন তার বক্তৃতা কোন প্রতিবেদন মাত্র নয়-এটা তাদের জন্যই সৃষ্টি করা। কোন শ্রোতার দল, যে বক্তা তাদের আগ্রহের বিষয়ে বলেন, তার কথা না শুনে পারেন না।

কোন বক্তব্য রাখার আগে নিজেকে একবার প্রশ্ন করে নিন আপনার বলার বিষয় শ্রোতাদের সমস্যা সমাধানে কতখানি সহায়ক হতে পারে। তারপরেই এগিয়ে চলুন। যেমন ধরুন, আপনি যদি অ্যাকাউন্ট্যান্ট হন তাহলে এই ভাবেই শুরু করতে পারেন : ‘আমি আপনাদের দেখাতে চাই করের ব্যাপারে আপনারা কিভাবে পঞ্চাশ বা একশ ডলার বাঁচাতে পারেন…।’ অথবা আপনি যদি একজন আইনজ্ঞ হন তাহলে শ্রোতাদের উইল করার কলা কৌশল সম্বন্ধে বলতে পারেন, আগ্রহী শ্রোতার অভাব হবে না।

লর্ড নর্থক্লিফকে যখন প্রশ্ন করা হয় ‘মানুষের আগ্রহ জাগে কিসে’ তিনি জবাব দেন : ‘শ্রোতারা নিজেরাই নিজেদের আগ্রহ জাগায়’। এই একটি বিশ্বাসে নির্ভর করেই তিনি সংবাদ পত্রের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

‘মাইন্ড ইন দি মেকিং’-গ্রন্থে জেমস হার্ভে রবিনসন অবকাশকে ‘চিন্তার ক্ষেত্রে এক স্বতঃস্ফূর্ত ভাব’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে অবকাশের ফাঁকে মানুষের ধ্যানধারণা একটা নির্দিষ্ট রূপ পেয়ে চলে। আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের চেয়ে আগ্রহের বিষয় আর কিছুই নেই।

ফিলাডেলফিয়ার হ্যারল্ড ডোয়াইট একবার আমাদের পাঠক্রমের এক ক্লাসের শেষ পর্যায়ে ভারি চমৎকার একটি ভাষণ দেন। তিনি তাঁর টেবিলে উপস্থিত সমস্ত লোকের সঙ্গেই এক এক করে কথা বলেন। তাঁদের প্রত্যেকের সম্পর্কেও বলেন। তাঁরা কি রকম উন্নতি করেছেন, কি ত্রুটি আছে তাদের তার অনেকখানি আবার নকল করেও দেখান। এতে বেশ হাসির ধূম পড়ে যায়। প্রত্যেকে দারুণ উপভোগ করে ব্যাপারটা। ব্যাপারটা সত্যিই আদর্শ। মি. ডোয়াইট জানতেন কিভাবে মানুষের চরিত্র নাড়াচড়া করতে হয়।

কিছুকাল আগে আমেরিকান ম্যাগাজিনের এক উঁচু কর্মী জন শিডলের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়। তিনি বলেছিলেন, মানুষ বড়ই স্বার্থপর। তারা কেবল নিজেদের নিয়েই মাথা ঘামায়। তারা সরকার কিভাবে রেল চালাবেন তা নিয়ে ভাবতে চায় না। তারা শুধু জানতে চায় কিভাবে উন্নতি হবে, কি ভাবে মাইনে বাড়তে পারে, কি করে স্বাস্থ্যরক্ষা হবে ইত্যাদি। আমি যদি কাগজের সম্পাদক হতাম তাহলে আমি তাদের জানাতাম কি করে দাঁতের পরিচর্যা করা যায়, গরমে শীতল হওয়া যায়, কি করে উঁচু পদে ওঠা যায়, কর্মচারিদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয়, ব্যাকরণ ভুল কী করে বন্ধ করা যায় এই সবই। মানুষ কেবল মানুষের কথাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে চায়। তাই আমি জানাতে চাইতাম কোন লোক কিভাবে কোটিপতি হয়েছে…।’

এরই কিছু পরে শিডলকে কাগজের সম্পাদক করা হল। সাময়িক পত্রটির প্রচার সংখ্যা ছিল সামান্য। শিডল যা যা বলেছিলেন সম্পাদক হয়ে তিনি ঠিক তাই করলেন। এর ফল কি রকম হল জানেন? একেবারে অত্যাশ্চর্য। প্রচার সংখ্যা বেড়ে উঠল প্রায় দুলক্ষে। তারপর তিন চার থেকে একদম পাঁচ লক্ষে। তারপর দাঁড়াল দশ লক্ষে। এর কারণ, সম্পাদক শিডল পাঠকদের ব্যক্তিগত চিন্তা আর স্বার্থের কথাই বলেছিলেন তাঁর কাগজে।

এরপর যখন কোন শ্রোতাদের মুখোমুখি হবেন আপনারও চেষ্টা করা উচিত তাদের মনের কথা জেনে সেই বিষয়েই বক্তব্য রাখা। যে বক্তা এই সুযোগ গ্রহণ করতে অপারগ তিনি দেখবেন তাঁর শ্রোতারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। তাঁরা সভাস্থল ছেড়ে যেতেই উদগ্রীব।

২. সৎ ঐকান্তিক প্রশংসা করুন

শ্রোতারা এক একজন আলাদা মানুষেরই সমষ্টি। তারা আলাদা মানুষের মতই ব্যবহার করতে চান। খোলাখুলিভাবে কোন শ্রোতাদের একবার সমালোচনা করে দেখুন। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই সে বিষয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। আবার কোনভাবে তাঁদের প্রশংসা করুন দেখবেন তাদের হৃদয় মন্দিরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে গেছেন। অবশ্য এটা করতে গেলে আপনার ক্ষেত্রে কিছুটা গবেষণা চালাতে হবে। অথচ কেউ যদি বলেন, ‘এমন চমৎকার বোদ্ধা শ্রোতা আমি আগে দেখিনি’ তাহলে কিন্তু কাজ হবে না, কারণ বুদ্ধিমান শ্রোতারা এমন তোষামোদে খুশি হন না।

বিখ্যাত বক্তা চন্সি এম. ডিপিউ বলেন ‘শ্রোতাদের সম্পর্কে এমন কিছু বলুন যা আপনি জানেন তাঁরা ভাবতেই পারবেন না।’

এসব ক্ষেত্রে এমন কিছু জানানো ঠিক হবে না যাতে আপনি ভুল করছেন মনে হবে। সেটা করলে শ্রোতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই ঘটবে। এক্ষেত্রে এটা এড়িয়ে চলাই ভালো।

৩. শ্রোতাদের একজন হয়ে উঠুন

শ্রোতাদের সামনে কোন কথা উচ্চারণ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এমন কথা উচ্চারণ করুন যেন তাদের সঙ্গে আপনার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আপনাকে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে যদি সম্মানিত করা হয়ে থাকে সে কথা বলুন। হ্যারল্ড ম্যাকমিলান যখন ইন্ডিয়ানায় ডি পাও বিশ্বাবিদ্যালয়ে স্নাতক ক্লাসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তখন এই ভাবেই শুরু করেছিলেন।

‘আপনাদের সাদর অভ্যর্থনায় আমি অভিভূত’, তিনি আরম্ভ করেছিলেন। কারণ গ্রেট বৃটেনের কোন প্রধান মন্ত্রীকে এইভাবে আপনাদের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী পদই এই আমন্ত্রণের একমাত্র কারণ অবশ্যই নয়।

এরপর তিনি জানালেন তার মা একজন আমেরিকান মহিলা, জন্মেছেন ইণ্ডিয়ানাতেই আর তাঁর বাবা এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রথম আমলের স্নাতক।

তিনি আরও বলেন, আমি আপনাদের কথা দিতে পারি ডি পাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে আমি গর্বিত এবং আমার গর্ব হচ্ছে এর সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক আছে বলে এবং তাকে আবার নতুন করে ভাবতে উদ্দীপনা পাচ্ছি।’

আপনারা ধরেই নিতে পারেন ম্যাকমিলান তাঁর বাবা মার সঙ্গে আমেরিকান জীবন ধারার সম্পর্কের কথা বলায় শ্রোতাদের সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধু করে নিতে পেরেছিলেন।

যোগাযোগ স্থাপন করার আরও একটা পথ হল শ্রোতাদের কারও নাম উল্লেখ করে শুরু করা। আমি একবার এক সম্বর্ধনা সভায় বক্তার পাশেই বসেছিলাম। হলের নানা মানুষ সম্পর্কে তার আগ্রহ দেখে বেশ অবাক হয়ে যাই। নৈশভোজের সময় সারাক্ষণ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি যে ভদ্রলোক প্রধান আমন্ত্রককে বারবার বিশেষ বিশেষ ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। তিনি যখন কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়ালেন তখনই বুঝতে পারলাম তার আগ্রহের কারণ কী। তিনি চমৎকার কায়দায় বেশ কিছু উপস্থিত ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের নাম উল্লেখ করলেন। আমি দেখতে পেলাম তারা এতে অসম্ভব খুশিও হলেন আর তাঁদের মুখও হাসিতে ঝলমল করতে আরম্ভ করল। তাঁদের চোখে মুখে বেশ একটা উত্তাপ মেশানো বন্ধুত্বের স্পর্শ ফুটে ওঠে। সামান্য ওই কৌশলে বক্তা একাজ করতে পেরেছিলেন।

তবে এখানে একটু সতর্কতা নেওয়ারও প্রয়োজন আছে। ব্যাপারটি অন্য কিছুই নয়–যে নাম আগে থেকে শুনে আপনি উল্লেখ করবেন তাদের সম্পর্কে সঠিক বিবরণ অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত। তাঁদের নাম উপযুক্ত সময়েই উল্লেখ করবেন।

শ্রোতাদের আরও কাছে টানার অপর কৌশল হল কথার মাঝখানে মাঝে মাঝে সর্বনাম ব্যবহার করা। কখনও তাঁরা’ কথাটা ব্যবহার করবেন না বরং করবেন আপনি বা আপনারা।

আমাদের নিউইয়র্কের ক্লাসে একজন ছাত্র শ্রোতাদের সামনে সালফিউরিক অ্যাসিড নিয়ে নিচের বিবৃতিটি দিয়েছিল :

সালফিউরিক অ্যাসিড আপনার জীবনকে নানাভাবেই ছুঁয়ে যায়। সালফিউরিক অ্যাসিড না থাকলে আপনার গাড়ি থেমে যেত। কেননা এই অ্যাসিড দিয়ে কেরোসিন আর গ্যাসোলিন সাফাই হয়। যে বিদ্যুতের আলো আপনার অফিস আর বাড়িতে আলো দেয় তাও এটা না থাকলে সম্ভব হত না।

‘স্নান করার সময় যে সাবান ব্যবহার করেন আপনি তাও পেতেন না এই অ্যাসিড না থাকলে, কারণ ওই অ্যাসিডেই তেল শোধন করা হয়। আপনার দাঁত মাজার ব্রাশ বা মাথার চুল আঁচড়ানোর চিরুনিই বানানো যেত না এই পদার্থ না থাকলে।‘

‘তাই যেখানে যেভাবেই থাকুন এই পদার্থটিকে কোন ভাবেই এড়িয়ে চলার পথ আপনার নেই।’

বেশ কৌশলে ‘আপনি’ কথাটা ব্যবহার করে বক্তা শ্রোতাদের একাত্ম করতে পেরেছিলেন তাঁদের প্রচুর আগ্রহীও করতে পেরেছিলেন। আবার এটাও মনে রাখবেন এই ‘আপনি’ সর্বনাম ব্যবহার যখন বিপজ্জনক মনে হবে তখন ব্যবহার করবেন ‘আমি’ বা ‘আমরা’।

যেমন ধরুন একজন যদি বলেন, ‘আমরা সবাই জানতে চাই কীভাবে একজন ভাল ডাক্তার ঠিক করতে পারা যায়।’ কথাটা বলেছিলেন ড. ডব্লিউ বোয়ার। এরপর তিনি বলেন, এরপর আমরা যখন, আমাদের ডাক্তারের কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ চাইবো তখন কি আমরা জানতে চাইব না ভালো রোগী কেমন করে হতে হয়?

৪. শ্রোতাদের আপনার বক্তৃতার সঙ্গী করে নিন

আপনাদের কখনও কি মনে হয়েছে আপনারা শ্রোতাদের প্রতিটি কথাতেই একটু প্রদর্শন কৌশল দেখিয়ে তাতিয়ে বা মাতিয়ে রেখেছেন? যে মুহূর্তে আপনি শ্রোতাদের কাউকে বেছে নিয়ে কোন বক্তব্য বুঝিয়ে দিতে বা নাটকীয় করে তুলতে তার সাহায্য নেবেন, তখনই তাদের মধ্যে বেশ একটা পরিবর্তন আর আগ্রহ ফুটে উঠতে দেখবেন। নিজেদের শ্রোতা হিসেবে ভেবে নেওয়ার জন্য শ্রোতারা অতিরিক্ত মাত্রায় আত্মসচেতন হয়ে উঠতে চায় যে মুহূর্তে তাদের কোন ভাবে বেছে নেওয়া হয়। বক্তা আর শ্রোতাদের মধ্যে যদি কোন অলঙ্খ প্রাচীর থাকে তাহলে এমন কাজের ফলে সে প্রাচীরের ব্যবধান দূর হয়ে যাবেই। আমার মনে পড়ছে একবার একজন বক্তা গাড়িতে ব্রেক কষলে থামতে কতক্ষণ লাগে বোঝনোর জন্য একজন শ্রোতাকে মঞ্চে উঠে আসার জন্য অনুরোধ করেন। শ্রোতাটি একটা মাপ-জোপ করার ফিতে সহ উঠে এসে সেটা টেনে মঞ্চের প্রান্ত অবধি নিয়ে যায়। সেই সময় আমি বাকি শ্রোতাদের লক্ষ্য করেছিলাম। তারা দারুণ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা শুনে যেতে চাইছিল।

শ্রোতাদের অংশ গ্রহণের ব্যাপারে আমার কৌশল হল সহজে প্রশ্ন করা আর তাতেই বেশ ভালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া। আমার কায়দা হল শ্রোতাদের কাউকে উঠে দাঁড়াতে বলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা। পার্সি এইচ. হুইটিং তাঁর লেখা ‘হাউ টু পুট হিউমার ইন ইওর স্পিকিং অ্যান্ড রাইটিং’–অসংখ্য ভালো পরামর্শ এ ব্যাপারে রেখেছেন। তিনি বলেছেন শ্রোতাদের সামনে আপনার সমস্যা সমাধানের বিষয় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। মি. হুইটিং বলেছেন, ‘শ্রোতাদের আমি সহকর্মী বলেই মনে করি।’ একথাটাই এই পরিচ্ছেদের মূল কথা। আপনি যদি শ্রোতাদের আপনার বক্তব্যের সঙ্গী করে নিতে পারেন তাহলেই আপনার কাজ অর্ধেকটাই সম্পন্ন হবে।

৫. নিজেকে প্রকাশ করুন

বক্তা-শ্রোতাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার মধ্যে আন্তরিকতার কোন পরিবর্তন নেই। একবার নর্মান ভিনসেন্ট পীল তার একজন সহকারী মন্ত্রীকে খুব দামী পরামর্শ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীটি তার শ্রোতাদের একাগ্র করতে বড়ই হিমশিম খাচ্ছিলেন, তিনি তাঁদের তাঁর মতবাদ গ্রহণ করাতে পারছিলেন না। ডঃ পীল মন্ত্রীকে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন তিনি তাঁর বিবেকের কাছে কি আদৌ জানতে চেয়েছেন তিনি শ্রোতাদের পছন্দ করেন কি না, তাঁদের সাহায্য করতে চান কি না, তাঁদের নিজের তুলনায় বুদ্ধিগত দিক থেকে নিকৃষ্ট মনে করেন কি না? ডঃ পীল বলেছেন তিনি নিজে কখনই তার শ্রোতাদের প্রতি আন্তরিক টান ছাড়া মঞ্চে ওঠেন না। কোন বক্তা মঞ্চে আসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতারা তাকে চুলচেরা বিচার করে ফেলার চেষ্টা করেন। বক্তা হয়তো নিজেকে তাদের তুলনায় জ্ঞানী বলেই ভাবতে চায়। তাই এসব ক্ষেত্রে শ্রোতাদের মন জয় করার সবসেরা পথই হল নিজেকে তাদের সামনে প্রকাশ করে ফেলা।

মেইনের মার্কিনী সেনেটর এডমাণ্ড এস. মাস্কি এই ব্যাপারটি বোস্টনের আমেরিকান ফরেনসিক অ্যাসোসিয়েশনে বক্তৃতা দেবার সময় বুঝিয়ে ছিলেন।

তিনি সেখানে বলেন, ‘আজ সকালে যখন এখানে আমার কাজ করার জন্য আসি আমার বেশ সন্দেহ ছিল আমি পারব কি না। এর কারণ হল আমার শ্রোতাদের পেশাদারী গুণাবলী আর তাদের সামনে আমার সামান্য জ্ঞান প্রকাশ যুক্তিসম্মত হবে কিনা। তাছাড়া যতদিন আমি রাজনীতিগত দিক থেকে কাজে নিয়োজিত থাকব, ততদিন আমাদের শ্রোতাদের মধ্যে ভেদ থাকবেই।’

‘এইসব সন্দেহ নিয়েই হাজির হয়ে কোথায় শুরু করব বুঝতে পারছি না।’

সেনেটর মাস্কি অবশ্য ওখান থেকেই শুরু করে চমৎকার ভাবেই এগিয়ে ছিলেন আর অমূল্য একটা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।

অ্যাডলাই স্টিভেনসন ও এইভাবে নিজেকে বক্তৃতার সময় প্রকাশ করে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করতেন।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাদানের সময় তিনি বলেছিলেন, এই রকম কোন অবস্থায় আমি নিজের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে বড়ই ভাবনায় পড়ে যাই। আমি এক্ষেত্রে কি করব ভাবতেই স্যামুয়েল বাটলারের মন্তব্য স্মরণ করি। সেটা হল : ‘আগামী পনেরো মিনিট কিভাবে কাজে লাগাবো সেটাই আমি জানি না। আর আমার পক্ষে পরের বিশ মিনিটই আমায় ভাবনায় ফেলে দেয়।

শ্রোতাদের বিরাগভাজন করে তোলার সবচেয়ে সহজ পথ হল নিজেকে তাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ভেবে বসা। আপনি যখন জনসংযোগ করেন আর তা আপনার বক্তৃতার মাধ্যমে তখন আপনি থাকেন আসলে একটা শো কেসের মধ্যে। তখন আপনার সব কিছু প্রকাশ হয়ে পড়ে, আপনার দোষ গুণ, আপনার ব্যক্তিত্ব সবই। এক্ষেত্রে সামান্যতম বাগাড়ম্বর বা দম্ভ প্রকাশ করা হয়ে ওঠে মারাত্মক। অন্যদিকে আবার আন্তরিক বিনয় প্রকাশে শ্রোতারা বশীভূত হবেনই এবং সহজেই তাতে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা সম্ভব। আপনি যদি জানান যে কোন বিষয়ে আপনার জ্ঞান সীমাবদ্ধ তাতে আপনার শ্রোতারা আপনার প্রতি বিরূপ না হয়ে বরং খুশিই হবেন।

সমালোচনায় রাগ করবেন না বরং সমালোচনাকে আহ্বান করাই ভালো। ঠিক এমনই করতেন আমেরিকান দূরদর্শনের এড সুলিভান। তাঁর নিজের কিছু ত্রুটি অবশ্যই ছিল! দর্শকরা এ ব্যাপারে তাঁর সমালোচনা করায় তিনি তা হাসি মুখেই গ্রহণ করতেন আর হাসতেও চাইতেন। এতেই তিনি দর্শকের একান্ত প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। আসলে দর্শকরা বা শ্রোতারা আন্তরিকতা ঘৃণা করে না।

কনফুসিয়াস সম্বন্ধে বলা হয় তিনি কোন সময়েই মানুষকে তাঁর জ্ঞানের উদাহরণ দিয়ে চমকে দিতে চাইতেন না। বরং তিনি সহানুভূতির প্রলেপ দিয়ে তাদের আলোকিত করতে চাইতেন। আমাদেরও যদি এই সহানুভূতির ভাব থাকে তাহলে শ্রোতাদের হৃদয় মন্দিরে প্রবেশ, সেটাই হবে চাবিকাঠি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *