রিমঝিম – ১২

৭ কার্তিক।

শেষরাত্রি থেকে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আশ্বিনে ঝড়বৃষ্টি হয়, এবার কার্তিক মাসে হল। অকালের বাদল। আমার কপালে কী আছে জানি না।

দুযোগের জন্যে সকালে কলাবতী আসতে পারেনি। পিউ ঘুম ভেঙে হাঙ্গামা শুরু করেছিল, অতি কষ্টে ঠাণ্ডা করেছি। টিনের দুধ খেয়েছে; কিন্তু গাল ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফোলাচ্ছে। কী যে করি ওকে নিয়ে!…

দুপুরবেলা পিউ ঘুমুলে ডায়েরি লিখতে বসেছিলুম। কিন্তু ভাল লাগল না। বাইরে ঝড় থেমেছে, রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। মনটা উদাস হয়ে গেল। পিউয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লুম।

ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, ঘুম ভেঙে গেল শুক্লার গলার আওয়াজে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে,–আসুন আসুন—কেমন আছেন?

তারপরই মোটা গলার আওয়াজ,—প্রিয়দম্বা কোথায়? পিউ কোথায়?

আমার শরীর নিথর হয়ে গেল; তারপর থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। কিছুতেই কাঁপুনি থামাতে পারি না; যেন ম্যালেরিয়ার জ্বর আসছে। পিউ আগেই জেগে উঠেছিল, বিছানায় বসে পুতুল নিয়ে খেলা করছিল। সে ঘাড় হেলিয়ে শুনছে, বাপের গলা চিনতে পেরেছে।

শুক্লা ছুটে ঘরে ঢুকল, আমার কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলল, এই প্রিয়া, শিগগির ওঠ। শঙ্খনাথবাবু এসেছেন। বলেই ছুটে বেরিয়ে গেল।

দশ মিনিট পরে আমি যখন পিউকে কোলে নিয়ে বাইরের ঘরে গেলুম তখন শরীরের কাঁপুনি থেমেছে, মনও শক্ত করেছি। কিছুতেই হৃদয়াবেগ প্রকাশ করা হবে না, সহজভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষ যেমন কথা বলে তেমনই কথা বলব।

তবু তাঁকে দেখে বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। রোগা হয়ে গেছেন, চোখের কোলে কালি; আগুনে-ঝলসানো চেহারা। বসে ছিলেন, আমাদের দেখে উঠে এসে পিউয়ের দিকে হাত বাড়ালেন। পিউ একটু ইতস্তত করে তাঁর কোলে গেল, আবার তখনই আমার কোলে ফিরে এল। কারুর মুখে কথা নেই।

কলাবতীকে উনি সঙ্গে এনেছেন, সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল; এখন এগিয়ে এসে আমার কোল থেকে পিউকে নিয়ে চুপি চুপি বলল, চল পিউরানি, আমরা খেলা করি গিয়ে। আমাকে বলল, মাজী, পিউকে ফুটপাথে নিয়ে যাই? বিষ্টি থেমেছে।

যাও।

সে পিউকে নিয়ে চলে গেল।

শুক্লা গলা বাড়িয়ে বলল, চা করছি। শঙ্খনাথবাবু, চলে যাবেন না।

উনি গলার মধ্যে সম্মতিসূচক শব্দ করে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমি একটু দূরে বসলুম।

দুজনে চুপ করে বসে আছি। উনি কী ভাবছেন উনিই জানেন, আমি কথা খুঁজে পাচ্ছি না। কী বলব? এরকম অবস্থায় মানুষ সহজভাবে কোন্ কথা বলে?

শেষ পর্যন্ত উনি প্রথম কথা কইলেন, আমার পানে চোখ না তুলেই বললেন, সলিলা মরে গেছে।

মরে গেছে। বিদ্যুতের মত সলিলার চেহারা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল। এত রূপ, এমন যৌবন—মরে গেছে। তাহলে উনি তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন! তাহলে—!

তারপর তিনি এলোমেলো কথা বলতে আরম্ভ করলেন। কখনও দুটো কথা বলে চুপ করে বসে থাকেন, কখনও গড়গড় করে খুব খানিকটা কথা বলেন। গলার স্বর কখনও অস্পষ্ট হয়ে যায়, আবার কিছুক্ষণের জন্যে জোরালো হয়ে ওঠে। আমি আচ্ছন্নের মত বসে আছি। শুনতে শুনতে কখন তাঁর কাছে গিয়ে বসেছি জানতে পারিনি। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, পশ্চিমের আকাশে মেঘের গায়ে আলতাপাটি শিমের রঙ ধরেছে, ঘরের মধ্যে বেশী আলো নই। আমি যেন ছেলেমানুষের মত বসে রোমাঞ্চকর গল্প শুনছি।–

শঙ্খনাথবাবু যখন জানতে পারলেন যে সলিলা লেফটেনেন্ট লজপৎ সিংয়ের সঙ্গে পালিয়েছে তখনই তিনি তার বাপ কর্নেল হরবংশ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হরবংশ সিংয়ের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ, তাগড়া চেহারা, অত্যন্ত কড়া মেজাজের লোক। শঙ্খনাথবাবু তাকে জিগ্যেস করলেন, লজপৎ সিং কোথায়?

হরবংশ সিং শঙ্খনাথবাবুকে চিনত, আগে দু-একবার দেখেছে; কিন্তু এখন চিনতে পারল না। বলল, হু আর ইউ? কী চাও?

শঙ্খনাথবাবু বললেন, তোমার ব্যাটা লজপৎ সিংকে চাই। কোথায় সে?

হরবংশ সিং চোখ রাঙিয়ে এগিয়ে এল, বলল, সে খবরে তোমার দরকার কী? মিলিটারি গুপ্ত কথা জানতে এসেছ? যাও—গেট আউট।

শঙ্খনাথবাবু তার গালে একটি চড় মারলেন। সে মাটিতে পড়ে গেল, কিন্তু চেঁচামেচি করল না। একটা অডার্লি দোরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, বোধহয় লজপৎ সিংয়ের ব্যাপার জানত; সে ছুটে এসে শঙ্খনাথবাবুকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল, রাস্তায় বার করে দিয়ে খাটো গলায় বলল, বাবুজী, এখানে কি জন্যে এসেছ? দিল্লি যাও।

পরদিন সকালে পিউকে আমার কাছে রেখে সন্ধ্যের গাড়িতে তিনি দিল্লি যাত্রা করলেন। প্লেনে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্লেনের টিকিট পেলেন না।

ট্রেনের কামরায় একটি বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল। তিনিও দিল্লি যাচ্ছেন। মিলিটারি অফিসার, মেজর হরিদাস মৈত্র। দিল্লীতে পোস্টেড, ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন, আবার কাজে জয়েন করতে যাচ্ছেন। কথায় কথায় শঙ্খনাথবাবু তাকে জিগ্যেস করলেন, লেফটেনেন্ট লজপৎ সিংকে তিনি চেনেন কি না! মেজর মৈত্র লজপৎ সিংকে চেনেন না, তার বাপ হরবংশ সিংয়ের নাম জানা থাকলেও পরিচয় নেই। আর্মিতে হাজার হাজর অফিসার আছে, কে কাকে চেনে?

পরদিন সন্ধ্যেবেলা নয়াদিল্লি স্টেশনে পৌঁছে শঙ্খনাথবাবু মেজর মৈত্রকে বললেন, আপনাদের মিলিটারি মহলে খোঁজ নিলে লজপৎ সিংয়ের খবর পাওয়া যাবে কি?

মেজর মৈত্র বললেন, আপনি এক কাজ করুন। আমার ঠিকানা দিচ্ছি, পরশু আমার সঙ্গে দেখা করবেন। ইতিমধ্যে আমি খবর সংগ্রহ করে রাখব।

তিনি ঠিকানা দিয়ে চলে গেলেন। শঙ্খনাথবাবু একটা হোটেলে উঠলেন। সেই রাত্রেই তিনি অনুসন্ধান আরম্ভ করলেন। কাছেপিঠে কয়েকটি হোটেল ছিল, সেখানে খোঁজ নিলেন। পিস্তল তাঁর পকেটে আছে। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে পেলেন না।

পরদিন সকাল থেকে রীতিমতো তল্লাশ শুরু হল। দিল্লিতে অসংখ্য হোটেলে; নয়াদিল্লির অশোক হোটেল থেকে পুরনো দিল্লির মোসাফিরখানা পর্যন্ত নানা হোটেল আছে। শঙ্খনাথবাবু পিস্তল পকেটে নিয়ে একটির পর একটি হোটেল তল্লাশ করে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও আশাজনক কোনও খবর পেলেন না। একটা হোটেলে গিয়ে শুনলেন, এক জোড়া স্ত্রী পুরুষ কয়েকদিন থেকে সেখানে আছে; তারা বাইরে বেশী বেরোয় না, ঘরের মধ্যেই থাকে। তাদের ভাষা খুব পরিষ্কার নয়, বাঙালী কিংবা মাদ্রাজী হতে পারে। বর্ণনা শুনে শঙ্খনাথবাবুর সন্দেহ হল এরাই সলিলা আর লজপৎ সিং। তিনি ম্যানেজারের কাছ থেকে ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।

তিনতলার ওপর ঘর। শঙ্খনাথবাবু এক হাতে পকেটের পিস্তল চেপে ধরে অন্য হাতে দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুলে দাঁড়াল ড্রেসিং-গাউন পরা এক ছোকরা, তার পিছনে একটি তরুণী। সলিলা আর লজপৎ সিং নয়। দুজনেই বাঙালী; নতুন বিয়ে হয়েছে, রাজধানীতে মধুচন্দ্র যাপন করতে এসেছে। পরস্পরের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে, বাইরে বেরোয় না। শঙ্খনাথবাবু মাফ চেয়ে চলে আসছিলেন, কিন্তু তারা ছাড়ল না। অনেকদিন তারা বাঙালীর সঙ্গে কথা বলেনি; তারা শঙ্খনাথবাবুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক গল্প করল, চা খাওয়াল। তারপর আবার আসবেন বলে ছেড়ে দিল।

সমস্ত দিন খোঁজাখুঁজির পর রাত্রি দশটার সময় শঙ্খনাথবাবু নিজের হোটেলে ফিরে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে ধোঁকা লাগল; ওরা যদি হোটেলে না উঠে থাকে? যদি কোনও বন্ধুর বাসায় উঠে থাকে? কিন্তু শঙ্খনাথবাবু সহজে হতাশ হবার লোক নন; তিনি প্রথমে দিল্লির সমস্ত হোটেল দেখবেন, এখনও অনেক হোটেল বাকী আছে। তারপর অন্য রাস্তা ধরবেন। ভারতবর্ষ তোলপাড় করে ফেলবেন; যতক্ষণ পলাতকদের ধরতে না পারেন ততক্ষণ নিরস্ত হবেন না।–

শুক্লা এই সময় চা আর জলখাবার এনে টেবিলে রাখল; নিজেও বসল। শঙ্খনাথবাবু কিছুই লক্ষ্য করলেন না, আপন মনে ছাড়া-ছাড়া ভাবে গল্প বলে যেতে লাগলেন।

–পরদিন তিনি মেজর মৈত্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মেজর মৈত্র বললেন, হেড কোয়ার্টার থেকে খবর যোগাড় করেছি। লেফটেনেন্ট লজপৎ সিং কলকাতায় পোস্টেড ছিল, দশদিন আগে হঠাৎ কমিশনে রিজাইন করেছে। ওরা জলন্ধরের লোক। ইস্তফা দিয়ে হয়তো দেশে ফিরে গেছে।

আর কোনও খবর নেই?

না।

সেখান থেকে শঙ্খনাথবাবু অশোক হোটেলে গেলেন। বিরাট হোটেল। ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হল না, কিন্তু ম্যানেজারের অসংখ্য সহকারীর মধ্যে একজন বাঙালী যুবক ছিল, শঙ্খনাথবাবু তাকে ধরলেন। বর্ণনা শুনে যুবক বলল, হপ্তাখানেক আগে এই রকম একটি দম্পতি এসেছিল। মহিলাটি অপূর্ব সুন্দরী; বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তারা দুরাত্রি ছিল, তারপর চলে গেছে।

কোথায় গেছে বলতে পারেন?

যুবক একটা বাঁধানো খাতা খুলে দেখলে, বলল, এই যে, মিস্টর অ্যান্ড মিসেস এল সিং। না, ঠিকানা রেখে যায়নি। কিন্তু–দাঁড়ান। যুবক খাতা বন্ধ করে খানিকক্ষণ চোখ বুজে রইল, তারপর বলল, মনে পড়েছে। তারা বম্বেতে তাজমহল হোটেলে স্যুট রিজার্ভ করার জন্যে টেলিগ্রাম করেছিল।

সেই রাত্রেই শঙ্খনাথবাবু প্লেনে বোম্বাই যাত্রা করলেন।

বোম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ তাজমহল হোটেলে পলাতকদের খোঁজ পাওয়া গেল। তারা এসে দুরাত্রি ছিল, তারপর চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না।

শঙ্খনাথবাবু একটা সূত্র পেয়েছিলেন, আবার তা হারিয়ে গেল।

বম্বেতে দুদিন খোঁজাখুঁজি করে আবার তিনি দিল্লি ফিরে গেলেন। সেখান থেকে জলন্ধর গেলেন, সেখান থেকে অমৃতসর পাতিয়ালা। কিন্তু কোথাও কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।

এইভাবে দুহপ্তা কেটে গেল। একদিন শঙ্খনাথবাবুর কী মনে হল, তিনি আগ্রা গেলেন। আগ্রায় তাজমহল দেখলেন, হোটেলগুলোতে অনুসন্ধান করলেন, আগ্রা ফোর্ট, ফতেপুর সিক্রিতে ঘুরে বেড়ালেন; কিন্তু কোনই ফল হল না। ওরা যদি এখানে এসেও থাকে, তিনি আসবার আগেই। পালিয়েছে। কোথাও তারা দুরাত্রির বেশী থাকে না।

পরদিন সকালে তিনি স্টেশনে গেলেন, এখান থেকে মথুরা যাবেন। ওদের অবশ্য তীর্থস্থানে। যাওয়ার সম্ভাবনা কম; কিন্তু তীর্থস্থানে নিত্য অচেনা লোকের ভিড় লেগে থাকে, সেখানে লুকিয়ে থাকার সুবিধে আছে।

তিনি টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলেন। কিন্তু তাঁকে মথুরা যেতে হল না, আগ্রার রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মেই তিনি সলিলার দেখা পেলেন।

তখনও ট্রেন আসেনি, কিন্তু প্ল্যাটফর্মে বেশ একটু উত্তেজনা। যাত্রীরা, কুলিরা, এমনকী স্টেশনের কর্মচারীরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পুবদিকে যেখানে রেলের লাইন দূরে চলে গেছে সেই দিকে তাকিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে। শঙ্খনাথবাবু একজন টিকিট চেকারকে জিগ্যেস করলেন, সে বলল, স্টেশন থেকে মাইল পাঁচেক দূরে একটি স্ত্রীলোকের লাশ পাওয়া গেছে, তাকেই আনা হচ্ছে। মনে হয় রাত্রে সিক্স আপ গাড়ি আগ্রা ছাড়ার পর কেউ তাকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে। রাত্রে জানা যায়নি, সকালে গুমটি থেকে খবর এসেছে।

একটা ট্রলি আসছে দেখা গেল। ক্রমে ট্রলি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। তার ওপর শুয়ে আছে সলিলার দেহ। মুখখানা আশ্চর্য রকম অবিকৃত, কিন্তু দেহ চুর্ণ হয়ে গেছে। সিল্কের শাড়ি রক্তে মাখামাখি, গায়ে একটিও গয়না নেই।

ব্যাপার অনুমান করা শক্ত নয়। লজপৎ সিং সলিলাকে নিয়ে সারা ভারতবর্ষ ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, প্রেমের নেশাও ছুটে গিয়েছিল। কাল দুপুর-রাত্রে তারা আগ্রা স্টেশনে ট্রেনে উঠেছিল, তারপর লজপৎ সিং সলিলার গায়ের গয়না কেড়ে নিয়ে তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।

শঙ্খনাথবাবু কাউকে কিছু বললেন না, লাশ সনাক্ত করলেন না। মথুরার টিকিট বদল করে কলকাতার টিকিট কিনে বাড়ি ফিরে এলেন। লজপৎ সিং সম্বন্ধে তাঁর মন সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েছে। সে মরুক বাঁচুক এখন আর কিছু আসে-যায় না।

গল্প শেষ হবার পর আমরা কিছুক্ষণ নিঝুম হয়ে বসে রইলুম। তারপর শুক্লা উঠে পেয়ালায় চা ঢেলে ওঁর হাতে দিল। তিনি পেয়ালা নিয়ে কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর এক চুমুকে পেয়ালা শেষ করে টেবিলের ওপর রাখলেন। শুক্লা মৃদুস্বরে বলল, একটু কিছু মুখে দেবেন না।

না। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন; এমন ভাবে চারদিকে তাকালেন, যেন কোথায় আছেন ঠাহর করতে পারছেন না।

শুক্লা তাঁর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখ ছলছল করছে, সে গাঢ় স্বরে বলল, শঙ্খনাথবাবু, যা হয়ে গেছে তা ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। আমরা আপনাকে নিতান্ত আপন জন মনে করি তাই। বলতে সাহস করছি। জীবনে অনেক দুঃখ শোক আসে, তাই বলে ভেঙে পড়লে তো চলবে না।

উনি বললেন, কে ভেঙে পড়েছে। আমি। আমি? বলে একটা শুকনো কঠিন হাসি হাসলেন।

শুক্লা বলল, কোনও দুঃখই স্থায়ী নয়, অতিবড় শোকও মানুষ ভুলে যায়। সংসার ছাড়া তো আমাদের গতি নেই, তাই ভুলতেই হবে। আপনিও সেই চেষ্টা করুন। অতীতকে ভুলে গিয়ে আবার সংসারের দিকে মন ফিরিয়ে আনুন। আপনার কতই বা বয়স

তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, আবার সংসার! কী বলছ তুমি? আর না—আর না। মেয়েমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আমার জন্মের মত চুকে গেছে।

শুক্লা থতমত হয়ে বলল, কিন্তু পিউয়ের কথাও তত ভাবতে হবে।

পিউ। তিনি চারদিকে চাইলেন,—পিউ কোথায়? তাকে নিয়ে যাব।

এই সময় কলাবতী পিউকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

কান্নায় আমার গলা বুজে এসেছিল। বুকের মধ্যে ঝড় বইছিল। আমি ছুটে গিয়ে পিউকে কোলে নিলুম, তাকে বুকে চেপে বললুম, না, আমি পিউকে যেতে দেব না। এই বলে পিউকে নিয়ে নিজের চলে এলুম।

বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলুম। পিউও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, সে চুপটি করে শুয়ে রইল।

খানিক পরে চোখ মুছে দেখি উনি বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন, প্রিয়দম্বা, তুমি আমার উপর রাগ করেছ? তাঁর কণ্ঠস্বর বড় করুণ, দীনতারা।

পিউকে জড়িয়ে ধরে বললুম, না, পিউকে আমি দেব না।

পিউ তোমার কাছেই থাক। কিন্তু তুমি আমার ওপর রাগ কোরো না। এই বলে খুব আস্তে আস্তে আমার গায়ে হাত রাখলেন।

আমার সমস্ত শরীর শিউরে কেঁপে উঠল। আমি আবার বালিশে মাথা গুঁজে আর্তস্বরে বললুম, না, না, আমাকে ছুঁয়ো না। তুমি যাও তুমি চলে যাও।

তাঁর হাত আমার কাঁধের ওপর থেকে সরে গেল। কিছুক্ষণ পরে চোখ মুছে মুখ তুললুম, দেখি উনি নিঃশব্দে চলে গেছেন।

শুক্লা ঘরে ঢুকল। যেন কিছুই হয়নি এমনই সহজ সুরে বলল, শঙ্খনাথবাবু কলাবতীকে নিয়ে চলে গেলেন। রাত হয়ে গেছে, এবার ওঠ। পিউকে খাওয়াতে হবে না?

পিউ আজ বোতলের দুধ খেতে কোনও হাঙ্গামা করল না। তাকে খাইয়ে আবার বিছানায় শুলুম। শুক্লাকে বললুম, আমি আজ কিছু খাব না। খিদে নেই।

শুক্লা মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে চলে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে জিগ্যেস করলুম, উনি কি রাগ করে চলে গেলেন?

না—হ্যাঁ—ওই একরকম— বলতে বলতে সে বেরিয়ে গেল।

পিউ সহজে ঘুমুল না; তারও বোধহয় ঘুম চটে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। আমি তখন তার কানে কানে বললুম, তোর বাবাটা যাচ্ছেতাই, না পিউ?

পিউ মুখ গম্ভীর করে বলল, হুঁ।

তোকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি দিইনি, তাই আমাকে বকেছে, মেরেছে।

পিউ চোখ গোল করে বলল, মেনেছে।

হ্যাঁ, মেরেছেই তো। মারা আর কাকে বলে? আয় এবার ঘুমুই।

কিছুক্ষণের মধ্যে পিউ ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সারারাত চোখ চেয়ে জেগে রইলুম। জেগে জেগে একসময় মনে হল, পিউ যে মাতৃহীনা হয়েছে একথা কারুর খেয়াল হয়নি। মা-হারা মেয়ে বলে কেউ তার জন্যে দুঃখ করবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *